0

আলাপ বিস্তার - সব্যসাচী ভট্টাচার্য

Posted in
আলাপ বিস্তার


পটদীপ - পটচিত্রকথা 
সব্যসাচী ভট্টাচার্য


স্থান : বিশ্ববাংলা হাট, প্রান্তিক, শান্তিনিকেতনের কাছে
কাল : গ্রীষ্ম শুরুর পটদীপ আলো মাখা বিকেল
পাত্র : জবা পটিদার (গ্রাম হরিচক, পূর্ব মেদিনীপুর)

প্রায় জনশূন্য শানবাঁধানো হাটে ঘুরতে ঘুরতে নজরে পড়ল একরাশ পট আর মাটির পাত্র ও নানারকম ঘর সাজানোর জিনিসের ওপর যেগুলির গায়ে রঙের নকশা। পটগুলির মধ্যে যেমন আছে পৌরাণিক কাহিনী, দেবদেবীর ছবি, সামাজিক ঘটনা, তেমনি আছে পশুপাখী এবং মাছ -- মাছের বিয়ে।

ছোট মাছ সন্তানের বিয়েতে বড় মাছকে নিমন্ত্রণ না করায় অপমানিত বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে। চলমান জনজীবনের এক আশ্চর্য উর্দ্ধরৈখিক সামাজিক দম্ভবিভাজনের বর্ণন! 

এগিয়ে গিয়ে প্রাথমিক পরিচয়ের পর কথা শুরু করি জবাদির -- জবা পটিদারের সঙ্গে। আমার সঙ্গে বন্ধু দেবাশিস, উৎসাহী শিল্পরসিক। কথা শুরু থেকে ক্রমে জানা যায় যে ছোটবেলা থেকেই জবাদির পটের প্রতি ঝোঁক। বাবার ছিল ঝুড়ি, মাদুর তৈরীর ব্যবসা -- খুব বড় নয় যদিও। বিভিন্ন গ্রামীণ হাটে মেলায় ঘুরে ঘুরে বিক্রী করতেন। সঙ্গে থাকতেন জবাদি, এরই মধ্যে উৎসাহদাতা বা গুরু হিসেবে পান বাসেদ চিত্রকরকে। ধীরে ধীরে পট আঁকা আরম্ভ হয়। বাবার উৎসাহ এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। যদিও শৈশবে মাতৃহীন জবাদি মূলত বড় হয়ে উঠেছেন তাঁর পিসির কাছে। লেখাপড়ায় আগ্রহের জন্য পড়েছেন গ্রামের স্কুলে। কিন্তু মাধ্যমিক বা শেষ পরীক্ষা দিতে পারেননি অন্য সংসারে চলে যাওয়ার দরুণ। কিন্তু কপালের লিখনে বাবার কাছে ফিরে আসতে হয় স্বামীর অন্য সংসার থাকায়। এরই মধ্যে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয় এবং তিনমাস বয়সেই শিশুটি চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায় আগুনে পুড়ে। 

ক্রমাগত ভাগ্যবিপর্যয় কিন্তু জবাদিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, পট আঁকায় ছেদও পড়েনি। ক্রমশঃ দক্ষ হয়েছেন পেনসিল ছাড়াই সরাসরি তুলি দিয়ে বলিষ্ঠ রেখায় পট আঁকায়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরা, মাটির ঘর সাজাবার জিনিসে ছবি আঁকা। মেয়েকে এই দুঃখ দুর্দশার মধ্যেও ক্লাস ইলেভেন পর্যন্ত পড়িয়েছেন অতি কষ্টে। পট ও ছবি আঁকায় এবং পটগানে উৎসাহ দিয়ে গেছেন ও এখনও দিয়ে চলেছেন যাতে মেয়ে অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়। 

কথায় কথায় রাত নামে সন্ধে গড়িয়ে। ক্রমে জানতে পারি এক একক সংগ্রাম কাহিনী। পট আঁকাকে পেট চালানোর উপায় হিসেবে বেছে নেওয়ার আগে পর্যন্ত জবা পটিদার ছোট ছোট বাচ্চাদের বাড়িতে পড়াতেন। নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে জবাদির মুখে কিন্তু কোনওরকম দুঃখের ছাপ দেখিনি বরং দেখেছি এক বিজয়িনীর দৃঢ়তা। ধর্মে মুসলমান কিন্তু হিন্দু দেবদেবীর পট আঁকছেন, গান করছেন --- এই প্রসঙ্গ তোলাতে তিনি বলে চলেন --- এই কাজের জন্য তিনি কোনওরকম ধর্মীয় সংগঠন বা মসজিদ থেকে চাপের সম্মুখীন হননি কখনোই। কারণ এই পট আঁকিয়েদের অনেকেই বংশানুক্রমে ধর্মে মুসলমান -- তা প্রায় চার পাঁচ পুরুষ আগের সেই ধর্মান্তকরণের কাল থেকে (মূলে হিন্দু নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠী)। উনি আগে শাঁখা, সিঁদুর, পলা ব্যবহার করতেন কিন্তু গ্রামের মসজিদ থেকে সিঁদুরে আপত্তি করায় এখন শুধুই পলা পরেন। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল যে ধর্ম নিয়ে হানাহানি বা সংঘাত কেবলমাত্র মূল ধারার জনগোষ্ঠীর মধ্যেই। গৌণ বা প্রান্তিক জনসমাজে বোধহয় এই ভেদবুদ্ধি কোনওদিনই ছিল না। 

ছবি বা পট আঁকার প্রকরণের কথা উঠতেই জবাদি বলেন যে উনি শুধুমাত্র ভেষজ ও খনিজ রঙ ব্যবহার করেন পটের ক্ষেত্রে আর অ্যাক্রাইলিক রঙ সরা বা দোপাট্টার সময়। 

পরদিন আলাপ হলো জবাদির মেয়ে পুতুল পটিদারের সঙ্গে। আর এক দৃঢ়চেতা বাস্তববোধ সম্পন্না মেয়ে। ত্রিশ বছর বয়সেই বয়সেই দুনিয়াদারি কম দেখেনি। মায়ের কাছে শেখা বিদ্যা কাজে লাগিয়ে আর ছোটদের পড়িয়ে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে শাড়ী, ব্যাগ এবং অবশ্যই পট তৈরী করে চলেছে। এসবের রংই তার জীবনের একমাত্র রং। 

প্রায় মোহগ্রস্তের মতো এই জীবনপটের রংরাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম।






0 comments: