2

সম্পাদকীয়

Posted in




সম্পাদকীয়


শীত পড়ছে না পড়ছে না করেও পৌষের প্রথম সপ্তাহেই একটু ঠাণ্ডা পড়েই গেলো কলকাতায়। তাপমাত্রা নামল ১৫-র আশেপাশে। শীতকাতুরে বাঙালী তাতেই যুগপৎ জবুথবু এবং আহ্লাদে আটখানা। কারণ, শীতকাতুরে বাঙালী যে একাধারে ভোজনরসিকও। সাহিত্যচর্চার ফাঁকে ফাঁকে একটু কবজি ডুবিয়ে পেটপুজোর সুযোগ, আর কি! এবারের ঋতবাক-এ থাকছে এমনই কিছু স্মৃতিচারণ এবং প্রসঙ্গ বিন্যাস। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতেই হয়, আমার খাদ্যাভ্যাস নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত চারিত্রিক মৌলিকতা। সেটা অন্য কেউ ঠিক করে দিতে পারেন না। আবার একজন দায়িত্বশীল সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে আমারও একটা দায়িত্ব বর্তায় খাদ্যতালিকা নির্মাণের বিষয়ে। আমি যদি এখন বাঘ খাওয়ার বায়না ধরি, তবে তা তর্কাতীতভাবেই অন্যায্য হবে। এ বিষয়ে যুক্তিগুলো অবশ্যই হতে হবে বিজ্ঞান নির্ভর। ধর্মের দোহাই দিয়ে ভয় দেখিয়ে বাঘ আর গোরুকে একসঙ্গে পাশাপাশি বসিয়ে চরণামৃত গেলানোর দিন মনে হয় আমরা বহুযুগ পেরিয়ে এসেছি। আর তাছাড়া, ভারতীয় সংস্কৃতি আদতে এ বিষয়ে কি বলছে, সেটাও তো জানা দরকার। চোখ রাখুন এবারের ঋতবাক-এ।


এদিকে, সব ঠিকঠাক এগোলে এ মাসের শেষ সপ্তাহেই এসে যেতে পারে বহু প্রতীক্ষিত হাতে গরম ঋতবাক মুদ্রিত সংস্করণ। বেশ উত্তেজিত লাগছে। এবিষয়ে আপনাদের সকলের এত উৎসাহই নিঃসন্দেহে আমাদের অনুপ্রেরণা। এই পথচলায় সঙ্গে পেয়েছি নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী, বিশ্বনাথ রায়, সুজিত আচার্যের মতো বিশাল মাপের গবেষকদের। এ এক পরম পাওনা। আমরা কৃতজ্ঞ। এই সংসর্গ দীর্ঘস্থায়ী হোক। 


শুভেচ্ছা জানবেন সকলে।


সুস্মিতা বসু সিং

2 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ সুবর্ণ হাজরা

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


আর্য মানসে ক্ষুধা, খাদ্য ও ঈশ্বর
সুবর্ণ হাজরা 


বাঙালি কবি লিখেছেন, ‘‘পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’’... আর গান্ধীজি বলেছেন, ‘‘ক্ষুধার্তের সামনে রুটি ছাড়া স্বয়ং ভগবানও অন্য চেহারায় আসতে সাহস পান না।’’ এসব না হয় আধুনিক কালের ভারতবর্ষের কথা। কিন্তু যখন সুদূর অতীতের কথা ওঠে, তখনকার সময়কে আজকের ভারতবর্ষের একপাল দুর্বুদ্ধিজীবি যখন স্বর্ণযুগ বলে বর্ণনা করেন, বলেন আর্যভূমি ভারতবর্ষে ‘‘সে ছিলো বড়ই সুখের সময়’’, তখন সেইসময়কার অবস্থা সত্যিই কেমন ছিলো জানতে ইচ্ছে করে। অবশ্য সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে আর্যদের ভারতে আগমন সম্পর্কে একটু বলা দরকার।

আর্যদের এদেশে আগমন পর্ব অনেকটাই কুয়াশাচ্ছন্ন একারণে যে, পরবর্তী কালের ইতিহাসের মতন সেই পর্বের কোনও লিখিত প্রমাণ পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু পৃথিবীর সর্বত্রই যেসব প্রমাণের উপর ভিত্তি করে সেই সময় বা তার চেয়েও বেশী অতীতের ইতিহাস (প্রাক-ইতিহাস) রচিত হয়, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যে আর্যরা এদেশে এসেছিলো তারা যে একবারেই এসেছিলো তা নয়, এসেছিলো দফায় দফায়। প্রায় হাজার দেড় হাজার বছর ধরে। শেষ বড় দলটি এসেছিলো খ্রীষ্ট জন্মের প্রায় দু হাজার বছর আগে। এরা আর্যদেরই দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলো----আলপীয়ান আর নর্ডিক। এর মধ্যে আলপীয়ানরা ছিলো জীবনযাত্রায় তুলনামূলক ভাবে অগ্রসর। তারা শুধুমাত্র পশুপালন নয়, কৃষিকাজও শুরু করে দিয়েছিলো। এমন কি বাণিজ্য পথেও চলতে আরম্ভ করেছিলো। তাদের পরবর্তী সময়ে আসা নর্ডিক আর্যরা ছিলো প্রধানত পশুপালক। তারা পশুর দুধ খেতো, পশুর মাংস খেতো, পশুর চামড়া গায়ে জড়াতো। এরাই আজ আদি হিন্দু শাস্ত্র বলে যা পরিচিত সেই বেদ-উপনিষদের রচয়িতা। ডঃ অতুল সুর এই নর্ডিক আর্যদের সম্পর্কে “বর্বর জাতি” অভিধাটি ব্যবহার করেছেন। উভয় গোষ্ঠীই এসেছিলো মোটামুটি একই জায়গা থেকে।ভাষাতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের ভিত্তিতে ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্ত এই যে, বর্তমান রাশিয়ার উরাল পর্বতমালার দক্ষিণদিকের শুকনো ঘাসে ঢাকা সমতল ভূখণ্ডই আর্যদের আদি বাসস্থান। এখানে নর্ডিক ও আলপীয়ান দুই গোষ্ঠীই বসবাস করতো।‘আর্য’ শব্দটি সেইসময়ে জাতিবাচক না হয়ে ভাষাবাচক পরিচিতির শব্দ ছিলো, অর্থাৎ ‘আর্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী’বলে তারা চিহ্নিত হতো। এরা পূর্বদিকে যাত্রা করে ইরানের ভেতর দিয়ে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম কোণ দিয়ে এদেশে ঢুকে আসে। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা আর্যদের ইন্দো-ইরানীয় বা ইন্দো-আর্যভাষী বলে চিহ্নিত করেছেন। ইরান থেকে যে গোষ্ঠী পূর্বদিকে ভারতে না এসে ইউরোপে চলে গেলো, তারা চিহ্নিত হলো ইন্দো-ইউরোপীয়ান বলে। ইন্দো-ইরানীয় বা ইন্দো-আর্যদের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো ইরানে থেকে যাওয়া আর্যদের। ভাষাও এত কাছাকাছি ছিলো যে ইরানের আবেস্তা আর ঋগবেদের গোড়ার দিকের ভাষা প্রায় এক। সেটি ছিলো আর্যভাষা। পরবর্তীকালের ঋগবেদের ভাষা মার্জিত হয়ে প্রথমে দেবভাষা ও পরে সংস্কৃত বলে পরিচিত হয়। দেবভাষা হওয়ার কারণ এই যে, ঋগবেদের এই পর্যায়ের সমস্তটাই ছিলো দেবতাদের কাছে, বিশেষতঃ ইন্দ্র, অগ্নি, মিত্র, বরুণ ইত্যাদি দেবতাদের কাছে প্রার্থনার ভাষা। ‘সংস্কৃত’শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভাষাটির উন্নতির কথা — যার সংস্কার করা হয়ে গেছে, তাই সংস্কৃত।

আর্যরা যখন এদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে (বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) এসে প্রথম ডেরা বসালো, তখন তারা কৃষিকাজ জানতোনা। ছিলো মূলত মাংসখেকো যাযাবর। তাদের খাদ্যাভ্যাস শতপথ ব্রাহ্মণে প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে “প্রথমে দেবতারা একজন মানুষকে বলি স্বরূপ উৎসর্গ করলেন। তার উৎসর্গীকৃত আত্মা অশ্বদেহে প্রবেশ করলো।দেবতারা অশ্বকে উৎসর্গ করলেন। উৎসর্গীকৃত আত্মা বৃষদেহে প্রবেশ করলো। বৃষ উৎসর্গীকৃত হলে তার আত্মা মেষদেহে প্রবেশ করলো। মেষ উৎসর্গীকৃত হলে তা ছাগদেহে প্রবেশ করলো। ছাগ উৎসর্গীকৃত হলে তার আত্মা পৃথিবীতে প্রবেশ করলো। দেবতারা পৃথিবী খনন করে গম ও যব আকারে ঐ আত্মাকে পেলেন।” এই কাহিনীটি জানাচ্ছে আর্যদের খাদ্যাভ্যাসের বিবর্তন তথা সামাজিক পরিবর্তনের কথা। এর থেকেই প্রমাণিত হয়, তাঁরা যখন এদেশে এসেছিলেন, তখন ছিলেন মাংসাশী, এমন কি হয়তো বা অন্যান্য আদিম মানুষের মতন নরখাদক। পরবর্তীকালের রচনাগুলিতেও অনেক জায়গায় যজ্ঞে কিম্পুরুষ বলি দিয়ে তার মাংস খাবার কথা উল্লিখিত আছে। পরবর্তী কালে এঁরা কৃষিকাজ শিখেছিলেন। এঁরাই এদেশে অশ্ব নিয়ে এসেছিলেন, তার আগে এদেশে অশ্ব ছিলোনা। যদিও গাধা ছিলো। এদেশের প্রাগার্য মানুষ যাতে অশ্ব না পায় তার জন্য আর্যরা সচেষ্ট ছিলেন। এর প্রমাণ ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলেই ব্যাকুল প্রার্থনা “ইন্দ্র, অসুরদের অশ্ব দিওনা।” এই ঘোড়ার মাংস খাওয়ার একটা বড় অনুষ্ঠান ছিলো অশ্বমেধ যজ্ঞ। ঋগবেদের মণ্ডলে মণ্ডলে তো বটেই, উপনিষদেও বার বার বর্ণিত আছে শুধু অশ্ব নয়,বৃষ,গাভী,গোবৎস,মহিষ, গাধা সমেত প্রায় সমস্ত প্রাণীর মাংস তাঁরা খেতেন। এমন কি চিতাবাঘ ও গণ্ডারও বাদ যেতোনা। অতিথি এলে সমাদর করে তাঁকে গোরুর মাংস খাওয়াতেন। এই জন্যই অতিথির অন্য পরিচয় ছিলো ‘গোঘ্ন’ অর্থাৎ যাঁর জন্য গোহত্যা করা হয়।পরবর্তীকালে পাণিনি এই বিশেষণটির উল্লেখ করেছেন। গোঘ্নর মতই আরেকটি শব্দ ‘অতিথিনীর্জা’র উল্লেখ ঋগবেদে আছে, যার অর্থ অতিথির খাদ্যের উপযোগী গোরু। গোরু বা গো-বৎস ভক্ষণ করতে না পারলে বেদ-উপনিষদের রচয়িতা ব্রহ্মজ্ঞানী মুনি ঋষিরাও রুষ্ট হতেন। অশ্বমেধের অশ্বমাংসের মতই গোমাংস ভোজনের বড় যজ্ঞগুলি ছিলো রাজসূয়, গোমেধ, বাজপেয় ইত্যাদি।প্রসঙ্গত, বাজপেয় যজ্ঞের পুরোহিতদের বলা হতো বাজপেয়ী (অটল বিহারী মাফ করবেন)! কিন্তু এই নিবন্ধ যেহেতু ‘গোরুর রচনা’ নয়, তাই এবার প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যাক।

আর্যরা খাদ্যাভাবে পীড়িত ছিলেন, এ সত্য গোপন রাখার কোনও জায়গা নেই। ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলেই পাঁচ এর সূক্তে ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে, “অন্ন নিয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত হোন।” এছাড়াও অজস্রবার অন্নের জন্যে প্রার্থনা করতে দেখা যাচ্ছে। এঁরা ক্ষুধার্ত হয়েই প্রার্থনা করতেন অবশ্যই। কিন্তু এঁদের কাছে ক্ষুধার রূপ কি ছিলো ? খাদ্যের বা জলের মহিমাই বা কি ছিলো?

আর্যদের কাছে ক্ষুধার শেষ পরিণতি অজানা ছিলোনা। বেদ এবং উপনিষদ উভয়েতেই এ বিষয়টি একধিকবার আলোচিত হয়েছে, যাতে প্রমাণিত হয় আর্য জনসমাজে ক্ষুধা তার ভয়াবহতার ছাপ রেখেছিলো। উপনিষদে তাই বলা হয়েছে “ক্ষুধাই মৃত্যু।” একটি উপাখ্যানেও বলা হয়েছে, প্রাণীর ক্ষুধা নিবৃত্তির দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তার। ব্রহ্মা দেখলেন ক্ষুধার জন্য তাঁর সৃষ্ট প্রাণীকুল বিনষ্ট হচ্ছে।তখন তিনি স্তনের সৃষ্টি করলেন।

আর্যদের কাছে ব্রহ্মই আদি, তিনিই সর্বোচ্চ অজ্ঞেয়, অবাঙমানসগোচর। ব্রহ্মর স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা বলা হয়েছে। যেমন শব্দই ব্রহ্ম, আলোই ব্রহ্ম, ইত্যাদি। কিন্তু ক্ষুধার বিষয়ে বলতে গিয়ে সেখানেও ব্রহ্মকে টেনে আনা হয়েছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে স্পষ্ট ভাবেই বলা হয়েছে, “প্রথমে কিছুই ছিলোনা, সব মৃত্যু দিয়ে আবৃত ছিলো, ক্ষুধা দিয়ে—ক্ষুধাই মৃত্যু।” আবার “ক্ষুধা মানুষের শত্রু একথা যে জানে সে ক্ষুধারূপ শত্রুকে হণন করে”, এও বলা হয়েছে। অন্ন শব্দের প্রকৃত অর্থ খাদ্য। কিন্তু আজ তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাত। যদিও আর্যদের কাছে মাংস, গম, যব সবই ছিলো অন্ন। উপনিষদে বারবার বলা হয়েছে অন্নই জীবন। অন্নই ব্রত। অন্নই ভদ্র। জলের প্রয়োজনীয়তার কথা বার বার বলা হয়েছে। বলা হয়েছে জল (অপ বা আপ) অন্নের জন্মদাত্রী।

ছান্দোগ্য উপনিষদের ‘অন্নব্রহ্ম’ অধ্যায়টি উল্লেখযোগ্য। এখানে বলা হয়েছে অন্নকে উপাসনা করো। অন্নই ব্রহ্ম। এবার আর্য মুনিঋষিদের ব্রহ্মবিদ্যা মাটিতে নেমে এলো প্রাগার্যদের চাষাবাদে। সকল দেবতার উপরে যেমন ব্রহ্মের স্থান (গার্গী- যাজ্ঞবল্ক সংলাপ স্মর্তব্য), তেমনই সকল বস্তুর উপরেই অন্নের স্থান। এই অন্ন কেবলমাত্র ফসল নয়। যা সাধারণ ভাবে অখাদ্য, ক্ষুধাপীড়িত আর্যদের দৃষ্টিতে প্রাণ বাঁচাতে তাও খাদ্য—অন্ন। ছান্দোগ্য উপনিষদে প্রাণকে সর্বেন্দ্রিয়ের উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রাণ ইন্দ্রিয়দের কাছে জানতে চেয়েছে তার রক্ষার উপায় কি? উত্তরে সর্বেন্দ্রিয় জানাচ্ছে, কুকুর, শকুনি সহ সর্বজীবের যা কিছু অন্ন আছে, সেই সব।‘অন’শব্দটি প্রাণের অন্য নাম। যে তা জানে তার কাছে কোনও অন্নই অনন্ন হয়না। অর্থাৎ কুকুর বা শকুনের মাংসই শুধু নয়, তারা যা খায় তাও অন্ন। ‘অন’কে রক্ষা করার জন্য যা খাওয়া হয়, তাই অন্ন।

ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণের উষন্তি উপাখ্যান মনে করা যাক। স্থানাভাবের জন্যে এখানে সম্পূর্ণ বর্ণনা করা গেলোনা। উষন্তি বলেছিলেন,প্রাণই মূল দেবতা। অন্নই দেবতা। সেজন্য মাহুতের এঁটো মাষকলাই খেতেও উষন্তির বাধেনি, কারণ সেই প্রাণরূপ দেবতার উপাসনা। মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে“তপস্যার দ্বারা ব্রহ্ম পাওয়া যায়। তার থেকে অন্ন জাত হয়। অন্ন থেকে প্রাণ,মন,সত্য।আর ব্রহ্ম যদি পরম সত্য হন, তবে অন্নই পরম সত্য।” উষন্তির ঘটনা তবু একরকম। কিন্তু ঋষি বামদেবের কাহিনী এবং বক্তব্য বেদের স্বর্ণ যুগে প্রকৃত অবস্থা কি ছিলো তা তুলে ধরেছে। ঋষি বামদেব বলেছেন, “অভাবের জন্য আমি কুকুরের নাড়ীভুঁড়ি খেয়েছি। দেবতারাও কেউ সাহায্য করেন নি। স্ত্রীকে চূড়ান্ত অবমানিতা হতে দেখেছি।” খাদ্যাভাব ও ক্ষুধা কতটা তীব্র হলে সেই “স্বর্ণযুগে” এই অবস্থা হয়! এ প্রসঙ্গে উপনিষদে বর্ণিত মহর্ষি বিশ্বামিত্রের কুকুরের মাংস খাওয়া এবং অগ্নিতে সেই মাংস আহূতি দেওয়ার কথাও মনে করা যায়।

আর্যদের উদর চিন্তায় কখনও নিরামিষ ভোজনের কথা ছিলোনা। শতপথ ব্রাহ্মণেও বলা হয়েছে, “সব খাবারের সেরা খাবার মাংস।” আর মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক যেটুকু বাকী ছিলো, তারও পাদপূরণ করে দিয়েছেন এই বলে যে, সব মাংসই খাবার, কিন্তু তিনি পছন্দ করেন গো-মাংস। গোরু নেহাৎ ই খাদ্য। আর্য সাহিত্যে, ঋগবেদ থেকে শুরু করে সর্বত্রই, এমন কি অনেক পরের মহাভারতেও গোমাংস ভোজনের উল্লেখ করা আছে। দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন রচনায় গোমাংস ভোজনের কথা অস্বীকার করা হয়নি। যে সত্য এখন অস্বীকার করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে যে আর্যরা গোরু বলতে গাভী, ষাঁড়, বলদ সবই ধরতেন।গুহ্যসূত্রগুলিতে কোন অনুষ্ঠানে কটি ষাঁড় বা কটি বলদ বা কটি গাভী বলি দিতে হবে, তাও নির্দিষ্ট করা আছে। এমন কি তার মধ্যে কটি বাঁজা হতে হবে, তাও। উপনিষদগুলিতে বার বার বলা হয়েছে, যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে গোবধ এবং তার মাংসাহার ছিলো খুব সাধারণ ব্যাপার। এমন কি শ্রাদ্ধেও গোবধের কথা গুহ্যসূত্রগুলিতে বলা আছে। আজও ‘বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ’করে থাকেন নানা শ্রাদ্ধাধিকারীরা। এই ‘বৃষ- উৎসর্গ’ যে প্রকৃতপক্ষে আর্যদের সময়কালীন ষাঁড় বা বৃষ বলি, তা আজ পুরোহিতকে মূল্য ধরে দিয়ে আসল সত্যকে ঢেকে দেওয়ার অপচেষ্টা। শ্রাদ্ধের মত বিবাহ, সীমন্তোন্নয়ন, সন্তান জন্মের মতন সব উৎসবেই বৃষ বলি দেওয়া হতো। উদাহরণ স্বরূপ সম্পূর্ণতই ব্রাহ্মণদের‘গবাময়ন যজ্ঞ’। এই যজ্ঞে তিনটি বন্ধ্যা গোরু বলি দেওয়া হতো।বশিষ্ঠ ধর্ম সূত্রানুযায়ী কোনও কারণে অন্য মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হলেও গাভী ও ষাঁড়ের মাংস খাওয়া অনুমোদিত। গোরুকে আর্য সাহিত্যে ‘গোধন’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, যদিও পশুপালক আর্যদের অন্যান্য পশুও ছিলো। দুধ-মাংস ছাড়াও গোরুর কোনওকিছুই ফেলা যেতোনা। গোবধ পরবর্তীতেও গোরুর চামড়া যোদ্ধা আর্যদের গুরুত্বপূর্ণ কাজে আসতো।যেমন,গোরুর চামড়া দিয়ে ধনুকের ছিলা তৈরী হতো। রথের সংযোগকারী অংশ গোরুর চামড়া দিয়ে তৈরী রশি দিয়ে বাঁধা হতো। অস্ত্রশস্ত্র শরীরের সঙ্গে বা রথের সঙ্গে অথবা ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে রাখার জন্যও গোরুর চামড়া থেকে বানানো রশি ব্যবহার করা হতো। অঙ্কুশ বা চাবুক তৈরী হতোগোরুর চামড়া ও লেজ দিয়ে। এছাড়া গোরুর চামড়া দিয়ে তৈরী হতো পরিধেয় ও তাঁবু। স্মর্তব্য, সেই স্থান বা সময়ে তুলোর ব্যবহার ছিলোনা। গোরুর চামড়ার এতরকম ব্যবহারও কিন্তু গোহত্যাকেই নির্দেশ করে। মনুস্মৃতিতে ভক্ষণযোগ্য পোষা প্রাণীদের তালিকায় হস্তী এবং উট ছাড়া গোরু সমেত সমস্ত প্রাণীকেই ভক্ষ্য বলা হয়েছে। তাঁর টীকাকার মেধাতিথি বৈদিক ও বৈদিকোত্তর যুগে গোরু ও অন্যান্য পোষা প্রাণীর মাংস (গব্যজমাংসম) ভক্ষণ আর্যরীতি ছিলো বলে উল্লেখ করেছেন। এরকম উদাহরণ দ্বাদশ শতকের সংস্কৃত সাহিত্যেও পাওয়া যায়। হাজারে হাজারে এই রকম উদাহরণ থেকে দেখা যায় আর্য মানসে গোরু সমেত প্রায় সমস্ত প্রাণীর মাংস ভক্ষণ আর্যরীতির অঙ্গ ছিলো।

স্মৃতি থেকে উপনিষদের একটি ছোটো কাহিনীর উল্লেখ করে এই প্রসঙ্গের ইতি টানব। মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে গেছেন মহর্ষি জমদগ্নি। বশিষ্ঠ তাঁর দুই শিষ্যকে বললেন, “গব্যজমাংসম” সহ মুনির উপযুক্ত সৎকার করতে। বিলম্ব দেখে এবং মহর্ষি জমদগ্নিকে ক্ষুধায় কাতর দেখে বশিষ্ঠ শিষ্যদের ডেকে পাঠালেন। শিষ্যরা এল রুধিরাক্ত। বশিষ্ঠ বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে তারা জানাল যে সবচেয়ে বড় বৃষটিকে কবজা করে কাটতে সময় লেগেছে। বশিষ্ঠ তিরস্কার করে বললেন, “তোমরা দেখছো মুনি বয়োবৃদ্ধ। তোমাদের উচিৎ ছিলো একটি নধর বাছুর কাটা।” মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। মহাভারতেও উল্লেখ আছে চর্মণ্বতী নগরীর রাজা মহাত্মা রন্তিদেবের পাকশালায় প্রতিদিন অন্তত দুহাজার পশুবধ হতো, যার বহমান রক্ত নদীর সৃষ্টি করেছিলো। এর অধিকাংশই হতো গাভী, বৃষ বা বলদ। লোককথা অনুযায়ী এই চর্মণ্বতী আজকের চম্বল। রক্ত নদীর ধারাও আজকের চম্বল নদী।

চরক, সুশ্রুত ও বাণভট্ট, আয়ুর্বেদের তিন দিকপাল বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য গোমাংস ভক্ষণের নিদান দিয়েছেন। শেষ করার আগে স্বামী বিবেকানন্দের কথা মনে করিয়ে দিই- “এই ভারতের এমন এক সময় ছিলো যখন গোমাংস ভোজন না করিলে ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব থাকিতনা। বেদ পাঠ করিলে দেখিতে পাইবে কোনও বড়ো সন্ন্যাসী বা রাজা কিংবা অন্য কোনও বড়লোক আসিলে...গোহত্যা করিয়া তাঁহাদিগকে ভোজন করাইবার প্রথা ছিলো।”

বলার অনেকই আছে। বিস্তারিত বলারও। কিন্তু নেহাৎই স্থানাভাব। পাঠকের ধৈর্যের কথাও ভাবা দরকার। তাই এখানেই দাঁড়ি টানি। অলমিতি বিস্তারেন।

আরো পড়ুনঃ-

১) The Myth of the Holy Cow—D. N. Jha
২) Advent of the Aryans in India—R.S.Sharma
৩) The Prehistoric Background of Indian Civilization—D.H. Gordon
৪) Looking for the Aryans —R.S. Sharma
৫) The Vedic People—Rajesh Kochhar
৬) Material Culture & Social Formations in Ancient India—R . S. Sharma
৭) সিন্ধুসভ্যতার স্বরূপ ও অবদান—অতুল সুর
৮) হিন্দু সত্তায় গোমাংস— দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা
৯) বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য —সুকুমারী ভট্টাচার্য
১০) বৈদিক সভ্যতা—ইরফান হাবিব, বিজয় কুমার ঠাকুর।

1 comments:

0

প্রবন্ধঃ কৃষ্ণদেব রায়

Posted in


প্রবন্ধ


বাঙালি হেঁশেলের বনেদীয়ানা
কৃষ্ণদেব রায়


আজ থেকে হাজার বছর আগেও বাঙালী জাতিটা ছিল কিনা, সেটা ঐতিহাসিকেরা বলবেন। আমি শুধু বলবো যে, বাঙালী তার জন্মলগ্ন থেকে অন্তত বছর পঞ্চাশ আগে অবধি কাউকে তার হেঁশেলে ঢুকতে দেয়নি। তখন কি বাঙালি বিয়ের ভুরিভোজে কি রবিবার দুপুরের খাওয়ায় সাবেকি বাঙালী খাবারই পরিবেশিত হতো। যদিও এই সাবেকি বাঙালী খানায় কতটা বিশুদ্ধ বাঙালীয়ানা ছিলো, সেটা বলা খুব মুশকিল। কারণ, এক তো দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বর্হিবাণিজ্য এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি শাসন এবং প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের ফলে খুব সামান্য হলেও কখন যে অজান্তে আমরা কিছু বিদেশি খাবারকেই নিজের ভেবে নিয়েছি, জানিনা। তবে এটা ঠিক যে আমাদের প্রাত্যহিক খাওয়াদাওয়ায় এখনও অবধি যৎসামান্য বিদেশি প্রভাব পড়লেও বাঙালী খানা তার উত্তরাধিকার ছাড়েনি। সুতরাং এটা বলা যেতেই পারে যে, দীর্ঘদিন মুঘলদের এবং ব্রিটিশদের শাসনে থেকেও আজও, এই বিশ্বায়নের যুগেও,বাঙালীর প্রাত্যহিক খাবার একান্তই তার নিজস্ব ঘরানার। তবে, ইদানীং বাঙালী জলখাবারে বা টিফিনে এবং মাঝেমধ্যে শখ করে নতুন বউ-এর রান্না চেখে দেখতে গিয়ে অনেক বাঙালীই এখন মাঝেমধ্যে পাস্তা বা নুড্ল, চাউমিন বা চিলি চিকেন পরখ করছেন। কিন্তু এখনও অবধি সেটা নিত্যনৈমিত্তিক রূপ নেয়নি। 

বাঙালীর প্রভাতী জলখাবারে অবশ্য একটি বিদেশি খাবার জাঁকিয়ে বসেছে বহুদিন। সেটি হল পাঁউরুটি! তবে এই পাঁউরুটি কিন্ত মোগল বা ব্রিটিশদের কাছ থেকে নয়, বরং এসেছে পর্তুগীজদের কাছ থেকে। পর্তুগীজ ভাষায় পাও কথাটার অর্থই হলো লোফ। এরা ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বেশ ভালো সংখ্যার বিদেশীরাও চেষ্টা করে গেছে বাঙালীর খাদ্যাভ্যাস পালটে দিতে। এবং তারা বাঙালীর মধ্যাহ্নভোজন বা নৈশাহারে তেমন থাবা বসাতে না পারলেও, বাঙালীর প্রভাতী জলখাবার বা বিকেলের জলখাবারে বেশ ভালো রকমই প্রভাব ফেলেছে। সকালের টোস্ট-ওমলেট-চা এর তিনটেই কিন্তু একেবারে ব্রিটিশ এবং পর্তুগীজদের কাছ থেকে নেওয়া। আর বাগদাদ থেকে আসা অভিবাসী ইহুদীরা এখানে কেক, পেস্ট্রি, প্যাটিসের বেকারি খুলে বসে। পরে অবশ্য বাঙালীরা সেটাকে আত্মস্থ করে নেয়। নিউ মার্কেটের বিখ্যাত নাহুম-এর দোকান এমনই এক অভিবাসী বাগদাদী ইহুদীর। কিন্তুএখন বাপুজি কেক একান্তভাবেই বাঙালীর। এই সব খাবারের অনুপ্রবেশের ফলে বাঙালীর, বিশেষ করে শহুরে বাঙালীর, জলখাবার থাকে হারিয়ে গেছে মোয়া, নাড়ু, তক্তির মতন খাবারগুলি। বরং সে তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে আসা ডাচ আর ফরাসীরা বাঙালীর খাদ্যাভ্যাসে তেমন কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। পশ্চিমবাংলার কলকাতায় চাইনিজরা এবং পূর্ব বঙ্গে আফগানরা নিজেদের একটা কমিউনিটি গড়ে তুলেছিল। সত্তরের দশকের শেষদিকে বা আশির দশকের প্রথম থেকেই বাঙালী চিনে পাড়ায় গিয়ে চিনে খাবারের আস্বাদ নেওয়া শুরু করে। 

দেড়শো বছর আগে একটি বিদেশী সবজি কিন্তু বাঙালী হেঁশেলে তার পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। সেটি হল আলু! শ’ দেড়েক বছর আগে বাঙালী জানতোই না আলুর শাকটা খায় না কন্দটা খায়। ভাবুন একবার! যে আলুর চপের জন্য বাঙালীর ভুবন জোড়া খ্যাতি, তার চল কিন্তু এই সেদিন। ঠাকুরের ভোগের খিচুড়িতে আলু দেওয়া ছিল চরম ম্লেচ্ছ কাজ।

মনে রাখতে হবে যে, বাঙালীর খাদ্যাভ্যাসের কথা বলতে গিয়ে আমি কিন্তু শুধুমাত্র হিন্দু বাঙালিদের কথা বলছিনা। বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গের আগে পাঁচশো বছরের মোগল শাসন মূলত ঢাকা কেন্দ্রিক ছিল। বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গ সামনে আসে যখন মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলার নবাব হন ১৭১৭ সালে এবং তিনিই ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসেন মুর্শিদাবাদে। দীর্ঘদিন মুসলিম সংস্পর্শে থাকার ফলে পূর্ববঙ্গীয় রান্নায় মুসলিম প্রভাব বেশ ভালো রকম লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু, ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের কাছে পরাজয়ের পরে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম সংস্পর্শ খুব বেশিদিন স্থায়ী না হওয়ায় এদেশের হেঁশেলে তাদের উপস্থিতির প্রভাব খুবই নগন্য। কিন্তু তবুওকোর্মা, কোপ্তা, কালিয়া প্রভৃতি রান্নাগুলো বাঙালির হেঁশেলে ঢুকে পড়ে মূলত ১৮৫৬ সালে, যখন আওয়াধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে ইংরেজরা নির্বাসিত করে মেটিয়াবুরুজে পাঠালেন। শোনা যায় সেইসময়ে নবাব ওয়াজিদ আলি নাকি সঙ্গে করে বেশ কয়েকশো বাবুর্চি, খানসামা এবং মশলচি (যারা মশলা পেষেন) সঙ্গে নিয়ে আসেন।

স্বাধীনতার পরে যখন পূর্ব বঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ ভাগ হয়ে গেলো দুটি পৃথক দেশে, লক্ষ লক্ষ পূর্ববঙ্গীয় সীমানা পেরিয়ে এদেশে চলে এলেন। তাঁরা প্রায় সবাই হয় হিন্দু বাঙালি নাহয় হিন্দু পাঞ্জাবী। বাঙালীরা মিশে গেলেন এদেশের ঘটিদের সাথে এবং কালক্রমে বিয়ে-শাদীর মাধ্যমে দুটি সংস্কৃতি মিলে এক নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব হলো, যার প্রভাব পড়ল বাঙালীর হেঁশেলেও। স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গ একটি ছোটো রাজ্য হলেও এর বন্দর, বাজার, বাসিন্দাদের ধন-দৌলত ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হলো। বাঙালির সাবেকি ছানার মিষ্টির জায়গায় এল হলদিরাম, গাঙ্গুরামের ক্ষীরের মিষ্টি। তবে, ভারতের আর অন্য কোনও রাজ্য যা পারেনি, পাঞ্জাব কিন্তু তা করে দেখিয়েছে। বাঙালি হেঁশেলের মটর পনীর বা পালক পনীর কিংবা তড়কা পাঞ্জাবীদের অবদান। এইসবের মাঝে ১৯৬৬ সালের চরম খাদ্য সংকটের হাত ধরে বাঙালির হেঁশেলে হানা দিলো এক নতুন আগন্তুক। উত্তর ভারত, বিহার, রাজস্থানের রুটি। বাঙালি একবেলা ভাত আর একবেলা রুটি খাওয়া শুরু করলো এবং এখন খাদ্য এবং চালের যথেষ্ট জোগান থাকলেও অনেক বাঙালিই এখন হয় দিনে না হয় রাতে এক বেলা রুটি খান।

মাছে ভাতে বাঙালি। ঘটিরা যেসব মাছ খায়, বাঙালরা তার অনেকগুলিই খায়না। আবার বাঙালরা যে মাছখায়, ঘটিরা তার মধ্যে অনেকগুলিই হেঁশেলে ঢোকায় না। কিন্তু ইলিশ সবাই খায়। আর বাঙালদের আর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য রান্না হলো শুঁটকি মাছ। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতন কিন্তু এখানে জাতি বর্ণ অনুসারে খাওয়ার ছল নেই। একজন ব্রাহ্মন বা একজন শূদ্র প্রায় একই ধরণের খাবার খান। যদিও মুরগীর মাংস বেশ কিছুদিন আগেও বাঙালির হেঁশেলে ব্রাত্য ছিলো। মাছ এবং মাংস বাঙালির প্রিয় হলেও বাংলার নিজস্ব ঘরানার নিরামিষ রান্নাগুলিও কিন্তু যথেষ্ট সুস্বাদুও উপাদেয়।বাঙালীর হেঁশেলের এই পরম্পরা টিঁকিয়ে রাখার জন্যে কিন্তু মূলত বাঙালি হিন্দু বিধবাদের অবদান অনেকটাই। ১৮৫৬ সালে বিধবাদের পুনর্বিবাহের আইন চালু হলেও সেটা বাস্তবে পরিণত হতে সময় লেগেছে বহুদিন। আর বাঙালি হিন্দু বিধবাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কঠোর অনুশাসন ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও অধিকাংশ বাঙালি যৌথ পরিবারের হেঁশেলের দায়িত্বে কিন্ত একজন বিধবাই থাকতেন। নিরামিষ রান্না তো বটেই, এমন কি আলুর খোসা বা পালং শাকের গোড়া দিয়েও তাঁরা এমন স্বাদু রান্না করতে জানতেন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর খাদ্য সম্বন্ধীয় এক গবেষণায় লেখিকা চিত্রিতা ব্যানার্জি এক জায়গায় এই বাঙালি হিন্দু বিধবাদের উল্লেখ করে বলেছেন, “নিরামিষ রান্না যে এত সুস্বাদু হতে পারে সেটা তোমায় বোঝানো অসম্ভব যতক্ষন না তোমার নিজের বউ বিধবা হচ্ছে!”

আসুন, এবারে আমরা এক ঝলক দেখে নিইবাঙালীর চিরন্তন রান্নার পদগুলি, যা এখনও আমাদের নিত্যদিনের আহার্য। এর মধ্যে যে যে খাবারগুলিতে বিদেশী প্রভাব রয়েছে, আমি বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করে দেবো।

অম্বল, আচার, বড়া, ভাজা, ভাপা, ভর্তা, চচ্চড়ি, চপ (ব্রিটিশ প্রভাবিত), কাটলেট (ব্রিটিশ প্রভাবিত, কবিরাজি কাটলেট কথাটি এসেছে Coverage অথবা Cover:egg থেকে), ছ্যাঁচড়া, ছেঁচকি, লাবড়া, চাটনি, ডালনা, দম, দোলমা(একবার কথা উঠেছিলো যে, দোলমা কথাটি গ্রীক শব্দ Dolmathes বা Dolmamades থেকে এসেছে... কিন্তু এটি প্রমণিত নয়), ঘন্ট, ঝাল, ঝোল, কালিয়া, কোফতা, কোর্মা (মোগলাই রান্না), পোলাও, কষা, পাতুড়ি,পোড়া, পোস্ত, তরকারি, শুক্তো, শাক। আর মিষ্টির মধ্যে, পায়েস বা পরমান্ন, রাবড়ি, সন্দেশ, রসগোল্লা,পান্তুয়া, দরবেশ, চমচম, জিলিপি আর পিঠে। এছাড়া মিষ্টি দই, যা একমাত্র বাঙালি ছাড়া আর কেউ খায়না।আমার বলা শেষ হল। আপনাদের যদি কারোর কিছু আরো যোগ করার থাকে, দয়া করে মন্তব্যে জানাবেন।

0 comments:

0

প্রবন্ধঃ আইভি চট্টোপাধ্যায়

Posted in





প্রবন্ধ


শক্তিপীঠ ও আমার ধর্মজিজ্ঞাসা 
আইভি চট্টোপাধ্যায়



চৈতন্যদেব থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ। স্বামী বিবেকানন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ। মিল এক জায়গায়। প্রত্যেকেই তথাকথিত ধর্মসম্পর্কিত ভাবনা এবং ধারণাকে ভেঙেচুরে নতুন আলো দেখাতে চেয়েছেন। স্বাধীনতার এত বছর পরেও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের নাগরিক হিসেবে আমাদের বহুবিধ জটিল ও জরুরী প্রশ্নের একটি আমাদের ধর্মভাব নিয়ে। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এই যে, ধর্ম মানুষকে যতখানি সম্পন্ন করে ততখানিই বিপন্নও করে।

হিন্দুত্বের উপর প্রত্যক্ষে জোর দেওয়া রাজনীতি নিয়ে মানুষ প্রায়শই বিভ্রান্ত। অবাক হই যখন ‘শিক্ষিত’ মানুষকে প্রশ্ন করতে শুনি,‘ভারত কি হিন্দু রাষ্ট্র হবে না?’‘উচ্চশিক্ষিত’ মানুষ জোরগলায় তর্ক তোলেন,‘ধর্মেই মানুষের শেষ মুক্তি।’

অথচ ভারত এক স্বাধীন সার্বভৌম গণতন্ত্র। ভারত এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে হিন্দু মুসলমান শিখ খ্রিস্টান পার্সী বৌদ্ধ জৈন সবাই সমান। হিন্দুরা চাইছেন বেশি করে হিন্দু হতে, মুসলমান চাইছেন বেশি করে মুসলমান হতে। খ্রিস্টান চাইছেন আরো অনেক মানুষকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে। এই চাওয়ার মধ্যে একটা শব্দ বারবার বাদ পড়ে যাচ্ছে। সেই শব্দটি হল ‘ভালো’। একজন ‘ভালো’ হিন্দু,‘ভালো’ মুসলমান বা ‘ভালো’ খ্রিস্টান হতে চাইলে অনেক সমস্যার আশু সমাধান।

পৃথিবীর প্রতি ধর্মের উদ্দেশ্য সর্বজনীন কল্যাণ: ভ্রাতৃত্ব, বিশ্বমৈত্রী, শান্তি। ভালো করে নিজের ধর্মশিক্ষাটুকু অনুসরণ করলে এ সংঘাতের সমস্যা মিটে যায়।

পুজো, অর্চনা, প্রার্থনা। নিয়ম করে দিনে পাঁচবার পাঠ, উপাসনা। পোষাক থেকে শুরু করে বহুবিধ আয়োজন। নানা আচার অনুষ্ঠান। সমর্পণের ভাবনাকে ছাপিয়ে ওঠে বাহ্যিক আড়ম্বর।

মানুষের জীবনদেবতাকে নিয়ে যে ধর্ম, যে ধর্ম সেই সত্যকে নিয়ে, যা সমাজ এবং ব্যক্তিমানুষকে ‘ধারণ’ করে, সে ধর্ম কোথায়?

ঠিক এইখান থেকে আমার ধর্মজিজ্ঞাসার শুরু। বুদ্ধ এবং গান্ধী, চৈতন্যদেব এবং রবীন্দ্রনাথ, যীশু এবং বিবেকানন্দ... সবার ভাষ্যে মিল এক জায়গায়। মানুষের এক নতুন চৈতন্যলোক চাই। আবহমান কাল ধরে পৃথিবীর দাবি একটাই। মানবতাবোধে বিশ্বাসী নতুন ‘বিশুদ্ধ’ মানুষ।

অন্বেষণের এই যাত্রায় আমার প্রথম উপলব্ধি, ভক্ত যে ভগবানকে চায়, সে তার নিজের পূর্ণতার জন্যেই।‘সোহহম’। আমি আর আমার ঈশ্বর একই। ঈশ্বরের যে প্রীতি ও কল্যাণভাবনা সকল মানুষের প্রতি সমান প্রসারিত, সেই ভাবনার আলোয় নিজের অহংবোধের সীমা অতিক্রম করে পরমশক্তির সঙ্গে একাত্ম হতে চাওয়া।

এই প্রসঙ্গেই শক্তি-আরাধনা নিয়ে নানা ভাবনা। দুর্গা, কালী, দশমহাবিদ্যা। একান্নটি শক্তিপীঠ। এই শক্তিপীঠ নিয়ে আমার ধর্মজিজ্ঞাসার শুরু।

‘পীঠ’ কথাটির অভিধানগত অর্থ ‘দেব দেবীর আসন’, দেবতা যেখানে বিশেষভাবে বিরাজিত। পীঠনির্ণয়-তন্ত্র অনুসারে একান্নটি শক্তিপীঠ।

১) জলন্ধর ২) জ্বালামুখী ৩) কাশ্মীর: শারদাপীঠ, অমরনাথ, ক্ষীরভবানী 

৪) মানস ৫) প্রয়াগ ৬) কুরুক্ষেত্র ৭) বৃন্দাবন 

৮) হিংলাজ ৯) প্রভাস ১০) পুষ্কর(মণিবেদক) ১১) অবন্তী 

১২) উজ্জয়িনী ১৩) বারাণসী ১৪) নর্মদা ১৫) জনস্থান

১৬) পঞ্চসাগর ১৭) শুচিদেশ ১৮) করবীর ১৯) রামগিরি

২০) কামাখ্যা ২১) কালীঘাট(কলকাতা) ২২) কালীঘাট(বর্ধমান)২৩) ত্রিপুরেশ্বরী

২৪) চন্দ্রনাথ(চট্টগ্রাম) ২৫) বৈদ্যনাথ ২৬) জয়ন্তীয়া ২৭) ক্ষীরগ্রাম

২৮) বক্রেশ্বর ২৯) কেতুগ্রাম ৩০) অট্টহাস ৩১) তমলুক(বিভাসক)

৩২) কিরিটেশ্বরী ৩৩) ত্রিস্রোতা ৩৪) নলহাটী ৩৫) রত্নাবলী

৩৬) নন্দিপুর ৩৭) যশোর ৩৮) শ্রীহট্ট ৩৯) বিরাট 

৪০) সুগন্ধা ৪১) ভবানীপুর ৪২) বিরজাক্ষেত্র (উত্‍কল) ৪৩) কালমাধব 

৪৪) কন্যাশ্রম ৪৫) গণ্ডকী ৪৬) নেপাল ৪৭) শ্রীপর্বত 

৪৮) গোদাবরী তীর ৪৯) মিথিলা ৫০) কাঞ্চী ৫১) শ্রীলঙ্কা 

সাধারণভাবে এই একান্নটি শক্তিপীঠের নাম থাকলেও বিভিন্ন আধ্যাত্মিক রচনায় সংখ্যাটা অন্য। জ্ঞানার্ণবতন্ত্রে পীঠের সংখ্যা পঞ্চাশ, কুব্জিকাতন্ত্রে বিয়াল্লিশ। শিবচরিতে একান্নটি পীঠের সঙ্গে সঙ্গে ছাব্বিশটি উপপীঠের বর্ণনা।

তন্ত্রসার গ্রন্থ অনুসারে মূল পীঠ চারটি: জলন্ধর, উড্ডীয়ান, পূর্ণগিরি, কামরূপ।

কালিকাপুরাণে মূল চারটি পীঠ: ওড্রা, জালশৈল, পূর্ণশৈল, কামরূপ। যদিও কালিকাপুরাণের অষ্টাদশ অধ্যায়ে পীঠসংখ্যা বাড়িয়ে সাত করা হয়েছে।দেবীকূট, উড্ডীয়ান, কামগিরি, কামরূপ, জলন্ধর, পূর্ণগিরি, কামরূপ সীমান্ত।

কুব্জিকাতন্ত্রে পীঠ: কর্ণসুবর্ণ, ক্ষীরগ্রাম, বৈদ্যনাথ, বিল্বক, কিরীট, অশ্বতীর্থ, মঙ্গলকোট, অট্টহাস

তন্ত্রচূড়ামণি মতে পীঠ: বহুলা, উজালী, ক্ষীরখন্ড, কিরীট, নলহাটি, বক্রেশ্বর, অট্টহাস, নন্দীপুর।

প্রতি পীঠে দেবী আলাদা নামে পূজিতা।

আর প্রতি পীঠে দেবীর সঙ্গে একজন ভৈরবের পুজো হয়। আর্যরা আসার পর শিব ও শক্তির সমন্বয়ে যে এক অর্ধনারীশ্বর পুজো রীতি শুরু হয়েছিল, এই দেবী-ভৈরব আরাধনায় সে সত্য প্রতিষ্ঠিত।

 “শিব: শক্ত্যা যুক্তো যদি
ভবতু শক্ত: প্রভবিতুং 
নচেদেবং দেবো
ন খলু কুশল: স্পন্দিতুমপি’’ (আনন্দলহরী–শঙ্করাচার্য) 

অর্থাৎ, পরমদেব শিব শক্তির সঙ্গে যুক্ত হলেই সমর্থ হন। নতুবা শক্তিহীন শিবও শব মাত্র। সত্যিই তো! শক্তি এবং তাঁর ভৈরব। নইলে কি সৃষ্টি হয়!

শক্তিপীঠ গড়ে ওঠার পিছনে যে পৌরাণিক কথা... দক্ষরাজার সভায় সতীর দেহত্যাগ, মহাদেবের প্রলয়নৃত্য থামাতে বিষ্ণুর সুদর্শনচক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ফেলা, আর সে দেহাংশ যে যে স্থানে পড়লো সেখানেই শক্তিপীঠ গড়ে ওঠা... অনুরূপ একটি গল্প মিশরের পুরাণে আছে।

মিশরের প্রিয় দেবতা ওসিরিজ। মাথায় সাপ, পরনে বাঘছাল, বাহন এপিস নামের ষাঁড়। ঠিক যেন আমাদের মহাদেব। ওসিরিজের স্ত্রী দেবী আইসিস। ওসিরিজের ভাই সেট ওসিরিজের প্রতি ঈর্ষায় মত্ত হয়ে একদিন তাঁকে হত্যা করে নীলনদের জলে সে দেহ ভাসিয়ে দিলেন। আইসিস পাগলের মতো স্বামীকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। নীলনদের ধারে অবশেষে খুঁজেও পেলেন। কিন্তু সেট সে দেহ ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিলেন। যে যে স্থানে ওসিরিজের দেহাংশ পড়ল, সেখানে একটি করে তীর্থস্থান গড়ে উঠল।

আমরা ইতিহাস থেকে জেনেছি, সেকালে ভারত এবং মিশরে বাণিজ্য ব্যবস্থা ছিল।

প্রশ্ন জাগে, কোন পুরাণ-কথাটি বেশি প্রাচীন! এই গল্পকথা কি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই প্রচারিত হয়েছিল? ওসিরিজের শরীরের টুকরোগুলো মিশরেই পড়লো? সতীর দেহাংশ কেবল ভারতবর্ষে?

সবচেয়ে মজার কথা, শক্তিপীঠ যে দেবীর দেহাংশ পড়েই গড়ে উঠেছে, সে তথ্য প্রথম জানা গেছে ষোড়শ শতাব্দীর আইন-ই-আকবরী থেকে।

পরে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক সাহিত্য এ তথ্য স্বীকার করে। তাই অনেক গবেষকই মনে করেন, পুরাণ-কথা হিসেবে সতীর দেহাংশ থেকে পীঠস্থান গড়ে ওঠার গল্পটি পীঠস্থান উত্‍পত্তির অনেক পরে বিশেষ উদ্দেশ্যে রচিত।

ভারত নামে দেশটার ভৌগোলিক সম্পূর্ণতার যে ধারণা আজকের মানুষের বোধে আনা সহজ হয়েছে, অতি প্রাচীনকালে তা কিন্তু ছিল না। হিন্দুধর্ম পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াসে শঙ্করাচার্য ভারতের অখণ্ডতার প্রথম ছবি আঁকেন। অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বরূপ হৃদয়ে ধারণ করার কাজে ব্রতী হয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ, গান্ধীজী। সে অনেক পরের কথা।

প্রাচীনকালে সমগ্র ভারতকে উপলব্ধি করার প্রয়াস ছিল ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। মহাভারতের মাঝখানে প্রক্ষিপ্ত গীতা সেই সর্বব্যাপী সমন্বয়তত্ত্বের আলোচনা করে।

শক্তিপীঠ ভাবনার সঙ্গে শক্তিপূজা-ভাবনা যতখানি, তার চেয়েও বড় সত্যি ভারতের ঐক্য এবং জাতীয়তাবোধকে ধরে রাখার চেষ্টা। ধার্মিক হিন্দুর কাছে ভারতের চারপ্রান্তে স্থিত চারধাম-যাত্রা পুণ্যের কাজ। শক্তিপীঠ ভ্রমণেও সেই পুণ্য-অর্জনের ইচ্ছে।

লাভ এই যে, তীর্থ করতে গিয়েও দেশটাকে দেখা হয়, জানা চেনা হয়।

যদিও প্রতিটি স্থানমাহাত্ম্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে খানিক ইতিহাস, কিছু বিজ্ঞান, এবং অনেকখানি কুসংস্কার, অলৌকিকতা প্রচারের নেতিবাচক দিক। ধর্মান্ধ মানুষ ইতিহাস ও বিজ্ঞানের অংশটুকু বাদ দিয়ে দেন, আর মেতে থাকেন অলৌকিকতার কুসংস্কার নিয়ে। তাই দৃষ্টি পরিষ্কার হয় না।

অথচ পীঠস্থানগুলোর বিশ্লেষণ করলে সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতের ধর্মীয় বিবর্তনের এক স্পষ্ট ইতিহাস জানা সম্ভব।

এই বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে শক্তিপীঠ সংক্রান্ত বহু গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকারের ‘দ্য শক্তি পীঠস’ উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত বহু গবেষণা এই গ্রন্থকে প্রামাণ্য ধরে আলোচনায় এগিয়েছে।

অন্তত চোদ্দটি পীঠ – তমলুক, কিরীটেশ্বরী, মানস, কুরুক্ষেত্র, বৃন্দাবন, হিংলাজ, প্রভাস, অবন্তী, উজ্জয়িনী, বারাণসী, পুষ্কর(মণিবেদক), কন্যাশ্রম, গণ্ডকী, নেপাল – কেবল হিন্দুদের তীর্থ নয়। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন – এই তিন সম্প্রদায়ের তীর্থ এই চোদ্দটি শক্তিপীঠ। আবার হিন্দুদের মধ্যেও কেবল শক্তি-উপাসক শাক্ত নয়, শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ও এই চোদ্দটি পীঠকে সাধনক্ষেত্র হিসেবে মানে।

এই প্রসঙ্গেই আমার আরেকটি পর্যবেক্ষণ এইরকম যে, হিন্দুধর্মের তিন মূল ধারা: শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব... এই তিন ধারার মিলিত একটি রূপও ভারতে আবহমান কাল ধরে চলছে। বিষ্ণু ও শিবকে মিলিয়ে দিয়ে হরি-হর, শিব ও শক্তিকে মিলিয়ে অর্ধনারীশ্বর। বাংলার বাউল ও মহারাষ্ট্রের মহানুভব সম্প্রদায়ের ধর্ম-ভাবনায় একইভাবে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের মিলিত ধারা।

বৃন্দাবন এবং মথুরায় দেবী উমা কঙ্কালমালিনী নামে পূজিতা। তাঁর ভৈরবের নাম ভূতেশ। একসময় কঙ্কালমালিনীর মন্দিরে বৌদ্ধ ও জৈন বিহার ছিল।

তমলুক বা তাম্রলিপ্ত বৌদ্ধদের অন্যতম প্রধান তীর্থ। খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন এবং তার দুশো বছর পর হিউয়েন-সাঙ তমলুককে বৌদ্ধধর্মের তীর্থ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসের কোন রাজনীতি ও ধর্মীয় বিবর্তনের পথ ধরে তমলুক হিন্দু তীর্থস্থান হিসেবে শক্তিপীঠের মর্যাদা পেলো, তা আগ্রহ জাগায়।

একই ইতিহাস মুর্শিদাবাদের লালবাগের কাছে কিরিটেশ্বরী শক্তিপীঠেও। বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্য, আবার ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনর্বিজয়।

বিরজাক্ষেত্র (উত্‍কল), প্রাচীন নাম উড্ডীয়ান। তন্ত্রমতে, এই স্থানে দেবীর নাভি পতিত হয়। দেবীর নাম বিমলা, ভৈরবের নাম জগন্নাথ। পুরাণ মতে, কলিঙ্গরাজ এই নাভি তিনটি বিগ্রহের মধ্যে স্থাপন করেন। কালো ভৈরব, হলুদ ভদ্রা (দুর্গা), সাদা শিব। বিবর্তনের অনেকখানি পথ পেরিয়ে এসে এই তিন বিগ্রহ আজ জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা।

বিরজাক্ষেত্রের ধর্মীয় বিবর্তন খুব আকর্ষণীয় বিষয়। দশম শতাব্দী পর্যন্ত এখানে বৌদ্ধধর্ম প্রবল ছিল। বৌদ্ধগ্রন্থ হেবজ্রতন্ত্রে উড্ডীয়ানের উল্লেখ আছে। ইন্দ্রভূতি নামে এক বৌদ্ধ সাধক এই উড্ডীয়ানে নির্বাণলাভ করেছিলেন। অনেক গবেষকের মতে, বর্তমানের হিন্দু দেবতামূর্তি আসলে বুদ্ধ, বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধসঙ্ঘের প্রতীক।

বৌদ্ধ ধর্মসাহিত্যে উত্‍কলবন্দনা অনেকখানি। ইতিহাসও আমাদের জানায়, বৌদ্ধধর্মের প্রভাবেই জগন্নাথধামে জাতিভেদপ্রথা নেই, যে জাতি-বর্ণ ভেদাভেদ অন্য সমস্ত হিন্দুতীর্থের বৈশিষ্ট্য।

বারাণসীতে প্রথমদিকে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রাবল্য ছিল, কিন্তু বৌদ্ধযুগে হিন্দুধর্ম প্রায় অবলুপ্ত হয়। মুসলমান শাসনকালে বারাণসীর সমস্ত হিন্দু দেবমূর্তি বিধ্বস্ত হয়। ইতিহাসের কোন প্রবাহে বারাণসী অন্যতম হিন্দু ধর্মস্থান শক্তির পীঠ হয়ে উঠলো, তা সত্যিই কৌতূহল জাগায়।

শক্তিপীঠ হিংলাজ-এদেবীর নাম কোট্টরী, তাঁর ভৈরবের নাম ভীমলোচন। মুসলমান সম্প্রদায় কোট্টরী দেবীকে ‘নানী’ নামে শ্রদ্ধা জানায়। মুসলমানের কাছে হিংলাজ-তীর্থের নাম ‘নানী কি হজ’।

শক্তিপীঠের পরিক্রমায় এইভাবেই হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন-ইসলাম নানা ধর্মের পরিক্রমা। আমার ধর্ম-জিজ্ঞাসা নতুন আলোয় ঝলমল। তাহলে ধর্ম নিয়ে কেন এত হানাহানি? কেন এত বিভ্রান্তি? কিছু ষড়যন্ত্রী মানুষ বুঝি ধর্মের নামে আপামর সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বিপথগামী করে রাখতে চাইছে? যেসব তীর্থ নিয়ে সব ধর্মের মানুষের আবেগ জড়িয়ে থাকে, তাদের কোনো একটি ধর্মের নামের গণ্ডীতে বেঁধে রাখা উচিত? এই শক্তিপীঠগুলোকে কেন্দ্র করেই আবার মানুষে মানুষে ভালোবাসার মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারি না আমরা সবাই?

অনেক গবেষকের মতে, খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর আলাউদ্দিন খিলজির রাজত্বকালে ইসলাম শাসনের অত্যাধিক পীড়নের ফলে হিন্দু মানসিকতায় ধর্মবাদের আলোড়ন। হিন্দুদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস যাকে বলে। সেই ক্রাইসিস, এক অভূতপূর্ব বিপন্নতা থেকেই একান্ন পীঠের জন্ম।

সেই অসহায় সময়ে সমস্ত আঞ্চলিক দেবীকে এক মাতৃশক্তির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে মাতৃপূজার আবহ তৈরী করা হয়েছিল। লক্ষ্য করার মতন বিষয় এই যে, পূর্বভারতে শক্তিপীঠের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কেন? পূর্বভারতে অত্যাচার ও নিপীড়ন বেশি হয়েছিল?

অন্য একটি কারণও আছে। তন্ত্রসাধনার বিস্তার। তন্ত্রসাধনার সূত্রপাত চীনে। চীন, তিব্বত, আসাম হয়ে পূর্বভারতে তন্ত্র ভাবধারার প্রসার। তাই পূর্বভারতে সতীপীঠের সংখ্যা বেশি। তান্ত্রিক সাধনায় বাংলা ও আসামের খ্যাতি ছিল। সাধক বামাক্ষ্যাপা দেবীকে মাতৃভাবে তন্ত্র সাধনা করতেন। বাংলার দুই সাধক, রামপ্রসাদ ও শ্রীরামকৃষ্ণ তন্ত্রসাধনা করেছেন। বারাণসীর বিখ্যাত সাধক ত্রৈলঙ্গস্বামী তান্ত্রিক সাধক ছিলেন। মহারাষ্ট্রের কঢ়ারী ব্রাহ্মণরা তান্ত্রিক সাধক ছিলেন। বৌদ্ধদের মহাযান ধর্মমত তান্ত্রিক সাধনার মত।

তান্ত্রিক প্রক্রিয়া সাধারণ মানুষের কাছে রহস্যপূর্ণ ব্যাপার। ভারতীয় ধর্মচেতনায় সাধন-পদ্ধতির দুই মার্গ। এক, নিবৃত্তিমার্গ। দুই, প্রবৃত্তিমার্গ। নিবৃত্তিমার্গ-অনুসারীর চোখে জগৎ সংসার মায়া,মোহ, মিথ্যা। প্রবৃত্তিমার্গে সাধক পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাধনায় বিশ্বাস করেন। তন্ত্রসাধনা প্রবৃত্তিমার্গের সাধনা।

বৈদিক সভ্যতার শেষে বৌদ্ধযুগ। যে বৌদ্ধধর্ম বৈদিক পূজা-পদ্ধতিকে অস্বীকার করে গড়ে উঠলো, বৌদ্ধযুগের শেষদিকে তাঁরাই গুপ্তভাবে বৈদিক যাগযজ্ঞ কর্মকাণ্ড অনুসরণ করতে শুরু করেছিলেন। এই গুপ্ত প্রক্রিয়া থেকেই তন্ত্র সাধনার শুরু।

তন্ত্রসাহিত্যে পীঠস্থানের উল্লেখ আছে। মূল চারটি শক্তিপীঠ,জলন্ধর, উড্ডীয়ান, পূর্ণগিরি, কামরূপ, বৌদ্ধদের সাধনপীঠ হিসেবে স্বীকৃত। বৌদ্ধগ্রন্থ হেবজ্রতন্ত্রে এই চার সাধনপীঠের উল্লেখ আছে। বৌদ্ধগ্রন্থ সাধনমালা-য় জলন্ধরের বদলে শ্রীহট্ট নাম উল্লিখিত।

এ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে, শক্তিপীঠ আসলে তন্ত্রসাধনার পীঠ। কিভাবে এই পীঠগুলো হিন্দু তীর্থ হয়ে উঠল, সেটাই ইতিহাস। শক্তিপীঠের স্থানগত কারণগুলো আসলে সবটাই ইতিহাস। সবটাই ধর্মীয় ও রাজনীতিক বিবর্তনের ফল।

এইসব যুক্তি দিয়েই মনে হয় আমার, ধর্মভাব প্রবল হয়ে ওঠার যে অধুনা ইতিহাস, তাতে অদূর ভবিষ্যতে পীঠসংখ্যা বেড়ে একশ’ হয়ে গেলেও অলৌকিকত্বের দোহাই দেবার প্রযোজন পড়বে না।

আসলে মানবহৃদয়ের চিরাচরিত পৌত্তলিকতা ভাবনা থেকে কোনো সময়, কোনো সমাজ, কোনো ধর্মই রক্ষা পায় নি। আদিম মানুষ সুরক্ষাজনিত ভয় থেকে, অশিক্ষার অন্ধকারে থেকে যে পদার্থ-উপাসনা শুরু করেছিল, সেই ধারা প্রবহমান।

তাই যে যীশু কোনো ধর্ম-প্রতিষ্ঠান গঠন করতে চান নি, তাঁর দেহাবসানের পর রোমান সাম্রাজ্যে তাঁর নামকে ঘিরেই গড়ে উঠল নতুন একটি ধর্ম: খ্রিস্টধর্ম। যীশু প্রতিভাত হলেন স্বয়ং ঈশ্বর হিসেবে। দিকে দিকে চার্চ ও প্রতিষ্ঠানের যুগোচিত আবহাওয়ায় যীশু হয়ে উঠলেন একজন স্বর্গীয় সম্রাট। যীশু বলেছিলেন পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্যের কথা, ঈশ্বরের রাজ্যের কথা। যীশুর স্বপ্ন, ঈশ্বরে বিশ্বাস অর্পণ করে পৃথিবীতে প্রেম ও অহিংসার স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলা। চার্চ জানালো, যীশুই ঈশ্বর, মুক্তিদাতা। স্বর্গীয় আচরণের স্থান পরলোকে। দিকে দিকে খৃষ্টধর্ম প্রচার করা ও সেই ধর্মের ছায়ায় অগণিত মানুষকে দীক্ষিত করাই স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলার উপায়।

এই আপোষধর্মী মনোভাবের জন্যেই গৌতম বুদ্ধ, যিনি পুজো-অর্চনার বিরোধিতা করে গেলেন আজীবন, তিনিও ভগবান হয়ে পুজো পেতে লাগলেন দেহরক্ষার পর থেকেই। তাঁর নামকে ঘিরে বৌদ্ধধর্ম প্রচার।

কিংবা রাজা রামমোহন রায়। মুক্তমনা একটি সমাজ তৈরী করতে চেয়েছিলেন। পৌত্তলিকতা ভাবনা নয়, সর্ব ধর্ম সমন্বয়ে এক মুক্ত সমাজ। ব্রাহ্মসমাজ। যেখানে সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে শুদ্ধচিত্তে প্রার্থনা করবেন, একাত্ম হবেন। রামমোহনের দেহরক্ষার পর তৈরী হল একটি নতুন ধর্ম: ব্রাহ্মধর্ম।

বিবর্তনের স্রোতে নতুন পরিস্থিতি, নতুন ভাবনা, নতুন চিন্তা আসবেই। সে নিয়ে আপত্তির কারণ নেই। কিন্তু পূর্বসূরীদের অন্তর্দৃষ্টি আমাদের কাছে অর্থবহ হওয়া উচিত। নইলে একান্ন শক্তিপীঠের জায়গায় একশ’ একান্নটি শক্তিপূজাতেও লাভ নেই।

হিন্দুধর্ম, কিংবা যে কোনো ধর্মকেই বুঝতে গেলে ভারত নামের এই দেশটাকে বুঝতে হবে। হিন্দুধর্ম এক বিশাল দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনের প্রবহমান ধারার নাম। আর ভারতের সংস্কৃতি, সভ্যতা, ধর্ম, কোনটাই মানুষকে ছাপিয়ে উঠতে পারে না। মানুষের খাদ্যাভ্যাস, পোষাক আশাক, রীতিনীতি নিয়ন্ত্রণ করে ধর্মশিক্ষা হয় না।

হিন্দুধর্ম হল আত্মদর্শন। শান্তংশিবমদ্বৈতম্। শান্ত, শিব। এবং এই দুই মিলে আত্মার মধ্যে সামঞ্জস্যসাধনে অদ্বৈত হয়ে ওঠার অন্য নাম হিন্দু হয়ে ওঠা। শক্তিপীঠ পরিক্রমায় এই সত্যটুকুই আমার অনুভবে এসেছে। অদ্বৈত হয়ে উঠতে না পারলে সব তীর্থই অসার।

তথ্যঋণ: বিভিন্ন তন্ত্র, কালিকাপুরাণ, শিবপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, উদ্বোধন পত্রিকা
যাঁদের লেখালেখি থেকে এই অন্বেষণের তাগিদ এবং সমৃদ্ধি: 
শ্রী ক্ষিতিমোহন সেন, ড: দীনেশচন্দ্র সরকার, শ্রী হোসেনুর রহমান,
শ্রীমতি পূর্বা সেনগুপ্ত, শ্রীমতি কেতকী কুশারি ডাইসন,
স্বামী সারদানন্দ, স্বামী নিগুঢ়ানন্দ

0 comments:

0

প্রবন্ধঃ অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


পর্নোগ্রাফির আশীর্বাদ
অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য



এ যেন ভুতের মুখে রাম নাম। পর্ণোগ্রাফি। যে শব্দটার মধ্যেই অশ্লীলতা। নৈতিকতার পতন। মানবতার স্খলন। এরকম হাজার বিশেষণ-বিশেষ্য পদের সমাহার, সমার্থক হয়ে যায় পর্নোগ্রাফি শব্দটার সাথে। সেই পর্নোগ্রাফি কিনা আশীর্বাদ। নারীবাদী দৃষ্টিতে পর্নোগ্রাফি অভিশাপ। সেই অভিশাপই কিনা আশীর্বাদ! এ যেন শাপে বর। রাজা দশরথের সেই উক্তি। পুত্র না হলে পুত্র শোক হবে কি করে। পর্নোগ্রাফি সেরকমই। এটাই বাস্তব, আজ আমরা যে হাই-স্পীড ইন্টারনেট দেখি, সেটা প্রত্যক্ষ ভাবে পর্ণ ইন্ডাস্ট্রির কাছে ঋণী। আজ আমরা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করি। GPS দিয়ে খুঁজে নিই পথের ঠিকানা। এক ক্লিক। ভিডিও লোড। কিন্তু এর জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকতে হবে সেই অশ্লীল পর্নোগ্রাফির কাছে। 

একটা প্রবচন আছে - প্রয়োজনীয়তা থেকেই জন্ম নেয় নতুন আবিষ্কার বা উদ্ভাবন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ একদিকে যেমন মানব সভ্যতার কলঙ্ক, তেমনি সেই বিশ্বযুদ্ধ এক লাফে প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে কয়েক যোজন। অপারেশন-রিসার্চ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর অবদান। প্রায় হাজার অপারেশন-রিসার্চ বিজ্ঞানীর প্রচেষ্টা ছিলো সৈন্যবাহিনীর সাফল্য বা ব্যর্থতার পিছনে। প্রযুক্তি বিদ্যা যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছে কতটা কৃতজ্ঞ, সেটা লিখে শেষ করা যাবে না। হেবার প্রসেস পরিপূর্ণতা পেয়েছে সেই দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়। রাতারাতি জার্মানি বানিয়ে ফেলে অ্যামোনিয়া। সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্ট, ইনভেন্টরি কন্ট্রোল, সব কিছুই সৃষ্টি হয়েছে রাতারাতি। 

সেরকম আধুনিক ইন্টারনেট বিকাশ লাভ করেছে পর্ণোগ্রাফির হাত ধরে। প্রথম বা আদি রিপুর তাড়নায় এমন এক ব্যবসা, যা বদলে দিল পৃথিবীর জনসংযোগ পদ্ধতি। প্রথম ইন্টারনেট ওয়েবসাইট যেখানে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা শুরু হয় সেটা একটা পর্ণ সাইট। ওয়েবক্যাম পর্নোগ্রাফির হাত ধরেই নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে। সাথে আসে কাস্টমার delight। প্রয়োজন হয় উন্নত ব্যান্ড উইডথ (width)। যাতে ভিডিও সহজেই পৌঁছে যায় গ্রাহকের হাতে। ইন্টারনেট ছাড়াও পর্ণোগ্রাফি প্রযুক্তিকে অনেক আগে থেকেই উন্নত করেছে। লাইব্রেরি কার্ড ক্যাটালগ সিস্টেম, হোম ভিডিও, সব কিছুতেই সেই পর্নোগ্রাফির অবদান। মোবাইল আসার আগে একটা জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল VCR। সেই জনপ্রিয়তাও এসেছিল পর্নোগ্রাফির হাত ধরে। বর্তমান যুগে পর্ণ ইন্ডাস্ট্রি আয়তনে খুব একটা ছোটো নয়। 2014 সালে বিশ্বব্যাপী যে পরিমান পর্ণ ভিডিও দেখা হয়েছে তাতে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ গড়ে 11 টি পর্ণ ভিডিও দেখেছে সারা বছরে। মোবাইল apps এর প্রায় 36% পর্ণ কেন্দ্রিক। ইউ-টিউব খুললে দেখা যাবে কেমন করে পর্ণ সিনেমা তৈরী হয়। টেকনোলজি, অভিনয়, সব কিছুরই সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগ। 

কিন্তু পর্নোগ্রাফির অন্ধকার দিক ঢেকে ফেলছে আলোকে। নিষিদ্ধ শিল্পকলা শিল্প কে কলা দেখিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে নারী শরীরের বেসাতি। MMS বানানোর নির্লজ্জ কৌশল নষ্ট করে দিয়েছে মনুষ্যত্বর সমস্ত ব্যাকরণকে। ফলে, যে ইন্টারনেট পর্ণ ইন্ডাস্ট্রির কাছে ঋণী, সেই ইন্টারনেট আজ পর্ণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নাম করা সার্চ ইঞ্জিন তাদের অ্যালগরিদম পরিবর্তন করেছে।পরিবর্তন হয়েছে আইন ব্যবস্থায়। সেফ মোড সার্চ অন অফ অপশন নিয়ে এসেছে গুগল। পর্ণকে অপসারণ করতে এসেছে নতুন প্রোগ্রাম। তাই আজ শতাব্দী প্রাচীন পর্ণ শিল্প হারিয়ে ফেলছে তার আন্তর্জাতিক বাজার। অন্তর্বাস বিজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে নতুন পথ খোঁজার চেষ্টায় এই ইন্ডাস্ট্রি।

শিল্প পরিবর্তনশীল। জন্ম মুহূর্তে মোবাইল আকারে বড় ছিল। তারপর ছোট হতে হতে মিনি, মাইক্রো। আবার আকারে বড়। অথবা ধরা যাক ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। এক দিকে জিরো সাইজ ফ্যাশন। অন্য দিকে প্লাস সাইজ ফ্যাশন কাঁপিয়ে দিচ্ছে রাম্প। সেরকম পর্ণ ইন্ডাস্ট্রি। নতুন পথে ঠিকই খুঁজে নেবে নিজের পরিচয়। অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম আবার চিনিয়ে দেবে নতুন পথ। হয়তো সেই পথেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি। যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন। কেউ হয়ত কোনওদিন ভাবে নি, সভ্য সমাজ যে পর্ণকে সমাজচ্যূত করেছিলো, সেই পর্নের মধ্যেই লুকিয়ে ছিলো জন্ম লগ্নের ভ্রুণ। যা থেকে জন্মেছে আধুনিক ইন্টারনেট। হয়ত ভবিষ্যতের প্রযুক্তির পথও লেখা আছে সেই সামাজিক বঞ্চনার মধ্যে। 

তথ্য সূত্র: The Times of India 






0 comments:

1

বিশেষ নিবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


বিশেষ নিবন্ধ


নৌকো নিয়ে সাত-সতেরো
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



এক তরুণ কিছুদিন আগে আমাকে বলেছিলো,‘‘জেঠু,তুমি তো লেখো। তা, নৌকো নিয়ে কিছু লেখো না!’’ ঘটনাচক্রে তখন আমরা দুজনেই খেয়া নৌকায়গঙ্গা পার হচ্ছিলাম। হেসে কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিলাম বটে, কিন্তূ নৌকা নিয়ে সাতসতেরো কথা ফাঁদবার ইচ্ছেটা মাথায় থেকে গিয়েছিলো।

সপ্তাহে দিন দুয়েক গঙ্গা পারাপারের জন্য আমাকে নৌকায় চাপতে হয় সেই ছেলেবেলা থেকে।তার মানে এই নয় যে নৌকা সম্পর্কে আমার কিছু বলার অধিকার জন্মেছে। তবে অভিজ্ঞতায় ভর করে আর বইপত্তর নাড়াচাড়া করার সুবাদে এ নিয়ে দু’এক ছত্র লেখা যেতে পারে ভেবেই এই সাত-সতেরো লেখা।গঙ্গার তীরেই তো জন্ম থেকে চুয়াত্তরটা বছর কাটিয়ে দিলাম। মাঝিদের সঙ্গে কত গল্প, ডিঙ্গি নৌকায় জেলেদের ইলিশমাছ ধরা দেখা, কৈশোরে নৌকায় চেপে অনেক দূর যাওয়া, সখের দাঁড় বাওয়া, নৌকায় দুর্গাপ্রতিমা ভাসান,নৌকার ছইয়ে বসে সারা রাত চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা ভাসান দেখা কিংবা গঙ্গার বুকে নৌকার প্রতিযোগিতা (বাইচ) দেখার উত্তেজনা এখনও মনে পড়ে বৈকি!ছোটবেলায় দেখেছি, তখন মালবাহী ছোট বড় গাড়ির চল ছিলো না এখনকার মতন, বড় বড় নৌকা (গাদা বোট) বোঝাই হয়ে মালপত্তর আসতো বড়বাজার থেকে, গঙ্গার ঘাটে খালাস হতো। ইঁট, বালি প্রভৃতি ইমারতী জিনিসও নৌকা বোঝাই করে আসতো।আমার শৈশবটাও তো কেটেছে জেলেপাড়ায়, গঙ্গার ধারে। এখন আর খেয়া নৌকা আগের মতন নেই। হাল আর দাঁড়ের বদলে বসেছে ডিজেল যন্ত্র। নৌকা হয়ে গেছে ভটভটি।আশ্চর্য সমাপতনই বলবো। আমার জন্ম ও তারুণ্য গঙ্গাতীরে খেয়া ঘাটের গায়ে আর জীবনের উপান্তে পৌছে বাসা বেঁধেছি ঠিক তার উলটো পাড়ের গঙ্গাতীরে খেয়াঘাটেরই গায়ে।

আমরাতো সকলেই জানি যে,নৌকা হলো মানব সভ্যতার আদি জলযান।পৃথিবীর প্রায় সব মুখ্য ধর্মকাহিনীর প্রারম্ভিক পর্বের সূত্রপাত হয়েছে প্লাবনের মধ্য দিয়ে এবং সেই প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নৌকা ব্যবহার করতে হয়েছে। তাই সভ্যতার সেই ঊষালগ্নে যাতায়াতের জন্য নৌকার উদ্ভাবন হয়েছিলো, যাকে বলা হত ‘ভেলা’। ভেলারই বিবর্তিত রূপ নৌকা। প্রাগৈতিহাসিককালের মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসাবশেষে, অজন্তার গুহাচিত্রে এবং সাঁচিস্তুপে নৌকার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। কালের স্রোতে কত স্থলযানের বিলোপ হয়েছে, মানুষ-চালিত যানের স্থান নিয়েছে যন্ত্রচালিত যান, কিন্তু জলযান নৌকার স্বকীয়তার বিলোপ হয়নি, বরং এর ব্যবহার বেড়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে কিংবা এইবাংলায়, বিহারে নৌকা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংবাদ হামেশাই সংবাদপত্রে দেখতে পাই। কিন্তু বোধ করি পথদুর্ঘটনার সংখ্যা বহুগুণ বেশি হয়।

ছেলেবেলায় একটা কথা খুব বলতাম - ‘চল পানসি বেলঘড়িয়া’। কথাটা প্রবাদ হয়ে গেছে। কোনও কাজে দলবদ্ধভাবে এগিয়ে চলার জন্য উৎসাহ-বর্ধক হিসাবে কথাটা বলা হয়। ‘পানসি’ মানে একধরনের নৌকা। কিন্তু পানসি বেলঘড়িয়ায় যাবে কেন, কি করেই বা যাবে? কারণ বেলঘড়িয়া অঞ্চলের অবস্থান তো গঙ্গাতীর থেকে প্রায় সাড়ে তিন/চার কিলোমিটার দূরে! আমি এই প্রবাদের অর্থ কোথাও পাই নি। তবে একটা সূত্র আমার মনে হয়েছে। নিমতা ও অন্যপাশে গঙ্গাতীরের গ্রাম আড়িয়াদহর মধ্যে যে অঞ্চলটার নাম বেলঘড়িয়া, সেটা প্রাচীনকালেছিলো পাট ও তরিতরকারি বানিজ্যের বৃহৎ কেন্দ্র। গঙ্গার তীরে আড়িয়াদহ থেকে নৌকা বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হতো। মাল খালাস ও বোঝাই করার জন্য খালাসিদের ডাকা হতো ঘন্টা বাজিয়ে। একটা বড় আকারের ঘন্টা বা বেল ছিলো, সেই ঘন্টার শব্দে মাল খালাসকারীরা জড়ো হয়ে যেতো।সেই থেকে নাম বেলঘড়িয়া। তো মনে হয় নৌকার মাঝি ও মালখালাসকারীরা ‘চলো পানসি বেলঘড়িয়া’ হাঁক দিতো ঘন্টার শব্দ শুনে।

এতো গেল প্রবাদের কথা। নৌকার কত নাম, কত ধরণ, আর তার কত অঙ্গ, কত সরঞ্জাম, তার ইয়ত্তা নেই। নৌকা, পানসি, বজরা, ডিঙ্গি, সাম্পান, ছিপ,নাও, গয়না,পাতাম, শ্যালো নৌকা, কোশা, গাদা বোট, ভড় ইতাদি। বৈঠা, হাল, পাল, দাঁড়, গলুই, ছই, গুন, লগি, পাটা, মাস্তুল, নোঙ্গর– ইত্যাদি শব্দগুলো যুক্ত নৌকার সঙ্গে – নৌকারই অঙ্গ। রূপকথার ‘ময়ূরপঙ্খী নাও’, কিংবা মনসামঙ্গলে বর্ণিত ধনপতি সওদাগরের ‘সপ্তডিঙ্গা মধুকর’– এইসব সকলেই শিশুকাল থেকেই শুনে আসছে। আমাদের দেশের, বোধহয় সব দেশেরই, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, প্রবাদ, ছড়া, রূপকথা ও ধর্মীয় আচারে নৌকার বিশিষ্ট স্থান আছে যুগ যুগ থেকে। পবিত্রতার প্রতীক হিসাবেই নৌকাকে দেখা হয়।মূলত পূর্ববঙ্গীয় লোকসঙ্গীতের একটা রূপ ‘ভাটিয়ালি’ গান সৃষ্টি হয়েছে নৌকা বাওয়াকে ঘিরে। নদীতে ভাটার টানে নৌকা বাওয়ার সময় নৌকামাঝিদের যে গান তাইই, ভাটিয়ালি গান।‘মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না’, কিংবা ‘নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে / তর তরাইয়া চলুক রে নাও মাঝ দরিয়া বাইয়া রে নাও মাঝ দরিয়া বাইয়া’।পঞ্জিকা বিশারদরা গণনা করে সিদ্ধান্ত জানান দেবী দুর্গার আগমন কোন বছরে নৌকায়।আজকের যন্ত্র-যানের যুগেও যখন সলিল চৌধুরীর লেখা ও সুর করা নৌকা বাওয়ার গান শুনি ‘ওমাঝি বাইও, বাইওরে নাও বাইও / খরনদীর স্রোতে স্বপ্নের দেশে যাইও / হেঁই রে আকাশে আসে তুফান বড় ভারি, হেঁই রে ঢেউয়ের তালে তুফান নাচে, মরণ মহামারি/ হেঁইও হো, বল মাভৈঃ যাবোই খরনদীর পারে...” তখন যেন নৌকা বাওয়ার গান সব বাধা পেরিয়ে মানুষের লক্ষ্যেপৌঁছানোর প্রতীক হয়ে যায়।এ ভাবেইআমাদের সংস্কৃতিতে ‘নৌকা’ যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, চিরন্তন এক দার্শনিক সত্যের প্রতীকে। নদীতে স্রোতের পক্ষে বা স্রোতের বিরুদ্ধে নৌকা বাওয়া যেন মানবজীবনের ওঠা-পড়া, ভাঙা-গড়াজীবন-নদীর ওপারে পৌছানোর জন্য।

নৌকা নিয়ে দর্শন, রূপকথা, গল্পকথা থাক, এবার ইতিহাসে ফেরা যাক।ইউরোপীয়রা বৃহদাকার নৌকা নির্মাণের কৃৎকৌশল আয়ত্ত করেছিলো তাদের সমুদ্র অভিযানের জন্য। কেমন আকার ছিলো ক্রিস্টোফার কলম্বাস, ভাস্কো-দা-গামাদের সেই বৃহদাকার পাল তোলানৌকা, যাতে চেপে তাঁরা আমেরিকা, ভারতের সমুদ্রপথ আবিষ্কারের সাহসী অভিযানে বেরিয়েছিলেন তা বোঝার উপায় নেই, কল্পনায় আঁকা ছবি ভিন্ন। নব্বই জন সঙ্গী নিয়ে তিনটি নৌকায় দুঃসাহসিক সমুদ্র অভিযানে বেরিয়েছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে। কলম্বাসের নৌকাটির নাম ছিলো ‘সান্তামারিয়া’। কেমন ছিলোকলম্বাসের ‘সান্তামারিয়া’র আকৃতি, তা অনুমান নির্ভর, কিন্তু বিশালাকারবত্রিশ দাঁড়ের আশি ফুট দৈর্ঘ্যের বিস্ময়-নৌকা ‘ভাইকিং’এর নমুনা কয়েকশো বছর পরে আবিষ্কৃত হয়েছে আর আজও তা অসলোর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।

নৌকার সাতসতেরোয় রূপকথার প্রসঙ্গ ছুঁয়েছি, ‘ভাইকিং’এর বৃত্তান্তও রূপকথার মতন। মধ্যযুগে দারিদ্র ও খাদ্যাভাবে জর্জরিত দেশ নরওয়ে জলদস্যুতার উদ্দেশ্যে ‘ভাইকিং’ নির্মাণের কৌশল আয়ত্ত করেছিলো। ইউরোপের সাগরকূলের নানান প্রান্তে অতর্কিত অভিযান চালিয়ে খাদ্য, পণ্য ও সম্পদ লুন্ঠন করতো তারা।

বড় আকারের পালতোলা নৌকা, ইউরোপীয়রা যাকে জাহাজ বলতো, সেইরকম নৌকাতেইমাদ্রাজ থেকে পাড়ি দিয়ে জোব চার্ণক ভাগীরথীর তীরে ‘সুতানূটি’ গ্রামে (এখনকার শোভাবাজার) নোঙ্গর ফেলেছিলেন ১৬৯০এর ২৪শে অগস্ট। এদেশে ইউরোপীয়দের জলদস্যুতা, বানিজ্য বিস্তার আর তারপর উপনিবেশ স্থাপন, সবকিছুরই সূত্রপাত নৌকার সহায়তায়। এ আর এমন কি? মৃত লখিন্দরের শব নিয়ে বেহুলাপৌঁছে গিয়েছিলো স্বর্গের দেবতাদের কাছে নৌকা ভাসিয়ে,আর ইউরোপীয়রা এতবড় ভারত দেশটাকে জিতে নেওয়ার কৌশলের সূত্রপাত করলো সেই নৌকারই সহায়তায়! তারা কলকাতা দিয়েই শুরু করেছিলো। অতএব নৌকার কলকাতার কথাও বলি।

“বালিঘাটা এড়াইল বেনিয়ার বালা।

কালিঘাটে গেলো ডিঙ্গা অবসান বেলা”। 

কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের মনসামঙ্গলে ধনপতি সওদাগরের বানিজ্য যাত্রার বর্ণনা। তাহলে কালীঘাট দিয়ে ভাগীরথীর স্রোতধারা বয়ে চলতো ও নৌচলাচল হতো। এতো ষোড়শ শতাব্দীর বৃত্তান্ত।প্রাচীনকাল কেন, বেশি দিনের কথা নয়, মাত্র তিনশো বছর আগেও এখনকার কলকাতার অনেক ব্যস্ততম রাস্তা তখন রাস্তা ছিলো না, ছিলো খাল বা নদীর স্রোতধারা, যেখানে নৌচলাচল হতো। টাইম মেশিনে চেপে যদি যেতে পারতাম তিনশো বছর আগের ক্রীক রো’তে, হয়তো শুনতে পেতাম কুঁড়ে ঘরের জানালা দিয়ে কোনও গৃহবধু শুধাচ্ছে “কোথা যাও গো মাঝি”? কিংবা সার্কুলার রোডে, পড়ন্ত বিকালে কোনও ক্লান্ত হাটুরে ডাকছে “কুথা যাবেক গো মাঝি? সোঁদর বন যাবো গো, পাটায় একটুন জায়গা দিবা?” হ্যাঁ, এই রকমই তো ছিলো তিনশো বছর আগের কলকাতা। এখনকার অনেক ব্যস্ততম রাস্তা, গলি তৈরি হয়েছে খাল বুজিয়ে।

নৌকা চলতো মানে নৌকাডুবিও হত। সে’কথাও বলা যাক। কলকাতা নগরীর পত্তনের আগে থেকেই “চাঁদপাল ঘাটের কাছে গঙ্গা থেকে একটা খাল বেরিয়ে হেস্টিংস স্ট্রীটের উত্তর দিয়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের ভেতর দিয়ে সার্কুলার রোড পার হয়ে এন্টালির উত্তর গা হয়ে বেলেঘাটার লবণ হ্রদের ভেতর দিয়ে ধাপায় পড়তো” (তথ্যসূত্র – ‘কলিকাতা দর্পন’ – রথীন্দ্রনাথ মিত্র)। এখান দিয়ে নৌকা চলাচল করতো। এই খালগুলি বুজিয়ে কলকাতাররাস্তা, গলি হয়েছে কলকাতার নগরায়নের পরে। প্রবল ঝড়ের বেগে নাকি একবার অনেক নৌকা ভেঙে গিয়েছিলো, তাই এখন যে গলিটার নাম ক্রীক রো, সেটার নাম ছিলো‘ডিঙ্গা ভাঙা গলি’। এইসব বৃত্তান্ত সঠিক জানার উপায় নেই, কারণ তখন এদেশে সংবাদপত্রতো দূরস্থান, ছাপার অক্ষরই তৈরি হয়নি। সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্যস্যার ফ্রান্সিস রাসেলতাঁর একটা চিঠিতে ১৭৩৭ সালের৩০শে সেপ্টেম্বর রাত্রের এক মহা দুর্যোগের বর্ণনা লিখেছিলেন, যা লন্ডনের ‘জেন্টলম্যান’স ম্যাগাজিন’-এর প্রতিবেদনে বেরিয়েছিলো। সেই রিপোর্ট মতে,‘‘কলকাতা ও আশপাশ মিলে নিহত মানুষের সংখ্যা ত্রিশ হাজার, পশু-পাখি অসংখ্য এবং ছোট বড় জাহাজ নৌকো ইত্যাদি কুড়ি হাজার ...।”(তথ্য সূত্র ‘কলকাতা’ – শ্রী পান্থ )

ইতিহাসের কথা যখন বলছি, তখন উনিশ শতকের অভিজাত মহলের নৌকা ব্যবহারের দু’একটি চমকপ্রদ ঘটনা তুলে আনি।জর্জ এভারেস্ট, যাঁর নামে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম, তিনি ১৮৪৩এর ১লা অক্টোবর দেরাদুন থেকে পুরোটা নদীপথে কলকাতা এসেছিলেন, সময় লেগেছিলো ৩৫ দিন। ১৮০১এর অগস্ট মাসে তখনকার বড়লাট ওয়েলেসলি বারাকপুর থেকে নৌকা চেপে নদীপথে এলাহাবাদ পৌঁছেছিলেন, সময় লেগেছিলো ৫মাস। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী থেকে যানা যায়, ১৮৫৬তে কলকাতা থেকে কাশী গিয়েছিলেন নৌকা চেপে, সময় লেগেছিলো দেড় মাস আর নৌকা ভাড়া একশ’ টাকা। সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়িতে এলাহাবাদ, আগ্রা গিয়ে আগ্রা থেকে নৌকায় দিল্লী পৌঁছেছিলেন এক মাসে। যদিও তখন রেলগাড়ি চালু হয়ে গিয়েছিলো।

উইলিয়াম হিকি এদেশে অ্যাটর্নি জেনারেল হয়ে এসেছিলেন ১৭৭৭এ, তখন কলকাতার নগরায়ন সবে শুরু হয়েছে। ১৮০৯ পর্যন্ত হিকি দীর্ঘ বত্রিশ বছর কলকাতায় ছিলেন। লন্ডনে ফিরে গিয়ে চার খণ্ডে তাঁর স্মৃতিকথা (১৭৪৯ থেকে ১৮০৯ পর্যন্ত)প্রকাশ করেন, যেটি আদি কলকাতার সমাজ জীবন জানার জন্য এক অমূল্য দলিল হিসাবে বিবেচিত হয়। ১৭৪৯-এ, মানে পলাশীর যুদ্ধেরও আট বছর আগে, কলকাতা তখন অজ গ্রাম মাত্র, আর ইংরাজরা সুতানূটিতে ঘাঁটি গাড়া বণিক মাত্র। হিকি তাঁর স্মৃতিকথা শুরু করেছেন এইভাবে - “১লা নভেম্বর, ১৭৭৭ সন। ভোর চারটে থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে বেলা প্রায় দুপুর আন্দাজ সাগরদ্বীপে এসে পৌঁছলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা পানসি নৌকা এল, কর্নেল ওয়াটসন আগেই সেটি ভাড়া করে রেখেছিলেন কলকাতায় যাবার জন্য। বেলা দুটোর সময় আমরা সকলে মিলে পানসিতে করে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করলাম। পানসিতে যেতে আমার আপত্তি ছিলো, কারণ বাংলা দেশের এই বিচিত্র নৌকাটি এমনভাবে তৈরি যে তার মধ্যে সোজা হয়ে বসা যায় না। এমন কি পা ঝুলিয়ে একটু আরাম করে বসাও সম্ভব নয় ... তবু পানসির অভিনবত্বের জন্য এই অসুবিধাটুকু আমাদের সয়ে গেল। ছ’জন কালা আদমি(মাঝি) খুব জোরে জোরে দাঁড় বাইছিলো, পানসিও তরতর করে দুরন্ত বেগে। সন্ধ্যা ছটার সময় আমরা কুলপিতে এসে পৌঁছলাম ......। 

পানসি ভিড়ল...... বহু দূরে – প্রায় নয় মাইল লম্বা ও দু’মাইল চওড়া জলের একটা আস্তরের উপর দিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম ও কলকাতা শহরের অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। আগাগোড়া জলের ওপর ছোট বড় শত শত জাহাজ ও নৌকা নোঙর বেঁধে রয়েছে। তারই ভিতর থেকে যেন কলকাতা শহর নদীস্নান করে গাত্রোত্থান করেছে তার বিচিত্র সৌন্দর্য নিয়ে।”

এটা প্রায় তিনশ’ বছর আগেকার বর্ণনা। আজও কি হিকি বর্ণীত এই সৌন্দর্যবোধের কিছুমাত্র কম হয়েছে? এই সৌন্দর্যবোধের উৎস হয়ে মানবসভ্যতার প্রাচীতম জলযান নৌকা ভাসতেই থাকবে মানুষের কল্পনা আর শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-রূপকথা আর আমাদের দার্শনিকবোধ ও বিশ্বাসে। রবীন্দ্রনাথ যেমন ভাসমান নৌকার মধ্যে চলমান মানবজীবনকে দেখেছেন -

“মানুষের মধ্যে এক একটা মাঝি আছে-- তাহাদের না আছে দাঁড়, না আছে পাল, না আছে গুণ; তাহাদের না আছে বুদ্ধি, না আছে প্রবৃত্তি, না আছে অধ্যবসায়। তাহারা ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া স্রোতের জন্য অপেক্ষা করিতে থাকে। মাঝিকে জিজ্ঞাসা কর, "বাপু, বসিয়া আছ কেন?" সে উত্তর দেয়, "আজ্ঞা, এখনো জোয়ার আসে নাই।" "গুণ টানিয়া চলনা কেন?" "আজ্ঞা, সে গুণটি নাই।" "জোয়ার আসিতে আসিতে তোমার কাজ যদি ফুরাইয়া যায়?" "পাল-তুলা, দাঁড়-টানা অনেক নৌকা যাইতেছে, তাহাদের বরাত দিব।" অন্যান্য চলতি নৌকা সকল অনুগ্রহ করিয়া ইহাদিগকে কাছি দিয়া পশ্চাতে বাঁধিয়া লয়, এইরূপে এমন শতশত নৌকা পার পায়। সমাজের স্রোত নাকি একটানা, বিনাশের সমুদ্র মুখেই তাহার স্বাভাবিক গতি। উন্নতির পথে অমরতার পথে যাহাকে যাইতে হয়, তাহাকে উজান বাহিয়া যাইতে হয়। যে সকল দাঁড় ও পালবিহীন নৌকা স্রোতে গা-ভাসান দেয়, প্রায় তাহারা বিনাশ সমুদ্রে গিয়া পড়ে। সমাজের অধিকাংশ নৌকাই এইরূপ, প্রত্যহ রাম শ্যাম প্রভৃতি মাঝিগণ আনন্দে ভাবিতেছে, "যেরূপ বেগে ছুটিয়াছি, না জানি কোথায় গিয়া পৌঁছাইব।’’ একটি একটি করিয়া বিস্মৃতির সাগরে গিয়া পড়ে ও চোখের আড়াল হইয়া যায়। সমুদ্রের গর্ভে ইহাদের সমাধি, স্মরণ স্তম্ভে ইহাদের নাম লিখা থাকেনা।”



[তথ্যসূত্র – ‘ভারতকোষ’, ‘কলিকাতা দর্পন ২য় খন্ড’ – রথীন্দ্রনাথ মিত্র, ‘কলিকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ – বিনয় ঘোষ, ‘কলকাতা’ – শ্রী পান্থ]

1 comments:

0

প্রাচীন কথাঃ কৃষ্ণদেব রায়

Posted in


প্রাচীন কথা


বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন
কৃষ্ণদেব রায়



কথা দিয়েছিলাম যে আমাদের এই সিন্ধু অভিযানে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণের ফাঁকফোঁকরে পারলে আপনাদের একটু মহেঞ্জোদাড়োতে উইন্ডো শপিং-এ নিয়ে যাবো। আসুন, আজ একটা অন্য গল্প শোনাই, আর সেইসঙ্গে মহেঞ্জোদাড়োতে পাওয়া এক পুরুষ আর এক নারী মূর্তি দেখে আসি। আমার এবারের কাহিনীর প্রচ্ছদ চিত্রটা লক্ষ্য করুন দয়া করে। এক শ্যামা নারী, বয়েস খুব বেশী হলে তেরো থেকে পনেরো। তাবড় তাবড় ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকরা এটির নাম দিয়েছেন এক আদিবাসী উদ্ধত নাচুনি মেয়ে। তবে আমি এবং আমার অগ্রজপ্রতিম ভিন্নদৃষ্টির ঐতিহাসিক সুজিত আচার্য এই মূর্তিটির ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করি। একজন ইতিহাসের ছাত্রকে গাইড করে উইন্ডো শপিং এ বেরোলে আপনাদের কিছু কথা শুনতেও হবে আর বলতেও হবে। পুরু ঠোঁটের এই শ্যামাঙ্গী মহিলাকে দেখে প্রথমেই দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর এক মহিলার কথা মনে পড়ে। বিশ্ববিখ্যাত দুই পুরাতত্ত্ববিদ হান্টিংটন এবং পিগট একে যথাক্রমে দ্রাবিড়ীয় এবং বালুচি বা আদি অস্ট্রেলীয় বলে মূল্যায়ন করেছেন। প্রাচীন সভ্যতায় দলবদ্ধ নৃত্য বা যূথবদ্ধ নৃত্য ও সঙ্গীত কলার প্রচলন অবশ্যই ছিলো। কিন্তু একক নৃত্যের ধারণা তখন ছিলো কি? আর একজন নৃত্যশিল্পীর একক নৃত্য যাঁরা দেখবেন, তাঁরা নিশ্চয় শহরের অভিজাত ধনী ব্যক্তি। তাঁরা কি একজন কু-মুখশ্রী যুক্ত, থ্যাবড়া নাক, অনুন্নতস্তনা (লক্ষ্য করুন, মেয়েটির স্তন কিন্তু মোটেই প্রকট নয়), ক্ষীণজঙ্ঘা, অপুষ্ট নিতম্ব, অস্বাভাবিক দীর্ঘ বাহুদ্বয় সংবলিত কোন নারীর মোহে আবিষ্ট হবেন? আরও ভালো করে খুঁটিয়ে দেখুন, মেয়েটির এক হাতে প্রায় চব্বিশ পঁচিশটি এবং অন্য হাতে গোটা চারেক ভারী বালা পরা আছে। হাতে চব্বিশটি ভারি বালা পরলে তার হাত দিয়ে কি নাচের মুদ্রা বাহাতের চলমানতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?সোজা কথায় হাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নাচা সম্ভব? মেয়েটির গোটা শরীরে সব থেকে প্রকট এবং দৃশ্যমান তার যোনিপ্রদেশটি। কেন? আসছি সে কথায় পরে। তার আগে চলুন দেখে নিই আর একটি শীলমোহর, যেটি হরপ্পা প্রাঙ্গণ থেকে সংগৃহীত হয়েছে। 

ধর্মীয় চেতনায় ‘কাম’ এর প্রাচীনতম প্রত্ননিদর্শন হরপ্পা থেকে পাওয়া এই ৪২০ নং শীলমোহরটি। দেখতেই পাচ্ছেন প্রচ্ছদের ছবি থেকে যে এখানে মহিষের শিংয়ের শিরোভূষণ পরিহিত তিন মস্তক বিশিষ্ট এক ধ্যানমগ্ন ব্যক্তি উচ্ছৃত লিঙ্গে যোগাসনে উপবিষ্ট। আর তাঁর চতুর্দিকে বিভিন্ন হিংস্র পশুরা বিরাজ করছে। কৃষিজীবি হওয়ার আগে পর্যন্ত মানুষ ছিলো হয় শিকারী-খাদ্যসংগ্রাহক, নাহয় পশুপালক। সেই সময়ে খুব স্বাভাবিক কারণেই মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রধান অন্তরায় ছিলো এই সব হিংস্র জানোয়ারেরা। এই ভীতি থেকেই ঐসব হিংস্র পশুর হাত থেকে পরিত্রাণের আশায় তাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করতে অথবা তাদের শাসন করতে সক্ষম এমন এক দেবকল্পনার উদ্ভব হয়েছিলো সম্ভবত। যে দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তাদের জীবন ও জীবিকা নিরাপদ হবে। শিবই সেই দেবতা যিনি সমস্ত পশুদের নিয়ন্ত্রণে আর বশে রাখতে সক্ষম। আর সেই কারণেই শিবের আর এক নাম পশুপতি। পশুপালকের জীবিকা থেকে কৃষিনির্ভর জীবিকায় উত্তরণের পরে কৃষিতে যখন পশুর ব্যবহার শুরু হলো ভূমি কর্ষণের জন্যে, এবং এই কর্ষণ ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাই তাদের জীবন ও জীবিকার প্রধান ভিত্তি হয়ে দেখা দিলো, তখনই মনে হয় এই পশুপতিরূপী আদি শিবের উচ্ছৃত লিঙ্গ সংযোজিত হলো লাঙলের প্রতীক রূপে। মনে রাখতে হবে যে, লিঙ্গ, লাঙল আর লাঙ্গুল এই তিনটে শব্দই কিন্তু এসেছে সংস্কৃতের লং ধাতু থেকে। জমি বা ভূমি কর্ষণের ক্ষেত্রে লাঙলের ব্যবহার আর সন্তান সৃষ্টিতে স্ত্রী-যোনিতে লিঙ্গের ব্যবহারকে একই প্রতীক কল্পনায় আনা হলো। অবশ্য এটা স্বীকার করতেই হবে যে, যতদিন না হরপ্পা লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হচ্ছে, ততদিন সিন্ধু প্রান্তরের এই মূর্তিটি কোনও সর্বজনগ্রাহ্য স্বীকৃতি পাবেনা শিব কিংবা অন্য দেবতা হিসাবে। এটিই আদি শিবমূর্তি কিনা এ ব্যাপারে প্রত্নতাত্ত্বিক মতপার্থক্য থাকলেও এ ব্যাপারে পোশেলের বক্তব্যটি আমাদের জানা দরকার। পোশেলের বক্তব্য বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়, “মূর্তিটির ভঙ্গী, হাবভাব এবং পরিধান এসবগুলো মিলেই ইঙ্গিত দেয় যে ৪২০ শীলমোহরটির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মূর্তিটি কোনও একজন দেবতার। এই দেব কল্পনার কৃষ্টিমূলক প্রসঙ্গগুলির বিচারে এই মহিষের শিং-এর শিরোভূষণটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ… মূর্তিটির রূপটি আমাকে একটি অপ্রতিরোধ্য সিদ্ধান্তে আসতে প্রণোদিত করে যে এটি একটি দেবমূর্তি, কারণ একে দেখতে একজন দেবতার মতনই।’’ 

এই মহিষের শিং নিয়ে দেবকল্পনার প্রাচীনত্ব ও ব্যাপ্তি সম্পর্কেও পোশেলের বক্তব্যটি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। বঙ্গানুবাদে, “প্রাচীন ভারতে, অন্তত খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের পুরাণগুলির সমসাময়িক কালে, মহিষ পূজার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এটি দক্ষিণভারতে, যেখানে দ্রাবিড় ভাষাসমূহ প্রচলিত, সেখানে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।” শিবের এই বিতর্কিত মূর্তিটি ছাড়া তর্কাতীতভাবে শিবলিঙ্গ সমন্বিত শিব পূজাকে সূচিত করে এইরকম বেশ কয়েকটি শীলমোহরের চিত্রগুলি সম্পর্কে বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক আলচিন দম্পতি তাঁদের গ্রন্থে এই আলোকচিত্র গুলি পরিবেশন করেছেন। এটা নিয়ে আলোচনার শেষে তাঁরা বলছেন, “অধিকন্তু, শিবের লিঙ্গ প্রতীকের মতন অবিকল প্রস্তরখণ্ড শহরগুলি থেকে পাওয়া গেছে।” আলোকচিত্রটিতে প্রস্তর লিঙ্গকে স্থাপন করার উপযুক্ত দুটি গোলাকৃতি বেদীও রয়েছে। মনশ্চক্ষে যদি লিঙ্গটিকে বেদীর ওপর স্থাপন করা যায়, তাহলে যে ছবিটা পাওয়া যায়, বর্তমান কালেও যোনিবেষ্টনী রহিত শিবলিঙ্গের যে অবস্থান দেখতে পাওয়া যায়, তার সঙ্গে এটির কোনও ফারাক নেই। সুতরাং এমন প্রস্তাবনা করা যেতেই পারে যে হরপ্পা প্রাঙ্গণে আবিষ্কৃত এই শিলমোহরেই আদি শিবের প্রতিমূর্তি দেখা যায়।

ফিরে আসি সেই নগ্নিকা ব্রোঞ্জ মূর্তিটির কথায়, যাকে পুরাতত্ত্ববিদেরা উদ্ধত আদিবাসী নাচুনি মেয়ে বলেছেন। ১০.৮ সেমি উচ্চতা বিশিষ্ট এই নগ্ন নারীমূর্তিটিও পুরাতত্ত্ববিদদের এক বিতর্কিত বিষয়। আগেই বলেছি, যেহেতু এই মূর্তিটি এককভাবে একটি নগ্নিকা নারী মূর্তি, তাই একে নাচিয়ে মেয়ে বললে সে যুগে একক নৃত্যকলার প্রচলন ছিলো বলে ধরে নেওয়া হয়। তর্কের খাতিরে যদি সেটা মেনেও নি, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায় যে এর কু-মুখশ্রীযুক্ত, থ্যাবড়া নাক, অবিন্যস্ত কেশবিন্যাস, গাত্রালঙ্কার, দাঁড়াবার ভঙ্গী, হাত দুটির অবস্থান এবং গ্রীবাভঙ্গী—এর কোনোটাই কিন্তু এক একক নৃত্য পরিবেশনকারীর সঙ্গে খাপ খায়না। মার্শাল যদিও একে এক আদিবাসী উদ্ধত নাচুনী বলে চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু পোশেল বলেছেন, “এই ছোট্টো মূর্তিটি প্রকৃতই একজন নর্তকীকে প্রতিফলিত করে কিনা সে সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে।” এই নগ্নিকা মূর্তিটি ১৯২৬-২৭ সালে খনন কার্যের সময়ে সাহনী কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছিলো। ১৯৩০-৩১ সালে মহেঞ্জোদাড়ো থেকেই খনন কার্যের সময় ম্যাকে প্রায় অনুরূপ আর একটি নগ্নিকা মূর্তি আবিস্কার করেন। তৃতীয় মূর্তিটি আবিষ্কৃত হয় মাত্র ২০০৪-০৫ সালে ভিরানা (Bhirrana) নামক স্থানে, যেটি মহেঞ্জোদাড়ো থেকে কয়েক শত কিলোমিটার দূরে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার একটি খনকার্যের সময় একটি ভারি লাল ভগ্ন মৃৎপাত্রের ওপর খোদিত অবস্থায় মূর্তিটি পাওয়া যায়। এটিও মহেঞ্জোদাড়ো প্রাঙ্গণ থেকে প্রাপ্ত দুটি ব্রোঞ্জ নগ্নিকা মূর্তির অনুরূপ (ফ্রন্টলাইন পত্রিকা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০০৮ সংখ্যা)। পোশেল যেহেতু বলেছেন যে, এই ছোট্ট মূর্তিটি প্রকৃতই এক নর্তকীর কিনা সে সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে এবং বাস্তবসম্মত ভাবে যেহেতু হাতে ২৪/২৫ টি ভারী বালা পরে নৃত্য পরিবেশনায় হস্ত সঞ্চালন অসম্ভব, তাই আসুন এই মূর্তিটি ঠিক কি হতে পারে সে বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক। 

এটি আর যাই হোক, সন্তান প্রতিপালিকা কোন মাতৃমূর্তি নয়। কারণ, সন্তান প্রতিপালনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে অফুরন্ত দুধের ভাণ্ডরূপী সুবিশাল স্তন। সন্তান প্রতিপালক মাতৃমূর্তি তাই বিশ্বের সমস্ত স্থানেই অনিবার্যভাবে স্ফীতবক্ষা। কিন্তু এটির স্তন মোটেই সু-উন্নত নয়। এই মূর্তিটির যে অংশটা সবথেকে বেশী প্রতীয়মান এবং প্রকট, সেটি হলো মূর্তিটির যোনিদেশ বা কামাঙ্গ। দেহের বাকি সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মধ্যে এটিই সবথেকে স্ফীত, সুবিস্তৃত, ভগরেখা প্রায় নাভিমূল পর্যন্ত বিস্তৃত এবং কামাঙ্গটি বিশেষ ভাবে উদ্ধত। কেন জানিনা, দেশী বিদেশী কোনও পুরাতাত্ত্বিক বা প্রত্নতাত্ত্বিকের নজর এদিকে পড়েনি। এই ব্যাপারে আমাদের, মানে আমার আর আমার শিক্ষকসম অগ্রজবান্ধব ঐতিহাসিক সুজিত আচার্যের বিশ্লেষণটা শোনানোর আগে, অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্যের উল্লেখ করছি। “দেবীর সমস্ত অঙ্গের মধ্যে জননাঙ্গকে প্রধানতম বলে বিচার করা হয়েছে বলেই তাঁর নাম ভগবতী।” এর পর বেদে ঐশ্বর্যের দাতা হিসাবে ভগ নামক দেবতার উল্লেখ করে তাঁর জিজ্ঞাসা, “…আদিতে যে নাম ঐশ্বর্যবাচক, সেই নামই নারী-জননাঙ্গ বাচক হয়ে দাঁড়াল কি ভাবে?” উত্তরে আবার তিনিই বলেছেন, “সম্ভবত নারীর জননাঙ্গকেই পার্থিব ঐশ্বর্যের উৎস মনে করা হত, তাই।” (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ঃ লোকায়ত দর্শন, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৬৮-৬৯)। আমাদের আলোচ্য এই স্ফীতযোনি, নগ্নিকা সিন্ধু সভ্যতার ফসল আর ‘ভগ’-এর উৎস বেদের চেয়ে অনেক প্রাচীন।

আলোচনার এই পরিপ্রেক্ষিতে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের চাষবাসের চিত্রটা একটু দেখে নেওয়া যাক। সিন্ধু সভ্যতার প্রথমদিকে জলসেচিত সমতলভূমিতে নানা খাদ্যশস্য ও তরিতরকারীর চাষ-আবাদ হলেও ধানের চাষ কিন্তু শুরু হয় অনেক পরে। রেডিও কার্বন নিরুপিত প্রত্ন তথ্য থেকে আমরা জানতে পারি যে খ্রীঃপূঃ দুহাজার সালের কিছু আগে থেকে সিন্ধু সভ্যতার দক্ষিণাংশে ধানচাষের প্রচলন ছিলো (বি &আর আলচিনঃ দ্য রাইজ অফ সিভিলাইজেশন ইন ইন্ডিয়া &পাকিস্তান, পৃঃ ১১৫-১১৬)। পূর্ব ভারত থেকেই ধান চাষ ক্রমশ পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ পূর্ব ভারত থেকে দুটি ধারায় ধান্যোৎপাদক মুণ্ডারী ভাষা গোষ্ঠীর লোকেরা---যারা নৃতাত্বিক বিচারে আদি অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীভুক্ত, উত্তর ও পশ্চিম ভারত অভিমুখে ক্রমব্যাপ্ত হচ্ছিল। ভারতে কৃষিবিকাশে এই আদি-অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর মুণ্ডা, কোল, সাঁওতাল প্রভৃতি ‘ব্রাত্য’ মানুষদের অবানের প্রতি ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রভাবিত তথা আর্যগর্বী ইতিহাসবেত্তারা চিরকালই চরম ঔদাসীন্য দেখিয়ে এসেছেন। মুণ্ডারী ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের এই চিরস্মরণীয় অবদানের প্রত্ন ইতিহাস “Origin of the Mundas” নামে এক বৃহৎ প্রবন্ধে সোভিয়েত প্রত্ন-তথা-ইতিহাসবেত্তা জি. এম. বনগার্ড লেভিন তুলে ধরেছেন। প্রত্নসাক্ষ্য তুলে ধরে বনগার্ড লেভিন দেখিয়েছেন, উত্তর ভারতে আর্য আগমনের বহু শত বৎসর পূর্ব থেকেই এই মুণ্ডারী ভাষা গোষ্ঠীর লোকেরা দিল্লীর নিকটবর্তী হস্তিনাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত প্রাঙ্গণে কৃষির সূত্রপাত করেছিলো। ক্রমাগ্রসরমান এই ধান্যোৎপাদক রা দক্ষিণ রাজস্থান পার হয়ে সিন্ধু সভ্যতার দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশ করে খ্রীঃপূঃ দুই সহস্রাব্দের কিছু আগে। এই সময়কালেই বর্তমান গুজরাটের লোথাল থেকে পাঞ্জাবের কালিবঙ্গানের দক্ষিণ অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত সমভূমিতে ধান চাষ হতো। মুণ্ডারী ভাষীরা সিন্ধু প্রাঙ্গনে প্রবেশের পর সেখানে প্রচলিত হলকর্ষণ নির্ভর কৃষির উপযোগিতা বুঝতে পেরে ধান্যোৎপাদনেও লাঙলের ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো বলে সঙ্গত অনুমান। এটা ঠিকই যে, কোনও হরপ্পীয় শীলমোহরে এখনও পর্যন্ত লাঙলের কোনও নিদর্শন পাওয়া যায়নি। কিন্তু তবুও কালিবঙ্গানে উদঘাটিত একটি প্রাচীন ক্ষেত্র থেকে হলকর্ষনের নিশ্চিৎ সমর্থন পাওয়া গেছে। এই হলকর্ষিত ক্ষেত্রের চিত্রটি আলচিনদ্বয়ের গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। চিত্রটিতে একদিকে লম্বালম্বি ভাবে অতি নিবিড় কর্ষন চিহ্ন; আবার সেই একই কর্ষিত জমিতে যথেষ্ট ফাঁক রেখে আগের কর্ষণ রেখার সঙ্গে সমকোণ সৃষ্টি করে আড়াআড়িভাবে কর্ষণ করা হয়েছিলো (প্রচ্ছদ চিত্র দ্রষ্টব্য)। আলচিন গ্রন্থকার দ্বয়ের মন্তব্য, “চিহ্নগুলি সংকেত দেয় যে একটি কাঠের লাঙল বা ‘অড়’ ব্যবহৃত হয়েছিলো।” স্বাভাবিকভাবেই সিন্ধুসভ্যতার অধিবাসীদের জীবনে লাঙল এক সমৃদ্ধির বার্তাবাহক। তাই লাঙলের প্রতিরূপ লিঙ্গ, যা নাকি যোনি কে কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করে বীর্যক্ষেপন দ্বারা, সেই লিঙ্গ একসময়ে পশুপতি দেবতার দেহচ্যুত হয়ে বেদীর উপর স্থাপিত হয়ে পূজিত হতে থাকে --- যে প্রতীকের পূজা আজও ভারতময় প্রচলিত।

পূর্বভারতের মুণ্ডারী ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা যখন শিকারী ও কৃষক, এই দ্বৈত ভূমিকায় বিরাজিত থেকে ক্রমশ পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, মনে হয় তখন তারা প্রতি বছরই শিকারের স্বার্থে নতুন নতুন এলাকায় উপস্থিত হত। আর চাষের মরসুমে সেই নতুন এলাকায় জঙ্গল সাফ করে সম্ভবত ঝুম পদ্ধতিতে কৃষিকাজে ব্রতী হত। ফলত প্রায় প্রতি বছরই তারা এক কুমারী মাটিতে শষ্যোৎপাদন করতো। কুমারী কেন? কারণ এর পূর্বে সেখানে আর কোনওদিন কেউ চাষ করেনি। কৃষির এই প্রাথমিক পর্যায়ে বীজ বপন ও ফসল কাটা ইত্যাদি কাজগুলি মেয়েরাই করতো বলে পণ্ডিতদের ধারণা। ফলে এই কুমারী মাটিতে কৃষির সাফল্যের প্রত্যাশায় কিছু যাদু-বিশ্বাসের উদ্ভব হওয়াটাই স্বাভাবিক। কুমারী কন্যা, যতদিন না ঋতুমতী হচ্ছে ততদিন তার যোনি লিঙ্গ কর্ষিত এবং বীর্যধারণ করলেও গর্ভবতী হতে পারতোনা। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের ধারণা হয়েছিলো যে এই কুমারি মাটিও যদি ঋতুমতী না হয় তাহলে তার গর্ভেও শষ্যোৎপাদন হবেনা। সেই বিশ্বাসেই তারা কৃষিক্ষেত্রে বীজবপনের আগে এক প্রথম রজস্বলা কিশোরীকে নগ্ন অবস্থায় ঐ কৃষিক্ষেত্রের ওপর বিচরণ করাত এই বিশ্বাসে যে এর ফলে কৃষিক্ষেত্রটিও রজস্বলা হবে এবং গর্ভে বীজ ধারণ করে সন্তান সম শষ্যোৎপাদন করবে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া একটি তথ্য থেকে আমরা জেনেছি যে বর্তমান কালেও ভীলেরা চাষের পূর্বে এই আচার অনুসরণ করে। মহেঞ্জোদাড়োতে পাওয়া ঐ অল্পবয়েসী, “যখন প্রথম ফুটেছে কলি”, প্রথম রজস্বলা কুমারীর প্রতিরূপ বলেই অনুমান। যদি আপনারা এটাকে একটা গালগল্প, গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে আমার তুনীরে কিন্তু আরো একটা অমোঘ বাণ আছে! কি সেটি? গৌহাটির কামাখ্যা মন্দিরে কামাক্ষী দেবীকে ঘিরে প্রায় অবিকল এই প্রথা আজও প্রচলিত। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে অম্বুবাচির দিনগুলিতে কামেশ্বর শিবের পত্নী কামাক্ষীদেবীও ঋতুমতী হন। ধরিত্রীও ঋতুমতী হয়। এই সময়ে তিনদিন কামাখ্যা মন্দিরের ফটক বন্ধ থাকে আর পাশের নালা দিয়ে অবিরত বয়ে যায় লাল রঙের তরল। আর আশে পাশের তো বটেই এমন কি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেও কৃষিজীবি নারী পুরুষেরা কেউ কলসী, কেউ বোতলে ভরে এই জল সংগ্রহ করে নিয়ে যান বীজ বপনের আগে মাটিতে ছেটাবার জন্যে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে অম্বুবাচীর দিনগুলিতে কামেশ্বর শিবের পত্নী কামাক্ষীদেবীও ঋতুমতী থাকেন; ধরিত্রীও ঋতুমতী হয়। আর অম্বুবাচীর পরেই প্রস্তুত জমিতে বীজ বপনের ধর্মীয় বিধান রয়েছে। এছাড়াও, পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এখনও প্রচলিত রীতি হলো নতুন শস্যের জন্য বীজ বপনের আগে ক্ষেত সংলগ্ন একটি পাথরে লাল রঙ লাগিয়ে দেওয়া হয়, রজস্বলা নারীর প্রতীক হিসেবে। স্পষ্টতই বোঝা যায় একটিপ্রাচীন যাদু বিশ্বাস কিভাবে ধর্মীয় প্রথায় রূপান্তরিত হয়েছে।

আর একটা কথা। ব্রোঞ্জের নগ্নিকা মূর্তিটির বাঁ হাতের তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে একটি বৃত্ত রচিত হয়েছে। প্রত্নবিদ পিগটের অনুমান যে সেই বৃত্তে একটা ছোটো লাঠি ছিলো। কিন্তু লাঠি না হয়ে এই শষ্যের কর্ত্রীর বা দেবীর হাতে একগুচ্ছি ধানের শীষ বসিয়ে দিলে কেমন হয়? তবে মনে রাখতে হবে যে লিঙ্গ ও যোনীর এই কল্পনা কিন্তু কামাবেগ প্রসূত নয়। বরং শষ্যোৎপাদনে সমৃদ্ধির কামনা প্রসুত। উচ্ছৃত লিঙ্গ ৪২০ নং শিলমোহরটি যদি আদি শিব এর প্রতিমূর্তি হয়, তাহলে নগ্ন, শিরোভূষণ বিহীন এই মূর্তিটিকেও আদি কালী হিসেবে ধরাই যেতো। কারণ দেবীদের মধ্যে একমাত্র কালীই নগ্নিকা এবং শিরোভূষণহীনা। তদুপরি, মূর্তিটির দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা আমাদের বামা কালী বা দক্ষিনা কালীর কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু, না। আমি আপাতত একে কালী না বলে এক রজস্বলা কুমারী মেয়েই বলতে চাই। অন্তত যতদিন না হরপ্পা লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়। 



(চলবে )

0 comments:

0

প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রাচীন কথা 



উত্তরাপথের পথে
সৌরেন চট্টোপাধ্যায়



= অষ্টম পর্ব =



দ্রুত ধাবমান অশ্বপৃষ্ঠে মালতির যন্ত্রনায় কাতর সুকোমল শরীরটি বৃক্ষচ্যূত লতিকার মত অর্ধচেতন অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার হাতদুটি পিছন দিকে ঘুরিয়ে বাঁধা, মুখ এবং চোখও একটা অত্যন্ত দুর্গন্ধ গাত্রমার্জনী দিয়ে ঢাকা। এমতাবস্থায়ও সে বুঝতে পারছে, এই অশ্বারোহী একা নয়, একাধিক অশ্ব পাশাপাশি ও সামনে-পিছনে ছুটে চলেছে একই গতিতে। ঘোড়সওয়ারদের বিজয়-উল্লাস এবং অশ্বখুরধ্বনির সঙ্গে আরও কয়েকটি নারীকন্ঠের তীব্র আর্তনাদ অস্পষ্ট ভাবে তার কানে আসছে। সে বুঝতে পারল, তার মত আরো কয়েকজনমেয়েকেএই দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে নিয়ে চলেছে; কিন্তু কোথায় যে এই দুঃসহ যন্ত্রনাময় পথের শেষ, সে জানে না। তাদের অনেকটা পিছনে অশ্বের গতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া দুষ্কর জেনেও দুই অনার্য যুবক বিধু ও বিহান তিলার্ধও না থেমে প্রাণপণে দৌড়ে চলেছে।



রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট কয়েকটি কৃষকপল্লীর মাঝখান দিয়ে মেঠো পথের ধূলি উড়িয়ে ছুটে চলেছে সামন্তরাজা দুর্জয়ের ঘোড়সওয়ারেরা, ঘোড়াগুলির পিঠে চারটি অসহায় বন্দিনীর যন্ত্রনাকাতর আর্তস্বর ও অশ্বখুরধ্বনি শুনে কর্মরত পল্লীর নারীপুরুষেরা শুধু মুখ তুলে চেয়েছে মাত্র, তাদের মনে বিন্দুমাত্র কৌতূহলের উদ্রেক হয় নি, এমন দৃশ্য তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। পুরুষানুক্রমে আজন্ম ধনিকশ্রেণীর হাতে নির্বিচারে শোষিত ও লাঞ্ছিত হওয়ার জন্যই যে তাদের জন্ম, একথা কে না জানে! রাজা ও সামন্তদের বিকৃত ভোগ-লালসার বলি হওয়াই যেরূপলাবণ্যবতী হতভাগিনী মেয়েগুলির ললাট-লিখন!



দেশের রাজা থাকেন অনেক দূরবর্তী তাঁর রাজধানী-নগরে। তাঁরা শুধু তাঁদেরঅধীনস্থ সামন্তপ্রভুদের কাছ থেকে সংগৃহীত করের অর্থ সম্পদ ও উপঢৌকন পেয়ে এবং ভোগ-লালসায় দিনযাপন করেই তাঁদের রাজধর্ম পালন করেন। রাজার প্রাপ্য দিতে এবং নিজেদের ভোগতৃষ্ণা মেটাতে সামন্ত-জমিদাররা নিরীহ প্রজাদের যথেচ্ছভাবে শাসন, শোষণ ও সম্ভোগ করে চলে। ধনিক উচ্চবর্ণ শ্রেণী-শাসিত এই সমাজে দরিদ্ররা উপেক্ষিত হলেও রূপসী মেয়েদের বিশেষ কদর। তাদের যৌবনবতী শরীর জাত-পাত, ধনী-দরিদ্রের শত প্রভেদ সত্ত্বেও নির্বিচারে ভোগ্যবস্তু হতে কোনও বাধাই নেই। 



গ্রামাঞ্চলের মানুষ রাজার কাছে তাদের অভাব অভিযোগ জানানো তো দূরের কথা,তাঁর সাক্ষাৎ বা সান্নিধ্যলাভের কোনও সুযোগ পেতো না। প্রজারা বংশপরম্পরায় শুধু রাজার নাম ও ঐশ্বর্য-সম্পদের সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে কাহিনী শুনে যায়। এই ভাবেই যুগ যুগ ধরে রাজ-রাজড়াদের সঙ্গে কাল্পনিক কোনও এক স্বর্গলোকের দেব-দেবীদের সম্পর্ক মিশিয়ে বিচিত্র সব অলীক যশ-কীর্তি-বীরত্বের গল্প-গাথা লোকমুখে প্রচারিত হয়ে নানা অলৌকিক পৌরাণিক কাহিনীর জন্ম দেয়।

কয়েকটি পরগণার একজন সামন্ত-জমিদারের অধিকারে প্রীতিকূটের মত স্বয়ংসম্পূর্ণ সচ্ছল গ্রাম যেমন আছে, তেমনি অতি সাধারণ কৃষকপল্লীও আছে। গ্রামগুলিতে সব বর্ণ ও পেশার মানুষের বাস, তবে গ্রামে ধনীর সংখ্যা মুষ্টিমেয়, হতদরিদ্র কৃষক এবংশ্রমজীবি মানুষের সংখ্যাই বেশী। জনপদের সীমান্তে অনার্য অধ্যুষিত অরণ্য অঞ্চল।অনার্যরা বেশির ভাগই শিকার ও পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ ভাগ্যান্বেষণে বা বাধ্য হয়ে জনপদবাসীদের সংস্পর্শে এসে কায়িক শ্রমের বিনিময়ে শূদ্রের জীবিকা পালন করে। সেই সব অনার্য ও শূদ্রদের রূপবতী কন্যারা অনেক ক্ষেত্রে অভিজাত উচ্চবর্ণের পুরুষদের সঙ্গে প্রণয়ঘটিত দৌর্বল্যে বা ধর্ষণের ফলে জারজ সংকর-শিশুর জন্ম হয়, সেই সব শিশুরা বড় হয়ে পিতৃনামহীন শ্রমিক রূপে উচ্চবর্ণের সেবা পরিচর্যা করে অথবা ক্রীতদাস-দাসীরূপে অন্যত্র বিক্রি হয়ে যায়। 



দুর্জয় নিজেকে রাজা বললেও আসলে সে একজন ক্ষুদ্র সামন্ত-জমিদার, তার অধীনে দুটি পরগণার দেড়শতর মত গ্রামের আবালবৃদ্ধ নরনারীর সে-ই হর্তাকর্তা বিধাতা। প্রীতিকূট থেকে প্রায় পাঁচ ক্রোশ দূরে দুইশত বিঘা পরিমাণ জায়গায় তার সামন্তনিবাসটি একটি বিরাট খামার-বাড়ির সদৃশ।



খামারবাড়ির মধ্যস্থলে তিন-মানুষ সমান প্রাচীর বেষ্টিত অনেকটা স্থান জুড়ে ইষ্টক-প্রস্তর নির্মিত ও চুন এবং বালুকার প্রলেপ দেওয়া একটি সুরম্য ও বৃহৎ ত্রিতলপ্রাসাদের একদিকে অনেকগুলি দুই বা তিন কক্ষবিশিষ্ট ছোট-বড় গৃহ। নীচের জমি থেকে অনেকটা উপরে গৃহগুলির দাওয়া অবধি পাথরের সোপান নেমে এসেছে, মাঝে সংকীর্ণ লালমাটির পথ। অপেক্ষাকৃত বড়গুলি দুর্জয়ের রক্ষিতাদের বাসস্থান, ছোটগুলির একাংশে ভৃত্য-দাসী ও ক্রীতদাসরা থাকে, অপর অংশে ভ্রাম্যমান সাধু, শ্রমণ ও অনাহূত-রবাহূত অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট। অন্যদিকে সারিবদ্ধ ভাবে অশ্ব ও হস্তিশালা এবং পানীয় জলের কয়েকটি কূপ। প্রাসাদের বাইরে একটি বিশাল দীর্ঘিকা, তার চতুষ্কোণে চারটি শ্বেতমর্মর-নির্মিত ঘাটের পাশে ভগবান পুরারাতির চারটি ছোট মন্দির।প্রাসাদ সংলগ্ন ঘাটটি কেবলমাত্র রাজবাড়ির বাসিন্দারাই ব্যবহার করে। অন্যগুলি প্রায় অব্যবহৃতই পড়ে থাকে।



প্রাসাদের ঠিক সম্মুখে চত্বরের উপর একটি বাঁধানো উঁচু বেদী। এখানে বসে দুর্জয় সামন্ত তার রাজকার্য চালায়। তার রাজকার্য বলতে কোনও বিবাদের মীমাংসা, অবাধ্য প্রজাদের শাস্তিদান আর বিশেষ করে রাজকোষে আরও ধনাগমের জন্য বেতনভুক বশংবদ নায়েক ও সৈনিকদের নিজের অধিকৃত বা পার্শ্ববর্তী কোনও দুর্বল পরগণার কোনও জনপদ লুন্ঠনের আদেশ দেওয়া ও কর-আদায়কারিদের আরও নির্মম হওয়ার নির্দেশ দেওয়া।



বিধু ও বিহান, দুই অনার্য যুবক অশ্বের পিছনে ছুটতে ছুটতে যখন ধূমলপ্রদেশে দুর্জয়ের প্রাসাদের কাছে পৌঁছালো, তখন সন্ধ্যা হতে কিছুটা দেরি আছে।প্রাসাদের সিংহদ্বারে মুক্ত কৃপাণ হাতে অন্তত দশ জন ভীষণ-দর্শন প্রহরী প্রহরায় নিযুক্ত, তাদের চোখ এড়িয়ে একটি মক্ষিকাও ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে না।



এতটা পথ অবিশ্রান্তে ছুটে এসে বিধু ও বিহান স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত। প্রাসাদ-প্রাচীরের বাহিরে ও ভিতরে বিভিন্ন ধরণের প্রচুর গাছ থাকায় দূর থেকে স্থানটিকে একটি ছায়াচ্ছন্ন বনভূমি বলে ভ্রম হয়। অনার্য যুবকদ্বয় এমন জায়গায় আগে কখনও আসেনি, পথঘাট সম্পূর্ণ অপরিচিত। আপাতত প্রথমে কিছু খাদ্য ও পানীয়ের খুবই প্রয়োজন, তারপর সামনের প্রচণ্ড শীতের রাত্রিতে মাথা গোঁজার জন্য একটু ঠাঁই চাই। কিন্তু কি করবে, কোথায় যাবে, কিছুই ভেবে উঠতে পারছে না। প্রাসাদের লৌহ-নির্মিত বিশাল সিংহদ্বার হয়তো সন্ধ্যার পরেই বন্ধ হয়ে যাবে, আর সম্ভবত কাল সকালের আগে খুলবে না, আর ওই তিন মানুষ সমান প্রাচীরই বা কি করে লঙ্ঘন করা যায়!



সামন্তরাজার সৈন্যদের গ্রামের চারটি মেয়েকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে আসতে দেখে তাদের যৌবন রক্ত স্থির থাকতে পারেনি, অথচ ওই যুবতীদের সঙ্গে তাদের বিশেষকোনও পরিচয়ও নেই, কোনওদিন তাদের সঙ্গে বিশেষ বাক্যালাপও হয়নি। একটা অসম্ভব জেদ আর ঝোঁকের বশে তারা ঘোড়সওয়ারদের অনুসরণ করে এতদূর ছুটে এসেছে। যদিও ‘ভয়’ শব্দটি এই দুই যুবকের অভিধানে নেই, তবুও এভাবে নিঃসম্বল ও নিরস্ত্র অবস্থায় এখানে আসা যে বিষম অবিমৃশ্যকারিতা হয়েছে, তা এখন ভালই উপলব্ধি হচ্ছে। কিন্তু এতদূর এসে শেষ পর্যন্ত উদ্ধারের চেষ্টা না করে ফিরে যেতেও মন চাইছে না।



প্রাসাদের প্রাচীর ঘুরে দীর্ঘিকার দূরপ্রান্তের ঘাটের সোপানে বসে দুই বন্ধু নিজেদের মধ্যে এই সব নানা আলোচনা করছে, এমন সময় পিছনে মন্দিরের পাশ থেকে শুষ্ক পত্রমর্মর ধ্বনি শুনে দুজনেই সচকিত হয়ে পিছনে ফিরে তাকালো। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় একজন বৃদ্ধ মানুষের অবয়ব, যষ্টিতে ভর দিয়ে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন।পরণে ধুতি, উর্দ্ধাঙ্গে কর্পট ও একটি ধূসর কম্বল। তাঁর তাম্রাভগাত্রবর্ণ, শুভ্র চামরের ন্যায় প্রলম্বিত কেশ ও শ্মশ্রু সমন্বিত চেহারা ও পোশাক দেখে অনুমান হয় তিনি কোনও রাজপুরুষ বা অভিজাত শ্রেনীর মানুষ নন, নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ। তিনি যে কখন নিঃশব্দে এসে পিছনে দাঁড়িয়েছেন, তারা বুঝতে পারেনি। ওরা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে প্রণাম জানালে বৃদ্ধ হাতের ইশারায় বারণ করে নিজেই তাদের পাশে বসে সহৃদয় কন্ঠে বললেন, ‘‘তোমাদের কথা শুনে বুঝেছি তোমরা অনেক দূর পথ অতিক্রম করে এসেছো, এবং ক্ষুধার্ত।তোমরা কে? এখানে কেন এসেছো? আর এই শীতের সন্ধ্যায় এখানেই বা কি করছ?’’



‘‘আমরা অতি সামান্য মানুষ প্রভু,’’বিহান সবিনয়ে বলল, ‘‘প্রীতিকূট গ্রামের নাম শুনেছেন আপনি? সেই গ্রামের গোপালক আমরা।’’



‘‘কি নাম বললে? প্রীতিকূট!!’’ বৃদ্ধ যেন নামটা শুনে একটু চমকে উঠলেন, বিড়বিড় করে কয়েকবার নামটা মন্ত্রের মত জপ করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘গো-বাথান উৎসব হয়ে গিয়েছে তোমাদের?’’



‘‘আপনি জানেন আমাদের গো-বাথান মোচ্ছবের কথা?’’বিধু অবাক হয়ে শুধালো।



‘‘হ্যাঁ জানি, খুব ভালো করেই জানি,’’বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, একটু থেমে বললেন, ‘‘এক সময় আমার ওখানেই বাড়ি ছিল, সে অনেক কাল আগের কথা। সে সব কথা পরে হবে।তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত; আর তোমরা যে বিনা কারণে প্রীতিকূট থেকে ধূমলে আসোনি, সেটাও বুঝেছি।পরে তোমাদের কথাও শুনবো সব, এখন এসো আমার সঙ্গে।’’বলতে বলতে যষ্টিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ মানুষটি।



বিধু ও বিহান প্রৌঢ়ের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সামন্তরাজার প্রাসাদ থেকে অনেকটা দূরে বেশ জমজমাট জনবসতি এলাকায় এসে পৌঁছালো। চারিদিকে ইষ্টক-প্রস্তর-নির্মিত ছোট-বড় অট্টালিকা, পরিচ্ছন্ন পথঘাট, পথের পাশে পাশে প্রপা, মাঝে মাঝে ছোট ছোট চবুতরে বিভিন্ন দ্রব্য-সজ্জিত বিপণি, মদিরালয়, রণ্ডাগৃহ, এবং অশ্ব ও গো-শকট রাখার স্থান।

সঙ্গী মানুষটি জানালেন, এই জায়গাটিতে বেশীরভাগই অবস্থাপন্ন ধনী বৈশ্য ও অভিজাত ক্ষত্রিয়দের বাস; আরো কিছুটা দূরে মধ্যবিত্ত ও শূদ্রশ্রেণীর মানুষের পল্লী এবং জনপদের সীমান্তে পাহাড়ি অরণ্য অঞ্চলে অনার্যদের বাসভূমি। কথা বলতে বলতে বৃদ্ধ যুবকদের নিয়ে একটি মিষ্টান্ন বিপণির সামনে দাঁড়ালেন। বিপণিটিতে বড় বড় কটাহে ও বারকোশে নানা ধরণের মিষ্টদ্রব্য সজ্জিত রয়েছে। বৃদ্ধের নির্দেশে পশারিপিটক ও সর্জবৃক্ষের পত্রে তাদের নানা রসনাতৃপ্তিকর খাদ্য পরিবেশন করতেই ক্ষুধার্ত যুবকেরা দ্বিরুক্তি না করে সেগুলি গোগ্রাসে উদরস্থ করল।এমন সুখাদ্য তারা জীবনে কখনও খায়নি। ভোজন সাঙ্গ হলে বিক্রেতাকে মূল্য দিয়ে বৃদ্ধ আবার তাদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর গিয়ে একটি সাধারণ গ্রাম্য-পল্লীতে উপস্থিত হলেন।



ইতিমধ্যে শীতঋতুর অল্পস্থায়ী দিনের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে, পথের দুপাশে গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে ইতস্তত ছড়ানো মৃন্ময় গৃহগুলিতে সন্ধ্যাদীপ জ্বলে উঠেছে, পথ প্রায় জনশূন্য। অবশেষে পল্লীর শেষ প্রান্তে এসে বৃদ্ধ একটি কপাটবিহীন মৃন্ময় গৃহের সামনে থামলেন।



আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ জ্যোৎস্না ছড়িয়ে উদিত হচ্ছে। বৃক্ষপত্রের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে ভূমিতে অদ্ভুত নকশা অঙ্কিত করেছে। পাশাপাশি দুটি কক্ষবিশিষ্ট গৃহটি চারিদিকে নীচু প্রাচীরবেষ্টিত, মধ্যস্থলে একটি ছোট অঙ্গন, দু-চারটি গাছ ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। অঙ্গনটি গাছের শুষ্ক পত্র ও ধূলায় পূর্ণ, গৃহে কোন দেবমন্দির, এমনকি তুলসীমঞ্চও নেই। সর্বত্র অমার্জিত ও অপরিচ্ছন্নতার ছাপ; কোন রমণীর কল্যাণময়ী হস্ত যে এস্থান স্পর্শ করে না, তা সুনিশ্চিত। পথশ্রান্ত বিধু আর বিহান ধুলিময় দাওয়ায় শরীর এলিয়ে ক্লান্তিতে চোখ বুজলো। বৃদ্ধ ওদের দিকে মায়াময় দৃষ্টিতে ক্ষণকাল চেয়ে থেকে মৃদু হাসলেন।

************ 



একটি একটি করে কুসুমকলি ফুটে উঠছে, সপ্তাশ্ববাহিত রথে দিনাধিপতির আকাশ পরিক্রমার শেষ-পথে সেই নামগোত্রহীন কলিরা তাদের রূপ-রস-গন্ধ অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে একসময় ঝরে পড়ে পরমাকাঙ্খিত ধরিত্রীর স্নেহময়ী অঞ্চলে। স্মৃতির মুকুর তাদের প্রতিবিম্ব ধরে রাখে না। নিত্য নূতন বিচিত্র ছবির মাঝে বিস্মৃতির অনন্ত সাগরে বুদবুদের মতই তারা ক্ষণকালের জন্য প্রতিভাত হয়, আবার মিলিয়ে যায়। জীবন থেমে থাকে না, সতত প্রবাহিনীর মতই সে মোহপাশমুক্ত; তার ফেলে আসা স্রোতপথের সমস্ত আনন্দ-বেদনার অসংখ্য মুহূর্তগুলিকে সে আপন তরঙ্গে ভাসিয়ে আপন গতিতে কালরূপ সাগরের অভিমুখে চির-বহমান।



নিত্যপ্রথামত অতি প্রত্যুষেই শয্যা ত্যাগ করে আচার্য চিত্রভানু পুত্র বাণকে সঙ্গে নিয়ে তমসা নদীর তীর ধরে অনেক দূর পর্যন্ত পাদচারণা শেষ করে এক জায়গায় প্রস্তরাসনে উপবিষ্ট হলেন।

প্রস্ফুটিত জবাকুসুমনিভ ভগবান বিবস্বান অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছেন আলোক ও উত্তাপ, কেটে যাচ্ছে হিমেল রাত্রির শৈত্য-প্রকোপ, ভোরের ঘন কুয়াশার যবনিকা সরে গিয়ে ধীরে ধীরে অনেক দূরের ধূসরবর্ণা নাতিউচ্চ পর্বতশ্রেণী আর ঘন হরিৎ বর্ণের বনভূমির দিগন্তুরেখা দৃশ্যমান হচ্ছে। বিশ্বচরাচরের সুগম্ভীর সুর ধারায় আপ্লুত হয়ে এক অপার্থিব ভাব-জগতে বিচরণ করতে করতে আত্মসমাহিত আচার্যদেব ভাবগম্ভীর স্বরে উপনিষদের মহতী শ্লোকের আবৃত্তি করলেন। 

উর্ধ্বমূলোহবাকশাখ এষোহশ্বত্থঃ সনাতনঃ।

তদেব শুক্রং তদব্রহ্ম তদেবামৃতমুচ্যতে।

তস্মিল্লোকাঃ শ্রিতাঃ সর্বে তদু নাত্যোতি কশচন। এতদ্বৈ তৎ।। (কঠোপনিষদ) 

এই যে সংসার-বৃক্ষ, ইহা অশ্বত্থের ন্যায় অচিরস্থায়ী, সর্বোচ্চ ব্রহ্মরূপ মূল হইতে ইহার উদ্ভব, ইহার শাখাগুলি গীবাদিরূপে নিম্নদিকে বিস্তৃত, ইহা সনাতন, অর্থাৎ প্রবাহক্রমে নিত্য। এই সংসার-বৃক্ষের যিনি মূল, তিনিই ব্রহ্ম --- তিনি শুদ্ধ, তিনিই অমৃত বলিয়া কথিত। তাঁহাতেই পৃথিবী সহ সমস্ত লোক আশ্রিত আছে, কেহই তাঁহাকে অতিক্রম করিতে পারে না। ইনিই সেই (আত্মা)।

বাণ তন্ময় হয়ে ব্রহ্মজ্ঞানী পিতার আবৃত্তি ও ব্যাখ্যা শুনে পরম প্রীতি লাভ করলো। তারপর তমসার স্নিগ্ধ-শীতল জলে অবগাহন করে পিতা-পুত্র গৃহে প্রত্যাগমণ করলেন। 



প্রীতিকূটের মধ্যস্থিত ব্রাহ্মণাধিবাসে প্রীতিকূটের সর্বজনশ্রদ্ধেয় আচার্য চিত্রভানুর নিবিড় ছায়াচ্ছন্ন ও শান্তিময় আশ্রমসদৃশ গৃহ। গৃহ-সম্মুখস্ত প্রশস্ত-কংকরসমাচ্ছন্ন রাঙা মাটির পথটির অন্যদিকে স্বর্ণাভ পক্কশস্যের ভারে আনমিত বিস্তীর্ণ গোধূম ক্ষেত্রে সৈরিকগণ কর্মব্যস্ত, পাশের স্বচ্ছ জলের তড়াগ থেকে ব্রাহ্মণাধিবাসের কূলবধুরা মৃন্ময় কলস ভরে জল নিয়ে যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে সবই স্বাভাবিক মনে হলেও আনন্দময় ও কর্মচঞ্চল প্রীতিকূট এখন গভীর বিষাদে নিমগ্ন। গো-বাথান উৎসবের সেই ভয়ংকর ঘটনায় সমস্ত জনপদের মানুষ ভয়ার্তচিত্তে দিনযাপন করছে।



আচার্যের গৃহপ্রাঙ্গণের একদিকে একটি ছোট আটচালায় আচার্যের চতুষ্পাঠী, অন্যদিকে পাশাপাশি দুটি শয়নকক্ষের মধ্য দিয়ে যে সঙ্কীর্ণ পথটি বাটীর পিছনের দিকে চলে গিয়েছে, সেখানে অনেকখানি জায়গা জুড়ে নানা বৃক্ষের সমারোহে বড় বাগিচাটি নিয়মিত পরিচর্যায় বেশ পরিচ্ছন্ন। আচার্য চিত্রভানু ধীর পদবিক্ষেপে গোময়লিপ্ত পরিচ্ছন্ন প্রাঙ্গণের এক কোণে বৃক্ষতলের প্রস্তর ও মৃত্তিকা-নির্মিত বেদীতে তাঁর প্রিয় আসনটিতে এসে বসলেন। সাধারণত স্থিতপ্রজ্ঞ ভট্টদেবের মনে জাগতিক চিন্তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, কিন্তু আজ তাঁর চিত্ত বড়ই বিক্ষিপ্ত। 



আচার্যদেব বংশপরম্পরায় ও স্বোপার্জিত প্রচুর ভূসম্পত্তির অধিকারী হওয়ায় তাঁর সংসার সচ্ছল হলেও তা ছিল নিতান্তই আড়ম্বরহীন। বহুশ্রুত ঋষিবংশে চিরদিনই ছিল বিদ্যার মর্যাদা এবং আলোচিত হত নানা বিদ্যা প্রসঙ্গ। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবেশে তাঁর প্রিয় পুত্র বাণের স্বভাব-চরিত্র অন্য সাধারণ কিশোরদের মত বস্তুবাদী না হয়ে জ্ঞান এবং ভাব জগতের মানুষরূপে প্রতিভাত হয়ে উঠেছিল, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার মেধা ও প্রতিভা।



স্বাধীনচেতা বাণ নিজেকে মেলে ধরতে চায় প্রকৃতির অসীম অঙ্গন মাঝে। নিজের মনে রচনা করে সুললিত কাব্য-আলেখ্য। এই সব সময়ে সে যেন সামান্য এক কিশোর নয়, এক ভাবগম্ভীর কবি! আর হবে নাই বা কেন! মহর্ষি বাৎস্যায়নের শোনিতধারা বহে চলেছে তার ধমনিতে, তার সঙ্গে মিশেছে ঋষিপ্রতিম পিতা চিত্রভানুর অসীম জ্ঞানের ঐশ্বর্যরাশি! পিতা অন্যান্য বটুকদের সঙ্গে তাকেও যথারীতি শিক্ষা দেওয়া ছাড়াও সময় পেলেই আলাদা ভাবে নানা শাস্ত্র ও বিদ্যা দান করেন।



বাণের শিশু বয়সেই জননী রাজদেবী গত হয়েছেন, পিতা চিত্রভানু পিতা-মাতা উভয়ের স্নেহে লালন করেছেন তাঁকে। পিতৃস্নেহে পুষ্ট হয়ে বাণের ধৃতিশক্তি চন্দ্রকলার মতই বিকশিত হয়েছে। অসম্ভব ধীশক্তির অধিকারী বাণ তার আচার্য-পিতার বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার থেকে সাধ্যমত জ্ঞানাহরণ করে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বিষয়ে যথেষ্ট পারঙ্গম হয়ে উঠেছে। ক্রীড়া-কৌতুকের সঙ্গে সঙ্গে অধীত ও আহৃত জ্ঞান তাকে এই চতুর্দশ বছর বয়সেও বেশ চিন্তাশীল করে তুলেছে। দিনের মধ্যে কিছুটা সময় সে নিজের সঙ্গে কাটায়। কখনও উচ্ছল-স্রোতা তমসা নদীর উপল-সংকুল তটভূমিতে, তন্বী নদীর নূপুরনিক্বণে তার মনের মধ্যে বেজে ওঠে একের পর এক সুরের লহরী। আবার কখনও একাকী আপন মনে সে হেঁটে চলে স্নিগ্ধ-শীতল ছায়াঢাকা ছোট্ট জনপদটির কংকর-সমাচ্ছন্ন রাঙ্গা মাটির বীথিকা ধরে, দুচোখ ভরে দেখে আশপাশের স্বচ্ছ জলের তরাগ ও দীর্ঘিকাগুলিতে পাদপশ্রেণীর প্রতিবিম্বর মাঝে প্রস্ফুটিত কুবলয়ের শোভা, পত্র-পুষ্প-ফলভারে আনত তরুশোভিত মনোরম উদ্যানে ঘেরা প্রস্তর-নির্মিত দেবদেউলে সকাল-সন্ধ্যা শঙ্খ-ঘন্টাধ্বনি আর সমবেত কন্ঠের সন্ধ্যা সামগীতের সুর তাকে পৌঁছে দেয় তারই স্বরচিত অন্য এক ভুবনে, যা একান্তই তার নিজস্ব।



অন্যান্য দিনের মতই কিছুক্ষণ আগেই বটুকগণ মুখরিত কলহংসের ন্যায় তাদের প্রভাতী-পাঠ সমাপন করে বিদায় নিয়েছে। আচার্যদেব কখনই বিদ্যাদানের বিনিময়ে কোন কিছু গ্রহণ করেন না।



প্রভাতকালীন অধ্যয়নের শেষে অন্যরা চলে গেলে বাণ ও তার সমবয়সী কয়েকজনসঙ্গী প্রায় প্রতিদিনই নিত্য-নতুন ক্রীড়া উদ্ভাবন করে মেতে ওঠে খেলায়। তার প্রিয় সঙ্গী ব্রাহ্মণ পিতার ঔরসে ও শূদ্রাণী মাতার গর্ভজাত দুই ভাই চন্দ্রসেন ও মাতৃষেণ ছাড়াও ভিষকপুত্র মন্দারক এবং আরও দুই নিত্যসহচর রুদ্র ও নারায়ণ। 



পিতা ছাড়া পিতৃস্বসা মালতি ছিল এই সংসারে মাতৃহীন বাণের একমাত্র অভিভাবিকা ও আপনজন। তার ওই ভাবে অপহৃতা হওয়ার পর শুধুমাত্র পিতা চিত্রভানুর সান্নিধ্যে যেটুকু সময় থাকে, তা ছাড়া বাণের আর কোনওকিছুতেই মন বসে না। বাণের মন ভাল নেই তাই এই কয়দিন ক্রীড়াকৌতুকও বন্ধ।



আজ পাঠ সাঙ্গ হলে বাণ তার নিত্যসঙ্গীদের নিয়ে বাথানেএল।গোপালকদের কুটির থেকে মেয়েদের কথা ও রন্ধনের শব্দ ছাড়া চারিদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। রাখাল বালকেরাও গত দিনের ভয়ংকর বিপদের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তারা একস্থানে জড়ো হয়ে নিজেদের মধ্যে নিম্নস্বরে কথা বলছে।শুধু গোপালকরানিত্যনৈমিত্তিক দীর্ঘিকার জলে গরুগুলিকে স্নান করাচ্ছে, তারা সকলেই আচার্য চিত্রভানুর প্রিয়দর্শী এই কিশোর পুত্রটিকে চেনে, ভালোবাসে।

গোপালকদের দলপতি শ্রীনিবাস বাণকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, ‘‘প্রণাম ঠাকুর, আচার্যদেব ও অন্যান্য সকলের কুশল তো!’’



‘‘আচ্ছা যে দুজন সেই লুন্ঠকদের পিছনে পিছনে ছুটে গিয়েছিল, তারা কি ফিরেছে?’’বাণ সে কথার উত্তর না দিয়ে শুধালো। 



‘‘না গো ঠাকুর, সেই থেকে তাদেরও আর কেউ দেখেনি।’’হতাশ গলায় বলল শ্রীনিবাস, ‘‘তারা যে কোথায় গেল, কি অবস্থায় আছে, জানতে পারিনি।’’



‘‘আমি পিতার মুখে শুনেছি, ওই দুর্বৃত্তরা সামন্তরাজা দুর্জয়ের লোক।’’ মাতৃষেণ পাশ থেকে বলে উঠল।

‘‘তারা তো সেই ঘোড়সওয়ারদের পিছনেই ছুটেছিল দেখেছি,’’নারায়ণ বলল, ‘‘নিশ্চয়ই ওরা ধূমল প্রদেশেই গিয়েছে।’’



‘‘সে তো আমিও জানি।’’শ্রীনিবাস বলল, ‘‘কিন্তু আমরা কেউই কখনও সে জায়গায় যাইনি, কি যে করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। এদিকে বিধু আর বিহানের বাপ-মা তো খাওয়া-ঘুম ছেড়ে দিনরাত কেঁদে ভাসাচ্ছে।’’



ওদের কথার মাঝেই দূর থেকে ধানুক তার চিরসঙ্গী তৈল-চিক্কণ মোটা বেত্রযষ্টিটি হাতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ধানুক অত্যন্ত দক্ষ লাঠিয়াল, তার মেদহীন, পেশী ও শিরাবহুল কালো কষ্টি পাথরে খোদাই করা দেহে প্রচণ্ড শক্তি। সবাই জানে ধানুকের হাতে ঐ বেত্রদণ্ডটি থাকলে সে অনায়াসেবিশ-ত্রিশজন পুরুষের সম্মুখীণ হতে পারে।



‘‘দ্যাখো নিবাস, আমি বলি কি, এভাবে পুরুষ মানুষ হয়ে হাত-পা কোলে নিয়ে বসে না থেকে কিছু একটা করা দরকার।’’ধানুক তার একমাথা অবিন্যস্ত বাবরি চুল নাড়িয়ে বলল, ‘‘বিধু আর বিহানের মত দুটো ছোকরার এত সাহস আর মনের জোর, আর আমরা শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি!’’



‘‘আমিও ঠিক এই কথাটাই বলতে এসেছি তোমাদের।’’বাণ খুশি হয়ে বলল।



‘‘তাহলে চল, আমরা এখনি গ্রামে গিয়ে আচার্যদেব আর অন্যদের ডেকে পরামর্শ নিই, তাঁরা যা বলবেন তাই করব।’’ শ্রীনিবাস সঙ্গে সঙ্গেই রাজি। 

শ্রীনিবাসের ডাকে আরও জনা দশেক জোয়ান এগিয়ে এল।তারপর সবাই মিলে প্রীতিকূটের দিকে চলল।কিছু একটা যে করতেই হবে!(ক্রমশ প্রকাশ্য)



কয়েকটি স্বল্প প্রচলিত শব্দের অর্থ ---বিবস্বান – সূর্য / বটুক – বিদ্যার্থী / প্রপা- জলসত্র / পিটক – মাটির ভাঁড় / সর্জবৃক্ষ- শাল গাছ / পুরারাতি – শিব / রণ্ডাগৃহ – বেশ্যালয়

0 comments: