0

গল্প - সুমিত চট্টোপাধ্যায়

Posted in


গল্প


২৫ শে বৈশাখের গল্প - অমধুরেণ 
সুমিত চট্টোপাধ্যায়



এরকম খাবার আর বানিও না, বউমা। অর্ধভুক্ত মিষ্টির বাটিটা পাশে সরিয়ে রাখলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর আস্তে আস্তে উঠে গেলেন খাবার টেবিল থেকে। 

হেমলতাদেবী কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। এতদিন পরেও! 

ঠিক ধরে ফেলেছেন। 

ইদানীং দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে সামান্য সময় বিশ্রাম নেওয়াটা অভ্যেস হয়েছে রবীন্দ্রনাথের। আগে ছিল না। সত্তর বছর বয়েসে বউমা আর নাতবৌমাদের পাল্লায় পড়ে এই নতুন বন্দোবস্ত। প্রথমে একটু কেমন কেমন লাগতো। এখন অবশ্য ভালই লাগে। 

আজও একটু চোখ বুজে বিশ্রাম নিলেন। বেশী না, পনের কুড়ি মিনিট পরেই অবশ্য চটকাটা ভেঙে গেল। 

আরে, একি। বউমা। তুমি কখন এলে? পায়ের কাছে বসে কেন? 

হেমলতাদেবী চোখ তুলে তাকালেন। আমায় ক্ষমা করুন, দাদামশাই! 

আরে, না না। কি বলছ! আমারই উচিত হয়নি তখন অতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়াটা। বুড়ো হয়েছি তো। কিছু মনে কোরো না, হ্যাঁ? 

মনে করবো না - যদি আপনি যে গল্পটা অনেকদিন ধরে বলবো বলবো করছেন, কিন্তু বলছেন না - সেটা যদি বলেন। একগাল হেসে বললেন হেমলতা দেবী। সম্পর্কে তিনি রবীন্দ্রনাথের দাদার নাতবৌ। আর স্বভাবজ হাসিখুশি প্রকৃতির। বেশীক্ষণ মুখ গোমড়া করে থাকা তার পোষায় না। 

কোন গল্পটা বলোতো? দুষ্টু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন রবীন্দ্রনাথ। যদিও তার ভালোই মনে আছে কোন গল্পটা। 

কোনটা আবার? আপনাদের বিয়ের গল্পটা। আমার দিদিশাশুড়ির গল্পটা। 

ও। ওইটে। সে ত অনেকদিন আগের কথা। সব মনে নেই। 

না। মনে নেই বল্লে শুনব কেন? খাবার টেস্ট করেই ধরে ফেললেন। মনে নেই বললেইহলো! 

হেসে ফেললেন রবীন্দ্রনাথ। সত্যি। তুমি ছোট বউয়ের রেসিপিটা পেলে কোথা থেকে বলোতো? অবিকল বানিয়েছ! 

ওমা আপনি জানেন না। ওনার রেসিপি লেখা খাতাটা ত আমাদের কাছেই থাকে। 

বাহ্। তাই ত বলি। তাই তুমি কদিন ধরে বলছিলে আমাকে একটা খাবার খাইয়ে চমকে দেবে। তা আগে করোনি ত! আজ কি ব্যাপার? 

আপনার কিচ্ছু মনে থাকে না, দাদামশাই। আজই তো আপনাদের বিবাহবার্ষিকী। 

অ্যাঁ। আজ! আরে তাই তো। আজই তো চব্বিশে অঘ্রাণ। নাহ্। সত্যি, কিছু মনে থাকে না। রবীন্দ্রনাথ একটু উদাস হয়ে গেলেন। ইস। কি করে আজকের দিনটা ভুলে গেলেন! মেমারিটা একেবারে গেছে। অবশ্য মেমারির আর দোষ কি! একি আজকের কথা। ছোটবউ তো চলেই গেছে আজ থেকে তিরিশ বছর আগে। তখন ও ঊনত্রিশ আর রবীন্দ্রনাথ একচল্লিশ। একসঙ্গে ছিলেন মাত্রই ঊনিশ বছর। 

মাত্র ঊনিশ? 

আবার কি? আসলে আরো কম। বিয়ের সময় ওর বয়স কত আর - নয় কি দশ। তখন তো আর আমার কাছে থাকতো না! বিয়ের পর তখন তো সবাই আবার বাপের বাডি চলে যেত। যদিও ওদের বাপেরবাড়ি গরীব ছিল বলে বাবামশাই বউমাকে আর ওর বাবার ওখানে পাঠাননি। জোড়াসাঁকোতেই রেখে ট্রেনিং চলছিল। লোরেটোয় ইংরেজি শিখতে যেত, বাড়িতে সংস্কৃত টিচার রাখা হয়েছিল। 

আমি একটা কথা জিগ্যেস করবো, কিছু মনে করবেন না? 

বলো না। মনে করবো কেন? অনেকদিন কেউ এসব জিগ্যেস করেনি। ভালই লাগছে বলতে। 

আমি শুনেছি খুব সাধারণ ফ্যামিলি থেকে এসেছিলেন। দেখতে শুনতে... 

অতি সাধারণ ছিল, তাই তো? আসলে জানো তো আমাদের বাড়িতে ফরসা রং, সুন্দর মুখশ্রী এসবগুলোকে খুব প্রাধান্য দেওয়া হতো। মানুষটা কেমন - সে কথা যেন ভাবতোই না। আমার বউদিরা তো বিরাট হতাশ হয়েছিল। এই নাকি রবির বউ! 

তাহলে বিয়েটা হলো কেন? 

সে অনেক কথা। আমরা তো পিরালির ব্রাহ্মণ। অরিজিনাল টাইটেল কুশারী। সেই কবে মুসলমানের হাতের ভাত খেয়েছিল বলে বর্ণহিন্দুরা কেউ আমাদের ঘরে মেয়ে দিতে চাইতো না। ফলে আমাদের বউয়েরা সব যশোর থেকেই আসত। আর মজাটা কি জানো। গায়ের রং নিয়ে বউদিদের এত চিন্তা, অথচ আমার বউদিরা কিন্তু সবাই আমার দাদাদের থেকে কালো! অথচ বিয়ের কয়েকদিন পরে তাঁরাই এসব ভুলে রবির বউয়ের গায়ের রং কেন চাপা সেই নিয়ে... 

হি হি। সে অবশ্য সত্যি কথা। আমরা যারা ঠাকুর পরিবারের বউ তারা কেউই আপনাদের বাডির ছেলেদের নখের যোগ্য নই! 

না। না। ওরকম বোলো না। মানুষের গায়ের রং কি মানুষের পরিচয়। তার গুণটাই আসল। 

সে যাকগে। তারপর? হেমলতা দেবী তাডা লাগালেন। একটু পরেই বিকেল হবে। আর লোকের লাইন পড়ে যাবে কবির সঙ্গে দেখা করার জন্য। ব্যাস্। গল্পটা মাঠে মারা যাবে। 

তো, বুঝলে। কানাঘুষো শুনে আমারও মনটা কেমন কেমন করছিল। তখন আমার বয়স বাইশ। মন তো রোমান্সে থই থই। কিন্তু কি আর করবো। খবর নিতে লাগলাম। মেয়ের ভাল নাম ভবতারিণী। ডাকনাম দুটো - পদ্ম আর ফুলি। 

এ মা। এরকম নাম? 

আরে তা তো হবেই। ওর বাবা তো আমাদেরই ছোট গোমস্তা। তার মেয়ের আবার কি নাম হবে। রবীন্দ্রনাথ মুচকি হেসে বলেন। তো, নাম চেন্জ করা হলো। পদ্মের পরিবর্তে মৃণালিনী। 

ও। 

তো, বিয়েরদিন আমার মনেও খুব একটা আনন্দ নেই। কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করছি না। উল্টে জোরসে ইয়ারকি করছি। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ তো একটু বকাই দিলেন। তবে বিয়ের সময় শ্বশুরমশাই আর বউকে দেখে বড় মায়া হলো, জানো? 

মায়া? 

হ্যাঁ। দেখি দুজনেই কিরকম জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। প্রতিটা নড়াচডার মধ্যই যেন তাদের হীনন্মন্যতা ফুটে উঠছে। না, মানে এমন নয় যে আমার বাডির লোকেরা তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। কিন্তু, তারা নিজেরাই... 

হেমলতা দেবী চুপ করে শুনতে থাকলেন। 

দেখে না বড্ড মন কেমন লাগল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম এই অতি সাধারণ মেয়েটিকেই আমি সারাজীবন খুব ভালবাসবো। 

তারপর? 

দুর! দু:খের কথা আর কি বলবো। ভালবাসবো কি। কাছেই তো পাই না। সারাদিন তার 'ট্রেনিং' চলছে। রাতে শোয়া সব দূর সম্পর্কের আত্মীয়াদের কাছে। এই ভাবে কেটে গেল দু তিন বছর। তারপর একদিন দুপুরবেলা হঠাৎ বাড়ি ফিরে এসেছি। গরমকাল। পরনের পিরানটা খুলেছি, হঠাৎ ঘরের কোণ থেকে দেখি টুংটাং শব্দ। কি ব্যাপার? দেখি ছোটোবউ। অনেকদিন কাছ থেকে দেখিনি। তাই প্রথমবারে চিনতে পারিনি। বেশ লম্বা হয়ে গেছে। চেহারাটাও বেশ ভাল হয়ে গেছে। মজা করার ইচ্ছে হলো। চোখ পাকিয়ে ডাকলাম। 

তারপর কি হলো? হেমলতা নড়ে চড়ে বসলেন। 

আর বোলো না। কিছুতে কাছে আসবে না। অতি কষ্টে পাশে বসালাম। জিগ্যেস করলাম - কি ব্যাপার। এখন আমার ঘরে কেন? বলল ও নাকি প্রায় দুপুরবেলা সুযোগ পেলেই আমার ঘর গোছাতে চলে আসে। তাছাড়া এখন তো গরমের ছুটি পড়ে গেছে। কি মনে হলো কাছে টেনে নিলাম। বললাম এইবার? না বলে আমার ঘরে ঢোকার শাস্তি জানো? 

হেমলতা মুচকি হেসে বললেন - এবার কি হলো আমি বুঝে গেছি। 

আরে না রে মেয়ে, তুমি যা ভাবছ তা নয়। কিছুই হলো না। হাঁচড় পাঁচড় করে পালিয়েই গেল। তবে যাবার আগে বলে গেল - এবার থেকে রোজই আসবে যদি আমিও রোজ এসময় আসি। 

আপনি আসতেন? 

আসব না? গিন্নির হুকুম বলে কথা। স্মিত হেসে বললেন রবীন্দ্রনাথ। রোজ আসতুম। বেশ চলছিল, বুঝলে? ওর একটা নামও দিলাম। ছুটির সময় ঘনিষ্ঠতা। তাই নাম রাখলাম - ছুটি। কয়েকদিন পর ওর লজ্জাটাও কেটে গেল। আমার কাছেই বসতো। তো, এরকমই একদিন গল্প করছি। সেদিন একটু মনটা খারাপ। 

কেন। মন খারাপ কেন? হেমলতা জিজ্ঞাসা করলেন। 

পরের দিন থেকে ইস্কুল খুলে যাচ্ছে তো। আর এভাবে দেখা হবে না। সেটা নিয়েই একটু কথাবার্তা হচ্ছে। এমন সময়, আমরা গল্প করতে এমনি মশগুল, খেয়ালই করিনি আমার এক বৌদি আমাদের গল্প করতে দেখে ফেলেছে। আর যায় কোথায়! সারা বাড়ি সেটা রাষ্ট্র করেছে। 

তারপর? 

তারপর আর কি। শাস্তি পেতেই হলো। 

শাস্তি! কি শাস্তি? 

আবার কি। দুপুরবেলা এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা সাক্ষাত বন্ধ। 

ইস্। 

ইস্ বলে ইস্। দুপুরে এভাবে দেখা করা যাবে না। তবে, ... 

তবে? 

তবে এবার থেকে রাত্রে দেখা করা যাবে - কারণ এবার থেকে ছোটোবউ আমার কাছে থাকতে পারবে। 

ওহ্। কি মজা। হাততালি দিয়ে উঠলেন হেমলতা দেবী। 

নাত বউমার ছেলেমানুষি দেখে বেশ জোরেই হেসে ফেললেন কবি। 

হেমলতা এবার একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন। তবু জিগ্যেস করলেন, তারপর? 

তারপর আর কি। কিছুদিন পরে ছুটির কোল আলো করে এল আমার বড় মেয়ে বেলা। আর তার কিছুদিন পরেই জমিদারি দেখাশোনার জন্য সপরিবার চলে গেলাম গাজিপুর। 

গাজিপুর না শিলাইদহ? 

আরে, ঐ গাজিপুর বাসের পরিণতিই হলো শিলাইদহে। 

শুনেছি, সে নাকি খুব সুন্দর জায়গা। 

সুন্দর বলে সুন্দর। বাংলাদেশের মতো সুন্দর পৃথিবীতে কোথাও আছে নাকি? আর এই শিলাইদহে গিয়ে আমারও লেখার হাত খুলে গেল আর তোমার দিদিশাশুড়িকেও যেন নতুন করে চিনলাম। 

নতুন করে? 

হ্যাঁ, নতুন করে। আসলে কি জান, এখানে তো বাড়ির ছোট বউ। আর ওখানে তো ওই সর্বময় কর্ত্রী। ওর গুণগুলো যেন শিলাইদহে পাখনা মেলে দিল। ছোটোবউয়ের রান্নার হাত তো বরাবরই ভাল, ওখানে গিয়ে আরও সরেস হয়ে গেল। কত উদ্ভট আব্দার করতুম। সব বানিয়ে খাওয়াত। 

কিরকম? 

যেমন ধরো দইয়ের মালপো। 

দইয়ের মালপো? এরকম খাবারও হয় নাকি! ঐ খাতাটাতে এটা লেখা নেই তো। 

কেন লেখা নেই আমি কি করে বলব। তারপর ধরো পাকা আমের মিঠাই, চিঁড়ের পোলাও, কচুর পিঠে। 

এ বাবা। হেমলতা কলকল করে উঠলেন, এগুলো একটাও লেখা নেই। কি হবে? 

কি আবার হবে? কিছু হবে না। তোমার রান্নার হাতও ভারি চমৎকার। তুমি যেমন রাঁধো, তেমনি রাঁধবে। তো, যা বলছিলাম। এ তো গেল রান্নার কথা। মানুষকে ভালবাসার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ছোটোবউয়ের। আমি ছিলাম জমিদার। ফলে আমার সঙ্গে সব প্রজাদের ঠিক বনতো না। কিন্তু ছোটোবউ হয়ে গেল সব প্রজাদেরই- মা। রোজই বাড়িতে একগাদা পাত পড়ত। সময় নেই অসময় নেই প্রজারা হাজির। কারোর খাজনা মকুব করতে হবে। কারোর মাইনে একটু বাড়ানো দরকার। রাস্তা সারাইয়ের টাকা লাগবে। একবার আব্দার হলেই হলো। সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে হাজির। তোমার দিদিশাশুডির মুদ্রাদোষ ছিল- 'এই শুনছো'- বলা। এই শুনছো - অমুকের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না। ওকে কিছু টাকা দিতেই হবে। এই শুনছো। তমুকের বাড়ির চাল ঝড়ে উড়ে গেছে। ওকে একটু সাহায্য করো না! 

ইস্। কি ভালো মন। 

আর ভালো মন। আমি মাঝে মাঝে মজা করে বলতাম এরকম করলে জমিদারি লাটে উঠবে। তবে না করারও উপায় নেই। না বললেই হয় ঠোঁট ফুলোবে, নয়তো ... নয়তো, মহাজনের কাছে নিজের গয়নাগাটি বন্ধক রেখে টাকা জোগাড করে দেবে। সে তো প্রেস্টিজ নিয়ে টানাটানি। কাজেই যা বলতো, তাই করতাম। 

তারপর? 

তারপর সংসারও ভরে গেলো। আরো দুই মেয়ে আর দুই ছেলে ওখানে ইহলো। জমজমাটি ব্যাপার। সত্যি বলতে কি, শিলাইদহে আমরা আমাদের দাম্পত্য জীবনের সেরা সময়টুকু কাটিয়েছি। 

আপনাদের ঝগড়া হতো? 

হবে না! ছোটবউ ঝগড়া করত আমি খেতাম খুব কম বলে। আর আমি রেগে যেতাম ও একটুও সাজতো না বলে। 

একটুও সাজতেন না? 

না। একদম না। আরে তুমি জমিদার গিন্নি। সারাদিন ভুতের মতো পরিশ্রম করো আর পেত্নীর মতো সেজে থাক। লোকে কি বলবে? 

তা উনি কি বলতেন? 

কি আবার। মুখ টিপে হাসত। আর পরক্ষণেই বলত - এই শুনছো। ঐ পাশের গ্রামের বদরী এসেছিল। ওর নামে শমন এসেছে। তুমি একটু কোতোয়ালিতে বলে দাও না! 

তারপর? 

তারপর! এত সুখ আর সইল না। আমার মাথায় শান্তিনিকেতনের ভুত চাপল আর কষ্টেরও শুরু হলো। 

কেন? উনি কি মানিয়ে নিতে পারছিলেন না? 

না। না। ঠিক উল্টো। সেখানে গিয়েও তো একই দশা। সেই সবারই- মা। তবে কষ্ট পেত নিজের ছেলেমেয়েগুলোকেও যখন অন্যদের সঙ্গে বসে জোলো ডাল আর কাঁকড়ে ভরা ভাত খেতে হতো। আর বোলপুরে তো খুব গরম। শিলাইদহের সঙ্গে বোলপুরের তুলনাই চলে না। কেন যে তখন মাথায় শান্তিনিকেতনের ভুত মাথায় চাপল। খুব কষ্ট গেছে। শারীরিক, মানসিক আর আর্থিক। 

কেন, আর্থিক কেন? জমিদারির টাকায়... 

না, বউমা। শান্তিনিকেতন আমার শখ, আমার স্বপ্ন। আমি কেন বংশের জমিদারির টাকা নেবো। ফলে খুব টানাটানির মধ্যে সংসার চলত। কি বলবো, কি লজ্জার কথা। শেষে ছোটোবউয়ের গয়নাগাটি বন্ধক রাখতে পর্যন্তহলো! কবি চুপ করে রইলেন। 

হেমলতাও চুপ করে রইলেন। 

কবি আবার বলতে শুরু করলেন। এত অভাব, তবু আনন্দ ছিল। জানো? কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা অন্যরকম। মাত্র দেড় বছরই ওখানে কাটাতে পারল। তারপর তো ..... 

কি হয়েছিল? 

কি জানি। তখন তো কিছু বুঝতেই পারিনি। এখন ডাক্তারেরা শুনে বলে অ্যাপেনডিসাইটিসের প্রবলেম হয়েছিল। সাইলেন্ট বার্স্ট করেছিল। হতেও পারে। প্রথম প্রথম তো বলত - তলপেটে বড্ড ব্যথা। শেষে আর কিছু বলতে পারত না। নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল, কথা বন্ধ হয়ে গেল। কেবলই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতো। আর দুচোখ দিয়ে খালি জলের ধারা গড়িয়ে পড়ত। 

দাদামশাই। আমি কোথায় যেন শুনেছিলাম শেষ শয্যায় আপনি নাকি টানা একমাস ওনার সেবা করছিলেন? 

হ্যাঁ। নার্স আয়া সবই ছিল। কিন্তু আমার ওকে সেবা করতে খুব ভাল লাগত। আমি ওর পাশে থাকলে একটু যেন শান্তি পেত। বুঝতে পারছিলাম যে ও চলে যাবে। তাই যতটা পারি ওকে ছুঁয়ে বসে থাকতাম। তারপর একদিন...। চুপ করে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। 

আবার অনেকক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলেন। তারপর হেমলতাই নীরবতা ভাঙলেন। দাদামশাই, আরেকটা কথা জিগ্যেস করবো। রাগ করবেন না, তো? 

না না। রাগ করবো কেন? তুমি বলো। 

দাদামশাই, আপনি আবার বিয়ে করলেন না কেন? আপনার এত সুন্দর চেহারা, তখন অত অল্প বয়স। ঘরে ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে। 

কবি সোজা হয়ে বসলেন। 

হয়ত উচিত ছিল, জানো? অনেক সম্বন্ধও এসেছিল। আমার দাদা বৌদিরা অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি। কোথায় আর আমি এমনটি পেতাম, বলো তো? কে এমন করে আমার জীবনটা ভরিয়ে রাখত? কে আর আমায় এমন করে - 'এই শুনছ' - বোলতো? তাই আর... 

হেমলতা চুপ করে রইলেন। চোখদুটো তার জলে ভরে এল।

0 comments: