Next
Previous
Showing posts with label ধারাবাহিক. Show all posts
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in







৩. শহীদুল জহিরের ছোটগল্প: বিষয় ও বৈচিত্র্যে


হৃদীবরেষু সুস্মি,

গত কয়েক মাস থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসেন। মাত্র সাত মাসেই ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন ঐকতানে অভাবনীয় পতন হয়েছে সেই সরকারের। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর দেশত্যাগ ২০২১ সালের আফগানিস্তান পরিস্থিতি ও ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনীয়। তখন গণ-আন্দোলনের মুখে আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশত্যাগ করেছিলেন। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিভিন্ন কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ৫ আগষ্ট বিকেলের দিকে জনস্রোত গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে। সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বাসভবন সুধা সদন, তেজগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়, বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি। হামলা হয় জাতীয় সংসদে, প্রধান বিচারপতির বাড়িতে। ছয় ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় বিমানবন্দরের কার্যক্রম। জেলায় জেলায় হামলা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কার্যালয়ে। বিভিন্ন জায়গায় হামলা হয়েছে থানায়। ভাঙচুর করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। বাংলাদেশের এই পরিস্থিতিতে খুব করে মনে পড়ছে একজনের কথা। আমি বিশ্বাস করি তিনি বেঁচে থাকলে এই সময়ের প্রেক্ষাপটে দারুন কিছু লেখা পড়ার সুযোগ ঘটতো, জানি এই বিষয়ে তুমিও একমত হবে। বস্তিজীবন থেকে যে গল্পধারার শুরু তা সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পেরিয়ে খুব উঁচুতে যেতে পারেনি। তাঁর গল্পে উচ্চবিত্ত চরিত্র খুবই কম, যেমন কম উচ্চশিক্ষিত বা এলিট শ্রেণির চরিত্র। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাই বলেছেন, “তাঁর তাবৎ গল্প থেকে একটি চারিত্র্যই উদ্ভাসিত হয়- সমাজের অন্ত্যেবাসী মানুষের জীবনযাপনের চিত্রণই তাঁর লক্ষ্য। বহির্জীবনই অনেকখানি, তারই মধ্য দিয়ে অন্তর্লোকে যাত্রা। এ বহির্জীবনের পটভূমি বাংলাদেশের, শুধু ঢাকা শহর নয়- ঢাকার বাইরেরও কোনো কোনো স্থান নির্বাচন করে নিয়েছেন এবং গভীর সততা ও নিবিষ্টতার সঙ্গে তার রূপায়ন ঘটিয়েছেন। আমি জানি এইটুকু পড়েই তুমি ঠিক বুঝতে পারছো আমি কার কথা লিখছি।

বাংলা ছোটগল্পের উত্তরাধিকারে ভিন্নধারার কথাশিল্পী শহীদুল জহির (১৯৫৩-২০০৮) এর কথাই বলছিলাম, যার আবির্ভাব জীবনানন্দ দাশের মতো শিল্পীসত্তায় নির্জনতাকে সঙ্গী করে । বাংলা ছোটগল্পের ভুবনে তিনি সংযোজন করেছেন অসামান্য কিছু গল্প। তাঁর গল্পের জীবনসংবেদী বিষয়, অভিনব আঙ্গিক, অন্তরঙ্গ চরিত্র- আর সবকিছু ছাপিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় সমৃদ্ধ বিচিত্র বর্ণনাকৌশল বাংলা সাহিত্যে অভিনব সংযোজন। আবহমান সমাজকাঠামোর পুরনো গল্পগুলোই তিনি নতুন করে উপস্থাপন করেছেন, আর তাঁর অভূতপূর্ব উপস্থাপনভঙ্গির কারণে সেগুলো স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত। তিনি বহির্বাস্তবকে গৌণ করে অন্তর্বাস্তবকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এই বাস্তব-অবাস্তবের খেলায় বাস্তব ধরা দিয়েছে তীব্রভাবে। জাদুর ঘোর লেগে গেলেও তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবই থেকে গেছে। বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে এ ধারা শুরু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র হাত ঘুরে শহীদুল জহিরে এসে তা পুষ্ট হয়েছে এবং স্বকীয় বর্ণনাশৈলিতে পূর্বসূরীদের আড়াল করে তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন, বলাই বাহুল্য। শহীদুল জহির অধিকাংশ সময় ঘটে যাওয়া গল্প লেখেন। সেই গল্পটা আবার তিনি নির্মাণ করেন সমষ্টির বয়ানে। অর্থাৎ মহল্লা বা ডাউনটাউনের লোকজন সেই গল্পের কথক। তিনি তাদের মুখে গল্পটা তুলে দিয়ে নিজে কিছুটা দূরে সরে যান। অনেকটা পাঠকের অবস্থানে অবস্থান করেন। ফলে তিনি গল্পে কথা বলার ধরন মিশিয়ে যে-কথন তৈরি করেন সেখানে আখ্যান বা অবয়ব বলে কিছু থাকে না। ঐতিহ্যগত নির্মাণশৈলীটা ভেঙে পড়ে। এজন্য তাঁকে উত্তরকাঠামোবাদী (Post-structuralist) হিসেবে আমরা ভাবতে পারি।

আজ্ছা, বাংলাদেশে তোমার যেসব আত্মীয় স্বজন আছেন, তাদের সাথে নিশ্চয় যোগাযোগ হয়েছে। ভালো আছেন তো তারা? দেশভাগের শিকার প্রজন্মের যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের জীবনে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। তাঁদের স্মৃতিতে আছে দেশভাগের বহু গল্প। ঠাকুরদার কাছে শুনেছি ১৯৪৭ সালের জুন মাসের আগেই দেশত্যাগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখনো ভারত–পাকিস্তানের সীমান্ত ঘোষণা করা হয়নি। এর মধ্যেই মানুষ ‘নিরাপদ অঞ্চল’-এ অভিবাসন করছিলেন। দেশভাগের মতো নির্মম বাস্তবতার সামনে পূর্ব পাকিস্তান নতুন এক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। 'কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা'- পাকিস্তানিদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় পূর্ব পাকিস্তান। তার পরম্পরায় শোষনের বিরুদ্ধে বাঙালি নতুন প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বলা যায়, এভাবেই দেশভাগ ভিন্ন এক আলো নিয়ে আসে বাঙালির জীবনে। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে মনে হয় ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রতিমূহুর্তে বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে ভারত বিদ্বেষ সম্প্রীতি হারিয়ে যাবার কারণ হিসেবে আমার বারবার মনে হয় দেশভাগ পরবর্তী পূর্ববাংলার পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থায় অভিজাত হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংকট মুখ্য। পূর্ববাংলার আর্থ-রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিপত্তিশীল ও নিয়ন্ত্রণকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিজাত বা উচ্চবর্ণ গোষ্ঠী নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে সকল ক্ষেত্রেই ছিল অনুপস্থিত। এর পাশাপাশি ছিল মনস্তাত্ত্বিক সংকট। তোমার কি মনে হয়? চল্লিশের দশকে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান আন্দোলনের জোয়ারে সাময়িকভাবে হলেও ভেসে গিয়েছিল বাংলাদেশের দেশের মুসলিম জনগণ। তারা ভুল বুঝেছিল। কৃষক ভেবেছিলেন জমিদারি শোষণ থেকে মুক্তি পাবেন। মধ্যবিত্ত ভেবেছিল তাদের শ্রেণিগত উন্নতি হবে। দ্রুতই তাদের স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল। পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু কাজে আসেনি। এখনো যারা মনে করে, মুসলমানিত্ব পরিচয়ের জন্য বাঙালিত্ব ঘুচিয়ে দিতে হবে, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করে।

একটা জিনিস তুমি খেয়াল করেছো নিশ্চয় শহীদুল জহির ছাড়া বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তাঁর আগে বা সমকালে জাদুবাস্তবতার দেখা পাওয়া যায়নি বা অন্য কারো লেখায় এ-প্রসঙ্গ অনুপস্থিত তা কিন্তু নয়। ষাটের দশকের কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সচেতনভাবেই গল্পে, উপন্যাসে এর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। আবার জহিরের সহযাত্রী নাসরীন জাহানের একাধিক উপন্যাসেও এর বিন্যাস ভাষ্যরূপ পেয়েছে। কথাসাহিত্যে অভিনব গদ্যভঙ্গির চর্চা শহীদুল জহিরকে অনন্য করে তুলেছে। আঞ্চলিক কথ্য ভাষাভঙ্গির অনায়াস ব্যবহার তাঁর গদ্যশৈলীকে করে তুলেছে শক্তিশালী আর তার চরিত্রগুলোকে দান করেছে মাটিঘেঁষা শেকড়সন্ধানী অভিযাত্রা। বেশিরভাগ গল্পের চরিত্রগুলো তাঁর জন্মস্থান পুরান ঢাকা, কখনও পৈত্রিক নিবাস সিরাজগঞ্জ, পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহ বা সাতকানিয়ার ভাষায় কথা বলে। জাদুবাস্তবতার ধারণা আয়ত্ত করা প্রসঙ্গে তিনি নিজেই কয়েকটি সাক্ষাৎকারে মার্কেজের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। গ্রাম, নগর, পাড়া-মহল্লা নির্বিশেষে তাঁর কথাসাহিত্যে জাদুবাস্তবতার যে-ভুবন গড়ে ওঠে, তা একান্তই এদেশীয় জনমানুষের প্রাত্যহিকতা ও শিকড়ঘেঁষা জীবনের স্বাদ, আবহ, গন্ধ ও সৌকর্যকে ধারণ করে বিচিত্র গল্পকথা, আখ্যান, গুজব ও কিংবদন্তিযোগে। উত্তরাধুনিক সাহিত্য-রচনার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে জহির জাদুবাস্তবতাকে গল্প ও উপন্যাসের আধার ও আধেয় – উভয় দিকের উৎকর্ষ সাধনের হাতিয়ার করে তুলেছেন।

শহীদুল জহিরের প্রথম গল্পগ্রন্থের রচনাকাল বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক, প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পারাপার’-এর গল্পগুলোতে মার্ক্সীয় দর্শনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রচনাকালের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীনতা পরবর্তী দেশকে তার নিজস্ব দেখা থেকেই তিনি সমাজে বঞ্চিতদের কথা বলতে চেয়েছেন, তাদের জীবনসংগ্রামের কথা এবং সেই সংগ্রামে জয়লাভের কথা বলতে চেয়েছেন। সমাজে বঞ্চিত, দলিত মথিত মানুষগুলোর মধ্যে একধরনের ঋজু দৃঢ়তা, প্রতিবাদ ও প্রত্যয় এই পর্বের গল্পে মুখ্য হয়ে ওঠে। লেখক নিজেই বলেছেন, ‘পারাপার বইটাই গরিব লোকদের নিয়া লেখা, শহরের গরিব, গ্রামের গরিব।’ তাই গল্পগুলোকে প্রতিবাদী চেতনার ফসল বলে মনে হয়।

তুমি তো জানই আমার ঠাকুরদা দেশভাগের সময় অসমে চলে আসেন। নওগাঁর শিয়ালমারীতে বিশাল সম্পত্তি বিনিময় করে এলেও সেই সুখ বেশিদিন টেকেনি। বাঙালি খেদাও আন্দোলনের সময় আবার আমার পরিবার উদ্বাস্ত্ত, সব ছেড়ে নতুন করে শুরু করেছিলেন ঠাকুরদা কোাচবিহারে। তোমার পরিবারকে নিশ্চয় এতবার উদ্বাস্তু হতে হয়নি। হিন্দু বাঙালীরা সব সময়েই মনে হয় উদ্বাস্তু তাদের কোন দেশ নেই। পঞ্জাবের দিকে দেখো। প্রথম প্রথম কাটাকাটি, খুনোখুনি যা হবার তা হয়ে গেছে। ওদিক থেকে ট্রেন ভর্তি মৃতদেহ এলে তার প্রত্যুত্তরে এদিক থেকেও ট্রেন ভর্তি শব গেছে। মাউন্টব্যাটেনের আমলেই ওদিক থেকে যারা চলে আসবার এসেছে, এদিক থেকে যারা যাবার, গেছে। কিন্তু বাংলার দিকে যে আগমন-নির্গমন কিছুতেই থামছে না।

শহীদুল জহিরের প্রথম গল্প ‘ভালোবাসা’(১৯৭৪) গল্পটিতে অন্যরকম এক ভালোবাসার রূপ দিয়েছেন জহির। বাবুপুরা বস্তি এলাকার গল্প। তুচ্ছ একটা ফুল দিয়ে যে মানুষের মনকে জয় করা যায়, তার সত্যিকার চিত্রাঙ্কন করেছেন তিনি ‘ভালোবাসা’ নামক গল্পে। বস্তিবাসী হাফিজদ্দি এবং তার স্ত্রী আবেদার প্রাত্যহিক নিস্তরঙ্গ জীবনে ক্ষণিকের জন্য ঢেউ তোলে হলুদ রঙের ডালিয়া ফুল। বস্তির মেয়েদের প্রায় সবাই কাছাকাছি কোনো বাড়িতে ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে, পুরুষরা হয় ঠেলাগাড়ি ঠেলে বা দিনমজুর। ঝুপড়ির এক ঘরে ঠাসাঠাসি করে দিনাতিপাত করে। এমনি এক পরিবেশে হাফিজদ্দি ডালিয়া ফুল নিয়ে বাড়ি ফিরলে সবার মধ্যে ঔৎসুক্য তৈরি হয়। আর ‘আবেদার বুকের ভেতরটা কেঁপেছিল কী এক সুখে। হঠাৎ ঝরা বৃষ্টির পর পোড়া চরাচরের মতো আবেদার মনে হয় কী আরাম বৃষ্টির এই অনাবিল জলে ভেজায়।’ সমাজের অন্ত্যেবাসী মানুষদের জীবনে ভালোবাসার পেলব উৎস হয়ে দাঁড়ায় ফুলটি। তাই ‘তহুরা তো জানে না বাবা মাকে কী জাদু করে রেখে বাইরে গেছে।’লেখকের অসামান্য দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ফুলটিই শেষ পর্যন্ত গল্প হয়ে দাঁড়ায়।

দ্বিতীয় গল্প ‘তোরাব শেখ’ (১৯৭৫) গল্পটি একটি চমৎকার আঙ্গিকের শক্তিশালী গল্প। বস্তিজীবনের প্রাত্যহিকতা, স্বপ্ন-বাস্তবতা আর জীবন সংগ্রামের গল্প। জহিরের গল্পে বিশ্লেষণ ও বর্ণনা প্রচুর। অনেক ক্ষেত্রে তিনি শব্দ নিয়ে এঁকেছেন চিত্র। কাহিনিকে আরো স্বাবলম্বী ও উদ্ভাসিত করতে এক ধরনের কাব্যময়তা তৈরি করেছেন। নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতিদিনের দিনলিপি নিখুঁতভাবে দেখেছেন অথবা অনুভব করেছেন বলেই অনেক চিত্র অন্ধকারাচ্ছন্নের মধ্যেও তুলে ধরেছেন বলিষ্ঠভাবে। তোরাব সেখ, লতিকা, জমির, লালবানু প্রত্যেকেই অস্তিত্বসংগ্রামী। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে জীবনের ঘানি টেনে যাচ্ছে যারা তারা জেগে উঠলেই বদলে যাবে পৃথিবী, মার্কসীয় এ বিশ্বাসের প্রতিফলন এ গল্প। লেখকের জীবনদৃষ্টির ভিন্নতা, সাধারণ মানুষের প্রতি মমত্ব প্রকাশ পেয়েছে “পারাপার”(১৯৭৫) গল্পে।গণমানুষের নিয়তিতাড়িত জীবনধারার পরিবর্তনে শৈশব থেকে প্রাণান্ত চেষ্টার গল্প এটি। ছোট দুটি শিশু আবুল আর বশিরের জীবন সংগ্রাম, সমাজের উঁচুতলার মানুষদের নির্দয় আচরণ, এবং তাদের রোষানল থেকে মুক্তিপ্রত্যাশা গল্পটিকে অনন্য করেছে। সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য অত্যন্ত সহজ পরিসরে উঠে এসেছে। ওলি চরিত্রটির অবস্থান এই দুই শ্রেণির মাঝে।

সংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ জীবন, স্বাভাবিক অশ্লীলতা বা সাবলীলভাবে কোনো বাচ্চার জন্ম নিয়ে কথা তোলা গ্রামীণ আবহে সম্ভব। মানুষ সামাজিক বিষয়ে গালগল্পের ওপর নির্ভরশীল। গ্রামীণ সংস্কৃতির নিবিড় অবলোকন থেকে উঠে আসা এমনি একটি গল্প “মাটি ও মানুষের রং” (১৯৭৬)। গল্পটি পুরোদস্ত্তর মনস্তাত্ত্বিক, ধনী-গরিবের যে-তারতাম্য তার প্রকৃত একটা চিত্র শহীদুল জহির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দারিদ্রে্যর প্রতি যে-অবিচার করা হয়, অবিচার করা হয় শ্রেণিহীন মানুষের ওপর, তা রূপকের মধ্য দিয়ে শহীদুল জহির বলে গেছেন। আমাদের এই সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থাটা গড়ে উঠেছে ধনী-গরিবের বৈষম্যে। এখানে মানুষের আত্মীয়তা বা রক্তের সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই, মূল্য নেই মানবিকতার। তারপরও মানুষ স্বপ্ন দেখে। অভাব বা দারিদ্র্য স্বপ্নকে কোনোভাবে আটকাতে পারে না। “ঘেয়ো রোদের প্রার্থনা নিয়ে”(১৯৭৬) গল্পে সামাজিক পীড়ন, শোষণে পিষ্ট সহায়হীন অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ নবাব। সে সমগোত্রের প্রতিহিংসার শিকারও বটে। নিজেকে বড় করতে না পেরে অন্যকে ছোট করে দেখানোর চিরন্তন মানবীয় হীন মনোবৃত্তি এস্থলে লক্ষ্যণীয়। নিম্ন শ্রেণির মানুষের তাই অপরের জীবন সম্পর্কে অহেতুক কৌতুহল। নিরীহ নবাবকে কোনোভাবেই শায়েস্তা করতে না পেরে ঘৃণ্য অপবাদ দিয়ে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করে। খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে এটাও এক বিনোদন। শহীদুল জহিরের আঞ্চলিক ভাষার বিচিত্রবর্ণা মুকুটে ভিন্ন পালক যোগ করেছে এ গল্পে নবাবের মুখের ভাষা। তার প্রকৃত নাম আলফাজুদ্দিন আহম্মদ। পুরান ঢাকার চরিত্রে লেখক সতত যেসব নাম ব্যবহার করেছেন, এ নামটি সেগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম। তেমনি ব্যতিক্রম নবাব চরিত্রটি। অত্যন্ত প্রমিতভাষী নবাব চালচলনে এ সমাজে বেমানান। তাই তার প্রতি সবার অবিশ্বাস একসময় আক্রোশে পরিণত হয়।

জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর অনেকেরই এমন কিছু ‘বোধোদয়’ হয়, যা আরও আগে হলে জীবনটা হয়তো আরও সুন্দর হতে পারত। অনেকে হয়তো জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে এটা উপলব্ধি করেন। কিন্তু তাতে তো আর ফেলে আসা দিনগুলো সুন্দর করে তোলা যায় না! আমার পরিবারের যারা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে গেছিলো তাদের প্রায়শ বলতে শুনি বাংলাদেশে ফেরাটা তাদের ভুল ছিল। তোমার আত্মীয়স্বজনও কি তাই বলে? আমরাই কি আদতে ভালো আছি? ভুলে গেলে চলবে না আমাদের এই সংস্কৃতির ভিত্তি বা উৎস ধর্ম নয়, বরং লোকায়ত চিন্তা ও ভাবাদর্শ, যা প্রজন্ম–পরম্পরায় চলে আসছে। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত।

জহিরের গল্প-যাত্রাকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা চলে। ‘পারাপার’ এর পরবর্তী গল্পগ্রন্থের জন্য পাঠককে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৫ বছর। ‘পারাপার’ এর গল্পগুলো তাঁর ২১ থেকে ২৩ বছর বয়সেলেখা। 'পারাপার'-এর রিয়েলেস্টিক ধারার গল্প। পারাপারে জহির অনেক বেশি ট্র্যাডিশনাল, যেখানে গল্প একটি বক্তব্য বা অদেখা বিষয়কে সামনে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন তিনি। অন্যদিকে তার পরের গল্পগ্রন্থটি জাদুবাস্তবতার আখ্যান, ২য় গল্পগ্রন্থ ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ র ১ম গল্পটি লেখা তাঁর ৩৮ বছর বয়সে অর্ধাৎ তাঁর সাহিত্যমানস তখন আরও পরিণত। ততদিনে তাঁর উপন্যাস ‘জীবন এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা’ (১৯৮৮) এবং ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ (১৯৯৫) প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো বাংলা উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার সফলতম প্রয়োগ বলে স্বীকৃত। ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ নিয়ে ২০০০ সালে তিনি যখন আবির্ভূত হলেন, তখন তার বাস্তব আর জাদুর জগৎ এক হয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর গল্পের আঙ্গিক আর ভাষাশৈলী চলে এসেছে দৃষ্টিসীমার কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে চরিত্রেরা রয়েছে পুরনো শ্রেণি-পেশার বা বর্গের। বেশিরভাগ গল্পে পুরান ঢাকার এমন একটি এলাকা বা মহল্লাকে বেছে নিলেন যেখানে জীবন সরলরৈখিক হলেও বৈচিত্র্যে ঠাসা। অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত এসব মানুষ কখনও আঁকড়ে থাকে তাদের চিরায়ত ধ্যান-ধারণায়, কখনও নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের সঙ্গে ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ খেলে আবার কখনও নিজের অজান্তেই কোনো মহৎ কাজের অংশীদার হতে এগিয়ে আসে। ঘটনার পুনাবৃত্তি থাকলেও তাঁর আশ্চর্য বর্ণনকৌশলের কারণে পাঠকের মুগ্ধতা কাটে না।

‘আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই’ (১৯৯১) এই গল্পে নয়নতারা ফুলগাছগুলো এ গল্পের চরিত্র হয়ে ওঠে। আবদুল করিম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জড়িয়ে যায় বিশেষত্বহীন ফুল নয়নতারার সঙ্গে। ভূমিকম্পের সময় দুটো নয়নতারার টবকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সে নিজেই চারতলা থেকে পড়ে মগজ থেঁতলে মারা যায় এবং পরবর্তীতে তার শোকে গাছগুলো আত্মহত্যা করতে থাকে।এমন একটি জাদুবাস্তবতার চিত্র তিনি এঁকেছেন যা একইসঙ্গে পাঠকের মোহগ্রস্ততা এবং ধন্দ তৈরি করে। এ গল্প থেকেই তিনি জড়িয়ে গেলেন জাদুর জগতে যা পরবর্তীতে আরও বিকশিত হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা শহরকে এক সূত্রে বেঁধেছেন ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ (১৯৯২) গল্পে, ভূমিহীন অতিদরিদ্র আকালু ও তার স্ত্রী টেপি, রিকশাচালক চান্দু এবং তাদের সারল্যমাখা জীবনাচরণে। ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাকের অলৌকিক ভূমিকা, জাদুবাস্তবতাধর্মী আখ্যান ও ঘটনাংশ, অবিশ্বাস্য লোককথা ও গুজব, সর্বোপরি গল্পের ব্যাখ্যাতীত পরিসমাপ্তি। বহুদিন আগে ঢাকা শহর কাকশূন্য হওয়ার বৃত্তান্তকে ঘিরে এ-গল্পের ঘটনাবিন্যাসের সূত্রপাত। সেই ইতিবৃত্ত নির্মাণে বাস্তবতা ও রূপকথার অলৌকিক-অতিলৌকিক সমাবেশের মাধ্যমে পাঠককেও এক পরাবাস্তব জগতে লেখকের আহবান গল্পটির গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ।

শহীদুল জহিরের একটি ভিন্নধর্মী গল্প ‘ডুমুরখেকো মানুষ’ (১৯৯২)। গল্পে জনৈক মোহব্বত আলী পাড়ায় পাড়ায় জাদু দেখায় আর ডুমুর বিক্রি করে। প্রথমে ফ্রি দিয়ে যে ডুমুর বিক্রি শুরু হয় ক্রমেই তা অমূল্য হয়ে ওঠে। বেশি দামে বিক্রি করলেও মোহব্বত তার গ্রাহকদের বলে, মজা হলেও এই ডুমুর জুগিয়ে খাওয়া উচিত, যাতে শেষ জীবন পর্যন্ত চলে। ডুমুরকে যৌবনের প্রতীকও মনে হয়। কারণ বুড়ো ও বয়স্করা এই ফল বারবার খেতে আগ্রহ প্রকাশ করে। মোহব্বত ডুমুর বিক্রি করলেও ডুমুরের গাছ বিক্রি করতে রাজি হয় না। গাছ না পেয়ে মোহগ্রস্ত মানুষেরা জাদুকরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এবং একসময় নিজেরাও মৃত্যুবরণ করে। জাদুকরের রহস্যময় হাসির মতোই লেখক রহস্যাবৃত করে রেখেছেন গল্পের শেষ অংশ। তাই গল্প শেষ করে পাঠককে ভাবতে হয় ‘এতক্ষণ যা কিছু ঘটেছে তা স্বপ্ন ছিল।’

নরনারীর হৃদয়াবেগ ও প্রেম নিয়ে শহীদুল জহির বিভিন্নভাবে নিরীক্ষা চালিয়েছেন এমনি একটি গল্প ‘এই সময়’ (১৯৯৩)। ‘কাঁটা’(১৯৯৫) গল্পে যুদ্ধের সময় সংখ্যালঘু সুবোধচন্দ্র ও স্বপ্নার প্রতি যদিও সবাই অসহায় মমতা অনুভব করে কিন্তু আপন অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে তাদেরকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয়নি তারা। যেখানে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে 'কুয়ো'র প্রসঙ্গটি। সুবোধ-স্বপ্না দম্পতির কুয়োতে ডুবে মরা বেশ সিম্বলিক। এখানে একটি ইতিহাস ভ্রমণের ব্যাপার আছে। এই কুয়োটি যে সাম্প্রদায়িকতার কূপ তা বুঝতে পাঠকের আর বাকি থাকে না। তাই গল্পে কুয়োটি বন্ধ করার জন্য এলাকাবাসীকে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে দেখা যায়, যা ইতিবাচক।

নকশাল আন্দোলন নিয়ে লেখা গল্প ‘ধুলোর দিনে ফেরা’ (১৯৯৭)। পাখির রূপকে লেখক নূরজাহান ও আবদুল ওয়াহিদের মনোবিশ্লেষণ করেছেন যা প্রেম সম্পর্কে পাঠকের উপলব্ধিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়। একই চরিত্র একই মহল্লা শহীদুল জহিরের গল্পে ঘুরে ফিরে এসেছে। কখনও মহল্লাও আবির্ভূত হয়েছে চরিত্র হিসেবে। এই পরিচিত গন্ডির মধ্যেও লেখক কখনও চিত্রিত করেছেন সামষ্টিক জীবনাচরণ, আবার কখনও ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, একরৈখিকতা। এমনি একটি গল্প ‘চতুর্থমাত্রা’ (১৯৯৮)। এটিকে গল্প না বলে ‘একাঙ্কিকা’ বলা যায়।

‘হিন্দুস্থান কেবলমাত্র হিন্দুদের দেশ এবং মুসলমান, খ্রিস্টান ও অন্যান্য জাতি ভারতে বাস করছে আমাদের অতিথি হিসেবে। অতিথি হিসেবে যতদিন ইচ্ছে তারা এখানে বাস করতে পারে'—এমনটাই বলেছিলেন ১৯৩৩ খ্রি. পাঞ্জাবের বিখ্যাত আর্যসমাজপন্থী হিন্দু মহাসভার নেতা পরমানন্দ । আবার এমনই একটি সুর শোনা যায় লাহোরে ‘জামাত-ই-ইসলামী'-র প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবদুল আলার কণ্ঠে। তিনি বলেন—‘মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা অপরিহার্য এবং তাহা ইসলাম ব্যতীত আর কিছুই নহে।' তাহলে পথ কোথায় ? এই উগ্রতা কোনো লক্ষ্যে কি পৌঁছে দেয় আমাদের? মৌলবাদ আসলে কী? সময় কী সাক্ষ্য দেয় এই মৌলবাদের প্রেক্ষিতে? আর সাধারণ মানুষের মনে কোন ভাবনা এসে জমে এই শব্দটিকে ঘিরে? ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি আর মৌলবাদ শব্দগুলো কি পরস্পরের হাত ধরে চলে? ধর্মনিরপেক্ষ দেশে এর ভূমিকাই বা কী? এটি সংহতি নাকি সংকীর্ণতা—কোন গন্তব্যে আমাদের পৌঁছে দেয়? এই উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল তরবারির জোরে নয়, বরং সুফি মতবাদী ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা। তাঁদের মতবাদের সঙ্গে এই দেশের শোষিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তাদের সহজিয়া মতবাদের অনেক সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছিল। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের অনেক আগেই যে বৌদ্ধধর্মের সহজিয়া মতবাদ ও বেদবিরোধী লোকায়ত দর্শন জনমনে গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছিল, তার মানবিক দিক ছিল অনেক বেশি। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার সংকট শুরু হয় আশির দশক থেকে। উপমহাদেশজুড়ে মুসলিম মৌলবাদ এবং হিন্দু মৌলবাদ ক্যানসারের মতো বাড়ছে। শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারে বৌদ্ধ মৌলবাদও। মৌলবাদ আসলে ফ্যাসিবাদও। মৌলবাদীর কাছে ‘আমরা’ ছাড়া অন্যরা ‘অপর’। ‘অপরদের ওপর’ ‘আমাদের’ ধর্মের আলো চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো অপরাধই অপরাধ নয়। সব অত্যাচার করা বৈধ। ইউরোপের এনলাইটমেন্টের সময় থেকে পৃথিবীজুড়ে ‘অপরের’ ওপর অত্যাচারকে বৈধতা দেওয়া শুরু। উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং মৌলবাদের উত্থান নিয়ে যে কোনো মানবিক মানুষ উদ্বিগ্ন হবেন এটাই স্বাভাবিক। আমার নিরপেক্ষতার ভাাবনা তোমার ভাবনার সাথে হয়ত মিলে যাবে। কিন্তু এও জানি আমার তোমার ভাবনায় ডানা মেলে দেবে না ধর্মান্ধ পৃথিবী।

তৃতীয় এবং শেষ গল্পগ্রন্থ ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘কোথায় পাবো তারে’(১৯৯৯)। পুরান ঢাকায় সামষ্টিক শ্রেণিচরিত্রের মাঝে আবদুল করিমের প্রেমের বিষয়টি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তার ময়মনসিংহ বা ফুলবাড়িয়া যাওয়ার ঘটনায় মহল্লার সবাই আন্দোলিত হয়। ‘ভূতের গলির এই মহল্লার লোকদের দিন উত্তেজনায় ভরে যায়, হালায় প্রেম করে নিহি, তারা বলে-- ফলে মহল্লার লোকদের রাতের ঘুম বিঘিœত হয়, সারাদিনের কর্মক্লান্ত দেহে তারা বিছানায় জেগে থাকে।’ শহীদুল জহিরের গল্পের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যহলো একটি গল্পের মধ্যে আরেকটি গল্পের অন্তর্বয়ন। এমনি একটি গল্প ‘আমাদের বকুল’(২০০০)। আকালু বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে একটি গাভী পায়। পরবর্তীতে দেখা যায় তার স্ত্রী ফাতেমা আর গাভীটির সমান্তরাল জীবনাচরণ- একই সঙ্গে গর্ভধারণ, একই সঙ্গে জমজ বাচ্চা প্রসব এবং একই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া সবই প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আঠারো বছরের তরুণ শহীদুল জহিরের সংবেদনশীল সত্তায় গভীর ক্ষত তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধ। তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। সেই অতৃপ্তি বা হাহাকার থেকে মুক্তিযুদ্ধকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে এনেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। তাঁর ‘মহল্লায় বান্দর, আবদুল হালিমের মা এবং আমরা’ (২০০০) গল্পে ভূতের গলির জনজীবনে যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখি -‘ভূতের গলিতেও অবধারিতরূপে একাত্তর সন নেমে আসে এবং আবদুল হালিম এই সময়ের পাকচক্রে ধরা পড়ে, আহা রে আবদুল হালিম, আহা রে আমার পোলা, বলে তার মা হয়তো নীরবে বিলাপ করে, মহল্লার লোকেরা এই কান্নার শব্দ শুনতে পায় অথবা পায় না।’ বানরের উৎপাতে অতিষ্ঠ ভূতের গলির মানুষ প্রথমদিকে কারও ভাতের হাঁড়ি বা হাতঘড়ি বা হরলিকস এর বয়াম হারানোর ঘটনায় অন্যকে দোষারোপ করতে থাকে এবং ঘটনাগুলো রহস্যময়ই থেকে যায়। ধীরে ধীরে বানর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে।একই সমান্তরালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল হালিম আর ঝর্ণার প্রেম, যুদ্ধে পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে ঝর্ণার আকস্মিক মৃত্যু, আবদুল হালিমের যুদ্ধে যাওয়ার পথেই বুড়িগঙ্গার পানিতে ডুবে মৃত্যু এসবই লেখক বানরের গল্পের সঙ্গে বলে গিয়েছেন। ছেলের মৃত্যুর পর তার মা ছেলের তোষকের নিচে ঝর্ণার লাল সাটিনের ফিতা আবিষ্কার করেন এবং বহুবছর পর গৃহকর্মীর মেয়ে জবাকুসুমকে ফিতাটি দিয়ে চুল বেঁধে দেন ‘এবং তারপর সেদিন মহল্লায় লাল চুলের ফিতার ইতিহাস প্রকাশিত হয়।’ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর পাশবিকতার পাশাপাশি বানরদের এই সামান্য চুরিকে লেখক মানবিকই বলতে চেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের জনজীবনে মানুষরূপী কিছু হায়েনার হিংস্রতার নৃশংসতার ভয়াবহতা লেখক শহীদুল জহির অত্যন্ত নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে এনেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। তাঁর ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’ গল্পে যুদ্ধের সময় ভূতের গলিতে হানাদার-রাজাকারদের নিয়মিত হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং সাধারণ মানুষের প্রাণ রক্ষার্থে পলায়নকে লেখক বলেছেন ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’- ‘তারপর ভূতের গলিতে ৩০ মে রবিবার সকাল সাড়ে নয়টার সময় পাকিস্তানি মিলিটারি আসে। ... টিপু সুলতান রোডের মোড়ে ট্রাক থামার সঙ্গে সঙ্গে মহল্লায় খবর হয়ে যায়।... মহল্লার লোকেরা গাট্টি বোঁচকা মাথায় করে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বলধা গার্ডেন এবং হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভেগে যায়। মহল্লায় কোনো লোক না দেখে পাকিস্তানি মিলিটারি দলের নেতা লেফটেনান্ট শরিফ খেপে, সে বলে, কেয়া বাত হ্যায়, শালে লোগ সব ভাগ গিয়া? ... আবদুল গণি বলে, হালারা চুহা হ্যায়।... ইয়ে এক খেইল হ্যায়, ইন্দুর বিলাই খেইল হায়, চুহা বিল্লি হায়। তারপর মহল্লার চল্লিশটা বাড়ির ভেতর কেবল খতিজা বেগমদের ৩১ নম্বর বাড়িটা ছাড়া অন্য সব বাড়ি ২৭ অক্টোবর বুধবার পর্যন্ত মোট দুইবার করে পোড়ে।’ এই খেলা মহল্লায় বলবৎ থাকে যুদ্ধের পরও এবং স্বাধীন দেশে সন্ত্রাসীরা নিরীহ মানুষের সঙ্গে এই জীবনমরণ খেলায় লিপ্ত হয়। শিশুদের সাধারণ ‘লৌড়ালৌড়ি’ থেকে শুরু করে ডেঙ্গুজ্বর বা মানুষের জিম্মিদশা পর্যন্ত এই খেলায় প্রতিভাত হয়। লেখক এই খেলার মাধ্যমে ভিন্ন আঙ্গিকে একটি মহল্লায় তথা সমগ্র দেশে সাধারণ মানুষের অস্তিত্বের সংগ্রামকে পুননির্মাণের চেষ্টা করেছেন এবং সফল হয়েছেন। ‘প্রথম বয়ান’ (২০০২) গল্পে আবদুর রহমান শেপালি আকতারের প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অনেকটা খেয়ালের বশেই। পরবর্তীতে কৈশোরের সে প্রেম খুঁজে বেড়ায় সারাজীবন। শেপালি আকতার ‘দান দান তিনদান’ চেষ্টার পরও যখন আবদুর রহমানকে চম্পা ফুলের ডাল দিতে পারেনি তখন তার অভিমান হয় এবং পরিবারের বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে তার বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র। আবদুর রহমানের কাছে বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়েই থাকে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হানাদারদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ভূতের গলির বাসিন্দারা জিঞ্জিরায় আশ্রয় নেয়। তখন কোনো এক রাতে তাদের দুজনের দেখা হয় এবং শেপালির মুখে চম্পাফুলের গল্প শুনে ‘আবদুর রহমানের মনে হয়তো দুঃখ জেগে ওঠে, অধিকারের ভেতরকার পাকা আম পঁচে গেলে যে দুঃখ হয়, সেই দুঃখ, সেই শোক’। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের একরাত্রি গল্পের নায়কের কথা। কৈশোরে সুরবালাকে হেলায় হারনোর পর উকিল রামলোচন রায়ের স্ত্রী হিসেবে যখন তাকে আবিষ্কার করে তখনই নায়কের আত্মপীড়ন শুরু হয়। এতকালের আত্মপ্রবঞ্চনার খতিয়ান নিয়ে ‘বানের জল’ থেকে বাঁচতে প্রলয়রাত্রে সুরবালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এবং কোনো কথা না বলে ফিরে যাওয়াকেই সে জীবনের পরম পাওয়া বলে মনে করে।

অনেক দীর্ঘ লিখে ফেলেছি, আসলে আরো কত কিছুই তো লেখার বাকী আছে। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশটাকে নিজের বলেই জেনে এসেছি কিন্তু এই কদিনে এত বিষ বাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে চেনা মানুষগুলোকেও ভীষণ অচেনা ঠেকছে। এত দ্বেষ এত ঘৃণা জমেছিল মানুষের মনে আগে বুঝিনি। আমি রাজনীতি বুঝিনা, ইনফেক্ট রাজনীতি বুঝতে চাইও না। চারদিনে কলকাতা দখল কিংবা সেভেন সিস্টার দখল করার গল্প শুনে কষ্ট পেলেও আমি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাতে চাইনা। শুধু বলতে ইচ্ছে করে শহীদুল জহিরের প্রথম বয়ানের ভাষাতেই-‘ সুরবালা তোমার কী না হইতে পারিত’- এই বোধ আবদুর রহমানকে তাড়িয়ে বেড়ায় এবং বহুবছর পরেও ‘কেরোসিন বাত্তি খোঁজার ছলে’ তার বাল্যপ্রেমকেই খুঁজে বেড়ায়। কারণ “আবদুর রহমানের হয়তো এক শোক হয়। যে ঘটনা ঘটার সময় বোঝা যায় না, পরে বোঝা যায়, তার জন্য শোক করা ছাড়া আর গতি কী? ভূতের গলিতে আবদুর রহমান এই অবস্থায় পড়ে ‘চাপা খায়া থাকে’।

নিরন্তর ভালো থেকো। পরশু কয়েকদিনের জন্য পাহাড়ে যাবো আশা করি সেখান থেকে ফিরে এসে দেখবো তোমার চিঠি অপেক্ষা করছে নতুন কোন আলো নিয়ে।

ইতি-
বাসু
১৫ জানুয়ারি,২০২৫

বিঃদ্রঃ নতুন বছরে কি এখনো বই কেনো নতুন কি কি বই কিনলে জানিও। ফেব্রুয়ারি মাসে তো তোমার জন্মদিন, বুড়ি হয়ে যাচ্ছো সুস্মি! কেমন লাগছে? চিরনতুন বৃদ্ধাকে অগ্রীম জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in









বের্নহার্ডের বাবা মা এই অবিশ্বাসের ব্যাপারটা অনুভব করেছেন, কিন্তু বুঝতে পারছেন না যে সমাজে তাদের চেনা লোকজনেরা সবাই কেন ছেলেটাকে ঠিক নির্ভরযোগ্য বলে মনে করছে না। গোটা ব্যাপারটা তাদের রাগিয়ে দিয়েছিল। প্রথমে তারা নিজেদের আত্মীয়বন্ধুদের উপরে রেগে গিয়েছিলেন। কারণ এর ফলে তাঁদের অভিভাবকত্বের গরিমা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। কিন্তু পরে তারা খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পেরেছেন যে বের্নহার্ডের আচার আচরণের মধ্যে উদ্ভট কিছু জিনিস আছে এবং এটা বুঝতে পেরেই তারা শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। বিশেষত বের্নহার্ডের মা, তিনি যথেষ্ট ভদ্র এবং বুদ্ধিমতী মহিলা, যিনি লক্ষ্য করেছেন যে বের্নহার্ড ক্রমশ তাঁর কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। তিনি ভেবেছিলেন যে তিনি বের্নহার্ডকে বেশ ভাল বুঝতে পারেন এবং ছেলের স্বভাবচরিত্র কতকটা তাঁরি মত হয়েছে। কিন্তু যত সময় গড়াচ্ছে, এটা বোঝা যাচ্ছে যে বের্নহার্ড একটু আলাদা রকমের আচরণ করছে। এটা বুঝতে পেরে বের্নহার্ডের মায়ের মনে প্রশ্ন জাগছে যে তবে কি ছেলে তাঁকে এড়িয়ে যেতে চাইছে আজকাল? ছেলে ঠিক কী করছে, সেটা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তাঁর হৃদয় সব সময় বের্নহার্ডের জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকছে। ছেলের এভাবে দূরে সরে যাওয়াটা তিনি মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। ছেলের জন্য দু’ হাত বাড়িয়ে প্রস্তুত তিনি, অথচ মনে আশঙ্কা যে ছেলে আর ফিরে আসবে না আগের অবস্থানে। কোথাও কি একটা ভয় আর তিক্ততা তৈরি হয়ে যাচ্ছে? কেন? কোথায় সমস্যা? মায়ের কাছে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। কেউ যদি এসব তাঁকে জিজ্ঞেস করে… তিনি উত্তর দিতে পারবেন না এবং তাঁর চোখ দিয়ে নীরবে অশ্রুপাত হতে থাকবে।

এদিকে আবার বের্নহার্ডের বাবা সঠিকভাবেই জানেন যে বের্নহার্ডের চরিত্রের সমস্যা ঠিক কোথায়। তাঁর মতে, বের্নহার্ড যথেষ্ট সপ্রতিভ এবং ভাল ছেলে; তবে বেশি স্বাধীনতা বের্নহার্ডের বিপদ ডেকে আনতে পারে। কারণ, সে সহজে অন্য মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায়। ফলে তাঁকে যথাশীঘ্র সম্ভব ক্ষতিকারক সঙ্গ থেকে বের করে নিয়ে আসা দরকার এবং ভবিষ্যতে যাতে তাঁর আচরণ বিপজ্জনক না হয়ে ওঠে, সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। সেটা তেমন কিছু কঠিন কাজ নয় বের্নহার্ডের বাবার মতে। বের্নহার্ডের ঠাকুমাও ছেলের সঙ্গে এই ব্যাপারে সহমত হলেন। তারপর অবশ্য তিনি চলে গেলেন নিজের ঘরে, কারণ সময় প্রায় রাত বারোটা এবং বের্নহার্ডের বাবা বললেন যে তিনি বের্নহার্ডের জন্য অপেক্ষা করতে চান।

দু’টো বাজল। বের্নহার্ড ফেরেনি এখনও।

বের্নহার্ডের দু’ চোখ ভর্তি ঘুম। শরীরে ভীষণ ক্লান্তি। সে গের্টের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন তাঁকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে বাড়ি পাঠানো অসম্ভব ব্যাপার, ভাবছিল ইনেস। গের্ট যদি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়।

বের্নহার্ডের খুব ভাল লাগছিল। ইনেস তাঁকে ঘুম থেকে তুলবার জন্য চুম্বন করছিল। শুধু তাই নয়, ঘুম থেকে উঠে যখন আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বের্শেন ফরাসি ভাষায় বিড়বিড় করছিল, তখন ইনেস তাঁর দুটো কান ধরে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে তাঁকে অন্তত আরও তিনবার চুমু খেয়েছিল। নিজেকে আদুরে খরগোশের মত মনে হচ্ছিল বের্শেনের। গের্ট নিজের বড় কোটের ভেতরে মালপত্র প্যাক করবার মত করে তাঁকে ঢুকিয়ে নিয়ে প্রায় টানতে টানতে একতলায় নামিয়েছিল। তারপর বের্শেন গাড়িতে আধঘুমন্ত অবস্থায় নিজেকে ইনেস আর গের্টের মাঝখানে বসে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করেছিল। খুব ভাল লাগছিল তাঁর; ইচ্ছে করছিল যেন প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে এই গাড়ির যাত্রাপথ অনেক দীর্ঘ হয়।

বের্নহার্ডের বাবা বাড়ির সামনে একটা গাড়ি থামার শব্দ পেয়েছিলেন। নিজের ঘরের দরজা খুলে ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পেলেন যে একতলার আলো জ্বলে উঠল এবং কয়েকজন ঢুকল। তিনি তাড়াতাড়ি ছায়ায় সরে গিয়ে নিচে কী হচ্ছে সেটা দেখতে লাগলেন। লম্বা একহারা চেহারাটা দেখে তিনি গের্টকে চিনতে পারলেন। গের্ট প্যাকেট খুলবার মত করে একটি ছেলেকে মোটা কোটের ভেতর থেকে বের করছে, সে নিঃসন্দেহে বের্নহার্ড। পাশে ইনেস দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর হাতে বের্নহার্ডের নিজের কোট। গের্ট তারপর বের্নহার্ডকে প্রায় টানতে টানতে একতলায় ঘরের সামনে এনে দাঁড় করালো। কাজটা করতে যথেষ্ট শক্তি প্রয়োজন। বের্নহার্ড তারপর ইনেসের হস্তচুম্বন করল। উত্তরে ইনেস বের্নহার্ডের মাথার চুলে আলতো টোকা দিল। তারপর বেশ জোরে জোরে বলে উঠল... ‘গের্ট, তুমি বের্শেনকে দোতলায় তুলে দিয়ে এসো। আমি বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করছি।’ তারপর বের্নহার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুভরাত্রি বের্শেন! আগামীকাল ভাল ভাবে স্কুলের ক্লাস কোর।’

বের্নহার্ড, যাকে খুব ঘুমন্ত দেখাচ্ছে, সে ধীরে ধীরে গের্টের হাত ধরে এবং গের্টের কাঁধে মাথা রেখে উপরে উঠে এল।

বের্নহার্ডের বাবা কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে, গের্ট এবং ইনেস কেউ তাঁকে দেখে ফেলবার আগে, যতটা নিঃশব্দে সম্ভব, সেইভাবে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন।

বের্নহার্ডের সঙ্গে তাঁর বাবার কথোপকথন মোটেই সুখপ্রদ ছিল না। অবশ্য সেটাকে ঠিক কথোপকথন বলা চলে না। কারণ, বের্নহার্ড সেরকম কোনো কথাই বলেনি। এমনকি যে ক্ষেত্রে আপত্তি জানাবার প্রয়োজন ছিল, সে ক্ষেত্রেও বের্নহার্ডের বক্তব্য অনেকখানি ক্ষমাপ্রার্থনার মত শোনাচ্ছিল।

সেই মুহূর্তে বাবা মায়ের ভাবনা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু সেই কারণে যে তাঁর মা এতখানি কষ্ট পেয়েছেন, সেটা শুনে সে ভারি আশ্চর্য হয়েছিল। সে এইভাবে ভেবে দেখেনি ব্যাপারটা। এ কথা, সে কথা বলতে বলতে তাঁর বাবা হঠাৎ প্রশ্ন করলেন যে ইনেস কখনও বের্নহার্ডকে চুম্বন করেছে কি না। বের্নহার্ড এই প্রশ্নে ভয়ানক ঘাবড়ে গেল। তাড়াতাড়ি বলে দিল যে না, সেরকম কিছু হয়নি। তাঁর মনে হয়েছিল সেটা বলাই সঠিক কাজ। তাঁর নিশ্চিত ধারণা ছিল যে নাহলে তাঁর বাবার ইনেস সম্বন্ধে খারাপ ধারণা হবে। তাছাড়া ইনেস তাঁকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঘুম থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসবার জন্যই চুমু খেয়েছিল সেদিন। নাহলে সাধারণ ভাবে এরকম কিছু ঘটে না। কিন্তু বাবা প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলেন তাঁর জবাব শুনে এবং পরবর্তী প্রশ্নটা করতে তাঁর অনেকটা সময় লাগল। রাগত স্বরে বলে উঠলেন তিনি…

-‘তোমার লজ্জা করে না সারাক্ষণ মিছে কথা বলে যেতে?’



(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in





একুশ

আজ সুনীতা গ্রামের বাড়ি যাবে। সে পরিবারের সঙ্গে বাসস্টপে এসেছে ব্যাগপত্তর নিয়ে। সুনীতাকে দেখে অতনু কাছে এল। অতনুর মা বললেন, সুনীতার মুখে তোমার কথা শুনেছি। আজকে তোমাকে ছাড়ছি না। আমাদের সঙ্গে গ্রামের বাড়ি পুজো দেখতে চল। অতনু বলল,আমি অনাথ পুজোবাড়িতে আমার স্থান হবে? সুনীতার মা বললেন, কে বললো তুমি অনাথ। তুমি আমাদের পরিবারের একজন হলে। আমরা আছি, চল। অতনু তার সঙ্গিদের বললো, আমি পুজোয় গ্রামে যাচ্ছি। তোরা সাবধানে থাকিস।

গ্রামের পুজোবাড়িতে আরতির বাজনা বাজছে। ধুনোর গন্ধে পুজোবাড়ি মাতোয়ারা। আর একটু পরেই ধুনুচি নাচ শুরু হবে।

সুনীতা ধুনুচি নাচ নাচছে। ধুনোর গন্ধে অতনু খুশি। একটা শিহরণ তার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। সুনীতার চোখ তার দিকে। সুনীতার মা অতনুকে হাত নেড়ে হাসিমুখে ডাকছেন। সুনীতার মায়ের মুখটা ঠিক দুর্গা প্রতিমার মত। তার চোখের দিকে তাকিয়ে অতনু এই প্রথম বলে উঠলো, মা, মা গো...।

রাজুকে বিপিন তার বাড়ি নিয়ে আসে,গল্পগুজব করে।সে বলে,তোমার যখন ইচ্ছে হবে আমার বাড়ি আসবে। এবার পুজোয় আমরা আবাডাঙা যাব।বিপিন বলে,শুনেছি ওখানে পটের ঠাকুর পূজিত হন।রাজু বলে,হ্যাঁ।দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল।রাজু বিপিনকে নিয়ে এল আবাডাঙা।সে বলল,বীরভূমের আবাডাঙা গ্রামে বাড়ুজ্জে পরিবারের পটের পুজো বিখ্যাত। পটের দুর্গা,পটের লক্ষী,পটের কার্তিক নানা জায়গায় পূজিত হন। পাটের থিম "পট ও পুতুল এর মাঝে এস ই ও " মূলত প্রতিটি জেলার হস্তশিল্পের তাদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ।থিমটি প্রথমবারের মতো বাংলার ২৩টি জেলার প্রতিটি হস্তশিল্পের সারমর্ম। সমৃদ্ধসাংস্কৃতিক এই ঐতিহ্যকেই মূলত তুলে ধরতেই চেয়েছে এসইও।এসইও র এই উদযাপন শুধু বাসিন্দাদের জন্যই নয়।ঘরের মেয়ের এই আগমন উৎসব সমস্ত দর্শকদের উপভোগের জন্যও সমান খোলা থাকে। ভাস্করশিল্পী প্রদীপ রুদ্র পালের হাতে এবার তৈরি হচ্ছে তাদের মাতৃমূর্তি।দূরদূরান্ত থেকে লোক ছুটে আসে সিলভার ওকের এমন নির্মল ও কল্যাণময় মাতৃমূর্তি দেখতে। সারল্যই এই মূর্তির বৈশিষ্ট। মা পরে থাকেন সুতির শাড়ী। সহজ সরল গ্রাম্য মেয়ের সাজে সেজে ওঠেন ওখানে মা। সঞ্জায় দাসের সৃজনশীল নির্দেশনায় এবার সেজে উঠছে সিলভার ওকের মন্ডল। আলোকসজ্জ করছেন এবারে বিশ্বজিৎ সরকার। প্যান্ডেল ডিসাইনের দায়িত্বে আছেন সুরজিৎ সেন।

পূজার সময় একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে এবার। তাদের মধ্যে

প্রথম হলো আনন্দমেলা উৎসব এই উৎসবে বাড়ির শেফরা তাদের রান্নার দক্ষতা প্রদর্শন করবেন ।

দ্বিতীয়ত আবাসিকদের জন্য থাকছে ঘরোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, যেখানে নাটক, আবৃত্তি, নাচ, গান প্রভৃতি পরিবেশন করতে পারবেন ৮ থেকে ৮০ সকলে

তৃতীয়ত স্বনামধন্য গায়ক অনীক ধর ও উর্মি চৌধুরী আসছেন এই পুজোয় গান গাইতে।

চতুর্থত থাকছে মহাভোজ। এই চারদিন আবাসিকরা মণ্ডপেই পুজোর ভোগ খাবেন। আর খাওয়া দেওয়ার সাথেই চলতে থাকবে আড্ডা।

ভগ্নপ্রায় মন্দিরেই পুজো পান দেবী পটেশ্বরী। বর্ধমান রাজবাড়িতে যখন রাজা রাজত্ব করতেন তখন সাড়ম্বরে পূজা পেতেন দেবেন পটেশ্বরী। কিন্তু এখন সেই পুজোর জৌলুস খানিকটা মলিন হয়েছে। অতীতে বহু মানুষ এই পুজো দেখতে ভিড় জমাতেন। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসত এই বাড়ির পুজো দেখতে। বর্ধমান রাজার তৈরি লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ ঠাকুরের বাড়িতে পুজো হতো।

এই পুজোতে বাড়ির মহিলারা কখনই সবার সামনে আসতেন না। গোপন রাস্তা দিতে তাঁরা মন্দিরে আসতেন এবং সেখানকার দ্বিতলে বসে পুজো দেখতে। পুজোটা আজও হয়। কিন্তু যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মন্দির প্রায় ভেঙে গিয়েছে। গত দুই বছর করোনার কারণে জনসাধারণ এই বাড়িতে প্রবেশ করতে পারেনি।
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৮.২

গ্রামসভার প্রধান হতে হলে শনিচরকে আগে জনগণকে বোঝাতে হবে—দেখ ভাইলোগ, আমি কিন্তু কারও চেয়ে কম ধূর্ত নই। আমাকে নেহাত ভালমানুষ ভেবে ভোট না দেয়ার ভুল করে বোস না যেন!

ও ভাবছিল যে গাঁয়ে কোন বড় কাজ করে দেখাবে। রঙ্গনাথের থেকে শুনেছে ভোটের আগে বড় বড় নেতারা নিজের নির্বাচন ক্ষেত্রে কোত্থেকে যেন কী এক কায়দায় টাকার বাণ্ডিল ঠেলাগাড়ি করে নিয়ে যায়। তারপর জনকল্যাণের নামে ওসব নর্দমায় ফেলে দেয়। শনিচরও অমনই কোন ম্যাজিক দেখাবে। এসব ও বৈদ্যজী মহারাজকে জানায় নি। শেষে এই কাজের জন্য কালিকাপ্রসাদ নামের এক ‘গঞ্জহা’কে নিজের দোসর বানিয়ে ফেলল।

কালিকাপ্রসাদের পেশা হল সরকারি গ্রান্ট এবং ঋণ গিলে ফেলা। ও সরকারের পয়সার ভরসায় এবং সরকারি পয়সার জন্যে বাঁচত। এই পেশায় সাহায্য পেত তিনজনের থেকে--এই অঞ্চলের এম এল এ; খদ্দরের পোশাক এবং এই কথাটি---‘ না না, এখন টাকা ফেরতের কথাই বলবেন না। আপনার যাতে ঋণ আদায়ের কাজ কিছুদিন চেপে রাখতে অসুবিধে না হয় তার জন্য উপরমহলে দরখাস্ত করে দিয়েছি’।

আমার চোখে ও হল গাঁয়ের সবচেয়ে আধুনিক লোক। কারণ ওর পেশাটি আধুনিক কালের। ও একেবারেই প্রেমচন্দের গল্পের নায়ক নয় যে খাজনা আদায়ের সরকারি আমলাকে দেখলে ঘাবড়ে গিয়ে ঘরের ভেতর লুকিয়ে পড়বে আর বৌকে বলবে—দরজায় যম দাঁড়িয়ে আছে।

ও সেইরকম নায়ক যার বাড়িতে হাজার টাকা আদায়ের জন্য বাড়িঘর নীলাম করতে সরকারি আমিন এসেছে। তবে আমিন দাঁড়িয়েছে বারান্দার নীচে আর খোশামদ করছে, কিন্তু আমাদের নায়ক বারান্দায় নিশ্চিন্ত হয়ে বসে রয়েছে। উলটে আমিনকে বলছে—‘আপনার নীলাম বন্ধ করতে কষ্ট হচ্ছে? তাহলে বলুন, উপর থেকে লিখিয়ে আনি’!

কালিকাপ্রসাদের পুরো কর্মযোগ সরকারি স্কীমের ফিলজফির উপর টিকে রয়েছে। যেমন, মুর্গীপালনের জন্য গ্রান্ট দেয়ার স্কীম বেরোল তো ও ঘোষণা করল-- মুর্গী পুষবে। একদিন ও বলে দিল---‘জাতপাত সব ফালতু। বামুন হই বা চামার, আমরা সব্বাই এক’।

এর পেছনের কারণটা হল সরকার চামড়া পালিশের জন্য গ্রান্ট দেবে বলেছে। ব্যস্‌, চামারের দল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এদিকে কালিকাপ্রসাদ চামড়ার গ্রান্ট আদায় করে নিজের গায়ের চামড়া আরও চকচকে করে ফেলল। এইভাবে ও একের পর এক জৈবসার তৈরির গর্তকে পাকা করার, ঘরে ঘরে ধোঁয়াহীন উনুন লাগানোর এবং নতুন ধরনের পায়খানা বানানোর গ্রান্ট আদায় করে ফেলল। সরকার কাজ কতদূর হয়েছে জানতে চাওয়ায় ও অনায়াসে যেমন রিপোর্ট চাই তেমনটি লিখে জমা করে দিল।

একই অবস্থা সরকারি কর্জা এবং তাকাভি বা চাষের জন্য নেয়া নগদ ঋণের। ওর ছিল পাঁচ বিঘে জমি। সেটাকেই জামিন রেখে পঞ্চাশ রকমের ঋণ নেয়া হয়েছে। তিনি প্রত্যেক সরকারি যোজনাতেই ঋণের টাকা নগদে চান, প্রত্যেক হাকিম তাঁকে নগদে দেয়ার সুপারিশ করেন, প্রত্যেকবার ওকে নগদ ঋণ দেয়া হয় এবং প্রত্যেকবার টাকা আদায়ের সময় সরকারি কদম উপরের নির্দেশে থেমে যায়।

ওর জ্ঞান ছিল বিপুল এবং বিশদ। যোজনা আয়োগ গ্রান্ট বা ঋণ দেবার জন্য কোন নতুন স্কীম খালি ছকে ফেলার দেরি, দেখা যাবে শ্রীমান এর মধ্যেই সেটার হাড়হদ্দ জেনে বসে আছেন। হতে পারে ওর চালচলন খানিকটা গেঁয়ো, কিন্তু যেসব ব্যবসায়ীরা নতুন বাজেট আসার আগেই ট্যাক্সএর খুঁটিনাটি জানতে পারে – উনি তাদের থেকে চতুর। উপর থেকে টাকা পয়সার স্যাংশন আসার আগেই দরখাস্ত নিয়ে জেলা- অফিসে হাজির। দেখা যাবে, আগামী দিনে কী কী নতুন স্কীম আসছে ও সেসব হাকিমদেরও বুঝিয়ে ছেড়েছে!

এমনই কালিকাপ্রসাদ এখন শনিচরের নতুন সহকারী।


গোড়ার দিকে যে ময়দানের কথা বলেছিলাম তার সবটাই ভূদান যজ্ঞে আহুতি দেয়া হয়নি। একটা টুকরো বেঁচে গেছল। তার বেশিরভাগই এবড়োখেবড়ো, যেটুকু সমতল সেটাও রুক্ষ্ম উষর। কিন্তু সরকারি কাগজপত্তরে সবটাই ‘উদ্যান’। জমিটির দশমুখী ব্যক্তিত্ব, তাই বিগত কয়েক বছর ধরে ওই জমি নানান কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

প্রতি বছর গাঁয়ে ‘বন-মহোৎসব’ পালন করা হয়। ভুল বুঝবেন না, এরমানে জঙ্গলে পিকনিক নয়, বরং উষর জমিতে বৃক্ষরোপণ। কখনও কখনও তহসীলদার সাহেব এবং বিডিও সাহেব লোকলস্কর নিয়ে মহাসমারোহে এখানে গাছ লাগাতে আসেন।

ওই জমির টুকরোকে কলেজের সম্পত্তি দেখিয়ে ইন্টারমিডিয়েট স্তরে কৃষি বিজ্ঞানের শাখা খোলা হল। ওটাকেই খেলার মাঠ দেখিয়ে শিবপালগঞ্জ গ্রামের নবযুবকদের যুবক-মঙ্গল-দলের নামে গ্রান্ট পাওয়া গেল। এই জমিটাকে শনিচর নির্বাচনের আগে নিজের কর্মক্ষেত্র হিসেবে পছন্দ করল।

গ্রামসভার প্রধান পদের নির্বাচনের প্রায় একমাস বাকি। একদিন ছোটে পালোয়ান বৈদ্যজীর বৈঠকখানায় বলল, ‘শনিচর তিনদিন ধরে কালিকাপ্রসাদের সঙ্গে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজকে খবর পাওয়া গেল যে মামলা সেট হয়ে গেছে’।

বৈদ্যজী তক্তপোষে সমাসীন ছিলেন। খবরটা শুনতেই মনের ভেতরে কৌতুহল ছটফটিয়ে উঠল। কিন্তু বেশি আগ্রহ দেখানো আর ‘ছোটে’কে খোলাখুলি জিজ্ঞেস করা—দুটোই ওনার সম্মানের পক্ষে অনুচিত। তাই উনি রঙ্গনাথকে বললেন—‘শনিচরকে ডেকে আনা হোক’।

ছোটে পালোয়ান নিজের জায়গায় দাঁড়ানো অবস্থাতেই হাঁক পাড়ল—‘ শনিচর, শনিচর, শনিচর হো-ও-ও’!

যে লোকটি দৃষ্টিপথের এবং হাতের নাগালের বাইরে, তাদের ডাকার জন্যে শিবপালগঞ্জে এক বিশেষ পদ্ধতি প্রচলিত। এই পদ্ধতির প্রয়োগের জন্য তিনটে জিনিস দরকার—গলার নির্লজ্জ জোর, মজবুত ফুসফুস আর বিশুদ্ধ গোঁয়ার্তুমি। এই পদ্ধতির প্রয়োগের পেছনে পাক্কা বিশ্বাস হল যাকে ডাকা হচ্ছে সে যেখানেই থাকুক, তিনডাকের মধ্যে একবার তো শুনতে পাবে। যদি নাও শোনে, দ্বিতীয়বার যখন ডাক দেয়া হবে তখন তো শুনবেই। কারণ, দ্বিতীয়বারে তার নাম ডাকা হবে এভাবে—‘আরে কোথায় মরে গেলি রে! শনিচরা, শনিচরা রে’!

যেভাবে কোন ভদ্রতা ছাড়াই ছোটে পালোয়ান শনিচরকে ডাক দিল, সে ব্যাটাও ডাক শোনা মাত্র অমনই ভাবে বৈদ্যজীর দরবারে হাজির হল। ওর আণ্ডারওয়ার বিশেষ জায়গায় ফাটা, খালি গা, তবে চুল সরষের তেলে চপচপে। মুখের ভাব বেশ হাসিখুশি। এটা বোঝা মুশকিল যে কোনটার হাঁ বেশি বড়—মুখের নাকি আন্ডারওয়ারের?

এটা বলার তাৎপর্য এই যে শনিচরের মুখের বর্তমান চেহারা প্রমাণিত করছে --আমাদের মনে আনন্দ থাকলে দারিদ্র্য আমাদের দুখী করতে পারে না। অতএব, গরীবী হটাও প্রকল্পের সার কথা হল আমাদের হাসিখুশি থাকতে হবে, তবে না!

বৈদ্যজী প্রশ্ন করলেন—কী সমাচার শনিচর? শুনলাম, শহরে গিয়ে খুব কৃতিত্ব দেখিয়েছ?

শনিচর বিনম্র ভঙ্গিতে বলল, ‘হ্যাঁ মহারাজ। আমাকে বাধ্য হয়ে অনেক কৃতিত্ব দেখাতে হল। যখন সবদিক থেকে কৃতিত্ব, খুব কৃতিত্ব দেখালাম, তখন গিয়ে ‘খাপে খাপ পঞ্চার বাপ’ হল।

রঙ্গনাথের আর সহ্য হল না।

--‘আরে হেঁয়ালির ভাষা ছেড়ে আসল কথাটা বল; হয়েছেটা কী’

শনিচর দাঁত চেপে শিস টেনে বলল,’রঙ্গনাথ বাবু, এসব গঞ্জহাদের হেঁয়ালি। এত সহজে বুঝতে পারবে না’। কিন্তু এসব বলার পরে ও অল ইন্ডিয়া রেডিও’র খবর পরার ঢঙে একের পর এক হেডলাইন ও ধারাবাহিক বর্ণনা শুরু করল।

--‘গুরু মহারাজ, ওই লোকটা, যার নাম কালিকাপ্রসাদ, ও কিন্তু মহা হারামী’। কথাটা এমনভাবে বলল যেন কালিকাপ্রসাদকে পদ্মশ্রী উপাধি দেয়া হচ্ছে।

‘হাকিমের থেকে নিজের পছন্দমত রায় পেতে মুখের চেহারা কালিকাপ্রসাদের মত হওয়া চাই। দরকার পড়লে ও বড় বড় ভাষণ ঝাড়তে পারে, কান-লেজ সব নাচিয়ে মুখ থেকে আগুন ছড়াতে পারে। এক নিঃশ্বাসে পাঁচ-পাঁচ সাত-সাত এমএলে’র নাম নিতে পারে। আর হাকিম বেচারার মুখ খোলা থাকে, বন্ধ হয় না। ওই সময় কেউ কালিকাপ্রসাদের লাগাম টেনে ধরুক দেখি!

‘কিন্তু মহারাজ, ওই কালিকাপ্রসাদ যদি কোন এঁড়ে হাকিমের মুখোমুখি হয়, তখন প্রথমেই কেঁচোর মতন নরম এবং বাঁকাচোরা হয়ে যায়। বলব কি মহারাজ! মাটির দিকে চোখ রেখে এমন ভূ-দানী নমস্কার করে যে হাকিমও ভাবতে থাকে লোকটা কে? বিকাশভাই নাকি প্রকাশভাই? বুদ্ধিতে চাণক্য কিন্তু এমন ভোঁদা চেহারা করে দাঁড়িয়ে থাকে যে কারও সাধ্যি নেই ওর আসল রূপ টের পায় ! বড় বড় বুদ্ধিমান ওকে বোকা ভেবে খারিজ করে দেয়। আর তখনই ও পেছন ত্থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

‘আর গুরু মহারাজ, ওর দাঁও-প্যাঁচেরও বলিহারি! এ-হে- হে! সরকারি অফিসে চাপরাশি থেকে বড়বাবু, আর বড়বাবু থেকে হাকিম—সর্বত্র ওর অবাধগতি। ও একটি ঘুণপোকা, পাক্কা ঘুণ! যে ফাইলটা বলবেন সেটাতেই ঢুকে চেটেপুটে বেরিয়ে আসবে।

‘শিবপালগঞ্জের মুখ উজ্বল করেছে।

‘গুরু মহারাজ, আমাকেও বেশ কেরদানি দেখাতে হয়েছে। কিন্তু কালিকাপ্রসাদ না থাকলে আমি টানাটানি করে একগাছি ছিঁড়তে পারতাম না। ও নিজেও আমার সঙ্গে থেকে তিনদিন ধরে গোটা শহর চষে বেড়িয়েছে। এমন হয়েছে যে বড় বড় রিকশাওলাও হার মেনে গেছে।ও কিন্তু তৈরি, বলে এখানে কাজ না হলে চলো ওখানে যাই। ওখানে না হলে ফের সেখানে চলো। পুরো শহরের নকশা মুখস্থ হয়ে গেল!

‘গুরুজী, কিছু আক্কেল তো আমারও আছে। বলতে গেলে বুদ্ধিটা আমারই। তার জেরে গাড়ি লাইনে এল। কিন্তু সেটা চালাতে লাগল কালিকাপ্রসাদ। আপনার দরবারে ওঠ-বোস করে করে আমিও কিছু দাঁও-প্যাঁচ শিখেছি। কথায় বলে—কুস্তির আখড়ায় রোজ লাথি খাওয়া লোকও একদিন পালোয়ান হয়ে ওঠে। বদ্রী ভাইয়ার আখড়া থেকে যেমন ছোটে পালোয়ান হয়েছে। তেমনই কিছু বিদ্যা আমার পেটেও ঢুকেছে।

‘ তো জানতে পারলাম যে আজকাল সমবায় আন্দোলনের হাওয়া বইছে। ব্লক অফিস থেকে একজন এডিও* এসে বলল—নিজের চাষের জমিকে ‘নিজের’ বলবে না। সবার খেতকে তোমার খেত বলো আর নিজের খেতটিকে সবার খেত বল। তবে গিয়ে সমবায় চাষ সম্ভব হবে আর খুব ফসল ফলবে।

‘আমি বললাম—এ তো মন্দ নয়! আমি গ্রামসভার প্রধান হয়ে গেলে সমস্ত খেত সরকারকে দিয়ে দেব। বলব-- নাও, সমবায় চাষ কর।

কিন্তু এডিও বলল—সরকার তোমার খেত নিয়ে কী করবে? চাষের খেত কী কল-কারখানা? খেত তোমারই থাকবে, চাষ তুমিই করবে। একটু কাগজের পেট ভরে দাও, তাহলেই চাষবাস সরকারি হয়ে যাবে। গাঁয়ে কু-অপারেটিব ফারম খুলে যাবে। শিবপালগঞ্জ সব বাপারে এগিয়ে। এই বিষয়েও সবার আগে হবে।

‘গুরু মহারাজ! আমি ভাবলাম, শিবপালগঞ্জ এগিয়ে যাক কি পিছিয়ে—আমাকে তো গুরু মহাআরাজের হুকুম মেনে চলতে হবে। প্রধান হবার জন্য দাঁড়িয়েছি, তো প্রধান হয়েই ছাড়ব। আমি এডিওকে বললাম- সাহেব, শিবপালগঞ্জকে কতটুকু চিনেছ? আমাদের পেচ্ছাপ কারও থেকে পাতলা নয়। আমরা সব ব্যাপারে এগিয়ে আছি, এগিয়ে থাকব। তাই এডিও সাহেবকে আমড়াগাছি করে বললাম—মামলা শুকনো, নাকি ভেজা? ও স্বীকার করল।

‘তখনই গুরুজী, আমার কালিকাপ্রসাদের কথা মনে পড়ল। ভাবলাম—হে বজরঙ্গবলী! তুমি কালিকাপ্রসাদকে তো উজাড় করে দিয়েছ। এবার তোমার ভক্ত এই বাঁদরটার কিছু গতি করে দাও। সব টাকাপয়সা কেবল কালিকাপ্রসাদের ঘরের দিকেই ছুটে যায় কেন? বজরঙ্গবলী, একবার আমার ঘরের পথেও কিছু পাঠাও”।

* এডিও=এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট অফিসার।

‘ব্যস্‌, বজরঙ্গবলীর ধ্যান করে লাল ল্যাঙোট বেঁধে আমিও কালিকাপ্রসাদের ঘরে হাজির। কালিকাপ্রসাদের সঙ্গে কোন ছ্যাঁচড়ামি করিনি। নিজেকে বললাম-বেটা শনিচর, ‘খুল্লা খেল ফারুকাবাদী’ খেলো! তবে কাজ হবে। আমরা দুজনে মিলে এমন এক ইস্কীম বানালাম যে ব্লকের এডিও-ফেডিও সবার হাগু নরম, পেট সাফ। এডিও পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন—এই না হলে গঞ্জহা! কাল কথা হয়েছে আর আজ ইস্কীম তৈয়ার।

‘গুরুজী, হয়েছে কি এই গাঁয়ে একটা কুওপারেটিব ফার্ম খুলবে। এ তল্লাটে কোথাও এই ফারম নেই। পশ্চিম দিকের উষর জমিতে ফারম দুলে উঠবে। উষর হয়েছে তো কী! কাগজপত্তরের কাজগুলো ব্লকওলারা সামলে নেবে। কাগজের ব্যাপারে ওরা তহসীল অফিস বা থানাদারের বাপ! বলুন তো আকাশে কুওপারেটিব বানিয়ে দেবে, এ তো সামান্য ধরতীর মামলা।

‘শহরে গিয়ে সব ফিট করে এসেছি। ভাবলাম, আপনি তো গত বছর কলেজে এক মিনিস্টারকে ধরে এনেছিলেন। এবার আমিও এক মিনিস্টার আনবো। তবে এই কাজটা আপনি ছুঁয়ে না দিলে হবে না। কিন্তু কালিকাপ্রসাদ বলল—এর জন্য মিনিস্টার কেন, হাকিমকে পটাও। কাজ হওয়া নিয়ে কথা।

‘এরপর তো সব কালিকাপ্রসাদের এলেম। শহরের নানা জায়গায় ঘুরে ও কখনও মুখ থেকে আগুন উগরে দিচ্ছে , তো কখনও একেবারে কেঁচো হয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে। ওখানে টের পেলাম কালিকার কেমন চেনাজানা! কত জায়গায়! ও ঠিক বলেছে – যাই হোক, হাকিমই সব । ও এমন একজন হাকিমকে পাকড়েছে যার খুব মালা পরার ও লেকচার দেয়ার শখ। সকাল থেকে গলায় দশটা মালা চড়ার আগে ও দাঁতন করে না। আছোঁচা মুখে বসে থাকে।

‘তাহলে গুরুজী, মাথায় তো দশটা কাজের বোঝা চাপিয়েছি। তিন দিনের পরেই এখানে ফারমের সভা হবে। সামনে আপনিই থাকবেন। জলসা-বাদ্যি, মালা-সামিয়ানা, ফটো-টটো এসব ব্লকওলারা সামলে নেবে। কিন্তু আমাদেরও জোরদার ব্যবস্থা করতে হবে। খাবার ব্যাপারে মটর-ঘুগনিতেই কাজ চলে যাবে। হাকিম বলেছেন উনি চাষিদের সঙ্গে বসে চাষিদের মত করে খাবেন। আমরা বুঝেছি- গুরু, যার মত করেই খাও, আসলে তুমি না খেয়ে ছাড়বে না! মটর তো শহর থেকে আনাতে হবে, এখানে মটর কোথায়’?

শনিচর তো জলসার ব্যবস্থার কথায় মত্ত, ছোটে পালোয়ান দিল ধমক।

--‘এবার মটর নিয়ে সটর সটর থামাও। কাজের কথা বল। হাতে কী এল’?

শনিচর নিস্পৃহভঙ্গীতে বলল, ‘আমার হাতে কী আসবে, পালোয়ান? যে সুসাইটি তৈরি হবে ফারমের কাজ শুরু করতে ওকে পাঁচশ’ টাকা দিতে হবে। সব জায়গায় এটাই রেট। যা পাওয়ার, সুসাইটি পাবে’।

ছোটে পালোয়ান ঠা-ঠা করে হাসল। ‘ বাহ্‌ রে বেটা মঙ্গলদাস! কী কথাই না শোনালে! কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ’!

বৈদ্যজী প্রসন্নচিত্তে সব শুনছিলেন। ওনাকে দেখেই মনে হচ্ছে ভবিষ্যত উজ্বল। উনি পঞ্চতন্ত্রের স্টাইলে একটা কিসসা শুনিয়ে শনিচরের তারিফ করে বললেন—বাঘের বাচ্চা প্রথম বার শিকার করতে বেরিয়ে একলাফে একটা সম্বর হরিণ মেরে এনেছে।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in












নবনীতা দেবসেন: নারীকেন্দ্রিক জীবনদৃষ্টি




প্রিয় বাসু,

গতকাল সন্ধ্যায় তোমার চিঠি পেলাম। আকাশ কাঁসার বাসনের মতো রঙে ধূসর হয়ে আছে। কিছু পাখপাখালি আকাশে উড়লে মনে হয় খড়কুটো উড়ছে। কর্পোরেট জীবনের ব্যস্ততায় আগের মতন পড়তে পারি কোথাায় বলো! বিগতা যৌবনা শব্দটা ব্যবহার করে খোঁচা দিলে মনে হলো তবে তা তুমি বলতেই পারো। আগের মতন রোজ কবিতা পড়া হয়না তাই বলে ভেবো না সব ভুলে গেছি। খুব প্রিয় একটা কবিতার শেষ কটি লাইন তোমার সমস্ত চিঠির উত্তর হতে পারে।

আমি তোমার হই
তুমি
আমার কোলের শিশু হ'য়ে আমাকে বরণ করো
আমাকে হরণ করো
পূরণ করো।

বিংশ-একবিংশ শতকের বাংলা সাহিত্যে নবনীতা দেবসেন একজনই। তিনি উচ্ছল, সহাস্য, সুদূরপিয়াসী, কখনো তির্যক, কখনো ক্রুদ্ধ, প্রয়োজনে কঠোর। ছেলেভোলানো রূপকথা থেকে অচঞ্চল কবিতা, সরস ট্রাভেলগ থেকে প্রশ্নাত্মক অ্যাকাডেমিক রচনা – সবকিছুতেই তাঁর অনায়াস বিচরণ। তিনি ঠিক যতটাই ধ্রুপদি, ততটাই আধুনিক বা সমকালীন। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম প্রত্যয়‘ প্রকাশ পায় ১৯৫৯ সালে। তখন তাঁর মাত্র একুশ বছর বয়স। এই কাব্যগ্রন্থের ‘বৃন্তহীন একটি গোলাপ‘ কবিতাটির কথা মনে আছে? কবিতার শুরু এই রকম: “কিন্তু, তুমি এখন তো জানো/ বর্ণ গন্ধ ফুলের জঞ্জালে/ বুক রেখে কিংবা মুখ রেখে/ কোনো লাভ নেই।” বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। কিন্তু চোখে লাগে ‘জঞ্জালে‘ শব্দটি। বর্ণ গন্ধ ফুল তাঁর পূর্ববর্তী সব কবিদের কাছে মহার্ঘ ছিল। নবনীতা এক কালোপযোগী তিক্ততা হানেন বর্ণ গন্ধ ফুলের প্রতি, ওই ‘জঞ্জালে‘ শব্দটি প্রয়োগ করে। কবিতাটিতে শুধুমাত্র ওই একটি শব্দই আধুনিকতার নিশান ওড়ায়। নবনীতা দেবসেনকে পড়তে গিয়ে কোথাও মনে হবে না প্রতিবাদী চেতনার বিস্ফোরণ আছে। দুঃসাহসী দামাল নবনীতার অকুতোভয় প্রকৃতি সেখানে ডালপালা মেলেনি। এজন্য তাঁর নারীবাদী চেতনায় বিদ্রোহী বিকার নেই, রয়েছে স্বাধিকারবোধে অসহনীয় আত্মপ্রত্যয়। ‘নারীবাদী লেখক’ তকমা আঁটাতে আপত্তি। কিন্তু, মেয়েদের অধিকার আদায়ের পক্ষে, অন্যায়ের প্রতিবাদে তাঁর প্রিয় টেম্পলপেড়ে মেরুন শাড়ির আঁচলের তলার প্রদীপটি মশাল হয়ে জ্বলে ওঠে। সে মশালের আলো ও আগুন ঝরে অক্ষরে। বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন। নিজের মতো করে বেঁচেছেন হার না-মানা প্রকৃতিতে। ব্যক্তিত্বের বহুমুখী বিস্তারে নবনীতা মা রাধারানিকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন কখনও কখনও। নবনীতার কবিতাগুলিকে মনে হয় তাঁর স্পষ্টশ্রুত স্বগতোক্তি। কবিতার মধ্যে দিয়ে নবনীতা আসলে যেন নিজের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, তাঁর সব দুঃখ-শোক বা প্রণয়বাণী নিজেকেই শোনাতে চেয়েছেন। নবনীতার কবিসত্তাতেও নারীজীবনের বহুমাত্রিক প্রতিবাদী চেতনা সবাক্‌মূর্তি লাভ করেছে। পিতৃতান্ত্রিকতা থেকে মুক্তিপিয়াসী নবনীতা ত্রাতা হিসাবে পুরুষের রাজকীয় ভূমিকাকে মেনে নিতে পারেননি। ওঁর সারাজীবনের কবিতাতেই এক অতৃপ্ত প্রেমতৃষ্ণা ধিকিধিকি জ্বলতে দেখা যায়। প্রেমের রাশ হাতে রেখে পুরুষই বলতে চেয়েছে শেষকথা, নারী বাধ্য হয়েছে তা পালন করতে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আত্মস্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে অর্জিত প্রেমের রাজদণ্ডধারী রূপ ক্রমে প্রকট হবার সঙ্গে সঙ্গে, নিঃস্বার্থ সমর্পণের অবমূল্যায়ন বুঝতে শিখেছে নারী। এর মধ্যেকার ‘ঐতিহ্যপ্রসূত’ মহনীয়তা শিকারি ও শিকারের বাস্তব সম্পর্কে জর্জরিত। প্রেমিক হলেন প্রভু, নারীর আত্মোপলব্ধি ‘শিকার’ হিসাবে। নবনীতা তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম রাখলেন ‘লায়নটেমারকে’ (১৯৮৯-১৯৯৫)। নামকরণের মধ্যে পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত। তবে এই আক্রমণ, প্রতিবাদ ধ্বনিত হল নারীর নিজস্ব যন্ত্রণার সমাজতাত্ত্বিক প্রকাশে। কবি যেন নিজের থেকে এক নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব বজায় রেখে নিজের চোখে আঙুল দিয়ে নিজেকেই চেনাতে চাইলেন প্রহার-দগ্ধ নারীর বিকৃত স্বরূপ। নবনীতার কবিতার আরও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, তার একাকীত্বের সুর। প্রেমের ডাকে সাড়া দিতে আকুল কবি। কিন্তু প্রণয়মুকুটের বদলে তাঁকে যেন চিরদিন শিরোধার্য করতে হয়েছে বিরহের বা নিঃসঙ্গতার কাঁটা। নবনীতা সেই শ্রেণির কবি, যিনি নিজের বক্তব্যকে পাঠকের কাছে জটিল অস্পষ্টতায় পেশ করতে চান না। তাই তাঁর কাব্যভাষা খুব সহজ। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, তাঁর কবিতা সবলে সমস্ত পেশি ফুলিয়ে এক অত্যাশ্চর্য শক্তিরূপ প্রকাশ করতে পারে না। বড় বিনম্র তাঁর কাব্যভাষা। তাঁর উৎকৃষ্ট কবিতাগুলির সঠিক পরিচয় পাঠককে পেতে হয় সেই নম্রতা স্পর্শ করে। কবিতার প্রচ্ছন্ন ব্যঞ্জনার ছটা আটপৌরে প্রকাশভঙ্গিতে হয় হৃদয়ের সম্পদ।

তোমাকে এত বছর পর এইসব কেন লিখছি, লেখার কোন মানে আছে কিনা তাও জানিনা। তবে তোমার চিঠি অজান্তেই উস্কে দিচ্ছে অনেক কিছু। নবনীতা দেবসেনের কোন এক লেখায় পড়েছিলাম ‘সংসারের কোনো কোনো বাসন কোসন, কাপ পিরিচ সম্ভাব্য বন্ধুরতা অতিক্রম করে বিস্ময়করভাবে বহুদিন টিকে থাকে, কিন্তু একদিন হয়ত দেখা যায় যে জন্য এত আয়োজন, সেই সংসারটাই টেকে না, সম্পর্ক ভেঙে যায়।’ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ সম্পর্কে রসিকতার ছলে এক হৃদয়গ্রাহী স্বীকারোক্তি, অনেকটা জীবন পেরিয়ে এসে মনে হয় না কি চরম সত্য খেলাচ্ছলে লিখে দিলেন? আমাদের সম্পর্কটাও…

বিদ্রোহের সরবতাই বিপ্লবের আগমনী বার্তা বয়ে আনে। অথচ সেই সরবতা উচ্চকিত না হয়েও যে বৈপ্লবিক চেতনার বিস্তার করা যায়, তা লেখিকা নবনীতা দেবসেন দেখিয়ে দিয়েছেন। নারীবাদী লেখিকা হিসাবে কখনই তিনি সরব হয়ে ওঠেননি। অথচ, তার অবকাশ ছিল। তাঁর পরিবারের মধ্যেই সে রসদ মজুত ছিল। তাঁর মধ্যে পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের বৈষম্যপীড়িত জীবনবোধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চেতনায় নারীবাদের পরিচয় নানা ভাবেই প্রকাশমুখর। ছোটবেলায় ছোট ভাই দিদিকে মারলেও দিদি মারতে পারবে না, দিদিকে তা সহ্য করার চেতাবনির মধ্যে তাঁর মেয়েদের অন্যচোখে দেখার চেতনা জেগে উঠেছিল। সমাজে পুরুষের আধিপত্যে নারীদের আনুগত্যবোধের মধ্যে তাঁর প্রতিবাদী চেতনাই তাঁর বৈদগ্ধপূর্ণ বনেদি অবস্থানে আত্মপরিচয়ের সোপান হয়ে উঠতে পারত। সেখানে তাঁর আমৃত্যু ডাকাবুকো চরিত্রপ্রকৃতিই তাঁর সঙ্গতের পক্ষে যথেষ্ট সরব ছিল। বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন।

হাসতে হাসতে এক কাপড়ে ট্রাকে চড়ে অরুণাচল সীমান্তে ভারত-চিনের ম্যাকমোহন লাইন ছুঁয়ে এসেছিলেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনি ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমোহনে’। আবার হায়দরাবাদে সেমিনারে গিয়ে কুম্ভমেলায় গিয়েছেন একাকী। তাঁর লেখনীর পরশে তাই ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’ ভ্রমণসাহিত্যে প্রতিমায়িত হয়েছে। এ ভাবে দুরারোগ্য ব্যধিকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়েছেন পৃথিবীর দুর্গম পথে, বাংলা সাহিত্যে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতায় অসংখ্য ফসল ফলিয়েছেন অবলীলায়।

তোমার মনে আছে আমাদের বমডিলা ভ্রমণের কথা। পাহাড়ের গায়ে অজস্র স্ট্রবেরি গাছে লাল স্ট্রবেরি ঝুলে রয়েছে। অয়ন, তুমি আর সোমজা পাকদণ্ডি পথে পাহাড়ের উপরে উঠে হারিয়ে গেছিলে। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি সহসাই আকাশ সোনালী রোদে ঝলমল। কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তোমাদের খুঁজে পেলাম পাহাড়ের উপরে মনস্ট্রিতে। প্রার্থনা কক্ষে শাক্যমুনি বুদ্ধের বিশাল মূর্তি। মূর্তির একপাশে অবলোকিতেশ্বর ও অন্যপাশে রিনচেংপংযের মূর্তি। মনস্ট্রির মধ্যে ছায়াছন্ন বন্য ধুপের গন্ধ বাতাসে মিশে গিয়ে এক রহস্যময় প্রাচীনত্বের আভাস ছড়িয়ে পড়ছিল। আচ্ছা, আমাদের যে দিন গেছে সে কি একেবারই গেছে?

নবনীতার গল্পে অধিকাংশ নারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তারা একদিকে আজন্ম-লালিত সংস্কারকে আঁকড়ে থেকেছে আবার সেই সংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে উত্তরণের পথ খুঁজেছে। যেমন ‘বিমাতা’ গল্পের তাপসী। তাঁর গল্পের নারীরা জীবনের কথা বলে। ‘গদাধরপুর উইমেন্স কলেজ’ গল্পের কথক একজন নারী। সে চায় আত্মপ্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তি। স্বামীর সংসারে অস্তিত্বহীন স্ত্রীর চরিত্র প্রথমদিকে তার ভালো লাগলেও একসময় খারাপ লাগতে থাকে। সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়; কিন্তু সংসার ভেঙে নয়, সংসারে থেকেই। ‘এক্সপেন্স একাউন্ট’ গল্পটিতে একজন ছোট পিসিকে পাই আমরা, যিনি বৈশ্বিক আবহাওয়ায় বদলে যাওয়া কলকাতাকে দেখে ব্যথা পান। মেনে নিতে পারেন না। সুকৌশলে তিনি চারপাশের মানুষগুলোকে পুরনো দিনের ঐতিহ্যের কথা শোনান। ‘দাদামনির আংটি’ এক সাধারণ গৃহবধূর অসাধারণ হয়ে ওঠার কাহিনি। দাদামনির আংটি চুরি গেলে এই বধূ থানায় ডায়েরি করতে যায়। থানা ডায়েরি নিতে আপত্তি করে। বধূ প্রতিবাদ করে। সাফ সাফ বলে দেয়, ডায়েরি না নিলে তিনি নিজেই কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তার নামে এফআইআর করবেন। ‘পরীর মা’ গল্পের মা নিজের সন্তানকে ঘটনাচক্রে হারিয়ে ফেললেও অন্যের সন্তানকে বুকে টেনে নেন।
‘শুভমিতা প্রোপ্রাইটার’ গল্পে শুভমিতা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেও প্রথম সন্তান শুভকে ভুলতে পারে না। এমন অনেক মানবিক বার্তা আছে তাঁর গল্পে। আবার আধুনিক গল্পও রয়েছে। ‘আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন’ তেমন একটি গল্প। এ-গল্পে এলিজাবেথ এক অসাধারণ নারী। সে অন্য পন্থায় সন্তান ধারণ করে কারো বাধা না মেনে। একটি অসাধারণ বাক্য আছে এ-গল্পে, ‘মায়ের মুখের একটা কথার ওপরে বাবার বাবাত্ব টলমল করছে। আর তো কেউ জানে না প্রকৃত বাবাটি কে!’ তাঁর গল্পে নারীর বহুমাত্রিক রূপ আমরা দেখি। গল্পের নারীরা হিংস্র নয়। পুরুষের ব্যাপারে তাদের অনীহা বা অশ্রদ্ধা নেই। প্রতিহিংসাও তারা দেখায় না। তাদের প্রতিবাদ পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। যা কিছু পুরনো তার বিরুদ্ধে। পুরনো ঐতিহ্যের মাঝে যে ভালো থাকে সেই ভালো বার্তাই পাই আমরা তাঁর সাহিত্যে।

পড়ন্ত বেলার রোদ্দুর পশ্চিমের জানলা দিয়ে লাল মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দিনগুলি আর হয়ত ফিরবে না। পিছনের দিকে ফিরে গিয়ে ভাবলে মনে হয় কোন রূপকথার গল্পে হারিয়ে যাচ্ছি। অনেকদিন ধরেই একটা সন্ধ্যাজুড়ে তোমাকে চিঠি লিখতে চাচ্ছিলাম। ‘মাঝে মাঝে ভাবি। সবই কি তাহলে মিথ্যা? সব ভাবনা কি মিথ্যা? আমি আমার আত্মাকে জিজ্ঞেস করি। আমি কত যে খুশি হতাম যদি তুমি আমার মনের এই আর্তিটাকে বুঝতে পারতে! সন্ধ্যার সব হৈ হুল্লোড়, আড্ডায় কেন জানি বড় একা লাগে মনে হয় প্রেমহীন নাগরিক জীবনে, হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে আজ সবাই খুব নিঃসঙ্গ।

রূপকথার কথায় মনে পড়ল নবনীতা দেবসেনের রূপকথা। তাঁর প্রিয় বিষয় রূপকথা। আদর্শ জীবন, আদর্শ মানুষ, আদর্শ সমাজ তৈরির সুযোগ আছে রূপকথায়। তাঁর রূপকথায় মেয়েরা কুশীলব। রানি এসে রাজাকে উদ্ধার করে। রূপকথায় পুরুষরাই চিরদিন মেয়েদের উদ্ধার করে। মেয়েদের বন্দি করে, পেটায়, কাটে আবার উদ্ধারও করে। পুরুষই তাদের কষ্ট দেয়, আবার তারাই উদ্ধার করে। মেয়েদের আসল চেহারা নেই, তারা শুধুই বন্দিনী। ছেলেদের তুলনায় প্যাসিভ। তাঁর রূপকথায় মেয়েদের পজিটিভ ও অ্যাকটিভ রোল তুলে ধরা হয়েছে। তারা উদ্ধার করে যুদ্ধ করে নয়, অস্ত্রবলে নয়, বুদ্ধির অস্ত্রবলে। কেন রূপকথা লেখেন তা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "আমার রূপকথার গল্পগুলি সেই পড়ুয়াদের জন্যে, যাদের বুকের মধ্যে শৈশব অমলিন আছে"। ‘চন্দনরাজার বউ’ গল্পে দেখা যায়, চন্দনরাজা সারাদিন মৃত্যু কোলে ঢলে থাকেন, শুধু মধ্যরাত্রে বেঁচে ওঠেন। কয়েক ঘণ্টা পর আবার মৃত মানুষে পরিণত হন। চন্দনরাজাকে এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে মুক্ত করেন রাজকন্যা চন্দনী। ‘পদ্ম কদম’-এ রাজপুত্র কদমকুমারকে পহ্লবী রাজার কারাগার থেকে জেলেবাড়ির মেয়ে পদ্মকুঁড়ি উদ্ধার করেন। ‘সুসনি-কল্মি’ গল্পে রয়েছে, গরিব দুই বোন ছাগলের দুধ খাইয়ে রাজার দুরারোগ্য ব্যাধী সারিয়ে দেন। দুই রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে হয় সেই দুই বোনের। আবার, ‘বোকা রাজার বুদ্ধিমতী রানি’ গল্পে দেখা যায়, রাজা যতবার বেরোন যুদ্ধ করতে, রানি ততবারই স্বপ্নের গল্প ফেঁদে রাজাকে বিরত করেন। রাজকর্মচারীরা বিপদে পড়লে তাঁদের পরামর্শ দিয়ে রক্ষা করেন পাশের রাজ্যের রাজকন্যা। রানির উদ্যোগের সেই রাজকন্যা রাজার বৌমা হলেন। বিয়ের পর একদিন ওই মেয়ে তাঁর শ্বশুরকে দিয়ে অঙ্গীকার করিয়ে নিলেন, তিনি কখনও আর যুদ্ধযাত্রা করবেন না। এইভাবে নবনীতা তাঁর রূপকথার গল্পগুলোতে নারীশক্তির জয়গান গেয়েছেন। ইচ্ছেমতী, রূপসা, পদ্মমুখী, পুঁটুরানী সব চরিত্ররাই যেন আসলে নবনীতার ছায়া হয়ে ওঠে। তারা যুদ্ধ করে না। অস্ত্র ধরে না। কিন্তু জয় করে নেয় শক্রুকে। শুধুমাত্র মেধা, মনন আর ভালোবাসা দিয়ে।

বৃষ্টি থেমে গেছে। শেষ বিকেলের নিস্তেজ শীর্ণ আলোতে প্রকৃতি, তার সবুজ, হলুদ, লাল, কালো নানা-রঙা নিশান উড়িয়ে দেয় আকাশে আকাশে, বহুবর্ণ গালচে বিছিয়ে দেয় জমিতে, উজ্জ্বল, অগণিত স্পন্দিত তারা আর জোনাকির ঝাড়লণ্ঠন ঝুলিয়ে দেয় আকাশের চাঁদোয়ার নীচে; অন্ধকার রাতে। জঙ্গলের মধ্যে জঙ্গল, গাছের মধ্যে গাছ, পাতার মধ্যে পাতা, ফুলের মধ্যে ফুল, স্মৃতির মধ্যে স্মৃতি সেঁধিয়ে যায়। মেয়েদের ভিতরে একটা আলাদা চোখ থাকে জানো তো? সেই চোখ দিয়ে দেখছি। তুমি গেট ঠেলে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলে না। জানো, প্রথম প্রথম তোমার কথা মনে পড়লে কী কষ্ট যে হত, তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। সেইজন্য আমি আস্তে আস্তে তোমার মুখচ্ছবিখানি বদলে দিয়েছি। এই যে পাহাড়, এই যে ছোটো নদী, ফুলের সমারোহ, প্রজাপতি এমনকি কাঠঠোকরা পাখিটির মধ্যেও ভাগ ভাগ করে দিয়েছি তোমাকে। ভাালো থেকো নিরন্তর। আশা করি দ্রুতই তোমার চিঠি পাবো।

শুভেচ্ছান্তে-

সুস্মি

২৪ নভেম্বর,২০২৪


0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in






ওরা কোনো কথা শোনে না। হাসতে থাকে সবাই। একসঙ্গে অন্তত গোটাদশেক হাত বের্শেনকে বয়ে নিয়ে যেতে থাকে। বসার ঘরে যেখানে টেলিফোন আছে, সেখানে সবাই মিলে ওকে নিয়ে যায়। সেখানে গের্ট একটা চওড়া চামড়া দিয়ে মোড়া আরামকেদারাতে বসে টেলিফোনে ডায়াল করছে। গের্ট বের্শেনকে নিজের হাঁটুর উপরে বসিয়ে হাতে টেলিফোনের রিসিভার ধরিয়ে দেয়।

‘হ্যালো’… বের্শেন কণ্ঠ থেকে বিরক্তির ছাপ এখনও মুছে ফেলতে পারেনি… ‘আমি কি ফ্রয়লাইন ইনেসের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’

কেউ একজন ওপাশ থেকে পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কে কথা বলছেন ফোনে?’

‘বের্নহার্ড’ বলে কয়েকমুহূর্ত পরে বের্নহার্ডের খেয়াল হয় যে তার একটা ডাকনাম আছে এবং ইনেস তাকে সেই নামেই ডাকে। ইনেস তাকে জিজ্ঞেস করে যে সে ঠিকঠাক আছে কি না।

-‘না’ বলে বের্শেন, ‘কিন্তু তোমার আজ আসা উচিত ছিল একবার। সবাই ভেবেছিল তুমি আসবে। গের্ট, ফার্দিনান্দ… ‘

-‘কিন্তু তাতে তোমার কী, বের্শেন?’ ইনেসের কণ্ঠস্বরে শীতলতা, বন্ধুত্বের উষ্ণতা একটু কম মনে হয়।

-‘আ… আমি জানি না, জানি না’ বের্শেন তুতলে যায়… ‘আমি… আমরা ফেয়ারওয়েল পার্টি করছি।’

-‘আচ্ছা, বুঝলাম। সেইজন্য সবাই মাতাল হয়ে গেছে! কিন্তু বের্শেন, তুমিও?’

বের্শেন থমকে যায়….

-‘আরে… কথা তো বলো। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ বাকিরা সমস্বরে চেঁচিয়ে বের্শেনের হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে কথা বলবার চেষ্টা করে। কিন্তু ইনেস লাইন কেটে দিয়েছে ততক্ষণে। সমস্বরে চিৎকার এবং এরকম অদ্ভুত অভিযোগ সে একেবারে পছন্দ করে না।

কিন্তু ফার্দিনান্দকে থামানো যাচ্ছে না। সে বসবার ঘরের সিঁড়ি দিয়ে সমানে ওঠানামা করছে। তার মুখটা সাঙ্ঘাতিক ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বড় বড় চোখদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে।

‘একবার, অন্তত একবার কি সে আসতে পারত না আমায় বিদায় জানাবার জন্য?’ বন্ধুদের সামনে দাঁড়িয়ে ফার্দিনান্দ বলে যায়… ‘তোমাদের কি মনে হয় না যে তার আসা উচিত ছিল?’ ঘরের সিলিঙের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে অভিযোগ জানাবার ভঙ্গিতে সে বলে আর পায়চারি করে।

ছেলেরা প্রায় কেউই খেয়াল করেনি কখন দরজার বেল বেজেছে। হঠাৎ লুডভিগ তাড়াতাড়ি নিচে দৌড়ে গেল আর সবাই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝে উঠবার আগেই দেখল যে ইনেস এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছে। ফার্দিনান্দের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সে। ফার্দিনান্দের দৃষ্টি একদম শূন্য।

‘শুভ সন্ধ্যা, ভদ্রমহোদয়গণ!’ ইনেস বলে… ‘শুভ সন্ধ্যা ফার্দিনান্দ! কিন্তু আপনার কী হয়েছে? আপনাকে অপ্রকৃতিস্থ দেখাচ্ছে।’

ফার্দিনান্দ হঠাৎ হেসে উঠল। তার কাঠখোট্টা মুখটা একেবারে বদলে গেল এই হাসিতে। দেখে মনে হল বেদনাদায়ক অন্ধকার রাত অতিক্রম করে হঠাৎ এক আলোকোজ্জ্বল ভোরের সময়ে কেউ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। সে অনেকক্ষণ ধরে ইনেসের দিকে তাকিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। এক অসুস্থ মানুষের দিকে লক্ষ্য রাখার মত করে বাকিরা দূর থেকে একদৃষ্টে তার দিকে নজর রাখে…

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ফার্দিনান্দের ফেয়ারওয়েল পার্টির সন্ধ্যাতেই বের্নহার্ডের বাবা হঠাৎ করেই আগেভাগে কিছু না জানিয়ে শহরে এসে উপস্থিত হন এবং ছেলেকে বাড়িতে না পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যান। যদিও বের্নহার্ডের বিষয়ে ঠাকুমা সবসময় ভাল ভাল কথাই বলে থাকেন, তবুও ক’দিন ধরেই তার বাবার মনে বেশ কিছু সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। তাঁর মনে এই ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে বের্নহার্ড যথেষ্ট পরিশ্রমী ছাত্র। কারণ স্কুল এবং সঙ্গীতশিক্ষালয়, এই দুই জায়গা থেকেই ভাল ফল করছে সে বরাবর। কিন্তু অল্পসংখ্যক যে পরিবারগুলির সঙ্গে বের্নহার্ডকে মেলামেশা করতে বলা হয়েছিল, সে তাদের কারো সঙ্গেই যোগাযোগ রাখে না। শুধু স্কুলের বন্ধু কার্লের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে তার। সাধারণভাবে সবাই তার সম্বন্ধে বলছে যে ‘আকর্ষণীয় এবং আদবকায়দাদুরস্ত ছেলে’; কিন্তু কেউই তাকে বেশি দেখতে পায় না। এলাকার সম্মানীয় মানুষজন, সরকারি অফিসার, যাদের বেশ ভাল পরিবার আছে, বের্নহার্ডের বয়সী বাচ্চাকাচ্চা আছে, তাদের কারো সঙ্গে বের্শেন মেশে না। তাছাড়াও সন্ধেবেলায় তাকে বলা হয়েছিল নাচের স্কুলে ভর্তি হবার জন্য। সে বলেছিল যে তার নাকি সময় নেই। সে কথা যে ডাহা মিথ্যে, সেটাও পরিষ্কার।

বের্নহার্ডের ঠাকুমা অবশ্য তার পক্ষেই দাঁড়ালেন এবং বললেন যে বের্নহার্ড মিথ্যে কথা বলেনি। সাধারণত প্রতিদিন সে রাত এগারটা অবধি খাটে। সন্ধ্যায় মাঝেমধ্যে বেরয়, যদি কোথাও বাজনার অনুষ্ঠান থাকে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে বের্শেন লক্ষ্য করল যে এর বেশি আর ঠাকুমা কিছুই বললেন না। উল্টে তার বন্ধুদের সম্বন্ধে বেশ আপত্তিজনক কথা বলতে লাগলেন, বিশেষত গের্ট আর ইনেস সম্বন্ধে। কারণ, বের্নহার্ডের বাবা তাদের সম্বন্ধেই জানতে চাইছিলেন। পরিষ্কার বললেন ঠাকুমা যে আজকালকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপারস্যাপার তার মাথায় ঢোকে না বিশেষ। বের্শেন এই বন্ধুদের পছন্দ করে, করতেই পারে; এদের সঙ্গে লং ড্রাইভে যায়, সেটাও আলাদা ব্যাপার। কিন্তু এদের তিনি ঠিকঠাক বোঝেন না। ঠাকুমা নিজেও অল্পবয়সে খুব ভাল পিয়ানো বাজাতেন। তার প্রতিভাও ছিল। বের্শেন যখন বাজায়, তার ভারি ভাল লাগে। বের্শেনকে তিনি ভালবাসেন, এটাও ঠিক। বের্শেন যথেষ্ট প্রতিভাশালী। কিন্তু বের্শেনকে নিয়ে তিনি চিন্তিত। তাঁর অন্যান্য নাতিনাতনিদের থেকে বের্শেন অনেকখানি আলাদা স্বভাবের। তাঁর নাতিনাতনিদের মধ্যে অনেকেই বের্শেনের থেকে বয়সে বড়; অনেকেরই বেশ ভাল শিক্ষাদীক্ষা, অনেকেই যথেষ্ট প্রতিভার অধিকারী ( এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বের্শেনের দিকে তাকিয়ে তাঁর একথা আরও বেশি করে মনে হচ্ছে)। কিন্তু কেউই বের্শেনের মত স্বাধীনচেতা নয়। জীবনে কী করতে চায়, সেসব ভাবনার বিষয়ে তারা অনেক সহজ। যেমন, রল্‌ফ… সে তো কখনই ভাবেনি যে সঙ্গীতজ্ঞ হবে; স্কুলের পড়াশুনা শেষ করে সোজা বাবার আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায় যোগ দিয়েছে।

কিন্তু বের্নহার্ড? সে স্কুলের পাশাপাশি সঙ্গীতের পাঠ নিচ্ছে এবং সেটা নিয়েই সে ভবিষ্যতে এগোতে চায়। বাইরে খুব নরমশরম চেহারার হলেও এই ছেলে ভিতরে ভিতরে যা ভাবে, সেটাই করে। নিজের ভাবনাচিন্তার বিষয়ে অত্যন্ত একগুঁয়ে এবং উদ্ধত। সব থেকে ভয়ের ব্যাপার হল যে সে সবসময় নিজে বন্ধু নির্বাচন করে থাকে এবং এক্ষেত্রে কারো উপদেশ মানে না। বের্শেনের এইধরণের আচরণে ঠাকুমাও বাবার মতই চিন্তিত। মাত্র সতের বছর বয়সের এক কিশোরের পক্ষে এই আচরণ অত্যন্ত বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে অভিভাবকদের। তাছাড়াও, চেনাজানা যে বিশিষ্ট পরিবারগুলির সঙ্গে তাকে যোগাযোগ রাখতে বলা হয়েছিল, সে তাদের ধারকাছ দিয়ে যায় না। বের্শেনদের মত সম্মানিত পরিবারে এহেন অদ্ভুত আচরণ একেবারেই প্রত্যাশিত নয়। এটাই ঠাকুমার আসল চিন্তা, যেটা একটা চাপা তিক্ততার জন্ম দিচ্ছে। আসলে এমন একজনকেও পাওয়া যাচ্ছে না যে বলবে যে বের্শেন ভাল ছেলে নয়। বের্শেনের সুন্দর মুখ, খোলামেলা বন্ধুত্বপূর্ণ এবং আদবকায়দাদুরস্ত ব্যবহার সবার মন টানে। তবুও যখনই বের্শেনের প্রসঙ্গ উঠছে, কোথায় গিয়ে যেন তাল কাটছে। সবাই বলে যে সে খুবই ভাল ছেলে… তবে…; এই তবে অব্যয়টাই অভিভাবকদের ভাবিয়ে তুলেছে। কোথাও কি অবিশ্বাসের একটা বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে? প্রত্যেকে বলছেন যে বের্শেনের প্রতিভা এবং অন্যান্য ক্ষমতা নিঃসন্দেহে তুলনাহীন, কিন্তু কোনো একটা জায়গায় সম্ভবত তাকে কেউ বুঝতে পারছে না। সে যেন এই জগতসংসারে এক অচেনা আগন্তুকের মত অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে বাঁধা আছে। বাঁধনটা অদৃশ্য, তাই তাকে কেউ বুঝতে পারছে না ঠিকঠাক এবং পুরোপুরি বিশ্বাসও করতে পারছে না। এই অবিশ্বাসের জায়গা থেকেই অনেকের কাছে বের্শেনকে বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছে।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in








কুড়ি

রিমির পাশের বাড়িতে রাজু আর রাজুর বউ প্রজ্ঞা থাকে।রিমি না থাকলেই বিপিন প্রজ্ঞার কাছে যায়,কথা বলে।বিপিন গান করে,"গোলেমালে, গোলেমালে পিরীত কোরো না"। প্রজ্ঞা বলে,খুব তো সাহস দেখাও।বিয়ের আগে তো কিছু বলতে পারো নি। এখন তো আমি পরের বউ গো।বিপিন বলে,অপরজনা এখন আমার আপনজন হয়ে বসে আছে।বিপিন অতীতের কথা বলে প্রজ্ঞাকে,যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। ১৯৮০ সালের কথা এগুলি।এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।

বিপিন বলে,এবার আসি কবিতার কথায়। নব্বই দশকের বাংলা কবিতার যে প্রধান বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ছান্দিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বিষয় ভিত্তিক কবিতা লেখা, বা বলা যায় ভাবপ্রধান বাংলা কবিতার এক প্রবর্ধন, তা শূন্য দশকে এসে বেশ খানিকটা বদলে যায়। আমরা লক্ষ্য করি লিরিক প্রধান বাংলা কবিতার শরীরে কোথাও একটা অস্বস্তি সূচিত হয়েছে। হয়ত নব্বই দশকের লেখা থেকে নিজেদের আলাদা করার তাগিদ থেকেই এই উত্তর। হয়ত সত্তর দশকের ছায়ায় লালিত বাংলা কবিতার পাঠাভ্যাস থেকে নিজেদের আলাদা করার এক সচেতন প্রচেষ্টা। যেখানে নব্বই দশকের সংকলন করতে গিয়ে সম্পাদক সে দশকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখেন প্রেম এর সঙ্গে এটিএম এর অন্ত্যমিল, সেখানে শূন্য দশকের সম্পাদককে ঘাঁটতে হবে নির্মাণের ইতিহাস। যেখানে নব্বই দশকের কবি খুঁজে বেড়িয়েছেন গল্প বলার ছান্দিক দক্ষতা, সেখানে শূন্য দশকের কবি খুঁজেছেন ভাষা প্রকরণ। হয়ত এর পিছনে কাজ করেছে এক গভীর সত্য যে কবিতা আর জনপ্রিয় হয় না। কবি আর চটুল মনোরঞ্জন করবেন না। আর এই কাজে শূন্য দশক অনেকাংশই তাদের শিকড় পেয়েছে আশির দশকের নতুন কবিতা আন্দোলনে।

এছাড়া বাঙালীর দুর্গাপুজে এক ভালোলাগার দলিল।ঘুরে ঘুরে সারারাত কলকাতার ঠাকুর দেখা আর খাওয়াদাওয়া, ধুনুচি নাচের স্মৃতি জড়িয়ে বেঁচে থাকুক অমলিন স্মৃতি।কুমোরপাড়ার খ্যাতি ছিল হাঁড়ি কলসি ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য বাসনপত্র তৈরির জন্যই। এখানকার পুরনো অধিবাসীদের কথায় জানা যায়, বিশ শতকের গোড়ার দিকেও নাকি এখানে কিছু মাটির হাঁড়ি-কলসি নির্মাতার দেখা পাওয়া যেত। প্রথমে হাঁড়ি-কলসি, তার পরে ঘর সাজাবার পুতুল এবং একটা সময়ের পরে, যখন দুর্গাপুজো ক্রমে আমজনতার উৎসবে পরিণত হল, তখন থেকে ছোট্ট সেই কুমোর পাড়া রূপান্তরিত হয়ে উঠতে লাগল প্রতিমা নির্মাণের প্রধানতম কেন্দ্র,কুমোরটুলিতে।

বাসস্টপেজেই অতনুর বাড়ি।সে বলে, রাত বাড়লে বাসস্ট্যান্ড একটা আমোদের জায়গা হয়ে যায়। অন্ধকারে শুয়ে থাকা কিশোরী থেকে বুড়ি ভিখারির পাশে শুয়ে পড়ে মাতালের দল। তারা তো জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি খায় না। শুধু একগ্রাস ভাত জোগাড় করতেই তাদের দিন কেটে যায়। তারপর রাতচড়াদের বাজার। কেউ ওদের মালিক নয়। বাজারি মাল দরিয়া মে ঢাল। ঠিক এই পদ্ধতিতে পৃথিবীর আলো দেখেছিল অতনু। কে তার বাপ সে জানে না। আর জন্মদাত্রী ফেলে দিয়েছিল বাসের ছাদে। সেখানে শকুনের মত ওৎ পেতে থাকে হায়েনার মত ভয়ংকর অমানুষের দল। তারা অনাথ ছেলেমেয়েদের নিয়ে বড় করে। বড় হলে চুরি বা ভিক্ষা করে তারা যে টাকা আয় করে তার বৃহৎ অংশ নিয়ে নেয় হায়েনার দল। না খেতে পাওয়ার প্রবাহ চলতেই থাকে। এর থেকে মুক্তি পায় না অনাথ শিশুরা।

অতনু এখন বেশ স্মার্ট, বুদ্ধিমান। সে নিজের চেষ্টায় মেকানিকের কাজ শিখে নিয়েছে। মাথা উঁচু করে চলা ছেলেদের সকলেই সমীহ করে।

অতনু চুরি করে না, ভিক্ষাও করে না। সে বলে, হাত পা আছে। খেটে খাব। আর তোদের যা পাওনা মিটিয়ে দেব। সে বলে হায়েনার দলকে, বেশি ঘাঁটালে আমাকে, দেব শালা খালাস করে। আমার বাঁধন শক্ত বে। ওসব মাস্তানী তোর পকেটে রেখে দে।

যতই হোক শয়তানদের সাহস কিন্তু বেশি হয় না। অতনু একটা দল করেছে ছেলে মেয়েদের। সে বলে, শালা, কোন শালা রাতে খারাপ কাজ করতে এলে একসঙ্গে আ্যটাক করব। ওদের দৌড় বেশিদূর নয়। অতনু থাকতে আর অনাথের দল বাড়াতে দেব না বাসস্টপে। এই এলাকা এখন নতুন প্রজন্মের। ওরা আমাদের বড় করেছে তাই ওদের পাওনাটুকু দেব।

হায়েনার দল সাবধান হয়ে গেছে। এখন আর অনাথ বাচ্চা কম পায় এইস্থানে। অতনুর বিরুদ্ধে কাজ করে ওরা অনেকবার ঠকেছে।অতনুর দলবল দেখে ওরা অন্য জায়গায় ডেরা বাঁধে।

অতনু সকলকে নিজের পরিবারের সদস্যের মত দেখে।

এই পরিবারের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সুনীতা। সে পাশের পাড়ায় থাকে। অতনু তার আদর্শ। কিন্তু অতনুর বংশ পরিচয় নেই। তা না থাক তবু সে সমাজসেবী।

অতনু দেখেছে মারামারি বা লড়াই করে জেতার থেকে ভালবাসার জোর বেশি। ভালোবেসে কথা বললে শয়তানও বশ হয়ে যায়। এখন সে একদম আনন্দে থাকে। এলাকার লোকজন তাকে ভালবাসে।

সুনীতা ভাবে, অতনুদা এত বড় মন পেল কোথা থেকে।

সকলের উপকারে ছুটে যায় অতনু। হাসপাতাল,শ্মশান যেখানে যার প্রয়োজন প্রথমেই ডাকে তাকে। সুনীতা ভাবে, সে কি অতনুর প্রেমে পড়েছে। সবসময় অতনুকে দেখতে পায় খাতায়, জলে, দেওয়ালে, আয়নায়। তবু অতনুকে বলতে সাহস হয় না। যদি রেগে যায়। যা ব্যক্তিত্ব ছেলেটার, শ্রদ্ধা হয়। সুনীতা সবসময় এখন এইসব ভাবে।

অতনু বলে তার বন্ধুকে, আমি তো অনাথ, বেজন্মা। ভদ্র সমাজে আমার স্থান হবে না। আমি কি চিরদিন এই বাসস্টপেজেই থেকে যাব?

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in










১৮ (১) 

“ অনেকদিন আগের কথা। এক ছিলেন নবাব সাহেব, আর তাঁর ছিল এক শাহজাদা, বাপের সুপুত্তুর।

“ ভাল হল তোমরা পঞ্চায়েতের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছ। সেই প্রসঙ্গেই আমার এই কিসসা মনে পড়ল। ছোটে পালোয়ান সরপঞ্চকে মুখের উপর চ্যালেঞ্জ করেছে—বেশ করেছে। পঞ্চায়েত আদালতের বিচার ছোটেলালের মত লোকের জন্যে নয়। ও হল বড়মাপের মানুষ। এত বড় পালোয়ান! তায় আমাদের কলেজ কমিটির মেম্বার। ওখানকার বিচার তো গেঁয়ো লোকদের জন্য। কানাকড়ি দাম নেই এসব বিচারের। কোড়িল্যা মার্কা বিচার। হেঁ—হেঁ –হেঁ, কোড়িল্যা কাকে বলে জানো? রুক্ষ উষর জমিতে আপনা থেকেই জন্মায়। গ্রীষ্মকালে দেখে থাকবে—সাদা সাদা ফুল।

“আরে তুমি হলে শহুরে বাবু, এসব কী করে দেখবে? এই পঞ্চায়েতী আদালত? ওরা ওই কোড়িল্যা-ছাপ রায় দেয়। আর ওই সরপঞ্চ? সবাইকে কিছু একটা ফালতু গুরুগম্ভীর লেকচার দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। কিন্তু এবার পালা পড়েছিল ছোটে পালোয়ানের সাথে—একেবারে কুপোকাত! ও যেমন বুনো ওল, ছোটে তেমনি বাঘা তেঁতুল! ----

“কুসহরপ্রসাদকে আগেই বলেছিলাম-- পঞ্চায়েতী আদালতে যেওনা। শুনলে তো! এখন মাথায় ঢুকেছে। সরপঞ্চ চার-পাঁচটা কাঁচাপাকা শুনিয়ে দিতেই সব শুধরে গেল। ওখানেই ছোটেলালজীর সঙ্গে মিটমাট করে নিল।

“ ঠিকই হল, বাপ-বেটার মধ্যে কীসের আকচা-আকচি?

যা বলছিলাম, ওঁর ছিল এক শাহজাদা। কার? নবাব সাহেবের। হ্যাঁ, হ্যা; ওই কিসসাটাই তো বলছি। একবার ওর হল খুব অসুখ। জ্বর কিছুতেই নামছে না। কয় মাস ধরে ভুগছে; অনেক দামি দামি ওষুধ, বড় বড় কবিরাজ, হাকিম, ডাক্তার। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। কোটি কোটি টাকা নর্দমার জলের মত খরচ হচ্ছে, কিন্তু শাহজাদার হাল যে কে সেই।

“নবাব সাহেব মাথা চাপড়াচ্ছেন। চারদিকে ডঙ্কা বাজানো হল—কেউ এসে আদ্দেক সম্পত্তি নিক, শাহজাদিকে বিয়ে করুক,--কিন্তু শাহজাদাকে সারিয়ে তুলুক! এবার দূর দূর থেকে হাকিমের দল এলেন। অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু শাহজাদা চোখ মেললেন না।

“শেষে এলেন এক বুড়ো হাকিম। শাহজাদাকে দেখে বললেন, ‘আদ্দেক সম্পত্তি ও শাহজাদীতে আমার লোভ নেই, ভোগ-বিলাসে রুচি নেই। যদি আমার একটা দরখাস্ত মঞ্জুর করেন তো শাহজাদাকে সারিয়ে তোলার দায়িত্ব আমার। কিন্তু দরখাস্ত গোপনে পেশ করব’।

“তো নবাবের হুকুমে দরবার খালি হয়ে গেল। হাকিম বললেন, ‘বন্দাপরবর! দাসের প্রতি আপনার অনেক কৃপা। এবার বেগমকে এখানে আসতে হবে। যা জিজ্ঞেস করব তার জবাবে সত্যি কথা বলতে হবে।‘

“নবাব সাহেবও সেখান থেকে চলে গেলেন। বেগম সাহেবার দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে হাকিম বললেন, ‘যদি শাহজাদার প্রাণ বাঁচাতে চান তো সত্যি কথা বলুন। শাহজাদা আসলে কার সন্তান? কার ঔরসে জন্ম’?

“বেগমা সাহিবা কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘কাউকে বলবেন না! একসময় মহলে কাজ করত এক ভিস্তি, শাহজাদা তার ছেলে। তরতাজা জোয়ান, গ্রাম থেকে নতুন নতুন এসেছিল, তারপর কী করে যে কী হয়ে গেল তা’ জানিনা’।

“এটা শোনামাত্র হাকিম বললেন, ‘শুক্রিয়া! আর কিছু বলতে হবে না’। চুটকি বাজিয়ে বললেন, ’কথায় কথায় বুঝে গেছি শাহজাদা কীভাবে সারবেন’।

“তারপর হাকিম সাহেব আগের সব ওষুধ ফেলে দিলেন। কত দামি দামি দ্রব্যের অনুপান! হীরেমোতি, সোনাচাঁদি! কত রকমের অদ্ভুত সব আরক! সব নর্দমায় বয়ে গেল। তারপর উনি শাহজাদার চোখে জলের ছিঁটে দিয়ে বললেন, ‘আবে উঠ! ভিস্তির ব্যাটা! উঠে পড়’।

“ব্যস্‌, শাহজাদা চমকে উঠে চোখ খুললেন। তারপর হাকিম গেলেন মাঠে। সেখান থেকে কয়েকটা কৌড়িল্যার চারা উপড়ে এনে জলের ছিটিয়ে পিষে শাহজাদাকে গিলিয়ে দিলেন। তিনদিন নিয়মিত কৌড়িল্যার রস খেয়ে শাহজাদা চাঙ্গা!”

এই কিসস্যাটি বৈদ্যজীর দরবারে বসে শোনাচ্ছিলেন -প্রিন্সিপাল। মুখ্য শ্রোতা -রঙ্গনাথ। মুখ্য বিষয়—পঞ্চায়তী আদালত। গল্পের প্রেরণাশক্তি—ভাঙের শরবত।

উনি বলছিলেন, ‘তো রঙ্গনাথ বাবু, এই হল কৌড়িল্যামার্কা ন্যায়বিচার। দেহাতিদের এরকমই ধরে নেওয়া হয়—যত্ত নীচু জাতের লোকজন! ওদের আর কী চাই? চলে এসো পঞ্চায়তী আদালতে আর কৌড়িল্যামার্কা ন্যায়বিচার পেয়ে বাড়ি যাও!

“আর যারা বড় মানুষ, রঈস-টইস, হাকিম-হুকাম, উঁচু জাতের লোকজন। ওদের চাই দামি বিচার। ঘাস কাটার সরপঞ্চ নয়, মোটা চশমা পরা ইংরেজের মতন ইংরেজিবলা জজসাহেব। বড় মানুষদের জন্য রয়েছে জেলার বড় বড় আদালত, যেমনটি চাই তেমন।

“ওদের চেয়েও বড়দের জন্য রয়েছে অনেকগুলো হাইকোর্ট। সবচেয়ে উঁচু জাতের জন্য সুপ্রীম কোর্ট। কেউ একবার বাঁকাচোখে তাকিয়ে দেখুক তো! তাতেই সোজা দিল্লি গিয়ে রিট পিটিশন লাগিয়ে দেয়া হয়।

“কৌড়িল্যামার্কা আদালত আর যত নীচু জাতের লোক! ওখানে যদি একবার ফেঁসে যায় তো ধরে নাও বসা অবস্থা থেকে উঠে সোজা দাঁড়াতে পারবে না। এক দানা খাবারের জন্য ভিক্ষে করে বেড়াবে।

“হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট—এসবের শখ কী সবাইকে পোষায়? এক-একজন উকিলের পেছনে একশটা বেশ্যা পোষার খরচ!

“তাই গেঁয়ো লোকজনের জন্যে কৌড়িল্যা-মার্কা ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা। না হিং-লবঙ্গ, না ফিটকরি! তাতেও রঙ চোখা! এক দাগ খেয়ে দেখ, জ্বর নেমে যাবে। আমাদের দেশের কানুন একদম পাকা, --যেমন লোক, তার তেমনই আদালত”।

হঠাৎ উনি হিন্দি ছেড়ে অবধী বোলিতে চলে গেলেন। ‘যেমন পশু, তেমনি করে বাঁধা’।


গাঁয়ের বাইরে এক লম্বা চওড়া ময়দান যা ধীরে ধীরে ঊষরভূমি হয়ে গেছে। আজ একগাছি ঘাসও গজায় না। দেখলেই মনে হবে -আচার্য বিনোবা ভাবেকে ভূদান দেবার জন্য একেবারে আদর্শ জমি। আসলে তাই হয়েছিল। বছর দুই আগে এটাকে ভূদান-আন্দোলনে দিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে ওটা ফিরতি দান হয়ে গ্রামসভার অধিকারে এল। গ্রামসভা আবার ওটা প্রধানকে দান করে দিল।

প্রধান এটাকে কয়েক ভাগ করে নিজের আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবকে দিল। তারপর একটু আধটু টুকরো যা বেঁচে ছিল সেগুলো বাজারের কেনাবেচার নিয়ম মেনে কিছু গরীব ও ভূমিহীনকে “দান” করে দিল। পরে জানা গেল যে গরীব এবং ভূমিহীনকে দেয়া জমির টুকরোগুলো আসলে ওই ময়দানের অংশ নয়, বরং অন্য কোন কৃষকের জমির অংশ। সুতরাং এটা নিয়ে মোকদ্দমা শুরু হল, এখনও চলছে, ভরসা আছে—পরেও চলতেই থাকবে।

যাই হোক, ভূদান-যজ্ঞের ধোঁয়া এখনও ময়দানের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে। ওখানে খেত তৈরি হয়ে গেছে। তার প্রমাণ বলতে প্রতি পদে একএকটা আল বাঁধা হয়েছে, তার উপর বিছিয়ে দেয়া বাবলা গাছের কাঁটাওলা ডাল। সার-জল-বীজ বিনা স্রেফ ইচ্ছাশক্তির জোরে, গত বছর থেকে নাকি ভাল করে চাষ শুরু হয়েছে। আর স্রেফ পাটিগণিতের জোরে এটা প্রমাণ করা গেছে যে গ্রামসভায় গত বছর-- আগের সব বছরের থেকে – অনেক বেশি অন্ন উৎপাদন হয়েছে।

গাঁয়ের পশুর পাল কখনও কখনও ওই ময়দানকে নিজেদের চরে খাবার স্থান ভেবে পুরনো অভ্যাসে এদিকে চলে আসে। কিন্তু তারপরেই চাষিদের মধ্যে গালাগালি, মারপিট, পঞ্চায়েতের খোঁয়াড়, থানাপুলিশ, কোর্ট-কাচারি সব শুরু হত। তাই ধীরে ধীরে ওদিকে পশুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেল।

ময়দান আজকাল নিঃশব্দ নীরব। আশাবাদী কেউ যদি ওদিকে পা ফেলে তবে তার মনে হবে যে এই নীরবতার মধ্যেই প্রগতির শঙ্খ বেজে উঠল বলে!

ময়দানের এক কোণে বন-সংরক্ষণ, বৃক্ষারোপণ এসব শুরু হয়েছিল। যোজনা সফল হল কি বিফল—সেটা বিতর্কের বিষয়। চোখে পড়ে যে নালা কাটা হয়েছে আর শোনা যায় যে ওখানে বাবলা গাছের বীজ বোনা হয়েছে। এটাও শোনা যায় যে এই ‘গঁজহা’ লোকগুলো যদি অমন ‘গঁজহা’ নাহয়ে আশপাশের গাঁয়ের মত উদ্যোগী পুরুষসিংহ হত তাহলে এই উষর মরুতেও এতদিনে বাবলা গাছের বন গজিয়ে উঠত।

কিন্তু মাটি ভালো নয়, তাই নালার পাশে বাবলা গাছ গজালো না, কিন্তু পুরো যোজনা থেকে শিবপালগঞ্জের লোকেদের একটা লাভ হল। নালাগুলো ওদের সার্বজনিক শৌচালয় হয়ে গেল। এই ধরণের সরকারী স্কীম বানানো হয়েছিল বন নির্মাণের জন্য, এখন হয়ে গেল ঘরোয়া কাজের।

ময়দানের অন্য কোণে শূন্যতাকে ধর্ষণ করার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল বটগাছ। তারপাশে একটি কুয়ো। ওই কুয়োর বাঁধানো পাড়ে রঙ্গনাথ বসে আছে। হিন্দুস্তানের লেখাপড়া জানা লোকেদের মাঝে মাঝে একটা অসুখ হয়, তার নাম ‘ক্রাইসিস অফ কনশান্স’—বিবেকের দংশন! কোন কোন ডাক্তার এর মধ্যে ‘ক্রাইসিস অফ ফেথ’ বা বিশ্বাসের সংকট নামক অন্য একটা অসুখের লক্ষণও কষ্ট করে খুঁজে পান।

এইসব অসুখ সাধারণতঃ শিক্ষিত লোকের মধ্যেও তাদেরই হয় যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী মনে করে। মজার ব্যাপার হল এরা কেউ বুদ্ধির ভরসায় বাঁচে না, বরং আহার-নিদ্রা-ভয়-মৈথুনের মাধ্যমেই বাঁচে। (কারণ, শুধু বুদ্ধির ভরসায় বাঁচা অসম্ভব)।

এই অসুখের রোগী মানসিক চিন্তা এবং অবসাদে ভোগে, লম্বা লম্বা লেকচার ঝাড়ে এবং চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তর্ক করে। নিজেকে --বুদ্ধিজীবী হয়েছে তাই অসুস্থ, এবং অসুস্থ হয়েছে সুতরাং বুদ্ধিজীবী-- বলে প্রমাণ করত চায়। শেষে এই অসুখ নিরাময় হয় কফি হাউসের বিতর্কে, চঞ্চল মেয়েদের বাহুবন্ধনে, সরকারি চাকরি পেয়ে, কখনও কখনও আত্মহত্যায়।

কলেজে ম্যানেজারের নির্বাচন দেখার দিন থেকে রঙ্গনাথের মনে ওই অসুখের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিল। ওর মামা বৈদ্যজীকে দেখামাত্র ওর মনে সেদিনের এক দৃশ্য ভেসে ওঠে—প্রিন্সিপাল সাহেব শূলে বেঁধা শুয়োরের মতন চিঁচিঁ করতে করতে কলেজের গেট থেকে বেরোচ্ছেন আর জয়ধ্বনি করছেন। ওর মনে হল বৈদ্যজীর সঙ্গে থাকতে থাকতে ও যেন কোন ডাকাত দলের সদস্য হয়ে গেছে। যখন প্রিন্সিপাল সাহেব দাঁত বের করে ওকে কোন রগরগে কিসসা শোনাতে থাকেন---ওনার ভাণ্ডারে এমন কিসসা অগুনতি—তখন ওর মনে হয় এই লোকটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে কারও গলা টিপে দিতে পারে।

শহরে থাকলে এখন ও কফি হাউসে বন্ধুদের সামনে বসে এই নির্বাচন নিয়ে একটা লম্বাচওড়া লেকচার ঝাড়ত। বলত—কীভাবে দেশি পিস্তলের জোরে ছংগামল ইন্টার কলেজের ম্যানেজারি কব্জা করা হল। আর টেবিল চাপড়ে বলত যে মুলুকে ছোট ছোট জায়গায় ছোট ছোট ক্ষমতা হাতিয়ে নিতে এমন সব করা হয়, সেখানে বড় বড় ক্ষমতা লাভের জন্য কী না হতে পারে!

তারপর ঠিক বা ভুলে ভরা দু-চারটে ইংরেজি কোটেশন আউড়ে কফির কাপ খালি করার পর শান্তি পেত এই ভেবে যে ও একজন খাঁটি বুদ্ধিজীবী, এবং চারটে অকম্মার ঢেঁকির সামনে গণতন্ত্রের পক্ষে এক জ্বালাময়ী বক্তিমে ঝেড়ে ধরে নিত যে এবার ও ভেতরের জমে থাকা উষ্মা বের করে নিজের ‘ক্রাইসিস অফ ফেথ’কে ধামাচাপা দিতে পেরেছে।

কিন্তু এটা তো শহর নয়, নেহাত পাড়া -গাঁ, এখানে রূপ্পনবাবুর ভাষায়, নিজের বাপকেও বিশ্বাস নেই। এছাড়া , শনিচরের ভাষায়, এখানে কাটা আঙুলে পেচ্ছাপ করার মতও কেউ নেই। তাই রঙ্গনাথ এখানে নিজের মানসিক অসুখ থেকে রেহাই পেল না। ওর মাথায় দিনরাত একটা জিনিসই ঘুরছে----ও কোন ডাকাত দলে ফেঁসে গেছে। ডাকাতগুলো হামলা করে কলেজ লুট করেছে। এবার অন্য কোথাও আচমকা হামলা করার তালে আছে। ওর শরীরমন চাইছে বৈদ্যজীকে গালি দিতে আর তার চেয়েও বেশি উসখুস করছে কার সামনে বিশ্বাস করে গালি দেয়া যায়?

এমন বন্ধু আর কে আছে? খান্না মাস্টারের পেটে কথা থাকে না। ওর সামনে বললে পরের দিন গোটা গাঁও জেনে যাবে যে বৈদ্যজীর ভাগ্নে নিজের মামাকে গালি দেয়! দেখে নাও, আজকালকার লেখাপড়া জানা ছেলেগুলোক-- ভদ্রতা শেখেনি। হ্যাঁ, মালবীয় মাস্টারের কাছে বলা যেতে পারে। ও দলবাজিতে যুক্ত হলেও বড্ড সাদাসিধে। ওর সামনে গাল দিয়ে মজা নেই। বাকি রইল কে? রূপ্পনবাবু?

রঙ্গনাথের রূপ্পনবাবুর উপর খানিক ভরসা ছিল। কারণ, ওমাঝে মাঝে প্রিন্সিপালকে গাল দিয়ে বলত—কলেজের দুর্ভাগ্য! ওনার অভিযোগ—প্রিন্সিপাল লেখাপড়ায় গবেট, কিন্তু দুনিয়াদারিতে মহা ওস্তাদ! পাক্কা ছকবাজ! বাবাকে এমন ফাঁদে ফেলেছে যে সব কাজ ওই ব্যাটার ইচ্ছেতে হলেও বাবা ভাবে বাবার কথায় হচ্ছে। ব্যাটা খান্না মাস্টারের সঙ্গে খুব বাড়াবাড়ি করেছে। মানছি, খান্না মহাবেকুব। কিন্তু ওকে এত বেশি অপমান করা ঠিক নয়। আমার বাবার কাঁধে বন্দুক রেখে এক ব্যাটা বেকুব অন্য বেকুবকে মেরে দেয়া? এটা অনুচিত।

আজ ওই বটবৃক্ষের ছায়ায় কুয়োর পাড়ে বসে রঙ্গনাথ প্রশান্ত চিত্তে এক লম্বা শ্বাস টানল। অনেক দিন পরে আজ ওর সেই অসুখ ওকে বিচলিত করছে না। হল কি,আজ ও হিম্মত জুটিয়ে রূপ্পনবাবুর কাছে নিজের আত্মসংকট নিয়ে খোলাখুলি কথা বলল। স্পষ্ট করে বলল যে মামাজীর এমনটা করা ঠিক হয়নি। আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ম্যানেজারি হাসিল করলেন বটে, কিন্তু চারদিকে অপযশ তো রটেছে!

রূপ্পনবাবু ওনার ‘ধর -তক্তা- মার- পেরেক’ ভঙ্গিতে বললেন—‘দেখ দাদা, এসব তো পলিটিক্স। এটা তো কিছুই নয়। এ’লাইনে অনেক বড় বড় বদমাইশি হয়। পিতাজি যে পথে এগিয়ে চলেছেন তাতে আরও কিছু করতে হতে পারে। দুশমনকে –সে যেই হোক—চিৎ করতে হয়। না পারলে উনি নিজেই চিৎ হবেন, তারপর বসে বসে কবরেজি পুরিয়া বানাতে থাকবেন। কেউ ফিরেও তাকাবে না।

‘তবে কলেজটাকে অনেক শোধরাতে হবে। প্রিন্সিপাল ব্যাটা মহা হারামী। সারাদিন দলবাজি, সারাদিন কিচকিচ। খান্না মাস্টারও একনম্বরের গর্দভ, কিন্তু হারামী নয়। শালার প্রিন্সিপাল ওকে অনেক অপমান করেছে, নীচে নামিয়েছে। এবার ওকে টেনে তুলতে হবে। আমি পিতাজীর সঙ্গেও কথা বলেছি। কিন্তু উনি প্রিন্সিপালকে খাটো করতে চান না।

‘ভেবেছি , কিছুদিন বাবাকে কিছু না বলে খান্না মাস্টারকে একটু হাওয়া দেব। তাতেই প্রিন্সিপাল চিতপটাং হবে। ও শ্যালক ফুলে ঢোল হয়েছে। এখন ওর ফাটার সময়। একবার ব্যাটা চিৎ হলে বাবাও টের পাবেন ব্যাটা কত তালেবর---‘!

এইসব শুনে রঙ্গনাথ বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে নিঃশ্বাস টানল। এটা তো বোঝা গেছে যে রঙ্গনাথ এই বিষয়ে রূপ্পনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে পারে। এটাও স্পষ্ট হল যে রূপ্পনবাবুর সামনে ও খান্না মাস্টারের জন্য সহানুভূতি দেখাতে পারে, যে পড়ে গেছে তাকে টেনে তুলতে পারে, যে ফুলে গেছে তাকে ফাটিয়ে দিতে পারে। সোজা কথায়, অন্যায়ের সামনে মুখোমুখি দাঁড়াতে না পারলেও চোরাগোপ্তা ভাবে লড়াই করে ফের সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ওর থেকে প্রায় এক ফার্লং দূরে রূপ্পনবাবু একটা গাছের পেছনে অনেকক্ষণ ধরে বসে থেকে পেটের ভেতরের গণ্ডগোল সাফ করছিলেন। এভাবে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার সার্বজনিক সমাধান করে যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন রঙ্গনাথও কুয়োর পাড়ে উঠে দাঁড়ালো। রূপ্পনবাবু ওর দিকে আসছিলেন না, তাই রঙ্গনাথই ওনার দিকে এগিয়ে গেল।

(চলবে)