0

পথেপ্রবাসে - দীপ্ত প্রতিম মল্লিক

Posted in
পথেপ্রবাসে

পেরুতে বেড়ুবেড়ু
দীপ্ত প্রতিম মল্লিক


পর্ব ৩ 

১১ ই এপ্রিল ২০১৯- হুয়াকাচিনা থেকে আরুকিপা 

হুয়াকাচিনার এই হোটেলে তিনতলাটায় শুধু আমরাই ছিলাম একমাত্র। যেন পুরো তিনতলাটা আমাদের। চোখের সামনে লেগুন আর বালিয়াড়ির শোভা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম- মাত্র একরাত থাকাটা বড্ডো কম হয়ে গেলো- মন ভরলো না। মন খারাপ নিয়ে ঘরে গেলাম মাল প্যাক করতে। আচমকা পায়ের তলার মাটি দুলে উঠলো আর সাথে সাথে সমস্ত দরজা জানালার খটাখট শব্দ। সামান্য কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু উপলব্ধি করতে লাগলো কয়েক মিনিট। বুঝলাম এটা ভূমিকম্প। এখানে প্রায়ই হয়, কাজেই চিন্তার কিছু নেই। বস্তুতঃ পেরু দেশ টাই অগ্নি বলয়ের(Ring of Fire) ওপর, ফলে ভূমিকম্প এখানে স্বাভাবিক। 

যাই হোক, মালপত্র নিয়ে এলাম “ওয়াইল্ড রোভার হোস্টেল” যেখানে আমাদের আবার জমায়েত হবার কথা। দেখে আশ্বস্ত হলাম যে একই গাইড । এই গাইড, যার নাম ফারনানডো- অসাধারণ। যেন একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত আমরা। ফারনানডো তার লিষ্ট বের করে মিলিয়ে নিলো যে সবাই আছি কিনা। তারপর উঠলাম বাসে। এই বাসটি ছিলো সারা টুরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ । এটায় দেখলাম প্রায় শুয়ে পড়া যায়। আর সেটাই দরকার কেননা এটি আমাদের সবচেয়ে দীর্ঘ বাসযাত্রা। আমরা যাবো নাসকা হয়ে আরুকুপা- প্রায় সাড়ে সাতশো কিমি রাস্তা। দুপুর একটায় বাস ছেড়ে পৌছাবে পরদিন ভোরবেলা। আর আমরা উঠবো এ্যান্ডিস পর্বতমালার পথ ধরে প্রায় আট হাজার ফুট (৭৭০০ ফুট) ওপরে আরুকুপায়। সুদীর্ঘ পথ বলে সঙ্গে নেওয়া হলো দশ লিটার জলের বোতল। বাস ছাড়লো দুপুর একটায়। আধ ঘন্টা পর এলাম “পিসকো ভিন ইয়ার্ড”(Pisco Vineyard) । পিসকো অত্যন্ত বিখ্যাত তার ওয়াইনের জন্য। বস্তুত গোটা লাতিন আমেরিকাতেই পিসকো অতি বিখ্যাত একটি নাম। বিরাট ভিনইয়ার্ড – আমরা প্রথমেই এলাম যেখানে ফারমেন্টেশন হয়। ওয়াইন কিভাবে তৈরী হয় এসব জ্ঞান লাভের পর এলাম এই টুরের সব চেয়ে আকর্ষণীয় অংশ – টেস্টিং । লাইন দিয়ে চিয়ারে আমরা বসলাম। দেখলাম জনগন উত্তেজিত। টেস্টিং তে কোনো কার্পণ্য নেই। প্রত্যেক কে সাতখানা করে শট দেওয়া হলো। প্রথম তিনটে শট ৮% এ্যালকোহল হলেও পরের গুলি ৪২% ফলে সবার যেন একটু চনমনে ভাব। 

বাস ছাড়লো বেলা তিনটেয়। বাইরে তখন ধূ ধূ মরুভূমির কাঠ ফাটা গরম। মানে ৩০/৩১ ডিগ্রী কিন্তু ভিতরে এয়ার কন্ডিশনের জন্য শরীর শীতল। চলতে চলতে বিকাল ৫-৩০ তে বাস থামলো নাসকা টাওয়ারের কাছে। 
এখানে নাসকার সম্বন্ধে দু চার কথা বলি। নাসকাতে প্রায় একশো কিমি জায়গা জুড়ে দেখা গিয়েছে হাজার হাজার লাইন ও জ্যামিতিক নকশা। কোথাও বা লাইনগুলি মাইলের পর মাইল লম্বা এবং এমনই চওড়া ও গভীর যে বহু দূর থেকে দেখা যায়। ২০০০ বছর আগে টানা এই লাইন বা নকশা কে বানালো সে প্রশ্নর উত্তর আজও অমিল। নাসকা লাইন দেখার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে ছোট প্লেনে আধ ঘন্টার উড়ান নেওয়া। কিন্তু তার ঝামেলা অনেক। অপেক্ষা করতে করতে সারাদিন লেগে যায়। তার ওপর বহু উড়ানের নিরাপত্তা নিয়েও সন্দেহ - তাই ও পথে আমরা যাই নি। আর একটি সহজ উপায় হলো নাসকা শহর থেকে দশ কিমি দূরে এই চল্লিশ ফুট উঁচু টাওয়ার আছে- এর ওপর থেকে বেশ কয়েকটি লাইন দৃশ্যমান ।পুরো নাসকা লাইনের তুলনায় তা অতি নগন্য, কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায় আমাদের নেই- এই যে পাচ্ছি- এটাই কজন পায়! 

বাস থেকে নেমে আমরা এক এক করে নামলাম চল্লিশ ফুট উঁচু টাওয়ারে উঠবো বলে। জায়গা অপরিসর, তাই দশজন দশজন করে ওঠা। প্রচন্ড হাওয়া – লোহার সিঁড়ি- মনে হচ্ছে যেন ঠেলে ফেলে দেবে। বালি-ও উড়ছে সমান তালে। ধীরে ধীরে ওপরে উঠে যা দেখলাম- মন ভরে গেলো। দেখলাম একটা লিজারড, একটা গাছ ও একটা হাত আঁকা রয়েছে- নিঁখুত ভাবে – প্রতিটি লাইন একেবারে সোজা- পাথরে এরকম গভীর ভাবে কে কা কারা এই সব ছবি আঁকলো? ভাবলে গা ছমছম করে। 

আস্তে আস্তে নীচে নামলাম। মন এক অদ্ভুত ভালোবাসায় ভরে গিয়েছে। এক অজানা রহস্যকে প্রত্যক্ষ করার যে রোমাঞ্চ তার রেশ যেন রয়ে গেলো বাকী জীবন। 

সবার দেখা হলে আবার বাসে উঠলাম। সন্ধ্যা ছটা নাগাদ বাস এলো নাসকা। এখানে ফারনানডো আমাদের নিয়ে গেলো ডিনারের জন্য এক রেস্তোঁরাতে। আবার অপূর্ব খাবার ও তার স্বাদে রসনার পরিতৃপ্তি। 

এরপর সন্ধ্যা সাতটায় সেই যে বাস ছাড়লো- আর কোনো স্টপ নেই- সোজা যাবে আরুকিপা। চোখ বুজে সীট হেলিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করছিলাম। বাসের ইঞ্জিন গর্জে যাচ্ছে- বাস ওপরে উঠছে তো উঠছেই। প্রায় আট হাজার ফুট ওঠা। প্রতি ঘন্টায় দেখছি বাস দাঁড়াচ্ছে আর ইন্সপেকটররা টর্চ মেরে দেখছে যে বাসের টায়ার ঠিক আছে কিনা। রাস্তা অত্যন্ত ভালো- পাহাড়ে যেরকম ভয়ংকর বাঁক থাকে, সেরকম খুব একটা পেলাম না। ফলে আধো ঘুম আধো জাগরণে কেটে গেলো সারা রাত। ভোরের দিকে ভালোই ঘুম হচ্ছিলো, ঘুম ভাঙল ফারনানডোর ডাকে- আমরা আরুকিপা এসে গিয়েছি। 

১২ই এপ্রিল ২০১৯- আরুকিপা(Arequipa) 

আরুকিপা মানেই বোঝায় ঝকঝকে শুভ্রতার পরশ লাগা বাড়ী, ঘর, চার্চ – মানে অনেক কিছুই ধপধপে সাদা। কেননা আগ্নেয়গিরি দিয়ে ঘেরা এই শহরের বাড়ী ঘরদোর, অধিকাংশই সাদা আগ্নেয় শিলা দিয়ে তৈরী। ১৫৩৫ সালে স্প্যানিশরা পেরু দখল নেওয়ার পর ওরা আরুকিপার পত্তন করে। এর প্রধান কারণ ছিলো প্রথমতঃ সমুদ্র থেকে খুব একটা দূর নয় আবার কুজকো বা পোটাসির( এখন বলিভিয়াতে) থেকেও কাছে। কাজেই বানিজ্যর সুবিধার জন্য আরুকিপার উৎপত্তি। তিনটি আগ্নেয় গিরি এই শহরকে ঘিরে আছে- এক -মিসতি যে আজ ও সক্রিয়(৫৮২২ মিটার) , দুই- চাচানি(৬০৭৫ মিটার) আর তিন- পিচু পিচু(৫৫৭১ মিটার)। ইনকারা এই আগ্নেয়গিরিদের প্রভুত সম্মান দেখাতো এবং দেবতা বলে মনে করতো কেননা এদের বরফ চূড়ার জল থেকে আমাজন নদীর উৎপত্তি , যা ছিলো ইনকাদের জলের প্রধান উৎস । কোনো বছর ফসল ঠিক মতো না হলে বা কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে ইনকারা এই সব পাহাড়ের চূড়ায় জীবন্ত বলি দিতো- সে সব কথায় পরে আসছি। আপাততঃ এইটুকুই বলি যে ভোর পাঁচটায় আরুকিপায় এলাম। শহরের মধ্যে রাস্তা অনেক অপরিসর বলে পেরু হপ ট্যাক্সি বা গাড়ী করে দিলো হোটেল যাওয়ার জন্য আর মিনিট পনেরোয় বাস চলে এলো এক অপূর্ব হোটেলে- তিয়েরা ভিভা। ওখানে মালপত্র রেখে ব্রেকফার্স্ট খাওয়া হলো । তারপর মালপত্র রেখে বেরিয়ে পড়লাম পেরুর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আরুকিপা দর্শনে। প্রথমেই এলাম প্লাজা দ্য আরমাস। বিরাট সুন্দর চত্তর – সবুজে মোড়া- এর একপ্রান্তে আছে সাদা ধপধপে ক্যাথিড্রাল । একটু ধাতস্থ হয়ে দেখে এলাম- দারুণ এর ভিতরের কাজকর্ম । 

আরুকিপায় অজস্র চার্চ আছে আর সবকটিই অত্যন্ত সুন্দর। যেমন লা মারসিড চার্চ , সান্তা টেরিজা, সান্তা ডোমেনিকা ইত্যাদি। দুদিন ধরে এগুলো তারিয়ে তারিয়ে দেখেছিলাম। তবে আজ প্রথম আকর্ষণীয় জায়গা যেটি দেখলাম, তা হলো জুয়ানিটা (Juanita) মিউজিয়াম। জুয়ানিটা একটি ১৫ বছরের মেয়ে যাকে ২১০০০ ফুট পাহাড়ের ওপর জীবন্ত বলি দেওয়া হয়েছিলো। এট ঘটেছিলো ১৪৫০ থেকে ১৪৮০ সালের মধ্যে –যাকে বলে দেবতার উদ্দেশ্যে হিউম্যান স্যাক্রিফাইজ। প্রথমেই আমরা এর ওপর একটা মুভি দেখতে পেলাম- সম্যক ধারণা হলো ইনকাদের স্যাক্রিফাইজ কিভাবে হতো ও কেন। 
জুয়ানিটার মমি অনেক অনেক বছর পর ১৯৯৫ সালে আবিস্কার হয়। জুয়ানিটার মমি এই মিউজিয়ামে রাখা থাকে মে থেকে নভেম্বরে, আমরা তাই দেখতে পেলাম না। একদম হতাশ হলাম না কেননা জুয়ানিটার মমি একেবারে ওপরে পাওয়া গেলেও নীচে আর একজন বালককে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়- তার মমি ছিলো। এখানে ফটো তোলা বারণ তাই খালি হাতেই ফিরলাম। 

পরবর্তী আকর্ষণ সান্তা ক্যাতরিনা মনেষ্ট্রী। আরুকিপার একটা বিরাট সুবিধা যে আমরা সিটি সেন্টার তে থাকায়, প্রায় সব কিছু দ্রষ্টব্য স্থানই হাঁটা পথ। সান্তা ক্যাটারিনা বিরাট মনেষ্ট্রি - প্রায় বিশ হাজার স্কোয়ার মিটার জুড়ে। তাই একজন গাইড নিতে হলো। ভাগ্যিস গাইড নিয়েছিলাম, না হলে অনেক কিছু জানতেই পারতাম না। সাড়ে চারশো বছরের পুরানো এই মনেষ্ট্রির দ্বার সাধারণ জনতার জন্য খুলেছে সবে ১৯৭৫ সালে। এখানে নানদের বিভিন্ন শ্রেণী অনুযায়ী বাড়ী, ক্লয়স্টার, রান্নার সরঞ্জাম, বাসনপত্র ও আসবাবপত্র দেখলাম। একসময় এখানে বাড়ীর কোনো মেয়েকে নান হিসাবে পাঠাতে পারলে পরিবার ধন্য বলে মনে করতো। তার জন্য প্রচুর সোনাদানা ও টাকাকড়িও দিতে হতো। একসময় ৫০০ নানের আস্তানা ছিলো এই মনেষ্ট্রি । আজও তা চালু, যদিও ২০ জন নান এখন আছেন। 

























মনেষ্ট্রি দেখে বেরুতে বেরুতে প্রায় তিনটে। প্রচন্ড ক্ষিধেয় পেট জ্বলে যাচ্ছিলো । দারুণ ফলের রস ও খাবার খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি হলো। দেখেছি ফলের রস ও সব্জীর স্বাদ অতুলনীয় । অনেক চাইনীজ টাইপ খাবার রেস্তোঁরাও আছে, তাদের চিফা বলে- তার মানও খারাপ নয়। অনেকটা আমাদের কলকাতার চাইনীজের মতো। 

১৩ই এপ্রিল ২০১৯- আরুকিপা 

সারা শহরটা আজ ঘুরে ঘুরে দেখা হলো। বেশ কিছু দোকান পত্র-ও। প্রধান উদ্দেশ্য এখানে বেবী আলপাকার উলের সোয়োটার, চাদর, স্কার্ফ দেখা। অত্যন্ত নরম ও গরম এই বেবী আলপাকার সোয়োটার অতুলনীয়। দু একটি কেনাও হলো। 

সকালে আগ্নেয়গিরির রূপ আরো ভালো ভাবে প্রত্যক্ষ করবো বলে মাত্র ৬ সোল ভাড়ায় চলে এলাম মাইল দুয়েক দূরে “মিরাডোর দ্য ইয়ানাহুরা”(Miradaor de Yanahuara) ।এখানে উনিশ শতকের বানানো একটি ভিউ প্ল্যাটফর্ম আর গেটের মতো আছে। এখান থেকে মিসতিকে খুব ভালো দেখা গেলো। ঝকঝক করছে মিসতির চূড়া। 




(চলবে) 






0 comments: