0

সম্পাদকীয়

Posted in

সম্পাদকীয়


'তখনও সেখানে 
পেঁজা তুলোর আকাশ ছিলো, 
সাদামেঘের ডাক ছিলো
শিউলি ফোটার সকাল ছিলো
শিশির ভেজা ঘাস ছিলো
কাশফুলের পালক ছিলো
ডাকের সাজের দুগগা ছিলো
বুকে ভালোবাসাও ছিলো

আর ছিলো সে...'


প্রকাশিত হলো ঋতবাক শরৎ সংখ্যা। এভাবে তো বলি না কখনও! সচরাচর বলি, 'প্রকাশিত হলো ঋতবাক ষষ্ঠ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা'। আসলে সেদিন কৃষ্ণপ্রিয়র লেখা একটা বইয়ের ভূমিকার পাণ্ডুলিপির নিচের স্বাক্ষরে দেখলাম কৃষ্ণপ্রিয় লিখেছেন, শরৎ, ১৪২৬; হঠাৎ খেয়াল হলো শরৎ এসে গেছে!

এখন তো আলাদা করে ঋতু বোঝার উপায় প্রায় নেইই। সারা বছরই আবহাওয়া মোটামুটি একই রকম। মিশ্র। অথবা হয় প্যাচ প্যাচে গরম, নয়তো ঘ্যান ঘ্যানে বৃষ্টি! অভিমানী প্রকৃতিও কেমন নির্বিকার, নিস্পৃহ; দিন দিন হারাচ্ছে তার বৈচিত্র্য। 

এই যে এখনও যাঁরা বুঝতেই চাইছেন না আগামী কুড়ি বছরের মধ্যেই আসছে সেইসব ভয়ঙ্কর দিন, এখনও যাঁদের প্রাণের ভেতরটা হু হু করে উঠছে বিছানার গদির নিচে জমানো প্লাসটিক ব্যাগগুলোর কথা ভেবে, তাঁদের জন্য আমারও খুব মন খারাপ লাগছে, জানেন!

অবশ্য উল্টোদিকে সেই তাঁদের কথাও বলা উচিত, ওই যাঁরা সারাদিন-রাত চাকরী করছেন সব নামী নামী মাল্টিন্যাশানাল কম্পানীর হাই হাই পোস্টে; অথবা অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে... এঁরা কিন্তু তাও ভাবেন। এই পৃথিবীর কথাই ভাবেন, সত্যি বলছি। গ্লেন বা নিদেন পক্ষে অ্যাবসল্যুট হাতে নিলে এসব কথা ভাবাই দস্তুর। তাই ভাবেন। 

আসলে, বিদেশ থেকে আনা সাড়ে উনিশ হাজার টাকা দামের বিয়ন্সে হিটের গন্ধে শিউলির মৃদু সুবাস চাপা পড়ে গেছে সেই কবে...

আজকাল আর 'রাই জাগো, রাই জাগো' গেয়ে ভোরেরবেলা গোঁসাই ঠাকুর ঘুম ভাঙান না যে! তাই আমাদের ঘুম ভাঙতে বেশ বেলা হয়, অনেক দেরিতে... তাই সবেতেই লেট... লাল 'কালি'র দাগ পড়ে!!

আসুন, বেশি বেলা হয়ে যাওয়ার আগে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করি... 

শুভাচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - পল্লববরন পাল

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


গেছোদাদাদিদিদের হ য ব র ল
পল্লববরন পাল


- গরম লাগে তো তিব্বত গেলেই পার
- তিব্বত? ধ্যাৎ, ও সব বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না
- কেন? সে আর মুশকিল কি?
- কি করে যেতে হয় তুমি জানো?
- তা আর জানিনে? কলকেতা ডায়মণ্ডহার্বার রানাঘাট তিব্বত – ব্যাস্‌ - সিধে রাস্তা,

সওয়া ঘন্টার পথ – গেলেই হল।

- তাহলে তোমার সেই সিধে রাস্তাটা আমায় বাতলে দিতে পার?

এই আকুল প্রশ্ন আমাদের সর্বকালীন ও সার্বজনীন। মোক্ষের সর্টকাট বা সিধে রাস্তার গুগুল রোডম্যাপ। লক্ষ্য করুন, উল্লিখিত কথোপকথনে আমাদের এই প্রশ্ন করার ঠিক আগের অবস্থাটা – আমরা কিন্তু বিশ্বাস করে ফেলেছি যে তিব্বতে গেলে সত্যিসত্যিই এই গরম থেকে চিরকালীন নিষ্কৃতি হবে এবং এটাও বিশ্বাস করেছি যে, কলকাতা থেকে ডায়মণ্ডহার্বার রানাঘাট হয়ে তিব্বতের ব্যবধান দুরত্ব মাত্র সোয়া ঘন্টার। কার কথা বিশ্বাস করলাম? – মাত্র পাঁচ মিনিট আগে আলাপ হওয়া এক বিড়ালরূপী তপস্বীর, যিনি আবার আসলে বিড়ালও নন, একটু আগে অবধি যিনি ছিলেন রুমাল, আমারই নিজের পকেটের একান্ত বিশ্বাসী নিজস্ব ঘাম মোছার রুমাল – অর্থাৎ এইরকম একজন ক্ষণে ক্ষণে অসম্ভব অসম্ভব রূপবদলকারী, যার এই রূপবদলের যুক্তি হিসেবে ‘চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, রুমালের মা’ও আমরা ঘাড় নেড়ে অকাট্য বলে মেনে নিয়েছি। এই সিধে রাস্তার কথাটা হিজিবিজবিজ বা কাকেশ্বর বললে আমরা থোড়াই বিশ্বাস করতাম। উল্টে তর্কাতর্কি বাধিয়ে দিতাম। যেমন ‘সাত দু-গুনে কত হয়’ ইস্যুতে অথবা বয়সের বাড়তি কমতির তত্ত্ব কিম্বা ন্যাড়ার গানের পদ নিয়ে তো বিস্তর ঝগড়া-ঝঞ্ঝাট করেছি। বিনা যুদ্ধে মেদিনী ছাড়িনি। কিন্তু বিড়ালের সঙ্গে কেন করলাম না? কারণ, বিড়াল অত্যন্ত বিদ্বান ঋষিতুল্য। বিড়াল তপস্বী। যে কেউ তো আর তপস্বী হয় না। সাধু-সন্ন্যাসীদের আমরা ত্রিকালজ্ঞ দূরদর্শী বলে জানি। যুগ যুগ ধরে বিশ্বাস ও ভক্তি করে আসছি। গৈরিক বসন আর রাবীন্দ্রিক দাড়ি দেখলেই আমাদের দু’হাত আপনাআপনি জোড় হয়ে কপালে এসে ঠেকে। তাই রাস্তা বাতলানোর প্রশ্ন আমরা যুগে যুগে সেই মাননীয় বিড়ালতপস্বীকেই করে চলেছি। আর তপস্বীও সর্বযুগেই এর উত্তরে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে একইভাবে বলে উঠেছেন –

- সে আমার কম্মো নয়। আমার গেছোদাদা যদি থাকত, তাহলে সে ঠিক ঠিক বলতে পারত।
- গেছোদাদা? সে আবার কে? থাকেন কোথায়?
- গেছোদাদা আবার কোথায় থাকবে? গাছেই থাকে।

গাছ মানেই জঙ্গল – নো ম্যানস্‌ ল্যান্ড - রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে। কালীঘাটে নইলে নবান্নে। হরিশ চ্যাটার্জী নয় মুরলিধর সেন। আলিমুদ্দিন নয় বিধানভবন। সুখচর নয় দেওঘর। মক্কা কিম্বা কৈলাশ। মন্দির নয় মসজিদ নইলে গির্জা। আশ্রম নয় দরগা। বিভিন্ন নামে বিভিন্ন জঙ্গল এলাকায় থাকেন এই সব গেছোদাদা নয় গেছোদিদি।

ইদানিং অবশ্য অনেক ইয়াব্বড়োবড়ো স্বর্ণকন্ঠহার ও দামি সিল্কঝিকমিক বস্ত্রশোভিত দেড়েল বুড়োটে গেছোদাদা গজিয়ে উঠছে এলাকায় এলাকায়। সবচেয়ে পপুলার ও সহজ জীবিকা। সাফল্য গ্যারান্টিড্‌। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের থেকে অনেক সুখসমৃদ্ধি এবং সম্মানীয় জীবিকা। এখন অবধি কেউ গণধোলাই খেয়েছে বলে শুনিনি। দশ হাতে ইনকাম, জিএসটি-ফিএসটি নেই, ট্যাক্স-ফ্যাক্সেরও বালাই নেই। আইটি-ইডি-সিবিআইরা এসে পায়ের মোজার ছেঁড়া অংশের থেকে উঁকি দেওয়া বুড়ো আঙুলের ধুলো ভক্তিভরে নিজেদের মাথার চুলে মিশিয়ে নেবেন – সাষ্টাঙ্গে প্রণামরত সকল ভক্তের মাথায় হাত ঠেকিয়ে শুধু বিড়বিড় করলেই হবে। বিভূতি কিম্বা পুরিয়া। অমাবস্যার রাত্রিশেষে সূর্যোদয়ের আগে গঙ্গাস্নান করে তেত্রিশবার ঈশানমুখো চোখ বুঁজে ‘ওং তৎসৎ’ উচ্চারণ করে কোঁত করে গিলে খেলেই সাত খুন মাপ। এনারা সকলেই কিন্তু মানুষের মোক্ষের সিধে রাস্তার ঠিকানা বিলক্ষণ জানেন আর সোয়া ঘন্টার গুগুলম্যাপের জিপিএস আঁকা খাতাটা সারাক্ষণ সুগন্ধি-বগলে চেপে বসে আছেন।

- তো কোথায় তার সঙ্গে দেখা হয়?
- উহুঁ, সেটি হচ্ছে না, সে হবার যো নেই
- সে কিরকম?

এই উত্তরটা গত বিরানব্বই বছরব্যাপী প্রায় প্রত্যেক বাঙালীর মুখস্থ। বিরানব্বই সংখ্যাটা কিন্তু ফেসবুকের মতো ভার্চুয়াল ঢপবাজি নয়। আসলে সুকুমার রায়ের হাতে গেছোদাদার জন্ম হয়েছিলো আজ থেকে ওই বিরানব্বই বছর আগেই তো, তাই বলছি – বিরানব্বই বছর ব্যাপী মুখস্থ। কিন্তু, ঐ – মুখস্থ পর্যন্তই, তার বেশি কিছু আর নয়। আমরা আজও কথাটার আসল মর্মার্থ বুঝিনি। বোঝার চেষ্টা করিনি। বোঝানোর চেষ্টাও অবশ্য করেননি কোনো বিড়ালতপস্বী।

- সে কী রকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারি। যদি মতিহারি যাও, তাহলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টিপুর। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেছেন কাশিমবাজার। কিছুতেই দেখা হবার যো নেই।

এই উত্তরটা আমাদের মুখস্থ হলেও সঠিক সময়ে আমরা ঠিক স্মরণে রাখতে পারি না। আর এর মর্মার্থও বোধগম্যতার পাঁচিল টপকাতে পারেনি। তাই আমরা নেশাগ্রস্তের মতো জোড়হাতে গিয়ে দাঁড়াই মন্দিরে জাগ্রত বিগ্রহের সামনে – ‘অমুকটা করে দাও বাবা’। কে বাবা? কোথায় বাবা? আমি যখন মন্দিরে বাবা-বাবা করছি, তখন যে উনি কানের হেডফোনে ‘নাচ মেরি বুলবুল’ শুনতে শুনতে হাইওয়ের ধারের ধাবায় বসে চুপিচুপি বিফ্‌টিফ্‌ প্যাঁদাচ্ছেন না – কেউ বুক ঠুকে বলতে পারবে কি? একইরকমভাবে মসজিদ থেকে পালিয়ে আর একজনের বাবা হয়তো টেবিলের উল্টোদিকে বসে কবজি ডুবিয়ে পর্কের ঝোলভাত খাচ্ছেন। দুই বন্ধু হয়তো মাঝেমাঝেই এরকম একসাথে টুক করে বেরিয়ে নন্দনে বা আইনক্সে সলমনের ঢিসুমঢিসুম দেখেটেখে পার্কস্ট্রিটে ট্রিঙ্কাসে বসে ... বেয়ারা, চালাও ফোয়ারা, জিন শেরি শ্যাম্পেন রাম ... 

এই যে ক’দিন আগে কচুয়ায় এক বাবার মন্দিরে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেলেন কিছু ভক্ত – এ সম্পর্কেও তো আমার প্রশ্নের উত্তরে সেদিন এক তিলককাটা রণে-বনে-জলে-জঙ্গলের ভক্ত বললেন – বাবা তখন কচুয়ায় থাকলে কি আর ওদের মরতে হতো নাকি, বাবা ঠিক অলৌকিক উপায়ে বাঁচিয়ে দিতেন, কিন্তু বিপুল সংখ্যক ভক্তরা যখন কচুয়া গেছে বাবার দর্শনের অভিপ্রায়ে, তখন উনি চাকলা বা তেঘরিয়ার বনে জঙ্গলে ভক্তদের উদ্ধারে ব্যস্ত। ঐ, উলুবেড়ে-মোতিহারি-রামকিস্টিপুর-কাশিমবাজার - গেছোদাদা কেস। দর্শন বা গোদা বাঙলায় যাকে বলে পলিসি - সে তো একই।

আট বছরের বাচ্চা আসিফা বানো। শ্রীনগরের কাঠুয়া গ্রামের এক মন্দিরের মধ্যে একদল মানুষের ছদ্মবেশী জানোয়ার আটদিন ধরে মেয়েটির ওপর অকথ্য অত্যাচার করে তারপর পাথর দিয়ে থেঁৎলে থেঁৎলে তাকে হত্যা করে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে। এ খবর মুখবই মারফৎ ভাইরাল হয়েছে। সেখানে আমরা আসিফার নিষ্পাপ মুখের ছবিও দেখেছি। যে মন্দিরে এই ঘটনা ঘটেছিলো, সেটা কালীমন্দির। মা কালী তো মহাশক্তি – আদ্যাশক্তি মহামায়া – “দশ ভুজ দশ দিকে প্রসারিত, তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত, পদতলে শত্রু বিমর্দিত, পদআশ্রিত, বীরকেশরী, শত্রুনিপিড়নে নিযুক্ত”। ব্রহ্মাণ্ড নাকি চলে তাঁর নির্দেশে। তো সামান্য ঐ শিশু মেয়েটি তাঁর নিজের বাড়িতেই সুরক্ষা পেলো না কেন সেই আদ্যাশক্তির কাছে? মা তাঁর নিরীহ নিষ্পাপ শিশুসন্তানকে তাঁর চোখের সামনে আটদিন ধরে ঘটে যাওয়া অন্যায় থেকে কোনো লৌকিক বা অলৌকিক উপায়েও বাঁচাতে পারলেন না? হাসপাতালে রোগী মারা গেলে আমরা সগৌরবে ডাক্তার প্যাঁদাই, অথচ ঐ ফুটফুটে তাজা মেয়েটির মৃত্যুতে আমরা মা কালীকে – না না, প্যাঁদাপেঁদি উচিৎ কাজ নয়, আমি তা বলছিও না - কিন্তু নিদেন একটা কৈফিয়তও চাইলাম না, নিজের মনের মধ্যেও এ প্রশ্নটা তুললামনা কেন? কারণ, ঐ গেছোদাদা থিয়োরি। আমাদের স্থির বিশ্বাস, মা নিশ্চয়ই তখন অন্য কোনো ব্রহ্মাণ্ডের চলন নির্ধারণ করছিলেন। অন্য কোথাও সিক্সপ্যাক দেখাচ্ছিলেন। তাছাড়া দেশ জুড়ে লক্ষাধিক কালীমন্দির। ট্যুরে ট্যুরেই থাকতে হয় আমাদের দেশের বর্তমানে একনম্বর গেছোদাদার মতো। সব মন্দিরেই তাঁকে ঘুরেফিরে হাজিরা দিতে হয় – দেবত্বের চাকরি-শর্ত সম্ভবত। ঐ, উলুবেড়ে-মোতিহারি-রামকিস্টিপুর-কাশিমবাজার। যে যতো বড়ো গেছো, তার লিস্টি ততো বড়ো। তান্ত্রিক বা জ্যোতিষীদের মতো। তফাৎ শুধু, জ্যোতিষীরা কবে কোথায় কখন – তা নিয়মিত বিজ্ঞাপিত – মায়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা গোপনে – ঐ গেছোদাদার মতো।

এরকম শিউরে ওঠার মতো বিপর্যয়ের ঘটনা হররোজ ঘটছে – সারা পৃথিবী জুড়ে। আমরা কেউ কোনোদিন কোনো অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করিনি, কিন্তু আমরা সবাই জানি অমুকে দেখেছে চোখের সামনে। সেই অমুককে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে, সে নিজে দেখেনি, কিন্তু তমুকে যে দেখেছে, সেটা সে জানে। এখানেও গেছোদাদা তত্ত্ব। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো – আমাদের সকলেরই এই অলৌকিকে বিশ্বাসটা কিন্তু অটুট। এটাই যুগ যুগান্তর ধরে এই গেছোদাদা-তত্ত্বের ম্যাজিক। এই ম্যাজিকের ওপরেই ভরসা করে শয়তান রাজত্ব করে আমাদেরই মনের গভীরে এবং সমাজে, পৃথিবীর সর্বত্র। 

আশারাম বাপু, গুরমিত রাম-রহিম সিং, রামপাল, প্রেমানন্দ, স্বামী অমৃতচৈতন্য, স্বামী সদাচারি, নিথয়ানন্দ, ভিমানন্দ প্রমুখ স্বঘোষিত ঈশ্বররা তো হযবরল পড়েননি। তাই গেছোদাদা থিওরি ওনাদের জানা ছিলো না। তাই ধর্ষণ হত্যা কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে ধরা পড়ে গেছেন ও অধুনা জেল খাটতে হচ্ছে। এরকম স্বঘোষিত আরো ঈশ্বর হাজারে হাজারে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাথা উঁচু করে। আরে বাবা, লোকের বিশ্বাস অর্জন করে ঠকানো যাদের জীবিকা, তাদের এরকম একাধিক ডেরা বা বাসস্থান রাখা বাধ্যতামূলক। উলুবেড়ে-মোতিহারি-রামকিস্টিপুর-কাশিমবাজার। পোলিটিক্যাল নেতা থেকে শুরু করে ঠাকুর দেবতা সকলেই এই প্রাথমিক ব্যাপারটা সন্তর্পনে মাথায় রাখেন। নইলে দৃষ্টিকটু হলেও বাধ্য হয়েই নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাড়ির বাইরে চব্বিশ গুন সাত নিশ্ছিদ্র একেসাতচল্লিশ-প্রহরার ব্যবস্থা করতে হয়।

প্রত্যেক গেছোদাদা বা দিদির আবার নিজস্ব নিজস্ব রোডম্যাপ অর্থাৎ ঐ উলুবেড়ে-মতিহারি-রামকিস্টিপুর-কাশিমবাজার থাকে। এক একজনের একাধিক ডেরা। বিভিন্ন শহরে বা দেশে। কারো তেঘরিয়া-কচুয়া-চাকলা-বারদি, কারুর তিলজলা-মেদিনীপুর-কৃষ্ণনগর-দিনহাটা, একটু বড়ো গেছোদাদার আবার দেওঘর-হেমায়েতপুর-সোনামুখী-কুড়িয়ানা-ঢাকা, আরো বড়োদাদার মুম্বাই-পুনে-অস্ট্রিয়ার ওয়াস্কো-আমেরিকার অরেগন – বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ গেছোদাদা?

গুগুল ঘাঁটলে বিভিন্ন ধর্মের এরকম লক্ষ লক্ষ গেছোদাদা ও তাঁদের একাধিক উলুবেড়ে-মোতিহারি-রামকিস্টিপুর-কাশিমবাজারের ডেরার উদাহরণ বার করা যায়।

আমাদের পুরানে তেত্রিশকোটি দেবদেবীর এরকম অন্তত তেত্রিশকোটি গুণ চার সংখ্যক ডেরা আছে – এই ব্যাপারটার অনুসন্ধান করতে হলে পুরাণবাগীশ পণ্ডিত চাই – যাদের থেকে আমার তেত্রিশকোটি হস্ত দূরে অবস্থান। তবে তাঁদের মধ্যে যাঁরা মেগাস্টার, কলকাতারই বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁদের অসংখ্য ডেরা বা মন্দির আছে – যাতায়াতে দেখতে পাই, মানুষজন ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ বুঁজে গদগদভক্তিতে প্রণাম ঠোকে। যেমন মা কালীর কথাই ধরা যাক। কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বরে তো নিজের নামেই আছেন, আবার বেনামে তারাপীঠ(তারা মা), বোলপুর কঙ্কালীতলা, শিবপুর (হাজারহাতকালী), বাঁশবেড়িয়া (হংসেশ্বরী), বোড়াল (ত্রিপুরাসুন্দরী), বউবাজার (ফিরিঙ্গিকালী), পুরুষোত্তমপুর সিঙ্গুর (ডাকাতকালী), চায়নাটাউন (চীনাকালী), বড়োবাজার (পুঁটেকালী), ঠনঠনিয়া (সিদ্ধেশ্বরী) – কালীঠাকুরের স্বনামে ও বেনামে আনুমানিক কয়েকলক্ষ ডেরার পুরো তালিকা প্রকাশ করতে অন্তত পঞ্চাশ বছর ধরে কয়েক শো মানুষের অনর্গল চব্বিশগুনসাত ঘন্টার গবেষণা দরকার – অত ধৈর্য, স্যরি, আমার নেই। আর এই কুড়ি-বিশ যুগে কারুরই অত সময়ও নেই।

কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন জাগে – গুষ্টির পিণ্ডি, এই এত এত নাম কেন? ছদ্মনাম কবি-সাহিত্যিকেরা রাখেন – যেমন সমরেশ বসু-কালকূট, সুনীল গাঙ্গুলি-নীললোহিত। এনাদের ব্যাপারটা বোঝা যায়। একটা বিশেষ ধরণের লেখার জন্য তাঁরা অন্যনাম ব্যবহার করছেন। সেও তো একজনের ছদ্মনামও একটাই। কিন্তু, এই মা কালীর কথাই ধরুন। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে উপস্থিতি কেন? আমাদের পরিচিত মহলে এই অভ্যেস যাদের, সমাজে তারা খুব সম্মানিত মানুষজন নন। ইদানিং আমরা আমাদের প্রায় প্রত্যেকেরই এলাকায় এরকম গেছো্দাদাদিদি দেখি, যাদের একাধিক নামে পরিচিতি। মূলত ঠগ জোচ্চোরদের এই একাধিক নামের অর্থ বোঝা যায়। আর একটা বিশেষ রকম আছে – ট্যাক্স বাঁচাতে একই মানুষ অনেক নামে টাকা জমায়। এদের মধ্যে অনেকে অবশ্য সমাজে বিশিষ্ট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু মা কালী? ওনার পিছনে তো ইডি আইটি সিবিআইদের লাগার সম্ভাবনা নেই যে, আইন ও সম্পত্তি বাঁচাতে নাম ভাঁড়াতে হবে! কালীর মতোই দুর্গা শিব কৃষ্ণ গণেশ ইত্যাদি বহু ঠাকুরের নাম ও ডেরার সংখ্যাও – এ বলে আমায় দ্যাখ তো ও বলে ...

ইদানিং আরো বিভিন্ন দেবদেবী জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন বিভিন্ন সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণে – সেই অনুযায়ী তাঁদেরও ডেরার সংখ্যা বাড়ছে ব্যাঙের ছাতার মতো। কারোর কালীঘাট-সিঙ্গুর-ডেলোপাহাড়-নবান্ন আবার কারুর আমেদাবাদ-গোধরা-দিল্লি-নিউইয়র্ক। কেউ বলেন – রণে বনে জলে জঙ্গলে..., কেউ বলেন – সততার প্রতীক, আবার কেউ বলেন – অচ্ছে দিন। 

সম্প্রতি এক গেছোদিদি জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থা করেছেন। একেবারে সরাসরি। ফোন তুলুন, কথা বলুন। কিন্তু শোনা যাচ্ছে সেখানেও ওই গেছোদাদা তত্ত্ব। ওই যে, গেছোদাদার দর্শন পেতে গেলে যা করণীয় বলে লেখা আছে –

- আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই; তারপর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তারপর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তারপর হিসেব করে দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তারপর হিসেব করে দেখতে হবে...

হে ভক্তগণ, আপনারা ‘হ্যালো হ্যালো’ বলতে থাকুন। যুগ যুগ ধরে বিশ্বাস রাখুন। আজ কাল পরশু বা আগামী দু’হাজার বছরে যদি নাও হয়, অচ্ছেদিন একদিন না একদিন নিশ্চয়ই আসবে। গেছো দাদাদিদিরাই তো ভরসা আমাদের।

জয় শ্রী গেছোদাদা। 

জয় শ্রী, থুড়ি শ্রীমতী, ধ্যাৎ... মিস্‌ গেছোদিদি।

আমি বলি – জয় শ্রী সুকুমার রায়।

2 comments:

1

প্রবন্ধ - পিনাকী চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


চার ফুট সাড়ে আট ইঞ্চি 
পিনাকী চক্রবর্তী 


দাবী পরিত্যাগী কথন (ডিসক্লেইমার) : কোনো রূপ ফলের আশা রাখিয়া পড়িবেন না। এই কাহিনীর আরম্ভ হইতে সমাপ্তি পর্যন্ত কোথাও কোন ভাবের সমন্বয় বা সামঞ্জস্য নাই (গোদা বাংলায়, এ গল্পের কোনও মাথামুণ্ডু নেই)। কাহিনীর একাংশের সহিত অপরাংশের কোথাও কোনও ধারাবাহিকতা পরিলক্ষিত হইলে জানিবেন তাহা লেখকের অজান্তে আসিয়াছে, ইচ্ছাপ্রণোদিত ভাবে নয়। শ্রী এবং ছন্দহীন (ছিরিছাঁদ ছাড়া) এই গল্পে কোনও পাঠক/পাঠিকা যদি কোনও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী বা জ্ঞানদানের অপচেষ্টা খুঁজিতে প্রচেষ্টা লাভ করেন, তবে তিনি তাহা নিজ দায়িত্বে করিবেন। বিভিন্ন সূত্র হইতে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে রচিত এই কাহিনীর সত্যাসত্য বিচারের ভার কাহাকেও দেওয়া হয় নাই, স্বয়ং লেখককেও নহে। যে কোনও কারণে এই কাহিনী মনোমত না লাগিলে কোম্পানী দায়ী থাকিবেন না। এবং হ্যাঁ, এই রচনার প্রথম চারটি অনুচ্ছেদ (প্যারাগ্রাফ) না পড়িলেও চলিবে!

মনে করুন একটা পেট্রোল চালিত মোটর গাড়ি ঘন্টায় আশি নব্বই কিলোমিটার গতিতে রাস্তা দিয়ে ছুটছে। আপনি কি জানেন যে, সে সময় তার এঞ্জিনের মধ্যে মিনিটে প্রায় পাঁচ হাজার বার একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটে চলেছে? মিনিটে পাঁচ হাজার বার, মানে প্রত্যেক সেকেন্ডে প্রায় তিরাশি বার করে এই বিস্ফোরণ হয়ে চলেছে। অর্থাৎ, এক সেকেন্ডের একশো ভাগের প্রতি এক ভাগে একটা করে বিস্ফোরণ ... ভেবে দেখুন! আর, ওই বিস্ফোরণগুলো আপনা আপনি ঘটছে না, তাদের ঘটানো হচ্ছে। এঞ্জিনের ভেতরের সিলিন্ডারগুলোর মধ্যে পেট্রোল এবং হাওয়ার মিশ্রণকে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গের সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত ভাবে পূর্ব নির্ধারিত পরম্পরায় জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে এঞ্জিন তথা গাড়ি চলতে পারে। এই নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণের ধারাবাহিকতাই এ ধরনের এঞ্জিনের চালিকা শক্তির উৎস। 

এখানে কাজের কথাটা হলো “নিয়ন্ত্রিত ভাবে” ... অর্থাৎ এই তেল জ্বালানো আর এঞ্জিন চালানোর চেইন রিঅ্যাকশনের সমস্তটাই নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রাখা হয়, কোনও অংশকেই কখনও তার নির্দিষ্ট মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে দেওয়া হয়না। এমন কি, পর পর দুম দাম করে এরকম বিস্ফোরণের ফলে যে প্রচণ্ড উত্তাপের সৃষ্টি হয়, যে তাপশক্তি এই এঞ্জিনকে চালায়, তাকেও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এই পৌনঃপুনিক বিস্ফোরণে এঞ্জিন কতটা গরম হয়ে উঠতে পারে, তারও সীমা বেঁধে দেওয়া থাকে। তার কারণ, এ ধরনের এঞ্জিন সবচেয়ে বেশি দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে মোটামুটি একশো ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, যদিও এর থেকে অনেকটা কম এবং খানিকটা বেশি তাপমাত্রাতেও সাধারণ পেট্রোল এঞ্জিন স্বচ্ছন্দে কাজ করতে সক্ষম। তবে অনেকক্ষণ ধরে, খুব বেশি বা খুব কম তাপমাত্রায় কাজ করতে হ’লে এঞ্জিনের কর্মদক্ষতা এবং জীবনীশক্তি ... দূটোই অল্প অল্প করে কমে যায়। সাথে ফাউ হিসাবে পরিবেশ দূষণও বাড়তে পারে। তাই এটা হতে দেওয়া যায় না।

এতক্ষণ ধরে যা বলা হলো, তার সংক্ষিপ্তসার হলো সেরেফ দুটো কথা। এক) পেট্রোল এঞ্জিন চলতে থাকলেই গরম হবে, আর দুই) তাকে প্রয়োজনের থেকে বেশি গরম হতে দেওয়া চলবে না, কারণ তাহলে এঞ্জিনের আয়ু কমে যাবে। তাই এঞ্জিনের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে এঞ্জিনকে ঠান্ডা করার ব্যবস্থা, পরিভাষায় এঞ্জিনের কুলিং সিস্টেম। ঠান্ডা করার মাধ্যম হিসাবে সাধারণত জল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সাদামাঠা জল এ ধরনের বিরামহীন তাপপ্রবাহে বাষ্প হয়ে বেমালুম উড়ে যেতে পারে। তাই গাড়ির এঞ্জিন ঠান্ডা করার জলকে একটু অসাধারণ করে তোলা হয়। মানে, তাতে বিভিন্ন ধরনের কুল্যান্ট বা ঠান্ডাই মিক্সচার মেশানো হয়ে থাকে। 

এই ঠান্ডাই মিক্সচারের কাজ কিন্তু শুধু জলকে ঠান্ডা রাখাই না, আরো হরেক রকম হ্যাপা তাকে সামলাতে হয়। যেমন ধরুন, জলের থেকে রেডিয়েটর বা এঞ্জিনের যন্ত্রাংশে মরচে না ধরে, তাই তাতে রাস্ট ইনহিবিটর বা মরচে-নিরোধক কিছু পদার্থ মেশানো থাকে। ওয়াটার পাম্পের যন্ত্রাংশ ঠিকঠাক চালু রাখার জন্যে লুব্রিকেটর বা মসৃণতা প্রদায়ী কিছু যৌগও মেশানো হয়। বিদ্যুৎ পরিবাহিতা কম করার জন্যেও কিছুমিছু মেশানো হয়। আর মেশানো হয় অ্যান্টি ফ্রীজ নামক কিছু বস্তুর মিশ্রণ, যেগুলো ঠান্ডা দেশে এঞ্জিন ঠান্ডা রাখার জলকে জমে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচায়। মনে করুন, আপনি সিমলায় থাকেন। শীতের রাত্তিরে ঝুপ ঝুপ করে বরফ পড়ছে, আর আপনি গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে, গাড়িটাকে বাড়ির সামনে পার্ক করে হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে বাড়িতে ঢুকে পড়ে রুম হীটারের সামনে বসে গা গরম করছেন। আপনার গাড়ি কিন্তু সারা রাত একা একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলো। তার গরম এঞ্জিন ঠাণ্ডা হলো, কুলিং সিস্টেমের জলও আস্তে আস্তে গরম থেকে ঠান্ডা হলো। তার পর আরো ঠান্ডা হতে হতে জমে একেবারে বরফ হয়ে গেল। রেডিয়েটরের সূক্ষ্ম ঝিল্লিগুলোর মধ্যে জল যদি জমে বরফ হয়ে যায়, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? সিমলাতে শীতকালে বাড়ির জলের পাইপের মধ্যে জল জমে বরফ হয়ে গেলে কি হয়? পাইপ ফেটে যায়। কারণ জল জমে বরফ হয়ে গেলে তা আয়তনে বেড়ে যায়। এরকম জল জমানো ঠান্ডা পড়লে, গাড়ির ক্ষেত্রে এঞ্জিনের ভেতরে জল পরিবাহী রাবারের হোসপাইপগুলো ফেটে যেতে পারে, রেডিয়েটরের সাথে যুক্ত ধাতব পাইপগুলোও ফেটে যেতে পারে ... এমনকি আস্ত রেডিয়েটরটাই ফেটে যেতে পারে। এ সমস্যা শুধু সিমলাতেই নয়, নিউ ইয়র্কেও হয়, ক্যানাডার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হতে পারে, রাশিয়ার তো কথাই নেই...

সুতরাং এই সব জায়গায় দরকার কিছু অ্যান্টি ফ্রীজ পদার্থ, যা জলে মেশানো থাকলে জল চট করে জমে বরফ হয়ে যাবে না। এখন অবশ্য অনেক রকম অ্যান্টি ফ্রীজ আবিষ্কার হয়ে গেছে, কিন্তু আগেকার আমলে এত সুবিধে ছিলো না। আমি বলছি ১৯২৬ সালের কথা। সে সময় যা অ্যান্টি ফ্রীজ পাওয়া যেত, সেগুলো হয় খুব কাজের ছিলো না, অথবা খুব দামী ছিলো, আর নাহলে উদ্বায়ী হওয়ার কারণে সেই জিনিস ঘন ঘন ঢালতে হতো রেডিয়েটরের জলের মধ্যে। সেই আমলেও এটা বেশ বিরক্তিকর ব্যাপার ছিলো। আর সেই জন্যেই এই নিয়ে রিসার্চ চালাচ্ছিলেন দুই মার্কিন রসায়নবিদ, জোসেফ সি. প্যাট্রিক আর ন্যাথান ম্নূকিং। পরের নামটা পড়তে পারলেন কি? আমি তো পারছিলাম না! ওটা আসলে ময়ে নয়ে দীর্ঘ ঊ-কার, ম্নূ! ম্নূকিং! আচ্ছা, ওঁর নামটা যাই হোক, ওঁরা দুজনে মিলে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন সস্তায় কিছু টেঁকসই অথচ কার্যক্ষম অ্যান্টি-ফ্রীজ বানিয়ে বাজারে ছাড়ার জন্যে। এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন যৌগ দিয়ে নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট চালানোর সময় তাঁরা একবার ইথলীন ডাইক্লোরাইড আর সোডিয়াম পলিসালফাইড মিশিয়ে কিম্ভুত একটা বস্তু বানালেন। সেটা ভালো অ্যান্টি ফ্রীজ হলো কিনা কে জানে, কিন্তু বস্তুটা জন্মিয়েই একটা উৎকট রকম দুর্গন্ধ ছড়াতে লাগলো। তাড়াতাড়ি দুই বন্ধু সেটাকে ল্যাবের সিঙ্কে ঢেলে দিলেন। এবার জল ঢেলে সিঙ্কটা পরিষ্কার করতে যেতেই চিত্তির! তাঁরা দেখলেন সিঙ্কের নিকাশী ব্যবস্থা সম্পূর্ণ জ্যাম হয়ে গেছে।

দেখুন, সিঙ্ক জ্যাম হলে আপনি বা আমি প্লাম্বার ডাকবো! কিন্তু কেমিস্টরা অন্য ধাতু দিয়ে তৈরি। রসায়ানাগারে এরকম ছোটোখাটো দুর্ঘটনা হামেশাই ঘটে থাকে। ওঁরা এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত। তার ওপর ওঁদের হাতের কাছে বিস্তর সলভেন্ট থাকে, যেমন ধরুন ইথানল, মিথানল, অ্যাসিটোন, বেঞ্জিন, টল্যুইন, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, তাপ্পর অ্যাকোয়া রিজিয়া... মানে, বুঝতেই পারছেন, আমি তো আর কেমিস্ট নই... রসায়নে আমার বিদ্যের দৌড় হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত। তাই ওই লাইনে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারলাম না। তবে, ওই দুই বন্ধু ল্যাবে মওজুদ তাবৎ সলভেন্ট দিয়ে জট ছাড়ানোর চেষ্টা করে করে নিজেদের হালত খারাপ করে ফেললেন। কিন্তু সেই বিটকেল বস্তু কিছুতেই ওই সিঙ্ক থেকে সরানো গেলো না। সেটা যেমন সীল হয়ে ছিলো, তেমন সীল হয়েই থাকলো।

দুই বন্ধু এবার হাতে হাত লাগিয়ে সিঙ্কটাকেই খুলে ফেললেন, এবং তার নিকাশি পাইপ ফাটিয়ে ভেতর থেকে সেই পাইপকে সীল করে দেওয়া পদত্থটিকে উদ্ধার করলেন। সেটা দেখতে শুনতে অবিকল প্রাকৃতিক রাবারের এর মতো। অর্থাৎ ঘটনাচক্রে সেদিন ওই ল্যাবে একধরণের কৃত্রিম রাবার তৈরি হয়ে গেছে, সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম রাবার। এবার দুই বন্ধুর কানে জল ঢুকলো। মানে, এঁরা বুঝলেন যে, নিজেদের অজান্তে তাঁরা একটা খুব কাজের জিনিষ আবিষ্কার করে ফেলেছেন। মানে, অ্যান্টি ফ্রীজের জায়গায় তাঁরা একটা অ্যান্টি-লীক সীল্যান্ট আবিষ্কার করে ফেলেছেন। এমন জিনিস, যা ফাটা পাইপ, ভাঙা সিঙ্ক ইত্যাদিতে জব্বর রকম জোড়া এবং তাপ্পি দিয়ে দেবে! এমন তাপ্পি, যা জীবনে খুলবে না এবং জীবনে লীকও করবে না। অনেকটা আমাদের এখনকার এম-সীলের মতো ব্যাপার, বুঝলেন তো? 

দুই বন্ধু মিলে ঠিক করলেন এর একটা নাম দিতে হবে। অনেক নাম বাছাবুছি করে শেষে একটা নাম পছন্দ হলো, থায়োকল। গ্রীক ভাষায় সালফারের নাম থেইয়ন (বা থেইয়ঁ) এবং আঠাকে বলে কল্লা। এই থেইয়ন আর কল্লাকে জুড়ে দিয়েই তৈরি হলো থায়োকল। এবার এটাকে নিজেদের নামে পেটেন্ট করিয়ে নিয়ে ওঁরা ব্যবসায়িক চিন্তা ভাবনা করতে লাগলেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের দিয়ে বোধহয় এসব হয় না। নিজেরা কিছুই করে উঠতে পারলেন না, তাই চেষ্টা চরিত্র করে নিউ জার্সির স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানীর বড়কর্তাদের সাথে দেখা করলেন। ওঁদের পেল্লায় পেল্লায় তৈল শোধনাগার, মানে রিফাইনারি টিফাইনারি আছে, ওখানে যদি এই থায়োকল কোনও কাজে লাগে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েল এঁদের সাথে বৈষয়িক কথাবার্তা কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গেলেও, তাদের চুক্তির কিছু শর্ত দেখে শেষমেশ পিছিয়ে আসতে হলো দুই বন্ধুকে। হতাশ হয়ে, বছর দেড় দুই পরে ওঁরা পেটেন্টের স্বত্ব বিক্রি করে দিলেন এক নুনের কোম্পানীর মালিক-কাম-ম্যানেজারকে। 

সেই নুন কোম্পানীর মালিক, বেভিস লংস্ট্রেথ, কিছু পয়সা কড়ি জমিয়ে থায়োকল কেমিকাল কর্পোরেশন বলে একটা কোম্পানী খুলে বসলেন ১৯২৯ সালে মিসৌরির কানসাস সিটিতে। কোম্পানীটা বানাতো কৃত্রিম রাবার আর পলিমার সীল্যান্ট। কিন্তু তাঁদেরকে সেসব বানাতে দিলে তো! প্রোডাকশন শুরু হতে না হতেই থায়োকল চারপাশে এমন দুর্গন্ধ ছড়াতে লাগলো যে, কানসাস সিটির বাসিন্দারা দলবদ্ধ ভাবে শহরের মেয়রের কাছে গিয়ে থায়োকল কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ আনলেন। মেয়র তো পত্রপাঠ তাঁদের সেই অভিযোগ মেনে নিলেন। এদিকে সেই ঠেলায় কোম্পানী প্রায় লাটে ওঠে আর কি! কিন্তু রাখে কৃষ্ণ মারে কে? মরিয়া হয়ে নিজের পকেটের শেষ সম্বলটুকু খরচা করে লংস্ট্রেথ সাহেব নিউ জার্সির ট্রেন্টনে থায়োকলের ফ্যাক্টরি বানালেন ১৯৩৫ সালে। এ জায়গাটা মনে হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন, কারণ এখানে থায়োকলের দুর্গন্ধ নিয়ে কেউ আপত্তি তুললো না। ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে কোম্পানী চলতে লাগলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লংস্ট্রেথ ভেবেছিলেন তাঁর কৃত্রিম রাবার হয়তো অনেক কাজে লাগবে। কিন্তু কাজের বেলায় দেখা গেল প্রাকৃতিক রাবার রি-সাইকল করেই মিত্রশক্তি খরচ বাঁচাচ্ছে। তবে, যাই হোক, মিত্রশক্তিকে ওই কৃত্রিম রাবারের তৈরি কিছু বিশেষ হোস পাইপ আর এই তরল পলিমার সীল্যান্ট সাপ্লাই করেই থায়োকল কোম্পানী বাজারে টিঁকে থাকলো। যুদ্ধের শেষের দিকে, ১৯৪৪ সালে, লংস্ট্রেথ সাহেবও দেহ রাখলেন। কোম্পানীও আবার লাটে উঠতে চললো। কেউ আর এগিয়ে এসে এই ডুবন্ত কোম্পানীর দায়িত্ব নিতে চায় না। অবশেষে কোম্পানীর ভাইস-প্রেসিডেন্ট জোসেফ ক্রসবি সাহেবকে ধরে পেড়ে সবাই মিলে কোম্পানীর দায়িত্ব তাঁর হাতে তুলে দিলেন। 

এদিকে, ওই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরই শেষের দিকে, অক্ষশক্তি এবং মিত্রশক্তি, দু’পক্ষই প্রচুর গবেষণা চালাচ্ছিলো বিভিন্ন ধরনের রকেট নিয়ে। হিটলারের জার্মানি তরল জ্বালানী চালিত ভি-২ মিসাইল দিয়ে ইংল্যান্ডের ওপর সরাসরি আক্রমণ শানাচ্ছিলো ১৯৪৪ সালের শেষ দিক থেকে, যার পাল্টা জবাব দেওয়ার মতো কোনও অস্ত্র সেই সময় মিত্রশক্তির কাছে ছিলো না। মার্কিন মুলুকে সে সময় সলিড ফুয়েল রকেট নিয়ে গবেষণার কাজ চলছিল ক্যালিফোর্নিয়াতে, প্যাসাডেনার জেট প্রপালশন ল্যাব-এ (সংক্ষেপে জেপিএল)। এটা যদিও একটা সরকারী রিসার্চ ল্যাবরেটরি, কিন্তু ১৯৩০ সালে যখন এই জেপিএল তৈরি করা হয়, তখন থেকেই ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (ক্যালটেক) জেপিএল-এর দেখভাল করতেন। জেপিএল বর্তমানে নাসার রিসার্চ সেন্টার হলেও, এখনও ক্যালটেকের গবেষকরা এখানে মহাকাশযান নির্মাণ এবং রকেট বিজ্ঞান নিয়ে কাজকর্ম করে থাকেন। 

সে যাই হোক, সেই ১৯৪৫ সালে সলিড ফুয়েল রকেট নিয়ে জেপিএল নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলো। একে তো রকেটের ভেতর সলিড ফুয়েলকে ভালভাবে ধরেবেঁধে রাখা মেলাই ঝামেলা, তার ওপর এই কঠিন জ্বালানীর জ্বলন নিয়ন্ত্রনের উপযুক্ত কোনও স্টেবিলাইজারও পাওয়া যাচ্ছিলো না। 

কালীপুজোর সময় উড়ন তুবড়ি যাঁরা বানিয়েছেন, তাঁরা এই “ধরেবেঁধে রাখার প্রবলেমটা” হয়তো বুঝবেন। পটাশ, সোরা, গন্ধক, অ্যালুমিনিয়াম চূর্ণ, কাঠকয়লার গুঁড়ো ইত্যাদির মিশ্রণটা একটু কম ঠাসা হলে তুবড়িটা ঝট করে ফ্যাঁস দুম ফট হয়ে যায় বলে শুনেছি। (আমাকে মারবেন না প্লীজ, আমি একে এইসব বিপজ্জনক জিনিসের ফিনিশড প্রোডাক্টেই কখনো হাত দিইনি, তায় আবার সে বস্তু বানানোর টেকনোলজি!!! রক্ষে কর প্রভু)! তুবড়ির ব্যাপারটা ভালোভাবে না বুঝলে, ঝুরঝুরে শামী কাবাবের কথাও ভেবে দেখতে পারেন। ওখানে ছোলার ডালের পেস্টটা ঝুরঝুরে কিমাকে বাইন্ড করায় সাহায্য করে। সর্বোপরি ডিমের গোলা আছেই, কাবাবটাকে একসাথে ধরে রাখার জন্যে। এটা উড়ন তুবড়ি টেকনোলজির থেকে অনেক সহজ ব্যাপার, আমার মাথাতেও ঢুকলো…

তা সেই ১৯৪৫ সালে, একদিন জেপিএল-এর একজন গবেষক চার্লস বার্টলে তাঁর সলিড ফুয়েলের জন্যে ওইরকম ভালো বাইন্ডারের খোঁজে এটা সেটা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখছিলেন। এদিকে, সেই সময় ল্যাবের এক কোণায় পড়ে ছিলো এক বোতল থায়োকল সীল্যান্ট। সেদিকে সাহেবের চোখ পড়লো। বোধহয় কাজের জন্যে কোন জলের বা কলের মিস্ত্রী ওই পদাত্থটি নিয়ে এসেছিলেন, কাজ হয়ে গেলে বোতলটি ফেলে চলে গেছেন। হঠাৎ কি কারণে কে জানে, বার্টলে সাহেব উঠে গিয়ে বোতলটা তুলে এনে “যা থাকে কপালে” বলে ল্যাবের টেবিলে রাখা রকেটের সলিড জ্বালানীর ওপর অল্প খানিকটা ওই থায়োকল লিক্যুইড সীল্যান্ট ঢেলে দেখলেন ফলটা কিরকম হয়! ফল যা হলো তা দেখে তো ভদ্রলোকের চক্ষু চড়কগাছ! থায়োকল একই সাথে সলিড ফুয়েলকে চমৎকার ভাবে একটা বড়ির মতো ঢ্যালায় বাইন্ড করে ফেললো, আর তারপর তার জ্বলনকেও স্টেবিলাইজ করতে সক্ষম হলো। এবং এই সব কিছুর সাথে সাথে নিজেও এক ধরনের জ্বালানীর মতো সম্পূর্ণ ভাবে জ্বলে গেল!!! এ রকম তিন তিনটে প্রবলেমের একটা সিঙ্গল সল্যুশন সেরেফ আকাশ থেকে পড়া... এ রকম কেলেঙ্কারি কান্ড কেউ কি কোনওদিন চক্ষেও দেখেছে? মানে ভেবে দেখুন, এই নিয়ে এই সালফারযুক্ত পলিমার আঠা তার আবিষ্কর্তাদের দ্বিতীয় বার চমকে দিলো। মনে হলো, জেট প্রপালশন ল্যাব যেন এই থায়োকলেরই খোঁজে ছিল এতদিন। যাকে বলে বগলমে ছোড়া, গাঁও মে ঢিন্ডোরা! হাতের পাশেই ছিলো বোতলটা, বার্টলে সাহেবের নজরেই পড়েনি এতদিন!!!

এর কিছুদিন পরে থায়োকল কর্পোরেশনের মার্কেটিং বিভাগের প্রধান কোম্পানীর ভাইস চেয়ারম্যান ক্রসবি সাহেবের অফিসে জরুরী ভিত্তিতে দেখা করতে এলেন। তিনি ক্রসবিকে চোখ গোল গোল করে জানালেন, প্যাসাডেনার একটি ল্যাবোরেটরি দিন নেই রাত নেই, কেবল বিপুল পরিমাণে থায়োকল সীল্যান্ট কিনে চলেছে বাজার থেকে। অত সীল্যান্ট দিয়ে হয়তো তাবৎ ক্যালিফোর্ণিয়ার যাবতীয় পাইপ সীল করে দেওয়া যায়। অথচ এই ল্যাব যে ওই পরিমাণ সীল্যান্ট দিয়ে কি করছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। এদিকে থায়োকলের সাপ্লাই দিতে দিতে স্থানীয় খুচরো ব্যবসায়ীরা হাঁপিয়ে উঠেছেন। তাঁরা সমানে ট্রেন্টনের ফ্যাক্টরিতে এত্তালা পাঠাচ্ছেন, মাল পাঠাও, তুরন্ত, জলদি জলদি, আবভি কে আবভি! ব্যাপারটা রহস্যজনক, বুঝলেন তো ক্রসবি সাহেব, লাগতা হ্যায় ... ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়!

ডাল মে কালা কি হে, এ তো দেখছি পুরো ডালটাই কালা! ব্যাপারটাকে তো কাল্টিভেট করতে হচ্ছে! সমস্ত কাজকর্ম ফেলে ক্রসবি সাহেব ছুটলেন জেপিএল ল্যাবের উদ্দেশ্যে। ক্যালটেকের তত্ত্বাবধানে চললেও, এই ল্যাব তখন যুদ্ধের জন্যে ক্ষেপণাস্ত্র বানানোর কাজে লিপ্ত। সুতরাং ল্যাবে প্রবেশ করার ছাড়পত্র পাওয়া বেশ ঝঞ্ঝাটের কাজ! কিন্তু ক্রসবি সাহেব ল্যাবের গেটে মিলিটারি পাহারা দেখেই কিছু একটা আন্দাজ করে নিলেন। পরে ল্যাবের বাইরে দুয়েকজন গবেষকের সাথে কথাবার্তা বলে যা বোঝার তা বুঝে নিলেন অল্প সময়েই। বুঝে নিয়ে আর সময় নষ্ট করলেন না তিনি, সোজা রওনা দিলেন ওয়াশিংটনের দিকে। সেখানে মিলিটারী বড় কর্তাদের দেখা করার অনুমতি চাইলেন তিনি। এবং কিমাশ্চর্যম! অনুমতি সাথে সাথেই পাওয়া গেল। সেইদিনই মিলিটারী অর্ডন্যান্স কোরের জেনেরালদের সাথে খোলাখুলি ভাবে কথা বললেন তিনি। 

এধরণের মামলায় মিলিটারী কর্তারা সাধারণত তুম-তানা-নানা করে কিছু সময় কাটান। তাঁদেরকে পাকড়াও করে কোন চুক্তিপত্রে সই করানো কোনও ছোটখাটো ব্যবসায়ীর পক্ষে খুব একটা সহজ কাজ নয়। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারী বড়কর্তারা এক কথায় ক্রসবির সমস্ত শর্তে রাজি হয়ে গেলেন। শুধু তাই-ই নয়, তাঁরা জানালেন, রকেট ফুয়েলের ওপর রিসার্চ চালানোর জন্যে থায়োকল কর্পোরেশনকে তাঁরা সরকারী খরচায় একটা রিসার্চ ল্যাবরেটরি বানিয়ে দিতে চান। এর জন্যে জায়গা, জমি, পরিবেশ সংরক্ষণ সার্টিফিকেট, ল্যাব টেকনিশিয়ান, এমনকি সদ্য পাশ করে বেরোনো এঞ্জিনীয়ারদের একটি আস্ত বাহিনীও তাঁরা জুটিয়ে দিতে পারেন, (আক্ষরিক অর্থেই) যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। এ তো মেঘ না চাইতেই জল!!! লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে রাজী হয়ে গেলেন ক্রসবি সাহেব।

তারপর কাজ শুরু হয়ে গেল, ওই যুদ্ধকালীন তৎপরতাতেই। এবং, এতদিনে থায়োকল কর্পোরেশনের কপাল ফিরে গেল। তাঁরা ব্যবসার লাইনটাই চেঞ্জ করে নিজেদের বানিয়ে ফেললেন রকেট এঞ্জিন বানানেওয়ালা কোম্পানী। নিউ জার্সি থেকে চাটিবাটি উঠিয়ে মেরিল্যান্ডের এলক নদীর পাড়ে এলক্টন শহরে নতুন ল্যাবোরেটরি এবং রিসার্চ ফ্যাসিলিটি খুলে ফেললেন। এবং একই সাথে অ্যালাবামার হান্টসভিলে শুরু হয়ে গেল তাঁদের নতুন প্রোডাকশন ফ্যাসিলিটি। ১৯৪৮ সালে এলক্টন ল্যাবরেটরির লাগোয়া প্ল্যান্টে কোম্পানীর তৈরি প্রথম সলিড ফুয়েল মোটর প্রস্তুত হলো, রকেট চালানোর জন্যে। ১৯৪৯ সালে পৃথিবীর প্রথম সলিড ফুয়েল মিসাইল সিস্টেম টিএক্স-১৮ ফ্যালকন তৈরি করে ফেললো থায়োকল কর্পোরেশন। তার কিছুদিন পরেই, অর্থাৎ ১৯৫০ সালে কোরিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়াতে থায়োকল কর্পোরেশন আর চোখে মুখে কিছু দেখার অবস্থায় থাকলো না, এমনই তাদের ব্যস্ততা। সেই ব্যস্ততা চললো ভিয়েতনাম যুদ্ধ জুড়েও। ইতিমধ্যে মিনিটম্যান-৩ মিসাইল তৈরির অর্ডার হাতে পাওয়া যাবে, এই আশায় কোম্পানী ইউটার ব্রিগহ্যাম সিটিতে তাদের একটা ঝকঝকে নতুন প্রোডাকশন প্ল্যান্টও বানিয়ে ফেললো। এরই সাথে তৈরি হলো নিকটবর্তী মরুভূমিতে তাদের রকেট এঞ্জিন টেস্ট ফ্যাসিলিটি।

সে যাই হোক, আমি এখানে থায়োকল কর্পোরেশনের ঠিকুজী কুষ্ঠি খুলে বসিনি। এইভাবে কোম্পানীর গুণগান করার জন্যে আমি তাঁদের থেকে একটা পয়সাও পাবো না। সুতরাং এঁদেরকে ছেড়ে আমি আমার কাজের কথায় চলে আসি। তার মানে, আমি কি এতক্ষণ ভ্যারেন্ডা ভাজছিলাম? হয়তো, কতকটা তাই...! তবে দেখুন, আমার ছোটবেলার থেকেই একটা ধারণা ছিলো, যে রকেট মানেই মহাকাশযান। সেই ধারণার পথ ধরেই এগিয়ে চলতে চলতে দেখতে পেলাম, ১৯৫৯ সালে থায়োকলের হান্টসভিল প্ল্যান্টে তৈরি হয় অ্যাটলাস রকেটের সাথে ব্যবহৃত ক্যাস্টর স্ট্রাপ-অন বুস্টার রকেট। এই অ্যাটলাস রকেটই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপগ্রহদের মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছে, মহাকাশচারীদের নিয়ে মারক্যুরি মহাকাশযানকে মহাশূণ্যে উড়িয়েছে। এবং, এই কাজে হাত পাকিয়ে নেওয়ার পরেই, ১৯৭৪ সালে থায়োকল হাতে পেল একটা বহু কাঙ্ক্ষিত অর্ডার। সেটা হলো নাসার স্পেস শাটল উৎক্ষেপণের জন্য সলিড রকেট বুস্টার, বা সংক্ষেপে এসআরবি বানানোর বরাত।

এই ব্যাপারে নাসার বিজ্ঞানীরা থায়োকলের টেকনিকাল টীমের সাথে একটা প্রাথমিক মিটিং করে ফেললেন। বুস্টার রকেটের সব রকম স্পেসিফিকেশন তাঁরা ধরিয়ে দিলেন থায়োকলের টীমের হাতে। থায়োকলের এঞ্জিনীয়াররা এবার এই কাজের খুঁটিনাটি, সম্ভাব্যতা, ইত্যাদি পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে শুরু করবেন। 

কিন্তু পরের মিটিংয়েই গন্ডগোল বেধে গেল। থায়োকলের দল জানালেন, এই বুস্টার রকেট এঞ্জিনের মাপের কিছু পরিবর্তন করতে হবে। নতুবা, এই অপরিবর্তিত মাপের এঞ্জিন তাঁরা তাঁদের ব্রিগহ্যাম সিটির প্ল্যান্টে ডেলিভারি দিতে পারবেন, কিন্তু ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল, যেখান থেকে স্পেস শাটল উৎক্ষেপণ হবে, সেখানে পৌঁছে দিতে পারবেন না। শুনে তো নাসার মাথায় হাত। এরকম তো কথা ছিলো না। নাসা তো সব রকম মালপত্রের ডেলিভারি তাঁদের নিজেদের বাড়ির উঠোনেই, মানে ব্যাকইয়ার্ডেই চান। এই মাপের এঞ্জিন হলে থায়োকলের অসুবিধেটা কোথায়, জানতে চাইলেন তাঁরা।

থায়োকল বললেন, অসুবিধেটা হলো, চার ফুট সাড়ে আট ইঞ্চি নিয়ে। অর্থাৎ, রেল লাইনের স্ট্যান্ডার্ড গেজ নিয়ে।

নাসা বললেন, ঝেড়ে কাসুন, মশাই, আমাদের বেশি ধানাই পানাই করার সময় নেই।

থায়োকল টীম জানালেন, আপনারা চান আপনাদের রকেট বুস্টার ষোল ফুট ব্যাসের হোক, কিন্তু অ্যামেরিকান রেলরোড লোডিং গেজের অনুদিত তালিকা অনুযায়ী, চার ফুট সাড়ে আট ইঞ্চি গেজের, অর্থাৎ স্ট্যান্ডার্ড গেজের রেল রোডের যে সর্বাধিক উচ্চতায় মাল বহন করার অনুমতি আছে, তা হলো বারো ফুট সাত ইঞ্চি। অতএব আপনাদের এই রকেট বুস্টার, যার উচ্চতা হবে ষোল ফুট, সেটা আমরা কেমন করে ট্রেনে করে আপনাদের কাছে, অর্থাৎ ফ্লোরিডায় পৌঁছে দেব? উচ্চতা ছাড়া, এ রকেট আড়েও তো আটকে যাবে। চওড়াই-তেও লাইনের পাশে সিগন্যাল ইত্যাদির ক্লীয়ারেন্স থাকবে না। এবং সবচেয়ে বড় কথা, রকি মাউন্টেন পার হবার সময় যে কটা টানেল পার করতে হবে, তার মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক টানেলেরই ওই পরিমাণ ক্লীয়ারেন্স থাকবে। এই হলো কথা... এবার সমস্যাটা আপনারা বুঝে নিন।

বোঝার কিছু নেই। অঙ্কটা আবার করে কষতে হবে, এবং বুস্টার রকেটের ব্যাস কমাতে হবে। কিচ্ছুটি করার নেই। নতুন করে রেললাইন পাততে মেলা সময় লাগবে। ততদিনে হয়তো প্রেসিডেন্ট বদলে যাবেন, কংগ্রেস বদলে যাবে, হাতে আসা গ্রান্ট হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। তার থেকে রকেটের ডিজাইন বদলে দেওয়া অনেক সোজা। উঠে পড়লেন নাসার বিশেষজ্ঞের দল। যাওয়ার আগে শুধু এক ভদ্রলোক থায়োকলের এক এঞ্জিনীয়ারকে এক পাশে টেনে এনে বললেন, আচ্ছা, বলতে পারেন, এই চার ফুট সাড়ে আট ইঞ্চির গেজটা স্ট্যান্ডার্ড গেজ হলো কি করে? মানে, এটা কে ঠিক করে দিয়েছে?

থায়োকলের তরুণ ইঞ্জিনীয়ার পড়ুয়া ছেলে। সহাস্যে বললেন, সে অনেক কথা!

নাসা বললেন, বলুন শুনি। আমি যাবো ক্যালিফোর্নিয়া, আমার ফ্লাইট বিকেলবেলা। সুতরাং, এই মুহূর্তে আমার হাতে কিছুটা নষ্ট করার মতো সময় আছে।

থায়োকল বললেন, এই দেশে রেল লাইন প্রথম বিছিয়েছেন ব্রিটিশ এক্সপ্যাট এঞ্জিনীয়াররা। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায়, যে তাঁরা নিজেদের দেশে যে গেজে অভ্যস্ত, সেই গেজই এখানে ব্যবহার করবেন।

নাসা জিগালেন, কিন্তু ব্রিটেনেই বা এই গেজ চালু হলো কেন?

থায়োকল বললেন, দেখুন, এ ব্যাপারে পাক্কা কিছু আমার জানা নেই। তবে একটা কানাঘুষো শুনেছি বটে আমাদের মেকানিকাল এঞ্জিনীয়ারিংয়ের ক্লাসে। 

নাসা বললেন, তাই শুনি!

থায়োকল বললেন, ব্রিটেন এককালে রোমানদের দখলে ছিলো। রোমানরা ব্রিটেনে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার সময়ে ঘোড়ায় টানা যুদ্ধের রথ ব্যবহার করতো। সেই রথের চাকার দাগ কেটে বসতো মাটিতে। এক নাগাড়ে ইংল্যান্ডের গ্রামে গঞ্জে এই রোমান রথযাত্রা চলতে চলতে এমন অবস্থা হয়েছিলো, যে সব পথের মধ্যে দুটো চাকার ভারে দুটো গভীর দাগের সৃষ্টি হয়ে যেত ...

নাসা বললেন, হ্যাঁ জানি! ওকে বলে রাট ...

থায়োকল বললেন, বাধ্য হয়ে ব্রিটেনে সব ঘোড়ার গাড়ির চাকাও ওই রোমান রথের চাকার মাপে তৈরি করতে হলো। কারণ দুই চাকার মধ্যে দূরত্ব যদি ওই রথের চাকার সাথে খাপে খাপে না মেলে, তাহলে গাড়ির একদিকের চাকা গর্তে পড়ে গেলে এবং অন্যদিকের চাকা ওপরে থাকলে মূহুর্তের মধ্যে দুটো চাকাই মট মট করে ভেঙে যাবে।

নাসা বললেন, বুঝেছি। কিন্তু তার সাথে রেলের চাকার যোগ কোথায়?

থায়োকল বললেন, দেখুন, ওই ঘোড়ার গাড়ির অ্যক্সল বানানোর জন্যে যে জিগ, মানে মাপজোক করার ফ্রেম ব্যবহার করা হতো, প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রাম লাইন পাতার সময়েও সেই জিগ এবং যন্ত্রপাতিগুলোই ব্যবহার করা হয়েছিলো। রেল লাইনের গেজও সেই ট্রাম লাইনের অনুকরণেই তৈরি হয়েছিলো। এই কারণে... শুধু ব্রিটেনেই নয়, পশ্চিম এবং দক্ষিণ ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই রেলের গেজ এই রোমানদের রথের চাকার মাপে তৈরি।

নাসা বললেন, বাপরে, কি দাপট! তা, একটা কথা বুঝলাম না, রোমানরাই বা এইরকম একটা অদ্ভুত সংখ্যায় কি করে উপনীত হলো।

খুব গুরুগম্ভীর ভাবে হাসি চেপে থায়োকল বললেন, ওটা হলো দুটো রোমান যুদ্ধাশ্বের সম্মিলিত নিতম্বের মাপ!

নাসা চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ?.

থায়োকল বললেন, আজ্ঞে, সেইরকমই তো শুনেছি। মানে ঘোড়া তো অনেক মাপেরই হয়, হতেই পারে। কিন্তু যুদ্ধের রথ টানার জন্যে যখন ঘোড়া বাছাই করা হতো, তখন তাদের নিতম্বের মাপটাই ছিলো কোয়ালিফাইং ফ্যাক্টর। রোম সাম্রাজ্য ভীষণ নিয়ম মেনে চলতো। প্রত্যেকটা চ্যারিয়ট এক মাপের হবে, তাদের চাকার গেজ এক মাপের হবে, চ্যারিয়ট টানার জন্যে নির্বাচিত ঘোড়ারা প্রত্যেকে এক মাপের হবে ... অবশ্য রথের দুটো ঘোড়া অসমান মাপের হলে সে রথ কন্ট্রোলে রাখাও মুশকিল ...

অনেকক্ষণ ধরে এই তথ্যটা হজম করে নাসা বললেন, পবিত্র হাগু! পৃথিবীর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উন্নত ব্যোমযানের রকেট এঞ্জিনের মাপ ঠিক করে দিলো প্রাচীন রোমান ঘোড়ার ইয়ে (মানে উনি যা বলেছিলেন, তার আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় “ঘোড়ার গাধা”)!

সংক্ষিপ্ত অভিযোজন : কলকাতার ট্রামলাইনের গেজও কিন্তু ওই চার ফুট সাড়ে আট ইঞ্চি। আমি বলছি বলে সেরেফ মুখের কথায় বিশ্বাস করে নিন। টেপ নিয়ে রাস্তার মধ্যে আবার যেন মাপতে বসবেন না! আর, ওই কলকাতায় যখন ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলতো, তখন কিছু দিন দুই ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলেছিলো (সুরেন বাঁড়ুজ্জে রোডের বোর্ণ অ্যান্ড শেফার্ডের ফোটোগ্রাফির দোকানে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ আছে, নেট থেকে কপি করে সেরকম দুটো ছবি এখানে দিলাম)। পরে, চড়নদার লোকজন তেমন না হওয়ায়, এক ঘোড়ার ট্রাম দিয়ে চেষ্টা করে দেখা হয়, এমনকি গেজ ছোট করে মিটার গেজ করেও দেখা হয়েছিলো। কিন্তু তেমন সুবিধে হয়নি। শেষে, ঘোড়ার পাট তুলে দিয়ে ওয়েস্টিংহাউজ ইলেকট্রিক কোম্পানী এই শহরে ট্রামের বৈদ্যুতিকরণ করেছিলেন। তারপর থেকে ট্রাম আজও চলছে কলকাতার বুকে, সেই চারফুট সাড়ে আট ইঞ্চি গেজের লাইন ধরে…

1 comments:

1

প্রবন্ধ - গৌতম মিত্র

Posted in

প্রবন্ধ


নতুন জীবন : বইয়ের গোলকধাঁধা ও গোলকধাঁর বই
গৌতম মিত্র


ইস্তাম্বুল শহর। মধ্যরাত। বহুক্ষণ হল নিঃসঙ্গ ফেরিওয়ালা বাড়ি ফিরে গেছে। মালবাহী ট্রেন বিষাদ মাখানো রেললাইনে শব্দ তুলে দূরে মিলিয়ে গেল। ভেজা ও শূন্য পথের আলোয় যেন হ্যূজ্যূন মিশে আছে। তুরস্কের এই 'হ্যূজ্যূন' বিষণ্ণতা ও নস্টালজিয়ার এক মিশেল।

ওসমান নামের কুড়ি-বাইশ বছরের একজন তরুণ, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র, রেলচাকুরে বাবা বহুদিন হল মারা গেছে, আর মা সদ্য টিভি বন্ধ করে ঘুমাতে গেল।

ঠিক এমন একটা মুহূর্তে ওসমান নিজের কামারায় একটি বই দ্বারা আক্রান্ত।

হ্যাঁ! এমনভাবে আক্রান্ত হল যে তার অতীত দ্রুত মুছে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় দিশেহারা। এক দ্যুতিময় আলো বইটির পৃষ্ঠা থেকে ধেয়ে এসে ওসমানের চৈতন্যকে গ্রাস করছে। আন্দোলিত সেই আলোয় ওসমানের চোখের সামনে থেকে তখন উড়ে যাচ্ছে রংচটা ঘর, উন্মত্ত যান, আবছা অক্ষর, মৃত শহর, হারানো জীবন ও অপদেবতা। পরিত্রাণহীন এক বিধুর ভ্রমণে উত্তমপুরুষে কথক নায়ক ওসমানকে এবার বেরিয়ে পড়তে হবে।

এভাবেই তুরস্কের নোবেলজয়ী লেখক ওরহান পামুকের পঞ্চম উপন্যাস 'Yeni Hayat' বা 'নতুন জীবন' শুরু হচ্ছে। তুরস্কের সাহিত্যের ইতিহাসে দ্রুত বিক্রির রেকর্ডধারী যে বইটিকে আজও কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। প্রথমেই নামটি নিয়ে ধাঁধা লাগে। একজন উৎসুক পাঠক প্রশ্নটি করেই ফেলেন পামুককে। দান্তের 'Vita Nouva' বা 'নতুন জীবন'-এর সঙ্গে কোনও আত্মীয়তা আছে বইটির? উত্তরে পামুক বলেন, 'দান্তের কাছে বিষয়টি ছিল কীভাবে তিনি প্রেমে পড়েছেন আর তার সঙ্গে প্রণয় পরিনতির আত্মজৈবনিক বিষয়বিচ্যুতি। ...আর আমার বইটি প্রেমের মধ্য দিয়ে পরিণামদর্শী হয়ে ওঠার প্রয়াস।'

এরপর স্বভাবতই দান্তের বিয়াত্রিচের সঙ্গে পামুকের 'নতুন জীবন'-এর নায়িকা জানান(হৃদয়েশ্বরী)-র তুলনার প্রসঙ্গটি ওঠে। পামুক আগের মতোই শান্ত। শুধু অবাধ্য চুল সামলে স্মিত হাসিমুখে উত্তর দেন, 'হ্যাঁ বিয়াত্রিচের প্রতিরূপ জানান, তবে বিয়াত্রিচের থেকে একটু কম সরলমতি, একটু কম আদর্শবান আমার জানান।' আলোচনার শেষে স্ব স্ব দেশের, ধর্মীয় উদ্বেগের ভিন্নতার কথা জানাতে পামুক ভোলেন না।

তবে পামুক তো আর ১৯৯৬-কে ১২৯০-তে পৌঁছে দিতে 'নতুন জীবন' লেখেন না। বরং তাঁর লেখায় ১২৯০-এর সকল আর্তি ও সংকট ১৯৯৬-তে এসে দাঁড়ায়। সুনিপুণ এক অন্তর্বয়নে তিনি তাঁর উত্তর আধুনিক আখ্যান বোনেন। ১৬ টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত ২৯৬ পৃষ্ঠার বইটির জুড়ি বিশ্বসাহিত্যে দুর্লভ। প্রাচী ও প্রতীচী, সময় ও সময়হীনতা, গতি ও মন্থরতা বইটির পরতে পরতে। দান্তের মতো পাশ্চাত্যের এক মহাকবিকে আশ্রয় করে এই রচনা প্রাচ্যের একজন তরুণ প্রতিভাবান লেখকের তর্পণও বটে।

বইকে বিষয় করে বই লেখার সূচনা সেই বাইবেলের সময় থেকে। পাশ্চাত্যের চিন্তা-চেতনায় বই রীতিমত একটি চরিত্র। মালার্মে, প্রুস্ত, বোর্খেস, কালভিনো থেকে শুরু করে ভলটার বেনিয়ামিন, এডমণ্ড জেবস, দেরিদা অবধি এই ভাবনার সহচর। পামুকও এর উত্তরসূরি। ওসমান যেমন বইটির প্রভাবে বদলে যায়, বইটিও তেমন ওসমানের ঈক্ষণ দ্বারা পরিমার্জিত হয়। বাস্তব ও কল্পনা, কোনওটিই ঠাহর করতে না পেরে পাঠক দিশেহারা।

কী অমোঘ আর হিমহিম এই উচ্চারণ:

'তুমি ভাবছ যে তুমি বইটি পড়ছ, আসলে তুমি বইটিকে পুনর্লিখন করছ মাত্র। বেশিরভাগ মানুষই নতুন জীবন বা নতুন জগতকে বরন করতে জানে না। ফলত তারা বইয়ের লেখককে হত্যা করে।'

'নতুন জীবন' উপন্যাসে কোনও একরৈখিক গল্প নেই। সময় এখানে বারবার টাল খায়। কখনও অতীত তুবড়ে গিয়ে ভবিষ্যতে সিঁধিয়েছে আবার কখনও ভবিষ্যৎ এসে আছড়ে পড়েছে বর্তমানে। এ এক নিরুপম যাত্রা। আততায়ীর গুলিতে এইমাত্র মৃত্যু হল যার, সে আদৌ মৃত কিনা আন্দাজ করা যায় না। সমস্ত চরিত্রই এখানে সান্দ্র। যেন যে কোনো মুহূর্তে গলে যাবে। ডিফর্মড হয়ে যাবে।

তো সেই না-গল্পের গল্পটা কী? গল্পটা এই। 'নতুন জীবন' নামের একটি বই ওসমানের জীবন বদলে দিয়েছে। বইটি যেন ওসমানকে নিয়েই লেখা। বইটির প্রতিটি অক্ষর যেন ওসমানের সত্তার নির্মাণ। বইটি এতদূর অবধি আলোকিত যে ওসমান নিজের মত্যু অবধি দেখতে পায়। অবশ্য বই পড়ার অভিজ্ঞতা ওসমানের কাছে নতুন নয়। ছোটবেলায় বই পড়তে পড়তে 'সমাপ্ত' শব্দটিতে পৌঁছে ওসমানের মনে হত, এ যেন একটা দেশের নিষ্ক্রমণপথ, যা সে কোনওদিনই পেরোতে চায় না। বইয়ের জগতকে বাস্তব ভেবে নেওয়া তার ছোটবেলাকার অভ্যাস।

কিন্তু শুধু বই তো নয়। আমাদের ওসমান যে প্রেমে পড়েছে। কলেজ ক্যান্টিনে একটি মেয়ের হাতে 'নতুন জীবন' বইটি দেখতে পেয়ে আশ্চর্য ভাবে বাড়ি ফেরার পথে পুরনো বইয়ের দোকানে সে 'নতুন জীবন' বইটি পেয়ে যায়। এরপর ওসমান মেয়েটিকে খুঁজে বেড়ায়। দেখাও মেলে একদিন। জানান নামের মেয়েটি একই কলেজে স্থপতিবিদ্যার ছাত্রী।

মেয়েটিকে সে 'নতুন জীবন' পাঠের শিহরণের কথা জানায়। জানতে চায় বইটির মধ্য দিয়ে মেয়েটির যাত্রা ও ফিরে আসবার অভিজ্ঞতার কথা। উত্তরে জানান নামের সেই মেয়েটি জানায়, বইটির অন্দরমহলে পৌঁছানোর জন্য কী কী করতে পারবে ওসমান। মৃত্যুবরণ করাটাও তো তখন ওসমানের কাছে সামান্য ঘটনা।

মেয়েটি ওসমানকে মেহমেত নামের এক যুবকের কথা বলে যে 'নতুন জীবন' বইটির মধ্য দিয়ে যাত্রা করে ফিরে এসেছে। এই মেহমেতের প্রতি জানানের দুর্বলতা আছে ভেবে ওসমান ভেতরে ভেতরে পুড়ে খাক হয়। আর কী আশ্চর্য, ওসমানের সঙ্গে পরিচয়ের দিনটিতেই আততায়ীর গুলিতে মেহমেত মারা গেল। আর জানানকেও সাময়িকভাবে হারিয়ে ফেলল ওসমান।

দিশেহারা ওসমান এক নতুন জীবনের সন্ধানে বাস ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ল। তুরস্কের মফস্বল শহর পথে ছুটে চলে সেই বাস। পথ দুর্ঘটনায় বারবার যাত্রা বিঘ্নিত হয়। তবু বাস বদল করে হলেও ওসমান যাত্রা অব্যাহত রাখে। আবারও এক দুর্বিপাকেই জানানের সঙ্গে দেখা হয় ওসমানের। গ্যুজ্যুল নামের এক শহরে পৌঁছায় তারা। স্বামী-স্ত্রী সাজতে তাদের নাম এখন অলি কারা ও এফসুন কারা।

দেখা হয় ডক্টর ফাইন-এর সঙ্গে। মৃত মেহমেত-এর বাবা সে। জানতে পারে মেহমেতের আরেকটি নাম নাহিত। নাহিতের অর্থ শুকতারা। জানানের চোখ জলে চিকচিক করে। অদ্ভুত মানুষ এই ডক্টর ফাইন। চার ছেলের নাম রেখেছে চারটি বিখ্যাত ঘড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানির নামে। জেনিথ, সেইকো, মোভাদো ও ওমেগা। তার বিশ্বাস মুসলিম দুনিয়ার মতো ঘড়িকে আর কেউ চেনে না। দিনে পাঁচবার নামাজে বসবার কথা এই ঘড়িই তো জানান দেয়। পাশ্চাত্যে ঘড়ি শুধু ছুটে চলবার হিসেব রাখে। ডক্টর ফাইন আরও মনে করে, মুদ্রিত অক্ষর একটি জাতির সম্মিলিত স্মৃতি-লাইব্রেরিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

এরপর ওসমানকে আমরা আবিষ্কার করি বিবাহিত রূপে। এক কন্যার পিতা সে। ঘুরতে ঘুরতে ওসমান একদিন বাবার মৃত বন্ধু রিফকি কাকার বাড়ি চলে যায়। এই রিফকি কাকাই ছোটবেলায় ওসমানকে গল্প শোনাত, ছোটদের জন্য গল্পের বই লিখত। পেশায় রেলের উকিল। এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে রিফকি কাকার বিধবা স্ত্রী রতিবে কাকীর সাহায্যে আবিষ্কার হল, 'নতুন জীবন'-এর লেখক বড়োদের জন্য একটিমাত্র বইয়ের লেখক ছদ্মনামের আড়ালে রিফকি কাকা।

ওসমান এবার রিফকি কাকার পড়াশোনার টেবিল তন্নতন্ন করে হাতড়াতে লাগল। যদি 'নতুন জীবন'-এর জীবাশ্ম কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়। বাড়ি ফেরার পথে রিফকি কাকার পড়ার টেবিল থেকে তেত্রিশটি বই ধার নিয়ে আসে। 'নতুন জীবন' লেখার সময় রিফকি কাকা যে এই বইগুলির মধ্যেই ডুবে ছিল।

শুরু হয় ওসমানের রাত জেগে বই পড়া। বইগুলোর পাতায় পাতায় কাকার হাতের মার্জিনের দাগ। কী বই? কী বই? দান্তের 'নতুন জীবন', রিলকের 'দুইনো এলিজি', ইবন অ্যাররির 'দ্য সীলস্ অফ উইজডম ', জুল ভের্নের 'ফামিল-সঁ-নো' ইত্যাদি। বইগুলোর সঙ্গে 'নতুন জীবন'-এর যোগসূত্রটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে ওসমানের কাছে। বিশেষত দান্তের 'নতুন জীবন' -এর মার্কিং করা এই পংক্তিটিতে চোখ আটকে যায় ওসমানের:

'আমি জীবনের সেই প্রান্তে পা ফেলেছি যেখানে প্রত্যাবর্তনের আশা করে কেউ যায় না।'

শেষবারের মতো ওসমান আবারও পথে নামে। আবারও ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। মনে প্রশ্নের ঢেউ।

জীবন কী? সময়ের একটি পর্যায়? সময় কী? একটি দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা কী? একটি জীবন। নতুন জীবন।

উল্টো দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের আলো ওসমানের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এই আলোর সঙ্গে বইয়ের সেই আলোর আশ্চর্য মিল। কিছুক্ষণের মধ্যে ওসমান এক নতুন জীবনে পৌঁছে যাবে। বুঝতে পারে একেই তবে মৃত্যু বলে। তবু সে বাড়ি ফিরতে চায়। এই মুহূর্তে মরবার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। নতুন জীবন পেরিয়ে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই তার।

উপন্যাস শেষ হয়। ভ্রমণও। কিন্তু পাঠকের আর এক যাত্রা শুরু হয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে। উপন্যাসটির আত্মতা, ধমনী, মৃত্যু ও প্রেম কখন যেন চারিয়ে যায় পাঠক সত্তায়। ওসমান বা পামুকের(হ্যাঁ! এটি পামুকের আত্মজীবনীই) বইয়ের সন্ধানে পাঠকও ডানা দেয়। যে দেবদূতটিকে উপন্যাসে বারবার দেখা যায়, ঘুরে ঘুরে কথা কয়, সে যে আর কেউ নয়, স্বয়ং পাঠক।

পামুক লেখক ও পাঠকের মাঝখানের কাঁটাতারটি হটাতে সক্ষম হয়েছেন। আমরাও ওসমানের মতো কিংবা পামুকের মতো বইয়ের শেষে 'সমাপ্ত' দেখতে নারাজ।

1 comments:

0

প্রবন্ধ - জিললুর রহমান

Posted in

প্রবন্ধ


আমি যাহা জানি নাই চিনি নাই
জিললুর রহমান


তিনি আমাকে অকস্মাৎ গুরু বলিয়া সম্বোধন করিলেন। জানি না কখন কোন্ মনের ভুলে আমি তাহাকে কোনও কিছু জ্ঞান দিবার অপচেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হইয়াছি কিনা। যতটুকু আহমদ ছফা পড়িয়া জানিয়াছি ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বহিতে আব্দুর রাজ্জাক মহাশয় তাঁহাকে জীবনের শিক্ষাই দান করিয়াছিলেন। অথচ আমার ক্ষেত্রে তিনি আবদার করিলেন মৃত্যু বিষয়ে গদ্য লিখিবার জন্য।

হায়! আমি যাহারে জানি নাই, চিনি নাই, তাহারে কী প্রকারে বিবৃত করিব মাননীয় প্রস্তাবক সমীপেষু? তবু তিনি চিন্তাচেতনা বা কাজ হইতে বিরত তো হইবেনই না, বরং চতুর্গুণ বেগে ও আবেগে আপ্লুত হইয়া মৃত্যু পানে ধাবিত হইবেন। বলুন তো, এই বিস্তীর্ণ জগতে এমন কে আছে যে মৃত্যুর পানে ধাবিত হইতেছে না? এযাবৎ জীবজগতে অবিনশ্বর কে হইতে পারিয়াছে নিজের চেষ্টায়? তবে হেমলক বিষ পানে বাধ্য করিয়া তৎকালে সক্রেটিস নাম্নী এক বেয়াদব যুবাকে অমর করিয়া রাখিল সেদিনের গ্রিকসমাজ। ক্রুশে বিদ্ধ করিয়া যিশুকেও অবিনশ্বর করিয়া গিয়াছে। কোপার্নিকাস ব্রুনো গ্যালিলিও-র কথাই বা বাদ যাইবে কেন? তাহা হইলে কী অমর হইবার সঠিক পথ সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণ করিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া? অবস্থা দৃষ্টে তাহাই প্রতিপাদ্য।

সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সক্রেটিস মহাশয় মেঘমন্দ্রস্বরে উচ্চারণ করিয়াছিলেন “I to die, you to live, which is better only God knows।” আজিকার দিনে আর অবিদিত নাই যে সক্রেটিস মরিয়া বাঁচিল। তবু আমি দেখিতে পাই, অশীতিপর রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই মরিতে চাহেন নাই। মৃত্যু তাঁহার জীবনটাকে আলুথালু করিয়া দিবার পরেও একের পরে এক মৃত্যুর মিছিলের পশ্চাদ্ধাবন করিতে করিতে তিনি উচ্চারণ করেন – “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।” অথচ যৌবনে একদা তিনিই উচ্চারণ করিয়াছিলেন “ওরে মোর মূঢ় মেয়ে / কে রে তুই, কোথা হতে কি শকতি পেয়ে / কহিলি এমন কথা এত স্পর্ধা ভরে –/ যেতে আমি দিব না তোমায়……” এই চরাচরে হেন গর্ব কথা বলা নিতান্তই মূঢ়তার সামিল বৈকি! তবুও প্রতিদিন আমাদের সম্মুখে আসিয়া যে মৃত্যু আমাদের চারিপাশ শূন্য করিয়া হৃদয়ের সকল বন্ধন ছিন্ন করিয়া লইয়া যায়, তাহারেই আমাদের পরম আরাধ্য মানিতে হইবে। তাই যৌবনে রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিকতায় আকীর্ণ হইয়া বলিয়াছিলেন “মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান।” কিন্তু কালক্রমে আমরা দেখিতে পাইলাম রবীন্দ্রনাথ সেই জীবনদেবতাজ্ঞানে মৃত্যুরে শুধাইতেছেন – “আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে / হে সুন্দরী? / বলো কোন্ পার ভিড়িবে তোমার / সোনার তরী/ …… বলো দেখি মোরে, শুধাই তোমায় / অপরিচিতা - / ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কুলে / দিনের চিতা, / ঝলিতেছে জল তরল অনল, / গলিয়া পড়িছে অম্বরতল, / দিক বধূ যেন ছলছল আঁখি / অশ্রুজলে, / হোথায় কি আছে আলয় তোমার…” (নিরুদ্দেশ যাত্রী)

তাই বলিতেছি, এই বাঙ্গালা মুল্লুকের সর্বজন সম্মানিত ঋষিতুল্য কবি যেখানে নানা ছলে মৃত্যুকে ডাকিয়াও কোনও কুলকিনারা করিতে পারিলেন না, সেইখানে আমি কোন দর্পে এমন ঘোষণা দিয়া মৃত্যু লইয়া বাতচিত করিতে ব্যাপৃত হইব? মৃত্যু সে স্বাভাবিকভাবে কিংবা অস্বাভাবিকভাবে যেমত-প্রকারেই আসুক না কেন, জীবন নাটকের দৃশ্যপট হইতে আপনাকে গাত্রোত্থান করিতেই হইবে। ইহার পরেও যদি আপনি অবিনশ্বর হইয়া মানুষের মগজ শাসন করিয়া থাকেন তো বুঝিতে হইবে আপনি জীবৎকালে মহৎকর্ম করিয়া গিয়াছেন। যেমন সক্রেটিস, যিশু, গ্যালিলিও, ইত্যাকার কত কত নাম। তবে মনে রাখিতে হইবে, মৃত্যু আপনার আসিবেই। যদিও জনগোষ্ঠির একাংশ বিশ্বাস করিয়া থাকেন যে যুধিষ্ঠির মৃত্যুর সহিত সাক্ষাৎ না করিয়াই স্বর্গে পদার্পন করিয়াছেন, তবে তাহার স্বপক্ষে কেবল এক কল্পনা-প্রবণ মহাঋষির রচিত কিতাব ভিন্ন আর কোন প্রমাণ মেলে না। জনগোষ্ঠীর আর এক অংশ ইহাও বিশ্বাস করিয়া থাকে যে, ক্রুশে ঝুলানোর কালে অতীন্দ্রিয় উপায়ে যিশুকে জীবিতাবস্থায় স্বর্গে তুলিয়া লইয়া যাওয়া হইয়াছে, এবং পুনরায় তাঁহাকে ধরাধামে ফেরত পাঠানো হইবে। ইহার সপক্ষেও বিশ্বাসীদের কিতাব ভিন্ন আর কোন প্রমাণ কেহ উপস্থিত করিতে পারেন নাই। তাই, আমরা দেখি, পৃথিবীর মানুষ যে প্রকারে স্বর্গে যাইতে ইচ্ছুক, সেই গতিতে মৃত্যুর সম্মুখে হাজির হইতে ইচ্ছুক নহে। আর এমতও দেখি না যে, মৃত্যুভয়ে তাহারা সৎকর্মে প্রবৃত্ত হইয়াছে। তবে কি তাহারা মৃত্যু-পরবর্তী জীবন বিষয়ে সংশয়াকুল? যাহার হাতে নাতে প্রমাণ নাই, তাহাতে সংশয় স্বাভাবিক বৈকি! যে জীবন দোয়েলের শালিকের শামুকের ঝিনুকের মানুষের — সে জীবন চরম সত্য। তাই জীবনের প্রতি মায়া, স্বর্গের শত প্রলোভনেও মানুষ ত্যাগ করিতে পারিল না। আমিও না।

তবু প্রস্তাবক সমীপেষু, দুইচারিখানি কথা সাধারণ সকলের মতো আমার মগজেও উদিত হইতেছে আপনার প্রণোদনা হেতু। কেননা আমিও মরিতে চাহিনা – তাহা ভুবন সুন্দর অথবা অসুন্দর যেমনই হউকনা কেন। শৈশব কাল হইতে পরজগতের স্বর্গ-সৌন্দর্যের বর্ণনা এত শুনিয়া আসিয়াছি যে, তেমন করিয়া যদি এই ভূপৃষ্ঠের বর্ণনা শুনিতে পাইতাম, তবে ভূগোল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার জন্য এত হেঁচকাহেঁচকি করিতে হইত না।

তারপর, বর্ণমালা শিখিবার আগেই আমাদের শিশুমনে আত্মা প্রবেশ করিল। অর্থাৎ আমাদের জানানো হইল যে, আমাদের শরীরে আত্মা বলিয়া একটি অপদার্থ অবস্থান করিয়া থাকে, যাহা হইতে-পারে আলো বা নূরের তৈয়ারী। আর রাক্ষসবৎ কোনও স্বর্গীয় দূত একদিন আসিয়া আমাদের শরীর হইতে এই আলো উৎপাটন করিয়া লইয়া গেলে “থাকে শুধু অন্ধকার”। তবে মুখোমুখি বসিবার জন্য কোনও বনলতা সেনের গ্যারান্টি না পাইয়া, কিছুতেই এই নূর উৎপাটনে আগ্রহ জাগে নাই আশৈশব। যদিও তেমন তেমন যৌবনবতী রূপসীর প্রলোভন নিত্য শুনিয়া আসিতেছি, কিন্তু তাহা সৎকর্মের সহিত শর্তসাপেক্ষ। অতএব, আমি বাঁচিতে চাহি যতটুকু পর্যন্ত পারি। আমি চলৎশক্তি রহিত হইয়া পড়িলেও দুইচক্ষু উন্মিলিত করিয়া যেন পৃথিবীর রূপ দেখিতে পাই। আমার পরজন্মে “হয়তো মানুষ নয়, শংখচিল শালিকের বেশে, এই বাংলায়” পুনরায় ফিরিয়া আসিবারও অভিপ্রায় হয় না। কারণ তাহার নিশ্চয়তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি একইরকমভাবে দুর্বল।

পর সমাচার এই যে, অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি নামক বিষয়গুলো নানান গবেষণা সম্পন্ন করিয়াও আত্মার জন্য কোনও ফোকর, কুঠুরী বা প্রকোষ্ঠ খুঁজিয়া পায় নাই। অতএব, এইসব কল্প কথায় মজিয়া সবেধন নীলমনি একখানি স্বর্ণালী জীবন আমি বেহুদা বিনষ্ট করিতে চাহি না। কিন্তু কথা হইল, আমি চাহি বা না চাহি, তিনি আসিবেন। অর্থাৎ একদিন ভবলীলা সাঙ্গ হইবে। আমি না চাহিলেও এখানে মৃত্যুর সকল ব্যবস্থাই পাকা হইয়া আছে। বরং মৃত্যুর এত আয়োজন একপাশে ঠেলিয়া রাখিয়া কী প্রকারে জীবনের পঞ্চাশটি বৎসর পার করিয়া দিয়া এখনও টিকিয়া আছি, তাহা এক বিপুল বিস্ময়। কারণ, অস্বাভাবিক মৃত্যু বিশ্বময় প্রাদুর্ভাবের মত ছড়াইয়া আছে। একটি ধর্মগ্রন্থ মতে, পৃথিবীর প্রথম মৃত্যু হত্যাকাণ্ড — কাবিল কর্তৃক হাবিলের। ইহা ছাড়াও রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডেসিসহ সকল প্রাচীন গ্রন্থই যুদ্ধ ও হত্যার স্বাক্ষর রাখিয়া গিয়াছে। আর এখনও বিশ্বময় যুদ্ধ ও হত্যা সর্বত্র জীবন কাড়িয়া লইতেছে। এইখানে প্রেমের জন্য হত্যা, ক্ষমতার জন্য হত্যা, জমির জন্য হত্যা, মর্যাদার জন্য হত্যা — ইত্যাকার নানাবিধ কারণ, অপমৃত্যুর কারণ হইয়া জীবনের সহিত টেক্কা দিয়া টিকিয়া আছে। আবার বিজ্ঞানের উন্নতির কারণ হেতু দুর্ঘটনার কবলে পড়িয়া মৃত্যু ঘটিতেছে — যেমন, উড়োজাহাজ, রেলগাড়ি, বা বাস ট্রাক দুর্ঘটনা নিত্য কাড়িয়া লইতেছে শতশত প্রাণ। আবার রোগ-বালাই — ঝড় — জলোচ্ছ্বাস — টর্নেডো ইত্যাদিও কোন অংশে কম যায় না। ইদানীং বন্যা জলোচ্ছ্বাস হইতে সৎ মানুষদের উদ্ধার কল্পে নূহের নৌকারও সন্ধান মিলিতেছে না। তবু জীবন চলিয়া যাইতেছে জীবনের নিয়মে।

তাহার পরও, একদিন ইহার দর্শন তো মিলিবেই। আমাদিগের মতো অতি নগন্য সাধারণ মানুষদের তো আর জাতিসংঘ গ্রহণ করিবে না, আমাদের শেষ আশ্রয় এই মৃত্যুই। তবু ভয়, এত ভয়, যে তাহার নাম উচ্চারণ করিলেও গায়ের আড়াইখানি কেশ ঝরিয়া পড়িয়া যায়। না জানি এই রচনা শেষ করিতে করিতে কত কেশই না ঝরিয়া পড়িবে। আমি তো অন্ধকারকে বড়ো ভয় করি। আমি জানি, ভূত বলিয়া কিছু নাই। বিশ্বাসও করি, তবু অন্ধকারে যেন গা ছমছম করিয়া উঠে। অন্ধকার পথে হাঁটিয়া যাইবার কালে কিংবা অন্ধকারে বসিয়া থাকিবার কালে মৃত্যু যেন আমাকে আলতো ছুঁইয়া দিয়া যায়। তাহার শীতল হস্ত আমার কন্ঠ রোধ করিয়া ধরে, আমি হাঁসফাঁস করিয়া উঠি। সর্বাংগ ঘর্মাক্ত হইয়া উঠে। বিজ্ঞানের ছাত্র হইয়াও, মার্ক্সবাদের ভক্ত হইয়াও, কুসংস্কার না মানা সত্ত্বেও যতটুকু মনে পড়িয়াছিল দোয়া দরুদ পড়িবার চেষ্টা করিতে থাকি। এমন একটি কাপুরুষ-সদৃশ ব্যক্তি কী করিয়া মৃত্যু বিষয়ে দুই-চারিখানি কথা বলিতে পারিবে তাহা কিছুতেই বোধগম্য নয়।

আমার গ্রামে এক প্রপিতামহের কবর দেখাইয়া আমার বাবা একদিন বলিয়াছিলেন, তাঁহার এই পূর্বপুরুষ জীবদ্দশায় কবর খোঁড়াইয়া তাহাতে রাত্রি বাস করিতেন এবং কুরআন তিলাওয়াত করিতেন। আমি এখনও তাঁহার অমিত সাহসে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠি। স্থানীয় জনগন এখনও তাঁহার সেই কর্মের সম্মান দেখাইয়া প্রতিদিন জেয়ারত করিয়া যায়। আমিও সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি তাঁহার সাহস ও সাধনাকে। কিন্তু নিজেকে কখনও সেই কবরে বসাইয়া বা শোয়াইয়া ভাবিতে গেলে হৃদপিণ্ডের দুই-একটি স্পন্দন আপনা হইতে বন্ধ হইয়া পড়ে।

তবু আমি তাহার দেখা পাইয়াছিলাম। একবার অনেক বছর আগে, যখন বগালেক-কেওক্রাডাং পদব্রজে যাত্রা করা ছাড়া ভিন্ন উপায় ছিলো না, তখন সেখানে বর্ষায় ভেঙে যাওয়া পর্বতের খাড়া দেয়ালের খাঁজ দিয়া পুলসেরাত সদৃশ্য এক পথ পাড়ি দিতেছিলাম। মাঝপথে আসিয়া যখন এদিক ওদিক কোনও দিকে যাইতে পারিতেছিলাম না, খাড়া নীচে — বহু নীচে ঝিরির শব্দ পর্যন্ত শোনা যাইতেছিল না, তখন হঠাৎ চক্ষু মুদিয়া আসিল, হস্ত-পদ কম্পিত হইল, কেবল স্ত্রী-কন্যার চেহারা ভাসিয়া উঠিল, আর মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম “হায়, এ আমি কী করিলাম, বউ-বাচ্চাকে একটা গতি না করিয়া এইভাবে তিরোহিত হইব?” আশ্চর্যের বিষয়, এমন ভয় জীবনে এর আগে না পাইলেও, একবারের জন্যও কোনও দোয়াদরুদ মনে আসিল না। না-ফরমানদের হয়তো এমনই ঘটিয়া থাকে।

আর একবার যখন আমার হাঁটুর প্যাটেলা নামের হাড্ডিখানি চুরমার হইয়া গেল, আর তাহার পরে উপর্যুপরি সার্জারির পরে ইনফেকশন হইয়া সেপটিসেমিয়ায় পর্যবসিত হইল, তখন আমি সকলই ঘোলা দেখিতেছিলাম। তখন আমার চোখের পর্দায় যেন এক শীতল অবয়ব আমাকে ইশারায় হাতছানি দিয়া ডাকিতেছিল। সেদিন অবশ্য প্রাণপণে বউবাচ্চার স্বার্থে আরও কদিন হায়াত-বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট দোয়া-দরুদ পড়িয়া নানা ছলে মৃত্যুদূতকে সেবারের মতো ঠেকাইয়া দিবার প্রাণান্ত চেষ্টার ত্রুটি করি নাই। যেবার ডান-বাহুর চামড়ার নীচে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কয়েকটি গোটা’র কোষ পরীক্ষা করিয়া আমার এক অগ্রজ চিকিৎসক কয়েকটি কোষ নিয়া সন্দিহান হইয়া পড়িলেন, তখন মনে হইয়াছিল — এ যাত্রা আর রক্ষা নাই। কর্কট আমাকে পাইয়া বসিয়াছে। ভাবিতে লাগিলাম, প্রতিদিন কত রোগীকে এক কলমের খোঁচায় কর্কটের সঙ্গী করিয়াছি, আর আজ আমিই শুনিতে পাইলাম সেই অমোঘ বাণী! পরে সার্জারি করিয়া অবশ্য নিশ্চিন্ত হইয়াছিলাম যে না, আমার এখনও ছুটির সময় আসে নাই। তবে সেই কয়েকটা দিন এক বিভীষিকাময় সময় কাটাইয়াছিলাম। নিজেকে মৃত্যুর হাতের মুঠার মধ্যে আমি আবিষ্কার করিয়াছিলাম। এই চরম সময়-ক্ষণের সাক্ষী একমাত্র সহধর্মিনী ছাড়া আর কেউ তো নাই।

হায়, জীবন এমনই বিচিত্র যে, এর বিচিত্র ছলনা জালে সে আকীর্ণ করিয়া রাখিয়াছে। তাই আজ আবার মৃত্যুর সকল চিহ্নগুলাকে অস্বীকার করিয়া, অগ্রাহ্য করিয়া, দিবারাত্র জীবনের সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখিয়াছি। যেন সেই বিভীষিকাময় দিবসগুলি আমার জীবনের কোনও অমা-রজনীর দুঃস্বপ্ন। ভোরের আলোক ফুটিবা মাত্র তাহার কৃষ্ণছায়া তিরোহিত হইয়াছে, আর আমার সম্মুখে জীবন জীবন শুধু — অনন্ত জীবন।

অতএব, প্রস্তাবক সমীপেষু, আবারও পুরনো রেকর্ড বাজাইয়া বলিতেছি, আমি যাহারে জানি নাই, চিনি নাই, তাহার গান কী করিয়া গাহিব?

0 comments:

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ বছরে জন্মে ঊনবিংশ শতকের অর্ধেকের আগেই মারা যান আলেক্সাণ্ডার পুশকিন। রাশিয়ায় তখন জারের শাসন। রাজতন্ত্রের মহিমায় তথাকথিত অভিজাত সমাজ এক অদ্ভুত সমাজে বিচরণ করে। সমাজের নীচু তলার মানুষদের সঙ্গে তাদের কোনোই যোগ নেই। সংযোগের অভাবে শ্রেণীগুলির মধ্যে কাল্পনিক ধারণা গড়ে উঠছে। কেউই কাউকে জানছে না। এরকম পরিবেশে পুশকিনের আবির্ভাব। মাত্র পনেরোতে কবিতা লিখে সুনাম কুড়িয়েছেন। কিন্তু তখনও মানুষ বোঝেনি তাঁর কলম ঠিক কতটা তীক্ষ্ণ। পুশকিন নব্য রাশিয়ার অগ্রণী লেখক বলে পরিচিত হবেন, তার প্রমাণ হিসেবে তাঁর প্রথম গদ্যের প্রকাশ হলো "ইভান পেট্রোভিচ বেল্কিনের বলা গল্প" নামের বইটিতে। মাত্র পাঁচটি গল্প। দ্য শট, ব্লিজার্ড, দ্য আন্ডারটেকার, দ্য পোস্টমাস্টার, লেডি ইনটু ল্যাসি।

গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট যদিও প্রাচীন রাশিয়া কিন্তু ট্রিটমেন্ট এতই আধুনিক যে সময় সময় চমকে উঠি, হয়তো এ লেখক পুরোনো কালকে নিয়ে একটু ছেলেখেলা করছেন। কি অসম্ভব রসবোধ ! প্রতিটি গল্পে একটা অন্তর্লিন স্যাটায়ার পাঠকের ঠোঁটের কোণে হাসি এনে দেয়। আমরা বুঝতে পারি, সেই সময়ের রাশিয়ার অন্তঃসারশূন্য সমাজের ছবি বিপ্লবের বহু আগেই এঁকেছেন পুশকিন। আর তাই হয়তো জার প্রথম আলেক্সাণ্ডার তাঁকে নির্বাসন দিয়েছিলেন।

বইটি ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। আমাজনে কিনতে পাওয়া যায়।

0 comments:

1

ওবাড়ির চিঠি - শতরূপা দত্ত

Posted in

ওবাড়ির চিঠি


পিতার ভবনে, অমৃতসদনে ইতিহাসের অশ্রুবিন্দু
শতরূপা দত্ত


বাঙালীর অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে একটি ঐতিহাসিক বাড়ির সঙ্গে। জড়িয়ে আছে হাজারো সংগ্রামের ইতিহাস। একটি জাতির মুক্তির ইতিহাস – একটি দেশের জন্মের ইতিহাস। ’৬০ এর দশক থেকে সেই ছোট্ট বাড়িটি সাহস, দৃঢ়তা আর বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে আছে বাংলার মানুষের কাছে। ধানমন্ডি লেকের ধারে ৩২ নম্বর সড়কে ৬৭৭ নম্বরধারী সেই বাড়িটি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে দেশের সব নাগরিককে একবারের জন্য হলেও এই ‘অমৃতসদনে’ আসতে হবে।

১৯৬২ সালের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বাংলার মুক্তিসনদ ’৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী ’৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ’৭১ সালের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বঙ্গবন্ধু নেতা-কর্মীদের সঙ্গে প্রেরণার বাতিঘর হয়ে মতবিনিময় করেছেন এই বাড়িতে বসেই। ৭ই মার্চের সেই কালজয়ী ভাষণের রূপরেখাও তিনি সাজিয়ে নিয়েছিলেন এ বাড়ির কনফারেন্স টেবিলে বসে। ২৩ মার্চ ১৯৭১-এ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনটিতেই বিক্ষুব্ধ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয় এখানেই, যা সাথে সাথেই ছড়িয়ে যায় সারা বাংলায়। স্বাধীনতা পরবর্তী দিনগুলোতে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবেও এ বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু তার রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। ৩২ নম্বরের এই বাড়িটিতে তখনও দেশের সাধারণ মানুষের জন্য ছিলো অবারিত দ্বার। আবার, এ বাড়িতেই নেমে আসে শোকাবহ রাত ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ এর সেই রাতে সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাড়িটির প্রেরণাদায়ক ঐতিহ্যের কথা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে পরবর্তীকালে এ বাড়ির নম্বরও পরিবর্তন করে দেয়া হয়। এই কু-উদ্দেশ্যেই একে বলা হতো, ধানমন্ডি ১১ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়ি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলা যে এত সহজ নয়, তা জানতো না খুনীরা। তাই, আজো ৩২ নম্বর বলতে মানুষ বঙ্গবন্ধুর বাড়িকেই বোঝে।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কৃষি ও বনমন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু। তবে, সে সরকার বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। অতঃপর ১৯৫৬ সালের কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। তবে, তখনও ঢাকায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের মাথা গোঁজার নিজস্ব কোনো ঠাঁই ছিল না। তিনি সপরিবারে থাকতেন ঢাকার আবদুল গণি রোডের ১৫ নম্বর বাড়িতে। এসময় পিডব্লিউডি থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছিল। একদিন বঙ্গবন্ধুর পিএস নুরুজ্জামান পিডব্লিউডি থেকে একটি আবেদনপত্র এনে দেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে। সেটি জমা দেয়া হলে ১৯৫৭ সালে বেগম মুজিবের নামে ছয় হাজার টাকা মূল্যের এক বিঘার একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রথমে দুই হাজার টাকা এবং পরে কিস্তিতে বাকি চার হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। ওই বছরই শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নিবেদিত প্রাণ শেখ মুজিব দলকে সময় দেবেন বলে ছেড়ে দেন মন্ত্রিত্ব।

১৯৫৮ সালে টি বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় সেগুনবাগিচায় একটি বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর নামে। সে বছরই আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করলে গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। ১২ই অক্টোবর সেগুনবাগিচার বাড়িটি তিন দিনের মধ্যে ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে। সন্তানদের নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুল মাঠের পাশে মাসিক ২০০ টাকা ভাড়ায় একটি বাড়িতে এসে ওঠেন বেগম মুজিব। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শেখ মুজিবের পরিবার যে এই বাড়িতে থাকেন, তা জানাজানি হয়ে গেলে বাড়ির মালিক বেগম মুজিবকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেন। সন্তানদের নিয়ে আবার তিনি এসে ওঠেন সেগুনবাগিচার একটি বাসার দোতলায়। পরবর্তী ২ বছর এখানেই তাঁরা ছিলেন। ১৯৬০ সালের ১লা অক্টোবর বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্তি পান। চাকরি নেন আলফা ইন্শিওরেন্স কোম্পানির কন্ট্রোলার অব এজেন্সিস পদে। বেতন ৩ হাজার টাকা। বেতনের সেই টাকার উপর নির্ভর করে পিডব্লিউডির বরাদ্দ দেয়া সেই প্লটে ১৯৬১ সালে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হয়।

বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধারকর্জ করে, বন্ধুবান্ধবদের সহায়তায় এবং হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে ঢাকার বুকে ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব ঠিকানা। নির্মাণ কাজ তদারকি করেছিলেন তৎকালীন পিডব্লিউডির নির্বাহী প্রকৌশলী ও পরবর্তীকালে পূর্তসচিব মাইনুল ইসলাম। নির্মাণ কাজে নানাভাবে আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও দপ্তরিক সহকর্মীরা। সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহকর্মী চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের নূরুল ইসলাম। আলফা ইন্শিওরেন্স কোম্পানির একজন কর্মকর্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক এবং পারিবারিক সম্পর্ক। নূরুল ইসলাম ‘ক্রস ওয়ার্ড’ লটারী খেলতেন। একদিন লটারীতে ব্যবহার করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোটকন্যা শেখ রেহানার নাম। সেইদিনই তিনি পেয়ে যান ছয় হাজার টাকা। সেই টাকা তিনি গচ্ছিত রাখেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে। বাড়ির নির্মাণ কাজে টাকার সংকট দেখা দিলে নূরুল ইসলাম এই গচ্ছিত টাকা কাজে লাগানোর অনুরোধ করেন। সেই টাকা ঋণ হিসাবে গ্রহণ করে পরবর্তীতে তা পরিশোধও করেন বঙ্গবন্ধু। বাড়ির জানালার গ্রিল সরবরাহ করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা রংপুরের মতিউর রহমান। বাড়ি নির্মাণকালে কেয়ারটেকার ছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার আরজ আলী।

কোনোমতে নির্মাণকাজ শেষ করে ১৯৬১ সালের ১লা অক্টোবর সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতে উঠে আসেন। বাড়িতে ঢুকতেই ছিল একটি ছোট রুম, যা ড্রয়িংরুম হিসাবে ব্যবহার করা হতো। আসবাব বলতে ছিল একসেট বেতের সোফা মাত্র। একতলা বাড়িটিতে তখন ছিল দুটি বেডরুম। যার একটিতে থাকতেন বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব। অন্যটিতে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তার পাশের কক্ষটি রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। রান্নাঘরের এক পাশে থাকতেন শেখ কামাল ও শেখ জামাল।

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ৩২ নম্বরের এ বাড়িটিকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে দোতলার কাজ শেষ হয়। ১৯৯৪ সালে লেখা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরেছেন ৩২ নম্বরের বাড়িতে তাঁদের বসবাসের দিনগুলির কথা :

‘১৯৬১ সালে এই বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কোনোমতে তিনটা কামরা করে এতে আমরা উঠি। এরপর মা একটা একটা কামরা বাড়াতে থাকেন। এভাবে ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে দোতলা শেষ হয়। আমরা দোতলায় উঠে যাই। ছয় দফা দেবার পর কাজকর্ম বেড়ে যায়। নিচতলাটা তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই ব্যতিব্যস্ত। নিচে আব্বার শোবার কামরাটা লাইব্রেরি করা হয়।’

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যে টেলিফোনটি প্রথম সংযোগ দেয়া হয় সেটির নম্বর ছিল ২৫৬১। এই টেলিফোন নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। আইয়ুব খানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রায়ই এ টেলিফোনটিতে আড়ি পাততো। তাই, শেখ ফজলুল হক মনি বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলতে চাইলে নিজের নাম গোপন করে ‘বালিওয়ালা’বলে নিজের পরিচয় দিতেন। আর সিরাজুল আলম খান নিজের পরিচয় দিতেন ‘ইটাওয়ালা’ বলে।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালির স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাসও, আছে হারানোর বেদনা। স্বাধীন দেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট রাতের অন্ধকারে একদল বিশ্বাসঘাতক বিপথগামী সেনা অফিসারের হাতে ৩২ নম্বরের বাড়িতেই সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন নরপিশাচরা রাতের অন্ধকারে হামলা চালায় স্বাধীনতার স্থপতির বাসভবনে। পৈশাচিক উল্লাসে বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুর নির্মমভাবে হত্যা করে তারা।

সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ তিনটি বাড়িতে সংঘটিত খুনীদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বীভৎসতার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ পিএসসি :

‘কী বীভৎসতা! রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল বাড়িটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাঁচ, মেঝে ও ছাদে। রীতিমতো রক্তগঙ্গা বয়ে যায় বাড়িটিতে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর হয়ে পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। নিথর দেহের পাশেই পড়েছিলো তাঁর ভাঙ্গা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল। টেলিফোন অপারেটর। মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব। বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল। নিচ তলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের। এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবীর ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের লাশ।’

সেদিন আরো হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর ছেলে আরিফ, কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, সেরনিয়াবাতের বাসায় থাকা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে।

এরপর বাড়িটি সিল করে দেয় তৎকালীন সরকার। হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। পরে, তাঁরা ভারত সরকারের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে ভারতে চলে আসেন। নির্বাসিত অবস্থায় দিল্লীতে বসবাস করতে থাকেন শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশে ফিরে এলে বাড়িটি ফিরে পান তিনি।

এর বছর খানেক পর শেখ হাসিনা সংবাদপত্রে একটি নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেখতে পান। হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশনের সেই বিজ্ঞপ্তির তালিকায় ৩২ নম্বরের বাড়িটিও ছিল। বাড়ি নির্মাণে পাকিস্তান আমলে ঋণ হিসেবে নেয়া ১২ হাজার টাকা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ও পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ক্ষমতায় থেকেও এই অতি সাধারণ বাড়িটির কোন ‘উন্নয়নও’ করার চেষ্টা করেননি তিনি। ঋণ বকেয়া থাকায় নিলামে ওঠে বাড়িটি। ১২ হাজার টাকা বকেয়া পরিশোধের পর বাড়িটির দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয় শেখ হাসিনাকে। জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য বাড়িটি বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেন তিনি।

১৯৯৪ সালের ১৪ই আগস্ট উদ্বোধন করা হয় জাদুঘরটি। নাম দেয়া হয়- ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর।’‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন:

‘মিউজিয়াম করতে গেলে অনেক পরিবর্তন করতে হয়। সে পরিবর্তন কমিটি করাচ্ছে। আমি প্রায়ই যাই দেখতে। দেয়ালগুলোতে যখন পেরেক ঠোকে, জিনিসপত্রগুলো যখন সরিয়ে ফেলে, বুকে বড় বাজে, কষ্ট হয়, দুঃখ হয়। মনে হয় ঐ পেরেক যেন আমার বুকের মধ্যে ঢুকছে। মাঝে-মাঝেই যাচ্ছি, ঘুরে দেখে আসছি যতই কষ্ট হোক। এই কষ্টের মধ্যে, ব্যথা-বেদনার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। সে আনন্দ হলো, আমরা জনগণকে তাদের প্রিয় নেতার বাড়িটি দান করতে পারছি। জনগণের সম্পত্তি হবে ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি। এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি। আমরা তো চিরদিন থাকবো না কিন্তু এই ঐতিহাসিক বাড়িটি জনগণের সম্পদ হিসেবে সব স্মৃতির ভার নিয়ে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবে।’

জাদুঘরটা সাদামাটা। তিন তলা ভবন মাত্র। নয় কক্ষবিশিষ্ট এ ভবনের আসবাব পত্রও একদমই সাধারণ মানের। ভবনে ঢুকতেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। প্রথম তলায় আরও রয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে নিহত সবার ছবি এবং কিছু আসবাবপত্র। এই ঘরটি আগে ছিল ড্রইং রুম। এই ঘরে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্বরা। এর পাশের ঘরটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের পড়ার ঘর। এখানে তিনি লেখালেখির কাজও করতেন। ১৯৭১ সালে এই ঘর থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠানো হয়েছিলো সারাদেশে।

দোতলায় বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘর। এ ঘরের সামনে করিডর থেকে নিচে যাওয়ার সিঁড়িতেই ঘাতকদের গুলিতে মারা যান জাতির পিতা। এখনো গুলির চিহ্ন সেখানে রয়ে গেছে। আর রয়েছে, শিল্পীর তুলিতে আঁকা বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ অবস্থার একটি প্রতিকৃতি। শোবার ঘরে তাঁর বিছানার পাশেই ছোট টেবিলে সাজানো আছে তাঁর প্রিয় পাইপটি, তামাকের কৌটা। রয়েছে টেলিফোন সেট ও রেডিও। সামনের খাবার ঘরের একপাশে আছে শিশু রাসেলের বাইসাইকেল। আছে খাবার টেবিল, থালা, বাটি। আছে রেকসিনের সোফা। শেখ জামালের কক্ষে দেখা যায় তাঁর সামরিক পোশাক। বাড়ির তৃতীয় তলায় শেখ কামালের কক্ষে তাঁর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সাজিয়ে রাখা আছে। এছাড়াও রয়েছে পুত্রবধূ সুলতানা কামালের বৌভাতের সবুজ বেনারসি শাড়ি, রোজী জামালের লাল ঢাকাই জামদানি, বিয়ের জুতা, ভাঙা কাচের চুড়ি, চুলের কাঁটা, রাসেলের রক্তমাখা জামা, বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা সাদা পাঞ্জাবি, তোয়ালে, লুঙ্গি, ডায়েরি।

বাড়ির দেয়াল, দরজা, ছাদসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘাতকের বুলেটের চিহ্ন ১৫ই আগস্টের সেই অমানবিক বীভৎসতার কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি যাদের ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে সম্বোধন করতেন, এদেশের সেই সমস্ত ভাইদের মধ্যকার একদল বিশ্বাসঘাতকের অপকীর্তির ইতিহাসের এই দেয়াললিখন যুগ যুগ ধরে নিন্দিত হতে থাকবে।

মূল বাড়ির পেছনে রয়েছে জাদুঘরের সম্প্রসারিত নতুন ভবন। বঙ্গবন্ধুর বাবা-মায়ের নামে এ ভবনের নাম দেয়া হয়েছে ‘শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুন’ গ্যালারি। ২০১১ সালের ২০শে আগস্ট এ অংশটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়। ছয় তলা এ ভবনের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র রয়েছে। পঞ্চম তলায় রয়েছে পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র।

বঙ্গবন্ধু ভবনের গেটের উল্টোদিকে একটি স্মৃতিস্তম্ভে খোদাই করে কীর্তিত হয়েছে সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা একটি অবিস্মরণীয় কবিতার বিশেষ অংশ, যেটা আসলে কবির উপলব্ধির চিরন্তন সত্যকেই ধারণ করে আছে। এই কবিতায় লেখা কথাগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রতিটি বাঙালির মনের কথা, যা সর্বদা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরে অন্তরে :

‘যতকাল রবে পদ্মা, মেঘনা
গৌরী, যমুনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান’

1 comments:

2

জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে

Posted in

জংলা ডায়েরি- ৩
শিবাংশু দে


৫.

আরো উত্তরে যাবো? বদনাম পলামু? চান্দওয়া,লাতেহার, লেসলিগঞ্জ, গাড়ওয়া। বাঙালি জঙ্গলবিলাসী লেখকদের গল্পে বারবার এসে পড়ে। এখন তো সেসব মুক্তাঞ্চল। সরকারে দরকার নেই, তাই নিজের সুড়ঙ্গে থাকা বনজঙ্গল। তবু ডালট্নগঞ্জ থেকে দক্ষিণে যদি গাড়িতে বারোয়াডির দিকে, তবে মাঝামাঝি জায়গায় বেতলার উত্তর গেটটির একটু আগে নর্থ কোয়েলের উপর যে কালভার্ট ব্রিজটি আছে, সেখানে তিষ্ঠ ক্ষণকাল। বাঁদিকে পাহাড়ের আড়াল থেকে নদী নেমে আসছে আর ডানদিকে দুতিন কিমি যতোটা চোখ যায়, তার মধ্যে নদী চারটি বাঁক নিয়েছে। অমন বিপজ্জনক মনভোলানো বাঁক আমি দেশেবিদেশে কোনও সুন্দরীতমা নারীর শরীরেও কখনও দেখিনি। খাজুরাহোর পূর্ণদেহী পত্রলেখার পাথরের শরীরে তার একটু ছায়া পাওয়া যাবে হয়তো। তার কাছেই, বাঁদিকের পাহাড়ে পায়ে পায়ে উঠে গেলে কেঁচকি বনবাংলো। অরণ্যের দিনরাত্রি, মনে পড়ে?

তবে 'আহা' বলি, বলতে হয়। আমাদের দলমা পাহাড়, দলমা রেঞ্জ। নিজের বাড়ি। সিংভূম আর মানভূমের মাঝখানে আড়াল করে রেখেছে, সবুজে সবুজ তুমি নীলিমায় নীল। সোজা উত্তরে মানগোয় পেরিয়ে যাওয়া সুবর্ণরেখা। জাতীয় সড়ক ৩৩। আসনবনি থেকে ডান দিকে গাড়ির রাস্তা। খানিকটা অল্প চড়াই। হরিণবাগান, আদিবাসী গ্রাম। ফাগুন আসার আগেই চারদিকে আগুন জ্বলছে পলাশের ডালজোড়া। হেঁটে যেতুম তিরিশ বছর আগে, এখন জীপে। চড়াই, চড়াই, রাস্তা চড়ছে। একদিকে খাই, অন্যদিকে বনময় মাটির উড়ান। শালই রাজা, সঙ্গে আছে বাবলা, শিরিস আর কুলের বন। টানা ফুল ফুটে আছে বুগেনভিলিয়া, দশটা রঙে। মাটির কাছে পুটুস আর আকন্দ আর আকাশছোঁয়া শালপাতার কাঁচা সবুজ। বর্ষাকালে এখানে হাতীর সাম্রাজ্য, আসা মানা। বসন্তকালেই ডাকে এর পূর্ব থেকে পশ্চিমে টানা বনভূমি। পূবদিকে বেলপাহাড়ি, ঝরি, রানিবাঁধ আর ঝিলিমিলি। পশ্চিম পারে দলমা রেঞ্জ মিলে যাচ্ছে চান্ডিল-গামারিয়া রেঞ্জের সঙ্গে। গড়াতে গড়াতে জঙ্গল পৌঁছে যায় সারান্ডা রেঞ্জ। যেতে পারি, কেন যাবোনা? বনবিভাগের বাংলো পিন্ড্রাবেড়ায়, একটু নীচুতে। কিন্তু থাকা যায় ভালো। বেশি বায়নাক্কা না থাকলেই হলো। ডিমের ঝোল আর গরম রুটি। ফাস্ট কেলাস।ঝোলা বারান্দায় বসে দূরে আঁধারে জামশেদপুর শহরে আলোর অমরাবতী। নীল, হলুদ, সোনালি, রুপোলি। গান শোনাবেন রাশিদ খান আর আখতারিবাই। রামকুমারই বা বাদ থাকেন কেন? বাদ যাবে " আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে।" বাঙালির মুনলাইট পিকনিকের গান। এতোদিনেও মুগ্ধা জননীর সন্তানেরা গান শুনতে শেখেনি। ভোরবেলা পাকদন্ডি ধরে উঠে যাওয়া একটু দক্ষিণে টাটাবাবার অতিথশালায়। ফির্দৌসে জমিনস্ত। হাত বাড়ালেই আকাশ আর নীচে নেমে যাওয়া স্তরে স্তরে সবুজঘেরা হাজার রঙের ফুলের আগুন। অগোছালো, অসংসারী, অগৃহিণী বনকুমারীর ঘরসংসার। ঢুকতে গেলে পাসপোর্ট লাগে। ব্যাংকের পাসবুক বাড়িতে রেখে আসতে হয়। সবাই পারেনা। মধ্যরাতে আকণ্ঠ দারুপান করে অতিথশালার টানা বারান্দায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ম্যানেজারসাহেব, তোমাকে আরো একবার জন্মাতে হবে হে।

৬.

"..... বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে,
পরাঙ্মুখ সবুজ নালি ঘাস দুয়ার চেপে ধরে...."

বাংলা কবিতার সঙ্গে সম্বন্ধ নেই এমন বাঙালিরাও এই দুটো লাইন কবিতা শুনলে ঠিক চিনতে পারেন,

তার পর সেই চিরন্তন প্রশ্ন, অবনী কী আমি ? সে কী বাড়িতে আছে? জঙ্গল কি আদৌ 'বাড়ি' হতে পারে? আমার উত্তর, একশোবার হবে। আমি তো সেখানেই থাকি। এমন 'বাড়ি' ছেড়ে কোথায় আর যাবো? এমন বাড়ি তো আমার আরো আছে। সেই কোথায়, কতোদূরে চেরাপুঞ্জি, মোসিনরাম বা বর্ষাকালে কোহিমার জাপফু পাহাড়। আর প্রায় 'পৃথিবী'র অন্যপ্রান্তে পশ্চিমঘাটে ইদুক্কি মুন্নারের কাছে নীলগিরির এই এরাভিকুলম জাতীয় অরণ্য। এখানে রয়েছে হিমালয়ের পর দেশের সব চেয়ে উঁচু আনামুড়ি গিরিশিখর (২৬৯৫ মিটার)। আর 'শোলা'বন। মালয়ালিতে 'শোলা' মানে ঝোপঝাড়ের জঙ্গল। ইংরিজিতে যাকে বলে ট্রপিক্যাল মন্টেন। যতোদূর চোখ যায়, পাহাড়ে, সমতলে ছড়িয়ে আছে ঝোপজমি, ঘাসজমি আর চা-বাগান। রয়ে্ছে লোক্কোম জলপ্রপাত আর অসংখ্য বিরল বন্যপ্রাণী। এই পাহাড়-অরণ্যময় দৈবী সবুজের রাজপাটকে ঘিরে আছে পশ্চিমে পেরিয়ার নদী আর পূর্বদিকে কাবেরী। এখানে সত্যিই মেঘ মানুষের চারপাশে গাভীর মতো চরে বেড়ায়। না চাইতেই ভিজিয়ে দিয়ে যায়। আর আদিগন্ত সবুজ ঘাস, আমাদের তাকাবার অপেক্ষায় ভিজে ভিজে চোখ নিয়ে চেয়ে থাকে। কবি'র অনন্য কল্পনাও যেন প্রকৃতির আয়োজনের বিশালত্বে ফিকে পড়ে যায়।

বাঙালি পর্যটকের পৃথিবী উত্তরে মানালি'র বরফ পাহাড় আর দক্ষিণে মুন্নারকে দিয়ে ঘেরা যেন। মাঝখানে রয়েছে আরো অনেক, অন্তহীন মায়াবী সুন্দরের উপনিবেশ। আমাদের পশ্চিমঘাটে সেই রত্নগিরি থেকে প্রকৃতি দু'হাত ভরিয়ে সুন্দরের সর্বনাম ছড়াতে ছড়াতে নীলগিরি পাহাড়শ্রেণী হয়ে হয়ে নেমে আসছে। তটীয় কর্ণাটকের মঙ্গলুর, উদিপি, মারকারা হয়ে কেরালার ওয়াইনাড়, কোঝিকোড়, পালাক্কাড় হয়ে আরো দক্ষিণে এই ইদুক্কি। সেই উর্দু শ্যয়েরটা মনে পড়ে যায়। এতো সৌন্দর্য দেখার জন্য মাত্র দুটো চোখ যথেষ্ট নয়। অ্যায় খুদা, আরো কয়েকটা চোখ দাও আমাকে, নয়তো কতো কিছু অদেখা থেকে যাবে। কিন্তু যে চোখ এতো কিছু দেখে, তাতো ভিতরে লুকিয়ে। তাকে কী বাইরে ঠাহর করা যায়? এই যে নীলগিরি টানা পাহাড়, এর কাছে মেঘ এসে বলে, বারবারই বলে ' যাবো যাবো', কিন্তু যায়না। যেতে পারেনা। ওড়নার মতো জড়িয়ে থাকে পাহাড়ের সারা গায়ে।

গাড়ি তো নামিয়ে দেবে একটা পার্কিং ঘাটে। তার পর নিজেকে নিয়ে উঠে যাওয়া ঘোরানো পাহাড়ি পথে, জলের সঙ্গে, মেঘের সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে। যতো উপরে যাওয়া যায়, মেঘপাহাড় ততো কাছে আসে। শুধু দেখে যাওয়া। বলার মতো কথা কিছু জমতে পারেনা। নৈঃশব্দ্যই শুধু জানাতে পারে আসল ভালোবাসার চুপকথা। মেঘ ঝরে যাচ্ছে, জল ঝরে যাচ্ছে, ঝরে যাচ্ছে পাগলা ঝোরা আর আকাশ ছোঁয়া জলপ্রপাত। কালোপাথরের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রুপোলি জেদি জলের ছোটোবড়ো স্রোত। পাহাড়ে আর পাকদণ্ডি নেই। সবই বাঁধানো পিচের পথ, সিনেমাদুহিতার গণ্ডদেশের মতো মসৃণ। চা-বাগানের ছোটো ছোটো লরি আর ট্র্যাক্টর । নয়তো বনবিভাগের সবুজ জীপ। ফসিল প্রদূষণ ঐটুকুই। বাকি শুধু অক্সিজেন।

হে পথিকবর, কোথাও একদণ্ড দাঁড়িয়ে চোখ ছুটিয়ে দাও। দূরে মেঘের আড়ালে আনামুড়ি শিখরের লুকোচুরি দেখো। নয়তো মাইলের পর মাইল শ্যামলসুধায় টগোবগো উপত্যকা। চারদিকে তিনচারটে জাতীয় অরণ্যপার্ক। মানুষের সঠিক স্পর্শ প্রকৃতিকে কীভাবে আরো রমণীয় করে তুলতে পারে, তার কিছু মিসাল এখানে দেখা যাবে। আমাদের দেশের পক্ষে বিরলই বলা যায়। বনস্পতি থেকে ফার্ন/ অর্কিড, নীলগিরি হরিণ থেকে অসংখ্য রংবেরঙের পাখি, আকাশছোঁয়া পাহাড় থেকে পায়ের তলার ঘাসজমি, সব্বাই সেজেগুজে অপেক্ষা করে আছে সেই সব মানুষদের জন্য, যারা তাদের মর্যাদা দিতে পারে।

চলত মুসাফির, মোহ লিয়া রে পিঁজরেওয়ালি মুনিয়া.....

(ক্রমশ)

2 comments: