Next
Previous
Showing posts with label ধারাবাহিক. Show all posts
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in





















১৩. ভার্জিনিয়া উলফ ও কবি লেখকের আত্মহত্যা





সুপরিচিতাসু সুস্মি,


ষষ্ঠীর রাত। ঘন্টাখানেক আগেই নিউ জলপাইগুড়ি জংশন থেকে ট্র্রেনে চেপেছি। অনেকদিন হলো তোমার কোন চিঠি পাইনা। ভালো আছো নিশ্চয়? কাজের প্রেশারে চিঠি লিখতে পারছো না মনে হয়। বৈশুর হাতে তৈরি লুচি আার আলুর দম দিয়ে ডিনার সেরে জানালার পাশে বসে আছি বহুক্ষণ। রাতের ট্রেন ছুটছে, এসির জানালায় দূরের কোন আলো কাঁপছে। মনটা আজ খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, তোমাকে খুব মনে পড়ছে। কেন পড়ছে জানিনা। কিংবা এভাবে তোমাকে মনে করা উচিত হচ্ছে কিনা তাও বুঝতে পারছিনা। আমরা আজো যেহেতু মোবাইল নম্বর দেয়া নেয়া করিনি সেহেতু তোমাকে লেখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই, পুরো কম্পার্টমেন্ট আধো ঘুমে আমি জেগে বসে তোমাকে লিখছি। আজ সন্ধ্যায় একটা সুইসাইড নোট পড়ছিলাম ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ শেষ বিদায়ের আগে প্রিয়তম স্বামীর উদ্দেশে লেখা এই চিঠিটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পড়া সুইসাইড নোটগুলোর একটি। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ওই চিঠিটি এখনও পড়েন বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমীরা, আমিও আগে বহুবার পরেছি কিন্তু কেন জানিনা আজ পড়ার পর থেকেই খুব কষ্ট লাগছে, বয়স বেড়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। এই চিঠি তোমারও নিশ্চয় পড়া। যেখানে আত্মহত্যাকারী লিখছেন—



প্রিয়তম,

আমি বুঝতে পারছি, আমি আবারও পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি বুঝতে পারছি এবার হয়তো আমাদের এই কঠিন সময় অতিক্রান্ত হবে না। আমি নানা রকম স্বর শুনতে পাচ্ছি, কিছুতেই মনঃসংযোগ করতে পারছি না। তাই যা সবচেয়ে ভালো মনে হচ্ছে তা-ই করতে যাচ্ছি আমি। তুমি আমাকে যতটুকু সম্ভব সুখী করেছ। তুমি সে সবই করেছ যা যা কোনও মানুষের তরফে করা সম্ভব। আমার মনে হয় না দুইজন মানুষ মিলে তোমার-আমার চেয়ে বেশি সুখী হতে পারতো, যতদিন না আমার এই ভয়ঙ্কর রোগটা দেখা দেয়। আমি আর এর সাথে যুদ্ধ করতে পারছি না। আমি জানি আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে ফেলছি, আমি না থাকলেই তুমি কাজ করতে পারবে। এবং তুমি করবেও, আমি জানি তা। এই দেখ, এই চিঠিটাও আমি ঠিকভাবে লিখতে পারছি না। আমি পড়তে পারি না। আমি সর্বার্থে বলতে চাই, আমার জীবনের সমস্ত সুখের জন্য আমি তোমার কাছে ঋণী। তুমি আমার সঙ্গে চরম সহিষ্ণুতা দেখিয়েছ, অসাধারণ সহৃদয় আচরণ করেছ। আমি বলতে চাই- এ সত্য সকলেই জানে। কেউ যদি আমাকে বাঁচাতে পারতো, সেটা হতে তুমিই। তুমি এত ভালো!- আমি তোমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করতে পারি না। আমার মনে হয় না আমাদের দুজনের চেয়ে বেশি সুখী আর কেউ হতে পারবে।



এই কথাগুলো আমারও হতে পারে কিংবা যেকোন সংবেদনশীল মানুষের কথাও হতে পারে তাই না? নিশ্চয় বুঝে ফেলেছো এটা কার সুইসাইড নোট। তার মৃত্যুও কাব্যিক ব্যঞ্জনার। নিজের ওভারকোটের পকেটে নুড়ি পাথর বোঝাই করে হেঁটে নেমে গিয়েছিলেন খরস্রোতা পাথুরে নদীতে। আর কোনদিন ফিরে আসেননি। বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম অ্যাডলিন ভার্জিনিয়া স্টিফেন উলফ নারীদের হয়ে লিখে গেছেন বহু চিঠি এবং ডায়রি। তাঁর ডায়রিতে বর্ণিত ঘটনাগুলি সেই সময়ের এক বিশ্বস্ত দলিল। পনের বছর বয়েসে তিনি প্রথম ডায়রি লেখেন। আর শেষ লেখাটি লিখেছিলেন মৃত্যুর ঠিক চারদিন আগে অর্থাৎ ২৪ মার্চ। তিনি তার লেখা খুব যত্ন করে রঙিন কাগজের মলাটের ভিতরে গুছিয়ে রাখতেন। অতীতচারণা করার সময়ে ডায়রির সাহায্য নিতেন, পরবর্তীতে এই বিষয়ের উপরে বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন। তিনি লন্ডনের একটা কলেজে ইংরাজি ও ইতিহাস পড়ানোর পাশাপাশি দ্য গার্ডিয়ান, দ্য টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্ট এবং বিভিন্ন প্রকাশনার জন্যে নিবন্ধ, রিভিউ লেখেন সমসাময়িক এবং ধ্রুপদী সাহিত্য বিষয়ে। এই সময়ে তিনি এবং তাঁর স্বামীর কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা বৌদ্ধিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলেন। লন্ডনের গর্ডন স্কোয়ারে ১৯০৬ সালে ‘থার্সডে ইভিনিং’ এবং পরে ‘ফ্রাইডে ক্লাব’-এ সাহিত্য, শিল্পকলা, বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলত। লেখার পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন। নারী যখন ফিকশন লেখে তখন তার একটি কক্ষ আর কিছু অর্থ খুব প্রয়োজন”। এই উক্তি বিশ্ব সাহিত্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক ভার্জিনিয়া নারী মুক্তির অগ্রদূত, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার, লিঙ্গবৈষম্য, রাজনৈতিক দর্শন ও সমাজ বিশ্লেষক হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য উদ্দেশ্য করে ভার্জিনিয়ার ভাষ্য, যদি নিজস্ব একটা ঘর আর ৫০০ পাউন্ডের নিশ্চয়তা দেয়া হয়, নারীরাও অনেক উন্নতমানের সাহিত্য উপহার দিতে পারবে। জেইন অস্টেন থেকে ব্রন্টি ভগ্নিদ্বয়, জর্জ এলিয়ট ও মেরি কারমাইকেল পর্যন্ত সব লেখিকাই অনেক প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও শেকসপীয়রের স্তরে উন্নীত হতে পারছে না আর্থিকভাবে সামর্থ না থাকার কারনে। আর তাই নারীকে নির্ভর করতে হয় পুরুষের ওপর। আর নারীদের নিচে ফেলে না রাখলে পুরুষরা বড় হবে কি করে- এই মনোভাব বজায় রাখলে নারীদের মুক্তি মিলবে কিভাবে? তদানীন্তন সময়ে ঝাঁঝালো এই প্রশ্ন ব্রিটিশ পুরুষতান্ত্রিক সুশীল সমাজের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়।



জীবনের পরিবর্তনশীলতা, সময়, স্মৃতি, সামাজিক সম্পর্ক, এবং মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভার্জিনিয়ার লেখা তার শেষ উপন্যাস বিটুইন দ্য এ্যাক্টস তোমার খুব প্রিয় আমি জানি। তুমি জানো নিশ্চয় ভার্জিনিয়া শিক্ষা, গির্জা, চিকিৎসা, আইন ইত্যাদি নানা জায়গায় কাজের জন্যে শিক্ষিত নারীদের প্রবেশাধিকারের সমস্যা নিয়ে কলম ধরেছিলেন। অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ থেকে নারীদের বহিষ্কারের ফলে তাঁর কলম গর্জে ওঠে। নারী পুরুষের সমতা নিয়ে তাঁর লেখা উপন্যাস, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রামসে’ পড়েছো কি? কিংবা তার বায়োগ্রাফি ‘ফ্লাস’? রোডলফ বেসিয়ারের একটি নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ফিকশনধর্মী এই উপন্যাসটি একটি কুকুরের চোখ দিয়ে পুরো থিমটি তুলে ধরা হয়েছে। ভার্জিনিয়া উলফ তার আন্টি ফটোগ্রাফার জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরুনের জীবনের নানা দিক নিয়ে ‘ফ্রেশওয়াটার’নামে একটি নাটক লিখেছিলেন। আমার অবশ্য ভালো লাগে ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘এম আই এ স্নব’। বইটিতে মূলত সমাজের ধনাঢ্য শ্রেণী এবং সেই সাথে সুশীল সমাজের একজন প্রতিনিধি হওয়ার যে সংকট তা তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও তাঁর জেকবস্ রুম, ওরলানডো, দ্য ওয়েভস্ উপন্যাসগুলোও আমার ভালো লাগে।



আমার মাথায় একটা প্রশ্ন সন্ধ্যা থেকে ঘুরছে, লেখকের মৃত্যু, বিশেষত আত্মহত্যা তাঁকে মহান করে কি? বিশ্বসাহিত্যে শতাধিক খ্যাতনামা কবি-লেখকের খোঁজ মিলবে, যাঁরা আত্মহত্যায় নিজেদের জীবনের ছেদ টেনেছেন। খোঁজ নিলে আরও দেখা যাবে, তাঁদের লেখালেখিতে নিজেদের মনোজগতের ছাপ পড়ুক বা না-ই পড়ুক, তাঁরা প্রত্যেকেই ব্যক্তিজীবনে প্রবল মানসিক চাপ বয়ে বেড়িয়েছেন, যা প্রায়ই তাঁদের এক দুঃসহ বিষণ্নতা ও মনোবৈকল্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অতি বিখ্যাত আত্মহননকারী হিসেবে যাঁদের নাম প্রথমেই মনে আসে—প্রত্যেকেই মনোরোগের নানা লক্ষণে আক্রান্ত ছিলেন। ভার্জিনিয়া উলফের হৃদয়বিদারক সুইসাইডের কথা ভেবে উঠতে উঠতে তোমাকে আরও কয়েকটা নাম মনে করিয়ে দিই— সিলভিয়া প্লাথ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, ইয়ুকিও মিশিমা। প্রত্যেকে আত্মহন্তারক। মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও বড় যত্নে ঘুমন্ত ছেলেমেয়ের বিছানার পাশে প্লাথ সাজিয়েছিলেন দু-গ্লাস গরম দুধ আর রুটি, তারপর মাথাটা গুঁজে দিয়েছিলেন জ্বলন্ত ওভেনের ভেতরে। হেমিংওয়ে তাঁর সেই আত্মঘাতী রাতে শুতে যাওয়ার ঠিক আগে খেয়েছিলেন নিউ ইয়র্ক স্ট্রিপ স্টেক, বেকড পোট্যাটো আর সিজার স্যালাড, সঙ্গে ছিল দুর্মূল্য বোরদো। কী এক অসহ্য তাড়না তাঁকে ডেকে নিল গহীন ঘুমের ভেতর থেকে, আর সুষুপ্তির অন্তরালে পার্শ্ববর্তিনীকে ফেলে রেখে নীচের বারান্দায় গিয়ে তিনি গুলি চালালেন নিজস্ব করোটি ফুঁড়ে। ‘আত্মহত্যা নিয়ে আমার না আছে কোনও শ্রদ্ধা, না আছে কোনও মায়ামমতা’— এমন পঙ্‌ক্তিমালা লেখার পরেও গ্যাসের নব নিজের হাতে খুলে দিয়ে নিজের শ্বাস রোধ করে মৃত্যু চেয়েছিলেন কাওয়াবাতা। আর মিশিমা? অনেক আশার বারুদ ঠাসা ছিল তাঁর বুকে, সেই সব স্বপ্নজাগরের অকালমৃত্যুসম্ভাবনায় আপন হাতে পেটের নাড়িভুঁড়ি চিরে বের করে বেছে নিলেন হারাকিরি মৃত্যু। সিলভিয়া প্লাথ ভেবে দেখবেন একবার, যেই মুহূর্তে আপনি জানলেন এঁদের প্রত্যেকের আত্মহননবৃত্তান্ত, এঁদের লেখার মোহের চাইতেও এঁদের আত্মহত্যার বয়ানটি জানার দুর্মর লোভ চেপে কি বসছে না আপনার মনে? ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা’ করা সেই ‘বিপন্ন বিস্ময়’ সম্পর্কে অনন্ত কৌতূহল কি আপনাকে কি গ্রাস করছে না? উলফও জানতেন সে-কথা। জানতেন, হাজার আলোর রোশনাই এসে পড়বেই তাঁর জলে ভিজে হেজে-যাওয়া মৃত মুখে, শ্যাওলা-জড়ানো চুলে, পাথরের ভারে ছিঁড়তে বসা পকেটের খাঁজে। লেখকের ‘সুইসাইড নোট’ও সাহিত্যবিচারের আতসকাচের তলায় পড়তে পারে, এ-কথা ভাবতে পেরেছিলেন বলেই, স্বামীকে উদ্দেশ্য করে লেখা সেই শেষ চিঠিতে কৈফিয়তের জবানিতে লিখে গেলেন— ‘দ্যাখো, এ চিঠিটাও আমি ঠিকমতো লিখতেই পারছি না। পড়তেও পারি না আর।’ তবু রেহাই মেলেনি। তিন সপ্তাহ পর অর্ধগলিত সেই শবদেহ যখন শনাক্ত করছেন লিওনার্ড উলফ, ইতিমধ্যেই হাজার অভিযোগের তির ধেয়ে এসেছে তাঁর দিকে। ‘ঘোড়ার মতো মুখ আর হাত-কাঁপার জন্মগত রোগ’ওয়ালা এই কপর্দকশূন্য ইহুদিটাকে কেন এককালে বিয়ে করেছিলেন ভার্জিনিয়া স্টিফেন, নিশ্চয় এর অযত্ন আর অবহেলাতেই প্রাণ গেল সম্ভাবনাময়ীর! এমন চিত্রনাট্য তখন রোজ ছাপা হয় খবরের কাগজে। প্লটটা অবশ্য মুখ থুবড়ে পড়ল, কারণ কাগজে-কলমে লিওনার্ড প্রমাণ করলেন, ভার্জিনিয়া ভুগছিলেন বাইপোলার ডিজঅর্ডারে। ভয়াবহ ডিপ্রেশন আর ম্যানিয়াগ্রস্ত উত্তেজনা যে-রোগের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী।



সৃজনশীলতার সঙ্গে মানসিক অসুস্থতার কি কোনো সংগোপন সম্পর্ক রয়েছে? কারও কারও ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়, ব্যাপারটা এমন একধরনের মানসিক বিকার (কখনো কখনো অসুস্থতার কাছাকাছি), যা সৃজনশীলতাকে উদ্দীপ্ত করতেও সাহায্য করে, আবার অন্যদের ক্ষেত্রে তা হয়তো একপর্যায়ে বিনাশী রূপ ধরেই আসে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, লেখালেখি বা শিল্পচর্চা ছাড়াও সামগ্রিকভাবে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যাঁরা লিপ্ত, তাঁরা সমাজের অন্যদের থেকে কমপক্ষে ৮ শতিংশ বেশি বিষণ্নতা, মানসিক ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। তবে কবি-লেখকদের বেলায় এই ঝুঁকি আতঙ্কিত হওয়ার মতো বেশি। ভুক্তভোগীদের শতকরা ৫০ জনই আত্মহত্যায় জীবনের ছেদ টেনেছেন এমন তথ্য রয়েছে। মার্কিন ঔপন্যাসিক ই এল ডকটোরো এ বিষয়ে খোলাখুলি মতামত দিয়েছেন এই বলে যে লেখালেখি সামাজিকভাবে অনুমোদনপ্রাপ্ত একধরনের সিজোফ্রেনিয়া।



ভার্জিনিয়া উলফের বিষয়ে ধারণা করা হয়, তাঁর শেষ উপন্যাস বিটুইন দ্য এক্টস-এর (মৃত্যুর পর প্রকাশিত) পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার পরপরই তাঁকে প্রচণ্ড বিষণ্নতা পেয়ে বসেছিল। ইতিপূর্বেও একাধিকবার এমন হয়েছিল—পরিবারের আপনজনের মৃত্যুতে এবং বই প্রকাশের পর অসন্তুষ্টিতে। তবে সে সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকবলিত পৃথিবীর নানা দুর্যোগও তাঁর বিষণ্নতাকে মনোবৈকল্যের এক চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। একার অন্ধকারে ডুবে মরা এই ভার্জিনিয়ার জন্য কোথাও ছিল না একফোঁটা চোখের জল। সবাই তাঁর মেধার দখলস্বত্ব বুঝে নিতে চায় শুধু। একের পর এক খবর তখন সিলমোহর দিয়ে জানান দিচ্ছে ভার্জিনিয়ার মৃত্যুজনিত বিষণ্নতা আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীর শহুরে ক্লান্তি আর বিষণ্নতার দ্যোতক। তাদের নির্মম তাত্ত্বিক দর্শনের পুঁজি উপুড় করে এই মৃত্যুকে মুড়ে ফেলতে চাইছে গবেষণার শুখা কাগজে। বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়ে জীবন দুর্বহ হয়ে পড়ার ঘটনা খ্যাত-অখ্যাত বিস্তর কবি-সাহিত্যিকের বেলায় ঘটেছে। কেবল খ্যাতনামাদের তালিকাই কম দীর্ঘ নয়; তবে এই বিষণ্নতা সবার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত তা বলা যাবে না। ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বিষণ্নতাসহ নানা বিতর্ক দাঁড় করালেও এর পেছনে বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ায় বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাঁর বৈরিতাজনিত হতাশাকে মূলত দায়ী করা হয়ে থাকে। সৃজনশীলতা, বিষণ্নতা ও আত্মহত্যা—এই তিনের অন্তঃসম্পর্ক নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন। বইপত্রও লেখা হয়েছে। সুরাহা হওয়ার বিষয় নয়, তবু কোথাও যেন একই সুতার টান টের পান কেউ কেউ, বিশেষত মনোবিশ্লেষকেরা।



তোমাকে লিখতে লিখতে রাত পেরিয়ে পুবের আকাশ রাঙা হয়ে উঠছে। ব্রহ্ম মূহুর্ত পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। আকাশটা প্রথমে গভীর নীল, তারপর ধীরে ধীরে ফিকে হচ্ছে। দিগন্তে যেন কেউ হালকা হলুদ রঙের তুলির আঁচড় টেনে দিয়েছে। সেই আঁচড়ের ভেতর থেকে বেরোতে শুরু করেছে লালচে আভা। আর কয়েক ঘন্টা পরেই বেনারস নামবো। ভাবছি বহুবছর পরে আবার যখন এসেছি বাবু মায়ের পিন্ডটা দিয়ে যাবো। আবার কবে আসবো আদৌ আসবো কিনা জানিনা। ট্রেনের কামরা জেগে ওঠছে। চিঠিটা বেনারস নেমে পোষ্ট করবো। নিরন্তর ভালো থেকো।



অন্তে প্রীতি হোক

বাসু

২৮ সেপ্টেম্বর,২০২৫
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















১৫

গের্ট হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ ইনেসের দিকে।

-‘উকিল হয়ে পাশ করলে… কিন্তু সেটা তো আলাদা ব্যাপার। সেটা তো পেশা!’

-‘পেশা হোক বা ব্যক্তিগত জীবন… আসল ব্যাপারটা তো তোমাকে নিয়েই। যাই হোক, আমার মতে তোমার মনের জোর যে কম শুধু তাই নয়, তুমি অদ্ভুত কাপুরুষের মত আচরণ করছ।’

-‘কাপুরুষের মত?’

-‘হ্যাঁ। কারণ বের্শেন চলে গেছে বলে তুমি কষ্ট পাচ্ছ এবং কষ্ট পেয়ে নিষ্কর্মার মত বসে আছ। কোনও কাজ না করার ফলে তোমার কষ্ট আরও বেড়ে যাচ্ছে। তুমি নিজেও জান যে তোমার মনের জোর নেই এবং সেই কারণেই তুমি পড়াশুনায় ফিরতে চাইছ।’

-‘সেই কথাটা তোমার আমাকে না বললেও চলবে। ও হ্যাঁ, ভাল কথা… ঠিক কী কারণে বের্শেনকে আমার ভালবাসা উচিত নয়?’

-‘এটা তো আমারও প্রশ্ন! শোনো গের্ট, তুমি তো আর কচি খোকা নও। নিজের প্রতি সৎ থাকো। আসল কথাটা কী?’

-‘আমার ভীষণ একা লাগছে ইনেস। সহ্য করতে পারছি না আমি।’

-‘পড়াশুনা শুরু করলে অবশ্য একদিকে ভালই হবে। তুমি তো আগে কখনও সেভাবে খাটবার চেষ্টা করনি।’

-‘এইরকম একাকিত্ব আমি সহ্য করতে পারছি না!’

-‘অনেকেই তো একা। তাছাড়া তোমার সঙ্গে তো আমি আছি, ফ্লক আছে। তুমি যদি চাও, বের্শেনের সঙ্গে দেখা করে আসতে পারো। সে হতভাগা নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে।’

-‘ভুল করছ… আমি তো বের্শেনের কাছে কিছু চাইনি। বরঞ্চ সে চলে যাবার পরে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। ওর সুন্দর মাথার গড়ন, মিষ্টি শিশুসুলভ মুখ… এসব দেখেই আমার অসহ্য লাগতো। ও সব সময় আমাদের সঙ্গে চিপকে থাকতো… সব সময়! পুরো ব্যাপারটাই বিরক্তিকর!

- ‘থামো! তুমি নিজেও জানো যে যা বলছ সেটা তুমি বিশ্বাস কর না।’

কিন্তু গের্ট থামে না। থামতে চায় না সে। ইনেসের দুটো হাত শক্ত করে ধরে আছে সে। মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে প্রচণ্ড আবেগমথিত স্বরে সে বলে যায়…

‘ইনেস, ও আমাদের বিরক্ত করত। আমি একদম নিশ্চিতভাবে, ঠিকভাবে ভেবেই বলছি তোমায় যে ও আমাদের জ্বালিয়ে খেত। তুমি ওকে কত প্রীতি ভালবাসা দিয়েছ, আমিও দিয়েছি। তুমি সব সময় ওকে আগলে দেখে রাখতে, যখন আমরা সন্ধ্যায় একসঙ্গে বেরতাম লং ড্রাইভে। আমরা ওকে ভালবাসায় ভরিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।’

‘এবং সে শান্ত হয়ে ফ্লককে কোলে নিয়ে তার কলারটা চেপে আমাদের মাঝে বসে থাকত; সেও সব সময় আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ উষ্ণ প্রীতি দেখিয়েছে।’

‘কিন্তু তুমি তাকে আমার চেয়েও বেশি ভালবাসা দিয়েছ। আমার ব্যাপারে তুমি সেভাবে পরোয়া কর না।’

‘ছেলেমানুষি কোর না গের্ট!’

‘ওহ… ইনেস, আমি চাই যে তুমি আমায় ভালোবাসো!’ গের্ট আরও শক্ত করে চেপে ধরে ইনেসের দুই হাত। এতটাই শক্ত করে ধরে যে তার কব্জি ফ্যাকাসে হয়ে যায়; ইনেসের হাতের পাতায় সে নিজের মুখ চেপে ধরে। এক অদ্ভুত সমর্পণে কম্পিত হয়ে আনত হয় তার শরীর। মুখমণ্ডল উত্তেজনায় সাদা হয়ে যায়। ইনেস গের্টের গলা জড়িয়ে ধরে তার দুই হাতে। কিছুক্ষণ পিছনদিকে হেলিয়ে রাখে তার মাথা। তারপর হঠাৎ চুম্বনে আবদ্ধ হয়ে কেঁদে ওঠে তীব্রভাবে।

-------------------









প্রথমে বের্নহার্ড চার্লসকে জেরাল্ডের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেনি। তবে যাবার কথা উঠতো মাঝে মাঝেই। বিকেলের দিকে সময়টা ফাঁকা থাকত। ইচ্ছে হলে পরদিনই যেতে পারত তারা। এরকম একটা অদ্ভুত ব্যাপার বেশিদিন ফেলে রাখা ঠিক নয়। কিন্তু চার্লসের এক গোঁ; সে যেতে একেবারেই রাজি নয়। সে বলল যে তার ভয় করছে। এখন এই ভয়ের ব্যাপারে বের্নহার্ড আর কী বা করতে পারে? চার্লস উল্লেখ না করলে জেরাল্ডের বাড়ি যাবার ব্যপারে বের্নহার্ড আর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কিছুই বলবে না ঠিক করল।



অবশ্য বের্নহার্ড নানা ব্যাপারে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অচেনা জায়গা, সবকিছুই অজানা অচেনা তার কাছে। ফলে অনেক সময় তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। তাছাড়া আসল কথা হল যে তার আরও অর্থ প্রয়োজন। মাসের প্রথমে বাবা যে টাকাটা পাঠিয়ে দেন, তাতে ঘর ভাড়া আর দুই বেলার খাওয়া হিসেব করে চললে কুলিয়ে যায়। কিন্তু লন্ড্রির খরচ, স্বরলিপি কিনবার খরচ, পিয়ানোর ভাড়ার খরচ ছাড়াও শীতের জন্য বেশ কিছু পোশাক কেনা প্রয়োজন, যেগুলো সে এখনও কিনে উঠতে পারেনি। এছাড়া বাসভাড়া থেকে শুরু করে চার্লসকে সিগারেট কিনতে ধার দেওয়া পয়সা… খরচের কি শেষ আছে? মোট কথা হল যে তার টাকা দরকার।

আশ্চর্য হয়ে সে লক্ষ্য করল যে চার্লস এবং অন্যান্য বন্ধুদের কাছে সে যেরকম পরিস্থিতির কথা অতীতে শুনেছে, সে নিজেই এখন সেরকম পরিস্থিতিতে পড়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি সামলে নেবার জন্য সে একেবারেই প্রস্তুত নয়। তার টাকার দরকার এবং সে জানে না যে কী ভাবে সেই টাকা যোগাড় হবে। চার্লস সে কথা শুনে শুধুই কান এঁটো করা হাসি দিল। বের্নহার্ডের একেবারেই ভাল লাগল না তার এই অদ্ভুত ব্যবহার। কারণ বের্নহার্ড তাকে গত বেশ কয়েকটা সপ্তাহে বারেবারে সাহায্য করেছে। তাছাড়া পরের কিস্তির টাকা মাদাম দুবোয়ার কাছ থেকে পেতে আরও আটদিন বাকি আছে এবং সে কথা শুনে কী ভাবে কারো হাসি পায়, সেটাও বের্নহার্ড ভেবে পেল না।

বের্নহার্ড তার সঙ্গীতশিক্ষকের কাছে জানালো তার সমস্যার কথা। সঙ্গীতশিক্ষকের কাছে একটা নয়, একাধিক উপায় জানা আছে এই সমস্যার সমাধান বের করবার। এখন বের্নহার্ডকে বেছে নিতে হবে সে ঠিক কোন কাজটা করতে চায়।

‘আপনি তো নিজেও সঙ্গীত শিক্ষা দিতে পারেন, আপনার অগ্রগতি প্রশংসনীয়!’

প্রশংসা শুনে বের্নহার্ড লজ্জায় লাল হয়ে যায়।

‘কিন্তু আপনাকে দেখতে খুবই তরুণ… আসলে দেখে মনে হয় স্কুলের শিক্ষার্থী!’

বের্নহার্ড এই কথাটা হাসিমুখে একেবারে অগ্রাহ্য করে। কারণ, যে উপায়গুলি তার সামনে এসেছে, সেগুলো বেশ আকর্ষণীয়। যেমন, একজন ভদ্রমহিলা এসেছেন আমেরিকা থেকে, মাতৃভাষা জার্মান, পোষা একটা বাঁদর আছে বাসায় এবং তিনি কণ্ঠসঙ্গীত শিখতে চান। বের্নহার্ডের শিক্ষকের নামডাক শুনে তাঁর শরণাপন্ন হয়েছেন। এই ভদ্রমহিলা খুব ধনী এবং গায়িকা হতে চান; অথচ তিনি কিছুতেই বুঝতে চান না যে কেন শিক্ষক প্রতিদিন তাঁকে সঙ্গীতশিক্ষা দিতে রাজি হন না।

এছাড়া আছে একটা রাশিয়ান কয়ার, যারা একজন বাজিয়ে খুঁজছে, যে স্বরলিপি দেখে চট করে বাজিয়ে দিতে পারবে এবং অন্যান্য যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পী এবং কণ্ঠসঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে রিহার্সাল দেবার সময় বের করতে পারবে।

আর আছে একটা জ্যাজ ব্যান্ড, যারা একজন প্রতিভাবান পিয়ানোবাদকের সন্ধানে আছে। এরা সিন নদীর উত্তরে শহরের কেন্দ্রস্থলে একটা ছোট বারে নিয়মিত কনসার্ট করে। দিনে চার ঘণ্টা এদের সঙ্গে বাজাতে হবে। অনুষ্ঠানের সময় শিল্পীরা লাল স্যুট আর সাদা লাল চেক টাই পরে এবং বের্নহার্ড এদের সঙ্গে বাজালে দিনে ১৫০ ফ্রাঁ রোজগার করতে পারবে, কারণ এই ব্যান্ডটার বেশ নামডাক আছে।

কিন্তু এই তরুণ পিয়ানোবাদককে সব বিষয়গত খুঁটিনাটি ভালভাবে জানতে হবে এবং সেই ব্যান্ডে অন্তর্ভুক্ত হবার আগে একটা অডিশন পরীক্ষায় উপস্থিত হতে হবে। কিন্তু বের্নহার্ডের মনে একটু সন্দেহ ছিল যে এই কাজটা সে ঠিকভাবে সামলাতে পারবে কি না। ফলে সে ওই আমেরিকান ভদ্রমহিলা, যার পোষা বাঁদর আছে, তাঁকে সঙ্গীতশিক্ষা দেবার কাজটা বেছে নিল। তার শিক্ষক তার যোগ্যতা বিষয়ে সুপারিশ করে খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখে দিলেন। চিঠিটা নিয়ে দিনের শেষে বের্নহার্ড খুব ক্লান্ত হয়ে নিজের বাসায় ফিরল।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















২৩.২

রঙ্গনাথের প্রিন্সিপালের কথায় বাধা দিয়ে কিছু বলার সাহস হল না। তাই বলল, “হ্যাঁ, প্রিন্সিপাল

সাহেব, ঠিকই আছে’।


হঠাৎ প্রিন্সিপাল খেপে গেলেন। “ঠিক তো বটেই রঙ্গনাথ বাবু, আমায় চার চার বোনের বিয়ে দেয়া

বাকি। পকেটে একটা ফুটো কড়িও নেই। কাল বৈদ্যজী যদি আমায় কান ধরে কলেজ থেকে বের করে দেন

তো কেউ ভিক্ষাও দেবে না।

“তাহলে আমি ওই খান্না-বান্নাকে বাপ বলে ডাকব, নাকি বৈদ্যজীকে? তুমিই বলে দাও”।

গোড়ার কথাবার্তায় প্রিন্সিপালের একটা মানবিক এবং সংবেদনশীল চেহারা দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু

এখন উনি যা করছেন তাতে সেই চেনা বাংগড়ুপনা বা ক্যাওড়ামিই প্রকট হচ্ছে। এভাবে ওঁর তৈরি

সাময়িক আবেগঘন মায়ার প্রভাব গায়েব হয়ে গেল।

রঙ্গনাথ আগের মত হালকা মেজাজে। বলল, “না না; আপনি যা করছেন- সব ঠিক। আর যেখানে যা আছে,

সব ঠিকই আছে। ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হলে বেশি কি হত? এখানে আপনি কোন ভাইস চ্যান্সেলরের

চেয়ে কম নাকি”?

এতক্ষণে প্রিন্সিপাল একটু হাসলেন। বললেন। “ হ্যাঁ, সে তো বটেই। আমি তো নিজেকে ভাইস

চ্যান্সেলরের থেকেও সেরা ভাবি। আজকাল ভাইস চ্যান্সেলরের জীবনও নরক সমান। সকাল থেকেই

নিজের মোটরগাড়ি চড়ে সমস্ত আমলাদের সেলাম ঠুকতে বেরোয়। কখনও চ্যান্সেলরের সামনে হাজির

হও, কখনও কোন মন্ত্রীর, কখনও সেক্রেটারির। গভর্নর বছরে অন্ততঃ চারবার বকুনি লাগান।

দিনরাত ক্যাঁও -ক্যাঁও, চ্যাঁও -চ্যাঁও! ছাত্রের দল মুখের উপর মা-বোন তুলে গালি দিতে দিতে মিছিল

বের করে। সবসময় মার খাওয়ার ভয়! পুলিস ডাকো তো এসপি হাসে। বলে -দেখ এই ভাইস

চ্যান্সেলরকে! ছেলেদের উপর বছরে দশ- বিশবার লাঠি তলোয়ার না চালিয়ে এনার শান্তি নেই। এই তো

অবস্থা, বাবু রঙ্গনাথ”!

গলা খাঁকারি দিয়ে ফের বললন,”এখনও প্রিন্সিপালগিরিতে এসব ঝামেলা শুরু হয় নি। আর যেখানে

বৈদ্যজীর মত ম্যানেজার, সেখানে প্রিন্সিপাল, ধরে নাও, কোন বব্বর সিংহের চেয়ে কম নয়। আমি

কাউকে খোশামোদ করতে চাই না। বৈদ্যজীর খুঁটি ছুঁয়ে রেখে সবাইকে জুতোর আগায় ঠিক রাখি। তুমি কী

বল, বাবু রঙ্গনাথ”?

“যা বলছেন, একদম ঠিক”।

“আর সত্যি কথা জানতে চাও তো বলি—ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার না হওয়াতে আমার কোন দুঃখ

নেই। ওখানে আরো বড় নরক, একেবারে কুম্ভীপাক! রাতদিন খোসামুদি। কোন সরকারি বোর্ড দশ

টাকার গ্রান্ট দেয়, তো কান ধরে যেমন ইচ্ছে থিসিস লিখিয়ে নেয়। যাকেই দেখ, একটা না একটা

রিসার্চ প্রোজেক্ট বগলদাবা করে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলে বলে—রিসার্চ করছি। কেমন রিসার্চ?

যার খাচ্ছ, তার গুণ গাইতে থাক, ব্যস। এদের কী যেন বলে? একটা বিশেষ শব্দ? হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়ল-

-বুদ্ধিজীবী। অবস্থা এমন যে এইসব বুদ্ধিজীবীরা বিলেত যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য নিজের বাপের

নাম বদলে দিতে পারে। এদের চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে দশবার জুতোপেটা কর, কিন্তু একবার তো

আমেরিকা ঘুরে আসতে দাও! এই হল তোমার বুদ্ধিজীবী”।

এবার উনি নিজের মাতৃভাষা অবধী থেকে একটি প্রবাদ আউড়ে দিলেন।

“গু খেতে হলে হাতির গু খাব। আমি তো এটাই ভেবেছি যে বৈদ্যজীর খোসামোদ করলে আর কাউকে তেল

দেবার দরকার নেই। লেকচারার হওয়া আমার পোষাবে না”।




প্রিন্সিপাল মাথা নেড়ে লেকচারার হবেন না জানিয়ে দিলেন। ওনার মুখের ভাবে মনে হল যেন সংসারের

সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শোকের ছায়া নেমেছে।

“এটা একদম ঠিক বলেছেন”, রঙ্গনাথ সায় দিল।

প্রিন্সিপাল তীক্ষ্ণ চোখে রঙ্গনাথকে দেখতে লাগলেন। তারপর ফিকে হেসে ধীমে স্বরে বললেন, “কী

ব্যাপার বাবু রঙ্গনাথ? আজ আমি যাই বলি সবতাতেই হ্যাঁ বলছ যে”?

রঙ্গনাথ বলল, ‘ভাবছি, আপনার অভিজ্ঞতা থেকে শিখব। কী দরকার কারও কথার ভুল বের করার? যে

যাই বলুক, আমি বলব –ঠিক বলেছেন”।

প্রিন্সিপাল সাহেব হা-হা করে হেসে উঠলেন, “তুমিও ঠিক বলেছিলে, রঙ্গনাথ বাবু। যখন পিকাসোর নাম

নিলাম, তোমার নিশ্চয়ই বমি পাচ্ছিল, এটা বুঝি—।

“এতে অবাক হবার কী হয়েছে? এসব কথার প্রভাব মেশিনের উপরেও পড়ে। তোমায় একটা ঘটনার কথা

বলি।

“একটা হাওয়াই জাহাজ ইন্ডিয়া থেকে ইংল্যাণ্ড যাচ্ছিল। যাত্রীদের মধ্যে একজন তামাক ব্যবসায়ী

ছিল। শালার সারা জীবন কাটল বিড়ি-সিগ্রেটের কারবার করে। হঠাৎ ওর কী যে হল, ব্যাটা লিটারেচার

আর ফিলজফির তত্ত্ব আওড়াতে লাগল। ব্যস, তক্ষুণি হাওয়াই জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল।

বিমান একহাজার ফুট নীচে নেমে এল। আতংক ছড়িয়ে পড়ল। সবাই ভাবল কোন দুর্ঘটনা হয়েছে, কিন্তু

একটু পরে আবার ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। বিমান উড়তে লাগল।

“হাওয়াই জাহাজের ইঞ্জিনিয়ার কারণ খুঁজে কী পেল জান? ওই তামাকের ব্যবসায়ী হঠাৎ কার্ল

জেসপার্সের নাম নিয়েছিল। আর সেই ঝটকায় বিমানের ইঞ্জিনের হার্ট ত্থেমে গেল।তখন সব যাত্রী

ওই লোকটাকে মিনতি করতে লাগল—মশাই, হয় চুপ করে থাকুন, নয় শুধু তামাক নিয়ে কথা বলুন। নইলে

অ্যাকসিডেন্ট হবে”।

রঙ্গনাথ হেসে উঠল,”আজ আপনি ভারি মজার কিসসা শোনাচ্ছেন”।

প্রিন্সিপালের চেহারায় উদাস ভাব। “আপনার জন্য রোজ এমন সব কিসসা শোনাতে পারি। কিন্তু আপনি

আমাকে কোথায় পাত্তা দিচ্ছেন? আপনি তো আজকাল খান্না মাস্টারের কথায় নাচছেন”।




ওরা এখন ফেরার পথ ধরেছেন। আঁধার নেমেছে। বাতাসে শীতের আমেজ। রাস্তার ধারে কয়েকজন

যাযাবর শ্রেণীর লোক বসে আগুন পোহাচ্ছিল আর অভিজাতকুলের অবোধ্য কোন ভাষায় নিজেদের

মধ্যে গল্প করছিল। যেভাবে লোকে পথের ধারে পড়ে থাকা গরু -মোষকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যায়,

প্রিন্সিপাল তেমনই করে ওদের এড়িয়ে চলতে লাগলেন। রঙ্গনাথ একবার পেছন ফিরে ওদের দেখে

মন্তব্য করল—“বেশ ঠান্ডা পড়েছে”।

প্রিন্সিপাল সাহেব আবহাওয়া নিয়ে কোন কথা বলার মুডে ছিলেন না। উনি আগের কথার খেই ধরে

বললেন,”তোমরা এখনও লোক চিনতে শেখ নি। রূপ্পন তো শুনলাম খান্না মাস্টার চক্করে পড়েছে।

কিন্তু, বাবু রঙ্গনাথ! এই খান্না মাস্টারটি কেমন চিজ সে তো তোমার বোঝা উচিত।




“খান্না বড় চালু মাল। দেখ, সেদিন কলেজে মারপিটের পরিস্থিতি হল কিনা? ওর তো কিছু এসে যায় না।

কিন্তু কলেজের ইজ্জত গেল”।

রঙ্গনাথ, “আমি তো শুনেছি ঝগড়ায় দু’পক্ষেরই দোষ ছিল”।

প্রিন্সিপাল সাধু-সন্তের মত বললেন, “তোমার শোনা -না -শোনায় কি হয় বাবু রঙ্গনাথ? মামলা তো

এখন কাছারিতে পৌঁছে গেছে। ম্যাজিস্ট্রেট যেমন বুঝবেন, ফয়সালা করবেন”।

--“এ তো বড় খারাপ কথা”!

--‘খারাপ মানে? এক ঘটি জলে ডুবে মরার সমান, রঙ্গনাথ বাবু! কিন্তু খান্না মাস্টারের লজ্জা-শরম

বলতে কিছুই নেই। আমাকেই ওর গলায় পাথর বাঁধতে হবে, তবে না ডুববে”!

উনি এখন সরকারের প্রচার বিভাগের মত নিস্পৃহভাবে—অর্থাৎ কেউ শুনুক, না শুনুক, আমি তো

বলবই—বলতে লাগলেন।

“ পুলিস জবরদস্তি দু’পক্ষেরই নামে ধারা ১০৭ এর মামলা শুরু করেছে। এটা পুলিসের হারামিপনা। খান্না

করল বদমাইসি। ওর সঙ্গীসাথীরা মারামারির জন্যে উসকে দিল। আর পুলিস চালান কাটল দুপক্ষের

নামে! এ তো একদম ‘অন্ধের নগরী চৌপট রাজা’ 1 কেস।

“কালকেই শুনানি ছিল। আমাকে বলল মিটমাট করে নাও। আমি বললাম—তার কি দরকার? আমাকে

সোজা ফাঁসিকাঠে চড়িয়ে দিন—ঝামেলা খতম। শিবপালগঞ্জে শুধু খান্না মাস্টার থাকবে, আর থাকবে

ওর গুণ্ডার পাল। ফের কিসের ঝগড়া, কিসের বিবাদ?

“আমি তো চুপচাপ চলে এলাম। কিন্তু ওদের দেখ—সত্তরটা ছেলে নিয়ে ‘প্রিন্সিপাল মুর্দাবাদ’ মিছিল

বের করেছে। শহরের আদালত। অনেক ভালো লোকের নিবাস। ওরা জিজ্ঞেস করছিল—এইসব ছেলেপুলে

কোথাকার? খান্না মাস্টার আগ বাড়িয়ে বলে দিল –ওরা ছঙ্গামল কলেজের ছাত্র।

“বেশরম হতে হয় তো ওর মত”।

ফের উনি অবধী বুলিতে তিন নম্বর প্রবাদ আউড়ে দিলেন—'ন্যাংটোর পোঁদে জুটেছে ইজের, তো নেচে

নেচে বলছে-এই তো ছায়া পেয়েছি’।

“ বুঝেছ বাবু রঙ্গনাথ! এই হচ্ছে তোমাদের খান্না মাস্টার। রূপ্পন বাবুকে বলে দিও—ওর সঙ্গে বেশি

গা ঘষাঘষি না করতে। নইলে একদিন কাঁদতে হবে”।




এবার ওরা থানার সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। লণ্ঠন হাতে ক’টা সেপাই এদিক করছে। ভারি শোরগোল।

কয়েকটা ছোঁড়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোরাস গাইছে। থানার পাশে দারোগাজির কোয়ার্টারের সামনে তিনটে

ট্রাক দাঁড়িয়ে, তাতে মালপত্র তোলা হচ্ছে। হো-হল্লার আসল কারণ ওটাই।

প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, “মনে হচ্ছে দারোগাজীর হয়ে গেছে”! বলতে বলতে উনি রঙ্গনাথের কাঁধ

ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন, “এই ব্যাপার! পুরো এলাকা নোংরা ময়লায় ভরে গেছল। এবার সাফ হচ্ছে”।

1 হিন্দি কথা সাহিত্যের প্রখ্যাত ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রের লেখা ‘অন্ধের নগরী চৌপট রাজা”।

প্রবাদের অর্থ যে দেশে নিয়ম কানুন নেই, রাজা গায়েব।




রঙ্গনাথ,”বুঝতে পারছি না, এত তাড়াতাড়ি অর্ডার এসে গেল! কী ভাবে? দুপুর বেলাতেও কোন খবর

শুনিনি তো”।

প্রিন্সিপাল সাহেবের খুশির কোন সীমা নেই। দেখে মনে হচ্ছে এবার উনি ডানা মেলে আকাশে উড়ে

সামনের গাছের ডালে গিয়ে বসবেন আর বুলবুলির মত সুরেলা শিস দেবেন। বললেন, “বাবু রঙ্গনাথ,

এতদিন মামার সঙ্গে থেকেও ওনাকে চিনতে পারোনি? আগের দারোগাকে উনি বারো ঘণ্টার মধ্যে

শিবপালগঞ্জ থেকে ভাগিয়ে দিয়েছিলেন। এই দাওগা তো তবু চব্বিশ ঘন্টা টাইম পেয়ে গেল”।

এরপর ফিসফিসিয়ে, “বৈদ্যজীর মহিমা কেউ বুঝতে পারে? যেদিন উনি জোগনাথকে জামিনে ছাড়লেন না,

সেদিনই বুঝেছিলাম যে এনার দিন ঘনিয়ে এসেছে। তার সাথে আমার ১০৭ ধারার মামলা। তুমিই বল বাবু

রঙ্গনাথ, এর কোন দরকার ছিল? কিন্তু এনাকে বোঝাবে কে? ইনি রামাধীনকে বাপ ডেকেছেন। ও যেমন

ইচ্ছে, তেমনই নাচিয়েছে—সে তো তুমি দেখেছ। এখন এটাও দেখলে যে দশটা দিন গেল না, ওর শমন

এসে গেল”।

ছোকরার দলের কোরাস জারি—“দারোগাজী, ট্রাকে চড়লেন, দারোগাজী, ট্রাকে চড়লেন”।

ওরা দলবেঁধে ট্রাকে দারোগাজীর মালপত্র তোলা দেখছে।

একটা ট্রাকে শিশু কাঠের কিছু বড় বড় পালংক উঠে গেছে আর খালি জায়গাটুকুতে একটা চমৎকার

ভাল জাতের গরু আর তার বাছুর। প্রিন্সিপাল সাহেব দেখে টেখে প্রশ্ন করলেন, “মোষ দেখছি না যে!

মুররা জাতের দুধেল মোষ”?

রঙ্গনাথ বোঝাতে লাগল, “ এই গরুটা টিকৈতগঞ্জের ঠাকুর পরিবার দিয়েছিল। বিধবা ছেলে বৌয়ের পেট

খসানোর মামলা। গোদান করে পাপমুক্ত”!

উনি বিশেষ কাউকে লক্ষ্য না করে উঁচু আওয়াজে বললেন, “মোষটা কোথায় গেল? দেখছি না যে”!

অন্ধকারে কারও স্বর ভেসে এল—“বিক্রি হয়ে গেছে”।

“কোথায়”?

“শহর থেকে এক গোয়ালা এসেছিল”।

“কততে গেল”?

“একশ’তে আর কত? তুমি কি ভেবেছিলে-- হাজার”?

“আমি তো এখনও তাই ভাবছি”, প্রিন্সিপাল মজা করে বললেন।

তারপর রঙ্গনাথের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিলেন। ভাবটা—তুমিও কথাবার্তার মজাটা উপভোগ কর।

এখন ট্রাকের পাশে সেরেফ কিছু পালংক পড়ে আছে। রঙ্গনাথ শুনেছিল যে দারোগাবাবুর শখ নানারকম

পালংক জোগাড় করা। এখন নিজের চোখে দেখল। খুব হৈচৈ আর চেঁচামেচির মধ্যে ট্রাকে পালংক তোলা

হচ্ছে। কিছু উঠে গেছে, কিছু উঠছে, কিছু উঠবে। রাস্তায় কোরাস গাওয়া ছেলের দল এখন অন্ধকারের

মধ্যেও ট্রাকের কাছে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ভারি উৎসাহের সঙ্গে ট্রাকে পালংক তোলা দেখছে।

এক সেপাই ট্রাকে রাখা পালংকের উপর চড়ে হাতে লণ্ঠন ঝুলিয়ে নীচের লোকজনকে পালংক তুলতে

নির্দেশ দিচ্ছে। “আবে ও! কব্জাটা ভেঙে ফেললি তো! জানতাম, এ ব্যাটা না ভেঙে ছাড়বে না”।




ওর হুঙ্কার শুনলে সবাই মানবে যে পালংকের কব্জা ভেঙে ফেলাটা আজ ভারতীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে

বড় দুর্ঘটনা বটে! রঙ্গনাথও পালংক যারা ট্রাকে তুলছিল তাদের সান্ত্বনা দেবার জন্যে শীতল স্বরে

বলল, “হাঁ ভাই, কব্জা-টব্জা ভেঙো না। সামলে সুমলে ট্রাকে তোলো”।

প্রিন্সিপাল সাহেব রঙ্গনাথের কথা শুনে জোরে হেসে উঠলেন। এক সেপাই পালংক তোলার কাজ

করতে করতে নিজের জায়গা থেকে বলল, “কে বটে? প্রিন্সিপাল সাহেব নাকি? জয়হিন্দ্‌ সাহেব”।

“কী হয়েছে ভাই? জয়হিন্দ! বদলি হয়েছে কি”?

“হ্যাঁ, প্রিন্সিপাল সাহেব। দারোগাজী এসপি সাহেবকে দরখাস্ত দিয়েছিলেন। মেয়ের পড়াশুনোর জন্যে

শহরে বদলি চেয়েছিলেন”।

“আমার কলেজে ভর্তি করাতেন। শিবপালগঞ্জ কোন শহর থেকে কম নাকি”?

“আপনার কলেজ তো একটা হিন্দুস্থানী স্কুল। উনি ইংরেজিতে পড়াতে চান। ভগতিন স্কুলে। বেবির

উর্দি তৈরি হয়ে গেছে। নীল নীল উর্দি। গায়ে চড়ালে একদম ইংরেজ মেয়ের মত দেখায়”।

“তাহলে শহরে বদলি হয়েছে। বেশ, ভাল কথা। কিন্তু গরু কোথায় রাখবেন? খড় ভুষি কোথায় পাবেন?

গরুটা বেচবেন কি”?

সেপাই এবার একটা বড় পালংক হেঁইয়ো করে সর্বশক্তি দিয়ে ট্রাকে তুলছিল। কোঁকাতে কোঁকাতে

বলল, “না। গরু থাকবে সৈনিক ফার্মে। দারোগার ভাইসাহেব ওখানেই চাকরি করেন। এখানে গাই বেচারার

ঠিক মত খাওয়া জুটত না। এখন ওর খাওয়ার দিন আসছে”।

ট্রাকের উপরে সওয়ার সেপাইয়ের পুরো নজর পালংকের কবজায় আটকে ছিল। ও দাঁতে দাঁত পিষে

বলছিল, “ ঠিক সে। আবে ঠিক সে। আরে, আরে, এবার অন্য পালংকটাকেও ভাঙবি নাকি! যদি ভাঙে তো

সালা ---“।

কেউ বলল যে বৈদ্যজী এক্ষুণি দারোগাজীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। বলছিলেন—উনি থাকতে ওনার

বদলি কী করে হতে পারে? আদেশ বদলে দেবেন।

প্রিন্সিপাল রঙ্গনাথকে বললেন, “যদি চোখের চামড়া থাকে, তাহলে দারোগাজী ভোরের মোরগ ডাকার

আগে শিবপালগঞ্জ ছেড়ে চলে যাবেন”।

খানিকক্ষণ ট্রাকে চড়া মালপত্তর খুঁটিয়ে দেখা হল। রঙ্গনাথ বলল, “ দারোগাজীর শখ ছিল নানারকম

পালংক”।

“ওনার শখ যা কিছু মিনি মাগনা পাওয়া যায় তা হাতিয়ে নেয়া”। হঠাৎ উনি ট্রাকের উপড় চড়ে থাকা

সেপাইকে ডাক দিয়ে বললেন, “ আরে ভাই সেপাইজি! ওই কব্জা ভাঙা খাটিয়াটা ছেড়ে দাও না! যদি

টাকাখানেক দামে নীলামে ওঠে তো আমিই কিনে নেব”।

সেপাই বলল, “আপনি এত বড় মানুষ হয়ে কেন ছোটলোকের মত কথা বলছেন? নেবেন তো পুরো ট্রাক

নিয়ে নিন। বলুন, আপনার ঘরে পুরো ট্রাক পাঠিয়ে দিই”?

“হেঁ-হেঁ-হেঁ! একটা গোটা ট্রাক নিয়ে আমি কি করব? আমি তো মামুলি এক মাস্টার”। ফের গলার স্বর

বদলে মোটা আওয়াজে বললেন, “দারোগাজী ঘরেই আছেন তো? বৈদ্যজীও রয়েছেন? তো চলুন বাবু




রঙ্গনাথ, দারোগাজীকে সেলাম করে আসি। বেচারি বড্ড ভালমানুষ ছিলেন। কখনও কাউকে কষ্ট দেন

নি। কারও থেকে কিছু চাইতেন না। ভগবান যা দিতেন তাই চোখ বুঁজে নিয়ে নিতেন”।

হ্যাঁ, সত্যিই ভালোমানুষ ছিলেন, তাই চলে যেতে হল—রঙ্গনাথ ভাবছিল।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















১৪


ইনেস তাঁর বন্ধু গের্টকে নিয়েও বিশেষ চিন্তিত। গের্ট অবশেষে আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়বার ব্যাপারে মনস্থির করেছে। আগামী হেমন্ত থেকেই ক্লাস শুরু হবে। সে হিসেব করে দেখেছে যে পাশ করে বেরতে আরও তিন বছর লাগবে; কারণ কিছু সেমিস্টারের ক্লাস সে এর মধ্যেই করা হয়ে গিয়েছে তাঁর। গের্ট এই বিষয়ে ইনেসের সঙ্গে বেশ গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে আলোচনা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে নেওয়া সরু, হলদে সিলেবাসের বইটা নিজের পকেট থেকে বের করে যে যে ক্লাসের লেকচারগুলো শুনতে সে ইচ্ছুক, সেগুলোর পাশে একটা সোনালি রঙের পেন্সিল দিয়ে দাগ টানে।


ইনেস গের্টের পরিকল্পনা মনোযোগ দিয়ে শোনে। মনে মনে আগামী শীতের সময়টা কল্পনা করে সে। ফ্লকের সঙ্গে সে মাঝে মাঝে গের্টের এপার্টমেন্টে যাবে দেখা করতে। তবে খুব ঘনঘন যাবে না, কারণ গের্ট কাজে এবং পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকবে। বের্নহার্ডের সুন্দর পোর্ট্রেটের পেন্সিল স্কেচগুলোর বদলে কালো রঙের কলেজ খাতায় আর ‘করপাস ইউরিস সিভিলিস’ এর অনেক খণ্ডে ভরে থাকবে গের্টের টেবিল। একজন উকিলের ঘরে আর কী কী থাকতে পারে, সেই বিষয়ে ইনেসের পরিষ্কার ধারণা নেই। ফলে সে আর বেশি কল্পনা করতে পারে না; তবে তাঁর মনে হতে থাকে যে গের্টের চেহারা ক্রমেই একঘেয়ে ক্লান্ত, বিরক্ত ধরনের হয়ে যাবে এবং সে সবসময় তিরিক্ষি মেজাজে থাকবে।

কিন্তু তাঁর অন্যান্য বন্ধুরা? ফার্দিনান্দ আর বের্নহার্ড চলে যাবার পর থেকে সন্ধের আড্ডাগুলোর সেরকম কোনো আকর্ষণ আর নেই। হতে পারে যে তুমি আইনের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব করলে… ভবিষ্যতের উকিল অথবা বিচারক কিম্বা কৌঁসুলি যারা। এরা খুব গুরুগম্ভীর প্রকৃতির, সব সময় নিজের মর্যাদা বিষয়ে অত্যধিক সচেতন। তরুণ সঙ্গীতশিক্ষার্থীরা এমন নয়, উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে সবসময় সব ব্যাপারে চরম মতামত পোষণ করে না তারা। তবে গের্টকে ভবিষ্যতে স্থির করতে হবে যে সে হিটলারের পক্ষে না বিপক্ষে…


-‘গের্ট!’ ইনেস শুরু করে, … ‘তুমি কি হিটলারপন্থী?’


-‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?’


-‘না, এমনিই… জিজ্ঞেস করলাম আর কি!’


ইনেসের হঠাৎ গের্টকে আইনের ক্লাসের ছাত্র হিসেবে কল্পনা করে হাসি পায়। সাধারণত ছাত্র মানেই মানুষ তাদের স্নেহের চোখে দেখে। কিন্তু গের্ট ছাত্র হিসেবে নিঃসন্দেহে হাস্যকর… একটা অসম্ভব কাণ্ড ঘটতে চলেছে বলে মনে হয় ইনেসের। কারণ গের্ট খুবই সংবেদনশীল এবং সহজেই মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর। তাছাড়া যে কাজটা তাঁর পছন্দ হয় না, সেটা শেষ করা তো দূর, সে কিছুতেই বেশিক্ষণ টেনে নিয়ে যেতে পারে না। গের্ট নিজেও হয়তো নিশ্চিতভাবে এখনো বুঝতে পারছে না যে ভবিষ্যতে সে কী ভাবে ব্যাপারটা সামলাবে। তবে সে সমাজে ‘একজন’ হয়ে উঠতে চায়। সেটাই এই মুহূর্তে তাঁর একমাত্র ইচ্ছা। ‘একজন’ হয়ে ওঠা মানে সমাজে একটা ভাল জায়গা, একটা ভাল ডিগ্রি, উপাধি ইত্যাদি।

গের্ট এখনো অনিশ্চয়তায় ভুগছে। তবে নিজের সম্বন্ধে যথেষ্ট গর্ববোধ আছে তাঁর এবং এই বোধটাই তাঁর দুর্বলতা হয়ে উঠছে। কারণ সেটাই বদলে যাবার পথে তাঁকে ভিতরে ভিতরে বাধা দিচ্ছে। এই বিরক্তিকর এবং একঘেয়ে পরিস্থিতি থেকে বেরতে পারছে না সে। তাঁর দ্বিধা এখনো কাটেনি এবং সে বিষণ্ণ তিক্ত মেজাজে সিলেবাসের হলুদ বইটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।

ইনেস শান্তভাবে তাঁকে নিরীক্ষণ করে। তাঁর সুন্দর মুখমণ্ডলের রেখাগুলি, তামাটে হয়ে পুড়ে যাওয়া কপালের অর্ধেকটা কালো চুলের গুচ্ছে ঢাকা। তাঁর চোখদুটো গাঢ় রঙের, তীব্র এবং অস্থির। ঠোঁট এবং চোয়াল ক্রুদ্ধ, কঠিন, মাঝে মধ্যে সে মুখটা অল্প খুলছে যেন এখনই কোনও খেদ, অভিযোগ কিম্বা প্রতিবাদী সমালোচনার শব্দ বেরিয়ে আসবে।

কিন্তু গের্ট কখনই অভিযোগ করে না। তাঁর গর্ববোধ তাঁকে সেটা করতে বাধা দেয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে যখন সে অনেক কথা একসঙ্গে বলতে থাকে, সেসব কথাবার্তা উদ্ধত এবং বিদ্বেষপূর্ণ। যদি কোনও কারণে সে আহত হয়, তখন অবুঝের মত অনেক কথা আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে বলে দেয়। অনেক মানুষ এই কারণে গের্টকে একেবারেই পছন্দ করে না। তাঁকে উগ্র এবং বিশ্বাসের অযোগ্য বলে মনে করে। অনেকেই ইনেসকে সতর্ক করে গের্টের সঙ্গে মিশবার কারণে। আবার অনেকে অবাক হয় ইনেসের সাহসের কথা চিন্তা করে, কারণ সাধারণভাবে মানুষ মনে করে যে গের্টের মত ব্যক্তির কাছাকাছি থাকতে হলে অনেক সাহসের প্রয়োজন। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর। কারণ ইনেস গের্টের থেকে অনেক বেশি সপ্রতিভ এবং মানসিক শক্তির অধিকারিণী। তাছাড়া সে বের্নহার্ড এবং অন্যান্য বন্ধুদের যেভাবে সবসময় সাধ্যমত সাহায্য করতে প্রস্তুত, সেভাবেই সে গের্টকেও সাহায্য করে থাকে।

তবে এইমুহূর্তে গের্টের জন্য ইনেসের বেশ চিন্তা হচ্ছে। এতদিন গের্ট ভবিষ্যতে কী করতে চায়, সে বিষয়ে ইনেস একেবারেই মাথা ঘামায়নি। কারণ গের্ট সপ্রতিভ উজ্জ্বল তরুণ, যদিও বিশেষ উচ্চাশা নেই জীবনে। এদিকে আবার গর্ববোধ আছে যথেষ্ট পরিমাণে। জীবনে কিছু একটা করতে চায় সে সাফল্যের সঙ্গে, নিজের কাজের জন্য একটা স্বীকৃতিলাভ করতে চায় সে। কিন্তু সম্প্রতি সে সব ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে গিয়েছিল। নিজের ঘরে সিগারেট খেতে খেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কখনো একা বসে থাকছিল, আবার কখনও বন্ধুদের সঙ্গে এখানে সেখানে মাতাল হয়ে বেড়াচ্ছিল; এতকিছু করে কোনও উপকার অবশ্য হয়নি। এসব কাণ্ড ঘটিয়ে সে আবার লজ্জিত হয়ে শাস্তি পাওয়া স্কুলের ছাত্রের মত মুখ নিচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এদিক সেদিক। সবকিছুই ইনেসের কানে এসেছিল। ইনেস তাঁকে একসঙ্গে ঘুরতে কিম্বা হাঁটতে যাবার কথা বলেছিল; সে একেবারেই রাজি হয়নি এবং হাজারটা বাহানা দেখিয়েছিল। ইনেসের যে একটু খারাপ লাগেনি তা নয়, তবে সে মাঝে মাঝেই ফোন করে গের্টের খবরাখবর নিত। কারণ তার মনে হয়েছিল যে এসব বদমায়েশি আর ছেলেমানুষি কাণ্ড ঘটিয়ে গের্ট হয়তো তার সঙ্গে দেখা করতে লজ্জা পাচ্ছে। এর মধ্যে একদিন হঠাৎ গের্ট নিজে থেকেই ইনেসকে ফোন করে দেখা করতে চায়; বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা করতে, কারণ সে নাকি বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছে ইনেসকে একটা জরুরি কথা বলবার জন্য। এখন সে বলছে যে সে এখন সত্যিই ভালভাবে পড়াশুনা শুরু করতে চায়।


… ‘গের্ট, আসলে তুমি ঠিক কোন কারণে পড়াশুনা শুরু করতে চাও?’


-‘আমার বাবা মা সেটাই চান।’


-‘সেটা কি তুমি এতদিন জানতে না? জানা সত্ত্বেও তুমি সেই ব্যাপারে কোনও গুরুত্ব দাওনি।’


-‘কারণ আমি বিশ্বাস করতাম যে আমি ভাল আঁকতে পারি। আমি একজন শিল্পী।’


-‘কবে থেকে তোমার বিশ্বাসে চিড় ধরল?’


-‘বের্নহার্ড চলে যাবার পর থেকে।’


-‘তুমি এখন আর ছবি আঁকতে ভালবাস না?’


গের্ট যন্ত্রণাকাতর মুখে তাকায় ইনেসের দিকে… ‘তুমি তো সবই জানো।’ বলে সে… ‘কেন শুধুশুধু এই প্রশ্ন করছ?’ মুখটা অন্যদিকে ফেরায় সে… ‘আমি ভেবেছিলাম আমি আঁকতে পারব। কিন্তু আমি শুধু বের্নহার্ডকেই আঁকতে পারতাম। সে ছাড়া আর কাউকে, আর কোনওকিছু আমি আঁকতে পারি না। সে চলে যাবার পর আমি একটা রেখাও টানতে পারিনি কাগজে। আমার কোনও প্রতিভা নেই, ইনেস। ছবি আঁকতে নয়, আমি বের্নহার্ডকে ভালবাসি।’

অবশেষে গের্ট মুখ খুলেছে। আবেগমথিত খেদ আর অভিযোগের বন্যা বেরিয়ে আসছে এখন তার খোলা মুখ দিয়ে।

ইনেস স্তব্ধ হয়ে যায়। বিষণ্ণভাবে একদৃষ্টে গের্টের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। যদিও এই বিষণ্ণতা চট করে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না। মানুষের মনে হবে যে ইনেসের মুখমণ্ডলে অদ্ভুত প্রশান্তি বিরাজ করছে।

‘তুমি যদি পাশ করে উকিল হয়ে বেরোও, তাহলে কি তুমি আর বের্নহার্ডকে ভালবাসবে না?’ বলে ওঠে ইনেস, ‘তুমি কি তখন বদলে যাবে?’


(চলবে)
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in




















১২. নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় যে প্রেম সে কি কাম?





হৃদিবরেষু বাসু

''হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,/ মন বাড়িয়ে ছুঁই,/ দুইকে আমি এক করি না/ এককে করি দুই।'' এ যেন হৃদয়ের ভেতর থেকে আচমকা উঠে আসা একটি কবিতা! এই চিঠি যখন লিখছি তুমি নিশ্চয় তখন বেনারসে। পুজোর ছুটি নিয়ে ঘরে বসে আছি। সময় কাটাতে তাই অনেক খুঁজে বের করেছি নির্মলেন্দু গুণের নির্বাচিত কবিতা সংকলন। বইটা স্বয়ং কবির হাত থেকে পেয়েছিলাম। তোমাকে তার কবিতা নিয়ে বলার কিছু নেই জানি এমনকি বাংলাদেশের কাব্য-কবিতা–শিল্পসাহিত্য বিষয়ে যাঁদেরই একটু প্রাথমিক খোঁজখবর আছে, তাঁরা বোধ করি খুব বেশি দ্বিমত করবেন না যে নির্মলেন্দু গুণ যথেষ্ট পাঠকপ্রিয় কবি। এই কবি বেড়ে উঠেছেন উত্তপ্ত অগ্নিবলয়িত সময়ের ভেতর। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের লড়াইয়ের দিনগুলোতে তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে সক্রিয় ছিলেন। এজন্য সমাজ ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধ তিনি এখনো। এই কবি কবিতার মাধ্যমে একাত্মতার বাণী প্রচার করেছেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের একাত্ম হওয়ার সেই বাণী অসংখ্য পাঠককে মুগ্ধ করেছে, বাংলা কবিতায় নির্মিত হয়েছে একটি স্বতন্ত্র ধারা। তিনি প্রতিবাদ-সংগ্রামসর্বস্ব কবি নন মোটেও। বরং তাঁর কাব্যজগৎ পরিভ্রমণ করলে তাঁকে প্রধানত রোমান্টিক কবি বলেই মনে হবে। প্রেমই তাঁর কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। তাহলে যা হওয়া অসম্ভব বলে তিনি মনে করেছিলেন শেষ পর্যন্ত তিনি কি তা-ই হয়েছেন? হয়তো সেটাই সত্য। তবে এই সত্যের সঙ্গে কিছু শর্ত জুড়ে আছে। তিনি ‘নিরপেক্ষ বা নির্ভেজাল রোমান্টিক কবি’ হওয়াকে অসম্ভব বলেছেন, অর্থাৎ ‘পক্ষপাতী বা ভেজাল রোমান্টিক কবি’ হতে অসুবিধা নেই। তাহলে এই ‘পক্ষপাতী বা ভেজাল রোমান্টিক কবি’র চারিত্র্য কী? তিনি কি সেটাই হয়েছেন? এ-সম্পর্কিত তাঁর একটি স্বঘোষণা এক্ষেত্রে পর্যালোচনা করা যেতে পারে – আমি অন্তহীন আনন্দের উৎস খুঁজে পেয়েছি জীবনের মাঝে। পরিপার্শ্ব যতো বৈরীই হোক না কেন, – আমি তো আর মেনে নিচ্ছি না তা। আমি জানি, সংগ্রামই সত্য, সংগ্রামই সুন্দর। প্রেম, সেও এক সংগ্রাম। প্রেম এবং সংগ্রাম তাঁর দৃষ্টিতে অবিচ্ছিন্ন। অর্থাৎ ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর আকাঙ্খাকে তিনি অভিন্ন বলে বিবেচনা করেন। তাঁর প্রেম ও দ্রোহকে এই দৃষ্টিতে বিচার করাই যুক্তিযুক্ত হবে বলে আমার মনে হয়। নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই – প্রথম প্রকাশ ১৯৭০ সালে। এই গ্রন্থের সব কবিতা ষাটের দশকে লেখা, যে-সময়টা ‘উদ্দাম যৌবনতরঙ্গের মতো … মুক্তিমন্ত্রে ফুঁসে উঠেছিল’, যখন ‘নিরপেক্ষ বা নির্ভেজাল রোমান্টিক কবি হওয়া একেবারেই সম্ভব ছিল না’। কিন্তু তখনো তিনি প্রেমবিবর্জিত ছিলেন না, তবে তাঁর প্রেম ছিল সংগ্রাম-অভিমুখী, বা তাঁর সংগ্রাম ছিল প্রেম-প্রাণিত।

কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতায় আমরা চারটি প্রধান প্রবণতা খুঁজে পাই। প্রথমটি সুখী বা বিবাহিত জীবন অথবা পারস্পরিক ভালোবাসা। দ্বিতীয়টি প্রেমের প্রতি অবজ্ঞা, নিন্দা। প্রেম সম্পর্কে নিষ্ঠুর মনোভাব- যা নারীবিরোধী মনে হয়। তৃতীয়টি অধরা প্রেম বা প্লেটোনিক প্রেমের আধিপত্য সম্পদর্কিত, প্রেমের প্রতি সমর্পণ। চতুর্থ প্রবণতা হচ্ছে নারী সৌন্দর্যের চিত্রায়ণ খুব কমই।প্রথম প্রবণতার কবিতাগুলো সরল, বিশুদ্ধ, পারস্পরিক প্রেম ও দাম্পত্য প্রেমের সেরাটি সমর্থন করে। প্রেমের প্রতি সমর্পণের কথা রয়েছে। দুই আত্মা; কিন্তু মন যেন একটি- এসব কবিতার বৈশিষ্ট্য। এসব কবিতায় প্রিয়জন ছাড়া অন্য কোনো সত্তা নেই। এই প্রবণতার কবিতার সংখ্যা অনেক। কবি তার বন্ধুকে কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই একে অন্যকে ভালোবাসতে বলেন। কারণ তারা বিশ্বের কোনো ক্ষতি করছে না। তারা সব জড়জগৎ ত্যাগ করেছে। কবি বলেন যে, তাদের নিরীহ শারীরিক প্রেমের মাধ্যমে তারা প্রেমের জন্য আদর্শ হিসেবে অনুমোদিত হবে। তিনি প্রেমকে পারস্পরিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে মনে করতেন। তিনি বাইরের হস্তক্ষেপের উল্লেখ ছাড়াই এবং প্রেয়সীর মধ্যে অপর্যাপ্ততার কোনো ইঙ্গিত ছাড়াই পারস্পরিক প্রেম তৈরির আনন্দ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের কবিতায় অতিমাত্রায় নারী ও যৌনতার অনুপ্রবেশ ঘটানোর দায় নির্মলেন্দু গুণের এই কথা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। যদিও আমার মনে হয়, গুণের জনপ্রিয়তার মূলে ওই নারী ও যৌনতাবিষয়ক কবিতাগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। অমীমাংসিত রমণী কাব্যগ্রন্থ থেকে তাঁর এই যাত্রা শুরু। এরপর বিভিন্ন সময়ে নারী ও সংস্কারহীন যৌনতা প্রাধান্য পাওয়া কবিতাগুলো যথেষ্ট পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ মুঠোফোনের কাব্য, নিশিকাব্য, বাৎসায়ন কাব্যগ্রন্থগুলোর মাধ্যমে গুণ ভিন্নভাবে যেন হানা দিলেন। এর ভেতর দিয়ে ‘বাহ্যিক আদর্শ শাসিত’ পাঠকসমাজের গোপন বাজারটি তিনি দখল করে নিলেন। ফলে গুণের জনপ্রিয়তার পরিসর আরও বিস্তৃত হলো। নির্মলেন্দু গুণ নারীদের সম্পর্কে কথা বলতে পারেন, অনেক কবিতায় সৌন্দর্যের প্রশংসাও করেছেন। কিন্তু নারী সৌন্দর্যের চিত্রায়ণ খুব কমই আছে। তিনি সরাসরি বলেননি যে, তিনি তার প্রিয়জনের চুল বা ঠোঁট পছন্দ করেন। তিনি প্রেম-ভক্ত এবং শারীরিক চেহারা নয়, আবেগের কথা বলেন। তার কাছে ভালোবাসা মানে শুধু যৌনতা নয়। যদি সে তার প্রেয়সীর শরীরের কোনো অংশের কথা বলে, তা হলে সে কেবল তার মোহনীয়তা বর্ণনা করে। সরাসরি নারীর চরিত্র নির্মাণ না করা নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতায় অন্যতম ও আকর্ষণীয় প্রবণতা বলে মনে করি। প্রেমের কবিতায় নির্মলেন্দু গুণের সবচেয়ে মৌলিক অবদান সম্ভবত কল্পনার সঙ্গে চিন্তার মিশ্রণ, বুদ্ধির সঙ্গে আবেগ ও বাস্তবতার প্রতিফলন। পান্ডিত্যপূর্ণ এবং কল্পনাপ্রসূত তুলনা দ্বারা তিনি তার কবিতায় একটি বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি তৈরি করার জন্য বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে চমৎকার সেতুবন্ধন তৈরিতে অসাধারণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। প্রেমের অপূর্ব কিছু চিত্রকল্প। নির্মলেন্দু গুণের 'তোমার চোখ এত লাল কেন' কবিতাটি বেশ জনপ্রিয়। কোনো রাক-ঢাক না রেখেই একজন পুরুষের জবানিতেই কবিতায় উঠে এসেছে একাকী এক পুরুষের একাকীত্বের প্রগাঢ় বেদনা। খুব সরলভাবে মুখের ভাষায় তিনি কবিতায় বলেন, 'বাইরে থেকে দরজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত'। তাই, তিনি চান, কেউ একজন তার জন্য অপেক্ষা করুক। অপেক্ষা করুক ঘরের ভেতর। সেই অপেক্ষারতার কাছে বেশি কিছু প্রত্যাশা থাকবে না একাকী পুরুষটির। সে শুধু চায় ঘরের ভেতর থেকে একটি হাত দরজাখানি খুলে দেবে! এইটুকু! শুধু এইটুকু! এই সামান্য আকাঙ্ক্ষার কথা পড়তে পড়তে পাঠকের হৃদয় আর্দ্র হয়ে ওঠে। এই আকাঙ্ক্ষা শুধু কোনো একাকী পুরুষের নয়। একজন পুরুষের জবানিতে হলেও এই আকাঙ্ক্ষার কাছে এসে কবিতাখানি হয়ে ওঠে নারী-পুরুষ সকলের কবিতা। খাবার টেবিলে দিনের পর দিন একাকী রাতের খাবার এই নগরীর বহু মানুষ খায়। কোনো এক দুর্বল দিনে একাকী আহারের সময় কার না মনে হয়, আহা! কেউ একজন থাকুক পাশে বসে। খেতে-খেতে দু'জনে গল্প হবে। খুনসুটি হবে। তারপর আবার না হয় ফেরা যাবে যে যার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের প্রাচীর ঘেরা কুঠুরিতে।

নর-নারীর মৌলিক সম্পর্ক যৌনসম্বন্ধ নিয়ে প্রাচীন ভারতে কোনো কূপমণ্ডূকতা ছিল না। নারী যেমন নিজের শরীরের প্রয়োজনে আকাঙ্খা করতো পুরুষশরীর, পুরুষও তেমনি নিজের প্রয়োজনেই কামনা করতো নারীশরীর। শরীর বিষয়ে কোন সংস্কার তাঁরা মনের গোপন গহীনে লালন করতো না। বাঁধা হয়ে দাঁড়াতো না কোনো সামাজিক রক্তচক্ষু। এমনি অবাধ, স্বচ্ছন্দ, উদার, চিরকাক্ষিত ও ধ্রুপদী জীবনপ্রবাহের যুগেই জন্মেছিলেন ঋষি বাৎসায়ন। সমগ্র পৃথিবীতে তিনিই প্রথম নারী-পুরুষের যৌনজীবন এবং তার বিভিন্ন দিক নিয়ে রচনা করেছেন অসাধারণ গবেষণাগ্রন্থ ‘কামসূত্র’। ‘কামসূত্র’ শাস্ত্রটির যৌক্তিকতা, মৌলিকতা, তথ্যের প্রাচুর্য অর্থাৎ বিষয়ের বিচিত্র ব্যাপকতা এত শক্তিশালী ছিল যে বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যৌনবিজ্ঞান বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ হিসেবে ‘কামসূত্র’ সম্মানিত হয়। এই চির আধুনিক গ্রন্থ ‘কামসূত্র’ রচনা করতে গিয়ে বাৎসায়নের থাকতে হয়েছিল যৌনবিষয়ে সন্ধানী, যুক্তিবাদী, কৌতুহলী, বিশ্লেষণপ্রবণ এবং নির্মোহ একটি মন। ঋষিসুলভ প্রাজ্ঞ অন্বেষণ দিয়ে বাৎসায়ন নারীশরীর ও পুরুষশরীরের প্রতি বর্গইঞ্চির প্রতিটি সুগন্ধকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি মৈথুন বিষয়ে পোষণ করতেন উদার ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী। মানব শরীরের প্রতিটি ভাঁজ-বাঁকে লুকিয়ে থাকে যে আনন্দ সেই আনন্দ অন্বেষায় বাৎসায়ন ছিলেন মৌলিক, নান্দনিক ও বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গীর অধিকারী। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নর-নারী সম্পর্কের প্রধান ভিত্তি শরীর। প্রেম বা ভালোবাসা নামক কল্পিত বিষয়টি মূলতঃ গাছে ফোটা ফুলের মতো বড়ই বাহ্যিক। তার রং ও সৌন্দর্যটা সহজে চোখে পড়ে কিন্তু যা মূল তা থেকে যায় চোখের আড়ালে। বাৎসায়ন অন্যদের মতো শুধু ফুল দেখে মুগ্ধ হননি। বৈজ্ঞানিক সচেতনতা নিয়ে খুঁজে বের করেছেন গাছের প্রাণের উৎস শিকড়কে তথা নর-নারীর প্রাণোচ্ছলতার শুদ্ধ উৎস কামপ্রবণতাকে। প্রাজ্ঞ কবি নির্মলেন্দু গুণ উপলব্ধি করেছেন নর-নারী সম্পর্কের আদি ও মৌলিক উৎসটি এখনও যথেষ্ট ক্রিয়াশীল। মানুষের গভীর সম্পর্ক ও আকর্ষণের ভিত্তি এখনও শরীর। মানুষ হিসেবে- পুরুষ হিসেবে নির্মলেন্দু গুণ এই ধ্রুপদী ও জৈবিক প্রত্যাশাকে প্রবলভাবে নিজের জীবনে অনুভব করেছেন। ‘বাৎসায়ন’ কাব্যটি তাঁর এই মানবিক বোধের সতেজ প্রস্ফুটন। তিনি পুরুষ হিসেবে নারীর শরীরের প্রতিটি গিরিগুহাকে, প্রতিটি স্পর্শকে, প্রতিটি আলিঙ্গনকে, প্রতিটি শীৎকারকে প্রবল প্রাণপ্রবণতায় উপভোগ করেছেন। পুরুষ নির্মলেন্দু একলব্যের অধ্যবসায়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন নারীর শরীর ও কামসূত্রকে। তাঁর কবিমন ও ‘কাব্যকামকুশলতা’ আশ্রয় পেয়েছে শরীর মন্থনে। তিনি জানেন মানুষের সর্বোচ্চ আনন্দের অনুভূতি ও জ্ঞানের উপলব্ধি ঘটে এই শরীর বিনিময়েই। তাই তিনিই বলতে পারেন- “আনন্দের শ্রেষ্ঠ উৎস হচ্ছে কাম। কাম থেকে জন্ম নিয়েছে কবি।”নির্মলেন্দু গুণের প্র্রেমজ কবিতা গুলো দিকে নজর ফেরালে দেখা যাবে নির্মলেন্দু গুণের একটি প্রিয় বিষয় দেহ ও দেহানুষঙ্গ। তিনি কপট নন। তাই অকপটে নিজের বিশ্বাস ও কল্পনা প্রকাশ করেন। কিন্তু কখনো, কখনো তা নারীকে প্রয়োজনীয় সম্মানের পক্ষে আপত্তিজনক। যেমন, তিনি যখন লেখেন: ‘রান্নাঘর থেকে টেনে এনে স্তনগুচ্ছে চুমু খাও তাকে, বাথরুমে ভেজানো দরোজা ঠেলে অনায়াসে ঢুকে যাও- সে যেখানে নগ্ন দেহে গানার্র্থেই তৈরি হয়ে আছে আলোকিত দুপুরের কাছে-, মনে রেখো, তোমার রাত্রি নেই, অন্ধকার বলে কিছু নেই। বিবাহিত মানুষের কিছু নেই একমাত্র যত্রতত্র স্ত্রীশয্যা ছাড়া।’ -স্ত্রী তখন, অশ্লীলতার চূড়ান্তে পৌঁছেও কবিতার স্বার্থে তা হজম করা যায়। কিন্তু নির্মলেন্দু গুণ যখন লেখেন নিচের পঙ্ক্তিগুলো, তখন? ‘যেমন প্রত্যহ মানুষ ঘরের দরোজা খুলেই দেখে নেয় সবকিছু ঠিক আছে কিনা, তেমনি প্রত্যহ শাড়ির দরোজা খুলে স্ত্রীকেও উলঙ্গ করে দেখে নিতে হয়, ভালো করে দেখে নিতে হয়: -জঙ্ঘায়, নিতম্বে কিংবা সংরক্ষিত যোনির ভিতরে অপরের কামনার কোনো কিছু চিহ্ন আছে কিনা।’ -ঐ এগুলো কীভাবে গ্রহণ করা যাবে? কবির দৃষ্টিতে এখানে ‘মানুষ’ হলো পুরুষ আর সেই পুরুষের স্ত্রী যেন আসবাব, তালাবদ্ধ ঘরের জিনিসপত্র! নির্মলেন্দু গুণ এখানে পুরুষতান্ত্রিক প্রথাবদ্ধ দৃষ্টিতে আবদ্ধ। ‘স্ত্রী’ কবিতাটি কবির ১৯৭২ সালে প্রকাশিত না প্রেমিক না বিপ্লবী কাব্যগ্রন্থভুক্ত। তার মানে, গুণের কবিতায় কামগুণ শুরু থেকেই ছিল। ২০০০ সালে বেরিয়েছে বাৎসায়ন, এর পর কামগন্ধী বহু কবিতা মিলিয়ে বের করেন কামকানন (২০০৭)। কেন কামের রাজ্যে বসবাস?- এক সাক্ষাৎকারে (প্রথম আলো : ২২শে জুন, ২০০৭) নির্মলেন্দু গুণ জানিয়েছেন: ‘আমি [নির্মলেন্দু গুণ] কিছুটা সচেতনভাবেও করেছি বলা যায়। আমি ভেবেছি, কামকেন্দ্রিক কবিতার ধারাটিকে আরও প্রবল করে উপস্থাপন করি।’ নির্মলেন্দু গুণের এ ভাষ্যে আমার আপত্তি আছে। নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় প্রেম-কাম-রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে- এটাই তাঁর বৈশিষ্ট্য। তিনি মনে করেন না যে, কবিতা গণশিক্ষা কার্যক্রমে মাস্টারমশাইয়ের ভূমিকা নেবে। আবার নারীর স্তনাগ্র-চূড়ায় তাঁর বিশ্ব কেঁপে ওঠে। তিনি চুম্বনাকাক্সক্ষায় উটের মতো গলা বাড়িয়ে দেন : ‘আমার অন্তিম চুম্বনের জন্য আমি তোমার নেত্রকোণার উদ্দেশ্যে তখন প্রসারিত করবো আমার অধরোষ্ঠ। ঝর্নার উচ্ছল জলের দিকে যেরকম তৃষিত গ্রীবাকে প্রসারিত করে উষ্ট্র। তোমার বাম চোখে আমি পান করব এক লক্ষ ক্যান ঠাণ্ডা জার্মান বিয়ার, ডান চোখে লক্ষ পেগ স্কচ হুইস্কি।’ -এক সময় কামকে কাব্যের বড় উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আমাদের পূর্বপুরুষরা সেটা চেষ্টা করেছেন। আমি চেষ্টা করেছি কামকে কতটা শিল্পরূপ দিয়ে প্রকাশ করা যায়। এ চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে। প্রেম তো যৌনতারই একটি সংস্কৃত প্রকাশ।’ (মহুয়া : নির্মলেন্দু গুণ সংখ্যা : ২০০৮)।

কবি ও কবিতাকে বিচার করার মতন পড়ালেখা ও জ্ঞান কোনটাই আমার হয়ত নেই তবু কেন যেন বিশ্বাস করতে মন চায় প্রেমের কবিতাগুলোয় কবি নির্মলেন্দু গুণের জগৎ নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও নারীর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিটি কবিতায় ভিন্ন। কোথাও তারা অনুগত আবার কোথাও তারা অবিশ্বস্ত। নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতা তার অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করে। একজন প্রেমের কবি হিসেবে নির্মলেন্দু গুণ পার্থিব প্রেমের প্রতি তার মনোযোগ নিবদ্ধ করেছেন। পাঠকরা কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও আবেগের কোথাও সে তার প্রিয়তমার সঙ্গের কথা বলে; কোথাও তিনি জীবনের অন্য যে কোনো জিনিসের চেয়ে প্রেম পছন্দ করেন। কিছু সময়ে তিনি নারীদের অবিশ্বস্ত প্রকৃতি সম্পর্কে কথা বলেছেন। তারুণ্য গুণের কবিতার বড় সম্পদ। কবিতায় ও যাপনে তিনি কখনো বুড়িয়ে যাননি। জীবন ও চারপাশ নিয়ে প্রথম জীবনেও তিনি হেঁয়ালি করেছেন, এখনো করেন। আর তাই কিনা জানিনা তিনি বলে ফেলতে পারেন, “আমার স্তনস্তবমুখরিত কবিতায়, তাই দুগ্ধবতী নারীরা হয়েছে আমার ঈশ্বরী” তিনি নারীর বুকের পুষ্পযুগলের অপরূপ শোভা প্রাণভরে উপভোগ করেছেন। বিকশিত পুষ্পদ্বয়ের গভীরে প্রাণরূপ মধু ও কামরূপ শক্তির যে বিরাট খনি লুকিয়ে আছে তার সৌন্দর্য দেখে মোহিত হয়েছেন। কামশাস্ত্রজ্ঞ যে কবি বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে- “দেখিলেন সেই অপরূপ শোভা, মনোলোভা, নিদ্রিতা, নিশ্চুপ।” সেই তিনিই দেখেছেন সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো সুডৌল পুস্পকলি দুটি প্রস্ফুটনের জন্য অপেক্ষা করে পুরুষআঙ্গুলের সামান্য স্পর্শের, আর তারপরেই ঘটে যায় মহাবিস্ফোরণ- “অসতর্ক পুরুষ-আঙুলের সামান্য আঘাতে বিভাজিত হল পরমাণু, বিস্ফোরিত হল বোমা।” নির্মলেন্দু গুণের জীবনে কবিতা ও সেই সম্পর্কিত প্রতিটি অবস্থানই চির আকাঙ্খার। তিনি দেখেছেন তাঁর সমস্ত কাব্যসাধনা, কাব্যযশ এবং‘কাব্যকামকুশলতা’র প্রধান উৎস কাম। সমকালীন বাস্তববিমুখ মানুষের কাছে তা অপরিচিত হলেও প্রেমিক কবি চণ্ডীদাশ ও বাৎসায়নকে অনুধাবন করে তিনি জেনে নিয়েছেন পরম সত্যটিকে- “তাঁরই কল্যাণে নারীকে চিনেছি, শিখেছি সঙ্গম কলা, রতিরঙ্গরস; তা না হলে সকলি গরল ভেল, কামসিদ্ধি বিনা ব্যর্থ কাব্যযশ।” নাকি দেহ মনেরই প্রকাশ?” এই অমীমাংসিত প্রশ্ন বাৎসায়নের মতো নির্মলেন্দু গুণকেও বিক্ষত করেছে চলেছে জীবনভর। অবশেষে উত্তীর্ণ যৌবনে কবি পেয়েছেন সত্যের সন্ধান। “বুঝেছেন মন বড় সত্য নয় মানবের দেহই প্রধান।”

আমার সাথে তোমার ভাবনা কতটা মিললো আদৌ মিললো কিনা জানিনা, কয়েকদিন ধরে নির্মলেন্দু গুণ পড়তে পড়তে যা মনে এলো তাই তোমাকে লিখে দিলাম। কেমন হলো তোমার বেনারস ভ্রমণ? খুব যদি ভুল না করে থাকি এটাই তোমার জীবনে কোন বন্ধুর সাথে পারিবারিক ট্যুর। মনতোষ কি সেই আগের মতন নিজের ভেতরে গুটিয়ে থাকে? তোমার সাথে প্রথম বেঞ্চ শেয়ার করা মানুষটি কোন অভিমানে নিজেকে তোমার থেকে গুটিয়ে নিয়ে এতবছর কষ্ট পেলো সেই সন্ধান নিশ্চয় করেছো? গিনির কথা শুনে তাকে খুব দেখার শখ জেগেছে। তার ভালো হোক, অনেক বড় হোক সে। বৈশুকে আমার শুভকামনা ও ভালবাসা দিও। মনতোষ তো এমন একজন সঙ্গীই ডিজার্ভ করে তাই না? তোমাদের ঘোরাঘুরির ছবি পাঠিও সঙ্গে ভ্রমণ বৃত্তান্ত। বহুবছর তোমাকে দেখিনা এই সুযোগে তোমাকে দেখা হবে সঙ্গে মনতোষ, বৈশু আর গিনি মা কেও দেখে নেয়া যাবে। নিরন্তর ভালো থেকো। মনতোষ ও তাঁর সংসার দেখে এবার অন্তত নিজেকে নিয়ে ভাবো। সবশেষে একরাশ দুষ্টু হাসি...

ভালবাসা ও শুভকামনায়

সুস্মি

দশমী সন্ধ্যা

০২.১০.২০২৫
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















২৩.১

কোন এক গাঁয়ে কেউ কাউকে খুন করেছে। শত্রুতাবশ কেউ অন্য কারও নাম থানায় উন্মাদ খুনী রূপে

লিখিয়ে দিয়েছে। এবং কেউ শত্রুতাবশ ওর বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়েছে। আবার কেউ একজন ওর হয়ে উপর

মহলে সুপারিশ করেছে। ফের কেউ ওর হয়ে কাউকে ঘুষ দিয়েছে। কেউ আবার কোন সাক্ষীকে ভয়

দেখিয়েছে, অন্য কাউকে বোকা বানিয়েছে, আবার অন্য কাউকে ভালবেসেছে। এই ভাবে হাকিমের

এজলাসে পৌঁছতে পৌঁছতে খুনের মামলাটার চেহারাই বদলে গেল। ওটা আর খুনের মামলা না হয়ে “খুন কা বদলা” নামের ড্রামা হয়ে গেল।

সেই নাটকে দু’পক্ষের দুই উকিল চমৎকার অভিনয় করল। জজের মনে হল যা প্রস্তুত করা হল সেটা

নাটক হিসেবে অতি উত্তম। কিন্তু প্রমাণ হিসেবে যা পেশ করা হল সেটা আসলে জাল। এই জালসাজির

থিওরি জজকে এমন প্রভাবিত করল যে উনি মেনে নিলেন আসামী নির্দোষ এবং এটাও ভাবলেন যে

আদপে কোন খুন হয় নি! পরিণামে ‘আসামী হরিরাম’ খুনের মামলায় সসম্মানে মুক্তি পেল।

কিন্তু আসামী হরিরাম সেরেফ জজের কথায় তো ‘সম্মানিত নাগরিক’ হয় না। সবাই জানে যে ও আগে

যেমন গুণ্ডা ছিল, জেলের বাইরে এসেও তাই থাকবে। কিন্তু ছাড়া পেতেই ও গোটা এলাকায় যাদের মানী

আদমি বলা হয়---মানে, মহিলা, অস্পৃশ্য এবং মুসলমান বাদে—তাদের সবাইকে ভোজ খেতে নেমন্তন্ন

করল। ফলে সেদিন শিবপালগঞ্জের সমস্ত বিশিষ্ট লোকজন হরিরামের বাড়িতে ভোজ খেতে গেল। শুধু

বৈদ্যজীর বাড়িতে রঙ্গনাথ একা।

সারাদিন কেটে গেল কোন নিরুত্তাপ, ক্লান্তিকর লেকচার শোনার মত। বিকেল হতেই ও হাঁটতে বেরিয়ে

পড়ল। দেখল, প্রিন্সিপাল সাহেব একটা পান দোকানে দাঁড়িয়ে আছেন।

উনি পান চিবুচ্ছেন এবং পানওয়ালাকে দাম দেয়ার চেষ্টা করছেন। তাম্বোলী অর্থাৎ পানওলা ওনাকে

পান তো খাইয়ে দিয়েছে, কিন্তু কত হল জানতে চাইলে বারবার বলছে—এটা তো আপনারই দোকান।

তখনই রঙ্গনাথ ওখানে হাজির। তাই দেখে প্রিন্সিপাল গম্ভীর চেহারায় দোকানের মালপত্রের স্টক

চেক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

চৌকাটের দেয়াল থেকে লটকে থাকা একটি বহুবর্ণের ছবিতে মহাত্মা গান্ধী দাঁত বের করে বিচ্ছিরি

হাসি হাসছেন। পাশে ওনার উত্তরাধিকারী নেহরু হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। ছবিটির বিজ্ঞাপনের

তাৎপর্য একটি রঙিন তেল যা বাচ্চাদের সুখা রোগ সারাতে অব্যর্থ। রঙ্গনাথ প্রিন্সিপালকে বলল

‘দেখেছেন”?

জবাবে শোনা গেল এক অবধী প্রবাদ, “জইস পসু তইস বাঁধনা”। (যেমন পশু, তেমনই তার বাঁধন) যেমন

গেঁয়ো এলাকা, তেমনই তো ছবি হবে”।

-“গেঁয়ো শহুরে আবার কী কথা? সবাই তো গান্ধীজিকে সম্মান করে”। খানিকক্ষণ মন দিয়ে ছবিটা দেখে

রঙ্গনাথ বলল, “ইচ্ছে করছে যে এঁকেছে তাকে একশ’ ঘা জুতোর বাড়ি লাগাই”।

প্রিন্সিপাল হাসলেন। হাসি দিয়ে বোঝালেন যে রঙ্গনাথ নেহাতই বোকা। বললেন, “যত গুড় তত মিঠে।

তেলি-তাম্বোলীর ওজন কতটুকু? মামুলি দোকানে কেউ পিকাসো টাঙায় নাকি”?




উত্তেজিত রঙ্গনাথ মাঝখানে বলে উঠল, “দাঁড়ান, দাঁড়ান, মাস্টারমশায়! পিকাসোর নাম নাই নিলেন।

আপনার মুখে এমন নাম শুনলে বমি পায়।

হাঁটতে হাঁটতে দুজনেই এখন বড় রাস্তায় এসে গেছেন এবং গরুমোষের ভীড় ঠেলে হাওয়া খেতে চেষ্টা

করছেন। তবে, কোথাও হাওয়া নেই; আছে ফুসফুসে ঢোকার জন্যে ধূলো, নাকে ঢোকার জন্যে গোবরের

গন্ধ আর পিঠে ঢোকার জন্যে কোন গোমাতার শিং।

রঙ্গনাথের কথাটা প্রিন্সিপাল সাহেবের এত খারাপ লাগল যে উনি ভদ্র শিক্ষিত ব্যক্তির মত কথা

বলতে লাগলেন।

--“তো রঙ্গনাথজী, আপনি কি আমাকে একেবারে অশিক্ষিত ভাবেন? আমিও ইতিহাসে এম এ, ফিফটি

নাইন পারসেন্ট পেয়েছিলাম। নেহাৎ ভাগ্যের দোষে এখানে প্রিন্সিপাল হয়ে পড়ে আছি”।

এইরকম সিরিয়াস কথাবার্তার চোটে রঙ্গনাথের হিম্মত ফুস্‌ হয়ে গেল। ওর মনে হল, পিকাসোমার্কা

খোঁচা দিয়ে ও প্রিন্সিপালকে আহত করেছে। ও সোজা প্রিন্সিপালের কাছে ক্ষমা চাইল। বলল, “এ তো

আমি আগেই জানতাম। কোন বাজে ডিভিসন পেলে আপনি কি আর এখানে প্রিন্সিপাল হতেন”!

“সেটা ঠিক, বাজে নম্বর পেলে ইউনিভার্সিটির লেকচারার হতাম। আমার কিছু থার্ডক্লাস নম্বরওলা

বন্ধু এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে বটে”।

প্রিন্সিপাল খানিকক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে চলতে লাগলেন। ভাবুক হবার চেষ্টা করছিলেন। একটু পরে

বললেন, “বাবু রঙ্গনাথ, তোমরা আমার সম্বন্ধে কী ভাব সব জানি। তুমি হয়ত ভাবছ—ব্যাটা একটা

কলেজের প্রিন্সিপাল, অথচ কীরকম ল্যাবা! সবার সামনে ‘ হেঁ -হেঁ-হেঁ’ করতে থাকে। কথাটা সত্যি।

আমি তো—খান্নাটান্নার কথা ছাড়, ও শালারা নেহাৎ ছোকরা—সবার কথা অনেকখানি মাথা নুইয়ে

শুনি। বিশেষ করে যারা আমার চেয়ে বড় তাদের কথায় হরদম তাল দিয়ে চলি। এবার তুমি আমায় বোকা

ঠাউরাতে পার, কিন্তু এরও এক কারণ আছে---

“কারণটা হল---“ কথা অসমাপ্ত রেখে উনি একটা মোষকে পথ ছেড়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে হেঁ -হেঁ

করে হাসতে লাগলেন।

“কারণটা হল -যেমন বুদ্ধির একটা ভ্যালু আছে, তেমনি হদ্দ বোকামিরও এক নিজস্ব ভ্যালু রয়েছে।

বোকার কথা তুমি হেসে উড়িয়ে দাও অথবা মেনে নাও—তাতে বোকার কিছু আসে যায় না। তাই আমার

কথা হল- বোকার হদ্দকে খোঁচাতে নেই।

কখনও কখনও এরকম করি বলে লোকে আমাকে হদ্দ বোকা ভাবে, আসলে ওরাই বোকা। কী বুঝলে বাবু

রঙ্গনাথ”?

প্রিন্সিপাল সাহেবের মুখ থেকে এত অবিরল বাক্যস্রোত! রঙ্গনাথ হকচকিয়ে গেল। তখনই একটা

বাছুর ওর পিঠে শিং দিয়ে খোঁচা মারল। কিন্তু রঙ্গনাথ কিচ্ছু টের পেল না। প্রিন্সিপাল ওর হাত ধরে

টেনে একপাশে সরিয়ে দিলেন। ওনার ওই ‘বুদ্ধিমান-রূপ দর্শন’ এক বিশিষ্ট অনুভব বটে। ও বুঝতেই

পারেনি কখন ওর দাঁত বেরিয়ে এল এবং কখন ও নিজেও ‘হিঁ -হিঁ-হিঁ’ করতে লাগল। পরমুহুর্তেই ও

প্রিন্সিপাল সাহেবের থেকে মাফ চাইছিল আর প্রায় এরকম কিছু বলছিল,” হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি যে

আপনি পিকাসোর সম্বন্ধে সবই জানেন। জী, যাকগে যা হবার হয়েছে। জী, হয়েছে কি আপনি পিকাসোর

নাম নিয়েছেন শিবপালগঞ্জে দাঁড়িয়ে। আপনিই বলুন, এখানে কেউ পিকাসোর সম্বন্ধে ভাবতে পারে!




তাই আমার বমি পাচ্ছিল। আসলে দোষ না আপনার, না আমার; না শিবপালগঞ্জের—এমনকি

পানওয়ালারও নয়। যত দোষ সব পিকাসোর”!

প্রিন্সিপাল রঙ্গনাথের ব্যক্তিত্বের ভেঙে পড়ে খান খান হয়ে যাওয়া দেখতে লাগলেন। ফের গলার

স্বর ভারি করে বলতে লাগলে,”আমারও কখনও ওজনদার কথা বলার অভ্যেস ছিল। তখন এম এ

পড়ছিলাম। তুমি শহুরে ছুঁড়িদের রাস্তায় চলার ভঙ্গি খেয়াল করেছ? ওদের মধ্যে কেউ কেউ যুবতী

হয়েও বালিকার মত উচ্ছল হয়ে চলে। আমারও ছিল ওই অবস্থা। কখনও খেয়াল করতাম না কোন

প্রফেসর ওজনদার আর কে পাক্কা ইডিয়ট। সবার সামনে নিজেকে জাহির করতে চাইতাম। এক

প্রফেসর তাতেই খাপ্পা হয়ে আমার সর্বনাশ করলেন।

“জেনে নাও বাবু রঙ্গনাথ”!

এঁরা এখন গাঁয়ের বাজার পেরিয়ে বাইরে এসে গেছেন। সন্ধ্যা নামছে। ছোলা-বাদাম ভাজার ধুঁয়ো কড়াই

থেকে উপরে না উঠে সামনের দিকেই ভেসে বেড়াচ্ছে। সূর্য ডুবে গেছে। কিন্তু তার অন্তিম ছটা এখনও

যে আলো ছড়াচ্ছে তাতে রঙ্গনাথ ছোলাওয়ালার দোকানে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে চুপচাপ বুঝে নিল

–হ্যাঁ, দেখার মত জিনিস বটে!

লোকজনের বসতি প্রায় পঞ্চাশ গজ পেছনে ছেড়ে আসা হয়েছে। এ জায়গাটা জনশূন্য। এরকম

জায়গাতেই মানুষ কবিতা, লুঠপাট এবং পায়খানা সব কিছু করতে পারে। তাই কবিতা এবং লুঠপাটে

অক্ষম কিছু বাচ্চা রাস্তার দু’পাশে বসে পায়খানা করছে আর একে অন্যকে ঢিল ছুঁড়ছে। আরও

খানিকটা দূরে অনেক প্রৌঢ় এবং অভিজ্ঞ মহিলারা একই উদ্দেশ্যে রাস্তার দুপাশে লাইন লাগিয়ে

দলবেঁধে বসে আছেন। ওখানে ওনাদের আব্রুহীন উপস্থিতি নতুন ভারতের নির্মাতাদের দুয়ো দিচ্ছে।

কিন্তু ওই নির্মাতারা নিশ্চয়ই এসব ব্যাপারে অজ্ঞ, কিছুই জানেন না। কারণ, ওঁরা সম্ভবতঃ এই

সময় নিজের বাড়ির সবচেয়ে ছোট কিন্তু চকমক কামরায় কমোডে বসে খবরের কাগজ, কোষ্ঠকাঠিন্য

এবং বিদেশগমন গোছের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করছেন।

এই দুই আগন্তুককে দেখে ওই মহিলার দল পায়খানার কাজে ফুলস্টপ লাগিয়ে সোজা উঠে

দাঁড়ালেন—যেন গার্ড অফ অনার দিচ্ছেন! তবে এসব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই রঙ্গনাথ এবং

প্রিন্সিপাল সহজভাবে এগিয়ে চললেন। মহিলারাও সহজভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটা ছাগল ম্যা-ম্যা

করে রঙ্গনাথ আর প্রিন্সিপালের সঙ্গে ধাক্কা খেল এবং একদম রাস্তার ধারে পৌঁছে এক মহিলার

জলের লোটাকে উলটে দিয়ে পাশের একটা বাগানে ঢুকে গেল। কয়েকটা বাচ্চা ঢিল ছোঁড়া এবং প্রাকৃতিক

কাজকম্মের সাথে সাথে চেঁচাতে শুরু করল। আর ক’টা বাচ্চা ওই অবস্থাতেই উঠে ছাগলের পেছন পেছন

দৌড়তে লাগল।

এমন পরিবেশে প্রিন্সিপাল এবং রঙ্গনাথ খানিকক্ষণ মৌনব্রত ধারণ করলেন। আরও দশ গজ এগিয়ে

প্রিন্সিপাল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলেন—মহিলারা আগের মত লোটা নিয়ে মাটিতে বসে পড়েছে।

প্রিন্সিপাল আবার নিজের কথা শুরু করলেন-

“আমার এক প্রফেসর ছিলেন জনৈক ব্যানার্জি সাহেব। আমাকে ইতিহাস পড়াতেন। ওনার বৈশিষ্ট্য

সোজা কথাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলা। ব্যস, লোকে ওনাকে ভারি পণ্ডিত ভাবত।

“আমি নতুন নতুন ওনার ক্লাস করছিলাম, উনি আমাকে খেয়াল করলেন এবং চাইছিলেন যে আমিও

ওনাকে বিদ্বান বলে মেনে নিই। ---




“একদিন উনি আমাদের অশোকের শিলালেখ পড়াচ্ছিলেন। তখন দেশ মাত্র আজাদ হয়েছে আর গৌতম

বুদ্ধ, সম্রাট অশোক এসব নিয়ে খুব চর্চা হচ্ছে। কারণ, তখনও চীন থাবড়া মারে নি। আমরা অহিংসা

নীতি নিয়ে খুব কিচিরমিচির করছি। রাস্তা এবং পাড়ার নামও অশোক এবং গৌতম বুদ্ধের নামে রাখা

হচ্ছে।

“প্রফেসর ব্যানার্জিও খুব আবেগে ভাসছিলেন। উনি ক’দিন ধরে খালি অশোক পড়াচ্ছিলেন এবং কথায়

কথায় গোলপোস্ট থেকে সরে আজকের রাজনীতিতে অশোক কী চমৎকার ফিট হচ্ছেন সেটা নিয়ে দু’চার

কথা বলে দিতেন। একদিন উনি এদিক সেদিক নানাপ্রসঙ্গের পর একটা শব্দে আটকে গেলেন।

“শব্দটা হল ‘বিমান’।

“হ্যাঁ, সেটাই –যেমন পুষ্পক বিমান। অশোকের শিলালেখে একজায়গায় বিমানের উল্লেখ আছে। প্রফেসর

ব্যানার্জি বললেন—‘তোমরা বোধহয় ভাবছ বিমান মানে দেবযান বা দেবতাদের বাহন’।

“রঙ্গনাথ বাবু, এইটুকু বলে বুড়ো চুপ মেরে গেল আর মুচকি মুচকি হাসতে লাগল, যেন আমরা সব

বোকাপাঁঠা। আমি বললাম, ‘প্রফেসর সাহেব, বিমানের আরও একটা মানে আছে’। তখন উনি হাত দেখিয়ে

আমাকে থামিয়ে দিলেন।

“তারপর শুধু উনিই মুখ চালাতে থাকলেন, আর কাউকে বলার সুযোগই দিলেন না। বললেন, “প্রফেসর

ভাণ্ডারকরও ঠিক এই ভুলটাই করেছিলেন। অনেকদিন আগের কথা, আমি ওনার সঙ্গে কিছু জৈন

গ্রন্থের উপর রিসার্চ করছিলাম। আর উনি আমার সঙ্গে অশোকের শিলালিপি নিয়ে রিসার্চ

করছিলেন। একদিন আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলা, ‘ডক্টর ভান্ডারকর, বিমান মানে কী’? উনি বললেন,

‘ব্যানার্জি, এ তো সবাই জানে—এর সামান্য অর্থ হল বাহন, বিশেষ করে দেবতাদের বাহন’।

“রঙ্গনাথ বাবু, এই গল্পটা উনি থেমে থেমে বেশ সাসপেন্স তৈরি করে বলছিলেন। আর সব ছাত্রগুলো

ভ্যাবলা মুখ করে শুনছিল। খানিকক্ষণ চুপ করে ফের শুরু করলেন, ‘শোন তোমরা, আমি ডক্টর

ভাণ্ডারকরের কথার প্রতিবাদ করলাম। বললাম যে ওই শিলালেখে বিমান শব্দের অর্থ এটা নয়।

ভাণ্ডারকর জানতে চাইলেন সঠিক অর্থটি কী? তোমরা শুনছ তো? আমি বলে দিলাম যে অন্য কিছু’।

“প্রফেসর ব্যানার্জি বললেন যে এটা শোনার পর ভাণ্ডারকরের চেহারা যা হল না! তারপর উনি বললেন,

‘সংস্কৃত ভাষার সমস্ত কোষ আমি পড়েছি। বিমানের সামান্য অর্থ সবাই বলেছে—আকাশগামী যান।

আর ব্যানার্জি, তুমি কী করে বলছ যে অন্য কোন মানে আছে’? জবাবে আমি বললাম,’ডক্টর,

গোড়াতে আমিও তাই ভাবতাম। সংস্কৃত সাহিত্য আর ব্যাকরণ পড়তে পড়তে আমারও অর্ধেক জীবন

কেটেছে। কিন্তু বুঝলাম যে বিমান শব্দের সঠিক অর্থ জানতে হলে খালি সংস্কৃত পড়লে হবে না,

প্রাকৃত পড়তে হবে। আমি প্রাকৃত ভাষায় বেশ কয়েকটা জৈন গ্রন্থ পড়েছি। ডক্টর ভাণ্ডারকর,

আপনার প্রাকৃত জানা আছে’?

“রঙ্গনাথ বাবু, প্রফেসর ব্যানার্জি এই গল্প খুব রসিয়ে রসিয়ে বলছিলেন। বলছিলেন। ‘ভাণ্ডারকর

প্রাকৃত জানতেন না। অথবা আমার চেয়ে অনেক কম জানতেন। তাই আমি ওনাকে একটা প্রাকৃত গ্রন্থ

পড়ালা্ম, যেটাতে বিমান শব্দের প্রয়োগ যা অশোকের শিলালিপিতে রয়েছে-- সেই অর্থে করা আছে ।

বুঝলে তোমরা, তখন উনি বিমান শব্দটির সঠিক অর্থ শিখলেন’।

“রঙ্গনাথ বাবু, আমি গেঁয়ো লোক, তায় জাতে বামুন, আবার ভূতপূর্ব জমিদার বংশের। ব্যানার্জির এই

তামাশা দেখে আমার সর্বশরীর জ্বলতে লাগল। মন তো চাইছিল –ঘাড়টা ধরে এত জোরে ঝাঁকাই যে




বিমান শব্দের আসল অর্থ ওর জিভ থেকে টপ্‌ করে বেরিয়ে আসবে। ততক্ষণে ব্যানার্জি উত্তেজিত

হয়ে বলছেন—‘তোমরা নোট করে নাও, বিমান শব্দের আসল অর্থ সাতমহলা বাড়ি’!

“চারদিক নিস্তব্ধ। রঙ্গনাথ, আমারও নিজের ক্ষমতার অহংকার ছিল। চ্যাংড়ামি করে বসলাম।

দাঁড়িয়ে উঠে বললাম, ‘প্রফেসর সাহেব, বিমান শব্দের এমন অর্থ তো সংস্কৃত সাহিত্যের সব

পণ্ডিতেরই জানা। এ নিয়ে এত রিসার্চ করার কী ছিল’?

“শোনামাত্র প্রফেসর আমাকে চোখ ছোট করে দেখলেন। তারপর বললেন,’ঠিক আছে। আপনি না হয়

রিসার্চ না করেই এতসব জেনে ফেলেছেন, তো বলুন শ্রীমান, এই অর্থটি আপনি কোন পুস্তকে

পেয়েছেন? নিন, বলে ফেলুন’।

“রঙ্গনাথ বাবু, চ্যাংড়ামি বলে কথা। আমিও এক লেকচার ঝেড়ে দিলুম। দশটা সংস্কৃত বইয়ের নাম এক

নিঃশ্বাসে আউড়ে দিলাম। মেঘদূত নামের চালু গ্রন্থের নামও নিলাম। শেষে ফের বললাম যে বিমান

শব্দের এমন অর্থ তো সবারই জানা। আপনারা এর জন্যে এত পরিশ্রম করলেন! আশ্চর্য !

“এর ফল কী হল আন্দাজ করতে পার?

“ সেইদিন থেকে আমি প্রফেসর ব্যানার্জির দু’চোখের বিষ। বললেন,” আপনি তো খুব বড় স্কলার।

আমি ইউনিভার্সিটির অতি সাধারণ অধ্যাপক’। মন করল, বলে দিই যে আপনি আমার সম্বন্ধে ভুল

বলছেন কিন্তু নিজের সম্বন্ধে ঠিক; কিন্তু ওনার রাগ দেখে চুপ মেরে গেলাম। কিন্তু উনি থামার পাত্র

নন। ফের শুরু করলেন, ‘আমি তো সব কথাতেই রিসার্চ করি। আপনার মত পণ্ডিত তো নই যে সব

বিষয়ের সমাধান মুখে মুখে করে ফেলব? এটাই কি কম যে আপনি যে বিমান শব্দের অর্থ নিয়ে আমার

সঙ্গে সহমত হয়েছেন? এ তো আমার সৌভাগ্য! যাকগে, আপনার মত স্কলার আমার ক্লাসে উঠে

দাঁড়াবেন এটা ঠিক হল না। আপনি বসে পড়ুন’।

“ তো রঙ্গনাথ বাবু, সেই যে উনি চটে গেলেন, সেটাই আমার কাল হল। আমার সব কথায় উনি ভুল ধরতে

লাগলেন। শেষে আমার ডিভিসন খারাপ করে দিলেন আর এমন কিছু কান-ভাঙানি দিলেন যে উনি যতদিন

ছিলেন আমি ইউনিভার্সিটিতে পা রাখতে পারি নি।

“ওই বছরে ওনাকে না চটালে আজ আমি ওখানে ওঁর জায়গাতে হতাম”।

প্রিন্সিপাল সাহেব এই কিসসা শুনিয়ে খানিক চুপ করে রইলেন। দুজনে কোন কথা না বলে চুপচাপ

চলছিলেন। একটু পরে প্রিন্সিপালই মুখ খুললেন,”এরকম বেশ ক’বার গচ্চা খেয়েছি। শেষে মেনে নিলাম

যে সব এভাবেই চলতে থাকবে। তাহলে চলুক। সবাই যখন পাখি শিকার করেই সন্তুষ্ট, আমি কেন

খামোকা বাঘ শিকার করি? তাতে কার কী ছিঁড়বে? আর এখন আমার অবস্থা দেখছ রঙ্গনাথ বাবু? তুমি

কিছু বললে-হ্যাঁ, ভাই! ঠিক বলেছ। বৈদ্যজী মহারাজ কিছু বললেন?—হ্যাঁ মহারাজ, একদম ঠিক। আর

রূপ্পন বাবু কিছু বললে? -- হ্যাঁ মহারাজ, একদম ঠিক। বদ্রী পালোয়ান?—হ্যাঁ ভাই, সব ঠিক আছে”।