ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত
Posted in ধারাবাহিকযুদ্ধমাঝে শান্তির দূত মাহমুদ দারবিশ
সুপ্রিয় বাসু,
বহুবছর পর তোমার ভাবানুবাদে সিলভিয়া প্লাথের কবিতা পড়ে দারুন লাগলো। মনে পড়ে গেলো মাহমুদ দারবিশের কবিতার কথা। ‘ফিলিস্তিন’ বর্তমান বিশ্বের এক আলোচিত ভূখণ্ডের নাম। ভূমধ্যসাগরের তীরের এই দেশের রয়েছে হাজার বছর পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্য। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষভাবে আলোচিত হবার কারণ অবশ্য এটি নয়। ফিলিস্তিন নিয়ে বাতচিতের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে থাকে তিন ধর্মের পবিত্র শহর জেরুজালেম ও সেখানকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনি। জায়নিস্টদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের নিপীড়িত হবার ঘটনা নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর সেই যে শুরু হয়েছিল তা এখনও চলমান। ফিলিস্তিনের (আরবি উচ্চারণে ফলাস্তিন) গাজায় এখন যা ঘটছে তা কেবল গণহত্যা নয়, এটা জাতিহত্যা। একটি মুক্তিপিয়াসী জাতিকে নির্মূল করতে সেখানে চলছে পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। গাজা এখন ‘বসবাসের অযোগ্য’ এক মৃত্যু-উপত্যকা। প্রতিদিনই সেখানে লাশের মিছিল বাড়ছে। এর প্রকৃতির জলপাই রঙের স্নিগ্ধ মেদুরতা প্রায়-অপসৃত, মাটি রক্তাক্ত, আকাশের নীলিমা বিধ্বস্ত। নির্বাসন ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই তাদের।
ভাষা ও সাহিত্যের সবচেয়ে বলিষ্ঠ মাধ্যম কবিতা। সুপ্রাচীনকাল থেকে কবিতাই মানুষের দ্রোহ, প্রেম, আবেগ, অনুভূতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চার অন্যতম প্রধান অবলম্বন। মন ও মননের ছান্দসিক প্রকাশের কারণে সব যুগেই কবি ও কবিতা সমাদৃত। যুগে যুগে স্থান, কাল ও সীমান্তের সীমা অতিক্রম করে কবিতা হয়ে উঠেছে মানব ও মানবতার বৈশ্বিক কণ্ঠস্বর। মাহমুদ দারবিশের কবিতা এমনই—ভালোবাসা ও বিদ্রোহ, প্রতিরোধ ও আলিঙ্গন হাত ধরাধরি করে এগোয়। বয়স যখন উনিশ, প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ আসাফির বিলা আজনিহা (‘উইংলেস বার্ড’ অথবা ‘পালকহীন পাখি’)। প্রথমদিকে তিনি ধ্রুপদী রীতিতে কবিতা লেখা শুরু করেন। কিন্তু খুব বেশিদিন এই ধ্রুপদী দুর্গের মধ্যে আটকে থাকেননি দারবিশ। সিরীয় কবি সিজার কাব্বানি এবং আলী আহমদ সাঈদ অ্যাডোনিসের নব্য কবিতা আন্দোলনের আছড়েপড়া ঢেউ তাঁর ধ্রুপদী ভাবনার নীল নির্জন দুর্গকে ভেঙে খানখান করে দেয়। স্বপ্নলোকচারী কবি চলে আসেন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে লোকানুবর্তী ও লক্ষ্যভেদী। ফিলিস্তিনের মাঠ, ক্ষেত, উপত্যকা, মাটি, অলিভ গাছের সারি প্রভৃতি দিয়ে দারবিশ নির্মাণ করতে থাকেন কবিতার পর কবিতা। ফিলিস্তিনের নিসর্গের বিমূর্ত সুর আর স্বাধীনতা, প্রেম, স্বাদেশিকতার ধারণার যোগসাজশে দারবিশ এক বিশ্বজনীন কবিতা নির্মাণের প্রয়াস পান। দারবিশের কবিতার ভাষা সহজ ও স্বচ্ছ। কিন্তু তাতে রয়েছে মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার সুদৃঢ় অঙ্গীকার। তাঁর কবিতা পড়লে এক গভীর মানবিক চেতনায় সমস্ত দেহমন আন্দোলিত হয়ে ওঠে। বিপন্ন অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়েও তিনি কখনো মানবতা ও মানবপ্রেমের মন্ত্র থেকে বিচ্যুত হননি।
মাতৃভূমি থেকে উন্মূল মাহমুদ দারবিশ আজীবন হৃদয়ের অন্তস্তলে ধারণ এবং লালন করেছেন বেদনাপীড়িত, বুলেট-বেয়নেট-বোমায় ক্ষতবিক্ষত ফিলিস্তিনকে, কবিতার শাণিত হাতিয়ার দিয়ে লড়েছেন ফিলিস্তিনি জনগণের জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীন বাসভূমির জন্য। কৈশোর থেকেই তিনি ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে থেকে লড়াই করেছেন প্রবল পরাক্রান্তের বিরুদ্ধে। আর সেই লড়াইটা করেছেন কবিতার শাণিত শব্দাবলি দিয়ে। দারবিশ প্রথম কবিতা পাঠ করেন ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে। স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি আবৃত্তি করেন : ‘তুমি চাইলেই সোনালি রোদে খেলা করতে পারো, তুমি চাইলেই হাতের নাগালে পাও আলোকিত পুতুল, কিন্তু আমার তা নেই। তোমার আছে ঘর, আমার কিছু নেই। তোমার আছে উৎসব আর উদ্যাপন, কিন্তু আমি তার দেখা পাই না। বলো, কেন আমরা একসঙ্গে খেলতে পারি না।’ ফিলিস্তিনিহীন পৃথিবীর মানচিত্রে বালক দারবিশের কবিতা যেন লাল ফিলিস্তিন হয়ে আঘাত করে ইসরায়েলিদের বুকে। কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে বারুদের গন্ধ! এমন বারুদমাখা কবিতা শুনে স্কুল কর্তৃপক্ষ ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ হয় দারবিশের ওপর, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর লোকেরা তাকে শাসিয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর কবিতাটা কতটা ক্ষুরধার, কতটা অভ্রভেদী। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই আরবি ভাষায় রচিত, তবে অনায়াসে লিখতে পারতেন হিব্রু, ইংরেজি, ফরাসিতে। ‘আরবদের সবচেয়ে উৎকর্ষশীল শিল্প’ কবিতাকে তিনি এক নতুন ভুবনের সন্ধান দেন, অধিষ্ঠিত করেন অনন্য উচ্চতায়, ফলে মাহমুদ দারবিশের কবিতা ও প্রবন্ধের দ্যুতি আরব জাহান অতিক্রম করে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক চেতনার কবিতার পাশাপাশি দারবিশ বার বার বলতেন শুদ্ধ কবিতার (Pure Poetry) কথা। কেননা তার কবিতা হলো বহুমুখী সংস্কৃতির সঙ্গে কথোপকথন। নির্দ্ধিধায় তিনি কবিতায় ব্যবহার করেন ইসলামিক, খ্রিষ্টিয় ও ইহুদি মিথ। মোহময় সংগীতময়তায় আচ্ছন্ন তাঁর কবিতা। যেখানে রয়েছে জীবনের আশ্চর্যময়তা Mistry of Life এবং মৃত্যু। কিন্তু মৃত্যু তাঁর কাছে এক অন্য রূপান্তর। জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনিই তো বলতে পারেন:- “যখনই আমি নিজেকে খুঁজি অসংখ্য মানুষের দেখা পাই যখনই তাঁদের খুঁজতে যাই তখন আমি একা নিঃসঙ্গ। তখন আমি লাখো জনতা।” (ম্যুরাল) এভাবেই তিনি আত্মপরিচয়ের অযুথ বাণী তুলে ধরেন কবিতায়। জীবনের যুযুধান সময়কে সামনে রেখে হাঁটতে থাকেন। কেননা একই সঙ্গে তিনি একা এবং অসংখ্য। (Individul Crowed) জাতিগত বিভেদের সমথনে যখন রাষ্ট্রীয় শক্তি দম্ভ প্রকাশ করে, দুই মানুষের মাঝখানে দেয়াল তুলে দেয়, তখন একজন কবিকে তা সবচেয়ে বেশি আহত করে। সাহিত্য-সমালোচকরা তাঁকে চিহ্নিত করেন আরব জাহানের সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও সম্মানীয় কবিদের একজন এবং সমকালীনদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হিসেবে। ‘কেউ কেউ মনে করেন, আরব-কবিদের মধ্যে অ্যাডোনিসের পরেই তাঁর স্থান। তবে কাব্যচিন্তা ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে অ্যাডোনিসের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য অনেক। বর্তমানে আরব কবিতায় যে আধুনিকতা দেখা দেয় তা প্রধানত এসেছে অ্যাডোনিসের হাত ধরেই। কিন্তু আরব কবিতায় যে বিপ্লবী জোশ দেখা দেয় তা এসেছে দারবিশের হাত ধরে।’ প্রিয় স্বদেশের বিপন্ন মুখ, দখলদার বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন এবং বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ, ফিলিস্তিনিদের মরণপণ লড়াই – এসবই দারবিশের কবিতার প্রধান বিষয়। রক্ত, আগুন, প্রতিবাদ, জখম, পাথর এ-ধরনের শব্দ ও চিত্রকল্প বারবার ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় শৈল্পিক প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক চিন্তা, দেশাত্মবোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মাতৃভূমির প্রতি দুর্মর ভালোবাসা, পাইন-জলপাই ঘেরা স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন তাঁকে কবি করে তোলে, যদিও তিনি বলতেন, ‘আমি এখনো কবি হয়ে উঠতে পারিনি, মনে হচ্ছে এ-পথে আসাটাই ভুল হয়েছে।’ তাঁর বেশিরভাগ কবিতাতেই ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের মর্মভেদী বেদনা এবং তাদের প্রতি কবির উদ্বেগ ও আতঙ্ক। তাঁর প্রায় সব ধ্যানজ্ঞান, স্বপ্ন-কল্পনা আবর্তিত হয়েছে আরবদের ইতিহাস-ঐতিহ্য কিংবা পিতা-পিতামহের অতীত স্মৃতি ও বেদনাকে ঘিরে। উদ্বাস্তু জীবন থেকে দেশে ফিরে তিনি অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে লিখেছেন : ‘আমি ফিলিস্তিনে। কিন্তু কোথায় আমার ফিলিস্তিন? আমি কখনো আমার বাড়িতে ফিরে যেতে পারিনি। প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমার গ্রাম বিধ্বস্ত-ভস্ম।’ জন্মভূমি হারানোর বেদনা আর নির্বাসিত জীবনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নানাভাবে মূর্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়, তাঁর প্রবন্ধে। মাতৃভূমির প্রতি প্রবল টান, স্বজন-হারানোর বেদনা-হাহাকার, দেশত্যাগজনিত ক্ষত ও রক্তক্ষরণ তাঁকে কলম ধরতে ও তাতে শাণ দিতে শিখিয়েছে। শেকড়ে ফিরে আসার প্রবল আকুতি, বুকের মধ্যে জমা দ্রোহ-দাহ, ক্ষোভ, হাহাকারই বারবার ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি হয়ে বেজেছে তাঁর কবিতায় ও সৃজনভুবনে। দারবিশের কবিসত্তা জাগ্রত হয়েছে প্রাচীন আরব কবি মু-আল্লাকারের কবিতার স্বপ্নছোঁয়ায়, পিতামহ হুসাইন দারবিশের কাব্যপ্রীতিও তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তবে তাঁর কবি হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে নিজ মাতৃভূমির রক্তাক্ত-ছিন্নভিন্ন মানচিত্র ও ইসরায়েলিদের বর্বরতা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর মতো আর কোনো শতাব্দীতেই এতো অধিকসংখ্যক মহান কবির জন্ম হয়নি।’ উৎপীড়ন, যুদ্ধ, বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলির উত্থান-পতন, বর্ণবাদ, স্বৈরতন্ত্র, ফিলিস্তিনি ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও এই শতাব্দীতে অসংখ্য কবি আবির্ভূত হয়েছে। এই শতাব্দী যেমন যুদ্ধ, ধ্বংস, অশ্রু এবং ট্র্যাজেডির শতাব্দী, তেমনি কবি ও কবিতার উৎকর্ষের শতাব্দী। মাতৃভূমি, নিপীড়িত দেশবাসীর বেদনামাখানো চিৎকার-হাহাকার, বিশ্বরাজনীতির মোড়লদের অমানবিক কু-নাট্যের অভিঘাতে দারবিশের প্রতিটি কবিতা হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। অগ্নিদগ্ধ জাতির অগ্নি ও উত্তাপ ধারণ ও লালন করার জন্য তাঁকে ‘পোয়েট অফ দ্য রেজিস্ট্যান্স’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ‘দখলদার ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা ফিলিস্তিনিদের মূলধারার রাজনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।’ আরবি ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের রক্ষাকর্তা হিসেবে এই কবি বিশ্বাস করতেন, তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি একদিন ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির থাবা থেকে মুক্ত হবেই। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে রাখলেও তারা তাঁর জিহ্বায় উচ্চারিত শব্দ ও প্রতিবাদী কবিতাকে দখল করতে পারেনি, পারবেও না। ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির লড়াইকেও স্তব্ধ করতে পারবে না। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, কবিতাকে যেমন ধ্বংস করা যায় না, তেমনি মানুষের মুক্তির লড়াইকেও থামানো যায় না।
তুমি যেভাবে প্লাথের কবিতা পাঠিয়েছিলে,তোমার মতন করে দারবিশের কবিতার ভাবানুবাদ করে পাঠাতে পারলাম না। কিন্তু ইচ্ছে ছিল তোমাকে লিখে দেই একটা গোটা জীবন, যাক সব পেলে জীবন হয়ত অতৃপ্ততা চিনতো না। ভালো থেকো নিরন্তর। শেষ করার আগে দারবিশের কবিতায় খুব বলতে ইচ্ছে করছে -
Between Rita and my eyes
There is a rifle
And whoever knows Rita
Kneels and prays
To the divinity in those honey-colored eyes.
And I kissed Rita
When she was young
And I remember how she approached
And how my arm covered the loveliest of braids.
And I remember Rita
The way a sparrow remembers its stream
Ah, Rita
Between us there are a million sparrows and images
And many a rendezvous
Fired at by a rifle.
Rita’s name was a feast in my mouth
Rita’s body was a wedding in my blood
And I was lost in Rita for two years
And for two years she slept on my arm
And we made promises
Over the most beautiful of cups
And we burned in the wine of our lips
And we were born again
Ah, Rita!
What before this rifle could have turned my eyes from yours
Except a nap or two or honey-colored clouds?
Once upon a time
Oh, the silence of dusk
In the morning my moon migrated to a far place
Towards those honey-colored eyes
And the city swept away all the singers
And Rita.
Between Rita and my eyes—
A rifle.
শুভেচ্ছান্তে-
সুস্মি
১৭ মে, ২০২৫