Next
Previous
Showing posts with label আলাপ বিস্তার. Show all posts
1

আলাপ বিস্তার - সব্যসাচী ভট্টাচার্য

Posted in



আলাপ বিস্তার 
সব্যসাচী ভট্টাচার্য


এবারের আলাপ বিস্তারে সৌমিত্র বসুর সাক্ষাৎকার নেব ঠিক করলাম। বলাই বাহুল্য, প্রশ্ন প্রণয়নও আমারই। এখন পাঠক জিজ্ঞাসা করতে পারেন, কে এই সৌমিত্র বসু। পরিচয় হিসাবে বলতে পারি একজন ক্রিয়াশীল, তন্নিষ্ঠ নাট্যকর্মী, প্রাবন্ধিক এবং অন্তরে আদ্যন্ত সাহিত্যপ্রেমী। যেহেতু সৌমিত্র বসু আমার বাল্যবন্ধু শুধু নন একই বিদ্যালয়ের সহপাঠীও, সেই কারণে ওঁর আজকের এই 'হয়ে ওঠা'র ধাপগুলি অনেকটাই আমার কাছে জানা; এবং ঠিক এই কারণেই সাক্ষাৎকারটি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় পরিণত হয়েছে। একেবারে সেই কিশোর বেলা থেকেই (তখন ক্লাস সিক্স-এ বালিগঞ্জ রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়ে আমরা একই সেকশনে পড়ি) আমাদের একসঙ্গে বেড়ে ওঠা প্রকৃতপক্ষে। ছুটির দিনগুলোর বিকেল, দুপুর, পালা করে দু'জনের বাড়ি যাতায়াত -- একই পরিবারের অন্তর্ভুক্তি। এমনকি, আমার নাটকের প্রতি আগ্রহের মূলেও সৌমিত্রই। ও-ই আমাকে নাটক পড়তে শেখায়, প্রতি সপ্তাহে শনি ও রবিবার নিয়ম করে দু'জনের নাটক দেখা -- কোনওদিন ও কাটে তো কোনওদিন আমি। প্রথম একসঙ্গে বহুরূপীতে যোগ দেওয়ার জন্য যাওয়া এবং গম্ভীর কঠিন প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি হওয়া, যেহেতু তখনও আমরা স্কুলের গণ্ডী পার হইনি (১৯৭৪ সাল,শীতকাল)। ছোটবেলা থেকেই ওর লেখার (কবিতা, গল্প বা উপন্যাস) প্রথম পাঠক/শ্রোতা আমিই ছিলাম। এই অভ্যাস অনেকদিন পর্যন্ত বজায় ছিল -- তারপর কালের নিয়মে এবং কর্মব্যস্ততায় ক্রমশঃ ফিকে হয়ে এলেও এখনও কোনওদিন ওর বাড়ি গেলে প্রথমেই ওর লেখার প্রসঙ্গ ওঠে। ওর সৌজন্যেই বিভিন্ন নাট্যব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। শম্ভু মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সবিতাব্রত দত্ত, তৃপ্তি মিত্র, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, এবং এদের মতো আরও অনেকের সঙ্গে। শুধু নাট্যজগতের গুণীরাই নন, সৌমিত্রর সঙ্গে আমি নিয়মিত যেতাম কবি মণীন্দ্র গুপ্তের বাড়ি, সেখানে আমি শ্রোতা মাত্র। কত ভাল আলোচনা শুনেছি মণীন্দ্রবাবু এবং ওঁর স্ত্রী দেবারতি মিত্রর মুখে। সেসব সোনালী দিন আমার জীবনকে ঋদ্ধ করেছে। আমার অল্পবিস্তর ছবি আঁকার অভ্যাসকেও ও উৎসাহ দিয়ে এসেছে বরাবর। স্কুলের ছাত্রদের পত্রিকা বাগবিতানে ওর লেখা গল্পের সঙ্গে আমার ছবি ছাপা হয়, যে ঘটনাটি আমার শ্লাঘনীয়। আমার অল্পবিস্তর সংগীতচর্চাও ও যথেষ্ট সম্ভ্রমের চোখে দেখত। যেমন, একবার, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর ওর লেখা নাটকে (নায়ক আসছেন) আমি সুর দিয়েছিলাম। একটি মাত্র শো হয় বন্ধু শ্যামলেন্দুর পিসির বাড়ির ছাদে। সুতরাং পাঠক বুঝতেই পারছেন যে কেন এই সাক্ষাৎকার আলাপচারিতার রূপ নিয়েছে। 


সব্যসাচী : আমরা অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ডঃ সৌমিত্র বসুর সাক্ষাৎকার নেব না নাট্যকর্মী সৌমিত্র বসুর সঙ্গে কথা বলব? 


সৌমিত্র : এরা আলাদা মানুষ নাকি? যে কোনও মানুষই তার সারা জীবনে নানা রকম কাজ করে, বা একটু গ্রাম্ভারি করে বলতে গেলে নিজেকে প্রকাশের চেষ্টা করে। সবটা নিয়েই সে। কাজেই যে দিক থেকে পারো গোলাগুলি চালাও।


সব্যসাচী : ব্যক্তিত্বের বহুকৌণিক হীরক বিচ্ছুরণ চার পাশের দর্শক, পাঠক কী ভাবে দেখে বলে তোমার মনে হয়?


সৌমিত্র : বহুকৌণিক হীরক বিচ্ছুরণ? ওরে বাবারে! দর্শক, পাঠক আমাকে আলাদা করে নজর করে এমন তালেবর হয়েছি বলে তো মনে হয় না। মুশকিল যেটা হয়, যিনি আমার নাটুকে পরিচয়টা জানেন, তিনি যখন সেই সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার ওপর দাবি করতে থাকেন তখন স্বভাবতই আমার অন্য ক্ষেত্রগুলোকে মনে রাখেন না। অভিমান করেন তাঁর দাবি মেটাচ্ছি না বলে। দুই, সবটা মিলিয়ে বেশ চাপ পড়ে যায়। আর আমি যেহেতু অমর সৃষ্টি করে যেতে হবে এই রকম কোনও সাঙ্ঘাতিক প্রতিজ্ঞা নিয়ে বাঁচি না, তাই মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে। সব ছেড়ে কোথাও গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে। 


সব্যসাচী : কিশোর বয়স থেকে মূলতঃ একজন হয়ে -উঠতে - চাওয়া সাহিত্য সেবক কী ভাবে ক্রমে একজন নাট্যকর্মীতে পরিণত হলো : উত্তরণের সেই সময়ছবিকথা আমাদের বলো।


সৌমিত্র : কম বয়সে গল্প, কবিতা লিখতাম, যেমন সবাই লেখে, বা অন্তত আমাদের সময় লিখত। আসলে ওই বয়সে তো নানাভাবে ভেতরের কথাগুলো বের করে দেখবারএকটা তাগিদ থাকেই, মানে থাকার কথা। মনে পড়ে, তুমিও তো ছবি আঁকতে, সেতার বাজাতে। কিন্তু মনে রাখতে বলব নাটকের প্রতি আমার আকর্ষণটাও দুর্মর ছিল। তুমি আর আমি দুজনে মিলে কত কত নাটক দেখেছি সেই বয়সে; বহুরূপী, পি.এল.টি, নান্দীকার থেকে নতুন জন্মানো চেতনা, থিয়েটার ওয়র্কশপ, শূদ্রক আরও কত কত নাটক। কতসব বিখ্যাত মানুষের বাড়ি হুটহাট করে চলে গেছি। তাই নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা, তর্ক, স্বপ্ন দেখার কথা মনে পড়ে নিশ্চয়ই? সেই সূত্রে বহুরূপী এবং তারপর প্রাতিষ্ঠানিক নাট্যচর্চার মধ্যে ঢুকে পড়া। প্রতিষ্ঠানের তো নিজস্ব কিছু দাবি থাকে, সে তোমাকে তার শর্তে অধিকার করে নিতে চাইবেই। কিছুদিন পর কবিতা আবার ফিরে এসেছিল আমার কাছে। আমার ভাই আত্মহত্যা করে। সেই আঘাতের চাপ শুধু নাটকের পক্ষে সামলানো সম্ভব ছিল না, ফলে কবিতার আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু সেটা স্থায়ী হয়নি। বয়স বাড়লে তো মানুষকে অনেকের ভেতর থেকে এক বা দুইকে বেছে নিতেই হয়। আমার কপালে নাটকটাই প্রধান হয়ে উঠল। 


সব্যসাচী : একটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী নাট্যগোষ্ঠীতে সংলগ্ন হওয়া, তারপর মগ্ননাট্যচেতন থেকে অন্য আরএক মগ্নতায় নিজের নাট্যদোহার গঠন -- এ ব্যাপারে সিংহাবলোকন আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নাও।


সৌমিত্র : বহুরূপী নানা কারণে ক্লান্ত করছিল শেষের দিকে, আদর্শগত দিক থেকেও কিছু কিছু ব্যাপার মেনে নিতে অসুবিধে হচ্ছিল। ছেড়ে দিলাম। ভেবেছিলাম থিয়েটারই আর করব না। কিন্তু এর মধ্যে অন্য জায়গা থেকে ডাক এসে গেল। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। একটু বিজ্ঞাপন করি? আমার একটা আত্মকথা আছে। 'বহুরূপী যাপন' নামে। সপ্তর্ষি থেকে বেরিয়েছে। তাতে এসব কথা অনেক অনুপুঙ্খসহ লেখা আছে। 


সব্যসাচী : এই প্রজন্মে নাট্যকর্মী হয়ে ওঠার আগ্রহ একজন নাট্যকার, নির্দেশক এবং শিক্ষক হিসেবে তুমি কীভাবে দেখছ? 


সৌমিত্র : রবীন্দ্রভারতীর নাটক বিভাগে একবার একটা বিতর্ক তৈরির চেষ্টা করেছিলাম, থিয়েটারটা পেশাদার হবে না হবে না। পেশাদারিত্বের পক্ষে প্রায় সবাই। প্রচণ্ড উত্তেজনা, চেঁচামিচি। এখনকার ছেলেমেয়েরা পেশাদার নাট্যকর্মী হয়ে উঠতে চাইছে, অনেকে হয়ে উঠছেও। নাটক করেই এখন মোটামুটি একটা রোজগার করা যায়। আমরা এ সব ভাবতে পারতাম না। কিন্তু পরিকাঠামোটা খুব পেশাদারিত্বের পক্ষে অনুকূল হতে পেরেছে এমন নয়। থিয়েটার থেকে রোজগার করা যায় যদি তার ভেতরের নানা সম্ভাবনাকে বার করে আনতে পারি। সে কাজে বাংলা থিয়েটার এখনও বেশ পিছিয়ে। তার একটা কারণ, আমাদের মিডিয়াধন্য থিয়েটার থেকে আদর্শ ও নীতিবোধ মোটামুটি বিদায় নিয়েছে। ফলে পেশাদার নাট্য অভিনেতারা খানিকটা পেশাদার সিরিয়াল অভিনেতাদের মতো হয়ে দাঁড়াচ্ছে, দক্ষ এবং খেপবাজ। 


সব্যসাচী : সিরিয়ালের ফেনায়িত খারস্রোতে ঋদ্ধ অভিনয়রীতি ক্ষতিগ্রস্ত - এই মত সম্বন্ধে তোমার মনের কথা কী?


সৌমিত্র : সিরিয়ালটা কেবলমাত্র ব্যবসা এবং লোক পটানো ব্যবসা। এ পাড়ায় আসা অভিনেতাদের মুশকিল হলো ক. পুরো গল্পটা তার জানা নেই, ফলে সে চরিত্রের সামগ্রিক রূপ সম্পর্কে অন্ধকারে। চিত্রনাট্যকার বা পরিচালকেরাও তাই। খ. সেদিনের যে পার্টটুকু তাকে দেওয়া হয়, তা নিয়ে ভাববার সময়ও অভিনেতা পায় না, মুখস্তটুকু করে যা হয় করে দেওয়ার বাইরে কিছু করার নেই। গ. পুরো পরিবেশটার মধ্যে এমন একটা গা এলানো, চালিয়ে দাও, গোছের মনোভাব থাকে, যার সংক্রমণ সিরিয়াস অভিনেতার পক্ষেও এড়ানো মুশকিল। পরিচালক একটু জটিল শট নিতে গেলেই অভিনেতারা সমস্বরে দাবি তোলেন, শিল্প কোরো না, ছেপে দাও বলে। পরিচালককেও রোজ বেশ অনেক মিনিটের কাজ দেখাতে হয়, তা না হলে ড্রইং রুম বা শোওয়ার ঘরের প্রাত্যহিক খাদ্য দেওয়া যাবে না। এইসব অভিনেতারা অনেকেই থিয়েটার করেন, চরিত্রের গভীরে ঢোকার, একটি চরিত্রকে তার ডালপালা শুদ্ধু দেখার অভ্যেসই তাঁদের নষ্ট হয়ে গেছে। 


সব্যসাচী : একটি সম্পূর্ণ প্রজন্ম বেতারে তোমার বাচিক অভিনয় শুনে বড় হয়েছে। বেতারে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে ভাগ নেবে?


সৌমিত্র : বেতার অভিনয় অভিনেতাকে বাচিক অভিনয়ে পারদর্শী করে তুলতে পারে। উচ্চারণ, কন্ঠের উচ্চাবচতা, কোন শব্দে কেমন জোর পড়বে ইত্যাদি। আবার গলা বাঁচিয়ে অভিনয় করার একটা খারাপ অভ্যেসও রেডিওর অভিনেতাদের মধ্যে তৈরি হয়ে যায়। আমার একটা বাড়তি সুবিধে ছিল, আমার গলাটা নায়কোচিত নয়। ফলে গৌতম চক্রবর্তী, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়রা যেখানে মূলত বিড়বিড়ে গলার নায়কের পার্ট করে যাচ্ছে, আমি সেখানে নানা ধরনের চরিত্র করার সুযোগ পাচ্ছি। গলা নিয়ে কোনও খুঁতখুঁতুনিও তৈরি হতে পারেনি। তবে সেখানেও খুব গভীরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো না। আসলে পণ্যের মালিক তো চাইবেন তাড়াতাড়ি তাঁর মালটা তৈরি হয়ে যাক, তাতেই তাঁর লাভ। পণ্যাভিনয় এক ধরনের দক্ষতা নিশ্চয়ই তৈরি করে, কিন্তু ক্ষতিও করে মারাত্মক।


সব্যসাচী : নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় বহুরূপী 'নবান্ন' মঞ্চস্থ করে নতুন করে। তাতে তোমার অভিনয় দেখে কোনও একজন নাট্যসমালোচক বলেছিলেন শম্ভু মিত্রের তৃতীয় বা চতুর্থ কার্বন কপি ...এইরকম কিছু একটা। এ বিষয়ে কিছু বলবে? 


সৌমিত্র : মন্তব্যটা সুরজিৎ ঘোষের, তিনি তখন 'দেশে' নাট্যসমালোচনা লিখতেন। একটু চালাক চালাক কথা লেখার অভ্যেস ছিল তাঁর। কিছু অভিনেতা যেমন গ্যালারি মাতানো অভিনয় করেন, এও হলো সেইরকম গ্যালারি মাতানো লেখা। অবশ্য কথাটা সত্যি। তবে এর জন্য দায়ী কুমার রায়, যিনি ঐ ঘরানাটা মেনে চলতেন; বহুরূপীর তখনকার অবস্থা, যেখানে শম্ভু মিত্রকে ঈশ্বরের জায়গায় বসানো হতো অন্তত বাইরের আচরণে; আর নিশ্চয় আমার কম বয়সের ব্যক্তিত্বহীনতা, যা সহজেই প্রবল ওই অভিনয়রীতির মধ্যে ডুবে মরেছিল। এখন বোধহয় সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।
-
-
-
অসম্পূর্ণ...। আরও কত কথাই মনে পড়ছে। আপনাদেরও জানাতে ইচ্ছে করছে। আবার আর একদিন বসবো হয়তো ওর সঙ্গে... মুখোমুখি। আজ এই পর্যন্তই... 







0

আলাপ বিস্তার - সব্যসাচী ভট্টাচার্য

Posted in
আলাপ বিস্তার


পটদীপ - পটচিত্রকথা 
সব্যসাচী ভট্টাচার্য


স্থান : বিশ্ববাংলা হাট, প্রান্তিক, শান্তিনিকেতনের কাছে
কাল : গ্রীষ্ম শুরুর পটদীপ আলো মাখা বিকেল
পাত্র : জবা পটিদার (গ্রাম হরিচক, পূর্ব মেদিনীপুর)

প্রায় জনশূন্য শানবাঁধানো হাটে ঘুরতে ঘুরতে নজরে পড়ল একরাশ পট আর মাটির পাত্র ও নানারকম ঘর সাজানোর জিনিসের ওপর যেগুলির গায়ে রঙের নকশা। পটগুলির মধ্যে যেমন আছে পৌরাণিক কাহিনী, দেবদেবীর ছবি, সামাজিক ঘটনা, তেমনি আছে পশুপাখী এবং মাছ -- মাছের বিয়ে।

ছোট মাছ সন্তানের বিয়েতে বড় মাছকে নিমন্ত্রণ না করায় অপমানিত বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে। চলমান জনজীবনের এক আশ্চর্য উর্দ্ধরৈখিক সামাজিক দম্ভবিভাজনের বর্ণন! 

এগিয়ে গিয়ে প্রাথমিক পরিচয়ের পর কথা শুরু করি জবাদির -- জবা পটিদারের সঙ্গে। আমার সঙ্গে বন্ধু দেবাশিস, উৎসাহী শিল্পরসিক। কথা শুরু থেকে ক্রমে জানা যায় যে ছোটবেলা থেকেই জবাদির পটের প্রতি ঝোঁক। বাবার ছিল ঝুড়ি, মাদুর তৈরীর ব্যবসা -- খুব বড় নয় যদিও। বিভিন্ন গ্রামীণ হাটে মেলায় ঘুরে ঘুরে বিক্রী করতেন। সঙ্গে থাকতেন জবাদি, এরই মধ্যে উৎসাহদাতা বা গুরু হিসেবে পান বাসেদ চিত্রকরকে। ধীরে ধীরে পট আঁকা আরম্ভ হয়। বাবার উৎসাহ এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। যদিও শৈশবে মাতৃহীন জবাদি মূলত বড় হয়ে উঠেছেন তাঁর পিসির কাছে। লেখাপড়ায় আগ্রহের জন্য পড়েছেন গ্রামের স্কুলে। কিন্তু মাধ্যমিক বা শেষ পরীক্ষা দিতে পারেননি অন্য সংসারে চলে যাওয়ার দরুণ। কিন্তু কপালের লিখনে বাবার কাছে ফিরে আসতে হয় স্বামীর অন্য সংসার থাকায়। এরই মধ্যে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয় এবং তিনমাস বয়সেই শিশুটি চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায় আগুনে পুড়ে। 

ক্রমাগত ভাগ্যবিপর্যয় কিন্তু জবাদিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, পট আঁকায় ছেদও পড়েনি। ক্রমশঃ দক্ষ হয়েছেন পেনসিল ছাড়াই সরাসরি তুলি দিয়ে বলিষ্ঠ রেখায় পট আঁকায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরা, মাটির ঘর সাজাবার জিনিসে ছবি আঁকা। মেয়েকে এই দুঃখ দুর্দশার মধ্যেও ক্লাস ইলেভেন পর্যন্ত পড়িয়েছেন অতি কষ্টে। পট ও ছবি আঁকায় এবং পটগানে উৎসাহ দিয়ে গেছেন ও এখনও দিয়ে চলেছেন যাতে মেয়ে অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়। 

কথায় কথায় রাত নামে সন্ধে গড়িয়ে। ক্রমে জানতে পারি এক একক সংগ্রাম কাহিনী। পট আঁকাকে পেট চালানোর উপায় হিসেবে বেছে নেওয়ার আগে পর্যন্ত জবা পটিদার ছোট ছোট বাচ্চাদের বাড়িতে পড়াতেন। নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে জবাদির মুখে কিন্তু কোনওরকম দুঃখের ছাপ দেখিনি বরং দেখেছি এক বিজয়িনীর দৃঢ়তা। ধর্মে মুসলমান কিন্তু হিন্দু দেবদেবীর পট আঁকছেন, গান করছেন --- এই প্রসঙ্গ তোলাতে তিনি বলে চলেন --- এই কাজের জন্য তিনি কোনওরকম ধর্মীয় সংগঠন বা মসজিদ থেকে চাপের সম্মুখীন হননি কখনোই। কারণ এই পট আঁকিয়েদের অনেকেই বংশানুক্রমে ধর্মে মুসলমান -- তা প্রায় চার পাঁচ পুরুষ আগের সেই ধর্মান্তকরণের কাল থেকে (মূলে হিন্দু নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠী)। উনি আগে শাঁখা, সিঁদুর, পলা ব্যবহার করতেন কিন্তু গ্রামের মসজিদ থেকে সিঁদুরে আপত্তি করায় এখন শুধুই পলা পরেন। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল যে ধর্ম নিয়ে হানাহানি বা সংঘাত কেবলমাত্র মূল ধারার জনগোষ্ঠীর মধ্যেই। গৌণ বা প্রান্তিক জনসমাজে বোধহয় এই ভেদবুদ্ধি কোনওদিনই ছিল না। 

ছবি বা পট আঁকার প্রকরণের কথা উঠতেই জবাদি বলেন যে উনি শুধুমাত্র ভেষজ ও খনিজ রঙ ব্যবহার করেন পটের ক্ষেত্রে আর অ্যাক্রাইলিক রঙ সরা বা দোপাট্টার সময়। 

পরদিন আলাপ হলো জবাদির মেয়ে পুতুল পটিদারের সঙ্গে। আর এক দৃঢ়চেতা বাস্তববোধ সম্পন্না মেয়ে। ত্রিশ বছর বয়সেই বয়সেই দুনিয়াদারি কম দেখেনি। মায়ের কাছে শেখা বিদ্যা কাজে লাগিয়ে আর ছোটদের পড়িয়ে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে শাড়ী, ব্যাগ এবং অবশ্যই পট তৈরী করে চলেছে। এসবের রংই তার জীবনের একমাত্র রং। 

প্রায় মোহগ্রস্তের মতো এই জীবনপটের রংরাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম।