Next
Previous
Showing posts with label ধারাবাহিক. Show all posts
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















১৪


ইনেস তাঁর বন্ধু গের্টকে নিয়েও বিশেষ চিন্তিত। গের্ট অবশেষে আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়বার ব্যাপারে মনস্থির করেছে। আগামী হেমন্ত থেকেই ক্লাস শুরু হবে। সে হিসেব করে দেখেছে যে পাশ করে বেরতে আরও তিন বছর লাগবে; কারণ কিছু সেমিস্টারের ক্লাস সে এর মধ্যেই করা হয়ে গিয়েছে তাঁর। গের্ট এই বিষয়ে ইনেসের সঙ্গে বেশ গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে আলোচনা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে নেওয়া সরু, হলদে সিলেবাসের বইটা নিজের পকেট থেকে বের করে যে যে ক্লাসের লেকচারগুলো শুনতে সে ইচ্ছুক, সেগুলোর পাশে একটা সোনালি রঙের পেন্সিল দিয়ে দাগ টানে।


ইনেস গের্টের পরিকল্পনা মনোযোগ দিয়ে শোনে। মনে মনে আগামী শীতের সময়টা কল্পনা করে সে। ফ্লকের সঙ্গে সে মাঝে মাঝে গের্টের এপার্টমেন্টে যাবে দেখা করতে। তবে খুব ঘনঘন যাবে না, কারণ গের্ট কাজে এবং পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকবে। বের্নহার্ডের সুন্দর পোর্ট্রেটের পেন্সিল স্কেচগুলোর বদলে কালো রঙের কলেজ খাতায় আর ‘করপাস ইউরিস সিভিলিস’ এর অনেক খণ্ডে ভরে থাকবে গের্টের টেবিল। একজন উকিলের ঘরে আর কী কী থাকতে পারে, সেই বিষয়ে ইনেসের পরিষ্কার ধারণা নেই। ফলে সে আর বেশি কল্পনা করতে পারে না; তবে তাঁর মনে হতে থাকে যে গের্টের চেহারা ক্রমেই একঘেয়ে ক্লান্ত, বিরক্ত ধরনের হয়ে যাবে এবং সে সবসময় তিরিক্ষি মেজাজে থাকবে।

কিন্তু তাঁর অন্যান্য বন্ধুরা? ফার্দিনান্দ আর বের্নহার্ড চলে যাবার পর থেকে সন্ধের আড্ডাগুলোর সেরকম কোনো আকর্ষণ আর নেই। হতে পারে যে তুমি আইনের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব করলে… ভবিষ্যতের উকিল অথবা বিচারক কিম্বা কৌঁসুলি যারা। এরা খুব গুরুগম্ভীর প্রকৃতির, সব সময় নিজের মর্যাদা বিষয়ে অত্যধিক সচেতন। তরুণ সঙ্গীতশিক্ষার্থীরা এমন নয়, উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে সবসময় সব ব্যাপারে চরম মতামত পোষণ করে না তারা। তবে গের্টকে ভবিষ্যতে স্থির করতে হবে যে সে হিটলারের পক্ষে না বিপক্ষে…


-‘গের্ট!’ ইনেস শুরু করে, … ‘তুমি কি হিটলারপন্থী?’


-‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?’


-‘না, এমনিই… জিজ্ঞেস করলাম আর কি!’


ইনেসের হঠাৎ গের্টকে আইনের ক্লাসের ছাত্র হিসেবে কল্পনা করে হাসি পায়। সাধারণত ছাত্র মানেই মানুষ তাদের স্নেহের চোখে দেখে। কিন্তু গের্ট ছাত্র হিসেবে নিঃসন্দেহে হাস্যকর… একটা অসম্ভব কাণ্ড ঘটতে চলেছে বলে মনে হয় ইনেসের। কারণ গের্ট খুবই সংবেদনশীল এবং সহজেই মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর। তাছাড়া যে কাজটা তাঁর পছন্দ হয় না, সেটা শেষ করা তো দূর, সে কিছুতেই বেশিক্ষণ টেনে নিয়ে যেতে পারে না। গের্ট নিজেও হয়তো নিশ্চিতভাবে এখনো বুঝতে পারছে না যে ভবিষ্যতে সে কী ভাবে ব্যাপারটা সামলাবে। তবে সে সমাজে ‘একজন’ হয়ে উঠতে চায়। সেটাই এই মুহূর্তে তাঁর একমাত্র ইচ্ছা। ‘একজন’ হয়ে ওঠা মানে সমাজে একটা ভাল জায়গা, একটা ভাল ডিগ্রি, উপাধি ইত্যাদি।

গের্ট এখনো অনিশ্চয়তায় ভুগছে। তবে নিজের সম্বন্ধে যথেষ্ট গর্ববোধ আছে তাঁর এবং এই বোধটাই তাঁর দুর্বলতা হয়ে উঠছে। কারণ সেটাই বদলে যাবার পথে তাঁকে ভিতরে ভিতরে বাধা দিচ্ছে। এই বিরক্তিকর এবং একঘেয়ে পরিস্থিতি থেকে বেরতে পারছে না সে। তাঁর দ্বিধা এখনো কাটেনি এবং সে বিষণ্ণ তিক্ত মেজাজে সিলেবাসের হলুদ বইটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।

ইনেস শান্তভাবে তাঁকে নিরীক্ষণ করে। তাঁর সুন্দর মুখমণ্ডলের রেখাগুলি, তামাটে হয়ে পুড়ে যাওয়া কপালের অর্ধেকটা কালো চুলের গুচ্ছে ঢাকা। তাঁর চোখদুটো গাঢ় রঙের, তীব্র এবং অস্থির। ঠোঁট এবং চোয়াল ক্রুদ্ধ, কঠিন, মাঝে মধ্যে সে মুখটা অল্প খুলছে যেন এখনই কোনও খেদ, অভিযোগ কিম্বা প্রতিবাদী সমালোচনার শব্দ বেরিয়ে আসবে।

কিন্তু গের্ট কখনই অভিযোগ করে না। তাঁর গর্ববোধ তাঁকে সেটা করতে বাধা দেয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে যখন সে অনেক কথা একসঙ্গে বলতে থাকে, সেসব কথাবার্তা উদ্ধত এবং বিদ্বেষপূর্ণ। যদি কোনও কারণে সে আহত হয়, তখন অবুঝের মত অনেক কথা আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে বলে দেয়। অনেক মানুষ এই কারণে গের্টকে একেবারেই পছন্দ করে না। তাঁকে উগ্র এবং বিশ্বাসের অযোগ্য বলে মনে করে। অনেকেই ইনেসকে সতর্ক করে গের্টের সঙ্গে মিশবার কারণে। আবার অনেকে অবাক হয় ইনেসের সাহসের কথা চিন্তা করে, কারণ সাধারণভাবে মানুষ মনে করে যে গের্টের মত ব্যক্তির কাছাকাছি থাকতে হলে অনেক সাহসের প্রয়োজন। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর। কারণ ইনেস গের্টের থেকে অনেক বেশি সপ্রতিভ এবং মানসিক শক্তির অধিকারিণী। তাছাড়া সে বের্নহার্ড এবং অন্যান্য বন্ধুদের যেভাবে সবসময় সাধ্যমত সাহায্য করতে প্রস্তুত, সেভাবেই সে গের্টকেও সাহায্য করে থাকে।

তবে এইমুহূর্তে গের্টের জন্য ইনেসের বেশ চিন্তা হচ্ছে। এতদিন গের্ট ভবিষ্যতে কী করতে চায়, সে বিষয়ে ইনেস একেবারেই মাথা ঘামায়নি। কারণ গের্ট সপ্রতিভ উজ্জ্বল তরুণ, যদিও বিশেষ উচ্চাশা নেই জীবনে। এদিকে আবার গর্ববোধ আছে যথেষ্ট পরিমাণে। জীবনে কিছু একটা করতে চায় সে সাফল্যের সঙ্গে, নিজের কাজের জন্য একটা স্বীকৃতিলাভ করতে চায় সে। কিন্তু সম্প্রতি সে সব ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে গিয়েছিল। নিজের ঘরে সিগারেট খেতে খেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কখনো একা বসে থাকছিল, আবার কখনও বন্ধুদের সঙ্গে এখানে সেখানে মাতাল হয়ে বেড়াচ্ছিল; এতকিছু করে কোনও উপকার অবশ্য হয়নি। এসব কাণ্ড ঘটিয়ে সে আবার লজ্জিত হয়ে শাস্তি পাওয়া স্কুলের ছাত্রের মত মুখ নিচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এদিক সেদিক। সবকিছুই ইনেসের কানে এসেছিল। ইনেস তাঁকে একসঙ্গে ঘুরতে কিম্বা হাঁটতে যাবার কথা বলেছিল; সে একেবারেই রাজি হয়নি এবং হাজারটা বাহানা দেখিয়েছিল। ইনেসের যে একটু খারাপ লাগেনি তা নয়, তবে সে মাঝে মাঝেই ফোন করে গের্টের খবরাখবর নিত। কারণ তার মনে হয়েছিল যে এসব বদমায়েশি আর ছেলেমানুষি কাণ্ড ঘটিয়ে গের্ট হয়তো তার সঙ্গে দেখা করতে লজ্জা পাচ্ছে। এর মধ্যে একদিন হঠাৎ গের্ট নিজে থেকেই ইনেসকে ফোন করে দেখা করতে চায়; বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা করতে, কারণ সে নাকি বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছে ইনেসকে একটা জরুরি কথা বলবার জন্য। এখন সে বলছে যে সে এখন সত্যিই ভালভাবে পড়াশুনা শুরু করতে চায়।


… ‘গের্ট, আসলে তুমি ঠিক কোন কারণে পড়াশুনা শুরু করতে চাও?’


-‘আমার বাবা মা সেটাই চান।’


-‘সেটা কি তুমি এতদিন জানতে না? জানা সত্ত্বেও তুমি সেই ব্যাপারে কোনও গুরুত্ব দাওনি।’


-‘কারণ আমি বিশ্বাস করতাম যে আমি ভাল আঁকতে পারি। আমি একজন শিল্পী।’


-‘কবে থেকে তোমার বিশ্বাসে চিড় ধরল?’


-‘বের্নহার্ড চলে যাবার পর থেকে।’


-‘তুমি এখন আর ছবি আঁকতে ভালবাস না?’


গের্ট যন্ত্রণাকাতর মুখে তাকায় ইনেসের দিকে… ‘তুমি তো সবই জানো।’ বলে সে… ‘কেন শুধুশুধু এই প্রশ্ন করছ?’ মুখটা অন্যদিকে ফেরায় সে… ‘আমি ভেবেছিলাম আমি আঁকতে পারব। কিন্তু আমি শুধু বের্নহার্ডকেই আঁকতে পারতাম। সে ছাড়া আর কাউকে, আর কোনওকিছু আমি আঁকতে পারি না। সে চলে যাবার পর আমি একটা রেখাও টানতে পারিনি কাগজে। আমার কোনও প্রতিভা নেই, ইনেস। ছবি আঁকতে নয়, আমি বের্নহার্ডকে ভালবাসি।’

অবশেষে গের্ট মুখ খুলেছে। আবেগমথিত খেদ আর অভিযোগের বন্যা বেরিয়ে আসছে এখন তার খোলা মুখ দিয়ে।

ইনেস স্তব্ধ হয়ে যায়। বিষণ্ণভাবে একদৃষ্টে গের্টের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। যদিও এই বিষণ্ণতা চট করে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না। মানুষের মনে হবে যে ইনেসের মুখমণ্ডলে অদ্ভুত প্রশান্তি বিরাজ করছে।

‘তুমি যদি পাশ করে উকিল হয়ে বেরোও, তাহলে কি তুমি আর বের্নহার্ডকে ভালবাসবে না?’ বলে ওঠে ইনেস, ‘তুমি কি তখন বদলে যাবে?’


(চলবে)
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in




















১২. নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় যে প্রেম সে কি কাম?





হৃদিবরেষু বাসু

''হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,/ মন বাড়িয়ে ছুঁই,/ দুইকে আমি এক করি না/ এককে করি দুই।'' এ যেন হৃদয়ের ভেতর থেকে আচমকা উঠে আসা একটি কবিতা! এই চিঠি যখন লিখছি তুমি নিশ্চয় তখন বেনারসে। পুজোর ছুটি নিয়ে ঘরে বসে আছি। সময় কাটাতে তাই অনেক খুঁজে বের করেছি নির্মলেন্দু গুণের নির্বাচিত কবিতা সংকলন। বইটা স্বয়ং কবির হাত থেকে পেয়েছিলাম। তোমাকে তার কবিতা নিয়ে বলার কিছু নেই জানি এমনকি বাংলাদেশের কাব্য-কবিতা–শিল্পসাহিত্য বিষয়ে যাঁদেরই একটু প্রাথমিক খোঁজখবর আছে, তাঁরা বোধ করি খুব বেশি দ্বিমত করবেন না যে নির্মলেন্দু গুণ যথেষ্ট পাঠকপ্রিয় কবি। এই কবি বেড়ে উঠেছেন উত্তপ্ত অগ্নিবলয়িত সময়ের ভেতর। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের লড়াইয়ের দিনগুলোতে তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে সক্রিয় ছিলেন। এজন্য সমাজ ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধ তিনি এখনো। এই কবি কবিতার মাধ্যমে একাত্মতার বাণী প্রচার করেছেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের একাত্ম হওয়ার সেই বাণী অসংখ্য পাঠককে মুগ্ধ করেছে, বাংলা কবিতায় নির্মিত হয়েছে একটি স্বতন্ত্র ধারা। তিনি প্রতিবাদ-সংগ্রামসর্বস্ব কবি নন মোটেও। বরং তাঁর কাব্যজগৎ পরিভ্রমণ করলে তাঁকে প্রধানত রোমান্টিক কবি বলেই মনে হবে। প্রেমই তাঁর কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। তাহলে যা হওয়া অসম্ভব বলে তিনি মনে করেছিলেন শেষ পর্যন্ত তিনি কি তা-ই হয়েছেন? হয়তো সেটাই সত্য। তবে এই সত্যের সঙ্গে কিছু শর্ত জুড়ে আছে। তিনি ‘নিরপেক্ষ বা নির্ভেজাল রোমান্টিক কবি’ হওয়াকে অসম্ভব বলেছেন, অর্থাৎ ‘পক্ষপাতী বা ভেজাল রোমান্টিক কবি’ হতে অসুবিধা নেই। তাহলে এই ‘পক্ষপাতী বা ভেজাল রোমান্টিক কবি’র চারিত্র্য কী? তিনি কি সেটাই হয়েছেন? এ-সম্পর্কিত তাঁর একটি স্বঘোষণা এক্ষেত্রে পর্যালোচনা করা যেতে পারে – আমি অন্তহীন আনন্দের উৎস খুঁজে পেয়েছি জীবনের মাঝে। পরিপার্শ্ব যতো বৈরীই হোক না কেন, – আমি তো আর মেনে নিচ্ছি না তা। আমি জানি, সংগ্রামই সত্য, সংগ্রামই সুন্দর। প্রেম, সেও এক সংগ্রাম। প্রেম এবং সংগ্রাম তাঁর দৃষ্টিতে অবিচ্ছিন্ন। অর্থাৎ ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর আকাঙ্খাকে তিনি অভিন্ন বলে বিবেচনা করেন। তাঁর প্রেম ও দ্রোহকে এই দৃষ্টিতে বিচার করাই যুক্তিযুক্ত হবে বলে আমার মনে হয়। নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই – প্রথম প্রকাশ ১৯৭০ সালে। এই গ্রন্থের সব কবিতা ষাটের দশকে লেখা, যে-সময়টা ‘উদ্দাম যৌবনতরঙ্গের মতো … মুক্তিমন্ত্রে ফুঁসে উঠেছিল’, যখন ‘নিরপেক্ষ বা নির্ভেজাল রোমান্টিক কবি হওয়া একেবারেই সম্ভব ছিল না’। কিন্তু তখনো তিনি প্রেমবিবর্জিত ছিলেন না, তবে তাঁর প্রেম ছিল সংগ্রাম-অভিমুখী, বা তাঁর সংগ্রাম ছিল প্রেম-প্রাণিত।

কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতায় আমরা চারটি প্রধান প্রবণতা খুঁজে পাই। প্রথমটি সুখী বা বিবাহিত জীবন অথবা পারস্পরিক ভালোবাসা। দ্বিতীয়টি প্রেমের প্রতি অবজ্ঞা, নিন্দা। প্রেম সম্পর্কে নিষ্ঠুর মনোভাব- যা নারীবিরোধী মনে হয়। তৃতীয়টি অধরা প্রেম বা প্লেটোনিক প্রেমের আধিপত্য সম্পদর্কিত, প্রেমের প্রতি সমর্পণ। চতুর্থ প্রবণতা হচ্ছে নারী সৌন্দর্যের চিত্রায়ণ খুব কমই।প্রথম প্রবণতার কবিতাগুলো সরল, বিশুদ্ধ, পারস্পরিক প্রেম ও দাম্পত্য প্রেমের সেরাটি সমর্থন করে। প্রেমের প্রতি সমর্পণের কথা রয়েছে। দুই আত্মা; কিন্তু মন যেন একটি- এসব কবিতার বৈশিষ্ট্য। এসব কবিতায় প্রিয়জন ছাড়া অন্য কোনো সত্তা নেই। এই প্রবণতার কবিতার সংখ্যা অনেক। কবি তার বন্ধুকে কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই একে অন্যকে ভালোবাসতে বলেন। কারণ তারা বিশ্বের কোনো ক্ষতি করছে না। তারা সব জড়জগৎ ত্যাগ করেছে। কবি বলেন যে, তাদের নিরীহ শারীরিক প্রেমের মাধ্যমে তারা প্রেমের জন্য আদর্শ হিসেবে অনুমোদিত হবে। তিনি প্রেমকে পারস্পরিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে মনে করতেন। তিনি বাইরের হস্তক্ষেপের উল্লেখ ছাড়াই এবং প্রেয়সীর মধ্যে অপর্যাপ্ততার কোনো ইঙ্গিত ছাড়াই পারস্পরিক প্রেম তৈরির আনন্দ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের কবিতায় অতিমাত্রায় নারী ও যৌনতার অনুপ্রবেশ ঘটানোর দায় নির্মলেন্দু গুণের এই কথা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। যদিও আমার মনে হয়, গুণের জনপ্রিয়তার মূলে ওই নারী ও যৌনতাবিষয়ক কবিতাগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। অমীমাংসিত রমণী কাব্যগ্রন্থ থেকে তাঁর এই যাত্রা শুরু। এরপর বিভিন্ন সময়ে নারী ও সংস্কারহীন যৌনতা প্রাধান্য পাওয়া কবিতাগুলো যথেষ্ট পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ মুঠোফোনের কাব্য, নিশিকাব্য, বাৎসায়ন কাব্যগ্রন্থগুলোর মাধ্যমে গুণ ভিন্নভাবে যেন হানা দিলেন। এর ভেতর দিয়ে ‘বাহ্যিক আদর্শ শাসিত’ পাঠকসমাজের গোপন বাজারটি তিনি দখল করে নিলেন। ফলে গুণের জনপ্রিয়তার পরিসর আরও বিস্তৃত হলো। নির্মলেন্দু গুণ নারীদের সম্পর্কে কথা বলতে পারেন, অনেক কবিতায় সৌন্দর্যের প্রশংসাও করেছেন। কিন্তু নারী সৌন্দর্যের চিত্রায়ণ খুব কমই আছে। তিনি সরাসরি বলেননি যে, তিনি তার প্রিয়জনের চুল বা ঠোঁট পছন্দ করেন। তিনি প্রেম-ভক্ত এবং শারীরিক চেহারা নয়, আবেগের কথা বলেন। তার কাছে ভালোবাসা মানে শুধু যৌনতা নয়। যদি সে তার প্রেয়সীর শরীরের কোনো অংশের কথা বলে, তা হলে সে কেবল তার মোহনীয়তা বর্ণনা করে। সরাসরি নারীর চরিত্র নির্মাণ না করা নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতায় অন্যতম ও আকর্ষণীয় প্রবণতা বলে মনে করি। প্রেমের কবিতায় নির্মলেন্দু গুণের সবচেয়ে মৌলিক অবদান সম্ভবত কল্পনার সঙ্গে চিন্তার মিশ্রণ, বুদ্ধির সঙ্গে আবেগ ও বাস্তবতার প্রতিফলন। পান্ডিত্যপূর্ণ এবং কল্পনাপ্রসূত তুলনা দ্বারা তিনি তার কবিতায় একটি বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি তৈরি করার জন্য বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে চমৎকার সেতুবন্ধন তৈরিতে অসাধারণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। প্রেমের অপূর্ব কিছু চিত্রকল্প। নির্মলেন্দু গুণের 'তোমার চোখ এত লাল কেন' কবিতাটি বেশ জনপ্রিয়। কোনো রাক-ঢাক না রেখেই একজন পুরুষের জবানিতেই কবিতায় উঠে এসেছে একাকী এক পুরুষের একাকীত্বের প্রগাঢ় বেদনা। খুব সরলভাবে মুখের ভাষায় তিনি কবিতায় বলেন, 'বাইরে থেকে দরজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত'। তাই, তিনি চান, কেউ একজন তার জন্য অপেক্ষা করুক। অপেক্ষা করুক ঘরের ভেতর। সেই অপেক্ষারতার কাছে বেশি কিছু প্রত্যাশা থাকবে না একাকী পুরুষটির। সে শুধু চায় ঘরের ভেতর থেকে একটি হাত দরজাখানি খুলে দেবে! এইটুকু! শুধু এইটুকু! এই সামান্য আকাঙ্ক্ষার কথা পড়তে পড়তে পাঠকের হৃদয় আর্দ্র হয়ে ওঠে। এই আকাঙ্ক্ষা শুধু কোনো একাকী পুরুষের নয়। একজন পুরুষের জবানিতে হলেও এই আকাঙ্ক্ষার কাছে এসে কবিতাখানি হয়ে ওঠে নারী-পুরুষ সকলের কবিতা। খাবার টেবিলে দিনের পর দিন একাকী রাতের খাবার এই নগরীর বহু মানুষ খায়। কোনো এক দুর্বল দিনে একাকী আহারের সময় কার না মনে হয়, আহা! কেউ একজন থাকুক পাশে বসে। খেতে-খেতে দু'জনে গল্প হবে। খুনসুটি হবে। তারপর আবার না হয় ফেরা যাবে যে যার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের প্রাচীর ঘেরা কুঠুরিতে।

নর-নারীর মৌলিক সম্পর্ক যৌনসম্বন্ধ নিয়ে প্রাচীন ভারতে কোনো কূপমণ্ডূকতা ছিল না। নারী যেমন নিজের শরীরের প্রয়োজনে আকাঙ্খা করতো পুরুষশরীর, পুরুষও তেমনি নিজের প্রয়োজনেই কামনা করতো নারীশরীর। শরীর বিষয়ে কোন সংস্কার তাঁরা মনের গোপন গহীনে লালন করতো না। বাঁধা হয়ে দাঁড়াতো না কোনো সামাজিক রক্তচক্ষু। এমনি অবাধ, স্বচ্ছন্দ, উদার, চিরকাক্ষিত ও ধ্রুপদী জীবনপ্রবাহের যুগেই জন্মেছিলেন ঋষি বাৎসায়ন। সমগ্র পৃথিবীতে তিনিই প্রথম নারী-পুরুষের যৌনজীবন এবং তার বিভিন্ন দিক নিয়ে রচনা করেছেন অসাধারণ গবেষণাগ্রন্থ ‘কামসূত্র’। ‘কামসূত্র’ শাস্ত্রটির যৌক্তিকতা, মৌলিকতা, তথ্যের প্রাচুর্য অর্থাৎ বিষয়ের বিচিত্র ব্যাপকতা এত শক্তিশালী ছিল যে বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যৌনবিজ্ঞান বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ হিসেবে ‘কামসূত্র’ সম্মানিত হয়। এই চির আধুনিক গ্রন্থ ‘কামসূত্র’ রচনা করতে গিয়ে বাৎসায়নের থাকতে হয়েছিল যৌনবিষয়ে সন্ধানী, যুক্তিবাদী, কৌতুহলী, বিশ্লেষণপ্রবণ এবং নির্মোহ একটি মন। ঋষিসুলভ প্রাজ্ঞ অন্বেষণ দিয়ে বাৎসায়ন নারীশরীর ও পুরুষশরীরের প্রতি বর্গইঞ্চির প্রতিটি সুগন্ধকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি মৈথুন বিষয়ে পোষণ করতেন উদার ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী। মানব শরীরের প্রতিটি ভাঁজ-বাঁকে লুকিয়ে থাকে যে আনন্দ সেই আনন্দ অন্বেষায় বাৎসায়ন ছিলেন মৌলিক, নান্দনিক ও বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গীর অধিকারী। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নর-নারী সম্পর্কের প্রধান ভিত্তি শরীর। প্রেম বা ভালোবাসা নামক কল্পিত বিষয়টি মূলতঃ গাছে ফোটা ফুলের মতো বড়ই বাহ্যিক। তার রং ও সৌন্দর্যটা সহজে চোখে পড়ে কিন্তু যা মূল তা থেকে যায় চোখের আড়ালে। বাৎসায়ন অন্যদের মতো শুধু ফুল দেখে মুগ্ধ হননি। বৈজ্ঞানিক সচেতনতা নিয়ে খুঁজে বের করেছেন গাছের প্রাণের উৎস শিকড়কে তথা নর-নারীর প্রাণোচ্ছলতার শুদ্ধ উৎস কামপ্রবণতাকে। প্রাজ্ঞ কবি নির্মলেন্দু গুণ উপলব্ধি করেছেন নর-নারী সম্পর্কের আদি ও মৌলিক উৎসটি এখনও যথেষ্ট ক্রিয়াশীল। মানুষের গভীর সম্পর্ক ও আকর্ষণের ভিত্তি এখনও শরীর। মানুষ হিসেবে- পুরুষ হিসেবে নির্মলেন্দু গুণ এই ধ্রুপদী ও জৈবিক প্রত্যাশাকে প্রবলভাবে নিজের জীবনে অনুভব করেছেন। ‘বাৎসায়ন’ কাব্যটি তাঁর এই মানবিক বোধের সতেজ প্রস্ফুটন। তিনি পুরুষ হিসেবে নারীর শরীরের প্রতিটি গিরিগুহাকে, প্রতিটি স্পর্শকে, প্রতিটি আলিঙ্গনকে, প্রতিটি শীৎকারকে প্রবল প্রাণপ্রবণতায় উপভোগ করেছেন। পুরুষ নির্মলেন্দু একলব্যের অধ্যবসায়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন নারীর শরীর ও কামসূত্রকে। তাঁর কবিমন ও ‘কাব্যকামকুশলতা’ আশ্রয় পেয়েছে শরীর মন্থনে। তিনি জানেন মানুষের সর্বোচ্চ আনন্দের অনুভূতি ও জ্ঞানের উপলব্ধি ঘটে এই শরীর বিনিময়েই। তাই তিনিই বলতে পারেন- “আনন্দের শ্রেষ্ঠ উৎস হচ্ছে কাম। কাম থেকে জন্ম নিয়েছে কবি।”নির্মলেন্দু গুণের প্র্রেমজ কবিতা গুলো দিকে নজর ফেরালে দেখা যাবে নির্মলেন্দু গুণের একটি প্রিয় বিষয় দেহ ও দেহানুষঙ্গ। তিনি কপট নন। তাই অকপটে নিজের বিশ্বাস ও কল্পনা প্রকাশ করেন। কিন্তু কখনো, কখনো তা নারীকে প্রয়োজনীয় সম্মানের পক্ষে আপত্তিজনক। যেমন, তিনি যখন লেখেন: ‘রান্নাঘর থেকে টেনে এনে স্তনগুচ্ছে চুমু খাও তাকে, বাথরুমে ভেজানো দরোজা ঠেলে অনায়াসে ঢুকে যাও- সে যেখানে নগ্ন দেহে গানার্র্থেই তৈরি হয়ে আছে আলোকিত দুপুরের কাছে-, মনে রেখো, তোমার রাত্রি নেই, অন্ধকার বলে কিছু নেই। বিবাহিত মানুষের কিছু নেই একমাত্র যত্রতত্র স্ত্রীশয্যা ছাড়া।’ -স্ত্রী তখন, অশ্লীলতার চূড়ান্তে পৌঁছেও কবিতার স্বার্থে তা হজম করা যায়। কিন্তু নির্মলেন্দু গুণ যখন লেখেন নিচের পঙ্ক্তিগুলো, তখন? ‘যেমন প্রত্যহ মানুষ ঘরের দরোজা খুলেই দেখে নেয় সবকিছু ঠিক আছে কিনা, তেমনি প্রত্যহ শাড়ির দরোজা খুলে স্ত্রীকেও উলঙ্গ করে দেখে নিতে হয়, ভালো করে দেখে নিতে হয়: -জঙ্ঘায়, নিতম্বে কিংবা সংরক্ষিত যোনির ভিতরে অপরের কামনার কোনো কিছু চিহ্ন আছে কিনা।’ -ঐ এগুলো কীভাবে গ্রহণ করা যাবে? কবির দৃষ্টিতে এখানে ‘মানুষ’ হলো পুরুষ আর সেই পুরুষের স্ত্রী যেন আসবাব, তালাবদ্ধ ঘরের জিনিসপত্র! নির্মলেন্দু গুণ এখানে পুরুষতান্ত্রিক প্রথাবদ্ধ দৃষ্টিতে আবদ্ধ। ‘স্ত্রী’ কবিতাটি কবির ১৯৭২ সালে প্রকাশিত না প্রেমিক না বিপ্লবী কাব্যগ্রন্থভুক্ত। তার মানে, গুণের কবিতায় কামগুণ শুরু থেকেই ছিল। ২০০০ সালে বেরিয়েছে বাৎসায়ন, এর পর কামগন্ধী বহু কবিতা মিলিয়ে বের করেন কামকানন (২০০৭)। কেন কামের রাজ্যে বসবাস?- এক সাক্ষাৎকারে (প্রথম আলো : ২২শে জুন, ২০০৭) নির্মলেন্দু গুণ জানিয়েছেন: ‘আমি [নির্মলেন্দু গুণ] কিছুটা সচেতনভাবেও করেছি বলা যায়। আমি ভেবেছি, কামকেন্দ্রিক কবিতার ধারাটিকে আরও প্রবল করে উপস্থাপন করি।’ নির্মলেন্দু গুণের এ ভাষ্যে আমার আপত্তি আছে। নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় প্রেম-কাম-রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে- এটাই তাঁর বৈশিষ্ট্য। তিনি মনে করেন না যে, কবিতা গণশিক্ষা কার্যক্রমে মাস্টারমশাইয়ের ভূমিকা নেবে। আবার নারীর স্তনাগ্র-চূড়ায় তাঁর বিশ্ব কেঁপে ওঠে। তিনি চুম্বনাকাক্সক্ষায় উটের মতো গলা বাড়িয়ে দেন : ‘আমার অন্তিম চুম্বনের জন্য আমি তোমার নেত্রকোণার উদ্দেশ্যে তখন প্রসারিত করবো আমার অধরোষ্ঠ। ঝর্নার উচ্ছল জলের দিকে যেরকম তৃষিত গ্রীবাকে প্রসারিত করে উষ্ট্র। তোমার বাম চোখে আমি পান করব এক লক্ষ ক্যান ঠাণ্ডা জার্মান বিয়ার, ডান চোখে লক্ষ পেগ স্কচ হুইস্কি।’ -এক সময় কামকে কাব্যের বড় উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আমাদের পূর্বপুরুষরা সেটা চেষ্টা করেছেন। আমি চেষ্টা করেছি কামকে কতটা শিল্পরূপ দিয়ে প্রকাশ করা যায়। এ চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে। প্রেম তো যৌনতারই একটি সংস্কৃত প্রকাশ।’ (মহুয়া : নির্মলেন্দু গুণ সংখ্যা : ২০০৮)।

কবি ও কবিতাকে বিচার করার মতন পড়ালেখা ও জ্ঞান কোনটাই আমার হয়ত নেই তবু কেন যেন বিশ্বাস করতে মন চায় প্রেমের কবিতাগুলোয় কবি নির্মলেন্দু গুণের জগৎ নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও নারীর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিটি কবিতায় ভিন্ন। কোথাও তারা অনুগত আবার কোথাও তারা অবিশ্বস্ত। নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতা তার অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করে। একজন প্রেমের কবি হিসেবে নির্মলেন্দু গুণ পার্থিব প্রেমের প্রতি তার মনোযোগ নিবদ্ধ করেছেন। পাঠকরা কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও আবেগের কোথাও সে তার প্রিয়তমার সঙ্গের কথা বলে; কোথাও তিনি জীবনের অন্য যে কোনো জিনিসের চেয়ে প্রেম পছন্দ করেন। কিছু সময়ে তিনি নারীদের অবিশ্বস্ত প্রকৃতি সম্পর্কে কথা বলেছেন। তারুণ্য গুণের কবিতার বড় সম্পদ। কবিতায় ও যাপনে তিনি কখনো বুড়িয়ে যাননি। জীবন ও চারপাশ নিয়ে প্রথম জীবনেও তিনি হেঁয়ালি করেছেন, এখনো করেন। আর তাই কিনা জানিনা তিনি বলে ফেলতে পারেন, “আমার স্তনস্তবমুখরিত কবিতায়, তাই দুগ্ধবতী নারীরা হয়েছে আমার ঈশ্বরী” তিনি নারীর বুকের পুষ্পযুগলের অপরূপ শোভা প্রাণভরে উপভোগ করেছেন। বিকশিত পুষ্পদ্বয়ের গভীরে প্রাণরূপ মধু ও কামরূপ শক্তির যে বিরাট খনি লুকিয়ে আছে তার সৌন্দর্য দেখে মোহিত হয়েছেন। কামশাস্ত্রজ্ঞ যে কবি বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে- “দেখিলেন সেই অপরূপ শোভা, মনোলোভা, নিদ্রিতা, নিশ্চুপ।” সেই তিনিই দেখেছেন সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো সুডৌল পুস্পকলি দুটি প্রস্ফুটনের জন্য অপেক্ষা করে পুরুষআঙ্গুলের সামান্য স্পর্শের, আর তারপরেই ঘটে যায় মহাবিস্ফোরণ- “অসতর্ক পুরুষ-আঙুলের সামান্য আঘাতে বিভাজিত হল পরমাণু, বিস্ফোরিত হল বোমা।” নির্মলেন্দু গুণের জীবনে কবিতা ও সেই সম্পর্কিত প্রতিটি অবস্থানই চির আকাঙ্খার। তিনি দেখেছেন তাঁর সমস্ত কাব্যসাধনা, কাব্যযশ এবং‘কাব্যকামকুশলতা’র প্রধান উৎস কাম। সমকালীন বাস্তববিমুখ মানুষের কাছে তা অপরিচিত হলেও প্রেমিক কবি চণ্ডীদাশ ও বাৎসায়নকে অনুধাবন করে তিনি জেনে নিয়েছেন পরম সত্যটিকে- “তাঁরই কল্যাণে নারীকে চিনেছি, শিখেছি সঙ্গম কলা, রতিরঙ্গরস; তা না হলে সকলি গরল ভেল, কামসিদ্ধি বিনা ব্যর্থ কাব্যযশ।” নাকি দেহ মনেরই প্রকাশ?” এই অমীমাংসিত প্রশ্ন বাৎসায়নের মতো নির্মলেন্দু গুণকেও বিক্ষত করেছে চলেছে জীবনভর। অবশেষে উত্তীর্ণ যৌবনে কবি পেয়েছেন সত্যের সন্ধান। “বুঝেছেন মন বড় সত্য নয় মানবের দেহই প্রধান।”

আমার সাথে তোমার ভাবনা কতটা মিললো আদৌ মিললো কিনা জানিনা, কয়েকদিন ধরে নির্মলেন্দু গুণ পড়তে পড়তে যা মনে এলো তাই তোমাকে লিখে দিলাম। কেমন হলো তোমার বেনারস ভ্রমণ? খুব যদি ভুল না করে থাকি এটাই তোমার জীবনে কোন বন্ধুর সাথে পারিবারিক ট্যুর। মনতোষ কি সেই আগের মতন নিজের ভেতরে গুটিয়ে থাকে? তোমার সাথে প্রথম বেঞ্চ শেয়ার করা মানুষটি কোন অভিমানে নিজেকে তোমার থেকে গুটিয়ে নিয়ে এতবছর কষ্ট পেলো সেই সন্ধান নিশ্চয় করেছো? গিনির কথা শুনে তাকে খুব দেখার শখ জেগেছে। তার ভালো হোক, অনেক বড় হোক সে। বৈশুকে আমার শুভকামনা ও ভালবাসা দিও। মনতোষ তো এমন একজন সঙ্গীই ডিজার্ভ করে তাই না? তোমাদের ঘোরাঘুরির ছবি পাঠিও সঙ্গে ভ্রমণ বৃত্তান্ত। বহুবছর তোমাকে দেখিনা এই সুযোগে তোমাকে দেখা হবে সঙ্গে মনতোষ, বৈশু আর গিনি মা কেও দেখে নেয়া যাবে। নিরন্তর ভালো থেকো। মনতোষ ও তাঁর সংসার দেখে এবার অন্তত নিজেকে নিয়ে ভাবো। সবশেষে একরাশ দুষ্টু হাসি...

ভালবাসা ও শুভকামনায়

সুস্মি

দশমী সন্ধ্যা

০২.১০.২০২৫
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















২৩.১

কোন এক গাঁয়ে কেউ কাউকে খুন করেছে। শত্রুতাবশ কেউ অন্য কারও নাম থানায় উন্মাদ খুনী রূপে

লিখিয়ে দিয়েছে। এবং কেউ শত্রুতাবশ ওর বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়েছে। আবার কেউ একজন ওর হয়ে উপর

মহলে সুপারিশ করেছে। ফের কেউ ওর হয়ে কাউকে ঘুষ দিয়েছে। কেউ আবার কোন সাক্ষীকে ভয়

দেখিয়েছে, অন্য কাউকে বোকা বানিয়েছে, আবার অন্য কাউকে ভালবেসেছে। এই ভাবে হাকিমের

এজলাসে পৌঁছতে পৌঁছতে খুনের মামলাটার চেহারাই বদলে গেল। ওটা আর খুনের মামলা না হয়ে “খুন কা বদলা” নামের ড্রামা হয়ে গেল।

সেই নাটকে দু’পক্ষের দুই উকিল চমৎকার অভিনয় করল। জজের মনে হল যা প্রস্তুত করা হল সেটা

নাটক হিসেবে অতি উত্তম। কিন্তু প্রমাণ হিসেবে যা পেশ করা হল সেটা আসলে জাল। এই জালসাজির

থিওরি জজকে এমন প্রভাবিত করল যে উনি মেনে নিলেন আসামী নির্দোষ এবং এটাও ভাবলেন যে

আদপে কোন খুন হয় নি! পরিণামে ‘আসামী হরিরাম’ খুনের মামলায় সসম্মানে মুক্তি পেল।

কিন্তু আসামী হরিরাম সেরেফ জজের কথায় তো ‘সম্মানিত নাগরিক’ হয় না। সবাই জানে যে ও আগে

যেমন গুণ্ডা ছিল, জেলের বাইরে এসেও তাই থাকবে। কিন্তু ছাড়া পেতেই ও গোটা এলাকায় যাদের মানী

আদমি বলা হয়---মানে, মহিলা, অস্পৃশ্য এবং মুসলমান বাদে—তাদের সবাইকে ভোজ খেতে নেমন্তন্ন

করল। ফলে সেদিন শিবপালগঞ্জের সমস্ত বিশিষ্ট লোকজন হরিরামের বাড়িতে ভোজ খেতে গেল। শুধু

বৈদ্যজীর বাড়িতে রঙ্গনাথ একা।

সারাদিন কেটে গেল কোন নিরুত্তাপ, ক্লান্তিকর লেকচার শোনার মত। বিকেল হতেই ও হাঁটতে বেরিয়ে

পড়ল। দেখল, প্রিন্সিপাল সাহেব একটা পান দোকানে দাঁড়িয়ে আছেন।

উনি পান চিবুচ্ছেন এবং পানওয়ালাকে দাম দেয়ার চেষ্টা করছেন। তাম্বোলী অর্থাৎ পানওলা ওনাকে

পান তো খাইয়ে দিয়েছে, কিন্তু কত হল জানতে চাইলে বারবার বলছে—এটা তো আপনারই দোকান।

তখনই রঙ্গনাথ ওখানে হাজির। তাই দেখে প্রিন্সিপাল গম্ভীর চেহারায় দোকানের মালপত্রের স্টক

চেক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

চৌকাটের দেয়াল থেকে লটকে থাকা একটি বহুবর্ণের ছবিতে মহাত্মা গান্ধী দাঁত বের করে বিচ্ছিরি

হাসি হাসছেন। পাশে ওনার উত্তরাধিকারী নেহরু হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। ছবিটির বিজ্ঞাপনের

তাৎপর্য একটি রঙিন তেল যা বাচ্চাদের সুখা রোগ সারাতে অব্যর্থ। রঙ্গনাথ প্রিন্সিপালকে বলল

‘দেখেছেন”?

জবাবে শোনা গেল এক অবধী প্রবাদ, “জইস পসু তইস বাঁধনা”। (যেমন পশু, তেমনই তার বাঁধন) যেমন

গেঁয়ো এলাকা, তেমনই তো ছবি হবে”।

-“গেঁয়ো শহুরে আবার কী কথা? সবাই তো গান্ধীজিকে সম্মান করে”। খানিকক্ষণ মন দিয়ে ছবিটা দেখে

রঙ্গনাথ বলল, “ইচ্ছে করছে যে এঁকেছে তাকে একশ’ ঘা জুতোর বাড়ি লাগাই”।

প্রিন্সিপাল হাসলেন। হাসি দিয়ে বোঝালেন যে রঙ্গনাথ নেহাতই বোকা। বললেন, “যত গুড় তত মিঠে।

তেলি-তাম্বোলীর ওজন কতটুকু? মামুলি দোকানে কেউ পিকাসো টাঙায় নাকি”?




উত্তেজিত রঙ্গনাথ মাঝখানে বলে উঠল, “দাঁড়ান, দাঁড়ান, মাস্টারমশায়! পিকাসোর নাম নাই নিলেন।

আপনার মুখে এমন নাম শুনলে বমি পায়।

হাঁটতে হাঁটতে দুজনেই এখন বড় রাস্তায় এসে গেছেন এবং গরুমোষের ভীড় ঠেলে হাওয়া খেতে চেষ্টা

করছেন। তবে, কোথাও হাওয়া নেই; আছে ফুসফুসে ঢোকার জন্যে ধূলো, নাকে ঢোকার জন্যে গোবরের

গন্ধ আর পিঠে ঢোকার জন্যে কোন গোমাতার শিং।

রঙ্গনাথের কথাটা প্রিন্সিপাল সাহেবের এত খারাপ লাগল যে উনি ভদ্র শিক্ষিত ব্যক্তির মত কথা

বলতে লাগলেন।

--“তো রঙ্গনাথজী, আপনি কি আমাকে একেবারে অশিক্ষিত ভাবেন? আমিও ইতিহাসে এম এ, ফিফটি

নাইন পারসেন্ট পেয়েছিলাম। নেহাৎ ভাগ্যের দোষে এখানে প্রিন্সিপাল হয়ে পড়ে আছি”।

এইরকম সিরিয়াস কথাবার্তার চোটে রঙ্গনাথের হিম্মত ফুস্‌ হয়ে গেল। ওর মনে হল, পিকাসোমার্কা

খোঁচা দিয়ে ও প্রিন্সিপালকে আহত করেছে। ও সোজা প্রিন্সিপালের কাছে ক্ষমা চাইল। বলল, “এ তো

আমি আগেই জানতাম। কোন বাজে ডিভিসন পেলে আপনি কি আর এখানে প্রিন্সিপাল হতেন”!

“সেটা ঠিক, বাজে নম্বর পেলে ইউনিভার্সিটির লেকচারার হতাম। আমার কিছু থার্ডক্লাস নম্বরওলা

বন্ধু এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে বটে”।

প্রিন্সিপাল খানিকক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে চলতে লাগলেন। ভাবুক হবার চেষ্টা করছিলেন। একটু পরে

বললেন, “বাবু রঙ্গনাথ, তোমরা আমার সম্বন্ধে কী ভাব সব জানি। তুমি হয়ত ভাবছ—ব্যাটা একটা

কলেজের প্রিন্সিপাল, অথচ কীরকম ল্যাবা! সবার সামনে ‘ হেঁ -হেঁ-হেঁ’ করতে থাকে। কথাটা সত্যি।

আমি তো—খান্নাটান্নার কথা ছাড়, ও শালারা নেহাৎ ছোকরা—সবার কথা অনেকখানি মাথা নুইয়ে

শুনি। বিশেষ করে যারা আমার চেয়ে বড় তাদের কথায় হরদম তাল দিয়ে চলি। এবার তুমি আমায় বোকা

ঠাউরাতে পার, কিন্তু এরও এক কারণ আছে---

“কারণটা হল---“ কথা অসমাপ্ত রেখে উনি একটা মোষকে পথ ছেড়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে হেঁ -হেঁ

করে হাসতে লাগলেন।

“কারণটা হল -যেমন বুদ্ধির একটা ভ্যালু আছে, তেমনি হদ্দ বোকামিরও এক নিজস্ব ভ্যালু রয়েছে।

বোকার কথা তুমি হেসে উড়িয়ে দাও অথবা মেনে নাও—তাতে বোকার কিছু আসে যায় না। তাই আমার

কথা হল- বোকার হদ্দকে খোঁচাতে নেই।

কখনও কখনও এরকম করি বলে লোকে আমাকে হদ্দ বোকা ভাবে, আসলে ওরাই বোকা। কী বুঝলে বাবু

রঙ্গনাথ”?

প্রিন্সিপাল সাহেবের মুখ থেকে এত অবিরল বাক্যস্রোত! রঙ্গনাথ হকচকিয়ে গেল। তখনই একটা

বাছুর ওর পিঠে শিং দিয়ে খোঁচা মারল। কিন্তু রঙ্গনাথ কিচ্ছু টের পেল না। প্রিন্সিপাল ওর হাত ধরে

টেনে একপাশে সরিয়ে দিলেন। ওনার ওই ‘বুদ্ধিমান-রূপ দর্শন’ এক বিশিষ্ট অনুভব বটে। ও বুঝতেই

পারেনি কখন ওর দাঁত বেরিয়ে এল এবং কখন ও নিজেও ‘হিঁ -হিঁ-হিঁ’ করতে লাগল। পরমুহুর্তেই ও

প্রিন্সিপাল সাহেবের থেকে মাফ চাইছিল আর প্রায় এরকম কিছু বলছিল,” হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি যে

আপনি পিকাসোর সম্বন্ধে সবই জানেন। জী, যাকগে যা হবার হয়েছে। জী, হয়েছে কি আপনি পিকাসোর

নাম নিয়েছেন শিবপালগঞ্জে দাঁড়িয়ে। আপনিই বলুন, এখানে কেউ পিকাসোর সম্বন্ধে ভাবতে পারে!




তাই আমার বমি পাচ্ছিল। আসলে দোষ না আপনার, না আমার; না শিবপালগঞ্জের—এমনকি

পানওয়ালারও নয়। যত দোষ সব পিকাসোর”!

প্রিন্সিপাল রঙ্গনাথের ব্যক্তিত্বের ভেঙে পড়ে খান খান হয়ে যাওয়া দেখতে লাগলেন। ফের গলার

স্বর ভারি করে বলতে লাগলে,”আমারও কখনও ওজনদার কথা বলার অভ্যেস ছিল। তখন এম এ

পড়ছিলাম। তুমি শহুরে ছুঁড়িদের রাস্তায় চলার ভঙ্গি খেয়াল করেছ? ওদের মধ্যে কেউ কেউ যুবতী

হয়েও বালিকার মত উচ্ছল হয়ে চলে। আমারও ছিল ওই অবস্থা। কখনও খেয়াল করতাম না কোন

প্রফেসর ওজনদার আর কে পাক্কা ইডিয়ট। সবার সামনে নিজেকে জাহির করতে চাইতাম। এক

প্রফেসর তাতেই খাপ্পা হয়ে আমার সর্বনাশ করলেন।

“জেনে নাও বাবু রঙ্গনাথ”!

এঁরা এখন গাঁয়ের বাজার পেরিয়ে বাইরে এসে গেছেন। সন্ধ্যা নামছে। ছোলা-বাদাম ভাজার ধুঁয়ো কড়াই

থেকে উপরে না উঠে সামনের দিকেই ভেসে বেড়াচ্ছে। সূর্য ডুবে গেছে। কিন্তু তার অন্তিম ছটা এখনও

যে আলো ছড়াচ্ছে তাতে রঙ্গনাথ ছোলাওয়ালার দোকানে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে চুপচাপ বুঝে নিল

–হ্যাঁ, দেখার মত জিনিস বটে!

লোকজনের বসতি প্রায় পঞ্চাশ গজ পেছনে ছেড়ে আসা হয়েছে। এ জায়গাটা জনশূন্য। এরকম

জায়গাতেই মানুষ কবিতা, লুঠপাট এবং পায়খানা সব কিছু করতে পারে। তাই কবিতা এবং লুঠপাটে

অক্ষম কিছু বাচ্চা রাস্তার দু’পাশে বসে পায়খানা করছে আর একে অন্যকে ঢিল ছুঁড়ছে। আরও

খানিকটা দূরে অনেক প্রৌঢ় এবং অভিজ্ঞ মহিলারা একই উদ্দেশ্যে রাস্তার দুপাশে লাইন লাগিয়ে

দলবেঁধে বসে আছেন। ওখানে ওনাদের আব্রুহীন উপস্থিতি নতুন ভারতের নির্মাতাদের দুয়ো দিচ্ছে।

কিন্তু ওই নির্মাতারা নিশ্চয়ই এসব ব্যাপারে অজ্ঞ, কিছুই জানেন না। কারণ, ওঁরা সম্ভবতঃ এই

সময় নিজের বাড়ির সবচেয়ে ছোট কিন্তু চকমক কামরায় কমোডে বসে খবরের কাগজ, কোষ্ঠকাঠিন্য

এবং বিদেশগমন গোছের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করছেন।

এই দুই আগন্তুককে দেখে ওই মহিলার দল পায়খানার কাজে ফুলস্টপ লাগিয়ে সোজা উঠে

দাঁড়ালেন—যেন গার্ড অফ অনার দিচ্ছেন! তবে এসব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই রঙ্গনাথ এবং

প্রিন্সিপাল সহজভাবে এগিয়ে চললেন। মহিলারাও সহজভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটা ছাগল ম্যা-ম্যা

করে রঙ্গনাথ আর প্রিন্সিপালের সঙ্গে ধাক্কা খেল এবং একদম রাস্তার ধারে পৌঁছে এক মহিলার

জলের লোটাকে উলটে দিয়ে পাশের একটা বাগানে ঢুকে গেল। কয়েকটা বাচ্চা ঢিল ছোঁড়া এবং প্রাকৃতিক

কাজকম্মের সাথে সাথে চেঁচাতে শুরু করল। আর ক’টা বাচ্চা ওই অবস্থাতেই উঠে ছাগলের পেছন পেছন

দৌড়তে লাগল।

এমন পরিবেশে প্রিন্সিপাল এবং রঙ্গনাথ খানিকক্ষণ মৌনব্রত ধারণ করলেন। আরও দশ গজ এগিয়ে

প্রিন্সিপাল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলেন—মহিলারা আগের মত লোটা নিয়ে মাটিতে বসে পড়েছে।

প্রিন্সিপাল আবার নিজের কথা শুরু করলেন-

“আমার এক প্রফেসর ছিলেন জনৈক ব্যানার্জি সাহেব। আমাকে ইতিহাস পড়াতেন। ওনার বৈশিষ্ট্য

সোজা কথাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলা। ব্যস, লোকে ওনাকে ভারি পণ্ডিত ভাবত।

“আমি নতুন নতুন ওনার ক্লাস করছিলাম, উনি আমাকে খেয়াল করলেন এবং চাইছিলেন যে আমিও

ওনাকে বিদ্বান বলে মেনে নিই। ---




“একদিন উনি আমাদের অশোকের শিলালেখ পড়াচ্ছিলেন। তখন দেশ মাত্র আজাদ হয়েছে আর গৌতম

বুদ্ধ, সম্রাট অশোক এসব নিয়ে খুব চর্চা হচ্ছে। কারণ, তখনও চীন থাবড়া মারে নি। আমরা অহিংসা

নীতি নিয়ে খুব কিচিরমিচির করছি। রাস্তা এবং পাড়ার নামও অশোক এবং গৌতম বুদ্ধের নামে রাখা

হচ্ছে।

“প্রফেসর ব্যানার্জিও খুব আবেগে ভাসছিলেন। উনি ক’দিন ধরে খালি অশোক পড়াচ্ছিলেন এবং কথায়

কথায় গোলপোস্ট থেকে সরে আজকের রাজনীতিতে অশোক কী চমৎকার ফিট হচ্ছেন সেটা নিয়ে দু’চার

কথা বলে দিতেন। একদিন উনি এদিক সেদিক নানাপ্রসঙ্গের পর একটা শব্দে আটকে গেলেন।

“শব্দটা হল ‘বিমান’।

“হ্যাঁ, সেটাই –যেমন পুষ্পক বিমান। অশোকের শিলালেখে একজায়গায় বিমানের উল্লেখ আছে। প্রফেসর

ব্যানার্জি বললেন—‘তোমরা বোধহয় ভাবছ বিমান মানে দেবযান বা দেবতাদের বাহন’।

“রঙ্গনাথ বাবু, এইটুকু বলে বুড়ো চুপ মেরে গেল আর মুচকি মুচকি হাসতে লাগল, যেন আমরা সব

বোকাপাঁঠা। আমি বললাম, ‘প্রফেসর সাহেব, বিমানের আরও একটা মানে আছে’। তখন উনি হাত দেখিয়ে

আমাকে থামিয়ে দিলেন।

“তারপর শুধু উনিই মুখ চালাতে থাকলেন, আর কাউকে বলার সুযোগই দিলেন না। বললেন, “প্রফেসর

ভাণ্ডারকরও ঠিক এই ভুলটাই করেছিলেন। অনেকদিন আগের কথা, আমি ওনার সঙ্গে কিছু জৈন

গ্রন্থের উপর রিসার্চ করছিলাম। আর উনি আমার সঙ্গে অশোকের শিলালিপি নিয়ে রিসার্চ

করছিলেন। একদিন আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলা, ‘ডক্টর ভান্ডারকর, বিমান মানে কী’? উনি বললেন,

‘ব্যানার্জি, এ তো সবাই জানে—এর সামান্য অর্থ হল বাহন, বিশেষ করে দেবতাদের বাহন’।

“রঙ্গনাথ বাবু, এই গল্পটা উনি থেমে থেমে বেশ সাসপেন্স তৈরি করে বলছিলেন। আর সব ছাত্রগুলো

ভ্যাবলা মুখ করে শুনছিল। খানিকক্ষণ চুপ করে ফের শুরু করলেন, ‘শোন তোমরা, আমি ডক্টর

ভাণ্ডারকরের কথার প্রতিবাদ করলাম। বললাম যে ওই শিলালেখে বিমান শব্দের অর্থ এটা নয়।

ভাণ্ডারকর জানতে চাইলেন সঠিক অর্থটি কী? তোমরা শুনছ তো? আমি বলে দিলাম যে অন্য কিছু’।

“প্রফেসর ব্যানার্জি বললেন যে এটা শোনার পর ভাণ্ডারকরের চেহারা যা হল না! তারপর উনি বললেন,

‘সংস্কৃত ভাষার সমস্ত কোষ আমি পড়েছি। বিমানের সামান্য অর্থ সবাই বলেছে—আকাশগামী যান।

আর ব্যানার্জি, তুমি কী করে বলছ যে অন্য কোন মানে আছে’? জবাবে আমি বললাম,’ডক্টর,

গোড়াতে আমিও তাই ভাবতাম। সংস্কৃত সাহিত্য আর ব্যাকরণ পড়তে পড়তে আমারও অর্ধেক জীবন

কেটেছে। কিন্তু বুঝলাম যে বিমান শব্দের সঠিক অর্থ জানতে হলে খালি সংস্কৃত পড়লে হবে না,

প্রাকৃত পড়তে হবে। আমি প্রাকৃত ভাষায় বেশ কয়েকটা জৈন গ্রন্থ পড়েছি। ডক্টর ভাণ্ডারকর,

আপনার প্রাকৃত জানা আছে’?

“রঙ্গনাথ বাবু, প্রফেসর ব্যানার্জি এই গল্প খুব রসিয়ে রসিয়ে বলছিলেন। বলছিলেন। ‘ভাণ্ডারকর

প্রাকৃত জানতেন না। অথবা আমার চেয়ে অনেক কম জানতেন। তাই আমি ওনাকে একটা প্রাকৃত গ্রন্থ

পড়ালা্ম, যেটাতে বিমান শব্দের প্রয়োগ যা অশোকের শিলালিপিতে রয়েছে-- সেই অর্থে করা আছে ।

বুঝলে তোমরা, তখন উনি বিমান শব্দটির সঠিক অর্থ শিখলেন’।

“রঙ্গনাথ বাবু, আমি গেঁয়ো লোক, তায় জাতে বামুন, আবার ভূতপূর্ব জমিদার বংশের। ব্যানার্জির এই

তামাশা দেখে আমার সর্বশরীর জ্বলতে লাগল। মন তো চাইছিল –ঘাড়টা ধরে এত জোরে ঝাঁকাই যে




বিমান শব্দের আসল অর্থ ওর জিভ থেকে টপ্‌ করে বেরিয়ে আসবে। ততক্ষণে ব্যানার্জি উত্তেজিত

হয়ে বলছেন—‘তোমরা নোট করে নাও, বিমান শব্দের আসল অর্থ সাতমহলা বাড়ি’!

“চারদিক নিস্তব্ধ। রঙ্গনাথ, আমারও নিজের ক্ষমতার অহংকার ছিল। চ্যাংড়ামি করে বসলাম।

দাঁড়িয়ে উঠে বললাম, ‘প্রফেসর সাহেব, বিমান শব্দের এমন অর্থ তো সংস্কৃত সাহিত্যের সব

পণ্ডিতেরই জানা। এ নিয়ে এত রিসার্চ করার কী ছিল’?

“শোনামাত্র প্রফেসর আমাকে চোখ ছোট করে দেখলেন। তারপর বললেন,’ঠিক আছে। আপনি না হয়

রিসার্চ না করেই এতসব জেনে ফেলেছেন, তো বলুন শ্রীমান, এই অর্থটি আপনি কোন পুস্তকে

পেয়েছেন? নিন, বলে ফেলুন’।

“রঙ্গনাথ বাবু, চ্যাংড়ামি বলে কথা। আমিও এক লেকচার ঝেড়ে দিলুম। দশটা সংস্কৃত বইয়ের নাম এক

নিঃশ্বাসে আউড়ে দিলাম। মেঘদূত নামের চালু গ্রন্থের নামও নিলাম। শেষে ফের বললাম যে বিমান

শব্দের এমন অর্থ তো সবারই জানা। আপনারা এর জন্যে এত পরিশ্রম করলেন! আশ্চর্য !

“এর ফল কী হল আন্দাজ করতে পার?

“ সেইদিন থেকে আমি প্রফেসর ব্যানার্জির দু’চোখের বিষ। বললেন,” আপনি তো খুব বড় স্কলার।

আমি ইউনিভার্সিটির অতি সাধারণ অধ্যাপক’। মন করল, বলে দিই যে আপনি আমার সম্বন্ধে ভুল

বলছেন কিন্তু নিজের সম্বন্ধে ঠিক; কিন্তু ওনার রাগ দেখে চুপ মেরে গেলাম। কিন্তু উনি থামার পাত্র

নন। ফের শুরু করলেন, ‘আমি তো সব কথাতেই রিসার্চ করি। আপনার মত পণ্ডিত তো নই যে সব

বিষয়ের সমাধান মুখে মুখে করে ফেলব? এটাই কি কম যে আপনি যে বিমান শব্দের অর্থ নিয়ে আমার

সঙ্গে সহমত হয়েছেন? এ তো আমার সৌভাগ্য! যাকগে, আপনার মত স্কলার আমার ক্লাসে উঠে

দাঁড়াবেন এটা ঠিক হল না। আপনি বসে পড়ুন’।

“ তো রঙ্গনাথ বাবু, সেই যে উনি চটে গেলেন, সেটাই আমার কাল হল। আমার সব কথায় উনি ভুল ধরতে

লাগলেন। শেষে আমার ডিভিসন খারাপ করে দিলেন আর এমন কিছু কান-ভাঙানি দিলেন যে উনি যতদিন

ছিলেন আমি ইউনিভার্সিটিতে পা রাখতে পারি নি।

“ওই বছরে ওনাকে না চটালে আজ আমি ওখানে ওঁর জায়গাতে হতাম”।

প্রিন্সিপাল সাহেব এই কিসসা শুনিয়ে খানিক চুপ করে রইলেন। দুজনে কোন কথা না বলে চুপচাপ

চলছিলেন। একটু পরে প্রিন্সিপালই মুখ খুললেন,”এরকম বেশ ক’বার গচ্চা খেয়েছি। শেষে মেনে নিলাম

যে সব এভাবেই চলতে থাকবে। তাহলে চলুক। সবাই যখন পাখি শিকার করেই সন্তুষ্ট, আমি কেন

খামোকা বাঘ শিকার করি? তাতে কার কী ছিঁড়বে? আর এখন আমার অবস্থা দেখছ রঙ্গনাথ বাবু? তুমি

কিছু বললে-হ্যাঁ, ভাই! ঠিক বলেছ। বৈদ্যজী মহারাজ কিছু বললেন?—হ্যাঁ মহারাজ, একদম ঠিক। আর

রূপ্পন বাবু কিছু বললে? -- হ্যাঁ মহারাজ, একদম ঠিক। বদ্রী পালোয়ান?—হ্যাঁ ভাই, সব ঠিক আছে”।
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in



















১১.

অমলকান্তি রোদ্দুর





প্রিয় সুস্মি

জন্মদিনের ঠিক আগের দিন তোমার চিঠি পেলাম। সঙ্গে বিবেক বিদায় পালা। ধন্যবাদ দেয়া উচিত কিনা বুঝতে পারছিনা বইটি আগে কখনো পড়া হয়নি এমন কি এই বই সম্পর্কে তোমার চিঠিতেই প্রথম জেনেছি। বহুবছর পরে জমকালো জন্মদিন পালন হলো আমার, নিজেকে বেশ বিখ্যাত মনে হচ্ছিল। তোমার পাঠানো বই দিয়েই শুরু এবছরের জন্মদিন উদযাপন। আগের রাতে কেক কেটে ভাগ্নি অনন্যার সেলিব্রেশন দিয়ে শুরু হলেও কর্তার (জামাইবাবু) স্বহস্তে রান্না করা পোলাও মাংস ছিল দারুণ পাওয়া। তোমাকে তো বলাই হয়নি আঠাশ বছর পরে আমার প্রথম বন্ধু মনতোষ (মনুয়া) কে খুঁজে পেয়েছি। জেনকিন্স স্কুলের সেই টেস্ট পরীক্ষার পরে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটি এখন ঘোর সংসারী। জানো, বেটা ঠিক সেই স্কুলের মতই আছে। যদিও দারুণ এক জীবনসঙ্গী পেয়েছে, ইনফেক্ট সেই বৈশাখী বা বৈশুই তো মেলালো আমাদের এত বছর পরে, ওদের মেয়ে শ্রীধা ডাকনাম গিনি ওকে যদি দেখো একদম পাকা বুড়ি একটা কিন্তু চার বছর বয়সী তার নাচের এক্সপ্রেশন দেখলে মুগ্ধ হবে। সেই বৈশু তিনদিন আগেই বলে রেখেছিল তাদের বাড়ি জন্মদিনের দিন বিকেলে যেতে হবে। আমার জন্মদিন মানেই বৃষ্টি তুমি সেটা জানো। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ছুটেছি মনুয়া আর বৈশুর বাড়ি। মাথায় শয়তানী বুদ্ধি কিলবিল করছিল। তাই বৈশুর কল ধরছিলাম না সকাল থেকেই। সন্ধ্যার একটু আগে ওদের বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে মনুয়াকে কল করে বললাম আমি পৌঁচ্ছে গেছি কিন্তু বৈশুকে বলবো আমি আসছি না। তোকে কল করলে আবার বলে দিস না আমি পৌঁচ্ছে গেছি। মনুয়ার সাথে কথা শেষ করে বৈশুকে কল করে বললাম খুব বৃষ্টি এখানে তাই আজ যাওয়া হচ্ছে না। সে কি রাগ বৈশুর, যদিও কলে বলছিলো উনি যার তার সাথে রাগ করেন না। অনেকক্ষণ এইসব করে যখন বুঝলাম উনি রেগে প্রায় কেঁদেই ফেলবেন তখন ওদের বাড়ির কলিং বেলে চাপ দিলাম। ঘরে ঢুকতেই গিনি আর বৈশুর চোখ মুখে আনন্দের লহর বয়ে গেলো। কতবছর পরে পায়েস খেয়ে জন্মদিন উদযাপন করলাম মনেই করতে পারিনি। রাতে মনুয়া কেক নিয়ে এলে কেক কাটা হলো বৈশু সারা সন্ধ্যা ধরে বানালো পোলাও চিকেন চিলি, রাত রঙ্গিন হলো আড্ডায়, স্মৃতিচারণে।



সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দা থেকে বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে খাবার টেবিলের পাশে, একটু আগে বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। বৈশুর সাথে কথা বলতে বলতে মনে পড়ল- ‘সারা দিন ধরে বৃষ্টি ঝরছে। নির্জন গলি। অন্ধ আবেগে/ উন্মাদ ঝোড়ো হাওয়া হেঁকে যায়, শীর্ণ পথের/ স্মৃতির জীর্ণ খোলস নাড়িয়ে ছুটে যায়; ফের/ শার্সিতে বাজে একটানা সুর/ বৃষ্টির, মৃদু কান্নার সুর একটানা বাজে’। তোমার মনে পড়ে এই কবিতাটি? সেদিনও শ্রাবণ মাস অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল তিনদিন ধরে কলেজ ক্যান্টিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি বিড়বিড় করছিলাম এই কবিতাটি আর তুমি পাশ থেকে বলে উঠেছিলে- একটু জোরে বলুন না প্লিজ! আমি বিস্ময়ে তাকিয়েছিলাম এর আগে কোনদিন কথা হয়নি আমাদের অথচ রোজ তোমাকে দেখতাম ক্লাসে, ক্যান্টিনে, লাইব্রেরীতে, জানতাম তুমি আমার পাড়াতেই থাকো কিন্তু কথা হয়নি। তুমি বহুবার জানতে চেয়েছো আমি কেন বিস্মিত হয়েছিলাম সেইদিন, তোমাকে তার কারণ বলেছিলাম কিনা মনে করতে পারছিনা এত দশক পরে তাই আজ বলি সে সময় সুনীল, শক্তি বা পূর্ণেন্দু পত্রীদের কবিতা নারী মনের যতটা কাছের যতটা জনপ্রিয় নীরেন্দ্রনাথ ঠিক ততটা মুখে মুখে ঘুরে ফেরেন না। তাই তোমার আগ্রহ আমাকে বিস্মিত করেছিল। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জীবন শুরু হয়েছিল আর পাঁচটা সাধারণ শিক্ষিত বাঙালি পরিবারের ঘেরাটোপেই। ১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার চান্দ্রা গ্রামে তাঁর জন্ম। নীরেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘... সেখান থেকে সব চেয়ে কাছের রেল-ইস্টিশানটিও ছিল চব্বিশ মাইল দূরে।... বাড়ির সংখ্যা বিশ থেকে বাইশের মধ্যে। পাকা বাড়ি কুল্যে একটি। তাও দোতলা নয়, একতলা।...’’ এমন এক পরিবেশই হয়তো সে দিন প্রকৃতি ও মানুষ তাঁর কবিতার এই দুই সত্তাকে রোপণ করে দিয়েছিল তাঁর মধ্যে। পরে এক সময় বলেছিলেন, ‘‘যেমন বিশ্বপ্রকৃতি, তেমনি মানবপ্রকৃতি। এ-দুয়ের যোগসম্পর্ক এতই নিবিড় যে, একটায় যখন আস্থা হারাই, তখন অন্যটাতেও আস্থা থাকে না।’’ আর, হয়তো সেই কারণেই তাঁর কবিতার বইয়ের নাম দেন ‘নীরক্ত করবী’, ‘উলঙ্গ রাজা’ কিংবা ‘অন্ধকার বারান্দা’। ‘‘কোনও কোনও ঘটনায় ক্রুদ্ধ না হলে লিখতেই পারি না’’ এমন সহজ স্বীকারোক্তি কিংবা ‘‘আর না, মানুষ আর না’’ কথনের পরেও সাবলীল, ‘‘ওটা আসলে অভিমানের কথা। মানুষকে বড় ভালবাসি।’’এ কেবলই কথার কথা নয়। যে কোনও রকম প্রশ্নের কাছে তিনি কখনওই জ্ঞানীর দূরত্ব রাখেননি, বন্ধুর আন্তরিকতায় পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেছেন, জানার অহমিকা নিয়ে নয়, জানানোর আনন্দ নিয়ে। মানুষের প্রতি ভালবাসাই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে মানুষের কাছে। এবং ক্রমশ এরই কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্য এক প্রতিষ্ঠানস্বরূপ। নীল নির্জন থেকে শুরু হওয়া কবি, আনন্দমেলা-র যুগান্তকারী সম্পাদক, বাংলা ভাষার নীতি-নির্ধারক, গদ্যকার, শিক্ষিত বাঙালির শৈশবে হুল্লোড় তুলে দেওয়া টিনটিন অনুবাদক, জনপ্রিয় এই বহুমুখী লিখন প্রতিভাকে দেখতে হলে, তাঁর সময়কে খানিকটা পাশে রেখে হেঁটে আসা যেতে পারে।



রবীন্দ্রনাথের প্রভা ও প্রভাব থেকে তখনও বাংলা ভাষার কবিকুল পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেননি। অনেকেই তোড়জোড় শুরু করেছেন রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত হতে, কিন্তু সফল হচ্ছেন না! ক্রমে ঘরে বাইরে বহুমাত্রিক সঙ্কট, আর সেই সঙ্কটের বাতাবরণেই যেন জন্ম হল ত্রিশ-পরবর্তী কবিকুলের। নীরেন্দ্রনাথেরও। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা তাঁর সময়কে নিখুঁত ভাবে হাজির করে আশাবাদের কথা বলে। তাঁর অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চায়। তাঁর কবিতার বালক রাজাকে দেখে উলঙ্গ বলে ডেকে ওঠে। তাঁর কবিতায় পরাজয় নেই। তাঁর কলমে বিদ্রোহ বা বিপ্লবের জন্য প্রত্যক্ষ হুঙ্কার হয়তো ছিল না, কিন্তু ছিল মানুষ, সমাজ ও দেশের জন্য অপরিসীম ভালবাসা। কবিতার জন্য নীরেন্দ্রনাথ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। দীর্ঘ, সক্রিয় ও গতিশীল একটি জীবন তিনি যাপন করেছেন। পঁচানববই বছরের পথপরিক্রমায় কবিতার সঙ্গে কোনো দিনই বিচ্ছেদ রচিত হয়নি তাঁর। আর কবিতার বাইরে যা-কিছু লিখেছেন, সেখানে কবি নীরেন্দ্রনাথের আধিপত্যই নানা মাত্রায় উদ্ভাসিত। তাঁর গদ্য আক্ষরিক অর্থেই আপাদমস্তক একজন কবির গদ্য। গদ্যের সভায় তিনি কখনো আগন্তুক ছিলেন না, তাঁর পদচারণা রাজাধিরাজের মতো। আর এতেই যৌবন পেরনোর আগেই হয়ে উঠলেন খ্যাতিমান, জনপ্রিয়, সাহিত্যের প্রিয় জন। একেবারে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, চার পাশের দেখা-জানা জগৎ, কথা বা কাহিনিতে মানুষকে জড়িয়েই তাঁর কবিতা। অনেকটাই গল্পের প্রকৃতিতে রচিত ‘বাতাসী’, ‘হ্যালো দমদম’, ‘কলকাতার যিশু’, ‘জঙ্গলে এক উন্মাদিনী’, ‘স্বপ্নে দেখা ঘর-দুয়ার’ বা ‘কলঘরে চিলের কান্না’-র মতো অজস্র কবিতা মানুষের মুখে মুখে ফিরে সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে আজ ইতিহাস করে দিয়েছে। নিজের কবিতা-আদর্শ বিষয়ে তিনি বহু জায়গায় স্পষ্ট ভাবে বলেছেন। সাহিত্য অকাদেমি আয়োজিত তরুণ কবিদের ‘পারস্পরিক বিনিময়’ শীর্ষক এক রুদ্ধদ্বার কবিতা পাঠ অনুষ্ঠানে তিনি বলছেন, “আমি নিজে গালাগাল খেয়েছি অনেক, যখন কবিতার মধ্যে গল্প ঢোকাবার চেষ্টা করেছি। আমার ধারণা ঢোকানো যায়। গল্প সেই অর্থে গল্প না, একটা গল্পের ছায়া কবিতায় পড়তেই পারে। আমাকে বলা হয়েছিল এটা ঠিক তো কবিতা হচ্ছে না। এটা ঠিক কবিতা হল কি? কবিতা কি এইসব সহ্য করে? কবিতা কি সহ্য করে আর না করে ফতোয়াটা কে দেবে? আমার ধারণা কবিতাকে দিয়ে সব রকমের কাজ করানো যায়, সব রকমের।” এই সব কাজের জন্যে প্রথম কাব্যগ্রন্থ নীল নির্জন-এর যে আখ্যানহীন নির্যাস, যার ভরকেন্দ্র মূলত প্রকৃতি নির্ভরতা, তা থেকে ক্রমশ সরে গিয়ে সচেতন সহজ বোধ্যতার দিকে চলে যাচ্ছেন। পৃথিবী যে পুষ্পশয্যা নয় এ-কথা সমস্ত সংবেদনশীল মানুষই অনুভব করেন। এই অনুভব ও উপলব্ধির তারগুলো সবার ক্ষেত্রে সমান তালে বাজে না বলেই বিচিত্র সংগীতের জন্ম অনিবার্য হয়ে ওঠে। ‘ধ্বংসের আগে’ শীর্ষক কবিতাটিতে ব্যর্থতার দীর্ঘ ফিরিস্তি দিয়েছেন কবি, ‘ব্যর্থবীর্য শয়তানের আবির্ভাব’ মেনে নিয়েছেন, ‘পাতালের সর্বনাশা অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলে’ কবি দৃঢ়হাতে যবনিকা টেনে দেওয়ার কথা বলেছেন, বিষাদ বেদনার দৃঢ় পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘ঢালো গ্লানি, ঢালো মৃত্যু, শিল্পীর বেহালা ভেঙে ফেলে/ অন্ধকার রঙ্গমঞ্চে অট্টহাসি দু’হাতে ছড়াও। তবু কবির পথচলা, মানুষের জন্য কথা বলা কখনো থামবে না।



তুমি জানো কিনা জানিনা শিক্ষাজীবন শেষ করে নীরেন্দ্র্রনাথ শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতার কাজ। ‘প্রত্যহ’, ‘মাতৃভূমি’, ‘অ্যাডভান্স’, ‘ভারত’, ‘কিশোর’, ‘সত্যযুগ’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় কাজের পর ১৯৫১-তে আনন্দবাজার সংস্থায় যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নীরেন্দ্রনাথকে দেখা গেল তুখড় সাংবাদিক হিসেবেই। আড্ডা-আলাপে বৈঠকি বাঙালির রসবোধে টইটম্বুর, সভায়-সমাবেশে স্পষ্টবাদী, দৃঢ়চেতা। ক্রিকেট ও ফুটবল-পাগল মানুষটি যৌবনে খেলার মাঠে যতখানি ক্ষিপ্র, ঠিক ততখানিই তাঁর ক্ষিপ্রতা, যখন তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকার সম্পাদক। কঠিন সম্পাদক কিংবা কোমল মানুষ ছাড়াও কবিতার জন্য নীরেন্দ্রনাথ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। দীর্ঘ, সক্রিয় ও গতিশীল একটি জীবন তিনি যাপন করেছেন। পঁচানববই বছরের পথপরিক্রমায় কবিতার সঙ্গে কোনো দিনই বিচ্ছেদ রচিত হয়নি তাঁর। আর কবিতার বাইরে যা-কিছু লিখেছেন, সেখানে কবি নীরেন্দ্রনাথের আধিপত্যই নানা মাত্রায় উদ্ভাসিত। তাঁর গদ্য আক্ষরিক অর্থেই আপাদমস্তক একজন কবির গদ্য। গদ্যের সভায় তিনি কখনো আগন্তুক ছিলেন না, তাঁর পদচারণা রাজাধিরাজের মতো। নীরেন্দ্রনাথের কাছে বাংলা কবিতার মানুষ নন, বাংলাভাষার প্রত্যেকেই চিরকাল ঋণী থাকবেন হয়তো। বাংলা ভাষার বানানরীতি ও সাধারণ-মান্য ব্যাকরণের ভাবনায় তিনি আজীবন কাজ করে গিয়েছেন। ‘বাংলা কী লিখবেন, কেন লিখবেন’ কিংবা সম্পাদক ও লেখকদের জন্য একটি অভিধান রচনা ও সঙ্কলন তার সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর ‘কবিতার ক্লাস’ বা ‘কবিতার কী ও কেন’ বই দু’টিও কবিতার অনুরাগীর কাছে মূল্যবান। বাংলা ও ইংরেজি, দুই ভাষায় তাঁর ব্যুৎপত্তি সর্বজনবিদিত। অনুবাদের ক্ষমতা ছিল আশ্চর্য, বিশেষ করে ছোটদের জন্য অনুবাদের বেলায় তাঁর সৃষ্টিপ্রতিভার বিকাশ আজও অবাক করে দেয়। তাঁর কর্মজীবন আমাদের জানায় যে, বেহিসেবি, অলস, আপনভোলা, উদাসীন জাতীয় নানা অভিধায় কবিকুল চির দিন চিহ্নিত হলেও, সে অভিধাই শেষ কথা নয়।



সরস সুমধুর পরিশীলিত ব্যক্ত্বিত্বের অধিকারী নীরেন্দ্রনাথ বন্ধ ঘরের মানুষ নন, এই প্রবণতাটি যেন প্রথম থেকেই স্থির নির্দিষ্ট। সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে কবির একাকী নির্জন পথ তাঁর নয়, তিনি বিশ্ব নিখিলের বিরাট আয়োজনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে চেয়েছেন। মোহনবাগান-এর গোঁড়া ভক্ত নীরেন্দ্রনাথ তাসের (ব্রিজ) নেশায় ছিলেন মশগুল। আবার, এই সমুদ্রভক্ত মানুষটি বাংলা কবিতার প্রতিনিধিত্ব করতে বহু বার পাড়ি দিয়েছেন বিদেশে, ভারত উৎসবে। হয়তো সে কারণেই ক্রমশ তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রতিষ্ঠান-প্রতিম। অন্নদাশঙ্কর রায়ের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতির পদে তাই তাঁকেই দেখলাম আমরা। দেখলাম সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় মানুষ তাঁকে বার বার টানছেন। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (’৭৪), আনন্দ পুরস্কার (’৭৬), শরৎস্মৃতি পুরস্কার (’৯৬), প্রভৃতি অজস্র সম্মানে বাংলা ও বাঙালি তাঁকে ভূষিত করেছে তাঁর নানাবিধ সাহিত্যকীর্তির জন্য। পেয়েছেন ‘বঙ্গবিভূষণ’। নীরেন্দ্রনাথের নিজের ভিতরে এক ভিন্ন খোঁজও ছিল। তিনি বেঁচে থাকবেন, বাংলা কবিতার মানুষ যত দিন বাঁচবে। কেননা, তিনিই তো বলেছেন তাঁদের, ‘ঈশ্বর! ঈশ্বর’ শীর্ষক কবিতায়, ‘ঈশ্বরের সঙ্গে আমি বিবাদ করিনি।/ তবুও ঈশ্বর/ হঠাৎ আমাকে ছেড়ে কোথায় গেলেন?/ অন্ধকার ঘর।/ আমি সেই ঘরের জানলায়/ মুখ রেখে/ দেখতে পাই, সমস্ত আকাশে লাল আভা,/ নিঃসঙ্গ পথিক দূর দিগন্তের দিকে চলেছেন’।



আরো অনেক কথা লেখা যায়। কিন্তু চিঠিটা আর দীর্ঘ করতে চাইছি না। তোমার কথা বলো খিচুড়ির সাথে অবশেষে কি নিয়েছিলে। আমি ভুল না হলে নিশ্চয়ই মাংস কষাই ছিল। উত্তরবঙ্গে এখন আর আগের মতন লাগাতার সাতদিন বৃষ্টি হয়না। কংক্রিটের শহরে বৃষ্টির শব্দও আর আগের মতন শোনা যায় না, আমাদের গেছে যে দিন সে কি তবে একেবারই গেছে? নিরন্তর ভালো থেকো।



শুভেচ্ছা ও শুভকামনা সহ

বাসু

১৬ আগষ্ট, ২০২৫ । সন্ধ্যা



পুনশ্চ: এবার পূজা বিশ্বের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম বেনারসে কাটাবো। বর্ষায় বেনারসের ঘাটের সৌন্দর্য আলাদা। পরের চিঠিটা তোমাকে সেখান থেকেই লিখব।

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















১৪

ইনেস তাঁর বন্ধু গের্টকে নিয়েও বিশেষ চিন্তিত। গের্ট অবশেষে আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়বার ব্যাপারে মনস্থির করেছে। আগামী হেমন্ত থেকেই ক্লাস শুরু হবে। সে হিসেব করে দেখেছে যে পাশ করে বেরতে আরও তিন বছর লাগবে; কারণ কিছু সেমিস্টারের ক্লাস সে এর মধ্যেই করা হয়ে গিয়েছে তাঁর। গের্ট এই বিষয়ে ইনেসের সঙ্গে বেশ গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে আলোচনা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে নেওয়া সরু, হলদে সিলেবাসের বইটা নিজের পকেট থেকে বের করে যে যে ক্লাসের লেকচারগুলো শুনতে সে ইচ্ছুক, সেগুলোর পাশে একটা সোনালি রঙের পেন্সিল দিয়ে দাগ টানে।

ইনেস গের্টের পরিকল্পনা মনোযোগ দিয়ে শোনে। মনে মনে আগামী শীতের সময়টা কল্পনা করে সে। ফ্লকের সঙ্গে সে মাঝে মাঝে গের্টের এপার্টমেন্টে যাবে দেখা করতে। তবে খুব ঘনঘন যাবে না, কারণ গের্ট কাজে এবং পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকবে। বের্নহার্ডের সুন্দর পোর্ট্রেটের পেন্সিল স্কেচগুলোর বদলে কালো রঙের কলেজ খাতায় আর ‘করপাস ইউরিস সিভিলিস’ এর অনেক খণ্ডে ভরে থাকবে গের্টের টেবিল। একজন উকিলের ঘরে আর কী কী থাকতে পারে, সেই বিষয়ে ইনেসের পরিষ্কার ধারণা নেই। ফলে সে আর বেশি কল্পনা করতে পারে না; তবে তাঁর মনে হতে থাকে যে গের্টের চেহারা ক্রমেই একঘেয়ে ক্লান্ত, বিরক্ত ধরনের হয়ে যাবে এবং সে সবসময় তিরিক্ষি মেজাজে থাকবে।



কিন্তু তাঁর অন্যান্য বন্ধুরা? ফার্দিনান্দ আর বের্নহার্ড চলে যাবার পর থেকে সন্ধের আড্ডাগুলোর সেরকম কোনো আকর্ষণ আর নেই। হতে পারে যে তুমি আইনের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব করলে… ভবিষ্যতের উকিল অথবা বিচারক কিম্বা কৌঁসুলি যারা। এরা খুব গুরুগম্ভীর প্রকৃতির, সব সময় নিজের মর্যাদা বিষয়ে অত্যধিক সচেতন। তরুণ সঙ্গীতশিক্ষার্থীরা এমন নয়, উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে সবসময় সব ব্যাপারে চরম মতামত পোষণ করে না তারা। তবে গের্টকে ভবিষ্যতে স্থির করতে হবে যে সে হিটলারের পক্ষে না বিপক্ষে…

-‘গের্ট!’ ইনেস শুরু করে, … ‘তুমি কি হিটলারপন্থী?’

-‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?’

-‘না, এমনিই… জিজ্ঞেস করলাম আর কি!’

ইনেসের হঠাৎ গের্টকে আইনের ক্লাসের ছাত্র হিসেবে কল্পনা করে হাসি পায়। সাধারণত ছাত্র মানেই মানুষ তাদের স্নেহের চোখে দেখে। কিন্তু গের্ট ছাত্র হিসেবে নিঃসন্দেহে হাস্যকর… একটা অসম্ভব কাণ্ড ঘটতে চলেছে বলে মনে হয় ইনেসের। কারণ গের্ট খুবই সংবেদনশীল এবং সহজেই মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর। তাছাড়া যে কাজটা তাঁর পছন্দ হয় না, সেটা শেষ করা তো দূর, সে কিছুতেই বেশিক্ষণ টেনে নিয়ে যেতে পারে না। গের্ট নিজেও হয়তো নিশ্চিতভাবে এখনো বুঝতে পারছে না যে ভবিষ্যতে সে কী ভাবে ব্যাপারটা সামলাবে। তবে সে সমাজে ‘একজন’ হয়ে উঠতে চায়। সেটাই এই মুহূর্তে তাঁর একমাত্র ইচ্ছা। ‘একজন’ হয়ে ওঠা মানে সমাজে একটা ভাল জায়গা, একটা ভাল ডিগ্রি, উপাধি ইত্যাদি।



গের্ট এখনো অনিশ্চয়তায় ভুগছে। তবে নিজের সম্বন্ধে যথেষ্ট গর্ববোধ আছে তাঁর এবং এই বোধটাই তাঁর দুর্বলতা হয়ে উঠছে। কারণ সেটাই বদলে যাবার পথে তাঁকে ভিতরে ভিতরে বাধা দিচ্ছে। এই বিরক্তিকর এবং একঘেয়ে পরিস্থিতি থেকে বেরতে পারছে না সে। তাঁর দ্বিধা এখনো কাটেনি এবং সে বিষণ্ণ তিক্ত মেজাজে সিলেবাসের হলুদ বইটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।

ইনেস শান্তভাবে তাঁকে নিরীক্ষণ করে। তাঁর সুন্দর মুখমণ্ডলের রেখাগুলি, তামাটে হয়ে পুড়ে যাওয়া কপালের অর্ধেকটা কালো চুলের গুচ্ছে ঢাকা। তাঁর চোখদুটো গাঢ় রঙের, তীব্র এবং অস্থির। ঠোঁট এবং চোয়াল ক্রুদ্ধ, কঠিন, মাঝে মধ্যে সে মুখটা অল্প খুলছে যেন এখনই কোনও খেদ, অভিযোগ কিম্বা প্রতিবাদী সমালোচনার শব্দ বেরিয়ে আসবে।

কিন্তু গের্ট কখনই অভিযোগ করে না। তাঁর গর্ববোধ তাঁকে সেটা করতে বাধা দেয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে যখন সে অনেক কথা একসঙ্গে বলতে থাকে, সেসব কথাবার্তা উদ্ধত এবং বিদ্বেষপূর্ণ। যদি কোনও কারণে সে আহত হয়, তখন অবুঝের মত অনেক কথা আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে বলে দেয়। অনেক মানুষ এই কারণে গের্টকে একেবারেই পছন্দ করে না। তাঁকে উগ্র এবং বিশ্বাসের অযোগ্য বলে মনে করে। অনেকেই ইনেসকে সতর্ক করে গের্টের সঙ্গে মিশবার কারণে। আবার অনেকে অবাক হয় ইনেসের সাহসের কথা চিন্তা করে, কারণ সাধারণভাবে মানুষ মনে করে যে গের্টের মত ব্যক্তির কাছাকাছি থাকতে হলে অনেক সাহসের প্রয়োজন। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর। কারণ ইনেস গের্টের থেকে অনেক বেশি সপ্রতিভ এবং মানসিক শক্তির অধিকারিণী। তাছাড়া সে বের্নহার্ড এবং অন্যান্য বন্ধুদের যেভাবে সবসময় সাধ্যমত সাহায্য করতে প্রস্তুত, সেভাবেই সে গের্টকেও সাহায্য করে থাকে।

তবে এইমুহূর্তে গের্টের জন্য ইনেসের বেশ চিন্তা হচ্ছে। এতদিন গের্ট ভবিষ্যতে কী করতে চায়, সে বিষয়ে ইনেস একেবারেই মাথা ঘামায়নি। কারণ গের্ট সপ্রতিভ উজ্জ্বল তরুণ, যদিও বিশেষ উচ্চাশা নেই জীবনে। এদিকে আবার গর্ববোধ আছে যথেষ্ট পরিমাণে। জীবনে কিছু একটা করতে চায় সে সাফল্যের সঙ্গে, নিজের কাজের জন্য একটা স্বীকৃতিলাভ করতে চায় সে। কিন্তু সম্প্রতি সে সব ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে গিয়েছিল। নিজের ঘরে সিগারেট খেতে খেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কখনো একা বসে থাকছিল, আবার কখনও বন্ধুদের সঙ্গে এখানে সেখানে মাতাল হয়ে বেড়াচ্ছিল; এতকিছু করে কোনও উপকার অবশ্য হয়নি। এসব কাণ্ড ঘটিয়ে সে আবার লজ্জিত হয়ে শাস্তি পাওয়া স্কুলের ছাত্রের মত মুখ নিচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এদিক সেদিক। সবকিছুই ইনেসের কানে এসেছিল। ইনেস তাঁকে একসঙ্গে ঘুরতে কিম্বা হাঁটতে যাবার কথা বলেছিল; সে একেবারেই রাজি হয়নি এবং হাজারটা বাহানা দেখিয়েছিল। ইনেসের যে একটু খারাপ লাগেনি তা নয়, তবে সে মাঝে মাঝেই ফোন করে গের্টের খবরাখবর নিত। কারণ তার মনে হয়েছিল যে এসব বদমায়েশি আর ছেলেমানুষি কাণ্ড ঘটিয়ে গের্ট হয়তো তার সঙ্গে দেখা করতে লজ্জা পাচ্ছে। এর মধ্যে একদিন হঠাৎ গের্ট নিজে থেকেই ইনেসকে ফোন করে দেখা করতে চায়; বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা করতে, কারণ সে নাকি বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছে ইনেসকে একটা জরুরি কথা বলবার জন্য। এখন সে বলছে যে সে এখন সত্যিই ভালভাবে পড়াশুনা শুরু করতে চায়।

… ‘গের্ট, আসলে তুমি ঠিক কোন কারণে পড়াশুনা শুরু করতে চাও?’

-‘আমার বাবা মা সেটাই চান।’

-‘সেটা কি তুমি এতদিন জানতে না? জানা সত্ত্বেও তুমি সেই ব্যাপারে কোনও গুরুত্ব দাওনি।’

-‘কারণ আমি বিশ্বাস করতাম যে আমি ভাল আঁকতে পারি। আমি একজন শিল্পী।’

-‘কবে থেকে তোমার বিশ্বাসে চিড় ধরল?’

-‘বের্নহার্ড চলে যাবার পর থেকে।’

-‘তুমি এখন আর ছবি আঁকতে ভালবাস না?’

গের্ট যন্ত্রণাকাতর মুখে তাকায় ইনেসের দিকে… ‘তুমি তো সবই জানো।’ বলে সে… ‘কেন শুধুশুধু এই প্রশ্ন করছ?’ মুখটা অন্যদিকে ফেরায় সে… ‘আমি ভেবেছিলাম আমি আঁকতে পারব। কিন্তু আমি শুধু বের্নহার্ডকেই আঁকতে পারতাম। সে ছাড়া আর কাউকে, আর কোনওকিছু আমি আঁকতে পারি না। সে চলে যাবার পর আমি একটা রেখাও টানতে পারিনি কাগজে। আমার কোনও প্রতিভা নেই, ইনেস। ছবি আঁকতে নয়, আমি বের্নহার্ডকে ভালবাসি।’


অবশেষে গের্ট মুখ খুলেছে। আবেগমথিত খেদ আর অভিযোগের বন্যা বেরিয়ে আসছে এখন তার খোলা মুখ দিয়ে।

ইনেস স্তব্ধ হয়ে যায়। বিষণ্ণভাবে একদৃষ্টে গের্টের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। যদিও এই বিষণ্ণতা চট করে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না। মানুষের মনে হবে যে ইনেসের মুখমণ্ডলে অদ্ভুত প্রশান্তি বিরাজ করছে।

‘তুমি যদি পাশ করে উকিল হয়ে বেরোও, তাহলে কি তুমি আর বের্নহার্ডকে ভালবাসবে না?’ বলে ওঠে ইনেস, ‘তুমি কি তখন বদলে যাবে?’



(চলবে)
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২২.২

বাদাম তো পাওয়া গেল না, তবে শনিচরের দেখা পাওয়া গেল এক নাপিতের দোকানে । চিকিৎসা
বিজ্ঞানের ভুবনে কোন প্রাকৃতিক চিকিৎসা বা নেচারোপ্যাথির যতটুকু সম্মান , চুলকাটার সেলুনের
দুনিয়ায় এই দোকানের ইজ্জত ঠিক ততটাই। মানে, দোকান কোথাও নেই আবার সর্বত্র আছে। ময়লা
ছড়ানো কাঁচা রাস্তার ধারে একটি নিমগাছ। তার নীচে চটের বস্তা বিছিয়ে বসে আছে নাপিতভায়া। তার
সামনে একটা ইঁট পাতা রয়েছে। সেই ইঁটের উপর শনিচর—না বসে, না দাঁড়িয়ে, কেবল আছে বলা যায়।
নাপিত পেছনের দিকের চুলে মেশিন চালাচ্ছিল। মাথার দু’পাশের ঝোপঝাড় কাটা হয়ে গেছে। সামনের
দিকে কিছু চুল এমন কায়দায় ছেড়ে দেয়া যে দূর থেকে গোল টুপির মত দেখাবে। সংক্ষেপে
বললে—শনিচর বিলিতি ছাঁটে চুল কাটতে বলেছে।
ও রঙ্গনাথের ডাক শুনতে পেল এবং নাপিতের পোক্ত হাত এবং মেশিনের চাপ উপেক্ষা করে ঘাড়
ঘোরাল। চোখের কোণা দিয়ে দেখে বলল—শিবপালগঞ্জের সব নাপিত কোথাও অশৌচের হাজামত করতে গেছে। তাই ভাবলাম, এবার এখানেই চুল কাটিয়ে দেখি।
বলার ভঙ্গী এমন যেন শনিচর প্রতি চারদিনে চুল কাটায়! তবে আসল কথাটা হল--- এটা রঙ্গনাথও
জেনে গেছে--- চুল কাটানোর ব্যাপারে শনিচরের খেয়াল একটু অদ্ভূত। অর্থাৎ সারা বছর না নিজে চুলে
হাত দেয়, না কাউকে ছুঁতে দেয়। হঠাৎ কোনদিন মুড হলে কোথাও ইঁট পেতে চুল কাটাতে বসে যায়।
এইরকম চুল কাটানোর চিন্তার দার্শনিক ভিত্তি কি-সেটা রঙ্গনাথ ভেবে পেল না। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে
রইল।

নাপিত যেই দেখল রঙ্গনাথ দাঁড়িয়ে পড়েছে অমনই চুল কাটা বন্ধ করে দু’আঙুলে শনিচরের মাথায় ঠেলা
মেরে বলল—উঠে পড়, তোমার হয়ে গেছে।
শোনামাত্র শনিচর উঠে ইঁটে পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর জেব হাতড়ে একটা দোয়ানি নাপিতের হাতে দিল। আর নাপিত সেটা না দেখেই ‘অচল’ বলে ফেরত দিল। শনিচর কোন কথা না বলে সেটি ট্যাঁকে গুঁজে আর একটি দোয়ানি নাপিতকে দিল এবং রঙ্গনাথকে চোখ মেরে ইশারা করল –এতক্ষণ নাপিতের সাথে মশকরা করছিল।

এরপর যেন কোন সেনাপতি যুদ্ধ জিতে শত্রুর রক্তে মাখামাখি হয়ে গর্বের সঙ্গে ফিরে এলেন –এমনই
ভঙ্গীতে সারা গায়ে গোছা গোছা কাটা চুল নিয়ে বীরদর্পে রঙ্গনাথের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। রঙ্গনাথ
তৎক্ষণাৎ তিন হাত পিছে সরে গেল। শনিচর রঙ্গনাথকে এই গ্রামে আসার কারণ জিজ্ঞেস করায় ও
বাদাম-খোঁজার গল্পটা শুনিয়ে দিল।
শনিচর বিজ্ঞের মত রায় দিল।
“শিবপালগঞ্জের যত বেনে-মহাজন-শেঠজির দল , সবকটা একেবারে যা খুশি তাই করে খাচ্ছে। দোকানে
দু’ছটাক বাদামও রাখতে পারে না”? ফের দেশের খাদ্যসংকটে যেমন দিল্লির থেকে বার বার সব ঠিক
হয়ে যাবে গোছের আশ্বাসবাণী শোনা যায় ঠিক তেমনই ঢঙে বলল, “ তবে চিন্তা কোর না, সব ঠিক হয়ে
যাবে”।
রঙ্গনাথ এবার শনিচরের কথাবার্তায় এক নবীন আত্মবিশ্বাসের ঝলক দেখতে পেল যা পিছিয়ে পড়া
দেশের উন্নয়নের জন্য খুব জরুরি। ভাবল, আহা এমন লোকের জায়গা তো প্ল্যানিং কমিশনে হওয়া
উচিত। ততক্ষণে শনিচরের কথাবার্তা আরও দু’চার মিনিট এগিয়ে গেছে। ও বলছিল, “বাবু রঙ্গনাথ,
শিবপালগঞ্জ এবার শুধরে যাবেই। এমন যা ইচ্ছে তাই করা চলবে না”। রঙ্গনাথ ভাবল—কথাবার্তা
বুঝি এখনও দোকানে বাদামের অভাবের সমস্যাতেই আটকে রয়েছে আর শনিচর বোধহয় বিষয়টা
অনর্থক টেনে লম্বা করছে। কিন্তু আরও খানিকটা শোনার পর বুঝল যে এসব কথার বাদামের

অমস্যার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। এ সব হল কথার কথা, যে ধরণের কথা আমরা সবাই কিছু না ভেবে

শুধু বলার জন্যেই বলি।
“--- বাবু রঙ্গনাথ, ভেবেছটা কি? এই শিবপালগঞ্জ-- সেই যে কী যেন বলে—ও হ্যাঁ, এ হল পুরো একটা
অ্যাটম বোম। যতক্ষণ ফাটেনি, ততক্ষণ ফাটেনি, শুধু সিলির-সিলির করতে থাকে। কিন্তু যখন ধড়াম
করে ফাটে তখন টের পাওয়া যায় যে মামলা ঠান্ডা নাকি গরম”।
তারপর একটা পুরনো প্রবাদ আউড়ে নিল—“ঘোড়ার লাথি শুধু ঘোড়াই সইতে পারে”।
আজ শনিচরের অবস্থা একটু অদ্ভূত লাগছে। বারবার হাত মুঠো করছে আর মুখ দিয়ে শব্দ করে হাওয়া
টানছে। কখনও জোরে জোরে হাঁটছে, যেন এক্ষুণি ঘোড়ার লাথি খেয়েছে , কিন্তু সইতে পারে নি। আবার
কখনও কথা বলতে বলতে মুখ দিয়ে এমন ফেনা তুলছে যা কান অব্দি ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আজ ও চুল কাটিয়েছে। রঙ্গনাথ সব খেয়াল করেছে, কিন্তু ব্যাপারটা কী বুঝতে পারছে না।

এবার ওরা একটা বড়সড় আমগাছের নীচের থেকে এগিয়ে গেল। একটা চিল জোরে ডাক ছেড়ে উড়ে গেল।

শনিচর বিরক্তিভরে বলল—“এই সালীও খামোখা চিঁ চিঁ করছে”। এক দমে আর একটা খবর ছাড়ল-
“রামাধীন ব্যাটা এবার নিজে আখড়ায় নামছে”।
দুটো উক্তির সম্বন্ধ বুঝতে অপারগ রঙ্গনাথ জিজ্ঞেস করল—“কোন আখড়ায়”?

শনিচর এমন সহজ প্রশ্ন শুনে তাজ্জব, উত্তর দিল না। বরং গায়ের থেকে কাটা চুল ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে
দিতে দিতে বলল, “ হবে, এরও ওষুধ আছে। দেখতে থাকো। অ্যাটম বোম ফেটে যাক”।

আমবাগান ফুরিয়ে গেল। এবার ওরা সেই জায়গাটায় এসেছে যেখান থেকে কাশবন শুরু। পাকদণ্ডী
রাস্তায় রঙ্গনাথ সামনে চলেছে যাতে শনিচরের কাটা চুল হাওয়ায় উড়ে ওর দিকে না আসে।
আচমকা ও থেমে গেল।

কাশবনের ডালপালায় এক আশ্চর্য দৃশ্য! পথের দু’পাশে প্রায় একশ গজ জুড়ে কাশের ডগায় গিঁট বাঁধা,
যেন কাঠপুতলি নাচের স্টেজ জুড়ে সারি সারি কাঠপুতলি সেপাই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে। একটা লোক
আরও নতুন নতুন গিঁট লাগাতে ব্যস্ত।
শনিচর ষাঁড়ের মত হাম্বারবে বলল—“আবে ও খডুস? এটা কি হচ্ছে”? তারপর রঙ্গনাথকে বলল,
“দেখছ এই গোঁয়ারগোবিন্দগু বেয়াড়াগুলোকে? গোটা জঙ্গল নষ্ট করে দিল। কে জানে কোন উল্লুক এই
গিঁট লাগিয়েছে”!
রঙ্গনাথ চমকে উঠে শনিচরকে ভাল করে দেখল। আজ যেন গালির ফোয়ারা একটু বেশি ছুটছে। বলল,
“এই গিঁট লাগানোয় কারও কোন ক্ষতি তো হচ্ছে না”?
“হচ্ছে না মানে? জেনে রাখ, এই জমি শিবপালগঞ্জ গ্রামসভার। বুঝলে বাবু রঙ্গনাথ”? বীরদর্পে এই
ঘোষণা করে ও গিঁট বাঁধতে থাকা লোকটাকে গালি দেবার উদ্দেশ্যে উটের মত ঘাড় উঁচু করল, আর ওই
ব্যাটা নারীদেহের কোন অঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসেছে তার বর্ণনা দিয়ে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,”কাশের
গোছা তোমার বাপের”?
লোকটা পালটা জবাব দিল, “না তো কি তোমার বাপের”? ঝগড়া থামাতে রঙ্গনাথ মাঝখানে দাঁড়িয়ে
বলল—গালিগালাজ বন্ধ কর, ভাই”। ফের ঠান্ডা নরম স্বরে লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এটা কী
করছ”?
“যা গোটা দুনিয়া করছে, আমিও তাই করছি”, ও ঘাড় গোঁজ করে কড়া মেজাজে জবাব দিল-- যেন ও
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মৌলিক কাজটি করছে।
শনিচর বলল,”এটা জানা আছে কি যে জায়গাটা শিবপালগঞ্জের গ্রাম-সভার গায়ে লাগা, আর গিঁট বাঁধলে
কাশের বেড়ে ওঠা অসম্ভব হবে? কোন খবরও রাখ না। চালান হয়ে গেলে পালিয়ে বেড়াবে। তখন তোমার
এই ‘গোটা দুনিয়া’ কোন কাজে আসবে না”।
--“কোন সালা আমার চালান করবে”?
--“চালান তোমার সালা নয়, বোনাই করবে! আমি! চোখ খুলে তাকিয়ে দেখ, তোমার সামনে দাঁড়িয়ে
আছি—মাত্র পাঁচহাত দূরে”।
রঙ্গনাথের দিকে তাকিয়ে নিজের কথাটা আরও স্পষ্ট করল, “হ্যাঁ, রঙ্গনাথ বাবু এই আমি! আজই
যাচ্ছি প্রধান হওয়ার কাগজ জমা করতে। আর পনের দিন, ব্যস্‌। তারপর দেখে নিও রামাধীনের বুকে
চেপে বসে এখানে আসব। তারপর দেখব—কোন সালা আমার গ্রামসভার একগাছিও এদিক ওদিক করে”!

ও হো! তাহলে এই হল ব্যাপার। তাই ইংরেজ-ছাঁটে চুলকাটা হচ্ছে আর গাছের উপর বসা চিলের ডাকে
রাগ চড়ছে! অ্যাটম বোম ফাটবে! তাই গ্রামসভার জঙ্গল নিয়ে এতসব হুকুম জারি!
এবার গোটা ব্যাপারটা রঙ্গনাথের মাথায় ঢুকল। “নমিনেশন পেপার আজকেই জমা দেবে”?
“এখুনি! এই মুহুর্তে”! কাগজ আগে জমা করব, চান-টান পরে”। শনিচরের আবেগ তুঙ্গে। ও কাশের গিঁট
বাঁধতে থাকা লোকটার উপর হালকা নজর বুলিয়ে দেখতে চাইল এই ঘোষণার প্রভাব কতটুকু পড়েছে।
কিন্তু ফলাফল স্পষ্ট। শনিচরের উত্তেজনার প্রভাব শনিচরের মধ্যেই আটকে রয়েছে,--যেমন
আমাদের দেশের এশিয়া ও আফ্রিকার নেতা হওয়ার দাবি। ওই লোকটি ঠান্ডা মাথায় ধীর স্বরে বলতে
লাগল—ঠিক আছে, তুমিই না হয় গ্রামসভার প্রধান হলে। কাউকে না কাউকে তো হতেই হয়”। তারপর
তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “এইসব গ্রাম-পঞ্চায়েতও আসলে কি? একরকম সরকারি তামাশা”।
শনিচরের মনে হল ওকে অপমান করা হয়েছে। বলল, “বেশ, তামাশাই বটে। তবে পনের দিন পরে দেখে
নিও—কাশের একটা ডগা ছুঁলেও কী হতে পারে”।
লোকটি বেশি পাত্তা না দিয়ে বলল, “যদি তাই হয় তাহলে ছোঁব না। এই গিঁটলাগানো পুজো তো
শিবপালগঞ্জ থেকেই শুরু হয়েছে, ওখানেই থেমে যাবে”।

রঙ্গনাথ দেখল লোকটির সামনে কয়েক ডজন গিঁট লাগানো কাশ। বলল, “এটা আবার কিসের পুজা”?

--“কী জানি কিসের! শুনেছি হনুমানজি ওখানে কারও স্বপ্নে এসেছিলেন। ওনার হুকুম মেনে সবাই গিঁট
লাগাচ্ছে”।
শনিচর ঘাবড়ে গিয়ে হাত জোড় করল।
“তাহলে খুশিমত গিঁট বাঁধো ভাই। ধরম- করম নিয়ে কোন কথা হবে না”। কথাটা বলার পর ও মস্তিষ্কে
যতটুকু ঘিলু ছিল তার উপযোগ করে ভাবতে লাগল এবং রঙ্গনাথকে বলল, “ কিন্তু বাবু রঙ্গনাথ, আমি
তো এরকম কিছু শুনিনি। কার স্বপ্নে হনুমান এসেছিলেন? যখন সকালে এসেছিলাম, কাশের বনে কোথাও কোন গিঁট দেখিনি তো”।
রঙ্গনাথ উবাচ—“আমি কিছু জানি না। তবে আমাকে মামা বলেছিলেন -ওদিকে যাচ্ছ যখন কাশের ডগায়
একটা গিঁট বেঁধে দিও। তো আমি একটা বেঁধেছিলাম। মামাজী বলেছিলেন –এটা হনুমানজীর গিঁট”।
শোনামাত্র শনিচরের উপর হনুমানজীর ভর হল। লেজহীন বাঁদরের মত লাফ মেরে ও কাশবনের একটা
উঁচু ডালের কাছে পৌঁছে গিঁট বাঁধতে লেগে গেল। বাঁধতে বাঁধতে বার কয়েক ‘জয় বজরঙ্গ’ বলে চেঁচালো,
রামাধীনের উদ্দেশে গোটা কয়েক গালি দিল, শেষে বলল “সচ্চে কা বোলবালা হ্যায়, দুশমন কা মুঁহ কালা
হ্যায়”।
সত্যেরই হয় জিত, শত্তুর হবে চিৎ!
রঙ্গনাথ জুড়ে দিল, “রাম-নাম সত্য হ্যায়, সত্য বোলো মুক্তি হ্যায়”।
ভাগ্যিস এটা শনিচর শোনে নি, তাহলে খেপে যেত। কারণ, এই শ্লোগান শবযাত্রায় দেয়া হয়। তবে
ধার্মিক মতে এটা তো খাঁটি কথা আর রামনামের সঙ্গে যুক্ত কোন ধ্বনি যে কোন উপলক্ষে যেকোন
পরিস্থিতিতে দেয়া যায়। শনিচর একটা গিঁট বেঁধে ফের হনুমানজীর নাম নিল আর নিজের
আন্ডারওয়ারের পেছনে লেজ না থাকা সত্ত্বেও হাত মুছে দ্রুতগতিতে কাজ করতে করতে এগিয়ে চলল।

রঙ্গনাথের মনে ধীরে ধীরে শান্তি এবং আত্মগৌরবের এক ছায়া ঘনিয়ে এল। কিছু না ভেবেই আজ ও
এক নব-সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করে ফেলেছে। এর দর্শন-পুরাণ-কর্মকাণ্ড সব মিলিয়ে
একটাই—কাশের ডগায় গিঁট বাঁধো।
ও নিজেকে বুদ্ধ, মহাবীর , শংকরাচার্যের সঙ্গে একসারিতে দেখতে পেল। তারপর নিজের মনে
নিজেকেই প্রশ্ন করল,”ওস্তাদ, আমাকে তো চেনা আছে। কিন্তু তোমার কথা বল। এক নবীন
সম্প্রদায় সৃষ্টির চিন্তা তোমার মাথায় এল কী করে”?

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in



















১০.
প্রান্তিক মানুষের মহাশ্বেতা দেবী




সুপরিচিতাসু বাসু,

নীরদ সি চৌধুরীকে প্রথম চিনেছিলাম আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ পড়ে। এই বইয়ে রবীন্দ্র-জীবনের নানা অনুজ্জ্বল দিক নিয়ে চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণ করলেও রবীন্দ্রনাথের বাইরে যে বাঙালির সংস্কৃতি খানিকটা অস্তিত্বহীন তা-ও উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, "বাঙলা ও বাঙালির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক জন্ম-নাড়ির সম্পর্ক। বাঙলায় না জন্মালে, রবীন্দ্রনাথকে কিছু মাত্র না জানলে বাঙালির বাঙালিত্ব বজায় থাকে না। রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টা বাঙালীর স্বরূপ উপলব্ধরই প্রয়াস মাত্র"। তিনি রবীন্দ্রনাথকে ৪০ বছর, ৬০ বছর এবং ৮০ বছর বয়সে তাঁর কবি কৃতি, তাঁর প্রতিভা, তাঁর প্রখর মননশীলতা নিয়ে সমসাময়িক কালের বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাগণের সঙ্গে তুলনা করেও তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে কার্পণ্য করেননি। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাসের প্রতিটা বাক্য মনে হয় তিনি শুধু পড়েননি, বুঝেছেন এবং আত্মস্থ করেছেন। এক অপূর্ব স্বাভিমানী বাঙালি যেভাবে সারা জীবন ইংরেজিয়ানা চর্চা করে গেলেন তা বাঙালি মনীষার বিকাশেরও একটা রূপরেখা স্পষ্ট করে। এবং সেই ছবিটার ভুল ব্যাখ্যা করার কোনও সুযোগই তাঁর বিরোধীরা কখনও হাতছাড়া করেননি। আমার মনে হয় উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলাভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ভুবনে যে ক'জন ক্ষণজন্মা তুখোড় লিখিয়ে এবং মৌলিক চিন্তকের আবির্ভাব ঘটে, নীরদ সি চৌধুরী এঁদের অন্যতম।

নীরদ সি চৌধুরী নিয়ে তোমার ভাবনা পড়তে পড়তে সহসা মনে পড়লো এমন একজন সাহিত্যিকের কথা যিনি নীরদ সি চৌধুরীর একদম বিপরীত। যিনি নিপীড়িত মানুষের অলিখিত সংগ্রামী জীবনেতিহাসকে সাহিত্যের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করে বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। জীবনবিচ্ছিন্ন ভাবকল্পনা বা নিছক প্রণয়ের অর্ধকল্পিত উপাখ্যান নয়, প্রবলভাবেই জীবনসম্পৃক্ত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী সমগ্র জীবন মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি প্রবল দায়বোধে সাহিত্য রচনা করেছেন। জল-মাটি-শস্যের গন্ধবাহী মহাশ্বেতা দেবীর কথাসাহিত্য বাংলা সাহিত্যে যে স্বতন্ত্র ধারার সূচনা করেছে তা বহমান আছে, থাকবে আরো বহুকাল। ঝাঁসীর রাণী তাঁকে লেখক হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়।ইতিহাস-আশ্রিত জীবনীগ্রন্থ ঝাঁসীর রাণী সাহিত্যিক হিসেবে মহাশ্বেতার অবস্থানকে একটি শক্ত ভিত্তি দেয়। সেই ভিত্তিতেই তাঁর পরবর্তী জীবনের সুউচ্চ সাহিত্য-পিরামিড স্থাপিত। ঝাঁসীর রানি লক্ষ্মীবাঈ চরিত্রটির গভীরে ডুব দিতে দিতে দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে ন্যাশনাল লাইব্রেরি গিয়ে এতদসংক্রান্ত বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে তাঁর সংকল্পে থিতু হলেন তিনি, এই রানিকে নিয়ে লিখবেন তিনি। প্রাথমিকভাবে লিখেও ফেললেন চারশো পৃষ্ঠা। স্বস্তি পেলেন না লিখে। ছিঁড়ে ফেললেন সে-লেখা আর ঝাঁসী গিয়ে রানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি হৃদ্গত করে নিয়ে লিখবার জেদ তাঁকে সেখানে নিয়ে ছাড়ল। ‘সারা ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ-আয়োজন শুরু হয়েছে। এই উপলক্ষ্যে মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য কর্তৃক লিখিত বীরশ্রেষ্ঠা ভারতীয় নারী লক্ষ্মীবাঈয়ের বহু নূতন তথ্য সংবলিত জীবনালেখ্য ‘ঝাঁসীর রাণী’ ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৫৫ সাল জুড়ে ধারাবাহিকভাবে তা ছাপা হলো।

এমন কিন্তু নয় যে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি শুরু হয় এ লেখাটির মাধ্যমে। এর আগে ‘দেশ’ পত্রিকাতেই তাঁর দু-তিনটে ছোটগল্প বেরিয়েছিল। জিম করবেট, যাঁকে তিনি পরবর্তীকালে অনুবাদ করবেন, ছিল তাঁর প্রবন্ধের বিষয়, ওখানেই। তাছাড়া মহাশ্বেতা দেবীর লেখক সত্তার উন্মেষকাল তো শৈশবেই, শান্তিনিকেতন পর্বে। সেখানে সে সাহিত্যসভা হত নিয়মিত, সরলা দেবী চৌধুরানী সভাপতিত্ব করতেন, দশ-বারো বছরের মহাশ্বেতা দেবী লেখা পড়তেন সেখানে, যা ছাপাও হয়েছিল। সেই বয়সে আলফ্রেড নোবেলকে নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী প্রবন্ধ লিখছেন, ভাবা যায়? পরবর্তীকালে খগেন্দ্রনাথ সেনের ‘রংমশাল’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’ বইয়ের আলোচনা করেন যখন, তখন তাঁর বয়স মাত্রই তের (১৯৩৯)। হাতে-লেখা পত্রিকা বার করাও বাদ যায়নি, বয়সে তিন মাসের ছোট ঋত্বিক ঘটক যে-কাজে তাঁর সহযোগী। পত্রিকায় ছবি আঁকার দায়িত্ব ছিল ঋত্বিকের। রাজলক্ষ্মী দেবী ছিলেন বেলতলা স্কুলে মহাশ্বেতার সহপাঠিনী, এমএ ক্লাসেরও। স্কুলে পড়ার সময় তাঁরা আর-একবার হাতে-লেখা পত্রিকা বার করলেন, নাম ‘ছন্দ-ছড়া’। দ্বিতীয়বারের শান্তিনিকেতন-পর্বে তাঁর গল্প লেখার সূচনা। ‘দেশ’, ‘সচিত্র ভারত’ পত্রিকা-সহ আরও নানা পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন এ-সময়ে, পাঁচের দশকের গোড়া থেকে।

মহাশ্বেতা দেবী নিয়ে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি কি? তুমি কিভাবে দেখো তাঁর লেখাকে? খুব জানতে মন চাইছে। জানি এইসময় মুখোমুখি বসে থাকলে তুমি অনেক জানা অজানা কথা খুলে বসতে। তোমাকে যতটা চিনি ও জানি আমার বিশ্বাস মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্য জগতের চেয়ে তুমি বেশি নজর দিতে তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকে। উচ্ছাসিত হয়ে বলতে শুরু করতে তার রাজনৈতিক যাপনের কথা অনুমান করি সেসব তথ্যের ভিড়ে তুমি উজ্জ্বল হয়ে উঠতে। শ্রেণী সংগ্রাম, সমাজতন্ত্র নিয়ে বলতে বলতে তুমি চেনাতে অনন্য এক মহাশ্বেতা দেবীকে, যিনি লেখার পাশাপাশি অন্যতর এক পরিচয়ে পরিচিত, তিনি একজন সমাজকর্মী এবং তা কোনও সৌখিনতায় মোড়া নয়। বাংলা-বিহার-ওড়িশার প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর আদিবাসীর মধ্যে কাজ করে গেছেন তিনি আজীবন। জঙ্গলমহলের খেড়িয়া, শবর, লোধাদের সামাজিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন তিনি। এই জনজাতিকে জমির পাট্টা দিতে তাঁর নেতৃত্বদানের জন্য তিনি সেখানে মায়ের মত সম্মান পান। শবর জাতির ওপর ঔপনিবেশিক শোষণ ছিল সীমাহীন উপরন্তু ব্রিটিশরা এঁদের আখ্যা দেয় ‘অপরাধপ্রবণ’ জাতি হিসেবে। মহাশ্বেতা দেবী তাঁদের সেই দুর্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে দেখান, তাঁদের প্রাচীন সংস্কৃতি কী মহান। একদিকে তিনি তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁদের অর্থনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে গিয়েছেন, অন্যদিকে তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে ভারতের আদিবাসী সমাজের এক বিরাট অংশ তাঁদের সভ্যতা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-উত্তরাধিকার নিয়ে প্রামাণ্য ও মহত্ত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর’, ‘কৈবর্তখণ্ড’ ইত্যাদি উপন্যাস এবং তাঁর অসংখ্য ছোটগল্পে আদিবাসী মানুষের স্বেদ রক্ত হাহাকার ও সহজ আদিম জীবনযাপনের রেখাচিত্র অঙ্কিত হয়ে আছে। আদিবাসীদের জীবনের গভীরে গিয়ে তাঁদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়া, তাঁদের লোকাচার এবং ইতিহাসের পরম্পরাকে শ্রদ্ধাসহকারে অনুধাবনের চেষ্টা আর কোনও বাঙালি লেখকের মধ্যে দেখা যায়নি। বাংলা সাহিত্যের ভূগোলকে বিস্তৃতি দিয়েছেন তিনি, আদিবাসী সমাজের সঙ্গে আমাদের নৈকট্য এনে দিয়েছেন। উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেও মহাশ্বেতা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-সংগ্রামকে উপজীব্য করেছেন অনায়াস দক্ষতায়। ‘দ্রৌপদী’, ‘জাতুধান’, ‘শিকার’, ‘শিশু’, ‘সাগোয়ানা’, ‘লাইফার’, ‘মাছ’, ‘বিছন’ প্রভৃতি গল্পে সমাজের নানা অবিচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনতার প্রতিবাদের শিল্পভাষ্য নির্মিত হয়েছে।

জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে পিছনে ফিরে গেলে দেখি পরাগ দা আমাদের কমরেড পরাগ মিত্র ঘরময় বইয়ের স্তুপ। মনে আছে তোমার পরাগ দার কথা? পরাগ দা এখন মালবাজারে থাকে। তার ঘরেই বইয়ের স্তুপে মহাশ্বেতা দেবীর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। স্মৃতি বিট্রে না করলে সম্ভবত নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত হাজার চুরাশির মা উপন্যাসটি মহাশ্বেতা-কথাসাহিত্যের এক মাইলফলক বলে বিবেচিত হয় বলে সেই বইটিই পড়তে চেয়েছিলাম কিন্তু পরাগ দা বলেছিল আগে অরণ্যের অধিকার পড়, নিজেই বইয়ের স্তুপ থেকে খুঁজে বের করে দিল। সেই প্রথম আমার মহাশ্বেতা পাঠ। মুন্ডা বিদ্রোহের আখ্যানকে উপন্যাসের কলেবরে স্থান দিয়ে, অভাবী মুন্ডা সম্প্রদায়ের প্রতি শুধু মমত্বই প্রকাশ পায়নি, মুন্ডাজীবনের গভীর বেদনাও প্রকাশ পেয়েছে। পেটভরা ভাত, গায়ে মাখার তেল, পরনের জন্য কাপড় – এটাই তাদের জীবনের সর্বশেষ আকাঙক্ষা। ব্রিটিশ সরকার মনে করত, মুন্ডাদের বিদ্রোহ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। আসলে বিদ্রোহটা ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে। সেই শোষক বিদেশি নয়, ভারতের ভিন্নভাষী, ভিন্ন বর্গের মানুষ – বাঙালি, বিহারি, রাজপুত, মাড়োয়ারি, পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী ও জমির মালিকরা – আদিবাসীদের ভাষায় ‘দিকু’। ‘দিকু’রা আদিবাসীদের কষ্টে ফেলে, সুদের জালে আটকে তাদের ফসল নিয়ে গিয়ে তাদের নিঃস্ব ও ভূমিদাসে পরিণত করত। খাদ্য, বাসস্থান হারিয়ে, শোষণের পীড়নে মুন্ডারা তীর, টাঙি, বর্শা হাতে নিরুপায় হয়ে প্রশাসনের বন্দুকের গুলির সামনে এসে দাঁড়ায়। মহাশ্বেতা দেবী অরণ্যের অধিকার উপন্যাসে সেই দ্রোহের চিত্রটি জীবন্ত করে তুলেছেন। যেমন – ‘মুন্ডার জীবনে ভাত একটা স্বপ্ন হয়ে থাকে।… কোন না কোনভাবে ভাত বীরসার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। বেশিরভাগ সময়েই বীরসার যে উদ্ধত ঘোষণা মুন্ডা শুধা ‘ঘাটো’ খাবে কেন? কেন সে ‘দিকুদের’ মত ভাত খাবে না। ’ বীরসার ভগবান হয়ে ওঠার পেছনে অরণ্য-চেতনাটিকে লেখক সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এভাবে সে জিতেন্দ্রিয় পুরুষে পরিণত হয়। তার প্রতি আকর্ষণ অনেক মুন্ডা যুবতীর। কিন্তু সে নিজেকে উৎসর্গ করেছে ‘উলগুলানে’র কাজে। আকর্ষণ নিয়েও সে থাকে নিরাসক্ত। তাই বীরসাকে শুদ্ধ চরিত্র, জিতেন্দ্রিয়, আত্মত্যাগী, আদর্শ পুরুষে রূপ দিয়েছেন লেখক। কেননা অরণ্যের অধিকার উপন্যাসে বীরসার নেতৃত্বে পরিচালিত বিদ্রোহ বা ‘উলগুলান’ দেখানোই তার উদ্দেশ্য। আদিবাসী জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে অরণ্য। অরণ্য উচ্ছেদ করা মানে আদিবাসীদের জীবন বিপন্ন করা। অরণ্যবাসীদের আহার এবং আবাস – দুই জোগায় বনভূমি। সেই বনভূমি ‘দিকু’রা কেড়ে নিচ্ছে, বনভূমিতে তাদের অসিস্ত আর থাকছে না – বনভূমির কান্না, আদিবাসীদেরই কান্না। আদিবাসীরা ফিরে চায় অরণ্যের অধিকার। এজন্যই বীরসা মুন্ডাকে মহাশ্বেতা দেবী ভগবান মহিমা দান করে ঈশ্বরোপম করে চিত্রিত করেছেন। তার দ্রোহ ও নেতৃত্বে সঞ্জীবিত করে দিয়েছেন চিরকালের মহিমা। অরণ্যের অধিকার পড়ার অনেক পরে আমি পড়েছিলাম হাজার চুরাশির মা,যদিও এর আগে ‘রং নাম্বার’, ‘শরীর’, ‘প্রাত্যহিক’ গল্পেও একই বিষয় অবলম্বিত হয়েছিল। ‘রং নাম্বার’ গল্পে নকশাল আন্দোলনে নিহত দীপঙ্করের বাবা তীর্থবাবুর মানস জগতের উন্মোচনের মতো হাজার চুরাশির মা উপন্যাসে নকশালপন্থী নিহত তরুণ ব্রতীর মা সুজাতার অন্তর্দহনকে বিসত্মৃতি দিয়ে সত্তরের উত্তাল সময়কে ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় জীবনের রক্তাক্ত এক অধ্যায়কে সাহিত্যের দলিলীকরণের মধ্য দিয়ে এ-উপন্যাসে লেখক মধ্যবিত্তের আত্মতৃপ্তি ও মুগ্ধ সংকীর্ণতার প্রাকারে তীব্র আঘাত হানেন। গোর্কির মায়ের মতোই ব্রতীর মা সুজাতার অরাজনৈতিক সত্তা রূপান্তরিত হয় বিপ্লবী চেতনাসমৃদ্ধ সত্তায়।

জীবনের দুপুর পেরিয়ে এসে এই পড়ন্তবেলায় মনে হয় মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্যভাবনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা বিচিত্রমুখী প্রান্তিকজীবনের আখ্যান। নিকট ও দূরের ইতিহাসকে তিনি যেমন গ্রথিত করেন তাঁর সাহিত্যে, তেমনি সাম্প্রতিক সময়কেও ইতিহাসেরই বস্তুনিষ্ঠ তাৎপর্যে তুলে ধরেন তাঁর লেখায়। বর্তমানতার মধ্যেও তাই তাঁর লেখায় থাকে যেন দূরকালের ইতিহাসের বিভ্রম। তিনি একাধারে সমাজকর্মী এবং লেখক। বঙ্গদেশ তথা ভারতসহ বিশ্বক্ষেত্রে এমন দৃষ্টান্ত প্রায় নজিরবিহীন। মহাশ্বেতা দেবী শুধু লেখেন না। যা লেখেন, তাই করেও দেখান। তাই তাঁর সাহিত্য আর কর্মজীবন একাত্ম সাধনার এক অনন্য প্রয়াস। সর্বস্বহারাদের জন্য লেখেন না, তাদের জন্য সর্বস্ব ত্যাগও করেন। সৃষ্টির প্রাপ্তি অর্থ নিয়ে কলকাতা শহরে বসে থাকেন না। চলে যান প্রান্তিক পুরুলিয়ায়। তিনি শুধু ভয়েসলেস সেকশনের রাইটার নন, নিরক্ষর বাক্যহারা মানুষের মনের সম্রাজ্ঞী। যেখানে অত্যাচার, নিপীড়ন সেখানেই সবার আগে ছুটে গেছেন জননী মহাশ্বেতা দেবী। কারোর কাছে তিনি দিদি কিংবা বহিন, আবার কারো কাছে মমতাময়ী মা। সর্বার্থেই তিনি একজন যোদ্ধাকর্মবীর। তিনি কর্মসাধক। ব্যক্তিগতকে গুরুত্ব না দিয়ে সমাজের অবহেলিতদের সংগঠিত করার দুর্বার ব্রতকে আজীবন পালন করেছেন। আদিবাসীজনজাতি সমাজ ও সংস্কৃতির ভ্রান্ত ভাবনাকে দূর করার জন্য আপসহীন লড়াই করেছেন।

মুখরিত শ্রাবণ এসে গেলো, রাত ভর বৃষ্টি ছিল গতকাল এইখানে। স্কুলের দিনগুলোর মতন ইচ্ছে করেই আজ অফিস কামাই করেছি। মেঘলা দিনের সরলতা মেখে গ্যাসচুল্লিতে খিচুড়ী বসিয়েছি। কিন্তু ভেবে পাচ্ছিনা সঙ্গে কি ডিম অমলেট নেবো নাকি মাংস কষা। সামনেই তোমার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন চিরযুবক। তোমার জন্মদিনে ‘বিবেক বিদায় পালা’বইটি পাঠালাম। জানিনা বইটি তোমার পড়া কিনা যদি তোমার সংগ্রহে থেকে থাকে তাহলে আমার কপাল মন্দ। মহাশ্বেতা দেবী এই উপন্যাসে ধরেছেন শ্রীচৈতন্য ও তাঁর সমসময়কে। কোথায় জানি পড়েছিলাম এ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড লেখার ইচ্ছে ছিল তাঁর। দুর্ভাগ্য, নানান উপকরণ সংগৃহীত হলেও শেষ পর্যন্ত লেখা হয়ে ওঠেনি এ-উপন্যাসের খণ্ডটি। নিরন্তর ভালো থেকো। তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকলাম।



শুভেচ্ছা ও শুভকামনায়-

তোমার সুস্মি

১৯ জুলাই, ২০২৫