0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in

অনুবাদ সাহিত্য

অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ১
অংকুর সাহা 

প্রেমের কবিতার সন্ধান ও পাঠ: আমার অনেক দিনের অভ্যেস ও স্বভাব। গত চার দশক ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় রচিত প্রেমের কবিতা দেখলেই সংগ্রহ করি এবং তারপর সময়-সুযোগ পেলেই তাদের বাংলায় অনুবাদ করি। অনুবাদের মাধ্যমে দ্বিতীয়বার নিবিড়ভাবে উপভোগ ও অনুধাবন করা যায় কবিতাগুলিকে। খুবই এলোমেলো কাজ; একেবারেই কোনো চিন্তা বা পরিকল্পনা নিয়ে এই অনুবাদগুলি গড়ে ওঠে নি -- কেবল আমার ভালো লাগা দিয়েই তাদের মূল্যায়ন।

কেবল ইংরেজি ভাষার কবিতা নয়, কেবল পশ্চিমি দেশগুলির কবিদের কবিতা নয়, খানিকটা গণতান্ত্রিকভাবেই আমি নির্বাচন করেছি প্রেমের কবিতা; ফলে সবগুলি মহাদেশেরই কিছু কিছু কবিতা স্থান পাবে এই সংকলনে। আর অনুবাদগুলি মূলত ইংরেজির মাধ্যমে, কারণ অল্পস্বল্প মৌখিক এসপানিওল ছাড়া কেবল ইংরেজিই এই প্রতিবেদকের সম্বল। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকার সুবাদে আমার সহকর্মীরা অসংখ্য ভাষাভাষী এবং যেখানেই মূল কবিতার সন্ধান পাওয়া গেছে, সেখানেই আমি সেই কবিতার মাতৃভাষার কাউকে দিয়ে পড়িয়ে নেবার চেচ্টা করেছি, যাতে শব্দগুলোর উচ্চারণ এবং ছন্দের খাঁজখোঁজগুলো মনে গেঁথে যায় -- এইভাবে চিনে, জাপানি, হিব্রু, ফরাসি, আরবি, তুর্কি প্রভৃতি ভাষার খানিকটা আভাস পাওয়া গেছে বলে মনে হয়। 

প্রেমের কবিতা আজকাল লেখা হয় খুব কম। বেশির ভাগ রোমান্টিক আর অনুভবময়, গা শির শির করে ওঠা কবিতাগুলো রচিত হয়েছে ঊনবিংশ শতকে আর বিংশ শতকের প্রথমার্ধে। কিন্তু গত কয়েক দশকে ভীষণভাবে এবং খানিকটা বিপজ্জনকভাবেও কমে আসছে অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- সেটা কিন্তু ভালো লক্ষণ নয়। তরুণ কবিদের লেখা উল্লেখযোগ্য প্রেমের কবিতা আর যেন চোখেই পড়ে না। 

আমেরিকায় (যেখানে আমার বসবাস চার দশক ছুঁতে চললো), ফেব্রুয়ারী হলো কালো মানুষদের ইতিহাস উদযাপনের মাস, জুন হলো সমকামীদের গর্ব প্রকাশের মাস; কবিতার পাঠকদের কাছে এপ্রিল এক নিষ্ঠুর মাস; বর্ষাকালের কোনো একটি মাসকে “প্রেমের কবিতার মাস” নাম দিলে কেমন হয়?

সংকলিত ও অনুবাদিত কবিতাগুলির নির্বাচন নির্মমভাবে পবিত্র ও ব্যক্তিগত: তার একমাত্র মাপকাঠি আমার ভালো লাগা; কবিরা অনেকে পরিচিত ও জনপ্রিয় আবার এমন কবিও আছেন যাঁরা নিজের ভাষাতেই বিশেষ পরিচিত নন এবং বাংলা ভাষার অঙ্গনে এই তাঁদের প্রথম পরিক্রমা। যেখানেই পেরেছি কবিদের অনুমতি নিয়েছি, তবে সবসময় সম্ভব হয়নি।

কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে আমি মধ্যপথের পথিক -- প্রথমত, অনূদিত ভাষ্যটিকে বাংলা ভাষায় কবিতা হয়ে উঠতে হবে; আর দ্বিতীয়ত, তাকে মূল কবিতা (অথবা তার ইংরেজি টেক্সট এর) যতটা সম্ভব কাছাকাছি নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি; কিন্তু বাংলাতে কবিতা হয়ে ওঠাটাকে গুরুত্ব দিয়েছি বেশি। তৃতীয়ত, যেখানেই পেরেছি মূল কবিতার ছন্দমিলের শৈলীকে চেষ্টা করেছি বজায় রাখতে, তবে প্রথম শর্তের সঙ্গে সমঝোতা করে নয়। কিন্তু যেখানে মূল ভাষার সনেটকে ইংরেজি অনুবাদক জুতে দিয়েছেন মুক্তছন্দের বা টানা গদ্যের গোশকটে, সেখানে আমার বিশেষ কিছু করার ছিল না।

কবিদের মধ্যে আছেন নারী ও পুরুষ এবং দুই লিঙ্গের সীমান্তে সন্তর্পণে জীবনযাপন করা কিছু কবিও। তাঁরা শ্বেতকায়, কৃষ্ণকায়, হলুদ, বাদামি এবং রামধনুকের সাতটি রঙের। এই প্রেম নারী পুরুষ মানে না; নারী-নারী এবং পুরুষ-পুরুষের একান্ত ঘনিষ্ঠতাও পবিত্র ও সুষমাময়। তার মানে অবশ্য এই নয় যে নারী-পুরুষ অথবা পুরুষ-নারীর প্রেম নিয়ে কিছু অসুবিধে রয়েছে। কবিদের মধ্যে বেশ কিছুজন বিজ্ঞাপিতভাবে সমকামী। বাকিদের মধ্যে অনেকে প্রকাশ্যে অসমকামী হলেও তাঁদের উভকামিতার টুকরো-টাকরা সংবাদ মেলে।

কবিতা ও জীবনযাত্রার বৈচিত্রে এঁরা বর্ণময়; কবি হিসেবে এঁরা সাহসী, মুখর, দক্ষ এবং বহুমুখী - অনেক নানান পুরষ্কারে ভূষিত, আবার অনেকে লিখে গেছেন বা লিখে চলেছেন নির্জনতার অবহেলায়।

আর একটা কথা: আমি কেবল সেসব কবিদের নির্বাচন করেছি, যাঁদের জন্ম ১২৬৮ সনের পঁচিশে বৈশাখের পরে। কেন? ইচ্ছে, ইচ্ছে, ইচ্ছে!!!

এবং যতটা পেরেছি এই সংকলনের কবিদের উপস্থাপন করেছি তাঁদের জন্মসালের কালানুক্রমে। যে সব কবিদের জন্ম একই বছরে, তাদের স্থানগুলিতে কয়েক মাসের অনিচ্ছাকৃত আগুপিছু ঘটে যেতেও পারে।

আগের কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছে এই সংকলনের প্রথম ৮টি কবিতা “অনুবাদ কবিতাগুচ্ছ” নামে। তার পর থেকেই শুরু হলো এই কিস্তি।

আর বিলম্ব না না, আর বিলম্ব নয়। আসুন এবার প্রেমের কবিতাগুলো পড়া যাক। 

হুয়ানা দা ইবারবাওরাও: (উরুগুয়াই, ১৮৯২-১৯৭৯)

ভোর 

কাটিয়েছি নিদ্রাহীন অস্থির রজনী।
ভোর হয়ে আসে আর শয্যা ছেড়ে উঠি বিতৃষ্ণায়।
একা একা হেঁটে যাই দীর্ঘ পথ ধরে 
দুধারে অর্গলবদ্ধ দরজা আর ঘুমন্ত আলয়।

ধোঁয়ার মতন ভোর আসে।
মনে হয় বেরসিক, বিরক্ত তপন,
কাঁচা কাঠে আগুন ধরিয়ে 
চালে-ডালে রান্না জুড়েছেন।

বাতাসের আর্দ্র ছোঁয়া, সে যেন এসেছে আজ 
সদ্য স্নান সেরে। আকাশ বর্ণহীন, ম্লান,
মিটমিটে অসংখ্য তারারা 
দিগন্তে হারিয়ে যায় একে একে।

লালটুপি গোয়ালাটি হাঁটে।
পুরাতন গৃহের প্রাচীরে,
আপেল ফলের ভারে নুয়ে পড়া বৃক্ষশাখা,
দেখে লোভ হয়।

পায়ে পায়ে হাঁটি, হাঁটি, হাঁটি।
বাড়ি ফিরে তার মুখে নুয়ে 
চুমু খাই, ডেকে তুলি তাকে।
ভাববে সে খিদেয়, আশ্লেষে,
আমিও এসেছি তার পাশে, সদ্য স্নান সেরে।

[উরুগুয়াই এর মানবীকবিদের মধ্যে জনপ্রিয়তমা -- নারীবাদী ও প্রকৃতিপ্রেমী। হুয়ানা ফার্নান্দেস মোরালেস এর জন্ম মার্চ ৮, ১৮৯৫ অথবা ১৮৯২; তিনি বলতেন প্রথম তারিখটি, কিন্তু পরে জানা যাই যে পরেরটাই ঠিক। ২০ বছর বয়েসে তাঁর বিবাহ ক্যাপ্টেন লুকাস ইবারবাওরাও এর সঙ্গে -- ২৯ বছরের দাম্পত্যজীবন ও একটি সন্তান। এই সময়ের কবিতা প্রেম, যৌনতা ও প্রকৃতিকেন্দ্রিক। ১৯৪২ সালে স্বামীর মৃত্যু এক বিশাল মানসিক আঘাত -- পরবর্তী জীবনের কবিতায় মৃত্যুভাবনা ও নস্টালজিয়া চোখে পড়ার মতো। তাঁর শেষ জীবনের কবিতাতেও কুন্ঠা বা সংকোচের চিহ্ন নেই; তিনি সজীব, সতেজ, সামাজিক ও নৈতিক বাধানিষেধের নিগড় থেকে মুক্ত। ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের উচ্চ সাহিত্যিক পুরস্কারে ভূষিত। সংকলিত কবিতাটি ১৯২২ সালে প্রকাশিত “বন্য শিকড়” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া -- ইংরেজি অনুবাদ করেছেন পেরি হিগম্যান।]

আলফনসিনা স্তরনি: (আর্হেন্তিনা, ১৮৯২-১৯৩৮)

আমার জন্যে সমাধিলিপি 

এখানে শায়িত আমি: কথা বলছি আলফনসিনা 
দ্যাখো এ সমাধিলিপি, হে পথিক, ভালো লাগে কি না।

এখানে শায়িত আমি, শান্তিময় নিজস্ব গর্তে,
অনুভূতিহীন, রয়েছে সান্ত্বনা আর ভালো লাগে মরতে।

ঘোলাটে ও মৃত চোখদুটি, কোনোদিন ঝলসাবে না,
ঠোঁটদুটি, একটু ফাঁক, অকারণে আকুল হবে না।

শুয়ে আছি, চিন্তা নেই, অন্তহীন শান্তির নিদ্রায়,
ডাকে লোকে প্রতিদিন, উত্তর দিই না অনিচ্ছায়।

ঝুর ঝুর ধুলো ঝরে, তনুতে লাগে না শিহরণ,
শীত আসে, ঠান্ডা হওয়া, হাড়ে হাড়ে লাগে না কাঁপন।

বৈশাখে ফলের মতো পাকে না আমার স্বপ্নগুলি,
বসন্তে স্বপ্নেরা আর চুপি চুপি যায় না পথ ভুলি।

হৃদয় জাগে না আর, আলুথালু করে না আমাকে,
পার্থিব বাসনা আর শরীর আলাদা হয়ে থাকে।

ভোরবেলা পাখি ডেকে জীবিতকে কত কিছু বলে,
টাটকা সংবাদ আনে, বিচলিত গানের বল্কলে:

“উঠেছে নবীন চাঁদ, সুরভিত হয়েছে সাগর 
ঢেউয়ের ফেনায় স্নান, নগ্ন তনু, জাগ্রত, ডাগর।

একটি পুরুষ হাঁটে, তীর ধরে, সঙ্গে চলে তার,
মুখর ভ্রমর এক, এলোমেলো, পাগল, মাতাল।

শুভ্র পোশাকে ঢাকা, কামনায় তাহার শরীর 
আরেক শরীর চায়, মরণ কাঁপনে অস্থির।

নৌকার গলুই থেকে নাবিকের স্বপ্ন দেখা চলে,
যুবতীরা গান গায়, শস্য ভরা ডিঙি কথা বলে।

জাহাজের বেপরোয়া পাল ওঠে, নিচে খোলে বসে,
মানুষেরা পাড়ি দেয় নতুন জমির খোঁজে, অজানা সাহসে।

যে নারীটি শুয়ে আছে সংকুল পৃথিবী থেকে নিচে,
খিল খিল হাসে তার সমাধিতে লিখে রাখা মিছে 

কথাগুলি -- কারণ বিধুর নারী লিখেছিল লজ্জাপরবশ:
“জীবনে পুরুষ তাকে দিয়েছিলো অন্তহীন সুখের পরশ।

[জলজ আর্দ্রতার কবি: জন্ম হয়েছিল জাহাজে, আর্হেন্তিনা থেকে সুইটস্যারল্যান্ডে যাওয়ার পথে। ১৯১৬ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ “গোলাপের অস্থিরতা”, দু বছর পরে “সোহাগের ক্ষত”; সংকলিত কবিতাটি ১৯২৫ সালে প্রকাশিত “গেরুয়া” কাব্যগ্রন্থ থেকে। ইংরেজি অনুবাদ: পেরি হিগম্যান। ১৯৩৮ সালের অক্টোবর মাসে “লা নেশিওন” সংবাদপত্রে “ঘুমোতে যাই এখন” নামে একটি কবিতা পাঠিয়ে বেড়াতে গেলেন মার্ দেল প্লাতার সমুদ্রসৈকতে। সেখানে ২৫শে অক্টোবর বিকেলে সোজা হেঁটে গেলেন সমুদ্রে, ধরা দিলেন তার বাহুবন্ধনে। কয়েক দিন পরে সমুদ্র ফিরিয়ে দিল তাঁর শান্ত, প্রাণহীন দেহ। মৃত্যুর আশি বছর পরেও তাঁর কবিতা সজীব ও প্রাসঙ্গিক।]

এডনা সেন্ট ভিনসেন্ট মিলে: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৮৯২-১৯৫০)

সনেট--১০

হে দয়িত, কখনও কি ভেবেছ এ অসম্ভব কথা:
দিবসের স্রোতে এসে উপস্থিত অবিবেকী কাল,

চুম্বন ছিনিয়ে নেবে মৃত্যুধিক নির্মম পাষাণ,
আমি রয়ে যাব স্থির, হবে তুমি প্রৌঢ়, পক্বকেশ?

তুমি আর আমি প্রিয়, আরোহণে কেটেছে যৌবন 
জীবন মধুর স্বাদ, দাম্পত্যের ঊর্ধ্ব, উচ্চ চূড়া 
বেয়ে উঠি তীর্থযাত্রী, তার পরে ভুলে যাই স্মৃতি,
পৃথিবী ঘুরেই চলে নিয়মিত পাথুরে আঁধার।

শুই কিন্তু জেগে থাকি, হৃদয়ের গোপন বাতিটি 
এক ফুঁয়ে নিভে গেছে পরস্পরে নিগূঢ় পাথরে:
মনে পড়ে সেই দিন দরজা খুলে এসেছিলে তুমি 
আমি অকিঞ্চিৎ শিশু, তুমি যুবা বীর চূড়ামণি?

ধীরে ধীরে রাত শেষ, শান্ত অপ্রাকৃত ভোর আসে 
আমাদের মনস্তাপ শূন্যে ভাঙে দূরের আকাশে।

[কবি ও নাট্যকার; সাহসী, বোহেমিয়া জীবনযাত্রার জন্যে খ্যাত। ১৯২৩ সালে প্রথম মানবীকবি হিসেবে পুলিৎসার পুরষ্কার পান। এক স্বামী আর অনেক প্রেমিক, তাঁদের অনেকেই প্রথিতযশা কাব ও লেখক। কবিতাটি ১৯৫০ সালে প্রকাশিত “কবিতা সমগ্র” থেকে নেওয়া।]

ডরোথি পার্কার: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৮৯৩-১৯৬৭)

প্রহর রাতের স্তোত্র 

অনেক পুরুষ, অনেক পুরুষ 
পুস্তকালয় 
দেখলে দাঁড়ায়।

(দিদি গো, মনস্থির করো, সারা জীবনের হাপিত্যেশ!)

অনেক পুরুষ, অনেক পুরুষ
জুয়ার আড্ডা 
দেখলে দাঁড়ায়।

(বলেছিল, চাঁদ উঠলেই আসবে, এদিকে ভোর হয়ে এলো।)

অনেক পুরুষ, অনেক পুরুষ
মদের দোকান 
দেখলে দাঁড়ায়।

(রাত জেগে প্রতীক্ষায় থাকো, ভাত বেড়ে রাখো, এই তো জীবন।)

অনেক পুরুষ, অনেক পুরুষ
ভরযুবতী 
দেখলে দাঁড়ায়।

(ঈশ্বর, আমায় কেন দিলে না এমন সম্পদ?)

অনেক পুরুষ, অনেক পুরুষ
গলফের মাঠ 
দেখলে দাঁড়ায়।

(বই পড়ো, সেলাই-ফোঁড়াই করো, সাধ মিটিয়ে দিবানিদ্রা।)

অনেক পুরুষ, অনেক পুরুষ
গাড়ির শোরুম 
দেখলে দাঁড়ায়।

(কোনো হতভাগার জন্যে অপেক্ষা কোরো না সারা জীবন।)

[কবি, গল্পকার, হাস্যরসিক ও সমালোচক; “ভোগ” কাগজে কাজ করতেন, সেখানেই প্রথম কবিতার প্রকাশ; “ভ্যানিটি ফেয়ার”, “দি নিউ ইয়র্কার“ ও “এস্কোয়ার” পত্রিকায় লিখতেন নিয়মিত; সিনেমার চিত্রনাট্য লিখে অস্কার এর মনোনয়ন পেয়েছিলেন একাধিকবার; দুই স্বামীর সঙ্গে তিনবার বিবাহ; দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে মদের বোতলই তাঁর একমাত্র সঙ্গী; ম্যানহাটান এর হোটেল ঘরে একাকী মৃত্যু; কবিতাটি ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত “দি পোর্টেবল ডরোথি পার্কার” গ্রন্থ থেকে নেওয়া।]

পল এলুয়ার: (ফ্রান্স, ১৮৯৫-১৯৫২)

প্রেমিকা 

তোমার চোখের পাতায় সে দাঁড়িয়ে, 
আমার চুলে মিশেছে তার চুল,
আমার হাতের আদলে তার রূপ,
আমার আঁখির রঙেই তার রঙ,
আমার ছায়ায় মেশায় সত্তা তার,
পাথর যেমন উত্থিত আকাশে।

চক্ষু দুটি রেখেছে সে খোলা,
আমাকে সে দেয় না নিদ্রা যেতে,
দিনের আলোয় স্বপ্ন দেখে চলে,
বাধ্য যে হন পূষন উবে যেতে,

আমার তুমি হাসাও, কাঁদাও, হাসাও,
কথা বলে যাও, কোনোকিছু না বলে।

তোমাকে বলেছি

তোমাকে বলেছি, বলেছি মেঘের কথা,
বলেছি কেমন সাগরে গজালো গাছ,
রোজ ঢেউ ওঠে ডালে পাখিটির তরে,
প্রতিটি নুড়িতে মোলায়েম তার আওয়াজ,
প্রতিটি হাতের মূক, চেনাশোনা মুঠি,
প্রতিটি চোখের দৃশ্য বদলে যায়,
ঘুরে ফায়ার আসে আকাশের সব রঙ,
মদ গিলে আজ মাতাল হয়েছে রাত,
প্রতি পথে পথে সুরক্ষা, ম্যানহোল,
প্রতি জানালায় দেখা যায় খোলা সিঁথি,
তোমাকে বলবো কথা ও চিন্তাজাল,
প্রতিটি আদরে নেচে ওঠে বিশ্বাস।

[ফরাসি কবি এবং পরাবাস্তববাদী সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। বিতর্কিত সাহিত্য, বিতর্কিত জীবনযাত্রা, বিতর্কিত রাজনীতি। ফরাসি ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মেরি অ্যান ক’স।]


লুই আরাগোঁ: (ফ্রান্স, ১৮৯৭-১৯৮২)

পেচ্ছাপখানার দেওয়ালে ছুরি দিয়ে খোদাই কবিতা 

।।১।।

নেভাও নক্ষত্র 
শয্যার প্রান্তে 
দুধ শাদা 
অনুভূমিক 
মধুর তিক্ততা 
ঘুমালে কি 
শরতের ঠোঁট 
পুড়ছে তোমার স্তন 
নগ্ন নিশীথ 
গুঞ্জন শুনি 
অচেনা জিভ 
আমার কানে 
কমলালেবু ওঃ 
হে বিদেশি 
তুমি আমার মত্ততা 
আমার অরণ্য 
আমি নেকড়ে 
তোমায় খাবো 
কুকুরে চাটে 
তোমার পা 


।।২।।

কান পেতে শোনো 
আমার গহনে 
ঝড় ওঠে 
তোমার পানে; 
হাতে তোমার নাম
তোমার ক্রোধ 
তুমুল আঘাত 
ভালোবাসার 
যে মুহূর্ত আসে 
ভয়ের 
আর বিস্ময়ের 
চিৎকার করে 
চিৎকার চিৎকার 
চিৎকার চিৎকার
চিৎকার 
চিৎকার
আমি আছি আমি আছি 
আমি আছি 
মরে যাই মরে যাই 
মরে যাই আমি 

[ফরাসি কবি, কথাসাহিত্যিক ও পরাবাস্তববাদী সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ফরাসি ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মেরি অ্যান ক’স।]

গুয়েন্ডোলিন বেনেট: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯০২-১৯৮১)

কালো মেয়ের প্রতি 

তোমার বাদামি ত্বক নিজের মতন ভালোবাসি,
তোমার স্তনের বৃন্তে অপার, গভীর অন্ধকার,
কথা বললে ভেঙে যায় দু:খের আবেশ সহজেই 
ছায়া ভিড় করে আসে অস্থির দু চোখের পাতায়।

অনেকটা ভুলে যাওয়া প্রাচীন রানির মনোভাব,
আভিজাত্য ফুটে ওঠে ঋজু, মৃদু পদচারণায় 
এবং শিকলপায়ে ক্রীতদাসীদের হাহাকার,
নিভৃত কান্নায় গড়ে তোমার কথার ছন্দহার।

হে কৃশ, বাদামি মেয়ে, দু:খের জীবনসাথী তুমি,
রানির মতন তুমি মাথা উঁচু করে সহে যাও,
ভুলে যাও -- তুমিও গোলাম ছিলে সুদূর অতীতে;
তোমার নিটোল ওষ্ঠ ব্যঙ্গ করে ভবিতব্যে, হাসে! 

[কবি, সাংবাদিক ও গ্রাফিক শিল্পী; হার্লেম রেনেসাঁ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। “অপরচুনিটি: এ জার্নাল অফ নিগ্রো লাইফ ” পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন অনেক দিন। তাঁর এই বিখ্যাত কবিতাটি কালো মানুষের নানান কবিতা সংকলনে সংকলিত] 

হাভিয়ের ভিয়াউররুতিয়া: (মেহিকো, ১৯০৩-১৯৫০)

আমাদের প্রেম 

যদি না আমাদের প্রেম,
একই সঙ্গে হ’ত গোপন,
বেদনাদায়ক, সন্দেহপূর্ণ,
আসামিকে জেরার মতন;

যদি না দীর্ঘদিন 
থাকতে হ’ত অন্তহীন অপেক্ষায়,
বুকের অন্তরালে শূন্যতা 
যেখানে স্পন্দিত হয় হৃদয় 
নির্বিকার দরজায় 
বন্ধ মুঠির আঘাতের মতন;

যদি না আমাদের প্রেম 
হ’ত ব্যথিত স্বপ্নের মতো 
যেখানে আমাকে ছাড়াই জীবন কাটাও তুমি,
আর আমার অভ্যন্তরে , একটি প্রাণ 
আমাকে ডুবিয়ে দেয় শঙ্কায়;

যদি না কাহিল করতো অনিদ্রা 
গভীর রাতের আঁধারে 
উজ্জ্বল চিৎকার;

যদি না আমাদের প্রেম হ’ত 
শূন্যে দড়ির ওপরে হাঁটা 
আমরা দুজনে একসঙ্গে 
নিচে কোনো জাল নেই; 

যদি তোমার মুখের কথাই 
হ’ত একমাত্র কথা যাতে 
তোমার জিনিসপত্রের নাম,
আর কিছু নয়, এবং আমার;

যদি তাদের পুনর্জন্ম না হয়,
ট্র্যাজিক দূরত্ব থেকে তারা 
উঠে না আসে, ভুলে যাওয়া 
আর গুলিয়ে ফেলা বিদ্বেষগুলি;

যদি চোখের দেখা হয় 
সবসময় এক মুহূর্তের জন্যে 
আর সেই মুহূর্তটি চিরস্থায়ী!
তোমার নিবিড় আত্মসমর্পণ;

যদি তোমার চুম্বন হয় 
আর কারুর নয়, কেবল আমার 
ঠোঁটের জন্যে, কম্পিত ও নিবেদিত;
যদি তোমার নিষ্ঠীবন 
মিশে যায় আমার মুখের ভিতর 
অন্তহীন সুস্বাদে;

যদি না আমাদের দুজোড়া ঠোঁট 
শরীরের মতন নগ্ন,
এবং আমাদের শরীর 
দুজোড়া ঠোঁটের মতন নগ্ন;
মিলেমিশে বানায় এক দেহ 
আর এক নি:শ্বাস,
আমাদের হবে না প্রেম, আর 
প্রেম হবে না আমাদের।

[কবি ও গীতিকার, মেহিকোর আধুনিক নাট্য আন্দোলনের জনক। তিনি নিজেকে মূলত কবি বলে ভাবলেও, তাঁর নাটক ও গান বেশি জনপ্রিয়; আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নাট্যশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন; দেশে ফিরে এসে মেহিকোর প্রথম প্রথাবিরোধী থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা করেন; তাঁর কবিতায় মৃত্যুভাবনা এক প্রধান থিম; কবির সাহিত্যকীর্তি নিয়ে পুরো একটি বই লিখেছেন তাঁর অনুরাগী পাঠক ওক্তাবিও পাস ; কবিতাটির প্রথম প্রকাশ ১৯৪৮ সাল। এসপানিওল ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন পেরি হিগম্যান।]

সেপ্টেম্বর ২০১৯ [ক্রমশঃ]

0 comments: