0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


গার্ড (অনুবাদ গল্প) 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 



৫ 

সেদিন সূর্যটা ডুবে যাবার আগে মেঘের কিনারায় বিষণ্ণভাবে ঝুলছিল। মেঘেরা সেদিন অমিত শক্তিধর, বারবার ঢেকে দিচ্ছিল সূর্যটাকে। তবুও অস্ত যাবার আগে মেঘের কালচে নীল সমুদ্রের মধ্য থেকে অরণ্যের চারপাশে একটা বেগুনি আলোর আভা ছড়িয়ে যাচ্ছিল। রেলগেটের উল্টোদিকের জঙ্গলের সারিসারি পাইনের কাণ্ডগুলির গা দিয়ে যেন জ্বলন্ত এবং গলিত ইস্পাতের মতো একটা আলো ঠিকরে পড়ছিল। 

রেলওয়ে ট্র্যাকগুলোর গা দিয়েও আলো পিছলে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন আগুনে রঙের সাপ। আলোর রেখাগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে শুরু করল। মাটির গা থেকে মিলিয়ে যেতে যেতে একচিলতে তখনও লেগে ছিল পাইনগাছগুলোর মুকুটে। শান্ত এবং গম্ভীর এক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল সেই জায়গায়। 

ঠীল রেলগেটের বারের গায়ে হেলান দিয়ে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে দেখছিল এই দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ। হঠাৎ সে নড়ে উঠল। এক পা এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। দূরে একটা কালচে বিন্দু দেখা দিল। রেললাইনগুলো যেখানে মিলে গিয়েছে সেখানে বিন্দুটা বড় হতে লাগল। প্রথমে মনে হলো বিন্দুটা যেন স্থির হয়ে আছে দিগন্তে। কিন্তু না, বোঝা গেলো সেটা চলমান। হাল্কা গুনগুন মৌমাছির গুঞ্জনের মতো আওয়াজ ছিল প্রথমে। সেটা বাড়তে লাগলো। বাড়তে বাড়তে ঝিকঝিক ঝিকঝিক ছন্দ থেকে সেটা ক্রমশ একটা গর্জনের মতো শোনাচ্ছিল। যান্ত্রিক ধ্বনিতে মনে হচ্ছিল যেন অশ্বারোহী সৈন্যদলের অজস্র ঘোড়ার খুরের নালের ধাতব আওয়াজ। 

ট্রেনটা প্রচণ্ড আওয়াজে যেন একটা দৈত্যের মতো এগিয়ে আসছিল। প্রচণ্ড আক্রোশে একরাশ ধুলো, ধোঁয়ার মেঘ ছড়িয়ে একঝলক আগুনে বাতাসের দমকা ঝড়ো হাওয়া ছড়িয়ে বেরিয়ে গেলো ট্রেনটা। কয়লার ধোঁয়ার গন্ধে ভরে গেলো গার্ডের কেবিন, ট্র্যাক দুলে উঠল, মাটি কেঁপে উঠল। আওয়াজটা যেরকমভাবে বেড়ে উঠেছিল, ঠিক সেরকমভাবেই মিলিয়ে গেলো ধীরে ধীরে। ধোঁয়াশা কেটে গেলো। ট্রেনের অবয়বটা আবার বিন্দুর মতো ছোট হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেলো দিগন্তরেখার ওপারে। আবার সেই প্রবল গম্ভীর নৈঃশব্দ নেমে এলো অরণ্যের কোণে। 

‘মিনা’... একবার যেন স্বপ্নের ভেতর থেকে ঠীল উচ্চারণ করল এই নাম। তারপর ধীরপায়ে ফিরে গেলো কেবিনে। এককাপ কফি বানিয়ে চুমুক দিতে লাগলো ধীরে ধীরে। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা একটা নোংরা খবরের কাগজের দিকে কী যেন দেখছিল, কিংবা দেখছিল না কিছুই। 

হঠাৎ ঠীল একটু অস্থির হয়ে উঠল। ঘরটা চুল্লির আগুনে বেশ গরম হয়ে উঠেছিল। সে কোট আর ওয়েস্টকোট দুটোই খুলে ফেলল। নাহ, তাতেও আরামবোধ হলো না। সে এককোণ থেকে তুলে নিলো কোদালটা, বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। গেলো সেই জমিটার কাছে; তার উপহারস্বরূপ পাওয়া জমি। একচিলতে বালিমেশানো ভূমিখণ্ড, যদিও এখন আগাছায় ভরে আছে। দুটো খর্বকায় ফলের গাছ; শাখাগুলো ঢেকে আছে তুষারকণার মতো দেখতে কুচি কুচি সাদা ফুলে। ঠীল সেই জমির উপরে দাঁড়িয়ে কিছুটা শান্ত হলো। 

নাহ, এবার কাজে লেগে পড়া যাক। ভাবতে ভাবতে সে মাটি কোপাতে শুরু করল। মাটির টুকরো আলগা হয়ে যেতে লাগলো এক এক আঘাতে। জমির ভিতর থেকে ভেজা ভেজা দলা মাটি বেরিয়ে আসতে লাগলো। বিরামহীনভাবে সে কুপিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে থেমে গেল। মাথা ঝাঁকিয়ে জোরে জোরে বলতে লাগল, ‘না, না... এ হয় না।’ তারপর আবার বলে উঠল, ‘নাহ, এ অসম্ভব!’ তার মনে পড়ে গেলো যে এর পর থেকে লেনা নিয়মিত এই জমির তদারকি করতে আসবে। তাহলে যে তার এই নিশ্চিন্ত একাকী যাপন অনেকখানি বিঘ্নিত হবে। এই কথা মনে পড়া মাত্র, মুহূর্তে মিলিয়ে গেলো তার মনের ধীর স্থির খুশি ভাব। তার হঠাৎ ভীষণ বিরক্তিবোধ হলো। যেন বিরাট একটা ভুল হয়ে গেছে এমন ভাব করে মাটির থেকে তুলে নিল কোদালটা। আবার সেটা রেখে দিয়ে এলো তার কেবিনের এক কোণে। সেখানে গিয়ে সে গুম হয়ে বসে রইল। সে বুঝতে পারছিল না, কেন লেনার সাথে দিনের বেশিক্ষণ সময় কাটাবার ভাবনাটা নিজের কাছেই ভীষণ অসহ্য ঠেকছে। সে নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পেরে উঠছিল না। এই ঠাঁইটুকু তার বড় প্রিয়; বড় আপন, নিজের মনের আধ্যাত্মিক ভাবনার জায়গা। তার মনে হলো এই জায়গাটুকু বুঝি বা অপবিত্র হয়ে যাবে অন্য মানুষের স্পর্শে। তার পেশী কঠিন হয়ে উঠল। সমস্ত মন বিদ্রোহ করে উঠল। কিন্তু সে এত চরম ভাবনা ভাবছে কেন? মনকে নিয়ে এত নাড়াঘাঁটা করছে বলে পরমুহূর্তে তার নিজেরই হাসি পেলো। নিজের অজান্তে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা হাসির শব্দটা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল তার কাছে। সে চমকে উঠল। ছিন্ন হয়ে গেলো তার চিন্তার সূত্র। সেগুলো কুড়িয়েবাড়িয়ে জড়ো করতে করতে সে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল জমির কাজে। 

কাজ করতে করতে তার মনে হলো যেন তার চোখের সামনে থেকে হঠাৎ কোনও কালো পর্দা সরে গেলো। নিজস্ব পরিস্থিতির নতুন একটা অর্থ প্রকাশ পেলো তার কাছে। ধূসর কুয়াশার মতো চিন্তার জাল সরিয়ে তার মনে হলো, সে কি গত দুবছর ধরে ঘুমাচ্ছিল? কী মরণঘুমে পেয়েছিল তাকে! সে একবারও তলিয়ে ভাবেনি টোবিয়াসকে নিয়ে। সেই বিকেলেই ঘটে যাওয়া ঘটনাটা,... উফফ, এত টাটকা একটা ঘটনা – সে কীভাবে ভুলে আছে? আহা, অসহায় শিশু না জানি কত কষ্টে আছে। কত বেদনা সহ্য করছে এই মাতৃহারা শিশু! তার নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হলো। 

প্রচণ্ড গ্লানিতে সে অত্যন্ত অবসাদ বোধ করছিল। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে টেবিলের উপরে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তা তার মনেও ছিলনা। কতক্ষণ শুয়ে ছিল, তা তার মনেও নেই। ভাঙ্গা গলায় অস্ফুটে এক দু বার উচ্চারণ করেছিল, ‘মিনা’... 

তার ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড বৃষ্টির শব্দে। ঘুম ভেঙে দেখল চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। অবসন্ন শরীরে গায়ে কাঁটা দিল তার। সে লক্ষ্য করল যে তার নাড়ি অনিয়মিত চলছে, মুখ ভিজে রয়েছে অশ্রুতে। 

কী ভীষণ অন্ধকার! অন্ধ করে দেওয়া তমসার মাঝে সে দরজা খুঁজছিল। বুঝতে পারছিল না যে কোনদিকে যাবে। পা ঘষটে ঘষটে বোঝবার চেষ্টা করছিল। সে তার কষ্টটা পুরোপুরি ভুলতে পারছিল না। কেবিনের বাইরের জঙ্গলটা যেন একটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গিলতে আসছিল তাকে। বাইরে ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির তোড় যেন তার কুটিরের ভেতরে ঢুকে এসে তাকে গ্রাস করে নেবে। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সে যেন এক ডুবন্ত মানুষ। ঠিক তখনই একটা বিদ্যুতের তীব্র আলোর ঝলকানিতে সে আবার সবকিছু দেখতে পেল। এক পলকের জন্য যেন এই বিপুল অন্ধকারে সে একটা আলোর দিশা দেখতে পেল। 

তার মধ্যেই সে তার লণ্ঠনটা খুঁজে পেয়ে গেলো। সামলে নিল নিজেকে। জানালাগুলোয় ঝনঝন আওয়াজ উঠছিল; মনে হচ্ছিল কেবিনসুদ্ধু সবকিছু ভাসিয়ে, উড়িয়ে নিয়ে যাবে ঝড়-বৃষ্টির দাপট। মাটি যেন কেঁপে উঠছিল প্রবল দুর্যোগে। আলো জ্বালিয়ে সবার আগে সে যেটা খুঁজছিল, সেটা হলো নিজের ঘড়ি। সে দেখল যে এক্সপ্রেস ট্রেন আসতে আর মাত্র পাঁচমিনিট বাকি। তার মনে হলো যে সে নির্ঘাত সিগনাল শুনতে পায়নি ঘুমের মধ্যে। ঝড়ের মধ্যে এবং নিকষ অন্ধকারে যতটা তাড়াতাড়ি যাওয়া সম্ভব, গিয়ে রেলগেট বন্ধ করে দিল। যখন সে গেট বন্ধ করছিল, তখনই সিগনালের ঘণ্টা বেজে উঠল ভীষণ কর্কশ শব্দে। প্রচণ্ড হাওয়া এসে যেন ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল শব্দটাকেও। শব্দটা ছিটকে ছিটকে পড়ছিল নানাদিকে। পাইনের বন দমকা হাওয়ায় নুয়ে পড়ছিল; গাছের শাখাগুলি একে অপরকে ঘষে আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছিল প্রবল ঝড়ের মুখে; শনশন আওয়াজ উঠছিল। ঠিক তখনই এক মুহূর্তের জন্য চাঁদ বেরিয়ে এলো মেঘের আড়াল থেকে। ম্রিয়মাণ এক আবছা সোনালী বলয় মেঘের মাঝে ঘিরে রেখেছে চাঁদকে। সেই আলোতে দেখা গেলো হাওয়া এসে ভীষণবেগে দুলিয়ে দিচ্ছে পাইনগাছের মুকুটের মতো মাথাগুলিকে। রেলওয়ে ট্র্যাকের পাশে সারিবদ্ধভাবে লাগানো বার্চগাছগুলি এমনভাবে দুলছে, ঠিক যেন ভূতগ্রস্ত ঘোড়ার লেজ। তার নিচে সাপের মতো শুয়ে আছে রেললাইন, জলে ভেজা এক একটা বিন্দুতে তার গা থেকে ঠিকরে উঠছে ফ্যাকাসে জ্যোৎস্না। 

ঠীল মাথার থেকে টুপিটা খুলে ফেলল। বৃষ্টিটা হয়ে ভালই হয়েছে, মনে হলো তার। বৃষ্টির ধারা ধুয়ে দিচ্ছিল তার অশ্রু। তার মুখটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু মাথার ভেতরটা আগের মতোই ধোঁয়াটে লাগছিল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যে স্বপ্নগুলো দেখেছিল, মনে করবার চেষ্টা করছিল সে। 


(চলবে) 

[গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘বানভ্যার্টার ঠীল’ গল্প অবলম্বনে রচিত] 

0 comments: