Next
Previous
Showing posts with label ধারাবাহিক. Show all posts
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in



















যুদ্ধমাঝে শান্তির দূত মাহমুদ দারবিশ



সুপ্রিয় বাসু,

বহুবছর পর তোমার ভাবানুবাদে সিলভিয়া প্লাথের কবিতা পড়ে দারুন লাগলো। মনে পড়ে গেলো মাহমুদ দারবিশের কবিতার কথা। ‘ফিলিস্তিন’ বর্তমান বিশ্বের এক আলোচিত ভূখণ্ডের নাম। ভূমধ্যসাগরের তীরের এই দেশের রয়েছে হাজার বছর পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্য। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষভাবে আলোচিত হবার কারণ অবশ্য এটি নয়। ফিলিস্তিন নিয়ে বাতচিতের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে থাকে তিন ধর্মের পবিত্র শহর জেরুজালেম ও সেখানকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনি। জায়নিস্টদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের নিপীড়িত হবার ঘটনা নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর সেই যে শুরু হয়েছিল তা এখনও চলমান। ফিলিস্তিনের (আরবি উচ্চারণে ফলাস্তিন) গাজায় এখন যা ঘটছে তা কেবল গণহত্যা নয়, এটা জাতিহত্যা। একটি মুক্তিপিয়াসী জাতিকে নির্মূল করতে সেখানে চলছে পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। গাজা এখন ‘বসবাসের অযোগ্য’ এক মৃত্যু-উপত্যকা। প্রতিদিনই সেখানে লাশের মিছিল বাড়ছে। এর প্রকৃতির জলপাই রঙের স্নিগ্ধ মেদুরতা প্রায়-অপসৃত, মাটি রক্তাক্ত, আকাশের নীলিমা বিধ্বস্ত। নির্বাসন ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই তাদের।

ভাষা ও সাহিত্যের সবচেয়ে বলিষ্ঠ মাধ্যম কবিতা। সুপ্রাচীনকাল থেকে কবিতাই মানুষের দ্রোহ, প্রেম, আবেগ, অনুভূতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চার অন্যতম প্রধান অবলম্বন। মন ও মননের ছান্দসিক প্রকাশের কারণে সব যুগেই কবি ও কবিতা সমাদৃত। যুগে যুগে স্থান, কাল ও সীমান্তের সীমা অতিক্রম করে কবিতা হয়ে উঠেছে মানব ও মানবতার বৈশ্বিক কণ্ঠস্বর। মাহমুদ দারবিশের কবিতা এমনই—ভালোবাসা ও বিদ্রোহ, প্রতিরোধ ও আলিঙ্গন হাত ধরাধরি করে এগোয়। বয়স যখন উনিশ, প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ আসাফির বিলা আজনিহা (‘উইংলেস বার্ড’ অথবা ‘পালকহীন পাখি’)। প্রথমদিকে তিনি ধ্রুপদী রীতিতে কবিতা লেখা শুরু করেন। কিন্তু খুব বেশিদিন এই ধ্রুপদী দুর্গের মধ্যে আটকে থাকেননি দারবিশ। সিরীয় কবি সিজার কাব্বানি এবং আলী আহমদ সাঈদ অ্যাডোনিসের নব্য কবিতা আন্দোলনের আছড়েপড়া ঢেউ তাঁর ধ্রুপদী ভাবনার নীল নির্জন দুর্গকে ভেঙে খানখান করে দেয়। স্বপ্নলোকচারী কবি চলে আসেন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে লোকানুবর্তী ও লক্ষ্যভেদী। ফিলিস্তিনের মাঠ, ক্ষেত, উপত্যকা, মাটি, অলিভ গাছের সারি প্রভৃতি দিয়ে দারবিশ নির্মাণ করতে থাকেন কবিতার পর কবিতা। ফিলিস্তিনের নিসর্গের বিমূর্ত সুর আর স্বাধীনতা, প্রেম, স্বাদেশিকতার ধারণার যোগসাজশে দারবিশ এক বিশ্বজনীন কবিতা নির্মাণের প্রয়াস পান। দারবিশের কবিতার ভাষা সহজ ও স্বচ্ছ। কিন্তু তাতে রয়েছে মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার সুদৃঢ় অঙ্গীকার। তাঁর কবিতা পড়লে এক গভীর মানবিক চেতনায় সমস্ত দেহমন আন্দোলিত হয়ে ওঠে। বিপন্ন অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়েও তিনি কখনো মানবতা ও মানবপ্রেমের মন্ত্র থেকে বিচ্যুত হননি।

মাতৃভূমি থেকে উন্মূল মাহমুদ দারবিশ আজীবন হৃদয়ের অন্তস্তলে ধারণ এবং লালন করেছেন বেদনাপীড়িত, বুলেট-বেয়নেট-বোমায় ক্ষতবিক্ষত ফিলিস্তিনকে, কবিতার শাণিত হাতিয়ার দিয়ে লড়েছেন ফিলিস্তিনি জনগণের জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীন বাসভূমির জন্য। কৈশোর থেকেই তিনি ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে থেকে লড়াই করেছেন প্রবল পরাক্রান্তের বিরুদ্ধে। আর সেই লড়াইটা করেছেন কবিতার শাণিত শব্দাবলি দিয়ে। দারবিশ প্রথম কবিতা পাঠ করেন ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে। স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি আবৃত্তি করেন : ‘তুমি চাইলেই সোনালি রোদে খেলা করতে পারো, তুমি চাইলেই হাতের নাগালে পাও আলোকিত পুতুল, কিন্তু আমার তা নেই। তোমার আছে ঘর, আমার কিছু নেই। তোমার আছে উৎসব আর উদ্যাপন, কিন্তু আমি তার দেখা পাই না। বলো, কেন আমরা একসঙ্গে খেলতে পারি না।’ ফিলিস্তিনিহীন পৃথিবীর মানচিত্রে বালক দারবিশের কবিতা যেন লাল ফিলিস্তিন হয়ে আঘাত করে ইসরায়েলিদের বুকে। কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে বারুদের গন্ধ! এমন বারুদমাখা কবিতা শুনে স্কুল কর্তৃপক্ষ ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ হয় দারবিশের ওপর, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর লোকেরা তাকে শাসিয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর কবিতাটা কতটা ক্ষুরধার, কতটা অভ্রভেদী। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই আরবি ভাষায় রচিত, তবে অনায়াসে লিখতে পারতেন হিব্রু, ইংরেজি, ফরাসিতে। ‘আরবদের সবচেয়ে উৎকর্ষশীল শিল্প’ কবিতাকে তিনি এক নতুন ভুবনের সন্ধান দেন, অধিষ্ঠিত করেন অনন্য উচ্চতায়, ফলে মাহমুদ দারবিশের কবিতা ও প্রবন্ধের দ্যুতি আরব জাহান অতিক্রম করে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক চেতনার কবিতার পাশাপাশি দারবিশ বার বার বলতেন শুদ্ধ কবিতার (Pure Poetry) কথা। কেননা তার কবিতা হলো বহুমুখী সংস্কৃতির সঙ্গে কথোপকথন। নির্দ্ধিধায় তিনি কবিতায় ব্যবহার করেন ইসলামিক, খ্রিষ্টিয় ও ইহুদি মিথ। মোহময় সংগীতময়তায় আচ্ছন্ন তাঁর কবিতা। যেখানে রয়েছে জীবনের আশ্চর্যময়তা Mistry of Life এবং মৃত্যু। কিন্তু মৃত্যু তাঁর কাছে এক অন্য রূপান্তর। জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনিই তো বলতে পারেন:- “যখনই আমি নিজেকে খুঁজি অসংখ্য মানুষের দেখা পাই যখনই তাঁদের খুঁজতে যাই তখন আমি একা নিঃসঙ্গ। তখন আমি লাখো জনতা।” (ম্যুরাল) এভাবেই তিনি আত্মপরিচয়ের অযুথ বাণী তুলে ধরেন কবিতায়। জীবনের যুযুধান সময়কে সামনে রেখে হাঁটতে থাকেন। কেননা একই সঙ্গে তিনি একা এবং অসংখ্য। (Individul Crowed) জাতিগত বিভেদের সমথনে যখন রাষ্ট্রীয় শক্তি দম্ভ প্রকাশ করে, দুই মানুষের মাঝখানে দেয়াল তুলে দেয়, তখন একজন কবিকে তা সবচেয়ে বেশি আহত করে। সাহিত্য-সমালোচকরা তাঁকে চিহ্নিত করেন আরব জাহানের সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও সম্মানীয় কবিদের একজন এবং সমকালীনদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হিসেবে। ‘কেউ কেউ মনে করেন, আরব-কবিদের মধ্যে অ্যাডোনিসের পরেই তাঁর স্থান। তবে কাব্যচিন্তা ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে অ্যাডোনিসের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য অনেক। বর্তমানে আরব কবিতায় যে আধুনিকতা দেখা দেয় তা প্রধানত এসেছে অ্যাডোনিসের হাত ধরেই। কিন্তু আরব কবিতায় যে বিপ্লবী জোশ দেখা দেয় তা এসেছে দারবিশের হাত ধরে।’ প্রিয় স্বদেশের বিপন্ন মুখ, দখলদার বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন এবং বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ, ফিলিস্তিনিদের মরণপণ লড়াই – এসবই দারবিশের কবিতার প্রধান বিষয়। রক্ত, আগুন, প্রতিবাদ, জখম, পাথর এ-ধরনের শব্দ ও চিত্রকল্প বারবার ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় শৈল্পিক প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক চিন্তা, দেশাত্মবোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মাতৃভূমির প্রতি দুর্মর ভালোবাসা, পাইন-জলপাই ঘেরা স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন তাঁকে কবি করে তোলে, যদিও তিনি বলতেন, ‘আমি এখনো কবি হয়ে উঠতে পারিনি, মনে হচ্ছে এ-পথে আসাটাই ভুল হয়েছে।’ তাঁর বেশিরভাগ কবিতাতেই ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের মর্মভেদী বেদনা এবং তাদের প্রতি কবির উদ্বেগ ও আতঙ্ক। তাঁর প্রায় সব ধ্যানজ্ঞান, স্বপ্ন-কল্পনা আবর্তিত হয়েছে আরবদের ইতিহাস-ঐতিহ্য কিংবা পিতা-পিতামহের অতীত স্মৃতি ও বেদনাকে ঘিরে। উদ্বাস্তু জীবন থেকে দেশে ফিরে তিনি অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে লিখেছেন : ‘আমি ফিলিস্তিনে। কিন্তু কোথায় আমার ফিলিস্তিন? আমি কখনো আমার বাড়িতে ফিরে যেতে পারিনি। প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমার গ্রাম বিধ্বস্ত-ভস্ম।’ জন্মভূমি হারানোর বেদনা আর নির্বাসিত জীবনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নানাভাবে মূর্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়, তাঁর প্রবন্ধে। মাতৃভূমির প্রতি প্রবল টান, স্বজন-হারানোর বেদনা-হাহাকার, দেশত্যাগজনিত ক্ষত ও রক্তক্ষরণ তাঁকে কলম ধরতে ও তাতে শাণ দিতে শিখিয়েছে। শেকড়ে ফিরে আসার প্রবল আকুতি, বুকের মধ্যে জমা দ্রোহ-দাহ, ক্ষোভ, হাহাকারই বারবার ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি হয়ে বেজেছে তাঁর কবিতায় ও সৃজনভুবনে। দারবিশের কবিসত্তা জাগ্রত হয়েছে প্রাচীন আরব কবি মু-আল্লাকারের কবিতার স্বপ্নছোঁয়ায়, পিতামহ হুসাইন দারবিশের কাব্যপ্রীতিও তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তবে তাঁর কবি হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে নিজ মাতৃভূমির রক্তাক্ত-ছিন্নভিন্ন মানচিত্র ও ইসরায়েলিদের বর্বরতা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর মতো আর কোনো শতাব্দীতেই এতো অধিকসংখ্যক মহান কবির জন্ম হয়নি।’ উৎপীড়ন, যুদ্ধ, বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলির উত্থান-পতন, বর্ণবাদ, স্বৈরতন্ত্র, ফিলিস্তিনি ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও এই শতাব্দীতে অসংখ্য কবি আবির্ভূত হয়েছে। এই শতাব্দী যেমন যুদ্ধ, ধ্বংস, অশ্রু এবং ট্র্যাজেডির শতাব্দী, তেমনি কবি ও কবিতার উৎকর্ষের শতাব্দী। মাতৃভূমি, নিপীড়িত দেশবাসীর বেদনামাখানো চিৎকার-হাহাকার, বিশ্বরাজনীতির মোড়লদের অমানবিক কু-নাট্যের অভিঘাতে দারবিশের প্রতিটি কবিতা হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। অগ্নিদগ্ধ জাতির অগ্নি ও উত্তাপ ধারণ ও লালন করার জন্য তাঁকে ‘পোয়েট অফ দ্য রেজিস্ট্যান্স’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ‘দখলদার ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা ফিলিস্তিনিদের মূলধারার রাজনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।’ আরবি ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের রক্ষাকর্তা হিসেবে এই কবি বিশ্বাস করতেন, তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি একদিন ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির থাবা থেকে মুক্ত হবেই। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে রাখলেও তারা তাঁর জিহ্বায় উচ্চারিত শব্দ ও প্রতিবাদী কবিতাকে দখল করতে পারেনি, পারবেও না। ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির লড়াইকেও স্তব্ধ করতে পারবে না। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, কবিতাকে যেমন ধ্বংস করা যায় না, তেমনি মানুষের মুক্তির লড়াইকেও থামানো যায় না।

তুমি যেভাবে প্লাথের কবিতা পাঠিয়েছিলে,তোমার মতন করে দারবিশের কবিতার ভাবানুবাদ করে পাঠাতে পারলাম না। কিন্তু ইচ্ছে ছিল তোমাকে লিখে দেই একটা গোটা জীবন, যাক সব পেলে জীবন হয়ত অতৃপ্ততা চিনতো না। ভালো থেকো নিরন্তর। শেষ করার আগে দারবিশের কবিতায় খুব বলতে ইচ্ছে করছে -

Between Rita and my eyes
There is a rifle
And whoever knows Rita
Kneels and prays
To the divinity in those honey-colored eyes.
And I kissed Rita
When she was young
And I remember how she approached
And how my arm covered the loveliest of braids.
And I remember Rita
The way a sparrow remembers its stream
Ah, Rita
Between us there are a million sparrows and images
And many a rendezvous
Fired at by a rifle.
Rita’s name was a feast in my mouth
Rita’s body was a wedding in my blood
And I was lost in Rita for two years
And for two years she slept on my arm
And we made promises
Over the most beautiful of cups
And we burned in the wine of our lips
And we were born again
Ah, Rita!
What before this rifle could have turned my eyes from yours
Except a nap or two or honey-colored clouds?
Once upon a time
Oh, the silence of dusk
In the morning my moon migrated to a far place
Towards those honey-colored eyes
And the city swept away all the singers
And Rita.
Between Rita and my eyes—
A rifle.



শুভেচ্ছান্তে-
সুস্মি
১৭ মে, ২০২৫
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


১১

বের্নহার্ড এখনও চার্লসের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানে না। তবুও তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সে প্রাণপণে নিজের বিস্ময় এবং বিরক্তি গোপন করবার চেষ্টা করে যায়। তাছাড়া তার রেওয়াজের সময় অর্ধেকের বেশি পেরিয়ে গেছে। কিন্তু চার্লসের মত এক সম্পূর্ণ অচেনা অজানা মানুষ কেন তাকে বিশ্বাস করে এত ব্যক্তিগত কথা বলে চলেছে সে একেবারেই বুঝতে পারছে না। এদিকে চার্লস একেবারেই লক্ষ্য করছে না যে বের্নহার্ড অধৈর্য হয়ে উশখুশ করছে। সে বিরতিহীনভাবে নানা কথা বলে যাচ্ছে। এমন ভাবে বলছে যেন এই কথাগুলো এই মুহূর্তে সে শুধুমাত্র বের্নহার্ডকেই বলতে পারে। তার এখন এক সহমর্মী বন্ধু না হলেও, নিদেনপক্ষে একজন একনিষ্ঠ শ্রোতা প্রয়োজন। ‘কারণ’ সে বলে… ‘আপনি বুঝতেই পারছেন যে আমি একবর্ণ বানিয়ে বলছি না। আমি তো আগাগোড়া আন্তরিক থাকতেই চেয়েছি, কিন্তু এই মুহূর্তে তো সেটাও সম্ভব নয়, তাই না?’ তার মানে সে বলতে চাইছে যে কাউকে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে সে দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে, মানে তাকে কেউ ঠকিয়েছে। অর্থাৎ সে নিজের কাহিনী একটা পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শুরু করেছে। অথচ সে যে সত্যি বলছে, অর্থাৎ তার নিজের যে কোনও দোষ নেই, সেটা বের্নহার্ডের কাছে প্রমাণ করবার কোনও সুযোগ এই মুহূর্তে তার কাছে নেই। কিন্তু গতকাল তার সঙ্গে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে; ফলে সে একেবারে ভেঙে পড়েছে। এই ঘটনা হয়তো সে নিজের মধ্যেই গোপন রাখতে পারত, কিন্তু এই ঘটনার মধ্যে আবার অনেকগুলো অতীতের সূত্র আছে। সেই সূত্রের সঙ্গে সংযুক্ত ঘটনাগুলো আবার বেশ দীর্ঘ। সেই পুরো ইতিহাস না বললে বের্নহার্ড কিছুই বুঝতে পারবে না। আবার যাদের নিয়ে এসব ঘটনা, তাদের কাউকে বের্নহার্ড চেনে না। ফলে সবকিছু খুলে না বললে ব্যাপারটা একেবারেই বোধগম্য হবে না।



অবশেষে চার্লস একটু ঠিকঠাক বাক্য গঠন করে কথা বলতে শুরু করে এবং একেবারেই থামতে পারে না সে। সে ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে কথা বলে যায়। বের্নহার্ড মৃদু হাসে তার দিকে তাকিয়ে। সে এই প্রথম হাসল চার্লসের দিকে তাকিয়ে এবং হাসির মধ্যে কোনও মেকি, সাজানো ব্যাপার নেই। তার মনে হল যে যদি সে একটু কষ্ট করে কথাগুলো শোনে, হয়তো তাহলে চার্লসের কষ্টটা একটু লাঘব হবে। সে সহানুভূতির সঙ্গে প্রশ্ন করে, ‘ঠিক কী হয়েছে?’ একটু সামনে ঝুঁকে বসে সে, যাতে বোঝা যায় যে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে সে সব কথা শুনছে। বের্নহার্ডকে চার্লস যেন অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরতে চায়। কথা বলতে বলতে সেও ঝুঁকে পড়ে টেবিলের উপরে। বের্নহার্ডের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে বলতে প্রায় তার মুখে মুখ ঠেকে যায়।

‘আপনি আমার বন্ধু’ সে ফিসফিস করে, ‘ওঃ, আমার মনে হচ্ছে যে আপনি আমার বন্ধু হতে চাইছেন, তাই না?’

বের্নহার্ডের একটু অপ্রস্তুত বোধ হয়; যদিও এই ভিনদেশি ছেলেটির আবেগ তাকে স্পর্শ করে, কিন্তু এই আবেগের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর ভাসিয়ে নেবার মত গতি আছে, যেটা তার ততখানি পছন্দের নয়। সে মৃদুস্বরে চার্লসের দিকে না তাকিয়েই বলে “Mais oui – soyez tranquille, je vous en prie, soyez tranquille!” (মাই উই— সইয়ে ত্রংকিল, জেভোসেঁপ্রি, সইয়ে ত্রংকিল) যার অর্থ হল ‘কিন্তু হ্যাঁ, শান্ত হোন, দয়া করে শান্ত হোন!’



চার্লস উঠে দাঁড়ায় তার দু’হাত আলোকিত টেবিলের উপরে রেখেই। তার হাতের আঙুলগুলো সরু সরু হলদেটে, বিশ্রী হাতের নখ।

‘ওঃ’ হঠাৎ তার কণ্ঠস্বরে একটু উদাস ভাব আসে, ‘ভাববেন না যে আমি আপনাকে খুব নাটকীয় কোনও গোপন কথা বলব। আমি আপনাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছি। তাই না? মাপ করবেন। আসলে অনেক সময় আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। আমি যথেষ্ট শিক্ষিত নই আপনার মত! গতকাল যা ঘটেছে, তার জন্য আমার দুর্বল শিক্ষাদীক্ষা দায়ী; নাহলে হয়তো ওই ঘটনাটা এড়ানো যেত। আপনার জানা আছে আশা করি যে আমার ধূমপানের অভ্যেস আছে। আসলে এটা ঠিক নেশা নয়, কিন্তু পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবার সময়ে আমার ধূমপান করা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন এই অভ্যেসটা ছাড়তে পারছি না। এটা ভাল নয়, কারণ খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু একটা গোটা সন্ধ্যা যদি ধূমপান না করে থাকতে হয়, তাহলে সেটাও আমার পক্ষে কষ্টকর। না, কষ্টকর নয়, বিষণ্ণ, ওঃ না, বিষণ্ণ সঠিক শব্দ নয় এক্ষেত্রে। বরঞ্চ বলা চলে যে আমার অস্থির লাগছিল, কিছু ভাল লাগছিল না, কী যেন খুঁজছিলাম আমি… জিভের মধ্যে একটা বিশ্রী স্বাদ… সবার সব কথার উত্তরে কটু কথা বলেছি আমি। গতকালের ব্যাপারটা কতকটা এইভাবেই শুরু হয়েছিল। আমরা বন্ধুরা রবার্টের সঙ্গে বসেছিলাম। রবার্টের কাছে কোনও সিগারেট ছিল না। ওইখানে আরও দুটো মেয়ে ছিল, ওরা গান গায়, ওরা বলল যে ওদের সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য হয় না। তো… সেইজন্য আমি সিগারেট কিনতেও যেতে পারছিলাম না, যদিও আমার কাছে পয়সা ছিল (আসলে গতকাল ফাঁকেতালে আমি এক বন্ধুর কাছ থেকে অনেক আগের ধার দেওয়া টাকাটা ফেরত পেয়েছিলাম।)। কিন্তু মেয়েদুটো যে সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারেনা, এটা একেবারে বাজে কথা… কারণ প্রতি সন্ধ্যায় আমি ওদের ঘন ধোঁয়ার মধ্যে বিবি বারে বসে ড্রিঙ্ক করতে দেখি। যাকগে, কে আর প্রমাণ করতে যাবে যে ওরা গায়িকা টায়িকা কিচ্ছু নয়, বরঞ্চ একেবারে সাধারণ অসফল বার গার্ল। কারণ ওরা যদি সফলই হবে… তো ওরা যেটা নয়, নিজেদের সেটা প্রমাণ করবার কোনও দায় থাকত না। মিছে ভান করত না তাহলে!’

চার্লস নিজের সঙ্গেই রাগতস্বরে কথা বলে যাচ্ছে। কণ্ঠস্বরে ঘৃণা এবং অবজ্ঞা ঝরে ঝরে পড়ছে। বের্নহার্ডের অবাক লাগে। সিগারেট খেতে না পারা কিম্বা ওই মেয়েদের আপত্তি, যারা গায়িকা হতে পারে কিম্বা হতেই পারে বার গার্ল… ধূমপান না করা কিম্বা ওই মেয়েদের সফল হওয়া… এইগুলোর মধ্যে কোনওটাই এমন উগ্র আচরণের কারণ হতে পারে না।

চার্লস বের্নহার্ডকে খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করে হিংস্রভাবে বলে ওঠে… ‘আপনার এত অবাক হবার মত কোনও কারণ ঘটেনি। আপনি জানেন না যে সারা সন্ধ্যা একঘেয়ে ধরনের মুখে পেইন্ট করা মেয়েদের পাশে থাকা কতখানি বিরক্তিকর, তাদের বোকা বোকা কথা শুনে যাওয়া, সর্বোপরি তাদেরই আপত্তির কারণে সিগারেট না খাওয়া… পুরো ব্যাপারটাই বিশ্রী এবং বিরক্তিকর। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না যে মেয়েগুলোর কণ্ঠস্বর কতখানি বোকা বোকা এবং অসহ্য! আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল। অতিকষ্টে নিজেকে সামলেছি। অবশ্যই আমি চলে আসতে চেয়েছিলাম (ফিরে এলেই ভাল হত!); কিন্তু আমি ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। আপনাকে বুঝতে হবে গোটা ব্যাপারটা। সারাদিন স্কুলে, তারপর সন্ধেবেলায় এইসব… নিজেকে স্পঞ্জের মত মনে হচ্ছিল আমার।’

‘আপনি ঘুমোতে চলে গেলেন না কেন?’

-‘আমার রবার্টের সঙ্গে থাকবার কথা ছিল। আপনি বুঝবেন না, কিন্তু ব্যাপারটা খুব প্রয়োজনীয় আমার কাছে। রবার্ট একটু অদ্ভুত ব্যক্তি এবং আপনি যদি তার বন্ধুবৃত্তে থাকেন, তাহলে বুঝবেন যে একটা সন্ধ্যাও রবার্টের সঙ্গ ছাড়া চলবে না আপনার। অনেকের সঙ্গে দেখা হয় সেখানে। হতে পারে যে ওইখান থেকে নানা যোগাযোগ হল ভবিষ্যতে কাজকর্মের ব্যাপারে। যদিও এখন এসব আমার কাছে অতীত… অবশ্যই অতীত। আমি সেখানে আর যাচ্ছি না। আপনি জানেন জেরাল্ডের উপরে ঐ রোমানিয়ান নেকুপুষুর কতখানি প্রভাব? কিন্তু আপনি তো আবার জেরাল্ডকে চেনেন না।’



বের্নহার্ড গভীরভাবে ভাবতে থাকে। জেরাল্ড নামটা সে এর মধ্যেই শুনে ফেলেছে। এই নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তার সঙ্গীতশিক্ষকের বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। তিনি তাকে তাঁর বাড়িতে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওঁর ভিজিটিং কার্ডটা এখনও আছে তার কাছে। কিন্তু সেই জেরাল্ড চিকিৎসক, একজন নামকরা শল্যচিকিৎসক। চার্লস যার সম্বন্ধে বলছে, হয়তো তিনি অন্য কোনও ব্যক্তি।



(চলবে)
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২১.১

সাত সকালে গোটা গাঁয়ে খবর চাউর হল যে পুলিস জোগনাথকে গ্রেফতার করেছে। সবাই অবাক,

ব্যাটা জোগনাথ তো বৈদ্যজীর লোক। ওকে ছুঁতে পুলিসের হিম্মৎ হল? গ্রামের গুণ্ডার দল এবং

ভালোমানুষ –সবাই ঘাবড়ে গেল। গুন্ডাদের চিন্তা—যখন বৈদ্যজীর খাস আদমীকে পুলিস ছেড়ে কথা

কয় নি, তো আমরা কিসের খয়ের খাঁ! ভালোমানুষের দল ভাবল—পুলিস যখন নিজেদের লোকের সঙ্গেই

এমন করেছে, তখন সময় খারাপ হলে আমাদের সঙ্গেও কী করবে , কী না করবে -কে জানে!

পুলিশের সমস্ত গ্রেফতারি বেশ নাটকীয় হয়, এটাও ব্যতিক্রম নয়।

এটা না বললেও চলে যে ব্যাপারটাকে নাটকীয় করে তোলার সমস্ত কৃতিত্ব পুলিশের। দারোগাজীকে

পড়ানো হয়েছিল যে বিপদজনক আসামীদের ধরতে উপযুক্ত সময় হল রাতের চতুর্থ প্রহর। তাই

জোগনাথকে ধরার জন্য ব্রাহ্মমুহুর্তই ঠিক হল--- যদিও সারাদিন জোগনাথকে গ্রামের মধ্যে

খোলাখুলি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এবং তাকে থানায় ডেকে এনে আটকে রাখা খুব সহজ।

ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ পুলিস এসে জোগনাথের বাড়ি ঘিরে ফেলল। এটা জানা কথা যে এখানে

গোলাগুলির কোন সম্ভাবনা নেই। তাই সব পুলিসের হাতে রাইফেল! দারোগাজী তাঁর পিস্তলে গুলি ভরে

হেড কনস্টেবলের কানে কানে বললেন—কানপুর থেকে একদল বদমাশ কাল এদিকে এসেছে। হতে পারে

ওরা জোগনাথের ঘরে লুকিয়ে আছে।

হেড কনস্টেবল—হুজুর, কানপুর থেকে যারা এসেছে ওরা আচার্য ভাবের ভুদান আন্দোলনের

কার্যকর্তা।

‘ওটাই তো’, দারোগাজী ফুসফুস করে বললেন,’ আগেকার দিনে বদমাশেরা সাধুর বেশ ধরে ঘুরে বেড়াতো,

আজকাল অন্য বেশ ধরেছে’।

সমস্ত সিপাহী প্রথমে বজরঙ্গবলীর নাম জপল, তারপর বৌ-বাচ্চার মুখ মনে করল। অবশেষে

হাতিয়ার তুলে বদমাশের দলের সঙ্গে মুখোমুখি হতে এগিয়ে চলল। সবাই নিশ্চিত মৃত্যুর জন্যে তৈরি,

সবার প্রাণ ধুকপুক করছে।

বাড়ি ঘেরাওয়ের পর বড় বড় পদক্ষেপ নেয়া হল। সমস্ত সেপাই খৈনি না ডলে, বিড়ি না খেয়ে পজিশন

নিয়ে পাথরের মূর্তির মত আধঘণ্টা অপেক্ষায় বসে রইল। কেউ হাসে নি, কেউ কাউকে হাসায় নি।

একজন সেপাই জুতো খুলে বুকে হেঁটে সবার কানে কানে মন্তর দিতে লাগল—ধৈর্য ধর, কোন বিপদের

সম্ভাবনা নেই।

সবাই অভিজ্ঞ, জানে যে বিপদ কারও মুখের কথায় কাটে না। তাই সবাই বিপদের মধ্যেই ঘাঁটি গেড়ে

বসে রইল। দারোগাজী পিস্তল নিয়ে এবং হেড কনস্টেবল রাইফেল হাতে জোগনাথের দরজায় দাঁড়িয়ে।

একটা লোক গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ওকে দেখে হেড কনস্টেবল ইশারায় ডাকল, কাছে এলে কানে কানে

প্রশ্ন করল,--পালাচ্ছিলে?

ও পালটা জবাব দিল—পালাবো কেন? সাতসকালে আপনাদের মুখদর্শন করার থেকে রেহাই চাইছিলাম।

দারোগাজী ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললেন—স্‌ স্‌ স্‌!




হেড কনস্টেবল—এই বারান্দায় বসে পড়। সাক্ষী দেবে।

ও বলল, --এখানে বসার কী দরকার? কাল, পরশু, তরশু যেদিন ইচ্ছে খবর দেবেন। এসে সাক্ষী দিয়ে

যাব। আমি আপনাদের পর তো নই।

ও কেটে পড়ছিল। হেড কনস্টেবল ফের ওর কানে কানে বলল,--ঠিক আছে, যাও। কিন্তু খবরদার!

আমরা যে এখানে রয়েছি সেটা কাউকে বলবে না।

ও হেড কনস্টেবলের কানে নিজের নাক ঢুকিয়ে বলল—বলার কী আছে? গোটা গাঁ জেনে গেছে।

লোকটা চলে গেল। ঘরের পেছনে ওত পেতে বসে থাকা সেপাইদের এবার বিড়ি-খইনির নেশা চাগাড় দিচ্ছে।

প্রায় ফর্সা হয়ে এসেছে। একটু দূর থেকে একজন আরেকজনকে দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ পেছনের সারির

সেপাইদের কানে এল খড় খড় শব্দ। কেউ বোধহয় বাইরের দরজাটা খুলছে। চটপট কথাবার্তার আওয়াজ

ভেসে এল। এরা বুঝে গেল –ধর্মক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের লগ্ন এসে গেছে। এরা বন্দুক ও

সঙীন উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।




ওদিকে দরজার কাছে কথাবার্তার স্বর আরও দ্রুত লয়ে চলছে এবং ক্রমশঃ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

সেপাইয়ের দল শরীরের ভেতর এক অস্বস্তি বোধ থেকে ছটফট করে কাশতে লাগল এবং প্রত্যেক

কাশির সঙ্গে শরীরের সমস্ত ছিদ্র থেকে পবন-মুক্তাসন! একটু পরে কাহিনীর ক্লাইম্যাক্স এল।

বিপদ সংকেতের সিটি বেজে উঠতেই এরা দৌড়ে দরজার কাছে পৌঁছে গেল। সেখান থেকে দৌড়ে পঞ্চাশ

গজ দূরের আমবাগানে। একেবারে নাটকীয় পরিস্থিতি!

ওরা দেখল-- জোগনাথ মাটিতে বসে আছে। দারোগাজী ওর বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে রেখেছেন। হেড

কনস্টেবল অন্যদিক থেকে সঙীন উঁচিয়ে রয়েছে। স্টেজে ব্লকিং হিসেবে দারুণ। শুধু ড্রপসিন নামাটাই

বাকি। সেপাইয়ের দল এসে দ্রুত কম্পোজিশন বদলে দিল। ওরা জোগনাথের শরীরের যতটুকু ভাগ

পিস্তল সঙীনের নিশানা থেকে বেঁচে রয়েছে সেখানে কব্জা করল। জোগনাথের একটুদূরে একটা বদনা

উলটে পড়ে আছে। পাশের খানিকটা জমি জলে ভেজা। দারোগাজী একটা সেপাইকে হুকুম করলেন—“ ওই

লোটা বাজেয়াপ্ত কর, প্রমাণ পেশ করতে কাজ দেবে”।

সেপাই বদনা তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে তারিফের সুরে বলল—মোরাদাবাদী পিতলের লোটা! তারপর কী

ভেবে বলল—সীল লাগিয়ে দিই?

--এখন না, পরে হবে’খন।

সেপাই লোটার জল পড়ে ভিজে যাওয়া জমি দেখতে দেখতে বলল—‘ওই মাটিও খানিকটা তুলে নিয়ে রাখি?

এটাও প্রমাণ হতে পারে’।

হেড কনস্টেবল ধমকে উঠল—বেশি চালাকি কোর না। যতটুকু বলা হয়েছে ততটাই কর।

দারোগাজীর হুকুমে জোগনাথকে দাঁড় করানো হল। ওর শরীর সার্চ করা হল। ফের বেয়নেট খাপে ঢুকে

গেল, পিস্তল চামড়ার হোলস্টারে। সেপাইদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হল।

একজন বলল-- ‘এ ব্যাটা বোধহয় সাতসকালে পেট সাফ করতে মাঠে গিয়েছিল।




দ্বিতীয়—কে বলতে পারে, হয়ত কাছাকাছি কোন বদমাশের দল আস্তানা গেড়েছে। ওদের খাবার এবং

জলটল দিতে গেছল।

তৃতীয়—এবার বৈদ্য্যজী ঝামেলা পাকাবেন।

চতুর্থ নীচুগলায় বলল—বৈদ্যজী এখন দারোগাজীর পকেটে; এবারের রেইড কাপ্তান সাহেবের হুকুমে

হয়েছে।

পঞ্চম—চুপ! চুপ! ওদিকে দেখ, কেমন তামাশা জমেছে।

জোগনাথ নিজের জায়গায় কোন লোকনৃত্যের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে এটা স্পষ্ট যে ও নাচবে না।

হঠাৎ দারোগাজী ওর গালে জোরদার থাপ্পড় লাগিয়ে বললেন—লোটা নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছিল?

আঘাত সামলাতে ও খানিকক্ষণ চোখ মিটমিট করল। তারপর দারোগাজীর চোখে চোখ রেখে

বলল—আমাকে টুকরো করে কেটে ফেললেও উকিল না আসা পর্যন্ত কিস্যু বলব না।

দারোগাজী হেড কনস্টেবলকে বললেন—ব্যাটাকে হাতকড়ি লাগিয়ে নিয়ে চল। এখন ওর ঘরের

খানাতল্লাসি নেয়া দরকার।

‘একে জেরা করাও দরকার’, হেড কনস্টেবলের মন্তব্য।




পুরো ঘটনার বিবরণ দারোগার মুখ থেকে শুনতে চাইলে উনি যেমন বলবেনঃ

আজ থেকে আট দিন আগে গাঁয়ে চোর এসেছিল। পুলিস গ্রাম-রক্ষা-সমিতির সাহায্যে ওকে ধরার চেষ্টা

করেছিল। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে, চালাক চোর দলের একজন স্থানীয় লোককে ছেড়ে

দিয়ে অন্ধকারে গায়েব হয়ে যায়। পুলিস ও গ্রাম-রক্ষা সমিতির সক্রিয়তার ফলে ওর অপরাধ করার

প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু দলের স্থানীয় লোকটি গ্রাম জুড়ে চোর নিয়ে চেঁচামেচির ফাঁকে গয়াদীনের

বাড়িতে হাত সাফ করতে ঢুকে পড়ে।

গ্রাম রক্ষা সমিতির হাঁক শুনে গয়াদীন পরিবারের সবাই জেগে ওঠে। তখনই কেউ দেখতে পায় যে

একজন সিঁড়ি দিয়ে ছাদে যাচ্ছে। পুলিস হাওয়ার বেগে পৌঁছে যায়, কিন্তু লোকটা বেমালুম হাওয়া। এই

সময় গয়াদীন পুলিসের হাতে চুরি হওয়া গয়না-অলংকারের লিস্টি ধরিয়ে দেয়। জায়গাটাতে ভাল করে

খোঁজাখুঁজি করে পুলিস চলে যায়। ফের পনের দিন ধরে কড়া তদন্ত চলতে থাকে। শেষে পুলিস এই

সিদ্ধান্তে পৌঁছয় –হ্যাঁ, গয়াদীনের ঘরে সেই রাতে চুরি হয়েছে বটে! শুধু তাই নয়, যে চটপট সিঁড়ি ভেঙে

ছাদে চড়ছিল সে চোর না হয়ে যায় না!

তারপর গুপ্তচরের থেকে পুলিস জানতে পারল যে জোগনাথ পিতা রামনাথ, সাকিন শিবপালগঞ্জের ঘরে

এমন কিছু গয়না আছে যা গয়াদীনের বাড়ির হলেও হতে পারে। পাকা খবর পাওয়ায় আজ ভোর ভোর

পুলিস ওর ঘরে পৌঁছে যায়। জোগনাথ ঘর থেকে বেরিয়ে লোটা হাতে কোথাও যাচ্ছিল। পুলিসের মুখোমুখি

হয়ে ও নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে এবং নিজের সামনে ঘরের তল্লাশি করিয়েছে। এই তল্লাশি

আইন মেনে একজন সম্ভ্রান্ত লোকের উপস্থিতিতে হয়েছে।

বলে রাখা ভাল, এইসব পাড়ায় প্রথমত, লোকের দেখা পাওয়াই মুশকিল। দ্বিতীয়ত, যদি পাওয়া যায়ও

সে যে সম্ভ্রান্ত হবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। সে যাই হোক, তল্লাশি দু’জন সাক্ষীর সামনে হয়-- ছোটে




পালোয়ান পিতা কুসহর প্রসাদ এবং বৈজনাথ পিতা ত্রিবেণী সহায়। তবে বৈজনাথ হল ভিন গাঁয়ের

বাসিন্দা। এই ‘সম্ভ্রান্ত’ ব্যক্তিটিকে পাশের গ্রাম থেকে ডেকে আনা হয়।

জোগনাথ দেখিয়ে দিলে ভেতরের ঘরের একজায়গা খুঁড়ে একটা হাঁড়ি পাওয়া যায়। সেই হাড়িতে কিছু গয়না

ছিল। তার বিবরণ নিম্নানুসারঃ

একটি রূপার করধন (কটিবন্দ), দাম হবে পঞ্চাশ টাকা; এক জোড়া বিছিয়া, দাম ধর তিন টাকা; একটা

চাঁদির গয়না, দাম পঁচিশ টাকা। একটা নাকে ফুটো করে পরার সোনার গয়না, দাম হবে তিরিশ টাকা।

এগুলো বাজেয়াপ্ত করে লিস্টিতে ওই দুই সাক্ষীর সই নেয়া হয়েছে। হাঁড়ি সমেত গয়নাগুলো একটা

কাপড়ে বেঁধে সীল করা হয়েছে। সমস্ত প্রক্রিয়া জোগনাথের ঘরে বসে করা হয়েছে।

জোগনাথ গ্রেফতার হওয়ার সময় ঝগড়া হাতাহাতি করেছিল। ওকে ধরতে গিয়ে হেড কনস্টেবলের জামা

ছিঁড়ে যায় এবং হাতে চোট লাগে। জোগনাথকে কাবু করতে ন্যুনতম শক্তি প্রয়োগ করা হয়—ব্যস,

যতটুকু দরকার। পরে আহত সেপাই এবং জোগনাথের ডাক্তারী পরীক্ষা করানো হয়। সেপাই দুই

সপ্তাহের মেডিক্যাল লীভ নিয়ে নিজের গ্রামে চলে গেছে। জোগনাথের শরীরে গোটা কুড়ি নীলচে নিশান

আর চল্লিশটা আঁচড়ের দাগ পাওয়া গেছে। সবগুলো মামুলী চোট, মাটিতে পড়ে যাওয়ার ফল।

এই কাহিনীটি বৈদ্যজীকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শোনানো হল। –পুলিস যা করে ঠিকই করে, এমন শাশ্বত

তত্ত্বে প্রথমবার বৈদ্যজীর সন্দেহ হল।

অবশ্য জোগনাথের সম্বন্ধে বৈদ্যজীর ধারণা খুব যে ভাল ছিল, এমন নয়। কিন্তু উনি যে দুনিয়ায় বাস

করেন সেখানে লোকের সম্মান সে কতটা ভালমানুষ তা দিয়ে ঠিক হয় না—দেখা হয় সে কীরকম কাজের

লোক। ওনার দলের লোকের মধ্যে একমাত্র জোগনাথ খোলাখুলি মাল খেয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর মদের

পয়সা যেখান থেকেই আসুক—নিজের পকেট বা অন্যের—দারু গেলার পরিমাণ কখনও কম হয়না। সব

মিলিয়ে ওকে একটি মাঝারি ধরণের গুণ্ডা বলা যায়।

বৈদ্যজীর সন্দেহ হচ্ছিল যে জোগনাথের গ্রেফতারির পিছে কোন রাজনীতির প্যাঁচ আছে। কিছুদিন ধরে

দারোগাজী যে ওনার বদলে রামাধীন ভীখমখেড়ীকে বেশি কেউকেটা ভাবছেন -এটা ওনার চোখে পড়েছে।

গোড়ায় মনে হচ্ছিল রামাধীন বোধহয় আফিমের চোরাই কারবারে দারোগাজীকেও পার্টনার বানিয়ে

ফেলেছে। এখন মনে হচ্ছে দারোগাজী ধোঁকা খেয়েছেন। বোধহয় ভেবেছেন যে রাজনৈতিক ল্যাং মারার

খেলায় রামাধীন ভীখমখেড়ী বৈদ্যজীর চেয়ে বেশি কাজের। সে যাই হোক, বৈদ্যজী সার বুঝেছেন যে

বর্তমান পরিস্থিতিতে জোগনাথের গ্রেফতারি হলে প্রথমে দারোগা যা চাইবেন তাই হবে। আসলে

রামাধীন ভীখমখেড়ী যা চাইছে তাই দারোগা চাইবেন।

কিন্তু রূপ্পন বাবু জিদ ধরেছেন—রামাধীনকে থানাতেই জামিন করিয়ে ছাড়িয়ে আনা হোক। তাই বৈদ্যজী

ইচ্ছে না হলেও দারোগার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছেন।

দারোগাজী এখন আর ভোর বেলায় দুঁদে দারোগা নন, মানে যিনি চোখ পাকালে গ্রামবাসীর গায়ে নীলচে

নিশান আর আর আঁচড়ে দাগ ফুটে ওঠে। এখন ওর ভারী শরীরের উর্ধভাগে সিল্কের পাঞ্জাবি আর

নিম্নাংগে খাদির পায়জামা। ঠোঁটের কোনায় পানের পিক চুঁইয়ে পড়ছে। ওঁর মুখ থেকে বৈদ্যজীর পুরো

ঘটনা শোনা হয়েছে। বৈদ্যজী অবাক হন নি, কিন্তু একটা খটকা লাগছে—জোগনাথের ঘর থেকে পুলিস

একটা দেশি কাট্টা পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করেনি!




পুলিসের সঙ্গে দীর্ঘকালীন সম্পর্কের দরুন উনি জানেন –এইধরণের গ্রেফতারির সময় পুলিস

অপরাধীর ঘর থেকে নিদেনপক্ষে একটা লোহার টুকরো হলেও বাজেয়াপ্ত করে। সেটাকে পিস্তল ধরে

নেয়া হয় আর একনজর দেখলেই কেন আঠেরশ এবং উনিশশ শতাব্দীতে মুষ্টিমেয় ইংরেজের সামনে

ভারতীয়রা হেরে যেত—সেই ঐতিহাসিক সত্য স্পষ্ট হয়।

ওনার মনে হল দারোগাজীকে ভদ্রতার খাতিরে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। তার ভূমিকা বাঁধতে গিয়ে উনি

প্রশ্ন করলেন—জোগনাথের ঘর থেকে শুধু গয়নাপত্র উদ্ধার হয়েছে? গাঁজা-ভাঙ-চরস বা আফিম

নয়?

--আমি আফিমের তল্লাসি করিনি তো। তাহলে লোকে বলত সেবার এক পার্টির এক চেলা আফিম শুদ্ধ

ধরা পড়েছে তাই এবার অন্য পার্টির একটাকে ধরা হয়েছে।




বৈদ্যজীর চোখ কপালে।

--পার্টি? কিসের পার্টি? এসব আপনি কাদের ভাষা বলছেন?

উত্তর এল রূপ্পন বাবুর থেকে—‘পুলিসের ভাষা’।

দারোগাজী চোখ মিটমিট করে ঘাড় ঝাঁকিয়ে নিজের মাথা সাফ রাখতে চেষ্টা করলেন। মনে মনে

ভাবলেন—বিলেতি মদের মধ্যে ‘জিন’ হল বড্ড দাগাবাজ। দেখতে সাদা জলের মত, কিন্তু পেটে পড়লে

জিভের আড় থাকে না। কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলি!

উনি চোখ খুললেন। বৈদ্যজীর চেহারা বেশ গম্ভীর। দারোগা ভাবলেন—এইবার কোন ত্যাড়া কথা শোনা

যাবে, তাই উনি মন দিয়ে বৈদ্যজীর মুখের দীপ্তি দেখতে লাগলেন।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in







ছাব্বিশ

ক্ষীরগ্রাম দেবী সতীর ৫১ পীঠের এক পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর আঙুলসহ ডান পায়ের পাতা পড়েছিল। দেবীকে এখানে যোগাদ্যা রুপে পূজা করা হয়।

জানা যায়, বর্ধমানের মহারাজা কীর্তি চন্দ এই গ্রামে যোগাদ্যার একটি মন্দির তৈরি করান। কিন্তু এরপর কোনও ভাবে হারিয়ে যায় প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তিটি। এরপরই সম্ভবত মহারাজার আদেশেই হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটির অনুকরণে একটি দশভূজা মহিষমর্দিনীর মূর্তি তৈরি করা হয়। তবে, পরবর্তী সময়েও নতুন তৈরি হওয়া মূর্তিটিও কিন্তু অবশ্য বছরের অন্যান্য সময়ে ডুবিয়ে রাখা হত ক্ষীরদীঘির জলেই বলে জানা যায়। কেবল ৩১ বৈশাখ দেবীকে জল থেকে তুলে এনে সর্বসমক্ষে রাখা হত।

এর মধ্যে হঠাৎই ঘটে যায় এক অলৌকিক কাণ্ড। ক্ষীরদীঘি সংস্কারের সময় হঠাৎই নতুন মূর্তির সঙ্গেই উঠে আসে ‘হারিয়ে যাওয়া’ পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটিও। এরপর, মূর্তি ফেরত পাওয়ার আনন্দে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের সাহায্যে সম্পূর্ণ আলাদা একটি মন্দির গড়ে তোলেন গ্রামের মানুষরা। সেই নতুন মন্দিরেই প্রতিষ্ঠিত হন ফিরে পাওয়া দেবী মূর্তিটি। তাই এখন গ্রামে গেলেই দেবীরদর্শন পান বহিরাগতরা। পাশাপশি সংক্রান্তিতে দুই মন্দিরেই চলে দেবীর আরাধনা।

জানা যায়, এই ক্ষীরগ্রামে একটা সময় বেশ কিছু চতুষ্পাঠী ছিল। সেই সময়ের সাক্ষী বহু প্রাচীন পুঁথি। স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের দাবি, বেশ কয়েক জন পণ্ডিত এই গ্রামে বিদ্যাচর্চা করতেন। অন্তত ৪০টি যোগাদ্যা বন্দনা পুঁথি পাওয়া গিয়েছে বলে জানা যায়। তবে জানা যায়, সবথেকে আগে যোগাদ্যা বন্দনা লিখেছিলেন কবি কৃত্তিবাস। কবির মতে, রামায়ণের কালে মহীরাবণ বধের পরে তাঁরই পূজিতা ভদ্রকালী বা যোগাদ্যাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেন রামচন্দ্র।

মন্দির থেকে অদূরে একটি টিলার উপর দেবীর ভৈরব ক্ষীরকণ্ঠ শিবের মন্দির। তাই এই গাঁয়ের নাম ক্ষীরগ্রাম, আদরের ক্ষীরগাঁ। মন্দির আর ক্ষীরদীঘি থেকে খানিকটা দূরে গ্রামের এক প্রান্তে ধামাসদীঘি। কথিত আছে, মহীরাবণকে কৌশলে বধ করে লক্ষ্মণ যখন পাতাল ত্যাগ করতে উদ্যাত হন, তখন রাবণের আরাধ্যা দেবী মহাকাল প্রভু রামচন্দ্রের সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। হনুমানের কাঁধে চেপে মহাকাল এসে ওঠেন মঙ্গলকোটের ক্ষীরগ্রামে। পুরাণ মতে, সেই সময় থেকেই দেবী মহামায়া বা মহাকালী কিংবা ভদ্রকালী যোগাদ্যা হয়ে রাঢ় বঙ্গে অন্ত্যজ শ্রেণির হাতে পূজিতা হতে শুরু করেন। শাক্ত মতে এটি সতীপীঠ। দেবীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল পড়েছিল এখানে। এখানে আলাদা কোনও কালী মূর্তি নেই । দেবীর রত্নবেদীতে কালীমন্ত্রে পুজো করা হয় দেবী যোগাদ্যাকে।
2

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in








সিলভিয়া প্লাথের কবিতা ও আত্মসন্ধান




সুপরিচিতা
সুস্মি,

তোমার ডাকে শান্তিনিকেতন যাওয়া হয়নি। তোমার কাছে অজুহাত মনে হতেই পারে। তবে সত্যিই আমি অসুস্থ ছিলাম। তোমাকে যখন লিখছি বাইরে তখন কালবৈশাখী। খানিক আগেও আকাশ ঝলমল করছিল। চোখের পলকে সকালের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যার মতন অন্ধকার। জীবন তো এমনই তাই না? তোমার চিঠি পড়তে পড়তে সিলভিয়া প্লাথের ডেথ এন্ড কোং কবিতার কয়েকটা লাইন বহুদিন পরে মনে পড়ে গেলো। Two, of course there are two. It seems perfectly natural now — The one who never looks up, whose eyes are lidded And balled, like Blake’s, Who exhibits…

কতটা রিলেট করতে পারছো জানিনা। তবে কলেজ থেকে ফেরার পথে পাদ্রী সাহেবের গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে খুব। বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা এইটুকু লিখতেই জীবনবাবুর কবিতা মনে পড়ল- চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে- সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে- কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে ! আমাদেরও দেখা হয়না কুড়ি বছর হলো। আবার অবাক করা কান্ড দেখো যে দুজনের কবিতা মনে হলো দুজনই যেন মিলেমিশে একজন। যাপনে, ভাবনায় এবং মরনেও! যদিও আমি জীবনানন্দ কে এগিয়ে রাখবো। তবুও অস্বীকার করার জায়গা নেই বিশ্বসাহিত্যে নারী কবি হিসেবে যারা সুপরিচিত তাঁদের মধ্যে মার্কিন কবি সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-১৯৬৩) অন্যতম। অথচ দেখো এই অমর কবি জীবনের কাছে প্রতারিত হয়েছেন, জীবন তাঁকে ক্রমাগত এক বিষণ্ণ, বেদনার্ত পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। জীবনের করুণ জাতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছেন। বেঁচে থাকার একঘেয়েমি কিংবা বেঁচে থাকার লড়াই তাঁকে ক্লান্ত করেছে। জীবন-মৃত্যুর দোলাচল তাঁর কবিতা আর জীবনকে ঘিরে থাকে তার মীমাংসা আমরা করতে পারি না। কেবলই পার্থিব জঞ্জাল আর বেদনাই তাঁকে অপার্থিব জগতে আকৃষ্ট করে।

জীবনানন্দকে গভীর মনোযোগ সহ নিরীক্ষণ করলেও দেখবো , কবির কাব্যশরীরে অন্ধকার প্রসঙ্গ এবং মৃত্যুচেতনার বারবাড়ন্ত যেন একটু গভীর নিকষ কালোর মত লেপ্টে রয়েছে। সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু চেতনা ঠিক জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু চেতনার মতো নয়। মৃত্যুকে জীবনানন্দ প্রেয়সী হিসাবে দেখতে চেয়েছেন প্লাথের ক্ষেত্রে মৃত্যু সর্বরোগহরা ওষুধমাত্র। সিলভিয়া শুধু জীবনাচরণে নন, বরং লেখার মেজাজে অনেকটাই কাছাকাছি থাকেন। এক অন্ধকার জগতে তাঁর কবিতার বসবাস। তবে তাঁর আঁধার জগৎ এডগার অ্যালান পোর অন্ধকার জগৎ নয়। রহস্য, রোমাঞ্চ নয়, বরং তার অন্ধকারের আড়ালে আছে ব্যথা ও বিদ্রোহের সুর। তাঁর কবিতার স্বরে নারী যন্ত্রণা, বেদনা ও মুক্তির গান খুঁজে পাওয়া যায়। অথচ সিলভিয়া বিশ্ব কবিতায় এমন এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর, যাঁর শক্তির উৎস নারীর অহম, বেদনা, গর্ব ও গর্ভ।

সিলভিয়া নিজের নারী এবং কবিসত্তার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। মাকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি হব পৃথিবীর কতিপয় নারী কবিদের অন্তর্গত এমন একজন সম্পূর্ণত আনন্দিত নারী, কোনো তিক্ত, হতাশ, বিকৃত পুরুষ-অনুকারক নয়, যে অনুকরণ অবশেষে নারী কবিদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি নারী এবং নারীজন্মে আনন্দিত। আমি গান গাইব পৃথিবীর উর্বরতার, ক্ষয়-শোক-মৃত্যুর মধ্যে মানুষের উর্বরতার গান। আমি গায়িকা হব। টেড আর আমার সুন্দর মিলিত জীবন হবে’ (উদ্ধৃতি: ভাবনার ভাস্কর্য, কেতকী কুশারী ডাইসন)।

সিলভিয়া উচ্ছল-উদ্যম জীবনযাপন করলেও তাঁর নিজের কাছেই নিজের জীবনটা খুব অদ্ভূত মনে হতো। ১৯৫২ সালে যখন স্মিথ কলেজে সদ্য ভর্তি হলেন তখন নিজের প্রতিই সিলভিয়ার প্রশ্ন ছিল—‘You walked in, laughing, tears welling confused, mingling in your throat. How can you be so many women to so many people, oh you strange girl?’ প্রথাগত কবিতার বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অভ্যন্তরীণ অনুভূতির সমন্বয়ে স্বীকারোক্তিমূলক কবিতায় নতুন একটা আবেগ উগরে দেন প্লাথ। এটা কবির মানসিক অবস্থানও বলা যায়। সিলভিয়া প্লাথের স্বীকারোক্তিমূলক কবিতায় (Confessional Poetry) অবলীলায় বলে দিয়েছেন অনেক গোপনীয় বিষয়। তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা সংখ্যাগত দিক থেকে অনেক বেশি। এবং ভাষা ও চিত্রনির্মাণ অনেক শক্তিশালী ও উন্নত। এখানে তিনি নির্ভীকভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আবেগ, সংগ্রাম প্রকাশ করেছেন। এসব কবিতার সফল অগ্রদূত বলা যায় তাঁকে। তাঁর আগে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকে স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা লিখে থাকলেও ধারাবাহিকভাবে অনেক শৈলীগত দিক, বক্তব্য-পষ্টীকরণ ও শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি দিক থেকে সিলভিয়া প্লাথ আলোচনার মূলকেন্দ্র। তিনি নারী হওয়ায় ও বাস্তব অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ (বাস্তবতা আরও বেশি ও ঝাঁজালো) করে বিশ্বের নারীবাদীদের ভরকেন্দ্রে রয়েছেন। বলে রাখি কনফেশনাল পোয়েট্রি মুভমেন্ট আমেরিকায় ১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি শুরু হয়। রবার্ট লয়্যাল, সিলভিয়া প্লাথ, অ্যানি সেক্সটন এ-আন্দোলনের প্রবক্তা। টি. এস এলিয়ট, ডব্লিউ. বি ইয়েটস প্রমুখ এ-আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এরা সবাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কবিতায় প্রকাশ (কিছুক্ষেত্রে রাখঢাক না করেই) করেছেন। আজকের ‘মি টু’ ইত্যাদি আন্দোলন অনেকটা এ ধারাবাহিকতার নতুন সংস্করণ।
মাত্র ৩০ বছরের জীবন তাঁর। ব্রিটিশ কবি টেড হিউজ তাঁর স্বামী ছিলেন। কিন্তু পরিবার ও সমাজের পাশাপাশি স্বামীর সংসারে সুখে ছিলেন বলা যায় না! ফলে সহজেই কবিতা ও লেখায় নারীর অবজ্ঞা, অবহেলা, নেতিবাচক-ধারণা ইত্যাদি বাস্তবজীবনের সঙ্গে মিশিয়ে নারীদের স্কেচ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। Daddz, Ladz Layarus, Ariel, The Applicant, Kindness, The Arrival of the Bee Box ইত্যাদি কবিতায় নারীর অন্তর্নিহিত শক্তি, বিবাহপরবর্তী নারীর নির্ভরশীলতা, নারীর স্বকীয়তা ও সৃষ্টিশীলতা, পুরুষের ওপর নারীর প্রতিশোধ, নারীর স্বাধীনতা সর্বোপরি নারীপ্রগতি ও নারী-উন্নয়নের চিত্র ফুটে উঠেছে। ছোট ছোট বাক্য, সরল শব্দ ব্যবহার করলেও সিলভিয়ার কবিতায় বহু প্রতীক, পুরাণের ব্যবহার আছে। অন্যদিকে ছোট ছোট শব্দ দিয়েই তিনি অনেক কিছু বলার চেষ্টা করেন, পুরো বাক্য বলেন না। ফলে প্রায়শই তাঁর কবিতা সহজপাঠ্য নয়। প্রায়শই তাঁর কবিতা বাড়তি মনোযোগ দাবি করে, ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। নারীবাদী কবিতা, নারীর প্রতি অবহেলা, নারী প্রগতি ও উন্নয়নের কবিতা সিলভিয়া প্লাথকে আলাদা ও সাফল্যমণ্ডিত করেছে। তাঁর কবিতায় নিজের মানসিক অবস্থা, মাতৃত্ব, পরিবার এবং বিভিন্ন সম্পর্ক সূক্ষ্মভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিতা অসামান্য এবং দক্ষতাপূর্ণে নান্দনিক ভাষা দিয়ে সৃষ্টি। কখনওবা তিনি বিভিন্ন প্রতীকীর আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর কবিতা পরিচিত বোধের চেনা পরিমণ্ডলকে বারবার আক্রমণ করেছে। চির অস্থিরতার চোরা স্রোত বয়ে চলে প্রতিটি শব্দ আঁকিবুঁকিতে। শ্লেষ্মা ছিটানো গলায় প্লাথ বলেন : And I wear the wry-faced pucker The sour lemon moon. প্লাথের Ariel কবিতা-সংকলন ব্যক্তিগত মানসিক-যন্ত্রণার বিষয়াদি জোরালোভাবে উঠে এসেছে। ১৯৬২ সালে ‘দ্য নিউ ইয়র্কারে’ প্রকাশিত প্লাথের টিউলিপস কবিতায় একটি হাসপাতালে টিউলিপের তোড়া গ্রহণকারী একজন মহিলাকে চিত্রিত করা হয়েছে। নার্সরা ‘উজ্জ্বল-সুচ’ দিয়ে মহিলাকে অসাড় করে। তিনি অ্যানেস্থেসিয়ায় আত্মহত্যা করেন। কবির কাছে সূর্যের চোখ এবং টিউলিপের চোখ যেন একই সমান্তরালে। যেন টিউলিপগুলি তাকে আঘাত করছে, তাকে দেখছে এবং তার অক্সিজেন চুষে নিচ্ছে। ''টিউলিপ''-এ শব্দের ক্ষমতায় কবিতা সত্যিই যেন দেওয়াল বেয়ে চলা সরীসৃপ। ফুলগুলোর জীবন্ত শ্বাসপ্রশ্বাস তার রোগী মনকে আরো অস্থির করে তোলে। কবিতাগুলির জীবন্ত ধুকপুক হাতের মুঠোয় ধরা যায়। টিউলিপের চোখ ফোটে লেখনীর ছোঁয়ায়। ভেসে ওঠে হাসপাতাল ঘর, শীতলতা, ওষুধের গন্ধ—কেবলমাত্র শব্দের গঠনে। খুব সহজেই শরীরের দখল ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে এক গভীর প্রতিবাদ লুকিয়ে থাকে। অভিমান কিভাবে বিশ্বজনীনতা ছুঁতে পারে প্লাথ না পড়লে বোঝা যায় না। নিজেকে জগৎ স্রষ্টার সাথে তুলনা করার দাপট তিনি দেখিয়েছেন—

I shut my eyes and the world drops dead.

গতানুগতিকতার বেড়ি মনে ও পায়ে তিনি কখনোই পরতে চান নি। অসম্ভব তেজিয়াল এক প্রেমিক সত্তা সমাজের মুখোশ, কৃত্রিম মানব সম্পর্কের জাল ছিঁড়তে চায় বারংবার। তার যন্ত্রণা তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক পটভূমির সাথে হাত মিলিয়ে জন্মায়—

"The Times are Tidy : Unlucky the hero-born In this province of the stuck record Where the most watchful cooks go jobless"

প্লাথের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রকৃতিপ্রেম খুঁজে পাওয়া যায়, যা ঠিক রোমান্টিক কবিদের মতো না হলেও কবির বুকের অসহায়ত্ব ও আশ্রয় পাবার গভীর আকুতি ধ্বনিত করে। 'The Moon and the Yew tree' এই সত্য তুলে ধরেছে। অনির্বচনীয় সন্তান স্নেহ মেলে ধরেছে Plath-এর মধ্যেকার এক মাকে :

"I want to fill it with color ducks,"

আয়নার আলোতে এগিয়ে আসে আরেক মায়ের প্রতিবিম্ব যার প্রতি একাধারে নির্ভরতা আরেক দিকে বিদ্বেষ, ঘৃণা লক্ষণীয়। Mirror—"I am important to her. She comes and goes,/ Each morning it is her face that replaces the darkness,/ In me she has drowned a young girl and in me old woman".

সিলভিয়া প্লাথ ভালো চিত্রকরও ছিলেন, ছবিতে রঙের ব্যবহার ছবিকে যেমন অনেক বেশি ধ্রুপদী করে তোলে তাঁর কবিতাতেও সেই রঙের ব্যবহার দেখতে পাই খুব নিপুণভাবে। ধারণা করা হয় ১৯৬৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে লেখা ‘প্রান্তরেখা’ (Edge) কবিতাটিই সিলভিয়া প্লাথের লেখা সর্বশেষ কবিতা। আত্মহত্যার মাত্র ছয় দিন আগে লেখা এই কবিতাটি তার ‘সুইসাইড নোট’ বলা যায়। আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের মানসিকতার একটা উৎকৃষ্ট নমুনা এই কবিতা। এই কবিতায় সিলভিয়া নারীর অর্থহীন জীবনকে তুলে ধরেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের ইচ্ছা ছাড়া নারী কিছুই করতে পারে না। আবার নারীর সব কাজকেই বিশেষত গৃহকর্মকে গুরুত্বহীন, অর্থহীন মনে করা হয়। প্লাথ তাই এমন এক মৃত নারীর কথা বলেছেন যার পূর্ণতা প্রাপ্তি হয় কেবল মৃত্যুতে। তাঁর ভাষায়, মৃত্যুতেই ‘নারীটি স্বার্থক পূর্ণতা পেয়েছে’। নারীর শরীর মৃত্যুর পর হেসে উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘প্রান্তরেখা’ সিলভিয়া প্লাথের সবচেয়ে তমসাচ্ছন্ন কবিতা (darkest poem)। এই কবিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রঙের ব্যবহার। সাদা, লাল আর কালো এই তিনটি রং এখানে রবার্ট গ্রেভসের ‘সাদা দেবীগণ’ তত্ত্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশ শতকের মাঝামাঝি পুরাণবিদ গ্রেভস রচনা করেন ‘দ্য হোয়াইট গডেস’। তিনি ইউরোপীয় মূর্তি পূজারিদের দেবীদের সম্পর্কে আলোচনা করে দেখান যে আসলে একজন দেবীই নানা নামে ও পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল। জন্মদান, জীবন ধারণ আর মৃত্যু আদতে একই নারী সত্তার কুমারীকাল, মাতৃত্বকাল এবং বৃদ্ধাকালের রূপান্তরিত চেহারা। এই তত্ত্ব মতে, সাদা হলো কুমারীর রং, লাল হলো মাতৃত্বের রং আর কালো হলো বয়োবৃদ্ধ কিংবা মৃত্যুর রং। সিলভিয়া এই প্রতীক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই তার শেষ কবিতায় ‘সাদা সাপ’ ‘দুধের পাত্র’, ‘গোলাপ’, ‘রক্তাক্ত সৌরভ’, ‘রাত্রি’, ‘চাঁদ’, ‘কৃষ্ণতা’ ইত্যাদি চিত্রময়তা ব্যবহার করেছেন। সিলিভিয়ার সমগ্র কবিতাতেই রঙের প্রতীকী ব্যবহার দারুণভাবে করা হয়েছে। আরেকটি বিখ্যাত এবং জটিল কবিতা ‘লেডি ল্যাজারাস’। সিলভিয়া প্লাথের রচনারীতি বোঝার জন্য এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা। ‘ড্যাডি’র মতো এ কবিতাতেও নাৎসি বাহিনীর অত্যাচার আর হতাকাণ্ডের চিত্র ফুটে উঠেছে। নাৎসিরা বন্দীদের চামড়া থেকে সাবান আর ল্যাম্পের শেড বানাত—কবিতার চতুর্থ ও পঞ্চম লাইনেই সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন সিলভিয়া। অন্যদিকে প্লাথের আত্মহত্যাপ্রবণতা, ক্রমাগতে মরতে চাওয়ার চেষ্টা এই কবিতা এসেছে। ‘ড্যাডি’ কবিতার মতোই এ কবিতাতেও জার্মান ভাষার ব্যবহার রয়েছে তার পিতার উত্তরসূরি সূত্রেই। অন্যদিকে জনাব শত্রু বলতে স্বামী টেড হিউজকে বুঝিয়েছেন তিনি। পুরুষ বলতেই পিতা ও স্বামীর কথা এসেছে তার কবিতায় বারবার। পুরাণের আগুনপাখি ফিনিক্স এ কবিতায় প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ফিনিক্স সেই পাখি, যাকে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় এবং পোড়া ছাই থেকে তার বারবার জন্ম হয়। সিলভিয়া প্লাথও যেন বারবার মৃত্যু থেকে ফিরে আসেন। তিনি এ কবিতা যেন ডাক্তার মহাশয়ের উদ্দেশে লিখেছেন। প্রতি দশ বছরে একবার করে মরতে চাওয়া সিলভিয়াকে বারবার ডাক্তাররাই ফিরিয়ে এনেছে। তাই পরেরবার যখন সে মরার প্রস্তুতি নেবে তখন ডাক্তার আর পুরুষদের আগে খাবে।

১৪৩২ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে তোমাকে কি আর দিতে পারি বলো- কলেজ দিনে যেমন কবিতা পাঠাতাম তেমনি কবিতা পাঠালাম তবে আমার লেখা নয়, সিলভিয়া প্লাথের কবিতার ভাবানুবাদ করে পাঠালাম। নিরন্তর ভালো থেকো।


পরিত্যক্তা (Jilted)

ভাবনাগুলো আজ শুকনো পাতার মতো—
কোনো এক হলদে বিকেলের স্তব্ধতায় ভেজা,

চোখ জুড়ে অম্ল জল

তিতকুটে চাহনির এক বিষণ্ণ, টক-হলুদ তারা
কাঁপছে নিঃশব্দ বিষাদের জ্বালায়।

রাতের হাওয়া ফিসফিসে—
ভালোবাসা নামে গুজব বয়ে আনে,
চাঁদের মুখে দেখি নিজের ছায়া—
এক পেকে না-ওঠা পাতিলেবুর ভাঁজ।

হৃদয়—
গ্রীষ্মের কাঁচা বরই,
ঝুলে আছে
শুকনো এক ডালে—
ছোট, সবুজ, তেতো।


রাত তিনটার মনোলগ (Monologue At 3 AM)

বরং অস্তিত্বের সব তার ছিঁড়ে যাক
উফ, মাথার ভেতর কী কষ্ট
রক্ত শুধু রক্ত ছিটকে পড়েছে
রক্তে ভিজে যাচ্ছে উজ্জ্বল চৌকি, কার্পেট, মেঝে —
আর দেয়ালের পাশে ঝুলে থাকা সাপ মার্কা বর্ষপঞ্জিকা সাক্ষ্য দেয় —
তুমি বহুদূর —মাঝখানে অস্তিত্বের একদিকে আমি অন্যদিকে তুমি
তুমি বেশ আছো সতেজতায় আর আমি —
এই নিঃশব্দ তারাদের নিচে কালো সময়ের অভিশাপ,
বিদায় সম্ভাষণ, জ্বালা করা চোখে বিদায়ী রেলগাড়ির স্মৃতি জড়িয়ে ধরে
সব হারিয়ে,
তোমার দিকেই তাকিয়ে আমার জগৎ
মুখের উপর দরজা বন্ধ করেছে
আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি আবারও।


ইতি—

বাসু
১৫ এপ্রিল,২০২৫
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















১০

জেরাল্ডের এপার্টমেন্টটার কথা আগেই লিখেছি। তবে সেটার খুঁটিনাটি বর্ণনা এখন থাক। পরে যখন বের্নহার্ড সেখানে যাবে, তখন নাহয় তার চোখ দিয়েই আমরা সেখানকার ব্যাপারস্যাপার জেনে নেব।

আসলে সবারই টাকাকড়ির প্রয়োজন। অদ্ভুত এইসব ছেলেমেয়েগুলো যারা বাড়িঘর ছেড়ে এসে শহরে পড়ে আছে, যাদের এখনও কোনো চাকরিবাকরি জোটেনি, অথচ সবার প্রতিভা আছে। প্যারিসে আসবার পর প্রথম প্রথম সবার বেশ আত্মবিশ্বাস থাকে; কিন্তু কিছুদিন পরে আর ভেবে কূলকিনারা পায় না যে কী ভাবে কোন কাজ করা উচিত। নিজেদের দুর্ভাগা মনে করতে শুরু করে তারা, এবং এই পরিস্থিতি যদি অনেকদিন ধরে চলে, তাহলে যেভাবে হোক টাকাকড়ি রোজগার করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই তখন তাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যে পরিণত হয়।

ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু আবার খুব অনায়াস সুন্দরও নয় যখন মানুষ নিজের সহজাত প্রবৃত্তিতেই অস্তিত্বরক্ষার লড়াইতে নেমে পড়ে। পুরো প্রক্রিয়াটা সাধারণত স্থূল প্রকারের হয়; তাছাড়া এই প্রক্রিয়াটা অবিরত চলতে থাকে। সবকিছু হঠাৎ নগ্ন এবং বেয়াব্রু হয়ে পড়ে এবং মানুষ অদ্ভুত উদ্ধত এবং হিংস্র আচরণ করতে শুরু করে। বের্নহার্ড নিজের স্কুলে বা সঙ্গীতবিদ্যালয়ের ছেলেদের মধ্যে এর আগে এরকম ব্যাপার দেখেছে। ফার্দিনান্দের মাসের শেষের দিকে পয়সা ফুরিয়ে যেত। তখন সসেজ আর বাঁধাকপির স্যালাদ খাবার জন্য সে অন্যের কাছ থেকে ধার করত। কিন্তু সবসময় কাছাকাছি কোনো না কোনও অভিভাবক থাকতেনই, বাবা মা কিম্বা মাসি কিম্বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য বা পারিবারিক বন্ধু। কোথাও না কোথাও একটা অবলম্বন বা নির্ভরতা থাকত। কিন্তু এখানে, মানে প্যারিসে, সে এমন অনেককে দেখেছে, যারা বলে যে “জে নে তু সাঁপ্লুমো পেরসোঁ” মানে তাদের একেবারে কেউ নেই। এই “Je n'ai tout simplement personne” শব্দটা, মানে দুনিয়ায় একেবারে কেউ না থাকার ব্যাপারটা বের্নহার্ড প্রথম শুনেছিল এক তরুণ রাশিয়ানের কাছে, যে লাঞ্চ করবার পরে তাকে বলেছিল টাকাটা দিয়ে দিতে, কারণ সে একেবারে কপর্দকশূন্য।

বের্নহার্ডের বাড়িওয়ালী মাদাম দুবোয়ার কাছে আরও একজন ছাত্র থাকে, চার্লস, যে নিজের স্নাতক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছেলেটা বেশ লক্ষ্মীছাড়া ধরনের, উনিশ বছর বয়স, গতবছরের দ্বিতীয় সেমিস্টারে ফেল করেছে। ছেলেটার বাবা একটা ছোট মফস্বল শহরে থাকেন। প্রতি মাসে তিনি ছেলেকে একটা করে চিঠি লেখেন। তিনি মাদাম দুবোয়ার কাছে সরাসরি টাকা পাঠিয়ে দেন। মাদাম দুবোয়া সেই টাকা থেকে মাসে চার বার করে প্রতি সপ্তাহে চার্লসের হাতে দরকারি টাকাকড়ি দেন; অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে হিসেব করে তিনি এই কাজটা করেন এবং অগ্রিম একেবারেই দিতে চান না। তাছাড়া তিনি সব কাপড়জামা ধুয়ে ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখেন, যদিও সেসব করতে তিনি একেবারেই বাধ্য নন। চার্লসকে তিনি মায়ের মতই যত্নআত্তি করেন। বের্নহার্ড এখানে আসবার আগে সে একাই ছিল মাদাম দুবোয়ার বাড়িতে। কিন্তু এই তরুণ গাঢ় ব্লন্‌ড চুলের জার্মান এই বাড়িতে এসে তার রাজত্বে ভাগ বসিয়েছে। মাদাম দুবোয়ার হৃদয়ে সম্ভবত চার্লসের জন্য আগের মত স্নেহ আর নেই। অনেক কিছু ঘটেছে। এই নতুন ছেলেটা শুধু যে নিজের ঘরদোর ঠিকমত গোছগাছ করে রাখে, তাই নয়, দেখা হলেই খুব সুন্দর করে মাদাম দুবোয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ স্বরে সুপ্রভাত জানায় এবং জিজ্ঞেস করে যে কেমন আছেন তিনি। মাদাম দুবোয়া চার্লসের জামাকাপড়, স্যুট ধুয়ে ইস্ত্রি করে দিলেও সে কখনই উল্টে কিছু বলে না, বরঞ্চ এমন ভাব করে যেন এসব তার জন্মগত অধিকার। এদিকে বের্নহার্ডকে মাদাম দুবোয়া যে কোনও কিছু পরিষেবা দিলেই সে সঙ্গে সঙ্গে ধন্যবাদ জানায়।

এছাড়াও চার্লসের বেশ কিছু বদ অভ্যাস আছে, যে কারণে ক্রমশ মাদাম দুবোয়ার স্নেহের জায়গাটা থেকে সে সরে যাচ্ছে। প্রতি রাতে সে দেরি করে ফেরে বাড়িতে। এপার্টমেন্টের দরজাটা খুলে ঢুকবার সময় প্রচুর আওয়াজ করে এবং সাধারণত করিডোরের আলোটা নেভাতে ভুলে যায়। মাঝরাত অবধি নিজের ঘরে বসে সিগারেট খায়, তারপর সিগারেটের পেছনের অংশটা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে ঘরের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে। বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে ঘরে বসে খায় তারপর বাকি খাবার কাগজে মুড়ে ড্রেসিং টেবিলে রেখে দেয় দিনের পর দিন। এইসমস্ত বদ অভ্যাস বাড়িওয়ালীকে সহ্য করতে হয়। তবুও এমনিতে সব মিলিয়ে তার ব্যবহার খারাপ নয় বলে মাদাম দুবোয়া তার এই বদ অভ্যাসগুলিকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখে থাকেন। তিনি তলিয়ে ভেবে দেখেছেন যে হয়তো শিশুকালের কিম্বা সাম্প্রতিক কোনও যন্ত্রণাকাতর অভিজ্ঞতার ফলেই চার্লস এত অগোছালো আর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এইসব পর্যবেক্ষণ করে মাদাম দুবোয়ার হৃদয় স্নেহে দ্রব হয়ে যায়, আবার একই সঙ্গে তিনি কিছুটা অপরাধবোধেও ভোগেন; কারণ তিনি এরই মধ্যে সুন্দর এই জার্মান কিশোর বের্নহার্ডকে এই অগোছালো তরুণ চার্লসের থেকে একটু বেশি স্নেহ করতে শুরু করেছেন।

একদিন সকালে দু’জনের দেখা হল সিঁড়িতে। চার্লস থেমে দাঁড়িয়ে বের্নহার্ডকে বলে, ‘আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।’ বের্নহার্ড বিনীতভঙ্গিতে বলে ‘নিশ্চয়ই’। তারপর চার্লসের পিছুপিছু তার ঘরে যায়। চার্লসের ঘর তার ঘরের উল্টোদিকেই। চার্লস তার ঘরের জানালা বন্ধ করে একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়। বের্নহার্ড ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে যে বেশ কিছু বই চারদিকে ছড়ানো ছেটানো রয়েছে। বেশির ভাগ পাঠ্য বই, কুর্স সুপেরিয়া অথবা মধ্যযুগের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। চার্লসের মেজাজমর্জির সঙ্গে বইগুলো ঠিক খাপ খাচ্ছে না…

দু’জনে মুখোমুখি বসে। তাদের হাত টেবিলের উপরে রাখে। টেবিল ল্যাম্পের আলো পড়ে তাদের মুখে।

চার্লসকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। দুই চোখ দিয়ে যেন সে গোটা দুনিয়াটা গিলে নেবে। প্রতিটি কথার সঙ্গে এলোমেলো নিঃশ্বাস পড়ছে। সে যেভাবে কথা বলছে, নিজের মনের ভাব প্রকাশ করবার চেষ্টা করছে, এই পুরো প্রক্রিয়াটা ভয়ানক ক্লান্তিকর। সে যেন সঠিক শব্দটি খুঁজে পাচ্ছে না কথা বলতে গিয়ে, নিজস্ব বক্তব্যের মধ্যে স্বচ্ছতা আর ব্যাপ্তি আনবার চেষ্টা করতে গিয়ে যেন ক্রমাগত লড়াই করে চলেছে এই তরুণ। প্রথম সাক্ষাতে তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বের্নহার্ডের বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। সে বুঝতে পারছে না যে চার্লস তার কাছ থেকে কী চায়। হঠাৎ তার নিজের স্কুলের বন্ধু কার্লের কথা মনে পড়ল, যার সঙ্গে মিলেমিশে সে লাতিন ক্লাসের প্রজেক্টগুলো করত। কার্লেরও ভাল নাম চার্লস, যদিও এই সামনে বসে থাকা ফ্যাকাসে, ভয়ঙ্কর প্রলাপ বকে যাওয়া ঘোরগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কার্লের তেমন কোনও মিল নেই।

কিন্তু চার্লস তার কাছে ঠিক কী চায়? বের্নহার্ড জানে না যে তার পক্ষে আদৌ কতখানি করা সম্ভব চার্লসের জন্য। চার্লস যে ভীষণ বাড়াবাড়ি রকমের অস্বাভাবিক আচরণ করছে, নিশ্চয়ই তার পেছনে কোনও কারণ আছে: চার্লসের জীবনে নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক কিছু ঘটে গেছে। সেগুলোর মুখোমুখি হতে পারছে না সে, কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করছে। অপ্রত্যাশিতভাবে সে বিস্মিত হয়েছে, নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে তার, অসহায় বোধ করছে সে। তার মনে হচ্ছে যে তার পাশে এখন কেউ নেই।

পুরো ঘটনাতে অবশ্যই তার নিজের দোষ আছে। অদ্ভুত অযৌক্তিক এক জীবন সে যাপন করছে। কোনও কিছুতে পরোয়া নেই, লজ্জা নেই। নিজের শরীরের যত্ন নেই, অথচ সে যে শারীরিকভাবে খুব শক্তিশালী বা সুস্থ, ব্যাপারটা এমনও নয়। শুধু শরীর নয়, তার আত্মাও ভুগে চলেছে তার অতিরিক্ত চাহিদার কারণে। চার্লসকে বাইরে থেকে যতই রুক্ষ এবং নির্মম দেখাক না কেন, ভেতরে ভেতরে সে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ এবং সংবেদনশীল। সে যে কাজেই হাত দেয়, সেটা করতে গিয়ে তার কোনও মাত্রাজ্ঞান থাকে না। যে কোনো বিপদ, যে কোনও অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে আগ বাড়িয়ে এগিয়ে যায় এবং তারপর বিপজ্জনক ভাবে তার মধ্যে ফেঁসে যায়। যদি কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে যে সে কেন এমন করছে, কারণ সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও এক অর্থহীন জীবন যাপন করছে, তাহলে হয়তো উত্তরে সে বলবে যে সে নিজেকে নিজেই ঘেন্না করে।

‘জে মি দিতেস্ত’ (Je me déteste)… ‘আমি নিজেকে ঘেন্না করি’ এই হল তার প্রতিদিনের লব্জ। যদিও এইসব কথা সাধারণত মানুষ ধর্তব্যের মধ্যে আনে না, তবুও এইসব কথা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় তার আত্মধ্বংসী মানসিকতা।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২০.২

ওই তিন নম্বর কিসসার জাদুতেই রঙ্গনাথ আজকাল ভয়ডর শিকেয় তুলে বেলাকে নিয়ে কল্পনা করতে শুরু করেছে। ক’দিন আগে মেলা থেকে ফেরার সময় রুপ্পনবাবুর প্রেমপত্র নিয়ে যে কিসসাটি শুনেছিল তারপর আর রুপ্পনের সঙ্গে এ’নিয়ে কোন কথাবার্তা বলার হিম্মৎ হয়নি। এখন এই খালি সময়ে বেলাকে নিয়ে ওর মনে যে ঝড় উঠেছে সেটা শান্ত করতে ওর সহায় শুধু কল্পনা, হস্তমৈথুন আর কুন্ঠা ছাড়া উপায় কি! তবে এইসব যুগে যুগে শিল্পীদের প্রেরণা যুগিয়েছে। তাই এখন রঙ্গনাথ এক শিল্পীর জীবনযাপন করছে বলা যেতে পারে।

ও দেখতে কেমন?

“মধুমতী” সিনেমার বৈজয়ন্তীমালার মত? নাকি “গোদান”এর শুভা খোটে? অথবা “অভিযান” এর ওয়াহিদা রহমান? না না, এরা সব তো অনেক আগেই ভারতমাতা হয়ে গেছে। বেলা এখনও বেশ তাজা। কেমন হবে? জানা নেই। কিন্তু যাই হোক, যেমনই হোক, হবে তো “ খুদা কী কসম লাজবাব”! চৌধবী কা চাঁদ সিনেমার গানের কলি রঙ্গনাথের গলায় হাড়ের মত আটকে গেছে, তবু মুখে হাসি ফুটেছে। অন্ধকারে প্রায় দেড় ইঞ্চি চওড়া মুচকি হাসি, বড় মধুর।

বেলাকে নিয়ে অনেক ভেবেছে। এত ভেবেছে যে নানান মাপের এবং ওজনের শ’খানেক নিতম্ব ও স্তন ওর মাথায় ভাসছে আর ডুবছে। ওগুলো জোড়ায় জোড়ায় হাজির হয়, গোছা গোছা ফুটে ওঠে, তারপর একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। রঙ্গনাথের খুব ইচ্ছে যে এগুলো থেকে একটা ভরন্ত নারী শরীর দেখা দিক, কিন্তু সে গুড়ে বালি! ওর কল্পনায় একবার একটি নারীদেহ এল বটে, কিন্তু তাতে চেহারা গায়েব! ওর মনে খানিকক্ষণ কুছ বাতিল স্তনের গোলা আকার খেলা করতে লাগল। শেষে, উত্তিষ্ঠত-জাগ্রত শরীরকে ঢিলে করার পর ও লেপের ভেতর সেঁধিয়ে গেল।

পরের রাত। রঙ্গনাথ ছাতে একা শুয়ে রয়েছে। কিন্তু বেলার কথা ভুলে গিয়ে ওর মামা বৈদ্যজীর ক্রোধে তমতম করা বীর্যময় চেহারা মনে পড়ছে।

দিনের বেলা শনীচর আর কালিকাপ্রসাদের চেষ্টায় তৈরি কো- অপারেটিভ ফার্মের উদ্বোধন হয়েছিল। মুখ্য অতিথি হয়ে যে অফিসার এসেছিলেন বৈদ্যজী তাঁকে নিজের সমবায় ইউনিয়নে টাকা তছরুপের ঘটনার উল্লেখ করলেন। তারপর ওনাকে মনে করিয়ে দিলেন যে তছরুপ হওয়া টাকা যাতে সরকার অনুদান হিসেবে সমবায় ইউনিয়নকে দিয়ে দেয় সে’ বাবদ একটি প্রস্তাব ওনাদের দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

বৈদ্যজী শীতল স্বরে ওনাকে বোঝাতে চাইলেন যে সরকার ওই অনুদান না দিলে এটাই বোঝা যাবে যে সরকারি আমলারা সমবায় আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎসুক নন।

অফিসারটি বোধহয় ডেল কার্নেগীর বিখ্যাত “প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ” বইটি সদ্য সদ্য পড়েছেন। উনি বৈদ্যজীর প্রত্যেকটি কথায় বলতে লাগলেন “আপনি ঠিক বলেছেন, কিন্তু ----“। এই বাক্যটি উনি সাতবার আউড়েছিলেন। আটবারের সময় ওনার গলার থেকে “আপনি অনুদান পেয়ে যাবেন” গোছের সুমধুর গান ঠিক বেরয় নি। বরং সেই পুরনো হেজে যাওয়া বাক্য-- “আপনি ঠিক বলেছেন, কিন্তু—“।

এবার শোনামাত্র বৈদ্যজীর মধ্যে দুর্বাসা মুনির ক্রোধ, হিটলারের একনায়কত্ব এবং নেহেরুর বিরক্তি একসঙ্গে জেগে উঠল। আর উনি সেই অফিসারের আদ্যশ্রাদ্ধ করতে লাগলেন—“এভাবে দেশোদ্ধার করবেন? এইসব ‘কিন্তু’,’পরন্তু’, ‘অধিকন্তু’, ‘তথাপি’ দিয়ে? এসব কী? শ্রীমান্‌ এগুলো নপুংসকের ভাষা। অকর্মণ্য ব্যক্তি এভাবেই নিজেকে এবং দেশকে বঞ্চিত করে থাকে। আপনার নির্ণয় স্পষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু! পরন্তু! থুঃ”!

বৈদ্যজী থামলেন না। দেশের দুর্দশা নিয়ে এক পেল্লায় লেকচার ঝাড়লেন। তাতেও পুরোপুরি শান্ত না হয়ে খানিকক্ষণ গজগজ করতে লাগলেন। অফিসারটিও অনেক বিনম্র, কিন্তু খানিকক্ষণ গজগজ করলেন। তারপর বাকি সবাই গজগজ করতে লাগল। শনিচরের জলসা তো অনেক আগেই শেষ। কাজেই এই সব গজগজানিতে ওর সাফল্যে কোন কলংকের দাগ লাগেনি। তবে শেষ পর্য্যন্ত গজগজানিরই জয়!

রঙ্গনাথ ওর শহরবাসের সময় এ’ধরণের গজগজানি অনেক শুনেছে। সব সময়, সব জায়গায়। ও জানত যে আমাদের দেশ হল গজগজানির দেশ। অফিসে, দোকানে, কলকারখানায়, পার্ক এবং হোটেলে, খবরের কাগজে, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধে—যেদিকে তাকাও লোক গজগজ করছে তো করছেই। ও ভাল করে বুঝে গেছল—এটাই আমাদের যুগের চেতনা।

তবে এখানে গাঁয়ে এসেও সেই গজগজানি! চাষিরা সরকারি আমলাদের নিয়ে গজগজ করে। আমলারা প্রথমে জনতার থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে জনতার বিরুদ্ধে গজগজ করে। তারপর এক নিঃশ্বাসে নিজেকে সরকার থেকে আলাদা করে সরকারের বিরুদ্ধে গজগজ করে। সবারই কোন না কোন কষ্ট, কিন্তু কেউ দুঃখকষ্টের মূলে যেতে রাজি নয়। কষ্টের যা কিছু তাৎক্ষণিক কারণ চোখে পড়ছে শুধু সেটা নিয়েই যত গজগজানি!

কিন্তু বৈদ্যজী ছিলেন ব্যতিক্রম, কখনও গজগজ করতেন না। আজ রঙ্গনাথের বুক ভেঙে গেল। ও ভেবেছিল মামাজী প্রথমে পবিত্র ক্রোধে গর্জে উঠবেন, ফের শুরু হবে প্রচন্ড বৃষ্টি, মুষলাধার। উনি গর্জে তো উঠেছিলেন, ফের গজর গজর করে বসে পড়লেন।

কেন?

ওই অফিসারটি লেজ নাড়াতে নাড়াতে এবং গজগজ করতে করতে ইশারা করল যে কো-অপারেটিভের তবিল তছরুপের ব্যাপারে স্পেশ্যাল অডিট করানো জরুরী।

রঙ্গনাথ ভাবল—এটা গর্জে ওঠার নয়, বরং গজর গজর করার দেশ।


রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে এক স্থুল কর্কশ আওয়াজ রঙ্গনাথের কানে থাপ্পড়ের মত আছড়ে পড়ল। কুশহরপ্রসাদ নিজের ঘরের চৌকাঠে বসে কাউকে গাল পাড়ছে। ও গজগজকরার দলের বুড়ো নেতা বটেন। কিন্তু ও কান্নাকাটি করছে না এবং ওর গালাগালের লক্ষ্য ওর ছেলে ছোটে পালোয়ান নয়, অন্য কেউ। কাকে গালি দিচ্ছে বোঝা মুশকিল। কারণ, কুশহর যখন ছোটেকে গালি না দিয়ে অন্য কাউকে দেয়, তখন অস্পষ্ট ভাববাচ্যে বলে। যেমন জঙ্গলে ময়ুর নাচে, উদবোধনের সময় নেতাগণ বলে থাকেন।

শব্দ! নিতান্ত জুমলা মাত্র। কুশহরপ্রসাদ থেকে থেকে গরজায়, ফের চুপ মেরে যায়। গাঁয়ের অন্য মুড়োয় একটা নেড়ি কুকুর ভৌ ভৌ করে, তারপর হঠাৎ ক্যাঁ ক্যাঁ করে ওঠে। মনের ভেতর কুকুরটার যে ছবি ফুটে ওঠে তাহল-- লেজ পেছনের দু’পায়ের ফাঁকে, মুখটা বুকের উপর ত্যাড়া হয়ে লটকে আছে, আর ডানদিক থেকে কারও লাঠির বাড়ি খেয়ে এঁকে বেঁকে চলছে। আরও ক’টা কুকুর ডেকে ওঠে।

রামাধীন ভীখমখেড়বী’র বাড়ির দরজা থেকে কোন নবযুবকের চড়া সুরে মিনমিন করে গাওয়া গান ভেসে আসছে। কান পেতে শুনলে বোঝা যায় ওটা কোন যাত্রাপালার গানের কলি।

“তোর মুখের কথা শুনে আমি এই বুঝেছি সার,

প্রেমে পড়েছিস কোন কাঙালের—চিত্ত চমৎকার”।

ও বারবার ওই একটা লাইন গেয়ে চলেছে। গাইতে গাইতে ওর গলা ধরে যায়, স্বর কেঁপে ওঠে। এটা হয়ত দেশি চোলাইয়ের প্রভাব, অথবা সত্যিই সে নিজের প্রেমিকার দুর্ভাগ্যে কাঁদছে। কেন যে এক ভিখিরির প্রেমে পড়ল! গাঁয়ের চার-পাঁচটা বখাটে ছোঁড়া নীচের গলি দিয়ে চলে গেল। গয়াদীনের ঘরে চুরি হওয়ার পর থেকে ওরা পালা করে রাত-পাহারা দেয়। আর “জাগতে রহো” হাঁক পাড়তে পাড়তে কিছু নতুন শ্লোগান তৈরি করে নেয়।

“জাগতে রহো!

সিকি আধুলি রূপোর চাঁদি,

জয় হোক তোমার মহাত্মা গাঁধী”!

সব শ্লোগানই মহা ফালতু। এখন সিকি আধুলির চলন কোথায়? সব তো পঁচিশ আর পঞ্চাশ নয়া পয়সা। সিকি খতম, আধুলি খতম, মহাত্মা গান্ধীও খতম। এরা বুঝে না বুঝে, কিছু না ভেবে স্লোগান দিয়ে যায়। কোথাও একটা রেলগাড়ি যাচ্ছে। ইঞ্জিনের তীব্র সিটি দূরে মিলিয়ে যেতে যেতে এসব শ্লোগানের উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত স্বরকে খানিকক্ষণ চেপে দেয়।

ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসা আওয়াজ আর গাঢ় অন্ধকারের মাঝে কখন যে ঘুম এসে গেছল! ঘুমের মধ্যে রঙ্গনাথের মনে হল ও একটা লিফটে চড়ে দ্রুত বেশ ক’টা তলা ছাড়িয়ে নীচে নামছে। হঠাৎ লিফট এক ঝটকায় তিন চার তলা ছাড়িয়ে উপরে উঠতে লাগল। রঙ্গনাথ ছটফটিয়ে উঠল।

নারকেল তেল আর কোন শস্তা সেন্টের গন্ধ ওর নাকে ঢুকছে। গন্ধটা না ভাল, না বিচ্ছিরি—শুধু গন্ধ মাত্র। চুড়ির হালকা রিনিঠিনি ওর ঘুমন্ত চেতনায় এক ধাক্কা দিল। এক মুহুর্তে ওর এমন অনুভূতি হল যা সারাজীবন খাজুরাহো কোণার্কের শিল্পকলা অধ্যয়ন করেও মানুষ শিখতে পারে না।

মেয়েটি এসে খাটিয়ার এক কোণায় বসেছে। ওর এক হাত রঙ্গনাথের অন্য পাশে। রঙ্গনা্থে বুকে এক জোড়া স্তনের ভারী চাপ। যদিও ওই যুগল স্তন আর ওর বুকের মাঝখানে স্তন ঢাকা কাপড় এবং রঙ্গনাথের লেপ রয়েছে। তবু স্তনের দৃঢ় স্পর্শ এবং উষ্ণতা সব বাধা পেরিয়ে ওকে স্পর্শ করছে। রঙ্গনাথের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়।

কেউ রঙ্গনাথের মুখের থেকে লেপ সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঘুরঘুট্টি আঁধারে কেউ কাউকে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। ওর বুকে বারুদ ভরা উষ্ণ স্পর্শের ছোঁয়া আর চাপ যেন আরও বেড়ে গেছে। তখনই ওর গালের উপর এক কোমল রেশমী গাল নেমে এল। কেউ গহন নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল- ওমা, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?

রঙ্গনাথের ঘুম হাওয়া হয়ে গেছে। ও মাথা নাড়ল আর মুখ থেকে এক অস্বাভাবিক স্বর বেরিয়ে এল—কে? কে তুমি?

এক মুহুর্তের জন্য বুকের উপর চেপে বসা যুগল স্তনের ধুকধুকি থেমে গেল। কেউ এক লাফে খাটিয়া থেকে সরে ছাদের এক কোণে চলে গিয়েছে। চাপা গলায় মেয়েলি স্বরে শোনা গেল—‘হায় মেরী মাইয়া’!

ও মাগো!

মাকে স্মরণ করা খুব ভালো। কিন্তু এখন শুধু ঘাবড়ে গিয়ে মুখ থেকে মাতৃনাম বেরিয়েছে। রঙ্গনাথ লেপ ছুঁড়ে ফেলে উঠে বসেছে। কিন্তু ততক্ষণে অজানা অদেখা মেয়েটি এই ছাত থেকে ওই ছাত, সেখান থেকে সেই ছাত করে-টরে আর কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেছে।

খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ও বারান্দায় এল। বাইরে ঠান্ডা। ও কান খাড়া করে চেষ্টা করল—যদি কিছু শোনা যায়। কিন্তু হাওয়ার সরসরানি ছাড়া আর কিছু পেল না। যে এসেছিল তার “‘হায় মেরী মাইয়া’ বলে মাতার পবিত্র নাম স্মরণের পরে আর কিছু বোঝার বাকি ছিল না।

দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ফের খাটিয়ায় শোয়ার সময় ওর কিছু ব্যাপার মাথায় ঢুকল।

প্রথম, কোণার্ক, ভুবনেশ্বর, খাজুরাহোর নারীমূর্তির উরোজ যদি পাথরের রূপ ছেড়ে কারও বুকে চেপে বসে তাহলে কাউকে পাগল করার জন্যে যথেষ্ট।

দ্বিতীয়, পুরাতত্ত্ব এবং ভারতীয় শিল্পকলা নিয়ে আজ অব্দি যা পড়েছে সব ফালতু, ভুলে ভরা।

তৃতীয়, ভারতীয় শিল্পকলায় ডক্টরেট করার চেয়ে সুরলোকের সুন্দরীদের মত দুই জীবন্ত স্তনের আশ্রয় পাওয়া সফলতার পরাকাষ্ঠা।

আর এসব হালকা এলোমেলো কথার আড়ালে যে আসল কথা, যে আফশোস ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে তা হল—শ্রীমান, আপনি একটা বোকাপাঁঠা! চেঁচানোর কী দরকার ছিল? ঘাবড়ে গেলে কেন? ওকে আরও কিছু করার সুযোগ দিয়ে দেখতে? তা না---!

শ্রীমান, আপনি শুধু বোকাপাঁঠাই নন, একটা গাধাও বটেন।

শ্রীমান, আপনি ওসব কিস্যু না। শুধু একজন সাধারণ হিন্দুস্তানী ছাত্র, ব্যস্‌। যার কপালে শুধু মেয়েদের ছবিই সম্বল।

অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও ঘুম এল না। একবার কিছু না ভেবেই নিজের বুক ছুঁয়ে দেখল। নাঃ, ওখানে কিছু নেই। শুধু নিজের রোমশ বুক।

কে মেয়েটি? ভাবার চেষ্টা করল, কিন্তু বৃথা। ওর চেতনা আচ্ছন্ন করে জোড়া পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে যে!

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in



















পঁচিশ

আজ সমীরণ ক্ষীরগ্রাম যাওয়া ঠিক করল।সমীরণ বলল, জনশ্রুতি অনুসারে এই জলাশয়ের দক্ষিণ দিকে দেবী সতীর ডান পায়ের আঙুল পড়েছে। দেবী যোগাদ্যা মায়ের স্থায়ী বাসস্থান এই জলাশয়ের নীচে। একমাত্র বৈশাখ সংক্রান্তিতে দেবীকে জল থেকে তুলে মূল মন্দিরে ভক্তদের সামনে রাখা হয়। এই দিন সবার অধিকার থাকে দেবীকে স্পর্শ করার পুজো দেবার। এই সংক্রান্তিতে সারাদিন ধরে মায়ের পুজো হয় ও গ্রামে মেলা বসে। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এই দীঘির ঘাটে মা যুবতীর বেশ ধরে শাঁখা পড়েছিলেন। সেই উপলক্ষে বৈশাখ মাসের উৎসবে মাকে শাঁখা পড়ানো হয় এবং গ্রামের বধূরাও ওই দিন শাঁখা পরে। পুজো শেষ হলে ভোরবেলা দেবীকে আবার ক্ষীরদীঘিতে রেখে আসা হয়। এছাড়াও বছরের অন্যান্য বিশেষ সময়ে দেবীকে জল থেকে তুলে মন্দিরে এনে পুজো করা হলেও ভক্তরা দেবীর দর্শন পান না। একমাত্র বৈশাখ সংক্রান্তির দিনই দেবীর দর্শন করা যায়।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দেবী যোগাদ্যাকে ক্ষীরগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বয়ং রাম। লংকায় রাম রাবণের যুদ্ধ চলাকালীন রাবণের ছেলে মহীরাবণ রাম ও লক্ষণকে মায়াজালে আবদ্ধ করে পাতালে নিয়ে আসে বলি দেবার জন্য।এই পাতালে মহীরাবণের আরাধ্যা দেবী ছিলেন ভদ্রকালি তথা দেবী যোগাদ্যা ।প্রতিদিন দেবীর সামনে নরবলি দেওয়া হতো। কিন্তু মহীরাবণের সেই উদ্দশ্য সফল হয় নি। হনুমান মহীরাবণকে পরাজিত করে রাম ও লক্ষণ কে উদ্ধার করেন। মা যোগাদ্যা রামের কাছে থাকতে এবং তার হাতে পুজো নেবার ইচ্ছে জানালে রাম দেবীকে পাতালপুরী থেকে পৃথিবীতে এনে এই ক্ষীর গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন। এই সব বর্ণনা কবি কৃত্তিবাসের রচনায় পাওয়া গেছে। যারা ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন তাদের মতে এই ক্ষীরগ্রাম থেকে বহু প্রাচীন পুঁথি উদ্ধার হয়েছে যেখানে যোগাদ্যা বন্দনার প্রায় ৪০টি পুঁথি পাওয়া গিয়েছে।

দেবী মূর্তিটি কালো কষ্টি পাথরের। দেবীর রূপ দশভূজা ও দেবী মহিষমর্দিনী। বলা হয় প্রাচীন মূর্তি চুরি যাওয়ায় বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ দাইহাটের নবীনচন্দ্র ভাস্করকে দিয়ে দশভূজা মহিষমর্দিনীর একটি প্রস্তর প্রতিমা তৈরি করিয়েছিলেন। এই প্রতিমাটিই ক্ষীরদীঘির জলের নীচে রাখা থাকে। তবে মূল মন্দিরে কোনো প্রতিমা নেই। গর্ভগৃহে বেদী রাখা আছে এই বেদীতেই মায়ের নিত্য পুজো করা হয়। মাকে আমিষ ভোগ প্রদান করা হয়। এই মন্দিরের একটু দূরে রয়েছে ভৈরব ক্ষীরকণ্ঠের শিব মন্দির। একসময় এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে, হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটি নিয়ে। ক্ষীরদীঘি সংস্কারের সময় নতুন মূর্তির সাথে খোঁজ মেলে হারিয়ে যাওয়া মূর্তির। পুরনো মূর্তি ফিরে পাবার আনন্দে গ্রামবাসীরা আরও একটি মন্দির গড়ে তোলেন। এই মন্দিরেই রাখা থাকে পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটি। ফলত এখন গ্রামে গেলে সারাবছরই মায়ের দর্শন পাওয়া যায়। এবং বৈশাখ সংক্রান্তির সময় গ্রামের দুই মন্দিরেই সমান আরাধনা চলে।

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২০ (১)

বদ্রী পালোয়ান গেছে পড়শি জেলায় এক নওজোয়ানের জামিনের তদ্বিরে। ছেলেটির উপর ধর্ষণ ও মারপিটের মামলা শুরু হয়েছে। যাবার আগে রঙ্গনাথকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল—ব্যাটা মহা গুণ্ডা! যেখানে যায় একটা না একটা ঝঞ্ঝাট বাঁধিয়ে ছাড়ে।

তারপর বৈদ্যজীর থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়ে জহরকোটের ভেতরের পকেটে ঠুঁসল। রঙ্গনাথের কৌতুহল—“এতগুলো নগদ টাকা এমন ভাবে নিয়ে যাওয়া”!

বদ্রীর জবাব,” গুণ্ডা শুধু এজলাসের নীচে কাঠগড়ায় নয়, উপরেও বসে রয়েছে।হাকিম তো তা-না-না-না করে জামিন দিয়ে দেবেন। কাগজ চলে যাবে কর্মচারিদের হাতে। তারপর বিশ রকম ঝামেলা। জামিনের উপযুক্ত কাগজ কই? কাগজ তৈরি কর। সম্পত্তির নকশা নিয়ে এস। তারপর সেটার যাচাই করা—কাঁচা এবং পাকা—সব হবে। এবং পদে পদে পয়সা ঠেকাতে থাক।

“ যারা ভাল মানুষ তারা জামিনের চক্করে না ফেঁসে জেলে পড়ে থাকা পছন্দ করে। নগদ নারায়ণের ব্যাপারই আলাদা—বড় আরাম। যেই হাকিম হেঁকে বলবে—একহাজার টাকার জামিন!

অমনই দশটা সবুজ কড়কড়ে নোট টেবিলে ছুঁড়ে দিয়ে বলব—নাও ভাই! রেখে দাও যেখানে তোমার ইচ্ছে”।

রঙ্গনাথ আরও জানতে চাইছে-“ বদ্রী দাদা, ব্যাটা যখন একনম্বরের গুণ্ডা তখন কেন হাত ময়লা করছ? পচুক না ব্যাটা জেলে”!

“ গুণ্ডা কে নয়? রঙ্গনাথ বাবু, ভেবে দেখ—গুণ্ডার মাথায় কী শিং বেরোয়”?

তারপর ধীর স্বরে বলল—“ আমি খালি এইটুকুই জানি যে ব্যাটা কখনও আমার আখড়ায় চ্যালাগিরি করেছিল। বাইরের লোকের চোখে ও যত বড় গুণ্ডাই হোক, আমার চোখে ওইদিন ভাসে যখন কুস্তির আখড়ায় ও আমার ল্যাং খেয়ে ছিটকে পড়ত”।

এবার ওর গলার স্বর আরও কোমল হয়ে খাদে নেমে এল,”যাই বল, আমারই তো পোষ্যপুত্তুর বটে”!

পোষ্যপুত্তুর শব্দের অমন লাগসই প্রয়োগ দেখে রঙ্গনাথ ভির্মি খেল। তবে ওর মাথায় একটা রিসার্চ পেপার লেখার চিন্তা ঘাই মারল—‘আধুনিক ভারতে পোষ্যপুত্তুরের মহত্ত্ব’।

“এই সেদিনও আখড়ায় এসে কাঁইচি মারা শিখছিল, এখন তো পুরোদস্তুর পালোয়ান”! বদ্রীর গলায় আবেগের ছোঁয়া।

রঙ্গনাথ বুঝতে পারল যে সব পোষ্যপুত্তুরের ক্যারিয়ার এভাবেই শুরু হয়।

প্রত্যেক মহাপুরুষের আশে পাশে পোষ্যপুত্তুরদের ভীড় লেগেই থাকে। পুরুষ মহাপুরুষ হয়ে গেলেই তাঁর সম্মান রাখার দায়িত্ব পোষ্যপুত্তুরদের ঘাড়ে এসে পড়ে। ওরা ওনার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেয়। কিছুদিন গেলে ওই ইজ্জত ফেটে গিয়ে সহস্রধারায় বয়ে চলে।লোকসভা বিধানসভার বিতর্কে সেই ধারায় ভেসে যায়। খবরের কাগজ আর বেতারে তার ছিঁটে পড়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়। সেই ধারায় পুরো গণতন্ত্র ডোবে আর ভাসে। শেষ হয় বেহায়াপনার মহাসাগরে লীন হয়ে।

বদ্রী পালোয়ান ব্যাখ্যান করতে শুরু করলঃ

“ঝগড়ার শুরু পড়শি এক বামুনকে নিয়ে---“

--- মহাপুরুষেরা সাধারণতঃ নিজের সিংহাসনে বসে পোষ্যপুত্তুরদের খেলাধুলো দেখতে থাকেন। এই দেশে মহাপুরুষ আর তাঁর পোষ্যপুত্তুর ছাড়া কিছু ঝামেলা পাকানোর লোকও থাকে। তারা কখনও সখনও মহাপুরুষের সামনে এসে চেঁচায়—“ ওগো মহাপুরুষ, তোমার পুষ্যিদের ভ্রষ্টাচার আর দুর্নীতির চোটে টেকা দায়। বড্ড বাড় বেড়েছে। তোমার ইজ্জত পাংচার হল বলে”।

এমন সময়ে মহাপুরুষেরা একটিই কাজ করে থাকেন।

“ কী বলছেন, ভ্রষ্টাচার! আসুন, আমরা সবাই মিলে আগে ঠিক করি ভ্রষ্টাচার কাকে বলে? তার সজ্ঞা কী”? রঙ্গনাথের চিন্তার স্রোত বয়ে চলে।

“তো পড়শি এক বামুন। ওর বৌয়ের ভরা যৌবন”।

ব্যস্‌, ওইটুকু শোনামাত্র রঙ্গনাথ তার ‘আধুনিক ভারতে পোষ্যপুত্তুরের মহত্ত্ব’ গোছের থিসিসের কথা ভুলে মনপ্রাণ দিয়ে বামুনের পারিবারিক কেচ্ছা শুনতে লাগল।

“--- আমার চ্যালা তার কাছেপিঠে কোথাও থাকত। বামুন-বৌয়ের সঙ্গে কয়েক মাস ওর ইন্টুমিন্টু চলছিল। বামুন সব জেনেও না দেখার ভান করত। একদিন হল কি, পর্দার আড়ালও রইল না। বামুন ফ্যালফ্যাল করে দেখল যে আমার চ্যালা ওর বৌকে জাপটে ধরেছে। কিন্তু সে ব্যাটা খানিক চোখ মিটমিট করে থলের মত চেহারা করে চুপচাপ কেটে পড়ল। এতে আমার চ্যালার হল মটকা গরম। ওর মন পরিষ্কার, বেশি জিলিপি প্যাঁচানো পছন্দ নয়। একলাফে এসে বামুনের ঘাড় ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল—কিঁউ বে, আমার সামনেই কেটে পড়ছিস, লাজ-লজ্জার মাথা খেয়েছিস? মরদ ব্যাটা, তোর একটু রাগও হল না? আরে সত্যিকারের মরদ হলে একবার আমাকে আওয়াজ দিয়ে দেখতিস্‌!

“ তো বামুন বেচারা করবেটা কী! মন্তর গোছের কিছু ফিসফিস করে আউড়ে দিল। তাতে খেপে গিয়ে আমার চ্যালা হাসিমুখে ওকে এক কাঁইচি মেরে চিৎ করে দিল। বেচারার ঊরুর হাড় গেল ভেঙে।

“তারপর চেঁচামেচি কান্নাকাটি সব শুরু হল। বামুন এবার গলা ফাটিয়ে চেল্লাতে লাগল। আবার ওর বৌ চিল-চিৎকার জুড়ল—দেখ দেখ, লোকটা আমার ইজ্জত লুটে নিচ্ছে।

এবার তুমিই বল রঙ্গনাথ বাবু, এই দুনিয়ায় কার শত্রু নেই? এতেই থানায় রিপোর্ট লেখানো হল আর আমার চ্যালা ফেঁসে গেল”।

বদ্রী পালোয়ান হাসতে লাগল, যেন খুব মজার কথা শুনিয়েছে।

রঙ্গনাথ –“কিন্তু বদ্রী দাদা, এটা কেমন হল? ----- আগে বেচারার বিবিকে --- তারপর ওকেও”--?

বদ্রীর হাসি থামছে না। “ রঙ্গনাথ বাবু, তুমি মুখ ফুটে বল, বা না বল—এটাই সত্যি। যে নিজের বৌকে সামলাতে পারে না , সে সারাজীবন বেচারাই থাকে। ওকে নিয়ে হা-হুতাশ করে কী হবে? আমার মাথাব্যথা নিজের চ্যালাকে নিয়ে”।


বদ্রী পালোয়ান ক’দিনের জন্য বাইরে যাওয়ায় রঙ্গনাথ আজ ছাতে একলাই শুয়েছে । শীত জাঁকিয়ে পড়েছে। শীতের মজা উপভোগ করবে বলে বদ্রী ওর খাটিয়া খোলা ছাতে লাগিয়ে শুচ্ছিল, রঙ্গনাথ ঘরের ভিতর।

রাত প্রায় এগারোটা। ওর ঘুম আসছে না।

খাটিয়ার পাশে একটা কাঠের বাক্সোর উপরে একটি ব্যাটারিতে চলা রেডিও রাখা। কাঠের বাক্সটিতে কলেজের জন্য বইপত্তর এসেছিল। বইপত্তর গেল প্রিন্সিপালের ঘরে আর বাক্সটা মেরামতের পর বৈদ্যজীর ঘরে। রেডিওটা কলেজের। তবে রঙ্গনাথ আসার পর কলেজ থেকে চেয়ে আনা হয়েছে। ওটা আসার পর রূপ্পনবাবুর ম্যাজিক বা কানে লাগিয়ে স্থানীয় রেডিও স্টেশন থেকে আবহাওয়ার খবর শোনার হেডফোনটা ফালতু হয়ে গেল। রেডিও সারাদিন বেজে চলে—সে ঘরে কেউ থাকুক বা না থাকুক। তবে রাতের কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম।

এ’সময় রেডিওতে শাস্ত্রীয় সংগীতের কোন প্রোগ্রাম তার শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ছিল, এবার যেন দাঙ্গা শুরু হল। ভায়োলিন আর তবলা একে অন্যের উপর ঘন্টায় দুশো মাইল বেগে হামলা করছে। মনে হচ্ছে, ওদের দুই গাড়ি সংঘর্ষের ফলে ক্র্যাশ করে টুকরো টুকরো হল বলে। চারদিকে হাহাকার। হঠাৎ ভায়োলিন বাদক তার পাতলা তারে একটা ‘কিরররররর—‘ ধ্বনি বের করল, রঙ্গনাথের কলজে যেন বল্লমের খোঁচায় এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল! তক্ষুণি তবলায় যেন বোমা ফাটল। তাতে সঙ্গীত-নাটক-অ্যাকাডেমির ভবনের ভিত নড়ে উঠল। রঙ্গনাথ লাফিয়ে উঠে দেখতে লাগল—রেডিও আস্ত আছে তো?

নাঃ, সেটা ক্যাসাবিয়াংকার মত নিজের কাজে অচল অটল। সমানে সঙ্গীত জগতের কোস্তাকুস্তির ধারাবিবরণী দিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে, এবার ভায়োলিন ল্যাজ গুটিয়ে পালাচ্ছে আর তবলার হামলায় আরও জোশ এসে গেছে। রঙ্গনাথ ক্লান্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে রেডিওর কান মলে দিল।

ঘন অন্ধকার! শীতের রাত তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আবির্ভুতা। এ’রম সময়ে লোকের মনে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস হোক বা না হোক, ভূতের বিষয়ে বিশ্বাস জন্ম নেয়। রঙ্গনাথ ভয় পায়নি, কিন্তু ওর কেমন যেন লাগছে, অদ্ভুত কোন অনুভূতি। সত্যি বলতে গেলে এসব ভয় পাওয়ারই লক্ষণ।

কিন্তু ভয়ের চিন্তা ফিকে হয়ে গেল। কারণ, রঙ্গনাথ এখন রেডিও থেকে রূপ্পন বাবু, ফের রূপ্পন বাবুর থেকে বেলা নামে এক মেয়ের কথা ভাবছে। যাকে কখনও চোখে দেখেনি, কিন্তু কানাঘুষোয় শুনেছে যে রূপ্পনবাবু নাকি ওকে প্রেমপত্র লিখেছে!

ও জানেনা যে সেই প্রেমপত্রটি কত লম্বাচওড়া, আর কতটা গভীর। তবে গুজব হল—সেই চিঠির বাক্যগুলো নাকি অনেকগুলো সিনেমার গানের লাইন জুড়ে তৈরি। পাড়ায় বলাবলি হচ্ছে যে বেলার পিসি প্রথম সেই লাভ লেটার ঘরের এক কোণায় পড়ে থাকতে দেখে। তারপর সেটা বেলার বাবা গয়াদীনের সামনে পড়া হয়। গোড়ায় দু’একটা লাইন থেকে গয়াদীনের কিছুই বোধগম্য হয়নি।

কিন্তু তারপর এল এই লাইনটি-‘মুঝকো আপনে গল্লে (গলে) লাগালো ও মেরে হমরাহী’। এটা পড়ামাত্র গয়াদীনের জ্ঞানের কপাট ধড়াম করে খুলে গেল। বোঝা গেল এই অনুরোধ কেউ বেলাকে করেছে। চিঠির শেষ লাইন অব্দি পৌঁছতে পৌঁছতে এটার আসল চেহারা স্পষ্ট হয়ে গেল। কারণ, তাতে বলা হয়েছে—“ ইয়ে মেরা প্রেমপত্র পড়কর কি তুম নারাজ ন হো, কি তুম্মেরি জিন্দগী হো, কি তুম্মেরি বন্দগী হো”। লেখকের নাম “শ্রী রূ”।

শোনা গেছে, চিঠিটা গয়াদীন ছাড়া শুধু প্রিন্সিপাল সাহেবই দেখেছেন। তার কারণ গয়াদীন গিয়ে রূপ্পনবাবুর নৈতিক অধঃপতনের সঙ্গে, কেন যেন, প্রিন্সিপালের নামও জুড়ে দিয়েছেন। প্রিন্সিপাল ওনাকে বোঝাতে চাইলেন যে লেখাটা কোন লাভ লেটার নয়, বরং বেশ উঁচু স্তরের কাব্যসংগ্রহ। আর সেটার লেখক ‘শ্রী রূ’ হলেও তাতে কাব্যগুণ কিছু কম হয়নি। কিন্তু ভবি ভোলেনি। গয়াদীনের মতে এগুলো নোংরামির প্রমাণ। তারপরে প্রিন্সিপাল বেশ কিছু কবিতার লাইন শুনিয়ে বোঝাতে চাইলেন যে সাহিত্যে এমন সব উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি রয়েছে। তখন গয়াদীন চটিতং হয়ে বললেন—ওইসব কবিতার লাইন তোমার চরিত্র-দোষের প্রমাণ। শেষে দু’জনে মিলে ঠিক করলেন—ওই চিঠির কথা আর কাউকে জানানো হবে না।

পরের দিন থেকেই শিবপালগঞ্জের হাওয়ায় নানারকম খবর উড়ে বেড়াতে লাগল।

একটা খবরঃ খান্না মাস্টারের দলের কোন ছোঁড়া বেলাকে প্রেমপত্র লিখেছে, কিন্তু মিছিমিছি রূপ্পনবাবুর নাম জুড়ে দিয়েছে।

দ্বিতীয় খবরঃ বেলা রূপ্পনবাবুকে চিঠি লিখেছে। রূপ্পন তার জবাব দিইয়েছেন, কিন্তু সেটা গয়াদীনের হাতে পড়ায় ইজ্জতে গ্যামাক্সিন হয়ে গেছে।

তৃতীয় খবরঃ বেলা একটি খারাপ মেয়ে। --এই গল্পটাই বেশি প্রসিদ্ধ হল।

(চলবে)