0

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ২৭

সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়



Diary Entry - 25
20th. October, 1942, Tuesday



প্রিয় কিটী 

তুমি কি জান, এখনও আমার হাত পা' সব কাঁপছে? আমি এখনও ভয় আর উৎকণ্ঠায় রীতিমত শিউরে উঠছি। গত দুঘণ্টায় আমাদের ভিতরের সব শিরা উপশিরার মধ্যে দিয়ে যে ভয়, আতঙ্ক আর জীবনের অনিশ্চয়তার শিহরণ স্রোত যেভাবে ক্রমাগত বয়ে গেছে, তাতে এই শক আর কাঁপুনিটাই বোধহয় স্বাভাবিক!গত দুঘণ্টা ধরে আমাদের সকলের মনে হচ্ছিল, আমাদের এই জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে যেটুকু ফাঁক আছে, তা' যে কোন মুহূর্তে ঘুচে যাবে। ঠোঁটের ডগায় মৃত্যু পিরিচের কাণা হয়তঃ এক্ষুনি চলে আসবে। আমাদের সঙ্গে মৃত্যুর আর কোন পার্থক্য থাকবে না। যাই হোক ঘন্টা দুয়েক মৃত্যুর সমূহ সম্ভাবনাকে সামনে রেখে আমাদের সময়গুলো কেটে গেল ---কখন কাটল, কিভাবে কাটল, তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। শুধু শেষে উপলব্ধি করলাম, পিরিচটা নেমে গেছে। জীবনটা মৃত্যু ছোঁয়নি। আমরা বেঁচে আছি। 

কিছুই হয়তঃ বুঝলে না। শোন তোমায় আসল ঘটনাটা বলি। ঘটনার নাটকীয়তা তোমায় প্রভাবিত করতে বাধ্য। তবে ঘটনাটা ঘটনাই ছিল, নাটক ছিল না। আমাদের এই ওপেক্টো হাউসে মোট পাঁচটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আছে। আমরা জানতাম একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর বিশেষ কিছু লোক এসে, এ'গুলোর মধ্যে আগুন নেভানোর উপযোগী গ্যাস বা ঐ ধরণের কিছু ভরে দেয়। কিন্তু কখন আসে বা কখনই তাদের আসার সময়, সে সব বিষয়ে আমরা কিছুই জানতাম না। এমন কি' এ'ব্যাপারে ছুতোর বা ঐ ধরণের কোন মিস্ত্রী কখন আসছে কি করবে, কতজন আসছে, সে ব্যাপারেও আমাদের কেউ কিছু বলেও নি বা কেউ সাবধানও করে দেয়নি। 

তার ফল হলো এই যে, তাদের আসার ব্যাপারে আমাদের কোনও মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। বাড়ির অ্যনেক্স বা উপগৃহের বাইরের অংশে বা প্রধান বিল্ডিং-এর অংশে তাদের কাজের ব্যাপারে আমরা সাবধান ত' ছিলামই না, উপরন্তু বিষয়টা আমাদের খেয়ালের মধ্যেও ছিল না।প্রস্তুত বা খেয়াল থাকার কথাও নয়, কারণ আমরা কিছুই জানতামই না। স্বভাবতঃ অফিস চলাকালীন সময়ে বা বাইরের অফিসে কেউ কাজ করলে যে আমাদের নিঃশব্দে এবং অতীব সাবধানে থাকতে হবে, এ' কথাটাই আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের অসাবধানে থাকার মাশুল কি হতে পারে, সে'টা তখনই বুঝলাম, যখন আমায়ের অংশের সাথে বাইরের অংশের যোগসূত্রের মাঝের বইয়ের আলমারি তথা দরজার ওপার থেকে হঠাতই হাতুড়ির ঘা'-এর বিকট শব্দ শুনতে পেলাম। আমার মাথায় প্রথম ছুতোরের কথাই এসেছিল। আমি সাথে সাথে ইলিকে (ইলি তখন আমাদের কাছে এসেছিল, কিছুটা সময় একসাথে কাটাতে। ইলি মাঝে মাঝেই আসত আমাদের বর্হিজগতের অভাব মেটাতে ) সাবধান করে দিয়ে বললাম, এখন তার কোন ভাবেই নীচে নামা যাবে না। ইলি আমাদের সাথে খাওয়ার জন্যে এসেছিল। ইলিরা মাঝে মাঝেই আমাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটানোর জন্যে আসে। শব্দটা শুনেই আমি আর বাবা তৎক্ষণাৎ বইয়ের তাকের দরজার এ'প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম ; যাতে বুঝতে পারি ও'প্রান্তে মিস্ত্রী আছে কি নেই! অথবা ঠিক কি হচ্ছে! প্রায় তিন কোয়ার্টার সময় একনাগাড়ে হাতুড়ি পেটানোর শব্দের পর বুঝতে পারলাম, মিস্ত্রী তার হাতুড়ি আর অনান্য যন্ত্রপাতি নামিয়ে রাখল। অর্থাৎ শব্দ বন্ধ হলো। তবে সেই সাথে এটাও বুঝলাম, সে মিস্ত্রী তার যন্ত্রপাতিগুলো আমাদের বইয়ের র‍্যাক/দরজার মাথায় রাখল। আর তারপরেই কিছুক্ষণ পর, শুরু করল বইয়ের র‍্যাক/দরজায় টোকা মারতে। একদিকে মিস্ত্রী র‍্যাক/দরজায় টোকা মারছে, আর অন্যদিকে আমাদের মুখগুলো ক্রমেই ফ্যাকাসে থেকে ফ্যাকাসেতর হয়ে উঠছে। আমরা সন্ত্রস্ত মনে ভাবতে শুরু করেছিলাম, যে, মিস্ত্রী নিশ্চয়ই সন্দেহ করতে শুরু করেছে যে র‍্যাক/দরজার ও'পারে কেউ আছে। আর তাই টোকা মেরে দেখছে, ও'প্রান্ত থেকে কেউ সাড়া দেয় কি'না! কিংবা মিস্ত্রী নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে র‍্যাক/দরজার ও'প্রান্তে কোন গোপন কুঠুরি আছে। আর সে ব্যাপারেই সে অনুসন্ধান শুরু করেছে। ক্রমেই বুঝতে পারছিলাম যে, আমাদের অনুমান ঠিক। কারণ কিছুক্ষণ নেড়ে চেড়ে দেখার পর সে টানাটানি, ঠেলাঠেলি, এমন কি মোচড় দিয়ে র‍্যাক/দরজা খোলার চেষ্টা শুরু করল। ভিতরে, আমাদের মুখগুলো তখন রক্তশূন্য নীলবর্ণের হয়ে গেছে। মৃত্যু পিরিচ প্রায় আমাদের ঠোঁটের কাছে চলে এসেছে। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন অজ্ঞান হয়ে যাব। বাইরের জগতে আমাদের গোপনীয়তা আর গোপন থাকল না। সবাই, বাইরের জগত, লুকিয়ে থাকা আমাদের সঙ্গেই আবিষ্কার করবে আমাদের অ্যানেক্সের সুন্দর গোপন অংশটাকে। তারপর কি হবে আমি জানি না। আমি জানি না, হয়তঃ আমাদের জীবনের শেষ প্রহরের শেষ ঘন্টা বাজবে।মৃত্যুর জগত চলে আসবে আমাএর চোখের সামনে। শেষ সময় আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এ'যেন মৃত্যুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা।

এমন সময় শুনলাম, দরজার ওপার থেকে মিঃ কোপহৌসের গলার স্বর। নিজেকে নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ঠিকমতো শুনছি ত’? মিঃ কোপহৌস র‍্যাক/দরজার ওপার থেকে ডাকছেন, " আরে ভিতরে কে আছ? দরজাটা খোল। আমি মিঃ কোপহৌস, শুনতে পাচ্ছ না? আমিই কড়া নাড়ছি। তোমরা শুনতে পাচ্ছ না ?" আমাদের আশ্বস্ত মুখগুলোর মধ্যে একজন এগিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল। র‍্যাক/ দরজার প্রধান হুকটা, যার উপর দরজাটা দাঁড়িয়ে আছে, সেটা কোনভাবে একটু বেঁকে গিয়ে জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। মিঃ কোপহৌস ওই হুকটাকে বাইরে থেকে কোনভাবে ঠিক করার চেষ্টা করছিলেন। কোপহৌস যাদের নিয়ে করছিলেন এবং যারা কাজটা করছিল, তাদের সবারই আমাদের গোপন অ্যানেক্সে যাতায়াত আছে। এই কারণে বাইরে যখন মিস্ত্রী হাতুড়ি নিয়ে হুকটাকে ঠিক করছিল, তখন কেউই আমাদের সাবধান করে দেওয়ার কথা চিন্তা করে নি। যেসব মিস্ত্রী কাজটা করছিল, তারা কাজটা শেষ করে নীচে নেমে যাওয়ার পর, মিঃ কোপহৌস উপরে উঠে এসেছেন। তাঁর আসার কারণ ইলিকে নীচে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেইজন্যেই মিঃ কোপহৌস এ'রকম অসময়ে উঠে এসে, আমাদের র‍্যাক/ দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন এ’কথাটা আমরা কোনভাবেই ভাবতে পারিনি। 

সবটা শুনে, শেষ পর্যন্ত আশ্বস্ত হলাম, “তা’হলে ত’ আমরা বেঁচে আছি, সবার মতোই শুধু বেঁচেই নেই, আমাদের আত্মগোপনের জায়গাটাও নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ আছে।“ আমরা আবার বাঁচার স্বপ্নে চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। মনে হল আমরা যেন এতক্ষণ এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। তোমায় একটা কথা বললে তুমি বিশ্বাস করবে? বন্ধ দরজার এ'প্রান্ত থেকে যখন আমরা ক্রমাগত ধাক্কার শব্দ শুনছিলাম, তখন আমাদের চোখে ভাসছিল এক বিপুলাকায় নাৎসি বাহিনীর পুলিশের ছবি, যে ধাক্কা দিয়ে আমাদের সমস্ত গোপনীয়তা ভেঙ্গে চুরমার করে র‍্যাক/দরজা অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকতে চাইছিল। মনে হচ্ছিল, ঐ কল্পিত দৈত্যাকার নাৎসি পুলিশের একটা লম্বা পা' আছে আমাদের গোপন দরজার সামনে, আর একটা পা' আছে মৃত্যুর গহ্বরে। বিশাল ওই দুই পায়ে এসে আমায়ের দুমড়ে মুচড়ে নিয়ে যেতে চাইছে, পিছনের মৃত্যুর গহ্বরে। 

যাই হোক যার শেষ ভাল, তার সব ভাল। আমাদের ভাগ্য ভাল যে শেষ পর্যন্ত আমরা ভাল আছি আর বেঁচেও আছি। এরই মধ্যে তুমি কি জান, গত সোমবারটা আমাদের খুব ভাল কেটেছে। সোমবার মিয়েপ আর তার স্বামী আমায়ের সাথে ছিলেন। রাত্রিটাও আমাদের সাথে কাটিয়েছেন। আমি আর মারগট সোমবার রাত্রে বাবা মার সঙ্গে এক সাথে শুয়েছিলাম। যাতে রাত্রে মিয়েপ আর ভ্যান সান্তেন এক সাথে এক ঘরে থাকতে পারেন সেদিন আমাদের রান্নাও স্পেশাল করে তৈরী করা হয়েছিল---- আর রান্নাটাও বেশ সুস্বাদু হয়েছিল। সবটাই ওদের জন্যে। খাওয়ার সময় ছোট্ট একটা অঘটন ঘটেছিল। হঠাত বাবার ঘরের লাইটটা কেটে গিয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ আমরা একেবারে অন্ধকারে বসে ছিলাম। এ'ছাড়া আর কি'ই বাঁ' করতে পারতাম ? আমাদের অ্যানেক্সে ফিউস বক্সে লাগানোর মতো ফিউস ছিল, কিন্তু সেটা ছিল ষ্টোর রুমে। এই অন্ধকারে স্টোর রুমের মধ্যে থেকে কে সেটা নিয়ে আসবে? বিষয়টা আদৌ সহজ কাজ ছিল না। তবে এই সব ভেবে আর যারাই বসে থাকুক না কেন, আমরা বসে ছিলাম না। মানুষ কোনদিন, তার প্রয়োজনীয় জিনিস, কে তার হাতের কাছে পৌছে দেবে, এ'কথা ভেবে বসে থাকেনি। সে বিকল্প ভেবেছে, এবং সমস্ত রকম প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে। এইভাবেই, ফিউস কেটে যাওয়ার মিনিট দশেকের মধ্যে আমরা মোমবাতি জোগাড় করে, অন্ধকারে আলো নিয়ে এলাম। 

আমি আজ খুব সকাল সকাল বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছিলাম। হেঙ্ক ঠিক সাড়ে আটটার সময় চলে গেলেন। তারপর আমাদের সাথে একসাথে প্রাতঃভোজনের পর মিয়েপ নীচে নেমে গেলেন। ঠাণ্ডা নিশ্চিন্ত স্রোতের মতো, একমুখ হেসে, আমাদের জানিয়ে গেলেন, আজ তার বেশ আনন্দের দিন। অন্ততঃ বিরক্তিকর আর একঘেয়ে সাইকেলে চেপে তাকে আজ অফিস আসতে হবে না। ঠিক এরপরের সপ্তাহে ইলি এসেছিল আমাদের সাথে রাত্রিযাপন করতে। 


ইতি,

অ্যানি। 





অনুবাদকের সংযোজন ঃ- 


উপরের ছবিটি হলো মিয়েপ গিয়েস এবং তাঁর স্বামী জ্যান অগস্তাস গিয়েসের। অ্যানি ফ্রাঙ্ক তার ডাইরিতে জ্যান অগস্তাস গিয়েসকে (Jan Augustus Gies) Henk van santen বা হেঙ্ক ভ্যান সান্তেন নামে উল্লেখ করেছে। আমস্টারডামের দক্ষিণাংশে জ্যান অগস্তাস জন্ম গ্রহণ করেন এবং বড় হয়ে ওঠেন। ১৯৩৩ সালে যখন মিয়েপের সাথে তাঁর প্রথম দেখা হয়, তখন তিনি একটা অফিসের কেরানী ছিলেন, এবং মিয়েপ একটি স্থানীয় কাপড়ের কলে চাকরি করতেন। এরপর দুজনেই নতুন ধারায় জীবন শুরু করেন। জ্যান আমস্টারড্যামের একটি "ডাচ সমাজ সেবা মূলক" সংস্থায় যোগ দেন, এবং মিয়েপ ওটো ফ্রাঙ্ককের কোম্পানী ওপেক্টোতে যোগ দেন। এই সময়ই তাঁদের দুজনের মধ্যে আবার সাক্ষাৎ হয়। সামাজিকভাবে সেই সাক্ষাৎকারের সময় ১৯৩৬ সাল। এর প্রায় পাঁচ বছর পর, ১৯৪১ সালের ১৬ই জুলাই তাঁরা পারস্পরিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই সময় একটা ঘটনা ঘটে। মিয়েপকে প্রশাসনিক স্তর থেকে নাৎসি মহিলা গোষ্ঠীতে যোগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি যোগ দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে, তাঁকে ভিয়েনাতে নির্বাসনের ভয় দেখানো হয়। এই রকম সময়েই মিয়েপ জ্যানকে বিবাহ করেন। মিয়েপ ও জ্যানের বিবাহতে, আমন্ত্রিতের তালিকায় ছিলেন ওটো ফ্রাঙ্ক, অ্যানি ফ্রাঙ্ক, হ্যারম্যান ভ্যান পেলস ও তাঁর স্ত্রী অগস্ট ভ্যান পেলস এবং মিয়েপ অনান্য সহকর্মী ভিক্টর ক্যুগ্লার, বেপ ভোস্কুজী এবং জোহানেস ক্লেম্যান। এর পরের বছরই গিয়েস, ওটো ফ্রাঙ্কের কোম্পানীতে নামমাত্র পরিচালকের পদ গ্রহণ করেন। কারণ এই সময়েই নাৎসি আইন প্রণীত হয়, যে, কোন ইহুদি আমস্টারড্যামের কোন কোম্পানীতে পরিচালকের পদের আসীন থাকতে পারবে না। এরপর থেকেই কোম্পানী "গিয়েস এয়ান্ড কোম্পানী" নামে ব্যবসা শুরু করে। জ্যান এই সময় থেকেই ওপেক্টোতে কাজ করতে শুরু করেন।

এরপর থেকে শুরু হয়, ইহুদিদের ওপর নির্যাতনের পালা। তাদেরকে উদ্বাস্তু ঘোষণা করে, শহরের বাইরে উদ্বাস্তু শিবিরে পাঠানো শুরু হয়। বহু ইহুদি বিভিন্ন জায়গায় গোপনে আশ্রয় নিতে শুরু করেন। এই সময় ওটো ফ্রাঙ্কের পরিবারও গোপন অ্যানেক্স ভবনে আশ্রয় নেন। জ্যান গিয়েস, মিয়েপের সাথে একযোগে তখন, লুকিয়ে থাকা ইহুদিদের জন্যে রেশনে খাবার ব্যবস্থা, তাদের লুকিয়ে থাকার জায়গা ঠিক করে দেওয়া, এবং ব্রিটিশ সংবাদপত্র জোগার করে তাদের হাতে পৌছে দেওয়ার কাজ গোপনে শুরু করেন। ব্রিটিশ সংবাদপত্রে ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্রচারের কোন জায়গা ছিল না। তাই ইহুদিদের কাছে ব্রিটিশ সংবাদপত্রের বেশ কদর ছিল। গিয়েসই ওটো ফ্রাঙ্কের পরিবারের জন্যে অ্যানেক্স ভবনটিকে নির্ধারণ করেন। পরে সেখানে ভ্যান পেলস পরিবারও এসে যোগ দেন। পরবর্তীকালে অ্যানি ফ্রাঙ্কে গ্রেপ্তার করার পর, মিয়েপ ও জ্যনা গিয়েসই অ্যানির লাল ডাইরিটা উদ্ধার করে, তার বাবা ওটো ফ্রাঙ্কের হাতে দেন। 

মিয়েপের জীবনে আরও কিছু চিত্তাকর্ষক গল্প আছে। মিয়েপ ভিয়েনাতে জন্ম গ্রহণ করেন, কিন্তু শিশু অবস্থায় তিনি কিছুটা অপরিণত মস্তিষ্কের কারণে তাঁকে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর "অপরিণত শিশু" হিসাবে উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে একটি 'সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের" দায়িত্বে তাঁকে হল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি আমস্টারড্যামেই থেকে যান। ১৯৩৩ সালে তাঁর সাথে ওটো ফ্রাঙ্কের দেখা হয়, তিনি মিয়েপকে তাঁর ট্রাভিস কোম্পানীতে চাকরি দেন। এরপর যখন অস্ট্রিয়া জার্মানের দ্বারা আধীকৃত হয়, তখন মিয়েপকে জার্মানির পাসপোর্ট প্রদান করা হয়। ১৯৪০ সালে জার্মান হল্যান্ড দখল করার পর, হল্যান্ডের জার্মান প্রশাসন মিয়েপকে " The German Club in the Netherlands"-এ যোগ দিতে বলে। কিন্তু মিয়েপ তার তীব্র প্রতিবাদ করলে, জার্মান প্রশাসন তাঁকে ডেকে পাঠায় এবং জানায়, যে, তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করা হচ্ছে, তিনি যেন তিনমাস কাল সময়ের মধ্যে আমস্টারড্যাম ছেড়ে চলে জান, নতুবা তাঁকে রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি হিসাবে ঘোষণা করা হবে, এবং উদ্বাস্তুর মর্যাদা দেওয়া হবে। কারণ তিনি হবেন রাষ্ট্রহীন উদ্বাস্তু। 

এই কঠিনতম সময়ে মিয়েপ ও হেঙ্ক ভ্যান স্যানটেন ( Henk van Santen ) ঠিক করেন পারস্পরিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। কারণ একমাত্র হেঙ্ককে বিবাহ করলেই শুধু মিয়েপ ডাচ নাগরিকের মর্যাদা বৈবাহিক সূত্রে ভোগ করতে পারবে। আইনসঙ্গতভাবেও নাৎসি প্রশাসন তাঁকে রাষ্ট্রহীন ব্যাক্তি হিসাবে বহিষ্কার করতে পারবে না। ১৯৪১ সালে দুজনে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। হেঙ্ক নিজেও গোপনে নাৎসি বিরোধী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত ছিলেন। মিয়েপ ও হেঙ্ক দু'জনেই অ্যানিদের খুবই ঘনিষ্ট ছিলেন। এমনকি অ্যানিদের সাহস যোগাতে দু'জনে একসাথে অ্যানেক্স ভবনে রাত্রিও কাটিয়েছেন। 

যেদিন পুলিশ এসেছিল, লুকিয়ে থাকা পরিবারগুলির তল্লাশী করতে, সেদিন অফিসে মিয়েপ ছাড়াও ছিলেন মিঃ ক্রেলার; মিঃ কোপহৌস; এবং ইলি। একমাত্র মিঃ ক্রেলার ছাড়া পুলিশ আর সবাইকে আদেশ দিয়েছিল, যে যেখানে আছে, সে যেন সেখানেই থাকে, পালানোর চেষ্টা যেন না করে। এরপর মিঃ ক্রেলারকে নিয়ে গেস্টাপো পুলিশ খানাতল্লাশী শুরু করে, তাদের খানাতল্লাশীর সময় মিঃ কোপহৌস মিয়েপকে অনুরোধ করেন, পালিয়ে যেতে। কারণ তিনি জানতেন শেষ পর্যন্ত পুলিশ সবাইকে গ্রেপ্তার করবে। কিন্তু মিয়েপ পালাতে অস্বীকার করেন। তখন মিঃ কোপহৌস মিয়েপের হাতে অফিসের মূল চাবিটা দিয়ে বলেন, 'পুলিশ জিজ্ঞাসা করলে সে যেন বলে, সে কিছুই জানে না।' মিঃ কোপহৌস বলেন, "আমি জানি তুমি আমাদের কাউকেই বাঁচাতে পারবে না। তবু যতটুকু পার রক্ষা করো। আর তুমি নিজেকে এর মধ্যে না জড়িয়ে, রক্ষা করো।"

এ'রকম অনুমান করা হয় যে, গোপনে ওপেক্টো হাউসেরই কেউ পুলিশকে খরবটা ফাঁস করে দিয়েছে। পুলিশ এসে, সবাইকে নীচে বসে থাকতে বলে মিঃ ক্রেলারকে নিয়ে উপরের দিকে র‍্যাক/ দরজার দিকে এগিয়ে যায়। মিঃ ক্রেলারের পিছনে পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে বাধ্য করা হয়, র‍্যাক/ দরজার ছিটকানী খুলতে। পুলিশ মিঃ ক্রেলারকে সামনে নিয়ে যখন অ্যানেক্সের মধ্যে প্রবেশ করে, তখন একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিঃ ওটো ফ্রাঙ্ক। মিঃ ক্রেলার তাঁকে বলেন, "গেস্টাপো পুলিশ এসেছে। তোমাদের গ্রেপ্তার করতে। মিঃ ওটো ফ্রাঙ্ক কোন উত্তর না দিয়ে, সামনে এগিয়ে আসেন। পুলিশ তাঁকে বলে, "তোমায়ের প্রয়োজনীয় কিছু থাকলে, তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও। আমাদের সাথে তোমাদের যেতে হবে।" পুলিশ অ্যানেক্সের লোকেদের সঙ্গে, মিঃ ক্রেলার আর মিঃ কোপহৌসকেও থানায় নিয়ে যায়। 

এই ঘটনাটা যখন ঘটে তখন সময়টা ছিল ১৯৪৪ সাল। জার্মান ইতিমধ্যেই বেশ কিছু জায়গায় হেরে যেতে শুরু করেছে। তাই ইহুদিদের সঙ্গে ব্যবহারে, আগের মতো অশিষ্টতা তাদের মধ্যে তখন ছিল না। ব্যবহার কিছুটা সহনীয় হয়ে ছিল। তবে অ্যানেক্সে পুলিশ আসার পর তাদের কেউই কোনরকম বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। 

পরবর্তীকালে মিয়েপ তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, "আমি চুপ করেই বসে ছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম অ্যানেক্সের সিঁড়ি দিয়ে ভারী বুটের শব্দ। আর তার ঠিক পিছনেই হালকা পায়ে নেমে আসছে অ্যানক্সের বাসিন্দারা। সব শেষে খুব হাল্কা পায়ে নামছিল অ্যানি। অ্যানক্সে থাকতে থাকতে, তার চলাফেরায় পায়ের শব্দটাও প্রায় মুছে গিয়েছিল। গতকালই ওর সাথে, ওদের সাথে কত কথা বললাম। আগামী কাল আর ওদের দেখতে পাব না। অফিসের দরজাটাও হয়তঃ বন্ধ হয়ে যাবে। আর কেউই এখানে থাকবে না।" ফ্রাঙ্করা চলে যাওয়ার পর, সর্ব শেষ পুলিশ অফিসারটি এসে তাঁকে প্রশ্ন করল, "তুমি কি কিছুই জানত না? এ'টা আমায় বিশ্বাস করতে বল?" মিঃ কোপোহৌস তাঁকে যেমন শিখিয়ে দিয়েছিলেন, তেমনিই সে বলল, 'না জানত না। সে শুধু এখানে চাকরি করত।' পুলিশ অফিসারটি তাঁকে আর কিছু না বলে, শুধু নির্দেশ দিলেন, কাল থেকে যেন অফিস যেমন খোলা থাকে তেমনিই খোলা থাকে। যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হবে। কারণ "পুলিশ জানে, তোমার স্বামী কোন গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত ছিল বা আছে।" 

সেইদিন রাত্রে অনেকক্ষণ মিয়েপ আর তাঁর স্বামী হেঙ্ক একা অফিসে বসে ছিলেন। কি করা যায়, কিভাবে ওদের ছাড়িয়ে আনা যায়, এসবই অলোচনা করছিলেন। হেঙ্ক বললেন, "তুমি একবার পুলিশকে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা কর। আর সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কারণ এখনও ওদেরকে আমস্টারড্যাম থেকে নিয়ে যায়নি। দেরী হলে ওদের শিবিরে পাঠীয়ে দেবে।" হেঙ্ক আর মিয়েপ ঠিক করলেন, তাঁদের কাছে যেটুকু জমানো অর্থ আছে, তা'র সবটা দরকারে দিয়ে দেবেন। ইত্যবসরে, যে বেকারী মিঃ কোপহৌসকে জিনিসপত্র সাপ্লাই করত, তার সাথে যোগাযোগ করাতে, সে' বেশ কিছু অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। পরেরদিন মিয়েপ গেস্টাপো বাহিনীর অফিসে গিয়ে অর্থের কথা বলাতে, অফিসার বললেন, "তা' আজ আর সম্ভব নয়। গতকালই তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে।" 

0 comments: