Next
Previous
Showing posts with label ধারাবাহিক. Show all posts
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in












নবনীতা দেবসেন: নারীকেন্দ্রিক জীবনদৃষ্টি




প্রিয় বাসু,

গতকাল সন্ধ্যায় তোমার চিঠি পেলাম। আকাশ কাঁসার বাসনের মতো রঙে ধূসর হয়ে আছে। কিছু পাখপাখালি আকাশে উড়লে মনে হয় খড়কুটো উড়ছে। কর্পোরেট জীবনের ব্যস্ততায় আগের মতন পড়তে পারি কোথাায় বলো! বিগতা যৌবনা শব্দটা ব্যবহার করে খোঁচা দিলে মনে হলো তবে তা তুমি বলতেই পারো। আগের মতন রোজ কবিতা পড়া হয়না তাই বলে ভেবো না সব ভুলে গেছি। খুব প্রিয় একটা কবিতার শেষ কটি লাইন তোমার সমস্ত চিঠির উত্তর হতে পারে।

আমি তোমার হই
তুমি
আমার কোলের শিশু হ'য়ে আমাকে বরণ করো
আমাকে হরণ করো
পূরণ করো।

বিংশ-একবিংশ শতকের বাংলা সাহিত্যে নবনীতা দেবসেন একজনই। তিনি উচ্ছল, সহাস্য, সুদূরপিয়াসী, কখনো তির্যক, কখনো ক্রুদ্ধ, প্রয়োজনে কঠোর। ছেলেভোলানো রূপকথা থেকে অচঞ্চল কবিতা, সরস ট্রাভেলগ থেকে প্রশ্নাত্মক অ্যাকাডেমিক রচনা – সবকিছুতেই তাঁর অনায়াস বিচরণ। তিনি ঠিক যতটাই ধ্রুপদি, ততটাই আধুনিক বা সমকালীন। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম প্রত্যয়‘ প্রকাশ পায় ১৯৫৯ সালে। তখন তাঁর মাত্র একুশ বছর বয়স। এই কাব্যগ্রন্থের ‘বৃন্তহীন একটি গোলাপ‘ কবিতাটির কথা মনে আছে? কবিতার শুরু এই রকম: “কিন্তু, তুমি এখন তো জানো/ বর্ণ গন্ধ ফুলের জঞ্জালে/ বুক রেখে কিংবা মুখ রেখে/ কোনো লাভ নেই।” বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। কিন্তু চোখে লাগে ‘জঞ্জালে‘ শব্দটি। বর্ণ গন্ধ ফুল তাঁর পূর্ববর্তী সব কবিদের কাছে মহার্ঘ ছিল। নবনীতা এক কালোপযোগী তিক্ততা হানেন বর্ণ গন্ধ ফুলের প্রতি, ওই ‘জঞ্জালে‘ শব্দটি প্রয়োগ করে। কবিতাটিতে শুধুমাত্র ওই একটি শব্দই আধুনিকতার নিশান ওড়ায়। নবনীতা দেবসেনকে পড়তে গিয়ে কোথাও মনে হবে না প্রতিবাদী চেতনার বিস্ফোরণ আছে। দুঃসাহসী দামাল নবনীতার অকুতোভয় প্রকৃতি সেখানে ডালপালা মেলেনি। এজন্য তাঁর নারীবাদী চেতনায় বিদ্রোহী বিকার নেই, রয়েছে স্বাধিকারবোধে অসহনীয় আত্মপ্রত্যয়। ‘নারীবাদী লেখক’ তকমা আঁটাতে আপত্তি। কিন্তু, মেয়েদের অধিকার আদায়ের পক্ষে, অন্যায়ের প্রতিবাদে তাঁর প্রিয় টেম্পলপেড়ে মেরুন শাড়ির আঁচলের তলার প্রদীপটি মশাল হয়ে জ্বলে ওঠে। সে মশালের আলো ও আগুন ঝরে অক্ষরে। বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন। নিজের মতো করে বেঁচেছেন হার না-মানা প্রকৃতিতে। ব্যক্তিত্বের বহুমুখী বিস্তারে নবনীতা মা রাধারানিকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন কখনও কখনও। নবনীতার কবিতাগুলিকে মনে হয় তাঁর স্পষ্টশ্রুত স্বগতোক্তি। কবিতার মধ্যে দিয়ে নবনীতা আসলে যেন নিজের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, তাঁর সব দুঃখ-শোক বা প্রণয়বাণী নিজেকেই শোনাতে চেয়েছেন। নবনীতার কবিসত্তাতেও নারীজীবনের বহুমাত্রিক প্রতিবাদী চেতনা সবাক্‌মূর্তি লাভ করেছে। পিতৃতান্ত্রিকতা থেকে মুক্তিপিয়াসী নবনীতা ত্রাতা হিসাবে পুরুষের রাজকীয় ভূমিকাকে মেনে নিতে পারেননি। ওঁর সারাজীবনের কবিতাতেই এক অতৃপ্ত প্রেমতৃষ্ণা ধিকিধিকি জ্বলতে দেখা যায়। প্রেমের রাশ হাতে রেখে পুরুষই বলতে চেয়েছে শেষকথা, নারী বাধ্য হয়েছে তা পালন করতে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আত্মস্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে অর্জিত প্রেমের রাজদণ্ডধারী রূপ ক্রমে প্রকট হবার সঙ্গে সঙ্গে, নিঃস্বার্থ সমর্পণের অবমূল্যায়ন বুঝতে শিখেছে নারী। এর মধ্যেকার ‘ঐতিহ্যপ্রসূত’ মহনীয়তা শিকারি ও শিকারের বাস্তব সম্পর্কে জর্জরিত। প্রেমিক হলেন প্রভু, নারীর আত্মোপলব্ধি ‘শিকার’ হিসাবে। নবনীতা তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম রাখলেন ‘লায়নটেমারকে’ (১৯৮৯-১৯৯৫)। নামকরণের মধ্যে পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত। তবে এই আক্রমণ, প্রতিবাদ ধ্বনিত হল নারীর নিজস্ব যন্ত্রণার সমাজতাত্ত্বিক প্রকাশে। কবি যেন নিজের থেকে এক নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব বজায় রেখে নিজের চোখে আঙুল দিয়ে নিজেকেই চেনাতে চাইলেন প্রহার-দগ্ধ নারীর বিকৃত স্বরূপ। নবনীতার কবিতার আরও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, তার একাকীত্বের সুর। প্রেমের ডাকে সাড়া দিতে আকুল কবি। কিন্তু প্রণয়মুকুটের বদলে তাঁকে যেন চিরদিন শিরোধার্য করতে হয়েছে বিরহের বা নিঃসঙ্গতার কাঁটা। নবনীতা সেই শ্রেণির কবি, যিনি নিজের বক্তব্যকে পাঠকের কাছে জটিল অস্পষ্টতায় পেশ করতে চান না। তাই তাঁর কাব্যভাষা খুব সহজ। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, তাঁর কবিতা সবলে সমস্ত পেশি ফুলিয়ে এক অত্যাশ্চর্য শক্তিরূপ প্রকাশ করতে পারে না। বড় বিনম্র তাঁর কাব্যভাষা। তাঁর উৎকৃষ্ট কবিতাগুলির সঠিক পরিচয় পাঠককে পেতে হয় সেই নম্রতা স্পর্শ করে। কবিতার প্রচ্ছন্ন ব্যঞ্জনার ছটা আটপৌরে প্রকাশভঙ্গিতে হয় হৃদয়ের সম্পদ।

তোমাকে এত বছর পর এইসব কেন লিখছি, লেখার কোন মানে আছে কিনা তাও জানিনা। তবে তোমার চিঠি অজান্তেই উস্কে দিচ্ছে অনেক কিছু। নবনীতা দেবসেনের কোন এক লেখায় পড়েছিলাম ‘সংসারের কোনো কোনো বাসন কোসন, কাপ পিরিচ সম্ভাব্য বন্ধুরতা অতিক্রম করে বিস্ময়করভাবে বহুদিন টিকে থাকে, কিন্তু একদিন হয়ত দেখা যায় যে জন্য এত আয়োজন, সেই সংসারটাই টেকে না, সম্পর্ক ভেঙে যায়।’ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ সম্পর্কে রসিকতার ছলে এক হৃদয়গ্রাহী স্বীকারোক্তি, অনেকটা জীবন পেরিয়ে এসে মনে হয় না কি চরম সত্য খেলাচ্ছলে লিখে দিলেন? আমাদের সম্পর্কটাও…

বিদ্রোহের সরবতাই বিপ্লবের আগমনী বার্তা বয়ে আনে। অথচ সেই সরবতা উচ্চকিত না হয়েও যে বৈপ্লবিক চেতনার বিস্তার করা যায়, তা লেখিকা নবনীতা দেবসেন দেখিয়ে দিয়েছেন। নারীবাদী লেখিকা হিসাবে কখনই তিনি সরব হয়ে ওঠেননি। অথচ, তার অবকাশ ছিল। তাঁর পরিবারের মধ্যেই সে রসদ মজুত ছিল। তাঁর মধ্যে পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের বৈষম্যপীড়িত জীবনবোধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চেতনায় নারীবাদের পরিচয় নানা ভাবেই প্রকাশমুখর। ছোটবেলায় ছোট ভাই দিদিকে মারলেও দিদি মারতে পারবে না, দিদিকে তা সহ্য করার চেতাবনির মধ্যে তাঁর মেয়েদের অন্যচোখে দেখার চেতনা জেগে উঠেছিল। সমাজে পুরুষের আধিপত্যে নারীদের আনুগত্যবোধের মধ্যে তাঁর প্রতিবাদী চেতনাই তাঁর বৈদগ্ধপূর্ণ বনেদি অবস্থানে আত্মপরিচয়ের সোপান হয়ে উঠতে পারত। সেখানে তাঁর আমৃত্যু ডাকাবুকো চরিত্রপ্রকৃতিই তাঁর সঙ্গতের পক্ষে যথেষ্ট সরব ছিল। বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন।

হাসতে হাসতে এক কাপড়ে ট্রাকে চড়ে অরুণাচল সীমান্তে ভারত-চিনের ম্যাকমোহন লাইন ছুঁয়ে এসেছিলেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনি ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমোহনে’। আবার হায়দরাবাদে সেমিনারে গিয়ে কুম্ভমেলায় গিয়েছেন একাকী। তাঁর লেখনীর পরশে তাই ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’ ভ্রমণসাহিত্যে প্রতিমায়িত হয়েছে। এ ভাবে দুরারোগ্য ব্যধিকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়েছেন পৃথিবীর দুর্গম পথে, বাংলা সাহিত্যে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতায় অসংখ্য ফসল ফলিয়েছেন অবলীলায়।

তোমার মনে আছে আমাদের বমডিলা ভ্রমণের কথা। পাহাড়ের গায়ে অজস্র স্ট্রবেরি গাছে লাল স্ট্রবেরি ঝুলে রয়েছে। অয়ন, তুমি আর সোমজা পাকদণ্ডি পথে পাহাড়ের উপরে উঠে হারিয়ে গেছিলে। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি সহসাই আকাশ সোনালী রোদে ঝলমল। কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তোমাদের খুঁজে পেলাম পাহাড়ের উপরে মনস্ট্রিতে। প্রার্থনা কক্ষে শাক্যমুনি বুদ্ধের বিশাল মূর্তি। মূর্তির একপাশে অবলোকিতেশ্বর ও অন্যপাশে রিনচেংপংযের মূর্তি। মনস্ট্রির মধ্যে ছায়াছন্ন বন্য ধুপের গন্ধ বাতাসে মিশে গিয়ে এক রহস্যময় প্রাচীনত্বের আভাস ছড়িয়ে পড়ছিল। আচ্ছা, আমাদের যে দিন গেছে সে কি একেবারই গেছে?

নবনীতার গল্পে অধিকাংশ নারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তারা একদিকে আজন্ম-লালিত সংস্কারকে আঁকড়ে থেকেছে আবার সেই সংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে উত্তরণের পথ খুঁজেছে। যেমন ‘বিমাতা’ গল্পের তাপসী। তাঁর গল্পের নারীরা জীবনের কথা বলে। ‘গদাধরপুর উইমেন্স কলেজ’ গল্পের কথক একজন নারী। সে চায় আত্মপ্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তি। স্বামীর সংসারে অস্তিত্বহীন স্ত্রীর চরিত্র প্রথমদিকে তার ভালো লাগলেও একসময় খারাপ লাগতে থাকে। সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়; কিন্তু সংসার ভেঙে নয়, সংসারে থেকেই। ‘এক্সপেন্স একাউন্ট’ গল্পটিতে একজন ছোট পিসিকে পাই আমরা, যিনি বৈশ্বিক আবহাওয়ায় বদলে যাওয়া কলকাতাকে দেখে ব্যথা পান। মেনে নিতে পারেন না। সুকৌশলে তিনি চারপাশের মানুষগুলোকে পুরনো দিনের ঐতিহ্যের কথা শোনান। ‘দাদামনির আংটি’ এক সাধারণ গৃহবধূর অসাধারণ হয়ে ওঠার কাহিনি। দাদামনির আংটি চুরি গেলে এই বধূ থানায় ডায়েরি করতে যায়। থানা ডায়েরি নিতে আপত্তি করে। বধূ প্রতিবাদ করে। সাফ সাফ বলে দেয়, ডায়েরি না নিলে তিনি নিজেই কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তার নামে এফআইআর করবেন। ‘পরীর মা’ গল্পের মা নিজের সন্তানকে ঘটনাচক্রে হারিয়ে ফেললেও অন্যের সন্তানকে বুকে টেনে নেন।
‘শুভমিতা প্রোপ্রাইটার’ গল্পে শুভমিতা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেও প্রথম সন্তান শুভকে ভুলতে পারে না। এমন অনেক মানবিক বার্তা আছে তাঁর গল্পে। আবার আধুনিক গল্পও রয়েছে। ‘আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন’ তেমন একটি গল্প। এ-গল্পে এলিজাবেথ এক অসাধারণ নারী। সে অন্য পন্থায় সন্তান ধারণ করে কারো বাধা না মেনে। একটি অসাধারণ বাক্য আছে এ-গল্পে, ‘মায়ের মুখের একটা কথার ওপরে বাবার বাবাত্ব টলমল করছে। আর তো কেউ জানে না প্রকৃত বাবাটি কে!’ তাঁর গল্পে নারীর বহুমাত্রিক রূপ আমরা দেখি। গল্পের নারীরা হিংস্র নয়। পুরুষের ব্যাপারে তাদের অনীহা বা অশ্রদ্ধা নেই। প্রতিহিংসাও তারা দেখায় না। তাদের প্রতিবাদ পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। যা কিছু পুরনো তার বিরুদ্ধে। পুরনো ঐতিহ্যের মাঝে যে ভালো থাকে সেই ভালো বার্তাই পাই আমরা তাঁর সাহিত্যে।

পড়ন্ত বেলার রোদ্দুর পশ্চিমের জানলা দিয়ে লাল মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দিনগুলি আর হয়ত ফিরবে না। পিছনের দিকে ফিরে গিয়ে ভাবলে মনে হয় কোন রূপকথার গল্পে হারিয়ে যাচ্ছি। অনেকদিন ধরেই একটা সন্ধ্যাজুড়ে তোমাকে চিঠি লিখতে চাচ্ছিলাম। ‘মাঝে মাঝে ভাবি। সবই কি তাহলে মিথ্যা? সব ভাবনা কি মিথ্যা? আমি আমার আত্মাকে জিজ্ঞেস করি। আমি কত যে খুশি হতাম যদি তুমি আমার মনের এই আর্তিটাকে বুঝতে পারতে! সন্ধ্যার সব হৈ হুল্লোড়, আড্ডায় কেন জানি বড় একা লাগে মনে হয় প্রেমহীন নাগরিক জীবনে, হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে আজ সবাই খুব নিঃসঙ্গ।

রূপকথার কথায় মনে পড়ল নবনীতা দেবসেনের রূপকথা। তাঁর প্রিয় বিষয় রূপকথা। আদর্শ জীবন, আদর্শ মানুষ, আদর্শ সমাজ তৈরির সুযোগ আছে রূপকথায়। তাঁর রূপকথায় মেয়েরা কুশীলব। রানি এসে রাজাকে উদ্ধার করে। রূপকথায় পুরুষরাই চিরদিন মেয়েদের উদ্ধার করে। মেয়েদের বন্দি করে, পেটায়, কাটে আবার উদ্ধারও করে। পুরুষই তাদের কষ্ট দেয়, আবার তারাই উদ্ধার করে। মেয়েদের আসল চেহারা নেই, তারা শুধুই বন্দিনী। ছেলেদের তুলনায় প্যাসিভ। তাঁর রূপকথায় মেয়েদের পজিটিভ ও অ্যাকটিভ রোল তুলে ধরা হয়েছে। তারা উদ্ধার করে যুদ্ধ করে নয়, অস্ত্রবলে নয়, বুদ্ধির অস্ত্রবলে। কেন রূপকথা লেখেন তা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "আমার রূপকথার গল্পগুলি সেই পড়ুয়াদের জন্যে, যাদের বুকের মধ্যে শৈশব অমলিন আছে"। ‘চন্দনরাজার বউ’ গল্পে দেখা যায়, চন্দনরাজা সারাদিন মৃত্যু কোলে ঢলে থাকেন, শুধু মধ্যরাত্রে বেঁচে ওঠেন। কয়েক ঘণ্টা পর আবার মৃত মানুষে পরিণত হন। চন্দনরাজাকে এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে মুক্ত করেন রাজকন্যা চন্দনী। ‘পদ্ম কদম’-এ রাজপুত্র কদমকুমারকে পহ্লবী রাজার কারাগার থেকে জেলেবাড়ির মেয়ে পদ্মকুঁড়ি উদ্ধার করেন। ‘সুসনি-কল্মি’ গল্পে রয়েছে, গরিব দুই বোন ছাগলের দুধ খাইয়ে রাজার দুরারোগ্য ব্যাধী সারিয়ে দেন। দুই রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে হয় সেই দুই বোনের। আবার, ‘বোকা রাজার বুদ্ধিমতী রানি’ গল্পে দেখা যায়, রাজা যতবার বেরোন যুদ্ধ করতে, রানি ততবারই স্বপ্নের গল্প ফেঁদে রাজাকে বিরত করেন। রাজকর্মচারীরা বিপদে পড়লে তাঁদের পরামর্শ দিয়ে রক্ষা করেন পাশের রাজ্যের রাজকন্যা। রানির উদ্যোগের সেই রাজকন্যা রাজার বৌমা হলেন। বিয়ের পর একদিন ওই মেয়ে তাঁর শ্বশুরকে দিয়ে অঙ্গীকার করিয়ে নিলেন, তিনি কখনও আর যুদ্ধযাত্রা করবেন না। এইভাবে নবনীতা তাঁর রূপকথার গল্পগুলোতে নারীশক্তির জয়গান গেয়েছেন। ইচ্ছেমতী, রূপসা, পদ্মমুখী, পুঁটুরানী সব চরিত্ররাই যেন আসলে নবনীতার ছায়া হয়ে ওঠে। তারা যুদ্ধ করে না। অস্ত্র ধরে না। কিন্তু জয় করে নেয় শক্রুকে। শুধুমাত্র মেধা, মনন আর ভালোবাসা দিয়ে।

বৃষ্টি থেমে গেছে। শেষ বিকেলের নিস্তেজ শীর্ণ আলোতে প্রকৃতি, তার সবুজ, হলুদ, লাল, কালো নানা-রঙা নিশান উড়িয়ে দেয় আকাশে আকাশে, বহুবর্ণ গালচে বিছিয়ে দেয় জমিতে, উজ্জ্বল, অগণিত স্পন্দিত তারা আর জোনাকির ঝাড়লণ্ঠন ঝুলিয়ে দেয় আকাশের চাঁদোয়ার নীচে; অন্ধকার রাতে। জঙ্গলের মধ্যে জঙ্গল, গাছের মধ্যে গাছ, পাতার মধ্যে পাতা, ফুলের মধ্যে ফুল, স্মৃতির মধ্যে স্মৃতি সেঁধিয়ে যায়। মেয়েদের ভিতরে একটা আলাদা চোখ থাকে জানো তো? সেই চোখ দিয়ে দেখছি। তুমি গেট ঠেলে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলে না। জানো, প্রথম প্রথম তোমার কথা মনে পড়লে কী কষ্ট যে হত, তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। সেইজন্য আমি আস্তে আস্তে তোমার মুখচ্ছবিখানি বদলে দিয়েছি। এই যে পাহাড়, এই যে ছোটো নদী, ফুলের সমারোহ, প্রজাপতি এমনকি কাঠঠোকরা পাখিটির মধ্যেও ভাগ ভাগ করে দিয়েছি তোমাকে। ভাালো থেকো নিরন্তর। আশা করি দ্রুতই তোমার চিঠি পাবো।

শুভেচ্ছান্তে-

সুস্মি

২৪ নভেম্বর,২০২৪


0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in






ওরা কোনো কথা শোনে না। হাসতে থাকে সবাই। একসঙ্গে অন্তত গোটাদশেক হাত বের্শেনকে বয়ে নিয়ে যেতে থাকে। বসার ঘরে যেখানে টেলিফোন আছে, সেখানে সবাই মিলে ওকে নিয়ে যায়। সেখানে গের্ট একটা চওড়া চামড়া দিয়ে মোড়া আরামকেদারাতে বসে টেলিফোনে ডায়াল করছে। গের্ট বের্শেনকে নিজের হাঁটুর উপরে বসিয়ে হাতে টেলিফোনের রিসিভার ধরিয়ে দেয়।

‘হ্যালো’… বের্শেন কণ্ঠ থেকে বিরক্তির ছাপ এখনও মুছে ফেলতে পারেনি… ‘আমি কি ফ্রয়লাইন ইনেসের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’

কেউ একজন ওপাশ থেকে পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কে কথা বলছেন ফোনে?’

‘বের্নহার্ড’ বলে কয়েকমুহূর্ত পরে বের্নহার্ডের খেয়াল হয় যে তার একটা ডাকনাম আছে এবং ইনেস তাকে সেই নামেই ডাকে। ইনেস তাকে জিজ্ঞেস করে যে সে ঠিকঠাক আছে কি না।

-‘না’ বলে বের্শেন, ‘কিন্তু তোমার আজ আসা উচিত ছিল একবার। সবাই ভেবেছিল তুমি আসবে। গের্ট, ফার্দিনান্দ… ‘

-‘কিন্তু তাতে তোমার কী, বের্শেন?’ ইনেসের কণ্ঠস্বরে শীতলতা, বন্ধুত্বের উষ্ণতা একটু কম মনে হয়।

-‘আ… আমি জানি না, জানি না’ বের্শেন তুতলে যায়… ‘আমি… আমরা ফেয়ারওয়েল পার্টি করছি।’

-‘আচ্ছা, বুঝলাম। সেইজন্য সবাই মাতাল হয়ে গেছে! কিন্তু বের্শেন, তুমিও?’

বের্শেন থমকে যায়….

-‘আরে… কথা তো বলো। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ বাকিরা সমস্বরে চেঁচিয়ে বের্শেনের হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে কথা বলবার চেষ্টা করে। কিন্তু ইনেস লাইন কেটে দিয়েছে ততক্ষণে। সমস্বরে চিৎকার এবং এরকম অদ্ভুত অভিযোগ সে একেবারে পছন্দ করে না।

কিন্তু ফার্দিনান্দকে থামানো যাচ্ছে না। সে বসবার ঘরের সিঁড়ি দিয়ে সমানে ওঠানামা করছে। তার মুখটা সাঙ্ঘাতিক ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বড় বড় চোখদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে।

‘একবার, অন্তত একবার কি সে আসতে পারত না আমায় বিদায় জানাবার জন্য?’ বন্ধুদের সামনে দাঁড়িয়ে ফার্দিনান্দ বলে যায়… ‘তোমাদের কি মনে হয় না যে তার আসা উচিত ছিল?’ ঘরের সিলিঙের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে অভিযোগ জানাবার ভঙ্গিতে সে বলে আর পায়চারি করে।

ছেলেরা প্রায় কেউই খেয়াল করেনি কখন দরজার বেল বেজেছে। হঠাৎ লুডভিগ তাড়াতাড়ি নিচে দৌড়ে গেল আর সবাই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝে উঠবার আগেই দেখল যে ইনেস এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছে। ফার্দিনান্দের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সে। ফার্দিনান্দের দৃষ্টি একদম শূন্য।

‘শুভ সন্ধ্যা, ভদ্রমহোদয়গণ!’ ইনেস বলে… ‘শুভ সন্ধ্যা ফার্দিনান্দ! কিন্তু আপনার কী হয়েছে? আপনাকে অপ্রকৃতিস্থ দেখাচ্ছে।’

ফার্দিনান্দ হঠাৎ হেসে উঠল। তার কাঠখোট্টা মুখটা একেবারে বদলে গেল এই হাসিতে। দেখে মনে হল বেদনাদায়ক অন্ধকার রাত অতিক্রম করে হঠাৎ এক আলোকোজ্জ্বল ভোরের সময়ে কেউ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। সে অনেকক্ষণ ধরে ইনেসের দিকে তাকিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। এক অসুস্থ মানুষের দিকে লক্ষ্য রাখার মত করে বাকিরা দূর থেকে একদৃষ্টে তার দিকে নজর রাখে…

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ফার্দিনান্দের ফেয়ারওয়েল পার্টির সন্ধ্যাতেই বের্নহার্ডের বাবা হঠাৎ করেই আগেভাগে কিছু না জানিয়ে শহরে এসে উপস্থিত হন এবং ছেলেকে বাড়িতে না পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যান। যদিও বের্নহার্ডের বিষয়ে ঠাকুমা সবসময় ভাল ভাল কথাই বলে থাকেন, তবুও ক’দিন ধরেই তার বাবার মনে বেশ কিছু সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। তাঁর মনে এই ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে বের্নহার্ড যথেষ্ট পরিশ্রমী ছাত্র। কারণ স্কুল এবং সঙ্গীতশিক্ষালয়, এই দুই জায়গা থেকেই ভাল ফল করছে সে বরাবর। কিন্তু অল্পসংখ্যক যে পরিবারগুলির সঙ্গে বের্নহার্ডকে মেলামেশা করতে বলা হয়েছিল, সে তাদের কারো সঙ্গেই যোগাযোগ রাখে না। শুধু স্কুলের বন্ধু কার্লের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে তার। সাধারণভাবে সবাই তার সম্বন্ধে বলছে যে ‘আকর্ষণীয় এবং আদবকায়দাদুরস্ত ছেলে’; কিন্তু কেউই তাকে বেশি দেখতে পায় না। এলাকার সম্মানীয় মানুষজন, সরকারি অফিসার, যাদের বেশ ভাল পরিবার আছে, বের্নহার্ডের বয়সী বাচ্চাকাচ্চা আছে, তাদের কারো সঙ্গে বের্শেন মেশে না। তাছাড়াও সন্ধেবেলায় তাকে বলা হয়েছিল নাচের স্কুলে ভর্তি হবার জন্য। সে বলেছিল যে তার নাকি সময় নেই। সে কথা যে ডাহা মিথ্যে, সেটাও পরিষ্কার।

বের্নহার্ডের ঠাকুমা অবশ্য তার পক্ষেই দাঁড়ালেন এবং বললেন যে বের্নহার্ড মিথ্যে কথা বলেনি। সাধারণত প্রতিদিন সে রাত এগারটা অবধি খাটে। সন্ধ্যায় মাঝেমধ্যে বেরয়, যদি কোথাও বাজনার অনুষ্ঠান থাকে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে বের্শেন লক্ষ্য করল যে এর বেশি আর ঠাকুমা কিছুই বললেন না। উল্টে তার বন্ধুদের সম্বন্ধে বেশ আপত্তিজনক কথা বলতে লাগলেন, বিশেষত গের্ট আর ইনেস সম্বন্ধে। কারণ, বের্নহার্ডের বাবা তাদের সম্বন্ধেই জানতে চাইছিলেন। পরিষ্কার বললেন ঠাকুমা যে আজকালকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপারস্যাপার তার মাথায় ঢোকে না বিশেষ। বের্শেন এই বন্ধুদের পছন্দ করে, করতেই পারে; এদের সঙ্গে লং ড্রাইভে যায়, সেটাও আলাদা ব্যাপার। কিন্তু এদের তিনি ঠিকঠাক বোঝেন না। ঠাকুমা নিজেও অল্পবয়সে খুব ভাল পিয়ানো বাজাতেন। তার প্রতিভাও ছিল। বের্শেন যখন বাজায়, তার ভারি ভাল লাগে। বের্শেনকে তিনি ভালবাসেন, এটাও ঠিক। বের্শেন যথেষ্ট প্রতিভাশালী। কিন্তু বের্শেনকে নিয়ে তিনি চিন্তিত। তাঁর অন্যান্য নাতিনাতনিদের থেকে বের্শেন অনেকখানি আলাদা স্বভাবের। তাঁর নাতিনাতনিদের মধ্যে অনেকেই বের্শেনের থেকে বয়সে বড়; অনেকেরই বেশ ভাল শিক্ষাদীক্ষা, অনেকেই যথেষ্ট প্রতিভার অধিকারী ( এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বের্শেনের দিকে তাকিয়ে তাঁর একথা আরও বেশি করে মনে হচ্ছে)। কিন্তু কেউই বের্শেনের মত স্বাধীনচেতা নয়। জীবনে কী করতে চায়, সেসব ভাবনার বিষয়ে তারা অনেক সহজ। যেমন, রল্‌ফ… সে তো কখনই ভাবেনি যে সঙ্গীতজ্ঞ হবে; স্কুলের পড়াশুনা শেষ করে সোজা বাবার আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায় যোগ দিয়েছে।

কিন্তু বের্নহার্ড? সে স্কুলের পাশাপাশি সঙ্গীতের পাঠ নিচ্ছে এবং সেটা নিয়েই সে ভবিষ্যতে এগোতে চায়। বাইরে খুব নরমশরম চেহারার হলেও এই ছেলে ভিতরে ভিতরে যা ভাবে, সেটাই করে। নিজের ভাবনাচিন্তার বিষয়ে অত্যন্ত একগুঁয়ে এবং উদ্ধত। সব থেকে ভয়ের ব্যাপার হল যে সে সবসময় নিজে বন্ধু নির্বাচন করে থাকে এবং এক্ষেত্রে কারো উপদেশ মানে না। বের্শেনের এইধরণের আচরণে ঠাকুমাও বাবার মতই চিন্তিত। মাত্র সতের বছর বয়সের এক কিশোরের পক্ষে এই আচরণ অত্যন্ত বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে অভিভাবকদের। তাছাড়াও, চেনাজানা যে বিশিষ্ট পরিবারগুলির সঙ্গে তাকে যোগাযোগ রাখতে বলা হয়েছিল, সে তাদের ধারকাছ দিয়ে যায় না। বের্শেনদের মত সম্মানিত পরিবারে এহেন অদ্ভুত আচরণ একেবারেই প্রত্যাশিত নয়। এটাই ঠাকুমার আসল চিন্তা, যেটা একটা চাপা তিক্ততার জন্ম দিচ্ছে। আসলে এমন একজনকেও পাওয়া যাচ্ছে না যে বলবে যে বের্শেন ভাল ছেলে নয়। বের্শেনের সুন্দর মুখ, খোলামেলা বন্ধুত্বপূর্ণ এবং আদবকায়দাদুরস্ত ব্যবহার সবার মন টানে। তবুও যখনই বের্শেনের প্রসঙ্গ উঠছে, কোথায় গিয়ে যেন তাল কাটছে। সবাই বলে যে সে খুবই ভাল ছেলে… তবে…; এই তবে অব্যয়টাই অভিভাবকদের ভাবিয়ে তুলেছে। কোথাও কি অবিশ্বাসের একটা বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে? প্রত্যেকে বলছেন যে বের্শেনের প্রতিভা এবং অন্যান্য ক্ষমতা নিঃসন্দেহে তুলনাহীন, কিন্তু কোনো একটা জায়গায় সম্ভবত তাকে কেউ বুঝতে পারছে না। সে যেন এই জগতসংসারে এক অচেনা আগন্তুকের মত অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে বাঁধা আছে। বাঁধনটা অদৃশ্য, তাই তাকে কেউ বুঝতে পারছে না ঠিকঠাক এবং পুরোপুরি বিশ্বাসও করতে পারছে না। এই অবিশ্বাসের জায়গা থেকেই অনেকের কাছে বের্শেনকে বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছে।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in








কুড়ি

রিমির পাশের বাড়িতে রাজু আর রাজুর বউ প্রজ্ঞা থাকে।রিমি না থাকলেই বিপিন প্রজ্ঞার কাছে যায়,কথা বলে।বিপিন গান করে,"গোলেমালে, গোলেমালে পিরীত কোরো না"। প্রজ্ঞা বলে,খুব তো সাহস দেখাও।বিয়ের আগে তো কিছু বলতে পারো নি। এখন তো আমি পরের বউ গো।বিপিন বলে,অপরজনা এখন আমার আপনজন হয়ে বসে আছে।বিপিন অতীতের কথা বলে প্রজ্ঞাকে,যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। ১৯৮০ সালের কথা এগুলি।এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।

বিপিন বলে,এবার আসি কবিতার কথায়। নব্বই দশকের বাংলা কবিতার যে প্রধান বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ছান্দিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বিষয় ভিত্তিক কবিতা লেখা, বা বলা যায় ভাবপ্রধান বাংলা কবিতার এক প্রবর্ধন, তা শূন্য দশকে এসে বেশ খানিকটা বদলে যায়। আমরা লক্ষ্য করি লিরিক প্রধান বাংলা কবিতার শরীরে কোথাও একটা অস্বস্তি সূচিত হয়েছে। হয়ত নব্বই দশকের লেখা থেকে নিজেদের আলাদা করার তাগিদ থেকেই এই উত্তর। হয়ত সত্তর দশকের ছায়ায় লালিত বাংলা কবিতার পাঠাভ্যাস থেকে নিজেদের আলাদা করার এক সচেতন প্রচেষ্টা। যেখানে নব্বই দশকের সংকলন করতে গিয়ে সম্পাদক সে দশকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখেন প্রেম এর সঙ্গে এটিএম এর অন্ত্যমিল, সেখানে শূন্য দশকের সম্পাদককে ঘাঁটতে হবে নির্মাণের ইতিহাস। যেখানে নব্বই দশকের কবি খুঁজে বেড়িয়েছেন গল্প বলার ছান্দিক দক্ষতা, সেখানে শূন্য দশকের কবি খুঁজেছেন ভাষা প্রকরণ। হয়ত এর পিছনে কাজ করেছে এক গভীর সত্য যে কবিতা আর জনপ্রিয় হয় না। কবি আর চটুল মনোরঞ্জন করবেন না। আর এই কাজে শূন্য দশক অনেকাংশই তাদের শিকড় পেয়েছে আশির দশকের নতুন কবিতা আন্দোলনে।

এছাড়া বাঙালীর দুর্গাপুজে এক ভালোলাগার দলিল।ঘুরে ঘুরে সারারাত কলকাতার ঠাকুর দেখা আর খাওয়াদাওয়া, ধুনুচি নাচের স্মৃতি জড়িয়ে বেঁচে থাকুক অমলিন স্মৃতি।কুমোরপাড়ার খ্যাতি ছিল হাঁড়ি কলসি ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য বাসনপত্র তৈরির জন্যই। এখানকার পুরনো অধিবাসীদের কথায় জানা যায়, বিশ শতকের গোড়ার দিকেও নাকি এখানে কিছু মাটির হাঁড়ি-কলসি নির্মাতার দেখা পাওয়া যেত। প্রথমে হাঁড়ি-কলসি, তার পরে ঘর সাজাবার পুতুল এবং একটা সময়ের পরে, যখন দুর্গাপুজো ক্রমে আমজনতার উৎসবে পরিণত হল, তখন থেকে ছোট্ট সেই কুমোর পাড়া রূপান্তরিত হয়ে উঠতে লাগল প্রতিমা নির্মাণের প্রধানতম কেন্দ্র,কুমোরটুলিতে।

বাসস্টপেজেই অতনুর বাড়ি।সে বলে, রাত বাড়লে বাসস্ট্যান্ড একটা আমোদের জায়গা হয়ে যায়। অন্ধকারে শুয়ে থাকা কিশোরী থেকে বুড়ি ভিখারির পাশে শুয়ে পড়ে মাতালের দল। তারা তো জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি খায় না। শুধু একগ্রাস ভাত জোগাড় করতেই তাদের দিন কেটে যায়। তারপর রাতচড়াদের বাজার। কেউ ওদের মালিক নয়। বাজারি মাল দরিয়া মে ঢাল। ঠিক এই পদ্ধতিতে পৃথিবীর আলো দেখেছিল অতনু। কে তার বাপ সে জানে না। আর জন্মদাত্রী ফেলে দিয়েছিল বাসের ছাদে। সেখানে শকুনের মত ওৎ পেতে থাকে হায়েনার মত ভয়ংকর অমানুষের দল। তারা অনাথ ছেলেমেয়েদের নিয়ে বড় করে। বড় হলে চুরি বা ভিক্ষা করে তারা যে টাকা আয় করে তার বৃহৎ অংশ নিয়ে নেয় হায়েনার দল। না খেতে পাওয়ার প্রবাহ চলতেই থাকে। এর থেকে মুক্তি পায় না অনাথ শিশুরা।

অতনু এখন বেশ স্মার্ট, বুদ্ধিমান। সে নিজের চেষ্টায় মেকানিকের কাজ শিখে নিয়েছে। মাথা উঁচু করে চলা ছেলেদের সকলেই সমীহ করে।

অতনু চুরি করে না, ভিক্ষাও করে না। সে বলে, হাত পা আছে। খেটে খাব। আর তোদের যা পাওনা মিটিয়ে দেব। সে বলে হায়েনার দলকে, বেশি ঘাঁটালে আমাকে, দেব শালা খালাস করে। আমার বাঁধন শক্ত বে। ওসব মাস্তানী তোর পকেটে রেখে দে।

যতই হোক শয়তানদের সাহস কিন্তু বেশি হয় না। অতনু একটা দল করেছে ছেলে মেয়েদের। সে বলে, শালা, কোন শালা রাতে খারাপ কাজ করতে এলে একসঙ্গে আ্যটাক করব। ওদের দৌড় বেশিদূর নয়। অতনু থাকতে আর অনাথের দল বাড়াতে দেব না বাসস্টপে। এই এলাকা এখন নতুন প্রজন্মের। ওরা আমাদের বড় করেছে তাই ওদের পাওনাটুকু দেব।

হায়েনার দল সাবধান হয়ে গেছে। এখন আর অনাথ বাচ্চা কম পায় এইস্থানে। অতনুর বিরুদ্ধে কাজ করে ওরা অনেকবার ঠকেছে।অতনুর দলবল দেখে ওরা অন্য জায়গায় ডেরা বাঁধে।

অতনু সকলকে নিজের পরিবারের সদস্যের মত দেখে।

এই পরিবারের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সুনীতা। সে পাশের পাড়ায় থাকে। অতনু তার আদর্শ। কিন্তু অতনুর বংশ পরিচয় নেই। তা না থাক তবু সে সমাজসেবী।

অতনু দেখেছে মারামারি বা লড়াই করে জেতার থেকে ভালবাসার জোর বেশি। ভালোবেসে কথা বললে শয়তানও বশ হয়ে যায়। এখন সে একদম আনন্দে থাকে। এলাকার লোকজন তাকে ভালবাসে।

সুনীতা ভাবে, অতনুদা এত বড় মন পেল কোথা থেকে।

সকলের উপকারে ছুটে যায় অতনু। হাসপাতাল,শ্মশান যেখানে যার প্রয়োজন প্রথমেই ডাকে তাকে। সুনীতা ভাবে, সে কি অতনুর প্রেমে পড়েছে। সবসময় অতনুকে দেখতে পায় খাতায়, জলে, দেওয়ালে, আয়নায়। তবু অতনুকে বলতে সাহস হয় না। যদি রেগে যায়। যা ব্যক্তিত্ব ছেলেটার, শ্রদ্ধা হয়। সুনীতা সবসময় এখন এইসব ভাবে।

অতনু বলে তার বন্ধুকে, আমি তো অনাথ, বেজন্মা। ভদ্র সমাজে আমার স্থান হবে না। আমি কি চিরদিন এই বাসস্টপেজেই থেকে যাব?

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in










১৮ (১) 

“ অনেকদিন আগের কথা। এক ছিলেন নবাব সাহেব, আর তাঁর ছিল এক শাহজাদা, বাপের সুপুত্তুর।

“ ভাল হল তোমরা পঞ্চায়েতের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছ। সেই প্রসঙ্গেই আমার এই কিসসা মনে পড়ল। ছোটে পালোয়ান সরপঞ্চকে মুখের উপর চ্যালেঞ্জ করেছে—বেশ করেছে। পঞ্চায়েত আদালতের বিচার ছোটেলালের মত লোকের জন্যে নয়। ও হল বড়মাপের মানুষ। এত বড় পালোয়ান! তায় আমাদের কলেজ কমিটির মেম্বার। ওখানকার বিচার তো গেঁয়ো লোকদের জন্য। কানাকড়ি দাম নেই এসব বিচারের। কোড়িল্যা মার্কা বিচার। হেঁ—হেঁ –হেঁ, কোড়িল্যা কাকে বলে জানো? রুক্ষ উষর জমিতে আপনা থেকেই জন্মায়। গ্রীষ্মকালে দেখে থাকবে—সাদা সাদা ফুল।

“আরে তুমি হলে শহুরে বাবু, এসব কী করে দেখবে? এই পঞ্চায়েতী আদালত? ওরা ওই কোড়িল্যা-ছাপ রায় দেয়। আর ওই সরপঞ্চ? সবাইকে কিছু একটা ফালতু গুরুগম্ভীর লেকচার দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। কিন্তু এবার পালা পড়েছিল ছোটে পালোয়ানের সাথে—একেবারে কুপোকাত! ও যেমন বুনো ওল, ছোটে তেমনি বাঘা তেঁতুল! ----

“কুসহরপ্রসাদকে আগেই বলেছিলাম-- পঞ্চায়েতী আদালতে যেওনা। শুনলে তো! এখন মাথায় ঢুকেছে। সরপঞ্চ চার-পাঁচটা কাঁচাপাকা শুনিয়ে দিতেই সব শুধরে গেল। ওখানেই ছোটেলালজীর সঙ্গে মিটমাট করে নিল।

“ ঠিকই হল, বাপ-বেটার মধ্যে কীসের আকচা-আকচি?

যা বলছিলাম, ওঁর ছিল এক শাহজাদা। কার? নবাব সাহেবের। হ্যাঁ, হ্যা; ওই কিসসাটাই তো বলছি। একবার ওর হল খুব অসুখ। জ্বর কিছুতেই নামছে না। কয় মাস ধরে ভুগছে; অনেক দামি দামি ওষুধ, বড় বড় কবিরাজ, হাকিম, ডাক্তার। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। কোটি কোটি টাকা নর্দমার জলের মত খরচ হচ্ছে, কিন্তু শাহজাদার হাল যে কে সেই।

“নবাব সাহেব মাথা চাপড়াচ্ছেন। চারদিকে ডঙ্কা বাজানো হল—কেউ এসে আদ্দেক সম্পত্তি নিক, শাহজাদিকে বিয়ে করুক,--কিন্তু শাহজাদাকে সারিয়ে তুলুক! এবার দূর দূর থেকে হাকিমের দল এলেন। অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু শাহজাদা চোখ মেললেন না।

“শেষে এলেন এক বুড়ো হাকিম। শাহজাদাকে দেখে বললেন, ‘আদ্দেক সম্পত্তি ও শাহজাদীতে আমার লোভ নেই, ভোগ-বিলাসে রুচি নেই। যদি আমার একটা দরখাস্ত মঞ্জুর করেন তো শাহজাদাকে সারিয়ে তোলার দায়িত্ব আমার। কিন্তু দরখাস্ত গোপনে পেশ করব’।

“তো নবাবের হুকুমে দরবার খালি হয়ে গেল। হাকিম বললেন, ‘বন্দাপরবর! দাসের প্রতি আপনার অনেক কৃপা। এবার বেগমকে এখানে আসতে হবে। যা জিজ্ঞেস করব তার জবাবে সত্যি কথা বলতে হবে।‘

“নবাব সাহেবও সেখান থেকে চলে গেলেন। বেগম সাহেবার দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে হাকিম বললেন, ‘যদি শাহজাদার প্রাণ বাঁচাতে চান তো সত্যি কথা বলুন। শাহজাদা আসলে কার সন্তান? কার ঔরসে জন্ম’?

“বেগমা সাহিবা কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘কাউকে বলবেন না! একসময় মহলে কাজ করত এক ভিস্তি, শাহজাদা তার ছেলে। তরতাজা জোয়ান, গ্রাম থেকে নতুন নতুন এসেছিল, তারপর কী করে যে কী হয়ে গেল তা’ জানিনা’।

“এটা শোনামাত্র হাকিম বললেন, ‘শুক্রিয়া! আর কিছু বলতে হবে না’। চুটকি বাজিয়ে বললেন, ’কথায় কথায় বুঝে গেছি শাহজাদা কীভাবে সারবেন’।

“তারপর হাকিম সাহেব আগের সব ওষুধ ফেলে দিলেন। কত দামি দামি দ্রব্যের অনুপান! হীরেমোতি, সোনাচাঁদি! কত রকমের অদ্ভুত সব আরক! সব নর্দমায় বয়ে গেল। তারপর উনি শাহজাদার চোখে জলের ছিঁটে দিয়ে বললেন, ‘আবে উঠ! ভিস্তির ব্যাটা! উঠে পড়’।

“ব্যস্‌, শাহজাদা চমকে উঠে চোখ খুললেন। তারপর হাকিম গেলেন মাঠে। সেখান থেকে কয়েকটা কৌড়িল্যার চারা উপড়ে এনে জলের ছিটিয়ে পিষে শাহজাদাকে গিলিয়ে দিলেন। তিনদিন নিয়মিত কৌড়িল্যার রস খেয়ে শাহজাদা চাঙ্গা!”

এই কিসস্যাটি বৈদ্যজীর দরবারে বসে শোনাচ্ছিলেন -প্রিন্সিপাল। মুখ্য শ্রোতা -রঙ্গনাথ। মুখ্য বিষয়—পঞ্চায়তী আদালত। গল্পের প্রেরণাশক্তি—ভাঙের শরবত।

উনি বলছিলেন, ‘তো রঙ্গনাথ বাবু, এই হল কৌড়িল্যামার্কা ন্যায়বিচার। দেহাতিদের এরকমই ধরে নেওয়া হয়—যত্ত নীচু জাতের লোকজন! ওদের আর কী চাই? চলে এসো পঞ্চায়তী আদালতে আর কৌড়িল্যামার্কা ন্যায়বিচার পেয়ে বাড়ি যাও!

“আর যারা বড় মানুষ, রঈস-টইস, হাকিম-হুকাম, উঁচু জাতের লোকজন। ওদের চাই দামি বিচার। ঘাস কাটার সরপঞ্চ নয়, মোটা চশমা পরা ইংরেজের মতন ইংরেজিবলা জজসাহেব। বড় মানুষদের জন্য রয়েছে জেলার বড় বড় আদালত, যেমনটি চাই তেমন।

“ওদের চেয়েও বড়দের জন্য রয়েছে অনেকগুলো হাইকোর্ট। সবচেয়ে উঁচু জাতের জন্য সুপ্রীম কোর্ট। কেউ একবার বাঁকাচোখে তাকিয়ে দেখুক তো! তাতেই সোজা দিল্লি গিয়ে রিট পিটিশন লাগিয়ে দেয়া হয়।

“কৌড়িল্যামার্কা আদালত আর যত নীচু জাতের লোক! ওখানে যদি একবার ফেঁসে যায় তো ধরে নাও বসা অবস্থা থেকে উঠে সোজা দাঁড়াতে পারবে না। এক দানা খাবারের জন্য ভিক্ষে করে বেড়াবে।

“হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট—এসবের শখ কী সবাইকে পোষায়? এক-একজন উকিলের পেছনে একশটা বেশ্যা পোষার খরচ!

“তাই গেঁয়ো লোকজনের জন্যে কৌড়িল্যা-মার্কা ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা। না হিং-লবঙ্গ, না ফিটকরি! তাতেও রঙ চোখা! এক দাগ খেয়ে দেখ, জ্বর নেমে যাবে। আমাদের দেশের কানুন একদম পাকা, --যেমন লোক, তার তেমনই আদালত”।

হঠাৎ উনি হিন্দি ছেড়ে অবধী বোলিতে চলে গেলেন। ‘যেমন পশু, তেমনি করে বাঁধা’।


গাঁয়ের বাইরে এক লম্বা চওড়া ময়দান যা ধীরে ধীরে ঊষরভূমি হয়ে গেছে। আজ একগাছি ঘাসও গজায় না। দেখলেই মনে হবে -আচার্য বিনোবা ভাবেকে ভূদান দেবার জন্য একেবারে আদর্শ জমি। আসলে তাই হয়েছিল। বছর দুই আগে এটাকে ভূদান-আন্দোলনে দিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে ওটা ফিরতি দান হয়ে গ্রামসভার অধিকারে এল। গ্রামসভা আবার ওটা প্রধানকে দান করে দিল।

প্রধান এটাকে কয়েক ভাগ করে নিজের আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবকে দিল। তারপর একটু আধটু টুকরো যা বেঁচে ছিল সেগুলো বাজারের কেনাবেচার নিয়ম মেনে কিছু গরীব ও ভূমিহীনকে “দান” করে দিল। পরে জানা গেল যে গরীব এবং ভূমিহীনকে দেয়া জমির টুকরোগুলো আসলে ওই ময়দানের অংশ নয়, বরং অন্য কোন কৃষকের জমির অংশ। সুতরাং এটা নিয়ে মোকদ্দমা শুরু হল, এখনও চলছে, ভরসা আছে—পরেও চলতেই থাকবে।

যাই হোক, ভূদান-যজ্ঞের ধোঁয়া এখনও ময়দানের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে। ওখানে খেত তৈরি হয়ে গেছে। তার প্রমাণ বলতে প্রতি পদে একএকটা আল বাঁধা হয়েছে, তার উপর বিছিয়ে দেয়া বাবলা গাছের কাঁটাওলা ডাল। সার-জল-বীজ বিনা স্রেফ ইচ্ছাশক্তির জোরে, গত বছর থেকে নাকি ভাল করে চাষ শুরু হয়েছে। আর স্রেফ পাটিগণিতের জোরে এটা প্রমাণ করা গেছে যে গ্রামসভায় গত বছর-- আগের সব বছরের থেকে – অনেক বেশি অন্ন উৎপাদন হয়েছে।

গাঁয়ের পশুর পাল কখনও কখনও ওই ময়দানকে নিজেদের চরে খাবার স্থান ভেবে পুরনো অভ্যাসে এদিকে চলে আসে। কিন্তু তারপরেই চাষিদের মধ্যে গালাগালি, মারপিট, পঞ্চায়েতের খোঁয়াড়, থানাপুলিশ, কোর্ট-কাচারি সব শুরু হত। তাই ধীরে ধীরে ওদিকে পশুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেল।

ময়দান আজকাল নিঃশব্দ নীরব। আশাবাদী কেউ যদি ওদিকে পা ফেলে তবে তার মনে হবে যে এই নীরবতার মধ্যেই প্রগতির শঙ্খ বেজে উঠল বলে!

ময়দানের এক কোণে বন-সংরক্ষণ, বৃক্ষারোপণ এসব শুরু হয়েছিল। যোজনা সফল হল কি বিফল—সেটা বিতর্কের বিষয়। চোখে পড়ে যে নালা কাটা হয়েছে আর শোনা যায় যে ওখানে বাবলা গাছের বীজ বোনা হয়েছে। এটাও শোনা যায় যে এই ‘গঁজহা’ লোকগুলো যদি অমন ‘গঁজহা’ নাহয়ে আশপাশের গাঁয়ের মত উদ্যোগী পুরুষসিংহ হত তাহলে এই উষর মরুতেও এতদিনে বাবলা গাছের বন গজিয়ে উঠত।

কিন্তু মাটি ভালো নয়, তাই নালার পাশে বাবলা গাছ গজালো না, কিন্তু পুরো যোজনা থেকে শিবপালগঞ্জের লোকেদের একটা লাভ হল। নালাগুলো ওদের সার্বজনিক শৌচালয় হয়ে গেল। এই ধরণের সরকারী স্কীম বানানো হয়েছিল বন নির্মাণের জন্য, এখন হয়ে গেল ঘরোয়া কাজের।

ময়দানের অন্য কোণে শূন্যতাকে ধর্ষণ করার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল বটগাছ। তারপাশে একটি কুয়ো। ওই কুয়োর বাঁধানো পাড়ে রঙ্গনাথ বসে আছে। হিন্দুস্তানের লেখাপড়া জানা লোকেদের মাঝে মাঝে একটা অসুখ হয়, তার নাম ‘ক্রাইসিস অফ কনশান্স’—বিবেকের দংশন! কোন কোন ডাক্তার এর মধ্যে ‘ক্রাইসিস অফ ফেথ’ বা বিশ্বাসের সংকট নামক অন্য একটা অসুখের লক্ষণও কষ্ট করে খুঁজে পান।

এইসব অসুখ সাধারণতঃ শিক্ষিত লোকের মধ্যেও তাদেরই হয় যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী মনে করে। মজার ব্যাপার হল এরা কেউ বুদ্ধির ভরসায় বাঁচে না, বরং আহার-নিদ্রা-ভয়-মৈথুনের মাধ্যমেই বাঁচে। (কারণ, শুধু বুদ্ধির ভরসায় বাঁচা অসম্ভব)।

এই অসুখের রোগী মানসিক চিন্তা এবং অবসাদে ভোগে, লম্বা লম্বা লেকচার ঝাড়ে এবং চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তর্ক করে। নিজেকে --বুদ্ধিজীবী হয়েছে তাই অসুস্থ, এবং অসুস্থ হয়েছে সুতরাং বুদ্ধিজীবী-- বলে প্রমাণ করত চায়। শেষে এই অসুখ নিরাময় হয় কফি হাউসের বিতর্কে, চঞ্চল মেয়েদের বাহুবন্ধনে, সরকারি চাকরি পেয়ে, কখনও কখনও আত্মহত্যায়।

কলেজে ম্যানেজারের নির্বাচন দেখার দিন থেকে রঙ্গনাথের মনে ওই অসুখের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিল। ওর মামা বৈদ্যজীকে দেখামাত্র ওর মনে সেদিনের এক দৃশ্য ভেসে ওঠে—প্রিন্সিপাল সাহেব শূলে বেঁধা শুয়োরের মতন চিঁচিঁ করতে করতে কলেজের গেট থেকে বেরোচ্ছেন আর জয়ধ্বনি করছেন। ওর মনে হল বৈদ্যজীর সঙ্গে থাকতে থাকতে ও যেন কোন ডাকাত দলের সদস্য হয়ে গেছে। যখন প্রিন্সিপাল সাহেব দাঁত বের করে ওকে কোন রগরগে কিসসা শোনাতে থাকেন---ওনার ভাণ্ডারে এমন কিসসা অগুনতি—তখন ওর মনে হয় এই লোকটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে কারও গলা টিপে দিতে পারে।

শহরে থাকলে এখন ও কফি হাউসে বন্ধুদের সামনে বসে এই নির্বাচন নিয়ে একটা লম্বাচওড়া লেকচার ঝাড়ত। বলত—কীভাবে দেশি পিস্তলের জোরে ছংগামল ইন্টার কলেজের ম্যানেজারি কব্জা করা হল। আর টেবিল চাপড়ে বলত যে মুলুকে ছোট ছোট জায়গায় ছোট ছোট ক্ষমতা হাতিয়ে নিতে এমন সব করা হয়, সেখানে বড় বড় ক্ষমতা লাভের জন্য কী না হতে পারে!

তারপর ঠিক বা ভুলে ভরা দু-চারটে ইংরেজি কোটেশন আউড়ে কফির কাপ খালি করার পর শান্তি পেত এই ভেবে যে ও একজন খাঁটি বুদ্ধিজীবী, এবং চারটে অকম্মার ঢেঁকির সামনে গণতন্ত্রের পক্ষে এক জ্বালাময়ী বক্তিমে ঝেড়ে ধরে নিত যে এবার ও ভেতরের জমে থাকা উষ্মা বের করে নিজের ‘ক্রাইসিস অফ ফেথ’কে ধামাচাপা দিতে পেরেছে।

কিন্তু এটা তো শহর নয়, নেহাত পাড়া -গাঁ, এখানে রূপ্পনবাবুর ভাষায়, নিজের বাপকেও বিশ্বাস নেই। এছাড়া , শনিচরের ভাষায়, এখানে কাটা আঙুলে পেচ্ছাপ করার মতও কেউ নেই। তাই রঙ্গনাথ এখানে নিজের মানসিক অসুখ থেকে রেহাই পেল না। ওর মাথায় দিনরাত একটা জিনিসই ঘুরছে----ও কোন ডাকাত দলে ফেঁসে গেছে। ডাকাতগুলো হামলা করে কলেজ লুট করেছে। এবার অন্য কোথাও আচমকা হামলা করার তালে আছে। ওর শরীরমন চাইছে বৈদ্যজীকে গালি দিতে আর তার চেয়েও বেশি উসখুস করছে কার সামনে বিশ্বাস করে গালি দেয়া যায়?

এমন বন্ধু আর কে আছে? খান্না মাস্টারের পেটে কথা থাকে না। ওর সামনে বললে পরের দিন গোটা গাঁও জেনে যাবে যে বৈদ্যজীর ভাগ্নে নিজের মামাকে গালি দেয়! দেখে নাও, আজকালকার লেখাপড়া জানা ছেলেগুলোক-- ভদ্রতা শেখেনি। হ্যাঁ, মালবীয় মাস্টারের কাছে বলা যেতে পারে। ও দলবাজিতে যুক্ত হলেও বড্ড সাদাসিধে। ওর সামনে গাল দিয়ে মজা নেই। বাকি রইল কে? রূপ্পনবাবু?

রঙ্গনাথের রূপ্পনবাবুর উপর খানিক ভরসা ছিল। কারণ, ওমাঝে মাঝে প্রিন্সিপালকে গাল দিয়ে বলত—কলেজের দুর্ভাগ্য! ওনার অভিযোগ—প্রিন্সিপাল লেখাপড়ায় গবেট, কিন্তু দুনিয়াদারিতে মহা ওস্তাদ! পাক্কা ছকবাজ! বাবাকে এমন ফাঁদে ফেলেছে যে সব কাজ ওই ব্যাটার ইচ্ছেতে হলেও বাবা ভাবে বাবার কথায় হচ্ছে। ব্যাটা খান্না মাস্টারের সঙ্গে খুব বাড়াবাড়ি করেছে। মানছি, খান্না মহাবেকুব। কিন্তু ওকে এত বেশি অপমান করা ঠিক নয়। আমার বাবার কাঁধে বন্দুক রেখে এক ব্যাটা বেকুব অন্য বেকুবকে মেরে দেয়া? এটা অনুচিত।

আজ ওই বটবৃক্ষের ছায়ায় কুয়োর পাড়ে বসে রঙ্গনাথ প্রশান্ত চিত্তে এক লম্বা শ্বাস টানল। অনেক দিন পরে আজ ওর সেই অসুখ ওকে বিচলিত করছে না। হল কি,আজ ও হিম্মত জুটিয়ে রূপ্পনবাবুর কাছে নিজের আত্মসংকট নিয়ে খোলাখুলি কথা বলল। স্পষ্ট করে বলল যে মামাজীর এমনটা করা ঠিক হয়নি। আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ম্যানেজারি হাসিল করলেন বটে, কিন্তু চারদিকে অপযশ তো রটেছে!

রূপ্পনবাবু ওনার ‘ধর -তক্তা- মার- পেরেক’ ভঙ্গিতে বললেন—‘দেখ দাদা, এসব তো পলিটিক্স। এটা তো কিছুই নয়। এ’লাইনে অনেক বড় বড় বদমাইশি হয়। পিতাজি যে পথে এগিয়ে চলেছেন তাতে আরও কিছু করতে হতে পারে। দুশমনকে –সে যেই হোক—চিৎ করতে হয়। না পারলে উনি নিজেই চিৎ হবেন, তারপর বসে বসে কবরেজি পুরিয়া বানাতে থাকবেন। কেউ ফিরেও তাকাবে না।

‘তবে কলেজটাকে অনেক শোধরাতে হবে। প্রিন্সিপাল ব্যাটা মহা হারামী। সারাদিন দলবাজি, সারাদিন কিচকিচ। খান্না মাস্টারও একনম্বরের গর্দভ, কিন্তু হারামী নয়। শালার প্রিন্সিপাল ওকে অনেক অপমান করেছে, নীচে নামিয়েছে। এবার ওকে টেনে তুলতে হবে। আমি পিতাজীর সঙ্গেও কথা বলেছি। কিন্তু উনি প্রিন্সিপালকে খাটো করতে চান না।

‘ভেবেছি , কিছুদিন বাবাকে কিছু না বলে খান্না মাস্টারকে একটু হাওয়া দেব। তাতেই প্রিন্সিপাল চিতপটাং হবে। ও শ্যালক ফুলে ঢোল হয়েছে। এখন ওর ফাটার সময়। একবার ব্যাটা চিৎ হলে বাবাও টের পাবেন ব্যাটা কত তালেবর---‘!

এইসব শুনে রঙ্গনাথ বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে নিঃশ্বাস টানল। এটা তো বোঝা গেছে যে রঙ্গনাথ এই বিষয়ে রূপ্পনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে পারে। এটাও স্পষ্ট হল যে রূপ্পনবাবুর সামনে ও খান্না মাস্টারের জন্য সহানুভূতি দেখাতে পারে, যে পড়ে গেছে তাকে টেনে তুলতে পারে, যে ফুলে গেছে তাকে ফাটিয়ে দিতে পারে। সোজা কথায়, অন্যায়ের সামনে মুখোমুখি দাঁড়াতে না পারলেও চোরাগোপ্তা ভাবে লড়াই করে ফের সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ওর থেকে প্রায় এক ফার্লং দূরে রূপ্পনবাবু একটা গাছের পেছনে অনেকক্ষণ ধরে বসে থেকে পেটের ভেতরের গণ্ডগোল সাফ করছিলেন। এভাবে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার সার্বজনিক সমাধান করে যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন রঙ্গনাথও কুয়োর পাড়ে উঠে দাঁড়ালো। রূপ্পনবাবু ওর দিকে আসছিলেন না, তাই রঙ্গনাথই ওনার দিকে এগিয়ে গেল।

(চলবে)

0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in





















১. বিভূতিভূষণের মৃত্যুচেতনা



জ্যোৎস্না-ধোয়া সাদা বাড়ির ভেতর থেকে কেউ চাপা গলায় হেসে উঠল যেন! খটকা লাগল। থামলাম। নাহ্‌, মনের ভুল- আমি ফের পা চালাাই। সেই বিশেষ অসমান জায়গাটার কাছে এসেই হুমড়ি খেলাম। জায়গাটার সিমেন্ট, বুনো ফুল এবং অযত্নে বাড়া ঘাসের ঝাড় হাপিস হয়ে গেছে। আামি বাসু মনে পড়ছে আমার কথা? দশ বছর ধরে আমি এই একই রাস্তায় সকাল-সন্ধ্যা মাইলের পর মাইল হাঁটছি কিন্তু অদ্যাবধি এক মুহূর্তের জন্যেও আরেকটি প্রাণের দেখা মেলে নি। সুস্মির কথা মনে আছে নিশ্চয়? আমি এবং সুস্মি প্রেমিক- প্রেমিকা। ও আমাকে ওর ছেলেবেলার অনেক গল্প শোনাত। ওর বাবা প্রতিদিন ইউনিভার্সিটিতে যেতো। ওর মা ওর সব জামাকাপড় বানিয়ে দিতো। ওর দিদার গা থেকে সবসময় ডিল ব্রেড ও ভ্যানিলার গন্ধ মৌ মৌ করে ভেসে আসতো। আমি হা করে এসব গল্প গিলতাম। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হোত যদিও সেটা করতে পারতাম না। আর সেইসব রূপকথা যেগুলোকে ও ভাবতো যে সবার জীবনেই আছে সেগুলোর জন্য মুখিয়ে থাকতাম। সুস্মি অনেক বছর দেশের বাইরে আমাদের ঠিক কেন কবে কোন কারণে কথা বন্ধ হয়েছিল আমার মনে নেই। মৃত একটা সম্পর্ক নিয়ে দিব্যি বেঁচে আছি, কিন্তু এতবছর পরে সু্স্মির হাতে লেখা চিঠি যখন হেমন্তের এক বিকালে ধূলোমাখা ডাকবাক্সে আলো ছড়াচ্ছিল তখন ফেলে আসা দিনগুলো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছিল শীতার্ত মনে।

খাম খুলে বেশ অবাক হলাম। চারটি সাদার পৃষ্ঠার পরে পঞ্চম পাতার শেষে লেখা-

‘সুন্দর জ্যোৎস্না ভেঙেচে নদীজলে- কি অপূর্ব্ব শোভা! ভগবানকে ডেকে বললুম- তোমার নিত্য সঙ্গী হয়ে থাকতে চাই- ঐ সন্ধ্যাতারার মত রহস্যের মধ্যে, জ্যোৎস্নালোকিত আকাশের উদার ব্যাপ্তির মধ্যে, বনপুষ্পের সুবাস ও বিহঙ্গকাকলীর মধ্যে আমায় তোমার খেলার সঙ্গী করে রেখো যুগে যুগে। তুমি আপন মনে বিশ্বের বনতলে নবীন কিশোর সেজে বনফুলের মালা গলায় উদাসী হয়ে বেড়াও- কে তোমায় পোঁছে? কেউ না। সবাই ধন, জন, মান, যশ নিয়ে ব্যস্ত। কে দেখেচে এই জ্যোৎস্নাময়ী নিশার অপূর্ব্ব মনমাতানো শোভা! আমায় দেখবার চোখ দিও জন্মে জন্মে।’

– ইতি, সুস্মি

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুস্মির প্রিয় কথাসাহিত্যিক। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৭ মে ১৯৪৩ সালে লেখা ডায়েরি থেকে সুস্মি এটা লিখেছে, এটা লিখতে গিয়ে চারটি পাতা খালি রাখার রহস্য বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে খামে জ্বলজ্বল করা সুস্মির ঠিকানায় একটা চিঠি লেখার লোভ সহসা পেয়ে বসলো। মোহাচ্ছন্ন আমি খাতা কলম নিয়ে বসে পড়লাম।

সুপরিচিতাষু সুস্মি,

এক যুগ পরে তোমাকে লিখছি। কেমন আছো? হেমন্তের পড়ন্ত বিকালে তোমার চিঠি পেলাম। চার পাতায় যা যা লিখবে ভেবেছিলে আমি যেন তা পড়তে পারছি সাদা পাতায়। আমার মনে হলো তোমার চিঠির উত্তর তোমার প্রিয় লেখকের কথাতেই দেই। ২৮ অগাস্ট, ১৯২৫-এ, ‘স্মৃতির রেখা’ দিনলিপিতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন: ‘…Sadness জীবনের একটা অমূল্য উপকরণ- Sadness ভিন্ন জীবনে profundity আসে না- যেমন গাঢ় অন্ধকার রাত্রে আকাশের তারা সংখ্যায় ও উজ্জ্বলতায় অনেক বেশী হয়, তেমনই বিষাদবিদ্ধ প্রাণের গহন গভীর গোপন আকাশে সত্যের নক্ষত্রগুলি স্বতঃস্ফূর্ত্ত ও জ্যোতিষ্মান হয়ে প্রকাশ পায়। তরল জীবনানন্দের পূর্ণ জ্যোৎস্নায় হয়ত তারা চিরকালই অপ্রকাশ থেকে যেত।’

প্রকৃতিপ্রেমিক, রোম্যান্টিক এমন নানা অভিধায় বিভূতিভূষণকে ধরা যায়, এ কথা ঠিক। কিন্তু বিভূতিভূষণের সৃষ্টি মৃত্যুর কথাও বলে, যে মৃত্যু শাল-পিয়ালের বনে সন্ধ্যা নামার মতো নিবিড়। তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে মন চাইছে, খুব খুব জানতে ইচ্ছে করছে তরুণী সু্স্মির মনে দোলা দেয়া বিভূতিভূণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃতিপ্রেম ছাপিয়ে কি বিগতা যৌবনার মনে কোথাও বিভূতিভূষণের মৃত্যুচেতনা ছায়া ফেলেছে? যা ভাবছি তা যদি সত্যি হয় তবে বলতেই হবে বয়স হয়েছে তোমার! তোমার মনে আছে কিনা জানিনা। কলেজের দিনগুলোয় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় মৃত্যুচেতনা নিয়ে কথা বলায় তুমি খুব রেগে বলেছিলে জীবনানন্দ দাশ ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি গুলিয়ে ফেলেছি। সেইদিন বলতে না পারলেও আজ এতগুলো বছরের শেষে তোমাকে লিখতেই পারি আমার ভাবনা। রাগ করবে না আশা করি।

বিভূতি-সাহিত্যে মৃত্যুর ধারণাটির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলে ‘বৃহদারণ্যক’ উপনিষদের একটি কাহিনির কথা মনে পড়ে। ঘটনাচক্রে, সৌরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে বিভূতিভূষণ বলছেন, ‘আমি সারা জীবন ধরে জন্ম-মৃত্যু রহস্যের আলোচনা করেছি ও রহস্য জেনে ফেলেছি।’ ওই চিঠিতেই তিনি বিশেষ ভাবে ‘বৃহদারণ্যক’ ও ‘ঈশোপনিষদ’-এর কথা উল্লেখ করছেন। এই সূত্রেই ওই কাহিনিটির অবতারণা। সেখানে মৈত্রেয়ীর প্রশ্ন, ‘ধরা যাক, গোটা পৃথিবী বিত্তে পরিপূর্ণ। তা আমার নিজস্ব সম্পত্তি হলে, আমি কি ‘অমৃতা’ হব?’ যাজ্ঞবল্ক্যের উত্তর, ‘বিত্তের দ্বারা ‘অমৃতত্ত্বের’ আশা করা নিরর্থক।’ বস্তুত, অমৃতের একটি অর্থ যদি অমরত্ব হয়। অন্য একটি নিগূঢ় অর্থ, আনন্দ।— জীবন-মৃত্যুর ধারণা নিয়ে বিভূতিভূষণ এই আনন্দেরই পিয়াসী। সেই তেষ্টা থেকেই তাঁর ‘আর্টের’ জন্ম।

জীবনের শেষ পর্বে বিভূতিভূষণ যখন ব্যারাকপুরে ছিলেন তখন সেখানে দেখা পেয়েছিলেন এক ভৈরবীর। বিভূতি মেতেও উঠেছিলেন তাঁর সঙ্গে। ভৈরবী শবসাধনা করতে এসেছেন জেনে, বিভূতিও তাঁর কাছে নিত্য যাতায়াত বাড়িয়েছিলেন। রেগে যেতেন কল্যাণী। তবু কী এক মায়ায় নাছোড় বিভূতিকে আগলে রাখতে পারতেন না! বিভূতিভূষণ রাতভর সাধনায় মেতে থাকতেন স্ত্রী-সংসার ভুলে। তাঁর দিনলিপির পাতায় পাতায় পরলোক নিয়ে বিশ্বাসের কথা রয়েছে। তারই সংশ্লেষ ‘দেবযান’ উপন্যাস। মৃত্যুর পর আত্মার উপস্থিতি নিয়ে বিভূতির বিশ্বাস যেন প্লটের বাঁকে বাঁকে। মৃত্যুর পর কোথায় থাকে আত্মা? শবের কাছেই কি দাঁড়িয়ে থাকে? কী ভাবে উড়ে যায়? ফিরে আসে কি? সব প্রশ্নের উত্তর যেন মিলে যায় যতীন চরিত্রটিকে নিয়ে তাঁর লেখায়। মৃত্যুর আগের জীবন সম্পর্কে আমরা সকলেই ওয়াকিবহাল কিন্তু মৃত্যুর পরবর্তী জীবন কেমন হবে এটাই মানুষের চির-কৌতূহলের বিষয়। এই চিন্তা থেকেই জন্ম নিয়েছে দেবযান। উপন্যাসটা পড়া শেষ করে মনে হয়েছে, এ তো শুধ মৃত্যু চেতনা নয় এর ভিতরে ধরা আছে স্রষ্টার গভীর চিন্তা ও বিশ্বাসের জগৎ। আছে সুগভীর রোমান্টিক চেতনাবোধ। তোমার সতের কিংবা আঠারতম জন্মদিনে তোমাকে উপহার দিয়েছিলাম দৃষ্টিপ্রদীপ ও দেবযান। বইগুলো কি তোমার সঙ্গে আছে নাকি বন্ধ বাড়ির বুকসেলফে উদাস তাকিয়ে আছে? এখনো নিয়ম করে রোজ রাতে কবিতা পড়ো? নাকি কর্মব্যস্ত কর্পোরেট জীবনে কবিতারা বই বন্ধি হয়ে পড়ে থাকে ল্যাপটপের পাাশে নিঃসঙ্গতায়? তুমি তো জন্মান্তরবাদ বিশ্বাস করতে। তাই না? ভারতীয় নিয়তিবাদ দুটি স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে আছে— জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদ। প্রথমে উদ্ভূত হয় জন্মান্তরবাদ, এবং লক্ষণীয় যে, প্রথম উল্লেখে এটি পুনর্জন্ম নয়, পুনমৃত্যু। এবং আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, এই ধারণাটি প্রথমে মানুষকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত হয়নি, দেবতাদের সম্পর্কেই এর আদিমতম উল্লেখ। জন্মান্তরবাদ প্রবর্তিত হল কেন? একটা সহজ কারণ হল, মানুষের জীবনপ্রীতি; মৃত্যুর ওপারে জীবনকে বিস্তারিত করে দেখার বাসনা এবং সে কারণেই যুক্তিগত ভাবে জন্মের পূর্বেও তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, জন্মান্তরে বিশ্বাস করলে এক জীবনে যত অভিজ্ঞতা হওয়া সম্ভব তার চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞতালাভের সম্ভাবনা দেখা দেয়। তৃতীয়ত, এ বিশ্বাস অনুসারে মানুষের এ জীবনের ভুলত্রুটি জন্মান্তরে সংশোধনের একটা অবকাশ পাওয়া যেতে পারে। চতুর্থত, এ বিশ্বাসে চূড়ান্ত অন্তিমতা বা আত্যন্তিকতার আতঙ্ক মন থেকে অন্তর্হিত হয়, যে-আতঙ্ক মানুষকে সর্বদেশে সর্বকালে তাড়া করে ফিরছে। কিন্তু এ-ও সত্য যে কেবলমাত্র জন্মান্তরবাদ মানুষের আধ্যাত্মিক বা ব্যবহারিক উন্নতির আশ্বাস বহন করে না। যাই হোক ধান ভাঙতে এসে শিবের গাজন গাওয়ার মতো কথা বলছি। বিভূতিভূষণের লেখায় মৃত্যুচেতনা বারবার চোখে পড়ে।

‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ এবং ‘দেবযান’ পরলোক এবং জন্মান্তরবাদ বিশ্বাসের কথা বলে। জীবনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়তো অবিশ্বাস করার উপায়ও ছিলনা। প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’-র প্রকাশের সময় (পরে এই অংশটি বাদ যায়) তার মধ্যেও ছিল সেই অপার্থিবের ছায়া – ‘‘এ আমি কাকে দেখলুম বলব? আমাদের এই পৃথিবীর জীবনের বহু ঊর্ধ্বে যে অজ্ঞাত রাজ্যে অনন্তের পথের যাত্রীরা আবার বাসা বাঁধবে, হয়তো সে দেশের আকাশটা রঙে রঙে রঙিন, যার বাতাসে কত সুর, কত গন্ধ, কত সৌন্দর্য, কত মহিমা, ক্ষীণ জ্যোৎস্না দিয়ে গড়া কত সুন্দরী তরুণীরা যে দেশের পুষ্পসম্ভার-সমৃদ্ধ বনে উপবনে ফুলের গায়ে বসন্তের হাওয়ার মতো তাদের ক্ষীণ দেহের পরশ দিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই অপার্থিব দিব্য সৌন্দর্যের দেশে গিয়ে আমাদের এই পৃথিবীর মা-বোনেরা যে দেহ ধারণ করে বেড়াবেন – এ যেন তাঁদের সেই সুদূর ভবিষ্যৎ রূপেরই একটা আভাস আমার বউদিদিতে দেখতে পেলুম।’’

‘দেবযান’- উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল, সারান্ডার জঙ্গলে ভ্রমণের সময়। অরণ্যের ‘সমাহিত স্তব্ধতায়’ লেখা উপন্যাসটির পরিকল্পনা বিভূতিভূষণ সম্ভবত সব থেকে বেশি দিন ধরে করেছিলেন। জন্ম-মৃত্যুর ভাবনাকে এক সূত্রে বাঁধতেই কি তাঁর এই সময় নেওয়া? আবার ‘তৃণাঙ্কুর’-এ যেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো করে তিনি প্রত্যাশা করছেন, অন্ধকার ‘জ্যোতির্ময় হউক’। এ ভাবেই হয়তো মৃত্যুও একটি প্রাণচক্রের অংশীভূত হয়ে এক বিরাট পরিধিতে ধরা দেয়। এখান থেকেই অভীষ্ট ‘অমৃত’ তথা আনন্দের সঙ্গে এক সরলরৈখিক গাঁটছড়া বাঁধে মৃত্যু ও জন্ম।

স্বভাব-উদাসীন এই মানুষটি নিজের লেখার বিরূপ সমালোচনা নির্লিপ্তভাবেই নিতেন, কিন্তু অতিলোকচিন্তা নিয়ে তর্ক উঠলে নিজের অভিজ্ঞতায় ভর করে সোচ্চার হয়ে উঠতেন। সজনীকান্ত দাস তাঁর আত্মস্মৃতিতে বলেছেন – “আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, আচারে ব্যবহারে কালাপাহাড় বলে অখ্যাতিও আছে।” পরলোকচর্চার জন্য বিভূতিভূষণকে তীব্র ব্যঙ্গ করতেন জানিয়ে তিনি আরো বলেছেন – “পথভ্রষ্ট(?) বৈজ্ঞানিকদের আলোচনায়ও দেখিয়াছি এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে অনেক তত্ত্ব জানিয়াছি। বিভূতিকে বাহির হইতে কখনও আমল দিই নাই, ঠাট্টা করিয়া তাহার দৃঢ় বিশ্বাসকে উড়াইয়া দিয়াছি ; কিন্তু ভিতরে ভিতরে ফল্গু ধারার মতো মৃত্যু পরপারের এই টুকরা রহস্যটি আমাকে বরাবরই প্রভাবিত করিয়াছে আর বিভূতিকে স্বীকার করিয়াছি।”

পথের পাঁচালীর দুর্গার মৃত্যু মাইলফলক হয়ে আছে। বিভূতিভূষণের উপন্যাসে মৃত্যু সর্বদা একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে এসেছে। মহাভারতের মতো অতি বড় বীর, অনিবার্য যার প্রয়োজন সেও অবলীলায় ঝরে যাচ্ছে। কিন্তু দুর্গা ও অপুর বেড়ে ওঠা, পাঠকের হৃদয়ের মধ্যে দুর্গা ধীরে ধীরে পরিণতি পায়। আকস্মিক দুর্গা দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেলে কণ্ঠ ছিঁড়ে কান্না আসে। মৃত্যুকে বিভূতিভূষণ তার উপন্যাসে এক প্রতীকী মাত্রায় তুলে ধরেছেন,—‘দুর্গা আর চাহিল না। আকাশের নীল আস্তরণ ভেদ করিয়া মাঝে মাঝে অনন্তের হাতছানি আসে—পৃথিবীর বুক থেকে ছেলেমেয়েরা চঞ্চল হইয়া ছুটিয়া গিয়া অনন্ত নীলিমার মধ্যে ডুবিয়া নিজেদের হারাইয়া ফেলে—পরিচিত ও গতানুগতিক পথের বহুদূর পারে কোনো পথহীন পথে—দুর্গার অশান্ত, চঞ্চল প্রাণের বেলায় জীবনের সেই সর্বাপেক্ষা অজানা ডাক আসিয়া পৌঁছাইছে।’ দুর্গার মৃত্যুর অবব্যহিত পরে ‘নতুন কাপড় পরাইয়া ছেলেকে সঙ্গে লইয়া হরিহর নিমন্ত্রণ খাইতে যায়। একখানা অগোছালো চুলে-ঘেরা ছোট মুখের সনির্বন্ধ গোপন অনুরোধ দুয়ারের পাশের বাতাসে মিশাইয়া থাকে—হরিহর পথে পা দিয়া কেমন অন্য মনস্ক হইয়া পড়ে।’ পাঠক চোখে অশ্রু না এনে পারে না।

‘অপরাজিত’-য় নদীর পাড়ের আসন্ন সন্ধ্যায় মৃত্যুর এক নব-রূপ প্রতীত হয়। মনে হয় জন্ম-মৃত্যুর চক্রটি এক ‘দেবশিল্পীর হাতে আবর্ত্তিত হইতেছে...সবটা মিলিয়া অপূর্ব রসসৃষ্টি— বৃহত্তর জীবনসৃষ্টির আর্ট।’

ইছামতী উপন্যাসে অত্যাচারী নীলচাষি শিপটন সাহেবের মৃত্যুদৃশ্যও আমাদের নাড়া দেয়। সুদূর ইংল্যান্ডের কোনো এক গ্রাম থেকে আসা। মৃত্যুকালে রক্ষিতা গয়া মেম আর রাম কানাই কবিরাজ মুচি বাগদিরা ছাড়া তেমন কেউ তার পাশে ছিল না। যখন সাহেবের কথা বন্ধ, শ্বাসকষ্ট—দেওয়ান হরকারী বলল, এ কষ্ট আর দেখা যায় না। মৃত্যুর চূড়ান্তপর্বে কষ্ট হয় কি না—মানুষের জানা সম্ভব নয়। বিভূতিভূষণ লিখলেন—

শিপটন সাহেবের কষ্ট হয় নি। কেউ জানত না সে তখন বহুদূর স্বদেশের ওয়েস্টমোরল্যান্ডের অ্যান্ডসি গ্রামের ওপরকার পার্বত্যপথ রাইনোজ পাস দিয়ে ওক আর এলম গাছের ছায়ায় ছায়ায় তার দশ বছর বয়সের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে চলেছিল খরগোশ শিকার করতে, কখনো বা পার্বত্য রদ এল্টার-ওয়াটারের বিশাল বুকে নৌকায় চড়ে বেড়াচ্ছিল, সঙ্গে ছিল তাদের গ্রেট ডেন কুকুরটা...

হয়তো মৃত্যুর আগে মানুষের অবচেতনে তার শৈশবের স্মৃতিই বেশি ভেসে ওঠে।

আসলে ‘মৃত্যুকে কে চিনিতে পারে, গরীয়সী মৃত্যু-মাতাকে? পথপ্রদর্শক মায়ামৃগের মতো জীবনের পথে পথে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে সে, অপূর্ব রহস্যভরা তার অবগুণ্ঠন কখনো খোলে শিশুর কাছে, কখনো বৃদ্ধের কাছে..।’

মানুষ নিজের মধ্যেও অনেকবার মরে যায়, তার দেহ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকে। শারীরিক অস্তিত্ব বিলয়ের জন্য যদি দুঃখবোধের উদয় হয়। কিন্তু কোন সে শরীর, মৃত্যুর সময় আমরা কোন শরীরের কথা বলি। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, এমনকি বার্ধক্যেও মানুষ এক রূপ থেকে অন্য রূপে যায়।

অশনি সংকেত নতুন করে পড়ে দেখতে পারো, পড়তে পড়তে মৃত্যুকে বিজয়ের প্রতীক মনে হবে কিংবা মৃত্যুর কাছে বর্ণের হার দেখে শত কষ্টেও সুখ অনুভব করবে।

মতির মৃতদেহ আমতলাতেই পড়ে আছে। কত লোক দেখতে আসচে। দূর থেকে দেখে ভয়ে ভয়ে চলে যাচ্চে। আজ যা ওর হয়েচে, তা তো সকলেরই হতে পারে! ও যেন গ্রামের লোকের চোখ ফুটিয়ে দিয়ে গেল। একটি মূর্তিমান বিপদের সংকেত স্বরূপ ওর মৃতদেহটা পড়ে রয়েচে আমগাছটার তলায়। অনাহারে প্রথম মৃত্যুর অশনি সংকেত।

কিন্তু মৃত্যু থেকেই এক নবজন্মের শুরু হয়। এই আখ্যান সেই কালের যে কালে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নীচু জাতের তফাৎ ছিল খুব বেশি। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষের মৃত্যু যেন সেই তফাৎকে ঘুচিয়ে দিল। অনঙ্গর অনুনয়কে ফেলতে পারেনা গঙ্গাচরণ, ব্রাহ্মণ ভটচাযও যোগ দেয়। সঙ্গে কাপালীদের ছোট বৌ। দুর্ভিক্ষের মৃত্যু এক নতুন সমাজের জন্ম দিল, জাতপাতের ঊর্ধে মানুষ মনুষ্যত্বকে স্থান দিতে পারলো। অনঙ্গ-বৌ এর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে হার মানতে হয়েছে গঙ্গাচরণের ব্রাহ্মণত্বের অহমিকাকে।

তেমার খুব প্রিয় আরণ্যক উপন্যাাসে আছে কলেরা নামক মহামারীর ছোবলের কথা। কী নির্মমভাবে মহামারীতে গ্রামের অগণিত মানুষ অকালে ঝরে পড়ছে; চিকিৎসার অভাব, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাব- এ জনপদে কী ভয়াবহ ইতিহাস গড়ে তুলছে, তারই বিশ্বস্ত ভাষ্য নির্মাণ করেছেন বিভূতি পরম মমতায় আর অভিজ্ঞতার নির্যাসে। প্রকৃতপক্ষে আরণ্যক এমন এক উপন্যাস যেখানে জীবনের বৃহৎ পরিসরে বিচিত্র রূপে মৃত্যুই হলো মানুষের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। মৃত্যু ভালো না জীবন ভালো আমরা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারি না। বিভূতিভূষণের উপন্যাস ছাড়া ছোটগল্পেও মৃত্যুর নানা প্রতীকী ব্যবহার যেমন আছে তেমন বিশালভুবন তাঁর মৃত্যু দিয়ে গড়া। ‘পুঁইমাচা’ গল্পটির উল্লেখ না করলে এ আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ক্ষেন্তির মৃত্যু কিন্তু মরণের গল্প নয়, এ জীবনেরই গল্প, যখন দেখি লেখক মাচার উপর দিয়ে পুঁইঝাড়ের দৃশ্য রচনা করলেন। বিভূতিভূষণ মৃত্যুভীতি থেকে মুক্তি পেতেই হয়তো কথাসাহিত্যে শ্রমের নিরলস তাজমহল নির্মাণ করে চলেছিলেন।

সব ঘরেই মৃত্যু আছে, মৃত্যু ছাড়া প্রাণ নেই। একদিন এক বৃদ্ধ মা তার একমাত্র সন্তানের মৃতদেহ নিয়ে বুদ্ধের কাছে মাতম করে বললেন, ‘হে মহাস্থবির আমার পুত্রের জীবন ভিক্ষা দিন। বুদ্ধ বললেন, যাও, একটি বিল্বপত্র নিয়ে এসো—সেই বাড়ি থেকে, যে বাড়িতে কেউ মারা যায় নি।’ যেখানে বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় আটটি পথের ক্রমাগত অনুশীলন বলে দর্শানো হয়েছে, বিভূতিভূষণ সেই দুরূহ পথের প্রতিস্থাপন করেন প্রকৃতিকে দিয়ে। আরেকটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রসঙ্গটিকে বোঝা যাক। বিভূতিভূষণ লিখছেন,

‘জগতের অসংখ্য আনন্দের ভান্ডার উন্মুক্ত আছে। গাছপালা, ফুল, পাখী, উদার মাঠঘাট, সময়, নক্ষত্র, সন্ধ্যা, জ্যোৎস্না রাত্রি, অস্ত সূর্য্যের আলোয় রাঙা নদীতীর, অন্ধকার নক্ষত্রময় উদার শূন্য… এসব জিনিস থেকে এমন সব বিপুল, অবক্তব্য আনন্দ, অনন্তের উদার মহিমা প্রাণে আসতে পারে, সহস্র বৎসর ধরে তুচ্ছ জাগতিক বস্তু নিয়ে মত্ত থাকলেও সে বিরাট অসীম, শান্ত উল্লাসের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই কোন জ্ঞান পৌঁছয় না।… সাহিত্যিকদের কাজ হচ্ছে এই আনন্দের বার্ত্তা সাধারণের প্রাণে পৌঁছে দেওয়া… তাদের অস্তিত্বের এই শুধু সার্থকতা।’

সংসার যদি দুঃখের সাগর হয়, তা হলে তার প্রতিকার, এই অসীম আনন্দের চাবি তিনি তুলে দিলেন প্রকৃতির হাতে। আর সাহিত্যিকের কী ভূমিকা? সাহিত্যিক হলেন যাজক। তিনি প্রকৃতি আর বিস্মৃত সাধারণ মানুষদের যোগস্হাপন করেন, মার্গপ্রদর্শক। অসীম আনন্দের আকরের সন্ধান দেওয়া তাঁর কাজ। আশ্চর্যের বিষয়, স্বভাববিনীত বিভূতিভূষণের প্রত্যয় এই ব্যাপারে বেশ দৃঢ়, বিশ্বের প্রেক্ষিতে তাঁর ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে তাঁর কোনও দ্বিধা নেই। একটা কথা এখানে বলা হয়তো প্রয়োজন। দুঃখের অনুভুতিকে বিভূতিভূষণ অবাঞ্ছিত রূপে দেখেননি, বরং জীবনের প্রয়োজনীয় একটি উপাদান হিসাবে দেখেছেন।

সময় অণুক্ষণ হাঁটে তার পায়ে ধূলো ওড়ে না। ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই তার! সন্ধ্যা গড়িয়ে কখন রাত নেমে এসেছে বুঝতেও পারিনি। তোমার উত্তর পাবো কিনা জানিনা তবে অপেক্ষায় থাকবো। চিঠির শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছে- ‘এই জীবনের ওপারে সেই বিরাট জীবনের জন্যে সকলে অপেক্ষায় থাকুক।’— এই অপেক্ষাতেই আমরা না হয় দু’দণ্ড রইলাম!

ভালো থেকো নিরন্তর।


ইতি-

বাসু

০৩ নভেম্বর,২০২৪
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















বের্শেন ইনেসের কথাই ভাবছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে তার বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন…

‘তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না যে তোমার বন্ধুর গ্লাস একেবারে খালি? আরেকটু মনোযোগী হও। এইসব বিষয়ে আরও শিখতে হবে তোমাকে।’

বের্শেনের চোখমুখ লাল হয়ে গেল। সে একটা গবলেট নিয়ে গের্টের জন্য ওয়াইন ঢালতে শুরু করলো (গের্ট একটা গ্লাস ভর্তি জল নিয়ে বসেছিল)। কেন জানা নেই, হঠাৎ তার একটা অস্বস্তি হতে লাগল এবং মনে হল এটা নিয়ে পরে গের্ট তার সঙ্গে তামাশা করবে। তাড়াহুড়ো করে গের্টের দিকে ওয়াইন ভর্তি গবলেটটা ঠেলে রাখবার সময় এক দু’ ফোঁটা ওয়াইন চলকে পড়ল টেবিলক্লথে। বের্শেনের মা সেটা লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি বোতলটা রেখে দিলেন ওয়াইনের দাগ ধরা জায়গাটার উপরে।

খাবার পর কালো কফি খেতে খেতে বের্নহার্ড ভাবছিল যে এবার ঘুমোতে গেলেই হয়; আসলে সেভাবে তার দিকে কারো নজর নেই। তার অভিমান হচ্ছিল, কিন্তু সে প্রকাশ করল না। তবে সে খুবই খুশি হয়েছে এটা দেখে যে তার বন্ধুবান্ধব সম্পর্কে বাড়িতে সবার মনে একটা ভাল ধারণা তৈরি হয়েছে। সে ফ্লকের সঙ্গে মেঝেতে বসে খেলতে শুরু করল। নানা আদুরে নামে তাকে ডাকতে লাগল। রান্নাঘর থেকে রুটি নিয়ে এল সে ফ্লকের জন্য। তবে রুটির মাঝে সসেজের টুকরো গুঁজে দিয়েছিল সে, নাহলে ফ্লক শুধু শুকনো রুটি একেবারেই খাবে না।

সে যখন ফ্লকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার নোংরা পশম ঝেড়ে দিচ্ছিল, তখনি কে যেন এসে তার ঘাড়ে হাত রাখল। বের্শেন মুখ ফিরিয়ে দেখল যে ইনেস। ইনেস নিচু হয়ে অনুচ্চকণ্ঠে বলল যে তাদের এখন বেরতে হবে। বের্শেন মনে মনে চমকে উঠল। সে তার বন্ধুদের চলে যাবার ব্যাপারটা এতক্ষণ ভাবেনি। তার মাথাতেই আসেনি যে ওরা এখন ফিরে যাবে ওকে এখানে রেখে। যদি ওরা অন্তত ফ্লককে রেখে যেতেও রাজি হয়…

পরে, নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বের্শেনের মনে পড়ল যে তার হোমওয়ার্কের ফাইলটা শহরেই পড়ে আছে এবং সে আগামীকাল নিজের হোমওয়ার্ক করতে পারবে না।

‘ধুত্তোর’… বলেছিল গের্ট। কিন্তু নিজের কাজ তার কাছে কতটা দরকারি, সেটা গের্ট বুঝবে কী ভাবে? এখন গের্ট ইনেস আর ফ্লককে নিয়ে ড্রাইভ করে ফিরছে। হঠাৎ ভীষণ রাগ, অভিমান একসঙ্গে এসে বের্শেনের মন ভারি করে দিল। সে বালিশে মুখ লুকিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে শুরু করল।


বের্নহার্ড থিয়েটারস্ট্রাসে* ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। সবে সাতটা বেজেছে। ওর সঙ্গীসাথির দল কেউই এসে এখনও পৌঁছায়নি। সাড়ে সাতটার আগে অবশ্য কেউ আসবেও না। আজকে ওরা সবাই মিলে কোণের ছোট পাবে খেতে যাবে, তারপর যাবে গের্টের বাড়িতে। আজ ফার্দিনান্দের ফেয়ারওয়েল পার্টি, যে আগামীকাল বার্লিনে চলে যাবে। ফার্দিনান্দের তেইশ বছর বয়স; সে মিউজিক কন্ডাকটর হতে চায়। সে ভীষণ ভাল বেহালা বাজায়। শহরের থিয়েটার হলে বেহালাবাদকের চাকরি তার পাকা। এমনকি সঙ্গীতশিক্ষকেরাও তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই চাকরিটা নিয়ে নেবার জন্য। কিন্তু ফার্দিনান্দের ভেতরে একটা অদ্ভুত একগুঁয়ে অদম্য আবেগী উচ্চাশা আছে। যে চাকরি পাওয়ার জন্য তার সঙ্গীসাথিরা সবাই তাকে ঈর্ষা করছিল, সে কিনা সেই চাকরিটা হেলায় ছেড়ে চলে যাচ্ছে! জেদ ধরে প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় বার্লিন চলে যাচ্ছে সে। সে বলে সে ফুর্টভ্যাংলার এবং ব্রুনো ওয়ালটারের সঙ্গীত শুনতে চায়। আরও শুনতে চায়, আরও শিখতে চায় সে। বলে যে পড়াশুনার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করে সে পয়সা রোজগার করবে। খুব রোগা আর লম্বা চেহারা ফার্দিনান্দের। এত রোগা যে ওর জামার কলারগুলো পর্যন্ত বিরাট বলে মনে হয় ওর অবয়বের উপরে। সুদর্শন বলা যাবে না তাকে। মুখটা এত ফ্যাকাশে যে ধূসর বলে মনে হয় মাঝে মাঝে। মুখে দৃঢ় একটা অভিব্যক্তি সবসময়। সে যখনই ঠোঁটদুটো ফাঁক করে, মনে হয় যেন খুব তেষ্টা পেয়েছে তার। শুধু তার চোখগুলো তার মুখে অদ্ভুতরকম বেমানান। শুধু বড় নয়, চোখগুলো বিশাল আয়তাকার, কিন্তু লাজুক এবং বিষণ্ণ। ইনেস বলে যে শুধু চোখ দেখেই ওই ছেলেটার প্রেমে পড়ে যাবে যে কেউ।

তাহলে ফার্দিনান্দ আগামীকাল যাচ্ছে। সঙ্গে থাকবে বেহালা, একটা পুরনো হাতব্যাগ আর ছোটখাট কিছু প্যাকেট যেগুলো বন্ধুরা স্টেশনে নিয়ে যাবে। কেক, আপেল, রুমাল, নানা ছোটখাট জরুরি জিনিসপত্র থাকবে সেই উপহারের প্যাকেটে। বের্শেন এমন একটা উপহার নিয়ে যাচ্ছে, যেটা ফার্দিনান্দকে একইসঙ্গে অবাক এবং খুশি করবে। সে নিয়ে যাবে ইনেসের একটা ছবি, যেটা সে চুপিচুপি ইনেসের কাছ থেকে চুরি করেছে। কারণ ফার্দিনান্দও ইনেসকে ভালবাসে। হ্যাঁ, নিশ্চিত ভালবাসে!

বের্শেন ঘড়ির দিকে তাকায়। এখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে এবং তার খিদে পেয়ে গেছে। সে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রেস্তোরাঁর আলোআঁধারি ঘরটায় ঢুকে পড়ল। ছোট ছোট টেবিলে ছাত্ররা বা মোটা মোটা সরকারি কর্মচারীরা বসে তাস খেলছে। সে সঙ্গীতশিক্ষার্থীদের জন্য রিজার্ভ করে রাখা টেবিলে গিয়ে বসে পড়ল। তারপর বাঁধাকপির স্যালাদ আর সসেজ অর্ডার করল বেশ উচ্চস্বরে।


‘স্যার, আপনি কি খাবারের সঙ্গে বিয়ার পান করবেন?’ ওয়েট্রেস জিজ্ঞেস করল তাকে।

বের্শেনের একটু অস্বস্তি হলেও সে পাল্টা একটা ধন্যবাদ দিল পরিবেশনকারিনীকে।


ফার্দিনান্দের হয়তো পাবে বসেই একটু একটু নেশা হয়ে গিয়েছিল। এখন সে গের্টের বাড়িতে একটা বিশাল চেয়ারে এলিয়ে পড়ে আছে সিলিঙের দিকে চেয়ে। তার চোখেমুখে এক বিষণ্ণ অভিব্যক্তি। বাকিরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে খোশমেজাজে জোরে জোরে আড্ডা মেরে যাচ্ছে। গের্ট, যে কিনা এখন বাড়ির মালিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ, সে সমানে এদিক ওদিক যাচ্ছে, সিগারেট নিয়ে আসছে এবং এখন একটু অনুকম্পামিশ্রিত সৌহার্দের সঙ্গে ফার্দিনান্দের সঙ্গে কথা বলছে। এই পার্টিতে মেয়েরা কেউ আসেনি। যদিও সঙ্গীত শিক্ষালয়ের ছাত্রদের অনেকেরই মেয়েবন্ধু আছে, তাছাড়া শিক্ষালয়ে একই ক্লাসে ছাত্রীরাও আছে; কিন্তু এই ধরণের পার্টিতে সাধারণত মেয়েদের ডাকা হয় না। যদিও তথাকথিত প্রগতিশীল মানুষদের কাছে ব্যাপারটা একটু হুমকির মত শোনাবে, যদিও ব্যাপারটা পুরুষদের নিজেদের যথেষ্ট আধুনিক হিসেবে প্রমাণ করবার পরিপন্থী, তবুও এটা এখানে পুরুষ ছাত্রদের বিয়ার টেবিলের প্রচলিত রীতি। অবশ্য সব রীতির ব্যতিক্রম আছে। এখানে এই ব্যতিক্রমের নাম ইনেস। ইনেসকে সব সময় আমন্ত্রণ করা হয়। যদিও সে অনেক মেয়েদের চেয়ে গম্ভীর আচরণ করে এবং স্বল্পবাক, তবুও সে এই জমায়েতে যোগদান করতে অস্বস্তিবোধ করে না। দশ পনের জন পুরুষের মাঝে একমাত্র মহিলা হিসেবে তাকে সবসময় অসাধারণ দেখায়। কিন্তু আজ সে আসেনি।

এদিকে ফার্দিনান্দ বার বার ইনেসের কথা জিজ্ঞেস করছে। এখন আবার বলছে যে ইনেসকে নাহয় আবার ফোন করে ডাকা হোক। বাকিরা গের্টের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

‘এখন প্রায় রাত এগারোটা, ওই বুড়ো… ওর বাবা ওকে বেরতে দেবে না এখন। তাছাড়া ইনেসও ভাববে যে আমরা অভদ্র আচরণ করছি’… গের্ট অসহায় কণ্ঠে নিজের দ্বিধা ব্যক্ত করে।

‘তাহলে বের্নহার্ড ফোন করুক।’ ফার্দিনান্দ বলে

‘আহা, সেটাও কি খুব ভাল হবে?’

‘অবশ্যই ভাল হবে। কারণ ইনেস বের্শেনের উপর রাগ করবে না।’

‘খুব ভাল। বের্শেন!’


বের্নহার্ড এত কথা কিছুই শোনেনি। তাকে জোর করে আধা গেলাস বিয়ার খাইয়ে দিয়েছে। তার বিয়ার খেতে খুব বিশ্রী লাগছিল। কেমন টক টক স্বাদ। কিন্তু গের্ট এবং ফার্দিনান্দ চেপে ধরে খাইয়ে দিয়েছে তাকে। সে এখন গের্টের বিছানায় আধোঘুমন্ত অবস্থায় শুয়ে আছে। সে এখন ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে নানা কথা ভাবছে। গের্ট তাকে মডেল করে যে ছবিগুলো এঁকেছিল, তার মধ্যে চার পাঁচটা গের্টের ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে। সেগুলো সবাই দেখেছে এবং সেগুলো নিয়ে খিল্লি করছে। বের্নহার্ড বুঝতে পারছে না কেন তার এত বিরক্ত লাগছে। তার কিচ্ছু ভাল লাগছে না। কেমন যেন লজ্জা করছে সবার মাঝে থাকতে। তবে ছাত্ররা সবাই তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে। কিন্তু এই মুহূর্তে বের্নহার্ড একা একা একটু ঘুমোতে চায়। সে চায় যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এরা যেন এই ঘর ছেড়ে চলে যায়। তার বদলে এরা চারদিকে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি চালিয়ে যাচ্ছে। সবাই চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে… ‘আরে, তোমরা চাও কি শুনি? কি চাও?’ চুপ করার বদলে সবাই আরও জোরে হেসে ওঠে।



(চলবে)



*স্ট্রাসে (straße) শব্দের অর্থ সরণী।
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৭

রাতের প্রথম পহর। বৈদ্যজীর ঘুম চটে গেছে, কারণ বড্ড শীত করছে। চব্যনপ্রাশ, স্বর্ণভস্ম, এবং বাদাম পাকের ব্যারিকেড ভেঙে ঠান্ডা ওনার চামড়ার নীচে ঢুকে পড়েছে আর মাংসের বেশ ক’টি পরত ভেদ করে হাড়মজ্জায় সেঁদিয়েছে। লেপটাকে ভাল করে গায়ে জড়াতে জড়াতে ওনার মনে পড়ল—বিছানায় একলা শুলে শীতের অনুভূতি বেশি হয়। এরপর ধেয়ে এল স্মৃতির মিছিল। তাতে লাভ হল এই যে একটু যেন চোখ লেগে গেল। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় একটু শান্তি। কিন্তু একটু পরেই শুরু হল পেটের ভেতর দুরন্ত হাওয়ার ক্রান্তি।

পেটের মধ্যে হাওয়ার চাপ দেহের নীচের ভাগ থেকে ঘন ঘন ঘোর নিনাদে বেরোতে লাগল। উনি লেপচেপে কয়েকবার পাশ ফিরলেন এবং শেষে বিপ্লবের এক ভয়ানক বিস্ফোটের পর ঘুমিয়ে পড়লেন। দেখতে দেখতে বিপ্লবের হাওয়া এক পোষা কুকুরের মত লেজ নাড়তে নাড়তে শুধু ওনার নাকের ফুটো দিয়ে শব্দ করে যাতায়াত করতে লাগল। উনি ঘুমিয়ে পড়লেন এবং ঘুমের মধ্যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতে লাগলেন।

দেখলেন গণতন্ত্র ওনার খাটের পাশে মাটিতে উবু হয়ে হাত জোড় করে বসে আছে। ওর চেহারাটা খেতে হাল জোতা চাষির মত, আর ইংরেজির কথাছেড়েই দিলাম, ওতো ঠিক করে হিন্দিও বলতে পারে না। তবু ও কাকুতিমিনতি করেই চলেছে আর বৈদ্যজী শুনছেন। উনি বারবার ওকে চৌকির উপর বিছানাতে উঠে বসতে বলছেন।ওকে বোঝাচ্ছেন—আরে গরীব তো কী হয়েছে, তুমি হলে আমার আত্মীয়; কিন্তু গণতন্ত্র তবু ওনাকে হুজুর হুজুর, সরকার--এইসব করে চলেছে।

অনেক বোঝানোর পর গণতন্ত্র উঠে এসে বৈদ্যজীর চৌকির কোণায় বসলো। আরো খানিক সান্ত্বনার পর যখন বুঝল এবার কিছু কাজের কথা বলা যেতে পারে তখন বৈদ্যজীর কাছে নিবেদন করল –আমার কাপড়চোপড় ছিঁড়ে গেছে, আমি প্রায় নগ্ন হয়ে গেছি। এই অবস্থায় কারও সামনে বেরোতে লজ্জা করে। তাই বলছি, হে বৈদ্যজী মহারাজ! দয়া করে এই অধমকে একটা সাফ-সুতরো ধূতি দিন, পরে দেখি।

বৈদ্যজী বদ্রী পালোয়ানকে বললেন ভেতর থেকে একটা ধূতি এনে দিতে, কিন্তু গণতন্ত্র মাথা নাড়তে লাগল। বলল—আমি আপনার কলেজের গণতন্ত্র। আর আপনি ওখানকার বার্ষিক সভা অনেক বছর ধরে ডাকেননি। ম্যানেজারের নির্বাচনও সেই কলেজ খোলার পর থেকে আর হয়নি। আজকাল আপনার কলেজ সব ব্যাপারে এগিয়ে চলছে, শুধু আমিই এককোণে অবহেলায় পড়ে রয়েছি। একবার আপনি নিয়মমাফিক নির্বাচন করিয়ে দিন। তাতেই আমার শরীর ঢাকার এক নতুন কাপড় হয়ে যাবে। আমার লজ্জা চলে যাবে।

এসব বলে গণতন্ত্র বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেল আর বৈদ্যজীর ঘুমটিও ফের ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই উনি লেপের তলায় ওনার ভেতরের ক্রান্তির এক তাজা বজ্রনির্ঘোষ শুনতে পেলেন। তখনই ঠিক করলেন যে দেখতে যেমনই ফালতু লাগুক, গণতন্ত্র লোকটা ভালোমানুষ, ওনার নিজের লোক এবং ওকে সাহায্য করা দরকার। ওকে অন্ততঃ একটা নতুন ধূতি দেয়া হোক। তাহলে ও আর পাঁচজন সভ্যভব্য লোকের সঙ্গে ওঠাবসা করতে পারবে।

পরের দিন কলেজের প্রিন্সিপালকে আদেশ দেওয়া হল—কলেজের বার্ষিক সভা ডাকা হোক এবং সমস্ত পদের সঙ্গে ম্যানেজারেরও নির্বাচন করা হোক। প্রিন্সিপাল অনেক বোঝালেন যে নতুন নির্বাচন করা দরকারী নয়, জরুরীও নয়। কিন্তু বৈদ্যজী নাছোড়, বললেন—তুমি থামো। এটা নীতির ব্যাপার।

কিন্তু প্রিন্সিপাল থামার পাত্র নন। বলে চললেন—আরে কোন খবরের কাগজে সমালোচনা হয়নি, ওপরমহলে নালিশ যায়নি, না কোন মিছিল বেরিয়েছে, না কেউ অনশনে বসেছে। সব শ্যালক নিজের নিজের গর্তে সেঁধিয়ে রয়েছে। কেউ তো বার্ষিক সভা ডাকার কথা বলছে না, আর যে বলছে সে ব্যাটা কে? সেই ব্যাটা খান্না মাস্টার, সেই রামাধীন ভীখমখেড়বী আর ওনার দু’চারটে চামচে। ওদের চালে ফেঁসে সভা ডাকার ফল ভাল হবে না।

বৈদ্যজী সব শুনলেন, তারপর বললেন—তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু এসব তোমার বুদ্ধির অগম্য। কারণ এটা হল নীতিগত সিদ্ধান্ত। যাও, গিয়ে সভা ডাকার ব্যবস্থা কর।

সেদিনই সন্ধ্যে নাগাদ গয়াদীনের বাড়িতে পাঠানো হল। উদ্দেশ্য নির্বাচনের ব্যাপারে ওনার মতিগতির একটু আঁচ পাওয়া। গয়াদীন হলেন কলেজ কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। কাজেই এখন ওনার অপরিসীম গুরুত্ব। জানা দরকার যে উনি এবার কাকে ম্যানেজার করার কথা ভাবছেন। আর যদি ওনার ভাবনা বৈদ্যজীর পক্ষে না হয়, তাহলে কী কৌশলে ওনার হৃদয়-পরিবর্তন করা যেতে পারে? রঙ্গনাথ এবং রুপ্পনবাবু প্রাথমিক কথাবার্তা শুরু করতে ওখানে গেছেন।

তবে গয়াদীন গোড়া থেকেই পুরো ব্যাপারটা সহজ করে দিলেন। উনি দু’জনকে আপ্যায়ন করে চারপাইতে বসালেন, রঙ্গনাথের শহুরে শিক্ষার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন করলেন, ওদের বিশুদ্ধ ঘী দিয়ে তৈরি মটরী ও লাড্ডু খাওয়ালেন, তারপর নির্বাচনের কথা উঠতেই সাফ বলে দিলেন—“সব কাজ ভাল করে ভেবেচিন্তে করা উচিত। সময়ের হাওয়ার সঙ্গে বয়ে গেলে চলবে না। ম্যানেজার পদের জন্য নির্বাচন করাতে হবে, ভাল কথা। কিন্তু ম্যানেজার বৈদ্যজী মহারাজই থাকবেন, কারণ কলেজটা ওনারই। অন্য কাউকে ম্যানেজার করার প্রশ্ন উঠছে কেন? এসব ভাল করে ভাবা উচিত”।

ওনার কথাশুনে মনে হল যেন খোদ রঙ্গনাথ আর রূপ্পনবাবু বৈদ্যজীর বিপক্ষে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছে, এবং বৈদ্যজীর তরফ থেকে নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব গয়াদীন নিজে সামলাচ্ছেন। রঙ্গনাথের মজা লাগছে। ও বলল,”আপনারা হলেন পুরানো লোক। প্রত্যেক বিষয়ে সঠিক বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু ওদিকে যে ভীখমখেড়বী আর অন্য কিছু লোকজন মামার জায়গায় অন্য কাউকে ম্যানেজার করতে চাইছে। জানি না কেন এসব করছে”?

গয়াদীনের কাশি উঠল। ধীরে ধীরে বললেন,” অভিজ্ঞতা নেই, তাই। ওরা ভাবছে ম্যানেজার অন্য কেউ হলে ওরা কিছু করে দেখাবে। কিন্তু এভাবে কোন কিছু হয় নাকি”? তারপর একটু থেমে কথা শেষ করলেন,” যেমন নাগনাথ, তেমনই সাপনাথ”।

কথাটা রঙ্গনাথের পছন্দ হল না। এই উপমায় ওর মামাজী বেশ খাটো হয়ে গেলেন যে! ও তাড়াতাড়ি বলল,”সে বুঝলাম, কিন্তু মামাজীর সঙ্গে তুলনায় ওরা দাঁড়াতে পারে?”

উনি ফের ব্যাখ্যা করতে লাগলেন, “দেখ একথাটা তো আমি আগেই বলে দিয়েছি। কলেজ বৈদ্যজীর, ওনার হাতেই থাকুক। পঞ্চায়েত রামাধীন ভীখমখেড়ীর, সেটা ওর হাতে থাকুক। সবাই নিজের নিজের ঘরে বসে সন্তুষ্ট হোক। ---

“নির্বাচনের তামাশায় আছেটা কী? নতুন লোককে ক্ষমতায় বসাবে? সেও একইরকম খারাপ হবে। সব একই ধরণের। তাই বলছি—যে যেখানে আছে, তাকে সেখানেই নির্বাচিত করে দাও। পড়ে থাকুক নিজের গুহায়। খামোকা ওলট-পালট করে কী লাভ”?

রুপ্পনবাবু বাটিতে পড়ে থাকা শেষ লাড্ডুটিকে মন দিয়ে দেখতে দেখতে “খাব-কি-খাব না” চিন্তায় মগন। যেই শুনেছেন যে গয়াদীন বৈদ্যজীকেই ম্যানেজার বানানোর পক্ষে, ওনার কথাবার্তায় আগ্রহ শেষ হয়ে গেল। উনি বুঝে গেছেন যে এরপরে খালি ফালতু বকোয়াস হবে। কিন্তু রঙ্গনাথ গয়াদীনের ভাবনায় কিছু নতুন চিন্তার খোরাক পেল।

যেমন, নির্বাচনে যারাই দাঁড়ায়, তাদের অধিকাংশই অধম এবং নীচ প্রকৃতির লোক। তাহলে যাদের বদমাইশি এবং প্যাঁচ-পয়জার লোকজন চিনে ফেলেছে, তাদের সরানো উচিত নয়। রঙ্গনাথ মনে মনে গণতন্ত্রের এই থিওরির নাম দিল ‘গয়াদীনবাদ’। ওর ইচ্ছে হল আরও কিছু শোনে।

গয়াদীন বলছিলেন, “নতুন লোক এসে কিছু করতেও যদি চায়, তো করবেটা কী? যদি লোকে কিছু করতে দেয় তবে না! আজকাল যে সময় পড়েছে, কেউ কাউকে কিছু করতে দেয়? এখন তো খালি---“।

ছংগামল ইন্টার কলেজের ছেলেদের খেলাধূলার জগতের সঙ্গে ভালরকম পরিচয় আছে। কারণ, কলেজ প্রতিমাসে ওদের থেকে খেলাধুলোর ফীস কান ধরে আদায় করে, যদিও কলেজের কাছে খেলেধুলোর জন্য কোন মাঠ নেই। কিন্তু এনিয়ে কারও হেলদোল নেই। সবাই সন্তুষ্ট। খেলাধুলোর দায়িত্ব গেমস টিচারের। ফলে তাঁর কাছে অফুরন্ত সময়। তাই তিনি মাস্টারদের দুটো দলের সঙ্গেই ভাব জমিয়ে তাদের ভেতরের খবর বের করে নেন।

এতে প্রিন্সিপালেরও খুব আরাম। এখানে হকি স্টিক নিয়ে মারপিট হয় না, কারণ এদের কোন হকি টিম নেই। আর এসব থেকে কলেজের ডিসিপ্লিনেও কোন আঁচ লাগে না। ছাত্রদের বাপও খুশি, কারণ ছেলেদের খেলার ঝামেলা শুধু ফীস দিলেই মিটে যাচ্ছে। আর ছেলেরাও সত্যি সত্যি কোন খেলোয়াড় হবে না। ছেলেদের দলও খুশো। কারণ ওরা জানে যে হাতে হকিস্টিক নিয়ে একটা ঢিলের টুকরোর মত ছোট্ট বলের পেছনে এই গোল থেকে ওই গোলপোস্ট পর্য্যন্ত পাগলের মত দৌড়তে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণে এক কুঁজো তাড়ির রস গেলা যায়। অথবা, জুয়োর আসরে দাঁও লেগে গেলে চার-ছ’টাকা পকেটে পোরা যায়।

এই ছেলেগুলোর হাতেই আজ হকিস্টিক এবং ক্রিকেট ব্যাট। সেগুলো ওরা এমন কায়দায় ধরেছে যেন ওদের হাতে কেউ রাইফেল গুঁজে দিয়েছে। প্রায় পঞ্চাশটা ছেলে এইসব হাতিয়ারে সজ্জিত হয়ে কলেজের গেটের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। রঙ্গনাথ ওদের এই অপরূপ সাজসজ্জা দেখে জানতে চাইল—হয়েছেটা কী? আজ কি স্কুল ইনস্পেক্টরের আসার কথা?

ছোটে পালোয়ান উত্তর দেবার চেষ্টা করল, অর্থাৎ কোমর থেকে আলগা হওয়া লুঙ্গির গিঁট কষে বাঁধল। তারপর বলল,”এইসব পটাপট ঝামেলার মধ্যে কার ইনস্পেকশনের দায় পড়েছে? এসব আয়োজন তো বার্ষিক সভার জন্য “।

ছোটে পালোয়ান কলেজের সমিতির সদস্য বটে। ছেলেরা ওকে দেখে হর্ষধ্বনি করল। গেটের কাছে ওর দেখা হল প্রিন্সিপালের সঙ্গে। উনি বললেন,”আসুন ছোটেলালজী! আপনারই অপেক্ষায় আছি।

--“এসেছি যখন, পালিয়ে যাব নাকি? আপনি আমার আগে চলুন”। এটা ছোটেলাল ভালো মনে বলল। রর্ষাকালে কুকুর বৃষ্টিতে ভিজলে এক বিশেষ ধরণের শব্দ করে হাঁচে। অপ্রস্তুত প্রিন্সিপালের হাসির চেষ্টায় গলা দিয়ে খানিক ওইরকম আওয়াজ বেরোল। উনি পালোয়ানের আগে আগে চলতে চলতে বলা শুরু করলেন,” রামাধীনের দলও কোমর কষেছে। বেজেগাঁওয়ের লাল সাহেবের সাহায্যে আরও কয়েকজনকে ভাঙিয়ে নিয়েছে। লালসাহেব কেন যে এই সব ঝামেলায় নাক গলিয়েছেন। থাকেন তো শহরে, কিন্তু গাঁয়ের সব বিষয়ে নাক গলানো চাই”। রামাধীনের দেমাক বেড়েছে। এখন বোঝা যাচ্ছেনা যে কতজন এদিকে আর কতজন ওদিকে”।

ছোটে পালোয়ান কলেজ বিল্ডিংয়ের সামনে ফুলের কেয়ারির দিকে তাকিয়ে রইল। প্রিন্সিপাল বিড়বিড় শুরু করলেন –‘বৈদ্যজী মহারাজও মাঝে মাঝে এমন সব কাণ্ড করে বসেন যে কী আর বলি—কী দরকার ছিল এই নির্বাচন-টির্বাচন করানোর---‘?

পালোয়ান তখন একটা জনপ্রিয় কীর্তনের লাইন আউড়ে দিল—‘কেন শুনি বাকি লোকেদের কথা, আমার কৃষ্ণ যে প্রাণাধিক—‘!

গেট পেরিয়ে ভেতরে যেতে যেতে প্রিন্সিপাল বললেন—‘আপনিও আসুন রঙ্গনাথ বাবু, আপনার কোন মানা নেই’।

রঙ্গনাথ মাথা হেলিয়ে জানালো যে ও আসছে, কিন্তু ভেতরে গেল না। এবার একজন দু’জন করে কলেজ পরিচালক সমিতির সাধারণ সদস্যরাও ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়ে আসতে শুরু করেছেন। কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের একজন ডায়রেক্টর এলেন পায়ে হেঁটে। কিন্তু এমন বেগে এলেন এবং এত তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে গেলেন যে ছোকরার দল ওনাকে না দেখে নিজেদের মুখ দেখতে লাগল। কয়েক মিনিট পরে ঠিকেদার সাহেব এলেন –কলেজের ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে, ফসল পায়ে দলে। কিন্তু উনি গেলেন অন্যদিকে, যেখানে কিছু মজুর কোন কাজ করছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কিছু জিনিস আকাশে তুলে মাটিতে পটকে দেওয়ার অভিনয় করে উনি হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলেন। একটু পরে এলেন বাবু গয়াদীন, ধীর পায়ে এসে গেটের কাছে কালভার্টের উপর ছোট সিমেন্ট বাঁধানো জায়গাটায় বসে পড়লেন। উনি উদাসী চোখে দেখতে লাগলেন---ছেলেদের হাতে হকিস্টিক আর ব্যাট এবং একটি ছেলের হাতে ক্রিকেট বল। তারপর ওই বলের দিকে এমন একাগ্র হয়ে তা্কিয়ে রইলেন যেন সম্মোহন করছেন।

প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন—চলুন মেম্বার সাহেব, অন্য সবাই এসে গেছেন।

উনি এমনভাবে তাকালেন যেন ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন, আর ওনাকে সাক্ষীদের সামনে আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডে যেতে বলা হয়েছে। অসুস্থ গলায় বলেন, ‘চলুন’। তারপর পেঙ্গুইনের মত পা ফেলে ফেলে উনি গেট পেরিয়ে কলেজ ভবনের মধ্যে অন্তর্হিত হলেন।

আরেকটু পরে সড়কে এক ঘোড়সোয়ারের আবির্ভাব হল, তার মাথায় পাগড়ি। দেখলে মনে হবে যেন ইতিহাসের দ্বাদশ শতাব্দীর পাতা থেকে এক্ষুণি ফরফর করে বেরিয়ে এসেছেন। ছোকরাদের মধ্যে একজন বলে উঠল—“এখন আর কেউ বৈদ্যজীর একগাছিও ছিঁড়তে পারবে না। ঠাকুর বলরাম সিং এসে গেছেন”।

বলরাম সিং এসেই ঘোড়ার লাগাম একটি ছেলেকে ধরিয়ে দিলেন। এখন উনি অষ্টাদশ শতাব্দীর চরিত্র। যেন দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহের খবর দিতে আগ্রার কেল্লায় ঢুকেছেন এমনি গতিতে কালভার্ট অব্দি এসে একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন—‘মারপিট হয়নি তো’?

--‘কিসের মারপিট? আমরা প্রিন্সিপালের দলে, অহিংসাবাদী’।

বলরাম সিং গোঁফে তা’ দিতে দিতে হেসে ফেললেন।

--‘তোরাও কিছু কম যাস না। হাতে হকিস্টিক আর ডান্ডা, আবার গান্ধীজির চেলাগিরি’!

ছেলেটা-‘মহাত্মাও লাঠি নিয়েই চলাফেরা করতেন। আমাদের হাতে কোন লাথি নেই। আর হকিস্টিক? এতে একটা বলও মরে না, মানুষ কোত্থেকে মরবে’?

প্রিন্সিপাল আবার বাইরে এসেছেন। ‘চলুন মেম্বার সাহেব, ভেতরে চলুন। কোরাম পুরো হয়ে গেছে। এবার মিটিং শুরু হবে’।

বলরাম সিং পাগড়ির কোনা দিয়ে ঘাম মুছলেন। বললেন,’কোন চ্যালাকে বলে দিন, ঘোড়াকে দানাপানি দিতে। আমি ভেতরে গিয়ে কী করব? আমার যত কোরাম, সব এখানেই’।

প্রিন্সিপাল খুশি হয়ে মাথা নাড়লেন। বলরাম সিং পাঞ্জাবীর পকেটটা শক্ত করে ধরে বললেন,’বিশ্বাস না হয় ছুঁয়ে দেখুন। কেমন কড়া! এটাই আসল কোরাম’।

প্রিন্সিপাল না ছুঁয়েই বললেন,’ ধরে নিন, ছুঁয়েছি। আরে আপনার কথা কি মিথ্যে হতে পারে’?

বলরাম সিং—‘ আসলী বিলেতি মাল, ছ’ঘরা। দেশি দোনলা নয় যে একবার ফুট্ট্‌ হয়ে থেমে যাবে। ঠাঁয় ঠাঁয় শুরু করে দিলে রামাধীনের দলের ছ’জন চড়াই পাখির মত ফুরুৎ হয়ে যাবে’।

--“ আহা, আপনার জবাব নেই! লা-জবাব”! প্রিন্সিপাল এমন ‘বাহ্‌ বাহ্‌’ করে উঠলেন, যেন বলরাম সিং কোন মুশায়েরাতে কাব্যপাঠ করছেন। উনি যেতে যেতে বললেন—“আমি ভেতরের মিটিংয়ে যাচ্ছি। বাইরেরটা আপনি সামলাবেন”। ফের পেছন ফিরে মহাত্মা বিদুরের বাণী ঝাড়লেন, “যাই করুন, শান্তিপূর্ণ ভাবে”।

বলরাম সিং ফের গোঁফে তা’ দিলেন। “ এখানে সব শান্তি। আমার উড়ুর নীচে গোটা পঞ্চাশেক শান্তি বিরাজ করছে”।

প্রিন্সিপাল সাহেব ভেতরে গেলেন। বলরাম সিং ফের কালভার্টের উপর পুলিয়াতে বসে পড়লেন। খানিকক্ষণ পিচির পিচির করে পানের পিক ফেললেন। তারপর যে ছেলেটা নিজেকে মহাত্মা গান্ধীর থেকে বড় অহিংসাবাদী ডায়লগ ঝেড়েছিল তাকে বললেন,” যাও তো ছেলে; একবার গোটা কলেজ চক্কর মেরে এসো। দেখে এস, আমার লোকজন ভেতরে ঠিক ঠিক জায়গা আটকে পাহারা দিচ্ছে কিনা? আর ব্যাটা রমেসরাকে বলে দাও—সালা যেন কারও সঙ্গে হাঙ্গামা না করে। যে বোঝালেও বুঝবে না তাকে এদিকে গেটের কাছে পাঠিয়ে দেয়, ব্যস্‌”।

ছেলেটা হালচাল বুঝতে ভেতরে চক্কর মারতে গেল। ও যেন একটা বয়স্কাউট, যে ভাবছে দেশের জয়-পরাজয় স্রেফ ওর মিশনের সাফল্যের উপর নির্ভর করছে। আশপাশের ছেলেগুলোর ছটফটানি বাড়ছে। তাই দেখে বলরাম সিং বললেন—“যাও ব্যাটারা; বেশ বড় চক্কর মেরে ঘুরে এস। আর নিশ্চিন্ত থাক, আমি যতক্ষণ পুলিয়াতে বসে আছি কোন দুশমন এদিকে ঘেঁষবে না”।

বেলা তিনটে। রাস্তা দিয়ে ট্রাক আর বলদে টানা গাড়ি আসছে যাচ্ছে। বলরাম সিং পুলিয়ার উপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে স্বপ্নিল চোখে ওই আসাযাওয়া দেখছেন। একবার ঘোড়া চিঁহি চিঁহি করে উঠল। উনি বললেন,”সাবাশ মেরে চেতক! সবুর কর। সময় হলে দানাপানি পাবি”।

চেতক সবুর করল এবং প্রমাণস্বরূপ খানিক পরে পরে জল ছাড়তে লাগল। ্কিছু ছেলে ওকে ঘিরে গোল করে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার নৈসর্গিক কাজকম্মের আগে ওপরের অবস্থা মন দিয়ে দেখে নিজেদের মধ্যে পেরাইভেট হাসাহাসি করতে লাগল।

হঠাৎ কলেজের সামনের রাস্তায় একটা ট্রাক এসে থামল। একটি লোক তার থেকে লাফিয়ে নেমে দ্রুত পায়ে কলেজের দিকে এগোতে লাগল। তার পরণে পরিষ্কার ধুতি-পাঞ্জাবী-টুপি আর হাতে একটা ছড়ি। ট্রাককে থামতে দেখেই ছেলের পাল এদিক ওদিক থেকে দৌড়ে দৌড়ে পাকলেজের সামনে পুলিয়ার দিকে দলবেঁধে আসতে লাগল। বলরাম সিং ভদ্রলোককে বাধা দিয়ে বললেন-- আপনার চরণ স্পর্শ করি পণ্ডিত!

লোকটি বিড়বিড় করে কোন আশীর্বচন বলে সিধে কলেজের গেটের দিকে এগোতে লাগলেন। বলরাম সিং বললেন—“পণ্ডিত, একটু ধীরে। কেউ তোমাকে তাড়া করছে না”।


লোকটি থতমত খেয়ে হাসল। বললেন—মিটিং শুরু হয়ে গেছে না?

বলরাম সিং উঠে দাঁড়ালেন। মাপা পায়ে পণ্ডিতের কাছে এলেন। ছেলের দল এগিয়ে আসছে, প্রায় ঘিরে ফেলছে। উনি ধমকে উঠলেন—“ ভেগে পড় ছেলের দল। একটু দূরে গিয়ে খেলাধূলো কর”। তারপর পণ্ডিতের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন-“পণ্ডিত, মিটিংয়ে তোমার হাজিরি লেগে গেছে। এবার ফিরে যাও”।

পণ্ডিত কিছু বলতে চাইল। কিন্তু উনি এবার পণ্ডিতের গায়ে গা লাগিয়ে বললেন—“কিছু ভেবেই বলছি। ফিরে যাও”।

পণ্ডিতের মনে হল জঙ্ঘার কাছে কিছু শক্ত জিনিস ধাক্কা দিচ্ছে। উনি বলরাম সিংয়ের পাঞ্জাবীর পকেটের দিকে তাকালেন এবং হড়বড়িয়ে দু’পা পেছনে হটে গেলেন।

ওনাকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বলরাম সিং ফের বললেন—“পণ্ডিত, চরণ-বন্দনা”!

লোকটি চুপচাপ ফিরে গেল। রাস্তায় কোন গাড়ি নেই, ট্রাক চলে গেছে। ও এবার কোন একদিকে দ্রুত পায়ে চলতে চলতে হঠাৎ দৌড়তে লাগল। একটা ছোকরা বলল—গেছে!

বলরাম সিং বললেন, “পণ্ডিত সমঝদার; বুঝতে পেরেছে”।

“সমঝদার তো বুঝলাম। কিন্তু অমন করে পালাবার কী হয়েছিল?” –একটি ছাত্রের প্রশ্ন।

বলরাম সিং—“এখনো চ্যাঙড়া বয়েস। একটু বড় হও তখন বুঝবে এমন সময়ে সমঝদার মানুষ এভাবেই দৌড়য়”।

একজন বিদ্যার্থী ঘোড়াকে দানাপানি দিচ্ছিল। ঘোড়া ফের চিঁহি করে উঠল। এবার বলরাম ধমকে উঠলেন—“চুপ বে চেতক”!

বয়-স্কাউট ছেলেটি ফিরে এসেছে। বলরাম ঘোড়াকে ধমকানোর সুরেই বলেন, “ কিঁউ বে, ক্যা খবর হ্যায়”?

স্কাউট গেল ঘাবড়ে। ক্লাসে ঘাবড়ে যাওয়া সাধারণ পড়ুয়ারা যেমন দাঁত বের করে তেমনি করে

হেসে বলল,” হ্যাঁ ঠাকুর সা’ব; সব ঠিকঠাক চলছে”।

“ক’জন আদমী এসেছিল”?

“সবাই বুঝে গেছে? নাকি কেউ অবুঝপনা করেছে”?

“সব্বাই বুঝে গেছে”। ছেলেটার সাহস ফিরে এল। দূরে পালাতে থাকা পণ্ডিতের দিকে ইশারা করে বলল, “ওনার মতই ধড়ফড় করে সবাই ফিরে গেল”।

ছেলেটা এবার প্রাণ খুলে হাসল। বলরাম সিং বললেন,” বেশি বুঝে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত”।


কলেজের ভেতর থেকে জয়ধ্বনি ভেসে আসছে। কেউ বলছে—‘ বোল্‌ সিয়াবর রামচন্দ্রকী জয়’!

জয় বলার ব্যাপারে হিন্দুস্তানিদের মোকাবিলা কে করবে? শুরু হল ‘সিয়াবর রামচন্দ্র’ থেকে, ফের ‘পবনপুত্র হনুমানের জয়’। ফের, কেউ জানেনা কেমন করে, ঝটপট মহাত্মা গান্ধীর জয়ে পৌঁছে গেল।

--“বোল্‌ মহাত্মা গান্ধী কী জয়”! ব্যস্‌ সবুজ পতাকা নাড়া হয়ে গেছে। পণ্ডিত জওয়াহরলাল নেহরু একবার ‘জয়’ পেলেন। তারপর প্রদেশের সব নেতাদের একটা করে। এক-একটা জেলার নেতাদের। এবার আসল জয়ধ্বনি—“ বোলো বৈদ্যজী মহারাজ কী জয়”!

বর্শায় বেঁধা শুওরের মত চিঁচিঁ করতে করতে প্রিন্সিপাল সাহেব বাইরে এলেন। উনিও চেঁচিয়ে উঠলেন—বোলো বৈদ্যজী মহারাজ কী!

‘জয়’ বলার জন্যে পরের প্রজন্ম গেটের সামনে হাজির ছিল।

কলেজের সামনে যেন মেলা বসেছে। প্রিন্সিপাল রঙ্গনাথকে বোঝাতে লাগলেন, “চলুন, বৈদ্যজী মহারাজ ফের সর্বসম্মতিতে ম্যানেজার নির্বাচিত হয়েছেন। এবার দেখুন কলেজ কেমন দ্রুত উন্নতি করে—ধকাধক, ধকাধক, ধকাধক! ্তুফান মেলের মত গতি”! উত্তেজনায় ওনার চেহারা ক্রমশঃ লাল হচ্ছে।

ছোটে পালোয়ান বলল, “এ প্রিন্সিপাল, বেশি ভড়ভড় করবে না তো। আমারও একটা কোথা শুনে নাও। এই যে ছোঁড়াগুলো হকির ডান্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এদের এক একটা বলও ধরিয়ে দাও। আর বলো কিছু লক্ষ্যভেদ করা শিখতে। এদের মধ্যে একটাও নেই যে বলে ডান্ডা মারতে পারে। সবকটা সাপমারার মত করে ধুলোর মধ্যে লাঠি পেটায়”।

-“অবশ্য, মেম্বার সাহেব, অবশ্য। খেলাধূলোর ব্যবস্থাও হবে। আগে এই ঝঞ্ঝাট থেকে রেহাই পাই —“।

ছোটে, “রেহাই তো পেয়ে গেছ। এবার আমাকে বলতে দাও। সব কথায় ‘হ্যাঁ’ বলা তোমার একটা স্বভাব। কিন্তু তোমার লাঙল-চষা ক্ষেতে একটা মূলোও জন্মায় না। খেলাধূলোর ব্যাপারটাও তাই। তোমার ছেলেগুলো শুধু হকির ডান্ডাটা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আজকেই যদি দরকার পড়ত তো ওরা খালি হাওয়াতে ডান্ডা ঘোরাতে থাকত, ব্যস্‌। কারও পিঠে নিশানা করে চালালে সেটা লাগত হাঁটুতে। দরকারের সময় নিশানা ঠিক হওয়া চাই”।

পেছন থেকে বৈদ্যজীর কন্ঠস্বরঃ “খেলাধূলোরও গুরুত্ব আছে প্রিন্সিপাল সাহেব! ছোটের কথা অনুচিত নয়”।

“হেঁ হেঁ”, প্রিন্সিপাল পালোয়ানের দেহসৌষ্ঠব প্রেমিকার চোখে দেখে বললেন, “এ পালোয়ান, নাকি হাসিঠাট্টার ফুলঝুরি! এ কখনও অনুচিত কিছু বলে না”।

(চলবে)