0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in

ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত




গোরাচাঁদ 

পালকের তৈরি নরম সুগন্ধি বিছানা থেকে নেমে একটা বেতের মোড়াতে বসলেন গোরাচাঁদ। জোহা তাঁর হাতে গরম পানীয় ভর্তি কাঠের তৈরি গ্লাস ধরিয়ে দিলো। গোরাচাঁদ পান করতে করতে খুব মনোযোগ দিয়ে ওদের দুজনার দিকে তাকিয়ে রইলো। দুয়ারের দিক থেকে একটা ছায়া ঘরের ভিতরে পড়তেই চেয়ে দেখলেন এক মহিলা। সোনা রঙ রেশম সুতোর বিদেশী ধর্মযাচিকার মত বস্ত্র থেকে সকালের রোদ ঠিকরে আসছে। গায়ের রঙ ঈষত্‍ বাদামি। গলায় রুদ্রাক্ষ জাতীয় লাল মালা। যখন সে গোরাচাঁদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে হাসলো তিনি পরিষ্কার চিনতে পারলেন। এতো জেরেকা! জেরেকা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে! ভোরের লালিমাতে সেই রুক্ষ কালো ছোপধরা গায়ের রঙ আর নেই। জেরেকা তাঁর দিকে তাকিয়ে আবার হাসলো।সেই ঝকঝকে সাদা দাঁত। ঝরঝরে বুদ্ধিমতী চেহারা। এখন মনে হচ্ছে ও যেন এক বিদেশিনী মঙ্গোলিয়ান ও ভিয়েতনামী সংমিশ্রণ। গোরাচাঁদ উঠে দাঁড়ালেন কিন্তু জেরেকা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। গোরাচাঁদ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না,এই সম্পুর্ণ অচেনা জগতে জেরেকা কী করছে? আবার ওর চেহারা এইরকম বদলে গেল কি করে? ঠিক এইসময় যুবকটি যখন পিছন ফিরে জেরেকাকে হাতে ধরে গোরাচাঁদের কাছে নিয়ে এল,তখনি হঠাত্‍ তাঁর কাছে সবকিছুই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। পেরো তার মাকে স্বীকার করে নিয়েছে! অদ্ভুত ওর চেহারা আর চরিত্রের পরিবর্তন? তক্ষুনি গোরাচাঁদের পুরোনো অতীতের ঘটনা এমনকি সুদূর অতীতে পদ্মদিঘীর সামনেতিনি যে এই কুটিরে এখানে ছিলেন,সেকথা মনে পড়ে গেল। তাহলে পেরো শিমুলিয়া অঞ্চলের সব জনজাতিদের উদ্ধার করে এখানে নিয়ে এসেছে? জেরেকা এগিয়ে এসে গোরাচাঁদের পায়ের কাছে বসে পড়ল। ওঁর মুখের ভাব দেখেই জোহা এগিয়ে এসে একটু হেসে বলল,

-আমাদের এই ঔষধি পানীয় যে এতো তাড়াতাড়ি কাজ করবে আমরা ভাবতে পারিনি। গুরুজি, ভালোই হয়েছে, আপনি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়েছেন। এখন আপনাকে অনেক কাজ করতে হবে।

জেরেকা তাদের এখানে আসা ও থিতু হওয়ার সব কথা আস্তে আস্তে বলল গোরাচাঁদকে। 

-দেখুন গুরুজি। ভগওয়ানের কি মহিমা। সেই পেরো থেকে এই পেরোর আকাশ পাতাল পরিবর্তন। আমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো পাওয়া হলো ও আমাকে মা বলে স্বীকার করে নিয়েছে। অবশ্য ওর চেহারার পরিবর্তন হয়েছে এখানের হাওয়া বাতাসের গুণে কিন্তু ওর মন ও বুদ্ধি বদলে দিয়েছে এই জোহা মেয়েটি। 

পেরো এবার নিচু গলায় আস্তে আস্তে বলতে চেষ্টা করল। বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠল,একটু থেমে চোখের জল মুছে আবার শুরু করল। -গুরুজি, আপনার মনে পড়ে? শিমুলিয়ার পাহাড়ের উপর ওই জোড়া গাছের নিচে আপনি ও আমি দুজনে কতবার পল রবসনের গান গাইতাম? মনে পড়ে? ওই গান শুনে আমি তার মানে ঠিক বুঝতাম না কিন্তু আমার রক্ত খলবল করে নেচে উঠতো। আমাদেরই বনজ সম্পদ আমাদের দিয়েই কাটিয়ে লোডিং করিয়ে ওরা নিয়ে যেত। বিনিময়ে আমি ওদের চোখে দেখতাম স্পষ্ট ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য। শিমুলিয়ার আসেপাশে ছোটো ছোটো চোরা গোপন মাইনস এখনো চলে। ওরা আমাদের মজুরি কম দিতো,মারতো জংলী নোংরা কালো বনমানুষ বলে গালাগালি করতো। আমরা বনবাসীরা এটাই আমাদের প্রাপ্য মানতাম। তবু শোষন মানে কি আমি বুঝতাম না। আপনার শেখানো গান ও লড়াইয়ের ভাষা আমাকে ও আমার বনবাসীদের শিখিয়েছে আমাদের অধিকার আমাদের সন্মান।আপনি আমার পল রবসন। কোথায় ছিলেন গুরুজি? এতদিন আপনার অভাবে আমি দিশাহারা হয়ে গেছিলাম। গুরুজি,আমরা এইভাবে এখানে চিরকাল নিজেদের গোপন রেখে কিভাবে বাঁচবো? আমরা দেশের মানুষদের মাঝে সম্মানের সাথে আমাদের অধিকার নিয়ে বাঁচতে চাই গুরুজি। কিন্তু কিভাবে? আমরা সরকার আর তার প্রশাসনের চোখে এমন অপরাধী যে এখান থেকে বেরোলেই তো আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। আমাদের কি কোনো গতি নেই গুরুজি? গোরাচাঁদ চুপ করে রইলেন। ঘরের ভিতর নিস্তব্ধতা। জেরেকা মুখ খুলল। 

-হতাশ হয়োনা পেরো। আমাদের পরিবর্তন তো হয়েইছে। আমরা সবাই দেখতে সেই বন্য মানুষের মতো আর নেই। চেহারায় জৌলুষ এসেছে। আমরা আর সেই আদিম নই। আরো কয়েকদিন এখানে থাকলে আরো সুন্দর আরো ভালো হয়ে যাবো। এখানে অনেক কিছু শিখতে শুরু করেছি। কৃষিকাজ ঠিকমতো রপ্ত করে নিলে আর ঘাসবীজ শাকপাতা পশু মাংস খেয়ে জীবন যাপন করতে হবেনা। কোথাও আর কুলি কামিন খাটতে যাবো না। স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচবো। গোরাচাঁদ এবার উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। শূন্যে মুঠোহাত তুলে বলিষ্ঠ কন্ঠে বলে উঠলেন,

-ঠিক,ঠিক বলেছ জেরেকা। আমরা সবরকমভাবে স্বনির্ভর হয়ে বাঁচবো আর অরণ্যের অধিকার কাউকে ছিনিয়ে নিতে আমরা দেব না। তারজন্যে আগামীকাল থেকেই শুরু করবো প্রশিক্ষণ। আমি এখানের প্রতিটি জনজাতিকে শিখিয়ে পড়িয়ে বিদ্যান ও যথার্থ জ্ঞানী করে তুলতে চাই।

জোহা পেরোর হাত ধরে গোরাচাঁদের কাছে এসে হাঁটুমুড়ে বসল। -আমরা দুজন ঠিক করে রেখেছি, নিয়মকরে রোজ আত্মরক্ষা ও আক্রমণ প্রতিহত করার কৌশল শেখাবো। বৃদ্ধ যুবক মহিলা এমনকি বাচ্চারাও যাতে শারিরীক ভাবে প্রত্যেকে যাতে আত্মরক্ষায় সক্ষম হয় আমরা তার ট্রেনিং দেব। বহিরগতদের নিয়ে এই অঞ্চলে আমরা মোট তিনশো জন আছি। তারমধ্যে পাঁচজন বহিরাগত আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে,এবং ধরাও পড়েছে। ওরা নিজে থেকেই শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু আমরা জানিনা আমরা এখন সম্পুর্ণ সুরক্ষিত কিনা। জানিনা এখনো কেউ আমাদের ভিতরে আছে কি না যারা সামান্য স্বার্থের লোভে আমাদের এই গোপন সুরক্ষিত বাসস্থানের কথা বাইরের জগতে ছড়িয়ে দিতে উদগ্রীব।

গোরাচাঁদ মনদিয়ে শুনলেন।–তোমাদের সবার থাকার ব্যবস্থা প্ল্যান মাফিক হতে হবে। মানে জোন মাফিক। প্রতিটি জোনে একজন মোড়ল থাকবে যার কাজ রোজ সেই জোনে বাস করা মানুষের হিসাব রাখা। জোহা বসে ছিল,কথা শুনে উঠে দাঁড়াল।–গুরুজি,এই কাজ আমরা আগে থেকেই করে রেখেছি। গোরাচাঁদ ওর দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালো।–বেশ তবে আগামী কাল থেকে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে দেওয়া যাক। আমাদের নতুন যুগ শুরু হোক।

0 comments: