ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে
Posted in ঝরনাতলার নির্জনে
জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড
শিবাংশু দে
জোড়াসাঁকো জংশন থেকে যখন গাড়িটি প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এগিয়ে গিয়েছিলো তখন কি মায়া কেটে গিয়েছিলো তার? দক্ষিণের বারান্দার মৃদু বসন্ত বাতাস অথবা জ্যোতিদাদার ছাতবাগানের জুঁইফুল ভাসাভাসি সন্ধের বিলোল আমেজ কি ছেড়ে গিয়েছিলো তা'কে? অনেক দীর্ঘ পথ অপেক্ষা করে আছে, এমন কোনও প্রতীতি হয়েছিলো কি? জোড়াসাঁকো থেকে জালিয়াঁওয়ালা বাগ, সুরুলকুঠি থেকে সুইডিশ আকাদেমি, শিলাইদহ থেকে সান ইসিদ্রো...
ক্লান্তিহীন যাত্রাপথের গান, শুধু কি আনন্দে? নাহ, মানুষের যাবতীয় ভাবনার শ্রমসংহিতা, সবাইকে জায়গা করে দেওয়ার অলিখিত ঈশ্বরী দায় , একলা ইঞ্জিনের পিছনে অন্তহীন সারিবাঁধা কামরার ঝমঝম সিম্ফনি .... রবীন্দ্রসঙ্গীত ....
'... মীড়গুলি তার, মেঘের রেখায় স্বর্ণলেখায় করব বিলীন'
'বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত' বিষয়টি এই মুহূর্তে বুদ্ধির কাছে এত বহুকথিত, আবেগ বা নিরাবেগ কলুষিত প্রদূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে রসিকজন হয়তো এই নিয়ে কিছু পড়ার চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ শুনতেও অধিক আকৃষ্ট হবেন। সম্প্রতি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে 'জীবন'এর আরও 'কাছাকাছি' আনার জন্য এক যোগে যে ধরনের এলিট ও সাব অল্টার্ন রুদ্ধশ্বাস প্রয়াস চলেছে, তাতে 'সঙ্গীতসরস্বতী'র (খুব ক্লিশে শব্দ হয়তো, তবু বিকল্প না থাকায় ব্যবহার করলুম) অবস্থা কুরুরাজসভায় পাঞ্চালী প্রতিম এবং এক্ষেত্রে বাসুদেব যেহেতু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, তাই এখনও পর্যন্ত কোনও মতে লজ্জারক্ষা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, আগে কহো আর।
নিধুবাবু, রাম বসু, দাশরথি রায়, রামমোহন, ব্রাহ্মসঙ্গীত থেকে জোড়াসাঁকো। দেড়শো বছর আগেই তা বাঙালিদের জন্য বেশ বড়ো কালচারাল শক ছিলো। তার মধ্যে ১৮৭৭ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত এক রবীন্দ্রনাথ এবং তার পর আরেক বা অনেক রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির রসবোধ ও সাংস্কৃতিক রুচি যে গতিতে এগিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ সর্বদা তার থেকে অনেক অধিক বেগে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এই গরমিলের কারণে দু'টি প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিকভাবে প্রকট। রসগ্রাহীদের মধ্যে এই সূত্রেই স্পষ্ট দু'টি ভার্টিক্যাল প্রথম থেকেই তৈরি হয়ে গেছে। একদল প্রহ্লাদ, যারা পূজা করে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়ার চেষ্টা করেছে, অপর দল ধরে আছে হিরণ্যকশিপুর টোটেম। তারা চিরকাল বিরোধিতা করে, বিরূপ থেকে, অনীহা দেখিয়ে, নিজস্ব জ্ঞানবুদ্ধির নিরিখে নানা কটূক্তি করে, রবীন্দ্রনাথকে পেতে চেয়েছে। ঘটনা হচ্ছে এই যে পছন্দ করুক বা নাই করুক, কোনও বাঙালিই রবীন্দ্রনাথ বা সমার্থে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে 'জীবন' থেকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যানে রাজি নয়। বাঙলির নানা স্ববিরোধী অবস্থানের মধ্যে এটিও একটি। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজনীতি বাঙালির নিত্যদিনের সড়ক রাজনীতির মতো-ই ধূসর, ধূমিল ও পরিণতিহীন।
অধরামাধুরী ধরেছি.....
-----------------------------
রাজনীতিসহিত বা রাজনীতিরহিত, যেকোনও অবস্থাতেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গত অন্ততঃ অর্ধশতক ধরে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। এই সংযোগটা খুব সহজে হয়নি। নানা ধরণের অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী টানাপড়েন এর মধ্যে কাজ করেছে। 'বাঙালি রুচিবোধ' নামক একটি ধারণার প্রতি মোটামুটি সব বাঙালিই বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করে। এটি প্রকৃত না অলীক, তা নিয়ে তর্ক করবো না। তবু এর কিছু স্বীকৃত লক্ষণ আছে। তার মধ্যে একটি, রবীন্দ্রনাথের প্রতি আনুগত্য। এই রবীন্দ্রনাথ কিন্তু গরিষ্ঠ শতাংশ বাঙালির কাছে গানের রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির অন্যধারাগুলির প্রতি সংখ্যাগুরু বাঙালির আগ্রহ বিষয়ে সন্দিহান হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান, যা আজ উভয়পারের বাঙালির কাছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি মূল স্রোত, উত্তর কপিরাইটযুগে তার রূপরেখা কী রকম হওয়া উচিত তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। অথচ, রবীন্দ্রসঙ্গীত একটি অতীব নথিবদ্ধ গীতধারা। আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিন্যাসের সঙ্গে তার খুব একটা পার্থক্য নেই। 'নতুন' কিছু করো'র উন্মাদনায় তার মূল চারিত্র্য'কে সওদাগরের নিলামে চড়ানোটাকে সঙ্গতভাবেই 'যথেচ্ছাচার' আখ্যা দেওয়া যায়। যে 'রুচিবোধ' নিয়ে বাঙালির বেশ একটু অহমভাব রয়েছে, তার অনেকটা জুড়েই তার সঙ্গীতরুচির ব্যাখ্যান চলে। তারও সিংহভাগ জুড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ন্যায্য অনুরাগ অতি প্রকট। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক কালে দেখছি রবীন্দ্রসঙ্গীত'কে গায়ন ও পরিবেশনের ক্ষেত্রে কিছু মানুষের স্থূল, শিল্পবোধরহিত পরীক্ষার শিকার হতে হচ্ছে। আগের প্রজন্মের শ্রোতারা, যাঁদের সঙ্গীতরুচি পরিণতিলাভ করে গেছে, তাঁদের নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু নতুন প্রজন্মের আগ্রহী শ্রোতারা, যাঁরা নিজেদের জেন-এক্স বলে চিহ্নিত করেন, তাঁদের কাছে গত এক শতক ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিবেশন শিল্পটি কীভাবে বিকশিত হয়েছে, তার একটি খতিয়ান প্রস্তুত করার ইচ্ছে হ'লো। ইতিহাসটি জেনে নিয়ে তাঁরা নিজস্ব সঙ্গীতরুচি তৈরি করুন, সেটাই ঈপ্সিত উদ্দেশ্য। বিষয়টি বিস্তৃত এবং নিজের সীমাবদ্ধতা বিষয়ে আমি অবহিত। তবু মোটামুটিভাবে একটি সামগ্রিক আলোচনা করার প্রয়াস করেছি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমার নিরীক্ষাটি এপার বাংলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ওপার বাংলায় এই বিষয়ে যে সমৃদ্ধধারাটি রয়েছে, ব্যক্তি আমি তার সঙ্গে যুক্ত হবার সঙ্গতি অর্জন করতে পারিনি।
----------------------------------------
যেকোন শিল্পসৃষ্টি অনুধাবন বা উপভোগ করতে গেলে কিছু মৌল প্রস্তুতি লাগে। শিল্পটি যদি সঙ্গীত হয়, তবে আগে গান 'শুনতে' শেখার অভ্যেস করতে হয়। তাই প্রথমে আমাদের গান শোনার অভ্যেস বিষয়ে দুটো কথা বলে নিই। উত্তর ভারতে যে শাস্ত্রীয় গান আমরা শুনে থাকি সেখানে কোনও একটি সুর, যাকে স্ট্রাকচারড ভাবে 'রাগ' বলা হয়, তার শুধু কংকালটুকুই নথিবদ্ধ থাকে। আরোহ ও অবরোহ। এর পর শিল্পীকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয় ঐ কংকালের উপর রক্ত মাংস মেদ ত্বক আরোপ করে একটি রাগের শরীরী ও আত্মিক সত্বাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য। তারও অনেক প্রথাবদ্ধ নিয়ম আছে, কিন্তু কোনও ধরাবাঁধা স্বরলিপির সংস্থান নেই। কিন্তু পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে সুরস্রষ্টার তৈরি করা স্বরলিপির বাইরে একবিন্দু সরে যাবার অধিকার পরিবেশক শিল্পীর থাকেনা। এ নিয়ে 'স্নেহের মন্টু', ধূর্জটি ও 'গুরুদেবে'র অসংখ্য বোধ, যুক্তি ও আলোচনার কথা সবাই জানেন।
তা মন্টুর নাম যখন এসেই গেল, তখন বলি তাঁর গান কীভাবে গাইতে হবে সে নিয়ে কবিকে প্রথম সিরিয়স চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন পুত্রবৎ এই মানুষটি। আসলে কবির গান শুধুমাত্র খণ্ডসুরের নির্মিতি নয়। যে গানটি আমাদের কাছে আসে তা বস্তুত একটি দীর্ঘ অন্তর্লীন প্রস্তুতির গভীর থেকে উঠে আসা সুন্দরের ছায়ামাত্র। সুন্দর নিজে ন'ন। দারুব্রহ্ম জগন্নাথের মূর্তি যেন । অন্তস্থ 'ব্রহ্ম' রয়েছেন সুদূর গভীর কন্দরে। এই গানকে ধরতে চাইলে সুন্দরকে চিনতে হবে। কিন্তু কীভাবে?
দিলীপকুমারের এক 'বিশেষ ভক্তিভাজন' শুভার্থী একবার তাঁকে বলেছিলেন, "রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্টতা করছ হে, ঘা খাবে। উনি প্রতিভাধর, কিন্তু স্নেহশীল নন। উনি স্নেহ করেন বুদ্ধি থেকে, হৃদয় থেকে নয়- একথা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে।" পরে আরও কেউ কেউ দিলীপকুমারকে একই কথা বলেছিলেন। দিলীপকুমার প্রতিবাদ করেছিলেন এই ধারণার। তর্ক করেছিলেন প্রথম বয়সে। রবীন্দ্রনাথের স্নেহশীলতা, হৃদয়বত্তা, ভালোবাসার ক্ষমতার অসংখ্য পরিচয় তিনি পেয়েছেন আকৈশোর। কবির নিজের ভাষায় "আদর করিতে জানা, অনাদৃতজনে", তার পরিচয় পেয়েছেন তিনি নিজে ছাড়াও অযুত মানুষ। কিন্তু যাঁরা অন্যরকম ভাবতেন, তাঁরাও কেউ 'নির্বোধ' ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের ভিতর কবির অন্তর্লীন সুন্দরকে চিনে ওঠার এলেমটি ছিলনা। তাঁর ব্যক্তি পরিচয়ের মতো, তাঁর সঙ্গীতের পরিচয় পেতে গেলেও প্রস্তুতি লাগে।
দিলীপকুমার এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "...আমার মতন সামান্যের এজাহারের মূল্য যে আমাকে তিনি গভীরভাবে স্নেহ করেছিলেন বলেই আমাকে বারবার ক্ষমা করেছিলেন-আমি ঝোঁকের মাথায় তাঁকে বারবার আঘাত করা সত্ত্বেও। আজ একথা ভাবতে আমার অনুশোচনার অবধি থাকেনা।" এই 'বারবার আঘাত'টি কী ছিল? দিলীপকুমারের ভাষায়, "...বাংলা গানে সুরবিহার- অর্থাৎ তান বিস্তারের স্বাধীনতার পথ খোলা রাখা দরকার। কিন্তু এখানেও আমার কাঁচা বুদ্ধির অভিজ্ঞতা ধোপে টিকবে কিনা এ-জিজ্ঞাসা আমার মনে ওঠা উচিত ছিল নিশ্চয়ই। মনে মনে আরও গভীরভাবে সচেতন হয়ে ওঠা উচিত ছিল বই কী যে, তিনি তাঁর সঙ্গে সমানে তর্কাতর্কি করার অধিকার দিলেও আমার পক্ষে সে-অধিকারে উল্লসিত হয়ে ওঠা স্পর্ধারই সগোত্র।" এই সময়ে দিলীপকুমার ছিলেন একজন 'যৌবনমদান্ধ' যুবক (১৯২৩)। তার পরেও একবার প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের আলিপুরের বাড়িতে দিলীপকুমার কবির সঙ্গে তুমুল তর্কে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন। প্রশান্তকুমার সখ্যের অধিকারে দিলীপকুমারকে 'খুব ধমকে' দেন। দিলীপকুমার কবির কাছে যখন ক্ষমা প্রার্থনা করেন তখন কবি তাঁকে লেখেন, তিনি (কবি) দিলীপকুমারকে 'অন্তরের সঙ্গে স্নেহ' করেন, কারণ তাঁর (দিলীপকুমার) মধ্যে তিনি 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্য' দেখেছেন। চাবিকাঠিটি ঠিক এখানেই আছে। রবীন্দ্রনাথকে পেতে গেলে 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্য' অর্জন করতে হবে। তাঁর সঙ্গীত কীভাবে গাইতে বা শুনতে হবে তার সূত্রটিও এখানেই। ঐ বোধটির মধ্যেই আছে। দিলীপকুমারের সুরবিহারের জেদ কীভাবে তাঁর ঘনিষ্ট সাহানা দেবীর এই গানটির মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে, শুনলেই বোঝা যাবে। যদিও রবীন্দ্রসান্নিধ্যের সাহানা দেবী রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদিতম রূপকারদের একজন। কিন্তু দৈলীপী প্রভাবে কীভাবে তাঁর গায়নের ধরনটি বদলে গিয়েছিল তা এই গানটিতে লক্ষিত হয়। পরিণতবোধের দিলীপকুমার অবশ্য এই অবস্থান থেকে সরে এসেছিলেন।
সঙ্গীত উপভোগ করার নানা মার্গ আছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে আবেগমুখী ও সন্ধানমুখী। একটু সাধারণীকরণের ঝুঁকি নিয়ে বলি, প্রথমটি আমাদের ধরন, দ্বিতীয়টি পাশ্চাত্য ধরন।
আমাদের সঙ্গীত চর্চা ও উপভোগ করার ব্যাকরণ যেহেতু ইম্প্রোভাইজ করার কৌশলকেই অনেক বেশি মূল্য দেয়, তাই আমাদের সন্ধানমুখী সাঙ্গীতিক প্রবণতা তেমন প্রত্যক্ষ নয়। স্বরলিপির মাধ্যমে সুরের কাঠামো ধরে রাখার কায়দাটি য়ুরোপীয়রাই আমাদের দিয়েছে। পণ্ডিত ভাতখণ্ডে যখন সুরসংস্থানের বিচারে হিন্দুস্তানি রাগরাগিনীর বিন্যাস করতে চেয়েছিলেন, তখন তাঁকে প্রভূত বিরোধের সম্মুখীন হতে হয়ে ছিলো।
সুরকে নির্দিষ্ট খাঁচায় বেঁধে রেখে সঙ্গীত চিন্তা ও পরিবেশন আমরা ভিতর থেকে এখনও খুব একটা মেনে নিতে পারিনা। বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ থাকে, স্বরলিপির বাঁধনে গানের আবেগ উচিত মাহাত্ম্যে প্রকাশ করা যায়না।
আমরা সতত মনে রাখি, যে কবি লেখেন ' বাঁধন ছেঁড়ার সাধন হবে' বা 'তোমার জ্ঞানী আমায় বলে কঠিন তিরস্কারে, পথ দিয়ে তুই আসিসনি যে, ফিরে যারে', তাঁকে এই বাঁধনে বদ্ধ করার চেষ্টা অনুচিত। রবীন্দ্রসঙ্গীত যাঁরা ভালোবেসে শোনেন, তাঁদের অনেকেরই মত, স্বরলিপি থেকে ঈষৎ বিচ্যুতি থেকে যদি গানের স্পিরিটকে আরও ভালোভাবে প্রকাশ করা যায়, তবে তাই হওয়া উচিৎ। ব্যক্তিগতভাবে আমি সহমত। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করলে আমার অবস্থানটি ব্যাখ্যা করার মতো 'যুক্তি' আমার কাছে থাকা দরকার। রবীন্দ্রনাথের গান বহিরঙ্গে যতটা সরল, প্রকৃতপক্ষে তা নয়।
রবীন্দ্রনাথই প্রথম প্রধান বঙ্গীয় সুরস্রষ্টা যিনি এই স্বরলিপির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং অত্যন্ত সিরিয়াসভাবে তাকে কার্যান্বিত করেন। মুখে যাই বলুন না কেন, তাঁর সম্যক ধারণা ছিলো তাঁর গানের প্রকৃত স্বরলিপি তৈরি না করে গেলে তাঁর আপাত সরল সৃষ্টিসকল একদিন শিকড়হীন লোকরুচি ও লোকমতের বেনোজলে মাহাত্ম্য হারাতে পারে। এর সঙ্গে তিনি বিশেষ সচেতনও ছিলেন যে তাঁর গানকে এই য়ুরোপীয় পদ্ধতির ধরাবাঁধার মধ্যে চেপে রাখলে তার প্রাসঙ্গিকতা ও লোকপ্রিয়তা ক্ষুণ্ণ হবে। তাই জীবৎকালে তিনি কাউকে কাউকে তাঁর গানে 'স্টিমরোলার' চালানোর অধিকারও দিয়েছিলেন। তবে এই অধিকার নেহাতই ব্যক্তিস্তরের, তার সামূহিক কোনও প্রয়োগ তিনি স্বীকার করেননি।
স্বরলিপির প্রয়োগ একটি ডিসিপ্লিনের অঙ্গ, যা মানুষ স্বেচ্ছায় মেনে চলে। তাকে কোনও ‘এসমা’দিয়ে মানাতে হয়না। যাঁরা অধিকারী, তাঁরা স্বরলিপির 'বন্ধন'এর মধ্যে পূর্ণত থেকেও অতি উপভোগ্য সঙ্গীত পরিবেশন করতে পারেন। তবে অধিকারীর পাত্রভেদ আছে। যে সব শিল্পীর সঙ্গীতের এই ধারাটিতে সিদ্ধিলাভ হয়েছে তাঁরাই অধিকারী। এই সিদ্ধিলাভের তকমা কোনও কলেজে কিনতে পাওয়া যায়না। দীর্ঘসময়ের নিবিষ্ট সাধনা ও অনুশীলন ও তার সঙ্গে অন্তর্লীন সঙ্গীত চেতনার মেলবন্ধন যখন সংবেদনশীল শ্রোতার কাছে প্রকাশ পায় তখন এই স্বীকৃতি আপনিই আসে। যাঁদের নামে মাঝে মাঝে 'সুরচ্যুতি' বা বাঁধাপথের বাইরে' গিয়ে গান শোনানোর অভিযোগ ওঠে, সেই সুচিত্রা মিত্র বা জর্জ বিশ্বাস সিদ্ধির সেই স্তরে পৌঁছে গেছিলেন, যেখানে তাঁদের কাছে সেই সব 'বিচ্যুতি'র জন্য কৈফিয়ৎ চাওয়াটা বাতুলতা। কারণ তাঁরা নিজস্ব পরিবেশনায় 'বিশুদ্ধ সত্যপরতা ও সারল্য'কে ভিত্তি করেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। এই সব বাঁধাবাঁধি আমাদের মতো নিম্ন ও মধ্যমেধার মানুষের জন্যই থাক। আমরা সেই সুধাসাগরের পারে বসে থাকার লোক, ডুব দেবার সামর্থ্য অর্জন করা হয়ে ওঠেনি।
(ক্রমশ)
0 comments: