Next
Previous
Showing posts with label ধারাবাহিক. Show all posts
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in



















১০.
প্রান্তিক মানুষের মহাশ্বেতা দেবী




সুপরিচিতাসু বাসু,

নীরদ সি চৌধুরীকে প্রথম চিনেছিলাম আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ পড়ে। এই বইয়ে রবীন্দ্র-জীবনের নানা অনুজ্জ্বল দিক নিয়ে চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণ করলেও রবীন্দ্রনাথের বাইরে যে বাঙালির সংস্কৃতি খানিকটা অস্তিত্বহীন তা-ও উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, "বাঙলা ও বাঙালির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক জন্ম-নাড়ির সম্পর্ক। বাঙলায় না জন্মালে, রবীন্দ্রনাথকে কিছু মাত্র না জানলে বাঙালির বাঙালিত্ব বজায় থাকে না। রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টা বাঙালীর স্বরূপ উপলব্ধরই প্রয়াস মাত্র"। তিনি রবীন্দ্রনাথকে ৪০ বছর, ৬০ বছর এবং ৮০ বছর বয়সে তাঁর কবি কৃতি, তাঁর প্রতিভা, তাঁর প্রখর মননশীলতা নিয়ে সমসাময়িক কালের বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাগণের সঙ্গে তুলনা করেও তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে কার্পণ্য করেননি। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাসের প্রতিটা বাক্য মনে হয় তিনি শুধু পড়েননি, বুঝেছেন এবং আত্মস্থ করেছেন। এক অপূর্ব স্বাভিমানী বাঙালি যেভাবে সারা জীবন ইংরেজিয়ানা চর্চা করে গেলেন তা বাঙালি মনীষার বিকাশেরও একটা রূপরেখা স্পষ্ট করে। এবং সেই ছবিটার ভুল ব্যাখ্যা করার কোনও সুযোগই তাঁর বিরোধীরা কখনও হাতছাড়া করেননি। আমার মনে হয় উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলাভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির ভুবনে যে ক'জন ক্ষণজন্মা তুখোড় লিখিয়ে এবং মৌলিক চিন্তকের আবির্ভাব ঘটে, নীরদ সি চৌধুরী এঁদের অন্যতম।

নীরদ সি চৌধুরী নিয়ে তোমার ভাবনা পড়তে পড়তে সহসা মনে পড়লো এমন একজন সাহিত্যিকের কথা যিনি নীরদ সি চৌধুরীর একদম বিপরীত। যিনি নিপীড়িত মানুষের অলিখিত সংগ্রামী জীবনেতিহাসকে সাহিত্যের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করে বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। জীবনবিচ্ছিন্ন ভাবকল্পনা বা নিছক প্রণয়ের অর্ধকল্পিত উপাখ্যান নয়, প্রবলভাবেই জীবনসম্পৃক্ত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী সমগ্র জীবন মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি প্রবল দায়বোধে সাহিত্য রচনা করেছেন। জল-মাটি-শস্যের গন্ধবাহী মহাশ্বেতা দেবীর কথাসাহিত্য বাংলা সাহিত্যে যে স্বতন্ত্র ধারার সূচনা করেছে তা বহমান আছে, থাকবে আরো বহুকাল। ঝাঁসীর রাণী তাঁকে লেখক হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়।ইতিহাস-আশ্রিত জীবনীগ্রন্থ ঝাঁসীর রাণী সাহিত্যিক হিসেবে মহাশ্বেতার অবস্থানকে একটি শক্ত ভিত্তি দেয়। সেই ভিত্তিতেই তাঁর পরবর্তী জীবনের সুউচ্চ সাহিত্য-পিরামিড স্থাপিত। ঝাঁসীর রানি লক্ষ্মীবাঈ চরিত্রটির গভীরে ডুব দিতে দিতে দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে ন্যাশনাল লাইব্রেরি গিয়ে এতদসংক্রান্ত বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে তাঁর সংকল্পে থিতু হলেন তিনি, এই রানিকে নিয়ে লিখবেন তিনি। প্রাথমিকভাবে লিখেও ফেললেন চারশো পৃষ্ঠা। স্বস্তি পেলেন না লিখে। ছিঁড়ে ফেললেন সে-লেখা আর ঝাঁসী গিয়ে রানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি হৃদ্গত করে নিয়ে লিখবার জেদ তাঁকে সেখানে নিয়ে ছাড়ল। ‘সারা ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ-আয়োজন শুরু হয়েছে। এই উপলক্ষ্যে মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য কর্তৃক লিখিত বীরশ্রেষ্ঠা ভারতীয় নারী লক্ষ্মীবাঈয়ের বহু নূতন তথ্য সংবলিত জীবনালেখ্য ‘ঝাঁসীর রাণী’ ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৫৫ সাল জুড়ে ধারাবাহিকভাবে তা ছাপা হলো।

এমন কিন্তু নয় যে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি শুরু হয় এ লেখাটির মাধ্যমে। এর আগে ‘দেশ’ পত্রিকাতেই তাঁর দু-তিনটে ছোটগল্প বেরিয়েছিল। জিম করবেট, যাঁকে তিনি পরবর্তীকালে অনুবাদ করবেন, ছিল তাঁর প্রবন্ধের বিষয়, ওখানেই। তাছাড়া মহাশ্বেতা দেবীর লেখক সত্তার উন্মেষকাল তো শৈশবেই, শান্তিনিকেতন পর্বে। সেখানে সে সাহিত্যসভা হত নিয়মিত, সরলা দেবী চৌধুরানী সভাপতিত্ব করতেন, দশ-বারো বছরের মহাশ্বেতা দেবী লেখা পড়তেন সেখানে, যা ছাপাও হয়েছিল। সেই বয়সে আলফ্রেড নোবেলকে নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী প্রবন্ধ লিখছেন, ভাবা যায়? পরবর্তীকালে খগেন্দ্রনাথ সেনের ‘রংমশাল’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’ বইয়ের আলোচনা করেন যখন, তখন তাঁর বয়স মাত্রই তের (১৯৩৯)। হাতে-লেখা পত্রিকা বার করাও বাদ যায়নি, বয়সে তিন মাসের ছোট ঋত্বিক ঘটক যে-কাজে তাঁর সহযোগী। পত্রিকায় ছবি আঁকার দায়িত্ব ছিল ঋত্বিকের। রাজলক্ষ্মী দেবী ছিলেন বেলতলা স্কুলে মহাশ্বেতার সহপাঠিনী, এমএ ক্লাসেরও। স্কুলে পড়ার সময় তাঁরা আর-একবার হাতে-লেখা পত্রিকা বার করলেন, নাম ‘ছন্দ-ছড়া’। দ্বিতীয়বারের শান্তিনিকেতন-পর্বে তাঁর গল্প লেখার সূচনা। ‘দেশ’, ‘সচিত্র ভারত’ পত্রিকা-সহ আরও নানা পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন এ-সময়ে, পাঁচের দশকের গোড়া থেকে।

মহাশ্বেতা দেবী নিয়ে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি কি? তুমি কিভাবে দেখো তাঁর লেখাকে? খুব জানতে মন চাইছে। জানি এইসময় মুখোমুখি বসে থাকলে তুমি অনেক জানা অজানা কথা খুলে বসতে। তোমাকে যতটা চিনি ও জানি আমার বিশ্বাস মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্য জগতের চেয়ে তুমি বেশি নজর দিতে তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকে। উচ্ছাসিত হয়ে বলতে শুরু করতে তার রাজনৈতিক যাপনের কথা অনুমান করি সেসব তথ্যের ভিড়ে তুমি উজ্জ্বল হয়ে উঠতে। শ্রেণী সংগ্রাম, সমাজতন্ত্র নিয়ে বলতে বলতে তুমি চেনাতে অনন্য এক মহাশ্বেতা দেবীকে, যিনি লেখার পাশাপাশি অন্যতর এক পরিচয়ে পরিচিত, তিনি একজন সমাজকর্মী এবং তা কোনও সৌখিনতায় মোড়া নয়। বাংলা-বিহার-ওড়িশার প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর আদিবাসীর মধ্যে কাজ করে গেছেন তিনি আজীবন। জঙ্গলমহলের খেড়িয়া, শবর, লোধাদের সামাজিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন তিনি। এই জনজাতিকে জমির পাট্টা দিতে তাঁর নেতৃত্বদানের জন্য তিনি সেখানে মায়ের মত সম্মান পান। শবর জাতির ওপর ঔপনিবেশিক শোষণ ছিল সীমাহীন উপরন্তু ব্রিটিশরা এঁদের আখ্যা দেয় ‘অপরাধপ্রবণ’ জাতি হিসেবে। মহাশ্বেতা দেবী তাঁদের সেই দুর্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে দেখান, তাঁদের প্রাচীন সংস্কৃতি কী মহান। একদিকে তিনি তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁদের অর্থনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে গিয়েছেন, অন্যদিকে তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে ভারতের আদিবাসী সমাজের এক বিরাট অংশ তাঁদের সভ্যতা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-উত্তরাধিকার নিয়ে প্রামাণ্য ও মহত্ত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর’, ‘কৈবর্তখণ্ড’ ইত্যাদি উপন্যাস এবং তাঁর অসংখ্য ছোটগল্পে আদিবাসী মানুষের স্বেদ রক্ত হাহাকার ও সহজ আদিম জীবনযাপনের রেখাচিত্র অঙ্কিত হয়ে আছে। আদিবাসীদের জীবনের গভীরে গিয়ে তাঁদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়া, তাঁদের লোকাচার এবং ইতিহাসের পরম্পরাকে শ্রদ্ধাসহকারে অনুধাবনের চেষ্টা আর কোনও বাঙালি লেখকের মধ্যে দেখা যায়নি। বাংলা সাহিত্যের ভূগোলকে বিস্তৃতি দিয়েছেন তিনি, আদিবাসী সমাজের সঙ্গে আমাদের নৈকট্য এনে দিয়েছেন। উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেও মহাশ্বেতা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-সংগ্রামকে উপজীব্য করেছেন অনায়াস দক্ষতায়। ‘দ্রৌপদী’, ‘জাতুধান’, ‘শিকার’, ‘শিশু’, ‘সাগোয়ানা’, ‘লাইফার’, ‘মাছ’, ‘বিছন’ প্রভৃতি গল্পে সমাজের নানা অবিচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনতার প্রতিবাদের শিল্পভাষ্য নির্মিত হয়েছে।

জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে পিছনে ফিরে গেলে দেখি পরাগ দা আমাদের কমরেড পরাগ মিত্র ঘরময় বইয়ের স্তুপ। মনে আছে তোমার পরাগ দার কথা? পরাগ দা এখন মালবাজারে থাকে। তার ঘরেই বইয়ের স্তুপে মহাশ্বেতা দেবীর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। স্মৃতি বিট্রে না করলে সম্ভবত নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত হাজার চুরাশির মা উপন্যাসটি মহাশ্বেতা-কথাসাহিত্যের এক মাইলফলক বলে বিবেচিত হয় বলে সেই বইটিই পড়তে চেয়েছিলাম কিন্তু পরাগ দা বলেছিল আগে অরণ্যের অধিকার পড়, নিজেই বইয়ের স্তুপ থেকে খুঁজে বের করে দিল। সেই প্রথম আমার মহাশ্বেতা পাঠ। মুন্ডা বিদ্রোহের আখ্যানকে উপন্যাসের কলেবরে স্থান দিয়ে, অভাবী মুন্ডা সম্প্রদায়ের প্রতি শুধু মমত্বই প্রকাশ পায়নি, মুন্ডাজীবনের গভীর বেদনাও প্রকাশ পেয়েছে। পেটভরা ভাত, গায়ে মাখার তেল, পরনের জন্য কাপড় – এটাই তাদের জীবনের সর্বশেষ আকাঙক্ষা। ব্রিটিশ সরকার মনে করত, মুন্ডাদের বিদ্রোহ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। আসলে বিদ্রোহটা ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে। সেই শোষক বিদেশি নয়, ভারতের ভিন্নভাষী, ভিন্ন বর্গের মানুষ – বাঙালি, বিহারি, রাজপুত, মাড়োয়ারি, পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী ও জমির মালিকরা – আদিবাসীদের ভাষায় ‘দিকু’। ‘দিকু’রা আদিবাসীদের কষ্টে ফেলে, সুদের জালে আটকে তাদের ফসল নিয়ে গিয়ে তাদের নিঃস্ব ও ভূমিদাসে পরিণত করত। খাদ্য, বাসস্থান হারিয়ে, শোষণের পীড়নে মুন্ডারা তীর, টাঙি, বর্শা হাতে নিরুপায় হয়ে প্রশাসনের বন্দুকের গুলির সামনে এসে দাঁড়ায়। মহাশ্বেতা দেবী অরণ্যের অধিকার উপন্যাসে সেই দ্রোহের চিত্রটি জীবন্ত করে তুলেছেন। যেমন – ‘মুন্ডার জীবনে ভাত একটা স্বপ্ন হয়ে থাকে।… কোন না কোনভাবে ভাত বীরসার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। বেশিরভাগ সময়েই বীরসার যে উদ্ধত ঘোষণা মুন্ডা শুধা ‘ঘাটো’ খাবে কেন? কেন সে ‘দিকুদের’ মত ভাত খাবে না। ’ বীরসার ভগবান হয়ে ওঠার পেছনে অরণ্য-চেতনাটিকে লেখক সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এভাবে সে জিতেন্দ্রিয় পুরুষে পরিণত হয়। তার প্রতি আকর্ষণ অনেক মুন্ডা যুবতীর। কিন্তু সে নিজেকে উৎসর্গ করেছে ‘উলগুলানে’র কাজে। আকর্ষণ নিয়েও সে থাকে নিরাসক্ত। তাই বীরসাকে শুদ্ধ চরিত্র, জিতেন্দ্রিয়, আত্মত্যাগী, আদর্শ পুরুষে রূপ দিয়েছেন লেখক। কেননা অরণ্যের অধিকার উপন্যাসে বীরসার নেতৃত্বে পরিচালিত বিদ্রোহ বা ‘উলগুলান’ দেখানোই তার উদ্দেশ্য। আদিবাসী জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে অরণ্য। অরণ্য উচ্ছেদ করা মানে আদিবাসীদের জীবন বিপন্ন করা। অরণ্যবাসীদের আহার এবং আবাস – দুই জোগায় বনভূমি। সেই বনভূমি ‘দিকু’রা কেড়ে নিচ্ছে, বনভূমিতে তাদের অসিস্ত আর থাকছে না – বনভূমির কান্না, আদিবাসীদেরই কান্না। আদিবাসীরা ফিরে চায় অরণ্যের অধিকার। এজন্যই বীরসা মুন্ডাকে মহাশ্বেতা দেবী ভগবান মহিমা দান করে ঈশ্বরোপম করে চিত্রিত করেছেন। তার দ্রোহ ও নেতৃত্বে সঞ্জীবিত করে দিয়েছেন চিরকালের মহিমা। অরণ্যের অধিকার পড়ার অনেক পরে আমি পড়েছিলাম হাজার চুরাশির মা,যদিও এর আগে ‘রং নাম্বার’, ‘শরীর’, ‘প্রাত্যহিক’ গল্পেও একই বিষয় অবলম্বিত হয়েছিল। ‘রং নাম্বার’ গল্পে নকশাল আন্দোলনে নিহত দীপঙ্করের বাবা তীর্থবাবুর মানস জগতের উন্মোচনের মতো হাজার চুরাশির মা উপন্যাসে নকশালপন্থী নিহত তরুণ ব্রতীর মা সুজাতার অন্তর্দহনকে বিসত্মৃতি দিয়ে সত্তরের উত্তাল সময়কে ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় জীবনের রক্তাক্ত এক অধ্যায়কে সাহিত্যের দলিলীকরণের মধ্য দিয়ে এ-উপন্যাসে লেখক মধ্যবিত্তের আত্মতৃপ্তি ও মুগ্ধ সংকীর্ণতার প্রাকারে তীব্র আঘাত হানেন। গোর্কির মায়ের মতোই ব্রতীর মা সুজাতার অরাজনৈতিক সত্তা রূপান্তরিত হয় বিপ্লবী চেতনাসমৃদ্ধ সত্তায়।

জীবনের দুপুর পেরিয়ে এসে এই পড়ন্তবেলায় মনে হয় মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্যভাবনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা বিচিত্রমুখী প্রান্তিকজীবনের আখ্যান। নিকট ও দূরের ইতিহাসকে তিনি যেমন গ্রথিত করেন তাঁর সাহিত্যে, তেমনি সাম্প্রতিক সময়কেও ইতিহাসেরই বস্তুনিষ্ঠ তাৎপর্যে তুলে ধরেন তাঁর লেখায়। বর্তমানতার মধ্যেও তাই তাঁর লেখায় থাকে যেন দূরকালের ইতিহাসের বিভ্রম। তিনি একাধারে সমাজকর্মী এবং লেখক। বঙ্গদেশ তথা ভারতসহ বিশ্বক্ষেত্রে এমন দৃষ্টান্ত প্রায় নজিরবিহীন। মহাশ্বেতা দেবী শুধু লেখেন না। যা লেখেন, তাই করেও দেখান। তাই তাঁর সাহিত্য আর কর্মজীবন একাত্ম সাধনার এক অনন্য প্রয়াস। সর্বস্বহারাদের জন্য লেখেন না, তাদের জন্য সর্বস্ব ত্যাগও করেন। সৃষ্টির প্রাপ্তি অর্থ নিয়ে কলকাতা শহরে বসে থাকেন না। চলে যান প্রান্তিক পুরুলিয়ায়। তিনি শুধু ভয়েসলেস সেকশনের রাইটার নন, নিরক্ষর বাক্যহারা মানুষের মনের সম্রাজ্ঞী। যেখানে অত্যাচার, নিপীড়ন সেখানেই সবার আগে ছুটে গেছেন জননী মহাশ্বেতা দেবী। কারোর কাছে তিনি দিদি কিংবা বহিন, আবার কারো কাছে মমতাময়ী মা। সর্বার্থেই তিনি একজন যোদ্ধাকর্মবীর। তিনি কর্মসাধক। ব্যক্তিগতকে গুরুত্ব না দিয়ে সমাজের অবহেলিতদের সংগঠিত করার দুর্বার ব্রতকে আজীবন পালন করেছেন। আদিবাসীজনজাতি সমাজ ও সংস্কৃতির ভ্রান্ত ভাবনাকে দূর করার জন্য আপসহীন লড়াই করেছেন।

মুখরিত শ্রাবণ এসে গেলো, রাত ভর বৃষ্টি ছিল গতকাল এইখানে। স্কুলের দিনগুলোর মতন ইচ্ছে করেই আজ অফিস কামাই করেছি। মেঘলা দিনের সরলতা মেখে গ্যাসচুল্লিতে খিচুড়ী বসিয়েছি। কিন্তু ভেবে পাচ্ছিনা সঙ্গে কি ডিম অমলেট নেবো নাকি মাংস কষা। সামনেই তোমার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন চিরযুবক। তোমার জন্মদিনে ‘বিবেক বিদায় পালা’বইটি পাঠালাম। জানিনা বইটি তোমার পড়া কিনা যদি তোমার সংগ্রহে থেকে থাকে তাহলে আমার কপাল মন্দ। মহাশ্বেতা দেবী এই উপন্যাসে ধরেছেন শ্রীচৈতন্য ও তাঁর সমসময়কে। কোথায় জানি পড়েছিলাম এ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড লেখার ইচ্ছে ছিল তাঁর। দুর্ভাগ্য, নানান উপকরণ সংগৃহীত হলেও শেষ পর্যন্ত লেখা হয়ে ওঠেনি এ-উপন্যাসের খণ্ডটি। নিরন্তর ভালো থেকো। তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকলাম।



শুভেচ্ছা ও শুভকামনায়-

তোমার সুস্মি

১৯ জুলাই, ২০২৫
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















১৩

অনেকদিন গের্ট, ইনেস আর দুষ্টু পোষ্য ফ্লকের খোঁজখবর পাইনি আমরা। শেষোক্ত প্রাণীটির জীবনযাপনে সেরকম কোনও পরিবর্তন হয়নি। ইনেসের ঘরের সামনের করিডরে সে ঘুমোয়। তার বাস্কেটে একটা লালরঙের কম্বল আছে। বাস্কেটের পাশে একটা এনামেল করা পাত্র রোজ সন্ধ্যায় জল ঢেলে ভর্তি করা হয়। ফ্লক নিশ্চিন্তে এবং শান্তিতে ঘুমোয়; সকালে উঠে সে নিজের থাবা দিয়ে ঘরের দরজাটা আঁচড়াতে শুরু করে, যতক্ষণ না সেটা খুলে দেওয়া হয়। তারপর তার ঝোড়ো আদুরে ভাবভঙ্গির উত্তরে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে ছোট করে ইনেস তাকে সুপ্রভাত জানায়। ফ্লক তাতে অবাক হয় না, দুঃখ পায় না। কারণ সে জানে যে ইনেস অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গেও একই ধরনের ব্যবহার করে থাকে। ব্যাপক আবেগী ভাবভঙ্গির সামনে সে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চায় সবসময়।

ইনেস লাল রঙের চপ্পল পরেছে। রঙটা ফ্লকের কম্বলের সঙ্গে ম্যাচিং। লম্বা একটা ড্রেসিং গাউন পরেছে সে; তার পোশাক থেকে অবর্ণনীয় সুন্দর একটা সুবাস আসছে। যখন ইনেস ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে তার নখের পরিচর্যা করে, তখন ফ্লক তার পোশাকের প্রান্তের নরম পশমে নাক ডুবিয়ে বসে থাকতে ভালবাসে। ইনেস সেটা লক্ষ্য করে তাকে একটু দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে; তবে দূরে যেতে বলার আগে অবশ্যই সে এক মুহূর্তের জন্য তার উষ্ণ এবং ঋজু হাতে তাকে আদর করতে থাকে এক দুই মুহূর্তের জন্য। ‘এবার এসো, ভালো কুকুরছানা!”… ইনেসের কথাগুলির মধ্যে যে এক মহান কোমলতা লুকিয়ে আছে সেটা ফ্লক অনুভব করে এবং এই অনুভূতিকে সে গের্টের আবেগের বিস্ফোরণ এবং ছোট্ট বের্নহার্ডের নিয়ত এবং বেশ অসহনীয় টোকা মেরে যাওয়া আদরের থেকেও অনেক বেশি পছন্দ করে। ফ্লক খুব ভাল এক পর্যবেক্ষক, যদিও সে এটা বোঝে না যে বের্নহার্ড যখন তাকে টোকা মেরে আদর করে, সেটা শুধুই তাকে আদর করবার ইচ্ছে হয় বলে করে না। যখন ইনেস এবং গের্ট বের্নহার্ডের উপস্থিতি সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চালিয়ে যায়, তখন নিজের অস্বস্তি গোপন রাখবার জন্য বের্নহার্ড তাকে আদর করে। কিম্বা যখন বিশেষ কোনও আলোচনায় বের্নহার্ড অংশগ্রহণ করতে চায় না, কোনওভাবে এড়িয়ে যেতে চায়, তখন সে ফ্লককে আদর করে। ঘটনাচক্রে, বের্নহার্ড প্যারিসে চলে যাবার পর থেকে শনিবারের বিকেলে গাড়ি চড়ে হাওয়া খেতে যাওয়া অনেকটা কমে গেছে। যেহেতু ফ্লক ওদের সবাইকে খুব ভালবাসে, সেহেতু একথা বলাই যায় যে ফ্লক বের্নহার্ডের উপস্থিতির অভাব অনুভব করে।

তবে ফ্লক রোজ খায়দায়, ঘুমায়, হাঁটতে যায়। তার দিনলিপির নিয়মের খুব সাঙ্ঘাতিক কোনও হেরফের ঘটে না। মোটের উপর এককথায় বলা চলে যে ফ্লক ভাল আছে।

কিন্তু ইনেস নানারকমের চিন্তা ভাবনায় জর্জরিত। যদিও সে খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে এবং বিভিন্ন বিষয়ে তার স্বচ্ছ চিন্তাভাবনা আছে, তবুও সম্প্রতি সে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কখনো কখনো। প্রতি ক্ষেত্রে সে ভেবে চলেছে যে ঠিক কী ভাবে করলে কাজটা ঠিকভাবে করা সম্ভব। যেমন, সে ভাবছে যে নিজের কেরিয়ারের উপরে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আমি হয়তো আগে পরিষ্কার করে বলিনি যে ইনেস কোনও চাকরি করে না, যদিও সে খুবই আধুনিকমনা নারী। ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। সাধারণ মানুষজনের চেয়ে তার বুদ্ধিমত্তা অনেক বেশি। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানগম্যি আছে এবং পরিশীলিত আদবকায়দাসম্পন্না; তার উপরে দেখতে সুন্দরী এবং যথেষ্ট আকর্ষণীয়া। তার এত গুণের সেরকম কোনও সদ্ব্যবহার সে করছে না। সে কালেভদ্রে বাড়ির বাইরে বেরোয়। অতিরিক্ত সামাজিকতা পালন করা কিম্বা সমাজে বিশেষ ভাবে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল দেখাবার কোনও তাগিদ নেই তার। তার বাবার এই ব্যাপারে বেশ আক্ষেপ আছে। কারণ সে সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রতিভার যথাযথ প্রয়োগ করছে না। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই ইনেস নিজের মত থাকতে ভালবাসে এবং তাঁর বাবা নিজস্ব মতামত মেয়ের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী নন। অবশ্য তার অর্থ এমন নয় যে ইনেস তাঁর বাবার মতামতকে কোনও গুরুত্ব দেয় না। ইনেসের বাবা খুব বুদ্ধিমান, নিজস্ব ব্যবসা নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকেন, শিক্ষিত, দূরদর্শী এবং মুক্তমনা ব্যক্তি। ইনেস বাবাকে খুবই ভালবাসে কিন্তু নিজের জীবনের কিম্বা তাঁর বন্ধুবান্ধব বেছে নেওয়া কিম্বা নিজস্ব সময় কাটানোর কোনও সিদ্ধান্তের ব্যাপারেই বাবার মতামত দ্বারা প্রভাবিত হয় না। কারণ সে মনে করে যে তাঁর জীবনের ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতা প্রয়োজন। স্বাধীনতা না থাকলে মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাইরের প্রভাব যদি ভুল হয়, সেক্ষেত্রে জীবনে ভুলের পরিমাণ বাড়তে থাকে। “পরিস্থিতি বুঝে চলা আর সেটার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া”… সে বলে, “এটাই তো জীবনে বেঁচে থাকার আসল কৌশল। তবে সেটা কখন কী ভাবে করব, সেটা অবশ্যই আমার পছন্দ! তবে দিনের শেষে আমি জানি যে বাবা আছেন এবং আমি সবসময় তাঁর উপরে ভরসা করতে পারি।”

উদাহরণস্বরূপ, তাঁর বাবা যদি জানতে পারেন যে গের্টের বাড়ির বন্ধুদের আড্ডায় সে ছাড়া আর কোনও মেয়ে যায়নি, তাহলে কেমন আচরণ করবেন? তাছাড়া সে যে সপ্তাহান্তে মাঝে মাঝে গের্টের সঙ্গে বেড়াতে চলে যায়, সেটার জন্যেও যদি সে অনুমতি চায়, বাবা কখনই রাজি হবেন না। যদিও আমরা জানি যে তিনি যথেষ্ট মুক্তমনা, উদারচিত্ত, তবুও তিনি আপত্তি করতেই পারেন এই কথা বলে যে ইনেস যদি এদের সঙ্গে এইভাবে মেলামেশা করে, তাহলে তাঁর সামাজিক সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে।



কিন্তু ইনেস তাঁর সঙ্গীত বিদ্যালয়ের বন্ধুদের আড্ডা এড়িয়ে থাকতে পারে না। যেমন ফার্দিনান্দ, ইনেসকে যার খুব দরকার; তাছাড়া বের্নহার্ড, সে তো ইনেসের বাড়িতেও এসেছে। গের্টের সঙ্গে সপ্তাহান্তের শেষে লং ড্রাইভ সে শুধুই সামাজিক সম্মান নষ্ট হবার ভয়ে বন্ধ করে দিতে পারে না। গ্রীষ্মের সময়ে গ্রামের দিকের পরিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নেওয়া সপ্তাহে অন্তত একদিন তাঁর, ফ্লকের এবং গের্টের জন্য খুব প্রয়োজন।

ইনেস তাঁর বাবার আপত্তির কারণগুলো বুঝতে পারে। কিছুটা সে বিবেচনা করেই চলে। কিন্তু সব কথা মেনে চলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ বাবার মূল্যবোধ আলাদা। তিনি মনে করেন যে গরমের ছুটি কাটানোর মজার থেকেও সামাজিক সম্মান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ভবিষ্যতের কথা তলিয়ে ভাবেন, অভিজ্ঞ এবং দূরদর্শী। অন্যদিকে ইনেস সামাজিক মানসম্মান নিয়ে ততখানি ভাবিত নয়। ভবিষ্যতের ব্যাপার নিয়ে ভাবতেও তাঁর বয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ তাঁর মতে খুব অনিশ্চিত এবং অনেক দূরের ব্যাপার। আপাতত সে আগামী শনিবার ফ্লক আর গের্টের সঙ্গে জঙ্গলের দিকে লং ড্রাইভে যাবে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পুরো পাহাড়টা পেরিয়ে যাবার ইচ্ছে আছে তাদের। পাহাড়ের উপরে একটা লেক আছে। সেখানে বসে তারা মাছভাজা খাবে আর বের্শেনের কথা ভাববে, যে প্যারিসে গেছে পিয়ানো শিখবে বলে। ফ্লকের গলার কলারটা খুলে দিয়ে তাকে ইচ্ছেমত দৌড়াতে দেবে ইনেস। যদিও ব্যাপারটায় ঝুঁকি আছে, কারণ ফ্লক খামকা ঘেউঘেউ করে সরাইওয়ালার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তারপর আবার তাকে শান্ত করতে হবে এবং বোঝাতে হবে যে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দৌড়ে যাওয়া চঞ্চল খরগোশগুলোকে ধরবার মত ক্ষমতা ফ্লকের নেই। অবশেষে অন্ধকার হয়ে আসবে। গের্টের মেজাজ খারাপ হবে। সে ফ্লককে বলবে অপদার্থ জন্তু, কারণ ফ্লক সব্বার মিলিত শিসের শব্দ অবধি শুনছে না, নিজের ইচ্ছেমত দৌড়ে কোথায় লুকিয়ে বসে আছে।

কিন্তু ফিরবার সময় কে জানে কোত্থেকে ফ্লক হঠাৎ এসে হাজির হবে ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে। আনন্দে, খুশিতে লাফাতে লাফাতে গড়াতে গড়াতে এসে সব্বার আগে আগে নিজের নাকটা উপর দিকে তুলে চলতে থাকবে সে। সরাইখানাটাকে অবশ্য ঠিক হোটেল বলা চলে না। ঘরোয়া ব্যবস্থাপনা। বিশাল বিশাল খাটগুলোতে অনেক বালিশ আর ডোরাকাটা উলের কম্বল। গের্ট ওয়াইন অর্ডার করবে আর প্রমাণ করবার চেষ্টা করবে যে সে একটুও ক্লান্ত হয়নি। ইনেস জোর করে ঘুমাতে চলে যাবে। ক্লান্ত অবস্থায় ঘুমিয়েও পড়বে। বের্শেন যে ভাবে রবিবারে জেগে উঠতে চায়, ঠিক সেইভাবেই সবার ঘুম ভাঙবে। ঝরনার জলের কুলকুল শব্দে, সূর্যের সোনালি আশাবাদী রশ্মি যা পাথরের সব ফাটলের মধ্যে ঢুকে চারদিক আলো করে দেয় এমন সকালে জেগে উঠবে তারা।

গের্ট সবসময় ইনেসের চেয়ে আগে উঠে যায় ঘুম থেকে। তারপর সে ইনেসের ঘরের সামনে বাইরে থেকে ইনেসকে ডাকবে। তারপর সরাইখানায় যে মেয়েটা প্রাতরাশ পরিবেশন করে, তাঁকে বলবে ইনেসের ঘরে সবার খাবার দিয়ে যেতে। গের্ট অনেক রুটি খেয়ে ফেলবে। তারপর সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে মেয়েটাকে বলবে আরও দুধ দিয়ে যেতে। তারপর প্লেটে ঢেলে চুপিচুপি বেশ কিছুটা দুধ ফ্লককে খাইয়ে দেবে।

কিন্তু সন্ধের মধ্যে ইনেস খুব ক্লান্ত হয়ে যাবে। রবিবারের সন্ধেটা খুব তাড়াতাড়ি আসে। এটা বের্শেন বলে। ফুলে ফুলে ঢাকা উপত্যকার মধ্য দিয়ে গাড়িতে ফিরবে তারা। যাবার পথে দিগন্তরেখার আকাশ প্রথমে উজ্জ্বল ছিল, তারপর ধীরে ধীরে বিষণ্ণ ফ্যাকাসে নীল হয়ে আলো নিবে আসবে।

বাতাসে উত্তাল পথ দিয়ে দিগন্তরেখার দিকে গাড়ি চালিয়ে যাবে গের্ট। পথে রাত হয়ে যাবে কখনো কখনো। একটা উজ্জ্বল চাকতির মত দেখতে চাঁদ ওদের পথের সঙ্গী হবে। ফ্লক ইনেসের হাতের মধ্যে নাক গুঁজে ঘুমিয়ে পড়বে।

আবার পরের শনিবার ইনেস ফ্লক আর গের্টকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে যাবে। তাতে তাঁর সামাজিক সম্মান থাকল না গেল, সেটা নিয়ে সে ভাবে না। তবে যাবার আগে সে কখনই তাঁর বাবার কাছে অনুমতি চায় না কিম্বা এই ভ্রমণ নিয়ে বাবার সঙ্গে কোনও আলোচনা করে না। কারণ সে জানে যে বাবা ব্যাপারটা সেভাবে অনুমোদন করেন না, তিনি সামাজিক সম্মান নিয়ে ভাবিত। ফলে অনাবশ্যক এই বিষয়ে আলোচনা করে বিতর্ক বাড়িয়ে সে তাঁর বাবাকে দুঃখ দিতে চায় না। তাছাড়া জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে যে কোনও ঘটনা ঘটে যাবার পরে সেটার মধ্যে আর ততখানি ধার থাকে না, অথচ কোনও ঘটনা ঘটবার আগে সেটা নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা এবং নানা আশঙ্কা মানুষের জীবনে অশান্তি ডেকে আনে।

কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি যে শনিবারের এই ভ্রমণ আগের মত ঘনঘন হচ্ছে না বের্শেন প্যারিসে চলে যাবার পরে এবং সেটার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে ফ্লক। অবশ্যই না বেরোবার বেশ কিছু কারণ আছে। সেটার মধ্যে অন্যতম হল যে ইনেস বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তিত থাকে আজকাল।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২২.১

শহরে চায়ের দোকান, কমিটি’র রুম, লাইব্রেরি এবং বিধানসভা যে দরকারে লাগে , গাঁয়ে রাস্তার পাশে
পুলিয়া বা কালভার্টের উপর ছোট সিমেন্ট- বাঁধানো বসার জায়গা একই কাজে আসে। অর্থাৎ,
লোকজন ওখানে বসে আড্ডা মারে। এখন রোববারের বেলা দশটা, রঙ্গনাথ এবং রূপ্পনবাবু একটি
পুলিয়ার উপর বসে রোদ পোহাচ্ছেন এবং বর্তমান সময়ের হালচাল দেখছেন।
বর্তমান সময়ের হালচাল—মানে অন্ধকারে দুই দৃঢ় স্তনের হাতে গরম ছোঁয়া। এ নিয়ে রঙ্গনাথই
প্রথম শুরু করল। ভেবেছিল সে রাতে যা ঘটেছিল সেটা কাউকে বলবে না। রূপ্পনের সঙ্গে ও কেবল
জেনারেল নলেজের কথা তুলেছিল আর এটাও জানতে চাইছিল যে মহল্লায় এমন কে কে আছে যারা
চাইলে কোন বক্ষবন্ধনী নির্মাতা কোম্পানির বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে ক্যালেন্ডারে ছবি হতে
পারে।

ও রূপ্পনের সঙ্গে এমন ভাবে আলাপ শুরু করল যেন ও নিজে ওই রকম কোম্পানির পাবলিসিটি
ম্যানেজার আর ওর মেয়েছেলে বা তাদের স্তন নিয়ে বেশি আগ্রহ নেই, শুধু বিজনেসের জন্য যতটুকু
দরকার, ব্যস্‌। রূপ্পন বাবু যখন এবিষয়ে একটু গভীর কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন তো ওর অবস্থা
হল গভীর আলোচনা শুরু হলে সব ভারতীয় ছাত্রের মত উনিও এদিক সেদিক পাশ কাটানো শুরু করলেন।
উনি বিষয়টা বদলে মেয়েদের স্বাস্থ্যের দিকে টেনে নিয়ে গেলেন এবং ‘দ্য গ্রেট ব্রা-ম্যানুফ্যাকচারিং
কোম্পানী’র পাবলিসিটি ম্যানেজারের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ‘অখিল ভারতীয় নাগরিক স্বাস্থ্য
সংঘে’র প্রধান সম্পাদক হয়ে গেলেন। কিন্তু রুপ্পন বাবুর প্রশ্নমালা তাঁকে সেই পদেও টিকতে দিল
না। খানিকক্ষণ অন্ধকার, শীত, ভুত-প্রেত নিয়ে কথা বলতে বলতে রঙ্গনাথ হঠাৎ টের পেলেন যে
অনিচ্ছাসত্ত্বেও উনি রূপ্পনবাবুকে একটু একটু করে সেই রাতে যা ঘটেছিল তার পুরোটাই বলে
ফেলেছেন।
রূপ্পনবাবু মন দিয়ে শুনছিলেন। রঙ্গনাথের কথা শেষ হবার মুখে ওনার মনে হল যেন এক জ্বলন্ত
উনুনের উপর বসে আছেন। নিজের ভেতরে এক অদ্ভূত টেনশন এবং গরম ভাপ টের পাচ্ছেন। মেয়েছেলে
নিয়ে কথাবার্তা হলেই ওনার ভেতর এই রকম অনুভূতি হয়। ওনার বিশ্বাস যে ছাতে যে মেয়েটি এসেছিল
সে বেলা ছাড়া কেউ নয় আর যার কাছে ও আত্মসমর্পণ করতে চাইছিল সে নিঘঘাৎ রূপ্পনবাবু!
আমার প্রেমপত্র এবার খেল দেখাচ্ছে। বেলা ছটফট করছে। ভেবে ভেবে রূপ্পন নিজেই ছটফট করতে
লাগলেন। ইস্‌, ওই রাতে আমি কেন খোলা ছাতে ঘুমোতে যাই নি! এই আফশোসে রূপ্পনবাবুর গলায়
একটি সিনেমার গানের লাইন এসে গেল। কিন্তু এখন রঙ্গনাথের সামনে নিজেকে এক সমঝদার ব্যক্তি
দেখাতে হবে তাই উনি গম্ভীর হলেন। উনি চুপ করে আছেন দেখে রঙ্গনাথ ফের নিজের অভিজ্ঞতার
বর্ণনা শুরু করে দিলঃ “ও যে কখন এল, কখন গেল—বুঝতেই পারি নি। শুধু এটুকু মনে আছে যে ও এসে
আমার বুকের উপর ঝুঁকে—“।
রূপ্পন বাবু বিচক্ষণ ব্যক্তির মত বললেন-“হ্যাঁ, এমন হয়। কখনও কখনও এমন ভ্রম হয়। কে
এসেছিল জানা নেই, সত্যি এসেছিল কি—তাও নয়। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। গেঁয়ো কারবার।
সবাই ভুত-প্রেত ভাববে। ক’জন বুঝবে? রঙ্গনাথ দাদা, তারচেয়ে মুখ খুলো না। হতে পারে তুমি স্বপ্ন
দেখছিলে, হতে পারে সত্যি ঘটেছিল”।

এই বিশ্লেষণে রঙ্গনাথের দুটো আপত্তি।
এক, রূপ্পন ওর অনুভবকে স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন।
দুই, উনি মেয়েটির জন্য পুংলিঙ্গের প্রয়োগ করছেন কেন?
তাই রঙ্গনাথ বলে উঠল, কোন ধোঁকা খাইনি। আমি জেগেই ছিলাম। ও এসে আমার খাটিয়ায় বসেছিল।
আমার উপর ঝুঁকে—“।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে”। হাত নেড়ে কিছু কাল্পনিক মশা তাড়াতে তাড়াতে রূপ্পন বললেন, “ মেনে
নিলাম। সত্যিই কোন ব্যাটা এসেছিল। কিন্তু এ নিয়ে কাউকে কিছু বলার দরকার নেই”।
“কোন ব্যাটা এসেছিল!” রঙ্গনাথ চোখ বুঁজে একবার কোণার্কের সুর্-সুন্দরীদের চেহারা ধ্যান করল
আর মনে মনে অন্ততঃ কুড়িবার বলল,” ব্যাটা নয়, কোন বেটি এসেছিল। রূপ্পন বাবু, তুমি কখনও
‘ব্যাটা’ ছাড়া কিছু ভাবতে পার না”?
পরের দিন। বাদাম ফুরিয়ে যাওয়ায় রঙ্গনাথকে শিবপালগঞ্জের গলি গলি খুঁজে বেড়াতে হল। দু’চারটে
দোকান ছিল। সেখানে জিজ্ঞেস করায় একেকজনের থেকে যা যা শোনা গেলঃ
‘আজকাল বাদাম কে বেচে! খাওয়ার লোক কই? বাদাম খেয়ে হজম করা সোজা নাকি! বড় বড় পালোয়ান
হার মেনেছে। ফের বাদাম কে কিনবে? গম আর ছোলা আজকাল বাদামের দামে বিকোচ্ছে-- তাই যথেষ্ট।
আগে বদ্রী পালোয়ান খুব বাদাম খেত। তখন আমরাও দোকানে বাদাম রাখতাম। ও আজকাল বাদাম
ছেড়ে কেবল দুধ-ঘি খাচ্ছে। আর ওর ভাই রূপ্পন! সে খেঁকুড়ে মুখে চা-বিস্কুট সাঁটিয়ে বেঁচে আছে।
“ এখানে আর বাদাম-টাদাম পাওয়া যায় না। বলতে গেলে, বাদামের শুধু নামই রয়ে গেছে। ভাল জাতের
কাগজি বাদাম আর আসে কোথায়? পাওয়া গেলেও শহরের বাজারগুলোতেই শেষ। নতুন নতুন শেঠ
দোকানদার গজিয়ে উঠছে। ওরা আগেই কিনে নিয়ে লাড্ডু বানিয়ে বেচে। যতখুশি খাও আর নেদে বেড়াও।
“বাদাম কি কোন ভাল জিনিস? পেটকে ইঁটের মত বানিয়ে দেয়। বাদাম সবসময় কিসমিস-মনাক্কার
সঙ্গে খেতে হয়। মনাক্কা হল আসল জিনিস। দুর্বল পেটে পড়লে দাস্ত করায়, কিন্তু স্বাস্থ্যবানের
পেট হালকা হয়।
“মনাক্কা নেবে তো বল। দেখে নাও, এই হল আসল মনাক্কা। শিবপালগঞ্জ বলে পেয়ে যাচ্ছ, শহরের
বাজারে গেলে সারা দিন চক্কর কাটতে। এ জিনিস ওখানে পাওয়া অসম্ভব”।
ছাগলের নাদির মত মনাক্কা দেখে দেখে রঙ্গনাথের চৈতন্য হল যে গাঁয়ে কেনার মত আদর্শ বস্তু হল
যা রাষ্ট্রকবি মৈথিলীশরণ গুপ্ত অর্ধশতাব্দী আগে লিখে গেছেনঃ
“কাশীফল কুষ্মান্ড কহীঁ হ্যায়, কহীঁ লৌকিয়াঁ লটক রহী হ্যাঁয়”।
(কুমড়ো আর ফুটি দেখ রয়েছে কোথাও,
আর কোথাও ঝুলে আছে লম্বা লম্বা লাউ)।
শুনতে পেল শিবপালগঞ্জ থেকে দু’মাইল দূরে এক গাঁয়ে কিছু দোকান আছে যেখানে ভাল বাদাম পাওয়া
যেতে পারে। রঙ্গনাথ রওনা হয়ে গেল। রাস্তাটার অনেকখানি পাকদণ্ডী মত, তায় কোথাও কোথাও
পথের দু’পাশে বাবুল গাছের কাঁটাওলা ডাল পোঁতা। নালা আর বড় খাদ কাটা হয়েছে, আবার কোথাও উঁচু

করে আল বাঁধানো। বোঝাই যাচ্ছে যে চাষিরা চায় না একটা পাখিও বেড়ার ফাঁক দিয়ে গলে যাক। কিন্তু
মানুষ তো আজকাল চন্দ্রাভিযান , মঙ্গল অভিযানের দুঃসাহস করে। তারা এসব বিঘ্ন-বাধা অতিক্রম
করে কখনও ক্ষেতের কখনও নালার ভেতর দিয়ে রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে।
একজন ভালোমানুষ ওদিকেই যাচ্ছেন। ব্যস, রঙ্গনাথ তাঁর পেছন পেছন চলতে লাগল। তিনি জানতে
চাইলেন –কাদের ঘরের ছেলে?
রঙ্গনাথ জবাব দিল—বৈদ্যজীর ভাগ্নে।
ভদ্রজন বিনয় দেখিয়ে বলল—আপনার নাম শুনেছি। আজ দেখা পেলাম। আপনি তো লেখাপড়ায় অনেক
দূর--বি এ এম এ পাশ।
রঙ্গনাথ বলল—রাস্তাটা বড্ড খারাপ। লোকে কেন যে বাবুলের কাঁটাওলা ডাল পুতে রেখেছে!
--এখানে দেখাশুনোর কেউ নেই। যার যা ইচ্ছে করছে। পথের মাঝখানে আল বানিয়ে দিচ্ছে, বাবুলের কাঁটা
পুঁতে দিচ্ছে। ।
--কেন, এখানে গ্রাম-পঞ্চায়েত আছে না?
--তা আছে। কোন কাজ করে না, শুধু জরিমানা লাগায়। আগের দিন হলে জমিদার ছিল, জুতোপেটা করত।
হিন্দুস্তান শালা ভেড়ার পাল। জুতো না খেলে শোধরায় না। জমিদারি উঠে গেছে, জুতোপেটা বন্ধ! এখন
দেখ, সরকারকে বাধ্য হয়ে জুতোপেটা করতে হচ্ছে। রোজ কোথাও না কোথাও লাঠি গুলি চালাতে হচ্ছে।
আর কী করবে? এরা সব লাথ খাওয়ার দেবতা, ভালো কথায় মানবে না।
জমিদারি উচ্ছেদ করে সরকার বাহাদুরও ঠেকে শিখেছেন—এ দেশ চালাতে আসল জিনিস হল জুতো!
রঙ্গনাথ—এটা কি কথা! জুতোপেটা করে কত লোককে আদবকায়দা শেখানো যায়?
কিন্তু ওই ভদ্রলোকের অভিমত হল –জুতোপেটা বন্ধ হওয়া ভুল। যতক্ষণ বদমাশের মাথায় একটা
চুলও বেঁচে থাকবে ততক্ষণ জুতো চলুক। ওনার খারাপ মুড দেখে রঙ্গনাথ চুপ করে গেল। খানিক দূর
চলার পর উনি প্রশ্ন করলেন—আচ্ছা, বিএর সম্মান বেশি, নাকি ওকালতের?
রঙ্গনাথ— কিসের ছোটবড়? দুটোই সমান।
--সে তো আমিও জানি। এই হতচ্ছাড়া দেশে ছোটবড় সব এখন এক হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে কোনটা
বড়?
রঙ্গনাথ এড়াতে চেয়ে বলল—ওকালতি।
“তাহলেই বোঝ, আমার ছেলে একজন উকিল”।
--“উনি থাকেন কোথায়”?
উকিলের পিতা এবার দম্ভভরে বললেন—“উকিল কোথায় থাকে? এখানকার গাঁয়ে পড়ে থাকবে নাকি?
শহরে থাকছে, তিন বছর ধরে ওকালতি করছে”।
--তাহলে তো নিশ্চয়ই বড় উকিল হয়েছেন”!
--“বড় মানে? অনেক বড়। তোমাদের গ্রামের জোগনাথওয়া আছে না? যে জেলে গেছল? ওর পক্ষে কেস
লড়ছে। বৈদ্যজী এখানে অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলেন না। দারোগা জামিন দিল না। কিন্তু
ছেলে এজলাসে দাঁড়িয়ে এককথায় জামিন করিয়ে দিল।
“বড়মানুষের মত হাত খোলা। ওকালতনামা আমিই ভরিয়ে ছিলাম। তক্ষুণি আমার হাতে পাঁচ টাকা ঠুঁসে
দিল”! রঙ্গনাথ উকিলের গর্বিত পিতাকে খুশি করতে বলল “ তাহলে নিশ্চয়ই ওঁর ভালো কামাই হচ্ছে”!
লোকটি চমকে উঠে পেছন ফিরে রঙ্গনাথকে ভালো করে দেখল “ভালো আর কি, ওই একরকম-- -- বলত
গেলে মোটামুটি চলে যাচ্ছে। তবে কামাচ্ছে তো তোমার মামাজী। কী দারুণ বৈঠকখানা বানিয়েছে!
“তেঁতুলে বীচির পুড়িয়া বানিয়ে কাউকে দিলেও এক টাকার কমে নয়। ওনার সময় ভাল যাচ্ছে”।
লোকটি হিংসেয় জ্বলে যাচ্ছে এবং সেটা লুকনোর চেষ্টা না করে বৈদ্যজীর নিন্দে করতে লাগল।
“দেখতে দেখতে কত বড় নেতা হয়ে গেছে। আগে অনেক সাদাসিদে ছিল। এখন মাটির উপরে যত, মাটির
নীচেও তত। ওঁর পেচ্ছাপে প্রদীপ জ্বলে”।
শেষে বলল, “দারোগা কিন্তু জোগনওয়ার মামলায় ওনাকে পাত্তা দেয় নি। বাঁদরের মত কাঠগড়ায় দাঁড়
করিয়ে জেলে পাঠিয়ে ছাড়ল”। তারপর ফিরে এল পুরনো প্রসঙ্গে—“আমার ছেলে জামিন না করালে
ব্যাটা এখন জেলারের বাচ্চাকএ কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো”।
--“আগামী শুনানি কবে”?
-- “জোগনাথের মামলার? মামলা চলছে অনারী মজরেটের এজলাসে। ও যখন চাইবে তখনই শুনানি হবে।
ছেলে আজকাল বাড়ি এসেছে। দু-চার দিনে শহরে ফিরে যাবে। তারপর কোনদিন শুনানির আদেশ বের করে
নেবে”।

ওরা যে পথ দিয়ে যাচ্ছিল সেখানকার জমি বেশ ঢালু আর ঝোপঝাড় কাঁটাগাছে ভরা। এছাড়া রয়েছে
কাশবন। এখন আর ‘ফুলে ফুলে সাদা’ নয়, শুকিয়ে শক্ত ডাল। চলতে গেলে পথিকের গায়ে খোঁচা লাগে।
এক জায়গায় কাশের শুকনো পাতা আর ডগা পাকদণ্ডী পথের দু’পাশ থেকে ঝুলছিল। রঙ্গনাথ ওগুলোকে
ঠেলে সরিয়ে এগিয়ে যেতে পারত, কিন্তু ওগুলো দু’হাতে চেপে ধরে এক মোটা গিঁট বেঁধে দিল। চলার পথ
খানিকটা সাফ হল। একটু এগিয়ে ফের ওইরকম কাশফুলের শুকনো ডাল, সেখানেও একই কায়দায় গিঁট
বেঁধে দিল।
উকিলের বাবা দাঁড়িয়ে পড়ে মন দিয়ে রঙ্গনাথের এই অদ্ভূত আচরণ দেখছিলেন। আরও একটা বড় গিঁট
বাঁধার পর জিজ্ঞেস করলেন—এটা কী হচ্ছে?
--কোনটা?
--এই যে একের পর এক গিঁট বাঁধছ?
--আচ্ছা, ওই গিঁট?

ভাবল একবার বুঝিয়ে বলে যে গিঁট বেঁধে দিলে এগুলো হাওয়ায় নুয়ে পথিকের রাস্তা আটকাবে না, আর
কিছু নয়। কিন্তু উকিলের বাপের চেহারা দেখে থমকে গেল। উনি উত্তেজিত হয়ে বিরাট কোন রহস্যের
গুপ্তকথা শোনার অপেক্ষায় রয়েছেন। রঙ্গনাথ ভাবল, ঠিক আছে, তাহলে তাই সই।
ও ফিসফিসিয়ে বলল, “কাউকে বলবেন না যেন! মামাজী আমাকে বলে দিয়েছেন—পথে একটা কাশবন
পড়বে। ওখানে শুকনো পাতা আর ডগা দেখলে গিঁট বেঁধে এগিয়ে যাবে। হনুমানজী প্রসন্ন হবেন”।
--আগে কখনও শুনিনি তো!
--‘আমিও শুনি নি’ , এই বলে রঙ্গনাথ এগিয়ে গেল। এখন ও আগে, উকিলের বাপ ওর পেছনে। তিনি
আবার ওকালতের মহিমা ব্যাখ্যান শুরু করলেন।
“এম এ , বি এ তে আছেটা কী? আমাদের সময় একটা ছড়া প্রচলিত ছিল, কী যেন, ধেত্তেরি, মনে পড়ছে
না। ও হ্যাঁ, ‘পাস হ্যায় মিডিল মুল্লু, ঘাস ছীলি আবে না’।
(মুল্লু এখন হল মিডল পাস,
কিন্তু ব্যাটা কাটতে নারে ঘাস!)
“এখন এটা বদলে দিচ্ছি “ বি এ ভয়ে পাস মুল্লু, ঘাস ছীলি আবে না”।
(মুল্লু এখন হল বি এ পাস,
কিন্তু আজও কাটতে নারে ঘাস)।
“আজকাল এমএ, বিএ তো একটাকা সের দরে বিকোচ্ছে। তোমার তো উকিল হওয়া উচিত ছিল। উকিল
হয়ে কাছারিতে টেবিল লাগিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসতে। যার মামা হলেন ‘গঁজহা’ (শিবপালগঞ্জের বাসিন্দে),
তায় বদ্যি এবং নেতা –তার আবার মোকদ্দমার অভাব! রোজ দশ-বিশটা মামলা তো তোমার মামাজীরই
চলতে থাকে”।
রঙ্গনাথ এমন পরামর্শের বিষয়ে কোন মতামত দিল না। তবে যেতে যেতে থেমে গিয়ে দুটো কাশফুলের
ডগায় তিন নম্বর গিঁট বেঁধে বলে উঠল—“জয় হনুমান কী”!
উকিলের বাপ এবার থেমে গেলেন। রঙ্গনাথের মুখ থেকে হনুমানের নাম বেরোতেই ওনার হাত কাশের
ডগায় পৌঁছে গেল। উনি গিঁট বাঁধতে ব্যস্ত হয়ে রঙ্গনাথকে বোঝাতে লাগলেন—“ভাবলাম, আমিও একটা
গিঁট বেঁধে দিই। এর জন্যে তো পয়সা লাগে না”।
রঙ্গনাথ গম্ভীর হয়ে বলল, “জয় হনুমানজী কী”!
উকিলের বাপ তক্ষুণি কাশের গিঁটকে প্রণাম করে বললেন--“জয় হনুমানজী কী”!

এক কেলটে মত মেয়েছেলে মাথায় একটা নোংরা পোঁটলা রেখে ওনার পেছন পেছন চলছিল। আগে ও
অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখেছিল। কিন্তু উনি গিঁট বাঁধতে ব্যস্ত হলে দু’জনের দূরত্ব অনেক কমে গেল।
বয়স হবে প্রায় পঁয়তাল্লিশ, কিন্তু মুখের চেহারায় বুড়ি বুড়ি ভাব। তবে আমাদের নজর ওর মুখের থেকে

নীচে নেমে এলে বোঝা যায় বেশ ভর-ভরন্ত খেত। ওর জামার দুটো বোতাম খোলা, কিন্তু ওর মুখের ভাব
মীরাবাঈয়ের মত তন্ময়। টের পায়নি যে ওর বুকের দুটো বোতাম কখন খুলে গেছে অথবা ওর জানা নেই
যে বোতাম খুলে যাওয়ায় কোন লাভ-লোকসান হতে পারে কিনা।
রঙ্গনাথ প্রথমে ওই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে নিল। ফের চোখ সরিয়ে উকিলের বাপকে দেখতে লাগল।
কিন্তু তিনি সেটা টের পেলেন না। কারণ, উনি তন্ময় হয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলেন যা একবার দেখে
রঙ্গনাথ চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
মেয়েছেলেটি ছাগলের মত ম্যা-ম্যা করে বলল—কী করছ ভাইয়া?
জবাব রঙ্গনাথকে দিতে হল না। উকিলের বাপ চটপট বলে উঠলেন—দেখছ না? হনুমানজীর গিঁট বাঁধছি।
মেয়েছেলে এবার মাথার পূঁটলি মাটিতে নামিয়ে সবিনয়ে জানতে চাইল—আমি তো মেয়েছেলে। আমরা
করলে মানা আছে কি?
“ভগবানের দরবারে কি মেয়েছেলে, কি ব্যাটাছেলে—সব সমান”, উকিলের বাপের গলার স্বরে দৃঢ়
আত্মবিশ্বাসের ঝলক। যেন এক্ষুণি সোজাসুজি ভগবানের দরবারে হাজির হয়েছিলেন, ওখান থেকেই
ফিরছেন। মেয়েছেলেটি এবার দুটো হাত কাশবনের এক ঝাড়ে গুঁজে দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, “জয়
বজরঙ্গবলী কী”!
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in



















৯.
'আত্মঘাতী বাঙালির' কাছে অচেনা নীরদ সি চৌধুরী




সুপ্রিয়বরেষু

সুস্মি,

তোমাকে যখন এই চিঠি লিখতে বসেছি বাতাসে তখন বারুদের ঘ্রাণ। দেশভাগ, দ্বিজাতি তত্ত্ব, স্বাধীনতা অনেক কিছু নিয়েই লেখা যায় তোমাকে, ভারত পাক যুদ্ধ নিয়ে লিখতে মন চাইলো না। বাংলাদেশ নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হলো তোমাকে বেলুচিস্তানের কথা লিখি তাদের স্বপ্নের কথা বলি। বহুবছর পর আত্নঘাতী বাঙালি নিয়ে বসেছি, পড়েছো নিশ্চয়। নীরদ সি চৌধুরীর লেখাগুলো সাহিত্যের ভুবনে খ্যাতি পাওয়ার পরেও জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে কেন উত্তীর্ণ হলো না, তা একটি ভাববার মতো বিষয়। তার অধিকাংশ রচনাবলীতে বিমর্ষতা হল এই প্রশ্নের উত্তর। নীরদের সাহিত্যকর্মে বিমর্ষতার লক্ষণগুলো অতটা সুস্পষ্ট নয়; অর্থাৎ, তাকে মূলধারার বিমর্ষ সাহিত্যিকদের কাতারে ফেলা যাবে না। নীরদ সি চৌধুরীর চাঁছাছোলা গদ্যরীতি আর বিমর্ষতা তার সাহিত্য চর্চায় সম্ভবত এক ধ্রুপদী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। তাঁর বোধে মার্ক্সীয় দর্শন এ যুগের নিরিখে অপ্রাসঙ্গিক। তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রশংসা করছেন এক দিকে, অন্য দিকে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে তুলনা করে তা যে হীন, তা বলতেও ছাড়ছেন না। তাঁর কাছে রেনেসাঁ হল মোগলযুগের আচ্ছন্নতা কাটিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে নতুন করে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার মহত্ত্বকে অনুভব করা। হিন্দুদের সুপ্রাচীন আধ্যাত্মিকতার গালভরা বড়াই নিতান্তই ভুয়ো অর্থহীন, নীরদ চন্দ্র তাঁর ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ গ্রন্থে দৃষ্টান্ত দিয়ে তা দেখিয়েছেন।

নীরদ চন্দ্র চৌধুরীকে তুমি কিভাবে দেখো জানিনা তবে আমার মনে হয় নীরদ সি চৌধুরী জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নানা দিকের প্রশস্তি গাথা রচনা করে। ইংরেজদের তিনি তাদেরই তৈরি করা খেলায় হারিয়েছেন- নীরদ বাবুর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এখানেই। তবে আগাগোড়া উদ্ধত, ভয়ানক, দ্বন্দ্বমুখর ব্যক্তিত্ব নীরদ চন্দ্র চোধুরীর বিষয়ে মূল্যায়ন করাও একটি দন্ধ মুখর কাজ, যা করতে যোগ্যতা, ধৈর্য, জ্ঞানের গভীরতা এবং নির্মহ হওয়ার চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। তাকে তাই মূল্যায়ন করা যায় না, তার বর্ণিল জীবন শুধু উপভোগ করা যায়, তার সাহিত্যকর্মের গভীরে পৌঁছে ইউরোপের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্বকে আয়েশ করে হৃদয়ঙ্গম করা যায়, তবে তার জীবন ও কর্মের বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছানো, স্বাস্থ্যহীন জীর্ণ-শীর্ণ মানুষের হিমালয় বিজয়ের আকাঙ্খার মতো।

দ্বান্দ্বিক নীরদ চন্দ্র তার প্রথম লেখা ইংরেজি বই দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান লেখার সময় ভূমিকায় বলেছেন, আমি জীবনের প্রথম পঞ্চাশটা বছর মুছে ফেলে নতুন করে বাঁচতে চাই। বন্ধুরা মনে করেন আমি এক ব্যর্থ মানুষ, আর এই বই লিখে সেই ব্যর্থতার এক অজুহাত খাড়া করতে চাইছি। তবে আমি সেই তথাকথিত পরাজয় এবং সেই পরাজয় স্বীকারের মাঝখানে একটা সরু, নোনা জলের দুরতিক্রম্য নদী বইয়ে দিতে চাইছি। রণে ভঙ্গ আমি দিচ্ছি না। তার এই স্বগতোক্তি আবার বাঙালি পাঠকদের মনে তার সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক চিন্তার উদ্রেক করে। প্রথম পঞ্চাশটি বছর যা তাকে বিশ্ব জগতকে দেখার সামর্থ্য তৈরি করে দিয়েছে, যে সময়ে তিনি একাডেমিক লেখা পড়ার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন মেধা সম্পন্ন মানুষদের সংস্পর্শে এসে নুতন দৃষ্টিভঙ্গি পেয়েছেন, সেই সময়কে তিনি মুছে ফেলতে চান। এরকম উক্তি তার মতো পন্ডিত ব্যক্তির মুখে যখন শোনা যায়, তখন তার দিকে সন্দেহ মিশ্রিত দৃষ্টিতেই তাকাতে হয়। আভিজাত্য, শ্রেণি-উত্তরণ, জ্ঞানের স্বীকৃতি, উন্নত জীবন অর্জনের জন্য যে আত্মঘাতী হতে হয়, তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এই কথাটি পাঠকদের স্মরণ করে দিতে তিনি বাধ্য করেন।

নীরদচন্দ্র চৌধুরী-র লেখা ‘অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’তোমার পড়া আছে কিনা জানি না। বইটি আত্মজীবনী হলেও পড়তে পড়তে মনে হবে এক জন ইতিহাসবিদের চোখে দেখা ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলা। ‘অটোবায়োগ্রাফি’ পড়ে এ দেশের মানুষ অসন্তুষ্ট হলেও বিদেশিরা বইটির প্রশংসা করেছেন। তাঁদের মধ্যে এমন দু’জন ছিলেন যাঁদের প্রশংসা পাওয়াটা বিরল ব্যাপার। এক জন বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ নায়পল, অন্য জন উইনস্টন চার্চিল। ‘অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ এক জন ভারতীয় বালকের বেড়ে ওঠার কাহিনি। সেটা গত শতকের গোড়ার দিককার কথা। যে জগতে ক্রমশ তিনি আর তাঁর নিজের পথ খুঁজে নিতে পারছেন না, ছটফট করছেন। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের বরাতের লেখা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে পরিণতির ইঙ্গিত দিয়ে। সেই সন্ধিক্ষণের কথা সমাজ ইতিহাসের পাতা থেকে নীরদ চৌধুরীর অটোবায়োগ্রাফির পাতায় উঠে আসছে সৎ স্বচ্ছ অবিকৃত বিবরণে। বইটির বিভিন্ন অংশে রয়েছে লেখকের পিতৃভূমি এবং মাতুলালয়ের গ্রামের কথা। বয়ঃসন্ধিকালে জাতীয়তাবাদী মনোভাবের জাগৃতি, কলকাতার মানুষ আর জীবনের কথা। শেষাংশে লিখছেন তাঁর ‘আইডিয়াজ় অব অ্যান এপিটাফ’—‘হিয়ার লাইজ় দ্য হ্যাপি ম্যান হু ওয়াজ় অ্যান আইলেট অব সেন্সিবিলিটি সারাউন্ডেড বাই দ্য কুল সেন্স অব হিজ় ওয়াইফ, ফ্রেন্ডস অ্যান্ড চিলড্রেন’। ‘অটোবায়োগ্রাফি’ বইটি তিনি উৎসর্গ করলেন ‘টু দ্য মেমারি অব দ্য ব্রিটিশ/ এমপায়ার ইন ইন্ডিয়া,/ হুইচ কনফার্‌ড সাবজেক্টহুড/ আপঅন আস/ বাট উইথহেল্ড সিটিজ়েনশিপ।’ ‘অটোবায়োগ্রাফি’-র এই উৎসর্গ ক্রুদ্ধ করল কতিপয় ভারতীয় তথা বাঙালিকে। যারা বরাবরই নীরদ সি-র ভাব-ভাবনা অপছন্দ করে আসছেন। তাঁকে এর জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের শেষ সমর্থক, ব্রিটিশভক্ত দালাল ইত্যাদি বাণ ছুড়তে কসুর করেননি তারা। তারা খেয়াল করল না ভারতীয়রা ইংরেজদের কাছ থেকে ‘সাবজেক্টহুড’ পেলেও ‘সিটিজ়েনশিপ’থেকে বঞ্চিত বলে নীরদচন্দ্র কী ভাবে ইংরেজদের শ্লেষবিদ্ধ করলেন। অটোবায়োগ্রাফির জন্য নীরদ সি-র বিলেত ভ্রমণের আমন্ত্রণ এল ব্রিটিশ দূতাবাসের মাধ্যমে। মাত্র ছ’সপ্তাহের জন্য। সেই প্রথমবার, তাঁর স্বপ্নের ‘স্বদেশযাত্রা’। তাঁর বিলেত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখলেন ‘আ প্যাসেজ টু ইংল্যান্ড’। তখন তাঁর বয়স ৬০ বছর। রবীন্দ্রনাথের ‘নোবেল’ প্রাপ্তিতে কতিপয় খ্যাতনামা ইংরেজ তাঁর যোগ্যতা ও স্বচ্ছতা বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। রুষ্ট নীরদচন্দ্র ইংরেজদের বুদ্ধিভ্রম সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হন। এক সময়ের সভ্যতার ধারক বাহক আর্যদের উত্তরপুরুষ ব্রিটিশদের যে বৌদ্ধিক অবনমন ঘটেছে, সে কথা তাঁর ‘দ্য কন্টিনেন্ট অফ সার্স’ গ্রন্থে বিধৃত আছে।

নির্মোহভাবে নীরদ সি’কে অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, তিনি উনবিংশ শতকের চিন্তাবিদদের তুলনায় স্বতন্ত্র এমন কী তাকে অনন্যও বলা যায়। আঠারো শতকের ইউরোপীয় দার্শনিকদের মতো মহা-দর্শন সন্ধানী, তার জ্ঞান অনুসন্ধানের পন্থা হলো, যুক্তি, নিজস্ব ভাবনা ও অন্তর্দৃষ্টি। তার চিন্তা ধারা ও রচনা আমাদের আঠারো শতকের সংঘটিত ও প্রাজ্ঞ সমালোচক ড. জনসনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নীরদ চন্দ্রের পড়াশোনা ছিলো সীমাহীন ও ব্যক্তিত্বের ধরন ছিলো স্বতন্ত্র। সেই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাঙালিসুলভ আবেগ, একগুঁয়েমি ও পান্ডিত্য গৌরব, যা তাকে এক অনন্য পরিচিতি দিতে সক্ষম হয়েছে। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখনী সম্পর্কে সজনীকান্ত দাস যাহা লিখিয়াছেন তাহা প্রণিধানযোগ্য: 'নীরদচন্দ্র চৌধুরী বিচিত্র মানুষ। বেঁটে খাটো মানুষটি অথচ বিদ্যার জাহাজ। সাত সমুদ্র তেরো নদীর খবর তাহার নখাগ্রে ছিল, ফরাসী সাহিত্যের তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ভক্ত এবং সারা পৃথিবীর সামরিক বিদ্যার তিনি ছিলেন মনোয়ারী জাহাজ। তাহার ভালো-লাগা এবং মন্দ-লাগা গুরু মোহিতলালের মতই অতি স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট ছিল; একটু খামখেয়ালি প্রকৃতির ছিলেন, বিপুল সমারোহে কাজ আরম্ভ করিয়া শেষ করিতে জানিতেন না, গাছে উঠিয়া নিজেই মই ফেলিয়া দিতেন।' কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার বনগ্রাম থেকে অক্সফোর্ড নগরীর ২০ ল্যাদবেরি রোডের তিনতলা বাড়িতে পৌঁছুনোর যাত্রা পথ সহজ ছিলোনা। এই যাত্রা পথে তিনি যতনা কুসুম কুড়িয়েছেন, কন্টক কুড়িয়েছেন অনেক বেশি। তিনি অধিকাংশ বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির অপছন্দের তালিকার মানুষ। নীরদ সিকে বাঙালি পাঠকেরা প্রথমে অবজ্ঞা করেন এবং এরপর সযত্নে তাকে এড়িয়ে চলেন। তার সম্পর্কে বাঙালির প্রবল অবজ্ঞার কারন হলো বাংলা ছেড়ে তিনি দীর্ঘদিন দিল্লি এবং পরে রানীর দেশে থিতু হয়েছেন সুতরাং এই ঔপনিবেশিক শক্তির সহযোগীর সাথে আমাদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে। এছাড়া বিদ্যার বহর জ্ঞানের চাকচিক্য দেখাতে তার কোন কার্পন্য ছিলো না। রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের ভাষায়, ‘বিদ্যার বহর দেখাইতে তাহার বড় আনন্দ।’ উপরন্তু তিনি বাঙালিকে ‘আত্মঘাতী’ মনে করেন, পূর্বতন ঔপনিবেশিক প্রভুর দেশে বসে তিনি বাঙালিকে ভর্ৎসনা করেন। অথচ দেখো কলকাতাতে নীরদ চন্দ্র চৌধুরী, লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সঙ্গে একই মেসের বাসিন্দা ছিলেন। ভাবতে কেমন অবাক লাগে, তিনটি মানুষ তিন ভূবনের বাসিন্দা।

নীরদ সি চৌধুরী নিজেকে যতই সাম্রাজ্যবাদী বলুন আদতে তিনি সত্যিকারের একজন বাঙালি তার জীবনাচরণ, প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অগাধ জ্ঞান এবং লেখালেখিতে ইউরোপিয়ান এবং ভারতীয় জ্ঞানের প্রতিফলন কূয়াশাচ্ছন্ন করে তোলে তার সমালোচকদের, তার স্বরূপ খোঁজে পাওয়া অনেক কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কখনো কখনো মনে হয় বাঙালিদের মধ্যে তিনিই বোধ হয় সব চেয়ে বড় আত্মঘাতী। আমার মনে হয় উনার কোনো কোনো লেখায় ব্যক্তি ও সমষ্টি আহত হয়েছেন। যুক্তিকে আমলে না নিয়ে, প্রেক্ষাপট ও পরিপ্রেক্ষিত না বুঝে দাঁড় করা হয়েছে বৈরী ব্যাখ্যা। কিন্তু সত্যিই সদর্থক অর্থে যদি বিশ্লেষণ করা হয় উনার লেখালেখি ও গবেষণা, তাহলে মতদ্বৈততা হয়তো দেখা দিতে পার, কিন্তু উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এখানেই নীরদবাবুর স্বার্থকতা। । দীর্ঘ জীবনের লেখালেখিতে তিনি আমাদের জন্য এমন সত্য উন্মোচন করেছেন। আবিস্কার করেছেন অনির্ণেয় এমনসব সম্পদ যা এ জাতিকে ধন্য ও গৌরবান্বিত হওয়ার পাথেয় যুগিয়েছে। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জাতিগত ভিত্তি ও শক্তি-সাহস এবং সৌন্দর্য নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছেন, যার জন্য এ জাতি ঋণ স্বীকার ও কৃতজ্ঞতা জানাতেই পারে। ৯৭ বছর বয়সে তুখোড় স্মৃতি নিয়ে লিখলেন ‘থ্রি হর্সমেন অব দ্য নিউ অ্যাপোক্যালিপ্স’ নামক বহুদর্শীর আলেখ্য। বাঙালির নৈতিক অবক্ষয় আর রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচারের যে চিত্র সেখানে অঙ্কিত, তা আজকের প্রেক্ষাপটেরই যেন নির্ভুল পূর্বানুমান। মননে একজন খাঁটি বাঙালি না হলে এইভাবে পূর্বানুমান করা কি সম্ভব? এই প্রশ্ন বারবার আমাকে ভাবায়। নির্মোহভাবে নীরদ সি’কে অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, তিনি উনবিংশ শতকের চিন্তাবিদদের তুলনায় স্বতন্ত্র এমন কী তাকে অনন্যও বলা যায়। আঠারো শতকের ইউরোপীয় দার্শনিকদের মতো মহা-দর্শন সন্ধানী, তার জ্ঞান অনুসন্ধানের পন্থা হলো, যুক্তি, নিজস্ব ভাবনা ও অন্তর্দৃষ্টি। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখার বড়গুণ হলো তাতে বহুকৌণিক দৃষ্টি রাখার সুযোগ থাকে অবারিত। রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-নৃতত্ত্ব-ভূগোল ও জাতীয়তার আলোচনায় উনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সিদ্ধান্ত ও ভবিষ্যদ্বাণীসমূহে কতটা নির্মোহ সত্য জারি রয়েছে, সেসব বিচারে ও পর্যবেক্ষণে বাঙালি নীরদচন্দ্র এবং সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজী লেখক নীরদ সি-র মধ্যে অনুরূপ এক বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা হয়ে এসেছে। নীরদবাবু সেটা মানেননি, কিন্তু তর্কটাকে ক্রমাগত উস্কে গেছেন। শেষ দিকে অঢেল সমালোচনাও করেছেন ব্রিটিশদের। তাতে হয়তো ওঁদের কাছে আরও প্রাসঙ্গিক হয়েছেন। কিন্তু এ দেশে? যুক্তি, প্রশ্রয় ও ভালবাসা দিয়ে পড়লে নীরদচন্দ্র ও নীরদ সি কিন্তু অবলীলায় এক হয়ে যেতে পারেন আমাদের ভাবনাচিন্তায়। মনে রাখা জরুরি নীরদ সি চৌধুরীকে নিয়ে গভীর পাঠের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি যদি সবচেয়ে বেশি সমালোচনার বিষয় হন তাকে নিয়ে আলোচনার দরকার তার চেয়ে বেশি। পাঠককে শুধু সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানো নয়, খোঁচা মেরে মাঝে মাঝে রক্তাক্ত করাও যদি লেখকের কাজ হয় নীরদ সি চৌধুরী সে তালিকায় উপরের দিকেই থাকবেন। তার খোঁচায় আমরা রক্তাক্ত হই, কষ্ট পাই-কিন্তু খোঁচার প্রয়োজনীয়তা কি অস্বীকার করতে পারি? লেখাটার শেষ টানছিনা। শেষ টানা সবসময়ের কাজ নয়। শুরু করাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তারপর তাকে টেনে নেয়াও বড় কাজ। আমি বিশ্বাস করি নীরদ সি চৌধুরীকে ভবিষ্যৎ হয়ত আরো ভালো করে অনুসন্ধান করে আবিষ্কার করবে। কারণ নীরদ সি চৌধুরীকে শত্রু মনে করে এমন লোকের সংখ্যাই বাঙালি পাঠকে বেশি। আর বন্ধুর চেয়ে শত্রুকে গভীর অধ্যয়ন করা কত গুরুত্বপূর্ণ এটা বাঙালী এখন না বুঝলেও ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ঠিকই বুঝে নিবে। যদিও লেখক নীরদ সি চৌধুরী মনে করেন তাকে এক বিদেশী ভদ্রলোক ভালো ধরতে পেরেছেন। ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’ তে বাঙালি পণ্ডিতেরা যে তাকে কম ধরতে পেরেছে এর উল্লেখ করে বলেন: “কিন্তু একজন বিদেশী পণ্ডিত আমার ব্যক্তিত্বের আসল রূপ চিনিতে পারিয়াছেন। তিনি শিকাগো ও কেমব্রিজের অধ্যাপক এডোয়ার্ড শিলস্। তিনি ত্রিশ বছরেরও বেশি কাল ধরিয়া আমাকে জানেন। কিছুদিন আগে তিনি ‘আমেরিকান স্কলার’ বলিয়া যে একটি পত্রিকা আছে তাহাতে আমার সম্বন্ধে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত করিয়াছেন। উহার এক জায়গায় তিনি লিখিয়াছেন,- “Mr Chaudhuri’s being an Indian and a Bengali, and a European and Englishman, all at the same time is unique. He is perhaps the only one of his kind and there is no established name for the likes of him. Perhaps the old designation of “citizen of the world’ is the only one available…Mr. Chaudhury is the real thing.

একটা কথা মনে রাখতে হবে বন্ধুকে ঠিকমত অধ্যায়ন না করলে সমস্যা নাও হতে পারে। কারণ তার থেকে কোন উপকার না পেলেও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তুকে শত্রুকে যতি ঠিকমত আবিষ্কার না করি তাহলে ব্যক্তি শুধু ভোগবেনা, ভুগবে সমাজ, দেশ ও জাতি! নীরদ সি চৌধুরী এমন এক ব্যক্তি যার কথায় কানে তুলা দিয়ে থাকা যাবেনা। কারণ কানে তুলা দিলেই তো ঝড় থেমে যায়না। নীরদ সি চৌধুরী একটি ঝড়ের নাম এবং তাকে খুবই মনোযোগ ও যত্ন সহকারে অধ্যয়ন করতে হবে! নীরদ সি চৌধুরী ভবিষ্যতের আলোচ্য বস্তু হওয়া উচিত। তোমার কি মনে হয়?

ইতি-

বাসু

১ জুন,২০২৫

পুনশ্চ: নীরদ সি চৌধুরীর ভাষায় ‘বাঙালী জীবনে নূতন ভালবাসার প্রবর্তনকর্তা বঙ্কিমচন্দ্র’। রবীন্দ্রনাথের হাতে এ বিশেষ প্রেমের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশিত হয়। এঁদের এই বইপত্র পড়েই নব্য কালো-ইংরেজ শ্রেণি নতুন সাদা প্রেম শিখেছে। আয়ত্ত করেছে প্রেমের ভাষা-সম্ভাষণ; দুই তরফা (নর–নারী) প্রেমের ব্যাকরণ।

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















১২

-‘আপনি দেখবেন… ‘ চার্লস বকবক করে যায়… ‘আমার বন্ধু আপনি। একবার জেরাল্ডকে দেখলেই বুঝবেন… ওঁকে দেখে, ওঁর সঙ্গে পরিচিত হলে বুঝতে পারবেন যে সবাই কেন ওঁর উপরে এত ভরসা করে! রবার্ট কিম্বা অন্য কারো উপরে কেউ এতটা ভরসা করে না। জেরাল্ড অবশ্য সেই অর্থে আমাদের বন্ধুবৃত্তের ভেতরের কেউ নন; বাইরের… কিন্তু বেশ অদ্ভুত! অবশ্য রবার্ট সম্বন্ধেও আমি সেই একই কথা বলেছি আপনাকে, তাই না? ফলে আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না যে অদ্ভুত বলতে আমি ঠিক কী বোঝাতে চাইছি। আসলে আমি খুব তাড়াতাড়ি পুরো বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করছি। রবার্ট এমনিতে বিশাল কেউকেটা নয়। তবে ও জেরাল্ডের বন্ধু এবং সেটাই একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। জেরাল্ড সন্ধেবেলা প্রায়ই রবার্টের কাছে আসেন এবং আমরাও সেই কারণে রবার্টের কাছে যাই। রবার্ট এমনিতে খুব দিলদরিয়া; তাছাড়া আমাদের সবার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করে। কিন্তু তাঁর কিছু দুর্বলতা আছে, ফলে সে খুব কষ্টভোগ করে। যেমন, উদাহরণ হিসেবে বলা চলে যে মিকার সঙ্গে ওঁর প্রেমের সম্পর্ক আছে। ওই যে মিচকে রোমানিয়ান মেয়েটার কথা বলছিলাম না? মেয়েটা এমনিতে বাইরে বেশ নরমশরম, মিষ্টি… কিন্তু ভেতরে ভেতরে একদম ভিজে বেড়াল। অবশ্য সেটা তত জরুরি কথা নয়। কারণ আমরা সবাই মেয়েটার স্বরূপ জানি এবং আমরা কেউই সেভাবে মেয়েটাকে বিশ্বাস করি না। কিন্তু জেরাল্ডের কথা একবার চিন্তা করে দেখুন। বুঝে দেখুন যে ওই মিকার আবার জেরাল্ডের উপরে বেশ ভাল প্রভাব আছে। জেরাল্ডের সঙ্গে যদি একবার আপনার পরিচয় হয়, তো বুঝতে পারবেন যে জেরাল্ড একদম অদ্ভুত মানুষ! তিনি একটাও মিথ্যে বলেন না, ফালতু কথা বলেন না এবং ওঁর মতামত একদম অব্যর্থ সত্য বলে প্রমাণিত হয়। মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যে এক আধজন মেয়ে কিম্বা ছেলেকে পছন্দ করে চিহ্নিত করেন তিনি। প্রথমে অনেকেরই মনে হয় যে ওঁর পছন্দ বা মতামত হয়তো ভ্রান্ত। কিন্তু শেষ অবধি দেখা যায় যে সেই মতামত ভুল নয়। যাদের জেরাল্ড পছন্দ করেন, তারা সত্যি সত্যি বিশেষ প্রতিভার অধিকারী কিম্বা অধিকারিণী। ফলে আপনি বুঝতেই পারছেন যে ওঁর মতামতের গুরুত্ব আমাদের কাছে অপরিসীম এবং সেই কারণেই সবাই ওঁর উপরে ভরসা করে থাকে।’

-‘তিনি কি আপনাকে পছন্দ করেন?’

-‘আমি ভেবেছিলাম সেরকমই কিছু একটা হবে।’… চার্লস মরিয়া ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকায়… ‘কিন্তু আমি মূর্খ… আমি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে উনি আমায় পছন্দ করেন। আমি ওঁর বাড়িতে যাবার কথা ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম যে ওঁকে জিজ্ঞেস করব যে আমার জন্য কোন পেশা ভাল হবে, ভবিষ্যতে কী করা যায়। কারণ সম্প্রতি সব জায়গা থেকে আমায় বিফল হয়ে ফিরতে হচ্ছে। এদিকে আমার তো পয়সার দরকার। সত্যি দরকার। আমি লেখালেখির কাজ ছাড়াও এদিক ওদিক নানা কাজের জন্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সব জায়গা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এদিকে আবার আমার শরীরটাও সুবিধের নয়। দেখুন, আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন। লোকে বলে যে আমার নাকি যক্ষ্মা হয়েছে, আমার নাকি স্যানাটরিয়ামে ঠাঁই হয়েছে। সন্দেহ আছে এ বছর আমি পরীক্ষায় পাশ করব কি না! শিক্ষকেরা কেউ আমার প্রতি সদয় নন। তাঁরা মনে করেন যে আমি খুব খারাপ এবং বিপজ্জনক মানুষ। আমি আর পারছি না… হাঁপিয়ে উঠেছি। সেইজন্য আমি জেরাল্ডের কাছে যাবার কথা ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম তাঁর উপদেশ নেব। হতে পারে এখন আবার হয়তো মিকা বসে রয়েছে তাঁর কাছে, যেভাবে গতকাল সে তাঁর হাঁটুর উপর বসেছিল!’

-‘হাঁটুর উপরে?’

-‘হ্যাঁ, হাঁটুর উপরে বসেছিল ওই বদ নেকুপুষু মেয়েমানুষটা! আমি অসুস্থ বোধ করছিলাম। তার উপর ওই বারের গায়িকা মেয়েদুটো আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল। আমার ভাল লাগেনি। অস্বস্তি হচ্ছিল। তবে চুপ করে থাকার বদলে আমি এক দুটো কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম ওদের। হয়তো খুবই কটু কথা বলেছিলাম। আসলে অপমানজনক কথা, নাকি কটু কথা… সেটাও এখন ঠিক মনে নেই। তারপর আরও অসুস্থ বোধ করছিলাম আমি। দৌড়ে বাইরে চলে গিয়েছিলাম। কেঁদেছিলাম। ফিরে ভেতরে গিয়ে দেখি মিকা তখনো জেরাল্ডের হাঁটুর উপরে বসে আছে। উনি ওকে এমন ভাবে ধরে আছেন যেন কচি খুকি। কিন্তু মিকার বয়স ষোল। তারপর খুব শীতলভাবে উনি আমায় বললেন, ‘চার্লস, আপনার নেশা হয়ে গিয়েছে!’ ব্যস, আর কিচ্ছু না। তারপর মিকা বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল আর ওঁর কানে কানে কিছু বলতে শুরু করল। নিঃসন্দেহে আমার নামেই কিছু বলছিল… আর সেগুলো নির্ঘাত খুব খারাপ কথা; কারণ উনি মিকাকে চুপ করতে বললেন। কিন্তু রবার্টকে? আমার শরীর খারাপ করছিল বলে রবার্ট একটা চায়ের পট নিয়ে এসে আমায় এক কাপ চা দিচ্ছিল। উনি তাকেও একই রকম শীতল কণ্ঠস্বরে বললেন, ‘তুমি বরঞ্চ চার্লসকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও! এখানে বসে ওঁর কাজটা কী? উনি এখনও ছাত্র… তাছাড়া উনি খারাপ ব্যবহার করছেন।’ শুনে সবাই চুপচাপ হয়ে গেল, আর আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন আমি একেবারে উচ্ছন্নে গিয়েছি। আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম যে জেরাল্ডের মতামতের উপরে সবাই অনেকখানি গুরুত্ব দেয়। তিনি আবার বললেন, ‘আপনি বাড়ি চলে যান, চার্লস!’ আমি চলে এলাম; অবশ্য তাছাড়া আর কী বা আমি করতে পারতাম?’

বিষণ্ণ এবং বিরক্ত চার্লস একদৃষ্টে তাঁর বড় হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। বের্নহার্ড বেশ বিচলিত বোধ করছে; সে অন্যরকম কিছু ভেবেছিল। সে ভেবেছিল যে হয়তো সাঙ্ঘাতিক নাটকীয় কোনও ঘটনা ঘটেছে। সে ভেবেছিল যে চার্লস খুব অসম্মানজনক, বিশ্রী কিম্বা অসাধু কোনও অপকর্ম করেছে হয়তো বা; এরকম ভেবে সে একটু ভীত ছিল, কারণ সে এইধরনের ঘটনা শুনতে চায় না। কিন্তু এখন চার্লসের বিষণ্ণতা তাকে স্পর্শ করছে এবং সে বিচলিত বোধ করছে। সে বেশ বুঝতে পারছে যে চার্লস কতখানি অপমানিত বোধ করেছে জেরাল্ডের ব্যবহারে। ‘বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া’র ব্যাপারটা যথেষ্ট অপমানজনক পরাভবের পর্যায়ে পড়ে। সাঙ্ঘাতিক নাটকীয় কোনও ঘটনা শুনবে বলে সে নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করছিল; কিন্তু সেসব নাটকীয় ঘটনার তুলনায় এই ব্যাপারটা কম অসহনীয় নয়।

-‘আমি দুঃখিত!’ বের্নহার্ড বলে… ‘আপনার সঙ্গে যেটা ঘটেছে সেটা মোটেই ভাল হয়নি। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে জেরাল্ড যা বলেছেন, সেটা আপনাকে অপমান করবার জন্য নয় এবং সেরকম কিছু গুরুগম্ভীর অর্থ নেই সেই কথার।’

-‘তিনি যে কথা বলেন, অর্থ বুঝেই বলেন। না বুঝে কিছু বলেন না।’

-‘সেক্ষেত্রে আমার মতে সবচেয়ে ভাল হবে আলাদাভাবে জেরাল্ডের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া। অবশ্যই যখন তিনি একা থাকবেন, তখন কথা বলতে হবে। রবার্টের সামনে নয়, কিম্বা ওই গায়িকাদের সামনেও নয়, কারণ তারা আপনাকে বিরক্ত করবে এবং মিকার সামনেও নয়, কারণ সে আবার হাসাহাসি শুরু করবে।’

-‘তাহলে আমায় জেরাল্ডের বাড়িতে যেতে হবে। কিন্তু সেখানে যাবার সাহস আমার নেই।’

-‘আপনি যদি চান, তাহলে আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারি।’

-‘আপনি যাবেন?’ চার্লস অবাক হয়েছে বোঝা যায়। সন্দিগ্ধচোখে তাকায় সে বের্নহার্ডের দিকে। টেবিলের উপর থেকে হাতদুটো সরিয়ে নেয়। তারপর হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে বের্নহার্ডের কাছে গিয়ে… ‘আমি জানতাম যে আপনি আমায় সাহায্য করবেন।’ তার চোখে শিশুর সারল্য… ‘আমি বিশ্বাস করি আপনাকে… আপনি একজন ভাল মানুষ।’




(চলবে)
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২১.২

“আপনি খামোখা এত সংকোচ করছেন”, বৈদ্যজী এবার মুখ খুললেন, “যে আফিমের চোরাকারবার করে
তাকে কখনও ক্ষমা করতে নেই। এরা দুরাচারী, এরা দেশদ্রোহী”।

দারোগাজী চুপ। মনে মনে ভেবে রেখেছেন, ‘জিন’ এর গুষ্টির তুষ্টি। আর কখনও বেফাঁস কিছু বলি!
বৈদ্যজী আচমকা প্রশ্ন করলেন, “জোগনাথের ঘর থেকে একটা দেশি পিস্তলও পাওয়া যায় নি, এটা
কীরকম খানাতল্লাসি”?
“ওই যা ভাবেন”, দারোগাজীর নম্র কণ্ঠস্বর। “এখন এত দেশি কাট্টা আর ক’টা আছে যে প্রত্যেক
খানাতল্লাসিতে একটা না একটা ধরা পড়বে”! উনি এবার মনে মনে হাসছেন, সত্যি! জিনের তুলনা নেই।
অভিনয় করতে গেলেও কাজ দেয়।
রূপ্পনবাবু এতক্ষণ খবরের কাগজে মুখ ঢেকে বসেছিলেন। ওই অবস্থাতেই বললেন,” কোথায় গেল সব
দেশি পিস্তল? আপনার মালখানার স্টক শেষ”?
দারোগাজী গম্ভীর। “শুনুন, সেবার বৈদ্যজী থানায় এসে যা লেকচার ঝেড়ে গেছলেন—এসব তারই ফল।
শোনার পর যত রাজ্যের বদমাশ তাদের সব কাট্টা এলাকার বাইরে ফেলে দিয়েছে। বেশিরভাগ উন্নাও
জেলার গ্যাং এর কাছে বেচে দিয়েছে”।
বদ্রী পালোয়ান উন্নাও গেছে। এখনও ফেরে নি। বৈদ্যজী চোখ কুঁচকে কিছু ভাবলেন, তারপর ফিক করে
হেসে বললেন, “শিবপালগঞ্জের জলবায়ু বড় উৎকৃষ্ট, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের অনুকুল”।
-“ আমার কাছে আপনিই শিবপালগঞ্জের জলবায়ু”।
দারোগাজী এটা বলার পর আর মনে মনে জিনকে দোষ দিলেন না, বরং প্রাণখুলে হেসে ঊঠলেন। সেই যে
হাসি শুরু হল, আর থামে না। দারোগাজী টের পান নি যে ‘জিন’ শুধু জিভ নয় গলাতেও ভর করে। বৈদ্যজী
দারোগাজীর কথাটা গায়ে মাখলেন না। দারোগাজী উঠে পড়লেন, যেতে হবে। উনি চৌকাঠের বাইরে পা
ফেলতে যাচ্ছিলেন, বৈদ্যজী কোন ভুলে যাওয়া কথা মনে পড়ার ঢঙে বললেন,”জোগনাথের জামিন
বোধহয় আমার নামে লিখেছেন”?
দারোগা এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। “অমন হলে তো আপনার দস্তখত করিয়ে নিতাম। চিন্তা
করবেন না, আদালতে জামিন হয়ে যাবে। কাউকে ওখানে পাঠিয়ে দেবেন”।
বৈদ্যজী চুপ, রূপ্পনের সোজা প্রশ্ন,” কেন, এখানে জামিন করাতে কিসের অসুবিধে”?
“চুরির কেস, এতে থানায় জামিন হয় না।
“আর খুনের কেস হলে”?
দারোগাজী হালকা মেজাজে জবাব দিলেন, “আপনি বোধহয় গতবছরের নেবাদা এলাকার কেসের কথা
বলছেন। কিন্তু সেই কেসে অপরাধী টি বি তে ভুগছিল। ওকে থানায় আটকে রেখে কে আরেকটা মৃত্যূর
কারণ হত”?
রূপ্পনবাবু আগেই খবরের কাগজ ফেলে উঠে পড়েছিলেন। “শুনুন, জোগনাথ তো এখন আপনার জিম্মায়।
ওর জেরা টেরা এখানেই সেরে জামিন দিয়ে দিন। ও অসুস্থ; তবে যক্ষ্মা নয়, গনোরিয়া”।
বৈদ্যজী ঠান্ডা আওয়াজে বললেন, “রূপ্পন, ভদ্রভাবে কথা বল। দারোগাজী আমাদের আত্মীয়, যা
করবেন ভেবেচিন্তেই করবেন”।
দারোগাজী ফের বললেন, “তাহলে এবার যাই? আজ্ঞা দিন”।

রূপ্পন, “হ্যাঁ, যান! যান!! থানায় রামাধীন আপনার জন্যে হাপিত্যেশ বসে আছে”।
দারোগাজী মুচকি হাসলেন। ফের আমলাদের সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনার ঘটনার উল্লেখ করে বললেন,” কী
বলব রূপ্পন বাবু, এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। নইলে অনেক বড় বড় লোক হাপিত্যেশ করে বসে থাকত”।
দারোগা চলে যাবার পর রূপ্পন নিজের মনে বললেন—যাকে আটার তাল ভেবেছিলাম, ও যে দেখছি
মুস্কিপাতি জর্দা!
তারপর বৈদ্যজীকে বললেন—বড্ড অপমান করে গেল!
বৈদ্যজীর চেহারায় বেশ শান্ত সমাহিত ভাব। ফের রঙ্গনাথকে উঠে বাইরে যেতে দেখে শাস্ত্র
আলোচনার ঢঙে বললেন,”লাভালাভ, জয়-পরাজয়, মান-অপমান—এসব সমবুদ্ধির দৃষ্টিতে দেখা উচিত”।
আরে পিতাজী এখন গীতা আওড়াচ্ছেন! রূপ্পনবাবু বুঝলেন –তাহলে এই দারোগা ব্যাটার রেহাই নেই।

বাবু রামাধীন ভীখমখেড়বীর ঘরে আজ ভাঙ ঘোটা হচ্ছে, সামনের একটা চালের নীচে জুয়োর আড্ডা
জমজমাট।দুটোতেই নিস্পৃহ রামাধীন চাতালের উপর একটা চারপাইয়ে শুয়ে লঙ্গড় বা ল্যাঙ্গড়ার কথা
শুনছিলেন। লঙ্গড় চাতালের নীচে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
রঙ্গনাথ আর শনিচর ওদিক দিয়েই যাচ্ছিল। বাবু রামাধীন ওদের হাঁক পেড়ে ডেকে নিলেন। নিজে
খাটিয়ার এক কোণে সরে গিয়ে ওদের মাথার দিকে বসতে দিলেন। শনিচরকে উনি বিশেষ পাত্তা দিলেন
না, শুধু ‘দাঁড়িয়ে কেন প্রধানজী, বসে পড়’ বলে কর্তব্য সারলেন।
রঙ্গনাথের জন্য এটা দ্বিতীয় সুযোগ। প্রথমবার যখন রামাধীনের ঘর পেরিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন
এখানে কোন ভাঙ বা জুয়োর আসর চোখে পড়েনি। আজ এখানকার পরিবেশ ভারি আনন্দময়। রঙ্গনাথ
লঙ্গরের দিকে ইশারা করে বলল—এর কী খবরটবর?
“বাহাদুর বটে! ধরে নাও ও বলদের দুধ দুইয়ে এসেছে”।
রামাধীন হস্তমুদ্রায় বুঝিয়ে দিলেন বলদের দুধ দোয়ার চেষ্টায় হাত ঠিক কোনখানে যায়।
রঙ্গনাথ বেশ চ্যালেঞ্জের আওয়াজে বলল—হয়েছেটা কী? মহকুমা অফিস ত্থেকে নকল পাওয়া
গেছে”?
লঙ্গর বৈষ্ণব মহাপুরুষদের নিরীহ ভঙ্গিতে উত্তর দিল,”হাঁ বাপু, ধরে নাও পেয়ে গেছি। আমার
দরখাস্ত মহকুমা সদর থেকে ফেরত এসেছে। এমনিতে সদরে জমা দেয়া বেশিরভাগ দরখাস্ত হারিয়
যায়, আমারটা হারায় নি। এসব তো আপনাদের পদধূলির মহিমা”।
শনিচর বুদ্ধিমানের মত বলল, “বহুত আচ্ছা, লঙ্গর। দরখাস্ত যখন ফেরত এসেছে, তখন নকল পেতে
দেরি নেই”।
“আরে কবে আসবে”? রঙ্গনাথ কিঞ্চিৎ অধৈর্য।
লঙ্গড়ের এইসব ছটফটানি পছন্দ হল না। রঙ্গনাথকে আশ্বস্ত করে বলল, “নকল-বাবু বলেছেন
তোমার নম্বর এল বলে”!

রামাধীন বললেন,”যাও লঙ্গড়, ওদিকে গিয়ে কিছু ঠাণ্ডাই-টান্ডাই (ভাঙ) খেয়ে নাও”। তারপর উনি
খানিকটা উদাসীন ভাব দেখিয়ে রঙ্গনাথকে প্রশ্ন করলে, “শুনলাম আজ জোগনাথ গ্রেফতার হয়েছে”!
রঙ্গনাথ এই প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল। পালটা প্রশ্ন করল, “ জোগনাথ আবার কে”?
রামাধীন অবাক হয়ে খানিকক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর শনিচরকে
বললেন,“প্রধানজী, একে বলে দাও জোগনাথ কে”।
শনিচর বলল,”বাবুসাহেব, তুমি আমাকে এখন থেকেই প্রধান ট্রধান নাই বললে! যেদিন তোমার
মহামূল্য ভোট মঙ্গলদাস পিতা দুলারেলালকে দেবে সেদিন আমি পঞ্চায়েত প্রধান হব। এখন থেকে
টিকির-টিকির করা বেকার। কিগো বাবু রংগনাথ, ঠিক বলেছি”?
ভাঙের গেলাস রঙ্গনাথকে ধরে দেয়া হয়েছে। রঙ্গনাথ মাথা নেড়ে বলল,”আমি তো এসব খাই না”।
রামাধীনের এমন অপমান! এর অন্তিম পরিণাম তো হলদিঘাটির সংগ্রাম। উনি গরগরিয়ে উঠলেন, “তুমি
কেন ভাঙ ছোঁবে ভায়া! এসব তো দুষ্টুলোকেরা খায়”।
রামাধীনের সামনে এক ব্যাটা ‘গঞ্জহা’ (শিবপালগঞ্জের নিবাসীদের চালু নাম) বসে ছিল। রঙ্গনাথ ওর
চেয়ে সাফ-সুতরো পরিচ্ছন্ন। তাই ওর চোখে রঙ্গনাথ হল স্বাভাবিক শত্তুর। ও বলে উঠল, “ইনি তো
শহুরে, তাই ভাঙ খাবেন না। এনার জন্যে একটা বোতল বের করে দাও বাবুসাহেব”!
রামাধীন রঙ্গনাথকে নিপাট ভালমানুষের মত তাকিয়ে বললেন, “না না, ইনি বোতলটোতল খাবেন না,
বামুন ঘরের যে”! তারপর রঙ্গনাথকে আদরমেশা সুরে বললেন, “আর যদি আপনার চলে তো হুকুম
করুন, বোতল এসে যাবে”।
বামুন বলে দেয়ায় রঙ্গনাথ খানিক বেকায়দায় পড়ে গেল। কিন্তু তক্ষুণি শনিচর বিনা কোন রাখঢাক না
করে বলে দিল , “তুমি কেন বোতল আনিয়ে দেবে? এই ব্যাটা চিমিরিখিদাস আনিয়ে দিক না! বোতলের
কথাটা তো ওই তুলেছে”!
তারপর ও লোকটার দিকে ঘৃণাভরে দেখে বলল, “ছ্যাঁচোড় কোথাকার”! তারপর ও ইতরভাষায় একটা
স্থানীয় প্রবাদ বলল যার মোটামুটি মানে—ষোল শ’ শুয়োরকে নেমন্তন্ন করে এনেছে অথচ পাছায়
একফোঁটা গু নেই।
রঙ্গনাথের মনে হল এবার এখান থেকে সরে পড়া দরকার। কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
“এবার যেতে আজ্ঞা দিন রামাধনজী। হাঁটতে বেরিয়েছি, দেরি হয়ে যাচ্ছে”।
“পায়চারি তো ঘোড়ী করে, জোয়ান পুরুষকে মানায় না”। তারপর বেশ ঘনিষ্ঠ সুরে বলল, “ ফটাফট
পাঁচশো ডন বৈঠক! দেখবেন, লোহালক্কড় সব হজম”।
ওরা দু’জন চলে যাচ্ছিল। যেতে যেতে জুয়াড়িদের ঠেকে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে গেল।
খেলা চলছে দুটো আলাদা দলে। একপাশে কয়জন বসে ‘কোটপিস’ খেলছে। বাহান্ন তাসের খেলা। তাসগুলো
বড্ড পুরনো, রঙচটা আর এমন ছেঁড়াখোঁড়া যে ঘাগ খেলাড়ি বাইরে থেকেই বুঝতে পারবে এটা কোন
তাস।একটু দেখলে বোঝা যাচ্ছে যে খেলছে আটজন মিলে। চারজনের হাতে তাস, ওরা গম্ভীর এবং মাথা
বুকের উপরে ঝুঁকে রয়েছে। বাকি চারজন একেকটি খেলুড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে খেলার ধারাভাষ্য দিয়ে
চলেছে এবং যখন চুপ থাকা দরকার তখন কিছু না কিছু বলছে।

শুধু তাই নয়, এরা খেলুড়েদের জন্য খৈনি ডলা, বিড়ি ধরানো, জল নিয়ে আসা, তাস পড়ে গেলে তুলে গুছিয়ে
দেয়া গোছের সব কাজ করে দেয়। আর খেলা শেষ হলে হার-জিতের হিসেব চুকলে দেনা-পাওনার সময়
খুচরো পয়সার জোগান দেয়া, বিজয়ীর পয়সা থেকে পান নিয়ে আসা—সবকিছুর দায়িত্ব এদের উপর।
বেঁচে যাওয়া তাসগুলো গুণে হেরে যাওয়ার পক্ষ নিয়ে কোন না কোন অজুহাতে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়ার
কাজটাও এরাই সুষ্ঠুভাবে করে থাকে। সামনে বসে থাকা খেলুড়েকে কোন তাস খেলতে হবে সেটা ইশারায়
বলে দেয়া এবং সেই ইশারা ধরা পড়ে গেলে গলাবাজি করা –কোনটাই বাদ যায় না।
রঙ্গনাথের মনে হল –এই খেলাটা মহা ফালতু বাজে খেলা, সিদ্ধির নেশার মত। কিন্তু, অন্য দলের
খেলাটায় উঁকি দিতেই ওর শিবপালগঞ্জের জুয়োর ব্যাপারে ধারণাটাই পালটে গেল।
ওরা খেলছিল ‘ফ্ল্যাশ’, যা ল্যান্টার্নকে “লালটেন” বলার নিয়মে “ফল্লাস” হয়ে গেছে। এখানে ধুন্ধুমার
হচ্ছিল। একদিকে ‘ব্লাফ’ নামের অটোমেটিক অস্ত্র গণহত্যায় মগ্ন, অন্যদিকে একজন বিশুদ্ধ দেশি
পদ্ধতিতে চাল চেলে এগোচ্ছিল। আচমকা ওর আক্কেল কোথায় পালিয়ে গিয়ে ওকে হতভম্ব করে দিল।
ও আত্মসমর্পণ করে হাতে্র তাস ফেলে দিল। আর অন্য খেলুড়েটি ফড়ের থেকে একমুঠো পয়সা তুলে
নিজের উরুর নীচে চেপে রাখল।
হেরো খেলুড়েকে রঙ্গনাথ দু’দিন আগে বৈদ্যজীর ঘরে দিনপ্রতি আট আনা মজুরিতে কাজ করতে
দেখেছিল। সে এখন শান্তভাবে একটা বিড়ি ধরিয়ে পরের বাজির জন্য ফেটতে থাকা তাসের দিকে নিস্পৃহ
ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। রঙ্গনাথ মনে মনে ওর ধৈর্য এবং সাহসের তারিফ করতে লাগল।
ঋষি দত্তাত্রেয় আজ জীবিত থাকলে নিশ্চয়ই এই খেলুড়েকে নিজের পঁচিশতম গুরু বলে স্বীকার
করতেন। রঙ্গনাথের মাথা ওই হেরো নির্বিকার খেলুড়ের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হল, তবে সত্যি কথা
বলতে কি, ওর হাতের তাস দেখার ইচ্ছেটাও মাথা নীচু করার একটা কারণ।
খেলুড়েদের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। এরা ‘পেয়ার’কে বলে ‘জোড়,’ ‘ফ্ল্যাশ’কে বলে ‘লঙ্গড়ি’,
‘রান্‌’কে ‘দৌড়’, ‘রানিং ফ্ল্যাশ’কে ‘পাক্কি’, আর ‘ট্রেইল’কে ‘টিরেইল’। রঙ্গনাথ বুঝতে
পারল—ইংরেজি শব্দকে হিন্দির ছাঁচে ঢেলে সাজানোর এটাই সহজ উপায়।
স্বাধীন ভারতে দেশজুড়ে শব্দকোষ রচয়িতার এবং ওদের সমিতির জাল বিছিয়ে রয়েছে। এঁরা ইংরেজি
শব্দ নিয়ে হিন্দি এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় তার প্রতিশব্দ রচনায় ব্যস্ত। কাজটা বেশ মজার।
একদিকে কামরার ভেতর একটি নতুন ভাষা জন্ম হচ্ছে। অন্যদিকে এটা করতে অনেক সময় লাগছে।
অর্থাৎ নতুন শব্দের নিমার্ণকর্তা প্রায় পেনশন পাওয়ার যোগ্য হয়ে যাচ্ছেন।
এটা এই জন্যেও মজার যে এভাবে কৃত্রিম ভাষা তৈরি করার কোন মানে হয় না। কেবল এইটুকু বলা যায়
–নাও ভাই, যেসব শব্দাবলী শুধু ইংরেজিতে আছে সেসব এখন তোমার ভাষাতেও এসে গেছে। এখন ভাই
সেটা নেবে কি নেবে না—তাতে কারও কিছু এসে যায় না।
রঙ্গনাথ এই ফালতু সমস্যার বিষয়ে কখনও কখনও চিন্তা করত, কিন্তু কোন সমাধান চোখে পড়ে নি।
এখন বার বার শুনছে “পাক্কি”, “টিরেইল” আর “লঙ্গড়ি” শুনতে শুনতে আজ ওর মাথায় একটা আইডিয়া
এলঃ যদি চার-পাঁচ ‘গঁঞ্জহা’র এক সমিতি বানিয়ে দিল্লি পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? এরা বড় বড়
পরিভাষার শব্দের জায়গায় নিজেদের স্থানীয় ভাষার ঝুলি থেকে সেরেফ সামাজিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত কিছু
শব্দ পেশ করবে। কিছু না হলেও ট্রেইল কে টিরেইল করে দিতে কতক্ষণ?

খেলুড়েগুলো যে আত্মবিশ্বাসের জোরে জুয়ো খেলে চলেছে এবং পাছার চামড়া পর্যন্ত বেচে দিয়ে
অনেক আশায় ‘ব্লাফ’ কল করছে, তা দেখে রঙ্গনাথ ধাঁধায় পড়ে গেল। এটা স্পষ্ট যে বিদেশ থেকে
কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ডেফিসিট ফাইনান্সের ইকনমিক মডেলের ওকালতি করা বড় বড় রাজনীতি
এবং অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও এমন কলজের জোরের দেখা পাওয়া ভার।
রঙ্গনাথ ভাবলঃ এই মজুর আর রাখালের দলের জীবন দেখার পর আমি দিল্লির মসনদে বসে
স্বপ্নদেখা মানুষের উপর রাগ করা ছেড়ে দিলাম।
ও সামনে তাস হাতে বসা লোকটাকে মন দিয়ে দেখতে লাগল। লোকটা আরেকটি বিড়ি ধরিয়েছে এবং
নির্বিকার চেহারায় এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। রঙ্গনাথ আর শনিচরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে এক
নজর দেখে লোকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আর এক মজদুরকে হাতের পাঁচ আঙুল দেখিয়ে ইশারায় টাকা
চাইল। মজদূরটি মাথা নেড়ে ইশারায় বলল, --না। তখন ও উঠে সোজা বাবু রামাধীনের কাছে গেল আর
চটপট ফেরত এসে আগের জায়গায় বসে পড়ল। চেহারা তেমনই নির্বিকার। তাস তুলে আধপোড়া বিড়ি
দূরে ছুঁড়ে ফেলে একটা ঢেকুর তুলল। তারপর একটা পাঁচ টাকার নোট ফেলে বাকি টাকা না তুলে চটপট
একটা চাল দিল। উলটো দিকের এক খেলুড়ে বলল, “মনে হচ্ছে এবার হাতে কোন বড় তাস এসেছে”।
রঙ্গনাথ ঝুঁকে ওর তাস দেখল। নাঃ, আগের মতই সেরেফ ‘ব্লাফ’!
বিদেশি সাহায্য কেন, কখন এবং কেমন মুখের চেহারা বানিয়ে চাইতে হয়—তার পাঠ রঙ্গনাথের চোখের
সামনে খোলা রয়েছে!


ওরা দু’জন এবার একটা ফাঁকা মাঠে পৌঁছে গেছে। রঙ্গনাথকে একা ছেড়ে দিয়ে শনিচর একটু দূরের
একটা ছোট ডোবার দিকে যাচ্ছিল। রঙ্গনাথ ওকে জিজ্ঞেস করল,”বাকি সব তো ঠিক, কিন্তু একটা
কথা মাথায় ঢুকছে না। ছোটে পালোয়ান জোগনাথের বিরুদ্ধে পুলিসের সাক্ষী হয়েছে—এটা কি ভাল হল?
শনিচর রকেটের গতিতে ডোবার দিকে এগিয়ে চলেছে। এবার আন্ডারওয়ারের গিঁট খুলে ফেলল। এই
তাড়াহুড়োর কারণ বেশ স্পষ্ট। কিন্তু যেতে যেতে ও সাতটা শব্দে উত্তর দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল,
“দেখতে থাক রঙ্গনাথ বাবু, এসব ‘গঁঞ্জহা’দের এঁড়েপনা”।
তারপর যেন কোন বিশ্বসুন্দরী ওকে শয্যায় আহ্বান করেছে এমন আতুর হয়ে ও আন্ডারওয়ার ছুঁড়ে
ফেলে রঙ্গনাথের সামনে একেবারে ন্যাংটো হয়ে ডোবার পাড়ে ঝটপট মোরগের লড়াইয়ের খেলুড়ের
ভঙ্গিমায় উবু হয়ে বসে পড়ল।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in






সাতাশ

সমীরণ, বিপিন ও রিমি আজ ঠিক করল,উজানি হয়ে কাটোয়ার বাসায় ফিরবে ওরা।সমীরণ বলল,তুমি তো জানো বিপিন,অজয় নদের পাড়ে এই মন্দির অবস্থিত। মূল মন্দিরটিতে প্রথমে একটি বারান্দা আছে। তার ভিতরে আয়তাকার গর্ভগৃহ। এই গর্ভগৃহের মধ্যে মা মঙ্গলচণ্ডীর ছোটো কালো পাথরের দশভূজা মূর্তি রয়েছে। প্রাচীন মূর্তিটি নব্বইয়ের দশকে চুরি হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালে মল্লিক উপাধিধারী গ্রামের এক ধনী পরিবার বর্তমানের কষ্টিপাথরের দশভুজা মূর্তিটি নির্মাণ করে দেন। সেই থেকে এই কষ্টিপাথরের মূর্তিটির পূজা হচ্ছে। ২০০৬ সালে মন্দিরটি সারানো এবং বাড়ানো হয়েছে। মূল মন্দিরের সামনে একটি ছোট নাটমন্দির যোগ করা হয়েছে।

প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। উজানি সতীপীঠে দেবীর নাম মঙ্গলচন্ডী। উঁচু কালো রঙের পাথরের একটি শিবলিঙ্গ হল দেবীর ভৈরব । ভৈরবের নাম কপিলাম্বর। অনেকে কপিলেশ্বর বলেও উল্লেখ করেন। শিবলিঙ্গের সামনে নন্দীর কালো পাথরের একটি ছোট মূর্তি আছে। শুধু তাই নয়, ভৈরবের বাঁদিকে একটি বজ্রাসন বুদ্ধমূর্তিও আছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এই মূর্তিটি পাল যুগের।কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে বর্ণিত ভ্রমরার দহ, মাড়গড়া, শ্রীমন্তের ডাঙা প্রভৃতি স্থানগুলি উজানিতেই। বর্তমানে সেই স্থানগুলির হদিশ পাওয়া যায় না। কথিত আছে সপত্নীপীড়িতা খুল্লনা উজানির কাছে ছাগল চরাতেন। যে স্থানে ভাত রান্না করে মাড় গালতেন সেই স্থানটি মাড়গড়া নামে পরিচিত ছিল। চণ্ডীমঙ্গলের ধনপতি দত্ত এই ভ্রমরার দহ থেকেই ডিঙায় চেপে সিংহলে বাণিজ্যে গিয়েছিলেন। আবার তাঁর পুত্র শ্রীমন্তও মঙ্গলচণ্ডীর চরণে পুজো দিয়ে সিংহলে পিতার অনুসন্ধানে যেতে ভ্রমরার দহ থেকেই সাত খানি ডিঙা ভাসিয়েছিলেন। যে স্থানে দাঁড়িয়ে সাতখানি ডিঙা দেখেছিলেন সেই স্থানটি শ্রীমন্তর ডাঙা নামে পরিচিত ছিল। সেগুলির সন্ধান বর্তমানে না পাওয়া গেলেও উজানির সতীপীঠ-কপিলাম্বর রয়েছেন স্বমহিমায়। দেবীর মূল পুজো হয় শারদীয়া দুর্গাপুজোর সময়। পুজো চলে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত। এটি সতীপীঠ হওয়ার কারণে পুজোয় আলাদা করে মূর্তি আসে না এবং নবপত্রিকা আনা হয় না। শুধু ঘট বারি আনা হয়। বছরে তিনবার ঘট বদল হয়। প্রথম ঘট আসে বৈশাখের শেষ মঙ্গলবার এবং বাৎসরিক পুজো হয়। এরপর ঘট আসে জিতাষ্টমীর পরদিন, যাকে বোধনের ঘট বলা হয়। তারপর ঘট আসে দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন। এছাড়াও বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসের মঙ্গলবারে মঙ্গলচণ্ডীর পুজো হয়। এখানে বলিপ্রথা চালু আছে। দুর্গাপুজোর সপ্তমী এবং অষ্টমীতে চালকুমড়ো, নবমীতে চালকুমড়ো, কলা, আখ এবং ছাগ বলি হয়। মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীরা লৌকিক ও পৌরাণিক দেবদেবীর মিশ্রণ। লৌকিক দেবদেবীদের সঙ্গে কালে কালে যুক্ত থাকে পরিপুষ্ট গভীর আবেগ, ভক্তির উচ্ছ্বাস, অন্ধবিশ্বাসের ঐকান্তিকতা। শ্রীমন্ত এই স্থান থেকে সিংহলে যাত্রা করে সিদ্ধকাম হয়েছিলেন এই বিশ্বাসের ওপর ভর করেই উজানি শক্তিপীঠের প্রতি সাধারণ মানুষের ভক্তি ও বিশ্বাস আজও অমলিন।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর বাঁ হাতের কনুই পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী মঙ্গলচন্ডী এবং ভৈরব হলেন কপিলাম্বর বা কপিলেশ্বর। পূর্ব বর্ধমান জেলার গুসকরার কাছে কোগ্রামে অবস্থিত এই সতীপীঠ।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় কোগ্রামের সতীপীঠ উজানিতে মাতা সতীর বাঁ হাতের কনুই পড়েছিল।যার সাধনায় অনেক অসাধ্যকে সাধ্য হতে দেখেছেন ভারতবাসী। এদেশের প্রতিটি ঘরে রয়েছে ঈশ্বর আরাধনার বাতাবরণ। রয়েছে সেই মহাশক্তির ছায়া। বাকি ভারতের সঙ্গে তুলনা টানলে দেখা যাবে যে এই বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। এমনকী এখানে নাস্তিকতার আড়ালেও চলে দৈব সাধনা, পুজো-অর্চ্চনা, জপ-তপ। চলে তন্ত্রচর্চাও। যার সাহায্যে জীবনের অনেক কঠিন পরিস্থিতিকে সহজে সামলে নেন ভক্তরা।

এই বাংলার আরও বড় সুবিধা যে এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি শক্তিপীঠ। বেশ কয়েকটি সিদ্ধপীঠ। এই বাংলায় জন্ম নিয়েছেন একের পর এক মহাপুরুষ। এমনই এক শক্তিপীঠ হল পূর্ব বর্ধমান জেলার কোগ্রামের উজানি। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী যেখানে দেবী সতীর বাম হাতের কনুই পড়েছিল। এখানে দেবী মণ্ডলচণ্ডী। আর ভৈরব কপিলাম্বর বা কপিলেশ্বর।

রিমি বলল,এছাড়া পূর্ব বর্ধমান জেলায়,ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা মা,কেতুগ্রামের বাহুলক্ষীতলা ও অট্টহাস সতীপীঠ উল্লেখযোগ্য সতীপীঠ বলে পরিচিত। সমীরণদা আজকের রাতটা আমাদের বাসায় থাক।সমীরণ বলল,নিশ্চয়ই।

তারপর রাত হলে বিপিন সমীরণকে পাঁচলাখ টাকার চেক দিয়ে বলল,তুমি তোমার আশ্রমের উন্নতি করো।আমি ও রিমি বয়স হলে তোমার সঙ্গি হব।

সমীরণ বলল,টাকায় আমার কাজ নেই।তবু আশ্রমের সেবার কাজে লাগে ভক্তদের সাহায্য। আমার আশ্রমের প্রবেশদুয়ার তোমাদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে চিরকাল।সমীরণ সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ল অজানার টানে।
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in



















যুদ্ধমাঝে শান্তির দূত মাহমুদ দারবিশ



সুপ্রিয় বাসু,

বহুবছর পর তোমার ভাবানুবাদে সিলভিয়া প্লাথের কবিতা পড়ে দারুন লাগলো। মনে পড়ে গেলো মাহমুদ দারবিশের কবিতার কথা। ‘ফিলিস্তিন’ বর্তমান বিশ্বের এক আলোচিত ভূখণ্ডের নাম। ভূমধ্যসাগরের তীরের এই দেশের রয়েছে হাজার বছর পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্য। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষভাবে আলোচিত হবার কারণ অবশ্য এটি নয়। ফিলিস্তিন নিয়ে বাতচিতের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে থাকে তিন ধর্মের পবিত্র শহর জেরুজালেম ও সেখানকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনি। জায়নিস্টদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের নিপীড়িত হবার ঘটনা নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর সেই যে শুরু হয়েছিল তা এখনও চলমান। ফিলিস্তিনের (আরবি উচ্চারণে ফলাস্তিন) গাজায় এখন যা ঘটছে তা কেবল গণহত্যা নয়, এটা জাতিহত্যা। একটি মুক্তিপিয়াসী জাতিকে নির্মূল করতে সেখানে চলছে পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। গাজা এখন ‘বসবাসের অযোগ্য’ এক মৃত্যু-উপত্যকা। প্রতিদিনই সেখানে লাশের মিছিল বাড়ছে। এর প্রকৃতির জলপাই রঙের স্নিগ্ধ মেদুরতা প্রায়-অপসৃত, মাটি রক্তাক্ত, আকাশের নীলিমা বিধ্বস্ত। নির্বাসন ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই তাদের।

ভাষা ও সাহিত্যের সবচেয়ে বলিষ্ঠ মাধ্যম কবিতা। সুপ্রাচীনকাল থেকে কবিতাই মানুষের দ্রোহ, প্রেম, আবেগ, অনুভূতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চার অন্যতম প্রধান অবলম্বন। মন ও মননের ছান্দসিক প্রকাশের কারণে সব যুগেই কবি ও কবিতা সমাদৃত। যুগে যুগে স্থান, কাল ও সীমান্তের সীমা অতিক্রম করে কবিতা হয়ে উঠেছে মানব ও মানবতার বৈশ্বিক কণ্ঠস্বর। মাহমুদ দারবিশের কবিতা এমনই—ভালোবাসা ও বিদ্রোহ, প্রতিরোধ ও আলিঙ্গন হাত ধরাধরি করে এগোয়। বয়স যখন উনিশ, প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ আসাফির বিলা আজনিহা (‘উইংলেস বার্ড’ অথবা ‘পালকহীন পাখি’)। প্রথমদিকে তিনি ধ্রুপদী রীতিতে কবিতা লেখা শুরু করেন। কিন্তু খুব বেশিদিন এই ধ্রুপদী দুর্গের মধ্যে আটকে থাকেননি দারবিশ। সিরীয় কবি সিজার কাব্বানি এবং আলী আহমদ সাঈদ অ্যাডোনিসের নব্য কবিতা আন্দোলনের আছড়েপড়া ঢেউ তাঁর ধ্রুপদী ভাবনার নীল নির্জন দুর্গকে ভেঙে খানখান করে দেয়। স্বপ্নলোকচারী কবি চলে আসেন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে লোকানুবর্তী ও লক্ষ্যভেদী। ফিলিস্তিনের মাঠ, ক্ষেত, উপত্যকা, মাটি, অলিভ গাছের সারি প্রভৃতি দিয়ে দারবিশ নির্মাণ করতে থাকেন কবিতার পর কবিতা। ফিলিস্তিনের নিসর্গের বিমূর্ত সুর আর স্বাধীনতা, প্রেম, স্বাদেশিকতার ধারণার যোগসাজশে দারবিশ এক বিশ্বজনীন কবিতা নির্মাণের প্রয়াস পান। দারবিশের কবিতার ভাষা সহজ ও স্বচ্ছ। কিন্তু তাতে রয়েছে মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার সুদৃঢ় অঙ্গীকার। তাঁর কবিতা পড়লে এক গভীর মানবিক চেতনায় সমস্ত দেহমন আন্দোলিত হয়ে ওঠে। বিপন্ন অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়েও তিনি কখনো মানবতা ও মানবপ্রেমের মন্ত্র থেকে বিচ্যুত হননি।

মাতৃভূমি থেকে উন্মূল মাহমুদ দারবিশ আজীবন হৃদয়ের অন্তস্তলে ধারণ এবং লালন করেছেন বেদনাপীড়িত, বুলেট-বেয়নেট-বোমায় ক্ষতবিক্ষত ফিলিস্তিনকে, কবিতার শাণিত হাতিয়ার দিয়ে লড়েছেন ফিলিস্তিনি জনগণের জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীন বাসভূমির জন্য। কৈশোর থেকেই তিনি ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে থেকে লড়াই করেছেন প্রবল পরাক্রান্তের বিরুদ্ধে। আর সেই লড়াইটা করেছেন কবিতার শাণিত শব্দাবলি দিয়ে। দারবিশ প্রথম কবিতা পাঠ করেন ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে। স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি আবৃত্তি করেন : ‘তুমি চাইলেই সোনালি রোদে খেলা করতে পারো, তুমি চাইলেই হাতের নাগালে পাও আলোকিত পুতুল, কিন্তু আমার তা নেই। তোমার আছে ঘর, আমার কিছু নেই। তোমার আছে উৎসব আর উদ্যাপন, কিন্তু আমি তার দেখা পাই না। বলো, কেন আমরা একসঙ্গে খেলতে পারি না।’ ফিলিস্তিনিহীন পৃথিবীর মানচিত্রে বালক দারবিশের কবিতা যেন লাল ফিলিস্তিন হয়ে আঘাত করে ইসরায়েলিদের বুকে। কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে বারুদের গন্ধ! এমন বারুদমাখা কবিতা শুনে স্কুল কর্তৃপক্ষ ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ হয় দারবিশের ওপর, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর লোকেরা তাকে শাসিয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর কবিতাটা কতটা ক্ষুরধার, কতটা অভ্রভেদী। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই আরবি ভাষায় রচিত, তবে অনায়াসে লিখতে পারতেন হিব্রু, ইংরেজি, ফরাসিতে। ‘আরবদের সবচেয়ে উৎকর্ষশীল শিল্প’ কবিতাকে তিনি এক নতুন ভুবনের সন্ধান দেন, অধিষ্ঠিত করেন অনন্য উচ্চতায়, ফলে মাহমুদ দারবিশের কবিতা ও প্রবন্ধের দ্যুতি আরব জাহান অতিক্রম করে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক চেতনার কবিতার পাশাপাশি দারবিশ বার বার বলতেন শুদ্ধ কবিতার (Pure Poetry) কথা। কেননা তার কবিতা হলো বহুমুখী সংস্কৃতির সঙ্গে কথোপকথন। নির্দ্ধিধায় তিনি কবিতায় ব্যবহার করেন ইসলামিক, খ্রিষ্টিয় ও ইহুদি মিথ। মোহময় সংগীতময়তায় আচ্ছন্ন তাঁর কবিতা। যেখানে রয়েছে জীবনের আশ্চর্যময়তা Mistry of Life এবং মৃত্যু। কিন্তু মৃত্যু তাঁর কাছে এক অন্য রূপান্তর। জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনিই তো বলতে পারেন:- “যখনই আমি নিজেকে খুঁজি অসংখ্য মানুষের দেখা পাই যখনই তাঁদের খুঁজতে যাই তখন আমি একা নিঃসঙ্গ। তখন আমি লাখো জনতা।” (ম্যুরাল) এভাবেই তিনি আত্মপরিচয়ের অযুথ বাণী তুলে ধরেন কবিতায়। জীবনের যুযুধান সময়কে সামনে রেখে হাঁটতে থাকেন। কেননা একই সঙ্গে তিনি একা এবং অসংখ্য। (Individul Crowed) জাতিগত বিভেদের সমথনে যখন রাষ্ট্রীয় শক্তি দম্ভ প্রকাশ করে, দুই মানুষের মাঝখানে দেয়াল তুলে দেয়, তখন একজন কবিকে তা সবচেয়ে বেশি আহত করে। সাহিত্য-সমালোচকরা তাঁকে চিহ্নিত করেন আরব জাহানের সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও সম্মানীয় কবিদের একজন এবং সমকালীনদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হিসেবে। ‘কেউ কেউ মনে করেন, আরব-কবিদের মধ্যে অ্যাডোনিসের পরেই তাঁর স্থান। তবে কাব্যচিন্তা ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে অ্যাডোনিসের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য অনেক। বর্তমানে আরব কবিতায় যে আধুনিকতা দেখা দেয় তা প্রধানত এসেছে অ্যাডোনিসের হাত ধরেই। কিন্তু আরব কবিতায় যে বিপ্লবী জোশ দেখা দেয় তা এসেছে দারবিশের হাত ধরে।’ প্রিয় স্বদেশের বিপন্ন মুখ, দখলদার বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন এবং বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ, ফিলিস্তিনিদের মরণপণ লড়াই – এসবই দারবিশের কবিতার প্রধান বিষয়। রক্ত, আগুন, প্রতিবাদ, জখম, পাথর এ-ধরনের শব্দ ও চিত্রকল্প বারবার ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় শৈল্পিক প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক চিন্তা, দেশাত্মবোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মাতৃভূমির প্রতি দুর্মর ভালোবাসা, পাইন-জলপাই ঘেরা স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন তাঁকে কবি করে তোলে, যদিও তিনি বলতেন, ‘আমি এখনো কবি হয়ে উঠতে পারিনি, মনে হচ্ছে এ-পথে আসাটাই ভুল হয়েছে।’ তাঁর বেশিরভাগ কবিতাতেই ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের মর্মভেদী বেদনা এবং তাদের প্রতি কবির উদ্বেগ ও আতঙ্ক। তাঁর প্রায় সব ধ্যানজ্ঞান, স্বপ্ন-কল্পনা আবর্তিত হয়েছে আরবদের ইতিহাস-ঐতিহ্য কিংবা পিতা-পিতামহের অতীত স্মৃতি ও বেদনাকে ঘিরে। উদ্বাস্তু জীবন থেকে দেশে ফিরে তিনি অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে লিখেছেন : ‘আমি ফিলিস্তিনে। কিন্তু কোথায় আমার ফিলিস্তিন? আমি কখনো আমার বাড়িতে ফিরে যেতে পারিনি। প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমার গ্রাম বিধ্বস্ত-ভস্ম।’ জন্মভূমি হারানোর বেদনা আর নির্বাসিত জীবনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নানাভাবে মূর্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়, তাঁর প্রবন্ধে। মাতৃভূমির প্রতি প্রবল টান, স্বজন-হারানোর বেদনা-হাহাকার, দেশত্যাগজনিত ক্ষত ও রক্তক্ষরণ তাঁকে কলম ধরতে ও তাতে শাণ দিতে শিখিয়েছে। শেকড়ে ফিরে আসার প্রবল আকুতি, বুকের মধ্যে জমা দ্রোহ-দাহ, ক্ষোভ, হাহাকারই বারবার ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি হয়ে বেজেছে তাঁর কবিতায় ও সৃজনভুবনে। দারবিশের কবিসত্তা জাগ্রত হয়েছে প্রাচীন আরব কবি মু-আল্লাকারের কবিতার স্বপ্নছোঁয়ায়, পিতামহ হুসাইন দারবিশের কাব্যপ্রীতিও তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তবে তাঁর কবি হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে নিজ মাতৃভূমির রক্তাক্ত-ছিন্নভিন্ন মানচিত্র ও ইসরায়েলিদের বর্বরতা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর মতো আর কোনো শতাব্দীতেই এতো অধিকসংখ্যক মহান কবির জন্ম হয়নি।’ উৎপীড়ন, যুদ্ধ, বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলির উত্থান-পতন, বর্ণবাদ, স্বৈরতন্ত্র, ফিলিস্তিনি ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও এই শতাব্দীতে অসংখ্য কবি আবির্ভূত হয়েছে। এই শতাব্দী যেমন যুদ্ধ, ধ্বংস, অশ্রু এবং ট্র্যাজেডির শতাব্দী, তেমনি কবি ও কবিতার উৎকর্ষের শতাব্দী। মাতৃভূমি, নিপীড়িত দেশবাসীর বেদনামাখানো চিৎকার-হাহাকার, বিশ্বরাজনীতির মোড়লদের অমানবিক কু-নাট্যের অভিঘাতে দারবিশের প্রতিটি কবিতা হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। অগ্নিদগ্ধ জাতির অগ্নি ও উত্তাপ ধারণ ও লালন করার জন্য তাঁকে ‘পোয়েট অফ দ্য রেজিস্ট্যান্স’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ‘দখলদার ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা ফিলিস্তিনিদের মূলধারার রাজনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।’ আরবি ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের রক্ষাকর্তা হিসেবে এই কবি বিশ্বাস করতেন, তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি একদিন ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির থাবা থেকে মুক্ত হবেই। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে রাখলেও তারা তাঁর জিহ্বায় উচ্চারিত শব্দ ও প্রতিবাদী কবিতাকে দখল করতে পারেনি, পারবেও না। ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির লড়াইকেও স্তব্ধ করতে পারবে না। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, কবিতাকে যেমন ধ্বংস করা যায় না, তেমনি মানুষের মুক্তির লড়াইকেও থামানো যায় না।

তুমি যেভাবে প্লাথের কবিতা পাঠিয়েছিলে,তোমার মতন করে দারবিশের কবিতার ভাবানুবাদ করে পাঠাতে পারলাম না। কিন্তু ইচ্ছে ছিল তোমাকে লিখে দেই একটা গোটা জীবন, যাক সব পেলে জীবন হয়ত অতৃপ্ততা চিনতো না। ভালো থেকো নিরন্তর। শেষ করার আগে দারবিশের কবিতায় খুব বলতে ইচ্ছে করছে -

Between Rita and my eyes
There is a rifle
And whoever knows Rita
Kneels and prays
To the divinity in those honey-colored eyes.
And I kissed Rita
When she was young
And I remember how she approached
And how my arm covered the loveliest of braids.
And I remember Rita
The way a sparrow remembers its stream
Ah, Rita
Between us there are a million sparrows and images
And many a rendezvous
Fired at by a rifle.
Rita’s name was a feast in my mouth
Rita’s body was a wedding in my blood
And I was lost in Rita for two years
And for two years she slept on my arm
And we made promises
Over the most beautiful of cups
And we burned in the wine of our lips
And we were born again
Ah, Rita!
What before this rifle could have turned my eyes from yours
Except a nap or two or honey-colored clouds?
Once upon a time
Oh, the silence of dusk
In the morning my moon migrated to a far place
Towards those honey-colored eyes
And the city swept away all the singers
And Rita.
Between Rita and my eyes—
A rifle.



শুভেচ্ছান্তে-
সুস্মি
১৭ মে, ২০২৫