0

প্রপঞ্চ - শিশির রায় ও পল্লববরন পাল

Posted in

প্রপঞ্চ


উত্তরাধিকার
শিশির রায় ও পল্লববরন পাল


ঘরে ঢুকতে দু’আঙুল নিজে থেকেই চলে যাচ্ছে নাকে। নিজেরই অজান্তে টিপে ধরছে দুই নাসারন্ধ্র।

পল্লববরন পাল
আমি তো ছোট তখন, কত হবে, ছয়-সাত! ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ সহবত শেখা হয়নি তখনও। বড়রা, যাঁরা মুহুর্মুহু ঢুকতেন-বেরোতেন, কে জানে— হয়তো শ্বাসটুকু বন্ধ করে রাখতেন ওই ঘরে থাকা সময়টুকু! নাকি অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল! তা-ই হবে। আর যাকে দিনের অনেকটা সময় ওই ঘরে কাটাতে হচ্ছে, বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার গা হাত-পা মুছিয়ে দিতে হচ্ছে, খাইয়ে দিতে হচ্ছে খাবার, হাগুমুতু পরিষ্কার করতে হচ্ছে, তার কাছে আবার ওই গন্ধটা কোনও ব্যাপার? মায়েদের, দিদিদের ও সব সয়ে যায়। বা, সইয়ে নিতে হয়। ওদের রান্নাঘর আছে। মশলা, ফোড়নের গন্ধে ও গন্ধ পালিয়ে যাবে। স্নানঘর আছে। নারকোল তেল, কসকো কি তিব্বত সাবানের গন্ধে ও গন্ধ মুছে যাবে। নরম-নরম, ফুলেল লাক্স হলে তো কথাই নেই।

বিছানায় শুয়ে যিনি, তিনি আমার ঠাকুরমা। পক্ষাঘাতে পঙ্গু, প্রকৃতি তাঁর নড়নচড়নে ঢ্যারা টেনে দিয়েছে। গ্রামের বাড়িতে পোষা গরু কী কারণে খেপে গিয়ে ঢুসিয়ে দিয়েছিল, সেই ক্ষত থেকে এই পরিণতি। শহরে আমাদের ভাড়াবাড়িতেই একটা ঘরে তিনি থাকতেন— চিকিৎসার, এবং জীবনেরও শেষ দিকটায়। সেই ঘরেই, ওঁর সঙ্গে থাকত ওই গন্ধটাও। শয্যাশায়ী, মুমূর্ষু রোগীর সামনে এলে যে নাক টিপে ধরে বসতে নেই, আমি কী করে জানব! মা বা দিদিরা নাক থেকে হাত সরিয়ে দিত। তিনি, আমার পিতামহী— কী জানি, দেখেও দেখতেন কি?

গন্ধটার উপকরণ যে কী কী ছিল, এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও বুঝতে পারি না। অনেক ওষুধ, ট্যাবলেট-ক্যাপসুল, সিরাপের শিশি, ইঞ্জেকশন-স্যালাইন একটা ঘরে থাকলে কি ও রকম গন্ধ হয়? তেতো, বিস্বাদ, গা গুলিয়ে-ওঠা একটা গন্ধ? নাকি পেচ্ছাপের গন্ধ, খাটের নীচে রাখা গামলাটা থেকে, বা মানুষটার শরীরে লেগে থাকা ক্যাথিটার থেকে যে গন্ধকণা ছেয়ে যায় ঘরের বাতাসে? বাসি কাপড়-জামার গন্ধ? সময়ে সময়ে বিছানার চাদর, গায়ের সাদা শাড়ি পাল্টে দিলেও যে গন্ধটা আঁকড়ে থাকে খাটের পায়া, টেবিলের কোনা, জানলার পর্দাকে? গজ-ব্যান্ডেজ, টেবিল-খাট মোছার ন্যাতার গন্ধ? নাকি ব্লিচিং পাউডার, ডেটলের— না-জীবনের দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকা একটা মানুষকেও যে জীবাণুনাশকের গন্ধও আর জীবনে ফেরাতে পারে না?

তাই আমি নাক টিপে ঠাকুরমার কাছে বসতাম। হাত সরিয়ে দিলেও, আবার সে খুঁজে নিত যথাস্থান। এখন বুঝি, গন্ধ আর ঘ্রাণ, এই দুইয়ের তফাত বুঝতে বড় হতে হয় না। ‘গন্ধ’ শব্দটার মধ্যেই কেমন যেন একটা জৈবিক, একটা পচনশীল ব্যাপার আছে। সুগন্ধের মধ্যে ‘গন্ধ’ থাকলেও সে যেন কেমন খাপছাড়া। ‘গন্ধ’ শব্দটার ওপর একচেটিয়া অধিকার যেন কেবল দুর্গন্ধেরই। আর ‘ঘ্রাণ’ শব্দটা ভালো। জীবনের যা-কিছু কোমল, সুন্দর, সু-স্মৃতি— মনে করায়। জবাকুসুম তেল। মুসুর ডালে পেঁয়াজের সম্বরা। টগবগ ভাতের হাঁড়ি। ইলিশ খেয়ে উঠে হাত শোঁকা। মহাভারতে পড়েছি, বড়রা ছোটদের মস্তক আঘ্রাণ করছেন। আসলে তো স্নেহের স্পর্শ, বাৎসল্যের প্রকাশ। কিন্তু এই ‘আঘ্রাণ’ শব্দটা কী নরম, হালকা!

বহু বছর পরে, এই গেল-ডিসেম্বরে, সেই গন্ধটা ফিরে এল। স্মৃতিটা নয়। সত্যিকারের গন্ধটা। এয়ারপোর্টে নেমেছি, গাড়িতে চেপে বাড়ি পৌঁছেছি, ঢুকেছি ওঁর ঘরে। শুয়ে ছিলেন। শুয়েই থাকতেন দিনের বেশির ভাগ সময়টা। এমন নয় যে অসুখ করেছে মারাত্মক কিছু। জীবন, রোজের রুটিন অমনই হয়ে গিয়েছিল— একটু কাগজ পড়া, কালেভদ্রে বই, নাম কা ওয়াস্তে খাওয়া, ঘরেরই এক কোণে চেয়ার-বাথরুমে পায়খানা-পেচ্ছাপ। ছোড়দি গা মুছিয়ে দেয়, পরিষ্কার করে দেয়। জীবনের চাকা কেমন গড়িয়ে গিয়েও ফিরে ফিরে আসে! ওঁর ঘরে ঢুকতেই, বহু বছর আগের সেই গন্ধটাও ফিরে এল নাকে। এখন তো বড় হয়ে গিয়েছি, ঢাকাচাপায় পারঙ্গম। তাই নাক কুঁচকোল না, হাত চলে গেল না প্রতিবর্ত ক্রিয়ায়। খাটে বসলাম, কথা বললাম, উঠলাম, গেলাম অন্য ঘরে।

আর বুঝলাম। এই এত, এত বছর পর। আমার বাবা, আমার জন্মদাতা বৃদ্ধ পিতার ঘরে যে গন্ধটা ঘুরপাক খাচ্ছিল, সে সেই পিতামহীর ঘরের গন্ধের উত্তরাধিকার। মৃত্যুর গন্ধ।
শিশির রায়

0 comments: