1

গল্প - সৌম্য ব্যানার্জী

Posted in

গল্প


দুর্গতিনাশিনী
সৌম্য ব্যানার্জী


বাইরে কম্পাউন্ডে ঢাক বাজছিলো। বোধহয় প্রতিমা এলো। ছেলেপিলেদের হুল্লোড়ের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। জানলার কাছে গিয়ে দেখলাম, ট্রাক ঢুকছে প্রতিমা নিয়ে। কমল ঢাকি ঢাক বাজাচ্ছে আর তার দশ বছরের ছেলে বাদল টাঁই টাঁই করে কাঁশি বাজিয়ে তার সঙ্গত করছে। আজ থেকে পুজোর ক’দিন ওদের এখানেই ঠিকানা।

আমাদের হাউসিং-এর পুজো। গত বছর কি যেন একটা পুরস্কার পেয়েছে, তাই এবছর ডবল উৎসাহ! তবে সুখের কথা এই যে, প্রতিমা নিয়ে এক্সপরিমেন্ট-টেন্ট হয়নি কোনও। কোনও থীম-টীমও নেওয়া হয়নি। যেমনটা প্রতি বছর হয়, সেই রকমই সাবেকি ডাকের সাজের একচালা ঠাকুর। হলুদ রঙের সিংহ প্রবল পরাক্রমে সবুজ রঙের অসুরকে কামড়াতে যাচ্ছে, কার্তিক-গণেশ-লক্ষ্মী-সরস্বতী সুবোধ বালক-বালিকার মতন দু’পাশে উপর-নীচ করে দাঁড়িয়ে আছে... আর সবার উপরে যামিনী রায়-মার্কা চোখ ভরা ক্রোধ আর আশীর্বাদ নিয়ে দশপ্রহরণধারিনী মা দুর্গা। আমার বউয়ের ভাষায়, ‘‘দেখলেই ভক্তি আসে।’’

কম্পাউন্ডের বাইরে কুকুরগুলো তারস্বরে চ্যাঁচাচ্ছিলো। বাঙালি কুকুরদেরও আজকাল পুজোয় উৎসাহ হয়েছে কি না ভাবছি, এমন সময় পিছন থেকে অমৃতদা বললো, ‘‘কি? দেবীর বাহন ডাকাডাকি করছে নাকি?’’

ফিরে তাকালাম। অমৃতদার ফ্ল্যাটেই বসেছিলাম। শনিবারের সকাল। আজ পঞ্চমী। কাল থেকে টানা ছুটি। গত বছর জুলাইতে এই আবাসনে শিফট করে আসার পরেই বউ এখানকার পুজো নিয়ে মেতে উঠেছিলো। গত বছরও পুজোর ছুটিতে বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি। এবার তো আর সেই প্রশ্নই নেই। তাই সামনে ক’দিন খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম আর আফুরন্ত আড্ডা। অমৃতদা এমনিতেই ঘরকুণো লোক।

বললাম, ‘‘কানে কি ম্যাগ্নিফায়ার লাগিয়েছো নাকি?’’

অমৃতদা ভুরু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে।

‘‘কুকুরের ডাককে সিংহের গর্জন মনে হচ্ছে...’’

‘‘সিংহের গর্জন মনে হবে কেন? কুকুরের ডাককে কুকুরের ডাকই মনে হচ্ছে।’’

এবার আমার ভুরু কোঁচকানোর পালা। একটা টিপিকাল অমৃত অধিকারী-মার্কা মোক্ষম কিছু আসছে... ‘‘দুর্গার বাহন কি কুকুর নাকি?’’

অমৃতদা কফির মাগটা একবার দু’আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে দিলো। সাসপেন্স তৈরি করার একটা স্টাইল, আর কি! তারপর বললো, ‘‘আদতে তাই ছিলো।’’

আমি হতভম্ব! বলে কি লোকটা? দুর্গার বাহন কুকুর ছিলো???

‘‘মানুষ বাঘ-সিংহের পিঠে সওয়ার হয়ে যুদ্ধ করতে গেছে শুনেছো কোনওদিন? পড়েছো কোনও ইতিহাসে?’’

মানতে হলো, তেমন কিছু সত্যিই পড়িনি কোনওদিন।

‘‘বেড়াল ইনস্টিংক্টিভ জানোয়ার। ওদের একটা লেভেলের পর কন্ডিশনিং করা যায় না। কোনওক্রমে পোষ মানিয়ে যদি যুদ্ধে নিয়েও যাও, যুদ্ধের উত্তেজনায় এবং নিজেদের কিলার ইনস্টিংক্টে যে এক সময় তোমার উপরেই ব্যাকফায়ার করবে না, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। তাই রাজারাজড়ারা এক কালে বাঘ-সিংহ পুষলেও তাদের কোনওদিনই যুদ্ধে ব্যবহার করেনি। তারা জানতো, ওটা করা যায় না। তাই ইতিহাসে কোনওদিন ওরকম কোনও ঘটনা পাবে না।’’

অকাট্য যুক্তি। কিন্তু তাই বলে কুকুর? আর তার থেকেও যেটা বড় প্রশ্ন... ‘‘দুর্গার গল্প কি ইতিহাস? মানে, দুর্গাকে ঐতিহাসিক চরিত্র বলছো?’’ প্রশ্নটা করেই ফেললাম।

খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে অমৃতদা পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘‘তোমার কি মনে হয়?’’

এটা নিয়ে ভাবিনি কোনওদিন। দেবদেবীদের সব পৌরাণিক চরিত্র বলেই জেনে এসেছি চিরকাল। আমার মাগটা তুলে কফিতে চুমুক দিলাম। অতি উপাদেয় ফিল্টার কফি... অমৃত অধিকারী স্পেশাল। তারপর বললাম, ‘‘যতদূর জানি, ইতিহাস ব্যাপারটা শুরু হয়েছে বৌদ্ধযুগে। মানে, অফিশিয়াল ডকুমেন্টেশন অফ হিস্টরি যাকে বলে। তার আগের সব কিছুই পুরাণ। সেদিক থেকে দেখতে গেলে দুর্গাও তাই, কারণ দুর্গার গল্প অবভিয়সলি বৌদ্ধযুগের আগের গল্প। তাই না?’’

এমনিতে অমৃতদার সামনে বিদ্যে জাহির করা বিপজ্জনক ব্যাপার। ইতিহাসের ডাকসাইটে অধ্যাপক, সংস্কৃত সাহিত্যে অগাধ জ্ঞান, বিপজ্জনক রকমের পণ্ডিত... এবং রূড, স্নব, ইত্যাদি সব বিশেষণে ভূষিত আমার প্রতিবেশী ডঃ অমৃত অধিকারী। বিশেষণগুলো যে খুব বাড়াবাড়ি নয়, সেটা ওর সামনে ইতিহাস, পুরাণ বা প্রাচীন সাহিত্য জাতীয় বিষয় সম্বন্ধে ভুলভাল কিছু বললেই টের পাওয়া যায়। তবে এই ব্যাপারটা জানা ছিলো। ইতিহাসে যে কল্পনা থাকতে পারে না, থাকা উচিত নয়, সে ধারণা মানুষের প্রথমটা ছিলো না। তাই আমাদের পুরাণগুলো বেশির ভাগ ওইরকম সব গাঁজাখুরি গপ্পে ভর্তি। বৌদ্ধ অর্হৎরা, মানে স্কলাররা, প্রথম ব্যাপারটা উপলব্ধি করেন এবং কল্পনারহিত ইতিহাস গ্রন্থন আরম্ভ করেন, এবং সেটা অবশ্যই পাঁচশো খ্রীষ্টপূর্বাব্দের আগে নয়।

‘‘হুঁ।’’ অমৃতদা মাথা নাড়লো। ‘‘বেশ আশ্চর্যভাবে, ভারতবর্ষে আর গ্রীসে প্রায় একই সময়ে ইতিহাস একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ডিসিপ্লিন হিসেবে চিহ্নিত হয়।’’ কফিতে চুমুক দিলো। ‘‘হেরোডোটাসের নাম শোনা আছে নিশ্চয়ই?’’

‘‘হ্যাঁ। ফাদার অফ হিস্টরি। সোক্রাটেসের সমসাময়িক ছিলেন না?’’ আমিও চুমুক দিলাম কফিতে।

‘‘হুঁ। চারশো বিসি-র মানুষ। ওইরকম সময়েই এখানেও বৌদ্ধ পণ্ডিতরা তোমার ওই... অফিশিয়াল ডকুমেন্টেশন অফ হিস্টরি শুরু করেন। কিন্তু সেটা অন্য প্রসঙ্গ। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, ইন্সটিটিউশনাল হিস্টরি লেখা শুরু হওয়ার আগের কোনও ডকুমেন্ট প্রামাণ্য নয় বলে কি সে সব বর্জনীয়?’’

আমি তাকিয়ে আছি অমৃতদার দিকে...

‘‘ভারতবর্ষের ইতিহাসে উল্লিখিত প্রথম রাজার নাম বিম্বিসার। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের নৃপতি বিম্বিসার, অজাতশত্রুর বাবা, যিনি নমিয়া বুদ্ধে মাগিয়া লইয়াছিলেন পদনখকণা তাঁর, সেই তিনিই। অবশ্যই তিনি ঐতিহাসিক চরিত্র। কিন্তু তাঁর বাবা, পদ্মপুরাণ যাঁর নাম বলছে ভট্টীয়, তাঁর কথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তার মানে কি এই যে, আদতে ওরকম কেউ ছিলো না? ভদ্রলোক নিতান্তই পৌরাণিকের কল্পনা?’’

তা যে নয়, বলা বাহুল্য। ঐতিহাসিক চরিত্রের বাবাও যে ইতিহাসেরই মানুষ, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু অমৃতদা বলতে কি চাইছে...?

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে অমৃতদা প্রশ্ন করলো, ‘‘আমাদের, মানে সো কলড হিন্দুদের, ক’রকমের দেবদেবী আছে জানো?’’

দেবদেবীদের নিয়ে কোনওকালেই বিশেষ মাথা ঘামাইনি। ইতিহাস চিরকাল আমার প্রিয় বিষয় হলেও ছোটবেলা থেকে বাড়ি এবং পাড়ার বামপন্থী আবহাওয়ায় বড় হয়েছি। এখন যদিও আমি কোনও রাজনৈতিক পন্থারই তোয়াক্কা করি না এবং ধর্মীয় উৎসবগুলোর সম্পূর্ণ ফায়দা আর মজা নিই, তবু ওই ঠাকুরদেবতাদের নিয়ে এখনও মাথা ঘামাই না। তাও যতটুকু জানি বললাম... ‘‘তেত্রিশ কোটি দেবদেবী আছে শুনেছি... আর তাদের সবার উপরে স্বয়ং শ্রীভগবান, মানে পরম ব্রহ্ম। তাই তো?’’

‘‘দর্শন আর পুরাণে গুলিয়ে ফেলছো হে ব্রহ্মদৈত্য!’’ একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বললো অমৃতদা... ‘‘পরম ব্রহ্ম বৈদান্তিক দর্শনের ব্যাপার। দেবদেবীরা নিতান্তই পৌরাণিক।’’

আমি চুপ।

কফিতে একটা চুমুক দিয়ে অমৃতদা বলতে আরম্ভ করলো, ‘‘একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখবে, আমাদের দেবদেবীরা দু’রকমের। প্রথম টাইপটা হলো প্রাকৃতিক শক্তি, ফোর্সেস অফ নেচার। যেমন সূর্য, চন্দ্র, পবন, অগ্নি, বরুণ, এক্সেট্রা। ভেবে দ্যাখো, এই জাতীয় দেবতাদের কারও বিশেষ কোনও ফীট বা অ্যাচিভমেন্ট নেই। মানে, যুদ্ধ-টুদ্ধ জাতীয় গল্প এদের নিয়ে খুব একটা নেই। দ্বিতীয় টাইপটাই ইন্টেরেস্টিং। এদের নিয়ে প্রচুর গল্প। প্রধানত যুদ্ধের গল্প।’’

‘‘এরা কারা?’’ প্রশ্ন করলাম আমি।

‘‘অতি প্রাচীন কালের মানুষ, যারা নিজেদের বুদ্ধি, সাহস এবং বাহুবলে অসাধ্যসাধন করেছিলো... কালক্রমে জনশ্রতি এবং স্মৃতিতে দেবতায় পর্যবসিত হয়েছিলো।’’

‘‘এর কোনও প্রমাণ আছে?’’ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর প্রশ্ন করে ফেললাম আমি, এবং করেই বুঝলাম, নিজের বিপদ ডেকে এনেছি... কারণ অমৃতদার ভ্রূ দু’টো কুঁচকে উঠলো।

‘‘এই হলো তোমাদের মতন দিগ্গজদের সমস্যা!’’ সোফার উপর পড়ে থাকা খবরের কাগজটাকে এক টানে টেবিলের উপর চালান করে দিয়ে বললো অমৃতদা... ‘‘এ কি তোমাদের ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-অঙ্ক-বায়োলজি পেয়েছো নাকি যে সব কিছুর প্রমাণ চাইবে? ইতিহাস গবেষণার ল্যাবোরেটরি হলো স্বয়ং এই পৃথিবী, এবং তার বয়ে গেছে ভবিষ্যতের জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ রাখতে। তাই বলে কি তোমার ওই অফিশিয়াল ডকুমেন্টেশন অফ হিস্টরি-র আগেকার সব কিছুকে প্রমাণ নেই বলে উড়িয়ে দেবে? ঘটনাগুলো কি ঘটেছিলো, জানার চেষ্টা করবে না? অবশ্য তোমরা বলতেই পারো, সে সব জেনে আর কি হবে? তার চাইতে বরং কোন ফিল্মস্টারের সঙ্গে কোন ক্রিকেটারের...’’

‘‘না না! আমি তা বলিনি!’’ আমি হাঁ হাঁ করে উঠলাম... ‘‘আমি, মানে, বলতে চাইছিলাম যে, এদের... মানে, এই আদতে যারা মানুষ ছিলো, পরে দেবতা হয়ে গেছে... এরা কারা? বাকিদের থেকে এদের আলাদা করে চেনা কি ভাবে যায়? মানে, ব্যাপারটা ভীষণ ইন্টেরেস্টিং...’’ লোকটাকে কিছুতেই চটানো যাবে না! চটে গেলে আর কিচ্ছু বলবে না, এবং তাহলে এমন ছুটির সকালটা পুরো মাটি!

‘‘হুঁ! ইন্টেরেস্টিং!’’ অমৃতদার ভ্রূজোড়া এখনও কোঁচকানো। ‘‘ভারতীয় পুরাণে কত পুরনো ঘটনার স্মৃতি ধরা আছে, কোনও ধারণা আছে সে বিষয়ে?’’

একটু আধটু থাকলেও এই মুহূর্তে নেই-টা মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। গোবেচারার মতন মুখ করে চেয়ে রইলাম। ভারতীয় ইতিহাস-পুরাণ বিস্ময়কর হতে পারে, কিন্তু বর্তমানে যে দেশটাতে সত্যিকারের গুণীর কদর নেই, তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ আমার সামনে বসা এই অদ্ভুত মানুষটা।

‘‘পুরাণ বলছে, মহিষাসুরের ঘন ঘন অ্যাটাকে ব্যতিব্যস্ত দেবতারা মীটিং-এ বসলেন এই আপদ থেকে রক্ষা পাবার একটা রাস্তা খোঁজার জন্য। লোকটাকে ব্রহ্মা নাকি ভুল করে বর দিয়ে ফেলেছিলেন যে দেব-দানব‌-যক্ষ-রক্ষ-নর-পিশাচ-পশু-পক্ষী কেউ ওর কিস্যু করতে পারবে না। তাই শেষ অবধি একজন মহিলাকে ডেলিগেট করা হলো কাজটা করার জন্য। নারীটা মেনশন করতে মহিষাসুর ভুলে গেছিলো, তাই ওর ইমিউনিটির লিস্ট থেকে ওই স্পিশিজটা এক্সেম্প্টেড ছিলো। সবাই মিলে সেই মহিলাকে প্রচুর আর্মস অ্যান্ড অ্যামিউনিশন দেওয়া হলো এবং তারপর তিনি সিংহের পিঠে সওয়ার হয়ে গিয়ে মহিষাসুরকে মেরে এলেন।’’ কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়ে কাপটা টেবিলের উপর রেখে আমার দিকে তাকালো অমৃতদা। ‘‘পুরাণ সেইরকমই বলছে তো?’’

সেইরকমই বলছে বটে। এই গল্পই তো ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। যদিও এটা ঘটনা যে, বাঘ-সিংহের পিঠে চড়ে মানুষের যুদ্ধ করতে যাওয়ার কোনও উল্লেখ ইতিহাসে নেই। অ্যান্থ্রোপলজি বা জূলজিও ব্যাপারটাকে সাপোর্ট করবে না। কিন্তু পুরাণের অনেক গল্পই তো এই রকম গাঁজাখুরি। ইন ফ্যাক্ট, বেশির ভাগই তাই। শব্দটা যদিও ব্যবহার করতে সাহস হলো না। তাই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ বললাম। অমৃতদা মাথা নাড়লো। তারপর বললো, ‘‘এই রকম লার্জার দ্যান লাইফ, আপাত-অবিশ্বাস্য গল্পগুলোর কোনও কোনওটার পিছনে অতি প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক সত্যের ইঙ্গিত আছে। কিন্তু কোনও প্রমাণ নেই... তাই বুঝ জন যে জানহ সন্ধান।’’

আমি ততক্ষণে গন্ধ পেয়ে গেছি। নড়ে চড়ে বসলাম। ‘‘কি রকম?’’

অমৃতদা টেবিলের উপর পড়ে থাকা প্যাকেটটা থেকে একটা সিগারেট বার করে ওর জিপো লাইটার দিয়ে ধরালো। তারপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললো, ‘‘মনে আছে, স্কুলের ইতিহাস বইতে পড়েছিলে, সিন্ধু উপত্যকায় প্রথম বসতি স্থাপনকারীরা ছিলো মাতৃতান্ত্রিক?’’

বিলক্ষণ মনে আছে ক্লাস এইট-নাইনে রমেশ মজুমদারের বইতে পড়া এই ঘটনাটার কথা। ক’দিন আগেও কোথায় যেন একটা পড়ছিলাম ব্যাপারটা নিয়ে... বললাম সে কথা।

‘‘হুঁ। যাদের পুরুষ প্রজাতি শারীরিক ভাবে বেশি সক্ষম, তাদের মাতৃতান্ত্রিক হওয়ার কি কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয়?’’

মোক্ষম প্রশ্ন! এটা ভেবে দেখিনি কোনওদিন। সত্যিই তো, একমাত্র স্পটেড হায়েনা ছাড়া আর কোনও স্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে এই ব্যাপারটা নেই। কোনও অজানা প্রাকৃতিক কারণে স্পটেড হায়নাদের মেয়েরা ছেলেদের থেকে সাইজে বড় এবং বেশি শক্তিশালী হয়। বাকিরা সবাই পুরুষপ্রধান। চিরকাল তাইই ছিলো। তাহলে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রমটা হবে কেন?

অমৃতদা মুচকি হাসলো। বোধহয় আমার হতভম্ব ভাব দেখে। তারপর বললো, ‘‘ভাবো... একটা শ্বেতাঙ্গ শিকারী-সংগ্রাহক যাযাবর গোষ্ঠী, হান্টার-গ্যাদারার নোম্যাডিক রেস, যারা সদ্য গবাদি পশুপালন শিখেছে, মধ্য এশিয়ার রুক্ষ প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এক সময় এসে উপস্থিত হলো হিমালয়-হিন্দুকুশ পর্বতপ্রাচীরের সামনে। শিকারের পিছনে ধাওয়া করতে করতে একসময় সে প্রাচীর পারও হয়ে গেলো, এবং এসে উপনীত হলো এপারে, সিন্ধুনদের শ্যামল অববাহিকায়।’’

একটু থামলো অমৃতদা। আমাকে পুরো বিষয়টা বুঝে নেবার জন্য কয়েক সেকেন্ড সময় দিলো। দুঁদে অধ্যাপকের স্টাইল, আর কি! তারপর আবার বলতে আরম্ভ করলো... ‘‘সিন্ধু উপত্যকার উর্বর জমি, দু’দিনে ঘাস গজিয়ে যায়... পশুচারণের কোনও অসুবিধা নেই। নদী দিয়ে বয়ে চলেছে অপর্যাপ্ত পরিস্কার, মিষ্টি জল। সেই নদীতে জল খেতে আসা শিকারও প্রচুর। তাই তাদের আর ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজন রইলো না। যাযাবর উপজাতির জীবনধারায় একটা ফান্ডামেন্টাল চেঞ্জ এসে গেলো। তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নিজেদের পছন্দ মাফিক জায়গা বেছে নিয়ে থিতু হয়ে বসতে আরম্ভ করলো। গোড়াপত্তন হলো একটা নতুন সভ্যতার।’’

সিপারেটটা অ্যাশট্রেতে ঘষে নেভালো অমৃতদা, আর সেই ফাঁকে আমিও আমার মাথার ভিতর ঘুরতে থাকা প্রশ্নটা করে ফেললাম। ‘‘এরাই কি আর্য?’’

অমৃতদা আবার ভুরু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে। আমি ‌আমতা আমতা করলাম, ‘‘না... মানে, শ্বেতাঙ্গ বললে তো, সেই জন্য...’’

‘‘সেই জন্য কি?’’ প্রচণ্ড ভ্রূকুটি করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে অমৃতদা... ‘‘আর্যরাই ভারতবর্ষের প্রথম শ্বেতাঙ্গ ইমিগ্র্যান্ট, এটা তোমায় কে বলেছে?’’

সত্যিই তো! কেউ বলেনি। তবু... ‘‘এই রকমই একটা ধারণা আছে না আমাদের, মানে সাধারণ লোকদের?’’

‘‘হুঁ!’’ ঠোঁটের কোণটা একটু কুঁচকালো অমৃতদার। ‘‘কি ভাগ্য আর্যদের অ্যাবরিজিনাল ভারতীয় বলোনি! সেই রকমও একটা ধারণা চালু হয়েছে না ইদানীং... তোমাদের, মানে সাধারণ লোকদের মধ্যে?’’

বিপজ্জনক প্রসঙ্গ! খোঁচাটা হজম করে কাঁচুমাচু মুখে চুপ করে থাকাই শ্রেয়।

‘‘জেনে রাখো হে সাধারণ লোক... যে ভূখণ্ডটাকে আজ তোমরা ভারতবর্ষ বা ইন্ডিয়া বলে জানো, শ্বেতাঙ্গ জাতির উদ্ভব সেই ভূখণ্ডে হয়নি। অ্যাফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ অ্যামেরিকার মতন ভারতবর্ষের অ্যাবরিজিনাল বা আদিবাসীরা সবাই কালো মানুষ। শ্বেতাঙ্গ জাতির উদ্ভব হয়েছিলো হিমালয়ের ওপারে, এই গ্রহের শেষ তুষার যুগ, মানে লাস্ট আইস এজ-এর ঘেরাটোপের ভিতর।’’

রীতিমতন বজ্রনির্ঘোষ! খানিকক্ষণ নৈঃশব্দ। নেহাৎ বাইরে তারস্বরে ঢাক বাজছে, নাহলে পিন ড্রপ সাইলেন্স বলা যেতো। কি বলে অমৃতদাকে আবার ট্র্যাকে ফেরানো যায় ভাবছি, এমন সময় সাক্ষাৎ দুর্গতিনাশিনীর মতন খাবারের ট্রে হাতে সুমিত্রাবউদির প্রবেশ। ট্রে-তে বউদির বিখ্যাত ফিশফ্রাই আর আলুভাজা। যত রাগই হোক না কেন, ও জিনিসের দর্শনে এবং গন্ধে মন ভালো হয়ে যেতে বাধ্য।

লাফিয়ে উঠে ‘‘থ্যাঙ্কিউ বউদি, থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ...’’ বলতে বলতে হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে ট্রে-টা টেবিলের উপর রাখলাম। বউদি মুচকি হেসে বললো, ‘‘সেকেন্ড রাউন্ড কফি হবে নাকি?’’ বুঝলাম, রান্নাঘর থেকে এতক্ষণ সব শুনছিলো। অমৃতদার দিকে তাকালাম। আমাদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ পণ্ডিত এই একটা মানুষের কাছেই জব্দ। ভুরু দুটো এখনও কুঁচকানো, কিন্তু দৃষ্টিটা ফিশফ্রাইয়ের দিকে। তাক বুঝে বললাম, ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ! হোক, হোক আরেক রাউন্ড কফি! গল্পটা... মানে, ঘটনাটা অসম্ভব ইন্টেরেস্টিং! প্লীজ বলো, তারপর কি হলো?’’ প্রচণ্ড মনোযোগী ছাত্রের মতন সিরিয়াস মুখ করে তাকিয়ে রইলাম অমৃতদার দিকে।

আমাকে একেবারেই পাত্তা না দিয়ে অমৃতদা নিজের প্লেটের উপর একটা ফ্রাই আর কয়েক টুকরো আলুভাজা তুলে নিয়ে নির্বিকারে খেতে আরম্ভ করলো। আমিও অগত্যা তাই করলাম। ‘ফলো স্যুট’ যাকে বলে, আর কি! অমৃত অধিকারীর গল্প ক্যান ওয়েট, বাট সুমিত্রাবউদির ফিশফ্রাই ক্যানট!

খাওয়া শেষ হতে হতে কফি এসে গেলো। কফিতে চুমুক দিয়ে অমৃতদা মুখ থেকে যে তৃপ্তির ‘‘আহঃ’’টা বেরলো, তাতে আমি বুঝে গেলাম, আপাতত নিশ্চিন্তি। বউদি উদ্ধার করে দিয়েছে আমার ছুটির সকালটা। আর কোনও বেমক্কা প্রশ্ন করবো না, এটা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে অমৃতদার দিকে যথাসম্ভব কৃপাপ্রত্যাশীর মতন মুখ করে তাকিয়ে রইলাম। অমৃতদা একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো, ‘‘হুঁ, কি বলছিলাম?’’

উল্লসিত হয়ে বললাম, ‘‘সিন্ধুর তীরে একটা সভ্যতার গোড়াপত্তন হলো।’’

‘‘হুঁ।’’ অমৃতদা বলতে আরম্ভ করলো। ‘‘এই সভ্যতা আর্যসভ্যতা নয়। আর্যরা অনেক পরে এসেছিলো, ঘোড়ার পিঠে চেপে, ককেশিয়ান পর্বতমালার ওপার থেকে। এদের ঘোড়া ছিলো না। সিন্ধুসভ্যতায় ঘোড়ার উপস্থিতির কোনও আর্কিওলজিক্যাল এভিডেন্স নেই। এদের ছিলো গোরু, ভেড়া, ছাগল আর চরার সময় তাদের দেখভাল করার জন্য বড় বড় নেকড়ে জাতীয় কুকুর। শিকারের কাজেও এরা সাহায্য করতো। একাধারে শেপার্ড এবং হান্টিং ডগস্।’’’’

তাহলে এই প্রাচীন সভ্যতার কুকুরদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে দুর্গার সিংহের রহস্য! কিন্তু আর কোনও প্রশ্ন নয়... কোনওওও প্রশ্ন নয়...

খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে, বোধহয় আমি কোনও প্রশ্ন করলাম না দেখে একটু খুশি হয়ে অমৃতদা আবার বলতে আরম্ভ করলো... ‘‘কিন্তু এই সেট্লমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে এদের সামনে একটা সমস্যা খাড়া হলো। ব্যাপারটা বোঝো... এতদিন এরা মধ্য এশিয়ার রুক্ষ প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে বেড়াতো। সম্পূর্ণ ভ্রাম্যমান জীবন। তাই ভূসম্পত্তির কোনও অধিকারবোধ, সেন্স অফ ওনারশিপ, এদের এতদিন ছিলো না। কিন্তু যেই এরা উর্বর জমির প্রচুর বিস্তার পেয়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সেট্ল্ করতে আরম্ভ করলো, অমনি সেই বোধটা এদের জন্মাতে শুরু করলো। একেকটা দল তাদের নিজেদের জমির সীমানা নির্দেশ করতে আরম্ভ করলো, পালিত পশুগুলোকে চিহ্নিত করতে শুরু করলো। শুরু হলো গোষ্ঠীতন্ত্র। কিন্তু সমস্যাটা হলো অন্য জায়গায়।’’ সিগারেটে একটা লম্বা টান দিলো অমৃতদা।

বাইরে ঢাকের আওয়াজ থেমেছে। ঘরের ভিতর নিশ্ছিদ্র নৈঃশব্দ। আমি উৎকর্ণ হয়ে আছি... ‘‘সমস্যাটা হলো ভূসম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে।’’ একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে অমৃতদা বললো। ‘‘ভাবো... একটা আদিম, উন্মুক্ত সমাজ। পুরুষরা ডমিনেট করে বটে, কিন্তু সেটা শুধুমাত্র শারীরিক ক্ষমতার জোরে যতটুকু করা সম্ভব, ততটুকুই। পশুদের মতন। বিয়ে-ফিয়ের মতন কোনও সামাজিক প্রতিষ্ঠান নেই। কোনও নারীর উপর কোনও পুরুষের নির্দিষ্ট কোনও অধিকার নেই। তাই কে কার বাবা, নির্ণয় করা দুরূহ কাজ। কিন্তু সম্পত্তির মালিকানা যখন হচ্ছে, তখন তার একটা উত্তরাধিকারও নির্দিষ্ট করতে হবে। সেক্ষেত্রে এদের কাছে আর একটাই অপশন ছিলো।’’

‘‘ম্যাট্রিয়ার্কি!’’ আমার মুখ দিয়ে অপনিই বেরিয়ে গেলো।

‘‘হুঁ।’’ অমৃতদা মাথা নাড়লো। ‘‘উন্মুক্ত সমাজে পিতৃত্বনির্ধারণ সম্ভব না হলেও কে কার মা সেটা বোঝার কোনও সমস্যা ছিলো না। তাই একেকজন নারীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলো একেকটা গোষ্ঠী বা ক্ল্যান। ক্ল্যানের বাদবাকি সদস্যরা হয় সেই নারীর সন্তান-সন্ততি, নয়তো তাঁর পছন্দের পুরুষ। দুর্গা ছিলেন সিন্ধুপারের ঔপনিবেশিকদের এইরকমই একজন গোষ্ঠীনেত্রী বা ক্ল্যানহেড। একাধারে মাতৃরূপিনী, শক্তিরূপিনী। মহীয়সী বীরাঙ্গনা যাকে বলে।’’

আবার খানিকক্ষণ নৈঃশব্দ। অমৃতদা সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ঘষে নেভালো। আর প্রশ্ন না করে উপায় নেই। ‘‘মহিষাসুর তাহলে কে ছিলো?’’

‘‘তুমি ঝাড়খণ্ডের ট্রাইবাল বেল্টে কাজ করেছো না?’’ আমার দিকে একটু ভুরু কুঁচকে তাকালো অমৃতদা।

করেছি। বছর দশেক আগে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের একটা ট্রাইবাল আপলিফ্টমেন্ট প্রোজেক্টের জন্য ডকুমেন্টারি ছবি তৈরি করেছিলাম। সেই সময় বেশ কয়েক মাস ওই অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করেছি। তার আগে পরেই কোনও এক সময়ে অমৃতদার সঙ্গে আমার কর্মসূত্রে পরিচয়। মনে রেখেছে ব্যাপারটা। বললাম, ‘‘মহিষাসুর ওই অঞ্চলের লোক ছিলো বলছো?’’

‘‘না। এই জন্য ওখানকার কথা বলছি, কারণ ওখানে এখনও অসুর নামের একটি আদিবাসী উপজাতি আছে। প্রধানত গুমলা, পালামৌ, লোহারডাগা, লাতেহার জেলার বাসিন্দা। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এরা লোহার ব্যবহার জানে। মহিষ পালে।’’

‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ! এদের একটা গ্রামে গেছিলাম তো! শূট করেছিলাম...’’ মনে পড়ে গেলো শালপাতায় ছাওয়া ছোট্ট ছোট্ট মাটির ঘরগুলো... তাদের লাগোয়া গোয়ালঘর... দাওয়ায় বসে দা’য়ে শান দেওয়া নিকষকৃষ্ণা নারীর ঝকঝকে হাসি...

‘‘অসুর নামটা এখন এই হাজার তিরিশেক জনসংখ্যার বিপন্ন উপজাতিটিকেই চিহ্নিত করে। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক যুগে বহিরাগত শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিকদের চোখে ভারতবর্ষের আদিম জনজাতিরা সবাই ছিলো অসুর, রাক্ষস, পিশাচ। ভারতবর্ষের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, সর্বত্র এদের বসবাস ছিলো। সিন্ধুপারেও ছিলো। মহিষপালক জাতি। মহিষের দুধ, মাংস খেতো, মহিষের পিঠে চড়েই যুদ্ধ করতো। যুদ্ধ মানে, রেইড। নবাগত শ্বেতাঙ্গদের পশুসম্পদ আর নারী হরণ করার জন্য।’’

অমৃতদা লেকচারার মোড-এ ঢুকে পড়েছে। নড়ে চড়ে বসলাম।

‘‘এই রকমই এক মহিষবাহন, তথাকথিত বর্বর জাতির নেতা ছিলেন মহিষাসুর। ভয়ঙ্কর যোদ্ধা। দুর্ধর্ষ নেতা। তাঁর নেতৃত্বে বিশাল বিশাল মহিষের পিঠ সওয়ার হয়ে অসুররা হানা দিতো শ্বেতাঙ্গদের ছোট ছোট বসতিগুলোতে। এরা ততদিনে একটু আধটু কৃষিকর্মও শিখেছে। সেই সব ফসল, নধরকান্তি গোরু-ভেড়া আর ফর্সা ফর্সা সুন্দরী মেয়েদের লুঠ করতো। ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলো একক ভাবে এদের এই সব ঝটিতি আক্রমণের মোকাবিলা করতে পারছিলো না। তাই তারা জোট বাঁধলো।’’ বলে অমৃতদা চুপ করলো।

‘‘তারপর?’’ আমি গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছি ওর দিকে।

‘‘তারপরের গল্প তো পুরাণেই আছে।’’ অমৃতদা শরীরটা টানটান করলো। ‘‘দেবতারা সবাই মিলে দুর্গাকে এম্পাওয়ার করলেন। তারপর দুর্গা সিংহ নিয়ে যুদ্ধে গেলেন এবং বিজয়িনী হয়ে ফিরলেন।’’

‘‘সে তো বুঝলাম। কিন্তু এর... আই মীন... সিগ্নিফিক্যান্সটা কোথায়? মানে, ঘটনাটা কি ঘটেছিলো আদতে?’’

‘‘ভাবো...’’ মুচকি হাসলো অমৃতদা। ‘‘বুদ্ধি লাগাও। কল্পনা খরচ করো। সব কি প্ল্যাটারে সাজানো পাবে নাকি?’’

কল্পনার রাশ আলগা দিলাম... লং শট... সিন্ধুনদের ধারে দিগন্তজোড়া মাঠের ওপ্রান্ত থেকে ছুটে আসছে বিশাল বিশাল মহিষের পিঠে সওয়ার মিশকালো অসুরের দল... কতজন হবে? শ’তিনেক? হাতে লোহার হাতিয়ার নিয়ে ‘‘রে রে’’ করে তেড়ে আসছে যমদূতের মতন... ক্যামেরা ক্লোজ ইন করলো... সবার আগে পাহাড়ের মতন একটা মহিষের পিঠে সওয়ার এক বিশালদেহী পুরুষ... হাতে একটা কাঁটাওয়ালা লোহার গদার মতন অস্ত্র... সাক্ষাৎ জিঘাংসার প্রতিমূর্তি...

কিন্তু সামনে কি যেন দেখে এদের গতি হঠাৎ শ্লথ হয়ে এলো... এক সময়ে থেমে গেলো... অবিশ্বাস ভরা চোখে সামনে দেখছে...

এবার উল্টো দিকে ক্যামেরা... নদীর ধার বরাবর এক বিরাট বাহিনী... কয়েক হাজার তো বটেই... নারী-পুরুষ সমন্বিত... এবং সেই সঙ্গে নেকড়ের মতন বড় বড় হিংস্র কুকুরের দল... এরা থামতেই ওরা প্রচণ্ড গর্জন করতে করতে ছুটতে শুরু করলো... সবার সামনে এক রণরঙ্গিনী নারী... পরনে চামড়ার আবরণ... চূড় করে বাঁধা পিঙ্গল চুল... এক হাতে বেঁটে, মোটা লাঠির আগায় বাঁধা ধারালো পাথরের ফলা... অন্য হাতে ঘাসের দড়িতে ফাঁস লাগানো ল্যাসো... পাশে পাশে ছুটতে থাকা বিশালকায় কুকুরটি একসময় দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে গেলো... সেই সঙ্গে আরও কয়েকশো কুকুর প্রচণ্ড গর্জন করতে করতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো মহিষগুলোর উপর... এবং তাদের পিছন পিছন মরিয়া মানুষগুলো সিন্ধুরই কুল ছাপানো বন্যার ঢেউয়ের মতন গিয়ে আছড়ে পড়লো মহিষবাহন আক্রমণকারীদের উপর...

অমৃতদার দিকে তাকালাম। ভুরু নাচিয়ে বললো, ‘‘কি? ক্লেয়ারভয়্যান্স হলো নাকি?’’

হাসলাম। ক্যামেরাও এক ধরণের ক্লেয়ারভয়্যান্স। কিন্তু সেটা অমৃতদাকে আর বললাম না। ‘‘ওই কুকুরগুলোই লোকপ্রবাদে সিংহ হয়ে গেছে বলছো?’’

‘‘কুকুরগুলো নয়, কোনও একটি বিশেষ কুকুর। সেটা দুর্গার নিজের কুকুরও হতে পারে, বা অন্য কোনও কুকুর। সিংহবিক্রম প্রদর্শন করেছিলো সেই যুদ্ধে।’’

‘‘বুঝলাম। কিন্তু একটা কথা বলো...’’ কথাটা অনেকক্ষণ ধরেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো... ‘‘সিন্ধুতীরের এই ঘটনা এত দূরে এখানে বাংলার সংস্কৃতিতে এত প্রমিনেন্স পেলো কি ভাবে? যেখানকার ঘটনা, কই সেখানে তো দুর্গাপুজোর এত হিড়িক নেই!’’

‘‘গুড কোয়েশ্চেন।’’ অমৃতদা সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেটটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। গুড কোয়েশ্চেনের রিওয়ার্ড, আর কি! ‘‘এর উত্তর লুকোনো আছে তোমার ওই ব্যাড কোয়েশ্চেনটার মধ্যে?’’

আমি হাঁ!

‘‘এরা আর্য ছিলো না। এরা ছিলো সেন্ট্রাল এশিয়ার সেমিটিক জাতি। ফর্সা রং, কিন্তু কালো চুল। কালো, কি বড় জোর ধূসর চোখ। পৃথিবীর শেষ তুষার যুগের বরফ গলতে আরম্ভ করে আজ থেকে মোটামুটি কুড়ি হাজার বছর আগে, এবং সেই সঙ্গে শুরু হয় সেই বরফের ঘেরাটোপে আটকে থাকা মানুষ এবং পশুর মাইগ্রেশন। এরা যে ঠিক কোন সময়ে পাহাড় পেরিয়ে ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডে এসে ঢুকেছিলো, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। অনুমান করা যায়, আজ থেকে মোটামুটি দশ হাজার বছর বা তার কিছু আগের কোনও সময় থেকে শুরু হয় এদের অনুপ্রবেশ। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এদের সভ্যতা। দুর্গার ঘটনা খুব কম হলেও সাড়ে সাত-আট হাজার বছর আগের কথা। এদেরই উত্তরপ্রজন্ম মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা-লোথাল-কালিবঙ্গানে নাগরিক সভ্যতার পত্তন করেছিলো।’’

অমৃতদা সিগারেটে একটা লম্বা টান দিলো। দেখাদেখি আমিও। তারপর আবার বলতে আরম্ভ করলো... ‘‘আর্যরা ভারতবর্ষে ঢোকে এদের অন্তত সাড়ে তিন চার হাজার বছর পরে। তারা ছিলো আদতে ইওরোপের মানুষ। নীলচক্ষু স্বর্ণকেশী শ্বেতবর্ণ পুরন্দর... বেদে লিখেছে। পুরন্দর ইন্দ্রের নাম ছিলো, জানো তো?’’

‘‘জানি। পুরীর অন্ত করেন যিনি। দ্য ডেস্ট্রয়ার অফ সিটিজ।’’

‘‘হুঁ। তুষার যুগের ঘেরাটোপের ভিতর সারভাইভালের যা পরীক্ষা এরা দিয়েছিলো, তেমনটা আর কেউ গোটা মানবজাতির বিবর্তনের ইতিহাসে কোনওদিন দেয়নি... কিন্তু সেটা অন্য প্রসঙ্গ। এখানে যেটা প্রাসঙ্গিক, সেটা হলো আজ থেকে হাজার ছয়েক বছর আগে এরা যখন ঘোড়ার পিঠে চড়ে অস্ত্র হাতে হিমালয় পেরিয়ে ভারতবর্ষে ঢোকে, তার অনেক আগে থেকেই এরা সম্পূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক ছিলো... যে কোনও যোদ্ধৃজাতি যেমন হয়। সিন্ধুপারের নগরসভ্যতা তছনছ করতে করতে গঙ্গার তীর অবধি এগিয়েছিলো, এবং এগোতে এগোতে এদের, মানে এই মাতৃতান্ত্রিক জাতিকে গঙ্গার এপারে খেদিয়ে দিয়েছিলো। তাদের সংস্কৃতি, তাদের সমাজচেতনা তাদের সঙ্গে সঙ্গেই পূর্বভারতে চলে এসেছিলো। এদিকে, মানে বাংলা, উড়িষ্যা, অহমে আর্য সংস্কৃতির প্রসার হতে অনেক সময় লেগেছিলো। ইন ফ্যাক্ট, আর্যদের পুরুষপ্রধান ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি কোনওদিনই পুরোপুরি এদিকে জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। তাই এখনও এখানে দেবতাদের থেকে দেবীদের প্রাধান্য কোনও অংশে কম নয়। বরং বেশিই। দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, জগদ্ধাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে এখনও এখানে মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী, ওলাবিবি, বনবিবিরা পূজা পান।’’

অমৃতদা থামলো। বাইরে কোথাও একটা কুকুর গম্ভীর শব্দে ডেকে উঠলো। বোধহয় সন্তুদের অ্যালসেশিয়নটা। কুঠারহস্তা নারীটির পাশে পাশে বিশাল হিংস্র কুকুরটার ছুটে আসার দৃশ্যটা আমার মাথার ভিতর একবার রিক্যাপ হলো...

গা টা হঠাৎ কেমন শিরশির করে উঠলো!

1 comment: