0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীন কথা


মিশ্রি পাক 
অনিন্দিতা মণ্ডল 



প্রথম পর্ব 

খৃস্টীয় দ্বিতীয় শতক। এক বিশাল পালতোলা জাহাজ দামলিপ্তি বা তাম্রলিপ্তি থেকে রওনা হয়ে বঙ্গোপ সাগর ছাড়িয়ে ভারত মহাসাগরে সিংহল দ্বীপ ছুঁয়ে আফ্রিকার উদ্দেশে। জাহাজের মালিক শ্রেষ্ঠী মণিপাল। অল্প বয়সেই সে বানিজ্যে বড় উন্নতি করেছে। তার জাহাজে আছে উৎকৃষ্ট মসলিন, মশলা, ল্যাপিস লাজুলি, এবং মৃগনাভি কস্তুরী। একেকটি মসলিন আংটির মধ্যে দিয়ে গলে যায়। কোনও কোনটি সিঁদুর কৌটোর মধ্যে পুরে রাখা যায়। ইয়োরোপের সভ্য সম্পদশালী দুনিয়ায় এ বস্তুর দারুন চাহিদা। প্লিনি তো লিখেই ফেলেছেন, এই প্রাচ্য ভূখণ্ডটি রোম সাম্রাজ্যের সমস্ত সোনা হরণ করেছে। অর্থাৎ যে পরিমাণ রপ্তানি এরা শুরু করেছে, আর যা সব পণ্য দিয়ে গ্রীক ও রোমক মহিলাদের মন ভোলাচ্ছে, তাইতে এরপরে রোমে আর সোনা অবশিষ্ট থাকবেনা। কিন্তু এই সতর্কবাণীতে কান দেয় কে? শ্রেষ্ঠী মণিপাল সমতটের বিখ্যাত বণিক। গঙ্গাহৃদির চোখের মণি মণিপাল। যদিও আশঙ্কা ছিল যে হয়ত জাহাজ নিয়ে ফিরে আসতে হবে, তবু বেনের ছেলে সমুদ্রে বাণিজ্যতরী না ভাসালে রাতের ঘুম থাকেনা যে। মণিপাল আজ তিন বছর ধরে তার পণ্য নিয়ে আসছেন মিশরে। মিশরের আলেকসান্দ্রিয়ায় ভূমধ্য সাগরের পারে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের বিকিকিনির হাট বসে। লেনাদেনা হয়। তবে দূতমুখে মণিপাল শুনেছিলেন রোম সম্রাট নাকি শিগগির আদেশ দিতে চলেছেন যে, গঙ্গাহৃদি থেকে মসলিন আমদানি আর হবেনা। এমন সূক্ষ্ম মাকড়সার জালের মতো কাপড়ে দেহ ঢেকে সুন্দরীরা নিজেদের আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলছে। কিন্তু বাংলার স্বাধীনচেতা বণিকেরা কবেই বা এসবে কান দিয়েছে? তাই ভাসল জাহাজ। এবং বহু পথ পেরিয়ে এসে মণিপাল তার পণ্য নিয়ে হাজির হলেন আলেকসান্দ্রিয়ায়। উটের পিঠে মাল নামিয়ে এনে রাখলেন তার নির্দিষ্ট স্থানে। এখানে হাটের মাঝে বেলে পাথরের তৈরি চারপাশ খোলা, বিপণি ঘর আছে। সেসব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বনিকের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। মণিপালের বান্ধব আন্তনি এই বিপণি গুলোর ভাড়া তোলে। রোম সাম্রাজ্যের খাজনা আদায় করে। তারই হেপাজতে মণিপালের জিনিসপত্র থাকে। আর সরাইখানাটিও আন্তনির। সেখানে মণিপালের ও তার সঙ্গে আসা আরও বন্ধু বণিক এবং কর্মচারীদেরও জায়গা মেলে। মণিপালের জাহাজে তার নিজের পণ্য ছাড়াও অন্য বণিকদের পণ্য এসেছে। অত বড় জাহাজের খোলে তার একার পণ্যই বা থাকবে কেন? অতএব বেশ কটি প্রায় সমবয়স্ক বেনের পো এসেছেন আলেকসান্দ্রিয়ায় বাণিজ্য করতে। 

আলেকসান্দ্রিয়ায় বাজার বসে বিকেল থেকে। রাত পর্যন্ত দীপালোকে চলে বিকিকিনি। নানা রকমের ক্রেতা বিক্রেতার শোরগোলে প্রান্তর ভরে থাকে। এইসব বেচাকেনার ফাঁকে ভিনদেশী বণিকদের মনোরঞ্জনের জন্য সরাইয়ের মালিকরা লাস্যময়ী রমণীদের হাটে ঘোরাফেরা করতে দেন। এতদিন ধরে ঘর ছেড়ে থাকতে হলে এরকম আমোদের ব্যবস্থা না থাকলে যে মারা পড়তে হবে! মণিপাল অবশ্য এইসব রমনীদের দিকে চোখ দেন না। তার দেশে নগরনটী আছেন। তাঁদের সামাজিক স্থান উচ্চে। সে এরকম প্রগলভ রূপোপজীবিনী দের সাহচর্য এড়িয়ে এসেছে এতকাল। সেদিন ভূমধ্য সাগরের পার থেকে সুন্দর হাওয়া উঠেছে। মণিপালের বিপণিতে এক রোমক ক্রেতা এসেছেন যিনি পাইকারী হারে মসলিন নিতে চান। রোমকরা এমনিতেই বড্ড দাম্ভিক। ঠিক সেই সময়ে এক কাজলনয়নী বাদামি ত্বকের সুন্দরী কন্যা বিপনির সামনে এসে উদ্দেশ্যহীন দাঁড়াল। মণিপালের বুক কি জানি কেন কেঁপে উঠল। রোমকটি মণিপালের উদাসীন ভাব দেখে মনে করল সে হয়ত মূল্য বাড়ানোর জন্য এমন ভাব দেখাচ্ছে। সে তখন সে স্থান ত্যাগ করে চলে গেল। এদিকে মণিপাল সেই সুন্দরীর দিকে চেয়ে মুগ্ধ। কিন্তু এ কিরকম আচার? সুন্দরী কিছু না বলেই তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে চলে গেল। শরবিদ্ধ হরিণের মতো বেদনাকাতর মণিপাল বিপণির পাথরের থামে হেলান দিয়ে বসে আছেন, এমন সময়ে আন্তনি এসে চিৎকার জুড়ে দিল। ‘তুমি কি পাগল? অ্যাঁ? বলি অমন শাঁসালো খদ্দের, আর তুমি কিনা স্বপ্নের দুনিয়ায়?’ মণিপাল দুর্বল স্বরে হাত তুলে দেখিয়ে বলল – ও কে? আন্তনি মাথায় হাত দিয়ে বসে তার নিজের ভাষায় প্রথমে বিড়বিড় করল খানিক। তারপর মণিপালের দিকে চেয়ে রাগত স্বরে বলল – তবে যে বল তোমার সুন্দরী ভালো লাগেনা? মণিপাল ওরকমই দুর্বল স্বরে বলল – এ যে অন্যরকম। এই কন্যা তার মনোহরণ করেছে। কিন্তু ভিন দেশে এভাবে তো প্রেম নিবেদন করা যায়না, অগত্যা আন্তনিই গতি। আন্তনি হতাশ ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে মণিপালের কাঁধে হাত রেখে বলল – তুমি যে বন্ধু একেবারে ক্লিওপাত্রার নাতনিকে মন দিয়ে ফেলেছ! এখন কি করি? মণিপালও হতবাক। ক্লিওপাত্রার নাতনি? সখা বিগলিত হেসে বলল – আরে না না। ঠাট্টা করছিলুম। তবে কিনা সিস্তানার ঠাকুমা সেবা বড় রাগী। নিজেকে কি যেন মনে করে। সেবা? মণিপাল বুঝতে পারছেন না আন্তনি ঠাট্টা করছেন কিনা। সেবা, সেবাবতী তো তাঁদের দেশের মেয়েদের নাম! এবারে কিন্তু আন্তনি হাসলনা। বলল আচ্ছা সবুর করো দেখি। দেখি কি করা যায়। চিন্তায় ফেললে তুমি। 

পরদিন দিনের বেলায়, যখন রোদ্দুরে ক্লান্ত হাট দিবানিদ্রা দিচ্ছে, তখন আন্তনি এসে তাকে সরাইয়ের বাইরে নিয়ে এলো। তারপর মণিপালকে নিয়ে রওনা দিলো উত্তরপূবের রাখোটিসের খাঁটি মিশরীয় পল্লীর দিকে। সে থাকে রাখোটিস আর ব্রুসামের মাঝামাঝি এক পল্লীতে। সেখানে গ্রীক রোমক ও মিশরীয়দের মিশ্র প্রজাতির বাস। খাঁটি মিশরীয় সে নয়। কিন্তু যার প্রেমে মণিপাল পড়েছে সে খাঁটি মিশরীয়। সত্যি সত্যিই ভূমধ্য সাগরের পারে সেই পল্লীর মধ্যে হলুদ পাথরের বাড়ি গুলোর মাঝে সিস্তানাকে দেখতে পাওয়া গেলো। সে তখন পেছনের ক্ষেতে কি সব শাকপাতা তুলছে। মণিপালের মনে পড়ে গেলো বাংলার মাঠঘাট, জলে ভরা দীঘি নদী, সবুজ ক্ষেত। তাদেরও পাকশালে এমন করে শাকপাতা রান্না হয়। আহা, এ যেন সেই সমতট থেকে আরেক সাগর তটে নদীর মোহনা দ্বীপে এসে পড়েছে সে। তার ধ্যান ভাঙিয়ে দিয়ে এদিকে আন্তনি তার কানের গোড়ায় মুখ এনে বলতে লাগল – এমন হাঁ করে দেখতে থাকলে সিংহীর মুখে একা যাও। আমার কম্ম নয় তোমায় বাঁচাই। কাজ নিকেশ হলে অমন অনেক সময় পাবে দেখবার। অগত্যা সিস্তানাকে দৃষ্টিপথের বাইরে রেখে তারা দুজনে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল একটি উঠোনে। আন্তনি আবার সাবধান করে দিলো – সখা মুখটি বন্ধ রেখো কিন্তু। যা বলার আমি বলব। সেবা ঠাকুমা বড়ই উগ্রচণ্ডা। ক্লিওপাত্রার মতোই দেবী আইসিসের পুজো আচ্চা করে। আর এক অপূর্ব সুখাদ্য তয়ের করে। তার হাতের সেই বস্তুটি অমৃত। এমন পাক এ তল্লাটে কেউ করতে পারেনা। মণিপাল বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নাড়ল। সমতটের কেউ যদি তাকে এভাবে দেখে তবে সেই সম্পন্ন বণিক মণিপালকে দেখে অবাক হয়ে যাবে। এ কি হীন ভাবসাব! কিন্তু প্রেমে পড়লে এমন হয়।

0 comments: