Next
Previous
Showing posts with label ধারাবাহিক. Show all posts
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in








৩৯

বের্শেম আগে যে লেফটেন্যান্টকে পেয়েছিল গান কম্যান্ডার হিসেবে, তার নাম গ্রাশ্‌ট। যুদ্ধে যোগ দেবার আগে গ্রাশ্‌ট ছিল ধর্মযাজক। বের্শেম খুব বেশি ধর্মযাজকের সংস্পর্শে আসেনি সেভাবে কোনোদিন। তবে তার মতে গ্রাশ্‌ট বেশ ভালো মানুষ ছিল। গ্রাশ্‌ট সব সময় তার বরাদ্দ সাতটা গোলা হাইডেসহাইমের বাঁয়ে নদীর মোহনার দিকে ছুঁড়ত। সেখানে একটা কর্দমাক্ত বাদাবন ধরনের ব-দ্বীপ জেগে ছিল নদীর মুখে। উঁচু উঁচু ঘাসের বন, বেতের ঝোপ সেখানে। স্থানীয় বাসিন্দারা ওই জায়গাটাকে বলে কের্পেল। সেখানে ছুঁড়লে কারো আঘাত লাগার কথা নয়। বের্শেম তার নোটবইতে দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার লিখে রাখত… ‘নদীর মুখে সন্দেহজনক নড়াচড়া।’ লেফটেন্যান্ট এই বিষয়ে আর কিছু বলেননি। ফলে গ্রাশ্‌ট সাতটা গোলা ওই জায়গাটাতেই ছুঁড়ত। কিন্তু দিনদুয়েক হল আরেকজন সেনা মোতায়েন হয়েছে এখানে। সেই সার্জেন্টের নাম শ্নিভিন্ড; সে আবার সাতটা গ্রেনেডের প্রতিটার ব্যাপারে হিসেবী। জ্যাম ফ্যাক্টরির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমেরিকান সেনার গাড়িটায় অবশ্য সে গোলা ছোঁড়ে না। শ্নিভিন্ড-এর লক্ষ্য হল সব সাদা পতাকাগুলো। আসলে ভাইডেসহাইমের সব বাসিন্দাদের মনে এই আশা ছিল যে আমেরিকান সেনারা তাদের জায়গাটা হয়তো দখল করে নেবে। তাই অনেকেই সুরক্ষিত থাকবার জন্য বাড়িতে সাদা পতাকা টাঙ্গিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমেরিকানরা কাছেই ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকলেও জায়গাটা দখল করেনি। আসলে ভাইডেসহাইমের অবস্থানটা একটু অদ্ভুত। নদীর বাঁকের মধ্যে; ফলে গোটা গ্রামের প্রতিটি বাড়ি দৃশ্যমান। সেই কারণে আমেরিকান সেনারা হাইডেসহাইম অবধি এসে তারপর থেমে গেছে। হাইডেসহাইমের অবস্থান আবার উল্টো। একটু ভেতরদিকে। ফলে চট করে বাইরে থেকে দেখা যায় না। সেইজন্য আমেরিকান সেনাদের আর এগোবার কোনো পরিকল্পনা নেই। জার্মানির বিভিন্ন জায়গায় মার্চ করতে করতে প্রায় ২০০ কিমি ভেতরে ঢুকে গেছে আমেরিকান সেনা; প্রায় দেশটার মাঝখানে পৌঁছে গেছে। কিন্তু শুধুমাত্র এই অঞ্চলে হাইডেসহাইম অবধি এসে তিন সপ্তাহ ধরে এখানে বসে আছে। একটা গোলা যদি হাইডেসহাইমের দিকে কেউ ছুঁড়েছে, তবে আমেরিকানরা একশখানার বেশি ছুঁড়ে প্রত্যুত্তর দেবে। সেইজন্য এখন কেউ হাইডেসহাইমের দিকে ছুঁড়ছে না গুলিগোলা। ফলে যে সাতখানা গ্রেনেড বরাদ্দ, সেই সবকটা ভাইডেসহাইম এবং তার আশেপাশে ছুঁড়তে হবে। ভাইডেসহাইমের যেসব বাসিন্দারা সাদা পতাকা টাঙ্গিয়ে রেখেছে, সার্জেন্ট শ্নিভিন্ড তাদের শাস্তি দিতে চায়। যারা সাদা পতাকা টাঙ্গিয়েছে, শ্নিভিন্ড-এর মতে তাদের না আছে সাহস, না আছে দেশপ্রেম। সে সাদা পতাকাগুলো সহ্য করতে পারছে না।

যাই হোক, বের্শেম আবার তার নোটবইতে লিখে রাখল, ‘৯ টা বাজে, নদীর মুখে সন্দেহজনক নড়াচড়া।’ ১০.১৫ এবং ১১.৪৫ নাগাদ সে আবার একই জিনিস লিখে রাখল। ‘হাইডেসহাইম থেকে আমেরিকান সেনার গাড়ি এসে জ্যামের কারখানার সামনে দাঁড়াল’। বারোটা নাগাদ সাধারণত সে কিছু সময়ের জন্য নিজের জায়গাটা ছেড়ে খাবার খেতে নামে। আজ যখন সে মই বেয়ে নামতে যাবে, নিচ থেকে শ্নিভিন্ড বলে উঠল …

‘এক মিনিট অপেক্ষা করুন। ওইখানেই থাকুন একটু।’ বের্শেম আবার হামাগুড়ি দিয়ে খামারবাড়ির জানালায় দূরবিনের কাছে ফিরে গেল। শ্নিভিন্ড তার হাত থেকে দূরবিনটা নিয়ে নিল। তারপর দূরবিনে চোখ রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে দেখতে লাগল। বের্শেম পাশে বসে তাকে লক্ষ্য করতে লাগল। আসলে শ্নিভিন্ড এমন একজন মানুষ, যে প্রায় কোনো কিছুই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আত্মবিশ্বাস প্রচুর এবং চারপাশের লোকজনকে বুঝিয়ে ছাড়ে যে সে অনেক কিছুই পারে। যেরকম উৎসাহ নিয়ে সে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে এবং দূরবিন তাক করে নির্জন, নিষ্প্রাণ ভাইডেসহাইমের দিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, এই পুরো ব্যাপারটাই দেখানেপনা ছাড়া কিচ্ছু নয়। বের্শেম লক্ষ্য করে দেখল… যে তারামার্কা মেডেলটা বুকে আটকানো আছে শ্নিভিন্ডের, সেটা একদম নতুন। এছাড়া ঘোড়ার ক্ষুর মার্কা মেডেলটাও নতুন মনে হচ্ছে। শ্নিভিন্ড দূরবিনটা ফেরত দেয় তার হাতে, তারপর গজগজ করতে থাকে… ‘শুয়োর সব কটা, অপদার্থ, অভিশপ্ত শুয়োরগুলো সাদা পতাকা আটকে রেখেছে… দিন আমায়, আপনার নোটবুকটা দিন!’ বের্শেম দেয়।

শ্নিভিন্ড নোটবুকটার পাতা উল্টে উল্টে দেখতে থাকে… ‘অর্থহীন কাণ্ডকারখানা!’ বলে ওঠে সে… ‘আমি জানি না ওই নদীর মুখে বাদাবনে আপনি রোজ কী দেখেন! ওইখানে ব্যাঙ ছাড়া কিছু নেই। দেখি, দিন আমায়’… বলে সে দূরবিনটা আবার ছিনিয়ে নেয়। এবার তাক করে নদীর মোহনার দিকে। বের্শেম দেখতে থাকে লোকটার দিকে। সে দেখে যে লোকটার মুখের চারদিকে হালকা থুতুর লালা লেগে আছে… সরু সুতোর মত লালা ঠোঁটে লেগে নিচের দিকে ঝুলে আছে কিছুটা।

‘কিচ্ছু নেই’ বিড়বিড় করে শ্নিভিন্ড… ‘একেবারে কিছুই নেই ওই বাদাবনে… কিচ্ছুটি নড়ছে না… অর্থহীন ভাবনা!’ বের্শেমের নোটবই থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নেয় লোকটা। নিজের পকেট থেকে এক টুকরো পেন্সিল বের করে। জানালা দিয়ে আবার দেখতে থাকে। তারপর কী যেন লেখে পাতায়… বিড়বিড় করে… ‘শুয়োর… শুয়োরের দল।’ তারপর কোনো রকম অভিবাদন না জানিয়ে উঠে চলে যায় লোকটা। নেমে যায় মই বেয়ে। এক মিনিট পরে বের্শেমও ওই জায়গা ছেড়ে উঠে চলে যায় নিজের খাবার খেতে।

--… ---… ---…



পাহাড়ের উপর থেকে, একটা আঙ্গুরক্ষেতের জমিতে দাঁড়িয়ে ফাইনহালস বুঝতে পারল যে ভাইডেসহাইম কেন আমেরিকান বা জার্মান, কোনও বাহিনী এখনও দখল করেনি। এই জায়গাটা দখল করে আদতে কোনও লাভ হবে না কোনও পক্ষেরই। গোটাপনেরো বাড়ি আর একটা বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা জ্যামের কারখানা… এছাড়া আর কিছু নেই। রেলস্টেশন এখানে নেই; সেটা হাইডেসহাইমে। নদীর উল্টোদিকে আউয়েলব্যার্গ, সেখানে রেলস্টেশন আছে। কিন্তু ওই জায়গাটা জার্মানরা দখল করে রেখেছে। ভাইডেসহাইম একটা নদীর বাঁকের মধ্যে, নদীটা এখানে দড়ির ফাঁসের মত বাঁক নিয়েছে। ভাইডেসহাইম এই দৃশ্যমান বাঁকের মধ্যে একেবারে ফেঁসে রয়েছে।

ভাইডেসহাইম আর পাহাড়ের মাঝে অপেক্ষাকৃত গোপন একটা ঢালের ফাঁকে রয়েছে হাইডেসহাইম অঞ্চলটা। ফাইনহালস দেখতে পেল ওই এলাকার মাঠে মাঠে অনেক ট্যাঙ্ক জড়ো করা আছে। স্কুলের মাঠে, গির্জার মাঠে, বাজারের চৌমাথায়, হোটেল, সরাইখানার আঙিনায় সর্বত্র ট্যাঙ্ক আর সেনাবাহিনীর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো এমনকি গাছপালা বা অন্য কিছু দিয়ে ঢেকে ক্যামোফ্লাজ করাও নেই। পাহাড়ের ঢালে উপত্যকায় এখন গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে উঠছে। সাদা, গোলাপি, নীলচে সাদা ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে চারিদিক। বাতাস হালকা হয়ে গেছে। বসন্তের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। ফিঙ্কের জমি, বাড়ি, সব দেখা যাচ্ছে উপর থেকে। রাস্তার দু’ পাশে দু’টো চৌকো উঠোন, দাঁড়িয়ে থাকা চারজন প্রহরী… সব দেখতে পেল ফাইনহালস। কফিনের দোকানটার উঠোনে বসে একটা লোক কাজ করছে। বিরাট একটা সাদাটে হলদে বাক্স, একটু হেলে থাকা, নতুন একটা কফিন বানাচ্ছে লোকটা। সদ্য পালিশ করা কাঠ রোদ্দুরে চকচক করছে। লালচে হলুদ আভা ছড়াচ্ছে যেন। লোকটার বউ কাছেই একটা বেঞ্চে বসে আছে। রোদ্দুরে বসে সব্জি কেটেকুটে পরিষ্কার করছে।

রাস্তায় রাস্তায় লোকজন দেখা যাচ্ছে। মেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, দোকান বাজারে কেনাকাটা করছে। সেনাদের দেখা যাচ্ছে ইউনিফর্ম পরা। শহরতলির এক প্রান্তে স্কুলবাড়ি থেকে ক্লাসের শেষে এইমাত্র ছাত্রছাত্রীরা বেরিয়ে এল; দল বেঁধে পথে হেঁটে যাচ্ছে তারা। কিন্তু উল্টোদিকে ভাইডেসহাইমে সবকিছু নিস্তব্ধ, চুপচাপ। গাছের পাতায় কিছু কিছু বাড়ি ঢেকে আছে। তবে ফাইনহালস ওখানে সবাইকে চেনে। সব কটা বাড়ি তার চেনা। এক ঝলক দেখে সে লক্ষ্য করল ব্যার্গ এবং হপেনরাথ… এদের বাড়িগুলো গোলা লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু তার বাবার বাড়িটা একটাও আঁচড় লাগেনি। রাস্তার উপরে বাড়িটার চওড়া, হলুদ রঙের সুন্দর, শান্ত সামনের অংশটা দেখা যাচ্ছে। ফাইনহালস দোতলায় তার বাবা মায়ের ঘরের উপরের ছাদের অংশে সাদা পতাকা লাগানো দেখতে পেল। অন্যান্য বাড়ির তুলনায় তাদের বাড়ির পতাকাটা অনেক বড়। চারদিকে লিনডেন* গাছ সবুজে সবুজ হয়ে উঠছে। কিন্তু এলাকা একেবারে জনমানবশূন্য। একটিও প্রাণী কোনও জায়গায় দেখা যাচ্ছে না। সাদা পতাকাগুলো শক্ত করে লাগানো আছে বাড়িগুলোর গায়ে। অদ্ভুত শ্মশানের মত শান্তি বিরাজ করছে এলাকায়। জ্যামের কারখানার উঠোনটাও একদম খালি। মরচে ধরা খালি বালতিগুলোর স্তুপ দেখা যাচ্ছে। কারখানার শেডটা তালাবন্ধ। হঠাৎ ফাইনহালসের চোখে পড়ল যে হাইডেসহাইম স্টেশন থেকে উপত্যকা, ফলের বাগান পেরিয়ে একটা আমেরিকান গাড়ি দ্রুতবেগে ভাইডেসহাইমের দিকে যাচ্ছে। সাদা ফুলে ফুলে ঢাকা গাছের মধ্য দিয়ে মাঝে মাঝেই গাড়িটা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু অবশেষে দেখা গেল যে ভাইডেসহাইমের প্রধান সড়কের উপর দিয়ে যেতে যেতে গাড়িটা জ্যামের কারখানার গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

‘যাচ্চলে… একী!’ ফাইনহালস নিচুস্বরে বলে। তারপর আঙুল দিয়ে গাড়িটার দিকে দেখিয়ে বুড়ো ফিঙ্ককে জিজ্ঞেস করে… ‘এটা কী ব্যাপার?’

পাহাড়ের উপরে একটা শেডের সামনে বেঞ্চিতে বুড়ো ফিঙ্ক বসেছিলেন ফাইনহালসের পাশেই। মাথা নাড়েন তিনি… ‘কিছু নয়… সেরকম কিছু না… সেরকম অর্থপূর্ণ ব্যাপার নয়… এ হল ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখের প্রেমিক, রোজ একবার করে দেখা করতে আসে।’

‘একজন আমেরিকান?’

‘হ্যাঁ’ … বলে ওঠেন ফিঙ্ক… ‘আসলে স্বাভাবিক কারণেই ফ্রয়লাইন মের্ৎজবাখ বাড়ি থেকে বেরোতে ভয় পান। কারণ জার্মানরা মাঝে মাঝে ভাইডেসহাইমের উপরে গোলা ছুঁড়তে থাকে। সেজন্য লোকটিই আসে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে।’



(চলবে)



*লিনডেন গাছ বা লাইমউড ইউরোপের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় জন্মানো খুব পরিচিত ওষধিগুণসম্পন্ন গাছ। এই গাছ প্রতীকী অর্থে প্রেমপ্রীতি ও শান্তির বাহক। পাতাগুলি হৃদয়চিহ্নের আকারের।





ReplyForward


Add reaction
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in





বারো



রবিবাবুর স্ত্রীর নাম আলো। আলো পাশের বাড়ির বৌটার সঙ্গে মেশে।তার বরের নাম অভয়।

অনেকগুলো ছেলে মেয়ে জন্মের পর মরে যাওয়ায় অভয় এবারের ছেলের নাম রাখলো গু,য়ে। ভালো নাম রাকবো না রে। আবার যদি মরে যায়। পরের বছর যে হবে তার নাম রাকবো আকু। বললো,অভয়। গ্রামের পুরোহিত বললো,ঠিক করেছো। এইবার তোমার ছেলে,মেয়ে বাঁচবে।

ছেলে দুটো বাঁচার পরে আরও দুটো মেয়ে হলো। আর সন্তান নিলো না অভয়। অনেকে বললো,সংসার ছোটো রাকো,তাহলে অভাব হবে না। অভয় বললো,আমার বন্ধু রামুর তো নয়টা ছেলে আর দুটো মেয়ে। আছে তো দু বিঘে জমি। ওরা বুঝলো,তর্ক করে লাভ নেই। যে বোঝার নিজে থেকেই বোঝে।

তারপর বড় হয়ে স্কুলে ভরতি হওয়ার সময় আকুর নাম হলো সমর আর গুয়ের নাম হলো অমর। আর ভয় নেই। শিব ঠাকুরের কাছে মানত করে অভয়,ছেলেদের বললো,বছরে একবার গাজনের সময় ভক্ত হবি। তাহলে সব বিপদ কেটে যাবে। অভয় ভাবে,মেয়েরা তো তাড়াতাড়ি বাড়ে। বিয়ে দিতে হবে। অভাবের জন্য ওরা বেশিদূর পড়তে পারলো না। সমর মুদিখানার দোকানে কাজ নিলো। আর মেয়েরা বাড়ির কাজ করে। অমর পড়াশোনায় ভালো বলে স্কুল ছড়লো না। হেড মাষ্টার নিজে খরচ দিয়ে অমরকে পড়াতেন স্কুলে। তখনকার দিনে স্কুলে পড়তে গেলে টাকা,পয়সা লাগতো।কাদা, মাটির রাস্তা গ্রামে। বর্ষাকালে মুদিখানার মাল রেলস্টেশন থেকে সমর মাথায় করে নিয়ে আসতো। নুনের বস্তাও মাথায় করে আনতো। লোকে বলতো অভয়কে,অত খাটাস না ছেলেটাকে। চোখে, কোমরে রোগ ধরে যাবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।

মেয়ে দুটোর একই দিনে বিয়ের ব্যবস্থা করলো অভয়। বড়ো মেয়ের বয়স সতেরো। আর ছোটো মেয়ের বয়স ষোলো। বেশ ধুমধাম হলো। কলা পাতা দিয়ে গেট বানানো হলো। সতরঞ্জি পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। গরীব মানুষ। তবু বাড়ির সকলে খুব আনন্দ করলো।বিয়ের দিনে বর পথে দুর্ঘটনায় মারা গেল। কপাল পুড়ল মেয়েটার।



তারপর চলে এল জগদ্ধাত্রী পুজো।এই গ্রামে ধূমধাম করে মশাল জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের পুজো হয়। গ্রামের বাজারে বহু বছর যাবৎ এই পুজো হয়ে আসছে। পাটকাঠির মশাল জ্বালিয়ে এই পুজো মহা সমারোহে পালন করা হয়। কথিত আছে জ্ঞানের আলো এই দেবি জগতে ছড়িয়ে দেন। তাই আলোময় মশাল জ্বালিয়ে দেবির পুজো করা হয়। ভিন্ন মতও অনেক আছে।

তবে মতবাদের ককচকচানির উর্ধ্বে উঠে সকল গ্রামবাসী এক হয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হন এই কটা দিন।পাটকাঠির বোঝা বেঁধে বড় বড় মশাল তৈরি হয়। মশালে আগুন ধরিয়ে ঢাক ঢোলের তালে তালে নাচতে থাকে ভক্তের দল। চারদিকে আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে পুজোমন্ডপ। মশাল জ্বালিয়ে গ্রাম ঘোরে প্রতিমাসহ মশালবাহির দল। বড় সুন্দর এই দৃশ্য। সব মানুষ ভেদাভেদ ভুলে মেতে যান এই উৎসবে।আর কোথাও এই পুজো আছে কি না জানা নেই রবিবাবুর।তবে তিনি বলেন,এই পুজোয় গ্রামবাসীর আনন্দ তাকেও আনন্দিত করে তোলে।

0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(১৫)

বেলগাছিয়ায় অকল্যান্ড সায়েবের সুদৃশ্য বাগানবাড়িটি সম্প্রতি নব্য শিল্পোদ্যোগী জমিদার বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রায় লাখ দুয়েক টাকায় কিনে একটি ব্যক্তিগত মজলিশের কেন্দ্রবিন্দু করে শহর কলকাতায় এখন বেশ জাঁক দেখাচ্ছেন। চোরবাগানের মল্লিকদের বাড়িটি শ্বেতপাথরের বলে তা এতদিন লোকের চোখে জ্বলজ্বল করত। আজকাল দ্বারকনাথের 'বেলগাছিয়া ভিলা' সেই দর্শনসুখের সামনে জোরালো একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।

এই সুরম্য অট্টালিকাটির সমস্ত আসবাব আনানো হয়েছে সুদূর ইংল্যান্ড, ও ইতালি থেকে। বিশেষ বিশেষ দিনে আলোর মালায় সেজে উঠে বাড়িটির রূপান্তর ঘটে যায় রূপকথার দ্বিতীয় অমরাবতীতে।

সেদিন ঈশ্বর গুপ্ত নামে এক রসিক নাগরিক কবিয়াল তার একটি বিদ্রুপাত্মক ছড়ায় সেদিন তো কাগজে কয়েকটি লাইন লিখেই বেশ শোরগোল ফেলে দিয়েছে। বাগবাজারে এখন রূপচাঁদ পক্ষীদের আখড়ায় গঞ্জিকা সেবনে টং হয়ে গায়েন পক্ষীদের দল ধুয়ো ধরে থেকে থেকেই ছড়াটি নানারকম ব্যঙ্গকন্ঠে সোচ্চারে গেয়ে উঠছে,

‘‘বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুরি কাঁটার ঝনঝনি....

খানা খাওয়ার কি মজা আমরা তাহার কি জানি?...ও জানেন ঠাকুর কোম্পানী...!"

.....

আজকের নৈশভোজটি এক পার্সী জাতীয় শিল্পোদ্যোগী রুস্তমজীর সাফল্যের দরুণ তাঁর মিত্র ও ব্যবসায়ী অংশীদার বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুরের সৌজন্যে।

গোলগাল চেহারার এই পার্সী বণিকটি কার টেগোর এন্ড কোম্পানিতে কিছু মুদ্রা বিনিয়োগ করা ছাড়াও জলযানের ব্যবসাতেও সহযোগিতা চেয়ে কলকাতায় এসেছেন।

এসব বাণিজ্যসাধনে এখন বাঙালীদের মধ্যে দ্বারকানাথ অগ্রগণ্য বলে দুজনের মিত্রাভাষ ক্রমশ শক্ত ভিতের মধ্যে এসে দাঁড়াতে চলেছে। তাই সানন্দে এই মজলিশে দ্বারকানাথ স্বয়ং রামমোহনকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে তার বিশিষ্ট বন্ধুমহলের সাথে রুস্তমজীকে পরিচিত হতে সাহায্য করছেন।

হিমায়িত পুডিং এর পাত্র হাতে রামমোহন হাসিমুখে রুস্তমজীকে সম্ভাষণ জানিয়ে শিষ্টতা বজায় রাখলেন। তিনি অনর্গল পারস্যভাষায় জেন্দা-আবেস্তা' থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন দেখে রুস্তমজী বিস্ময়ে হতবাক।

এসবের ফাঁকেই রামমোহন দ্বারকানাথকে আলাদা ডেকে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের অগ্নিদহন সংক্রান্তটি সবিস্তারে জানালেন। তবে প্রতিষ্ঠানটি ক্রয়ের বিষয়ে এখুনি কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে আরও একবার লাটভবনে গিয়ে মন্ত্রণা করার বিষয়েই দ্বারকানাথ জোর দিল।

তবে রামমোহনের বিলাত গমনের বিষয়ে তার কোনও আপত্তি নেই। বরং দ্বারকানাথেরও খুব ইচ্ছা যে রাণীগঞ্জ-মানভূমে কয়লাখনির ব্যবসা সংক্রান্ত জটিলতা স্বল্পদিনের মধ্যে মিটে গেলে সেও রামমোহনের সাথে বিলাত যাত্রায় শরিক হতে পারে।

.....

গোলকপতি দেখল সামনের আকন্দ ঝোপের ফাঁক দিয়ে লাল রং এর শাড়ির পাড়ের কিয়দংশটি দেখা যাচ্ছে।

বোঝা গেল, ওই মেয়েটি ঝোপটিতে এখনও আত্মগোপন করে আছে। হিসেবমতন তার শৌচকর্মটি কিন্তু প্রায় আধঘন্টা আগে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।

সে ধীরপায়ে ঝোপড়াটির কাছে এসে দাঁড়াতেই মেয়েটি মুখে গোঁ গোঁ শব্দ করে মূর্ছিত হয়ে পড়ল।

গোলকপতি বুঝতে পারল দূর্বলদেহে ও অর্ধভুক্ত জঠরে ধুতুরার বীজের গুঁড়ো জলের সাথে অতিরিক্ত মাত্রায় পান করার কারণে অতি উত্তেজনার বশেই সে সংজ্ঞা হারিয়েছে।

এরপর কাছে এসে সে মেয়েটির আব্রু বাঁচিয়ে তার মাথাটি তার নিজের কোলে তুলে নিয়ে তাকে অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

মেয়েটির ভ্রুযুগল কিঞ্চিৎ প্রগাঢ়। সে শ্যামবর্ণা ও দীর্ঘাঙ্গী। তবে তার মুখশ্রীটিকে এক অপরূপ দার্ঢ়্যতার সৌকর্যে সাজিয়ে তুলেছে তার চিবুক ও উন্নত নাসিকার আবেশটি।

গোলকপতির মনে হতে লাগল বৃদ্ধটির মৃত্যুর সাথে সাথেই এই রমণীরত্নটি ধর্ম ও লোকাচারের হাতে জীবন্ত পুড়ে মরতে চলেছে।

মেয়েটির জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করার সাথে সাথে সে নিজের মনেই নিজের উদ্দেশ্যে বসে বসে অনেক দুরূহ প্রশ্নবাণ ছুঁড়তে লাগল। সে ভাবতে বসল আজ তথাকথিত সমাজদ্রোহের পরিণতি সত্ত্বেও সে নিজে কি এই মেয়েটির জীবনের দায়িত্ব নিতে সক্ষম?
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১১

ছাতের কামরার সামনে টিনের শেড, টিনের নীচে রংগনাথ, ওর নীচে খাটিয়া। বেলা দশটা, এখন শুনুন আবহাওয়ার খবর।কাল রাত্তিরে আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল, এখন কেটে গেছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বিগত দিনে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাত হচ্ছিল, এখন সেসব পরিষ্কার হয়ে যেতেই পৌষের শীতের কামড় টের পাওয়া যাচ্ছে। বাজারের নব্বই প্রতিশত মিষ্টি যেমন দেখতেই ভাল, খেতে নয়, তেমনই রোদ্দূরও পিঠে লাগানোর ছেয়ে দেখেই বেশি আরাম।রোদ চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু দেখলে মনে হচ্ছে শুধু নীমগাছের মাথাতেই আটকে রয়েছে। রঙ্গনাথ ওই নীমগাছের মাথায় পাতায় পাতায় রোদ্দূরকে মন দিয়ে দেখছে। শহরেও নীম গাছ আছে। সেখানেও রোদ এসে পাতায় পাতায় খেলা করে। কিন্তু তখন রঙ্গনাথ ওর দিকে তাকিয়েও দেখত না।কিন্তু ওই রোদ্দূরের রূপ ও গাঁয়ে এসে খেয়াল করে দেখল। এরকম অনেকের সাথেই হয়।

রঙ্গনাথের হাবভাব ওইসব ট্যুরিস্টের মত দেশে থাকতে যাদের পথঘাট, হাওয়া, ঘরবাড়ি,রোদ, দেশপ্রেম, গাছপালা, বদমাইসি, মদ, ওয়ার্ক কালচার, যুবতী এবং ইউনিভার্সিটি এসব চোখে পড়েনা, কিন্তু বিদেশে গেলেই দেখতে পায়। এর মানে রঙ্গনাথের চোখ রোদ্দুর দেখছে, কিন্তু মন আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির গভীরে হারিয়ে গেছে। ওর অনেক কিছুই তো হারিয়ে গেছে, যা কেবল গবেষকরা খুঁজে বের করতে থাকে।

রঙ্গনাথ ওর রিসার্চের জন্যে এমনই এক সাবজেক্ট খুঁজে বের করেছে। হিন্দুস্তানীরা নিজেদের অতীতের খোঁজে ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে এমনই এক বিষয় দাঁড় করিয়েছে যার গালভরা নাম-ইন্ডোলজি। এই বিষয়ের গবেষণা শুরুই হয় আগে এ’ব্যাপারে কারা কারা গবেষণা করেতাঁদের নামের গবেষণায়।রঙ্গনাথ ঠিক তাই করছিল।দু’দিন আগে শহরে গিয়ে ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি থেকে গাদাগুচ্ছের বই তুলে এনেছে। এখন নীমগাছের মাথায় বিছিয়ে যাওয়া রোদ্দুরের চাঁদোয়ার নীচে বসে ওই বইগুলো পড়তে শুরু করেছে। ওর ডাইনে মার্শাল, বাঁয়ে কানিংহ্যাম, আর নাকের ঠিক নীচে শোভা পাচ্ছেন উইন্টারনিজ।কীথ পাছার কাছে পায়জামায় গা’ ঘষটাচ্ছেন। ভিনসেন্ট স্মিথ সরে গেছেন পায়ের কাছে এবং কিছু উল্টেপাল্টে গড়াগড়ি খাওয়া বইয়ের ভেতর থেকে উঁকি মারছেন মিসেস রাইস ডেভিস। পার্সিভ্যাল ব্রাউন ঢাকা পড়েছেন বালিশের নীচে। এতসব পন্ডিতের ভিড়ে বিছানার দোমড়ানো মোচড়ানো চাদরের এক কোণে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছেন কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল। ভান্ডারকর চাদরে মুখ ঢেকে লজ্জা লজ্জা ভঙ্গিতে তাকাচ্ছেন।ব্যস্‌, ইন্ডোলজির রিসার্চের হদ্দমুদ্দ একেবারে।

এইজন্যেই হঠাৎ একটা ‘হাউ-হাউ’ আওয়াজ ওর কানে কোন ঋষির সামবেদ গানের মত বেজে উঠল। ‘হাউ-হাউ’ আরও কাছে এল। ওর মনে হল কোন হরিষেণ বোধহয় সমুদ্রগুপ্তের বিজয়গাথা একেবারে ফুসফুসের সমস্ত জোর দিয়ে শোনাচ্ছে। এবার ওই ‘হাউ-হাউ’ নীচের গলিতে পৌঁছে গেছে আর তার সঙ্গে ‘মেরে ফেলব শালাকে’ গোছের কিছু ওজস্বী বাক্য যুক্ত হয়েছে। রঙ্গনাথ বুঝল –ওসব কিছু নয়, এটা ওই ‘গঞ্জহা’দের কোন লফড়া।

ও ছাদের কার্নিশের কাছে এসে নীচে গলির দিকে উঁকি মারল—এক যুবতী মেয়ে, এলোকেশি, রুক্ষ চুল, পরনের কাপড়টিও এলোমেলো, কিন্তু সমানে মুখ চালাচ্ছে। কিন্তু এইটুকু শুনে ভাববেন না যে শহরের ফ্যাশনদুরস্ত মেয়ে চুইংগাম চিবুচ্ছে। আসলে ও হোল ঠেট দেহাতি মেয়ে, নোংরা পোষাক, আর মুখ নড়ছে কারণ ও সঙ্গের ছাগলগুলোকে ‘হলে-হলে-হলে’ করে তাড়িয়ে আনছে।চার-ছ’টা বকরী পাঁচিলের ফাটলে গজিয়ে ওঠা একটি বটের চারাকে চিবুচ্ছে বা চিবিয়ে শেষ করে আরেকটি পাঁচিলের গায়ে কোন বটের চারা গজিয়েছে কিনা তার খোঁজে ব্যস্ত। রঙ্গনাথ মন দিয়ে দেখল- না, ওই হাউ-হাউয়ের উৎস এখানে নয়। ওর নজর ঘুরে ফিরে ওই মেয়েটির চেহারায় আটকে গেল। যারা কোন মেয়েছেলের কথা উঠতেই তালি বাজিয়ে নাচতে গাইতে লেগে যায়, এবং মেজে থেকে লাফিয়ে ছাদে ধাক্কা খায় তাদের জন্যে সব মেয়ে বা যেকোন মেয়ে, এমনকি এই মেয়েটিও ভাল দেখতে। তবে সত্যি কথা বলতে কি, এই মেয়েটির তুলনায় ওই বকরীগুলো বেশি সুন্দর। হাউ-হাউ ধ্বনি র উৎস জানা যায়নি, কিন্তু লাগাতার ওই ধ্বনির অনুরণন শোনা যাছে। এই অবস্থায় রঙ্গনাথ পার্সি ব্রাউন, কানিংহামদের ছাদে ফেলে রেখে নিচে নেমে বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়ল। বৈদ্যজী এখন ওঁর দাওয়াখানায় ওষুধ নিয়ে ব্যস্ত, চার-ছ’জন রোগী এবং শনিচর ছাড়া কারও টিকিটি দেখা যাচ্ছেনা। হাউ-হাউ আওয়াজ এতক্ষণে গলির ভেতরে সেঁধিয়ে গেছে।

রঙ্গনাথ শনিচরকে ইশারা করে শুধোল—শুনতে পাচ্ছ?

শনিচর রোয়াকে বসে একটা কুড়ুলে বাঁট লাগাতে ব্যস্ত ছিল। ও ঘাড় ঘুরিয়ে কান খাড়া করে খানিকক্ষণ ‘হাউ-হাউ’ শুনতে লাগল। হঠাৎ ওর কপালের চিন্তার ভাঁজগুলো মিলিয়ে গেল।ও শান্তভাবে বলল,’ হ্যাঁ, একতা হাউ-হাউ মত শোনা যাচ্ছে বটে। মনে হচ্ছে ছোটে পালোয়ান আর কুসহরের মধ্যে ফের ঝগড়া হয়েছে’।

এই খবরটা ও এমন নির্লিপ্তভাবে বলল যেন কোন মোষ কারও দেয়ালে একটু শিঙ রগড়ে নিল। ফের ও বাটালি দিয়ে কুড়ুলের বাঁট চাঁছতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

হঠাৎ হাউ-হাউ একেবারে জলজ্যান্ত সামনে হাজির! ষাট বছরের এক শক্তসমর্থ বুড়ো।খালি গা’, মালকোঁচা মেরে পরা ধুতিটা হাঁটু অব্দি ঢেকেছে। মাথায় তিনটে ক্ষত, তার থেকে রক্তের ধারা বইছে তিন আলাদা দিশায়, এরথেকে প্রমাণ হচ্ছে যে একজাতের খুনেরও নিজেদের মধ্যে মেলামেশা পচ্ছন্দ নয়। বুড়োটা জোরে জোরে হাউ-হাউ করে চেঁচিয়ে দুই হাত শূন্যে তুলে যেন সহানুভূতি কুড়োতে চাইছে।

রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেল রঙ্গনাথ।কাঁপা গলায় জানতে চাইল-এই লোকটা? এ কে? কে মেরেছে এমনি করে?

শনিচর কুড়ুলের বাঁট ও বাটালি আস্তে করে মাটিতে নামিয়ে রাখল।আহত বুড়ো মানুষটার হাত ধরে মাটিতে বসাল। লোকটি ‘কোন সাহায্য চাইনে’ ভাব দেখিয়ে হাত ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিল, কিন্তু বিনা ওজর আপত্তি মাটিতে বসে পড়ল।শনিচর চোখ কুঁচকে মন দিয়ে চোটগুলো দেখে বৈদ্যজীর দিকে ঠোঁটের কোণ বেঁকিয়ে ইশারা করল যে চোট হালকা, বেশি গভীর নয়।ও্রদিকে বুড়োর ‘হাও-হাও’টাও দ্রুতলয় ছেড়ে বিলম্বিত লয় ধরেছে এবং শেষে কোন জটিল তালের সমে গিয়ে আটকা পড়েছে। এসব গায়কের ঘরানার হিসেবে বেয়াড়া চলন, কিন্তু ওর উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট। ও রেগে উঠে চলে যাবেনা, বরং এখানে মৌরসীপাট্টা গেড়ে বসবে। শনিচর এবার নিশ্চিন্ত হয়ে এমন একখান শ্বাস টানল যেটা দূরের মানুষজন শুধু শুনতে নয়, দেখতেও পেল।

রঙ্গনাথের একেবারে পাঁজঞ্জুরিতে তিড়িতংক লেগে গেছে।শনিচর পাশের আলমারিটার থেকে তুলো বের করতে করতে জিজ্ঞেস মুখ খুলল,’ জিজ্ঞেস করছ ওকে কে মেরেছে? এটা আবার কেউ জিজ্ঞেস করে নাকি? এ হোল ছোটে পালোয়ানের বাপ। একে আর কে মারতে পারে, খুদ ছোটে পালোয়ান ছাড়া? কার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে পালোয়ানের বাপের গায়ে হাত তুলবে’?

কথা বলতে বলতে শনিচর এক লোটা জল ও কিছু তুলো নিয়ে বুড়োর কাছে পৌঁছে গেল।

নিজের ছেলের এবংবিধ প্রশংসা শুনে ছোটে পালোয়ানের বাপ কুসহর বা কুসহরপ্রসাদের বোধহয় একটু জ্বালা জুড়োলো।সে ওখান থেকেই উঁচু গলায় বৈদ্যজীকে বলল, ‘মহারাজ, এবার তো ছোটুয়া আমায় মেরেই ফেলেছিল। আর তো সয়না।এবার আমাদের ভাগাভাগি করে দাও। নইলে কোন দিন ওই আমার হাতে খুন হয়ে যাবে’।

বৈদ্যজী এবার তক্তপোষ থেকে নেমে রোয়াকের দিকে এগিয়ে এলেন।ক্ষতগুলো মন দিয়ে দেখে অভিজ্ঞ কবিরাজের গলায় বললেন—‘চোট টোটগুলো তেমন গভীর নয়। এখানে চিকিৎসা না করিয়ে হাসপাতালে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।ওখানেই পট্টি-টট্টি বেঁধে দেবে’খন’। তারপর দরবারের লোকজনকে শুনিয়ে বললেন- কাল থেকে ছোটের এখানে আসা বন্ধ। এমন নরকের বাসিন্দের এখানে স্থান নেই।

রঙ্গনাথের রক্ত টগবগ করছিল। বলল,’আশ্চর্য, এমনসব লোকজনকে বদ্রীদাদা পাশে বসিয়ে রাখেন’।

বদ্রী পালোয়ান ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে বলল,’লেখাপড়া জানা লোকেরা একটু ভেবেচিনতে কথা বলে। আসলে কার দোষ, কে জানে?এই কুসহরও কোন কম যায় না। এর বাপ গঙ্গাদয়াল যখন মরল, এ ব্যাটা বাপের শব ঘর থেকে চালিতে করে বের করতেই দিচ্ছিল না। বলছিল নদীর ঘাট অব্দি হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসবে’।

কুসহর ফের হাউ-হাউ হল্লা শুরু করল, কিন্তু বেশ কষ্ট করে। যার মানে, বদ্রী এসব কথা তুলে আসলে ওর প্রতি ভয়ানক অত্যাচার করছে।একটু পরেই ও সোজা দাঁড়িয়ে উঠে হুংকার ছেড়ে বলল, “বৈদ্যজী মহারাজ, ছেলেকে সামলাও। ও এইসব পুরনো কথা তুলে ইচ্ছে করে তোল্লাই দিচ্ছে যাতে দু’চারটে লাশ পড়ে যায়।ওকে চুপ করাও, নইলে খুন না করে থামবো না । আমি হাসপাতালে পরে যাব, আগে থানায় যাচ্ছি। ছোটুয়াকে এবার যদি আদালতে টেনে না নিয়ে যাই, তবে তোমরা আমায় গঙ্গাপ্রসাদের সন্তান নয়, জারজ সন্তান বলে ডেকো। আমি তো তোমাকে খালি আমার আঘাত দেখাতে এসেছিলাম। দেখে নাও মহারাজ, তিন জায়গা থেকে খুন বইছে; দেখে নাও, তোমাকেই আদালতে সাক্ষী দিতে হবে”।

বৈদ্যজী ওর আঘাত না দেখে অন্য রোগীদের দিকে মন দিলেন। তার সঙ্গে বক্তিমে চালু। যেমন, নিজেদের মধ্যে কলহ শোকের কারণ হয়। এসব বলে উনি লাপরমান ফিয়ে ইতিহাসের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। তারপর পুরাণের ঝাড়বাতির আলোর ছটা থেকে এক লাফে বর্তমানে ফিরে এলেন।এবার পারিবারিক কলহকে শোক ও পশ্চাত্তাপের মূল কারণ প্রমাণ করে উনি কুসহরকে পরামর্শ দিলেন যে কোর্ট-কাচারির চক্করে পড়তে নেই। শেষে উনি আবার প্রমাণ করতে লাগলেন যে থানা-পুলিশও শোকের মূল কারণ।

কুসহর গর্জে উঠল,” মহারাজ, এসব জ্ঞান নিজের কাছে রেখে দাও। এখানে রক্তের নদী বইছে আর তুমি গান্ধীগিরি ঝাড়ছ? যদি বদ্রী পালোয়ান কোনদিন তোমাকে চিত করে বুকের উপর চড়ে বসে তখন দেখব তোমার ইহলোক-পরলোক লেকচার কোথায় থাকে”!

বৈদ্যজীর গোঁফ থরথর করে কাঁপছে, তার মানে উনি অপমানিত বোধ করছেন। কিন্তু মুখের হাসিটি এমন যেন অপমান কাকে বলে উনি জানেনই না। যারা হাজির ছিল তাদের সবার মুখের চেহারা শক্ত হয়ে গেল। বোঝা যাচ্ছে, কুসহরের এখানে আর সহানুভূতি জুটবে না। বদ্রী পালোয়ান ওকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিল।

“ যাও যাও; মনে হচ্ছে ছোটুয়ার সাথে হাতাহাতি করে মন ভরেনি। গিয়ে ব্যান্ডেজ ফ্যান্ডেজ করিয়ে নাও। এখানে বেশি টিলটিলিও না”।

এখন পর্য্যন্ত যা নমুনা দেখা গেছে তাতে মনে হচ্ছে ছোটে পালোয়ানের বংশটি বেশ খানদানি।ওর প্রপিতামহের নাম পর্য্যন্ত মনে আছে! আর সমস্ত খানদানি বংশের ছেলেদের মত ও নিজের পরিবারের গৌরবগাথা শোনাতে ভালবাসে। কখনও কখনও কুস্তির আখড়ায় সাথিদের কিসসা শোনাতে থাকেঃ

‘আমার পরদাদার নাম ভোলানাথ। কথায় কথায় রাগ; রাগলে পরে নাকের পাটা ফুলে উঠত। রোজ সকালে উঠে আগে নিজের বাপের সঙ্গে একটু করে তারপর মুখ ধুতে যেত। ওই উস্তুম-ধুস্তুমটি না হলে ওনার পেটখারাপ হয়ে যেত’।

ছোটে পালোয়ানের বর্ণনায় পুরনো দিনের জন্যে এক ভালোলাগা ঝরে পড়ে। ওর কিসসা শুনতে শুনতে শ্রোতার চোখের সামনে ফুটে ওঠে একটি উনবিংশ শতকের গাঁইয়ের ছবি, যেখানে দরজার সামনে একগাদা গাইবলদ, গোবর ও চোনার ঝাঁঝালো গন্ধ, নিমের ছায়া আর যার নীচে খাটিয়ায় দুই মহাপুরুষ গড়াতে থাকে ও মাঝে মাঝে উঠে বসে গা’ থেকে নিমের পাতা ফুল ঝাড়তে ঝাড়তে একে অন্যকে এতক্ষণ শুয়ে থাকার অপরাধে গাল পাড়তে থাকে। ওই দুই মহাপুরুষের একজন বাপ, অন্যজন তার ব্যাটা। এরপর দুজন একে অপরকে মাটিতে জ্যান্ত পুঁতে ফেলার হুমকি দিতে দিতে খাটিয়া ছেড়ে উঠে দু’চারট্র আলতু ফালতু বকবক করে –‘যাও সবে নিজ নিজ কাজে’ হয়ে যায়। একজন বলদের লেজ মোচড়াতে মোচড়াতে নিজের খেতের দিকে রওনা হয়। অন্যজন মোষ চরাতে অন্যের খেতে চলে যায়।

এরকম একটা গল্প শেষ করার পর ছোটে হরদম বলত, ‘বাপটা মরে গেলে ভোলানাথ দুঃখে ভেঙে পড়েছিল’।

এই লাইনটা ছোটে ন্যাকামি করে বলত না। ভোলানাথ সত্যি সত্যি ছিভেঙে পড়েছিল।ওর বংশে এমনই রেয়াজ ছিল। ওদের খানদানে সব প্রজন্মেই বাপ-ব্যাটার সম্বন্ধ খুব ঘনিষ্ঠ হত। ওরা প্রেম করত শুধু নিজেদের মধ্যে, লাঠালাঠি? সেও ওই বাপ-ব্যাটার মধ্যে।ওদের ভেতরে ভালো-মন্দ, সুপ্ত প্রতিভা বা গুণ যাই থাকুক তার প্রয়োগ বাপ-ব্যাটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত।

বাবা ভোলানাথ নিজের বাপবুড়ো মরে গেলে সত্যি সত্যি বড় শোক পেয়েছিল। জীবনে এক নি;সংগতা এক শূন্যতা ছেয়ে গেল। সকালে উঠে কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে না পেরে ওর পেট গুড়গুড় করতে লাগল। চোখে মুখে জল দেয়ার ইচ্ছেটাও মরে গেল।রাতদিন খেতে বলদের মত পরিশ্রম করেও খাবার হজম হচ্ছিল না। তখন ওর ছেলে গঙ্গাপ্রসাদ এগিয়ে এল। লোকে বলে যে ছেলে হোল বুড়ো বয়সে চোখের জ্যোতি। তা’ গঙ্গাপ্রসাদ সতের বছর বয়সেই নিজে বাপ ভোলানাথকে এমন একখান লাঠির ঘা কষাল যে তিনি মাটিতে চিৎপটাং।তাঁর চোখের মণি কড়ির মত বেরিয়ে এল এবং চোখের সামনে ফুলঝুরি জ্বলতে লাগল।

এরপর বাপ-ছেলের সম্বন্ধ পাকা হয়ে গেল।। ভোলানাথ সরে গেল ওর মৃত বাপের ভূমিকায়, ওর ছেলে গঙ্গাপ্রসাদ চলে এল ওর জায়গায়। কিছুদিন গেলে হাত-পায়ের ব্যথার চোটে ভোলানাথের পেট ঠিক হয়ে গেল বটে, কিন্তু কানের মধ্যে সারাক্ষণ একটা সাঁই সাঁই আওয়াজ চলতে থাকে। এটা বোধহয় গঙ্গাপ্রসাদের কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়া গালির স্রোতের দান। যাই হোক, এবার সকাল বেলা ঘরের মধ্যে উস্তুম-ধুস্তুম করার আশায় গঙ্গাপ্রসাদের পেটের মধ্যে গুরগুর শুরু হোল।

ছেলে কুশহরপ্রসাদ হল ছোটু পালোয়ানের বাপ। কুশহরপ্রসাদ একটু গম্ভীর স্বভাবের। তাই বাপের সঙ্গে খামোখা গালাগালি করে সময় নষ্ট করত না। এছাড়া রোজ সকালে খেতে কাজ করতে যাওয়ার আগে বাপের সঙ্গে ঝগড়া করার যে কয়েক পুরুষের অভ্যেস সেটাও ও ছেড়ে দিল। তার বদলে আরম্ভ হোল মাসিক দরে মারপিট। গঙ্গাপ্রসাদের ছোটবেলা থেকেই নোংরা ছ্যাঁচড় গালির জন্যে এত নাম হোল যে নওজোয়ান গঞ্জহা’র দল রোজ বিকেলে ওর আড্ডায় হাজিরা দিতে লাগল। ওর মৌলিক এবং শিল্পসম্মত গালিগুলো শুনে ওরা পরে নিজের নামে চালিয়ে দিত। গালাগাল এবং গেঁয়ো গানের পদরচনার কোন কপিরাইট তো হয়না। এভাবে গঙ্গাপ্রসাদের গালিগুলো হাজার কন্ঠে হাজার পাঠান্তরের সঙ্গে ধ্বনিত হতে থাকল। কিন্তু বাপের এই প্রতিভায় কুসহর আদৌ প্রভাবিত হলনা। ও চুপচাপ গালি শুনতে শুনতে বাপকে মাসে একবার দু-চারটে লাঠির বাড়ি কষিয়ে ফের নিজের কাজে চলে যেত। দেখা গেল, বদহজমের পারিবারিক অসুখটি সারাতে এই পদ্ধতি বেশ কাজের। কারণ, বদহজমের সমস্যাটি গঙ্গাপ্রসাদের সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছল।

কুসহরপ্রসাদের আরও দুটো ভাই ছিল-বড়কু আর ছোটকু। ওরা দু’জন শান্তশিষ্ট, নিরস্ত্রীকরণের ভক্ত। সারাজীবনে একটা কুকুরকেও লাঠিপেটা করেনি। বেড়াল আরামসে ওর রাস্তা কাটে, ও তাদের একটা ঢিলও ছোঁড়েনা। কিন্তু ওরা বাপের থেকে গালি দেয়ার শিল্পকলা শিখে ফেলেছিল। আর তার দৌলতেই ওরা রোজ সন্ধ্যায় সমস্ত পারিবারিক ঝগড়ার সমাধান বিনা মারপিট করে সেরে ফেলত। রোজ সন্ধ্যে হলে দুই ভাই আর তাদের দুই গিন্নি মিলে যে ‘কাঁও কাঁও’ শুরু হত সেই অধিবেশন শেষ হতে হতে রাত দশটা। এই অধিবেশনগুলোর তুলনা দেশের সুরক্ষা সমিতির বৈঠকের সঙ্গে কয়রা যেতে পারে। কারণ ওই বৈঠকগুলোতেও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অনেকক্ষণ ‘কাঁও কাঁও’ করে যুদ্ধের সম্ভাবনা কিছুটা হলেও কম করে ফেলে।

এরকম দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কুশহরপ্রসাদ পরিবারের রোজকার হল্লাগুল্লাকে ঘৃণার চোখে দেখাটা প্রতিক্রিয়াবাদীর চিহ্ন, কিন্তু আশপাশের লোকজনের রাজনৈতিক চেতনা অতটা বিকশিত হয়নি যে, কী আর করা! ফলে যেই সন্ধ্যেবেলা ছোটকু ও বড়কুর গালি এবং হাহাকারের ধ্বনি গলির কুকুরের ভৌ ভৌকে ছাপিয়ে উঠে শিবপালগঞ্জের আকাশকে বর্শার খোঁচায় ফালাফালা করে ফেলে অমনই পড়শিদের টিপ্পনি শুরু হয়ে যায়ও।

‘ এখন এই কুকুরহাও’ (ঘেউ ঘেউ) মনে হচ্ছে আদ্দেক রাত অব্দি চলবে’।

‘ একদিন একটা ফাটা জুতো নিয়ে এদের উপর চড়াও হব, তবেই এরা শিখবে’।

‘এর জিভে ব্রেক ফেল হয়ে গেছে। চলছে তো চলছেই’।

এই ‘কুকুরহাও’ শব্দটা গঞ্জহাদের তৈরি। কুকুরের দল নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-মারামারি করে আর একটা আরেকটাকে উসকে দেয়ার জন্যে খানিকক্ষণ চেঁচায়, সেটাই ‘কুকুরহাও’।শব্দকোষের নিয়ম-টিয়ম দেখলে ছোটকু এবং বড়কুর আলাপকে ‘কুকুরহাও’ বলা বোধহয় উচিত হবেনা। আসলে এরা দুইভাই দুইবৌ যা করে সেটা হোল বান্দরহাও। এরা বাঁদরের মত খোঁ খোঁ করে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং কোন রেফারির বাঁশি না বাজলেও নিজে থেকে পিছিয়ে আসে। যদি বাইরের কেউ মধ্যস্থতা করতে আসে বা ওদের শান্তির মহত্ত্ব বোঝাতে চাইবে তাহলে তক্ষুণি ওরা দুজনে এক হয়ে তৃতীয় ব্যক্তির উপর খোঁ খোঁ করে হামলা করবে। বান্দরহাও এর এই নিয়ম সব গঞ্জহা জানে। তাই ছোটকু-বড়কুর পারিবারিক অধিবেশনের সমালোচনা হয় লুকিয়ে চুরিয়ে, পেছনে আর ওদিকে ওদের ওই অধিবেশন মাঝরাত পর্য্যন্ত বাধাহীন চলতে থাকে।

ছোটে পালোয়ানের বাপ কুশহরপ্রসাদ হোল কম কথার কাজের মানুষ।ও ছোট দু’ভায়ের বাগীশ্বরী প্রবন্ধাবলীর ব্যাপারটা কোনদিন বোঝেনি।ওর স্বভাব হোল খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর হঠাৎ হঠাৎ হাত চালিয়ে দেয়া। এটা আবার অন্য ভাইদের জীবনদর্শনের সঙ্গে একেবারে খাপ খায় না। এইজন্যে ও বাবা গঙ্গাপ্রসাদ মারা যাবার কয়েকবছর পরে ভাইদের থেকে আলাদা হয়ে গেল। মানে, কোন কথা না বলে একদিন লাঠির জোরে ভাইদের বাড়ি থেকে খেদিয়ে দিল। ওরা বাধ্য হোল একটা ক্ষেতের মধ্যে ঝুপড়ি বানিয়ে বাণপ্রস্থ-আশ্রম মেনে নিতে, আর নিজে পৈতৃক বাড়িতে জোয়ান ছেলের সঙ্গে ওদের বাপছেলের খানদানি ঐতিহ্যের সঙ্গে গৃহস্থ-আশ্রম চালাতে লাগল।

মাসের মধ্যে অন্ততঃ একবার বাপকে লাঠিপেটা করে কুশহরের এমন অভ্যেস হয়ে গেছল যে বাপ মরে যাওয়ায় ওর হা্তে মাসে দু’চার দিন পক্ষাঘাতের মত হয়ে যেত।পক্ষাঘাতের ভয়ে ও একদিন আবার লাঠি তুলে নিল এবং ছেলে ছোটে পালোয়ানের কোমরে ত্যাড়া করে এক ঘা কষাল। ছোটে তখনও ছোট, পালোয়ান হয়নি, কিন্তু গাঁয়ের বাইরে রেললাইনের পাশে তার টানা বড় বড় লোহার স্তম্ভের উপর সাদা সাদা ইনসুলেটর ঢিল ছুঁড়ে ভাঙা অভ্যেস করছিল। ওর নিশানা ছিল অব্যর্থ। যেদিন কুশহরপ্রসাদ ছোটের কোমরে লাঠির ঘা কষাল মাত্র সেইদিনই ও রেললাইনের ফাঁকে বিছানো নুড়ির থেকে বেশ ক’টা তুলে নতুন একটা স্তম্ভের গায়ে লাগানো সবক’টা ইন্স্যুলেটর ভেঙে আবার লাইনের ফাঁকে বিছিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। লাঠির ঘা’ খেয়ে ও রেললাইনের দিকে বিশ পা দৌড়ে গিয়ে একটা নুড়ি তুলে বাপের মাথাকে ইন্সুলেটর ভেবে তাক করল।ব্যস্‌ সেদিন থেকেই ওদের পরিবারে বাপ-ছেলের মধ্যে বংশপরম্পরায় চলে আসা সনাতন ধর্ম প্রাণ পেয়ে জেগে উঠল।ব্যস্‌ আরকি! এরপর প্রায় প্রতিমাসে কুশহরের চেহারায় দু’একটা ছোট ক্ষত পার্মানেন্ট দেখা যেতে লাগল। এভাবে অল্প দিনেই ও অঞ্চলের রানা সঙ্গার ( বাবরের সঙ্গে লড়াইয়ে আশিটা ঘা’ নিয়ে লড়ে যাওয়া মেবারের রাণা) টাইটেল পেল।

ছোটে পালোয়ান জোয়ান হয়ে উঠলে পরে বাপ-ব্যাটার মধ্যে শব্দের আদানপ্রদান থেমে গেল। ওরা উঁচুদরের শিল্পীর মত নিজের ভাবনার প্রকাশ চিহ্ন, প্রতীক ও ইংগিতের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে শুরু করল।ওদের মধ্যে মারপিটের ঘটনাও কমে গেল। ওসব বড় বড় নেতাদের জন্মদিন পালনের মত ধীরে ধীরে এক বার্ষিক অনুষ্ঠানের রূপ নিল, যা জনতার দাবি হোক না হোক, নির্ধারিত সময়ে পালন করা হয়ে থাকে।

কুশহরপ্রসাদ চলে গেলে রোয়াকের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ফুট কাটল- এই হোল কলিযুগ! বাপের সাথে ব্যাটার ব্যভারটা দেখলে!

মাথার উপরের নীম গাছের ডালপালা সরিয়ে আকাশের দিকে চোখ তুলে লোকটা ফের বলে উঠল, ‘প্রভু তুমি কোথায়? কবে কল্কি অবতাত্রের রূপ ধারণ করে নেমে আসবে?

উত্তরে কোন আকাশবাণী তো দুর, একটা কাকের আওয়াজও শোনা গেল না। কল্কি অবতারকে আহ্বান করা লোকটির মুখ কালো হয়ে গেল। কিন্তু কুড়ুলের বাঁট পরীক্ষায় ব্যস্ত শনিচর তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল, ‘যাও, তুমিও কুসহরের সঙ্গে সঙ্গে যাও। সাক্ষী দিও, সিকি-আধুলি কিছু না কিছু ঠিক জুটে যাবে’।

বদ্রী পালোয়ান মুচকি হেসে সায় দিল।রঙ্গনাথ দেখল কল্কি অবতারের বাতেলা করা লোকটি একজন পুরুতের মত দেখতে বুড়োমানুষ।চিমড়ে গাল, খিচুড়ি দাড়ি, বোতামহীন জামা, মাথায় একটা যেমন তেমন গান্ধীটুপি, তার পেছন থেকে টিকি এমনভাবে বেরিয়ে যেন আকাশ থেকে বাজ পড়লে আর্থিং এর কাজ দেবে।ওর কপালে লাল চন্দনের ফোঁটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।

লোকটা সত্যি সত্যি কুশহরের পেছন পেছন চলে গেল। শনিচর বলল,” ওই হোল রাধেলাল। সাক্ষী দেয়ার একনম্বর। কোন উকিল, যত নামজাদাই হোক, আজ অব্দি ওকে জেরা করে পেরে ওঠেনি।

শনিচরের পাশে একটা আমোদগেঁড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভক্তিভরে বলে উঠল, ’রাধে্লাল মহারাজের উপর কোন দেবতার ভর হয়। মিথ্যে সাক্ষী চটপট দিতে থাকে। উকিলের দল চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে। বড় বড় লোকের হাওয়া টাইট হয়ে যায়’।

খানিকক্ষণ রাধেলালের তারিফ করে কাটল। শেষে শনিচর আর ওই আমোদগেঁড়ের মধ্যে তর্ক বেঁধে গেল। শনিচরের হিসেবে রাধেলাল বড্ড গোঁয়ার আর শহরের উকিলগুলো হাঁদারাম, নইলে ওকে জেরায় কাত করতে পারে না? উলটো দিকে আমোদগেঁড়ে এটাকে দেবতার আশীর্বাদ এবং বিভূতি প্রমাণ করেই ছাড়বে। যুক্তি আর বিশ্বাসের লড়াইয়ে বিশ্বাস যে ক্রমশঃ যুক্তিকে পেড়ে ফেলছে সেটা বলার দরকার নেই। ঠিক তখনই পাশের কোন একটা গলি থেকে ছোটে পালোয়ান উদয় হোল। বৈদ্যজীর দরজায় এসে এদিক সেদিক উঁকিঝুঁকি মেরে তারপর বলল,’ চলে গেছে’?

শনিচর বলল, ‘হ্যাঁ গেছে। কিন্তু পালোয়ান, এই পলিসিটা মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে’।

পালোয়ান দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’তোর মনুষ্যত্বের ইয়ে করি’।

শনিচর কুড়ুল হাতে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচাল,’দেখো বদ্রী ভাইয়া! তোমার বাছুর আমাকে চাট মারছে! সামলাও’!

বৈদ্যজী ছোটেকে দেখে উঠে পড়লেন। রঙ্গনাথকে বললেন,’ এমন নীচপ্রবৃত্তির মুখ দেখাও পাপ! একে এখান থেকে ভাগাও’! এই বলে উনি ভেতরে চলে গেলেন।

ছোটে পালোয়ান বৈঠকখানার ভেতরে ঢুকে পড়ল। চারদিকে রোদের খেলা। সামনের নীমগাছে একগাদা টিয়েপাখি টে-টে করে ওড়াউড়ি করছে।রোয়াকের উপর শনিচর কুড়ুল হাতে খাড়া। বদ্রী পালোয়ান এক কোণে চুপচাপ একজড়া মুগুরের ওজন পরীক্ষায় ব্যস্ত।রঙ্গনাথ বৈঠকে পড়ে থাকা একটা বইয়ের পাতা ওল্টানোয় ব্যস্ত। ছোটে টের পেল যে হাওয়ায় বারুদের গন্ধ। এর জবাবে ও ছাতি ফুলিয়ে রঙ্গগনাথের পাশে ধপ করে বসে পড়ল আর চোয়াল নাড়িয়ে নাড়িয়ে মুখের ভেতর পুরে রাখা সুপুরির জাবর কাটতে লাগল।তারপর ছোটে রঙ্গনাথের দিকে এমন করে তাকাল যেন ও একেবারে নস্যি। তারপর তিরিক্ষি ভাবে বলল,’ তাহলে এই ব্যাপার! আমি তো আমার বদ্রীগুরুর ঘর ভেবে এসেছিলাম, কিন্তু যদি তোমাদেরই মাতব্বরি চলে তো এখানে আর পেচ্ছাপ করতেও আসছি না’।

রঙ্গনাথ হেসে পরিবেশ হালকা করতে চাইল। ‘আরে না না, পালোয়ান বসো দিকিনি! মটকা গরম হয়ে থাকে তো এক লোটা ঠান্ডা জল খাও’।

ছোটের গলার স্বর আগের মতই কর্কশ,’জল খাবো? আমি এখানে ছোঁচানোর জন্যেও জল চাইব না। সবাই মিলে আমায় ইল্লি করতে লেগেছে’।

বদ্রী এবার ছোটের দিকে প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর একটা মুগুর নিয়ে বাঁহাতে খেলতে খেলতে মুচকি হেসে বলল, ‘রেগে যাওয়া দুর্বলকে শোভা দেয়। তুমি কেন নাক ফোলাচ্ছ? তুমি মানুষ না পায়জামা’?

ছোটে পালোয়ানের সমর্থনের ইশারা বুঝতে দেরি হল না। আরও মেজাজ দেখিয়ে বলল,’ বদ্রী গুরু! আমার একটূও ভাল লাগছেনা। সবাই আমার পেছনে হাত ধুয়ে পড়েছে্‌, কাঠি করছে।খালি বলে-বাপের গায়ে কেন হাত তুলেছ? বাপকে কেন মেরেছ?যেন কুশহরপ্রসাদ শিবপালগঞ্জে সবার বাপ!আর আমিই খালি ওর শত্রু’।

বলতে বলতে ওর রাগ আরও চড়ে গেল। বলল,’ দেখ গুরু, শালা একটা বাপের মত বাপ হত, তাও বুঝতাম’।

খানিকক্ষণ সবাই চুপ।



রঙ্গনাথ ছোটে পালোয়ানের বাঁকা ভুরু মন দিয়ে দেখছে। শনিচর এবার রোয়াক থেকে দরবারের ভেতরে এল। ও পালোয়ানকে বোঝাতে চাইল,’এমন সব কথা মুখে আনতে নেই।একটু মাটিতে পা ফেল, খামোখা আকাশের বুকে খোঁচা মেরো না।কুসহর তোমাকে জন্ম দিয়েছে, পালন-পোষণ করে এত বড় করেছে, এটা তো মানবে’?

ছোটে কুড়কুড়িয়ে বলল,’আমি বুঝি স্ট্যাম্প লাগিয়ে দরখাস্ত পেশ করেছিলাম—আমাকে জন্ম দাও? ওরে আমার জন্মদেনেবালে রে’!

বদ্রী এতক্ষণ চুপচাপ কথাবার্তা শুনছিল। এবার মুখ খুলল,’অনেক হয়েছে ছোটে, এবার ঠান্ডা হ’ দিকি’!

ছোটে নিরুৎসাহ ভঙ্গিমায় বসে রইল।বোধহয় নিমগাছের মাথায় টিয়ে পাখির টে-টে কিচিরমিচির শুনছিল। শেষে এক লম্বা শ্বাস টেনে বলল,’তুমিও আমাকেই দোষী ঠাউরেছ গুরু! তুমি জাননা এই বুড়োটা কত বড় ব্জজাত!ওর জ্বালায় বৌ-ঝিরা আমাদের বাড়িতে জল ভরা বন্ধ করে দিয়েছে।আরও বলি? এরপর আর কী বলার থাকে? জিভ নোংরা হবে’।

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


 


















৩৮

বের্শেম সৈনিক হলেও যুদ্ধটা মোটেই পছন্দ করে না। ১৯৪৪ সালের শেষ অবধি যা হোক করে হোক সে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটা থেকে বেঁচে যায়। নাইটক্লাবের ওয়েটার আর ককটেল বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করত সে। যুদ্ধের সময়ে নাইটক্লাবের পরিস্থিতি নিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সে। প্রায় ১৫০০ রাতের ঘটনা দেখেছে সে।

সে জানে যে বেশির ভাগ পুরুষ যতটা মদ সহ্য হবে বলে ভাবে, তার চেয়ে অনেক কম খেয়ে মাতাল হয়ে যায়। তাছাড়া সারাজীবন অনেক পুরুষই নিজেদের বুনো মদ্যপ বলে মনে করে। নাইটক্লাবে যারা সঙ্গিনী নিয়ে আসে, তারা সঙ্গিনীদেরকেও এই ব্যাপারটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করাবার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে মদ্যপ বলতে যা বোঝায়, সেরকম পুরুষ খুব কম আছে। তারা যখন মদ্যপান করে, তখন সেটা দেখবার একটা আলাদা মজা আছে। যুদ্ধের সময়েও এমন পুরুষ সত্যিই বিরল।

এছাড়াও আরেকটা জিনিস সে লক্ষ্য করেছে যে একটা মানুষের বুকে অথবা গলায় সেঁটে দেওয়া পদকের এক টুকরো ধাতু সেই মানুষটাকে কিছুমাত্র বদলে দেয় না। অথচ অনেকেই এরকম ভাবে যে ওই টুকরোটা কিম্বা পোশাকের কারুকাজ এসব কিছু একটা ভীতু মানুষকে অসমসাহসী কিম্বা একটা মূর্খ মানুষকে বুদ্ধিমান বানিয়ে দেবে। কিন্তু বের্শেম লক্ষ্য করে দেখেছে যে সেরকম কিছু ঘটে না। যদি এইসব বাহ্যিক কাণ্ডকারখানা করে একটা মানুষকে বদলে দেওয়া যেত, তাহলে সেই বদলটা বড় জোর নেতিবাচক হতে পারে। তবে মানুষগুলোকে অবশ্য সে খুব বেশি হলে এক রাত বা দু’ রাত দেখেছে। অতীতে এদের কাউকেই সে চিনত না। তবে একটা ব্যাপার তার কাছে একদম পরিষ্কার যে এদের বেশির ভাগ মদ খেতেই পারে না। অথচ অনেক মদ গিলতে পারে, এরকম একটা হাবভাব করে। তাছাড়া একটু গিলেই এরা যখন মাতাল হয়, তখন আর কে হিসেব রাখবে যে কে কত গিলেছে? এরা মাতাল হয়ে গেলে, এদের কাণ্ডকারখানা দেখতে একটুও ভালো লাগে না তার। এই নাইটক্লাবে যুদ্ধের সময় প্রায় পনের শ’ রাত সে কাটিয়ে ফেলেছে। অনেক কিছু দেখেছে সে। তবে এই নাইটক্লাবে অবশ্য নিষিদ্ধ বা চোরাই জিনিস কেনাবেচার ক্ষেত্রে সেরকম কড়াকড়ি কোনো দিন ছিল না।

নাইটক্লাবে মদ কিম্বা ধূমপানের জন্য সিগারেট ইত্যাদি ছাড়াও মাঝে মাঝে খাবারদাবার বিক্রি হত। বের্শেমের বস ছিল এক আঠাশ বছরের ছোকরা, যার স্বাস্থ্য বেশ ভালো; অথচ ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর অবধি তাকে সৈনিকের ট্রেনিংও নিতে হয়নি, যুদ্ধেও যেতে হয়নি।

গোটা শহরটা যে বোমায় ধ্বংস হতে বসেছে, এইসব ব্যাপার নিয়ে বসের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। শহরের বাইরে জঙ্গলের কাছে বসের একটা প্রাসাদোপম বাংলো ছিল। শোনা যায় যে সেটাতে নাকি বাঙ্কারও ছিল। বিশেষ অতিথিদের নিয়ে গোপনে পার্টি করার জন্য বস তাদের গাড়ি করে নিয়ে যেত তার বাংলোর বাগানে।

বের্শেম যুদ্ধের সময়ে প্রায় পনেরশ রাত কাটিয়েছে নাইটক্লাবে। খুব খুঁটিয়ে সে সবকিছু লক্ষ্য করত। তাছাড়া বেশির ভাগ সময়ে তাকে কথা শুনে যেতে হত; নিজে কথা বলবার অবকাশ হত না সেরকম। যদিও একঘেয়ে লাগত। কিন্তু কিছু করার ছিল না। কত যে যুদ্ধের আক্রমণ আর চক্রব্যূহের মত ঘিরে ফেলবার ঘটনা সে শুনেছিল, সে কহতব্য নয়। তার মাঝে মাঝে মনে হত যে লিখে রাখলে কেমন হয়? কিন্তু অনেক, অনেক আক্রমণ, অনেক অনেক ঘিরে ফেলবার গল্প শুনেছিল সে। কত লিখবে? অনেক বীর যোদ্ধাদের দেখেছিল সে, যারা সব সময় পুরস্কার পাওয়া মেডেলগুলো পরত না। সীমান্তের ভাইল শহরের গল্প, আক্রমণের গল্প সব শুনে শুনে তার মনে হয়েছিল যে যুদ্ধের একদম হদ্দমুদ্দ জেনে নিচ্ছে সে। তবে মাতাল হয়ে সাধারণত সবাই সত্যি কথাই বলে। অর্থাৎ সেগুলো নেহাত গল্প ছিল না। সত্যি ঘটনা ছিল। বীর যোদ্ধাদের থেকে, বারের ওয়েট্রেসদের থেকে অনেক সত্যি ঘটনা শুনেছিল সে। ফ্রান্স, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া এসব জায়গা থেকে আসা অনেকগুলো মেয়েকেই ওয়েট্রেস হিসেবে দেখেছে সে নাইটক্লাবে। ওয়েট্রেসদের অনেকের সঙ্গেই ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যেত তার। ওদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে মদ খাওয়া… উফফ, সে একটা বেশ ব্যাপার বটে!

কিন্তু আপাতত সে আউয়েলব্যার্গ বলে একটা জায়গায় একটা খামারবাড়িতে চুপচাপ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে চোখে দূরবীন লাগিয়ে। বন্দুক ছাড়াও সঙ্গে আছে একটা স্কুল নোটবই, কিছু পেন্সিল আর একটা ঘড়ি। তার থেকে ঠিক দেড়শ মিটার দূরে বয়ে যাচ্ছে একটা নদী। নদীর ওপারে ভাইডেসহাইম বলে একটা জায়গা। সেই জায়গাটার উপরে নজর রাখতে হচ্ছে তাকে। তবে ভাইডেসহাইমে নজর রাখবার মত সেরকম কিছু ঘটছে না।

শহরটার সামনের দিকের প্রায় অর্ধেকটা জ্যাম কারখানার দেওয়াল দিয়ে ঘেরা এবং জ্যাম কারখানাটা এখন বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। মাঝেমধ্যে এক দুটো লোক দেখা যায় পথে। কালেভদ্রে কেউ কেউ পশ্চিম দিকে হাইডেসহাইমের দিকে যাচ্ছে। তারপর যেতে যেতে সরু রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ভাইডেসহাইমে কিছু কিছু লোক আঙুরের ক্ষেতে কিম্বা ফলের বাগানে কাজ করছে। দেখা যাচ্ছে যে লোকগুলো কাজ করছে। তবে সব কথাই কি নোটবুকে লিখে রাখতে হবে? যে বন্দুকের ভার দেওয়া হয়েছে তাকে, সেটার জন্য দিনে সাতটার বেশি গোলা বরাদ্দ নয়। দিনে সাতটা গোলা যদি সে খরচ না করতে পারে, তাহলে এই বন্দুকের জন্য গোলার বরাদ্দ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। এদিকে আবার হাইডেসহাইমের দিকে যেসব আমেরিকানরা ঘাঁটি গেড়েছে, তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে যেতে হলে ওই সাতখানা গোলা যথেষ্ট নয়। ওদের দিকে একখানা গোলা ছুঁড়লে ওরা একশখানা ছুঁড়ে জবাব দেয়। সেইজন্য ওদের দিকে গোলা ছোঁড়া একেবারে বারণ শুধু নয়, একদম নিষিদ্ধ। কোনো মানে হয় না ওদের দিকে গোলা ছোঁড়ার।

শুধু গোলা ছোঁড়া নয়, ওদের বিষয়ে নোট নেবারও কোনো মানে হয় না। বের্শেম তার নোটবুকে লিখে রেখেছে … ‘সকাল ১০.৩০ হাইডেসহাইমের দিক থেকে একটা আমেরিকান গাড়ি এসে ভাইডেসহাইমের জ্যাম কারখানার প্রবেশদ্বারের লাগোয়া একটা বাড়ি অবধি এলো। জ্যাম কারখানার সামনে গাড়িটা পার্ক করে রাখা থাকছে। গাড়িটা ফিরছে ১১.১৫।’

এই গাড়িটা রোজ আসছে। বন্দুকের থেকে মাত্র দেড়শ মিটার দূরে দাঁড়াচ্ছে রোজ। বন্দুকের নাগালের দূরত্বের মধ্যেই। কিন্তু ওই গাড়িটাতে গোলা ছোঁড়া হয় না। এই যে এত কিছু বের্শেম লিখে রেখেছে তার নোটবুকে, সেটারও কোনো মানে হয় না। সব সময় ওই গাড়িটা থেকে একজন আমেরিকান সৈনিক নেমে এসে ওই বাড়িটায় ঢোকে। ঘণ্টাখানেক থাকে। তারপর ফিরে যায়।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in







এগারো

(রবিবাবুর বিবাহ ও তার জীবনের কথা।)



রবিবাবু স্কুলের কাছে বিবেকানন্দ আশ্রমে যেতেন মাঝে মাঝে।সেখানে শুনতেন মহারাজের কথা।তিনি বলতেন,রামকৃষ্ণ দেব বলেছিলেন "তোদের চৈতন্য হোক" । আবার শ্রীচৈতন্য দেব ভক্ত দের নাম সংকীর্তনের মাধ্যমে নিজের ভক্তির অর্ঘ্য শ্রীহরির চরণে নিবেদন করতে বলেছেন । সহজ পথ তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন । তাঁদের দেখানো পথে যেতে পারলেই মন নিয়ন্ত্রিত হয়ে মৃত্যু ভয় দূর হয় ।জয় শ্রী গৌরাঙ্গ বলে ঝাঁপিয়ে পর মন , বাড়ির কাছেই পাবে শ্রী বৃন্দাবন । তবু বিষয় বিষে জর্জরিত মানুষ পার্থিব সুখ কে আঁকড়ে বাঁচতে চায় ।

মানুষের মন ও মৃত্যুচেতনা বিষয়ে অনেক বিচিত্র ধারণা প্রাচীন কাল থেকে মায়ার চাদরে আচ্ছাদিত ।আইনস্টাইন থ্রি ডাইমেনশন থেকে ফোর ডাইমেনশনে সময় যোগ করেছিলেন ।আমার মতো অর্বাচীন মন নিয়ে আপনাদের কতটুকু ধারণা দিতে পারি বন্ধু । তবু আমার মনে হয় ফাইভ ডাইমেনশনে মন যুক্ত হবে ।শিশুর সারল্যে মন যখন কোনো কিছু ভালোবাসে সেই ভালোবাসা স্থায়ী হয়ে মনের মণিকোঠায় আজীবন আনন্দের দামামা বাজিয়ে চলে । সাধক মানুষ সিদ্ধিলাভের পরে জীবনের পার্থিব চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে থাকে । কবিতা গান নাটক উপন্যাস সবকিছু এই বিচিত্র মনের সৃষ্টি ।বন পুড়লে দাবানল সৃষ্টি করে আর মন পুড়ে সৃষ্টি করে গান কবিতা ছবি । একটা কবিতা বা গান সুর তোলে মনের মণিকোঠায় । সকল দুঃখ বেদনা সারিয়ে তুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায় ।মন আজীবন মানুষের অভিভাবক হয়ে নির্দেশ দেয় সু পথে চলার ।

মন বলবেই মৃত্যু কে সহজেই স্বীকার করার কথা । মৃত্যু কে রোধ করার চেষ্টা করলে জীবনের গতিপথ যে বন্ধ হয়ে যাবে ।মৃত্যু ই তো জীবনের স্বাদ অমৃতময় করে তোলে ।অতএব সুখ দুঃখ আলো অন্ধকার সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হোক ।

মহাজ্ঞানী বুদ্ধদেব সন্তান হারা মাতাকে মৃত্যু প্রবেশ করেনি এমন বাড়ি থেকে একমুঠো সরিষা আনতে বলেছিলেন ।তিনি কি আনতে পেরেছিলেন । তাই বন্ধুদের কবি অসীম সরকারের একটা গানের লাইন শোনাই, " ও মন সওদাগর বিদেশে বাণিজ্যে এসে কেন বাঁধলি বসতঘর ;দেশের মানুষ দেশেই ফিরে চল"...আপন দেশ শ্রীহরির পাদপদ্মে সমর্পিত হোক আমাদের জীবন । শ্রীহরি আমার অন্তরে চৈতন্যের জাগরণ করে দাও, আমার অহংকার কেড়ে নাও ,আমাকে তোমার চরণে ঠাঁই দাও, এই হোক আমাদের প্রার্থনা ।

রবিবাবু মন দিয়ে কথাগুলো শোনেন।তার খুব ভাল লাগে শ্রীরামকৃষ্ণের কথা শুনতে। সন্ধে হলে তিনি বাড়ি ফিরলেন,দেখলেন কয়েকজন অপরিচিত লোক এসেছেন।রবিবাবুর বাবা বললেন,তাহলে আমরা আগামীকাল মেয়ে দেখে আসব।ফাইনাল কথা কালকেই বলব।

রবিবাবুও সম্মত হলেন।মেয়ে পছন্দ হলে তিনমাস পরে বিয়ে হয়ে গেল।এখন রবিবাবু বিবাহিত।

আশ্রমে যাওয়া এখন কমে গেছে।এখন শুধু বাজার,বাড়ি আর স্কুল।তারপর দশবছরের মধ্যে রবিবাবুর বাবা,মা পরলোকে চলে গেলেন।তার দুই পুত্রসন্তান স্কুলে ভর্তি হল।সময় থেমে থাকে না।

অভয়বাবুর সংসার ও মশালে জগদ্ধাত্রী পুজো।
0

ধারাবাহিক - শ‍্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(১৪)

বিকালের সামান্য আগে রামমোহন গঙ্গার পাড়ে নিয়মিত একটু হাওয়া খেতে বের হন। সতীদাহ নিবারণের বিল সরকারীভাবে পাশ হয়ে গেলেও শহর কলকাতার হাওয়াটি এখনও বেশ গরম।

শোভাবাজারের রাধাকান্ত দেব দায়িত্ব নিয়ে এই বিষয়টি কেন্দ্র করে এখনও একটা ঘোঁট পাকাতে চেয়ে বাইরে থেকে সনাতনীদের অন্যায়ভাবে মদত দিচ্ছেন।আসলে নবদ্বীপ থেকে ভাটপাড়া অবধি অনেক কূলীন ও বহুবিবাহে অভ্যস্ত সব ব্রাহ্মণদের দল ওঁদের মত কিছু রসদদারদের কাছ থেকেই নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকে বলে স্বভাবতঃই ওরা নব্য বাবুদের কাছে বিচার চেয়ে পরিবেশটিকে অযথা অস্থির করে তুলেছে।

এসব দেখে মাঝেমাঝে রামমোহনের নিজের ওপরেই ভীষণ রাগ হয়। সেই মনখারাপের হতাশাময় সময়টাতে অন্তত নির্জন গঙ্গার ধার থেকে একটু ঘুরে আসলে ঠান্ডা হাওয়ায় মনটা শান্তি পায়।

মির্জাপুর থেকে বেড়িয়ে তিনি তাঁর ফিটনের কোচোয়ানটিকে নিমতলা ঘাটের দিকে গাড়িটি একবার ঘোরাতে বললেন।

যদিও শ্মশান সংলগ্ন ঘাটটিতে শবানুগমন করতে আসা শোকগ্রস্ত মানুষেরা ছাড়া বিশেষ কেউ আসেনা তাও এখানে দিনে একটিও চিতা জ্বলছে না সেটা অবশ্য আশা করা কঠিন। তবুও তিনি এদিকটাতে যে কারণে প্রায়সই এসে থাকেন তার একটি কারণ হল নিমতলার কাছেই " সম্বাদ কৌমুদী " এর একটি ছাপাখানা আছে।

কাল রাতে এখানে কারা যেন এখানে আগুন লাগাতে এসেছিল বলে তিনি শুনেছেন।

গত একটি বছরে সতীদাহের বিপক্ষে তাঁরই কিছু রচিত প্রবন্ধগুলি এই সংবাদপত্রে নিয়মিত ছাপা হওয়ায় এখন এরাও সনাতনপন্থীদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। তাই এইভাবে প্রতিশোধ নিয়ে সমাজপতিরা নিজেরা অন্তত শেষবার মাথা তুলে একবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

তিনি এগিয়ে এসে যা দেখতে পেলেন তাতে বুঝতে পারলেন যে খবরটি নিজে একজন ফড়ে মারফৎ হলেও যা পেয়েছেন তা একেবারে মিথ্যা নয়।

দেখতে পেলেন ছাপাখানাটির একটি দিক খুব বাজে ভাবে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও এখন অর্ধভস্মীভূত আবহটি জনশূন্য।

বোঝাই যাচ্ছে যে ছাপাখানার মালিক আর অন্য কর্মচারীরা সব গোলমাল বুঝে চম্পট দিয়েছে। স্বয়ং রামমোহনকে হঠাৎ এদিকপানে আসতে দেখে একরকম ভূতের মত চমকে উঠে তাঁর কাছে এসে দাঁড়াল কম্পোজিটার দুলু কুন্ডু নামের এক প্রবীণ কর্মচারী।

কাঁচা পাকা চুলের প্রায় তটস্থ লোকটি যে এখনও যে এখানকার আশ্রয় ছেড়ে পালায়নি এটাই বড় আশ্চর্যের বিষয়। এবার লোকটি ভয়ে ভয়ে তাঁকে বলল, " কি সব্বোনাশের কান্ড বলুন দিকি! যাক্ আপনি তাহলে একোনো বেঁচে আচেন! বড়তলার জমিদার বাবুদের পাইকের দল এসে রাতে আমাদের ছাপাখানাটির ওপর চড়াও হয়েছিল! একোন ওরা আপনাকে একেনে দেকতে পেলে আর রক্কে থাকবেনি। আপনি মানী মানুষ!তাও আপনি পার পেয়ে যাবেন! কিন্তু আমি আপনার সাথে কথা কইচি এটা জানতে পারলে ওরা আমাকেও পুড়িয়ে মারবে। এইইইই নিন্ সতেরোটা প্রভাকর এখনো বেঁচে আচে...এগুলো সাথে করে নিয়ে আপনিও পালান গ্যে ! দুগ্গা..দুগ্গা! "

লোকটির ভীত চেহারাটি দেখে রামমোহনের খুব মায়া হল। উনি তক্ষুণি জোব্বার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কিছু স্বর্ণমুদ্রা বের করে লোকটির হাতে দিয়ে বললেন,

- " আহা বেরাদর! এই কটি মুদ্রা আজ আপনি আপাতত নিজের কাছে গচ্ছিত রাখুন। নিশ্চিন্ত থাকুন কল্য এই প্রতিষ্ঠানটি আইনমোতাবেক আমি নিজেই ক্রয় করে নেব ও আপনাকে কর্মে পুনর্বহাল করবো। এই যুগান্তকারী লড়াইএর দিনে আসলে ছোট বড় সবাইকে সংহত হয়ে একসাথে সংগ্রাম করতে হয়। তাই আপনিও আজ আমার মত এই যুদ্ধে একজন সৈনিক হলেন। সতীদাহ বিরোধী আইন পাশ হওয়ার পরও এখন দেখছি আরএকটি অন্য লড়াইয়ের সূচনা হয়েছে। তবে আশ্বাস দিলাম যে এই নির্ভীক মানুষটি সেই কঠিনতম দিনেও আপনাদের সবার পাশে আছে ও থাকবেও। বিদায়...শুভমস্তু!.."

কর্মচারীটির বিস্মিত চক্ষুদ্বয় আরও বেশী বিস্ফারিত হতে হতেই রামমোহন নিজের কঠিন থেকে কঠিনতর মুখশ্রীতে মির্জাপুরস্থিত বাসাবাড়ির দিকে ওঁর ফিটনটিকে এবার প্রত্যাবর্তনের জন্য গম্ভীর স্বরে আদেশ দিলেন।

....

মিত্রবর দ্বারকানাথ ইংরেজ কোম্পানীর বড় হোমরাচোমড়া সব কর্তাদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে আজ রাতে বেলগাছিয়ার ভিলায় একটি বর্ণাঢ্য খানাপিনার আয়োজন করে ওঁকেও সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেছে। সেখানে উপস্থিত থেকে এক ফাঁকে এই ভস্মপ্রায় প্রেসটিকে সত্বর কেনার ব্যাপারে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলোচনাটিও ওর সাথে সেরে ফেলতে হবে। এসব বাণিজ্যিক বিষয়ে দ্বারকনাথ বড় চৌখস।

তবে এ নিয়ে আর কোন সন্দেহ নেই যে এবারে তাঁকে আরও সংবেদী হয়ে মস্তিষ্কের লড়াইতে নামতে হবে ও দরকার হলে বিলেতে গিয়েও প্রিভি কাউন্সেলকে আরো কড়া ভাষায় সব উঠে আসা দেশীয় দ্বন্দ্বের সমূহ জবাবটি দিয়ে আসতে হবে।

......

গোলকপতি দেখল ঐ মৃতপ্রায় বৃদ্ধের সাথে আসা লোকজনেরা সব আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। বোঝা যাচ্ছে যে অন্তর্জলির সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা সঙ্গীদের মনে কিছুটা হলেও যেন বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়েছে।

এরমধ্যে মৃতপ্রায় বৃদ্ধটির দু'জন বলশালী পুত্রদের সাথে সম্ভাব্য শবদাহকারী ডোমেদের দুটি দিনের পারিশ্রমিক নিয়ে একপ্রস্থ বাদানুবাদ হয়ে গেল।

গোলকপতি দেখল যে এসবের ফাঁকে প্রস্তাবিত এই সতীদাহের জন্য আনা বধূটিও একবার তার শৌচকার্য্যটি আড়ালে সাড়ার জন্য সামনের ঝোপড়াটির উদ্দেশ্যে অনেকক্ষণ আগে যে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল, এখনও সেই মেয়েটি তার মৃতপ্রায় স্বামীটির শিয়রে ফিরে আসেনি। সেটা কিন্তু তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের কেউ সেইভাবে টেরও পায়নি। অবশ্য এর মধ্যেই কিছু মাতব্বর গোছের সদস্য তাদের দুটি আঙুলের ফাঁকে পোড়ামাটির কল্কে জ্বালিয়ে পরমানন্দে গঞ্জিকা সেবনে উদ্যত হয়েছে।

অবাক লাগে যে এই মৃতপ্রায় বৃদ্ধ মানুষটি সত্যিই মরণোন্মুখ ও অন্তর্জলিতে শেষতম শয়ানে মৃত্যুর প্রহর গুণছে তা যেন সঙ্গী সাথীর দল আজ ভুলতে চেয়ে খানিকক্ষণের জন্য নেশায় মৌজ হতে চাওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করছে।

.....

গোলকপতি যেন এইরকম একটি সুযোগের অপেক্ষাতেই সারাদিন ছিল। সে তার কাঁধের উড়নীটির সাহায্যে নিজের মুখখানিকে ঢেকে আর বাড়তি কথা না বাড়িয়ে নদীটির পূর্বদিকে ওই ঝোপড়াটির দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল।

এখন ওরও যেন মনে হচ্ছে যে নিজের এই অনির্দিষ্ট জীবনপ্রবাহ যেন খুব দ্রুত শেষ হয়ে আসছে এক ক্রমপ্রসন্নতার সমারোহে।
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১০

ছংগামল বিদ্যালয় ইন্টার কলেজ স্থাপিত হয়েছিল যে উদ্দেশ্য নিয়ে তা’হল ‘দেশের নবীন নাগরিকদের মহান আদর্শের পথনির্দেশ এবং উত্তম শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উত্থান’।

আপনি যদি চকচকে কাগজে কমলা রঙে ছাপা কলেজের ‘সংবিধান এবং নিয়মাবলী’ পড়েন তাহলে বাস্তব জগতের মলিনতায় আচ্ছন্ন আপনার মন সত্যি সত্যি নির্মল এবং পবিত্র হয়ে যাবে। অবশ্যি ভারতের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অধ্যায়টুকু পড়লেও আপনার একই অনুভূতি হয়।

যেহেতু এই কলেজ রাষ্ট্রহিতের কথা ভেবে তৈরি হয়েছে তাই এখানে আর কিছু হোক না হোক, দলাদলি খুব আছে। তবে দলাদলির আয়তন ও ওজন দেখলে মনে হবে এমন কিছু নয়, কিন্তু যে অল্প সময়ে এটি কলেবরে বেড়েছে তাতে বলা যায় যে হ্যাঁ, কিছু কাজ তো হয়েছে। দু’তিন বছরেই এটি দলাদলির ব্যাপারে আশেপাশের কলেজগুলোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। আর কোন কোন বিষয়ে তো অখিল ভারতীয় গালাগালিস্তরের কম্পিটিশন করার যোগ্যতা দেখিয়েছে।

ম্যানেজিং কমিটিতে বৈদ্যজীর দাপট, কিন্তু এর মধ্যেই রামাধীন ভীখমখেড়ভীজি তাঁর একটি উপদল বানিয়ে নিয়েছেন। এরজন্যে ওনাকে অনেক তপস্যা করতে হয়েছে। বেশকিছু দিন ওঁর দলে একজনই সদস্য ছিল—ভীখমখেড়ভীজি উনি স্বয়ং। পরে একজন দুজন ওঁর দলে চলে গেল। এরপর কড়া মেহনতের ফলে কলেজের কর্মচারিদের মধ্যেও দু’দল তৈরি করা গেছে বটে, কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি। প্রিন্সিপাল সাহেব বৈদ্যজীর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল, কিন্তু উল্টোদিকে খান্না মাস্টার এখনও রামাধীনের দিকে ততটা হেলে পড়েনি। ছাত্রদের মধ্যেও কোন দলবিশেষের প্রতি নিষ্ঠার ভিত্তিতে স্পষ্ট ভাগাভাগি হয়নি। মাঝেমধ্যে গালাগালি মারপিট হচ্ছে বটে কিন্তু এখনও ওদের ঠিকমত পথ দেখানো যায়নি। এখনও কলেজের কাজকম্ম দলীয় উদ্দেশ্যে নাহয়ে ব্যক্তিগত যোগাযোগে হচ্ছিল, তাই ছেলেপুলের গুন্ডামির শক্তিও রাষ্ট্রের সার্বজনিক হিতের বদলে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছিল। এ’বিষয়েও দলাদলির রাজনীতির অনেক কাজ করার আছে।

এটা সত্যি যে কলেজে বৈদ্যজীকে ছেড়ে আর কারও দলাদলির বিশেষ অভিজ্ঞতা নেই।অন্যেরা কাঁচা খেলুড়ে, কিন্তু প্রতিভায় কম যায় না।বছরে দু’একবার ওদের প্রতিভার ছটা যখন ঝিকিয়ে ওঠে তখন তার যেইতরঙ্গ শহর অব্দি পৌঁছে যায়। এখানে কখনও কখনও এমন সব দাঁও-প্যাঁচ দেখা যায় যে দলাদলির বড় বড় অভিজ্ঞ খেলুড়েও হতভম্ব হয়ে যায়। গত বছর রামাধীন বৈদ্যজীকে এমনই এক প্যাঁচে ফেলেছিলেন। প্যাঁচ ব্যর্থ হল, কিন্তু তার চর্চা দূরে-দূরান্তরে ছড়িয়ে গেল।খবরের কাগজে এ’নিয়ে লেখা হল। তাতে একজন দলবাজির খেলুড়ে এমন অভিভুত হলে যে শহর থেকে দৌড়ে এসে দুটো দলেরই পি্ঠ চাপড়ে দিলেন। উনি ছিলেন একজন সিনিয়র খেলুড়ে, থাকতেন রাজধানীতেই। ওঁর জীবনের বিগত চল্লিশটি বছর উনি চব্বিশ ঘন্টা দলাদলিতেই মজে থাকতেন।উনি অখিল ভারতীয় স্তরের একজন নেতা এবং প্রতিদিন খবরের কাগজে ওঁর কোন না কোন বিষয়ে বিবৃতি বেরোয়। তাতে থাকে দেশপ্রেম এবং দলাদলির অদ্ভুত খিচুড়ি। উনি একবার কলেজে পায়ের ধূলো দিতেই লোকের ভরসা হল যে এখানে কলেজ বন্ধ হয়ে গেলেও দলাদলি বন্ধ হবে না। কথা হচ্ছে -দলাদলি কেন হল?

এই প্রশ্ন করা আর বৃষ্টি কেন হয়, সত্যি কথা কেন বলা উচিত, বস্তু কী অথবা ঈশ্বর কী জানতে চাওয়া- একই ব্যাপার। আসলে এটি একটি সামাজিক, মনোবৈজ্ঞানিক এবং প্রায় দার্শনিক প্রশ্ন। এর উত্তর পেতে গেলে আপনাকে আগে দর্শন বুঝতে হবে এবং দর্শন-শাস্ত্র জানার জন্যে আপনাকে প্রথমে হিন্দী সাহিত্যের কবি বা গদ্যলেখক হতে হবে।

সবাই জানে যে আমাদের কবি এবং গদ্যলেখকেরা আসলে এক একজন দার্শনিক। ওঁরা কবিতা এবং গদ্য লেখেন ফাউ হিসেবে। যেকোন ঘ্যানঘেনে উপন্যাস খুলে পাতা ওল্টালে দেখা যাবে যে নায়ক নায়িকার তপ্ত অধরে অধর রেখে বলছে—না, নিশা না। আমি এটা মানতে পারিনা। এ তোমার একান্ত ব্যক্তিগত সত্য হতে পারে, কিন্তু আমার সত্য নয়’।

ইতিমধ্যে নিশার ব্লাউজ মাটিতে লুটোচ্ছে।ও অস্ফুট স্বরে বলে, ‘কেন নিক্কু, তোমার সত্য আমার সত্যের থেকে আলাদা কেন’?

এটাকেই বলে ‘টাচ্‌’। এভাবেই নিশা ও নিক্কু’র হাজার মিটার দৌড় শুরু হয়। এবার নিশার ব্রা খসে গিয়ে মাটিতে লুটোয় এবং নিক্কু’র টাই ও শার্ট হাওয়ায় উড়ে যায়। এভাবে হোঁচট খেয়ে, একে অন্যের উপর হুমড়ি খেয়ে যখন মাঠের অন্য প্রান্তে টাঙানো ফিতেটাকে অবশেষে ‘সত্য’ ভেবে ছুঁয়ে ফেলে, তখন টের পায়—ওটা ‘সত্য’ নয়। ফের যুক্ত হওয়ার শৃংগার, তপ্ত অধর ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পরে ওরা মাঠ ছাড়িয়ে জঙ্গলে পৌঁছে যায় এবং পাথরে ও কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে নগ্ন শরীরে প্রতিটি ঝোপে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়। এভাবে নগ্নতা, ঘ্যানঘ্যান, চুম্বন, লেকচার ইত্যাদির ভেতরে ওরা খুঁজে বেড়ায় এক খরগোসকে যার নাম ‘সত্য’।

এ’জাতীয় ফিলজফি প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাব্য ও কাহিনীতে রয়েছে। এ জন্যেই উপন্যাসটির পাঠক ফিলজফির ঝটকার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ভাবে—হিন্দিসাহিত্যের লেখকটি এতক্ষণ ধরে দুনিয়াভরের কথা বলে গেলেন কিন্তু ফিলজফি কোথায়? ব্যাপারটা কী? ব্যাটা ফ্রড নয়তো?

এটাও সত্যি যে ‘সত্য’ ‘অস্তিত্ব’ গোছের শব্দ শোনামাত্র আমাদের লেখক চেঁচিয়ে ওঠেন-“ শোন ভাইসকল, এখন গল্পের স্রোতকে এখানে থামিয়ে দিয়ে আমি তোমাদের খানিক ফিলজফি পড়াব, তবে তো বিশ্বাস হবে যে আমি আসলে ফিলজফার, ভাগ্যের ফেরে অল্পবয়েসে কুসঙ্গের প্রভাবে কবিতা লিখতাম।অতএব ভাইয়েরা, এই নাও এক ষোল পাতার ফিলজফির শক্‌।যদি আমার লেখা পড়তে পড়তে তোমাদের ভ্রম হয়ে থাকে যে অন্যদের মত ফিলজফি আমার ধাতে নেই, তাহলে সেটাকে এই নতুন ভ্রম দিয়ে খারিজ কর—‘।



বৈদ্যজী বেদান্ত দর্শনকে প্রায় সময় আয়ুর্বেদের চ্যাপ্টার বানিয়ে ফেলেন। ওঁর ভাষ্য অনুযায়ী দলাদলি হল পরমাত্মানুভুতির চরমদশারই আরেক নাম। তখন প্রত্যেক ‘ত্বম’ ‘অহম’কে, এবং প্রত্যেক ‘অহম’ সমস্ত ‘ত্বম’কে নিজের চেয়ে উচ্চতর আসনে অধিষ্ঠিত দেখে এবং নিজে সেখানে পৌঁছতে চায়। অর্থাৎ সমস্ত ‘ত্বম’ যত ‘অহম’ আছে তাদের নিজের জায়গায় টেনে নামিয়ে নিজেরা সবাই ‘অহম’ হতে চায়।

বেদান্ত হল আমাদের ঐতিহ্য, আর যেহেতু দলাদলির তাৎপর্য্য বেদান্তে খুঁজে পাওয়া যায়, তাই দলাদলিও আমাদের শাশ্বত, এবং এই দুয়ে মি্লেই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। স্বাধীনতার পর আমরা এমন অনেক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য খুঁজে বের করেছি। হাওয়াই জাহাজে চেপে ইউরোপ যাওয়ার সময়েও আমরা যাত্রার প্রোগ্রাম জ্যোতিষীকে দিয়ে বানিয়ে নিই, ফোরেন এক্সচেঞ্জ এবং ইনকাম ট্যাক্সের ঝঞ্ঝাট থেকে বাঁচতে বাবাজীর আশীর্বাদ নিই, স্কচ হুইস্কি খেয়ে ভগন্দর গজিয়ে গেলে চিকিৎসার জন্যে যোগাশ্রমে গিয়ে শ্বাস ফুলিয়ে পেট ভেতরে টেনে আসন করি। এভাবেই বিলিতি শিক্ষার দান গণতন্ত্র আমদানি করি, কিন্তু তার প্রয়োগ করি দিশি ঐতিহ্যের দলাদলি করে। আমাদের ইতিহাসের পাতা উলটে্ দেখুন, যুদ্ধপর্ব হোক কি শান্তিপর্ব, সব অবস্থাতেই দলাদলির ঐতিহ্য জ্বলজ্বল করছে।ইংরেজ রাজত্বের সময় ওদের খেদিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে কিছুদিন ভুলে ছিলাম বটে, স্বাধীন হতেই আরও অনেক ঐতিহ্যের সাথে একেও আমরা মাথায় তুলে নিয়েছি।এখন দলাদলির প্রগতির জন্যে আমরা অনেকগুলো পদ্ধতির সাহায্য নিচ্ছি-- যেমন ‘তুই বেড়াল না মুই বেড়াল’, লাথালাথি, জুতোপেটা, সাহিত্য-শিল্প কোনটাই বাদ পড়েনি। যে দেশ একসময় বেদান্তের জন্ম দিয়েছে আজ তারই এই প্রাপ্তি। সংক্ষেপে এই হল দলাদলির দর্শন, ইতিহাস ও ভূগোল।

ছংগামল কলেজে দলাদলির জন্যে এই সব আদিকারণ ছাড়াও অন্য একটি কারণ দায়ি। এখানকার লোকেদের ভাবনা হল সবসময় কিছু-না-কিছু হওয়া চাই। দেখুন, এখানে সিনেমা নেই, হোটেল নেই, কফি হাউস নেই, মারপিট, চাকুবাজি, পথদুর্ঘটনা, নিত্যি নতুন ফ্যাশনের মেয়েরা, এগজিবিশন, গরম গরম এবং গালাগালি ভরা সার্বজনিক সভাসমিতি—এসব কিস্যু নেই। লোকজন কোথায় যাবে? কী দেখবে? কী শুনবে? তাই কিছু-না-কিছু হওয়া চাই।

দিন চারেক আগে কলেজে একটা প্রেমপত্র পাওয়া গেল। একটি ছেলে লিখেছে কোন মেয়েকে। ছেলেটা চালাকি করে এমন ভাবে লিখেছে যে পড়লে মনে হবে আসলে মেয়েটির চিঠিতে লেখা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। কিন্তু এই চাল কাজে এল না। ছেলেটা বকুনি খেল, মার খেল, কলেজ থেকে বের করে দেয়া হল। তারপর ছেলের বাপ কথা দিল যে ওর ছেলে দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়বে না, এবং আরও কথা দিল যে কলেজের নতুন ব্লক তৈরির জন্যে পঁচিশ হাজার ইঁট দেবে। ব্যস, ছেলেটা ফের ভর্তি হয়ে গেল। যাই ঘটুক, এর প্রভাব কুল্লে চার দিন, তার বেশি নয়। এর আগে একটা ছেলের কাছে দেশি পিস্তল পাওয়া গেছল। তাতে কোন কার্তুজ ছিলনা এবং পিস্তলটা এত ফালতু যে দেশি কামারদের কারিগরি দক্ষতা্র কথা ভেবে চোখে জল এসে যায়। তবু কলেজে পুলিস এল এবং ছেলেটাকে ও ক্লার্ককে ধরে থানায় নিয়ে গেল- যদিও ক্লার্ক হলেন বৈদ্যজীর লোক। লোকজন উত্তেজনায় ছটফট করছিল -কিছু হবে, এবার চার-পাঁচ দিন ধরে কিছু না কিছু ঘটবে।কিন্তু সন্ধ্যে নাগাদ খবর এল যে ওটা পিস্তল না, একটা ছোটমত লোহার টুকরো । আর ক্লার্ককে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়নি, উনি নিজের ইচ্ছেয় বেড়াতে গেছলেন। এবং ছেলেটা গুন্ডামি করছিল না, বরং সুন্দর বাঁশি বাজাচ্ছিল। সন্ধ্যে নাগাদ যেই ছেলেটা বাঁশি বাজাতে বাজাতে এবং ক্লার্ক মশায় বেড়াতে বেড়াতে থানার বাইরে এলেন মানুষজন হতাশ হয়ে ভাবল—তাহলে কিছুই হয়নি। এর পর হাওয়ায় ভেসে এল সেই শাশ্বত প্রশ্ন- এবার কী হবে?

এই পরিবেশে লোকজনের নজর ছিল প্রিন্সিপাল সাহেব আর বৈদ্যজীর উপর। বৈদ্যজী তো মদনমোহন মালবীয় স্টাইলের পাগড়ি চাপিয়ে নিজের গদিতে গ্যাঁট হয়ে বসেছিলেন। কিন্তু প্রিন্সিপালকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন উনি সরসরিয়ে ল্যাম্পপোস্টের মাথায় চড়ে দুর থেকে কাউকে দেখে চেঁচাচ্ছেন- ‘দেখো, দেখো, ব্যাটার মাথায় কোন শয়তানি বুদ্ধি ঘুরছে’! ওঁর দৃষ্টিতে সন্দেহভরা, আসলে নিজের চেয়ার আঁকড়ে থাকা সবার মনেই ভয় যে কেউ না কেউ এসে ওকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে দেবে। লোকেরা এঁর দুর্বল জায়গাটা ধরে ফেলেছে এবং সেখানে খুঁচিয়ে ওনাকে এবং তার সঙ্গে বৈদ্যজীকে প্যাঁচে ফেলার তাল করছে।এদিকে এরাও মার খাবার ভয়ে আগে থেকেই মারার জন্যে মুখিয়ে রয়েছে।

ক’দিন আগে খান্না মাস্টারকে কেউ ফুসমন্তর দিয়েছে যে সব কলেজেই প্রিন্সিপালের সঙ্গে একটা ভাইস প্রিন্সিপালেরও পোস্ট থাকে। খান্না পড়াতেন ইতিহাস এবং সব থেকে সিনিয়র। সেই গুমরে একদিন বৈদ্যজীকে গিয়ে বলে এলেন যে ওনাকে ভাইস প্রিন্সিপাল বানিয়ে দেয়া হোক। বৈদ্যজী মাথা নেড়ে সায় দিলেন। বললেন- এ তো বেশ নতুন কথা। নবযুবকদের সবসময় নতুন নতুন চিন্তা করা উচিৎ। আমি সবরকম নতুন আইডিয়াকে উৎসাহ দিই। তবে এটা তো পরিচালক সমিতির এক্তিয়ারে। ওদের আগামী বৈঠকে এই প্রশ্নটি উঠলে আমি সমুচিত বিচার করব, কথা দিলাম। খান্না মাস্টার ভাবেননি যে পরিচালন সমিতির আগামী বৈঠক কখনও হয় না। উনি বার খেয়ে সাততাড়াতাড়ি ভাইস প্রিন্সিপাল পদে নিযুক্তির আবেদন বাবদ একটি দরখাস্ত মুসাবিদা করে প্রিন্সিপালকে ধরিয়ে দিয়ে অনুরোধ করলেন যেন পরিচালক সমিতির আগামী বৈঠকে এটি পেশ করা হয়।

খান্না মাস্টারের এই কারসাজিতে প্রিন্সিপাল হতভম্ব। বৈদ্যজীকে শুধোলেন- খান্না মাস্টারকে এই দরখাস্তটা লিখতে আপনি পরামর্শ দিয়েছেন?

এর জবাবে বৈদ্যজী তিনটে শব্দ উচ্চারণ করলেন- ওর বয়েসটা কম।

প্রিন্সিপাল ইদানীং শিবপালগঞ্জের রাস্তায় যার সঙ্গে দেখা হয় তাকেই ধরে অ্যান্থ্রোপলজি বোঝাতে থাকেন-‘সত্যি, আজকাল লোকজন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে’। খান্না মাস্টারের কারসাজির কথা বোঝাতে গিয়ে উনি হরদম কিছু প্রবাদবাক্যের ব্যবহার করছিলেন; যেমন ‘মুখে রামনাম, বগলে ছুরি’,’ আমার পোষা বেড়াল, আমাকেই খ্যাঁক খ্যাঁক’(যদিও বেড়াল কদাপি খ্যাঁক খ্যাঁক করে না),’পেছন থেকে ছুরি মারা’,’ব্যাঙের সর্দি’ এইসব। একদিন উনি গাঁয়ের চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে রূপকথা বলার ঢঙে শুরু করলেন- একদিন এক ঘোড়ার খুরে নাল লাগানো হচ্ছিল। তাই দেখে কোলাব্যাঙের শখ হল—আমিই বা বাদ যাই কেন!অনেক কাকুতিমিনতির পর নাল লাগানোর লোকটি ব্যাঙের পায়ে একটা নাল ঠুকে দিল। তো ব্যাঙবাবাজি ওখানেই চিতপটাং ! তাই বলছিলাম, নকল করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

এই পঞ্চতন্ত্র রচনার পেছনেও সেই একই গল্প। আজ ভাইস প্রিন্সিপাল হতে চাইছে, কাল প্রিন্সিপাল হতে আবদার করবে। তার জন্যে পরিচালন সমিতির মেম্বারদের হাত করবে। মাস্টারদের মধ্যে নিজের একটা দল বানাবে। ছাত্রদের মারপিট করতে উসকে দেবে। উপর মহলে নালিশ করবে। ব্যাটা বজ্জাত হাড় বজ্জাত হবে।

বড় বড় কথা ভেতর-ফাঁকা,

শাক দিয়ে মাছ যায় কি ঢাকা!

বৈদ্যজীর কাছে রামাধীন ভীখমখেড়ভীজির চিঠি এসেছে। লেটারহেডের মোনোগ্রামের জায়গায় রয়েছে ওই দ্বিপদীটি। চিঠির সারমর্ম হল- গত তিনবছরে একবারও পরিচালক সমিতির বৈঠক হয়নি, আগামী দশদিনের মধ্যে বৈঠকটি ডাকা হোক। আর কলেজের সাধারণ সমিতির বার্ষিক সভা কলেজ শুরু হওয়ার দিন থেকে একবারও হয়নি। সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যাক। চিঠিতে এজেন্ডা আইটেমের মধ্যে ভাইস প্রিন্সিপাল পদ শুরু করার প্রস্তাবও রয়েছে।

প্রিন্সিপাল সাহেব বৈদ্যজীর ঘর থেকে ফিরে আসার সময় চিঠিটি নিজের পকেটে ঢোকাতেই হঠাৎ বড্ড গরম গরম লাগল।মনে হোল গায়ের জামাটা পুড়ে যাচ্ছে এবং চারপাশ থেকে আগুনের হলকা আসছে। একটা হলকার চোটে কোটটা জ্বলতে শুরু করেছে, আরেকটা হলকা শার্টের ভেতর থেকে নীচের দিকে বইতে বইতে প্যান্টের ভেতরে নামছে। এরকম বোধ হতেই ওঁর চলার বেগ বেড়ে গেল। হলকার তৃতীয় ধারাটি ওঁর চোখ কান নাকে লাল লাল চিহ্ন ছড়িয়ে মাথার খুলির সেই কোটরে ঢুকে গেল যেখানে বুদ্ধিশুদ্ধি থাকে।

কলেজের গেটের কাছে ওঁর রূপ্পন বাবুর সঙ্গে দেখা হল। উনি রূপ্পনের পথ আটকে বোঝাতে শুরু করলেন—’ দেখছ তো? খান্না এবার রামাধীনের খুঁটি ধরেছে। ভাইস প্রিন্সিপালগিরির শখ চড়েছে। শোন, একবার এক কোলাব্যাঙ দেখল কি ঘোড়ার পায়ে নাল লাগানো হচ্ছে, তখন ও ভাবল-’।

কিন্তু রূপ্পনবাবুর একটু তাড়া ছিল। কলেজ পর্ব সেরে অন্য কোোঁথাও যাচ্ছিলেন।বললেন,’ হ্যাঁ, জানি তো।আর ব্যাঙের গল্পটা সবাই জানে। তবে আপনাকে একটা কথা স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দিচ্ছি। খান্নার জন্যে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু মনে হয়, কলেজে একজন ভাইস প্রিন্সিপাল হওয়া জরুরি। আপনি না থাকলে এখানকার মাস্টারগুলো কুকুরবেড়ালের মত খেয়োখেয়ি করতে থাকে। টিচার্স রুমে যা গুন্ডামি হয় তা আর কহতব্য নয়। ওই হ্যা-হ্যা, ঠ্যাঁ-ঠ্যাঁ, ফ্যাঁস-ফ্যাঁস’! এবার রূপ্পন একটু গম্ভীর হয়ে প্রায় আদেশের সুরে বললেন-‘প্রিন্সিপাল সা’ব! আমার মনে হয় আমাদের কলেজে একজন ভাইস প্রিন্সিপাল দরকার। খান্না সবচেয়ে সিনিয়র, ওকেই হ’তে দিন। সেরেফ নাম-কা-ওয়াস্তে, মাইনে তো বাড়বে না’।

প্রিন্সিপাল সাহেবের বুকের ভেতর এত জোরে ধক্‌ করে উঠল যেন লাফিয়ে ফুসফুসে ঢুকে পড়বে। “ভুলেও অমন কথা মুখে এনো না রূপ্পন বাবু! এই খান্না-টান্না বলে বেড়াচ্ছে যে তুমি নাকি ওদের সঙ্গে রয়েছ! এটা শিবপালগঞ্জ; ইয়ার্কি করলেও একটু ভেবেচিন্তে মুখ খুলতে হয়’।

“আমি যেটা উচিৎ সেটাই বলি। যাই হোক, পরে দেখা যাবে’খন”। বলতে বলতে রূপ্পনবাবু এগিয়ে গেলেন।

প্রিন্সিপাল সাহেব হড়বড়িয়ে নিজের কামরার ঢুকলেন। বেশ ঠান্ডা পড়েছে, কিন্তু উনি কোট খুলে ফেললেন। লেখাপড়ার সামগ্রী সাপ্লাইয়ের কোন দোকানের একটা ক্যালেন্ডার ঠিক ওঁর নাক বরাবর সামনের দেয়ালে টাঙানো রয়েছে। তাতে নগ্নবদন স্বচ্ছবসনা এক ফিলিম- অ্যাকট্রেস জনৈক পুরুষকে একটি লাড্ডুমতন কিছু নিবেদন করছে। পুরুষটির লম্বা লম্বা চুল, এক তুলে চোখ ঢাকার ভান করে এমন মুখভঙ্গী করছে যেন ঐ লাড্ডুটি খেলে ওর বদহজম হবে। এরা মেনকা ও বিশ্বামিত্র। খান্নাকে

প্রিন্সিপাল খানিকক্ষণ অপলক এদের দেখতে লাগলেন।হঠাৎ কলিংবেল না বাজিয়ে চেঁচিয়ে চাপরাশিকে ডাকলেন। ও এলে পরে বললেন-যাও, খান্নাকে ডেকে আন।

চাপরাশি রহস্যময় ঢঙে বলল, ‘ফিল্ডের দিকে গেছে। সঙ্গে মালবীয়জি’।

প্রিন্সিপাল চিড়বিড়িয়ে টেবিলের উপর রাখা কলমদানটাকে এক ধাক্কা মেরে আরেক মাথায় পাঠালেন। এই কলমদানটা কোন এডুকেশনাল এম্পোরিয়াম থেকে স্যাম্পল দিয়ে গেছল।কিন্তু প্রিন্সিপাল ওটাকে যেভাবে দুর দুর করলেন তাতে মনে হতে পারে এ’বছর এম্পোরিয়ামটা থেকে কলেজ কোন জিনিসপত্র কিনবে না।কিন্তু সেটা প্রিন্সিপালের উদ্দেশ্য ছিল না। উনি শুধু চাপরাশিকে এই মেসেজ দিতে চাইছিলেন যে এখন উনি চাপরাশির গুপ্তচরগিরির গোপন রিপোর্ট শুনতে উৎসুক নন। তাই উনি কড়া করে বললেন-আমি বলছি, খান্নাকে এক্ষুণি ডেকে আন।

চাপরাশির পরনে ধবধবে পাঞ্জাবি ও সাফসুতরো ধুতি, পায়ে খড়ম এবং কপালে তিলক। ও শান্তভাবে বলল,’ যাচ্ছি; ডেকে আনছি খান্নাকে। এত রেগে যাও কেন’?

প্রিন্সিপাল দাঁত কিটকিটিয়ে টেবিলের উপর রাখা একটি টিনের টুকরোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। টুকরোটাকে পালিশ করে একটা লালরঙা গোলাপ বানিয়ে দেয়া হয়েছে।পন্ডিত নেহেরুর পছন্দের গোলাপ, নীচে জুড়ে দেয়া হয়েছে দিন-তারিখ-মাস দেখার ক্যালেন্ডার। এটা বানিয়েছে একটি বিখ্যাত মদের কোম্পানি। এই ক্যালেন্ডারটি চারদিকে বিনে পয়সায় উপহার দেয়া হচ্ছে এই ভরসায় যে লোকে পন্ডিত নেহেরুর আদর্শের সঙ্গে এই শরাব কোম্পানিকেও মনে রাখবে। কিন্তু এখন এই ক্যালেন্ডারটি দেখে প্রিন্সিপাল সাহেবের মনে কোন প্রতিক্রিয়া হল না।পন্ডিত নেহেরুর গোলাপ ওঁর মনের ভার কমাতে পারেনি, আর ফেনিল বীয়রের গ্লাস কল্পনা করেও কোন উৎসাহ কোন উদ্দীপনা এলনা। উনি দাঁত পিসতে লাগলেন, পিসেই চললেন। হঠাৎ, চাপরাশির খড়মের আওয়াজ খালি চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে গেছে কি উনি হিসহিসিয়ে উঠলেন,’রামাধীন ওকে ভাইস প্রিন্সিপাল করে দেবে?ছ্যাঁচড় কোথাকার’! চাপরাশি ঘুরে দাঁড়াল। দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া আওয়াজে বলল,‘গালি দিচ্ছেন প্রিন্সিপাল সাহেব’’'?

--‘ঠিক আছে, ঠিক আছে; যাও, নিজের কাজে যাও’।

-- নিজের কাজই তো করছিলাম। আপনি বারণ করলে আর করছি না’।

প্রিন্সিপালের কপালে ভাঁজ পড়ল। উনি উলটো দেয়ালে আরেকটা ক্যালেন্ডারের দিকে মন দিলেন।চাপরাশি একইভাবে বলে চলল, ‘বলেন তোঁ খান্নাকে চোখে চোখে রাখা বন্ধ করে দিই’?

প্রিন্সিপালের মেজাজ চড়ে গেল, ‘চুলোয় যাও’!

চাপরাশি তেমনই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে।ডাঁটের মাথায় বলল,’ আমাকে খান্না-টান্না ভাববেন না যেন!চব্বিশ ঘন্টা খাটিয়ে নিন, পুষিয়ে যাবে। কিন্তু এই আবে-তাবে, তুইতোকারি একদম বরদাস্ত হয় না’।

প্রিন্সিপাল অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। চাপরাশি ফের বলল,’ শুনুন,আপনি বামুন তোঁ আমিও বামুন।নুন দিয়ে নুন কাটা যায় না, বলে দিলাম’।

প্রিন্সিপাল নরম পড়ে গেলেন।‘তোমার ভুল হয়েছে। তোমাকে না, খান্নাকে ছ্যাঁচড় বলেছি, মহা ছ্যাঁচড়! রামাধীনের সঙ্গে মিলে মিটিং ডাকার নোটিশ পাঠায়’? গালিটা যে খান্নাকে দেয়া সেটা বিশ্বাস করানোর উদ্দেশ ফের বললেন,’ছ্যাঁচড় কোথাকার’!

‘এখখুনি ডেকে আনছি’, চাপরাশিও নরম হল। খড়মের খট খট আওয়াজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। প্রিন্সিপালের চোখ এবার তৃতীয় এক ক্যালেন্ডারে আটকে গেছে। ওতে পাঁচ বছুরে দুটো বাচ্চা ইয়াবড় সব রাইফেল নিয়ে বরফের ওপর শুয়ে আছে। বোধহয় চীনে সৈন্যের অপেক্ষায়। এভাবে বড় শিল্পসম্মত ভাবে বিজ্ঞাপন করা হচ্ছে যে ওই কোম্পানিটির চটের ব্যাগ সবচেয়ে ভাল।

প্রিন্সিপাল ওই ক্যালেন্ডারটা দেখতে দেখতে ভাবছিলেন যে খান্নার ভাইস প্রিন্সিপালগিরির শখ না চাগিয়ে উঠলে জীবন কত সুন্দর হত।উনি ভুলে গেলেন যে সবারই কিছু-না-কিছু শখ থাকে। রামাধীন ভীখমখেড়ভীর শখ চিঠির গোড়ায় দু’লাইন উর্দু কবিতা লেখা। প্রিন্সিপালের নিজের শখ হোল অফিসের দেয়ালে নিত্যনতুন রঙীন ক্যলেন্ডার টাঙিয়ে রাখা। তেমনই চাপরাশির শখ হোল বুক চিতিয়ে বড় বড় কথা বলার। ক্লার্কের মতই ও বৈদ্যজীর দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয় যে!

প্রিন্সিপাল খান্না মাস্টারের আশার প্রতীক্ষায়। এরপর যা হবে তাকে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই দেবার প্রচেষ্টায় বারান্দায় ক্লার্ক সাহেব আড়ি পেতেছেন।দেয়ালের পেছনে জানলার ঠিক নীচে ড্রিল মাস্টার মৌজুদ। উনি পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করার বদলে বিড়ি ধরাতে ব্যস্ত। না, এরপর আর খান্না-প্রিন্সিপাল সংবাদের জনতার দরবারে পৌঁছনর আগে উপে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা রইলনা।

রাত্তিরে রঙ্গনাথ আর বদ্রী ছাতের কামরায় খাটিয়ায় গড়াতে গড়াতে এতোল বেতোল কথা শুরু করেছে। রঙ্গনাথ কথা শেষ করতে করতে বলল,’ খান্না আর প্রিন্সিপালের মধ্যে কী কথা হয়েছিল সেটা জানা যায়নি। ড্রিল মাস্টার জানলার নীচেই ছিল। খান্না চেঁচাচ্ছিল,”এই আপনার মনুষ্যত্ব”? ব্যস, ওইটুকুই শুনতে পেয়েছে’।

বদ্রীর হাঁই উঠছিল। বলল,’ প্রিন্সিপাল গালি দিয়ে থাকবে। জবাবে খান্না মনুষ্যত্ব -টত্ব বলে থাকবে। ও এভাবেই কথা বলে। শালা একনম্বরের বাঙরু’!

রঙ্গনাথ বলল।‘গালির জবাব তো জুতা’।

বদ্রী এর কোন উত্তর না দেওয়ায় ও ফের বলল,’ দেখছি- এখানে মনুষ্যত্বের কথা বলাই বেকার’।

বদ্রী ঘুমুবে বলে পাশ ফিরলো। তারপর গুড নাইট বলার স্টাইলে বলল,’ সে তো বুঝলাম। এখানে যে দুটো ক-খ-গ-ঘ পড়ে ফেলে সেই উর্দূ ঝাড়তে শুরু করে।কথায় কথায় খালি মনুষ্যত্ব-মনুষ্যত্ব!গলায় জোর না থাকলে সবাই মনুষ্যত্বের দোহাই দেয়’।

কথাটা ঠিক। শিবপালগঞ্জে আজকাল ‘মনুষ্যত্ব’এরই বাজার। দুকুরবেলা আমবনের ছায়ায় ছোঁড়াগুলো জুয়ো খেলে। যার জেতার সে জেতে, যে হারে সে চেঁচায়-এই বুঝি তোর মনুষ্যত্ব! জিততেই পেচ্ছাব চাগিয়ে উঠেছে? খালি ফোঁটা ফোঁটা টপকানোর অজুহাত খুঁজছিস?

আবার জেতাপার্টিও কখনও কখনও ‘মনুষ্যত্ব’ নিয়ে হামলে পড়ে। ‘একেই বলে মনুষ্যত্ব? এক বাজি হারতেই পিলপিলিয়ে গেলি? চারদিন ধরে খেলছি, আজ প্রথমবার দাঁও লাগল তো আমার পেশাব বন্ধ করিয়ে দিবি”?

তাড়ির দোকানে মজদুরের দল ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় দোলাতে থাকে। ১৯৬২তে চীনের অপ্রত্যাশিত বিশ্বাসঘাতকতায় যেমন ঝটকা লেগেছিল, প্রায় তেমনি হাবভাব করে বলতে থাকে,’বুধুয়া পাকা মকান বানিয়েছে রে! আজকাল কারখানাওলাদের দিন। বললাম, বাড়িতে অতিথি এসেছে, তাড়ি কেনার জন্যে দুটো টাকা দে। ব্যাটা সোজাসুজি হ্যাঁ-না করে পেছন ফিরে পাছা দেখিয়ে চলে গেল। এই কি মনুষ্যত্ব? নাগেশ্বর, তুমিই বল’।

অর্থাৎ রাজনীতিতে যেমন ‘নীতিবোধ’কে ধরা হয় তেমনই, ‘মনুষ্যত্ব’ শব্দটা শিবপালগঞ্জে চৌকস ও চালাক লোকদের লক্ষণ। তবে বদ্রী পালোয়ানের চোখে এটা গলার জোরের অভাব ছাড়া কিছু নয়। এইসব বকবক করতে করতে নৈতিকতা ব্যাপারটা রঙ্গনাথের ঘাড়ে চাপিয়ে বদ্রী ঘুমিয়ে পড়ল।

রঙ্গনাথ কম্বল জড়িয়ে শুয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আকাশপাতাল ভাবছিল।ছাদের দরজাটা খোলা, বাইরে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। খানিকক্ষণ ও সোফিয়া লোরেন এবং এলিজাবেথ টেলরের ধ্যান করল। তারপর মনে হোল এসব ক্যারেক্টার খারাপ হওয়ার লক্ষণ।তাই ও পাড়ার ধোপার মেয়ের ধ্যান শুরু করল। সেদিন ধোয়া কাপড়ের গাঁঠরি থেকে ওর কাপড় খোঁজার সময় ওর চোখ মেয়েটির হাতকাটা ব্লাউজে আটকে গেছল। খানিক পরে মনে হোল এটা আরও নোংরা, ফিরে এল ফিল্মের দুনিয়ায়। কিন্তু এবার জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম জেগে ওঠায় ও লিজ টেলরদের চিন্তা ছেড়ে ওয়াহিদা রেহমান ও সায়রা বানুর চিন্তায় ডুবে গেল। দু’চার মিনিট পর বুঝতে পারল যে সব ব্যাপারে বিদেশ থেকে প্রেরণা নেওয়া ঠিক নয়। আর ঠিকমত ধ্যান করলে দেশপ্রেমেও বড় মজা। হঠাৎ ওর ঘুম এসে গেল এবং অনেক চেষ্টার পরও সায়রা বানুর সমস্ত শরীরের চেয়ে ওর ধ্যানবিন্দু ক্রমশঃ ছোট আরও ছোট হয়ে গেল। কোত্থেকে এসে গেল কিছু বাঘ ও ভাল্লুক। ও একবার চেষ্টা করল কি সায়রা বানুর পুরো শরীর চেপে ধরে হিঁচড়ে নিয়ে আনবে, কিন্তু সায়রা বানু ওর হাত থেকে বার বার পিছলে গেল। এর মধ্যে বাঘ-ভালুকও কোথায় চলে গেল। তখন ওর মাথায় খান্না মাস্টারের চেহারাটা ভেসে উঠে ভেঙেচুরে গেল। খালি কানের মধ্যে একটা শব্দ টিপ টিপ করতে লাগল – মনুষ্যত্ব! মনুষ্যত্ব!

একবার মনে হোল— কেউ ফিসফিস করছে। তারপর মনে হোল এটা কেউ কোন মঞ্চের উপর থেকে গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করছে। এবার মনে হোল না, কোথাও দাঙ্গা লেগেছে, লোকজন ছোটাছুটি করছে আর বলছে- মনুষ্যত্ব! মনুষ্যত্ব!

ঘুমটা ভেঙে গেল। জেগে উঠতেই শুনতে পেল বাইরে খুব চেঁচামেচি হচ্ছে- চোর! চোর! চোর! পালিয়ে না যায়! পাকড়ো! পাকড়ো! চোর! চোর!

একটু পরে পরে আওয়াজ ফিরে ফিরে গানের ধুয়ো ধরছিল-চোর! চোর!

যেন গ্রামোফোনের পিন মুখড়ায় আটকে গেছে। ও দেখল, আওয়াজটা আসছে গাঁয়ের আরেক প্রান্ত থেকে।বদ্রী পালোয়ান খাটিয়া থেকে লাফিয়ে নেমেছে। ‘ছোটে বলছিল বটে, আজকাল একটা চোরের দল এ তল্লাটে ঘোরাফেরা করছে। মনে হচ্ছে আজ আমাদের গাঁয়ে ঢুকেছে’।

দুজনে তাড়াতাড়ি কাপড় পরে বাইরে বেরোল। কাপড় পরার মানে এ নয় যে বদ্রী চুড়িদার পাজামা ও শেরওয়ানি পরেছে। ঢিলে লুঙিটা কষে বেঁধে খালি গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিয়েছে, ব্যস্‌।রঙ্গনাথের এখনও ওর মত পরমহংস অবস্থা প্রাপ্ত হয়নি, তাই গায়ে একটা পাঞ্জাবি চড়িয়ে নিল।দরজা অব্দি যেতে যেতে ওদের চাল এবং হৃৎস্পন্দন দুইই বেড়ে গেল। এতক্ষণে চারদিকে শোনা যাচ্ছে -চোর! চোর! চোর!

হল্লাগুল্লা চীৎকার এমন পর্যায়ে উঠলো যে এটা ১৯২১ সালে ইংরেজ শুনলে নির্ঘাৎ ভারতে ছেড়ে পালিয়ে যেত।

দুজনে সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে এলো।বৈঠকখানা পার হয়ে বাইরে বেরোনোর সময় বদ্রী পালোয়ান রঙ্গনাথকে বলল, ‘তুমি ভেতর থেকে দোর বন্ধ করে ঘরেই থাক, আমি বাইরেটা দেখে আসি গে’। এরমধ্যে রূপ্পনবাবু কাঁধে ধুতির কোঁচা জড়িয়ে হড়বড়িয়ে ঘর থেকে এসে বললেন, “আপনারা ঘরে থাকুন, আমি বাইরে দেখতে যাচ্ছি”।

ভাবটা যেন চক্রব্যুহ ভেদ করতে যাচ্ছে। রঙ্গনাথ শহীদ হওয়ার ভান করে বলল, ‘ঠিক আছে, আপনারা যান, আমিই নাহয় ঘরে থাকবো’।

বাইরে ফুটফূটে জ্যোৎস্না, তিনটে লোক চোর! চোর! বলে ছুটতে ছুটতে গেল। ওদের পেছনে আরও দুটো ঠিক ওদের মত চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে গেল। তার পেছনে আরও একজন, সেই চিৎকার। এবার তিনজন, এদের সবার হাতে লাঠি। সবাই চিৎকার করছে, সবাই চোরকে তাড়া করছে। মিছিলের শেষভাগের একজনকে বদ্রী চিনতে পেরে দৌড়ে ওদের ধরে ফেলল।হেঁকে বলল,’ ক্যা রে? ছোটে? চোর কোথায়’? ছোটে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,’ আগে! আগে আগে পালাচ্ছে’! এরপর খানিকক্ষণ এখানে শান্তি। রূপ্পনবাবু ও রঙ্গনাথ বাইরের ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে ছাদে উঠে গেল। ইতিমধ্যে নীচের ঘরে বৈদ্যজীর ঘুম ভেঙেছে। গলা খাঁকরিয়ে আওয়াজ লাগালেন, ‘কে বটে’?

রূপ্পন জবাব দিল,’চোর, পিতাজী’।

বৈদ্যজী ঘাবড়ে গিয়ে হুঙ্কার দিলেন, ‘কে রুপ্পন? ছাদে গেছ নাকি’?

রূপ্পন বাইরের শোরগোলের সঙ্গে সমানতালে চেঁচিয়ে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আমিই। জেনেশুনে জিজ্ঞেস কর কেন? যাও, শান্তিতে ঘুমোও গে’।

বৈদ্যজী নিজের ছোটছেলের এমন মধুমাখা সম্ভাষণ শুনে চুপ মেরে গেলেন। রূপ্পন ও রঙ্গনাথ কান লাগিয়ে গাঁয়ের নানাদিক থেকে ভেসে আসা কোলাহল মন দিয়ে শুনতে লাগল।

এমন সময় ঘরের পেছন থেকে কারও আর্তনাদ ভেসে এল, ‘মেরে ফেলল রে’!

আবার চেঁচামেচি! কারও গলা শোনা গেল, ‘আরে ছেড়ে দে ছোটে, এ তো আমাদের ভগৌতি’!

‘ছাড়, এটাকে ছাড় বলছি! ওদিকে ! ওদিকে! চোর ওদিকে পালিয়েছে’।

কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অন্য কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে।“আরে কেন রাঁড়ির মত কেঁদে ভাসাচ্ছিস? এক ঘা লাঠিই তো!এতে এত ফোঁৎ ফোঁৎ করার কি হোল’?

কাঁদতে কাঁদতে অন্যজনের উত্তর,‘আমিও ছাড়ব না; দেখে নেব’।

আবার খুব চেঁচামেচি, হল্লাগোল্লা; ‘ওদিকে! ওদিকে! পালাতে দিস নে’। ডাইনে থেকে দে এক ঘা লাঠি! আরে লাফিয়ে উঠে মার! চোর শালা কি তোর বাপ লাগে’?

রঙ্গনাথের উত্তেজনার মাঝখানে হাসিও পাচ্ছিল। এ আবার কি নিয়ম! লাঠি মারার সময় বাপকে রেয়াত করতে হবে? ধন্য আমার ভারত, ধন্য রে তোর পিতৃভক্তি!

রূপ্পনবাবু বলল, ভগৌতি আর ছোটের মধ্যে কিছু একটা ক’দিন ধরে চলছিল। মনে হচ্ছে এই হট্টগোলের মাঝখানে ছোটে কিছু একটা করেছে’।

রঙ্গনাথ,’এ তো ভারি অন্যায়’।

রূপ্পন,’এর মধ্যে ন্যায় অন্যায়ের কি আছে? দাঁও লাগা নিয়ে কথা। ছোটে ব্যাটা দেখতে একদম ভোঁদু, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মহা ঘাগ’। দুজনে আবার চারদিকে নজর করে দেখে কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করল। রঙ্গনাথ বলল,’মনে হচ্ছে চোর পালিয়ে গেছে’।

‘প্রত্যেকবার এই তো হয়’।

রঙ্গনাথ ভাবল রূপ্পনের গ্রাম-প্রেম নিয়ে একটু আমড়াগাছি করা যাক।

‘শিবপালগঞ্জে চোর এসে কেটে পড়বে এ তো অসম্ভব। বদ্রীদাদা যখন গেছেন একটা-দুটো ধরেই ফিরবেন’।

রূপ্পন পুরনো দিনের কোন প্রবীণ নেতার মত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,’না গো রঙ্গনাথ দাদা। এখন ওই পালোয়ানির দিন গেছে। সে ছিল ঠাকুর দূরবীন সিংয়ের দিন। বড় বড় চোর শিবপালগঞ্জের নাম শুনতেই থরথরিয়ে কেঁপে উঠত’।

রূপ্পনবাবুর চোখ বীরপূজার আবেগে জ্বলে উঠল।কিন্তু কথাটা আর এগোল না। হৈ-হট্টগোল মিলিয়ে গিয়ে এখন আকাশ কাঁপিয়ে শোনা যাচ্ছে-জয়, বজরঙবলী কী জয়!

রঙ্গনাথ উৎসুক, ‘মনে হচ্ছে কোন চোর-টোর ধরা পড়েছে’।

রূপ্পনবাবুর ঠান্ডা জবাব,’ ধ্যাৎ, আমি গঞ্জহাদের খুব চিনি। ওরা চোরদের গাঁয়ের সীমানার বাইরে ভাগিয়ে দিয়েছে, ব্যস্‌। আরে চোরের দল যে এদের গাঁয়ের বাইরে তাড়িয়ে নিয়ে যায়নি সেটাই কি কম! সেই আনন্দে এরা জয়-জয়কার করছে’।

চাঁদনি রাত, রাস্তায় মানুষজন দু’এক জনের ছোট ছোট দলে গুজুর গুজুর করতে করতে আসছে যাচ্ছে। রূপ্পনবাবু ছাদের পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে দেখছিলেন। একটা দল নীচের থেকে আওয়াজ দিল, ‘জেগে থাকুন রূপ্পনবাবু! রাতভোর সাবধান থাকবেন’। রূপ্পন ওদের দিকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে বলল,’ যাও যাও, বেশি নকশাবাজি করতে হবেনা’।

এটা তো ভাল কথা, সুপরামর্শ। তবু রূপ্পন কেন খিঁচিয়ে উঠল? রঙ্গনাথ এর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি। একটু পরে ওই সুপরামর্শ গাঁয়ের এমাথা ওমাথা থেকে গুঞ্জরিত হল—জাগতে রহো! জাগতে রহো!

থেকে থেকে ওই ধ্বনি আর তার গুঞ্জন। এবার ওর সঙ্গে যুক্ত হোল হুইসিলের শব্দ। “ এই সীটি বাজছে কেন’?

রূপ্পনবাবু,’ কেন, পুলিশ আপনাদের শহরে সীটি বাজিয়ে টহলদারি করে না’?

‘আচ্ছা, পুলিশও এসে গেছে’?

“ আজ্ঞে; পুলিশই তো গ্রামবাসীদের সহযোগে ডাকাতদলের হামলার মোকাবিলা করল’।

রঙ্গনাথ হতভম্ব। “ডাকু’?

‘হ্যাঁ হ্যাঁ; ডাকু। এই চাঁদনি রাতে কি চোর আসে কখনও? এরা সব ডাকাত’। এবার রূপ্পনবাবু ঠা-ঠা করে হেসে বলল,’দাদা, এসব হোল গঞ্জহাদের চক্কর, বুঝতে সময় লাগে। আমি শুধু কাল সকালে খবরের কাগজে যা বেরোবে সেটা জানিয়ে দিলাম’।

একটা সীটি ঠিক ঘরের পাশের রাস্তায় শোনা গেল। রূপ্পন বলল, ‘মাস্টার মোতিরামের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে? পুরনো লোক। দারোগাজী ওঁকে খুব শ্রদ্ধা করেন। উনি দারোগাজিকে শ্রদ্ধা করেন। প্রিন্সিপাল ওই দুজনকেই শ্রদ্ধা করেন। কোন শালা এক পয়সার কাজ করে না, খালি একজন আরেকজনের শ্রদ্ধা করে সময় কাটায়।

‘ওই মাস্টার মোতিরাম হলেন শহরের কাগজটির বিশেষ প্রতিনিধি।যদি চোরকে ডাকু নাই বানালেন তো মাস্টার মোতিরাম হয়ে কী লাভ’?

রঙ্গনাথ হাসতে লাগল। হুইসিল ও ‘জাগতে রহো’ ক্রমশঃ দূরে মিলিয়ে গেল। এঘর ওঘর দরজা খোলার জন্যে লোকজনের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। ‘দরজাটা খুলে দে মুন্না’ থেকে ‘ শ্বশুর ব্যাটা মরে গেল নাকি’ এবং ‘আরে তোর বাপ বলছি, তখন থেকে চেঁচিয়ে মরছি’ গোছের সব শুরু হয়েছে। বৈদ্যজীর বাড়িতেও কেউ সদর দরজার শেকল ঝনঝনাচ্ছে। বাইরে বারান্দায় শোয়া একজন মুনিষ জোরে কেশে উঠল। রঙ্গনাথ বলল, ‘ বোধহয় বদ্রীদাদা, চলো তালা খুলে দিই’।

ওরা নীচে নেমে এল। তালা খুলতে খুলতে রূপ্পন বলল, ‘কে বটে’?

বদ্রীর হুংকার শোনা গেল, ‘খুলবি কিনা? কি কে-কে শুরু করেছিস’?

রূপ্পন তালা খুলতে খুলতে থেমে গেল। বলল,’ নাম বল’।

ওদিক থেকে বাজের আওয়াজ, ‘রূপ্পন, চুপচাপ ভালোয় ভালোয় খুলে দে বলছি’।

“ কে, বদ্রীদাদা’?

“ হ্যাঁ, হ্যাঁ, বদ্রী দাদা। খোল শিগগির”।

রূপ্পন হালকা হাতে তালা খুলতে খুলতে বলল,’ বদ্রীদাদা, বাপের নামটাও বলে ফেল’।

বদ্রীদাদা গালি দিতে দিতে বৈদ্যজীর নামটা বলল। রূপ্পন ফের বলল,’এবার নিজের ঠাকুর্দার নামটাও বলে দাও’।

বদ্রী ফের গালির সঙ্গে ঠাকুর্দার নাম বলল। আবার প্রশ্ন হল, ’বেশ, প্রপিতামহের নাম’?

বদ্রী দরজায় এক ঘুঁসি মেরে বলল, ‘তোকে আর খুলতে হবে না। আমি চললাম’।

-‘দাদা, দিনকাল খারাপ। বাইরে চোরবাটপাড় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাই জিগ্যেস করছি। সাবধানের মার নেই। ঠিক আছে, প্রপিতামহের নাম ভুলে গেছ তো বোল না। কিন্তু রেগে যাবার কী হোল? বেশি রাগলে লোকসান’।

এইভাবে রূপ্পনবাবু বদ্রীদাদার পরীক্ষে নিয়ে এবং ক্রোধে পাপ, ক্রোধে তাপ গোছের লেকচার দিয়ে তবে দরজাটা খুললেন। বদ্রী পালোয়ান বিছে বা চ্যালার মত হিলহিলিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। রূপ্পন ভালোমানুষের মত জানতে চাইল- কী হোল দাদা? সব ব্যাটা চোর পালিয়ে গেল?

বদ্রী কোন জবাব না দিয়ে দপদপিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের ঘরে চলে গেল।রূপ্পনবাবু নীচের ঘরে। রঙ্গনাথ আর বদ্রী খাটিয়ায় শুয়ে খালি দু’চোখের পাতা এক করেছে কি নীচে থেকে কেউ ডাকল -ওস্তাদ, নীচে নেমে এস; মামলা বড্ড গিচপিচ হয়ে গেছে।

বদ্রী উপরের দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়ল,- হোল কী ছোটে?ঘুমুতে দিবি নাকি সারারাত এখানেই হাল জুততে থাকবি?

ছোটে তেমনই চেঁচাল- ওস্তাদ, ঘুম-টুম গোলি মারো। এখন রিপোর্ট লেখানোর হাল হয়েছে। এদিকে সব শালা গলি গলিতে চোর-চোর চেঁচিয়ে বেরিয়েছে, ওদিকে এই সুযোগে কেউ হাত সাফ করেছে। গয়াদীনের ঘরে চুরি হয়ে গেছে। নীচে নেমে এস।