4

সম্পাদকীয়

Posted in



সম্পাদকীয়


মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি,
হে রাখাল, বেণু তব বাজাও একাকী…

উদগ্র উত্তাপে শহর উদ্‌ভ্রান্ত… তবুও বাঙালীর সাহিত্য রসবোধে টান ধরানোর সাধ্য নেই স্বয়ং প্রকৃতিরও। এমাসেই গেল বাঙালীর অন্যতম প্রধান উৎসব, রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী। একজন মানুষ (নাকি অতিমানুষ!) জন্মের ১৫৮ বছর পরেও কি অসম্ভব প্রাসঙ্গিক এবং আধুনিক, ভাবতেও আশ্চর্য লাগে। 

কিন্তু একইসঙ্গে একথাও মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের যথার্থ এবং সম্পূর্ণ মূল্যায়ন বুঝি আজও হয়নি। এখন আর শুধু আলোচনা ভালো লাগে না... এবার সময় হয়েছে তাঁকে যথার্থ উপলব্ধি করার। ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম আত্মার শান্তি মনের আনন্দ’... এ কথা বার বার উচ্চারণ করলেই শুধু হবে না আর... এবার এই আরামকে, শান্তিকে, আনন্দকে সুগভীর ভাবে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ততায় মিলিয়ে দিতে হবে। আর এই ভাবেই হয়তো তাঁর যথার্থ এবং সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করে তাঁকে পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা যাবে। 

এই শ্রদ্ধা নিবেদনের ধারায় ঋতবাকের এবারের প্রয়াস 'ঝরনাতলার নির্জনে'। রবীন্দ্র গানের বিবর্তন বিষয়ে লিখছেন শিবাংশু দে। ধারাবাহিক ভাবে, আগামী কয়েক মাস ধরে। 'জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড'। লেখকের নিজের ভাষায় - ক্লান্তিহীন যাত্রাপথের গান, শুধু কি আনন্দে? নাহ, মানুষের যাবতীয় ভাবনার শ্রমসংহিতা, সবাইকে জায়গা করে দেওয়ার অলিখিত ঈশ্বরী দায় , একলা ইঞ্জিনের পিছনে অন্তহীন সারিবাঁধা কামরার ঝমঝম সিম্ফনি .... রবীন্দ্রসঙ্গীত 

নিয়মিত বিভাগগুলির সঙ্গে সঙ্গে থাকছে রবীন্দ্র-বিষয়ে আরও বেশ কিছু লেখা। পাঠক বন্ধুদের অনেকদিনের অনুরোধে সাড়া দিয়ে এই সংখ্যা থেকে শুরু হলো নতুন বিভাগ 'ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে'। থাকছে দারুণ দারুণ সুস্বাদু সব রান্নার রেসিপি। 

সময় খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। প্রত্যেক দ্বিতীয় বা তৃতীয় মানুষটির মুখ মুখোশে ঢাকা। মোকাবিলার হাতিয়ার সৎ সাহস, সচেতনতা আর কঠোর পরিশ্রম। সততা মানে সেন্স অফ কারেক্টনেস। সমস্ত প্রতিকুলতার মধ্যেও আমরা ভালো থাকবো। আমরা ভালো আছি।

শুভেচ্ছা নিরন্তর

4 comments:

5

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - শিশির রায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


মৃত্যুচিন্তা চমৎকারা
শিশির রায়



রক্তের সম্পর্কের ভিতরে ও বাইরে যে প্রিয়জনেরা, যাঁদের অত্যাগসহন বলে ভাবি, তাঁরা জেনে শিউরে উঠতে পারেন। তবু বলি, আমি প্রায়শই ‘মৃত্যুচিন্তা’ করি। নিজের মৃত্যুকে নিয়ে চিন্তাই ‘মৃত্যুচিন্তা’, এ রকম একটা শব্দার্থ চালু আছে। মানুষ তার পরিবেশ-প্রতিবেশ, মন-মানসিকতা, পক্ষপাত, সংস্কার— নানান কিছুর ছাঁচে ফেলে একটা শব্দের মানে দাঁড় করায়। আমার ক্ষেত্রে ‘মৃত্যুচিন্তা’ শব্দটির ব্যাপকার্থ; আমি নিজের, এমনকি প্রিয়জনদেরও ‘মৃত্যুচিন্তা’ করি। আচ্ছা ঠিক আছে, যাতে আতঙ্ক একটু হলেও কমে, বাকি লেখাটুকু পড়ার দিকে এগোনো যায়, তাই নরম করে বললাম— ‘নিজের ও প্রিয়জনদের মৃত্যু নিয়ে ভাবি’। ‘ভাবি’ মানে এখানে ‘কল্পনা করি’ বুঝতে হবে। মৃত্যুর ক্ষণটির যত না, তারও বেশি মৃত্যু-পরবর্তী সময়ের কল্পনা। যে মুহূর্তটিতে আমার মৃত্যু ‘হচ্ছে’, সেটি তো এক ঘটমান বর্তমান, সেই সময়ে তো আমি আছি। কিন্তু যেই মরে গেলাম, শেষ প্রশ্বাসটি নিলাম বা নিশ্বাসটুকু ছাড়লাম, তখন আমি অতীত (অজর অমর আত্মার প্রসঙ্গে অন্তত এ লেখায় যাচ্ছি না)। যেহেতু তখন প্রাণ নেই, ইন্দ্রিয়গুলো নিষ্ক্রিয়, তাই ধরে নিচ্ছি সে সময় আমার মৃত্যুতে আমার প্রিয়জনদের কী প্রতিক্রিয়া, আমি দেখতে, শুনতে, বুঝতে পারব না। পারব না-ই তো। আর ঠিক সেই কারণেই নিজের ‘মৃত্যুচিন্তা’ করতে— মানে আমি যাঁদের ভালোবাসি, আমার মৃত্যুর পর তাঁদের প্রতিক্রিয়া কল্পনা করতে— আমার খুব লোভ হয়। অমুক কি খুব কাঁদবে? খুউউব? তমুক কি পাথর হয়ে যাবে শোকে? নাকি বাইরে দিব্যি স্বাভাবিক, হয়তো সব ব্যবস্থাপত্র করছে সহজতায়, কিন্তু ভিতরে নদীর পাড় ভাঙছে হাউহাউ করে! আমাকে ঘিরে-থাকা প্রিয়জনদের সেই মুহূর্তের চোখমুখমগজঅন্তরের রেখচিত্রগুলি দেখার তীব্র ইচ্ছা হয় আমার। আমি অবসরে-অনবসরে সেই ‘মৃত্যুচিন্তা’ করি।

একই ভাবনা আসে প্রিয়জনের ক্ষেত্রেও। হয়তো একসঙ্গে হাঁটছি, খাচ্ছি রেস্তরাঁয় তাঁর বা তাঁদের সঙ্গে, দল বেঁধে হাহাহিহি করছি, কথা বলছি বা নিশ্চুপ সঙ্গযাপন চলছে, তখনও এই ভাবনা আসে: আচ্ছা, এই যে এই মানুষটাকে এত ভালোবাসি, ইনি তো বয়সের স্বাভাবিক নিয়মে আর কিছু দিন পরেই থাকবেন না। তখন কী করব আমি? কোনও প্রিয়জনের জীবন এমনই দ্রুতিময়, আশঙ্কা হয়, এই দ্রুতিই দুর্ঘটনা হয়ে জীবনান্তের কারণ হয় যদি? তাঁর নিঃসাড় শবদেহটি দেখে কেমন হবে আমার বুকের ভূগোল? নিজের সেই সময়ের মুখটি দেখতে ইচ্ছে করে আমার। শ্মশান, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াস্থল ছবি তোলার সুস্থান নয়, নয়তো প্রিয়বিয়োগের আবহে একটা ‘ফোটোগ্রাফি প্রোজেক্ট’ ভাবা যেতে পারত। শোকে অন্তত আমাদের মন-মুখ(মণ্ডল) এক থাকে কি না, ধরা কি পড়ত না সেই সব ছবিতে?

আমার জীবনে প্রথম মৃত্যু দেখার অভিজ্ঞতা শৈশবে, যখন ঠাকুমা মারা গেলেন। আজ থেকে দু-আড়াই দশক আগেও বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়িতে দাদু-ঠাকুমারা অপরিহার্য অনস্বীকার্য ছিলেন, মৃত্যুর সঙ্গে পরিবারের শিশুটির প্রথম দেখাসাক্ষাৎ হত সাধারণত এঁদের কারও চলে যাওয়ার সূত্র ধরেই। মনে পড়ে, ঢাকা শহরের সেই একতলা ভাড়াবাড়িটির বাইরের ঘরের খাটেই শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। বাইরের ঘরেই কেন, তা মনে পড়ছে না। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে ঘরের গন্ধটা। অসুখের গন্ধ। ওষুধের গন্ধ। পক্ষাঘাতে শরীরের একটা দিক অসাড়, মানুষটা শুয়ে থাকেন লংক্লথের উপরে, সেখানেই পেচ্ছাপ। সেই গন্ধ। যখন মৃত্যু এগিয়ে আসছে, আমি বুঝতে পারিনি, কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম, গন্ধটা পাল্টাচ্ছে। রোগ, জরা, ক্লান্তি, প্রতীক্ষা, বার্ধক্যের গন্ধ মিলেমিশে কি মৃত্যুর গন্ধ তৈরি হয়? এক দিন দেখা গেল, বাড়িতে খুব ভিড়। আমার সব কাকা-পিসিরা এসেছে, আরও অনেক চেনা-অচেনা মানুষ। ঠাকুমাকে নিয়ে চলে গেল অনেকে, ডেটল-জলে ধুয়েমুছে এতদিনকার গন্ধটাও কোথায় চলে গেল এক দিন। আমার কোনও শোক হয়নি। শিক্ষা হয়েছিল। দূর থেকে দেখা একটি মৃত্যু আমাকে মৃত্যুর গন্ধ কেমন হয়, চিনিয়ে দিয়েছিল। প্রাচীন কোনও প্রিয়জনের কাছে গেলে, বসলে— এখন অস্বস্তি হয় আমার। ভয় হয়, সেই গন্ধটা ফিরে আসবে না তো, ঠাকুমার ঘরের সেই গন্ধটা!

মিশনের ইস্কুলে পড়ছি, গরমের ছুটিতে হস্টেল থেকে বাড়ি। কোথায় পুরুলিয়া, আর কোথায় ঢাকা! এক দেশ থেকে আর এক দেশ, মাঝখানে কাঁসাই-গঙ্গা-ইছামতী-রূপসা-পদ্মা, কত জল, কত জনপদ! কী কারণে আমরা খুলনা হয়ে ফিরছিলাম, বাবা আর আমি। দূরপাল্লার বাস, উঁচু হাইওয়ে দিয়ে হুহু ছুটছে। আমি জানলার ধারে, বাবা পাশের সিটে, প্যাসেজের দিকে। জানলা দিয়ে দেখছি, হাইওয়েটা ইংরিজি ইউ-অক্ষরের মতো বেঁকে গিয়েছে। আমরা আছি এ-পাশের হাতায়, ও-পাশের হাতাটা দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। মাঝখানে ঢালু খাদ, নীচে মাঠের মতো, ছাড়া-ছাড়া ঝোপঝাড়। ইউ-এর ঠিক তলাটা দিয়ে যখন বাঁক নিচ্ছে বাস, কী একটা হয়ে গেল। কয়েকটা সেকেন্ড মাত্র, অন্ধকার, আলো-আঁধারি। তার পর, চার দিকে চিৎকার। একটা বাচ্চা কাঁদছে তারস্বরে। নানান জন ডাকছে আরও নানান জনকে। আর আমি, বাবাকে দেখতে পাচ্ছি না। হাত বাড়াতে নরম, গোল কী একটা ধরলাম। একটা থ্যাঁতলানো কমলালেবু! আমি কোথায়? বাবা? আমার ব্যাগ কোথায়, তার মধ্যে বইপত্র আছে, হোমওয়ার্কের অপেক্ষায় থাকা খাতা!

ধাতস্থ হতে বোঝা গেল, অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে! আমাদের বাসটা এই মুহূর্তে খাদে। মাঠে। বাসের দরজা, যে দরজায় খালাসি গোছের একটা অল্পবয়সি ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই দরজাটা এখন মাটির সঙ্গে লেগে আছে। বাসের সামনের বিরাট উইন্ডশিল্ড ভেঙে বেরোচ্ছে আতঙ্কিত মানুষ। দুটো হাত কোথা থেকে এসে আমাকে ধরল, আমি জানি ওগুলো বাবার হাত। বাবার জামায় কী সুন্দর গোল গোল, লাল লাল বুটি! কিন্তু বাবা এমন পোলকা ডটওয়ালা জামা পরবে কেন? বাবার জামা তো সাদা! বাইরে এসে বুঝলাম, গোল, লাল বুটিগুলো আসলে রক্ত! অন্য মানুষের রক্ত। বাবার কিচ্ছু হয়নি, বুকের উপরে কার একটা বিরাট স্যুটকেস ধড়াম করে এসে পড়া ছাড়া। বাসভর্তি অজানা আহত মানুষের রক্তের দাগের নকশা মেখে বাবা আমাকে সুদ্ধু, আমাদের ব্যাগসুদ্ধু বাইরে নিয়ে এল। ভ্যানে চাপিয়ে কোথায় নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের। একটা ডাক্তারখানা। ডেটলের গন্ধ। আমি বাঁ কনুই বাসের জানলার পাশে ঠেকিয়ে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম, বাস খাদে পড়ে পাল্টি খাওয়ার সময় জানলার কাচ ভেঙে ঢুকে গেছে কনুইয়ে। হাঁ হয়ে যাওয়া চামড়া ঝুলছে খানিকটা। সেই হাঁ-মুখ বোজানো হলো সেলাই দিয়ে। সেলাই করার সময় ক্লাস সেভেনে পড়া আমি চিৎকার করিনি, দাঁতে দাঁত চেপে বাবার জামায় রক্তের বুটিগুলো গুনছিলাম মন ঘোরাতে। ৩৭টা রক্তের বুটি— বারবার। সে দিন যখন ভ্যানে চেপে বাসস্ট্যান্ডে ফিরছি আবার ঢাকার বাস ধরার জন্য, পাশের ভ্যানে একটা ‘বডি’ আমাদের সঙ্গী ছিল। বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই খালাসি ছেলেটা! 

সে বার এত কাছ থেকে মৃত্যু দেখে হতভম্ব হওয়া গিয়েছিল। কিন্তু শোকের অনুভূতি হয়নি, কারণ বাসের সেই ছেলেটির সঙ্গে আমার অপরিচয়ের দূরত্ব ছিল। অপরিচয় করুণা জাগায়, সমানুভূতি জাগায় না তত। কিন্তু কলেজবেলায় একটি মৃত্যু আমাকে প্রথম (ও সম্ভবত শেষ) বারের মতো শোকের সন্তাপ দিল। সে আমার প্রিয় বন্ধু, হস্টেলে রুমমেট। অনার্সের রেজাল্ট বেরিয়েছে সদ্য, সিনিয়র এক দাদা ইউনিভার্সিটিতে র‌্যাঙ্ক করেছে আমাদের কলেজ থেকে। আমরা তাকে ধরেছি, খাওয়াও! দল বেঁধে যাওয়া হচ্ছে গড়িয়াহাট মার্কেটে, সেখানে একটা হোটেলে জমিয়ে ইলিশ মাছ-ভাত খাব আমরা। নরেন্দ্রপুর থেকে অটোয় গড়িয়া, সেখান থেকে গড়িয়াহাট যাওয়া হবে। আমরা পাঁচ জন একটা অটোয় উঠলাম, আমার সেই বন্ধু আর একটা অটোয় ড্রাইভারের ডান দিকে বসেছিল। গড়িয়া মোড় আসার আগে একটা ম্যাটাডোরের সঙ্গে ধাক্কায়... ওদের অটোর আর কারও কিছু হয়নি, শুধু ওরই। গড়িয়াহাটের বদলে বাঙ্গুর হাসপাতালে গেলাম আমরা। আমি আমার বন্ধুকে দেখতে পাইনি। দেখতে দেওয়া হয়নি। ওরা বলল, দেখতে পারবি না তুই, সহ্য করতে পারবি না। মাথার একটা দিক...

এই মৃত্যু আমার জীবনকে বদলে দিয়েছিল। আমি ডুবে গিয়েছিলাম শোকে। শোক শুধু এ কারণে নয় যে আমার প্রিয় বন্ধু চলে গেল। শোক এ জন্যে, মৃত্যুর ক’দিন আগে থেকেই আমি কী কারণে সেই বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ও অনেক চেষ্টা করেছিল কথা বলার, আমি বলিনি। ডাইনিংয়ে না। ক্লাসে না, খেলার মাঠে না। রুমে দুই মুখোমুখি দেওয়াল ঘেঁষে আমাদের চৌকি— ও এমনকি খাট টেনে কাছে নিয়ে এসেছিল, যদি আমি একটু কথা বলি, গল্প করি। করিনি। তার পরেই এই আকস্মিক দুর্ঘটনা, ওর চলে যাওয়া। মৃত্যুশোককে সহ্য করা যায়, অপরাধবোধের গ্লানি মিশে-থাকা মৃত্যুশোক অসহ। একটা মানুষ, আমার প্রিয় বন্ধু, আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল, আমি বলিনি— তারুণ্যের বন্ধুতায় আকছার ঘটা এই তুচ্ছ ঘটনাটিকে আমার শোকাকুল অপরাধী মন সাজাল এই ভাবে: তুই কথা বললি না, মানুষটা মরে গেল! কী হতো একটু কথা বললে? এখন কোথায় পাবি তাকে? কথার ঝুড়ি নিয়ে বসে আছিস একা, কী কথা বলবি এখন?

এই প্রিয়জনমৃত্যুটি আমাকে জীবনের দুটি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে। এক: মৃত্যুশোকের অনুভূতিরও তারতম্য হয়, সব মৃত্যুশোক সমান নয়। যে মৃত্যুশোকগুলি আমার জন্য অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে প্রতীক্ষমাণ, তারা আমাকে বিচলিত করবে ঠিকই, কিন্তু এই বন্ধুটির মৃত্যুশোকের মতো অভিভূত করতে পারবে না। দুই: কোনও আশঙ্কা থেকে নয়, তবু আমি পারতপক্ষে বন্ধু বা বন্ধুপ্রতিম কারও সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করি না। যদি বা করেই থাকি তা হলে বুঝতে হবে, একসঙ্গে পথ চলতে চলতে জীবন হয়তো তাকে বন্ধু ঠাউরেছিল, কিন্তু বন্ধু সে ছিল না কোনও কালেই।

এই যে বললাম আর কোনও মৃত্যুই আমাকে ‘সে ভাবে’ স্পর্শ করবে না, প্রমাণ পেয়েছি বলেই বললাম। আমার অগ্রজ সহোদরটি ক্যান্সারে চলে গেলেন কয়েক বছর আগে। চেন্নাইয়ের হাসপাতালে তাঁর মস্তিষ্ক থেকে কোষ তুলে দেখে ডাক্তারের নিদান: বাসা বেঁধেছে টিউমার। প্রাথমিক স্তর অনেক দিনই পেরিয়ে গিয়ে সে এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে। এমন জায়গায়, অপারেশন করা যাবে না, নাড়াঘাঁটা হলেই বিপদ। মস্তিষ্কের স্নায়ু ছিন্ন হয়ে হয়তো মানুষটা বেঁচে থাকবে বোধহীন এক জড়পিণ্ড হয়ে! এখান থেকে যাত্রা শুধু সামনের দিকে, মৃত্যুর দিকেই। সমস্ত রিপোর্ট হাতে পেতে আরও ক’দিন সময় লাগবে, অচেনা শহরে শুধুই বসে থাকা কয়েকটি মনখারাপিয়া মানুষের। এক শনিবার আমি চলে গেলাম পন্ডিচেরি। একা। ছোট্ট সুন্দর শহর, মানুষের মুখমণ্ডলে প্রশান্তির ছাপ। সমুদ্র আমার ভালো লাগে না, কিন্তু এই সমুদ্র কী নিরভিমান, বিনয়ী! তার বাঁধানো পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, ছবির মতো সুন্দর কাফেতে বসে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে গেল সেই কলেজের বন্ধুটিকে। আর এক আসন্ন মৃত্যু-অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড়িয়ে আমি মনে মনে তাকে বললাম, আর তো ভয় করি না, তুই তো আমাকে শিখিয়ে গিয়েছিস মৃত্যুশোকের মানে। 

আমার অগ্রজ এর পর বছর দেড়েক বেঁচে ছিলেন। ফেব্রুয়ারির এক রাতে যে দিন ফোনে মৃত্যুসংবাদ এল তাঁর, আমি শান্তমনে গ্রহণ করেছি, গভীর সন্তোষে ঘুমিয়েছি বাকি রাত।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা পাড়া দুটো পাড়া হেঁটে মেট্রো ধরতে যাই রোজ। অলিগলিপথের বাঁক, টিউবওয়েলে জল নিতে আসা বুড়ি, এফএম শুনতে শুনতে সেলাই-দোকানে কাজ করা মেয়ে— এরা রোজ ঘটে যায় জীবনে, উপলক্ষহীন। ছোট্ট ছিমছাম এক লন্ড্রির দোকানের বাইরে বসে থাকেন মধ্যবয়সি এক মানুষ। আমি যখন তাঁর দোকান পেরোই, তিনি এক কাপ লাল চায়ে চুমুক দেন। জানি লাল চা, কারণ কাপটা স্বচ্ছ, দেখা যায়। চায়ের উপর কয়েক ফালি আদাও দৃশ্যমান। বুঝতে পারি, এই তাঁর রোজকার রুটিন। দোকান খুলে বসে, এক পাত্র চায়ে চুমুক দেওয়ার এইটুকু নির্লোভ, ব্যক্তিগত বিলাস। রোজ আমি তাঁর দোকান পেরোই, আর ওঁর চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া দেখে, ঘড়ির দিকে না তাকিয়েই বলে দিতে পারি, এই মুহূর্তে ক’টা বাজে। কাঁটার একটুও এদিক না, ওদিক না।

এক দিন, কাজের দিনেই— দোকান বন্ধ। মানুষটাও বসে নেই। পরের দিনও নেই। তার পরের দিনও না। কিছু হলো? তাঁর সঙ্গে কোনও দিন কথা হয়নি, কথা হওয়ার কথাও ছিল না। কাউকে জিজ্ঞেস করব? বাড়ির নীচেই দোকানটা, কলিংবেল টিপব বাড়ির? যাঃ, হয় নাকি তাই? কে কী ভাববে! হয়তো বেড়াতে গেছেন! ডাক্তার দেখাতে চেন্নাই-ব্যাঙ্গালোর হয়তো! নাগরিক অস্বস্তিতে রোজ পথটুকু পেরোই, হাতঘড়ি দেখতে দেখতে। নেই, নেই। এক সপ্তাহ, আট দিন, দশ দিন পেরোয়, দোকান খোলে না। লাল চায়ে আদা ভাসে না।

তার পর এক দিন, পথচলতি আমাকে স্তম্ভিত করে দেয় ধবধবে সাদা কাপড়ের একটা গেট। তার গায়ে গোল গোল সাদা ফুলের রিং। ‘ওঁ গঙ্গা’ লেখা কাগজ। সেই ঝাঁপ ফেলা দোকানটার সামনে। একটা মানুষ, রোজ সময় মেনে যে লন্ড্রির দোকান খুলত, লাল চায়ে কয়েক কুচি আদা ছাড়া জীবনে স্পষ্টত দৃশ্যমান চাহিদা বলে যার কিছু ছিল না, মরে গেল? আমি তাঁকে চিনি না, নাম জানি না, কথাও হয়নি কোনও দিন। তবু মনে হলো, এটা ঠিক হলো না। এই ভাবে না বলেকয়ে চলে যেতে হয়? আদা দেওয়া এক কাপ লাল চায়ে চুমুক দিয়ে এই শহরের এক নাগরিক-মুখে যে পরিতৃপ্তির মানচিত্র ফুটে ওঠে, তা থেকে আমাকে বঞ্চিত করাটা অন্যায় নয়? 

এখন অন্য গলি ঘুরে অফিস যাই রোজ। 

5 comments:

1

প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


‘হাতে পাঁজি মঙ্গলবার’  
উপলক্ষ্য মুদ্রিত পঞ্জিকার দুশো বছর

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় 

প্রাক-কথন : ২০১৮ অর্থাৎ এই বছরটি মুদ্রিত পঞ্জিকার দ্বিশতবার্ষিকী। দৈবজ্ঞ স্মার্ত পণ্ডিতদের গণনা, পূজার্চনা ও ধর্নাচরণের বিধান সম্বলিত হাতে-লেখা ‘পুঁথি-পঞ্জিকা’ মুদ্রিত পঞ্জিকার চেহারা পেয়েছিল ছাপাখানা আসার পর। পঞ্জিকা গবেষকরা জানিয়েছেন যে ১২২৫ বঙ্গাব্দে বা ইংরাজি ২০১৮ সনে জনৈক শ্রীযুক্ত রামহরি প্রথম বাংলা পঞ্জিকা ছাপিয়ে প্রকাশ করেন, পঞ্জিকার সংকলক ছিলেন দুর্গাপ্রসাদ বিদ্যাভূষণ। ১৩৫ পৃষ্ঠার পঞ্জিকাটিতে একটি ছবি ছিল। গবেষকরা জানিয়েছেন পঞ্জিকাটির একটিমাত্র সংখ্যা জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। অতয়েব বাংলা মুদ্রিত পঞ্জিকার প্রথম প্রকাশের দুশো বছর উপলক্ষ্যে আমার এই অকিঞ্চিতকর তথ্যানুসন্ধান ‘হাতে পাঁজি মঙ্গলবার’। 

পাঁজি বা পঞ্জিকার কথা উঠলেই একটা প্রশ্ন ধেয়ে আসে। পঞ্জিকা মানেই কুসংস্কারের আঁতুড়ঘর। পঞ্জিকা নিয়ে লেখা মানেই তো কুসংস্কারের আঁতুড় ঘরেই উঁকি মারা। আধুনিক বিজ্ঞানসচেতন মননে এমনতর ভাবনা অস্বাভাবিক নয় মোটেই। বিশেষ করে এই সময়ে যখন ধর্মীয় উন্মাদনা আমাদের শুভবুদ্ধিকে, সংস্কারমুক্ত মনকেই আচ্ছন্ন করতে চাইছে। মেনে নেওয়া ভালো যে,পঞ্জিকা মানুষের ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাস-সংস্কারকে লালন করে ঠিকই কিন্তু সে ধর্মীয় উন্মাদনায় ইন্ধন যোগায় না, অলৌকিত্বের দাবী করে না। পঞ্জিকা নির্ধনকে ধনবান করার ফন্দি-ফিকির বলে না। ১৯৫৬র গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকায় সম্পাদকের একটা অকপট স্বীকারোক্তি দেখছি, পঞ্জিকা সম্পাদক মশাই লিখেছেন “প্রাচীন ঋষিগণ ধর্ম-কর্মের কাল নিরুপনের জন্যই তিথ্যাদিগণনার আবশ্যকতা বোধ করিয়া ছিলেন – বর্তমান যুগের মানুষের বৈজ্ঞানিক কৌতুহল নিবারণের জন্য ঐরূপ গণনা তাহারা করেন নাই”। ভাবের ঘরে চুরি করতে আমরা খুবই দড়। তাই পাঁজি হলো কুসংস্কারের ডিপো, এ’ কথাটা সকলেই বলতে পারি কিন্তু জীবনের প্রতিটি পর্বে – জন্ম থেকে মৃত্যু প্রতিটি স্তরে পাঁজির বিধানকে অস্বীকার করার সাহস পাই না। বিবাহের দিন ঠিক করি পাঁজির বিধান মেনে, নবনির্মিত গৃহের ভিত্তিস্থাপন কিংবা গৃহপ্রবেশের দিন নির্ধারণ করি পাঁজি মেনে, কর্মক্ষেত্রে পূজো-পার্বণের ছুটি উপভোগ করি পাঁজির বিধান মেনেই। আমাদের সামাজিক জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে পঞ্জিকা বা পাঁজি। সেই পাঁজির মধ্যে বাস করে তার উদ্ভব, বাড়বাড়ন্ত ও প্রভাব বুঝতে চেয়ে আলোচনা না করে এড়িয়ে যাবো, তা কি করে সম্ভব! এ দেশে যে কোন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সূচনা হয় নারকেল ভেঙ্গে, পঞ্জিকা নির্ধারিত দিনক্ষণ মেনে। এমন যার সর্বব্যাপি প্রভাব তাকে শুধু কুসংস্কারের সমার্থক মনে করে এড়িয়ে যাই কি করে! বাংলা পঞ্জিকা শুধুমাত্র ধর্ম-কর্মের কাল নির্নয় সহায়িকা কিংবা পূজার্চনা ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের নির্ঘন্টের গ্রন্থ নয়, বরং বাংলার সমাজ ও লোকজীবনের, সংস্কৃতির চলমান বিস্ময়। দুশো বছর আগে মুদ্রিত পঞ্জিকার যুগ শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই পঞ্জিকাকে আশ্রয় করে লোকজীবনের বহুমুখী সংস্কার গড়ে উঠেছিল, যেগুলি তার আন্তরিক জীবনাচরণ ও বিশ্বাসের অন্তর্গত। আমি মানি বা না মানি, পঞ্জিকাকে বাঙালির সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করার কথা ভাবা যায় না। 

পাঁজি শব্দটি এসেছে পঞ্জি থেকে, যার চলতি অর্থ বিবরণ বা তালিকা। ‘ভারতকোষ’এ পঞ্জিকার সংজ্ঞা দেওয়া আছে - ‘যে পুস্তকে বৎসরের প্রতি দিনের তারিখ, তিথি, পর্বদিন শুভদিন ইত্যাদি থাকে তাকে পঞ্জিকা বা পাঁজি বলে’। অর্থাৎ বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ এই পঞ্চ অঙ্গের সমাহারে নির্মিত পুস্তকই পঞ্জিকা বা পাঁজি। আমাদের পঞ্জিকা জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম ধারার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আর তার সঙ্গে মিশেছে বৈদিক অনুশাসন, বিশ্বাস ও ধর্মীয় নিদান। এক কথায় বলতে হয় আমাদের পঞ্জিকা বা তার বিবর্তনের ইতিহাসের মধ্যে রক্ষিত হয়েছে হিন্দু সংস্কৃতির প্রায় সমস্ত দিক। 

সভ্যতা বিকাশের প্রথম যুগেই মানবসমাজে কাল বিভাগের প্রয়োজনীতা অনুভূত হয়েছিল। ভারতে বৈদিক ঋষিরা বিভিন্ন যজ্ঞানুষ্ঠান করার জন্য সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ণ গতি পর্যবেক্ষণ করে বৎসরকে ১২টি মাসে ভাগ করেছিলেন। এক হাজার খৃষ্টপূর্বাব্দ সময়কালকে ‘বেদাঙ্গ জ্যোতিষ’কাল বলা হয় , এই সময় থেকেই নাকি পঞ্জিকা গণনা শুরু হয়েছিল। বলা হয়, মহাভারতে পাণ্ডবদের বনবাস ও অজ্ঞাতবাসের সময়পূর্তির হিসাব বেদাঙ্গ জ্যোতিষ গণনা পদ্ধতিতেই করা হয়েছিল তারপর খ্রিষ্টীয় ৪র্থ শতকে ৫৫০ অব্দে রচিত জ্যোতির্বিদ বরাহমিহিরের ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ অবলম্বনে পঞ্জিকাগণনা পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। এখনও সূর্যসিদ্ধান্ত পদ্ধতিতেই পঞ্জিকার গণনা হয়। 

মানুষের পঞ্জিকা নির্ভরতা অতি প্রাচীন। দুশো বছর আগে মুদ্রিত পঞ্জিকার যুগ শুরু হবার আগে আদিতে পঞ্জিকা ছিল জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থ। মুদ্রিত পঞ্জিকার যুগে এতে ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্রের অনেক কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং প্রাধান্য লাভ করেছে। রাশিগত বর্ষফল,বর্ষগত লগ্নফল, রাষ্ট্রগত বর্ষফল এখনকার পঞ্জিকার অতি আবিশ্যিক বিষয়। বাংলাতেও পঞ্জিকাগণনার ইতিহাস অতি প্রাচীন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত ভারতকোষ-৪র্থ খণ্ডে পঞ্জিকা বিষয়ক আলোচনা থেকে জানতে পারছি “এ সম্বন্ধে নবদ্বীপ পঞ্জিকার নাম জানতে পারা যায়। মনে হয়, স্মার্ত রঘুনন্দন প্রথম উহার গণনা আরম্ভ করেন। তৎপর মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় হইতে রামরুদ্র বিদ্যানিধি নামক এক পণ্ডিত এই গণনাকার্য সম্পাদন করিতে থাকেন। তৎপরে বিশ্বম্ভর জ্যোতিষার্ণব এই কার্যভার গ্রহণ করেন। ইহার অল্পকাল পরেই এই নবদ্বীপ পঞ্জিকা বন্ধ হইয়া যায়। তৎপরে ইংরাজ আমলে তদানীন্তন সমাহর্তার চেষ্টায় বিশ্বম্ভর জ্যোতিষার্ণব পঞ্জিকার প্রনয়ণকার্য চালাইয়া যাইতে থাকেন। এইসকল পঞ্জিকা পুঁথির আকারে লিখিত হইত এবং কয়েকটি অনুলিপিও প্রস্তুত হইত। এই পঞ্জিকা ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে সর্বপ্রথম মুদ্রিতাকারে প্রকাশিত হয়। উহা এখন ‘গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা’ নামে প্রচলিত। ইহার অল্পকালের মধ্যেই সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা গণনার প্রয়োজনীয়তা পণ্ডিতসমাজ বিশেষভাবে উপলব্ধি করেন। ফলে ১২৯৭ বঙ্গাব্দ হইতে ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা’র প্রকাশনা আরম্ভ হয়”। তাতেও অবশ্য পঞ্জিকাগণনা নিয়ে পণ্ডিত সমাজের বিরোধ নিরসন হয়নি। ১৯৫২তে ভারত সরকার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে পঞ্চাঙ্গ শোধন সমিতি বা ক্যালেন্ডার রিফর্ম কমিটি গঠন করে পঞ্জিকা গণনা পদ্ধতির সংস্কার সাধনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। মেঘনাদ সাহা কমিটির সুপারিশ অনুসারে একটি রাষ্ট্রীয় পঞ্জিকা প্রকাশিত হতে থাকে ১৯৫৭ থেকে, বিভিন্ন ভাষায়। এতৎসত্বেও বাংলা পঞ্জিকায় গণনার ভিন্নতার নিরসন হয়েছে এমন নয়। ১৩৬৩ (বা ১৯৫৬) সনের গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকায় দেখছি পঞ্জিকা সম্পাদক রামরূপ বিদ্যাবাগীশ দাবী করেছেন “ধর্মবিশ্বাসী হিন্দুগণের নিকট আমাদের নিবেদন এই যে, আমাদিগের গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকাই প্রকৃত সূর্যসিদ্ধান্তসম্মত গণনা বিশিষ্ট ও ধর্মশাস্ত্রানুসারে ব্যবস্থাপিত পঞ্জিকা, এই অনুসারে ধর্মকর্ম করিলেই ধর্মকার্য নিঃসংশয়ে সিদ্ধ হইবে। অন্য কোন প্রকার গণনা ধর্মশাস্ত্রসম্মত নহে – ইহাই সিদ্ধান্ত”। এমন আত্মপ্রচার অবশ্য সব পঞ্জিকাই করে আসছে। বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় দেখছি তাঁর ছবির নিচে পরিচয় লেখা হছে ‘ডক্টর অফ ধর্ম’ বলে। 

ছাপা পঞ্জিকা আর বাংলা বই প্রায় সমবয়সী। পঞ্জিকাও তো বইই। ছাপাখানার যুগ শুরু হওয়ার পর পঞ্জিকা হয়ে গেল বাঙালি জীবনের বিশ্বস্ত সঙ্গী। যে বাঙালীর ঘরে কখনও বই ঢোকেনি, সেখানেও হয়তো একটা বই পাওয়া যাবে সেটি পঞ্জিকা। এখনও যে ঘরে স্কুলের পাঠ্যবই ভিন্ন বই ঢোকেনা, সে ঘরে একটা পঞ্জিকা ঢোকে। পঞ্জিকা যেন বাঙালীর জ্ঞানের সেরা উৎস! ছাপাখানা আসার আগেও পঞ্জিকা ছিল, তবে সেই পঞ্জিকা তো সকলের নাগালে আসতো না। তখন হাতে লেখা পঞ্জিকা নিয়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা বাড়িতে বাড়িতে ঘুরতেন, বিধান দিতেন। তালপাতায় হাতে লেখা পঞ্জিকা নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মুদ্রিত পঞ্জিকার চেহারা পেল উনিশ শতকের গোড়ায়, যখন সবে বই ছাপা শুরু হয়েছে। জানা যায়, ১৮১৮সনে মুদ্রিত জনৈক রামহরির পঞ্জিকাকেই সবচেয়ে প্রাচীণ মুদ্রিত পঞ্জিকার মান্যতা দেওয়া হয়। “১৩৫ পৃষ্ঠার এই পঞ্জিকায় একটিমাত্র ছবি ছিল। পরের বছর দুর্গাপ্রসাদ বিদ্যভূষণ একটি পঞ্জিকা প্রকাশ করেন” (“উনিশ শতকের পঞ্জিকার দু চার কথা’/ আশিস খাস্তগীর – ‘অনুষ্টুপ’ প্রাক-শারদীয় সংখ্যা ২০১৬)। ছাপাখানা চালু হওয়ার পর সেই ১৮১৮ সন থেকে এ পর্যন্ত কত প্রকাশক বা ব্যক্তি কত পঞ্জিকা প্রকাশ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। অনুষ্টুপ পত্রিকার প্রাক-শরদীয় ২০১৬ সংখ্যায় একটি প্রবন্ধে দেখছি ১৮১৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত এই ২০০ বছরে ১০০টি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়েছে। তার অনেকগুলিই কালের নিয়মে হারিয়ে গেছে, আবার দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে অনেক পঞ্জিকাই আজও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। এখন ঘরে ঘরে যে পঞ্জিকাগুলি শোভা পায় তার মধ্যে গুপ্তপ্রেস ডাইরেক্টরী পঞ্জিকা ১৮৬৯ সন থেকে প্রকাশিত হয়ে চলেছে, পি এম বাকচি ডাইরেক্টরী পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়ে চলেছে ১৮৮৩ সন থেকে, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার বয়স এখন ১২৮ বছর (প্রথম প্রকাশ ১৮৯০)। ১৯১৮ সনে প্রকাশিত পূর্ণচন্দ্র শীলের পঞ্জিকার নাম পরে হয় বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা, যেটি আজও বাঙালীর ঘরে ঘরে। পঞ্জিকা ব্যবহারকারীর অগাধ বিশ্বাস এবং সেই কারণে বিপুল বিপণন না হলে পঞ্জিকাগুলির এতো দীর্ঘকাল ধরে টিকে থাকা সম্ভব হতো না। 

পঞ্জিকার বিবর্তনের বিষয়টিও বেশ চমকপ্রদ। পঞ্জিকা প্রকাশের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণকে তারিখ, তিথি, রাশি গ্রহের অবস্থান ইত্যাদি জ্ঞাত করা, অর্থাৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে জ্যোতিষ শাস্ত্রের মিশেল দেওয়া একটা ব্যাপার। তারপর প্রকাশকের ব্যবসাবুদ্ধি এবং ব্যবসাবুদ্ধির প্রতিযোগিতায় পাঁজিতে যোগ হলো মানুষের কাজে লাগে এমন নানান তথ্য রেলের সময়সারণী, কোর্টের তথ্য, ছুটির তালিকা, খনার বচন, দেব-দেবীর পূজার মন্ত্র, বিধি, ইত্যাদি, পঞ্জিকায় এল নানান বৈচিত্র্য। তিথি, রাশি, পূজা-পার্বণের নির্ঘন্ট সম্বলিত সাদামাটা পঞ্জিকায় বৈচিত্র আনলেন প্রথম কিশোরীমোহন বাকচি। কিশোরীমোহন পিতার পি এম বাকচি নামে ১৫২০ পৃষ্ঠার বিপুলায়তন ডাইরেক্টরী পঞ্জিকা প্রকাশ করলেন ১৮৯৯ সনে। ঐ পঞ্জিকা নাকি ছাপা হয়েছিল ৭০০০০কপি। 

শুধু নানান তথ্যের সমাবেশই নয়, নানান লৌকিক আচার, অনুষ্ঠান বিশ্বাস যেগুলি স্মৃতিশাস্ত্র নির্ভর ব্রাহ্মণ্যধর্মের আওতায় ছিল না, সেগুলিও পাঁজিতে যায়গা করে নিয়েছে, নিয়ে চলেছে। একশো বছর আগে যে লৌকিক ব্রতগুলি পাঁজিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল না সেগুলি পরবর্তি সময়ে পাঁজিতে স্থান করে নিয়েছে। আসলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বহু অবৈদিক,অ-পৌরাণিক পূজার্চনা ব্রতকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আওতায় নিয়ে এসেছে। এখন পঞ্জিকা শুধুমাত্র দৈবজ্ঞ পণ্ডিতদের গণনা, শাস্ত্রীয় লোকাচার ও বৈদিক দেবদেবীর অর্চনা বিষয়ক সংকলন নয়, বৈদিক আচার-বিচারের পাশাপাশি যায়গা করে নিয়েছে নানান লৌকিক দেব-দেবী, লৌকিক বিশ্বাস, সংস্কার, ব্রতকথা। পঞ্চাশ বা একশো বছর আগেও যেসব লৌকিক ধর্মাচার, ব্রত পঞ্জিকাতে স্থান পেত না, সেগুলিও এখন পঞ্জিকাতে যায়গা করে নিয়েছে। আদিতে ইতুপূজা, তাল নবমি, পুণ্যিপুকুর, বিপত্তারিণী ব্রত - এইসব লৌকিক ব্রতগুলি পঞ্জিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না, স্মার্ত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সম্প্রসারণের ফলে এইসব লৌকিক ব্রত পঞ্জিকাতে যায়গা করে নিয়েছে আর সেগুলির ওপর শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ‘বাঙালির ইতিহাস’ (আদিপর্ব) নীহাররঞ্জন রায়ের পর্যবেক্ষন উল্লেখ করি। লিখেছেন – “বাংলাদেশে সমস্ত আদি ও মধ্যযুগ ব্যাপিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দীর ভিতর দিয়া বহু অবৈদিক, অস্মার্ত,অপৌরাণিক ব্রতানুষ্ঠান এইভাবে ক্রমশ ব্রাহ্মণ্যধর্মের স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে; আজও করিতেছে। ...আমাদের চোখের সন্মুখেই দেখিতেছি পঁচিশ বৎসর আগে গ্রামাঞ্চলে যে সব ব্রতানুষ্ঠানে পুরোহিতের প্রয়োজন হইত না আজ সে-সব ক্ষেত্রে পুরোহিত আসিয়া মন্তর পড়িতে আরম্ভ করিয়াছেন, অর্থাৎ সেই সব ব্রত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে”। এই প্রক্রিয়া এখনও চলছে নিরন্তর। নব নব দেব-দেবীও আবির্ভূত হচ্ছেন আর চলে আসছেন পঞ্জিকার আওতায়। নবীনতম দেবী সম্ভবত সন্তোষী মা। তিনি অবশ্য এখনও পঞ্জিকার কোন তিথি দখল করতে পারেননি। বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকায় দেখছি লোকনাথ বাবার পাঁচালী ও হনুমান চালিশা যায়গা করে নিয়েছে। দুটি লৌকিক প্রথা বা অনুষ্ঠান ‘ভাইফোঁটা’ ও ‘জামাই ষষ্ঠী’ পুথি-পঞ্জিকা যুগে পাঁজির আওতায় ছিলনা,এ’দুটি আচার অনুষ্ঠানের কোন পুরোহিত লাগে নয়া, কোন সংস্কৃত মন্ত্রপাঠ হয় না। কে বলতে পারে কোনদিন এই দুটি অনুষ্ঠানেও ব্রাহ্মণ পুরোহিতের ডাক পড়বে না! 

সেই শুরুর সময় থেকেই পঞ্জিকার নামকরণের বিষয়টও বেশ কৌতুহল জাগায়। অধিকাংশ পঞ্জিকার নামকরণ হয়েছে ছাপাখানার মালিক তথা প্রকাশকের নামে, দুর্গাচরণ গুপ্তর ছাপাখানায় মুদ্রিত পঞ্জিকার নাম ‘গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা’ , পি এম বাকচি পঞ্জিকা, পূর্ণচন্দ্র শীল, বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা ইত্যাদি, যদিও সব পঞ্জিকার ক্ষেত্রেই এক বিদগ্ধ পণ্ডিতমণ্ডলির অবদান থাকে। পঞ্জিকার প্রথম পৃষ্ঠাতে মুদ্রিত হতো সেই পঞ্জিকার প্রধান অনুমোদক পণ্ডিত মহোদয় এবং দেশের নানান প্রান্তের অনুমোদক পণ্ডিতমণ্ডলীর নাম। ১৯৫৬র গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকায় দেখছি ২৭ পৃষ্ঠা জুড়ে পণ্ডিতমণ্ডলির নাম। এখন পঞ্জিকায় দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের তেমন বোলবোলাও নেই, এখনকার অনেক পঞ্জিকাতেই অনুমোদক পণ্ডিতমণ্ডলির তালিকা পরিহার করা হয়েছে। আসলে এখন পঞ্জিকা এমন এক বিশ্বাসের যায়গা অর্জন করেছে যে অনুমোদক পণ্ডিতমণ্ডলির নাম অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করে না। এখন দেখছি বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকায় প্রতিষ্ঠাতা বেণীমাধব শীলের পরিচয় দেওয়া হয় ‘ডক্টর অফ ধর্ম’ বলে। 

পঞ্জিকার সাত-সতেরোর খোঁজখবর নিতে গেলে যে বিষয়টি না বললেই নয়, সেটি পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন। ষাট বছরেরও বেশি আগে শৈশব-কৈশোরে যখন পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্য বইয়েরের সঙ্গে পরিচয় হতে শুরু করেছে, তখন কিছু বুঝি না বুঝি পাঁজির পাতা উল্টে অনেক সময় কেটে যেত। আকর্ষণ থাকতো পাঁজির বিজ্ঞাপনের। বাংলা বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞাপনভাষার বিবর্তন সম্পর্কে যারা আগ্রহী তাদের কাছে ষাট-সত্তর বছর কিংবা তারও আগেকার পঞ্জিকা-বিজ্ঞাপনগুলির ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। বিজ্ঞাপনগুলি থেকে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানতে পারি সেই সময়ের মানুষের পণ্যরুচি, পণ্যচাহিদা, দৈবনির্ভরতা এমনকি সহজে প্রতারিত হওয়ার অশিক্ষাজনিত সরলতা। মনে রাখা দরকার, মুদ্রিত পঞ্জিকার যুগের শুরু থেকেই পঞ্জিকার বিপুল বিপণন হতো, আজও হয়। সে যুগে সুলভে বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসাবে পঞ্জিকার কোন বিকল্প ছিল না, দীর্ঘদিন ধরেই ছিল না। রেভারেণ্ড জেমস লঙের উক্তি ‘পঞ্জিকা হলো বাঙালির কাছে পান তামাকের মত’। এহেন বাঙালীর অন্দরমহলে ‘যাহা ইচ্ছা করিবেন তাহাই পাইবেন’ ঘোষণা করা যাদু আংটি, কিংবা ‘আসল মহাকালী কবচ, বিফলে ১০০০টাকা পুরষ্কার’, ‘নিজের ভূত-ভবিষ্যৎ জানিতে পারা’র আজব আয়না’র মনোহারী বিজ্ঞাপন পৌছে যেত। এইসব লোক ঠকানো সব বিজ্ঞাপনেই থাকতো জলন্ধর সিটির ঠিকানা,পোষ্ট বক্স নম্বর অর্থাৎ সশরীরে উপস্থিত হয়ে পরখ করে ‘আজব আয়না’ কিংবা ‘আড়াই টাকায় হাতঘড়ি’ কেনার সুযোগ ছিল না। বছরের পর বছর সম্মোহনী রুমাল’, ‘৫টাকায় জগৎবিখ্যাত ক্যামেরা’, ‘ফুল আপনার ভাগ্য বলিয়া দিবে’, ‘ঐন্দ্রজালিক সুগন্ধী’ ইত্যাদির বিজ্ঞাপন পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় শোভা পেত। ১৯৫৬’র ৩৫০ পৃষ্ঠার গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকায় ছিল পূর্ণ পৃষ্ঠা,অর্ধ পৃষ্ঠা ও ১/৪ পৃষ্ঠা মিলিয়ে ১১৮টি বিজ্ঞাপন। পঞ্জিকায় ‘জলন্ধর সিটি’ মার্কা বিজ্ঞাপনগুলি ছাড়া চিৎপুর এলাকার প্রকাশকদের বইয়ের বিজ্ঞাপন,যেগুলিকে বলি বটতলার বই, নার্সারির বিজ্ঞাপন হোমিওপ্যাথি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধের বিজ্ঞাপন ইত্যাদি। সত্তরের মাঝামাঝি কিংবা আশির দশক থেকে পঞ্জিকাগুলির বিজ্ঞাপনভাবনায় বদল এলো। ১৯৭০এর পঞ্জিকাতেও ‘ঐন্দ্রজালিক সুগন্ধী’, ‘সম্মোহনী রুমাল’ ‘আজব আয়না’ ইত্যাদির বিজ্ঞাপন দেখেছি। কিন্তু আশির দশক থেকে এইরকম বিজ্ঞাপন পঞ্জিকার পৃষ্ঠা থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেল। বদলে জাঁকিয়ে বসতে লাগলো ভাগ্য গণনা, হাত দেখা ও জ্যোতিষ সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন। ২০১৫ (১৪২২ বঙ্গাব্দ)র ৩৬০ পৃষ্ঠার বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকায় দেখছি ১৫০ট ভাগ্যগণনা ও জ্যোতিষ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন। 

এখন পঞ্জিকা শুধুমাত্র দৈবজ্ঞ পণ্ডিতদের গণনা, শাস্ত্রীয় লোকাচার ও বৈদিক দেবদেবীর অর্চনা বিষয়ক সংকলন নয়, বৈদিক আচার-বিচারের পাশাপাশি যায়গা করে নিয়েছে নানান লৌকিক দেব-দেবী, লৌকিক বিশ্বাস, সংস্কার, ব্রতকথা। পঞ্চাশ বা একশো বছর আগেও যেসব লৌকিক ধর্মাচার, ব্রত পঞ্জিকাতে স্থান পেত না, সেগুলিও এখন পঞ্জিকাতে যায়গা করে নিয়েছে। আদিতে ইতুপূজা, তাল নবমি, পুণ্যিপুকুর, বিপত্তারিণী ব্রত - এইসব লৌকিক ব্রতগুলি পঞ্জিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না , স্মার্ত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সম্প্রসারণের ফলে এইসব লৌকিক ব্রত পঞ্জিকাতে যায়গা করে নিয়েছে আর সেগুলির ওপর শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ‘বাঙালির ইতিহাস’ (আদিপর্ব) নীহাররঞ্জন রায়ের পর্যবেক্ষন উল্লেখ করি। লিখেছেন – “বাংলাদেশে সমস্ত আদি ও মধ্যযুগ ব্যাপিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দীর ভিতর দিয়া বহু অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক ব্রতানুষ্ঠান এইভাবে ক্রমশ ব্রাহ্মণ্যধর্মের স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে ;আজও করিতেছে। ...আমাদের চোখের সন্মুখেই দেখিতেছি পঁচিশ বৎসর আগে গ্রামাঞ্চলে যে সব ব্রতানুষ্ঠানে পুরোহিতের প্রয়োজন হইত না আজ সে-সব ক্ষেত্রে পুরোহিত আসিয়া মন্তর পড়িতে আরম্ভ করিয়াছেন, অর্থাৎ সেই সব ব্রত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে”। এই প্রক্রিয়া এখনও চলছে নিরন্তর। নব নব দেব-দেবীও আবির্ভূত হচ্ছেন আর চলে আসছেন পঞ্জিকার আওতায়। নবীনতম দেবী সম্ভবত সন্তোষী মা। তিনি অবশ্য এখনও পঞ্জিকার কোন তিথি দখল করতে পারেননি। বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকায় দেখছি লোকনাথ বাবার পাঁচালী ও হনুমান চালিশা যায়গা করে নিয়েছে। 

আমি বুঝতে চেয়েছি পঞ্জিকার বিবর্তন এবং আমাদের সংস্কৃতির কত গভীরে এঁর শিকড় রয়েছে। গ্রন্থাগারে বসে গত পঞ্চাশ ৭০/৭৫ বছরের পঞ্জিকার সাত-সতেরো তথ্য জানার জন্য খান পাঁচেক পঞ্জিকার পাতা ওল্টাচ্ছি দেখে গ্রন্থাগারের এক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী জানতে চাইলেন আমি হাতের রেখা বিচার করি কি না! পঞ্জিকার পাতা ওল্টাছি মানে নিশ্চই আমি হাত দেখতেও পারি! এটা বলা এইজন্য যে এ থেকে বোঝা যায় পঞ্জিকাকে ঘিরে মানুষের কি অগাধ বিশ্বাস, সংস্কার। বাঙ্গালি পাঁজিকে তার বইয়ের আলমারিতে অনেক বইয়ের মাঝে রাখেনা, রাখে পৃথকভাবে যখন প্রয়োজন তখনই পাওয়া যাবে এমন স্থানে। পাঁজি যে তার দরকার যখন-তখন - আমাবস্যা-পূণিমা-একাদশিতে, পূজা-পার্বণ, বিয়ে-শাদি,গৃহপ্রবেশ কিংবা দূরযাত্রার শুভক্ষণ দেখতে কিংবা চড়কপূজা থেকে সন্তোষীমায়ের ব্রত সবেতেই পঞ্জিকা, প্রবাদসিদ্ধ হাতে ‘পাঁজি মঙ্গলবার’।

1 comments:

1

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


রামায়ণের মহিলা কবি—সুবর্ণনলিনী দেবী
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


ইদং পবিত্রং পাপঘ্নং পুণ্যং বেদেশ্চ সম্মিতম্‌।
যঃ পঠেন রামচরিতং সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে।।

অর্থাৎ এই পবিত্র পাপনাশক পুণ্যজনক বেদতুল্য রামচরিত যে পাঠ করে, সে সর্ব পাপ থেকে মুক্ত হয়। 
বাল্মীকি রামায়ণের সূচনায় রামায়ণ সম্বন্ধে এই উপদেশ ও বাণী আপামর ভারতবাসীর সকল কর্মে ও ধর্মে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

বিশাল এই দেশ ভারতবর্ষ। তার আনাচে কানাচে পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য গল্পগাথা, শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস, নানা কাহিনী, যার অনেকটাই ঘিরে আছে রামায়ণ ও মহাভারত এই দুই মহাকাব্য। মহাভারত যুদ্ধের কাহিনী। কপটতা, দণ্ডনীতি, রাজনীতির নিপুণখেলা দেখি সমগ্র মহাভারতের কাহিনী জুড়ে। অপরদিকে, রামায়ণ হলো ঘরের মেয়ের দুঃখগাথা। রাজনীতি, কপটতা এখানেও যে নেই তা নয়। কিন্তু সব ছাপিয়ে প্রধান হয়ে উঠেছে ঘরের মেয়ে সীতার দুঃখগাথা। জনমদুখিনী সীতার দুঃখে, অপমানে, যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয় আপামর ভারতবাসী। রামায়ণের অনুপ্রেরণায় রামের সুশাসনের আশায় বুক বাঁধে মানুষ। ভাই এর সৌহার্দ্য, পিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য, প্রজার প্রতি রাজার স্নেহ, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অনুরাগ, ভক্তি এসব দেখে বিগলিত হয় সাধারণ মানুষের মন। প্রেম, প্রীতি, ভক্তি ও শ্রদ্ধার আদর্শ রূপায়ণ হলো রামায়ণ। রামায়ণ তাই এত প্রিয় সকলের কাছে।

দেশে ও বিদেশে নানান ভাষায় অনূদিত হয়েছে রামায়ণ। হয়েছে নানান টীকা, বিশ্লেষণ। দেশের প্রায় সমস্ত অঞ্চলের আঞ্চলিক কবিরা রচনা করেছেন রামায়ণ নতুন করে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে, আবার কেউ কেউ আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ করেছেন বাল্মীকির সমগ্র রামায়ণ। এই সব আঞ্চলিক ভাষায় অনূদিত এবং রচিত রামায়ণের সংখ্যা প্রায় তিনশোরও বেশী।

আশ্চর্য্যের বিষয় রামায়ণের টীকাকার বা রামায়ণ রচয়িতা হিসাবে পুরুষ কবিদের নাম যেভাবে জানা যায়, মহিলা কবি প্রায় নেই বললেই চলে। বিংশ শতাব্দীর একেবারেই গোড়ার দিকে প্রথম জানা যায় রামায়ণের মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর কথা। ইনিই রামায়ণের প্রথম মহিলা কবি। এই মহিলা কবির নাম সর্বসমক্ষে প্রচারের কৃতিত্ব চন্দ্রকুমার দে মহাশয়ের। ইনি ছিলেন ‘মৈমনসিংহ গীতিকারের’ সংগ্রাহক। বাংলা ১৩২০ (ইংরাজি ১৯১৩ খ্রীঃ) সালে চন্দ্রাবতীর রচনা প্রকাশিত হয়। সে সময়ে দীনেশচন্দ্র সেন এই রচনার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং দীনেশচন্দ্র সেন ও চন্দ্রকুমার দে উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় চন্দ্রাবতীর রচনা প্রকাশিত হয়। 

অধুনা সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেনের গবেষণাপত্র থেকে আমরা জানতে পারি আরও দুই মহিলা রামায়ণ রচয়িতার কথা। একজন হলেন মোল্লা কবি, যাঁর রচনা ‘মোল্লা রামায়নম্‌’ এবং আর একজন হলেন রঙ্গনায়াকাম্ম, যাঁর রচনা হলো ‘রামায়ণয়ম্‌ বিষবৃক্ষম্‌’। দুজনেই দক্ষিণের কবি। চন্দ্রাবতী হলেন প্রথম মহিলা রামায়ণ রচনাকার যিনি বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। তাঁর জন্ম ১৫৫০। চন্দ্রাবতী ছাড়াও এই বাংলায় রামায়ণ রচনা করেন আরও এক মহিলা কবি, যাঁর নাম প্রায় অজানা। চন্দ্রাবতীর জন্মের প্রায় সোয়া তিনশো বছর পর তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর নাম সুবর্ণনলিনী দেবী (১৮৭৬)। চন্দ্রাবতীর মতো ইনিও প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যান। লক্ষণীয়, মহিলা কবিদের রামায়ণ রচনার পিছনে বেশিরভাগ সময়েই রয়েছে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি এবং সমাজের কটুক্তি, অবহেলা, দুঃখ থেকে উত্তরণের পথ হিসাবে কলমকে বেছে নেওয়া। চন্দ্রাবতীর মতো ইনিও জীবনের দুঃখ, কষ্টের পরিত্রাণ হিসাবে কাব্য রচনা এবং রামায়ণ রচনাকেই বেছে নেন। যেখানে সেকালে ‘গৃহিণীরূপে বিরাজ করাই হিন্দু রমণীগণের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য’, ‘পরিবার পরিচালনোপযোগী যাবতীয় শক্তি নিচয়ের যথাযথ অনুশীলনই স্ত্রী শিক্ষার সার্থকতা’ ছিল মহিলাদের জীবনের একমাত্র আরাধনা, সেখানে সংসারের মধ্যে থেকে রামায়ণ রচনার মতো এমন একটি কাজে নিজেকে সমর্পণ করা যে অত্যন্ত দুরূহ কাজ একথা অবশ্যস্বীকার্য। দক্ষিণের মোল্লা রচিত রামায়ণ সেখানকার ব্রাহ্মণ সমাজ রাজসভায় পঠন ও পাঠের জন্য অনুমোদন করেননি। কারণ মোল্লা ছিলেন একজন শূদ্র রমণী। রঙ্গনায়কাম্মা রচিত রামায়ণ সামাজিক ভাবে প্রচন্ড বাধার সম্মুখীণ হয়, কারণ কবি মহাকাব্যটিকে আঘাত করেছেন এমন ধারণা করা হয়েছিল এবং তার জন্য কবিকে অনেক বাধা সহ্য করতে হয়েছিল। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ দুর্বল ও অসমাপ্ত রচনা বলে গ্রাহ্য করা হয়নি। অনুরূপভাবে সুবর্ণনলিনী দেবীর রামায়ণও বহুল প্রচলিত নয়, যদিও কারণ জানা যায় না। এই রচনাটিও একরকম প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যায়, সেও কি মহিলা কবির রচনা বলে? জানতে ইচ্ছে করে সেকথা।


সুবর্ণনলিনী দেবীর জন্ম বাংলা ১২৮২ সনে (ইংরাজি ১৮৭৬) বীরভূমে। সেই অর্থে সুবর্ণনলিনীকে আধুনিক যুগের রামায়ণ রচয়িতা বলা যায়। পিতা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আদিনিবাস ছিল চন্দননগর, যদিও তিনি চাকুরী সূত্রে ছিলেন বীরভূমে। সুবর্ণনলিনী দেবীর বাল্যকাল ও কৈশোরকাল কাটে বীরভূমে, এরপর তিনি উত্তরপাড়ায় হিতকরী সভার ‘অন্তঃপুর পরীক্ষায়’ সর্বোচ্চ স্থান লাভ করেন ও স্বর্ণ পদক লাভ করেন। এরপরেই তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁর স্বামীর ও একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর আঘাত তাঁর জীবনে নেমে আসে। স্বামীর মৃত্যু, একমাত্র পুত্রের(পনেরো বৎসর বয়সে) মৃত্যু তাঁকে বিচলিত করলেও তিনি সরস্বতীর সাধনাতেই মনোনিবেশ করেন ও বাংলা ভাষাতেই রামায়ণ রচনা করেন। চন্দ্রাবতী, দক্ষিণের মহিলা কবি মোল্লা এবং সুবর্ণনলিনীর মধ্যে মিল এই যে তাঁরা তিনজনেই মাতৃভাষায় রামায়ণ রচনা করেন।

রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যচরিতামৃত কিংবা এই ধরণের রচনায় দেখা যায় একই বিষয় নিয়ে অনেক কবির রচনা এবং তার ফলে অনেক কবি ও রচয়িতার নাম আমরা জানতে পারি। আবার এই সব কবিদের অনেকেই স্ব স্ব আরাধ্য দেব-দেবী অথবা কোন দেবতার দ্বারা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কাব্য রচনা করেছেন এমন কথাও জানা যায়। সুবর্ণনলিনী দেবীর রচনাতেও ঠিক এই ধরণের বক্তব্য জানা যায়। রামায়ণ রচনার কারণ হিসাবে তিনি স্বপ্নাদেশের কথা নিজেই বলেছেন---

রামনবমী তিথি আছি উপবাসী।
কহিলেন করুণাময় শিহরিয়া বসি।।
কত নিদ্রা যাও মাতঃ উঠ অতঃপর।
কহি রামগুণগাথা যুড়াও অন্তর।।
করিলা আদেশ তুমি নিশি অবসানে।
কথাগ্রে ’ক’ দিয়া গ্রন্থ লিখিবে যতনে।।
লিখ সপ্তকাণ্ড রামায়ণ এইভাবে।
করিব কামনা পূর্ণ জানিবে গো ভবে।।
স্বপন দেখিয়া নিদ্রা হইল ভঞ্জন।
যাইনু ভগিনীর কাছে কহিতে স্বপন।।

সুবর্ণনলিনী দেবীর রামায়ণের বৈশিষ্ট্য হলো, সমগ্র রামায়ণটি রচিত হয়েছে প্রতিটি পংক্তির শুরুতে ‘ক’ অক্ষরটির ব্যবহারে। এ বড় কম কথা নয়! উদাহরণ হিসাবে দেওয়া যেতে পারে...

কাণ্ড তিন গেল পুঁথি রামের মাহাত্ম্য।
কহি আর তিন কাণ্ড রাবণ চরিত্র।।

প্রতিটি পংক্তির শুরু ‘ক’ অক্ষর দিয়ে। তাঁর রামায়ণে আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি সমগ্র রামায়ণটিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন, প্রথম খণ্ডে রামের মাহাত্ম্য বর্ণন এবং দ্বিতীয় খন্ডে রাবণ চরিত্র বর্ণন। গ্রন্থের উপসংহারে মাত্র দুটি পংক্তি ব্যবহার করেছেন---

কহি সপ্তকাণ্ডর কথা অমৃতের খণ্ড
করিনু সমাপ্ত প্রভু এ উত্তরাকাণ্ড।।

সুবর্ণনলিনী দেবী সম্বন্ধে যেটুকু তথ্য জানা গেছে সেটি নবপর্যায় বীরভূমি, ভাদ্র ১৩১৮, (প্রায় একশত দুই বৎসর আগেকার) নামক একটি পত্রিকায় তাঁর সবন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে। রচনাটি ‘বীরভূম সাহিত্য পরিষদের’ দ্বিতীয় বর্ষের ৪তুর্থ বার্ষিক অধিবেশনে (২৮শে শ্রাবণ, ১৩১৮) পঠিত হয়। এ সম্বন্ধে আর বিশেষ কিছুই এখনও পর্য্যন্ত জানা যায়নি। চেষ্টা চলছে, চলা উচিৎ। 

চন্দ্রাবতী পরবর্তী বাংলা রামায়ণের অন্যতম মহিলা কবি সম্বন্ধে আর কোন তথ্য পাওয়া না গেলে সে লজ্জ্বা আমাদের। 

তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন কিশোর কুমার দাস। এই লেখক তাঁর কাছে সবিশেষ কৃতজ্ঞ।

1 comments:

0

প্রবন্ধ - জয়দীপ মজুমদার

Posted in


প্রবন্ধ


রিভার্স পাম্পিং
জয়দীপ মজুমদার


আমরা সবাই জানি পাম্প জল তোলে ট্যাংক ভরে। কিন্তু কোনও কারণে মোটরের কানেকশান যদি উল্টো হয়ে যায় তাহলে মোটর উল্টো দিকে ঘোরা শুরু করে যার ফলে পাম্পও উল্টো দিকে চলা শুরু করে। একবার যদি পাম্প উল্টো দিকে চলা শুরু করে তাহলে ট্যাংক ভরার বদলে ট্যাঙ্ক খালি করে দেয়। মানে এই অবস্থায় পাম্প যদি নাও চলে তাহলেও বোধহয় ভালো। কারণ সেক্ষেত্রে অন্তত আর যাই হোক পাম্প ট্যাংককে খালি করতে পারবেনা। মানুষের হৃৎপিণ্ড এরকম একটা পাম্প যে প্রতি মুহূর্তে সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হচ্ছে। আর তার মোটর হচ্ছে প্রাণশক্তি যে এই পাম্পটাকে চালাচ্ছে। কিন্তু সেই শক্তির সব সময় দরকার হয়না। মানুষ জন্মাবার ঠিক পরেই ফুসফুসে যখন প্রথম বাতাস ঢোকে এই পাম্প চলতে শুরু করে দেয় আর তার সঙ্গে রক্তের চলাচল শুরু হয় শরীরের সমস্ত কোষগুলোতে। বাতাসের বিশুদ্ধ অক্সিজেন সারা শরীরে পৌঁছয় আর সারা শরীরের সমস্ত কোষের দূষিত কার্বনডাইঅক্সাইড রক্তে বয়ে এসে ফুসফুস হয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। এটা চিরন্তন সনাতন পদ্ধতি এর জন্যে কাউকে কিছু করতে হয়না। সেটা একটা কান্না দিয়ে শুরু হয় এবং কখনও কখন সেটা ঠিকমতো না হলে ডাক্তার বাচ্চাকে উল্টোমুখো চ্যাংদোলা করে পেছনে একটু চাঁটি মেরে দেয় যাতে বাচ্চা কাঁদে এবং ফুসফুসে হাওয়া ঢোকে। এর পর আর কিছু করতে হয়না এবং এই পাম্প চলতেই থাকে যেরকম করে গাড়ী স্টার্ট হবার আগে একটু ব্যাটারীর দরকার হয় ইঞ্জিন স্টার্ট নেবার জন্যে। কিন্তু ইঞ্জিন একবার স্টার্ট নেবার পর আর ব্যাটারীর দরকার হয়না উল্টে ইঞ্জিন তখন ব্যাটারীকে চার্জ করতে পারে। যেরকম টিউবওয়েলে জল না উঠলে একটু জল ঢেলে পাম্প করতে হয়। তবেই যে জিনিষটা চাইছি সেটা পাব। তার মানে যে জিনিসটা আমি চাইছি সেটা আমার মধ্যে রয়েছে কিন্তু পরিমাণটা অনেক কম। সেই পরিমাণটা বাড়ানো মানে শক্তির ব্যবসা করা। ব্যবসায় লাভ ক্ষতি থাকে। যারা এই ব্যাবসায় পটু ওরা সমাজ সংস্কারক মহাপুরুষ হয়ে যায়।কিন্তু যারা পটু নয় ওরাও চেষ্টা করে কিন্তু হেরে যায় এবং ভেসে যায় ওদের সমস্ত পসিটিভ এনার্জি গুলো টিউবওয়েলে জল ঢালার মত হারিয়ে যায়। টিউবওয়েলে জলতো ওঠেইনা উপরন্তু যা জল সঞ্চিত ছিল লাভের আশায় তাও হারিয়ে গন্ধ হারানো খুশবু বিহীন ফুল হয়ে যায় মাঝখান থেকে। সেই আমি যখন জীবন যুদ্ধে হেরে যাই কিছুই করতে পারিনা, তখন আমার অসাফল্যকে প্রচার করে মহান হই ফেসবুকে বা ব্লগে পোষ্ট করে লাইক পাই আর মনে করি আমার কাজ শেষ। বাকী কাজ সরকার করবে। একবারও ভাবিনা সরকার যদি পঞ্চাশটা বা একশটা লোকের সংস্থান করতে পারে তাহলে আমিও একটা লোকের সংস্থান করতে পারি। আসুন আমরা সেই কঠিন কাজটা করবার শপথ করি যেদিন একটা লাওয়ারিশ লোকের সংস্থান করতে পারব সেই দিন ফেসবুকে পোষ্টিং দেব সেই দিন ব্লগে লিখব আমার সাক্সেস স্টোরি। তারপর সরকারকে বলব আমি আমার কাজ করে কথা বলছি বাতেলা দিচ্ছিনা হাওয়ায় সমাজ সংস্কারের কথা বলছিনা। 

কারণ আমাদের দেশে পোকা মাকড়ের মতো ফ্লাইওভারের নীচে রাস্তার ধারে মানুষ জন্মাচ্ছে। আমি আপনি এই দেশেকে represent করিনা। এই দেশকে represent করে ওরা। কারণ সংখ্যায় ওরা অনেক বেশী। সেই সব মানুষগুলোর কাছ থেকে থেকে আর কি আশা করা যায় যাদের জন্মই হয় শুধু শারীরিক বা পাশবিক কামনায়। 

যে লোকগুলো জানেনা কাল সকাল খাওয়া জুটবে কি জুটবে না কিন্ত খাওয়া জুটুক না জুটুক 'ঐ কাজটা' চাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে। এই সব অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত লোক গুলোকে সিরিয়া ইরাকে কাজে লাগানো হয়েছে উগ্রপন্থায়। প্রায় ধ্বংসের মুখে ওখানে পুরুষ জাত যুদ্ধ আর দাঙ্গায়। আর স্ত্রী মা বোনেরা পরিণত হয়েছে পতিতায় উগ্রপন্থীদের পণ্যে। প্রতিদিন নারী গণধর্ষণ উৎসব চলছে। সেখান থেকে যে সব অবৈধ পুরুষ সন্তানরা জন্মাচ্ছে একটু বড় হতেই ওদের হাতে বন্দুক ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর মেয়েদের তৈরী করা হচ্ছে বড় করা হচ্ছে মনোরঞ্জনের জন্যে next generation পতিতা। সারা দুনিয়ার কিছু দেশ থেকে ফাণ্ডিং হচ্ছে আর এদের জন্মদাত্রীরা পেটের দায়ে বা ইচ্ছের বিরুদ্ধে আবার নতুন করে ধর্ষিতা হচ্ছেন ওখানকারই উগ্রপন্থীদের হাতে। ধর্ম সেখানে এসব মা বোন মেয়েদের প্রোটেকশান দেয়না। সেখানে দ্রৌপদীকে রক্ষা করতে শ্রী কৃষ্ণের আবির্ভাব হয়না। স্বধর্মের লোকেদের হাতে ইজ্জত ভূলুন্ঠিত হওয়ার খবর নিউস পেপারের শিরোনামে আসেনা। জীবন এভাবে চলছে। এ প্রতিদিনকার দশটা পাঁচটা কাজ। যারা পেরেছে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। যেভাবে চিতার আগুনে জল ঢেলে উল্টো মুখে লাঠি দিয়ে শ্মশানে কলসী ভেঙে যে মরে চলে গেল তার সংগে সমস্ত সম্পর্ক চোকানো হয়। আর যারা রয়ে গেছে প্রতিদিন ধর্ষিতা হচ্ছে, তাদের কান্না তাদের সর্বশক্তিমান অবদি পৌঁছায়না ধর্ম এদেরকে বাঁচাতে পারছেনা। ইরাকের মেসোপটেমিয়ার টাইগ্রীস ইউফ্রেটিস নদীর মিলনস্থল ও তার অববাহিকায় একসময় যে সভ্যতা শুরু হয়েছিল এখন সেখানে তার অন্তেষ্টি হচ্ছে। নরকের সেই শেষ সীমায় আমরা এখনও পৌঁছাইনি। আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারি। সেই ক্ষমতা আমাদের আছে। 

আমার এখানে গাল্ফ নিউজের প্রথম পাতায় ওদের খবর আসেনা, আসে ইণ্ডিয়ায় দুটো মেয়ে রেপ হয়েছে সেটা প্রথম পাতায় । Indian males are f**king bulls এই T shirt পরে ইস্তানবুল এয়ারপোর্ট লোকজনদের ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে তার কিছু পোষ্টিংও আমি দেখেছি WhatsApp এ

অথচ ইণ্ডিয়া যখন সব চাইতে কম পয়সায় space satellite পাঠিয়ে celebrate করে সেই খবর Gulf News এর প্রথম পাতায় আসেনা। তাহলে আগেরটা কেন আসে? ধর্মীয় বলে। কিন্তু শুনেছি ইকনমি তো ধর্মের বাপ। পৃথিবীতে ইকনমি আগে এসেছে ধর্ম পরে। 

বাড়ীতে অনেক ছেলে মেয়ের মধ্যে একটা যদি খারাপ হয় তাহলে তাকে আমরা counselling করাতে নিয়ে যাই special education দিই। কিন্ত ওর negativity publish করিনা বা প্রচার করিনা root cause এ যাওয়ার চেষ্টা করি। Solution খোজার চেষ্টা করি। স্কুলের ওপর ছেড়ে দিইনা বা সরকারের পর ছেড়ে দিইনা। 

তার মানে এই নয় ধর্ষণকারী শাস্তি না পেয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু ধর্ষণকারীর চরম শাস্তি হবার পরেও আমাদের কাজ আছে। আমাদের প্রত্যেককে আমাদের অনুপাতের বরাদ্দের সেই কাজটুকু execute করতে হবে। 

বহুদূর হেঁটে আজ দেখতে পাচ্ছি কোনও একটা অজানা কারণে হৃৎপিণ্ডের পাম্পটা উল্টো দিকে ঘুরছে যার ফলে শরীরের সমস্ত অক্সিজেন বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে আর বাতাসের দূষিত কার্বনডাইঅক্সাইড শরীরের ভেতর ঢুকছে। এই অবস্থা বেশী দিন চললে যেকোন সময় ধংস অনিবার্য। 

কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, সব কিছু ঠিক ছিল আর দরকার ছিল খালি মোটরের ডাইরেকশানটা উল্টো করে দেওয়া। ব্যাস। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। তাহলেই শরীরে অক্সিজেন ঢুকবে আর কার্বনডাই অক্সাইড বাইরে বেরিয়ে যাবে। 

সত্য যুগে যেরকম মন্দির মসজিদ বা গির্জা ছিলনা সেরকম থানা পুলিশ বা জেল ও ছিলনা। প্রত্যেকটা মানুষ সেখানে এক একটা দেব শিশু ছিল। সেখানে মানুষের বিবেক মানুষকে পথ দেখাত। 

আরো তিনটে যুগ পেরিয়ে আসার পর বাতাসে এখন আর অক্সিজেন পাওয়া যায়না পাওয়া যায় শুধুই কার্বনডাইঅক্সাইড। কিন্তু তা থেকেও অক্সিজেন তৈরী করা যায় বাঁচা যায় এবং অন্যদের বাঁচার রসদ তৈরী করা যায় যেরকম গাছ বানায়। 

আমরাকি তার খানিকটা চেষ্টা করতে পারিনা? যদি করা শুরু করি দেখবেন সত্য যুগ আসবে নয় এসে গেছে। 

0 comments:

0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড
শিবাংশু দে

জোড়াসাঁকো জংশন থেকে যখন গাড়িটি প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এগিয়ে গিয়েছিলো তখন কি মায়া কেটে গিয়েছিলো তার? দক্ষিণের বারান্দার মৃদু বসন্ত বাতাস অথবা জ্যোতিদাদার ছাতবাগানের জুঁইফুল ভাসাভাসি সন্ধের বিলোল আমেজ কি ছেড়ে গিয়েছিলো তা'কে? অনেক দীর্ঘ পথ অপেক্ষা করে আছে, এমন কোনও প্রতীতি হয়েছিলো কি? জোড়াসাঁকো থেকে জালিয়াঁওয়ালা বাগ, সুরুলকুঠি থেকে সুইডিশ আকাদেমি, শিলাইদহ থেকে সান ইসিদ্রো...

ক্লান্তিহীন যাত্রাপথের গান, শুধু কি আনন্দে? নাহ, মানুষের যাবতীয় ভাবনার শ্রমসংহিতা, সবাইকে জায়গা করে দেওয়ার অলিখিত ঈশ্বরী দায় , একলা ইঞ্জিনের পিছনে অন্তহীন সারিবাঁধা কামরার ঝমঝম সিম্ফনি .... রবীন্দ্রসঙ্গীত ....


'... মীড়গুলি তার, মেঘের রেখায় স্বর্ণলেখায় করব বিলীন'

'বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত' বিষয়টি এই মুহূর্তে বুদ্ধির কাছে এত বহুকথিত, আবেগ বা নিরাবেগ কলুষিত প্রদূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে রসিকজন হয়তো এই নিয়ে কিছু পড়ার চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ শুনতেও অধিক আকৃষ্ট হবেন। সম্প্রতি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে 'জীবন'এর আরও 'কাছাকাছি' আনার জন্য এক যোগে যে ধরনের এলিট ও সাব অল্টার্ন রুদ্ধশ্বাস প্রয়াস চলেছে, তাতে 'সঙ্গীতসরস্বতী'র (খুব ক্লিশে শব্দ হয়তো, তবু বিকল্প না থাকায় ব্যবহার করলুম) অবস্থা কুরুরাজসভায় পাঞ্চালী প্রতিম এবং এক্ষেত্রে বাসুদেব যেহেতু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, তাই এখনও পর্যন্ত কোনও মতে লজ্জারক্ষা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, আগে কহো আর।



নিধুবাবু, রাম বসু, দাশরথি রায়, রামমোহন, ব্রাহ্মসঙ্গীত থেকে জোড়াসাঁকো। দেড়শো বছর আগেই তা বাঙালিদের জন্য বেশ বড়ো কালচারাল শক ছিলো। তার মধ্যে ১৮৭৭ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত এক রবীন্দ্রনাথ এবং তার পর আরেক বা অনেক রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির রসবোধ ও সাংস্কৃতিক রুচি যে গতিতে এগিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ সর্বদা তার থেকে অনেক অধিক বেগে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এই গরমিলের কারণে দু'টি প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রকট। রসগ্রাহীদের মধ্যে এই সূত্রেই স্পষ্ট দু'টি ভার্টিক্যাল প্রথম থেকেই তৈরি হয়ে গেছে। একদল প্রহ্লাদ, যারা পূজা করে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়ার চেষ্টা করেছে, অপর দল ধরে আছে হিরণ্যকশিপুর টোটেম। তারা চিরকাল বিরোধিতা করে, বিরূপ থেকে, অনীহা দেখিয়ে, নিজস্ব জ্ঞানবুদ্ধির নিরিখে নানা কটূক্তি করে, রবীন্দ্রনাথকে পেতে চেয়েছে। ঘটনা হচ্ছে এই যে পছন্দ করুক বা নাই করুক, কোনও বাঙালিই রবীন্দ্রনাথ বা সমার্থে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে 'জীবন' থেকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যানে রাজি নয়। বাঙলির নানা স্ববিরোধী অবস্থানের মধ্যে এটিও একটি। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজনীতি বাঙালির নিত্যদিনের সড়ক রাজনীতির মতো-ই ধূসর, ধূমিল ও পরিণতিহীন।

অধরামাধুরী ধরেছি.....

-----------------------------

রাজনীতিসহিত বা রাজনীতিরহিত, যেকোনও অবস্থাতেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গত অন্ততঃ অর্ধশতক ধরে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। এই সংযোগটা খুব সহজে হয়নি। নানা ধরণের অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী টানাপড়েন এর মধ্যে কাজ করেছে। 'বাঙালি রুচিবোধ' নামক একটি ধারণার প্রতি মোটামুটি সব বাঙালিই বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করে। এটি প্রকৃত না অলীক, তা নিয়ে তর্ক করবো না। তবু এর কিছু স্বীকৃত লক্ষণ আছে। তার মধ্যে একটি, রবীন্দ্রনাথের প্রতি আনুগত্য। এই রবীন্দ্রনাথ কিন্তু গরিষ্ঠ শতাংশ বাঙালির কাছে গানের রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির অন্যধারাগুলির প্রতি সংখ্যাগুরু বাঙালির আগ্রহ বিষয়ে সন্দিহান হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান, যা আজ উভয়পারের বাঙালির কাছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি মূল স্রোত, উত্তর কপিরাইটযুগে তার রূপরেখা কী রকম হওয়া উচিত তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। অথচ, রবীন্দ্রসঙ্গীত একটি অতীব নথিবদ্ধ গীতধারা। আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিন্যাসের সঙ্গে তার খুব একটা পার্থক্য নেই। 'নতুন' কিছু করো'র উন্মাদনায় তার মূল চারিত্র্য'কে সওদাগরের নিলামে চড়ানোটাকে সঙ্গতভাবেই 'যথেচ্ছাচার' আখ্যা দেওয়া যায়। যে 'রুচিবোধ' নিয়ে বাঙালির বেশ একটু অহমভাব রয়েছে, তার অনেকটা জুড়েই তার সঙ্গীতরুচির ব্যাখ্যান চলে। তারও সিংহভাগ জুড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ন্যায্য অনুরাগ অতি প্রকট। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক কালে দেখছি রবীন্দ্রসঙ্গীত'কে গায়ন ও পরিবেশনের ক্ষেত্রে কিছু মানুষের স্থূল, শিল্পবোধরহিত পরীক্ষার শিকার হতে হচ্ছে। আগের প্রজন্মের শ্রোতারা, যাঁদের সঙ্গীতরুচি পরিণতিলাভ করে গেছে, তাঁদের নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু নতুন প্রজন্মের আগ্রহী শ্রোতারা, যাঁরা নিজেদের জেন-এক্স বলে চিহ্নিত করেন, তাঁদের কাছে গত এক শতক ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিবেশন শিল্পটি কীভাবে বিকশিত হয়েছে, তার একটি খতিয়ান প্রস্তুত করার ইচ্ছে হ'লো। ইতিহাসটি জেনে নিয়ে তাঁরা নিজস্ব সঙ্গীতরুচি তৈরি করুন, সেটাই ঈপ্সিত উদ্দেশ্য। বিষয়টি বিস্তৃত এবং নিজের সীমাবদ্ধতা বিষয়ে আমি অবহিত। তবু মোটামুটিভাবে একটি সামগ্রিক আলোচনা করার প্রয়াস করেছি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমার নিরীক্ষাটি এপার বাংলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ওপার বাংলায় এই বিষয়ে যে সমৃদ্ধধারাটি রয়েছে, ব্যক্তি আমি তার সঙ্গে যুক্ত হবার সঙ্গতি অর্জন করতে পারিনি।

----------------------------------------

যেকোন শিল্পসৃষ্টি অনুধাবন বা উপভোগ করতে গেলে কিছু মৌল প্রস্তুতি লাগে। শিল্পটি যদি সঙ্গীত হয়, তবে আগে গান 'শুনতে' শেখার অভ্যেস করতে হয়। তাই প্রথমে আমাদের গান শোনার অভ্যেস বিষয়ে দুটো কথা বলে নিই। উত্তর ভারতে যে শাস্ত্রীয় গান আমরা শুনে থাকি সেখানে কোনও একটি সুর, যাকে স্ট্রাকচারড ভাবে 'রাগ' বলা হয়, তার শুধু কংকালটুকুই নথিবদ্ধ থাকে। আরোহ ও অবরোহ। এর পর শিল্পীকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয় ঐ কংকালের উপর রক্ত মাংস মেদ ত্বক আরোপ করে একটি রাগের শরীরী ও আত্মিক সত্বাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য। তারও অনেক প্রথাবদ্ধ নিয়ম আছে, কিন্তু কোনও ধরাবাঁধা স্বরলিপির সংস্থান নেই। কিন্তু পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে সুরস্রষ্টার তৈরি করা স্বরলিপির বাইরে একবিন্দু সরে যাবার অধিকার পরিবেশক শিল্পীর থাকেনা। এ নিয়ে 'স্নেহের মন্টু', ধূর্জটি ও 'গুরুদেবে'র অসংখ্য বোধ, যুক্তি ও আলোচনার কথা সবাই জানেন।

তা মন্টুর নাম যখন এসেই গেল, তখন বলি তাঁর গান কীভাবে গাইতে হবে সে নিয়ে কবিকে প্রথম সিরিয়স চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন পুত্রবৎ এই মানুষটি। আসলে কবির গান শুধুমাত্র খণ্ডসুরের নির্মিতি নয়। যে গানটি আমাদের কাছে আসে তা বস্তুত একটি দীর্ঘ অন্তর্লীন প্রস্তুতির গভীর থেকে উঠে আসা সুন্দরের ছায়ামাত্র। সুন্দর নিজে ন'ন। দারুব্রহ্ম জগন্নাথের মূর্তি যেন । অন্তস্থ 'ব্রহ্ম' রয়েছেন সুদূর গভীর কন্দরে। এই গানকে ধরতে চাইলে সুন্দরকে চিনতে হবে। কিন্তু কীভাবে?

দিলীপকুমারের এক 'বিশেষ ভক্তিভাজন' শুভার্থী একবার তাঁকে বলেছিলেন, "রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্টতা করছ হে, ঘা খাবে। উনি প্রতিভাধর, কিন্তু স্নেহশীল নন। উনি স্নেহ করেন বুদ্ধি থেকে, হৃদয় থেকে নয়- একথা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে।" পরে আরও কেউ কেউ দিলীপকুমারকে একই কথা বলেছিলেন। দিলীপকুমার প্রতিবাদ করেছিলেন এই ধারণার। তর্ক করেছিলেন প্রথম বয়সে। রবীন্দ্রনাথের স্নেহশীলতা, হৃদয়বত্তা, ভালোবাসার ক্ষমতার অসংখ্য পরিচয় তিনি পেয়েছেন আকৈশোর। কবির নিজের ভাষায় "আদর করিতে জানা, অনাদৃতজনে", তার পরিচয় পেয়েছেন তিনি নিজে ছাড়াও অযুত মানুষ। কিন্তু যাঁরা অন্যরকম ভাবতেন, তাঁরাও কেউ 'নির্বোধ' ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের ভিতর কবির অন্তর্লীন সুন্দরকে চিনে ওঠার এলেমটি ছিলনা। তাঁর ব্যক্তি পরিচয়ের মতো, তাঁর সঙ্গীতের পরিচয় পেতে গেলেও প্রস্তুতি লাগে। 

দিলীপকুমার এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "...আমার মতন সামান্যের এজাহারের মূল্য যে আমাকে তিনি গভীরভাবে স্নেহ করেছিলেন বলেই আমাকে বারবার ক্ষমা করেছিলেন-আমি ঝোঁকের মাথায় তাঁকে বারবার আঘাত করা সত্ত্বেও। আজ একথা ভাবতে আমার অনুশোচনার অবধি থাকেনা।" এই 'বারবার আঘাত'টি কী ছিল? দিলীপকুমারের ভাষায়, "...বাংলা গানে সুরবিহার- অর্থাৎ তান বিস্তারের স্বাধীনতার পথ খোলা রাখা দরকার। কিন্তু এখানেও আমার কাঁচা বুদ্ধির অভিজ্ঞতা ধোপে টিকবে কিনা এ-জিজ্ঞাসা আমার মনে ওঠা উচিত ছিল নিশ্চয়ই। মনে মনে আরও গভীরভাবে সচেতন হয়ে ওঠা উচিত ছিল বই কী যে, তিনি তাঁর সঙ্গে সমানে তর্কাতর্কি করার অধিকার দিলেও আমার পক্ষে সে-অধিকারে উল্লসিত হয়ে ওঠা স্পর্ধারই সগোত্র।" এই সময়ে দিলীপকুমার ছিলেন একজন 'যৌবনমদান্ধ' যুবক (১৯২৩)। তার পরেও একবার প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের আলিপুরের বাড়িতে দিলীপকুমার কবির সঙ্গে তুমুল তর্কে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন। প্রশান্তকুমার সখ্যের অধিকারে দিলীপকুমারকে 'খুব ধমকে' দেন। দিলীপকুমার কবির কাছে যখন ক্ষমা প্রার্থনা করেন তখন কবি তাঁকে লেখেন, তিনি (কবি) দিলীপকুমারকে 'অন্তরের সঙ্গে স্নেহ' করেন, কারণ তাঁর (দিলীপকুমার) মধ্যে তিনি 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্য' দেখেছেন। চাবিকাঠিটি ঠিক এখানেই আছে। রবীন্দ্রনাথকে পেতে গেলে 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্য' অর্জন করতে হবে। তাঁর সঙ্গীত কীভাবে গাইতে বা শুনতে হবে তার সূত্রটিও এখানেই। ঐ বোধটির মধ্যেই আছে। দিলীপকুমারের সুরবিহারের জেদ কীভাবে তাঁর ঘনিষ্ট সাহানা দেবীর এই গানটির মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে, শুনলেই বোঝা যাবে। যদিও রবীন্দ্রসান্নিধ্যের সাহানা দেবী রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদিতম রূপকারদের একজন। কিন্তু দৈলীপী প্রভাবে কীভাবে তাঁর গায়নের ধরনটি বদলে গিয়েছিল তা এই গানটিতে লক্ষিত হয়। পরিণতবোধের দিলীপকুমার অবশ্য এই অবস্থান থেকে সরে এসেছিলেন। 


সঙ্গীত উপভোগ করার নানা মার্গ আছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে আবেগমুখী ও সন্ধানমুখী। একটু সাধারণীকরণের ঝুঁকি নিয়ে বলি, প্রথমটি আমাদের ধরন, দ্বিতীয়টি পাশ্চাত্য ধরন।

আমাদের সঙ্গীত চর্চা ও উপভোগ করার ব্যাকরণ যেহেতু ইম্প্রোভাইজ করার কৌশলকেই অনেক বেশি মূল্য দেয়, তাই আমাদের সন্ধানমুখী সাঙ্গীতিক প্রবণতা তেমন প্রত্যক্ষ নয়। স্বরলিপির মাধ্যমে সুরের কাঠামো ধরে রাখার কায়দাটি য়ুরোপীয়রাই আমাদের দিয়েছে। পণ্ডিত ভাতখণ্ডে যখন সুরসংস্থানের বিচারে হিন্দুস্তানি রাগরাগিনীর বিন্যাস করতে চেয়েছিলেন, তখন তাঁকে প্রভূত বিরোধের সম্মুখীন হতে হয়ে ছিলো।

সুরকে নির্দিষ্ট খাঁচায় বেঁধে রেখে সঙ্গীত চিন্তা ও পরিবেশন আমরা ভিতর থেকে এখনও খুব একটা মেনে নিতে পারিনা। বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ থাকে, স্বরলিপির বাঁধনে গানের আবেগ উচিত মাহাত্ম্যে প্রকাশ করা যায়না।

আমরা সতত মনে রাখি, যে কবি লেখেন ' বাঁধন ছেঁড়ার সাধন হবে' বা 'তোমার জ্ঞানী আমায় বলে কঠিন তিরস্কারে, পথ দিয়ে তুই আসিসনি যে, ফিরে যারে', তাঁকে এই বাঁধনে বদ্ধ করার চেষ্টা অনুচিত। রবীন্দ্রসঙ্গীত যাঁরা ভালোবেসে শোনেন, তাঁদের অনেকেরই মত, স্বরলিপি থেকে ঈষৎ বিচ্যুতি থেকে যদি গানের স্পিরিটকে আরও ভালোভাবে প্রকাশ করা যায়, তবে তাই হওয়া উচিৎ। ব্যক্তিগতভাবে আমি সহমত। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করলে আমার অবস্থানটি ব্যাখ্যা করার মতো 'যুক্তি' আমার কাছে থাকা দরকার। রবীন্দ্রনাথের গান বহিরঙ্গে যতটা সরল, প্রকৃতপক্ষে তা নয়।

রবীন্দ্রনাথই প্রথম প্রধান বঙ্গীয় সুরস্রষ্টা যিনি এই স্বরলিপির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং অত্যন্ত সিরিয়াসভাবে তাকে কার্যান্বিত করেন। মুখে যাই বলুন না কেন, তাঁর সম্যক ধারণা ছিলো তাঁর গানের প্রকৃত স্বরলিপি তৈরি না করে গেলে তাঁর আপাত সরল সৃষ্টিসকল একদিন শিকড়হীন লোকরুচি ও লোকমতের বেনোজলে মাহাত্ম্য হারাতে পারে। এর সঙ্গে তিনি বিশেষ সচেতনও ছিলেন যে তাঁর গানকে এই য়ুরোপীয় পদ্ধতির ধরাবাঁধার মধ্যে চেপে রাখলে তার প্রাসঙ্গিকতা ও লোকপ্রিয়তা ক্ষুণ্ণ হবে। তাই জীবৎকালে তিনি কাউকে কাউকে তাঁর গানে 'স্টিমরোলার' চালানোর অধিকারও দিয়েছিলেন। তবে এই অধিকার নেহাতই ব্যক্তিস্তরের, তার সামূহিক কোনও প্রয়োগ তিনি স্বীকার করেননি।

স্বরলিপির প্রয়োগ একটি ডিসিপ্লিনের অঙ্গ, যা মানুষ স্বেচ্ছায় মেনে চলে। তাকে কোনও ‘এসমা’দিয়ে মানাতে হয়না। যাঁরা অধিকারী, তাঁরা স্বরলিপির 'বন্ধন'এর মধ্যে পূর্ণত থেকেও অতি উপভোগ্য সঙ্গীত পরিবেশন করতে পারেন। তবে অধিকারীর পাত্রভেদ আছে। যে সব শিল্পীর সঙ্গীতের এই ধারাটিতে সিদ্ধিলাভ হয়েছে তাঁরাই অধিকারী। এই সিদ্ধিলাভের তকমা কোনও কলেজে কিনতে পাওয়া যায়না। দীর্ঘসময়ের নিবিষ্ট সাধনা ও অনুশীলন ও তার সঙ্গে অন্তর্লীন সঙ্গীত চেতনার মেলবন্ধন যখন সংবেদনশীল শ্রোতার কাছে প্রকাশ পায় তখন এই স্বীকৃতি আপনিই আসে। যাঁদের নামে মাঝে মাঝে 'সুরচ্যুতি' বা বাঁধাপথের বাইরে' গিয়ে গান শোনানোর অভিযোগ ওঠে, সেই সুচিত্রা মিত্র বা জর্জ বিশ্বাস সিদ্ধির সেই স্তরে পৌঁছে গেছিলেন, যেখানে তাঁদের কাছে সেই সব 'বিচ্যুতি'র জন্য কৈফিয়ৎ চাওয়াটা বাতুলতা। কারণ তাঁরা নিজস্ব পরিবেশনায় 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্য'কে ভিত্তি করেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। এই সব বাঁধাবাঁধি আমাদের মতো নিম্ন ও মধ্যমেধার মানুষের জন্যই থাক। আমরা সেই সুধাসাগরের পারে বসে থাকার লোক, ডুব দেবার সামর্থ্য অর্জন করা হয়ে ওঠেনি।

(ক্রমশ)

0 comments:

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in

বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল



দে’জ থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ নির্জন শালিক। কবি তাপস মহাপাত্র। কবিতা প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত অনুভবে একটি বোধের বিষয়। সেই বোধ যা মন ছেয়ে থাকে। নানা ব্যাকরণ প্রকরণের কারিকুরি ছাপিয়ে যা এক মায়ায় এক অন্যতর চেতনভুমিতে মনকে স্থাপন করে। সমান্তরাল বাস্তবতা বলব একে। প্রায় আটষট্টিটি কবিতা আছে বইটিতে। তাপস মহাপাত্র আত্মমগ্ন কবি। সেরকম প্রকট উচ্চারণে তিনি প্রতিবাদ বা খারাপ লাগা জানান না। নিজের ভেতরে ডুব দিয়ে তুলে আনেন মুহূর্ত। অনুভূতির রঙের সঙ্গে মিলে যায় তাঁর দীর্ঘদিনের চর্চার বৈদগ্ধ্য। পাঠককে তা মুগ্ধ করে। যেমন বইটির নাম যে কবিতার নামে, কবি লিখছেন তাতে – আমার গৃহস্থালী পর্ণমোচী মনে/ কী করে লুকাই নিজে ঝরাপাতা বনে! এক নিমেষে পাঠক পৌঁছে যান কবিমনের সেই পর্ণমোচী বনে। এবং কবি স্পষ্ট করেন যে এ তাঁর একান্ত আত্মকথন। কবিতার শেষ লাইন জানিয়ে দেয় – এখন নির্জনে কী চাওয়া খুঁজি, নিজের ভিতরে নিজে বন্দী বুঝি। বিলীন কবিতার অংশ বিশেষ। “দুবাহুতে ভাসাই আমার অসীম আমাকে। মেঘের মতো জড়িয়ে থাকে কে!” এই সেই উপলব্ধির জগত। কবি নিজের অসীম সত্ত্বার কাছে সমর্পিত। সে তাঁকে জড়িয়ে থাকে মেঘের মতন। “অবশ করে বিবশ করে...”। বিরহ এমন একটি অনুভব যা চিরস্থায়ী। সেই অনুভব বাখানিতে তিলে তিলে নূতন হোয়। কবি নিজের ভিতরে সেই অনুভব জাগ প্রদীপের মতো জ্বালিয়ে রেখেছেন। তাই লিখছেন – আসিস কে রে পথে পথে ছড়াস যত ক্ষত/ কেন আমায় করল কে যে/ এমন হৃদয়-হত!(আহত)। সে যে নির্দিষ্ট কেউ নয় সে কবির উচ্চারণে স্পষ্ট। তিনি তাঁর মুখ দেখেননি। তবু কী আর্তি তাঁকে দেখার! গন্ধে বিভোর দূরের ভূমি/ অলক্ষ্যে তার আত্মীয় হোয়, বুঝতে না দেয়/ দুই অচেনার মধ্যিখানে-/ এক অন্তর, আকুল গোকুল। (ব্রজবাস)। একটি মাত্র শব্দে কবি বলে দেন অন্তরটি তাঁর আকুল গোকুল। হৃদিবৃন্দাবন। অসীমের স্পর্শ লাগা সেই অন্তর কি আর অন্য কিছু খুঁজতে পারে? তাপসের কবিতা জ্যৈষ্ঠ দিনের দুপুরবেলার শীতল জল। চারিদিকে অশান্ত পরিবেশ, চাওয়াপাওয়ার বিরক্ত ভিড়ে নির্জন শালিকের মতো পাঠকও সেই শীতল জল আকণ্ঠ পান করবেন। এক অন্য সমান্তরাল জগতে বেঁচে থাকবেন। একটিই কথা ছিল। কবি যদি প্রকাশিত কবিতার সন তারিখ সহ প্রকাশ পরিচয়টুকু জানিয়ে দিতেন তবে ভবিষ্যতের পাঠকের জন্য সুবিধে হত। এটি একান্তই নিজস্ব অনুভব।


প্রচ্ছদে শাদা আকাশের তলে সবুজ ঘাসজমিতে একটি একলা শালিক। ঠিক আমাদেরই মতো। শিল্পী দেবাশিস সাহা কবির মনের কথাটি ভারী সুন্দর বুঝেছেন। সুন্দর কাগজ ও বাঁধাইয়ে বইটি দীর্ঘজীবী হবে নিশ্চয়।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


গার্ড (অনুবাদ গল্প) 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 



৫ 

সেদিন সূর্যটা ডুবে যাবার আগে মেঘের কিনারায় বিষণ্ণভাবে ঝুলছিল। মেঘেরা সেদিন অমিত শক্তিধর, বারবার ঢেকে দিচ্ছিল সূর্যটাকে। তবুও অস্ত যাবার আগে মেঘের কালচে নীল সমুদ্রের মধ্য থেকে অরণ্যের চারপাশে একটা বেগুনি আলোর আভা ছড়িয়ে যাচ্ছিল। রেলগেটের উল্টোদিকের জঙ্গলের সারিসারি পাইনের কাণ্ডগুলির গা দিয়ে যেন জ্বলন্ত এবং গলিত ইস্পাতের মতো একটা আলো ঠিকরে পড়ছিল। 

রেলওয়ে ট্র্যাকগুলোর গা দিয়েও আলো পিছলে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন আগুনে রঙের সাপ। আলোর রেখাগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে শুরু করল। মাটির গা থেকে মিলিয়ে যেতে যেতে একচিলতে তখনও লেগে ছিল পাইনগাছগুলোর মুকুটে। শান্ত এবং গম্ভীর এক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল সেই জায়গায়। 

ঠীল রেলগেটের বারের গায়ে হেলান দিয়ে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে দেখছিল এই দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ। হঠাৎ সে নড়ে উঠল। এক পা এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। দূরে একটা কালচে বিন্দু দেখা দিল। রেললাইনগুলো যেখানে মিলে গিয়েছে সেখানে বিন্দুটা বড় হতে লাগল। প্রথমে মনে হলো বিন্দুটা যেন স্থির হয়ে আছে দিগন্তে। কিন্তু না, বোঝা গেলো সেটা চলমান। হাল্কা গুনগুন মৌমাছির গুঞ্জনের মতো আওয়াজ ছিল প্রথমে। সেটা বাড়তে লাগলো। বাড়তে বাড়তে ঝিকঝিক ঝিকঝিক ছন্দ থেকে সেটা ক্রমশ একটা গর্জনের মতো শোনাচ্ছিল। যান্ত্রিক ধ্বনিতে মনে হচ্ছিল যেন অশ্বারোহী সৈন্যদলের অজস্র ঘোড়ার খুরের নালের ধাতব আওয়াজ। 

ট্রেনটা প্রচণ্ড আওয়াজে যেন একটা দৈত্যের মতো এগিয়ে আসছিল। প্রচণ্ড আক্রোশে একরাশ ধুলো, ধোঁয়ার মেঘ ছড়িয়ে একঝলক আগুনে বাতাসের দমকা ঝড়ো হাওয়া ছড়িয়ে বেরিয়ে গেলো ট্রেনটা। কয়লার ধোঁয়ার গন্ধে ভরে গেলো গার্ডের কেবিন, ট্র্যাক দুলে উঠল, মাটি কেঁপে উঠল। আওয়াজটা যেরকমভাবে বেড়ে উঠেছিল, ঠিক সেরকমভাবেই মিলিয়ে গেলো ধীরে ধীরে। ধোঁয়াশা কেটে গেলো। ট্রেনের অবয়বটা আবার বিন্দুর মতো ছোট হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেলো দিগন্তরেখার ওপারে। আবার সেই প্রবল গম্ভীর নৈঃশব্দ নেমে এলো অরণ্যের কোণে। 

‘মিনা’... একবার যেন স্বপ্নের ভেতর থেকে ঠীল উচ্চারণ করল এই নাম। তারপর ধীরপায়ে ফিরে গেলো কেবিনে। এককাপ কফি বানিয়ে চুমুক দিতে লাগলো ধীরে ধীরে। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা একটা নোংরা খবরের কাগজের দিকে কী যেন দেখছিল, কিংবা দেখছিল না কিছুই। 

হঠাৎ ঠীল একটু অস্থির হয়ে উঠল। ঘরটা চুল্লির আগুনে বেশ গরম হয়ে উঠেছিল। সে কোট আর ওয়েস্টকোট দুটোই খুলে ফেলল। নাহ, তাতেও আরামবোধ হলো না। সে এককোণ থেকে তুলে নিলো কোদালটা, বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। গেলো সেই জমিটার কাছে; তার উপহারস্বরূপ পাওয়া জমি। একচিলতে বালিমেশানো ভূমিখণ্ড, যদিও এখন আগাছায় ভরে আছে। দুটো খর্বকায় ফলের গাছ; শাখাগুলো ঢেকে আছে তুষারকণার মতো দেখতে কুচি কুচি সাদা ফুলে। ঠীল সেই জমির উপরে দাঁড়িয়ে কিছুটা শান্ত হলো। 

নাহ, এবার কাজে লেগে পড়া যাক। ভাবতে ভাবতে সে মাটি কোপাতে শুরু করল। মাটির টুকরো আলগা হয়ে যেতে লাগলো এক এক আঘাতে। জমির ভিতর থেকে ভেজা ভেজা দলা মাটি বেরিয়ে আসতে লাগলো। বিরামহীনভাবে সে কুপিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে থেমে গেল। মাথা ঝাঁকিয়ে জোরে জোরে বলতে লাগল, ‘না, না... এ হয় না।’ তারপর আবার বলে উঠল, ‘নাহ, এ অসম্ভব!’ তার মনে পড়ে গেলো যে এর পর থেকে লেনা নিয়মিত এই জমির তদারকি করতে আসবে। তাহলে যে তার এই নিশ্চিন্ত একাকী যাপন অনেকখানি বিঘ্নিত হবে। এই কথা মনে পড়া মাত্র, মুহূর্তে মিলিয়ে গেলো তার মনের ধীর স্থির খুশি ভাব। তার হঠাৎ ভীষণ বিরক্তিবোধ হলো। যেন বিরাট একটা ভুল হয়ে গেছে এমন ভাব করে মাটির থেকে তুলে নিল কোদালটা। আবার সেটা রেখে দিয়ে এলো তার কেবিনের এক কোণে। সেখানে গিয়ে সে গুম হয়ে বসে রইল। সে বুঝতে পারছিল না, কেন লেনার সাথে দিনের বেশিক্ষণ সময় কাটাবার ভাবনাটা নিজের কাছেই ভীষণ অসহ্য ঠেকছে। সে নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পেরে উঠছিল না। এই ঠাঁইটুকু তার বড় প্রিয়; বড় আপন, নিজের মনের আধ্যাত্মিক ভাবনার জায়গা। তার মনে হলো এই জায়গাটুকু বুঝি বা অপবিত্র হয়ে যাবে অন্য মানুষের স্পর্শে। তার পেশী কঠিন হয়ে উঠল। সমস্ত মন বিদ্রোহ করে উঠল। কিন্তু সে এত চরম ভাবনা ভাবছে কেন? মনকে নিয়ে এত নাড়াঘাঁটা করছে বলে পরমুহূর্তে তার নিজেরই হাসি পেলো। নিজের অজান্তে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা হাসির শব্দটা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল তার কাছে। সে চমকে উঠল। ছিন্ন হয়ে গেলো তার চিন্তার সূত্র। সেগুলো কুড়িয়েবাড়িয়ে জড়ো করতে করতে সে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল জমির কাজে। 

কাজ করতে করতে তার মনে হলো যেন তার চোখের সামনে থেকে হঠাৎ কোনও কালো পর্দা সরে গেলো। নিজস্ব পরিস্থিতির নতুন একটা অর্থ প্রকাশ পেলো তার কাছে। ধূসর কুয়াশার মতো চিন্তার জাল সরিয়ে তার মনে হলো, সে কি গত দুবছর ধরে ঘুমাচ্ছিল? কী মরণঘুমে পেয়েছিল তাকে! সে একবারও তলিয়ে ভাবেনি টোবিয়াসকে নিয়ে। সেই বিকেলেই ঘটে যাওয়া ঘটনাটা,... উফফ, এত টাটকা একটা ঘটনা – সে কীভাবে ভুলে আছে? আহা, অসহায় শিশু না জানি কত কষ্টে আছে। কত বেদনা সহ্য করছে এই মাতৃহারা শিশু! তার নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হলো। 

প্রচণ্ড গ্লানিতে সে অত্যন্ত অবসাদ বোধ করছিল। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে টেবিলের উপরে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তা তার মনেও ছিলনা। কতক্ষণ শুয়ে ছিল, তা তার মনেও নেই। ভাঙ্গা গলায় অস্ফুটে এক দু বার উচ্চারণ করেছিল, ‘মিনা’... 

তার ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড বৃষ্টির শব্দে। ঘুম ভেঙে দেখল চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। অবসন্ন শরীরে গায়ে কাঁটা দিল তার। সে লক্ষ্য করল যে তার নাড়ি অনিয়মিত চলছে, মুখ ভিজে রয়েছে অশ্রুতে। 

কী ভীষণ অন্ধকার! অন্ধ করে দেওয়া তমসার মাঝে সে দরজা খুঁজছিল। বুঝতে পারছিল না যে কোনদিকে যাবে। পা ঘষটে ঘষটে বোঝবার চেষ্টা করছিল। সে তার কষ্টটা পুরোপুরি ভুলতে পারছিল না। কেবিনের বাইরের জঙ্গলটা যেন একটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গিলতে আসছিল তাকে। বাইরে ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির তোড় যেন তার কুটিরের ভেতরে ঢুকে এসে তাকে গ্রাস করে নেবে। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সে যেন এক ডুবন্ত মানুষ। ঠিক তখনই একটা বিদ্যুতের তীব্র আলোর ঝলকানিতে সে আবার সবকিছু দেখতে পেল। এক পলকের জন্য যেন এই বিপুল অন্ধকারে সে একটা আলোর দিশা দেখতে পেল। 

তার মধ্যেই সে তার লণ্ঠনটা খুঁজে পেয়ে গেলো। সামলে নিল নিজেকে। জানালাগুলোয় ঝনঝন আওয়াজ উঠছিল; মনে হচ্ছিল কেবিনসুদ্ধু সবকিছু ভাসিয়ে, উড়িয়ে নিয়ে যাবে ঝড়-বৃষ্টির দাপট। মাটি যেন কেঁপে উঠছিল প্রবল দুর্যোগে। আলো জ্বালিয়ে সবার আগে সে যেটা খুঁজছিল, সেটা হলো নিজের ঘড়ি। সে দেখল যে এক্সপ্রেস ট্রেন আসতে আর মাত্র পাঁচমিনিট বাকি। তার মনে হলো যে সে নির্ঘাত সিগনাল শুনতে পায়নি ঘুমের মধ্যে। ঝড়ের মধ্যে এবং নিকষ অন্ধকারে যতটা তাড়াতাড়ি যাওয়া সম্ভব, গিয়ে রেলগেট বন্ধ করে দিল। যখন সে গেট বন্ধ করছিল, তখনই সিগনালের ঘণ্টা বেজে উঠল ভীষণ কর্কশ শব্দে। প্রচণ্ড হাওয়া এসে যেন ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল শব্দটাকেও। শব্দটা ছিটকে ছিটকে পড়ছিল নানাদিকে। পাইনের বন দমকা হাওয়ায় নুয়ে পড়ছিল; গাছের শাখাগুলি একে অপরকে ঘষে আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছিল প্রবল ঝড়ের মুখে; শনশন আওয়াজ উঠছিল। ঠিক তখনই এক মুহূর্তের জন্য চাঁদ বেরিয়ে এলো মেঘের আড়াল থেকে। ম্রিয়মাণ এক আবছা সোনালী বলয় মেঘের মাঝে ঘিরে রেখেছে চাঁদকে। সেই আলোতে দেখা গেলো হাওয়া এসে ভীষণবেগে দুলিয়ে দিচ্ছে পাইনগাছের মুকুটের মতো মাথাগুলিকে। রেলওয়ে ট্র্যাকের পাশে সারিবদ্ধভাবে লাগানো বার্চগাছগুলি এমনভাবে দুলছে, ঠিক যেন ভূতগ্রস্ত ঘোড়ার লেজ। তার নিচে সাপের মতো শুয়ে আছে রেললাইন, জলে ভেজা এক একটা বিন্দুতে তার গা থেকে ঠিকরে উঠছে ফ্যাকাসে জ্যোৎস্না। 

ঠীল মাথার থেকে টুপিটা খুলে ফেলল। বৃষ্টিটা হয়ে ভালই হয়েছে, মনে হলো তার। বৃষ্টির ধারা ধুয়ে দিচ্ছিল তার অশ্রু। তার মুখটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু মাথার ভেতরটা আগের মতোই ধোঁয়াটে লাগছিল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যে স্বপ্নগুলো দেখেছিল, মনে করবার চেষ্টা করছিল সে। 


(চলবে) 

[গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘বানভ্যার্টার ঠীল’ গল্প অবলম্বনে রচিত] 

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in

ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত


॥২২॥ 

ভুল করে দরজা দিয়ে ঢোকে অপরিচ্ছন্ন আলো ও আঁধার/ঢোকে লাবণ্যহন্তা হাতিয়ার 

পেরো 

অন্ধকার সর্পিল সঙ্কীর্ণ পিছল গুহাপথ। একসাথে দুজনের বেশি পা ফেলা যায়না। তবু জোহা ও পেরো একসাথে জড়াজড়ি করে এগিয়ে চলেছে। পায়ের নিচে বরফ শীতল জলস্রোত। কোথাও বেশি কোথাও কম। কখনো উজানে কখনো নিচু। পা হড়কে যায়। সাবধানে নামতে হয়। দমকা শীতল হাওয়ায় থেকে থেকে পেরো কেঁপে কেঁপে উঠছে। জোহা আরো জোরে জড়িয়ে ধরছে তাকে। পেরোর সারা অঙ্গ জোহার প্রতি অঙ্গের উষ্ণতার সাথে পরিচিত হচ্ছে। যেন এই চলাতে আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। শরীরে শরীর মেলানো ছাড়া আর কোনো গন্তব্য নেই। মাঝে মাঝে জল ঢোডার ছপ ছপ করে লাফানো আর বুনো ইদুরের লাল লাল চোখ দেখে একটু থেমে ওদের চলে যেতে দেওয়া,এইসব চলছিল। হঠাত্‍ হঠাত্‍ উত্কট মাংস পচা গন্ধ আর কখনো বা অজানা ফুলের মায়াময় সৌরভ। 

বেহুশের মতো পড়তে উঠতে এইভাবে চলতে চলতে কখন যে অন্ধকার সরু সুড়ঙ্গ পথ শেষ হয়ে একটা বাঁক নিতেই পথ শেষ। দেখাগেল প্রায় দুশো ফুট নিচে উজ্জ্বল হালকা নীলচে সবুজ ডিম্বাকার জলাশয়। চারদিকে কুম্ভের ভিতরের মতো মসৃণ পাথরের দেওয়াল। অনেক উঁচুতে গোলমতো খোলা আকাশ দেখা যায়। সেখান থেকে আলোরশ্মি ছটা জলাশয়ে পড়ে সেটাকে দ্যুতিময় করে তুলেছে। সুড়ঙ্গমুখ থেকে জলস্রোত দুধের মতো সাদা ঝর্ণা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচে।পেরো দেখল ওদের সাথীরা সবাই পাশে একটা ঢালু পাথরের স্তুপ বেয়ে ধীরে ধীরে নামছে। পাথরগুলি স্ফটিক পাথরের মতো মসৃণ। পাহাড় দেওয়াল সমতল মসৃণ চাট্টান। পাথরের ছাদ থেকে নেমে এসেছে অসংখ্য স্ট্যালেগমাইট স্ট্যালেকাইট এর ঝুরি। মোটা ঝুরিগুলো কোনটা গাছ কোনটা মানুষ কোনটা সাপের আকার নিয়েছে।

পেরো জলাশয়ের কিনারায় গিয়ে আঁজলা ভরে খানিকটা জল খেল। দেখল জোহা পাথরের গাত্রে খোদাই করা কিছু লিপি দেখতে দেখতে পিছনে হাত বাড়িয়ে ওকে ডাকছে। পেরো কাছে গিয়ে দেখল তাদের বহু আগের পূর্বপুরুষদের লিপি যত্ন করে খোদাই করা রয়েছে। অলচিকি ও মুণ্ডারি ভাষার আদি সংমিশ্রণ। প্রতিটি শব্দের পাশে হেয়ারোগ্লিফিক্সের মতো ছবি আঁকা রয়েছে সেই শব্দের উচ্চারণ ও তার মানে। বিশাল পাথর দেওয়াল জুড়ে এই চিত্রণ। একজায়গায় আদি অস্ট্রিক মুণ্ডারি ভাষায় লেখা কবিতা। পেরো অলচিকি ও মুণ্ডারি লিপির সাথে ঘনিষ্ট পরিচিত। গুরুজি এই অক্ষরের পাঠ পড়িয়েছেন। উনি বলতেন,আজকাল এই উত্তর আধুনিক জীবনযাত্রায় অনেক ভাষা অব্যবহৃত হয়ে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে এই দুটি ভাষা। তার কারণ অস্তিত্ব বজায় রাখতে দলে দলে আদিবাসী ভাইয়েরা ধর্মান্তরিত হয়েছে ও হচ্ছে। অনেকে হীনমন্যতার শিকার হয়ে নিজস্ব জাতি ধর্ম গোপন করছে। সরকারি জনজাতি ও জনউপজাতির কোটাতে পড়াশুনো ও চাকরির লোভে নিজস্ব ভাষা ত্যাগ করছে। পেরো, এই বিপন্ন সময়ে নিজের মাকে বাঁচা। প্রায় লোপপেতে বসা এই ভাষাকে তুইই পারবি উদ্ধার করে ভবিষ্যতে এগিয়ে নিয়ে যেতে। জোহা পেরোর কোমর জড়িয়ে ধরে প্রস্তরলিপি কবিতাটি একসময় জোরে চেচিয়ে আবৃতি করতে লাগলো। পেরো অভিভূত হয়ে গলা মেলালো। অন্যেরাও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলো। ওদের উদাত্ত কোরাস পাথরের দেওয়ালে ঘুরপাক খেতে খেতে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। প্রায় নিস্তরঙ্গ শান্ত উজ্জ্বল নীল জলাশয়ে ছোট ছোট ঢেউ উঠল। 

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী

Posted in


ধারাবাহিক


পায়ের শব্দ 
সোমঙ্কর লাহিড়ী



চুম্বকঃ- অ্যান্ডির ঘর থেকে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের কিছু ছবি ও ভিডিও মোবাইলে নিয়ে চলে যাওয়ার সময় ধরা পরে যায় এক বয়স্কা কলগার্ল। অ্যান্ডি ও তার ব্যান্ডের বন্ধুরা ও অন্যান্য বন্ধুরা যায় দ্য টি ভ্যালী নামের এক রিসর্টে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। সেখানে নেশার ঝোঁকে রিসর্টের মালিকের স্ত্রীকে রুম সার্ভিসের মহিলা মনে করে তার সঙ্গে খানেক দুর্ব্যবহার করে অ্যান্ডি। 



৫ 

বাঙ্কোয়েটে ঢুকে তার সাইজ আর ডেকরেশান দেখে মোটামুটি চোখ গোল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো আর্মাডিলোর সকলের। যাদের মাচা থেকে শুরুকরে অনেক রাস্তা পেরিয়ে এখানে আসতে পেরেছে তাদের সব ব্যাপারে স্বাভাবিক থাকাটাই বাঞ্ছনিয়, যেটা শুধু মাত্র অ্যান্ডির হাবেভাবে প্রকাশ পেয়েছিল বাকিদের নয়। 

প্রথমে খানেকক্ষণ স্ট্যান্ড আপ কমেডি হল। পার্ফমার মোটামুটি হলের উপস্থিত সকলকে পেটে ব্যথা ধরিয়ে দিয়ে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে। এই সময়টা গোটা আর্মাডিলো একটা বড়ো ঘরে নিজেদের তৈরী করে নিলো। শেলী আর মুকেশ একবার এসে ওদের সাথে দেখা করল। শেলী বলে গেল পুরো প্রোগ্রামের মধ্যে সবথেকে বেশী সময় পাচ্ছে আর্মাডিলো। কিন্তু “বর্ষা”টা করা যাবে না? 


কেন? অ্যান্ডির ক্ষিপ্ত প্রশ্ন। 

ডিপি পার্সোনালি আমাকে রিকোয়েস্ট করেছে? শেলী জবাব দিলো। 

বাবা একেবারে ডিপি? অ্যান্ডির গলায় তিক্ত প্রশ্ন? 

কি করব বল? উনি নিজেই আমাকে বললেন এই নামে ডাকতে। 

তা তুই কি ওর হুকুমের বাঁদী? 

দেখ অ্যান্ডি টাকা দিচ্ছে, কিছু নির্দেশ তো আমাকে মানতেই হবে তাই না? 

তোকে তোর পার্ফমেনস থেকে আটকে দিলেও তুই সেটা মেনে নিবি? 

মুকেশ মাঝখানে ঢুকে অ্যান্ডির মেজাজটাকে সামলানর জন্য বলল, 

বস, প্রোগ্রামে কনসেনট্রেট করলে ভালো হয় না? 

শেলীকে বলল, তু প্লীজ যা স্টেজ কো সামাল। 

শেলী প্রায় পালিয়ে বাঁচল। 

চলে যাওয়ার পরে মুকেশ অ্যান্ডিকে বলল, শায়েদ যব অফার কিয়া ইসিলিয়ে পার্ফরমেনস করনে মে মানা কিয়া। 

অ্যান্ডি হেসে বলল, রাত তো ঠোকেগা, ইসি লিয়ে তাগড়া মাংতা হ্যায় শালা তেরা ডিপি। 

তু আপনে কাম পে মতলব রাখনা ইয়ার। 

অ্যান্ডিদের দল যখন স্টেজ পেলো তখন রাত দশটা। পুরো টিম সাদা, আর অ্যান্ডি একা মাথা থেকে পা অবধি কালো। 

শুরু করল এল্টন জনের একটা গান “ডোন্ট লেট দ্য সান গো ডাউন অন মি” 

দর্শক নড়ে বসল। তারপরে একের পর এক বব মার্লে, জিমি হেন্ড্রিক্স, মিক জ্যাগার, মাইকেল জ্যাকসন, ইত্যাদি আর্টিস্টের গান দিয়ে দর্শকদের রক্ত গরম করে তুলতে লাগল। একটা সময় এলো যখন দেখা গেল, গোটা হলে কম বয়েসই থেকে বেশী বয়েসই সবাই অ্যান্ডির হাত ধরে একটা ট্রান্সে চলে গেছে। গানের আর নাচের উন্মাদনা গোটা হলকে গ্রাস করেছে অ্যান্ডি শুরু করল, আভি তো পার্টি শুরু হুই হ্যায়। হলে বসার সমস্ত ব্যবস্থা লণ্ডভণ্ড করে শুরু হয়ে গেল অভ্যাগতদের নাচ। সেখান থেকে শুরু হয়ে গেল হিন্দি ডান্স নাম্বারস। প্রায় আড়াই ঘন্টা একা গোটা হলকে যখন তুরীয় অবস্থায় নিয়ে চলেগেছে অ্যান্ডি, ঠিক সেই সময় দেখতে পেলো শেলী আর ডিপি প্রায় একসাথে হলের দুটো আলাদা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। অ্যান্ডি দুহাত তুলে শ্রোতা, দর্শক অভ্যাগত সবাইকে একটু থামতে ইশারা করল, সবাই থমকে গেল, অ্যান্ডি সম্পূর্ণ ভিন্ন জঁরের গান শুরু করল, ‘ঘরের পাশে আরশি নগর, পড়শি বসত করে।’ 

এ যেন চলন্ত মেল ট্রেনকে আচমকা থামিয়ে দেওয়া। অনেকেই প্রথমে নাচ বন্ধ হওয়ার জন্যে বিরক্ত হল বটে। কিন্তু এক একটা দিন গায়কের হয়। কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখা গেল, সবাই আবার অদ্ভুত শান্ত হয়ে বসে গেল অ্যান্ডির গলায় ফোক শুনতে। একটা সম্পূর্ণ বিপরীত পরিবেশ, একদল ভিন্ন বয়েসের ভিন্ন রুচির মানুষকে একটা যুবক তার গলার জাদু দিয়ে বেঁধে ফেলেছে। গানটা যখন শেষ হলো, কিচ্ছুক্ষণ গোটা হল স্তব্ধ। তারপরে ফেটে পড়ল আওয়াজে। লোকে যে আনন্দ চায়, আজ অ্যান্ডি সেই আনন্দ তাদের দু হাতে বিতরণ করে দিয়েছে। সবাই ছুঁতে চাইছে অ্যান্ডিকে, তাদের আনন্দকে। 

অ্যান্ডি স্টেজ ছাড়াল প্রথম, নিজেদের ড্রেসিং রুমে যাওয়ার পথে অ্যান্ডি দেখল শুব্বু তারদিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। অ্যান্ডি হাত তুলে হাই জানাল। ঘরে ঢুকে ড্রেস ছাড়ার সময় মুকেশ ঢুকল। অ্যান্ডি কে জড়িয়ে ধরল, আনন্দে। 

তু ইয়ার, গলা বুজে এলো মুকেশেরও। 

অ্যান্ডি বলল, 

মাল দে, গলা শুকিয়ে গেছে। 

মুকেশের পিছনের পকেটের ফ্লাক্সটা অ্যান্ডি একাই শেষ করে দিল একটানে। তারপরে ওর হাতে ফ্লাক্সটা ফেরত দিতে দিতে বলল, 

আই ক্যান, বিকজ আয়াম দ্য বেস্ট। নাও হোয়াট? তোদের ডিপি তো শেলীকে ঠুকতে নিয়ে গেল। কোথায় গেল শালা কে জানে, এত বড়ো রিসর্ট। এবারে বল তো ভাই তোর গুঁড়োর নেশাটার ব্যবস্থা আছে না কি খালি লিকুইড? 

মুকেশ হেসে বলল, 

চেঞ্জ করে নে বস, সব ব্যবস্থা আছে। তোর জন্য স্পেশাল। 

কোথায়? 

তু চেঞ্জ তো কর। মুকেশ আস্বস্ত করে। 

দলের বাকীদের উদ্দেশ্যে অ্যান্ডি বলে, 

বাচ্ছারা তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো কেমন? কাল সকালে আবার আমাদের ফিরতে হবে। বলেই মুকেশের হাত ধরে বলে, চল। 

বিশাল বাঙ্কোয়েটের পাশে বেশ কিছু ছোটো ঘর, যে রকম ঘরে অ্যান্ডিরা তাদের গ্রীন রুম পেয়েছিল, সেই রকম একটা ঘরের দরজা খুলে মুকেশ আর অ্যান্ডি ঢুকল। সেখানেও একজন ডিজে তার ছোট্টো যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে তাদের নিজের মিক্স চালাচ্ছে। তবে আওয়াজ বেশ নীচু স্কেলে। তারপাশের বেশ অনেকগুলো টেবিলে রয়েছে রুপোর থালায় সাজানো নিশিদ্ধ মাদক। যার যেটা ইচ্ছে সে সেটার কাছে আসছে আবার ফিরে যাচ্ছে। নিজের টেবিলে। দেখে অ্যান্ডির মৌমাছির কথা মনে হলো। ফুলের কাছে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে নিজের মৌচাকে। 

মুকেশ ইশারা করল, একটি ছেলে এসে অ্যান্ডির জন্য সাদা গুঁড়োর লাইন সাজিয়ে দিল একটা কালো কাঁচের উপরে। অ্যান্ডি হাসি মুখে সেটা হাতে নিয়ে তারপরে নিজের নাকটা সেই সাদা গুঁড়োর লাইনে রেখে শ্বাস টানল বুক ভরে। ঝটকাটা ভালো লাগল, মাথাটা হঠাৎ বেশ হালকা লাগল। পেটের ভেতরে কেমন যেন একটা ফাঁকা ভাব, নাগরদোলা নীচে নামার সময় যেমন হয়। অ্যান্ডি চেয়ারের হেলান দেওয়ার জায়গাটার উপরে মাথার পিছন দিকটা রেখে সেই বিষাক্ত আরামটা উপভোগ করতে লাগল। 

মুকেশ হেসে বলল, অনলি ওয়ান লাইন? হাম শালা ক্যায়া ক্যায়া সোচা ওর তু এক লাইন লেনেকে বাদহি আউট? 

অ্যান্ডি মাথাটা তুলল, চোখে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি। ভালো করে দেখলে বোঝা যেত চোখের মনির ভেতরের কালো গোলটা আরো বড়ো। মুখে একটা হাসি এনে বলল, চুপ কর। এঞ্জয় করতে দে। 

তারপরে খানেক বাদে মাথা তুলে আরো দুটো লাইন নিজের ভেতরে নিয়ে নিল অ্যান্ডি। তারপরে আরো একটা। নাসারন্ধ্রের পাশে সাদা গুঁড়োর বেশ মোটা দাগ। থুতনি, কালো জামার উপরেও বেশ খানেকটা সাদা গুড়ো এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। অ্যান্ডি আগের অবস্থায় মাথাটা নিয়ে গিয়ে আবার চুপ করে নেশার কামড়টা উপভোগ করতে লাগল। 

মুকেশ এসে বলল, 

আর নিবি? বস্‌? 

অ্যান্ডি চুপ করে বসে রইল। 

মুকেশ এরপরে পরামর্শ দিলো, 

থোড়া হাওয়ামে ঘুমকে আ। মস্তি ওর জ্যাদা ফীল করেগা তু। 

অ্যান্ডি কোনও উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, তারপরে এগিয়ে গিয়ে বন্ধ দরজা খুলে বাইরের করিডরে পা রাখল। বাইরের ঠান্ডা হাওয়া, রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে দূর থেকে আসা ড্রামের শব্দ। সব মিলিয়ে অ্যান্ডির শরীরটাকে আরো নেশাতুর করে তুলল। তল্পেটের চাপ কমানর জন্য অ্যান্ডি ওয়াসরুমের খোঁজে এগিয়ে গেল করিডর ধরে মেন বাঙ্কোয়েটের দিকে। 

চোখের দোষ নয় চোখটাকে যে চালায় অর্থাৎ ব্রেনে যে পরিমাণ হাঙ্গামা বাধিয়েছিল অ্যান্ডি সেই চোখকে ভুল দিশা দেখিয়েছিল। কার্ড রুমের দরজার উপরে একটা বড়ো তাসের রাজার ছবি আঁকাছিল। অ্যান্ডি তার গন্তব্য পেয়ে গেছে মনে করে সেটা খুলে ভেতরে ঢুকেই শকটা খেল, আবছায়া ঘরে দূরতম প্রান্তে একটা কার্ড টেবিলের উপরে শুয়ে শীলা, আর মেঝেতে দাঁড়িয়ে ডিপি। বাকীটা বোঝার জন্য আর না দাঁড়ালেও চলে, মাথাটায় একটা ঝটকা লেগে যাওয়ার জন্য, বাইরে এসে অ্যান্ডি আবার দাঁড়াল চুপ করে। 

হোয়াট দ্য হেল আর ইয়ু ডুইং হিয়ার? গলাটা খুব চেনা। অ্যান্ডি ফিরে তাকিয়ে যাকে আশা করেছিল তিনিই, শুব্বু। ড্রেস এথেনিক, লুক রাইপ এন্ড গর্জাস, গলায় একটা সরু হার তাতে মাঝারি পেন্ডেন্টের ভেতরে কিছু একটা দামি পাথর। হাতে ক্লাচ। পায়ে? বোঝা যাচ্ছে না, আর অ্যান্ডির চোখও সাথ দিচ্ছে না। 

একটু তেতো গলায় বলল, 

ইউ গাইস ইউসড টু হায়ার এভ্রি নেসিসিটিস, নো? 

শুব্বু একটু অবাক হলো, সামনে দাঁড়িয়ে সেই ছেলেটা যে কিছুক্ষণ আগে বহুলোকের সব কিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল তার গানে। সেই এখন গায়ে উপর কিছু সাদা পাউডার ছড়িয়ে এখানে দাঁড়িয়ে তাকে এই অদ্ভুত প্রশ্ন করছে, কি ব্যাপার? 

দ্যাট ইস নীড বেসড, ইউ নো। শুব্বুর জবাব, কিছুটা দ্বীধাগ্রস্থ ভাবেই। 

দেন গো ইনসাইড এন্ড সি, হোয়াট ইয়োর হায়ার্ড অ্যাঙ্কার ডুইং ইনসাইড। অ্যান্ডি কথাটা বলে দরজার দিকে বুড়ো আঙুল তুলে ইঙ্গিত করল। 

শুব্বু দরজাটা খুলে ঢুকেই বেরিয়ে এলো। 

অ্যান্ডি ফুট কাটল, 

পিপল শুড হায়ার প্রপার পার্সন ফর প্রপার জব, ইসন্ট? 

শুব্বু হতবম্বের মতো দাঁড়িয়ে, কি করবে? কোথায় কিভাবে লুকোবে তার এই লজ্জা ঠিক করে উঠতে পারছে না। এতদিনের বিশ্বাস তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ল, তাও আবার বাইরের একটা ছেলের সামনে? শুব্বুর নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল। চোখ থেকে কখন যে দু ফোঁটা জল নেমে আসতে শুরু করেছে সেটা তার নিজের ও খেয়ালে রইল না। 

পার্টিতে মহিলাদের আকৃষ্ট করাটাই তো শুধু কাজ নয়, তাদের নিজের কাছে টেনে এনে নিজেদের ইচ্ছা চরিতার্থ করতে পারাটা একটা আর্ট। বহু পার্টি ও তার পরের আসঙ্গ পিপাসা দূর করতে সমর্থকরতেপারা অ্যান্ডি বুঝল, বাকীটা একটু সময়ের অপেক্ষা। যদি শুব্বু চিৎকার চ্যাঁচামিচি জুড়ে দিত তাহলে বোঝা যেত ইনি সিংহী প্রকৃতির। দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। ইনি চোখের জলে ভাসলেন। আহা রে! কি দুঃখ দেখো দেখি। এখন তো একটা ফাঁকা ঘর দরকার এই দুঃখ দূর করার জন্য। 

অ্যান্ডি খুব নরম গলায় বলল, 

ভেরী সরি শুব্বু। শুডন্ট হ্যাভ ডান দ্যাট। রেয়েলি সরি। বলে খুব ধীরে তার হাতটা দিয়ে শুব্বুর ডান হাতটা ধরে শুব্বুকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। 

একটু বাধা এল বটে, ওটুকু আসতই। অ্যান্ডি টানটা বজায় রাখল। শুব্বু অ্যান্ডির সাথে ওই করিডর ধরে চলতে শুরু করল। পিছনে উদ্দাম তালে বেজে চলতে শোনা গেল একটা মিশরিয় সুর। বোধহয় বেলী ড্যান্স। অ্যান্ডির ভাবার সময় নেই। নেফারটিটি এখন তার হাত ধরে। 

উড য়ু লাইক টু গো টু ইয়োর স্যুট? বলে অ্যান্ডি শুব্বুর দিকে তাকাল। সেই সরল কীলার চাউনি, যেটাকে শুধু উপযুক্ত সময়ে অ্যান্ডি ব্যভার করে। 

শুব্বু মাথা নাড়ল। করিডরের শেষ লিফট। লিফটের দরজা খুলে শুব্বুকে এগিয়ে যেতে দিল অ্যান্ডি। তারপরে নিজেও ঢুকল। বাব্বা, মাত্র তিন তলার জন্যেও লিফট। 

লিফটে ঢুকে অ্যান্ডিকে আবার দেখল শুব্বু। 

হোয়াট ইস দ্য হোয়াইট ডাস্ট অন ইয়োর ফেস, নসট্রেলস এন্ড ড্রেস? সরল প্রশ্ন। অ্যান্ডির লাইফ লাইন হয়ে গেল। 

হেসে বলল, 

দুঃখ ভোলার ওষুধ। আজ তুমি যে দুঃখটা পেয়েছ, আমিও সেটাই পেয়েছে। মাই ফার্স্ট লাভ। কিন্তু দেখ আমি কাঁদছি? তোমার মতো? 

হোয়াটস দ্যাট? কী ওটা? 

লাইক সাম? অ্যান্ডি হেসে জিজ্ঞাসা করল। লিফট তিন তলায় থামল। 

ইস ইট সাম শর্ট অফ ড্রাগস? শুব্বু কাতর ভাবে জিজ্ঞাসা করল। 

ইফ ইউ লাইক টু ফরগেট ইয়োর গ্রীফ দেন আই ক্যান হেল্প। আদারওয়াইস টেল মি হোয়্যার ইস ইয়োর রুম, আই মাস্ট টেক ইঊ দেয়ার এন্ড লীভ। এভার ব্রুডিং লেডীস। যত্তোসব আমার কপালেই জোটে। 

অ্যান্ডি আর শুব্বু গিয়ে পৌঁছাল শুব্বুর স্যুটে। 

শুব্বু দরজা খুলে পিছন ফিরে বলল, 

ইউ ডিডন্ট টেল মি হোয়াট ইস দ্যাট। 

অ্যান্ডি একটু দূরে দাঁড়িয়ে হেসে বলল, 

দ্যাটস ফর গ্রোন আপস, নট ফর কীডস লাইক ইউ। 

আয়্যাম নট অ্যা কীড। 

প্রুভ ইট। 

হাতে হ্যাঁচকা টানটা অ্যান্ডির দারুন লাগল। 

দরজাটা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে সিকিউরিটি রুম থেকে সিসিটিভি ফুটেজ কপি হয়ে পেন ড্রাইভে করে হাত বদল হয়ে গেল। 

0 comments: