Next
Previous
Showing posts with label ধারাবাহিক. Show all posts
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in










হৃদিবরেষু সুস্মি,

গত পরশু এসেছি কিন্তু পাহাড় থেকে ফিরতে মন চায় না, ব্যস্ততম শহরের ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে আসে আর তখন বারবার মনে পড়ে মেঘ-পাহাড়ের মিতালি। পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঝরনা। পাহাড়গুলো যেন এক জায়গায় এসে হেলে পড়েছে আকাশে। চারদিকে শুধু সবুজ। সকালে ঘুম ভাঙলেই পাখির ডাক। পাহাড়ের গায়ে কান পাতলে শোনা যায় চার্চের ঘণ্টার ধ্বনি। পাইন ও কফি গাছের সমারোহে আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে নদী ও জলপ্রপাতে।

কেমন হয় একজন পুরুষের নারীবিহীন জীবন? অনেকেই তো ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলেন। তারপর চাইলেই কি তাকে ভুলে থাকা সম্ভব হয়?একজন একাকী ছেলে, নিজের জীবন নিয়ে ডুবে থাকে, সে কি পারে না প্রেমে পড়তে? অথবা নারীদের আজীবন ঘৃণা করে চলা পুরুষটি যদি হুট করে কোনো নারীর প্রেমে পড়ে যায়? আমাদের গেছে যে দিন সেগুলো নিয়ে ভাবতে বসলে জামাল উদ্দিন রুমির কথা খুব মনে পড়ে- যা কিছু হারিয়েছো তার জন্য দুঃখ করো না। তুমি তা আবার ফিরে পাবে, আরেকভাবে, আরেক রূপে। এইবার পাহাড়ে গিয়ে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে পরিচয় হলো, এক সন্ধ্যায় বন্ধন, মায়া নিয়ে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, অতীতকে প্রাধান্য দিও না, ভবিষ্যত নিয়ে দিবাস্বপ্নও দেখবে না। তার চেয়ে বরং বর্তমান মুহূর্ত নিয়ে ভাবো। আমি জানতাম না গৌতম বুদ্ধ এই কথাটি বলেছিলেন তাই আমি যখন তার ভাবনা জগৎ নিয়ে প্রশংসা করছিলাম আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি জানান এই বানী বুদ্ধদেবের। পরক্ষণেই তিনি জানতে চাইলেন আমি হারুকি মুরাকামির লেখা পড়েছি কিনা? একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর মুখে ধর্মকথা বাদ দিয়ে সাহিত্যের কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম তাই হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বললাম না। কিন্তু আমি জানি হারুকি মুরাকামি এই শতকের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। যদিও জাপানি এই লেখকের বিরুদ্ধে খোদ জাপানে একটি অভিযোগ বারবার উঠে এসেছে যে, তিনি জাপানি ভাষায় মার্কিনি উপন্যাস লেখেন। যেখানে জাপানি সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে ভিনদেশি পাঠকের মানসিক ও সামাজিক অবস্থার বয়ান বেশি থাকে। আধুনিক জাপান যে ধরনের সংযত, পরিশ্রমী, সুশৃংখল, কর্মনিষ্ঠ জীবনধারার জন্য বিখ্যাত মুরাকামির গল্প-উপন্যাসে তাদের খুব একটা দেখা মেলে না। তবে মুরাকামির কাহিনিতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পণ্য নির্ভর অতি আধুনিক সমাজের দেখা মেলে। অথচ এই আধুনিক, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও হাতের নাগালে স্বাচ্ছন্দ্যের সব রকম উপকরণ থাকা মানুষগুলো কোথায় এসে যেন থমকে যায়। এক আশ্চর্য একাকীত্ব, কখনো একঘেয়েমি বা তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে গ্রাস করে প্রতিনিয়ত। তাদের হাতের নাগালে সুখে থাকার সব উপকরণ থাকলেও কোথাও না কোথাও জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলে তারা। বিষন্নতা, নিঃসঙ্গতা, অপূর্ণতা বিরাজ করে তাদের মানস জগতে।

বৌদ্ধ ভিক্ষু আমার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে কি বুঝলেন জানিনা তবে তার ঠোঁটের কোণে যে হাসি ফুটে উঠেছিল তা দেখে আমার মনে হলো সে হাসিতে আমার জন্য বিদ্রুপ আঁকা কিংবা তিনি মনে মনে আমাকে সস্তার পাঠক ভেবে হাসিতে বলতে চাইছিলেন তোমার পাঠের পরিধি বড় কম! কিছু কিছু সময় মানুষ বোধ করি হেরেও জিতে যায়। যেমন ঠিক সেই সময়টায় আমি! তিনি চোখ বন্ধ রেখে বৌদ্ধকে স্মরণ করলেন হয়ত বা আমাকে কী কী বলবেন সেটা মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে চোখ খুলে বলতে শুরু করলেন সত্যি বলতে হারুকি মুরাকামির লেখাকে এর আগে আমি কখনো এইভাবে বৌদ্ধ দর্শনের নিরিখে পড়িনি। সত্যি বলতে বৌদ্ধ ভিক্ষুর কথা শোনার পরে নিজেকে বড় নির্বোধ মনে হচ্ছিল কিন্তু আমার চোখ খুলে দেবার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুল করিনি।

ছোটগল্প নাকি আজকের দিনে এক ‘মৃতপ্রায় শিল্প’ বা ‘ডায়িং আর্ট’, কারণ পরিসংখ্যান প্রমাণ দিচ্ছে যে আধুনিককালের বিশিষ্ট সাহিত্যিকেরা আর ছোটগল্প লিখছেন না। গত কুড়ি বছরে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক লাভক্ষতির হিসেবেই জাপানের হারুকি মুরাকামি’র ছোটগল্প বিশিষ্ট আসন লাভ করেছে। জাপানি-ভাষায় রচিত লক্ষাধিক কপি বিক্রি হওয়া তাঁর উপন্যাসগুলো ইংরেজিসহ বিভিন্ন ইয়োরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে আজ বেস্টসেলার। সেরকমই মুরাকামি’র ছোটগল্পের অনুবাদও তাঁর উপন্যাসের মতো একইরকম আদরণীয়। মুরাকামি’র ছোটগল্প-সংকলনগুলোর অধিকাংশই আগের শতকের শেষবেলায় প্রকাশিত, কিন্তু ইংরেজি-অনুবাদে বইগুলোর বিশ্বের বাজারে পদার্পণ বেশিদিন আগেকার নয়। জাপানি-ভাষার হালের সবচাইতে জনপ্রিয় এই সাহিত্যিকের ছোটগল্পে কী এমন বিষয়ধর্মীতা রয়ে যাচ্ছে, বিশ্বের পাঠকের কাছে নিরবচ্ছিন্ন আবেদন রেখে চলেছে গত কয়েক দশক ধরে? ব্যাপারটিকে আধুনিক এক-সংস্কৃতির বিশ্ব বা বিশ্বায়নের নিরিখে ভাবতে চাইছেন অনেকেই। মুরাকামি’র বিশ্বে পূর্ব আর পশ্চিমের সংস্কৃতির পাশাপাশি বয়ে চলা রয়েছে, সংঘাত এবং পরাভব রয়েছে, কিন্তু দুই সংস্কৃতির ‘এক’ হয়ে যাওয়ার কথা কোত্থাও বলা নেই।

বৌদ্ধ ভিক্ষু ‘হাতিটা উধাও’ গল্পটি নিয়ে কথা শুরু করে বলেছিলেন এই গল্পটি পড়লে দেখবেন, বৃদ্ধ হাতি মাহুতসহ একদিন উধাও হয়ে যায়। যে মাহুতের সাথে হাতিটার এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দীর্ঘ এই সম্পর্কের ঠিক কোনো ব্যাখ্যা হয় না। তবে হাতিটা বৃদ্ধ, সে যেকোনো সময় মরে যেতে পারে। সে একটা বিশাল গরাদে বন্দি অবস্থায় থাকে, এ অবস্থায় সে কিভাবে মাহুত সমেত উধাও হয়ে যেতে পারে! এই উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় সবাই তার তত্ত্বাবধায়নকারী সিটি কর্পোরেশনের অবহেলাকে দায়ী করতে থাকে। কিন্তু এই গল্পের কথক জানান, হাতিটা তিনি মাহুত সমেত আকার পরিবর্তন করে উধাও হয়ে যেতে দেখেছেন। অর্থাৎ হাতিটা তার আকার পরিবর্তন করে ছোট হয়ে গরাদের বাইরে বের হয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। আবার একই সাথে বিষয়টি তার কাছে অতো পরিস্কারও নয়, যেন ঝাপসা এক ঝলক মাত্র। এই ঘটনা কথকের ভেতরে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। তিনি কিছু একটা করতে চান বলে ঠিক করেন আবার পরক্ষণেই ভাবেন, ব্যাপারটা করা আর না করার মধ্যে পার্থক্যটা কি! এক ধরনের দোলাচলে ভোগা লোকটা ভাবেন, চারপাশের সবকিছুর সঠিক ভারসাম্য যেন নেই। বৌদ্ধ দর্শনের আলোকে যদি চিন্তা করেন ঠিক এই পরিস্থিতিতে সেই ব্যক্তি তখন ধর্মহীন৷ ‘ধর্মহীন’ শব্দটির বৈদিক ও বৌদ্ধ অর্থে, বা ব্যুৎপত্তিগতভাবে ভাবলেও, সেই ব্যক্তি এমনই এক সত্তা যার কোনও ‘আধার’ বা ‘ধারক’ নেই। এই ‘মুক্ত’ সত্তাটির জন্য কোনও চেতনার রূপান্তর বা চেতনা হতে চেতনায় পৌঁছে যাওয়া, বা ‘চেতনান্তর’ ঘটবে না। অর্থাৎ বাইরের পৃথিবী আর তার অন্তর্জগতের মধ্যে কোনোরকম সাম্যতা লক্ষিত নাও হতে পারে। তাই তার দৃষ্টিতে প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনাগুলো অস্বাভাবিক ঠেকতে পারে, কার্য-কারণের সাধারণ হিসেবও গুলিয়ে যেতে পারে। সে যেন আজকের পৃথিবীর বহুল পরিচিত সেই মানুষ, যার সব থাকা সত্ত্বেও সে অন্তর থেকে অসুখী এবং আত্মপ্রত্যয়ের অভাবে দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা কেউ একজন। এমন মানুষের পরিচয় ইতিপূর্বে পশ্চিমের সাহিত্যে আমরা হয়ত অনেকবারই পেয়েছি। কিন্তু এই নিরিক্ষা সেসব ক্ষেত্রে একান্ত অনুপস্থিত। মুরাকামি’র নিরিক্ষা একান্তভাবেই পূর্বদেশীয়, যা পশ্চিমের অধিকাংশ আলোচকদের চোখে ‘এ সাটল টাচ অফ জেন! ইস্টার্ন ম্যানিফেসটেশন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড আফটার গ্লোবালাইজেশন!’ ভিন্ন আর কিছু নয়। বৌদ্ধ ভিক্ষু গল্প ধরে ধরে বৌদ্ধ দর্শনের সাথে প্রতিটি গল্পকে মিলিয়ে দিচ্ছিলেন আমার ভাবনায় তখন রামায়ণের একটা কাহিনি ভেসে ওঠে। যেখানে রামচন্দ্রের প্রেমে পড়ে সূর্পণখা নামের এক রাক্ষস, এবং রাম তার কুৎসিত রূপ দেখে তার নাক কেটে দেয় ও প্রেম প্রত্যাখ্যান করে। হারুকি মুরাকামি রামায়ণ পড়েছেন কিনা জানিনা তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় মুরাকামি জাপানের উন্নত সাহিত্য ধারণায় নিজেকে আটকে না রেখে বিচরণ করছেন বিশ্বজনীনতায়, আধুনিকতায়। তাই হয়ত ভাবনায় বা চেতনা জগতে রাম ও সূর্পণখা এসে মিলে মিশে যায় ‘একটি ছোট্ট সবুজ রাক্ষস’গল্পে, যেখানে বাগানের মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসা ক্ষুদে এক সবুজ রাক্ষস প্রেম নিবেদন করে এক নারীকে। যে নারী তার স্বামী কাজে বাড়ির বাইরে বের হয়ে যাওয়ার পর সারাদিন নিঃসঙ্গ সময় কাটান। ওই কুৎসিত দর্শন রাক্ষস নিশ্চয়ই তার কল্পনা নয়! আবার অখণ্ড অবসর কাটানোর উপাদানও হতে পারে না। তবু লেখক কেন প্রেমপ্রার্থী হিসেবে এমন এক কুৎসিত, ভয়ংকর দর্শন রাক্ষসকেই নির্মাণ করলেন! যার প্রেম তো অকৃত্রিম। কিন্তু তার কদাকার চেহারা ওই নারীর কাছে একই সাথে ভয়ঙ্কর ও বিরক্তি উদ্রেককারী। রাক্ষস দীর্ঘদিন ধরে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে টানেলের মত তৈরি করে তার ভেতর থেকে ক্রোলিং করে এসে যেভাবেই প্রেম নিবেদন করুক না কেন, নারীর তাতে সম্মতি দেয়ার কোনো কারণ নেই! সে মনে মনে রাক্ষসটাকে যতরকম ভয়ংকর ও বীভৎস নির্যাতন করা যায় তা ভাবতে থাকে। নারীর এই ভাবনার প্রত্যক্ষ প্রভাব রাক্ষসটার ওপরে পড়তে থাকে। নির্যাতিত রাক্ষস ক্রমাগত যন্ত্রণায় কাতর হয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। সে যতই বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে এভাবে নির্যাতন করার কথা ভেবো না। নারী তত তাকে আরো ভয়ংকর নির্যাতনের কথা ভাবে। এবং বলে, ‘এবার দেখো খুদে রাক্ষস তুমি জানো না, মেয়ে মানুষ কি জিনিস! তোমাকে যে কি কি করার কথা আমি ভাবতে পারি তার শেষ নেই।’ আপাতদৃষ্টিতে কাহিনীটি অদ্ভুত মনে হলেও! এর গভীরে রয়েছে ব্যক্তির হতাশা, বিষন্নতা বা অবিশ্বাস।

মুরাকামির গল্প উপন্যাসের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে সংগীত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ধ্রুপদি থেকে পপ, জ্যাজ থেকে র‌্যাপ, বারোক সংগীত থেকে রবিশঙ্কর, মোৎজার্ট থেকে বেটোফেন, আবার মাইলস ডেভিস, জোহান স্ত্রাউস বা হালকা চালের হুলিও ইগ্লেসিয়াশ। এছাড়াও ব্রুস স্প্রিংস্টিন, জেফবেক, ডোরস সহ অসংখ্য ঘরানার দেখা মেলে। মুরাকামির লেখায় পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য সব দেশের শিল্প- সংস্কৃতি বা সাহিত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। মুরাকামি আদতে তাঁর কাহিনীজুড়ে চেতনাতে বড়ো ইতিহাসকে নতুন করে বিশ্লেষণ করতে এগিয়ে আসছে ছোট ইতিহাসের নানান ঘটনা, আবার বড়ো ইতিহাস সরাসরি কিভাবে ছোট ইতিহাসের নির্মাণে অংশ নিচ্ছে, কিংবা একটি বিচ্ছিন্ন সত্তা তার চিন্তার মধ্যে কীভাবে বিশ্বজগতকে ধারণ করে রেখে দিতে পারে, বা তাকেও বিপরীত অভিমুখে দেখতে চাইলে দেখা যাবে যে, প্রতিনিয়ত তার স্মৃতির ভেতর নিত্যনতুন অতি ক্ষুদ্র থেকে অতি বৃহৎ সব সত্তার জন্ম এবং একইসঙ্গে মৃত্যুও ঘটছে। একটি মানুষ আসলে অতি-বৃহৎ একটি মানুষ, যে কিনা একসঙ্গে মানব-ইতিহাসের অনেকটা ধারণ করে রেখেছে তার সত্তার ভেতরে। তার প্রকাশ কখনো সরাসরি সত্তার প্রকাশে, কখনো বা বহিরঙ্গে সাদৃশ্যহীন এক পৃথিবী, জীবনযাপন, কিংবা বিসদৃশতায়। কদর্য, রূপহীন, বা কুরূপ নয়। আকারহীন বা সম্পূর্ণ নিরাকারও নয়। একটি জীবন, বা একটি মানুষ যেন বিসদৃশ। ফ্রানৎস কাফকা উত্তরাধুনিক সাহিত্যকালের যত লেখককে কমবেশি প্রভাবিত করতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে হারুকি মুরাকামি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কাফকা’র চরিত্রদের মতোই অসংখ্য বিসদৃশ চরিত্রের আনাগোনা তাঁর উপন্যাস আর ছোটগল্প জুড়ে। ‘একটি জানলা’ গল্পের সেই প্রোটাগনিস্ট, কোনও এক সংস্থার তরফে যে চিঠি লিখে বিষাদগ্রস্ত বা প্রেমে আঘাতপ্রাপ্ত একলা মহিলাদের কাউনসেলিং করত, বা ‘অঘটন পথচারী’ গল্পের সেই নিঃসঙ্গ পিয়ানো টিউন-করা ভদ্রলোক, কিংবা ‘চীনে যাওয়ার স্লো বোট’ গল্পের সেই নারী, যে অবিকল কাফকা’র এক নারী-চরিত্রের মতোই চিরকালের নীরব। নিঃসঙ্গ মানুষ নয় তারা কেউই, কিন্তু প্রত্যেকে পৃথিবীর সামনে একটু যেন বিসদৃশ। মুরাকামি আমাদেরকে দেখিয়ে চলেছেন এই দৃশ্যমান এবং চোখে সয়ে যাওয়া জগতটার বাইরেও একটি জগত রয়েছে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে সময়ের ছোট্ট উপাংশ অচেনা এক বিশ্বের ছোঁয়া দিয়ে চলেছে। একটি ‘লেডার-হাওজেন’ বা ইয়োরোপের মহিলাদের জন্য নির্মিত একরকম লেদারে প্রস্তুত গরম মোজা, যেটি দেহের মাপে মিলে যাওয়া মাত্র এক নারী জীবনের একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে সাহস করে ফেলে, অথচ এতকাল সেই সাহসটুকু তার কাছাকাছি এসেও কীভাবে যেন অধরা রয়ে যাচ্ছিল। কিংবা অত্যন্ত পছন্দের এক পুরুষকে খুঁজে পেয়ে এক নারী জানতে পারে যে সে আসলে ‘গে’, কিন্তু কিছুতেই তাকে পরিত্যাগ করার মতো জোর খুঁজে পায় না। কিংবা, ‘এপ্রিলের এক সুন্দর সকালে ১০০ ভাগ মনের মতো মেয়েটিকে দেখে’ একটি ছেলে বলে ওঠে, ‘আমি যে সারা জীবন তোমাকেই খুঁজছি। তোমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু তুমিই আমার ১০০ ভাগ মনের মতো মেয়ে।’

মুরাকামি কখনই তার ছোট গল্পের সোজাসাপ্টা সমাপ্তি করেননি। সবসময় পাঠকদের সমাপ্তি ভেবে নেবার সুযোগ করে দেন। যেন গল্পটি তার, কিন্তু পাঠক গল্পটি তার নিজের মতো করে গ্রহণ করবে। ছোট গল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ঐ কথার মতই “শেষ হয়েও হইলো না শেষ।” মুরাকামির গল্পে প্রতিটি বিষয়েরই যেন অস্তিত্ব আছে। যাকে ঠিক কল্পনা বলেও ধরে নেয়া যায় না, আবার যে কল্পনা হয়ে দাঁড়ায় অতি বাস্তবের প্রতীক। তিনি তাঁর গল্পে বসবাসকারী চরিত্রদের সুপ্ত বাসনা বা আকাঙ্ক্ষার একটা অদ্ভুত রূপ দেন। তাই মুরাকামি’কে নিশ্চিত করে কোনও নির্দিষ্ট ঘরানা বা গোলার্ধের লেখক বলে আখ্যায়িত করে ফেলাটা অন্যায়। মানুষে জীবনের গভীরতা উঠে আসে মুরাকামির লেখায়। বিষণ্নতা যে গভীর, সে কথাই নানাভাবে বলেন তিনি। ‘ঘুম’ গল্পটাতে আমরা দেখি টানা ১৭ দিন-রাত না ঘুমানো একজন ইনসোমনিয়ার রোগী ঘুম না হওয়াকে এক সময়ে ভাবছেন, ঘুম না হলে হবে না, তবে এই নিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে না ভুগে বরং এটা ভাবতে হবে যে সে তার জীবনটাকে প্রসারিত করছে। অর্থাৎ যে সময়টায় সে ঘুমাতো সেই সময়টা এখন তার একান্ত নিজস্ব একটা সময়। যে সময়টাতে কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না, যদিও এভাবে টানা নিদ্রাহীনতা তাকে বাঁচাতে পারেনি, যা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ঘুম গল্পটার মতো তাঁর এমন অনেক গল্পে মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনকে সাধারণ বা একঘেয়ে মনে হতে পারে,তবুও তার ভেতরেও থেকে যায় যন্ত্রণাময়, বিপজ্জনক বা কখনো মায়াবী এক কাহিনি। ‘কিনো’ গল্পটি, কিনো নামের এক ছেলেকে নিয়ে। যে একটি বার চালায়, শহর থেকে দূরে খুব নিরিবিলি এক এলাকায়। ফাঁকা জায়গা, নিশ্চুপ পরিবেশের ভেতরই কেমন একটা বিষণ্নতা ছড়িয়ে পড়ে। এর চেয়েও বিশাল বিষণ্নতা কিনোর ভেতরেই বসবাস করে। যদিও এ ব্যাপারে সে উদাসীন, তার স্ত্রী এবং সংসার হারানোর কষ্ট সে অনুভব করে না। কিন্তু তার বিষণ্নতা লেখক বারবার পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন, এমনকি সে যে তার অজান্তেই একাকিত্ব থেকে মুক্তি চাইতে শুরু করে, তা-ও পাঠকের সামনে মেলে ধরেন লেখক। কী অদ্ভুত এক খেলা শুরু হয়, গল্পের মূল চরিত্রের সাথে পাঠকের যেন সরাসরি দেখা হয়ে যায়, লেখক আড়াল থেকে বিষণ্নতাগুলো ফুটিয়ে তোলেন। এর চেয়েও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, পাঠকও একাকিত্ব অনুভব করতে শুরু করে!

হারুকি মুরাকামির গল্পে যৌনতার উপস্থিতি লক্ষণীয়। যৌনতা, গল্পে একটি আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে আসে। কিন্তু সেগুলো আরোপিত মনে হয় না; বরং চরিত্রগুলোর সংকট প্রকাশের একটি ভাষা হয়ে ওঠে। মুরাকামি আসলে সমস্ত জাঁকজমকপূর্ণ জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় এবং সবার সামনে নশ্বর পৃথিবীর নগ্নতাকে প্রকাশ করে দেয়। আমরা মানুষকে চিনতে পারি বলি বটে, কিন্তু আদতে চিনতে পারি না। প্রেম কি কেবল একটি স্বপ্ন যা আমরা আমাদের একাকী অস্তিত্বের বাস্তবতা এড়িয়ে যাবার জন্য দেখি? মানুষের মানসিক এমন সব আলোচনা, যা মানুষ আসলে বলতে চায় না, কিন্তু পুষে রাখে। কেমন হয় একজন মানুষের নিঃসঙ্গ জীবন? মানুষের বিষণ্নতা কেমন করে তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, যখন কেউ তার নিজের ভালবাসার নারীকে হারিয়ে ফেলে? এসবের মনস্তাত্ত্বিক দিক আর সে সময়ের বিষণ্ণতা নিয়ে মুরাকামি ‘দম দেয়া পাখি আর মঙ্গলবারের মেয়েরা’ গল্পটা পড়তে পড়তে মনে হয় কুয়াশায় আচ্ছন্ন এক পরিবেশে যেন কেউ পেঁজা তুলার মত হাওয়ায় ভাসছে। সন্দেহ, অবিশ্বাস পরস্পর শ্রদ্ধাহীনতা তাঁর গল্পে এই প্রতিটি বিষয়েরই যেন বাস্তব অস্তিত্ব আছে। যা দেখা যায় না ঠিকই, আবার নিছক কল্পনা বলেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কখনো কখনো কল্পনা হয়ে দাঁড়ায় অজানা অতি বাস্তবের প্রতীক। ‘ক্যাঙ্গারু বার্তা’ গল্পটাতে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের একজন প্রোডাক্ট ম্যানেজার তার কাছে পাঠানো ক্রেতার একটি অভিযোগপত্র পেয়ে হঠাৎই ওই অজানা অচেনা নারীর প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এখানে প্রেম ঠিক ওভাবে নেই। একটা নির্দোষ, সাদামাটা, বা একটু ভিন্নধর্মী অভিযোগপত্র পেয়ে কেউ কারো প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করতে পারে এমন অদ্ভুত কাহিনি মুরাকামির পক্ষেই লেখা সম্ভব! যেখানে কাহিনি ছাপিয়েও এর ভেতরে রয়েছে ব্যক্তির বিষণ্নতা। বান্ধবী থাকা সত্বেও তার মানসিক নিঃসঙ্গতা। অর্থাৎ সবকিছু হাতের নাগালে থাকতেও এক অদ্ভুত শূন্যতায় আচ্ছন্ন তাদের জগৎ। এই শূন্যতার প্রতীকী প্রতিফলন প্রকাশ পায় প্রায় তাঁর প্রতিটি লেখায়। এই অশান্তির অর্থ কি? উপশম কিসে? সেই খোঁজ কি রয়েছে মুরাকামির সব লেখায়? ব্যক্তি তার একাকিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে একদম একা। এক ধরনের বিমর্ষ একাকীত্ব নয়, আলাদা নানারকম একাকীত্ব আছে। যা খুবই যন্ত্রণার। স্নায়ু ছিড়ে যাওয়ার মতো। একইভাবে ‘মানুষ খেকো বেড়াল’ গল্পে আমরা দেখতে পাই, মানুষ তার সারাজীবন ধরে একজন আদর্শসঙ্গীর অপেক্ষায় থাকে। আর যে কোন সময় সেই সঙ্গীর দেখা পেতে পারে সে। হয়ত বিয়ের কয়েক বছর পরেও মিলতে পারে এমন কোন সঙ্গীর দেখা। দাম্পত্য সম্পর্ক হয়তো মসৃণভাবে চলছে, যেখানে অভিযোগ করার মত তেমন কিছু নেই। শ্রদ্ধা, ভালবাসা সব থাকার পরও হয়ত এমন কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, যাকে দেখলে মনে হয় এর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মেলে ধরা যায়। মুরাকামি এই ধারণাটাকে ঠিক ভালোবাসার লেবেল দিতে চাননি। এ যেন পরিপূর্ণ সহমর্মিতা। তিনি বিবাহ বহির্ভূত এই সম্পর্কটাকে এত স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করেছেন, এতো সহজতায় যে তাদের জৈবিক সম্পর্কটা যেন ঠিক যৌনতার জন্য নয়, ভালোবাসার এক শান্ত সমহিত প্রসন্ন টান। মুরাকামি’র উপাখ্যানে বাস্তব জগতে যে ‘বিসদৃশতা’ লক্ষ্য করা যায়, পশ্চিমের আলোচকেরা সেটিকে কাফকা’র কাহিনিতে ঘুরেফিরে বেড়ানো বিচিত্র সব মানব-চরিত্র বা তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ততোধিক বিচিত্র ঘটনাবলির সঙ্গে তুলনা করলেও, এই বিসদৃশতা-কে একান্তভাবে পশ্চিমের উত্তরাধিকার-ভাবনা বলা চলে না। ‘খামার-দহন’ গল্পটাতে এক যুবক জানায়, দুমাস পর পর এক একটা খামার পোড়ানো তার শখ। এখানে সে কোন নৈতিকতার ধার ধারে না। নৈতিকতা তার কাছে ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্বের ভারসাম্য। একই সাথে ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্ব। যেন একই সাথে টোকিওতেও আছে আবার টিউনেশিয়াতেও। ‘চীনে যাওয়ার স্লো বোট’ গল্পে নিজের দেশ জাপান’কে লিখতে বসে আমেরিকা, এবং আমেরিকা’র এক বিপরীত-সংস্কৃতি হিসেবে চায়না’কে নতুন করে মেলে ধরতে চেয়েছেন পাঠকের সামনে। এক নিঃসঙ্গ চাইনিজ ভদ্রলোক, যিনি টেলিফোন ডাইরেক্টরি ঘেঁটে তোকিয়ো শহরে বসবাসকারি চাইনিজ’দের ফোন নম্বর বের করেন, এবং তাদের বাড়ি গিয়ে ‘চাইনিজ এনসাইক্লোপেডিয়া’ বিক্রি করেন। এটিই তার পেশা। তার সঙ্গে একসময়ে যখন কাহিনির প্রোটাগনিস্টের দেখা হয়, তার মনে পড়ে যায়, ভদ্রলোক আসলে ছিলেন তার উচ্চতর ক্লাশের সহপাঠী। আজ তিনি শহরের চাইনিজ’দের বাড়িতে ঘুরে এনসাইক্লোপেডিয়া বিক্রি করেন। মুরাকামি একথাটি একবারও লেখেননি কোথাও, কিন্তু পাঠক নিজের থেকে উপলব্ধি করবেন, স্বদেশ ও সংস্কৃতির প্রতি সমর্পিতপ্রাণ যে ‘চাইনিজ’ ছেলেটি এককালে তার সহপাঠী ছিল, সে আজও একইরকম ‘চাইনিজ’ রয়ে গিয়েছে। কিন্তু কাহিনির প্রোটাগনিস্ট অর্থাৎ জাপানি ছেলেটি কীভাবে যেন নিঃশব্দে ‘আমেরিকান’ হয়ে গিয়েছে। এক অভূতপূর্ব প্যাসিভ ন্যারেটিভ হচ্ছে সুদীর্ঘ এই উপাখ্যানের প্রাণস্পন্দন, যা চরম উপভোগ্য ও স্মরণীয় হয়ে উঠেছে।

হারুকি মুরাকামি সামান্য ছোটগল্পকেও বৃহৎ পরিসরে লিখে থাকেন। আর কাফকা অন দ্য শো’র পরিসরই বৃহৎ, যা মুরাকামির লেখনীতে হয়ে উঠেছে অকল্পনীয় এক সৃষ্টি। জটিলভাবে গল্প না বললেও গল্পের বিষয়বস্তু জটিল হবার কারণে এই বই বিশ্লেষণ করা অনেকের কাছেই ভয়ঙ্কর একটি ব্যাপার। একাকীত্ব, বিষণ্ণতা, নীরবতা, ভালোবাসা, মানুষের বাস্তবিক জীবনের গল্পের কথা মুরাকামির লেখায় বার বার ফুটে উঠেছে। এসব বিষয়কে পাশে রেখে মুরাকামি বাস্তব ও কল্পনাকে মিশিয়ে ফেলতে ভালোবাসেন। তিনি এমন এক ঘরানা নিয়ে লেখালিখি করেন যে ঘরানার লেখক বর্তমানে হাতে গোনা। মানুষের জীবনের গল্প বা একটি মানুষের বেঁচে থাকা জীবনকে তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন প্রত্যেকটা গল্পে তা মুগ্ধতাকেও ছাড়িয়ে যায়। হিয়ার দ্য উইন্ডো বইতে মুরাকামি একটি কথা বলেছিলেন, “যখনই আমি সমুদ্রের দিকে তাকাই, সবসময় তখন আমার কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যখন আমি কারও সাথে কথা বলি, তখন আমার ইচ্ছা করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে। আমি এরকমই অদ্ভুত একজন মানুষ।” বাস্তব ও পরাবাস্তব নিয়ে প্যাঁচ লাগানো নিয়মতান্ত্রিক লেখকের জীবন কি আসলেই এমন অদ্ভুত?

নিরন্তর ভাল থেকো। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আশা করি হারুকি মুরাকামির লেখায় পেয়ে যাবে কিংবা আমারও…

ভালবাসা সহ-

বাসু
১২ মার্চ,২০২৫
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















হঠাৎ মনি খিলখিল করে হেসে ওঠে… ‘আমি ভেবেছিলাম যে তুমি ভুলে গিয়েছ!’

মনি বের্শেনের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কপালে, গালে, নাকের উপরে চুমু দিতে থাকে। ভেজা ভেজা শিশুর ঠোঁটে লেগে থাকা দুধের গন্ধ আর প্রাতরাশের ছোট ছোট গোল রুটির গন্ধ পায় বের্শেন।

বের্নহার্ডের বয়স মোটে সতের এবং এই প্রথমবার সে প্যারিসে এসেছে। সে সাধারণত একটা বাদামি রঙের স্যুট আর সাদা শার্ট পরে। যে মহিলার বাড়িতে প্রথমে সে থাকতো, তিনি বলেছিলেন যে সে যেন রঙিন শার্ট পরে, নাহলে তাকে প্রতিদিন জামা বদলাতে হবে, আর সেটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। বের্শেন লজ্জিত হয়ে লক্ষ্য করল যে তার শার্টের আস্তিন এর মধ্যেই বেশ ময়লা হয়ে গেছে। তার পর থেকে অবশ্য সে তার নীল স্পোর্টস শার্টটাই পরা শুরু করেছিল। এমনিতে মহিলা ভালই। তাঁর যা বয়স, তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানাদি থাকবার কথা। কিন্তু সেরকম কেউ আছে বলে মনে হয়নি। ফলে বের্শেন ধরে নিয়েছিল যে তার প্রতি ওই মহিলার অপত্যস্নেহ বর্ষিত হবে।

সে তার নিজের দুটি লাগেজ থেকে জিনিসপত্র বের করে গুছিয়ে রাখতে লাগল। তার চিরকালের গোছানো স্বভাব। বিছানার পাশে সে রাখল মনির ছবি। বাবা মায়ের ছবি বিছানা থেকে একটু দূরে রাখা দেরাজের উপরে। তার পাশে চুলের ব্রাশ, স্বরলিপির খাতা আর ক্যামেরা। ডেস্কের উপর রাখা হল আরেকটা ছবি, গের্ট আর ইনেস ঝুঁকে বসে ফ্লককে আদর করছে। এই ছবিটা রূপোলি ফ্রেমে বাঁধিয়েছে বের্শেন। এই ঘরে ডেস্ক না থেকে যদি একটা পিয়ানো থাকত, তাহলে খুব ভাল হত। তবে বাড়িওয়ালি জানিয়েছেন যে সামনের রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই বামদিকে বাদ্যযন্ত্রের একটা বেশ বড় বিপণি আছে। বের্শেন দরকার হলে সেখানে গিয়েও অভ্যেস করতে পারে। এই খবরটা পেয়ে সে কিছুটা আশ্বস্ত হয়। তার তখনি সেখানে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু তার এখন বেশ খিদে পেয়েছে। বেলা প্রায় দু’টো বাজে। আজ সকালে তার প্রাতরাশ করাও হয়নি।

খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে প্যারিসের মানচিত্রটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। এখানে আসবার আগে এই মানচিত্রটা তার মা সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। সে এখন যেখানে বসে আছে, জায়গাটা ওডিয়নের কাছে। লুক্সেমবুর্গ প্যালেস আর বাগানও খুব কাছে। ইচ্ছে হলেই সে ওই বাগানে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে পারবে। মোঁপার্নাস্সে অবধিও সহজেই চলে যেতে পারবে সে। তবে রিভ দ্রোয়াত এখান থেকে অনেকটা দূরে। তার শিক্ষক যেখানে থাকেন, সেই জায়গাটা, অর্থাৎ পাস্‌সি, সেটাও অনেকটা দূরে। সেখানে পৌঁছাতে তার ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যাবে। অনেকটা দূর যেতে এখন একটুও ভাল লাগছে না তার। ভারি স্বরলিপির ফোল্ডারটা হাতে নিয়ে বাসে কিম্বা মেট্রোতে এতখানি সে কী ভাবে যাবে, সেটা চিন্তা করতে লাগল। তাছাড়া হেঁটে হেঁটে এতদূর যাওয়া সম্ভব নয়। নিজের ফ্যাকাসে হাতের দিকে চেয়ে রইল সে। ফোল্ডার বয়ে বয়ে হাতে ব্যথা হয়ে, হাত শক্ত হয়ে ফুলে যাবে, ভাবতে লাগল সে। বাজনা বাজাবার জন্য হাত ঠিকঠাক রাখা খুব জরুরি।

অবশেষে পাস্‌সিতে বের্নহার্ড তার শিক্ষকের বাড়িতে ঠিকঠাকভাবেই পৌঁছেছিল। তবে সেখানে যাবার পরে সব কিছুই অন্যরকম মনে হয়েছিল তার। জায়গাটা তার ভাবনা, তার কল্পনার চেয়েও সুন্দর। বন্ধুত্বপূর্ণ চেহারার এক কিশোরী তাকে ভেতরে নিয়ে গেল। গানের ঘরের দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। পুরু কার্পেটে পা ডুবে যাচ্ছিল তার। দেওয়ালে অনেক ছবি ঝুলছে, যেগুলোর কোণে স্বাক্ষর করা। ঘরের বিশাল জানালা দিয়ে বিকেলের রোদ্দুর ঢুকে ঘরটাকে আলোকিত করে রেখেছে। ঘরের মধ্যে বিশাল একটা পিয়ানো অদ্ভুত আধিপত্য বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বরলিপির কাগজে ঢেকে গিয়েছে বাদ্যযন্ত্রটার দেহ।

বের্নহার্ড দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পিয়ানোটার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। বাম হাতটা সে পিয়ানোর চাবিগুলোর উপরে রাখলো এবং লক্ষ্য করল যে তার হাত একটু একটু কাঁপছে। সবে দু’ দিন হল সে বাড়ির বাইরে। একটা গোটা দিন অবশ্য কেটেছে যাত্রাপথে। একটা অজানা একাকিত্ব তাকে ঘিরে ধরেছে। নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বিপন্ন মনে হয়েছে। পথে অজস্র মানুষ হেঁটে চলেছে স্রোতের মত। কাউকে সে চেনে না। তাদের কারো সঙ্গে তার কোনও দরকার নেই। এক অন্ধ মানুষের মত ঘুরে বেড়িয়েছে পথে পথে। একটা দোকানের জানালা থেকে আরেকটা দোকানের জানালায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে, যদিও তার বিশেষ কিছু কেনাকাটি করবার প্রয়োজন ছিল না। লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে; পা ব্যথা করছিল । নতুন নতুন রাস্তা যেন খুলে গিয়েছে তার সামনে। সে ইচ্ছেমত যে কোনও একটা ধরে চলতে পারে। ঠাকুমার বাড়িতে থাকাকালীন একটা নির্দিষ্ট সময়ে তাকে ফিরতে হত। খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি বাঁধাধরা রুটিন ছিল। এখানে সেরকম কোনো ব্যাপার নেই। কেউ অপেক্ষা করে বসে থাকবে না তার জন্য। দিনের সময়টা অন্তহীন মনে হচ্ছে। রাতও সেরকম। শুরু নেই। শেষ নেই কোনোখানে। রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল তার। মাঝে একবার উঠে জল খেল সে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল আবার। অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছিল সে। তারপর যখন ঘুম ভাঙল, সে জানালার শাটারের ফাঁক দিয়ে হালকা আলোর রেখা দেখতে পেল। তার মনে হল যে ভোর হয়েছে।

বাড়িতে থাকাকালীন এমন আলো দেখে সে ভোরের কথাই ভাবতো। ঊষার প্রথম কিরণ, কুয়াশাজড়ানো ভোর। কিন্তু এখানে প্রায় নটা বেজে গিয়েছে। বের্নহার্ড লাফ দিয়ে উঠল বিছানা ছেড়ে। তবে উঠেই মনে পড়ল যে তাড়াহুড়ো করে কোনও লাভ নেই। সে বেল বাজিয়ে প্রাতরাশ চাইল। তাকে একটা ট্রেতে সাজিয়ে দুধ ছাড়া এক কাপ কালো কফি আর একটা লম্বাটে রুটি দেওয়া হল। খেয়ে পেট ভরল না তার। একপাশে সরিয়ে রাখল সে ট্রেটা। তারপর আবার চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। ধূসর সিলিংএর দিকে তাকিয়ে রইল সে। এই মুহূর্তে ধূসর রংটা দেখে তার এত অসহ্য লাগছে যে কহতব্য নয়। অতীতে এরকম বিশ্রী দেখতে কখনই মনে হয়নি তার এই রঙটাকে; কেমন যেন নোংরা আর বিষণ্ণ। তার মন হতাশায় আর বিরাগে ছেয়ে গেল। যে দিনটা শুরু হবে, সেই দিনটার প্রতি এবং নিজের প্রতি অবিশ্বাসে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল।

সারা সকাল জুড়ে ওই সিলিং-এর ধূসরতা তাকে তাড়না করতে লাগল; তার মনে হল শহরটার আকাশ, বাড়িঘরদোর, পথঘাট সব… সবকিছুই যেন ধূসরতায় ডুবে গিয়েছে। পাস্‌সি যাবার পথে যে সাবওয়েতে সে ঢুকেছিল, সেখানেও তার মনে হয়েছিল যে তার চোখে যেন একটা ধূসর পর্দা পড়ে গিয়েছে। নিজেকে কেমন যেন অনুভূতিহীন, ভোঁতা, ব্যথাতুর, অকর্মণ্য বলে মনে হচ্ছিল তার।

ধূসর বিষাদ পেরিয়ে এখন এই পিয়ানোর সামনে দাঁড়িয়ে বের্শেন নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। এই মুহূর্তে এই বিরাট শহরে সে একাকী নয়। এখনই এক পরিচিত এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কণ্ঠ তাকে সম্বোধন করবে; সে এমন একজনকে দেখবে যিনি গের্টকে চেনেন (কারণ বহুবার সঙ্গীতের ক্লাস শেষ হলে গের্ট তাকে গাড়িতে করে আনতে যেত); হঠাৎ গের্টের কথা ভেবে অপ্রত্যাশিতভাবে বের্শেনের বাড়ির জন্য মন খারাপ হল। মনে হল যে সে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, এখনই তার চোখে জল আসবে।

তার শিক্ষক পাশের ঘর থেকে এসে তার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন। বের্শেন উত্তেজনায় কাঁপছিল। … ‘ভয়লা দোঙ্ক লে পেতিত কোরাজোঁ’*- উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন শিক্ষক। হৃদ্যতাপূর্ণ প্রবল স্বরে বের্শেনকে জানালার আলোর কাছে নিয়ে এলেন তিনি, ‘তারপর, কেমন আছেন আপনি? পথে কোনো সমস্যা হয়নি তো? কোথায় উঠেছেন? জায়গাটা ভাল তো? আপনি কঠিন পরিশ্রম করবার জন্য তৈরি তো?’

বের্শেন একটু ঘাবড়ে যায় এত প্রশ্নের সামনে। কারণ, ফরাসি ভাষায় তার খুব বেশি দখল নেই। সে অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে যায় নিজের অস্বস্তি গোপন করার জন্য।

-‘আমি কিছু কিছু অভ্যাস করেছি।’ … বলে সে শিক্ষকের অনুমতির অপেক্ষা না করেই পিয়ানোর সামনে বসে পড়ে; বসে তার নিজেরই একটু বিব্রত বোধ হয়। অস্বস্তি কাটানোর জন্য সে জোরে জোরে হাতের আঙুল ঘষতে থাকে।

শিক্ষক অনুমতি দেবার ভঙ্গি করে মাথা নাড়েন… ‘চলুন, বাজাতে শুরু করুন। অসুবিধে নেই। আমি আমার এক বন্ধুকে খবর দেব, যিনি আপনার বাজানো শুনে খুব খুশি হবেন।’

বের্শেন গত বেশ কয়েক মাস বাখের কম্পোজিশন বাজায়নি। তবুও সে চুপচাপ বাজানো শুরু করল। বাজাতে বাজাতে সে চারপাশের দুনিয়া ভুলে এক ধ্যানের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। সুরের প্রদীপ্তির আবেশ তাকে ঘিরে রেখেছিল। বাজাতে বাজাতে এক মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে সে একজন অচেনা মানুষকে দেখতে পেল। সেই মানুষটি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। পিয়ানোর ঢাকনার উপরে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। বের্নহার্ডের একটু অদ্ভুত লাগে তাঁর দিকে তাকিয়ে; মুখমণ্ডলে মধ্যে গভীর এক বিষাদ ছেয়ে আছে; তাঁর মুখখানা ভারি ফ্যাকাসে। ঘরের আলোটা ততখানি উজ্জ্বল নয় বলেই তাঁর মুখখানা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কি না, সেটা সে বুঝতে পারে না। সে তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে মন কেন্দ্রীভূত করে পিয়ানোর চাবির উপরে। সুরের মায়ায়, ঐন্দ্রজালিক স্বপ্নের মাঝে ডুবে যেতে যেতে নেশাগ্রস্তের মত বাজাতে থাকে সে।

(চলবে)



* Voilà donc le petit courageux- ফরাসি ভাষার এই বাক্যবন্ধের অর্থ… ‘তাই তো এই ছোট্ট সাহসী মানুষটি এসেছে।’
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৯.২

এসব তো সকালের ঘটনা। বেলা গড়িয়ে দুপুর হবার আগে থানায় দু’পক্ষেরই রিপোর্ট লেখানো হয়ে
গেল। যার থেকে বোঝা গেল যে স্কুল মাস্টারের দল মারামারি করেছে এবং একে অপরকে খুন করতে
চাইছিল। কিন্তু তখন ওদের থামানোর জন্য কেউ ছিল না। তাহলে একটাও খুন হল না কেন?
পুলিশের মনে এই স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠায় ওরা এবার উলটো দিক থেকে তদন্ত শুরু করল।

সেদিন দুপুরের দিকে বৈদ্যজীর বৈঠকখানায় এ’নিয়ে ভারি কাটাছেঁড়া শুরু হল। সেখানে হাজির সাধারণ
নাগরিকদের মনে হল—ব্যাপারটা আরও একটু গড়ালে ভাল হত। ঠিক আছে, নিজেদের কারও হাড়
ভাঙেনি—সেটা ভাল, তবে খানিকটা রক্ত বেরনোর মত চোট লাগা উচিত ছিল। তবেই দুশমনদের
বিরুদ্ধে একটা খাসা মামলা দাঁড়াতে পারত। শনিচর ভাবল—গ্রামপ্রধান নির্বাচিত হওয়ার আগে
আরেকটু নেতাগিরি করে নিই। অতএব, নিঃশুল্ক উপকার করার চেষ্টায় বলল,-- প্রিন্সিপাল রাজি
হলে আমি ওনার হাতে কোঁচ দিয়ে খোঁচা মেরে রক্ত বের করে দিই? তাহলে ওটাও খান্না মাস্টারের
কাজ বলে থানায় লিখিয়ে দেয়া যাবে।
কিন্তু ছোটে পালোয়ান ওকে দূর দূর করে চুপ করিয়ে দিল।
সেই দুপুরে রঙ্গনাথ এবং রূপ্পনবাবু চুপচাপ সবার কথা শুনছিলেন, নিজে একবারও মুখ খোলেননি।
সেটা অবশ্য শিবপালগঞ্জে বোকামির চিহ্ন। আসলে ওরা ভেতরে ভেতরে প্রিন্সিপালের উপর রাগে
ফুঁসছিলেন। খানিক বাদে রূপ্পন বাইরে এসে বললেন—এই শালা বাবাকে কোর্ট-কাছারির দিকে নিয়ে
যাচ্ছে, এরপর জেলের ভাত খাইয়ে তবে শান্ত হবে।
এদিকে বৈদ্যজী সেই দুপুরে প্রিন্সিপালের মুখে খান্না মাস্টারের উৎপাতের গল্প গম্ভীর মুখে
শুনছিলেন। শেষে এমন একটা কথা বললেন যার সঙ্গে এই মামলার কোন সম্পর্ক নেই। কথাটি
একদম সত্ত্বগুণ সম্পন্ন এবং সেটা কোন লোককে নীরোগ করে দেবার জন্য যথেষ্ট।
উনি বললেনঃ
“জেলা স্কুল ইনস্পেক্টরের ধর্মে মতি দেখে আমি তো হতভম্ব। গত মঙ্গলবার শহরে যেতে
হয়েছিল। দেখলাম, একজন লোক হনুমানজীর মন্দিরের সামনে মাটিতে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করছে।
যখন ধূলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল দেখি আর কেউ নয়—আমাদের জেলা স্কুল ইনস্পেক্টর। চোখ থেকে,
কী আর বলব, প্রেমের অশ্রুধার বইছিল। আমি নমস্কার করায় উনি প্রতি নমস্কার করে রূদ্ধ
সরে ‘হাউ হাউ’ করে কীসব বলে ফের চোখ বন্ধ করলেন।
“ পরের বার পাঁচ -ছয় সের উত্তম ভৈঁসা ঘি নিয়ে যেতে হবে। এমন ধার্মিক মানুষ! খামোখা ডালডা
বনস্পতি খেয়ে খেয়ে ধর্ম নষ্ট করছে।
মহাকালের লীলা”।
একটা পুরনো শ্লোক ভুগোলের একটি উপপাদ্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সেটা হল—সূর্য কোন
নিয়ম মেনে পূর্বদিকে উদিত হয় না, বরং যেদিকে ওঠে সেটাই পূবদিক হয়ে যায়।তেমনই উঁচু স্তরের
সরকারি আমলা কাজের প্রয়োজনে ট্যুর করেন না। তিনি যখন ইচ্ছে যেদিকে যান, তখন সেখানেই
প্রয়োজন সৃষ্টি হয়। এই নবীন সূর্য সিদ্ধান্তের নিয়ম মেনে এক মহাপুরুষ সেদিন বিকেল চারটে
নাগাদ শহর থেকে মোটরগাড়ি চড়ে গ্রামের পথে যাচ্ছিলেন। পথের চারপাশে ঘন সবুজের সমারোহ
দেখে উনি নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলেন—হ্যাঁ, গতবছর যে লেকচার দিয়ে গেছলেন তার ফলেই
এদিকের গাঁয়ে এবার রবি ফসলের বাড়-বাড়ন্ত। চাষির দল ওনার পদ্ধতি মেনেই চাষ করেছে।

ওরা বুঝতে পেরেছে যে এই খেতগুলো লাঙল দিয়ে চষতে হবে। আর তাতে খালি সার দিলে হবে না,
বীজও বুনতে হবে। এই সব তত্ত্ব ওরা বুঝে নিচ্ছে এবং নবীন পদ্ধতির চাষের ব্যাপারে ওদের ভয়
দূর হয়েছে। কিসান এবার প্রগতিশীল হয়েছে, তবে ওরা আজও আগের মত চাষা-কে- চাষাই রয়ে
গেছে, সেজন্যেই পিছিয়ে পড়েছে।
মোটরগাড়ি চলছে তীব্র বেগে, আর রাস্তায় এঁকেবেঁকে চলতে থাকা লোকজন ঝড়ের মুখে শুকনো
পাতার মত উড়ে উড়ে রাস্তার কিনারে সরে যাচ্ছে। ফের নিজেকে ধন্যবাদ! যত আলসে নাগরিক ওঁর
মোটরের গতিবেগের ধাক্কায় কেমন চটপটে হয়ে উঠছে! দেখ, ওরা কেমন চালাক হয়ে গেছে! এমন
দ্রুতবেগে চলা গাড়ির চাকায় ওদের একটা বুড়ো আঙুলও পিষে যায়নি! উনি পরম সন্তোষে একবার
নিজেকে, ফের একবার গোটা ভারতকে বললেন—সাবাশ! তোর ভবিষ্যৎ উজ্বল বটে।
গাড়ি ছঙ্গামল ইন্টার কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। আন্ডারওয়ারের উপরে বুশশার্ট এবং
ডোরাকাটা পাজামার উপর গেঞ্জি -ছাড়া- জামা পরা ছেলের দল নালার পাশে ছোট্ট পুলের উপর
বসেছিল। দুটো দল নিজেদের মধ্যে তিতির-বুলি’র সাংকেতিক ভাষায় কথাবার্তা চালাচ্ছিল। সাহেব
এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশে বুঝে ফেললেন যে এরাই ছাত্র।
গাড়ি প্রায় এক ফার্লং এগিয়ে গেছল। কিন্তু মহাপুরুষের খেয়াল হল যে গত আটচল্লিশ ঘন্টায় উনি
নবযুবকদের কোন লেকচার দেননি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে এই তাজা তরুণদের জন্য উনি কত না
দুঃখ সয়েছেন! ওদের ভালর জন্যেই উনি গ্রামে নিজের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে শহরে এসে বাংলোয়
থাকছেন। পুকুর পাড়ে বসে থাকার বদলে সকাল-সন্ধ্যে একটা ছোট্ট কামরায় বসে থাকার অভ্যেস
করেছেন। নিজেকে কত বদলে ফেলেছেন!
যেই মনে হল যে ওনার বিশেষ পছন্দের নওজোয়ানদের সঙ্গে গত আটচল্লিশ ঘন্টায় কোন
কথাবার্তা হয়নি, অমনই খেয়াল হল—আরে! এতক্ষণ বিনা লেকচার ঝেড়ে রয়েছি? আমার মনে এত
ভালো ভালো চিন্তা উঁকি দিচ্ছে আর আমি কিনা সেসব স্বার্থপরের মত নিজের কাছে চেপে রেখেছি?
সত্যি, আমি আজকাল বড্ড কিপটে হয়ে গেছি। ধিক্‌ ধিক্‌! এই দেশে জন্মেও এতক্ষণ মুখ বন্ধ?
আটচল্লিশ ঘন্টা! মানে ২৮৮০ মিনিট? আর ৬০ দিয়ে যদি গুণ করি তো যা হবে তত সেকেন্ড; –
আচ্ছা, কত সেকেন্ড? এতটা সময় নওজোয়ানদের উৎসাহ দিতে কিছু জ্ঞান বিতরণ না করে
রয়েছি! আমার হলটা কী? পক্ষাঘাত নয় তো!
এক পলকে উনি ডিসিশন নিলেন—ড্রাইভার, গাড়ি ঘোরাও! এই কলেজটার স্ন্যাপ ইনস্পেকশন
করব।
উনি কলেজে পৌঁছে গেলেন আর ছুটির ঘোষণা হয়ে গেল। ছেলের দল ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে মাঠে
বসে পড়ল। স্থানীয় সরকারি আমলা, মাঠে ঘাটে কড়ি খেলার জুয়াড়ির দল, তাড়িখানায় বসে থাকা
নেশাখোর—সবাই দেখতে দেখতে এসে ভীড় জমিয়ে দিল। বেশ বড়সড় মিটিং হয়ে গেল। এরা না
এলেও মিটিং হত। বক্তা নির্লজ্জ হলে একটা ল্যাম্পপোস্টকেও শ্রোতা বানিয়ে একাই মিটিং করে
নেয়। কিন্তু এখানে তো সত্যি সত্যি ভালরকম মিটিং হল।
ছেলেপুলের ব্যাপারটাই এ’রম। ওদের ক্লাসের মধ্যে আটকে রাখ তো কলেজ হয়, আর ক্লাস থেকে
বার করে খোলা মাঠে ছেড়ে দাও তো মিটিং!
উনি ছেলেদের বোঝালেন যে ওরাই দেশের ভবিষ্যৎ আর মাস্টারদের বোঝালেন যে ওরাই দেশের
ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে। ছাত্র এবং মাস্টার এসব আগে থেকেই জানত। উনি ছেলেদের ধমকাতে
লাগলেন – কেন ওরা, আটচল্লিশ ঘন্টা তো দূর, আটঘন্টাও চুপ করে শুনতে পারেনা। তারপর উনি
টিচারদের ধমকালেন—কেন ওরা ছেলেগুলোকে সংযম শেখাচ্ছে না? উনি নালিশ করলেন—এই

ছোকরাগুলো জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতের বিষয়ে কিচ্ছু জানে না। আর মাস্টারের দল এসব
দেখেও খালি মাগ্যিভাতা বাড়াও, বেতন বাড়াও বলে চেঁচায়।
মাস্টার এবং ছেলের দল এসব নিয়ে তলিয়ে ভাবার আগেই ঊনি অন্য বিষয়ে বলতে শুরু করলেন। সেই
বিষয়, যেটা স্কুল-কলেজে লেকচার দিতে আসা সব মহাপুরুষই না বলে ছাড়ে না।
বললেন—“আমাদের শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। এই ব্যবস্থায় পড়াশুনো করে সবাই খালি ক্লার্ক হতে
চায়”।
ছাত্রদের পরামর্শ দিলেন যে এই শিক্ষা-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা দরকার। উনি অনেক
বিদ্বান, বিশেষজ্ঞ এবং শ’য়ে শ’য়ে সমিতি ও কমিশনের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে বোঝালেন যে
বর্তমান শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। বিনোবাজী এবং গান্ধীজির নামও বাদ পড়ল না। তখন কলেজের
ম্যানেজার বৈদ্যজীও মাথা হেলিয়ে সায় দিলেন-- আমাদের শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। তারপর কলেজের
প্রিন্সিপাল, ওঁর দলের মাস্টার, যত ভবঘুরে, নেশাড়ু সবার মাথা নাড়ানোর পালা। এইভাবেই ওরা
মেনে নিল যে আমাদের শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। এবার উনি বললেন - গত শতাব্দীর শিক্ষা পদ্ধতি
যে ভালো ছিল তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হল সবাই সাত তাড়াতাড়ি বুঝে গেল-- আমাদের শিক্ষা-
পদ্ধতি খারাপ।
ছাত্রদের বললেন যে ওদের উচিৎ চাষ করা, দুধ খাওয়া, শরীর চর্চা করা, আর আগামী দিনের
নেহেরু-গান্ধী হবার জন্য তৈরি থাকা। মুশকিল হল, এসব ছেলের দল ওনাকেও বলতে পারত। এসবের
পর উনি সমন্বয়, দেশের ঐক্য, রাষ্ট্রভাষা প্রেম ইত্যাদি হরেক বিষয়ে এক একটি বাঁধাগতের
বুলি বলে , কলেজের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার বার্ষিক আশ্বাস দিয়ে, কিছু মেওয়া ইত্যাদি খেয়ে,
চা খেয়ে ফের ঘন্টায় সত্তর মাইল বেগে ফুরুৎ হয়ে গেলেন। মাস্টার আর ছাত্রের দল খানিকক্ষণ
ওনার “ভাইয়োঁ ঔর বহেনোঁ’ জাতীয় বাঁধা বুলির নকল করে যে যার ঘরে চলে গেল। ফলে শিক্ষা-
পদ্ধতির আমূল পরিবর্তনের গুরু দায়িত্ব এসে পড়ল কলেজের মালী, চাপরাসি ও মজুরদের ঘাড়ে।
ক্লার্ক মেওয়ার প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখল মাত্র একটা কাজু পড়ে রয়েছে। সেটা তুলে ময়ূখে
দিতে গিয়ে কী ভেবে নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলল।

(চলবে)
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in








তেইশ

লালজি মন্দির চত্বরটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। লম্বা-চওড়ায় ৫৪ ফুট বর্গাকার মন্দিরটি প্রায় চার ফুট বেদির ওপর অবস্থিত। মন্দিরের সামনে আছে চারচালা নাটমন্দির। চত্বরে প্রবেশপথের উপরে আছে নহবতখানা। বাঁ-দিকে রয়েছে পর্বত আকৃতির গিরিগোবর্ধন। মূল মন্দিরের চারদিকে চারচালা ছাদযুক্ত দীর্ঘ এবং ত্রিখিলান বারান্দা আছে। প্রথম তলের ছাদের চার কোণে সৃষ্ট খাঁজে তিনটি করে---দুটি চূড়া সমউচ্চতায় এবং মাঝেরটি একটু পেছোনো অবস্থায় সমতল করে বসানো আছে। দক্ষিণমুখী মন্দিরের সম্মুখভাগে আছে ত্রিখিলান প্রবেশদ্বার। মন্দিরের সম্মুখভাগ টেরাকোটা অলংকরণ সমৃদ্ধ। রামায়ণ, নানা পৌরাণিক কাহিনির ফলকের পাশাপাশি নামের সঙ্গে সাজুয্য রেখে মন্দিরের টেরাকোটা অলংকরণের অনেকটা অংশ জুড়েই আছে কৃষ্ণলীলার নানা কাহিনির প্রতিফলন।

লালজি মন্দিরের বর্তমান বয়স ২৮০ বছর। ১৯৫৪ সালে জমিদারি উচ্ছেদের পর রাজবাড়িচত্বর প্রায় ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছিল। তার অন্তত ৪৫ বছর পর সমগ্র চত্বরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কলকাতা মণ্ডল অধিগ্রহণ করে। চত্বরের সৌন্দর্যায়নের কাজটি চমৎকারভাবে হলেও স্থাপত্য রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নন সাধারণ মানুষ।

রিমির মনটা আনবাড়ির আঙিনার ধুলোয় বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে মনটা।সকালে উঠে সমীরণের উঠোন ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে।তুলসীতলায় প্রদীপ দেয়।বিপিন ও সমীরণ হরিনাম করে।রিমি খোল বাজায়।

পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার অন্তর্ভুক্ত এই সতীপীঠ আমার জন্মস্থান বড়পুরুলিয়া গ্রামের কাছাকাছি। তাই বারবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে সতীপীঠে।

সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞে সতী শিবের নিন্দা সহ্য করতে না পেরে আত্মাহুতি দেন। এর পর মহাদেব কালভৈরবকে পাঠান দক্ষকে বধ করতে। সতীর দেহ নিয়ে তিনি শুরু করেন তাণ্ডবনৃত্য। ফলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ বিভিন্ন ভাগে খণ্ডিত করেন। এই অংশ গুলো যেখানে পরেছে সেখানে মন্দির তৈরি হয়েছে। এগুলোকে সতীপীঠ বা শক্তিপীঠ বলে। এগুলি তীর্থে পরিণত হয়েছে। পীঠনির্ণয়তন্ত্র তন্ত্র মতে দেবীর বাম বাহু পড়েছিল বহুলায়। পরে রাজা চন্দ্রকেতুর নামানুসারে এই গ্রামের নাম হয় কেতুগ্রাম ।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন।সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব এই দেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তান্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খন্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহ খন্ড গুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। সেই রকমই একটি সতীপীঠ হলো “বেহুলা” বা “বহুলা” সতীপীঠ।অন্নদামঙ্গল গ্রন্থে এটিকে আবার “বাহুলা” পীঠ বলে উল্লেখ করা আছে এবং এখানের অধিষ্ঠিত দেবীকে “বাহুলা চন্ডিকা” বলা হয়েছে। আবার “শিবচরিত গ্রন্থ” অনুযায়ী কেতুগ্রামেরই ‘রণখন্ড’ নামে একটি জায়গায় সতীর ‘ডান কনুই’ পড়েছে। এখানে অধিষ্ঠিত দেবীর নাম বহুলাক্ষী ও ভৈরব মহাকাল।

বর্ধমানের কাটোয়া থেকে সতেরো কিলোমিটার দূরে কেতুগ্রামে বহুলা সতীপীঠ অবস্থিত। অনেক বছর আগে এই গ্রামে তিলি বংশজাত ভূপাল নামক এক রাজা বাস করতেন। সেই রাজার একটি ছেলে ছিল, তার নাম চন্দ্রকেতু। মনে করা হয় চন্দ্রকেতুর নামেই এই গ্রামের নাম হয়েছে কেতুগ্রাম। প্রাচীনত্ত্বের বিচারে এই কেতুগ্রামের বয়স অনেক। অনেকের মতে এই কেতুগ্রামেই জন্মেছিলেন নানুরের বিশালাক্ষী-বাশুলি দেবীর উপাসক চন্ডীদাস। এই গ্রামে ছিল তার আদি বাসস্থান। এই কেতুগ্রামের উত্তরদিকের একটি জায়গাকে স্থানীয় মানুষজন চন্ডীভিটা বলে সম্বোধন করে থাকে। গ্রামেই অবস্থান বহুলা মায়ের মন্দিরের। রাও পদবিধারী জমিদারেরা বহুলা দেবীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। বর্তমানে মন্দিরের যে সেবাইতরা রয়েছেন তারা এই রাও জমিদারদের বংশধর। এই কেতুগ্রামে “মরাঘাট মহাতীর্থ” বলে একটি জায়গা রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে শিবচরিত গ্রন্থে রণখন্ড বলে যে জায়গার উল্লেখ করা আছে সেটি আসলে কেতুগ্রামের মরাঘাট মহাতীর্থ নামক জায়গাটি। এখানেই দেবীর দেহখন্ড পড়েছিল। এই মরাঘাটের পাশ দিয়ে ছোট নদী বয়ে গেছে। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে মরাঘাট মহাতীর্থ অনেক বছর আগে শশ্মান ছিল। শশ্মানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে মৃত শিশুদের দেহ পোঁতা হতো। এখানে অনেক সাধক সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন। এখানেই রয়েছে দেবীর ভৈরব ভীরুক। তবে এটা নিয়ে মতান্তর আছে। অনেকের মতে কেতুগ্রামে বহুলা দেবীর সাথেই ভৈরব ভীরুকের অবস্থান। আবার অনেকের মতে কেতুগ্রাম থেকে একটু দূর “শ্রীখন্ডে” আছে মায়ের আসল ভৈরব ভীরুকের লিঙ্গ ও মন্দির।

সমীরণ বলে,গ্রামে মায়ের যে মন্দির আছে, সেটিকে নতুন ভাবে সংস্কার করা হয়েছে। মন্দিরে দেবীর মূর্তিটিকে একটি কালো পাথরের উপর স্থাপন করা হয়েছে। দেবীর মুখ বাদে সারা শরীর সুন্দর বস্ত্র দ্বারা আবরণ করা থাকে। মায়ের মূর্তির চারটি হাত। মায়ের পাশেই রয়েছে অষ্টভুজ গণেশের মূর্তি। গণেশের এই মূর্তিটি অনেক পুরানো। মা এখানে স্বামী পুত্র নিয়ে একসাথে বাস করেন। এখানে দেবীর নিত্য পুজো করা হয়। মাকে রোজ অন্নভোগ দেওয়া হয়। মন্দিরের পাশে একটি পুকুর আছে, অনেকের বিশ্বাস এই পুকুরে অবগাহন করলে রোগ ভালো হয়ে যায়।
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





















১৯.১

জানুয়ারী মাসের আদ্দেক পেরিয়ে গেছে। এরপর ফেব্রুয়ারি এলে গ্রামসভার নির্বাচন হবে। ফের মার্চ মাসে হাইস্কুল আর ইন্টারমিডিয়েট কলেজের পরীক্ষা শুরু হবে। এই নির্বাচন একদিকে শনিচর ও বদ্রী পালোয়ানের কুস্তির আখড়াকে এবং অন্যদিকে রামাধীন ভীখমখেড়ী ও তার জুয়াড়ি সেনাপতিদের প্রজাতন্ত্রের সেবা করতে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এখন পর্য্যন্ত এদের সেবা করার বিশেষ পদ্ধতি বলতে যা দেখা যাচ্ছে তা হল বিরোধী দলকে পর্দার পেছনে গালমন্দ করা।

সবার আশা ফেব্রুয়ারি এসে গেলে এসব মুখোমুখি শুরু হবে। মার্চের পরীক্ষার কথা? এখনও কেউ ফাঁসে নি। ছাত্রের দল, অধ্যাপককুল, বিশেষ করে প্রিন্সিপাল সাহেব –কারও কোন হেলদোল নেই।

কিন্তু প্রিন্সিপাল সাহেব অন্য এক মামলায় ফেঁসে গেছেন। কিছুদিন আগে, কলেজ কমিটির বার্ষিক সভায় বৈদ্যজীকে সর্বসম্মতিতে ফের ম্যানেজার নির্বাচিত করা হয়। এটা নিয়ে কিছু সদস্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে নালিশ করেছেন। ওদের বক্তব্য—প্রস্তাবের বিরোধী সদস্যদের সভায় ঢুকতেই দেওয়া হয়নি, বরং আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ধমকানো হয়েছিল।

এই কথাটা চিঠিতে এত ফেনিয়ে লেখা হয়েছে যে ওটা পড়াই এক কঠিন কাজ। আর পড়লেও বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ, চিঠির পুরো বিবরণ সত্যি হলে মেনে নিতে হয় যে শিবপালগঞ্জে কোন নিয়ম কানুন নেই, থানা-পুলিশ বলতে কিছুই নেই, ওখানে গোটা চারেক গুণ্ডা মিলে যা খুশি তাই করে চলেছে।

এটা স্পষ্ট-- এই নালিশ যে মিথ্যে সেটা বুঝতে কোন তদন্তের আবশ্যকতা নেই। তবু বিরোধী পক্ষের কিছু সদস্য শহরে গিয়ে ওই নালিশের কপি করে শিক্ষা বিভাগের বড় বড় অফিসারের টেবিলে জমা করে ফিরে এল। তারপর গাঁয়ে এসে রটিয়ে দিল যে নালিশের তদন্ত করতে ডিপ্টি ডায়রেক্টর অফ এজুকেশন পদের অফিসার করবেন।

উনি নাকি সাদাসিধে গরু। কিন্তু এবার বৈদ্যজীর বাপেরও সাধ্যি নেই যে ওনাকে দুইয়ে নেবে। কারণ উপর থেকে সঠিক তদন্তের হুকুম জারি হয়েছে।

প্রিন্সিপাল সাহেবকে ফাঁসাতে ওইটুকুই যথেষ্ট। উনি জানেন যে তদন্তের দিকটা বৈদ্যজী নিজে দেখবেন। কিন্তু তদন্ত শুরু হলে হাকিমদের আনাগোনা লেগে থাকবে। সেসব প্রিন্সিপালকেই সামলাতে হবে। হাকিম কলেজে এলে সবার আগে কী দেখবেন? প্রিন্সিপাল নিজেকে উত্তর দিলেন— কলেজ ভবন।

এবার উনি ভবনের সৌন্দর্য বাড়াতে কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন।

শহরে গিয়ে দেখে এসেছেন-- একটা ছোট চারাগাছ পুঁতে তার চারদিকে ইঁট দিয়ে গোল ঘিরে লাল -সাদা রঙ লাগিয়ে দিলে অবহেলায় পড়ে থাকা মাঠ কেমন বাগান সেজে ঝলমলিয়ে ওঠে! ভাবলেন, কলেজের সামনে একসারি গুলমোহর আর অমলতাস গাছ লাগিয়ে দেয়া যাক। আর হাকিমের দলবল আসার আগেই নানারঙের ইঁট দিয়ে ঘিরে দেয়া যাক।

ওঁরা আসার সময় দেখবেন নানারঙে সেজেওঠা সাফ-সুতরো কলেজভবন এবং ফিরবেন একপেট ফার্স্ট ক্লাস চা এবং নাস্তা গিলে। তাহলে আর আমার বিরুদ্ধে কী রিপোর্ট দেবেন?

প্রিন্সিপাল সাহেব এসব ভেবে জানুয়ারির হাড়কাঁপানো শীতের অজুহাত ঝেড়ে ফেলে কাজে নেমে পড়লেন। গাছ লাগাতে বছরের যে কোন সময় উপযুক্ত বটেক—চুলোয় যাক বৈজ্ঞানিক লেকচারবাজি!

উনি কলেজের পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে গর্ত খোঁড়ার তদারক করছিলেন। ওনার হাতে দুটো বই—একটা মোটা আর একটা পাতলা—দেখামাত্র মনে হবে খুব দামি। । পরনে ওনার প্রিয় কেজো পোশাক, অর্থাৎ মোজাছাড়া জুতো আর হাফপ্যান্ট। লোকে দেখে যাই ভাবুক, উনি এই পোশাকে নিজেকে বেশ চটপটে এবং চালাক ভাবেন। বইদুটোকে উনি পোষা বেড়ালের মত আদর করে ধরে আছেন।

একজন মজুর কোদাল-গাঁইতি চালানো থামিয়ে ওনাকে বলল, ‘দেখে নিন মাস্টার সাহেব, গর্ত তো এতটাই হবে’?

প্রিন্সিপাল মাথা নেড়ে বললেন, ‘হুঁহ্‌ এটা কোন গর্ত হল? একটা পাখি মুতে দিলেই উপচে পড়বে। খুঁড়ে চল বেটা, এখনও অনেক বাকি’।

এসব বলে উনি পাশে দাঁড়ানো এক মাস্টারের দিকে দর্পভরে তাকালেন। মাস্টারমশায়টি ওঁর আগে থেকেই চেনা, কারণ সে এনার খুড়তুতো ভাই। তিনিও এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলেন শত্রুপক্ষের কোন মাস্টার কাছাকাছি আছে কিনা। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে আত্মীয় ঢঙে বললেন—ভাইয়া, এই কলেজে তুমি তো এখন উদ্যান-বিশারদ!

প্রিন্সিপাল বইদুটো বুকে ঠেকিয়ে বললেন, ‘সবকিছু এদের জন্যে সম্ভব হয়েছে। তবে ব্যাটারা বড্ড কঠিন সব ইংরেজি লিখেছে। বুঝতে গেলে সাধারণ-বুদ্ধির মাথা বোঁ- বোঁ করে ঘুরবে’।

খুড়তুতো ভাই উবাচ, ‘আপনি তো লৌহপুরুষ! কলেজের এত এত কাজ, পলিটিক্সে মাথা গরম হয়ে যায়। তারপর আপনি বইও পড়ে ফেলেন! আমার তো অবস্থা হল কেউ বই পড়তে না বলুক, বরং দশ ঘা জুতো মারুক। বই দেখলে গা গুলোয়’।

প্রিন্সিপাল ফিফটি পার্সেন্ট বড়দা এবং বাকি ফিফটি পার্সেন্ট প্রিন্সিপাল হয়ে বললেন- ‘চুপ কর। এসব বলতে নেই। সফরের সময়ও বই সঙ্গে রাখি। শুধু কোট-প্যান্ট পড়লে কী হবে? তাই দেখে কেউ তোমায় অধ্যাপক বলবে ভাবছ? কোট প্যান্ট তো কুঁজো বামনও পরতে পারে’।

ভাই বলল, ‘আপনিই ঠিক। মাঝখানে বাধা দেয়া আমার স্বভাব নয়। কিন্তু আমাদের আর কুঁজো-বামনের মধ্যে তফাৎ কোথায়? এই শালার টেক্সট বুক, বুঝে নিন, পচাগলা ফল ছাড়া কিছু নয়। আমরা ছোঁড়াদের পেটে এগুলো ঠুঁসতে থাকি। কারও হজম হয়, কেউ বমি করে ফেলে’।

প্রিন্সিপাল হেসে ফেললেন। ‘কথাটা অনেক দূর অব্দি নিয়ে গেলে। কিন্তু অতি বুদ্ধিমানের মরণ নিশ্চিত’।

কথাটা বলে উনি গর্ত কতটা গভীর হল উঁকি মেরে দেখতে লাগলেন। যেন কোন বুদ্ধিমানের মরণ হলে তাঁকে এই গর্তেই কবর দেবেন।

এমনসময় ওখানে আগমন হল খান্না মাস্টারের। উনি হড়বড় হড়বড় করে এসে প্রিন্সিপালের হাতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন—নিন, ধরুন।

প্রিন্সিপাল একবার সাহায্যের আশায় তুতো ভায়ের দিকে তাকালেন। তারপর গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে কঠোর মূর্তি ধরে অফিসারি মেজাজে বললেন—এটা কী?

--কী আবার! একটা কাগজ।

ওর দিকে বুক চিতিয়ে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন দেখে খান্না মাস্টার হিতৈষী স্বরে বলল—দিন, পড়ে শোনাচ্ছি।

--‘যান, নিজের কাজ করুন। আমাকে পড়ানোর কষ্ট নাই করলেন’। এসব উনি ঘেন্না মিশিয়ে বললেন।

খান্না দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল—এই জন্মে পড়ানোর হাত থেকে রেহাই কোথায়!

তুতো ভাই খান্না মাস্টারকে একদৃষ্টিতে দেখছিল। মালিকের বাংলোর ভেতর থেকে পোষা অ্যালসেশিয়ান রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলোকে যে চোখে দেখে। প্রিন্সিপাল অনেকক্ষণ ধরে কাগজের টুকোরোটার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে রইলেন। প্রাচীনকালের ঋষিমুনি হলে কাগজটা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যেত। খানিকক্ষণ পরে উনি ওই কাগজটাকে খান্না মাস্টারকেই ফেরত করে দিলেন।

খান্না রেগে গেল। ‘এটা কী’?

--‘কী আবার, কাগজ’। এবার প্রিন্সিপাল মন দিয়ে গর্তের গভীরতা দেখতে লাগলেন।

খান্না মাস্টার ঠোঁট কামড়ে গলার স্বর নামিয়ে বলল, ‘যাই হোক, লিখে আবেদন দিয়েছি। আপনার আদেশ ওই আবেদনের উপর লিখে দিতে হবে’।

প্রিন্সিপাল একজন মজুরের সঙ্গে কথা বলছিলেন-‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার থাম। আবে, গর্ত খুঁড়ছিস, কুয়ো নয়। ঢের হয়েছে’।

খান্না খানিকক্ষণ চুপচাপ। ফের মুখ খুলল,’আমি চারদিনের জন্য বাইরে যাব। ছুটি চাই। আপনি লিখে হুকুম দিন’।

প্রিন্সিপাল পায়ের পাতায় ভর দিয়ে গর্তের পাশে জমা ভিজে মাটির উপর বসেছেন। যাদের চোখ আছে, তারা দেখুক—কলেজের স্বার্থে উনি কাদা হোক, নালা-নর্দমা হোক, কিছুরই পরোয়া করেন না। এবার উনিমাটিকাটা মজুরদের গর্তের চারপাশে উঁচু করে আল বাঁধার ব্যাপারে বিস্তারিত নির্দেশ দিতে লাগলেন।

খান্না মাস্টারের কথাবার্তা এবার পার্শ্বসংগীতের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। তিনিও গর্তের উলটো পাড়ে পায়ের পাতায় ভর করে বসে বলে উঠলেন—‘ গর্তের ভেতর লাফিয়ে পড়ার আগে আমার কথার জবাব দিয়ে যান’।

প্রিন্সিপাল ওর দিকে খোলাচোখে তাকালেন। বললেন—‘ আগে তোমাকে ধাক্কা দিয়ে গর্তে ফেলব, তারপর তোমার উপর লাফিয়ে পড়ব। বুঝলে হে খান্না মাস্টার’! ডায়লগ মেরে উনি তুতো ভাইয়ের দিকে তাকালেন। ভাইটি একেবারে বিনয়ের অবতার হয়ে নম্রস্বরে বলল-‘যাই, চাপরাশিদের ডেকে আনি। মনে হচ্ছে ভালরকম ঝগড়া ঝঞ্ঝাট হবে। কিন্তু আমার দিব্যি, আমি ফিরে না আসা পর্য্যন্ত আপনি কিছু বলবেন না’।

--‘আমি আর কী বলব ভাই! সবকিছু মুখবুজে সহ্য করে যাচ্ছি। যেদিন ওর পাপের ঘড়া পূর্ণ হবে, সেদিন নিজে থেকেই ভক্‌ করে ফাটবে’।

প্রিন্সিপাল খান্না মাস্টারকে শাপ দিলেন নাকি? ও বেশ ঘাবড়ে গেল। ওর ভয় প্রিন্সিপাল হঠাৎ চেঁচাতে না শুরু করে—খান্না আমার গায়ে হাত তুলেছে। তারপর খান্না মামলা মোকদ্দমায় না ফেঁসে যায়!

ও চুপচাপ উঠে গর্তের থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মাস্টারের কাছে গেল। তারপর গোটা দুনিয়াকে শুনিয়ে চেঁচাতে লাগল—ভয় দেখাবেন না মাস্টার সাহেব, ধমকি দেবেন না। এটা নবাবী আমল নয়। এত সহজে খান্নার প্রাণ যাবেনা। বলে দিচ্ছি, আমার গায়ে হাত তুলেছেন তো রক্তগঙ্গা বইবে। এই বলে দিলাম, হাঁ!

খান্না ঠিক চেঁচাতে চায়নি। কিন্তু জোর গলায় বলতে গিয়ে ব্যাপারটা চেঁচানোর স্তরে পৌঁছে গেল। কয়েকজন মাস্টার এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না। খান্না হঠাৎ বিকট চিৎকার করে উঠল—‘মারুন, মারুন না আমাকে! ডেকে আনুন যত চাপরাশির দল। ওদের হাতেই আমার অপমান হোক। থেমে গেলেন কেন’?

খাসা তামাশা জমেছে। এই সত্যি কথাটা বোঝার তাগিদে দুই দলের কিছু মাস্টার দুদিকে জড়ো হল। ছাত্রের দল এখনও আসেনি। যে দু একটা এসেছিল, তাদের চাপরাশিরা আগে থেকেই ভাগিয়ে দিল। ওরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখতে পাচ্ছিল। তবে এই তামাশা সেরেফ ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ হয়ে গেল।

প্রিন্সিপল সাহেব এই আচমকা আক্রমণে প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেছলেন। তারপর ঠেলে ওঠা ক্রোধকে সংযত করে খান্নার কাছে গেলেন। ছুটির দরখাস্তটি ছিনিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন—‘চেঁচিও না খান্না মাস্টার! তোমার বুঝতে ভুল হয়েছে। দাও, দরখাস্তের উপর আদেশ লিখে দিচ্ছি’।

ওঁর ইশারায় তুতোভাই মাস্টার একটা ফাউন্টেন পেন বাড়িয়ে দিল। উনি হাতের হর্টিকালচারের বইটার উপর ছুটির দরখাস্তটি রেখে তার উপর খসখস করে কলম চালাতে লাগলেন। লিখতে লিখতে বললেন—‘আমাদের লড়াই নীতির। এর মধ্যে মারপিটের কথা উঠছে কেন? ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে’।

খান্না মাস্টার নিজের খাড়া করা তামাশায় নিজেই ক্লান্ত হয়ে বলল,-‘আগে এই দরখাস্তের ওপরে হুকুম লিখুন। তারপর বাকি কথা’।

তিনি মুচকি হেসে জানালেন,-‘সেটাই করছি’।

কয়েকটা শব্দের উপর উনি ‘ক্রস’ চিহ্ন লাগালে। অন্য কয়েকটায় গোল করে ঘিরে দাগিয়ে দিলেন। শেষে বড় করে ইংরেজিতে একটা শব্দ লিখলেন—‘রিজেক্টেড’!

খান্না মাস্টারের মুখ থেকে কোন শব্দ বেরোনের আগেই তিনি দরখাস্ত ওকে ফেরত দিয়ে বললেন—স্পেলিংয়ে অনেকগুলো ভুল। ‘হলিডে’ শব্দে ‘এল’ অক্ষরের পরে ‘ওয়াই’ লেখা হয়েছে। ‘খান্না’ শব্দে ‘কে’ অক্ষরটা ক্যাপিটালে লেখা নাকি স্মল বোঝা দায়। এসব খেয়াল করা উচিত’।

খান্না বাকশক্তিরহিত। তারপর হঠাৎ গণ্ডারের মত মুখ খুলে গর্জন করে উঠল—‘ একবার কলেজের বাইরে আয়! তোর সমস্ত স্পেলিং ওখানেই শিখিয়ে দেব’।

ব্যস্‌ মহারণ শুরু।
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in







সুপ্রিয়বরেষু বাসু,

অফিসের কাজে শহরের বাইরে ছিলাম প্রায় একমাস। তাই তোমার চিঠির উত্তর দিতে দেরী হলো। তুমি নিশ্চয়ই পাহাড় থেকে ফিরে এসেছো। কদিন আগেই যাকে বিগত যৌবনা বলে উপহাস করলে তাকেই লিখছো চিরনতুন বৃদ্ধা এ কেমন কথা? ভীমরতি ধরেছে নাকি মশাই! অবশ্য তোমারও তো বয়স হয়েছে এই বয়সে শুনেছি প্রায় পুরুষের কিছু চারিত্রিক ভীমরতি ঘটে, তোমারও কি তাই হলো নাকি বিগত যৌবনা বলে অনুশোচনায় ভুগছো? বছরের প্রথমেই শহরের বাইরে যাবার তাড়া ছিলো তাই নতুন বই কেনা হয়নি। বহুবছর পরে এয়ারপোর্টে কার সাথে দেখা হয়েছে শুনলে তোমার মনে দোলা লাগবে। কলেজের দিনগুলিতে যাকে একপলক দেখবে বলে তুমি ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যান্টিনে বসে থাকতে তোমার সেই চির যৌবনার সাথে দেখা হলো। স্বামী পুত্র নিয়ে দারুন সংসারী সে। তোমার কথা জিজ্ঞাসা করেছে খুটেখুটে আজও সংসারী হওনি শুনে মনে হলো কষ্ট পেয়েছে খুব। ওর সাথে ঘন্টাখানেকের সাক্ষাতের পরে আমার মনে হয়েছে নারীর জীবন ব্যক্তিগত নয়, পুরোপুরি রাজনৈতিক। দেশকেও তো আমরা মায়ের রূপে দেখি অর্থাৎ সেই নারী আর তাই হয়ত তারও ব্যক্তিগত কিছু নেই যা আছে তা পুরোপুরি রাজনৈতিক তা হোক ভারতবর্ষ,বাংলাদেশ, সিরিয়া কিংবা অন্য যেকোন দেশ। শহীদুল জহিরকে তোমার মতন করে গভীরভাবে আমার পড়া হয়নি তবে তোমার চোখে তাকে দেখে আরো গভীরভাবে তাকে পড়ার ইচ্ছে জেগেছে প্রবলভাবে তা স্বীকার করি। বাংলাদেশকে দেখার কথা যদি বলো তাহলে সবচেয়ে বেশি আমি দেখেছি সেলিনা হোসেনের লেখায়। ফ্রানৎস ফানো বলেছেন অতীত নয়, যে-অগ্নিগর্ভ বর্তমানের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, যা এ-মুহূর্তে আকার পাচ্ছে, সে-সময়কেই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখার কথা একজন সংবেদনশীল লেখকের সেটাই তো আত্মনির্ধারিত অন্বিষ্ট। শহীদুল জহির তেমনই একজন লেখক অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবু কেন জানি আমাকে বেশি টানে সেলিনা হোসেন। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা গভীরভাবে যেসব লেখকের রচনায় মূর্ত হয়ে উঠতে শুরু করে, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তাঁদেরই একজন। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি কিন্তু বাবা মা ও আত্মীয় স্বজনের মুখে এত গল্প শুনেছি আমার এখনো মনে পড়ে স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের ভাতঘুমের আগে ঠাকুরমার কাছে রোজ মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার দিনগুলি। মুক্তিযুদ্ধ প্রীতির জন্যই কিনা জানিনা বাবা সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬) বইটি কিনে দিয়েছিল বইমেলা থেকে। সেই জন্যও সেলিনা হোসেন আমার প্রিয় হতে পারেন। তুমি নিশ্চয়ই সেলিনা হোসেনের বহু লেখা পড়েছো। হাঙর নদী গ্রেনেড পড়ার পরে আমি সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা বেশকিছু উপন্যাস পড়েছিলাম।

বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ বেশি হয়ত পূর্বপুরুষের নাড়িপোতা আছে সেইজন্য কিংবা নিকটতম প্রতিবেশি দেশ বলে, কিন্তু পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখো সর্বত্র জনসাধারণ সমর্থিত ও অংশগ্রহণকৃত যুদ্ধ। ইতিহাস জানায়, এই সভ্য পৃথিবীতে একটি দিনের জন্যেও কখনো যুদ্ধ বন্ধ হয় নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজায় রাজায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রশাসকবৃন্দ নিজেদের প্রতিহিংসা, লোভ মেটাতে জনগণকে ছুড়ে ফেলেছে ক্ষুধার্ত

বাঘের খাঁচায়। এরিক মারিয়া রেমার্কের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এ দেখা যায়, দেশের যুবকরা বাধ্য হচ্ছে যুদ্ধে যেতে। সেই যুদ্ধ গৌরবের অনুভূতির পরিবর্তে তাদের দিয়েছে ক্লান্তি আর ঘৃণাবোধ। যুদ্ধ থেকে তারা ফিরেছে একরাশ হতাশা আর অর্থহীনতার বোধ সঙ্গে নিয়ে। ছাত্র রাজনীতি করলেও আমি যে তুখোড় রাজনীতিবিদ তেমনটা একদমই না। তবে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির কিছু গলদ অবশ্যই আছে। যা বাংলাদেশে ঘৃণাকে বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির কাল থেকেই ভারত এককভাবে আওয়ামী লীগকে অন্ধভাবে সমর্থন করেছে যা এতবড় গণতান্ত্রিক দেশের কুশলী পরারাষ্ট্রনীতি হতে পারেনা কোন ভাবেই।

বাংলাদেশের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানকে ছাত্ররা বলছে নতুন স্বাধীনতা। এটা একটা রাজনৈতিক পন্থা হলেও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম গণঅভ্যুত্থানের পরে অস্বীকার করতে চাইছে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। তাঁর ভাষণ পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার সংগ্রামের বীজমন্ত্র হয়ে উঠে। কালজয়ী এ ভাষণ বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষকে সবসময় প্রেরণা জুগিয়ে যাবে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে সেলিনা হোসেনের একটি উপন্যাস আছে 'সাতই মার্চের বিকেল'। এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা দুজনেই একাত্তরে রমনার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছে। ইতিহাসের সেই অগ্নিঝরা বিকেলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। লেখিকা উপন্যাসে দেখিয়েছে, নায়ক-নায়িকা যুদ্ধের পরে আবারও রমনার রেসকোর্স ময়দানে চলে আসে। মেয়েটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে গর্ভবতী হয়েছে। ছেলেটি মেয়েটিকে দেখে বলল, যুদ্ধের আগে আমাদের প্রেম ছিল। আমিতো তোমাকে এখনো একইভাবে চাই। তখন মেয়েটি বলে, আমার এই অবস্থাতেও তুমি আমাকে গ্রহণ করতে সম্মত আছো? ছেলেটি জানায়, গর্ভের সন্তানের দায়িত্ব নিতেও সে রাজি। গর্ভের সন্তানটি যেহেতু কোনো কিছুর জন্য দায়ী নয়, তাই তাকে গ্রহণ করতে তার আপত্তি নেই। তখন তারা দুজনে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যায়। বঙ্গবন্ধু সে সময় বাড়িতে ছিলেন না। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা তখন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বঙ্গমাতাকে জানায়, তারা দুজনে বিয়ে করতে আগ্রহী। যুদ্ধের আগেও তারা ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেত, তাই বঙ্গমাতা তাদের সম্পর্কের কথা জানতেন। তিনি এই নতুন পরিবর্তিত অবস্থায় দুজনের বিয়ে করার বিষয়ে সম্মত হওয়ার খবর জেনে কাজী ডেকে বিয়ে দিয়ে দেন। বঙ্গমাতা তার গলার সোনার চেইন খুলে মেয়েটির গলায় পরিয়ে দিয়ে তাদের আশীর্বাদ করেন। উপন্যাসটি পড়ে আমার মনে হয়েছে সেলিনা হোসেন এটাই দেখাতে চেয়েছেন যে, এসবই বাংলাদেশের সাতই মার্চের অর্জন।

৫ই আগষ্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পরে ৩২ নম্বরের সেই ঐতিহাসিক বাড়িটিতে আগুন দেয়া হয়েছে তারপর ৫ ই ফেব্রুয়ারি সেই বাড়ি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর সব প্রতিকৃতি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে আমার তখন আফগানিস্তানের কথা মনে পড়ছিল। সারাদেশ জুড়ে যে সব তান্ডব চলেছে তা শোনার পর অজানা কষ্ট ঘিরে ধরলেও আমাকে সাহস জুগিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেলিনা হোসেনের ১৯৭৬ সালে লেখা প্রথম উপন্যাস হাঙর নদী গ্রেনেড। এই লেখায় জনযুদ্ধ চিত্রায়নের সার্থক রূপায়ণ পাওয়া যায়। এই উপন্যাসে নেই কোনো রাজনৈতিক চরিত্র, সেনা কর্মকর্তা, কিংবা অসাধারণ কোনো ব্যক্তিত্ব। হলদীগাঁ নামে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম হওয়া বুড়ি নামের মেয়েটির শৈশব থেকে মধ্যবয়স পর্যন্ত বেড়ে ওঠা আর জীবনযাপনের অতিসাধারণ বর্ণনা আছে এতে। বুড়ির বিয়ে হয় বিপত্নীক দুই পুত্রের বাবার সাথে। উপন্যাসের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত হলদীগাঁয়ের নিস্তরঙ্গ কৃষিভিত্তিক গ্রামসমাজের আবহমান ছবি তুলে ধরা হয়েছে। রাজনীতি, মিটিং-মিছিল, দাবি-দাওয়া এসব যেন শহুরে বিষয়, গ্রামজীবনের নিভৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন বহুদূরের প্রসঙ্গ। উপন্যাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে শহর থেকে যুদ্ধ ক্রমশ গ্রামীণ জীবনকে আক্রান্ত করে। হতচকিত গ্রামবাসী বিষয়টা বুঝে উঠতে উঠতেই অনেকখানি ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়। গ্রামের সব যুবকের সাথে বুড়ির সৎ ছেলে সলিম-কলিম যুদ্ধে চলে যায়। বিশেষ পরিস্থিতিতে গ্রামের প্রতিবেশী দুই মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের বহু সাধনার কাঙ্খিত প্রতিবন্ধী পুত্রকে হায়েনার মুখে তুলে দেয় বুড়ি। সলিম-কলিম, বুড়ি কিংবা উপন্যাসে উল্লিখিত অন্য মুক্তিযোদ্ধারা কেউ ডিগ্রিধারী শিক্ষিত কিংবা রাজনীতি সচেতন চরিত্র নয়। কিন্তু এরাই একাত্তরের সিংহভাগ জনতা, যারা মাতৃভূমি বাঁচাতে নিত্যকার ঘর-গৃহস্থালি ফেলে কাস্তে-লাঙলের বদলে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। এই গল্পের আরেক ধরনের যোদ্ধার উপস্থিতি সম্পর্কে না বললেই নয়। বুড়ির বাল্যসখী নীরা ছিল বাউল দলের সদস্য। সারাদেশ ঘুরে দোতারা হাতে গান গাইত সে। গ্রামের রাজাকাররা তাকে প্রাণের হুমকি দিয়ে দোতারা কেড়ে নেয়, কারণ গানের ভেতর দিয়ে সে দেশমাতৃকার কথা বলছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূলত বায়ান্নের ভাষা সংস্কৃতি বাঁচানোর লড়াইয়ের ধারাবাহিক ফলাফল। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাওয়া, ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা, সবশেষে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড প্রমাণ করে দেয় যুদ্ধটা কেবলই ভূমি দখলের নিমিত্তে ঘটে নি। একটি জাতির মস্তিষ্ককে ধৌতকরণের মাধ্যমে দাসে পরিণত করাটাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেবল সশস্ত্র যুদ্ধ হলে এত দ্রুত স্বাধীনতা লাভ করা যেত না সম্ভবত, যদি না আব্দুল মান্নান আর আরজাতুন্নেসার মতো স্বেচ্ছাসেবকেরা কোনো প্রাপ্তির আশা না রেখে জনতার কাতার থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। কসবার কুল্লা পাথর এলাকার এই দুজন বাসিন্দা ইতিহাসস্বীকৃত চরিত্র। যুদ্ধের নয় মাস এই দুজন শহিদদের লাশ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে উপযুক্ত মর্যাদায় দাফন করেন। আব্দুল মান্নান এবং আরজাতুন্নেসার জন্য বহু শহিদের লাশ বেওয়ারিশ হয়ে যায় নি। লাশ ধোয়ানোর সেই চৌকি আজও ইতিহাসের স্বাক্ষ্য দেয়। আর তাতেই বলতে সাহস পাই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আদতে অসাম্প্রদায়িক, হয়ত এখনও।

তেমনি ‘ঘুমকাতুরে ঈশ্বর’উপন্যাসে নদীভাঙা মানুষের জীবনের দুঃখগাথা দিয়ে যে কাহিনির শুরু, সেইসব উপকাহিনির যোগসূত্র ঘটে একটি গণকবরের কাছে এসে। লেখক দেখাতে চান যে দেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় হয়ত যে কোনো উপায়ে আরো অধিক পুঁজি গড়তে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার জীবন বেছে নিয়েছে, যার ফলে দেশাত্মবোধ তাদের কাছে এখন লোকদেখানো আনুষ্ঠানিকতার নামান্তর। কিন্তু এই দেশেরই যেসব অতি সাধারণ জীবনযাপন করা মানুষের অবদানের কারণে একাত্তরে বিজয় এসেছিল, তাদের জন্য আজও স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের বোধে একাত্ম হওয়ার বিকল্প নেই। একতার শক্তিই পারবে মানবেতর জীবনযাপন করা এইসব মানুষের জীবনে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বয়ে এনে দিতে। আর নওরতন বেওয়া সেই মানুষ, যিনি পেরেছেন স্বদেশ ও স্বাধীনতার প্রতিকৃতিরূপে নিজেকে দশগ্রামের মানুষের কাছে দাঁড় করাতে। তাই তার বাড়িতে যারা আসে, তারা বলে, ‘শহীদের লাগি মোরাই তো কাঁদুম। শহীদের লাগি কাঁদলে মাটি, আকাশ, বাতাস খুশি থাকবে। নইলে মোগ উপর গজব নামবে। মাটি ফুঁইসা উঠবে। নদীগর্ভে তলায়ে যাইবে। জলোচ্ছ্বাস মোগরে দুইয়া সাফ কইরা দিবে। আবার ফুঁইসা উঠবে। বজ্রপাত অইবে। মোগরে বেইমান বইলে গালি দিবে। মোরা ধ্বংস অইয়া যামু।’ একটি গণকবর, একটি গণহত্যা দিবস এবং স্মৃতিসৌধরূপী নওরতন বেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রতীকায়িত করা হয়েছে, যে দেশের শেকড় ‘একাত্তর’ নামক একটি সময়ে প্রোথিত রয়েছে। শেকড়ে ফিরতে পারলে, নওরতন বেওয়ার মতো স্বাজাত্যবোধ আর স্বদেশপ্রেম ধারণ করতে পারলে অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব কিছু নয়। অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব হলে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমবে, অনেক মূল্যের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে উঠবে।

তোমার নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে বাংলাদেশের সমসাময়িক গণঅভ্যুত্থানকে কেন আমি সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস দিয়ে দেখছি। আসলে আমি তোমার মন জগতে যে ঢেউ উঠেছে তার হাহাকারের সাথে একাত্ম বোধ করছি কিন্তু অসাম্প্রদায়িক ও সরলমনা সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের প্রতি বিশ্বাস রাখছি সেলিনা হোসেনের লেখা থেকে কেননা গল্প-উপন্যাসের বিষয় ও চরিত্রের অনুসন্ধানে সশরীরে মাঠে-প্রান্তরে ঘুরে ফেরেন তিনি। উদ্দেশ্য একটিই, যে জীবনের গল্প তিনি নির্মাণ করছেন বা যে চরিত্র তিনি সৃষ্টি করছেন, তা যেন সঙ্গতিপূর্ণ হয়। বাস্তববাদী লেখক হওয়ার ইচ্ছে থেকে তিনি এ কাজ করেন না। এ কাজ তিনি করেন একজন শিল্পীর লড়াই হিসেবে। এই লড়াই তিনি সকল ক্ষেত্রেই করেন। এছাড়া উপন্যাসের বিষয়বৈচিত্র্য খোঁজা তার শিল্পীসত্তার মৌলিক স্বভাব। একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি তাঁর লেখায় খুব বেশি নেই। গল্প-উপন্যাসের বিষয় ও আঙ্গিকের অন্বেষণে রীতিমতো গবেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখি সেলিনা হোসেনকে। সৃজনসত্তার এই বিশেষ প্রবণতা বা আকুতি তার লেখালেখির শুরু থেকেই শুরু। 'পোকামাকড়ের ঘরবমতি' লেখার পূর্বে তিনি সশরীরের জেলেদের ট্রলারে চড়ে গভীর সমুদ্রের গিয়েছিলেন। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি লেখেন-

যে ট্রলারে চড়েছিলাম তার প্রধান জেলে ছিলেন একজন বয়সী মানুষ। চুল-দাড়ি ধবধবে সাদা। মাথায় চুপি। ভেবেছিলাম তিনি আমাকে ট্রলারে উঠতে দিতেই চাইবেন না। দেখলাম তিনি অন্য মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আসেন আসেন। আমি আর আনোয়ার উঠলাম ট্রলারে। ট্রলার যখন গভীর সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে, তিনি গুড়-মুড়ির পোটলা খুলে বললেন, খাবেন মাগো? এই হলো আমাদের সাধারণ মানুষের চিত্র। বিপরীতধর্মী মানুষ নেই তা নয়। তবে এরাই সংখ্যায় বেশি। সেখানে গিয়ে কাহিনী মাথায় দানা বাঁধে। ঠিক করি যে উপন্যাসের নায়ক হবে একজন সাহসী মানুষ, যে হাঙর ধরার স্বপ্ন দেখে। জেলে মালেকের এই স্বপ্নের সঙ্গে ছিল তার প্রেম, দুঃখ-বেদনার গল্প। (গল্পকথা, সেলিনা হোসেন সংখ্যা, রাজশাহী, ২০১৫)

তাঁর এই আত্মকথন প্রমাণ করে তিনি কল্পনাপ্রসূত চরিত্র বিনির্মাণ করেননি, তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা তাঁর নিজ চোখে দেখা ও গবেষণা সৃষ্ট। যা সাধারণের বাস্তব মনজগৎকে তুলে এনেছেন পরম মমতায় বাস্তবসম্মতভাবে। তিনি সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দেখেছেন নিবিড়ভাবে। তাঁর গল্পে শ্রমিক, চাষি, কাঠুরে, রিকশাচালকসহ বিচিত্র পেশার মানুষ উঠে এসেছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে রঙচঙ লাগিয়ে বিস্তর হৈচৈ হচ্ছে দেশের মিডিয়াগুলোয় কিন্তু বিশ্বের কোথায় সংখ্যালঘুরা ভালো আছে বলো তো? আমাদের দেশেও কি বিষ ছড়ানো হচ্ছে না? মানুষকে যতদিন মানুষ পরিচয়ে বিবেচনা না করে ধর্ম বা জাতি দিয়ে বিবেচনা করা হবে ততদিন মুক্তি আসবেনা। বিশেষ করে সংখ্যালঘু শব্দটা যতদিন আছে। সংখ্যালঘুদের জীবন নিয়েও সেলিনা হোসেনের একটি মুক্তিযুদ্ধকালীন উপন্যাস আছে। ‘মাটি ও শস্যের বুনন’ উপন্যাসে দেখা যায়, শ্যামল সবুজ ধমশর গ্রামে ভোর হয় গীর্জার ঘণ্টাধ্বনি শুনে। খ্রিষ্টধর্ম অধ্যুষিত গ্রামের শান্তিপ্রিয় মানুষদের জীবন নারকীয় হয়ে ওঠে পাক বাহিনীর আক্রমণে। ক্ষিতীশ ও মেরিনার কন্যাসন্তান র্ম্চ্ছূনার জন্ম হয় বিকট বোমা বিস্ফোরণের শব্দকে সঙ্গে নিয়ে। পরিবারের অসাম্প্রদায়িক মানবতাবোধসম্পন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত দেশচেতনা ধারণ করেই বেড়ে ওঠে সে। গির্জার ফাদার যোসেফ এবং স্থানীয় মিশনারি হাসপাতালটি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা ও আশ্রয়ের জন্য নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। হাসপাতালে নির্যাতিত নারী পারুলিয়া যুদ্ধশিশুর জন্ম দিয়ে হত্যা করতে উদ্যত হয়। ক্ষিতিশ ও মেরিনার উদ্যোগে শিশুটিকে গ্রামের নিঃসন্তান দম্পতি দত্তক গ্রহণ করে। যুদ্ধশিশুর প্রতি এই অসাধারণ দায়িত্বশীল উপলব্ধি সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়লে পরবর্তীকালে বীরাঙ্গনা এবং যুদ্ধশিশুদের নানাবিধ করুণ পরিণতি বরণ করতে হতো না। হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী চন্দ্রমুখী আহত মুক্তিযোদ্ধার কেটে ফেলা পা সশ্রদ্ধচিত্তে বাগানের মাটিতে পুঁতে রাখে, যেন সেই পা থেকে জন্ম নেবে স্বাধীনতা নামের বৃক্ষ। সেখানে ফুল ফুটবে প্রতিদিন বাংলাদেশ নামে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধে যে বৈষম্যহীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিল তার প্রতিফল ঘটেনি বলে স্বপ্নগুলো যেমন মিথ্যে হয়ে যায়না তেমনি হাজার বছরের সংস্কৃতিকে চাইলেই বদলে ফেলা সম্ভব না। মনে রাখা জরুরি আমাদের সংস্কৃতিতে লোকাচারে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল মন্ত্র ছিল, বাংলার প্রত্যেক মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে জনগণকে মুক্তি দেয়া। বাঙালি হবে একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি। ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মিশ্র আদর্শে এই ভূখণ্ড পরিচালিত হবে। বাংলাদেশের ভৌগলিক অনন্য বৈশিষ্ট এবং বিবিধ নৃতাত্ত্বিক সংমিশ্রণের ফলে এ সংস্কৃতি নিজস্বতা লাভ করেছে। বাঙালির স্বীকরণের ক্ষমতা এত বেশি ছিল যে শাসনতন্ত্র দিল্লি থেকে শত শত মেইল অবস্থানের পরেও শাসকদের অনুশাসন, ধার্মিকদের ধর্মাচার, দার্শনিকদের দর্শন ভাবনা ইত্যাদি যা কিছু বাংলা নামক এ প্রান্তিকে এসে পৌঁছেছে তাই বঙ্গীয় চরিত্র দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে। পাশাপাশি শতশত নদী শাখা নদী এবং বনভূমিতে পরিপূর্ণ বাংলাদশ আবার বহুভাগে বিভক্ত হয়েছে। এ কারণে এ অঞ্চলের সংস্কৃতিও খানিকটা স্বাতন্ত্র্র্য লাভ করেছে। এসব উপসংস্কৃতিও জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং বহু উপ-ভাষার কারণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে। বৈদিক, বৌদ্ধ এবং জৈন ইসলাম ধর্মের মতো প্রধান প্রধান ধর্মের উৎপত্তি এবং স্থান বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে অবস্থিত। সে কারণে এসব ধর্মের আদি অকৃত্রিম রূপ এ অঞ্চলে পৌঁছায়নি; বরং এসব বহিরাগত ধর্মের সঙ্গে স্থানীয় ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচারের এক অদ্ভুদ সমন্বয় ঘটেছে। তাই সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা কথা বলা যায় যে, সংস্কৃতি একটা দেশ তথা অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর শেকড়ের মতো।

‘কাঠকয়লার ছবি’ সেলিনা হোসেনের আরো একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে দেখা যায় চৈতীরাণী নামে এক নির্যাতিত নারীকে, চৈতীরাণী আদিবাসী বাঙালি এবং চাবাগানের শ্রমিক। একাত্তর সালে এইসব প্রান্তিক, অন্ত্যজ শ্রেণি যারা আজন্মকাল বহুবিধ শোষণের শিকার তারাও যুদ্ধে অবদান রেখেছিল নানাভাবে, ইতিহাসে যাদের কথা কোথাও লেখা নেই। যাদের আমরা অনেক সময় অকৃতজ্ঞের মতো বাঙালি বলে পরিচয় দিতেও লজ্জিত হই। চৈতীরাণী তেমন একটি চরিত্রের যে কিনা পাক বাহিনী এবং চা বাগানের বাঙালি ম্যানেজার কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয় এবং দুটো পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। যুদ্ধশিশু দুলালকে অবশ্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে বিদেশি দম্পতির কাছে দত্তক দিয়ে দেওয়া হয়। ‘মাটি ও শস্যের বুনন’ উপন্যাসের পারুলিয়াকে আমরা দেখেছি যুদ্ধশিশুকে ঘৃণার বশে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু এখানে দেখা যায় চৈতীরাণী নবজাতক শিশু হারানোর শোক আজীবন বহন করে চলে। এই উপন্যাসে একাধিক কাহিনির বিস্তারকে ছাপিয়ে যুদ্ধশিশু দুলালের উৎস সন্ধানের নিরন্তর প্রচেষ্টা উপন্যাসের মূল পটভূমি হয়ে পাঠক হৃদয়ে জেগে থাকে। দুলাল তার পালক পিতামাতার কাছে সব জানতে পেরে প্রথমে ভেঙে পড়লেও পরে জন্মদাত্রী মা এবং জন্মস্থান অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে পড়ে। এই খুঁজে ফেরা প্রতিটি যুদ্ধশিশুর জীবনের বেদনাদীর্ণ প্রতিচ্ছবি। বীরাঙ্গনা ও তার যুদ্ধশিশু যুদ্ধের আগে পরে বহুমুখী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। শোকের প্রেক্ষাপটে জেগে থাকে ক্ষত নিরাময়ের অযোগ্য আঘাত ও অপমানের স্মৃতি। পুরো উপন্যাসে দুলালের শেকড় খুঁজে বেড়ানোর আর্তি ও হাহাকার মিলেমিশে যুদ্ধশিশুর বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবায়। নাড়ির টানেই যেন দুলাল খুঁজে পায় মাকে। চারপাশে ঢোলের আওয়াজে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। মৃত্যু সন্নিকট হলেও মাতা-পুত্র দুজনেরই বিসর্জনের বাদ্য যেন হয়ে ওঠে হোলি খেলার উৎসব। এভাবেই লেখক যেন বাংলাদেশের মানুষকে সচেতনভাবে যুদ্ধশিশু আর বীরাঙ্গনা মায়েদের বরণ করে নেওয়ার জন্য উৎসবের আহ্বান করেছেন। যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য নারী নির্যাতন আর যুদ্ধশিশু একটি আদিম মারণাস্ত্র। সেই মারণাস্ত্রকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে দেশবাসীকেই, মন-মানসিকতার পরিবর্তন ও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্যোগের নাম সহিংস ধর্ম সন্ত্রাস বা লুকানো রিলিজিয়াস রেসিজম। এর বিষাক্ত ধোঁয়ায় আজ বাংলার আকাশও আচ্ছাদিত। শান্তিই নাকি পৃথিবীর সকল সম্প্রদায়গত ধর্মের গন্তব্য। তাহলে এই শতাব্দীর দ্বার প্রান্তে এসে এইসব আমরা কি দেখছি? মানুষের কল্যাণের জন্য যে ধর্ম তা নিয়েই কত রাজনীতি,মত বিভেদ, রক্তপাত, অত্যাচার, লাঞ্ছনা আর অশান্তি। ঔপনিবেশিক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের কারণে এই ধর্ম সন্ত্রাসের বীজ অনেক আগেই বাংলার মাটিতে বপন করা ছিল যা এখন বড় মহীরুহে পরিণত হয়েছে।

ইতি-

সুস্মি
১৪ ফেব্রুয়ারি,২০২৫



পুনশ্চ: "আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি।"
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















বের্নহার্ড বেশ ঘাবড়ে গেল। প্রায় কেঁদে ফেলবে সে। এই প্রথমবার সে শুনল যে গের্ট এবং ইনেস একেবারে বয়ে যাওয়া ছেলেমেয়ে এবং এই বন্ধুমহলে মেলামেশা না করাই তার পক্ষে মঙ্গল। এদের সঙ্গে মিশলে বের্নহার্ডের ধ্বংস অনিবার্য। ‘বয়ে যাওয়া’ আর ‘ধ্বংস’ শব্দদুটো শুনে সে বেশ বিরক্ত হল, যদিও উল্টে কিছু বলবার সাহস তার ছিল না। তাছাড়া এই কথাটা তো অগ্রাহ্য করা চলে না যে গের্ট একেবারেই পরিশ্রমী ছাত্র নয়। কিন্তু ইনেসকে এই দলে ফেলা যায় না। সে এইসব নিন্দার উর্ধে। তাছাড়া বাবা তো জানেনও না যে ইনেস তাদের বন্ধুবৃত্তে বেশ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। তবে বন্ধুদের দলের সবাই খারাপ, এটাও সঠিক কথা নয়। কারণ অনেকেই যথেষ্ট পরিশ্রমী, ভাল স্বভাবের এবং নিয়মানুবর্তী…

এই ঘটনার কিছুদিন পরে বের্নহার্ডকে বাড়িতে যাবার কথা বলা হয়েছিল, কারণ তিন সপ্তাহের ছুটি ছিল তার স্কুলে। বাবা বলেছিলেন যে সবকিছু বদলে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। বের্নহার্ড ভেবে উঠতে পারছিল না যে ঠিক কেমন বদল ঘটবে। তার একটু ভয় ভয় করছিল। তাকে গের্ট এবং ইনেসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে গের্টকে একবার ফোন করেছিল এবং জিজ্ঞাসা করেছিল যে তাদের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব কি না।

এই দেখা করবার ব্যাপারটা শেষ অবধি বেশ অদ্ভুত হয়ে দাঁড়ালো। বের্নহার্ড গের্টের বাড়িতে গিয়ে বেল বাজানোর পরে গের্ট নিজে এসে দরজা খুললো। তারপর তার নিজের ঘরে নিয়ে গেল। গের্টের ঘর এমনিতেও বেশ অগোছালো থাকে, আজও তাই। ঘরের কার্পেটে ফ্লক শুয়ে আছে। সে বের্শেনকে দেখে লেজ নেড়ে আহ্লাদ প্রকাশ করল। গের্ট বলল যে ইনেস চলে গেছে কুকুরটাকে রেখে দিয়ে। ‘কুকুর’ বলে উল্লেখ করাটা বের্নহার্ডের ভাল লাগল না। কারণ ফ্লককেও সে বন্ধু বলেই মনে করে। কিন্তু ইনেস চলে গেছে, এটা শুনে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তার হতবাক দশা দেখে গের্ট মজা পেলেও, বের্শেনের মতে ইনেসের চলে যাওয়াটা সত্যি সত্যি একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ফার্দিনান্দের চলে যাওয়া, লাতিন পেপারের পরীক্ষার খারাপ ফল, বাবার সঙ্গে তর্কাতর্কি, সব বিচ্ছিরি ঘটনা ছাপিয়ে গেছে ইনেসের চলে যাওয়া।

-‘ইনেস কোথায় গেছে?’ অবশেষে একেবারে বিধ্বস্ত স্বরে বের্শেন প্রশ্ন করে।

-‘ইংল্যান্ডে গেছে, ওর দিদির কাছে। দিদির বাচ্চা হয়েছে। তিন-চার সপ্তাহের জন্য গেছে।’

-‘হঠাৎ করে যেতে হল?’

‘হ্যাঁ। যাই হোক, তোমাকে বারতিনেক ফোন করেছিল ইনেস। কিন্তু তুমি ছিলে না।’

রাগে, দুঃখে, অসহায়তায় বের্নহার্ড একদম ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। ইনেস তার নামে একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে গের্টের কাছে।

‘প্রিয় বের্শেন,

আমি তোমাকে বিদায় জানিয়ে যেতে পারিনি বলে মন খারাপ করবে না। তোমায় তিন বার ফোন করেও কথা বলতে পারলাম না। আমি জানি না বিষয়টা আসলে ঠিক কী। কিন্তু আমার মনে হল ইচ্ছাকৃত তোমাকে ফোনে ডাকা হয়নি। তুমি যদি এমন কিছু করে থাকো, যেটা তোমার ঠাকুমা কিম্বা বাবা-মায়ের অপছন্দ, তাহলে সেই বিষয়ে তাড়াতাড়ি মিটিয়ে নাও পরিবারের মধ্যে কথা বলে। যদি আমাদের কোনও কাজকর্ম ওঁরা বুঝতে না পেরে থাকেন, সেক্ষেত্রে সেটা বোঝানোর দায়িত্ব আমাদের উপরেই বর্তায়। কারণ, আমাদের সামনে এখন গোটা জীবনটা পড়ে আছে। ভাল থেকো, খুশি থেকো আর আমার চিঠির উত্তর দিও।

ইতি,

তোমার প্রিয় বন্ধু ইনেস’



গের্ট তার কাঁধের উপর উঁকি দিয়ে চিঠিটা পড়ে ফেলেছিল। সে ক্রমাগত জিজ্ঞেস করে যেতে লাগল যে বের্শেন কী এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে।

চিঠিটার দিকে তাকিয়ে বের্শেন বলে… ‘কিচ্ছু না।’

গের্ট চিন্তান্বিত মুখে বের্নহার্ডের চুলে টোকা মারে।

‘কিন্তু কিছু একটা কাণ্ড তো নিশ্চয়ই তুমি ঘটিয়েছ বের্শেন। যদি ইনেস এখানে উপস্থিত থাকতো, তাহলে কি তুমি তাকে সেই কাণ্ডটা বলতে? এখন সে এখানে নেই, ফলে আমি হয়তো বুঝতে পারব না, সেইজন্য বলছ না আমায়?’

বের্নহার্ডকে নিরুত্তর বসে থাকতে দেখে অবশেষে সেও চুপ করে। ধীরে ধীরে তার মাথার চুলে টোকা মারে।

বের্নহার্ড হঠাৎ নিজের হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে হাহাকার করতে থাকে, ফেটে পড়ে দুঃখে… ‘আমায় ওঁরা আর তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে দেবেন না।’

গের্ট সাঙ্ঘাতিক অবাক হয়। বের্শেনকে টেনে নেয় তার কাছে। হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে… ‘এর চেয়ে যদি বেশি কিছু না ঘটে থাকে… তো… কিন্তু ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর!’

‘আগামীকাল আমায় বাড়ি চলে যেতে হবে… ছুটি পড়বে।’

‘খুশি থাকো, বের্শেন, তোমার একটু ছুটি খুব প্রয়োজন!’

‘এবং হয়তো তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমি আর নাও ফিরতে পারি!’

গের্ট চুপ করে বসে থাকে এক মুহূর্ত।

-‘কিন্তু বের্শেন!’ বলে ওঠে গের্ট… ‘আমিও যে এখানে একা থাকতে পারব না। ইনেস চলে গেছে… আবার তুমিও… আমি কী ভাবে থাকব যদি তুমিও এখানে না থাকো?’ গের্ট দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে একদম চুপ করে বসে থাকে। অবাক হয়ে বের্শেন লক্ষ্য করে যে গের্ট অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে আছে। বের্শেন চলে যাচ্ছে বলে গের্টের চোখে জল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বের্শেনের গলা জড়িয়ে ধরে।

শিক্ষকের কাছে চিঠি লেখে বের্নহার্ড ফরাসি ভাষায়,


মঁসিয়ে,

আপনাকে আমার পরিস্থিতি বিষয়ে অবগত করাবার জন্য নিঃসঙ্কোচে এই পত্র লিখছি। আপনি যখন পারী নগরে গিয়েছিলেন, তখন আমি জানতাম না যে এত শীঘ্র নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি স্থির করবার জন্য কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। বর্তমান সময়ে আমি দ্বিধাগ্রস্ত যে আমি যে কোনো চাকরিতে যোগ দেব নাকি আপনার নির্দেশিত পথে আপনার সঙ্গে পারী শহরে গিয়ে নিজের সঙ্গীতপ্রতিভা প্রমাণ করবার জন্য আরও কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াব। আমার পিতা অর্থনৈতিক সমস্যায় আছেন এবং তিনি চান যেন আমি এখনই স্কুল ত্যাগ করি। পিতা আমাকে খুব বেশি অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে সক্ষম হবেন না। ফলে আমি যদি পারী নগরে যাই, সেখানে আমাকেই উপার্জন করতে হবে। যদি আপনি আমাকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করেন, তাহলে অবশ্য আমি সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব এবং সবক্ষেত্রে সফলতা লাভ করব, এমন আশা রাখি।

আপনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

আপনার একান্ত অনুগত ছাত্র,

বের্নহার্ড


বাড়ির পরিবেশ যে সাঙ্ঘাতিকভাবে বদলে গেছে, ব্যাপারটা এমন নয়। বাবা মা যেভাবে থাকতেন বোন মনিকে নিয়ে, তেমনটিই আছেন। তবে বাড়ির ঘোড়াগুলো এবং গাড়িটা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির চারপাশে যে জমিগুলো ছিল, সেগুলো বিক্রি করা হয়েছে। চাকরবাকর যারা ছিল, সব একে একে বিদায় নিচ্ছে। শুধু যে পুরনো বৃদ্ধ গাড়োয়ান ছিলেন, তিনি এখন থেকে গৃহভৃত্য হিসেবে থাকবেন। মনির আয়া, যিনি শিশুকালে বের্নহার্ডকেও দেখাশোনা করতেন, তিনিও থাকছেন।

যেহেতু আগে থেকেই ঠিক ছিল যে বের্নহার্ড সঙগীত নিয়ে পড়াশুনা করবে এবং পারী শহরে যাবে, সেহেতু তার অবস্থান কিছুটা বদলে গেছে বাড়িতে। ফলে সারাদিন সে যাইই করুক না কেন, তাকে কেউ কিছু বলে না এবং তার উপরে সাঙ্ঘাতিক কঠোর বিধিনিষেধ কিছু আরোপ করা হয়নি। সে যখন পিয়ানো অভ্যাস করে, তখন কেউ তাকে বিরক্ত করে না। অর্থাৎ তার ক্রিয়াকলাপ আগের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এখন।

বের্নহার্ড মনির সঙ্গে অনেকটা সময় ধরে কথোপকথন চালিয়ে যায়। জঙ্গলে হাঁটতে যায় তারা। মনির ছোট হাত ধরে থাকে সে এবং তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেয়। মনি খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে এবং ধৈর্য ধরে সে তার সব কথা শোনে। হাঁটতে হাঁটতে মাথাটা একদিকে একটু হেলিয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে সব কথা শুনে যায় মনি।

-‘বের্শেন’… মনিই সাধারণত প্রথমে বাক্যালাপ শুরু করে এবং তার মিষ্টি গলায় নিজের নামটা শুনতে বের্নহার্ডের খুব ভাল লাগে … ‘বের্শেন, তুমি তো চলে যাবে শুনলাম… তা তুমি ফিরবে কবে?’

-‘সে তো জানি না, মনি!’

-‘জায়গাটা কি অনেক দূর?’

-‘নাহ, খুব বেশি দূর নয়। তুমি যদি আমায় চিঠি লেখ, আমি পরদিন সন্ধেবেলার মধ্যেই সে চিঠি পেয়ে যাব।’

-‘কিন্তু আমি তো লিখতে শিখিনি এখনও।’

-‘তুমি মা’কে বলে দেবে তোমার যা বলার। মা লিখে দেবেন তোমার হয়ে।’

-‘তুমিও আমায় চিঠি লিখবে তো?’

-‘অবশ্যই লিখব… আর তুমি যদি চাও তোমার জন্য খেলনাও পাঠাতে পারি।’

-‘ওঃ, অবশ্যই বের্শেন। অবশ্যই চাই।’

-‘সেইজন্য কি তুমি আমাকে একটা চুমু দেবে এখন?’

-‘অনেকগুলো দেব। কিন্তু তার জন্য তোমাকে নিচু হয়ে বসতে হবে। কারণ তোমার মুখ অবধি আমি উঠতে পারব না। আমার মনে হয় যে তোমার মুখটা খুব সুন্দর!’

বের্শেন একটা গাছের গোড়ার কাছে উঁচু শিকড়ের উপরে বসে মনির হাতটা ছেড়ে দিয়ে। শিশুটি তার সামনে চুপ করে গম্ভীরমুখে দাঁড়ায়… ‘বের্শেন, তোমার কি মনে হয় আমার মুখটাও সুন্দর?’

‘খুব’ বলে ওঠে বের্নহার্ড… ‘খুব সুন্দর, বিশেষভাবে সুন্দর!’

এবং এই কথাটা যে শুধুই তার মনে হয় এমন নয়। সে অন্তর থেকে অনুভব করে। মনির ছোট্ট মুখটা ভারি সুন্দর। তার কমনীয় ত্বক সূর্যের রশ্মিতে একটু লাল হয়ে গিয়েছে, তার বড় বড় চোখ যেন আলোর শিখার মত, নাকি তারার মত উজ্জ্বল। অসম্ভব মনে হয় বের্নহার্ডের কাছে মনির চোখের সঠিক কোনো উপমা খুঁজে বের করা… একটু ঢেউ খেলানো সোনালি চুল খুব ভারি নয়, রেশমের মত মসৃণ, মোলায়েম, ফুরফুরে। সবচেয়ে সুন্দর মনির হাতদু’খানি। সাধারণ শিশুদের মত নরমসরম গোলগাল নয় তার হাত। রোদ্দুরে লালচে হয়ে ওঠা সুঠাম হাতে সুগঠিত আঙুলগুলো, হাতের পাতার উপরিভাগে শিরা জেগে আছে। ক্ষুদ্র হাতের এই নীলচে চকচকে শিরাগুলি দেখতে অপূর্ব বলে মনে হল বের্নহার্ডের।

‘মনি’ বলে বের্নহার্ড… ‘চুমু কই?’


(চলবে)
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in





বাইশ

রাজবাড়ি তার জৌলুস হারালেও পুজোর রীতি নীতি, জৌলুস কোনওটাই কমেনি আজও। অতীতের নিয়ম মেনেই পূজিত হন দেবী পটেশ্বরী। প্রতিপদ থেকে এই পুজো শুরু হয়ে যায়। এই পুজো নাকি বর্ধমানের রাজা মহাতাব চাঁদ শুরু করেছিলেন। কাঠের পটের উপর নানান রঙ দিয়ে আঁকা হতো দশভূজাকে। এখানে কেবল গণেশের দুটি চোখ দেখা যায়। বাকি সকলেরই দেখা যায় একটি করে চোখ। এমন ভাবেই আঁকা হয় এই পট। এই বাড়িতে আজও আছে বলি প্রথা। তবে পাঁঠা নয়, বলি হয় মিষ্টির। আগে অবশ্য কুমড়ো বলি হতো। নবকুমারীর পুজোও হয় এই বাড়িতে অষ্টমীর দিন। সমীরণ বলে,বীরভূমের পট নিয়ে প্রচুর কিছু লেখা না হলেও কিছু মূল্যবান আলোচনা রয়েছে। যাদু পটুয়াদের কথা লিখেছেন ও’ম্যালি, গৌরীহর মিত্র প্রমুখ। এই পটুয়াদের সঙ্গে হাট সেরান্দির পটশিল্পীদের পার্থক্য রয়েছে।এখানকার পটশিল্পীরা সূত্রধর সম্প্রদায়ের। পটের সঙ্গে গান এঁরা করেন না। কেবলমাত্র দুর্গার পট আঁকা/লেখা ছাড়া অন্য পটও করেন না। সে দিক থেকে অন্যান্য পটুয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই পটশিল্পীদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে, এমনটা বলা যায় না। কিন্তু শোনা যায়, হাট সেরান্দির সূত্রধর শিল্পীদের পূর্বপুরুষ রাজারাম এসেছিলেন অজয়পাড়ের ভেদিয়া থেকে। তিনিও পটের শিল্পী ছিলেন। ভেদিয়া নামটির উৎস কেউ কেউ‘বেদিয়া’ বলে গণ্য করা হয়। বেদিয়াদের মধ্যে পটশিল্পীদের গোষ্ঠী রয়েছে। আসলে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি একটি অন্যটির সঙ্গে কোথাও না কোথাও জুড়ে রয়েছে। এই যোগসূত্রগুলি খুঁজে দেখা দরকার। যাই হোক, বর্তমানে আমরা সূত্রধর শিল্পীদের মধ্যে পট আঁকার প্রায় দুশো বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস পাচ্ছি। রামকৃষ্ণ সূত্রধরের পিতা আদরগোপাল, তাঁর পিতা কালীপদ, কালীপদের পিতা শিবরাম, শিবরামের পূর্বে দ্বারিকানাথ, তদূর্ধ্ব রাজারাম। এ ভাবেই পারিবারিক ইতিহাস বাহিত হয়েছে। সূত্রধরদের মধ্যে প্রবীণ মানিকচাঁদ গুণী শিল্পী। এই সম্প্রদায়ের বাইরে রয়েছেন রত্নাকর মেটে। পটশিল্পের ইতিহাস নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। আমার উদ্দেশ্য বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে কিছু কথা বলা।

সমীরণ নিজের আশ্রমে বেশিদিন তাকে না।এবার রিমি ও বিপিনকে নিয়ে চলে এলো কালনা ঘুরতে।সমীরণ বলে,পূর্ব বর্ধমান জেলার উল্লেখযোগ্য শহর অম্বিকা কালনা।ছোটথেকেই শুনে আসছি কালনা শহরের ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের কথা।দেখার সৌভাগ্য হল ডি এল এড পড়ার সুবাদে।কালনা নবকৈলাস মন্দিরের ১০৯টি মন্দিরের মধ্যে ১০৮টি মন্দির জ্যামিতিক বৃত্তে বিন্যস্ত। দুটি বৃত্তে বিন্যস্ত এই মন্দিরগুলির বাইরের বৃত্তে ৭৮টি এবং ভেতরের বৃত্তে মোট ৩৪টি অবস্থিত। বৃত্তের বহির্দেশে, পশ্চিমদিকে ১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি অবস্থিত। বৃত্তের মধ্যে অবস্থিত ১০৮টি মন্দির আটচালার আকৃতিতে নির্মিত। ভিতরের বৃত্তের পরিধি প্রায় ৩৩৬ ফুট এবং বাইরের বৃত্তের পরিধি ৭১০ ফুট। এই মন্দিরগুলি স্বল্প উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত এবং মন্দিরগুলি পরস্পর সংলগ্ন। মন্দিরগুলির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট এবং প্রস্থ ৯.৫ ফুট। এই মন্দিরের দেয়ালে রামায়ণ ও মহাভারতের পর্ব এবং শিকারের বহু দৃশ্যও চিত্রিত রয়েছে। ১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি আটটি সিঁড়িবিশিস্ট বারান্দার উপর অবস্থিত । এর মন্দিরটি ৬ ফুট উচ্চ ভিত্তিবেদীর উপর অবস্থিত, যার আয়তন ১৩ ফুট X ১৩ ফুট এবং উচ্চতা ৩৫ ফুট। এই মন্দিরটির বর্তমান নাম জলেশ্বর।বৃত্তদুটির কেন্দ্রে একটি বাধানো ইঁদারা আছে যা মন্দিরের পূজার কাজে ব্যবহৃত জলের চাহিদা মেটায়। তবে অনেকে মনে করেন এটি শূণ্য অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মস্বরূপ শিবের প্রতীক।

বর্ধমান রাজপরিবারে বৈষ্ণব ভাবধারা প্রচলিত ছিল। গঙ্গার অবস্থিতি এবং বৈষ্ণব পাট হিসেবে পরিচিত হওয়ায় বর্ধমান রাজপরিবার কালনাতেও আবাসস্থল এবং বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মন্দির স্থাপন করে। রাজপরিবারের সদস্যরা কালনায় গঙ্গাস্নানে যেতেন। এই উদ্দেশ্যে বর্ধমান এবং কালনার মধ্যে ১৮৩১ সাধারণাব্দে রাজপথ নির্মাণ করান তেজচন্দ্‌। এই সঙ্গে নির্মিত হয় প্রতি আট মাইল অন্তর জলাশয়, বাংলো, আস্তাবল ইত্যাদি। ভোলানাথ চন্দ্র প্রণীত 'ট্রাভেলস অব আ হিন্দু' (লন্ডন, ১৮৬৯) এবং ডব্লু ডব্লু হান্টারের 'আ স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল' (১৮৭৬) উদ্ধৃত করে বলা যায় যে, গঙ্গার ধারে ছিমছাম সুন্দর শহরের রূপকার বর্ধমান রাজপরিবার। কালনা ছিল বর্ধমান জেলার একমাত্র বন্দর এবং মূল বাণিজ্যকেন্দ্র। জেলার বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানি হত কালনা বন্দরের মাধ্যমে। কালনা পুরসভার অস্তিত্ব পাওয়া যায় ১৮৭১ সাধারণাব্দে। ১৮৭২-য় কালনার জনসংখ্যা ছিল ২৭,৩৩৬। 'ক্যালকাটা রিভিউ' পত্রিকায় রেভারেন্ড জেমস্‌ লং-এর রচনা থেকে জানা যায় যে, কালনা বাজারে ইটের তৈরি এক হাজার দোকান ছিল। রংপুর, দেওয়ানগঞ্জ এবং জাফরগঞ্জ থেকে প্রচুর পরিমাণে চাল কিনে মজুত করা হত কালনায়। খাদ্যশস্য, সিল্ক, তুলো ইত্যাদি ছিল প্রধান পণ্যদ্রব্য।

এ হেন কালনা রাজবাড়ি চত্বরের সবচেয়ে পুরোনো পঁচিশচূড়া মন্দিরটি হল লালজি মন্দির। ১৭৩৯ সাধারণাব্দে মন্দিরটি নির্মাণ করান বর্ধমানের জমিদার কীর্তিচন্দ্‌-জননী ব্রজকিশোরী দেবী। মন্দিরের প্রকৃত ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিংবদন্তি। 'লালজি'-র নামকরণের পিছনে তেমনই একটি কিংবদন্তি আছে।

কালনা ভ্রমণ শুরু করলাম চকবাজার এলাকায় অবস্থিত বিখ্যাত নবকৈলাস দর্শনের মধ্যে দিয়ে যা ১০৮ শিবমন্দির বলে পরিচিত। অম্বিকা কালনা ষ্টেশন থেকে টোটো করে চলে এলাম শহরের প্রানকেন্দ্রে ১৮০৯ সালে বর্ধমানের রাজা তেজ বাহাদুর কতৃক প্রতিষ্ঠিত অপরূপ শিল্পের এই একচালা মন্দির প্রাঙ্গণে। দুটি বৃত্তের মধ্যে ৪টি প্রবেশদ্বার নিয়ে ৭৪টি মন্দির বাইরে ও ভিতরে ৩৪টি মন্দির রয়েছে। বাইরের ৭৪টি মন্দিরে একটি সাদা শিবলিঙ্গ ও পাশেরটি কালো শিবলিঙ্গ এবং ভিতরের ৩৪টি মন্দিরে সাদা পাথরের শিবলিঙ্গ রয়েছে। মন্দিরের প্রত‍্যেকটি শিবলিঙ্গ উওরমুখী এবং শিবলিঙ্গগুলোর অবস্থান ও কিছুটা ভিন্ন। মন্দির প্রাঙ্গণের কেন্দ্রস্থলে লোহার জাল দ্বারা পরিবেষ্টিত এক জলাধার রয়েছে যেখানে দাঁড়িয়ে ৩৪টি শিবলিঙ্গ একসাথে দেখা যায়। অদ্ভূত এক চিন্তা চেতনা ও ভাবনার নিদর্শন হচ্ছে এই নবকৈলাস বা ১০৮ শিবমন্দির।প্রখর বুদ্ধিমতী ব্রজকিশোরী তাঁর রাধিকা মূর্তির সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন এক সন্ন্যাসীর কাছে থাকা শ্যামরায়-এর এবং রাজ-জামাতা 'লালজি'-র আবাসস্থল হিসেবে অনন্য শৈলীর দেবালয়টি নির্মাণ করিয়ে ছিলেন।