Next
Previous
Showing posts with label ধারাবাহিক. Show all posts
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in



















৯.
'আত্মঘাতী বাঙালির' কাছে অচেনা নীরদ সি চৌধুরী




সুপ্রিয়বরেষু

সুস্মি,

তোমাকে যখন এই চিঠি লিখতে বসেছি বাতাসে তখন বারুদের ঘ্রাণ। দেশভাগ, দ্বিজাতি তত্ত্ব, স্বাধীনতা অনেক কিছু নিয়েই লেখা যায় তোমাকে, ভারত পাক যুদ্ধ নিয়ে লিখতে মন চাইলো না। বাংলাদেশ নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হলো তোমাকে বেলুচিস্তানের কথা লিখি তাদের স্বপ্নের কথা বলি। বহুবছর পর আত্নঘাতী বাঙালি নিয়ে বসেছি, পড়েছো নিশ্চয়। নীরদ সি চৌধুরীর লেখাগুলো সাহিত্যের ভুবনে খ্যাতি পাওয়ার পরেও জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে কেন উত্তীর্ণ হলো না, তা একটি ভাববার মতো বিষয়। তার অধিকাংশ রচনাবলীতে বিমর্ষতা হল এই প্রশ্নের উত্তর। নীরদের সাহিত্যকর্মে বিমর্ষতার লক্ষণগুলো অতটা সুস্পষ্ট নয়; অর্থাৎ, তাকে মূলধারার বিমর্ষ সাহিত্যিকদের কাতারে ফেলা যাবে না। নীরদ সি চৌধুরীর চাঁছাছোলা গদ্যরীতি আর বিমর্ষতা তার সাহিত্য চর্চায় সম্ভবত এক ধ্রুপদী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। তাঁর বোধে মার্ক্সীয় দর্শন এ যুগের নিরিখে অপ্রাসঙ্গিক। তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রশংসা করছেন এক দিকে, অন্য দিকে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে তুলনা করে তা যে হীন, তা বলতেও ছাড়ছেন না। তাঁর কাছে রেনেসাঁ হল মোগলযুগের আচ্ছন্নতা কাটিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে নতুন করে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার মহত্ত্বকে অনুভব করা। হিন্দুদের সুপ্রাচীন আধ্যাত্মিকতার গালভরা বড়াই নিতান্তই ভুয়ো অর্থহীন, নীরদ চন্দ্র তাঁর ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ গ্রন্থে দৃষ্টান্ত দিয়ে তা দেখিয়েছেন।

নীরদ চন্দ্র চৌধুরীকে তুমি কিভাবে দেখো জানিনা তবে আমার মনে হয় নীরদ সি চৌধুরী জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নানা দিকের প্রশস্তি গাথা রচনা করে। ইংরেজদের তিনি তাদেরই তৈরি করা খেলায় হারিয়েছেন- নীরদ বাবুর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এখানেই। তবে আগাগোড়া উদ্ধত, ভয়ানক, দ্বন্দ্বমুখর ব্যক্তিত্ব নীরদ চন্দ্র চোধুরীর বিষয়ে মূল্যায়ন করাও একটি দন্ধ মুখর কাজ, যা করতে যোগ্যতা, ধৈর্য, জ্ঞানের গভীরতা এবং নির্মহ হওয়ার চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। তাকে তাই মূল্যায়ন করা যায় না, তার বর্ণিল জীবন শুধু উপভোগ করা যায়, তার সাহিত্যকর্মের গভীরে পৌঁছে ইউরোপের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্বকে আয়েশ করে হৃদয়ঙ্গম করা যায়, তবে তার জীবন ও কর্মের বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছানো, স্বাস্থ্যহীন জীর্ণ-শীর্ণ মানুষের হিমালয় বিজয়ের আকাঙ্খার মতো।

দ্বান্দ্বিক নীরদ চন্দ্র তার প্রথম লেখা ইংরেজি বই দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান লেখার সময় ভূমিকায় বলেছেন, আমি জীবনের প্রথম পঞ্চাশটা বছর মুছে ফেলে নতুন করে বাঁচতে চাই। বন্ধুরা মনে করেন আমি এক ব্যর্থ মানুষ, আর এই বই লিখে সেই ব্যর্থতার এক অজুহাত খাড়া করতে চাইছি। তবে আমি সেই তথাকথিত পরাজয় এবং সেই পরাজয় স্বীকারের মাঝখানে একটা সরু, নোনা জলের দুরতিক্রম্য নদী বইয়ে দিতে চাইছি। রণে ভঙ্গ আমি দিচ্ছি না। তার এই স্বগতোক্তি আবার বাঙালি পাঠকদের মনে তার সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক চিন্তার উদ্রেক করে। প্রথম পঞ্চাশটি বছর যা তাকে বিশ্ব জগতকে দেখার সামর্থ্য তৈরি করে দিয়েছে, যে সময়ে তিনি একাডেমিক লেখা পড়ার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন মেধা সম্পন্ন মানুষদের সংস্পর্শে এসে নুতন দৃষ্টিভঙ্গি পেয়েছেন, সেই সময়কে তিনি মুছে ফেলতে চান। এরকম উক্তি তার মতো পন্ডিত ব্যক্তির মুখে যখন শোনা যায়, তখন তার দিকে সন্দেহ মিশ্রিত দৃষ্টিতেই তাকাতে হয়। আভিজাত্য, শ্রেণি-উত্তরণ, জ্ঞানের স্বীকৃতি, উন্নত জীবন অর্জনের জন্য যে আত্মঘাতী হতে হয়, তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এই কথাটি পাঠকদের স্মরণ করে দিতে তিনি বাধ্য করেন।

নীরদচন্দ্র চৌধুরী-র লেখা ‘অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’তোমার পড়া আছে কিনা জানি না। বইটি আত্মজীবনী হলেও পড়তে পড়তে মনে হবে এক জন ইতিহাসবিদের চোখে দেখা ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলা। ‘অটোবায়োগ্রাফি’ পড়ে এ দেশের মানুষ অসন্তুষ্ট হলেও বিদেশিরা বইটির প্রশংসা করেছেন। তাঁদের মধ্যে এমন দু’জন ছিলেন যাঁদের প্রশংসা পাওয়াটা বিরল ব্যাপার। এক জন বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ নায়পল, অন্য জন উইনস্টন চার্চিল। ‘অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ এক জন ভারতীয় বালকের বেড়ে ওঠার কাহিনি। সেটা গত শতকের গোড়ার দিককার কথা। যে জগতে ক্রমশ তিনি আর তাঁর নিজের পথ খুঁজে নিতে পারছেন না, ছটফট করছেন। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের বরাতের লেখা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে পরিণতির ইঙ্গিত দিয়ে। সেই সন্ধিক্ষণের কথা সমাজ ইতিহাসের পাতা থেকে নীরদ চৌধুরীর অটোবায়োগ্রাফির পাতায় উঠে আসছে সৎ স্বচ্ছ অবিকৃত বিবরণে। বইটির বিভিন্ন অংশে রয়েছে লেখকের পিতৃভূমি এবং মাতুলালয়ের গ্রামের কথা। বয়ঃসন্ধিকালে জাতীয়তাবাদী মনোভাবের জাগৃতি, কলকাতার মানুষ আর জীবনের কথা। শেষাংশে লিখছেন তাঁর ‘আইডিয়াজ় অব অ্যান এপিটাফ’—‘হিয়ার লাইজ় দ্য হ্যাপি ম্যান হু ওয়াজ় অ্যান আইলেট অব সেন্সিবিলিটি সারাউন্ডেড বাই দ্য কুল সেন্স অব হিজ় ওয়াইফ, ফ্রেন্ডস অ্যান্ড চিলড্রেন’। ‘অটোবায়োগ্রাফি’ বইটি তিনি উৎসর্গ করলেন ‘টু দ্য মেমারি অব দ্য ব্রিটিশ/ এমপায়ার ইন ইন্ডিয়া,/ হুইচ কনফার্‌ড সাবজেক্টহুড/ আপঅন আস/ বাট উইথহেল্ড সিটিজ়েনশিপ।’ ‘অটোবায়োগ্রাফি’-র এই উৎসর্গ ক্রুদ্ধ করল কতিপয় ভারতীয় তথা বাঙালিকে। যারা বরাবরই নীরদ সি-র ভাব-ভাবনা অপছন্দ করে আসছেন। তাঁকে এর জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের শেষ সমর্থক, ব্রিটিশভক্ত দালাল ইত্যাদি বাণ ছুড়তে কসুর করেননি তারা। তারা খেয়াল করল না ভারতীয়রা ইংরেজদের কাছ থেকে ‘সাবজেক্টহুড’ পেলেও ‘সিটিজ়েনশিপ’থেকে বঞ্চিত বলে নীরদচন্দ্র কী ভাবে ইংরেজদের শ্লেষবিদ্ধ করলেন। অটোবায়োগ্রাফির জন্য নীরদ সি-র বিলেত ভ্রমণের আমন্ত্রণ এল ব্রিটিশ দূতাবাসের মাধ্যমে। মাত্র ছ’সপ্তাহের জন্য। সেই প্রথমবার, তাঁর স্বপ্নের ‘স্বদেশযাত্রা’। তাঁর বিলেত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখলেন ‘আ প্যাসেজ টু ইংল্যান্ড’। তখন তাঁর বয়স ৬০ বছর। রবীন্দ্রনাথের ‘নোবেল’ প্রাপ্তিতে কতিপয় খ্যাতনামা ইংরেজ তাঁর যোগ্যতা ও স্বচ্ছতা বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। রুষ্ট নীরদচন্দ্র ইংরেজদের বুদ্ধিভ্রম সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হন। এক সময়ের সভ্যতার ধারক বাহক আর্যদের উত্তরপুরুষ ব্রিটিশদের যে বৌদ্ধিক অবনমন ঘটেছে, সে কথা তাঁর ‘দ্য কন্টিনেন্ট অফ সার্স’ গ্রন্থে বিধৃত আছে।

নির্মোহভাবে নীরদ সি’কে অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, তিনি উনবিংশ শতকের চিন্তাবিদদের তুলনায় স্বতন্ত্র এমন কী তাকে অনন্যও বলা যায়। আঠারো শতকের ইউরোপীয় দার্শনিকদের মতো মহা-দর্শন সন্ধানী, তার জ্ঞান অনুসন্ধানের পন্থা হলো, যুক্তি, নিজস্ব ভাবনা ও অন্তর্দৃষ্টি। তার চিন্তা ধারা ও রচনা আমাদের আঠারো শতকের সংঘটিত ও প্রাজ্ঞ সমালোচক ড. জনসনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নীরদ চন্দ্রের পড়াশোনা ছিলো সীমাহীন ও ব্যক্তিত্বের ধরন ছিলো স্বতন্ত্র। সেই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাঙালিসুলভ আবেগ, একগুঁয়েমি ও পান্ডিত্য গৌরব, যা তাকে এক অনন্য পরিচিতি দিতে সক্ষম হয়েছে। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখনী সম্পর্কে সজনীকান্ত দাস যাহা লিখিয়াছেন তাহা প্রণিধানযোগ্য: 'নীরদচন্দ্র চৌধুরী বিচিত্র মানুষ। বেঁটে খাটো মানুষটি অথচ বিদ্যার জাহাজ। সাত সমুদ্র তেরো নদীর খবর তাহার নখাগ্রে ছিল, ফরাসী সাহিত্যের তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ভক্ত এবং সারা পৃথিবীর সামরিক বিদ্যার তিনি ছিলেন মনোয়ারী জাহাজ। তাহার ভালো-লাগা এবং মন্দ-লাগা গুরু মোহিতলালের মতই অতি স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট ছিল; একটু খামখেয়ালি প্রকৃতির ছিলেন, বিপুল সমারোহে কাজ আরম্ভ করিয়া শেষ করিতে জানিতেন না, গাছে উঠিয়া নিজেই মই ফেলিয়া দিতেন।' কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার বনগ্রাম থেকে অক্সফোর্ড নগরীর ২০ ল্যাদবেরি রোডের তিনতলা বাড়িতে পৌঁছুনোর যাত্রা পথ সহজ ছিলোনা। এই যাত্রা পথে তিনি যতনা কুসুম কুড়িয়েছেন, কন্টক কুড়িয়েছেন অনেক বেশি। তিনি অধিকাংশ বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির অপছন্দের তালিকার মানুষ। নীরদ সিকে বাঙালি পাঠকেরা প্রথমে অবজ্ঞা করেন এবং এরপর সযত্নে তাকে এড়িয়ে চলেন। তার সম্পর্কে বাঙালির প্রবল অবজ্ঞার কারন হলো বাংলা ছেড়ে তিনি দীর্ঘদিন দিল্লি এবং পরে রানীর দেশে থিতু হয়েছেন সুতরাং এই ঔপনিবেশিক শক্তির সহযোগীর সাথে আমাদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে। এছাড়া বিদ্যার বহর জ্ঞানের চাকচিক্য দেখাতে তার কোন কার্পন্য ছিলো না। রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের ভাষায়, ‘বিদ্যার বহর দেখাইতে তাহার বড় আনন্দ।’ উপরন্তু তিনি বাঙালিকে ‘আত্মঘাতী’ মনে করেন, পূর্বতন ঔপনিবেশিক প্রভুর দেশে বসে তিনি বাঙালিকে ভর্ৎসনা করেন। অথচ দেখো কলকাতাতে নীরদ চন্দ্র চৌধুরী, লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সঙ্গে একই মেসের বাসিন্দা ছিলেন। ভাবতে কেমন অবাক লাগে, তিনটি মানুষ তিন ভূবনের বাসিন্দা।

নীরদ সি চৌধুরী নিজেকে যতই সাম্রাজ্যবাদী বলুন আদতে তিনি সত্যিকারের একজন বাঙালি তার জীবনাচরণ, প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অগাধ জ্ঞান এবং লেখালেখিতে ইউরোপিয়ান এবং ভারতীয় জ্ঞানের প্রতিফলন কূয়াশাচ্ছন্ন করে তোলে তার সমালোচকদের, তার স্বরূপ খোঁজে পাওয়া অনেক কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কখনো কখনো মনে হয় বাঙালিদের মধ্যে তিনিই বোধ হয় সব চেয়ে বড় আত্মঘাতী। আমার মনে হয় উনার কোনো কোনো লেখায় ব্যক্তি ও সমষ্টি আহত হয়েছেন। যুক্তিকে আমলে না নিয়ে, প্রেক্ষাপট ও পরিপ্রেক্ষিত না বুঝে দাঁড় করা হয়েছে বৈরী ব্যাখ্যা। কিন্তু সত্যিই সদর্থক অর্থে যদি বিশ্লেষণ করা হয় উনার লেখালেখি ও গবেষণা, তাহলে মতদ্বৈততা হয়তো দেখা দিতে পার, কিন্তু উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এখানেই নীরদবাবুর স্বার্থকতা। । দীর্ঘ জীবনের লেখালেখিতে তিনি আমাদের জন্য এমন সত্য উন্মোচন করেছেন। আবিস্কার করেছেন অনির্ণেয় এমনসব সম্পদ যা এ জাতিকে ধন্য ও গৌরবান্বিত হওয়ার পাথেয় যুগিয়েছে। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জাতিগত ভিত্তি ও শক্তি-সাহস এবং সৌন্দর্য নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছেন, যার জন্য এ জাতি ঋণ স্বীকার ও কৃতজ্ঞতা জানাতেই পারে। ৯৭ বছর বয়সে তুখোড় স্মৃতি নিয়ে লিখলেন ‘থ্রি হর্সমেন অব দ্য নিউ অ্যাপোক্যালিপ্স’ নামক বহুদর্শীর আলেখ্য। বাঙালির নৈতিক অবক্ষয় আর রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচারের যে চিত্র সেখানে অঙ্কিত, তা আজকের প্রেক্ষাপটেরই যেন নির্ভুল পূর্বানুমান। মননে একজন খাঁটি বাঙালি না হলে এইভাবে পূর্বানুমান করা কি সম্ভব? এই প্রশ্ন বারবার আমাকে ভাবায়। নির্মোহভাবে নীরদ সি’কে অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, তিনি উনবিংশ শতকের চিন্তাবিদদের তুলনায় স্বতন্ত্র এমন কী তাকে অনন্যও বলা যায়। আঠারো শতকের ইউরোপীয় দার্শনিকদের মতো মহা-দর্শন সন্ধানী, তার জ্ঞান অনুসন্ধানের পন্থা হলো, যুক্তি, নিজস্ব ভাবনা ও অন্তর্দৃষ্টি। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখার বড়গুণ হলো তাতে বহুকৌণিক দৃষ্টি রাখার সুযোগ থাকে অবারিত। রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-নৃতত্ত্ব-ভূগোল ও জাতীয়তার আলোচনায় উনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সিদ্ধান্ত ও ভবিষ্যদ্বাণীসমূহে কতটা নির্মোহ সত্য জারি রয়েছে, সেসব বিচারে ও পর্যবেক্ষণে বাঙালি নীরদচন্দ্র এবং সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজী লেখক নীরদ সি-র মধ্যে অনুরূপ এক বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা হয়ে এসেছে। নীরদবাবু সেটা মানেননি, কিন্তু তর্কটাকে ক্রমাগত উস্কে গেছেন। শেষ দিকে অঢেল সমালোচনাও করেছেন ব্রিটিশদের। তাতে হয়তো ওঁদের কাছে আরও প্রাসঙ্গিক হয়েছেন। কিন্তু এ দেশে? যুক্তি, প্রশ্রয় ও ভালবাসা দিয়ে পড়লে নীরদচন্দ্র ও নীরদ সি কিন্তু অবলীলায় এক হয়ে যেতে পারেন আমাদের ভাবনাচিন্তায়। মনে রাখা জরুরি নীরদ সি চৌধুরীকে নিয়ে গভীর পাঠের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি যদি সবচেয়ে বেশি সমালোচনার বিষয় হন তাকে নিয়ে আলোচনার দরকার তার চেয়ে বেশি। পাঠককে শুধু সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানো নয়, খোঁচা মেরে মাঝে মাঝে রক্তাক্ত করাও যদি লেখকের কাজ হয় নীরদ সি চৌধুরী সে তালিকায় উপরের দিকেই থাকবেন। তার খোঁচায় আমরা রক্তাক্ত হই, কষ্ট পাই-কিন্তু খোঁচার প্রয়োজনীয়তা কি অস্বীকার করতে পারি? লেখাটার শেষ টানছিনা। শেষ টানা সবসময়ের কাজ নয়। শুরু করাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তারপর তাকে টেনে নেয়াও বড় কাজ। আমি বিশ্বাস করি নীরদ সি চৌধুরীকে ভবিষ্যৎ হয়ত আরো ভালো করে অনুসন্ধান করে আবিষ্কার করবে। কারণ নীরদ সি চৌধুরীকে শত্রু মনে করে এমন লোকের সংখ্যাই বাঙালি পাঠকে বেশি। আর বন্ধুর চেয়ে শত্রুকে গভীর অধ্যয়ন করা কত গুরুত্বপূর্ণ এটা বাঙালী এখন না বুঝলেও ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ঠিকই বুঝে নিবে। যদিও লেখক নীরদ সি চৌধুরী মনে করেন তাকে এক বিদেশী ভদ্রলোক ভালো ধরতে পেরেছেন। ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’ তে বাঙালি পণ্ডিতেরা যে তাকে কম ধরতে পেরেছে এর উল্লেখ করে বলেন: “কিন্তু একজন বিদেশী পণ্ডিত আমার ব্যক্তিত্বের আসল রূপ চিনিতে পারিয়াছেন। তিনি শিকাগো ও কেমব্রিজের অধ্যাপক এডোয়ার্ড শিলস্। তিনি ত্রিশ বছরেরও বেশি কাল ধরিয়া আমাকে জানেন। কিছুদিন আগে তিনি ‘আমেরিকান স্কলার’ বলিয়া যে একটি পত্রিকা আছে তাহাতে আমার সম্বন্ধে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত করিয়াছেন। উহার এক জায়গায় তিনি লিখিয়াছেন,- “Mr Chaudhuri’s being an Indian and a Bengali, and a European and Englishman, all at the same time is unique. He is perhaps the only one of his kind and there is no established name for the likes of him. Perhaps the old designation of “citizen of the world’ is the only one available…Mr. Chaudhury is the real thing.

একটা কথা মনে রাখতে হবে বন্ধুকে ঠিকমত অধ্যায়ন না করলে সমস্যা নাও হতে পারে। কারণ তার থেকে কোন উপকার না পেলেও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তুকে শত্রুকে যতি ঠিকমত আবিষ্কার না করি তাহলে ব্যক্তি শুধু ভোগবেনা, ভুগবে সমাজ, দেশ ও জাতি! নীরদ সি চৌধুরী এমন এক ব্যক্তি যার কথায় কানে তুলা দিয়ে থাকা যাবেনা। কারণ কানে তুলা দিলেই তো ঝড় থেমে যায়না। নীরদ সি চৌধুরী একটি ঝড়ের নাম এবং তাকে খুবই মনোযোগ ও যত্ন সহকারে অধ্যয়ন করতে হবে! নীরদ সি চৌধুরী ভবিষ্যতের আলোচ্য বস্তু হওয়া উচিত। তোমার কি মনে হয়?

ইতি-

বাসু

১ জুন,২০২৫

পুনশ্চ: নীরদ সি চৌধুরীর ভাষায় ‘বাঙালী জীবনে নূতন ভালবাসার প্রবর্তনকর্তা বঙ্কিমচন্দ্র’। রবীন্দ্রনাথের হাতে এ বিশেষ প্রেমের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশিত হয়। এঁদের এই বইপত্র পড়েই নব্য কালো-ইংরেজ শ্রেণি নতুন সাদা প্রেম শিখেছে। আয়ত্ত করেছে প্রেমের ভাষা-সম্ভাষণ; দুই তরফা (নর–নারী) প্রেমের ব্যাকরণ।

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















১২

-‘আপনি দেখবেন… ‘ চার্লস বকবক করে যায়… ‘আমার বন্ধু আপনি। একবার জেরাল্ডকে দেখলেই বুঝবেন… ওঁকে দেখে, ওঁর সঙ্গে পরিচিত হলে বুঝতে পারবেন যে সবাই কেন ওঁর উপরে এত ভরসা করে! রবার্ট কিম্বা অন্য কারো উপরে কেউ এতটা ভরসা করে না। জেরাল্ড অবশ্য সেই অর্থে আমাদের বন্ধুবৃত্তের ভেতরের কেউ নন; বাইরের… কিন্তু বেশ অদ্ভুত! অবশ্য রবার্ট সম্বন্ধেও আমি সেই একই কথা বলেছি আপনাকে, তাই না? ফলে আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না যে অদ্ভুত বলতে আমি ঠিক কী বোঝাতে চাইছি। আসলে আমি খুব তাড়াতাড়ি পুরো বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করছি। রবার্ট এমনিতে বিশাল কেউকেটা নয়। তবে ও জেরাল্ডের বন্ধু এবং সেটাই একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। জেরাল্ড সন্ধেবেলা প্রায়ই রবার্টের কাছে আসেন এবং আমরাও সেই কারণে রবার্টের কাছে যাই। রবার্ট এমনিতে খুব দিলদরিয়া; তাছাড়া আমাদের সবার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করে। কিন্তু তাঁর কিছু দুর্বলতা আছে, ফলে সে খুব কষ্টভোগ করে। যেমন, উদাহরণ হিসেবে বলা চলে যে মিকার সঙ্গে ওঁর প্রেমের সম্পর্ক আছে। ওই যে মিচকে রোমানিয়ান মেয়েটার কথা বলছিলাম না? মেয়েটা এমনিতে বাইরে বেশ নরমশরম, মিষ্টি… কিন্তু ভেতরে ভেতরে একদম ভিজে বেড়াল। অবশ্য সেটা তত জরুরি কথা নয়। কারণ আমরা সবাই মেয়েটার স্বরূপ জানি এবং আমরা কেউই সেভাবে মেয়েটাকে বিশ্বাস করি না। কিন্তু জেরাল্ডের কথা একবার চিন্তা করে দেখুন। বুঝে দেখুন যে ওই মিকার আবার জেরাল্ডের উপরে বেশ ভাল প্রভাব আছে। জেরাল্ডের সঙ্গে যদি একবার আপনার পরিচয় হয়, তো বুঝতে পারবেন যে জেরাল্ড একদম অদ্ভুত মানুষ! তিনি একটাও মিথ্যে বলেন না, ফালতু কথা বলেন না এবং ওঁর মতামত একদম অব্যর্থ সত্য বলে প্রমাণিত হয়। মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যে এক আধজন মেয়ে কিম্বা ছেলেকে পছন্দ করে চিহ্নিত করেন তিনি। প্রথমে অনেকেরই মনে হয় যে ওঁর পছন্দ বা মতামত হয়তো ভ্রান্ত। কিন্তু শেষ অবধি দেখা যায় যে সেই মতামত ভুল নয়। যাদের জেরাল্ড পছন্দ করেন, তারা সত্যি সত্যি বিশেষ প্রতিভার অধিকারী কিম্বা অধিকারিণী। ফলে আপনি বুঝতেই পারছেন যে ওঁর মতামতের গুরুত্ব আমাদের কাছে অপরিসীম এবং সেই কারণেই সবাই ওঁর উপরে ভরসা করে থাকে।’

-‘তিনি কি আপনাকে পছন্দ করেন?’

-‘আমি ভেবেছিলাম সেরকমই কিছু একটা হবে।’… চার্লস মরিয়া ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকায়… ‘কিন্তু আমি মূর্খ… আমি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে উনি আমায় পছন্দ করেন। আমি ওঁর বাড়িতে যাবার কথা ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম যে ওঁকে জিজ্ঞেস করব যে আমার জন্য কোন পেশা ভাল হবে, ভবিষ্যতে কী করা যায়। কারণ সম্প্রতি সব জায়গা থেকে আমায় বিফল হয়ে ফিরতে হচ্ছে। এদিকে আমার তো পয়সার দরকার। সত্যি দরকার। আমি লেখালেখির কাজ ছাড়াও এদিক ওদিক নানা কাজের জন্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সব জায়গা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এদিকে আবার আমার শরীরটাও সুবিধের নয়। দেখুন, আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন। লোকে বলে যে আমার নাকি যক্ষ্মা হয়েছে, আমার নাকি স্যানাটরিয়ামে ঠাঁই হয়েছে। সন্দেহ আছে এ বছর আমি পরীক্ষায় পাশ করব কি না! শিক্ষকেরা কেউ আমার প্রতি সদয় নন। তাঁরা মনে করেন যে আমি খুব খারাপ এবং বিপজ্জনক মানুষ। আমি আর পারছি না… হাঁপিয়ে উঠেছি। সেইজন্য আমি জেরাল্ডের কাছে যাবার কথা ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম তাঁর উপদেশ নেব। হতে পারে এখন আবার হয়তো মিকা বসে রয়েছে তাঁর কাছে, যেভাবে গতকাল সে তাঁর হাঁটুর উপর বসেছিল!’

-‘হাঁটুর উপরে?’

-‘হ্যাঁ, হাঁটুর উপরে বসেছিল ওই বদ নেকুপুষু মেয়েমানুষটা! আমি অসুস্থ বোধ করছিলাম। তার উপর ওই বারের গায়িকা মেয়েদুটো আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল। আমার ভাল লাগেনি। অস্বস্তি হচ্ছিল। তবে চুপ করে থাকার বদলে আমি এক দুটো কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম ওদের। হয়তো খুবই কটু কথা বলেছিলাম। আসলে অপমানজনক কথা, নাকি কটু কথা… সেটাও এখন ঠিক মনে নেই। তারপর আরও অসুস্থ বোধ করছিলাম আমি। দৌড়ে বাইরে চলে গিয়েছিলাম। কেঁদেছিলাম। ফিরে ভেতরে গিয়ে দেখি মিকা তখনো জেরাল্ডের হাঁটুর উপরে বসে আছে। উনি ওকে এমন ভাবে ধরে আছেন যেন কচি খুকি। কিন্তু মিকার বয়স ষোল। তারপর খুব শীতলভাবে উনি আমায় বললেন, ‘চার্লস, আপনার নেশা হয়ে গিয়েছে!’ ব্যস, আর কিচ্ছু না। তারপর মিকা বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল আর ওঁর কানে কানে কিছু বলতে শুরু করল। নিঃসন্দেহে আমার নামেই কিছু বলছিল… আর সেগুলো নির্ঘাত খুব খারাপ কথা; কারণ উনি মিকাকে চুপ করতে বললেন। কিন্তু রবার্টকে? আমার শরীর খারাপ করছিল বলে রবার্ট একটা চায়ের পট নিয়ে এসে আমায় এক কাপ চা দিচ্ছিল। উনি তাকেও একই রকম শীতল কণ্ঠস্বরে বললেন, ‘তুমি বরঞ্চ চার্লসকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও! এখানে বসে ওঁর কাজটা কী? উনি এখনও ছাত্র… তাছাড়া উনি খারাপ ব্যবহার করছেন।’ শুনে সবাই চুপচাপ হয়ে গেল, আর আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন আমি একেবারে উচ্ছন্নে গিয়েছি। আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম যে জেরাল্ডের মতামতের উপরে সবাই অনেকখানি গুরুত্ব দেয়। তিনি আবার বললেন, ‘আপনি বাড়ি চলে যান, চার্লস!’ আমি চলে এলাম; অবশ্য তাছাড়া আর কী বা আমি করতে পারতাম?’

বিষণ্ণ এবং বিরক্ত চার্লস একদৃষ্টে তাঁর বড় হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। বের্নহার্ড বেশ বিচলিত বোধ করছে; সে অন্যরকম কিছু ভেবেছিল। সে ভেবেছিল যে হয়তো সাঙ্ঘাতিক নাটকীয় কোনও ঘটনা ঘটেছে। সে ভেবেছিল যে চার্লস খুব অসম্মানজনক, বিশ্রী কিম্বা অসাধু কোনও অপকর্ম করেছে হয়তো বা; এরকম ভেবে সে একটু ভীত ছিল, কারণ সে এইধরনের ঘটনা শুনতে চায় না। কিন্তু এখন চার্লসের বিষণ্ণতা তাকে স্পর্শ করছে এবং সে বিচলিত বোধ করছে। সে বেশ বুঝতে পারছে যে চার্লস কতখানি অপমানিত বোধ করেছে জেরাল্ডের ব্যবহারে। ‘বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া’র ব্যাপারটা যথেষ্ট অপমানজনক পরাভবের পর্যায়ে পড়ে। সাঙ্ঘাতিক নাটকীয় কোনও ঘটনা শুনবে বলে সে নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করছিল; কিন্তু সেসব নাটকীয় ঘটনার তুলনায় এই ব্যাপারটা কম অসহনীয় নয়।

-‘আমি দুঃখিত!’ বের্নহার্ড বলে… ‘আপনার সঙ্গে যেটা ঘটেছে সেটা মোটেই ভাল হয়নি। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে জেরাল্ড যা বলেছেন, সেটা আপনাকে অপমান করবার জন্য নয় এবং সেরকম কিছু গুরুগম্ভীর অর্থ নেই সেই কথার।’

-‘তিনি যে কথা বলেন, অর্থ বুঝেই বলেন। না বুঝে কিছু বলেন না।’

-‘সেক্ষেত্রে আমার মতে সবচেয়ে ভাল হবে আলাদাভাবে জেরাল্ডের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া। অবশ্যই যখন তিনি একা থাকবেন, তখন কথা বলতে হবে। রবার্টের সামনে নয়, কিম্বা ওই গায়িকাদের সামনেও নয়, কারণ তারা আপনাকে বিরক্ত করবে এবং মিকার সামনেও নয়, কারণ সে আবার হাসাহাসি শুরু করবে।’

-‘তাহলে আমায় জেরাল্ডের বাড়িতে যেতে হবে। কিন্তু সেখানে যাবার সাহস আমার নেই।’

-‘আপনি যদি চান, তাহলে আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারি।’

-‘আপনি যাবেন?’ চার্লস অবাক হয়েছে বোঝা যায়। সন্দিগ্ধচোখে তাকায় সে বের্নহার্ডের দিকে। টেবিলের উপর থেকে হাতদুটো সরিয়ে নেয়। তারপর হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে বের্নহার্ডের কাছে গিয়ে… ‘আমি জানতাম যে আপনি আমায় সাহায্য করবেন।’ তার চোখে শিশুর সারল্য… ‘আমি বিশ্বাস করি আপনাকে… আপনি একজন ভাল মানুষ।’




(চলবে)
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২১.২

“আপনি খামোখা এত সংকোচ করছেন”, বৈদ্যজী এবার মুখ খুললেন, “যে আফিমের চোরাকারবার করে
তাকে কখনও ক্ষমা করতে নেই। এরা দুরাচারী, এরা দেশদ্রোহী”।

দারোগাজী চুপ। মনে মনে ভেবে রেখেছেন, ‘জিন’ এর গুষ্টির তুষ্টি। আর কখনও বেফাঁস কিছু বলি!
বৈদ্যজী আচমকা প্রশ্ন করলেন, “জোগনাথের ঘর থেকে একটা দেশি পিস্তলও পাওয়া যায় নি, এটা
কীরকম খানাতল্লাসি”?
“ওই যা ভাবেন”, দারোগাজীর নম্র কণ্ঠস্বর। “এখন এত দেশি কাট্টা আর ক’টা আছে যে প্রত্যেক
খানাতল্লাসিতে একটা না একটা ধরা পড়বে”! উনি এবার মনে মনে হাসছেন, সত্যি! জিনের তুলনা নেই।
অভিনয় করতে গেলেও কাজ দেয়।
রূপ্পনবাবু এতক্ষণ খবরের কাগজে মুখ ঢেকে বসেছিলেন। ওই অবস্থাতেই বললেন,” কোথায় গেল সব
দেশি পিস্তল? আপনার মালখানার স্টক শেষ”?
দারোগাজী গম্ভীর। “শুনুন, সেবার বৈদ্যজী থানায় এসে যা লেকচার ঝেড়ে গেছলেন—এসব তারই ফল।
শোনার পর যত রাজ্যের বদমাশ তাদের সব কাট্টা এলাকার বাইরে ফেলে দিয়েছে। বেশিরভাগ উন্নাও
জেলার গ্যাং এর কাছে বেচে দিয়েছে”।
বদ্রী পালোয়ান উন্নাও গেছে। এখনও ফেরে নি। বৈদ্যজী চোখ কুঁচকে কিছু ভাবলেন, তারপর ফিক করে
হেসে বললেন, “শিবপালগঞ্জের জলবায়ু বড় উৎকৃষ্ট, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের অনুকুল”।
-“ আমার কাছে আপনিই শিবপালগঞ্জের জলবায়ু”।
দারোগাজী এটা বলার পর আর মনে মনে জিনকে দোষ দিলেন না, বরং প্রাণখুলে হেসে ঊঠলেন। সেই যে
হাসি শুরু হল, আর থামে না। দারোগাজী টের পান নি যে ‘জিন’ শুধু জিভ নয় গলাতেও ভর করে। বৈদ্যজী
দারোগাজীর কথাটা গায়ে মাখলেন না। দারোগাজী উঠে পড়লেন, যেতে হবে। উনি চৌকাঠের বাইরে পা
ফেলতে যাচ্ছিলেন, বৈদ্যজী কোন ভুলে যাওয়া কথা মনে পড়ার ঢঙে বললেন,”জোগনাথের জামিন
বোধহয় আমার নামে লিখেছেন”?
দারোগা এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। “অমন হলে তো আপনার দস্তখত করিয়ে নিতাম। চিন্তা
করবেন না, আদালতে জামিন হয়ে যাবে। কাউকে ওখানে পাঠিয়ে দেবেন”।
বৈদ্যজী চুপ, রূপ্পনের সোজা প্রশ্ন,” কেন, এখানে জামিন করাতে কিসের অসুবিধে”?
“চুরির কেস, এতে থানায় জামিন হয় না।
“আর খুনের কেস হলে”?
দারোগাজী হালকা মেজাজে জবাব দিলেন, “আপনি বোধহয় গতবছরের নেবাদা এলাকার কেসের কথা
বলছেন। কিন্তু সেই কেসে অপরাধী টি বি তে ভুগছিল। ওকে থানায় আটকে রেখে কে আরেকটা মৃত্যূর
কারণ হত”?
রূপ্পনবাবু আগেই খবরের কাগজ ফেলে উঠে পড়েছিলেন। “শুনুন, জোগনাথ তো এখন আপনার জিম্মায়।
ওর জেরা টেরা এখানেই সেরে জামিন দিয়ে দিন। ও অসুস্থ; তবে যক্ষ্মা নয়, গনোরিয়া”।
বৈদ্যজী ঠান্ডা আওয়াজে বললেন, “রূপ্পন, ভদ্রভাবে কথা বল। দারোগাজী আমাদের আত্মীয়, যা
করবেন ভেবেচিন্তেই করবেন”।
দারোগাজী ফের বললেন, “তাহলে এবার যাই? আজ্ঞা দিন”।

রূপ্পন, “হ্যাঁ, যান! যান!! থানায় রামাধীন আপনার জন্যে হাপিত্যেশ বসে আছে”।
দারোগাজী মুচকি হাসলেন। ফের আমলাদের সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনার ঘটনার উল্লেখ করে বললেন,” কী
বলব রূপ্পন বাবু, এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। নইলে অনেক বড় বড় লোক হাপিত্যেশ করে বসে থাকত”।
দারোগা চলে যাবার পর রূপ্পন নিজের মনে বললেন—যাকে আটার তাল ভেবেছিলাম, ও যে দেখছি
মুস্কিপাতি জর্দা!
তারপর বৈদ্যজীকে বললেন—বড্ড অপমান করে গেল!
বৈদ্যজীর চেহারায় বেশ শান্ত সমাহিত ভাব। ফের রঙ্গনাথকে উঠে বাইরে যেতে দেখে শাস্ত্র
আলোচনার ঢঙে বললেন,”লাভালাভ, জয়-পরাজয়, মান-অপমান—এসব সমবুদ্ধির দৃষ্টিতে দেখা উচিত”।
আরে পিতাজী এখন গীতা আওড়াচ্ছেন! রূপ্পনবাবু বুঝলেন –তাহলে এই দারোগা ব্যাটার রেহাই নেই।

বাবু রামাধীন ভীখমখেড়বীর ঘরে আজ ভাঙ ঘোটা হচ্ছে, সামনের একটা চালের নীচে জুয়োর আড্ডা
জমজমাট।দুটোতেই নিস্পৃহ রামাধীন চাতালের উপর একটা চারপাইয়ে শুয়ে লঙ্গড় বা ল্যাঙ্গড়ার কথা
শুনছিলেন। লঙ্গড় চাতালের নীচে এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
রঙ্গনাথ আর শনিচর ওদিক দিয়েই যাচ্ছিল। বাবু রামাধীন ওদের হাঁক পেড়ে ডেকে নিলেন। নিজে
খাটিয়ার এক কোণে সরে গিয়ে ওদের মাথার দিকে বসতে দিলেন। শনিচরকে উনি বিশেষ পাত্তা দিলেন
না, শুধু ‘দাঁড়িয়ে কেন প্রধানজী, বসে পড়’ বলে কর্তব্য সারলেন।
রঙ্গনাথের জন্য এটা দ্বিতীয় সুযোগ। প্রথমবার যখন রামাধীনের ঘর পেরিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন
এখানে কোন ভাঙ বা জুয়োর আসর চোখে পড়েনি। আজ এখানকার পরিবেশ ভারি আনন্দময়। রঙ্গনাথ
লঙ্গরের দিকে ইশারা করে বলল—এর কী খবরটবর?
“বাহাদুর বটে! ধরে নাও ও বলদের দুধ দুইয়ে এসেছে”।
রামাধীন হস্তমুদ্রায় বুঝিয়ে দিলেন বলদের দুধ দোয়ার চেষ্টায় হাত ঠিক কোনখানে যায়।
রঙ্গনাথ বেশ চ্যালেঞ্জের আওয়াজে বলল—হয়েছেটা কী? মহকুমা অফিস ত্থেকে নকল পাওয়া
গেছে”?
লঙ্গর বৈষ্ণব মহাপুরুষদের নিরীহ ভঙ্গিতে উত্তর দিল,”হাঁ বাপু, ধরে নাও পেয়ে গেছি। আমার
দরখাস্ত মহকুমা সদর থেকে ফেরত এসেছে। এমনিতে সদরে জমা দেয়া বেশিরভাগ দরখাস্ত হারিয়
যায়, আমারটা হারায় নি। এসব তো আপনাদের পদধূলির মহিমা”।
শনিচর বুদ্ধিমানের মত বলল, “বহুত আচ্ছা, লঙ্গর। দরখাস্ত যখন ফেরত এসেছে, তখন নকল পেতে
দেরি নেই”।
“আরে কবে আসবে”? রঙ্গনাথ কিঞ্চিৎ অধৈর্য।
লঙ্গড়ের এইসব ছটফটানি পছন্দ হল না। রঙ্গনাথকে আশ্বস্ত করে বলল, “নকল-বাবু বলেছেন
তোমার নম্বর এল বলে”!

রামাধীন বললেন,”যাও লঙ্গড়, ওদিকে গিয়ে কিছু ঠাণ্ডাই-টান্ডাই (ভাঙ) খেয়ে নাও”। তারপর উনি
খানিকটা উদাসীন ভাব দেখিয়ে রঙ্গনাথকে প্রশ্ন করলে, “শুনলাম আজ জোগনাথ গ্রেফতার হয়েছে”!
রঙ্গনাথ এই প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল। পালটা প্রশ্ন করল, “ জোগনাথ আবার কে”?
রামাধীন অবাক হয়ে খানিকক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর শনিচরকে
বললেন,“প্রধানজী, একে বলে দাও জোগনাথ কে”।
শনিচর বলল,”বাবুসাহেব, তুমি আমাকে এখন থেকেই প্রধান ট্রধান নাই বললে! যেদিন তোমার
মহামূল্য ভোট মঙ্গলদাস পিতা দুলারেলালকে দেবে সেদিন আমি পঞ্চায়েত প্রধান হব। এখন থেকে
টিকির-টিকির করা বেকার। কিগো বাবু রংগনাথ, ঠিক বলেছি”?
ভাঙের গেলাস রঙ্গনাথকে ধরে দেয়া হয়েছে। রঙ্গনাথ মাথা নেড়ে বলল,”আমি তো এসব খাই না”।
রামাধীনের এমন অপমান! এর অন্তিম পরিণাম তো হলদিঘাটির সংগ্রাম। উনি গরগরিয়ে উঠলেন, “তুমি
কেন ভাঙ ছোঁবে ভায়া! এসব তো দুষ্টুলোকেরা খায়”।
রামাধীনের সামনে এক ব্যাটা ‘গঞ্জহা’ (শিবপালগঞ্জের নিবাসীদের চালু নাম) বসে ছিল। রঙ্গনাথ ওর
চেয়ে সাফ-সুতরো পরিচ্ছন্ন। তাই ওর চোখে রঙ্গনাথ হল স্বাভাবিক শত্তুর। ও বলে উঠল, “ইনি তো
শহুরে, তাই ভাঙ খাবেন না। এনার জন্যে একটা বোতল বের করে দাও বাবুসাহেব”!
রামাধীন রঙ্গনাথকে নিপাট ভালমানুষের মত তাকিয়ে বললেন, “না না, ইনি বোতলটোতল খাবেন না,
বামুন ঘরের যে”! তারপর রঙ্গনাথকে আদরমেশা সুরে বললেন, “আর যদি আপনার চলে তো হুকুম
করুন, বোতল এসে যাবে”।
বামুন বলে দেয়ায় রঙ্গনাথ খানিক বেকায়দায় পড়ে গেল। কিন্তু তক্ষুণি শনিচর বিনা কোন রাখঢাক না
করে বলে দিল , “তুমি কেন বোতল আনিয়ে দেবে? এই ব্যাটা চিমিরিখিদাস আনিয়ে দিক না! বোতলের
কথাটা তো ওই তুলেছে”!
তারপর ও লোকটার দিকে ঘৃণাভরে দেখে বলল, “ছ্যাঁচোড় কোথাকার”! তারপর ও ইতরভাষায় একটা
স্থানীয় প্রবাদ বলল যার মোটামুটি মানে—ষোল শ’ শুয়োরকে নেমন্তন্ন করে এনেছে অথচ পাছায়
একফোঁটা গু নেই।
রঙ্গনাথের মনে হল এবার এখান থেকে সরে পড়া দরকার। কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
“এবার যেতে আজ্ঞা দিন রামাধনজী। হাঁটতে বেরিয়েছি, দেরি হয়ে যাচ্ছে”।
“পায়চারি তো ঘোড়ী করে, জোয়ান পুরুষকে মানায় না”। তারপর বেশ ঘনিষ্ঠ সুরে বলল, “ ফটাফট
পাঁচশো ডন বৈঠক! দেখবেন, লোহালক্কড় সব হজম”।
ওরা দু’জন চলে যাচ্ছিল। যেতে যেতে জুয়াড়িদের ঠেকে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে গেল।
খেলা চলছে দুটো আলাদা দলে। একপাশে কয়জন বসে ‘কোটপিস’ খেলছে। বাহান্ন তাসের খেলা। তাসগুলো
বড্ড পুরনো, রঙচটা আর এমন ছেঁড়াখোঁড়া যে ঘাগ খেলাড়ি বাইরে থেকেই বুঝতে পারবে এটা কোন
তাস।একটু দেখলে বোঝা যাচ্ছে যে খেলছে আটজন মিলে। চারজনের হাতে তাস, ওরা গম্ভীর এবং মাথা
বুকের উপরে ঝুঁকে রয়েছে। বাকি চারজন একেকটি খেলুড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে খেলার ধারাভাষ্য দিয়ে
চলেছে এবং যখন চুপ থাকা দরকার তখন কিছু না কিছু বলছে।

শুধু তাই নয়, এরা খেলুড়েদের জন্য খৈনি ডলা, বিড়ি ধরানো, জল নিয়ে আসা, তাস পড়ে গেলে তুলে গুছিয়ে
দেয়া গোছের সব কাজ করে দেয়। আর খেলা শেষ হলে হার-জিতের হিসেব চুকলে দেনা-পাওনার সময়
খুচরো পয়সার জোগান দেয়া, বিজয়ীর পয়সা থেকে পান নিয়ে আসা—সবকিছুর দায়িত্ব এদের উপর।
বেঁচে যাওয়া তাসগুলো গুণে হেরে যাওয়ার পক্ষ নিয়ে কোন না কোন অজুহাতে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়ার
কাজটাও এরাই সুষ্ঠুভাবে করে থাকে। সামনে বসে থাকা খেলুড়েকে কোন তাস খেলতে হবে সেটা ইশারায়
বলে দেয়া এবং সেই ইশারা ধরা পড়ে গেলে গলাবাজি করা –কোনটাই বাদ যায় না।
রঙ্গনাথের মনে হল –এই খেলাটা মহা ফালতু বাজে খেলা, সিদ্ধির নেশার মত। কিন্তু, অন্য দলের
খেলাটায় উঁকি দিতেই ওর শিবপালগঞ্জের জুয়োর ব্যাপারে ধারণাটাই পালটে গেল।
ওরা খেলছিল ‘ফ্ল্যাশ’, যা ল্যান্টার্নকে “লালটেন” বলার নিয়মে “ফল্লাস” হয়ে গেছে। এখানে ধুন্ধুমার
হচ্ছিল। একদিকে ‘ব্লাফ’ নামের অটোমেটিক অস্ত্র গণহত্যায় মগ্ন, অন্যদিকে একজন বিশুদ্ধ দেশি
পদ্ধতিতে চাল চেলে এগোচ্ছিল। আচমকা ওর আক্কেল কোথায় পালিয়ে গিয়ে ওকে হতভম্ব করে দিল।
ও আত্মসমর্পণ করে হাতে্র তাস ফেলে দিল। আর অন্য খেলুড়েটি ফড়ের থেকে একমুঠো পয়সা তুলে
নিজের উরুর নীচে চেপে রাখল।
হেরো খেলুড়েকে রঙ্গনাথ দু’দিন আগে বৈদ্যজীর ঘরে দিনপ্রতি আট আনা মজুরিতে কাজ করতে
দেখেছিল। সে এখন শান্তভাবে একটা বিড়ি ধরিয়ে পরের বাজির জন্য ফেটতে থাকা তাসের দিকে নিস্পৃহ
ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। রঙ্গনাথ মনে মনে ওর ধৈর্য এবং সাহসের তারিফ করতে লাগল।
ঋষি দত্তাত্রেয় আজ জীবিত থাকলে নিশ্চয়ই এই খেলুড়েকে নিজের পঁচিশতম গুরু বলে স্বীকার
করতেন। রঙ্গনাথের মাথা ওই হেরো নির্বিকার খেলুড়ের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হল, তবে সত্যি কথা
বলতে কি, ওর হাতের তাস দেখার ইচ্ছেটাও মাথা নীচু করার একটা কারণ।
খেলুড়েদের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। এরা ‘পেয়ার’কে বলে ‘জোড়,’ ‘ফ্ল্যাশ’কে বলে ‘লঙ্গড়ি’,
‘রান্‌’কে ‘দৌড়’, ‘রানিং ফ্ল্যাশ’কে ‘পাক্কি’, আর ‘ট্রেইল’কে ‘টিরেইল’। রঙ্গনাথ বুঝতে
পারল—ইংরেজি শব্দকে হিন্দির ছাঁচে ঢেলে সাজানোর এটাই সহজ উপায়।
স্বাধীন ভারতে দেশজুড়ে শব্দকোষ রচয়িতার এবং ওদের সমিতির জাল বিছিয়ে রয়েছে। এঁরা ইংরেজি
শব্দ নিয়ে হিন্দি এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় তার প্রতিশব্দ রচনায় ব্যস্ত। কাজটা বেশ মজার।
একদিকে কামরার ভেতর একটি নতুন ভাষা জন্ম হচ্ছে। অন্যদিকে এটা করতে অনেক সময় লাগছে।
অর্থাৎ নতুন শব্দের নিমার্ণকর্তা প্রায় পেনশন পাওয়ার যোগ্য হয়ে যাচ্ছেন।
এটা এই জন্যেও মজার যে এভাবে কৃত্রিম ভাষা তৈরি করার কোন মানে হয় না। কেবল এইটুকু বলা যায়
–নাও ভাই, যেসব শব্দাবলী শুধু ইংরেজিতে আছে সেসব এখন তোমার ভাষাতেও এসে গেছে। এখন ভাই
সেটা নেবে কি নেবে না—তাতে কারও কিছু এসে যায় না।
রঙ্গনাথ এই ফালতু সমস্যার বিষয়ে কখনও কখনও চিন্তা করত, কিন্তু কোন সমাধান চোখে পড়ে নি।
এখন বার বার শুনছে “পাক্কি”, “টিরেইল” আর “লঙ্গড়ি” শুনতে শুনতে আজ ওর মাথায় একটা আইডিয়া
এলঃ যদি চার-পাঁচ ‘গঁঞ্জহা’র এক সমিতি বানিয়ে দিল্লি পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? এরা বড় বড়
পরিভাষার শব্দের জায়গায় নিজেদের স্থানীয় ভাষার ঝুলি থেকে সেরেফ সামাজিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত কিছু
শব্দ পেশ করবে। কিছু না হলেও ট্রেইল কে টিরেইল করে দিতে কতক্ষণ?

খেলুড়েগুলো যে আত্মবিশ্বাসের জোরে জুয়ো খেলে চলেছে এবং পাছার চামড়া পর্যন্ত বেচে দিয়ে
অনেক আশায় ‘ব্লাফ’ কল করছে, তা দেখে রঙ্গনাথ ধাঁধায় পড়ে গেল। এটা স্পষ্ট যে বিদেশ থেকে
কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ডেফিসিট ফাইনান্সের ইকনমিক মডেলের ওকালতি করা বড় বড় রাজনীতি
এবং অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও এমন কলজের জোরের দেখা পাওয়া ভার।
রঙ্গনাথ ভাবলঃ এই মজুর আর রাখালের দলের জীবন দেখার পর আমি দিল্লির মসনদে বসে
স্বপ্নদেখা মানুষের উপর রাগ করা ছেড়ে দিলাম।
ও সামনে তাস হাতে বসা লোকটাকে মন দিয়ে দেখতে লাগল। লোকটা আরেকটি বিড়ি ধরিয়েছে এবং
নির্বিকার চেহারায় এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। রঙ্গনাথ আর শনিচরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে এক
নজর দেখে লোকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আর এক মজদুরকে হাতের পাঁচ আঙুল দেখিয়ে ইশারায় টাকা
চাইল। মজদূরটি মাথা নেড়ে ইশারায় বলল, --না। তখন ও উঠে সোজা বাবু রামাধীনের কাছে গেল আর
চটপট ফেরত এসে আগের জায়গায় বসে পড়ল। চেহারা তেমনই নির্বিকার। তাস তুলে আধপোড়া বিড়ি
দূরে ছুঁড়ে ফেলে একটা ঢেকুর তুলল। তারপর একটা পাঁচ টাকার নোট ফেলে বাকি টাকা না তুলে চটপট
একটা চাল দিল। উলটো দিকের এক খেলুড়ে বলল, “মনে হচ্ছে এবার হাতে কোন বড় তাস এসেছে”।
রঙ্গনাথ ঝুঁকে ওর তাস দেখল। নাঃ, আগের মতই সেরেফ ‘ব্লাফ’!
বিদেশি সাহায্য কেন, কখন এবং কেমন মুখের চেহারা বানিয়ে চাইতে হয়—তার পাঠ রঙ্গনাথের চোখের
সামনে খোলা রয়েছে!


ওরা দু’জন এবার একটা ফাঁকা মাঠে পৌঁছে গেছে। রঙ্গনাথকে একা ছেড়ে দিয়ে শনিচর একটু দূরের
একটা ছোট ডোবার দিকে যাচ্ছিল। রঙ্গনাথ ওকে জিজ্ঞেস করল,”বাকি সব তো ঠিক, কিন্তু একটা
কথা মাথায় ঢুকছে না। ছোটে পালোয়ান জোগনাথের বিরুদ্ধে পুলিসের সাক্ষী হয়েছে—এটা কি ভাল হল?
শনিচর রকেটের গতিতে ডোবার দিকে এগিয়ে চলেছে। এবার আন্ডারওয়ারের গিঁট খুলে ফেলল। এই
তাড়াহুড়োর কারণ বেশ স্পষ্ট। কিন্তু যেতে যেতে ও সাতটা শব্দে উত্তর দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল,
“দেখতে থাক রঙ্গনাথ বাবু, এসব ‘গঁঞ্জহা’দের এঁড়েপনা”।
তারপর যেন কোন বিশ্বসুন্দরী ওকে শয্যায় আহ্বান করেছে এমন আতুর হয়ে ও আন্ডারওয়ার ছুঁড়ে
ফেলে রঙ্গনাথের সামনে একেবারে ন্যাংটো হয়ে ডোবার পাড়ে ঝটপট মোরগের লড়াইয়ের খেলুড়ের
ভঙ্গিমায় উবু হয়ে বসে পড়ল।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in






সাতাশ

সমীরণ, বিপিন ও রিমি আজ ঠিক করল,উজানি হয়ে কাটোয়ার বাসায় ফিরবে ওরা।সমীরণ বলল,তুমি তো জানো বিপিন,অজয় নদের পাড়ে এই মন্দির অবস্থিত। মূল মন্দিরটিতে প্রথমে একটি বারান্দা আছে। তার ভিতরে আয়তাকার গর্ভগৃহ। এই গর্ভগৃহের মধ্যে মা মঙ্গলচণ্ডীর ছোটো কালো পাথরের দশভূজা মূর্তি রয়েছে। প্রাচীন মূর্তিটি নব্বইয়ের দশকে চুরি হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালে মল্লিক উপাধিধারী গ্রামের এক ধনী পরিবার বর্তমানের কষ্টিপাথরের দশভুজা মূর্তিটি নির্মাণ করে দেন। সেই থেকে এই কষ্টিপাথরের মূর্তিটির পূজা হচ্ছে। ২০০৬ সালে মন্দিরটি সারানো এবং বাড়ানো হয়েছে। মূল মন্দিরের সামনে একটি ছোট নাটমন্দির যোগ করা হয়েছে।

প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। উজানি সতীপীঠে দেবীর নাম মঙ্গলচন্ডী। উঁচু কালো রঙের পাথরের একটি শিবলিঙ্গ হল দেবীর ভৈরব । ভৈরবের নাম কপিলাম্বর। অনেকে কপিলেশ্বর বলেও উল্লেখ করেন। শিবলিঙ্গের সামনে নন্দীর কালো পাথরের একটি ছোট মূর্তি আছে। শুধু তাই নয়, ভৈরবের বাঁদিকে একটি বজ্রাসন বুদ্ধমূর্তিও আছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এই মূর্তিটি পাল যুগের।কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে বর্ণিত ভ্রমরার দহ, মাড়গড়া, শ্রীমন্তের ডাঙা প্রভৃতি স্থানগুলি উজানিতেই। বর্তমানে সেই স্থানগুলির হদিশ পাওয়া যায় না। কথিত আছে সপত্নীপীড়িতা খুল্লনা উজানির কাছে ছাগল চরাতেন। যে স্থানে ভাত রান্না করে মাড় গালতেন সেই স্থানটি মাড়গড়া নামে পরিচিত ছিল। চণ্ডীমঙ্গলের ধনপতি দত্ত এই ভ্রমরার দহ থেকেই ডিঙায় চেপে সিংহলে বাণিজ্যে গিয়েছিলেন। আবার তাঁর পুত্র শ্রীমন্তও মঙ্গলচণ্ডীর চরণে পুজো দিয়ে সিংহলে পিতার অনুসন্ধানে যেতে ভ্রমরার দহ থেকেই সাত খানি ডিঙা ভাসিয়েছিলেন। যে স্থানে দাঁড়িয়ে সাতখানি ডিঙা দেখেছিলেন সেই স্থানটি শ্রীমন্তর ডাঙা নামে পরিচিত ছিল। সেগুলির সন্ধান বর্তমানে না পাওয়া গেলেও উজানির সতীপীঠ-কপিলাম্বর রয়েছেন স্বমহিমায়। দেবীর মূল পুজো হয় শারদীয়া দুর্গাপুজোর সময়। পুজো চলে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত। এটি সতীপীঠ হওয়ার কারণে পুজোয় আলাদা করে মূর্তি আসে না এবং নবপত্রিকা আনা হয় না। শুধু ঘট বারি আনা হয়। বছরে তিনবার ঘট বদল হয়। প্রথম ঘট আসে বৈশাখের শেষ মঙ্গলবার এবং বাৎসরিক পুজো হয়। এরপর ঘট আসে জিতাষ্টমীর পরদিন, যাকে বোধনের ঘট বলা হয়। তারপর ঘট আসে দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন। এছাড়াও বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসের মঙ্গলবারে মঙ্গলচণ্ডীর পুজো হয়। এখানে বলিপ্রথা চালু আছে। দুর্গাপুজোর সপ্তমী এবং অষ্টমীতে চালকুমড়ো, নবমীতে চালকুমড়ো, কলা, আখ এবং ছাগ বলি হয়। মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীরা লৌকিক ও পৌরাণিক দেবদেবীর মিশ্রণ। লৌকিক দেবদেবীদের সঙ্গে কালে কালে যুক্ত থাকে পরিপুষ্ট গভীর আবেগ, ভক্তির উচ্ছ্বাস, অন্ধবিশ্বাসের ঐকান্তিকতা। শ্রীমন্ত এই স্থান থেকে সিংহলে যাত্রা করে সিদ্ধকাম হয়েছিলেন এই বিশ্বাসের ওপর ভর করেই উজানি শক্তিপীঠের প্রতি সাধারণ মানুষের ভক্তি ও বিশ্বাস আজও অমলিন।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর বাঁ হাতের কনুই পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী মঙ্গলচন্ডী এবং ভৈরব হলেন কপিলাম্বর বা কপিলেশ্বর। পূর্ব বর্ধমান জেলার গুসকরার কাছে কোগ্রামে অবস্থিত এই সতীপীঠ।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় কোগ্রামের সতীপীঠ উজানিতে মাতা সতীর বাঁ হাতের কনুই পড়েছিল।যার সাধনায় অনেক অসাধ্যকে সাধ্য হতে দেখেছেন ভারতবাসী। এদেশের প্রতিটি ঘরে রয়েছে ঈশ্বর আরাধনার বাতাবরণ। রয়েছে সেই মহাশক্তির ছায়া। বাকি ভারতের সঙ্গে তুলনা টানলে দেখা যাবে যে এই বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। এমনকী এখানে নাস্তিকতার আড়ালেও চলে দৈব সাধনা, পুজো-অর্চ্চনা, জপ-তপ। চলে তন্ত্রচর্চাও। যার সাহায্যে জীবনের অনেক কঠিন পরিস্থিতিকে সহজে সামলে নেন ভক্তরা।

এই বাংলার আরও বড় সুবিধা যে এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি শক্তিপীঠ। বেশ কয়েকটি সিদ্ধপীঠ। এই বাংলায় জন্ম নিয়েছেন একের পর এক মহাপুরুষ। এমনই এক শক্তিপীঠ হল পূর্ব বর্ধমান জেলার কোগ্রামের উজানি। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী যেখানে দেবী সতীর বাম হাতের কনুই পড়েছিল। এখানে দেবী মণ্ডলচণ্ডী। আর ভৈরব কপিলাম্বর বা কপিলেশ্বর।

রিমি বলল,এছাড়া পূর্ব বর্ধমান জেলায়,ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা মা,কেতুগ্রামের বাহুলক্ষীতলা ও অট্টহাস সতীপীঠ উল্লেখযোগ্য সতীপীঠ বলে পরিচিত। সমীরণদা আজকের রাতটা আমাদের বাসায় থাক।সমীরণ বলল,নিশ্চয়ই।

তারপর রাত হলে বিপিন সমীরণকে পাঁচলাখ টাকার চেক দিয়ে বলল,তুমি তোমার আশ্রমের উন্নতি করো।আমি ও রিমি বয়স হলে তোমার সঙ্গি হব।

সমীরণ বলল,টাকায় আমার কাজ নেই।তবু আশ্রমের সেবার কাজে লাগে ভক্তদের সাহায্য। আমার আশ্রমের প্রবেশদুয়ার তোমাদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে চিরকাল।সমীরণ সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ল অজানার টানে।
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in



















যুদ্ধমাঝে শান্তির দূত মাহমুদ দারবিশ



সুপ্রিয় বাসু,

বহুবছর পর তোমার ভাবানুবাদে সিলভিয়া প্লাথের কবিতা পড়ে দারুন লাগলো। মনে পড়ে গেলো মাহমুদ দারবিশের কবিতার কথা। ‘ফিলিস্তিন’ বর্তমান বিশ্বের এক আলোচিত ভূখণ্ডের নাম। ভূমধ্যসাগরের তীরের এই দেশের রয়েছে হাজার বছর পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্য। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষভাবে আলোচিত হবার কারণ অবশ্য এটি নয়। ফিলিস্তিন নিয়ে বাতচিতের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে থাকে তিন ধর্মের পবিত্র শহর জেরুজালেম ও সেখানকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনি। জায়নিস্টদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের নিপীড়িত হবার ঘটনা নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর সেই যে শুরু হয়েছিল তা এখনও চলমান। ফিলিস্তিনের (আরবি উচ্চারণে ফলাস্তিন) গাজায় এখন যা ঘটছে তা কেবল গণহত্যা নয়, এটা জাতিহত্যা। একটি মুক্তিপিয়াসী জাতিকে নির্মূল করতে সেখানে চলছে পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। গাজা এখন ‘বসবাসের অযোগ্য’ এক মৃত্যু-উপত্যকা। প্রতিদিনই সেখানে লাশের মিছিল বাড়ছে। এর প্রকৃতির জলপাই রঙের স্নিগ্ধ মেদুরতা প্রায়-অপসৃত, মাটি রক্তাক্ত, আকাশের নীলিমা বিধ্বস্ত। নির্বাসন ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই তাদের।

ভাষা ও সাহিত্যের সবচেয়ে বলিষ্ঠ মাধ্যম কবিতা। সুপ্রাচীনকাল থেকে কবিতাই মানুষের দ্রোহ, প্রেম, আবেগ, অনুভূতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চার অন্যতম প্রধান অবলম্বন। মন ও মননের ছান্দসিক প্রকাশের কারণে সব যুগেই কবি ও কবিতা সমাদৃত। যুগে যুগে স্থান, কাল ও সীমান্তের সীমা অতিক্রম করে কবিতা হয়ে উঠেছে মানব ও মানবতার বৈশ্বিক কণ্ঠস্বর। মাহমুদ দারবিশের কবিতা এমনই—ভালোবাসা ও বিদ্রোহ, প্রতিরোধ ও আলিঙ্গন হাত ধরাধরি করে এগোয়। বয়স যখন উনিশ, প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ আসাফির বিলা আজনিহা (‘উইংলেস বার্ড’ অথবা ‘পালকহীন পাখি’)। প্রথমদিকে তিনি ধ্রুপদী রীতিতে কবিতা লেখা শুরু করেন। কিন্তু খুব বেশিদিন এই ধ্রুপদী দুর্গের মধ্যে আটকে থাকেননি দারবিশ। সিরীয় কবি সিজার কাব্বানি এবং আলী আহমদ সাঈদ অ্যাডোনিসের নব্য কবিতা আন্দোলনের আছড়েপড়া ঢেউ তাঁর ধ্রুপদী ভাবনার নীল নির্জন দুর্গকে ভেঙে খানখান করে দেয়। স্বপ্নলোকচারী কবি চলে আসেন মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে লোকানুবর্তী ও লক্ষ্যভেদী। ফিলিস্তিনের মাঠ, ক্ষেত, উপত্যকা, মাটি, অলিভ গাছের সারি প্রভৃতি দিয়ে দারবিশ নির্মাণ করতে থাকেন কবিতার পর কবিতা। ফিলিস্তিনের নিসর্গের বিমূর্ত সুর আর স্বাধীনতা, প্রেম, স্বাদেশিকতার ধারণার যোগসাজশে দারবিশ এক বিশ্বজনীন কবিতা নির্মাণের প্রয়াস পান। দারবিশের কবিতার ভাষা সহজ ও স্বচ্ছ। কিন্তু তাতে রয়েছে মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার সুদৃঢ় অঙ্গীকার। তাঁর কবিতা পড়লে এক গভীর মানবিক চেতনায় সমস্ত দেহমন আন্দোলিত হয়ে ওঠে। বিপন্ন অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়েও তিনি কখনো মানবতা ও মানবপ্রেমের মন্ত্র থেকে বিচ্যুত হননি।

মাতৃভূমি থেকে উন্মূল মাহমুদ দারবিশ আজীবন হৃদয়ের অন্তস্তলে ধারণ এবং লালন করেছেন বেদনাপীড়িত, বুলেট-বেয়নেট-বোমায় ক্ষতবিক্ষত ফিলিস্তিনকে, কবিতার শাণিত হাতিয়ার দিয়ে লড়েছেন ফিলিস্তিনি জনগণের জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীন বাসভূমির জন্য। কৈশোর থেকেই তিনি ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে থেকে লড়াই করেছেন প্রবল পরাক্রান্তের বিরুদ্ধে। আর সেই লড়াইটা করেছেন কবিতার শাণিত শব্দাবলি দিয়ে। দারবিশ প্রথম কবিতা পাঠ করেন ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে। স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি আবৃত্তি করেন : ‘তুমি চাইলেই সোনালি রোদে খেলা করতে পারো, তুমি চাইলেই হাতের নাগালে পাও আলোকিত পুতুল, কিন্তু আমার তা নেই। তোমার আছে ঘর, আমার কিছু নেই। তোমার আছে উৎসব আর উদ্যাপন, কিন্তু আমি তার দেখা পাই না। বলো, কেন আমরা একসঙ্গে খেলতে পারি না।’ ফিলিস্তিনিহীন পৃথিবীর মানচিত্রে বালক দারবিশের কবিতা যেন লাল ফিলিস্তিন হয়ে আঘাত করে ইসরায়েলিদের বুকে। কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে বারুদের গন্ধ! এমন বারুদমাখা কবিতা শুনে স্কুল কর্তৃপক্ষ ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ হয় দারবিশের ওপর, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর লোকেরা তাকে শাসিয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর কবিতাটা কতটা ক্ষুরধার, কতটা অভ্রভেদী। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই আরবি ভাষায় রচিত, তবে অনায়াসে লিখতে পারতেন হিব্রু, ইংরেজি, ফরাসিতে। ‘আরবদের সবচেয়ে উৎকর্ষশীল শিল্প’ কবিতাকে তিনি এক নতুন ভুবনের সন্ধান দেন, অধিষ্ঠিত করেন অনন্য উচ্চতায়, ফলে মাহমুদ দারবিশের কবিতা ও প্রবন্ধের দ্যুতি আরব জাহান অতিক্রম করে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক চেতনার কবিতার পাশাপাশি দারবিশ বার বার বলতেন শুদ্ধ কবিতার (Pure Poetry) কথা। কেননা তার কবিতা হলো বহুমুখী সংস্কৃতির সঙ্গে কথোপকথন। নির্দ্ধিধায় তিনি কবিতায় ব্যবহার করেন ইসলামিক, খ্রিষ্টিয় ও ইহুদি মিথ। মোহময় সংগীতময়তায় আচ্ছন্ন তাঁর কবিতা। যেখানে রয়েছে জীবনের আশ্চর্যময়তা Mistry of Life এবং মৃত্যু। কিন্তু মৃত্যু তাঁর কাছে এক অন্য রূপান্তর। জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনিই তো বলতে পারেন:- “যখনই আমি নিজেকে খুঁজি অসংখ্য মানুষের দেখা পাই যখনই তাঁদের খুঁজতে যাই তখন আমি একা নিঃসঙ্গ। তখন আমি লাখো জনতা।” (ম্যুরাল) এভাবেই তিনি আত্মপরিচয়ের অযুথ বাণী তুলে ধরেন কবিতায়। জীবনের যুযুধান সময়কে সামনে রেখে হাঁটতে থাকেন। কেননা একই সঙ্গে তিনি একা এবং অসংখ্য। (Individul Crowed) জাতিগত বিভেদের সমথনে যখন রাষ্ট্রীয় শক্তি দম্ভ প্রকাশ করে, দুই মানুষের মাঝখানে দেয়াল তুলে দেয়, তখন একজন কবিকে তা সবচেয়ে বেশি আহত করে। সাহিত্য-সমালোচকরা তাঁকে চিহ্নিত করেন আরব জাহানের সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও সম্মানীয় কবিদের একজন এবং সমকালীনদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হিসেবে। ‘কেউ কেউ মনে করেন, আরব-কবিদের মধ্যে অ্যাডোনিসের পরেই তাঁর স্থান। তবে কাব্যচিন্তা ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে অ্যাডোনিসের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য অনেক। বর্তমানে আরব কবিতায় যে আধুনিকতা দেখা দেয় তা প্রধানত এসেছে অ্যাডোনিসের হাত ধরেই। কিন্তু আরব কবিতায় যে বিপ্লবী জোশ দেখা দেয় তা এসেছে দারবিশের হাত ধরে।’ প্রিয় স্বদেশের বিপন্ন মুখ, দখলদার বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন এবং বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ, ফিলিস্তিনিদের মরণপণ লড়াই – এসবই দারবিশের কবিতার প্রধান বিষয়। রক্ত, আগুন, প্রতিবাদ, জখম, পাথর এ-ধরনের শব্দ ও চিত্রকল্প বারবার ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় শৈল্পিক প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক চিন্তা, দেশাত্মবোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মাতৃভূমির প্রতি দুর্মর ভালোবাসা, পাইন-জলপাই ঘেরা স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন তাঁকে কবি করে তোলে, যদিও তিনি বলতেন, ‘আমি এখনো কবি হয়ে উঠতে পারিনি, মনে হচ্ছে এ-পথে আসাটাই ভুল হয়েছে।’ তাঁর বেশিরভাগ কবিতাতেই ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের মর্মভেদী বেদনা এবং তাদের প্রতি কবির উদ্বেগ ও আতঙ্ক। তাঁর প্রায় সব ধ্যানজ্ঞান, স্বপ্ন-কল্পনা আবর্তিত হয়েছে আরবদের ইতিহাস-ঐতিহ্য কিংবা পিতা-পিতামহের অতীত স্মৃতি ও বেদনাকে ঘিরে। উদ্বাস্তু জীবন থেকে দেশে ফিরে তিনি অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে লিখেছেন : ‘আমি ফিলিস্তিনে। কিন্তু কোথায় আমার ফিলিস্তিন? আমি কখনো আমার বাড়িতে ফিরে যেতে পারিনি। প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমার গ্রাম বিধ্বস্ত-ভস্ম।’ জন্মভূমি হারানোর বেদনা আর নির্বাসিত জীবনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নানাভাবে মূর্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়, তাঁর প্রবন্ধে। মাতৃভূমির প্রতি প্রবল টান, স্বজন-হারানোর বেদনা-হাহাকার, দেশত্যাগজনিত ক্ষত ও রক্তক্ষরণ তাঁকে কলম ধরতে ও তাতে শাণ দিতে শিখিয়েছে। শেকড়ে ফিরে আসার প্রবল আকুতি, বুকের মধ্যে জমা দ্রোহ-দাহ, ক্ষোভ, হাহাকারই বারবার ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি হয়ে বেজেছে তাঁর কবিতায় ও সৃজনভুবনে। দারবিশের কবিসত্তা জাগ্রত হয়েছে প্রাচীন আরব কবি মু-আল্লাকারের কবিতার স্বপ্নছোঁয়ায়, পিতামহ হুসাইন দারবিশের কাব্যপ্রীতিও তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তবে তাঁর কবি হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে নিজ মাতৃভূমির রক্তাক্ত-ছিন্নভিন্ন মানচিত্র ও ইসরায়েলিদের বর্বরতা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর মতো আর কোনো শতাব্দীতেই এতো অধিকসংখ্যক মহান কবির জন্ম হয়নি।’ উৎপীড়ন, যুদ্ধ, বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলির উত্থান-পতন, বর্ণবাদ, স্বৈরতন্ত্র, ফিলিস্তিনি ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও এই শতাব্দীতে অসংখ্য কবি আবির্ভূত হয়েছে। এই শতাব্দী যেমন যুদ্ধ, ধ্বংস, অশ্রু এবং ট্র্যাজেডির শতাব্দী, তেমনি কবি ও কবিতার উৎকর্ষের শতাব্দী। মাতৃভূমি, নিপীড়িত দেশবাসীর বেদনামাখানো চিৎকার-হাহাকার, বিশ্বরাজনীতির মোড়লদের অমানবিক কু-নাট্যের অভিঘাতে দারবিশের প্রতিটি কবিতা হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। অগ্নিদগ্ধ জাতির অগ্নি ও উত্তাপ ধারণ ও লালন করার জন্য তাঁকে ‘পোয়েট অফ দ্য রেজিস্ট্যান্স’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ‘দখলদার ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা ফিলিস্তিনিদের মূলধারার রাজনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।’ আরবি ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের রক্ষাকর্তা হিসেবে এই কবি বিশ্বাস করতেন, তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি একদিন ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির থাবা থেকে মুক্ত হবেই। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে রাখলেও তারা তাঁর জিহ্বায় উচ্চারিত শব্দ ও প্রতিবাদী কবিতাকে দখল করতে পারেনি, পারবেও না। ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তির লড়াইকেও স্তব্ধ করতে পারবে না। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, কবিতাকে যেমন ধ্বংস করা যায় না, তেমনি মানুষের মুক্তির লড়াইকেও থামানো যায় না।

তুমি যেভাবে প্লাথের কবিতা পাঠিয়েছিলে,তোমার মতন করে দারবিশের কবিতার ভাবানুবাদ করে পাঠাতে পারলাম না। কিন্তু ইচ্ছে ছিল তোমাকে লিখে দেই একটা গোটা জীবন, যাক সব পেলে জীবন হয়ত অতৃপ্ততা চিনতো না। ভালো থেকো নিরন্তর। শেষ করার আগে দারবিশের কবিতায় খুব বলতে ইচ্ছে করছে -

Between Rita and my eyes
There is a rifle
And whoever knows Rita
Kneels and prays
To the divinity in those honey-colored eyes.
And I kissed Rita
When she was young
And I remember how she approached
And how my arm covered the loveliest of braids.
And I remember Rita
The way a sparrow remembers its stream
Ah, Rita
Between us there are a million sparrows and images
And many a rendezvous
Fired at by a rifle.
Rita’s name was a feast in my mouth
Rita’s body was a wedding in my blood
And I was lost in Rita for two years
And for two years she slept on my arm
And we made promises
Over the most beautiful of cups
And we burned in the wine of our lips
And we were born again
Ah, Rita!
What before this rifle could have turned my eyes from yours
Except a nap or two or honey-colored clouds?
Once upon a time
Oh, the silence of dusk
In the morning my moon migrated to a far place
Towards those honey-colored eyes
And the city swept away all the singers
And Rita.
Between Rita and my eyes—
A rifle.



শুভেচ্ছান্তে-
সুস্মি
১৭ মে, ২০২৫
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


১১

বের্নহার্ড এখনও চার্লসের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানে না। তবুও তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সে প্রাণপণে নিজের বিস্ময় এবং বিরক্তি গোপন করবার চেষ্টা করে যায়। তাছাড়া তার রেওয়াজের সময় অর্ধেকের বেশি পেরিয়ে গেছে। কিন্তু চার্লসের মত এক সম্পূর্ণ অচেনা অজানা মানুষ কেন তাকে বিশ্বাস করে এত ব্যক্তিগত কথা বলে চলেছে সে একেবারেই বুঝতে পারছে না। এদিকে চার্লস একেবারেই লক্ষ্য করছে না যে বের্নহার্ড অধৈর্য হয়ে উশখুশ করছে। সে বিরতিহীনভাবে নানা কথা বলে যাচ্ছে। এমন ভাবে বলছে যেন এই কথাগুলো এই মুহূর্তে সে শুধুমাত্র বের্নহার্ডকেই বলতে পারে। তার এখন এক সহমর্মী বন্ধু না হলেও, নিদেনপক্ষে একজন একনিষ্ঠ শ্রোতা প্রয়োজন। ‘কারণ’ সে বলে… ‘আপনি বুঝতেই পারছেন যে আমি একবর্ণ বানিয়ে বলছি না। আমি তো আগাগোড়া আন্তরিক থাকতেই চেয়েছি, কিন্তু এই মুহূর্তে তো সেটাও সম্ভব নয়, তাই না?’ তার মানে সে বলতে চাইছে যে কাউকে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে সে দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে, মানে তাকে কেউ ঠকিয়েছে। অর্থাৎ সে নিজের কাহিনী একটা পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শুরু করেছে। অথচ সে যে সত্যি বলছে, অর্থাৎ তার নিজের যে কোনও দোষ নেই, সেটা বের্নহার্ডের কাছে প্রমাণ করবার কোনও সুযোগ এই মুহূর্তে তার কাছে নেই। কিন্তু গতকাল তার সঙ্গে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে; ফলে সে একেবারে ভেঙে পড়েছে। এই ঘটনা হয়তো সে নিজের মধ্যেই গোপন রাখতে পারত, কিন্তু এই ঘটনার মধ্যে আবার অনেকগুলো অতীতের সূত্র আছে। সেই সূত্রের সঙ্গে সংযুক্ত ঘটনাগুলো আবার বেশ দীর্ঘ। সেই পুরো ইতিহাস না বললে বের্নহার্ড কিছুই বুঝতে পারবে না। আবার যাদের নিয়ে এসব ঘটনা, তাদের কাউকে বের্নহার্ড চেনে না। ফলে সবকিছু খুলে না বললে ব্যাপারটা একেবারেই বোধগম্য হবে না।



অবশেষে চার্লস একটু ঠিকঠাক বাক্য গঠন করে কথা বলতে শুরু করে এবং একেবারেই থামতে পারে না সে। সে ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে কথা বলে যায়। বের্নহার্ড মৃদু হাসে তার দিকে তাকিয়ে। সে এই প্রথম হাসল চার্লসের দিকে তাকিয়ে এবং হাসির মধ্যে কোনও মেকি, সাজানো ব্যাপার নেই। তার মনে হল যে যদি সে একটু কষ্ট করে কথাগুলো শোনে, হয়তো তাহলে চার্লসের কষ্টটা একটু লাঘব হবে। সে সহানুভূতির সঙ্গে প্রশ্ন করে, ‘ঠিক কী হয়েছে?’ একটু সামনে ঝুঁকে বসে সে, যাতে বোঝা যায় যে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে সে সব কথা শুনছে। বের্নহার্ডকে চার্লস যেন অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরতে চায়। কথা বলতে বলতে সেও ঝুঁকে পড়ে টেবিলের উপরে। বের্নহার্ডের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে বলতে প্রায় তার মুখে মুখ ঠেকে যায়।

‘আপনি আমার বন্ধু’ সে ফিসফিস করে, ‘ওঃ, আমার মনে হচ্ছে যে আপনি আমার বন্ধু হতে চাইছেন, তাই না?’

বের্নহার্ডের একটু অপ্রস্তুত বোধ হয়; যদিও এই ভিনদেশি ছেলেটির আবেগ তাকে স্পর্শ করে, কিন্তু এই আবেগের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর ভাসিয়ে নেবার মত গতি আছে, যেটা তার ততখানি পছন্দের নয়। সে মৃদুস্বরে চার্লসের দিকে না তাকিয়েই বলে “Mais oui – soyez tranquille, je vous en prie, soyez tranquille!” (মাই উই— সইয়ে ত্রংকিল, জেভোসেঁপ্রি, সইয়ে ত্রংকিল) যার অর্থ হল ‘কিন্তু হ্যাঁ, শান্ত হোন, দয়া করে শান্ত হোন!’



চার্লস উঠে দাঁড়ায় তার দু’হাত আলোকিত টেবিলের উপরে রেখেই। তার হাতের আঙুলগুলো সরু সরু হলদেটে, বিশ্রী হাতের নখ।

‘ওঃ’ হঠাৎ তার কণ্ঠস্বরে একটু উদাস ভাব আসে, ‘ভাববেন না যে আমি আপনাকে খুব নাটকীয় কোনও গোপন কথা বলব। আমি আপনাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছি। তাই না? মাপ করবেন। আসলে অনেক সময় আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। আমি যথেষ্ট শিক্ষিত নই আপনার মত! গতকাল যা ঘটেছে, তার জন্য আমার দুর্বল শিক্ষাদীক্ষা দায়ী; নাহলে হয়তো ওই ঘটনাটা এড়ানো যেত। আপনার জানা আছে আশা করি যে আমার ধূমপানের অভ্যেস আছে। আসলে এটা ঠিক নেশা নয়, কিন্তু পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবার সময়ে আমার ধূমপান করা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন এই অভ্যেসটা ছাড়তে পারছি না। এটা ভাল নয়, কারণ খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু একটা গোটা সন্ধ্যা যদি ধূমপান না করে থাকতে হয়, তাহলে সেটাও আমার পক্ষে কষ্টকর। না, কষ্টকর নয়, বিষণ্ণ, ওঃ না, বিষণ্ণ সঠিক শব্দ নয় এক্ষেত্রে। বরঞ্চ বলা চলে যে আমার অস্থির লাগছিল, কিছু ভাল লাগছিল না, কী যেন খুঁজছিলাম আমি… জিভের মধ্যে একটা বিশ্রী স্বাদ… সবার সব কথার উত্তরে কটু কথা বলেছি আমি। গতকালের ব্যাপারটা কতকটা এইভাবেই শুরু হয়েছিল। আমরা বন্ধুরা রবার্টের সঙ্গে বসেছিলাম। রবার্টের কাছে কোনও সিগারেট ছিল না। ওইখানে আরও দুটো মেয়ে ছিল, ওরা গান গায়, ওরা বলল যে ওদের সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য হয় না। তো… সেইজন্য আমি সিগারেট কিনতেও যেতে পারছিলাম না, যদিও আমার কাছে পয়সা ছিল (আসলে গতকাল ফাঁকেতালে আমি এক বন্ধুর কাছ থেকে অনেক আগের ধার দেওয়া টাকাটা ফেরত পেয়েছিলাম।)। কিন্তু মেয়েদুটো যে সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারেনা, এটা একেবারে বাজে কথা… কারণ প্রতি সন্ধ্যায় আমি ওদের ঘন ধোঁয়ার মধ্যে বিবি বারে বসে ড্রিঙ্ক করতে দেখি। যাকগে, কে আর প্রমাণ করতে যাবে যে ওরা গায়িকা টায়িকা কিচ্ছু নয়, বরঞ্চ একেবারে সাধারণ অসফল বার গার্ল। কারণ ওরা যদি সফলই হবে… তো ওরা যেটা নয়, নিজেদের সেটা প্রমাণ করবার কোনও দায় থাকত না। মিছে ভান করত না তাহলে!’

চার্লস নিজের সঙ্গেই রাগতস্বরে কথা বলে যাচ্ছে। কণ্ঠস্বরে ঘৃণা এবং অবজ্ঞা ঝরে ঝরে পড়ছে। বের্নহার্ডের অবাক লাগে। সিগারেট খেতে না পারা কিম্বা ওই মেয়েদের আপত্তি, যারা গায়িকা হতে পারে কিম্বা হতেই পারে বার গার্ল… ধূমপান না করা কিম্বা ওই মেয়েদের সফল হওয়া… এইগুলোর মধ্যে কোনওটাই এমন উগ্র আচরণের কারণ হতে পারে না।

চার্লস বের্নহার্ডকে খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করে হিংস্রভাবে বলে ওঠে… ‘আপনার এত অবাক হবার মত কোনও কারণ ঘটেনি। আপনি জানেন না যে সারা সন্ধ্যা একঘেয়ে ধরনের মুখে পেইন্ট করা মেয়েদের পাশে থাকা কতখানি বিরক্তিকর, তাদের বোকা বোকা কথা শুনে যাওয়া, সর্বোপরি তাদেরই আপত্তির কারণে সিগারেট না খাওয়া… পুরো ব্যাপারটাই বিশ্রী এবং বিরক্তিকর। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না যে মেয়েগুলোর কণ্ঠস্বর কতখানি বোকা বোকা এবং অসহ্য! আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল। অতিকষ্টে নিজেকে সামলেছি। অবশ্যই আমি চলে আসতে চেয়েছিলাম (ফিরে এলেই ভাল হত!); কিন্তু আমি ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। আপনাকে বুঝতে হবে গোটা ব্যাপারটা। সারাদিন স্কুলে, তারপর সন্ধেবেলায় এইসব… নিজেকে স্পঞ্জের মত মনে হচ্ছিল আমার।’

‘আপনি ঘুমোতে চলে গেলেন না কেন?’

-‘আমার রবার্টের সঙ্গে থাকবার কথা ছিল। আপনি বুঝবেন না, কিন্তু ব্যাপারটা খুব প্রয়োজনীয় আমার কাছে। রবার্ট একটু অদ্ভুত ব্যক্তি এবং আপনি যদি তার বন্ধুবৃত্তে থাকেন, তাহলে বুঝবেন যে একটা সন্ধ্যাও রবার্টের সঙ্গ ছাড়া চলবে না আপনার। অনেকের সঙ্গে দেখা হয় সেখানে। হতে পারে যে ওইখান থেকে নানা যোগাযোগ হল ভবিষ্যতে কাজকর্মের ব্যাপারে। যদিও এখন এসব আমার কাছে অতীত… অবশ্যই অতীত। আমি সেখানে আর যাচ্ছি না। আপনি জানেন জেরাল্ডের উপরে ঐ রোমানিয়ান নেকুপুষুর কতখানি প্রভাব? কিন্তু আপনি তো আবার জেরাল্ডকে চেনেন না।’



বের্নহার্ড গভীরভাবে ভাবতে থাকে। জেরাল্ড নামটা সে এর মধ্যেই শুনে ফেলেছে। এই নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তার সঙ্গীতশিক্ষকের বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। তিনি তাকে তাঁর বাড়িতে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওঁর ভিজিটিং কার্ডটা এখনও আছে তার কাছে। কিন্তু সেই জেরাল্ড চিকিৎসক, একজন নামকরা শল্যচিকিৎসক। চার্লস যার সম্বন্ধে বলছে, হয়তো তিনি অন্য কোনও ব্যক্তি।



(চলবে)
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২১.১

সাত সকালে গোটা গাঁয়ে খবর চাউর হল যে পুলিস জোগনাথকে গ্রেফতার করেছে। সবাই অবাক,

ব্যাটা জোগনাথ তো বৈদ্যজীর লোক। ওকে ছুঁতে পুলিসের হিম্মৎ হল? গ্রামের গুণ্ডার দল এবং

ভালোমানুষ –সবাই ঘাবড়ে গেল। গুন্ডাদের চিন্তা—যখন বৈদ্যজীর খাস আদমীকে পুলিস ছেড়ে কথা

কয় নি, তো আমরা কিসের খয়ের খাঁ! ভালোমানুষের দল ভাবল—পুলিস যখন নিজেদের লোকের সঙ্গেই

এমন করেছে, তখন সময় খারাপ হলে আমাদের সঙ্গেও কী করবে , কী না করবে -কে জানে!

পুলিশের সমস্ত গ্রেফতারি বেশ নাটকীয় হয়, এটাও ব্যতিক্রম নয়।

এটা না বললেও চলে যে ব্যাপারটাকে নাটকীয় করে তোলার সমস্ত কৃতিত্ব পুলিশের। দারোগাজীকে

পড়ানো হয়েছিল যে বিপদজনক আসামীদের ধরতে উপযুক্ত সময় হল রাতের চতুর্থ প্রহর। তাই

জোগনাথকে ধরার জন্য ব্রাহ্মমুহুর্তই ঠিক হল--- যদিও সারাদিন জোগনাথকে গ্রামের মধ্যে

খোলাখুলি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এবং তাকে থানায় ডেকে এনে আটকে রাখা খুব সহজ।

ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ পুলিস এসে জোগনাথের বাড়ি ঘিরে ফেলল। এটা জানা কথা যে এখানে

গোলাগুলির কোন সম্ভাবনা নেই। তাই সব পুলিসের হাতে রাইফেল! দারোগাজী তাঁর পিস্তলে গুলি ভরে

হেড কনস্টেবলের কানে কানে বললেন—কানপুর থেকে একদল বদমাশ কাল এদিকে এসেছে। হতে পারে

ওরা জোগনাথের ঘরে লুকিয়ে আছে।

হেড কনস্টেবল—হুজুর, কানপুর থেকে যারা এসেছে ওরা আচার্য ভাবের ভুদান আন্দোলনের

কার্যকর্তা।

‘ওটাই তো’, দারোগাজী ফুসফুস করে বললেন,’ আগেকার দিনে বদমাশেরা সাধুর বেশ ধরে ঘুরে বেড়াতো,

আজকাল অন্য বেশ ধরেছে’।

সমস্ত সিপাহী প্রথমে বজরঙ্গবলীর নাম জপল, তারপর বৌ-বাচ্চার মুখ মনে করল। অবশেষে

হাতিয়ার তুলে বদমাশের দলের সঙ্গে মুখোমুখি হতে এগিয়ে চলল। সবাই নিশ্চিত মৃত্যুর জন্যে তৈরি,

সবার প্রাণ ধুকপুক করছে।

বাড়ি ঘেরাওয়ের পর বড় বড় পদক্ষেপ নেয়া হল। সমস্ত সেপাই খৈনি না ডলে, বিড়ি না খেয়ে পজিশন

নিয়ে পাথরের মূর্তির মত আধঘণ্টা অপেক্ষায় বসে রইল। কেউ হাসে নি, কেউ কাউকে হাসায় নি।

একজন সেপাই জুতো খুলে বুকে হেঁটে সবার কানে কানে মন্তর দিতে লাগল—ধৈর্য ধর, কোন বিপদের

সম্ভাবনা নেই।

সবাই অভিজ্ঞ, জানে যে বিপদ কারও মুখের কথায় কাটে না। তাই সবাই বিপদের মধ্যেই ঘাঁটি গেড়ে

বসে রইল। দারোগাজী পিস্তল নিয়ে এবং হেড কনস্টেবল রাইফেল হাতে জোগনাথের দরজায় দাঁড়িয়ে।

একটা লোক গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ওকে দেখে হেড কনস্টেবল ইশারায় ডাকল, কাছে এলে কানে কানে

প্রশ্ন করল,--পালাচ্ছিলে?

ও পালটা জবাব দিল—পালাবো কেন? সাতসকালে আপনাদের মুখদর্শন করার থেকে রেহাই চাইছিলাম।

দারোগাজী ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললেন—স্‌ স্‌ স্‌!




হেড কনস্টেবল—এই বারান্দায় বসে পড়। সাক্ষী দেবে।

ও বলল, --এখানে বসার কী দরকার? কাল, পরশু, তরশু যেদিন ইচ্ছে খবর দেবেন। এসে সাক্ষী দিয়ে

যাব। আমি আপনাদের পর তো নই।

ও কেটে পড়ছিল। হেড কনস্টেবল ফের ওর কানে কানে বলল,--ঠিক আছে, যাও। কিন্তু খবরদার!

আমরা যে এখানে রয়েছি সেটা কাউকে বলবে না।

ও হেড কনস্টেবলের কানে নিজের নাক ঢুকিয়ে বলল—বলার কী আছে? গোটা গাঁ জেনে গেছে।

লোকটা চলে গেল। ঘরের পেছনে ওত পেতে বসে থাকা সেপাইদের এবার বিড়ি-খইনির নেশা চাগাড় দিচ্ছে।

প্রায় ফর্সা হয়ে এসেছে। একটু দূর থেকে একজন আরেকজনকে দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ পেছনের সারির

সেপাইদের কানে এল খড় খড় শব্দ। কেউ বোধহয় বাইরের দরজাটা খুলছে। চটপট কথাবার্তার আওয়াজ

ভেসে এল। এরা বুঝে গেল –ধর্মক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের লগ্ন এসে গেছে। এরা বন্দুক ও

সঙীন উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।




ওদিকে দরজার কাছে কথাবার্তার স্বর আরও দ্রুত লয়ে চলছে এবং ক্রমশঃ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

সেপাইয়ের দল শরীরের ভেতর এক অস্বস্তি বোধ থেকে ছটফট করে কাশতে লাগল এবং প্রত্যেক

কাশির সঙ্গে শরীরের সমস্ত ছিদ্র থেকে পবন-মুক্তাসন! একটু পরে কাহিনীর ক্লাইম্যাক্স এল।

বিপদ সংকেতের সিটি বেজে উঠতেই এরা দৌড়ে দরজার কাছে পৌঁছে গেল। সেখান থেকে দৌড়ে পঞ্চাশ

গজ দূরের আমবাগানে। একেবারে নাটকীয় পরিস্থিতি!

ওরা দেখল-- জোগনাথ মাটিতে বসে আছে। দারোগাজী ওর বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে রেখেছেন। হেড

কনস্টেবল অন্যদিক থেকে সঙীন উঁচিয়ে রয়েছে। স্টেজে ব্লকিং হিসেবে দারুণ। শুধু ড্রপসিন নামাটাই

বাকি। সেপাইয়ের দল এসে দ্রুত কম্পোজিশন বদলে দিল। ওরা জোগনাথের শরীরের যতটুকু ভাগ

পিস্তল সঙীনের নিশানা থেকে বেঁচে রয়েছে সেখানে কব্জা করল। জোগনাথের একটুদূরে একটা বদনা

উলটে পড়ে আছে। পাশের খানিকটা জমি জলে ভেজা। দারোগাজী একটা সেপাইকে হুকুম করলেন—“ ওই

লোটা বাজেয়াপ্ত কর, প্রমাণ পেশ করতে কাজ দেবে”।

সেপাই বদনা তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে তারিফের সুরে বলল—মোরাদাবাদী পিতলের লোটা! তারপর কী

ভেবে বলল—সীল লাগিয়ে দিই?

--এখন না, পরে হবে’খন।

সেপাই লোটার জল পড়ে ভিজে যাওয়া জমি দেখতে দেখতে বলল—‘ওই মাটিও খানিকটা তুলে নিয়ে রাখি?

এটাও প্রমাণ হতে পারে’।

হেড কনস্টেবল ধমকে উঠল—বেশি চালাকি কোর না। যতটুকু বলা হয়েছে ততটাই কর।

দারোগাজীর হুকুমে জোগনাথকে দাঁড় করানো হল। ওর শরীর সার্চ করা হল। ফের বেয়নেট খাপে ঢুকে

গেল, পিস্তল চামড়ার হোলস্টারে। সেপাইদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হল।

একজন বলল-- ‘এ ব্যাটা বোধহয় সাতসকালে পেট সাফ করতে মাঠে গিয়েছিল।




দ্বিতীয়—কে বলতে পারে, হয়ত কাছাকাছি কোন বদমাশের দল আস্তানা গেড়েছে। ওদের খাবার এবং

জলটল দিতে গেছল।

তৃতীয়—এবার বৈদ্য্যজী ঝামেলা পাকাবেন।

চতুর্থ নীচুগলায় বলল—বৈদ্যজী এখন দারোগাজীর পকেটে; এবারের রেইড কাপ্তান সাহেবের হুকুমে

হয়েছে।

পঞ্চম—চুপ! চুপ! ওদিকে দেখ, কেমন তামাশা জমেছে।

জোগনাথ নিজের জায়গায় কোন লোকনৃত্যের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে এটা স্পষ্ট যে ও নাচবে না।

হঠাৎ দারোগাজী ওর গালে জোরদার থাপ্পড় লাগিয়ে বললেন—লোটা নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছিল?

আঘাত সামলাতে ও খানিকক্ষণ চোখ মিটমিট করল। তারপর দারোগাজীর চোখে চোখ রেখে

বলল—আমাকে টুকরো করে কেটে ফেললেও উকিল না আসা পর্যন্ত কিস্যু বলব না।

দারোগাজী হেড কনস্টেবলকে বললেন—ব্যাটাকে হাতকড়ি লাগিয়ে নিয়ে চল। এখন ওর ঘরের

খানাতল্লাসি নেয়া দরকার।

‘একে জেরা করাও দরকার’, হেড কনস্টেবলের মন্তব্য।




পুরো ঘটনার বিবরণ দারোগার মুখ থেকে শুনতে চাইলে উনি যেমন বলবেনঃ

আজ থেকে আট দিন আগে গাঁয়ে চোর এসেছিল। পুলিস গ্রাম-রক্ষা-সমিতির সাহায্যে ওকে ধরার চেষ্টা

করেছিল। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে, চালাক চোর দলের একজন স্থানীয় লোককে ছেড়ে

দিয়ে অন্ধকারে গায়েব হয়ে যায়। পুলিস ও গ্রাম-রক্ষা সমিতির সক্রিয়তার ফলে ওর অপরাধ করার

প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু দলের স্থানীয় লোকটি গ্রাম জুড়ে চোর নিয়ে চেঁচামেচির ফাঁকে গয়াদীনের

বাড়িতে হাত সাফ করতে ঢুকে পড়ে।

গ্রাম রক্ষা সমিতির হাঁক শুনে গয়াদীন পরিবারের সবাই জেগে ওঠে। তখনই কেউ দেখতে পায় যে

একজন সিঁড়ি দিয়ে ছাদে যাচ্ছে। পুলিস হাওয়ার বেগে পৌঁছে যায়, কিন্তু লোকটা বেমালুম হাওয়া। এই

সময় গয়াদীন পুলিসের হাতে চুরি হওয়া গয়না-অলংকারের লিস্টি ধরিয়ে দেয়। জায়গাটাতে ভাল করে

খোঁজাখুঁজি করে পুলিস চলে যায়। ফের পনের দিন ধরে কড়া তদন্ত চলতে থাকে। শেষে পুলিস এই

সিদ্ধান্তে পৌঁছয় –হ্যাঁ, গয়াদীনের ঘরে সেই রাতে চুরি হয়েছে বটে! শুধু তাই নয়, যে চটপট সিঁড়ি ভেঙে

ছাদে চড়ছিল সে চোর না হয়ে যায় না!

তারপর গুপ্তচরের থেকে পুলিস জানতে পারল যে জোগনাথ পিতা রামনাথ, সাকিন শিবপালগঞ্জের ঘরে

এমন কিছু গয়না আছে যা গয়াদীনের বাড়ির হলেও হতে পারে। পাকা খবর পাওয়ায় আজ ভোর ভোর

পুলিস ওর ঘরে পৌঁছে যায়। জোগনাথ ঘর থেকে বেরিয়ে লোটা হাতে কোথাও যাচ্ছিল। পুলিসের মুখোমুখি

হয়ে ও নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে এবং নিজের সামনে ঘরের তল্লাশি করিয়েছে। এই তল্লাশি

আইন মেনে একজন সম্ভ্রান্ত লোকের উপস্থিতিতে হয়েছে।

বলে রাখা ভাল, এইসব পাড়ায় প্রথমত, লোকের দেখা পাওয়াই মুশকিল। দ্বিতীয়ত, যদি পাওয়া যায়ও

সে যে সম্ভ্রান্ত হবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। সে যাই হোক, তল্লাশি দু’জন সাক্ষীর সামনে হয়-- ছোটে




পালোয়ান পিতা কুসহর প্রসাদ এবং বৈজনাথ পিতা ত্রিবেণী সহায়। তবে বৈজনাথ হল ভিন গাঁয়ের

বাসিন্দা। এই ‘সম্ভ্রান্ত’ ব্যক্তিটিকে পাশের গ্রাম থেকে ডেকে আনা হয়।

জোগনাথ দেখিয়ে দিলে ভেতরের ঘরের একজায়গা খুঁড়ে একটা হাঁড়ি পাওয়া যায়। সেই হাড়িতে কিছু গয়না

ছিল। তার বিবরণ নিম্নানুসারঃ

একটি রূপার করধন (কটিবন্দ), দাম হবে পঞ্চাশ টাকা; এক জোড়া বিছিয়া, দাম ধর তিন টাকা; একটা

চাঁদির গয়না, দাম পঁচিশ টাকা। একটা নাকে ফুটো করে পরার সোনার গয়না, দাম হবে তিরিশ টাকা।

এগুলো বাজেয়াপ্ত করে লিস্টিতে ওই দুই সাক্ষীর সই নেয়া হয়েছে। হাঁড়ি সমেত গয়নাগুলো একটা

কাপড়ে বেঁধে সীল করা হয়েছে। সমস্ত প্রক্রিয়া জোগনাথের ঘরে বসে করা হয়েছে।

জোগনাথ গ্রেফতার হওয়ার সময় ঝগড়া হাতাহাতি করেছিল। ওকে ধরতে গিয়ে হেড কনস্টেবলের জামা

ছিঁড়ে যায় এবং হাতে চোট লাগে। জোগনাথকে কাবু করতে ন্যুনতম শক্তি প্রয়োগ করা হয়—ব্যস,

যতটুকু দরকার। পরে আহত সেপাই এবং জোগনাথের ডাক্তারী পরীক্ষা করানো হয়। সেপাই দুই

সপ্তাহের মেডিক্যাল লীভ নিয়ে নিজের গ্রামে চলে গেছে। জোগনাথের শরীরে গোটা কুড়ি নীলচে নিশান

আর চল্লিশটা আঁচড়ের দাগ পাওয়া গেছে। সবগুলো মামুলী চোট, মাটিতে পড়ে যাওয়ার ফল।

এই কাহিনীটি বৈদ্যজীকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শোনানো হল। –পুলিস যা করে ঠিকই করে, এমন শাশ্বত

তত্ত্বে প্রথমবার বৈদ্যজীর সন্দেহ হল।

অবশ্য জোগনাথের সম্বন্ধে বৈদ্যজীর ধারণা খুব যে ভাল ছিল, এমন নয়। কিন্তু উনি যে দুনিয়ায় বাস

করেন সেখানে লোকের সম্মান সে কতটা ভালমানুষ তা দিয়ে ঠিক হয় না—দেখা হয় সে কীরকম কাজের

লোক। ওনার দলের লোকের মধ্যে একমাত্র জোগনাথ খোলাখুলি মাল খেয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর মদের

পয়সা যেখান থেকেই আসুক—নিজের পকেট বা অন্যের—দারু গেলার পরিমাণ কখনও কম হয়না। সব

মিলিয়ে ওকে একটি মাঝারি ধরণের গুণ্ডা বলা যায়।

বৈদ্যজীর সন্দেহ হচ্ছিল যে জোগনাথের গ্রেফতারির পিছে কোন রাজনীতির প্যাঁচ আছে। কিছুদিন ধরে

দারোগাজী যে ওনার বদলে রামাধীন ভীখমখেড়ীকে বেশি কেউকেটা ভাবছেন -এটা ওনার চোখে পড়েছে।

গোড়ায় মনে হচ্ছিল রামাধীন বোধহয় আফিমের চোরাই কারবারে দারোগাজীকেও পার্টনার বানিয়ে

ফেলেছে। এখন মনে হচ্ছে দারোগাজী ধোঁকা খেয়েছেন। বোধহয় ভেবেছেন যে রাজনৈতিক ল্যাং মারার

খেলায় রামাধীন ভীখমখেড়ী বৈদ্যজীর চেয়ে বেশি কাজের। সে যাই হোক, বৈদ্যজী সার বুঝেছেন যে

বর্তমান পরিস্থিতিতে জোগনাথের গ্রেফতারি হলে প্রথমে দারোগা যা চাইবেন তাই হবে। আসলে

রামাধীন ভীখমখেড়ী যা চাইছে তাই দারোগা চাইবেন।

কিন্তু রূপ্পন বাবু জিদ ধরেছেন—রামাধীনকে থানাতেই জামিন করিয়ে ছাড়িয়ে আনা হোক। তাই বৈদ্যজী

ইচ্ছে না হলেও দারোগার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছেন।

দারোগাজী এখন আর ভোর বেলায় দুঁদে দারোগা নন, মানে যিনি চোখ পাকালে গ্রামবাসীর গায়ে নীলচে

নিশান আর আর আঁচড়ে দাগ ফুটে ওঠে। এখন ওর ভারী শরীরের উর্ধভাগে সিল্কের পাঞ্জাবি আর

নিম্নাংগে খাদির পায়জামা। ঠোঁটের কোনায় পানের পিক চুঁইয়ে পড়ছে। ওঁর মুখ থেকে বৈদ্যজীর পুরো

ঘটনা শোনা হয়েছে। বৈদ্যজী অবাক হন নি, কিন্তু একটা খটকা লাগছে—জোগনাথের ঘর থেকে পুলিস

একটা দেশি কাট্টা পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করেনি!




পুলিসের সঙ্গে দীর্ঘকালীন সম্পর্কের দরুন উনি জানেন –এইধরণের গ্রেফতারির সময় পুলিস

অপরাধীর ঘর থেকে নিদেনপক্ষে একটা লোহার টুকরো হলেও বাজেয়াপ্ত করে। সেটাকে পিস্তল ধরে

নেয়া হয় আর একনজর দেখলেই কেন আঠেরশ এবং উনিশশ শতাব্দীতে মুষ্টিমেয় ইংরেজের সামনে

ভারতীয়রা হেরে যেত—সেই ঐতিহাসিক সত্য স্পষ্ট হয়।

ওনার মনে হল দারোগাজীকে ভদ্রতার খাতিরে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। তার ভূমিকা বাঁধতে গিয়ে উনি

প্রশ্ন করলেন—জোগনাথের ঘর থেকে শুধু গয়নাপত্র উদ্ধার হয়েছে? গাঁজা-ভাঙ-চরস বা আফিম

নয়?

--আমি আফিমের তল্লাসি করিনি তো। তাহলে লোকে বলত সেবার এক পার্টির এক চেলা আফিম শুদ্ধ

ধরা পড়েছে তাই এবার অন্য পার্টির একটাকে ধরা হয়েছে।




বৈদ্যজীর চোখ কপালে।

--পার্টি? কিসের পার্টি? এসব আপনি কাদের ভাষা বলছেন?

উত্তর এল রূপ্পন বাবুর থেকে—‘পুলিসের ভাষা’।

দারোগাজী চোখ মিটমিট করে ঘাড় ঝাঁকিয়ে নিজের মাথা সাফ রাখতে চেষ্টা করলেন। মনে মনে

ভাবলেন—বিলেতি মদের মধ্যে ‘জিন’ হল বড্ড দাগাবাজ। দেখতে সাদা জলের মত, কিন্তু পেটে পড়লে

জিভের আড় থাকে না। কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলি!

উনি চোখ খুললেন। বৈদ্যজীর চেহারা বেশ গম্ভীর। দারোগা ভাবলেন—এইবার কোন ত্যাড়া কথা শোনা

যাবে, তাই উনি মন দিয়ে বৈদ্যজীর মুখের দীপ্তি দেখতে লাগলেন।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in







ছাব্বিশ

ক্ষীরগ্রাম দেবী সতীর ৫১ পীঠের এক পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর আঙুলসহ ডান পায়ের পাতা পড়েছিল। দেবীকে এখানে যোগাদ্যা রুপে পূজা করা হয়।

জানা যায়, বর্ধমানের মহারাজা কীর্তি চন্দ এই গ্রামে যোগাদ্যার একটি মন্দির তৈরি করান। কিন্তু এরপর কোনও ভাবে হারিয়ে যায় প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তিটি। এরপরই সম্ভবত মহারাজার আদেশেই হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটির অনুকরণে একটি দশভূজা মহিষমর্দিনীর মূর্তি তৈরি করা হয়। তবে, পরবর্তী সময়েও নতুন তৈরি হওয়া মূর্তিটিও কিন্তু অবশ্য বছরের অন্যান্য সময়ে ডুবিয়ে রাখা হত ক্ষীরদীঘির জলেই বলে জানা যায়। কেবল ৩১ বৈশাখ দেবীকে জল থেকে তুলে এনে সর্বসমক্ষে রাখা হত।

এর মধ্যে হঠাৎই ঘটে যায় এক অলৌকিক কাণ্ড। ক্ষীরদীঘি সংস্কারের সময় হঠাৎই নতুন মূর্তির সঙ্গেই উঠে আসে ‘হারিয়ে যাওয়া’ পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটিও। এরপর, মূর্তি ফেরত পাওয়ার আনন্দে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের সাহায্যে সম্পূর্ণ আলাদা একটি মন্দির গড়ে তোলেন গ্রামের মানুষরা। সেই নতুন মন্দিরেই প্রতিষ্ঠিত হন ফিরে পাওয়া দেবী মূর্তিটি। তাই এখন গ্রামে গেলেই দেবীরদর্শন পান বহিরাগতরা। পাশাপশি সংক্রান্তিতে দুই মন্দিরেই চলে দেবীর আরাধনা।

জানা যায়, এই ক্ষীরগ্রামে একটা সময় বেশ কিছু চতুষ্পাঠী ছিল। সেই সময়ের সাক্ষী বহু প্রাচীন পুঁথি। স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের দাবি, বেশ কয়েক জন পণ্ডিত এই গ্রামে বিদ্যাচর্চা করতেন। অন্তত ৪০টি যোগাদ্যা বন্দনা পুঁথি পাওয়া গিয়েছে বলে জানা যায়। তবে জানা যায়, সবথেকে আগে যোগাদ্যা বন্দনা লিখেছিলেন কবি কৃত্তিবাস। কবির মতে, রামায়ণের কালে মহীরাবণ বধের পরে তাঁরই পূজিতা ভদ্রকালী বা যোগাদ্যাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেন রামচন্দ্র।

মন্দির থেকে অদূরে একটি টিলার উপর দেবীর ভৈরব ক্ষীরকণ্ঠ শিবের মন্দির। তাই এই গাঁয়ের নাম ক্ষীরগ্রাম, আদরের ক্ষীরগাঁ। মন্দির আর ক্ষীরদীঘি থেকে খানিকটা দূরে গ্রামের এক প্রান্তে ধামাসদীঘি। কথিত আছে, মহীরাবণকে কৌশলে বধ করে লক্ষ্মণ যখন পাতাল ত্যাগ করতে উদ্যাত হন, তখন রাবণের আরাধ্যা দেবী মহাকাল প্রভু রামচন্দ্রের সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। হনুমানের কাঁধে চেপে মহাকাল এসে ওঠেন মঙ্গলকোটের ক্ষীরগ্রামে। পুরাণ মতে, সেই সময় থেকেই দেবী মহামায়া বা মহাকালী কিংবা ভদ্রকালী যোগাদ্যা হয়ে রাঢ় বঙ্গে অন্ত্যজ শ্রেণির হাতে পূজিতা হতে শুরু করেন। শাক্ত মতে এটি সতীপীঠ। দেবীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল পড়েছিল এখানে। এখানে আলাদা কোনও কালী মূর্তি নেই । দেবীর রত্নবেদীতে কালীমন্ত্রে পুজো করা হয় দেবী যোগাদ্যাকে।
2

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in








সিলভিয়া প্লাথের কবিতা ও আত্মসন্ধান




সুপরিচিতা
সুস্মি,

তোমার ডাকে শান্তিনিকেতন যাওয়া হয়নি। তোমার কাছে অজুহাত মনে হতেই পারে। তবে সত্যিই আমি অসুস্থ ছিলাম। তোমাকে যখন লিখছি বাইরে তখন কালবৈশাখী। খানিক আগেও আকাশ ঝলমল করছিল। চোখের পলকে সকালের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যার মতন অন্ধকার। জীবন তো এমনই তাই না? তোমার চিঠি পড়তে পড়তে সিলভিয়া প্লাথের ডেথ এন্ড কোং কবিতার কয়েকটা লাইন বহুদিন পরে মনে পড়ে গেলো। Two, of course there are two. It seems perfectly natural now — The one who never looks up, whose eyes are lidded And balled, like Blake’s, Who exhibits…

কতটা রিলেট করতে পারছো জানিনা। তবে কলেজ থেকে ফেরার পথে পাদ্রী সাহেবের গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে খুব। বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা এইটুকু লিখতেই জীবনবাবুর কবিতা মনে পড়ল- চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে- সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে- কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে ! আমাদেরও দেখা হয়না কুড়ি বছর হলো। আবার অবাক করা কান্ড দেখো যে দুজনের কবিতা মনে হলো দুজনই যেন মিলেমিশে একজন। যাপনে, ভাবনায় এবং মরনেও! যদিও আমি জীবনানন্দ কে এগিয়ে রাখবো। তবুও অস্বীকার করার জায়গা নেই বিশ্বসাহিত্যে নারী কবি হিসেবে যারা সুপরিচিত তাঁদের মধ্যে মার্কিন কবি সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-১৯৬৩) অন্যতম। অথচ দেখো এই অমর কবি জীবনের কাছে প্রতারিত হয়েছেন, জীবন তাঁকে ক্রমাগত এক বিষণ্ণ, বেদনার্ত পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। জীবনের করুণ জাতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছেন। বেঁচে থাকার একঘেয়েমি কিংবা বেঁচে থাকার লড়াই তাঁকে ক্লান্ত করেছে। জীবন-মৃত্যুর দোলাচল তাঁর কবিতা আর জীবনকে ঘিরে থাকে তার মীমাংসা আমরা করতে পারি না। কেবলই পার্থিব জঞ্জাল আর বেদনাই তাঁকে অপার্থিব জগতে আকৃষ্ট করে।

জীবনানন্দকে গভীর মনোযোগ সহ নিরীক্ষণ করলেও দেখবো , কবির কাব্যশরীরে অন্ধকার প্রসঙ্গ এবং মৃত্যুচেতনার বারবাড়ন্ত যেন একটু গভীর নিকষ কালোর মত লেপ্টে রয়েছে। সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু চেতনা ঠিক জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু চেতনার মতো নয়। মৃত্যুকে জীবনানন্দ প্রেয়সী হিসাবে দেখতে চেয়েছেন প্লাথের ক্ষেত্রে মৃত্যু সর্বরোগহরা ওষুধমাত্র। সিলভিয়া শুধু জীবনাচরণে নন, বরং লেখার মেজাজে অনেকটাই কাছাকাছি থাকেন। এক অন্ধকার জগতে তাঁর কবিতার বসবাস। তবে তাঁর আঁধার জগৎ এডগার অ্যালান পোর অন্ধকার জগৎ নয়। রহস্য, রোমাঞ্চ নয়, বরং তার অন্ধকারের আড়ালে আছে ব্যথা ও বিদ্রোহের সুর। তাঁর কবিতার স্বরে নারী যন্ত্রণা, বেদনা ও মুক্তির গান খুঁজে পাওয়া যায়। অথচ সিলভিয়া বিশ্ব কবিতায় এমন এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর, যাঁর শক্তির উৎস নারীর অহম, বেদনা, গর্ব ও গর্ভ।

সিলভিয়া নিজের নারী এবং কবিসত্তার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। মাকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি হব পৃথিবীর কতিপয় নারী কবিদের অন্তর্গত এমন একজন সম্পূর্ণত আনন্দিত নারী, কোনো তিক্ত, হতাশ, বিকৃত পুরুষ-অনুকারক নয়, যে অনুকরণ অবশেষে নারী কবিদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি নারী এবং নারীজন্মে আনন্দিত। আমি গান গাইব পৃথিবীর উর্বরতার, ক্ষয়-শোক-মৃত্যুর মধ্যে মানুষের উর্বরতার গান। আমি গায়িকা হব। টেড আর আমার সুন্দর মিলিত জীবন হবে’ (উদ্ধৃতি: ভাবনার ভাস্কর্য, কেতকী কুশারী ডাইসন)।

সিলভিয়া উচ্ছল-উদ্যম জীবনযাপন করলেও তাঁর নিজের কাছেই নিজের জীবনটা খুব অদ্ভূত মনে হতো। ১৯৫২ সালে যখন স্মিথ কলেজে সদ্য ভর্তি হলেন তখন নিজের প্রতিই সিলভিয়ার প্রশ্ন ছিল—‘You walked in, laughing, tears welling confused, mingling in your throat. How can you be so many women to so many people, oh you strange girl?’ প্রথাগত কবিতার বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অভ্যন্তরীণ অনুভূতির সমন্বয়ে স্বীকারোক্তিমূলক কবিতায় নতুন একটা আবেগ উগরে দেন প্লাথ। এটা কবির মানসিক অবস্থানও বলা যায়। সিলভিয়া প্লাথের স্বীকারোক্তিমূলক কবিতায় (Confessional Poetry) অবলীলায় বলে দিয়েছেন অনেক গোপনীয় বিষয়। তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা সংখ্যাগত দিক থেকে অনেক বেশি। এবং ভাষা ও চিত্রনির্মাণ অনেক শক্তিশালী ও উন্নত। এখানে তিনি নির্ভীকভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আবেগ, সংগ্রাম প্রকাশ করেছেন। এসব কবিতার সফল অগ্রদূত বলা যায় তাঁকে। তাঁর আগে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকে স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা লিখে থাকলেও ধারাবাহিকভাবে অনেক শৈলীগত দিক, বক্তব্য-পষ্টীকরণ ও শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি দিক থেকে সিলভিয়া প্লাথ আলোচনার মূলকেন্দ্র। তিনি নারী হওয়ায় ও বাস্তব অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ (বাস্তবতা আরও বেশি ও ঝাঁজালো) করে বিশ্বের নারীবাদীদের ভরকেন্দ্রে রয়েছেন। বলে রাখি কনফেশনাল পোয়েট্রি মুভমেন্ট আমেরিকায় ১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি শুরু হয়। রবার্ট লয়্যাল, সিলভিয়া প্লাথ, অ্যানি সেক্সটন এ-আন্দোলনের প্রবক্তা। টি. এস এলিয়ট, ডব্লিউ. বি ইয়েটস প্রমুখ এ-আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এরা সবাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কবিতায় প্রকাশ (কিছুক্ষেত্রে রাখঢাক না করেই) করেছেন। আজকের ‘মি টু’ ইত্যাদি আন্দোলন অনেকটা এ ধারাবাহিকতার নতুন সংস্করণ।
মাত্র ৩০ বছরের জীবন তাঁর। ব্রিটিশ কবি টেড হিউজ তাঁর স্বামী ছিলেন। কিন্তু পরিবার ও সমাজের পাশাপাশি স্বামীর সংসারে সুখে ছিলেন বলা যায় না! ফলে সহজেই কবিতা ও লেখায় নারীর অবজ্ঞা, অবহেলা, নেতিবাচক-ধারণা ইত্যাদি বাস্তবজীবনের সঙ্গে মিশিয়ে নারীদের স্কেচ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। Daddz, Ladz Layarus, Ariel, The Applicant, Kindness, The Arrival of the Bee Box ইত্যাদি কবিতায় নারীর অন্তর্নিহিত শক্তি, বিবাহপরবর্তী নারীর নির্ভরশীলতা, নারীর স্বকীয়তা ও সৃষ্টিশীলতা, পুরুষের ওপর নারীর প্রতিশোধ, নারীর স্বাধীনতা সর্বোপরি নারীপ্রগতি ও নারী-উন্নয়নের চিত্র ফুটে উঠেছে। ছোট ছোট বাক্য, সরল শব্দ ব্যবহার করলেও সিলভিয়ার কবিতায় বহু প্রতীক, পুরাণের ব্যবহার আছে। অন্যদিকে ছোট ছোট শব্দ দিয়েই তিনি অনেক কিছু বলার চেষ্টা করেন, পুরো বাক্য বলেন না। ফলে প্রায়শই তাঁর কবিতা সহজপাঠ্য নয়। প্রায়শই তাঁর কবিতা বাড়তি মনোযোগ দাবি করে, ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। নারীবাদী কবিতা, নারীর প্রতি অবহেলা, নারী প্রগতি ও উন্নয়নের কবিতা সিলভিয়া প্লাথকে আলাদা ও সাফল্যমণ্ডিত করেছে। তাঁর কবিতায় নিজের মানসিক অবস্থা, মাতৃত্ব, পরিবার এবং বিভিন্ন সম্পর্ক সূক্ষ্মভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিতা অসামান্য এবং দক্ষতাপূর্ণে নান্দনিক ভাষা দিয়ে সৃষ্টি। কখনওবা তিনি বিভিন্ন প্রতীকীর আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর কবিতা পরিচিত বোধের চেনা পরিমণ্ডলকে বারবার আক্রমণ করেছে। চির অস্থিরতার চোরা স্রোত বয়ে চলে প্রতিটি শব্দ আঁকিবুঁকিতে। শ্লেষ্মা ছিটানো গলায় প্লাথ বলেন : And I wear the wry-faced pucker The sour lemon moon. প্লাথের Ariel কবিতা-সংকলন ব্যক্তিগত মানসিক-যন্ত্রণার বিষয়াদি জোরালোভাবে উঠে এসেছে। ১৯৬২ সালে ‘দ্য নিউ ইয়র্কারে’ প্রকাশিত প্লাথের টিউলিপস কবিতায় একটি হাসপাতালে টিউলিপের তোড়া গ্রহণকারী একজন মহিলাকে চিত্রিত করা হয়েছে। নার্সরা ‘উজ্জ্বল-সুচ’ দিয়ে মহিলাকে অসাড় করে। তিনি অ্যানেস্থেসিয়ায় আত্মহত্যা করেন। কবির কাছে সূর্যের চোখ এবং টিউলিপের চোখ যেন একই সমান্তরালে। যেন টিউলিপগুলি তাকে আঘাত করছে, তাকে দেখছে এবং তার অক্সিজেন চুষে নিচ্ছে। ''টিউলিপ''-এ শব্দের ক্ষমতায় কবিতা সত্যিই যেন দেওয়াল বেয়ে চলা সরীসৃপ। ফুলগুলোর জীবন্ত শ্বাসপ্রশ্বাস তার রোগী মনকে আরো অস্থির করে তোলে। কবিতাগুলির জীবন্ত ধুকপুক হাতের মুঠোয় ধরা যায়। টিউলিপের চোখ ফোটে লেখনীর ছোঁয়ায়। ভেসে ওঠে হাসপাতাল ঘর, শীতলতা, ওষুধের গন্ধ—কেবলমাত্র শব্দের গঠনে। খুব সহজেই শরীরের দখল ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে এক গভীর প্রতিবাদ লুকিয়ে থাকে। অভিমান কিভাবে বিশ্বজনীনতা ছুঁতে পারে প্লাথ না পড়লে বোঝা যায় না। নিজেকে জগৎ স্রষ্টার সাথে তুলনা করার দাপট তিনি দেখিয়েছেন—

I shut my eyes and the world drops dead.

গতানুগতিকতার বেড়ি মনে ও পায়ে তিনি কখনোই পরতে চান নি। অসম্ভব তেজিয়াল এক প্রেমিক সত্তা সমাজের মুখোশ, কৃত্রিম মানব সম্পর্কের জাল ছিঁড়তে চায় বারংবার। তার যন্ত্রণা তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক পটভূমির সাথে হাত মিলিয়ে জন্মায়—

"The Times are Tidy : Unlucky the hero-born In this province of the stuck record Where the most watchful cooks go jobless"

প্লাথের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রকৃতিপ্রেম খুঁজে পাওয়া যায়, যা ঠিক রোমান্টিক কবিদের মতো না হলেও কবির বুকের অসহায়ত্ব ও আশ্রয় পাবার গভীর আকুতি ধ্বনিত করে। 'The Moon and the Yew tree' এই সত্য তুলে ধরেছে। অনির্বচনীয় সন্তান স্নেহ মেলে ধরেছে Plath-এর মধ্যেকার এক মাকে :

"I want to fill it with color ducks,"

আয়নার আলোতে এগিয়ে আসে আরেক মায়ের প্রতিবিম্ব যার প্রতি একাধারে নির্ভরতা আরেক দিকে বিদ্বেষ, ঘৃণা লক্ষণীয়। Mirror—"I am important to her. She comes and goes,/ Each morning it is her face that replaces the darkness,/ In me she has drowned a young girl and in me old woman".

সিলভিয়া প্লাথ ভালো চিত্রকরও ছিলেন, ছবিতে রঙের ব্যবহার ছবিকে যেমন অনেক বেশি ধ্রুপদী করে তোলে তাঁর কবিতাতেও সেই রঙের ব্যবহার দেখতে পাই খুব নিপুণভাবে। ধারণা করা হয় ১৯৬৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে লেখা ‘প্রান্তরেখা’ (Edge) কবিতাটিই সিলভিয়া প্লাথের লেখা সর্বশেষ কবিতা। আত্মহত্যার মাত্র ছয় দিন আগে লেখা এই কবিতাটি তার ‘সুইসাইড নোট’ বলা যায়। আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের মানসিকতার একটা উৎকৃষ্ট নমুনা এই কবিতা। এই কবিতায় সিলভিয়া নারীর অর্থহীন জীবনকে তুলে ধরেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের ইচ্ছা ছাড়া নারী কিছুই করতে পারে না। আবার নারীর সব কাজকেই বিশেষত গৃহকর্মকে গুরুত্বহীন, অর্থহীন মনে করা হয়। প্লাথ তাই এমন এক মৃত নারীর কথা বলেছেন যার পূর্ণতা প্রাপ্তি হয় কেবল মৃত্যুতে। তাঁর ভাষায়, মৃত্যুতেই ‘নারীটি স্বার্থক পূর্ণতা পেয়েছে’। নারীর শরীর মৃত্যুর পর হেসে উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘প্রান্তরেখা’ সিলভিয়া প্লাথের সবচেয়ে তমসাচ্ছন্ন কবিতা (darkest poem)। এই কবিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রঙের ব্যবহার। সাদা, লাল আর কালো এই তিনটি রং এখানে রবার্ট গ্রেভসের ‘সাদা দেবীগণ’ তত্ত্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশ শতকের মাঝামাঝি পুরাণবিদ গ্রেভস রচনা করেন ‘দ্য হোয়াইট গডেস’। তিনি ইউরোপীয় মূর্তি পূজারিদের দেবীদের সম্পর্কে আলোচনা করে দেখান যে আসলে একজন দেবীই নানা নামে ও পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল। জন্মদান, জীবন ধারণ আর মৃত্যু আদতে একই নারী সত্তার কুমারীকাল, মাতৃত্বকাল এবং বৃদ্ধাকালের রূপান্তরিত চেহারা। এই তত্ত্ব মতে, সাদা হলো কুমারীর রং, লাল হলো মাতৃত্বের রং আর কালো হলো বয়োবৃদ্ধ কিংবা মৃত্যুর রং। সিলভিয়া এই প্রতীক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই তার শেষ কবিতায় ‘সাদা সাপ’ ‘দুধের পাত্র’, ‘গোলাপ’, ‘রক্তাক্ত সৌরভ’, ‘রাত্রি’, ‘চাঁদ’, ‘কৃষ্ণতা’ ইত্যাদি চিত্রময়তা ব্যবহার করেছেন। সিলিভিয়ার সমগ্র কবিতাতেই রঙের প্রতীকী ব্যবহার দারুণভাবে করা হয়েছে। আরেকটি বিখ্যাত এবং জটিল কবিতা ‘লেডি ল্যাজারাস’। সিলভিয়া প্লাথের রচনারীতি বোঝার জন্য এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা। ‘ড্যাডি’র মতো এ কবিতাতেও নাৎসি বাহিনীর অত্যাচার আর হতাকাণ্ডের চিত্র ফুটে উঠেছে। নাৎসিরা বন্দীদের চামড়া থেকে সাবান আর ল্যাম্পের শেড বানাত—কবিতার চতুর্থ ও পঞ্চম লাইনেই সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন সিলভিয়া। অন্যদিকে প্লাথের আত্মহত্যাপ্রবণতা, ক্রমাগতে মরতে চাওয়ার চেষ্টা এই কবিতা এসেছে। ‘ড্যাডি’ কবিতার মতোই এ কবিতাতেও জার্মান ভাষার ব্যবহার রয়েছে তার পিতার উত্তরসূরি সূত্রেই। অন্যদিকে জনাব শত্রু বলতে স্বামী টেড হিউজকে বুঝিয়েছেন তিনি। পুরুষ বলতেই পিতা ও স্বামীর কথা এসেছে তার কবিতায় বারবার। পুরাণের আগুনপাখি ফিনিক্স এ কবিতায় প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ফিনিক্স সেই পাখি, যাকে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় এবং পোড়া ছাই থেকে তার বারবার জন্ম হয়। সিলভিয়া প্লাথও যেন বারবার মৃত্যু থেকে ফিরে আসেন। তিনি এ কবিতা যেন ডাক্তার মহাশয়ের উদ্দেশে লিখেছেন। প্রতি দশ বছরে একবার করে মরতে চাওয়া সিলভিয়াকে বারবার ডাক্তাররাই ফিরিয়ে এনেছে। তাই পরেরবার যখন সে মরার প্রস্তুতি নেবে তখন ডাক্তার আর পুরুষদের আগে খাবে।

১৪৩২ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে তোমাকে কি আর দিতে পারি বলো- কলেজ দিনে যেমন কবিতা পাঠাতাম তেমনি কবিতা পাঠালাম তবে আমার লেখা নয়, সিলভিয়া প্লাথের কবিতার ভাবানুবাদ করে পাঠালাম। নিরন্তর ভালো থেকো।


পরিত্যক্তা (Jilted)

ভাবনাগুলো আজ শুকনো পাতার মতো—
কোনো এক হলদে বিকেলের স্তব্ধতায় ভেজা,

চোখ জুড়ে অম্ল জল

তিতকুটে চাহনির এক বিষণ্ণ, টক-হলুদ তারা
কাঁপছে নিঃশব্দ বিষাদের জ্বালায়।

রাতের হাওয়া ফিসফিসে—
ভালোবাসা নামে গুজব বয়ে আনে,
চাঁদের মুখে দেখি নিজের ছায়া—
এক পেকে না-ওঠা পাতিলেবুর ভাঁজ।

হৃদয়—
গ্রীষ্মের কাঁচা বরই,
ঝুলে আছে
শুকনো এক ডালে—
ছোট, সবুজ, তেতো।


রাত তিনটার মনোলগ (Monologue At 3 AM)

বরং অস্তিত্বের সব তার ছিঁড়ে যাক
উফ, মাথার ভেতর কী কষ্ট
রক্ত শুধু রক্ত ছিটকে পড়েছে
রক্তে ভিজে যাচ্ছে উজ্জ্বল চৌকি, কার্পেট, মেঝে —
আর দেয়ালের পাশে ঝুলে থাকা সাপ মার্কা বর্ষপঞ্জিকা সাক্ষ্য দেয় —
তুমি বহুদূর —মাঝখানে অস্তিত্বের একদিকে আমি অন্যদিকে তুমি
তুমি বেশ আছো সতেজতায় আর আমি —
এই নিঃশব্দ তারাদের নিচে কালো সময়ের অভিশাপ,
বিদায় সম্ভাষণ, জ্বালা করা চোখে বিদায়ী রেলগাড়ির স্মৃতি জড়িয়ে ধরে
সব হারিয়ে,
তোমার দিকেই তাকিয়ে আমার জগৎ
মুখের উপর দরজা বন্ধ করেছে
আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি আবারও।


ইতি—

বাসু
১৫ এপ্রিল,২০২৫