0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীন কথা


ধর্মপ্রাণ
অনিন্দিতা মণ্ডল


সম্রাট প্রিয়দর্শী অশোক এখন মগধের রাজ সিংহাসনে। কলিঙ্গ যুদ্ধ সমাপ্ত বহুদিন। নিজের ও শত্রুপক্ষের লক্ষ লক্ষ সৈন্যের হত্যাকাণ্ড, অকুস্থলে তাঁর মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটায়। হঠাৎ অত রক্তপাত ও ব্যপক নৃশংসতা তাঁর বোধকে অবশ করে দিয়েছিল। দিগ্বিজয়ী বীর যুবরাজ ক্ষণিকের দুর্বলতায় ও কারুবাকীর মৃত্যুর বিহ্বলতায় প্রতিজ্ঞা করে বসলেন – আর যুদ্ধ নয়। যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি কাউকে আর মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে আনবেননা। এতদিন বৌদ্ধধর্মের প্রতি নিঃস্পৃহ ছিলেন। ধর্ম পালন ব্যাপারে মনোযোগ দিতেননা। যুবা বয়স। নীতিই হোক আর বিবেকই হোক। জাগ্রত করার সময় তো পড়ে আছে! এই যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ধর্মের শরণ নিলেন। সেই দয়া নদী। রক্তে লাল হয়ে যাওয়া নদীস্রোত। স্নান করে শুদ্ধ হবার সময়ে জলের পরিবর্তে সেই রক্তধারাই কি তাঁকে ভিজিয়ে দিলনা? কী এক অমোঘ নিরুচ্চার প্রতিজ্ঞা ছিল সেই সম্মিলিত মানব রক্তের! ইতিহাস যাকে দুই সহস্রাব্দেরও বেশি সময় পরে আবার মূল্যায়ন করতে বসবে। চিনতে চাইবে তাঁর প্রকৃত মন। উচ্চাশা এক বিষম বস্তু। দেবানাম পিয় এখন তাই সারা দেশ জুড়ে ধর্ম মহামাত্য নিয়োগ করেছেন। হিংসা নয়, অহিংস ধর্মের জয়গান গেয়ে মানুষকে মৌর্য রাজছত্রের তলায় আনবেন। সফল তাঁর নিরীক্ষা। আর্যাবর্ত জুড়ে এখন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অধঃপতন ও বৌদ্ধ ধর্মের বিজয় কেতন উড়ছে। যশস্বী সব পণ্ডিত বেদজ্ঞ সনাতনী বৌদ্ধ হচ্ছেন। এই তো চেয়েছেন সম্রাট! নাহলে কি করে তিনি এক আঞ্চলিক সম্প্রদায়কে এই মান্যতায় পৌঁছে দেবেন! এমনটাই ভাবেন তিনি। বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেন তথাগতের সমকালীন ও তিরোধানের ঠিক পরবর্তী সময়েই তাঁর ধর্মের উত্থান ও ব্যাপ্তির ইতিহাসকে। এমন কেউ নেই যিনি সম্রাটকে বলেন যে, বৌদ্ধধর্ম রাজধর্ম। স্বয়ং সম্রাট এর পৃষ্ঠপোষক বটে, কিন্তু ভারতে অহিংস ধর্মের প্রবর্তন ও প্রচার এর আগেও ঘটেছে। তথাগত নিজেও সেইসব মতের অনুসারী ছিলেন প্রথমে। তিনিও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সম্রাটকে এসব বলার অর্থ নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা। তাই প্রিয়দর্শী আনন্দে আছেন। তাঁর প্রচারিত ধর্ম নিরঙ্কুশ। নিজ মহিমায় তা ভারতভূমিকে এক রাজছত্রের আশ্রয়ে এনেছে। আশ্রয়ই তো! কে না জানে অশোক রাজা কত প্রজাপালক! প্রজারা তাঁর রাজত্বে কত সুখেই না থাকে! তবু সম্রাটের কপালে ভাঁজ।

বঙ্গের পূর্ব ভাগ। করতোয়া নদীর ধারে মহাস্থানগড়। পুণ্ড্রদেশ। এ দেশের অধিবাসীরা প্রাকৃত ভাষায় কথা বলে। নিতান্ত অবৈদিক। কোনোরকম আর্য সংস্কাররহিত। এদেশে এক সুমিষ্ট ইক্ষু জন্মায়। সেই আখের রস থেকে এরা গুড় মিছরি তৈয়ার করে। তাম্রলিপ্তির বন্দর থেকে সেসব বিদেশে যায়। স্বচ্ছলতা থাকলেও সভ্যতা নেই। ধর্মের নামে এরা স্বেচ্ছাচার করে। আখের রস থেকে তৈরি গুড় দিয়ে এরা গৌড়ী বলে এক পানীয় প্রস্তুত করে, যা পানে মাদকতা আসে। এরা উৎসবের দিনে সেই রস পান করে ও ভাবোন্মত্ত হয়ে নৃত্য করে। এরা বিশ্বাস করে প্রতিটি মানবশরীরে আত্মা আছেন। এবং এভাবে তাঁকে তৃপ্ত করা যায়। বেদের একেশ্বরবাদ তাঁদের অজানা। অশোক রাজার ধর্ম তো সেদিনের কথা! ব্রাহ্মণ্য ধর্মই সেখানে ডেরা বাঁধতে পারেনি। অথচ মগধ থেকে কতই বা দূরত্ব। 

রাজ্যশাসন কিন্তু ধর্মপ্রচার ছাড়াও আরও কিছু। সম্রাট তাই গুপ্তচরের পদ লোপ করেননি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে চর সংবাদ আনে। যারা জানেন যে কলিঙ্গ যুদ্ধ ছাড়াও অশোক ঠিক কতখানি নিষ্ঠুর নৃশংস হতে পারেন, তারা বিদ্রোহের কথা ভাবতেও পারেননা। স্থানে স্থানে তাই রাজনিযুক্ত ভাস্কর শিলালিপি খোদাই করে চলেছেন। তাম্রশাসন নির্মাণ চলছে। আর ভিক্ষুর ছদ্মবেশে চর ঘুরছে সারা দেশে। বিখ্যাত সব বিহার ও সংঘারামে তাঁদের নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব আশ্রয়। মগধ থেকে পুণ্ড্রের দূরত্ব তুলনায় কিছুই নয়। সামান্যই। তাই সম্রাট সংবাদ পান পুণ্ড্রের অধিবাসীদের খুঁটিনাটির। যদিও এরাও তাঁর প্রজা কিন্তু এরা অজীবিক। বৌদ্ধ নয়। মক্ষলি গোশালা এঁদের মান্যপুরুষ। তথাগতের সমসাময়িক। পুণ্ড্রে এখন তিনি ছাড়াও আরতি পান নির্গ্রন্থ জ্ঞাত্রিপুত্র। কয়েক শতক পর এখন মূল অহিংস ধর্মগুলি মিলে মিশে যায়। পুণ্ড্রের এক চিত্রকর ভাবের ঘোরে নির্গ্রন্থের একটি চিত্র এঁকেছেন। চিত্রে দণ্ডায়মান সমাহিত নির্গ্রন্থের সামনে অবনত তথাগত। তথাগতর পূর্ববর্তী আচার্য। তিনি তাই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছেন। চিত্রটি অসম্ভব সুখ্যাতি পেয়েছে। চিত্রকরকে সকলে ধন্য ধন্য করছে। এক শ্রেষ্ঠীর চিত্রশালায় সগৌরবে বিরাজ করছে এটি। সকলে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছেন। আরতি ও নৃত্য করে আসছেন। গীতবাদ্য সহকারে নৃত্য। ঠিক যেমনটি অজীবিকরা করে থাকেন। দূতমুখে সম্রাটের কাছে সংবাদ এলো। সম্রাটও বহুদিন ধরে পৌণ্ড্রদের সভ্যতা শেখানোর প্রয়াস করছেন। এদের এমন স্পর্ধা যে রাজধর্ম গ্রহণ করেনা! আজ এই সংবাদে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হলো। অবিলম্বে নির্দেশ জারি করলেন প্রধান মহামাত্যকে। হত্যা। এই শাস্তি অজীবিকদের। তথাগতের অবমাননা! কি অসম্ভব স্পর্ধা! এদের সমূলে উৎপাটন করতে হবে। মহামাত্যের বিস্মিত স্তম্ভিত মুখের পরে চেয়ে দূত চতুর হাসলেন। মহামাত্য কি অহিংস প্রজাজনপ্রিয় সম্রাটকে খুঁজছেন? হাঃ। সেদিন করতোয়ার স্রোতও লাল হয়ে উঠল আবার। হাজার হাজার অজীবিকের রক্ত মিশল জলধারায়। নিশ্চিহ্ন হলো পুণ্ড্রের অজীবিক সম্প্রদায়। একটি মাত্র নির্দেশে পুণ্ড্রের অষ্টাদশ সহস্র অজীবিক একসঙ্গে নিহত হলেন। অহিংস বৌদ্ধধর্মের প্রধান প্রচারক, মৌর্যসম্রাট অশোক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন তথাগতকে।

0 comments: