0

গল্প - বিপুল দাস

Posted in

গল্প


জাগরণপালা
বিপুল দাস


ভ্যানওয়ালা প্রাণপণে প্যাডেল মারছিল। তারও সন্দেহ হচ্ছিল শিলিগুড়ির সুপার, যেটা শহরে না ঢুকে বাইপাস হয়ে বেরিয়ে যায়, সেটা তার সওয়ারিকে ধরিয়ে দিতে পারবে কি না। কলেজমোড়ে ওঠা বা নামার প্যাসেঞ্জার না থাকলে সেটা দাঁড়ায় না। বাস যদি সে বাবুকে ধরিয়ে দিতে পারে, ডবল ভাড়া পাবে। না পারলে – মালিক একটা বাজে কথা বলেছিল। অন্যমনস্ক ভাবেই ভ্যানওয়ালা শামসুল তার পেছনে একটা শিরশিরে অনুভূতি টের পেল।

দিব্যেন্দু দ্রুত ভেবে নিচ্ছিল বাস না পেলে ফিরে যাওয়ার সম্ভাব্য পথ কী কী হতে পারে। এক – কলেজমোড়ের পাশে পেট্রল পাম্পে দূরযাত্রার ট্রাকগুলো এসে দাঁড়ায়। পাশেই পাঞ্জাবি ধাবা। ড্রাইভারদের কেউ রাতের খাওয়া সেরে খাটিয়ায় ঘুমিয়ে পড়ে। কেউ চা খেয়ে আবার গাড়িতে গিয়ে ওঠে। তাদের কারও গাড়িতে যদি বলে কয়ে ওঠা যায়। পৌঁছতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু একবার নিজের শহরে পৌঁছতে পারলে দিব্যেন্দুর আর চিন্তা নেই। ভাইকে মোবাইলে খবর দিলে যত রাত হোক, বাইকে এসে তাকে নিয়ে যাবে। দুই – বাস না আসা পর্যন্ত ভ্যানওয়ালাকে আটকে রাখা। বাস বা নিতান্ত ট্রাক পেলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। না হলে অগত্যা আবার ভ্যানেই আলতাডাঙায় ফিরে যাওয়া। কিন্তু যে মেজাজ দেখিয়ে সে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছে, আবার সেখানে সে কোন মুখে ফিরে যাবে? দেখা যাক, কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভ্যানওয়ালা, যাকে তার শ্বশুরমশাই শামসুল বলে ডেকেছিল – তার জন্য অপেক্ষা করবে কি না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাস বা ট্রাক পেলে দিব্যেন্দু তো দিব্যি চলে যাবে। শামসুলকে এই পাঁচ কিলোমিটার পথ খালি ভ্যান নিয়ে অত রাতে ফিরে যেতে হবে। শামসুল যদি অপেক্ষা করতে রাজি না হয়?

রাস্তার দু’পাশে লক্ষ জোনাকি আলোর ঢেউ হয়ে একত্রিশ সি জাতীয় সড়কের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। রাস্তার দু’পাশের নয়ানজুলিতে ব্যাং ডাকছিল ঘ্যাংগো ঘ্যাংগো। উল্টোদিক থেকে আসা গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিলে দিব্যেন্দু ভ্যানের সাইডের কাঠ শক্ত করে চেপে ধরছিল। প্রথমে বাঁ হাতের মণিবন্ধে, বুঝতে না পেরে মোবাইলে কিছুক্ষণ পর পর সময় দেখছিল দিব্যেন্দু।

কী ভাবে সে আবার আলতাডাঙায় ফিরবে? সে তো প্রায় ফাইন্যাল ডিসিশন নিয়েই ও বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। বিয়ের আগেই বীথির অ্যাবরশনের খবর দিয়েছিল ঝন্টু মাস্টার। বলেছিল – বিশ্বাস না হলে একবার খবর না দিয়েই এসে নিজের চোখে দেখে যান। অলোক সমাদ্দারের সঙ্গে বীথি রোজ বাঁধের পারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একদম রেন্ডি টাইপের হয়ে গেছে।

দিব্যেন্দু ফোন কেটে দিয়েছিল। বাইরের লোক তার নিজের বউকে খানকি বলছে, অথচ সে কোনও প্রতিবাদ করতে পারছে না। সম্ভবত দীর্ঘদিন ধরেই অলোক সমাদ্দারের সঙ্গে বীথির ফিজিক্যাল রিলেশন ছিল, দিব্যেন্দু ছিল বলির পাঁঠা। ঝন্টু মাস্টারের ফোন পাওয়ার পর ছোটখাট সন্দেহজনক ঘটনাগুলো দিব্যেন্দুর একটু একটু মনে পড়েছে।

দিব্যেন্দু চিরকাল আড়ালে-থাকা মানুষ। কোথাও ঝুটঝামেলা, লোকজনের ভীড় দেখলে তার চেয়ে লম্বা কোনও মানুষের পেছনে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে দেখার চেষ্টা করেছে। তার হাইট বাঙালিদের গড় উচ্চতার চেয়ে একটু কম। এ বাবদ সুবিধার কথাও সে ভাবে। চট করে কারও নজরে পড়ার সুযোগ কম। ভিড়ের ভেতরে সহজেই সে হারিয়ে যেতে পারে। পুরনো দিনের হিন্দি গান শুনতে ভালোবাসে। বীথিকে দেখে আসার পর সে শুধু বীথির হাইট আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল। তারপর ওরা যখন এ বাড়িতে এসেছিল, দিব্যেন্দুর বাড়ির সবাইকে অবাক করে একেবারে বিয়ের ডেট ফাইন্যাল করে ফিরেছিল। দিব্যেন্দুর বন্ধুরা আড়ালে বলেছিল তাকে একটা মই উপহার দেবে। বীথি লম্বা, স্বাস্থ্যবতী, ফর্সা। বন্ধুদের ঈর্ষা টের পাচ্ছিল দিব্যেন্দু। এখন দিব্যেন্দু বুঝতে পারে ওরা যেমন তেমন করে বীথির বিয়ে দিয়ে বাপের বাড়ি থেকে সরাতে চাইছিল। আগুনের খাপরা। বাতাস দেবার লোক দিনরাত আশেপাশে ঘুর করছে। 

গত সোমবার মামাতো ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে বীথি এখানে এসেছে। কথা ছিল দিব্যেন্দু শনিবারে এসে রবিবারে বউভাত খেয়ে সোমবার ভোরে বীথিকে নিয়ে ফিরবে। মঙ্গলবারে ঝন্টু মাস্টারের ফোন পেল দিব্যেন্দু।

অলোক সমাদ্দারের সঙ্গে তোমার কীসের সম্পর্ক? রাতে বীথিকে জিজ্ঞেস করল দিব্যেন্দু। অনেকবার রিহার্সাল দেওয়া সত্ত্বেও তার গলা কেঁপে উঠল।

কে, অলোকদা? দাদার সঙ্গে বোনের যেমন। নির্বিকার ছিল বীথি।

তিস্তার বাঁধের ওপর অলোকের সঙ্গে বেড়াতে যাওনি তুমি ?

তো কী হয়েছে? স্পষ্ট করে বলো কী জানতে চাইছ তুমি। অলোকদার সঙ্গে বাঁধের পারে বেড়াতে গেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? ছেলেবেলা থেকে ভাইবোনের মত বড় হয়েছি আমরা। আমার চেয়ে অন্তত পনেরো বছরের বড় অলোকদা। আর, অলোকদা কত ভালোমানুষ তুমি জানো? একটা লোক সম্পর্কে কিছু না জেনে তার চরিত্র নিয়ে যা খুশি ভাবলে ! ছি! কী নিচু মন তোমার। জানো, অলোকদা না থাকলে আমাদের সংসার কোথায় ভেসে যেত?

দিব্যেন্দু একবার ভাবল, বিয়ের আগে বীথির অ্যাবরশনের কথা সে জানে – বলে দেবে কিনা। কিন্তু সে তো শিয়োর নয় যে, তার জন্য অলোকই দায়ী। চ্যালেঞ্জ করলে সে আর কোনও প্রমাণ দিতে পারবে না। আমার কানে এসেছে – শুধু এ কথায় এতবড় অপবাদ বীথি কিছুতেই মেনে নেবে না। ঘটনা কবে হয়েছে, কোথায় হয়েছে, কেমন করে হয়েছে, তার আগে কী হয়েছিল, পরে কী হয়েছিল – কিছুই সে জানে না।

সন্ধে সাতটার সময় বীথির সঙ্গে তার কথা হচ্ছিল। ঠিক ছিল কাল ভোরের বাসে বীথিকে নিয়ে সে ফিরে যাবে। কিন্তু মুহূর্তেই সে ঠিক করল আজ রাতেই বীথিকে এখানে রেখে সে ফিরে যাবে। বীথির কথার কোনও উত্তর না দিতে পেরে এক রকম অপমানের আগুন তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। ঝন্টু মাস্টার কেন শুধুশুধু তাকে মিথ্যে বলবে? বীথি এখানে এলে প্রায় রাতেই সে মোবাইলে বীথিকে পায় না। এন্‌গেজড্‌ থাকে। কার সঙ্গে অত কথা বলে? কাল বিকেলে যখন এখানে এসে পৌঁছেছে, তখনও বীথি বাড়িতে ছিল না। তাকে দেখে বীথির মা তাড়াতাড়ি ছোটভাইকে কোথাও পাঠাল। সে বুঝতে পেরেছে।

কিন্তু একটা জিনিস দিব্যেন্দু বুঝতে পারছিল না। অলোকের কথা বলায় বীথির যতটুকু চমকে ওঠা উচিত ছিল, সে রকম তো হল না। সে ভেবেছিল ঘাবড়ে গিয়ে বীথি সব অন্যায় স্বীকার করবে। কিংবা মিথ্যে বলবে, যে মিথ্যে দিব্যেন্দু ধরে ফেলবে। তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে। কান্নাকাটি করবে। কই, সে সব কিছুই তো হল না। উলটে খারাপ সন্দেহ করার জন্য তাকেই কথা শুনতে হল। তবে কি ঝন্টু মাস্টার কোনও কারণে তার বউ-এর নামে মিথ্যে কথা রটাচ্ছে ?

একটা কূট ভাবনা দিব্যেন্দুর মাথায় খেলা করছিল। হয়তো বীথি নয়, বীথির মায়ের সঙ্গেই অলোকের কোনও অবৈধ সম্পর্ক আছে। এই ভাবনার সমর্থনে দিব্যেন্দু দেখল অনেক যুক্তি আছে। শরীরের ভেতরে যে আগুন এতক্ষণ দৌড়ে বেড়াচ্ছিল, এখন যেন তার গতি অনেক কমে এল। ঠিক, তাই হবে। বীথি বলল অনেকদিন ধরেই এ বাড়িতে অলোকের যাতায়াত। এ সংসার নাকি অলক না থাকলে ভেসে যেত। তো, হিসেব কষলে বীথির সঙ্গে অলোকের বয়সের ডিফারেন্স অনেক দাঁড়াচ্ছে। বীথি আর তার মাকে দেখলে তো মনে হয় দু’বোন। ভদ্রমহিলার চেহারা, সাজপোশাক, কথাবার্তা শুনলে তো মনে হয় এখানে, এই গ্রামে একজন সাধারণ ছোট দোকানদারের বউ হয়ে নয়, তার থাকা উচিত ছিল শহরের অনেক উঁচু কোনও ফ্ল্যাটবাড়িতে। দামি গাড়ি থেকে নেমে লিফ্‌টে উঠে ঘরে পৌঁছে যাবে। এই মহিলারই আসলে স্বভাব ভালো নয়।

আমি আজ রাতেই ফিরব ভাবছি। কাল সোমবার, দেরি হলে মুশকিল হবে।

সে কী ! ও বাড়িতে নেমন্তন্ন রয়েছে। আমি একা গেলে সবাই জানতে চাইবে জামাই এল না কেন।

যা হোক কিছু বলে দিও।

বাবাকে, মাকে কী বলব ?

বলে দিও নব্যেন্দু ফোন করেছিল। মার শরীর ভালো নেই।

তুমি কিন্তু আমাকে মিথ্যে সন্দেহ করছ। সন্দেহের স্বপক্ষে কোনও জোরালো যুক্তিপ্রমাণ খুঁজে না পেয়ে আরও কষ্ট পাচ্ছ, ভেতরে ভেতরে রেগে যাচ্ছ। যাও, তোমাকে বাধা দেব না। কিন্তু এখন তোমাকে রাতের খাওয়া না খাইয়ে মা কি যেতে দেবে? ও বাড়ি সবার নেমন্তন্ন বলে ভাতও বসেনি।

বীথি উঠে বাইরে বেরিয়েছিল। মাকে বলেছিল দিব্যেন্দুর কাল সকালে জরুরি কাজ আছে। আজ রাতেই সে ফিরবে। বাবা যেন শামসুলকে বলে দেয় ভ্যানে কলেজমোড়ে পৌঁছে দিতে। রাতে খেয়ে বেরোতে গেলে লাস্ট বাস বেরিয়ে যাবে। খুব তাড়াতাড়ি দু’পিস পাঁউরুটি সেঁকে ডিমভাজার সঙ্গে দিতে বলেছিল।



দূর থেকে দিব্যেন্দু দেখতে পাচ্ছিল কলেজমোড়ে একটা দোকানেই শুধু আলো জ্বলছে। তার মানে অন্য দোকানগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। সামনে পৌঁছে ভ্যান থেকে লাফ দিয়ে নেমে প্রায় দৌড়ে গিয়ে ছিল দিব্যেন্দু। দোকানদারকে শিলিগুড়ির সুপারের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। এই তো বেরিয়ে গেল – দোকানদারের কথা শুনে কাঁধ ঝুলে পড়ল, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল দিব্যেন্দুর।

শামসুল ফিরে গেছে। দিব্যেন্দু তাকে জোর করেই ফেরত পাঠিয়েছে। সে বলেছিল জামাইবাবুর উচিত এখানে না থেকে বাড়িতে ফিরে যাওয়া। তার ভ্যানে সে একদম হরি সরকারের বাড়ির উঠোনে নামিয়ে দিয়ে আসবে। দিব্যেন্দু তার হাতে একটা কুড়ি টাকার নোট দিয়ে বলেছিল – তুমি ফিরে যাও, আমি ট্রাক পেয়ে যাব। তারপর কী ভেবে আরও একটা দশটাকার নোট দিয়েছিল।

শামসুল ফিরে যেতেই দিব্যেন্দু পেট্রোল পাম্পের পাশে ধাবার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। চাতালে সারি সারি খাটিয়া পাতা রয়েছে। কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ বসে বড় গ্লাসে চা খাচ্ছে। গরম রুটি সেঁকার গন্ধ পাচ্ছিল দিব্যেন্দু। বড় বড় ট্রাকগুলো এসে দাঁড়াচ্ছে ধাবার সামনে। কোনও গাড়ি সারা রাতের জন্য এখানে থাকে, কেউ একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার চলতে শুরু করে ডিগবয়, নওগাঁ, তিনসুকিয়ার দিকে। ওদিক থেকেও গাড়ি আসে। বেশির ভাগই শিলিগুড়ি যায়। আরও দূরে যাওয়ার গাড়িও থাকে। কলকাতা, অওরঙ্গাবাদ, ঝাঁসি, বেরেলি, কানপুর, ফরুকাবাদ। কোথাকার ধুলো গাড়ির টায়ারে জড়িয়ে কোথায় চলে যায়।

ধাবার বাইরে চাতালে খাটিয়ায় শুয়ে দিব্যেন্দু দেখছিল মেঘহীন আকাশে অজস্র তারা। আকাশজুড়ে কে যেন মণিমুক্তার চাষ করে রেখেছে। ঝলমল করছে অনন্ত খেত। ধাবায় গান বাজছিল, কত পুরনো গান। তালাত মাহ্‌মুদের জ্বলতে হ্যায় জিসকে লিয়ে। একটু দূরে জাতীয় সড়কের দখল নিয়েছে জোনাকির ঢেউ। লক্ষ আলোকবিন্দু জ্বলছিল, নিভছিল। দিব্যেন্দুর মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে নেমে এসেছে ওরা। কোনও দেবতা ওদের স্বর্গ থেকে মাটির ধুলোয় পাঠিয়ে দিয়েছে – যাও, তোমাদের নির্বাসন দিলাম। আলতাডাঙার কাছে পিচঢালা পথে তোমরা আলোর ঢেউ হয়ে ছড়িয়ে থাকবে।

বাবু, কিছু লাগবে? সিগ্রেট, শরাব, আওর কুছ ...

দিব্যেন্দু সিগারেট খায় না। মদ এক আধদিন খেয়েছে। তাকিয়ে দেখল গেঞ্জি আর লুঙি-ভাঁজ-করে-পরা একজন দাড়িওয়ালা লোক তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এ লোকটা জানে না ঝন্টু মাস্টার তার বউকে স্পষ্ট খানকি বলেছে। সে শুধু তার ফোন বন্ধ করে দিয়েছিল। এ লোকটা জানে না সে কোনও দিন বীথির গালে একটা চড় মারতে পারবে না, নিখুঁত যুক্তি সাজিয়ে বীথিকে হারাতে পারবে না, বীথির মাকে কড়া গলায় বলতে পারবে না – এ বাড়িতে অলোক সমাদ্দার কেন আসাযাওয়া করে? তার চেয়ে লম্বা কোনও মানুষের ছায়ায় আরাম পায় সে।

এক বোতল মদ দাও আমাকে।

পুরা বটল নিবেন ? কোয়াটার ? বেঁটেখাটো মানুষটার কথা শুনে লোকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।

তোমার যেমন সুবিধে হয়, সেভাবেই দাও।

কাচের গ্লাস, জলের বোতল, মদ, প্লেটে ছোলাভাজা রেখে গিয়েছিল লোকটা। একটু ইতস্তত করে জানতে চেয়েছিল আর কিছু লাগবে কি না। তখনই দিব্যেন্দু দেখল ধাবার সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে আধো-অন্ধকারে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে ট্রাকের উজ্জ্বল আলো তার চোখেমুখে এসে পড়লে সে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করছিল। তার পাশ দিয়ে ট্রাকগুলো যাওয়ার সময় সিটি বাজাচ্ছিল ট্রাকের খালাসি। দিব্যেন্দু দেখল, একটা মেয়ে একটু দূরে দাঁড় করানো ট্রাকে গিয়ে উঠল। ভালো করে আশপাশের অন্ধকারে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল দিব্যেন্দু। সন্ধ্যার পর আকাশে একটা দুটো তারা ফুটে ওঠার মত দিব্যেন্দু দেখতে পেল ধাবার ডানদিকে টিউবওয়েলের পাশে, বাঁ দিকে পান-দোকানের আড়ালে, সামনে প্রতিটি গাছের নীচে অন্ধকারে কত মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রথম চুমুক দিয়েই দিব্যেন্দু বুঝল সে পেগটা বানাতে পারেনি। তরল আগুনের মত গলা দিয়ে পাকস্থলীর দিকে নেমে যাওয়া স্পষ্ট টের পেল সে। কিন্তু জল মেশাতে গিয়েও সে থেমে রইল। তার মনে হল জল মেশালে এই রেন্ডি টাইপের বোতলটার ভেতরের পানীয়র ঝাঁজ কমে যাবে। সে একটু একটু করে এটাই শেষ করবে। আবার একটা চুমুক দিয়ে দিব্যেন্দু বুঝল -- অসম্ভব, বুকগলাপেট সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। গ্লাসে আরও জল মেশাল দিব্যেন্দু। তালাত মাহমুদের গান বাজছে। অ্যায় মেরে দিল কহি আওর চল ...

একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল দিব্যেন্দুর খাটিয়ার পাশে। মাথা খাটিয়া থেকে সামান্য একটু ঝুলে পড়েছে দিব্যেন্দুর। পাশে একটা প্লাস্টিকের টেবিলের ওপর বোতল, গ্লাস রয়েছে। দিব্যেন্দু দেখল বিশাল লম্বা একটা মেয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আধো আলো-আধো অন্ধকারে মনে হয় মেয়েটার মাথা এখনই আকাশ ছুঁয়ে দেবে। মৃতদেহবহনকারী গাড়ি পাশ দিয়ে গেলে নাকে যেমন তীব্র অগুরুর গন্ধ ভেসে আসে, হঠাৎ সে রকম গন্ধ নাকে এল দিব্যেন্দুর। সস্তা সিন্থেটিক শাড়ি থেকে মাঝে মাঝে লালনীল আলোর আভা ছিটকে আসছিল দিব্যেন্দুর চোখে। ঘোর-লাগা চোখে তার মনে হচ্ছিল পিচ্ছিল একটা লালনীল খোলসের সাপ তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

বাবু, বোতলটা প্রায় শেষ। আমি নিব ? আপনেকে আর একটু দিব ?

যেন অনেক ওপর থেকে কথাগুলো ভেসে আসছে। দিব্যেন্দু মাথা তুলতে চেষ্টা করছিল। এত লম্বা মেয়েছেলে সে এর আগে দেখেনি। তার মাথা অসম্ভব ভার হয়ে রয়েছে। কী যেন বলল মেয়েটা। বোতলটা চাইছে বোধহয়। এখনও অনেকটা মদ রয়েছে। খালি পেটে দু’গ্লাস খেতেই তার মাথা ঘুরতে শুরু করেছিল। শুয়ে পড়েছিল, মাথা ঘুরছিল দিব্যেন্দুর। বমিও পাচ্ছিল।

বাবু, ধাবার পিছনে ঘর আছে। আশিটাকা নিবে, যাবেন ? ফিসফিস করে বলল মেয়েটা।

জোর করে উঠে বসল দিব্যেন্দু। খাটিয়া, তারাসহ আকাশ, জাতীয় সড়ক, কৃষ্ণচূড়া গাছ – সব দুলে উঠল। অস্বস্তি হচ্ছে তার। শরীরের এই ভাব কখন কাটবে কে জানে। জোর করে দিব্যেন্দু মাথাটা সাফ রাখার চেষ্টা করছিল।

যা, বোতলটা নিয়ে যা তুই।

বসবেন না ? মেয়েটা বুকের আঁচল সরিয়ে দিয়েছিল। এখন আর অতটা দীর্ঘ মনে হয় না তাকে। তার মুখ, বুক মাটির অনেক কাছে নেমে এসেছে। নারীশরীর নিয়ে যে কোনও মেয়েছেলে যেন।

তোর বয়স কত ? জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছিল দিব্যেন্দু।

একটু থমকে গেছে মেয়েটা। এর আগে এ রকম প্রশ্ন তাকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি। কী উত্তর দেবে বুঝতে পারছিল না। দরদাম হবে, ঘরে যাবে, শরীর দেবে, পয়সা নেবে, ব্যস। এর ভেতরে বয়সের কথা আসে কোথা থেকে? কী হবে বয়স দিয়ে? মাতাল এই সব পুরুষগুলো তো শরীরও ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারে না। এই লোকটা বাচ্চামেয়ে পছন্দ করে হয়তো, নাকি তাকেই আজ খুব বুড়ি দেখাচ্ছে।

জানি না বাবু, ভুলে গেছি। কখনও মনে হয় কুড়ি, কখনও চল্লিশ।

যা, তোর মাকে জিজ্ঞেস করে আয়। যা, আমি তোর জন্য বসে থাকব।

মা তো নেই বাবু, মরে গেছে।

এই কথায় দিব্যেন্দু হঠাৎ খাটিয়া ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তাকে দেখে অনেকটা মনোহর আইচ মনে হয়। পকেট হারকিউলিস। শরীরের সমস্ত পেশি ফুলে উঠেছে। নেশাটেশা মুহূর্তে কোথায় উধাও। খ্যাপা একটা জানোয়ারের মত যেন এখনই মেয়েটাকে নখদাঁত দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেবে।

কেন তোর মা মরল ? কেন মরল ?

টানতে টানতে মেয়েটাকে ধাবার পেছনে গাঢ় অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল দিব্যেন্দু। যেন বহুদিনের উপোসি একটা বনবেড়াল দীর্ঘ শীতঘুমের পর জেগে উঠেছে। আসলে মেয়েটার মাকে খুঁজছিল সে। তীব্র হতাশা থেকে যে ক্রোধ আসে, সেই ক্রোধে সে মেয়েটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে চাইছিল। উঃ বাবু, আস্তে – ব্যথায় মেয়েটা কেঁদে উঠলে দিব্যেন্দু হিসহিস করে উঠেছিল। বাবু কী রে, বল অলোক, অলোকদা, অলোককাকু... বল, বল...

0 comments: