0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়


সেই কবে বনওয়ারী বলে গেছে, 'বছর পার হয়েছে, তাতে দণ্ডকাল ফুরায় নাই...'

ঠিকই তো! মানুষের তৈরি নিয়মে বছরের শেষ মাস। তাতে কালের কি বা এসে যায়! কাল চলেছে কালের নিয়মে। কান পাতলেই শোনা যায় তার যাত্রা ধ্বনি। 

বহুকাল পরে এই ডিসেম্বরের মাঝামাঝি কলকাতার তাপমাত্রা নেমেছে ১৫ডিগ্রীর নিচে, তাও একটানা নয়, কখনও সখনও। তাতেই নাকি বাঙালি 'যুবুথুবু'। 

তা ভালো। উপভোগ করুন জয়নগরের মোয়া, নাগপুরের টক কমলালেবু, নলেনগুড়ের সন্দেশ। শাল কিনুন কাশ্মীরি শালওয়ালার কাছ থেকে। একটা উপলক্ষ্য তবু পাওয়া গেছে। 

দেখা হবে আবার নতুন বছরে।

সুস্থ থাকুন, সৃষ্টিতে থাকুন, আনন্দে থাকুন

শুভেচ্ছা নিরন্তর




0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - মনোজ কর

Posted in

প্রচ্ছদ নিবন্ধ


সমাজ প্রসঙ্গে 
মনোজ কর


শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের দ্বারা চালিত যে সমাজ দর্শনের কথা কার্ল মার্ক্স বলেছেন তাঁর ঐতিহাসিক এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্ত্তুবাদের ভিত্তিতে, আধ্যাত্মিক চিন্তার ভিত্তিতেও সেই একই সত্যের সন্ধান পেয়েছেন স্বামীজি। এই প্রবন্ধে সে কথাই বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। 

আমাদের ছোটবেলায় সমাজ বলতে আমরা বুঝতাম আত্মীয় পরিজন, বন্ধু বান্ধব এবং প্রতিবেশী বা খুব বেশী হলে শহরের যে অংশে আমরা থাকতাম সেখানকার অধিবাসীদের। বাবা শিক্ষক এবং জ্যাঠামশাই ডাক্তার হওয়ার সুবাদে আমাদের পরিচিতির গন্ডী বা সমাজ একটু বিস্তৃত ছিল। শ্রেণীগত হিসাবে আমরা ছিলাম মধ্যবিত্ত। শহুরে সমাজ মূলতঃ তিনটি অর্থনৈতিক শ্রেণীতে বিভক্ত। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত। অনেকে এই তিনটি শ্রেণীর প্রত্যেকটিকে আবার দুভাগে বিভক্ত করেন, যেমন উচ্চ মধ্যবিত্ত , নিম্ন মধ্যবিত্ত ইত্যাদি । যাই হোক এক্ষেত্রে আমার আলোচনা মূল তিনটি শ্রেণীতেই সীমাবদ্ধ রাখব। বলা যেতে পারে যে পরিচিত গন্ডীর মধ্যে আমাদের প্রতিদিনকার গতায়াত সেই গণ্ডির প্রত্যেকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত। এই শ্রেণীর মানুষেরা সাধারণত চাকুরিজীবি বা কোনো পেশাগত বৃত্তিতে নিযুক্ত। ছোট বা মাঝারি মাপের ব্যবসাজীবিরাও এই শ্রেণীর মধ্যে পড়ে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। এই শ্রেণীর মানুষেরা নিম্নবিত্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এদের অনেকেই বিগত বা বর্তমান প্রজন্মের পূর্ববর্তী সময়ে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত ছিলেন। কঠিন জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে এঁরা নিজেদের এই শ্রেণীতে উন্নীত করেছেন। আবার অনেকে হয়ত কয়েক প্রজন্ম ধরে এই শ্রেণীতেই অবস্থান করছেন।এই শ্রেণীভুক্ত মানুষেরা মেহনতি মানুষদের সরাসরি শোষণ করে মুনাফা অর্জন করেন না কিন্তু অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এই শোষণ প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেন।মধ্যবিত্তদের স্বাভাবিক প্রবণতা উচ্চবিত্ত হওয়ার প্রতি। সমস্ত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের জীবনসংগ্রামের মূল লক্ষ্য অধিক অর্থ উপার্জন এবং অধিকতর বিত্তশালী সম্প্রদায় বা উচ্চবিত্ত শ্রেণীভুক্ত হওয়া। স্কুলজীবনের প্রায় শেষ অবধি এটাই ছিল আমার সমাজ সম্পর্কিত ধারণা। 

কলেজে গিয়ে হাতে পেলাম সমাজ দর্শন এবং সমাজ বিজ্ঞান সংক্রান্ত নানান বই। পরিচয় হল মার্ক্সীয় দর্শনে সুপণ্ডিত কয়েকজন সিনিয়র দাদাদের সাথে। সমাজ সম্বন্ধে ধারণা পরিবর্তিত হতে থাকল। সমাজ কে অনেক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বুঝতে শুরু করলাম। অনুধাবন করলাম যে কোনো সমাজের ভিত্তি হল তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলতে প্রধানতঃ উৎপাদন ব্যবস্থাকে বোঝায়। উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই সমাজ পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনই সমাজ বিকাশের মূল কারণ। উৎপাদন ব্যবস্থার উপাদান দুটি। প্রথম উৎপাদিকা শক্তি বা উৎপাদন করার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী অর্থাৎ জমি, যন্ত্রপাতি, প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা , কারিগরি জ্ঞান ইত্যাদি। দ্বিতীয় উৎপাদন সম্পর্ক অর্থাৎ কোনো একটি বিশেষ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সমাজে বিভিন্ন মানুষের ভূমিকা। কোনো উৎপাদন প্রক্রিয়াতেই মানুষ একক ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাকে সমাজবদ্ধভাবেই অংশগ্রহণ করতে হয়। বিভিন্ন মানুষের ভূমিকা যেমন ভিন্ন তেমনি কিছু মানুষ অন্য মানুষের শ্রমের ফল ভোগ করে। কিছু মানুষের হাতে উৎপাদন সামগ্রীর মালিকানা থাকে আবার কেউ বা শুধুই শ্রম দেয়। উৎপাদিকা শক্তির বিবর্তন বা পরিবর্তনের সাথে উৎপাদন সম্পর্কেরও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই সমাজ পরিবর্তন হয়। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন সমাজ পরিবর্তন নিজের থেকে ঘটে না। সমাজ পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবের প্রয়োজন হয়। একটি সমাজের মধ্যেই পরবর্তী সমাজের অংকুর সৃষ্টি হয়। পুরাতন সমাজের মধ্যেই প্রথমে পরিবর্তন হয় উৎপাদিকা শক্তির। তারপর একটা স্তরে উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব খুবই প্রকট হয়ে ওঠে। তখন উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়। উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বই সমাজ বিকাশের মূল কারণ। 

আগেই বলেছি উৎপাদন সম্পর্ক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা যতই অনুভূত হোক না কেন, তা আপনি পরিবর্তিত হয় না। প্রগতিশীল শ্রেণীগুলি অর্থাৎ যে শ্রেণীগুলি সমাজ পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করে তারা প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীগুলিকে অর্থাৎ যারা ব্যক্তিগত স্বার্থে পুরনো উৎপাদন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায় তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করে নিজেরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নতুন উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করে এবং সঙ্গে সঙ্গে নতুন আর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে তৈরী করে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি অর্থাৎ উপরিকাঠামো। সমাজের আসল পরিবর্তন আসে শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে যার চূড়ান্ত রূপ হল বিপ্লব। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটে রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে শ্রেণী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। 

ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমাজ বিকাশের ইতিহাসকে নতুনভাবে এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে শিখিয়েছে। সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা কি রকম, সেই ভিত্তিতে মানব সমাজের ইতিহাসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়- (১) আদিম সাম্যবাদী যুগ, (২) দাস যুগ, (৩) সামন্ত যুগ, (৪) পুঁজিবাদী যুগ, (৫) সমাজতান্ত্রিক যুগ, (৬) সাম্যবাদী যুগ (ভবিষ্যতে আসবে) । 

আদিম সাম্যবাদী যুগে উৎপাদন ছিল অতি অনুন্নত। পশু শিকার ও বন থেকে ফলমূল সংগ্রহ। উৎপাদিকা শক্তি অতি অনুন্নত, পাথরের হাতিয়ার ইত্যাদি। সকল পুরুষ একত্রে পশু শিকার করত, মেয়েরা ঘরে কাজ করত এবং সকলে একত্রে সমানভাবে শিকার ভাগ করে খেত। এই অবস্থায় সঞ্চয় সম্ভব ছিল না। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। শ্রেণী ও রাষ্ট্র ছিল না। নারী ও পুরুষের সমান মর্যাদা ছিল। সেই সময় উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের ঐ স্তরে এই ধরণের উৎপাদন সম্পর্কই স্বাভাবিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। 

কালক্রমে মানুষ অধিকতর উন্নত উৎপাদন করতে শিখল। কিছু কৃষি কাজ ও পশু পালন করতে শিখল। অর্থাৎ উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটল। এই অবস্থায় এল নতুন উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন উৎপাদন সম্পর্ক। মুষ্টিমেয় প্রভুরা সকল উৎপাদন যন্ত্র ও উৎপাদিত দ্রব্যের মালিক। কিন্তু তারা শ্রম প্রয়োগ করে না। প্রকৃত উৎপাদন করে দাসেরা। আদিম সাম্যবাদী যুগেও গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে যুদ্ধ হত, কিন্তু যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হত অথবা মেরে ফেলা হত অথবা নিজেদের গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত করে নেয়া হত। তখন দাস করার কোন প্রয়োজন বা অবস্থাও ছিল না। পরবর্তী যুগে অধিকতর উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের স্তরেই এই দাস ব্যবস্থা এসেছে।এই দাস যুগের শুরুতে সমাজে কয়েকটি নতুন উপাদান দেখা দিল ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রেণী, শোষণ, শ্রেণী সংগ্রাম ও রাষ্ট্র। নারীও এই সময় পুরুষের পদানত হল। উন্নততর উৎপাদিকা শক্তির যুগে ও অধিকতর উৎপাদনের যুগে সঞ্চয় সম্ভব হল। তাই এল ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাধিকার প্রথা। একই সঙ্গে দেখা দিল শ্রেণী বিভাগ, প্রভু ও দাস। আদিম সাম্যবাদী যুগেও পুরুষ নারীর চেয়ে বলশালী ছিল। কিন্তু পুরুষ নারীর উপর কর্তৃত্ব করত না। গৃহকার্যে বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলার নেতৃত্ব স্বেচ্ছায় মেনে নিত। শ্রেণী বৈষম্যের যুগে উত্তরাধিকার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে নারীর উপর নানারকম বিধি-নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ দেখা দিল। নারী পুরুষের পদানত হল। 

দাসযুগে সম্পত্তির পরিমাণ ও সামাজিক প্রতিপত্তি নির্ধারিত হতো দাসের সংখ্যা দ্বারা। দাসরা নিশ্চয়ই স্বেচ্ছায় শোষণ মেনে নিতে রাজী হয় নি। শ্রেণী শোষণ যেখানে থাকবে, শ্রেণী সংগ্রামও সেখানে থাকবে। শোষিত শ্রেণীকে দমন করে রাখার জন্য, শোষক শ্রেণী বিভিন্ন ব্যবস্থার প্রবর্তন করে, তার মধ্যে আছে সেনাবাহিনী, প্রশাসন ব্যবস্থা, কয়েদখানা, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি। এগুলি মিলেই হচ্ছে রাষ্ট্র। 
পরবর্তীকালে সামন্তযুগে কৃষি উৎপাদনের জন্য উন্নততর যন্ত্র ও কৌশল মানুষ আবিষ্কার ও আয়ত্ত করে। এই উন্নততর কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে দাস উৎপাদন সম্পর্ক সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ, কিছুটা স্বাধীনতা ও অধিকার না দিলে ক্রীতদাস দিয়ে এই উন্নততর উৎপাদন পদ্ধতিকে কাজে লাগানো যায় না। এই অবস্থায় দাস প্রথার বিলোপের পক্ষে এসে দাঁড়ালো একদিকে দাসেরা ও অপরদিকে স্বাধীন কিছু নাগরিক। এরা প্রগতিশীল শ্রেণী। কিন্তু দাসের মালিকরা সমাজের সামগ্রিক উৎপাদন ও উন্নতির কথা না ভেবে দাস প্রথা টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতি ছিল। এরা প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী। তবে দাস ব্যবস্থা অসংখ্য দাস বিদ্রোহের জন্য ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে দাস প্রথা উঠে যায় এবং আরম্ভ হয় সামন্ত ব্যবস্থার যুগ। 

পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সামন্ত ব্যবস্থা বিভিন্নরূপ নিয়েছে। আবার সামন্ত ব্যবস্থাও কালক্রমে বহু পরিবর্তিত হয়েছে। এই ব্যবস্থায় উৎপাদনের প্রধান উপাদান জমি ভুস্বামী বা সামন্ত প্রভুর দখলে। প্রকৃত উৎপাদন করে কৃষক বা ভূমিদাস। কৃষক শ্রম প্রয়োগ করে ও উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ জোগাড় করে উৎপাদন করে। কৃষক উৎপাদিত ফসলের মালিক, কিন্তু উৎপাদিত ফসলের বিশেষ অংশ অথবা নির্দিষ্ট অংকের অর্থ খাজনা হিসাবে জমির মালিককে দিতে বাধ্য। ভূমিদাস ব্যবস্থায় ভূস্বামী ভূমিদাসের জীবন ধারণের জন্য সামান্য কিছু জমি দিয়ে দিত, কিন্তু ভূমিদাসকে বেশীর ভাগ সময় ভূস্বামীর জমিতে বেগার খাটতে হত। ভূমিদাসরা জমি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারত না। ভূমিদাসরা দাসদের চেয়ে কিছুটা উন্নত ও স্বাধীন। ভূমিদাস প্রথার মূল কথা বেগার শ্রম। আর অন্য ধরনের জমিদারী প্রথার মূল কথা খাজনা। সামন্ত সমাজে সম্পত্তির পরিমাণ ও সামাজিক প্রতিপত্তি নির্ধারিত হয় জমির পরিমাণ দ্বারা। 

সামন্ত সমাজের গর্ভেই পুঁজিবাদী সমাজের জন্ম হয় এবং যান্ত্রিক শিল্পের উদ্ভব হয়। বহু বিস্তৃত পণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়। যে ব্যবসায়ী শ্রেণী পণ্যের বাজারকে বিস্তৃত করে তাদের বলা হয় বুর্জোয়া। সামন্ত ব্যবস্থা থাকলে বিভিন্ন কারণে এই উন্নততর যান্ত্রিক শিল্প কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছিল না। বুর্জোয়া শ্রেণী সামন্ত উৎপাদন সম্পর্ক খতম করার জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠে। এ ছাড়া ভূমিদাস ও কৃষকরাও ইতিপূর্বে সামন্তদের শোষণের বিরুদ্ধে বহুবার বিদ্রোহ করে আসছিল। বুর্জোয়ারা কয়েকটি কারণে সামন্ত ব্যবস্থাকে আধুনিক যন্ত্রশিল্পভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশের পথে বাধা হিসাবে দেখছিল। 

প্রথমত সামন্ত ব্যবস্থায় বেশীর ভাগ মানুষ কৃষক ও ভূমিদাস এবং এদের ক্রয় ক্ষমতা এত নীচে থাকে যে, পণ্যের বাজার বিস্তৃত হতে পারে না। আর আধুনিক যন্ত্র শিল্প যে লক্ষ লক্ষ পণ্য তৈরী করে তার ক্রেতা তো সাধারণ মানুষই হবে, মুষ্টিমেয় ভূস্বামী নয়। দ্বিতীয়ত সামন্ত শ্রেণী কর্তৃক ধার্য কর ও অন্যান্য বাধা-নিষেধ বুর্জোয়ার বিকাশের পক্ষে বাধা হচ্ছিল। তৃতীয়ত ভূমিদাস প্রথা থাকলে কারখানার জন্য ‘স্বাধীন শ্রমিক’ পাওয়া যাবেনা। বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে কৃষক, ভূমিদাস ও অন্যান্য গরীব শ্রেণীগুলি সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে বিপ্লবে এগিয়ে আসে। এটাই বুর্জোয়া বিপ্লব। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামন্ত সমাজের অবসান ঘটেছে, গড়ে উঠেছে পুঁজিবাদী সমাজ। 

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিপতি অর্থ বিনিয়োগ করে কারখানা প্রতিষ্ঠা করে, কাঁচামাল জোগাড় করে, তারপর শ্রমিক নিয়োগ করে উৎপাদন করায়। উৎপাদিত দ্রব্য পুঁজিপতি বাজারে বিক্রি করে মুনাফা উঠিয়ে নিয়ে আসে। ‘স্বাধীন শ্রমিক’ নির্দিষ্ট বেতনে চাকুরি করে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শ্রমিক তার শ্রম শক্তি বিক্রি করে। প্রকৃত উৎপাদন করে শ্রমিক, কিন্তু উৎপাদনের পরিকল্পনা বা পরিচালনা করার দায়িত্ব তার নয়, পুঁজিপতির। উৎপাদিত দ্রব্যের মালিকও পুঁজিপতি। পুঁজিপতি বাজারে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে মুনাফা তুলে আনে। আসলে মুনাফা সৃষ্টি হয় উৎপাদনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই অর্থাৎ শ্রমিককে শোষণ করেই। শ্রমিক যে শ্রম প্রয়োগ করে, তার পুরো মূল্য সে পায় না। পুঁজিপতি শ্রমিকের শ্রম শক্তি ক্রয় করে, কিন্তু প্রদত্ত শ্রমের পুরো মূল্য সে শ্রমিককে দেয় না। পুঁজিপতি শ্রমিকের শ্রম শক্তি ক্রয় করে সস্তায়। এইখানেই সে ঠকায় শ্রমিককে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শোষণের মূল কথা হল এটাই। 

এখানে একজন পুঁজিপতির সঙ্গে সামন্ত প্রভুর পার্থক্য লক্ষ্যনীয় । পুঁজিপতি ও সামন্ত প্রভু উভয়ই শোষক এবং কেউই প্রকৃত উৎপাদন করে না। তবে পুঁজিপতি উৎপাদন পরিচালনা করে এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করে তাকে মুনাফা তুলে আনতে হয়। সামন্ত প্রভু উৎপাদনের ব্যাপারে কোন দায়িত্বই নেয় না। কৃষককেই উৎপাদনের সকল দায়িত্ব নিতে হয় (ভূমিদাসের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন) । জমিদার কেবল উৎপাদিত ফসলের উপর তার ভাগ বসায়। পুঁজিবাদী সমাজে সম্পত্তির পরিমাণ ও সামাজিক প্রতিপত্তি নির্ধারিত হয় টাকার অংকের দ্বারা। 

পুঁজিবাদ তার প্রথম যুগে উৎপাদনকে ও উৎপাদিকা শক্তিকে বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু একটা পর্যায়ে দেখা গেল পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদনকে আর বাড়াতে পারছে না, উৎপাদিকা শক্তিকেও আর কাজে লাগাতে পারছে না, তার বিকাশের সম্ভাবনাকেও রুদ্ধ করে দিচ্ছে। 

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উন্নততর স্তরে অতি উৎপাদনের সংকট দেখা যায়। ‘অতি উৎপাদন’ আসলে সঠিক নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিভিন্ন পুঁজিপতিরা মুনাফা তাগিদে নিজ নিজ হিসাব অনুযায়ী উৎপাদন করায়। সমাজের প্রকৃত প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনা মাফিক কোন উৎপাদন হয় না। ফলে মাঝে মাঝে দেখা যায়, উৎপাদিত পণ্যের বাজার নেই। চাহিদা নিশ্চয়ই আছে, নেই ক্রেতা সাধারণের ক্রয় ক্ষমতা। এই অবস্থায় পণ্য অবিক্রিত অবস্থায় থাকে, পুঁজিপতিরা ভবিষ্যতে বাজারদর বৃদ্ধি পাবে এই আশায় তাদের মাল নষ্ট করে ফেলে, কল-কারখানাও বন্ধ করে দেয়। এটা সমাজের সম্পদের অপচয়। এতে এটা প্রমাণ করে যে, উৎপাদিকা শক্তিকে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক আর কাজে লাগাতে পারছে না। কেন? কারণ, এই উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে যে বিষয়টি তা হল, উৎপাদন যন্ত্রের মালিক ব্যক্তি বিশেষ যার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র মুনাফা, সমাজের চাহিদা পূরণ নয়। এই অবস্থায় উৎপাদন যন্ত্রের উপর ব্যক্তি মালিকানার বদলে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলে সামাজিক সম্পদ ও শক্তির এই অপচয় হত না, উৎপাদিকা শক্তিকেও মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী পুরোপুরি কাজে লাগানো যেত। তাহলে পুঁজিবাদের একটা স্তরে উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। এখন ব্যক্তি মালিকানার বদলে সমাজতান্ত্রিক মালিকানার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। নতুন উৎপাদন সম্পর্ক অর্থাৎ উৎপাদন যন্ত্রের উপর সামাজিক মালিকানা ভিত্তিক উৎপাদন সম্পর্কই (এটাই সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক) হচ্ছে অধিকতর উন্নত উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে সবচেয়ে সঙ্গতিপূর্ণ। 

পুঁজিবাদী উৎপাদনের একটা স্তরে বেশীর ভাগ শিল্প, পুঁজি ও ব্যবসা মাত্র কয়েকজন পুঁজিপতির হাতে চলে আসে। একে বলে একচেটিয়াত্ব। এই অবস্থা পুঁজিপতিদের জন্য নিজেদের মধ্যে আগের মতো অবাধ প্রতিযোগিতা থাকে না। ফলে অধিকতর উৎপাদন, উন্নততর উৎপাদন এবং তারই প্রয়োজনে টেকনোলজির বিকাশ ও বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য পুঁজিপতিদের এক সময় যে আগ্রহ ছিল, এখন আর সে তাগিদ থাকছে না। কারণ তাদের উদ্দেশ্য কেবলমাত্র সর্বোচ্চ মুনাফা আদায়, অন্য কিছু নয়। ফলে এই অবস্থায় পুঁজিবাদ উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের জন্য আগ্রহী তো থাকেই না, বরং অনেক ক্ষেত্রেই তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে ব্যক্তি মালিকানার বদলে সামাজিক মালিকানা ভিত্তিক নতুন উৎপাদন সম্পর্কই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের পক্ষে সহায়ক হবে। 

কিন্তু পুঁজিপতিশ্রেণী নিশ্চয়ই নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে নতুন উৎপাদন সম্পর্কের পক্ষে দাঁড়াবে না। এই নতুন উৎপাদন সম্পর্কের পক্ষে দাঁড়িয়ে লড়ে শ্রমিকশ্রেণী। পুঁজিবাদ তার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত আরও বড় বড় কারখানা তৈরী করতে বাধ্য হয়। আর এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই ক্রমেই বেড়ে ওঠে, একত্রিত ও সংগঠিত হয় পুঁজিপতির বিরুদ্ধ শক্তি শ্রমিক শ্রেণী। পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতির সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রাম চলে। চূড়ান্ত পর্যায়ে শ্রমিকশ্রেণী পুঁজিপতিশ্রেণীকে ক্ষমতাচ্যুত করে ব্যক্তি মালিকানার বদলে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করে। এটাই সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রে শ্রেণী শোষণ নেই, ব্যক্তিগত সম্পত্তিও নেই। নিজস্ব ব্যবহারের জন্য পার্সোনাল প্রপার্টি আছে, কিন্তু কারো মালিকানায় এমন কোন সম্পত্তি (প্রাইভেট প্রপার্টি) নেই যার দ্বারা অপরকে শোষণ করে মুনাফা আদায় করা যায়। অর্থাৎ উৎপাদন যন্ত্রের উপর ব্যক্তি মালিকানা নেই। এই সমাজে সকলেই সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে। এবং প্রত্যেকে তার শ্রম ও যোগ্যতা অনুযায়ী নির্দিষ্ট মজুরী পায়। 

শ্রমিকশ্রেণী পুঁজিপতিশ্রেণীকে ক্ষমতাচ্যুত করে পুরাতন রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে ফেলে এবং শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। সমাজতান্ত্রিক সমাজেও রাষ্ট্র থাকে, কিন্তু আগের তিন যুগের (দাস, সামন্ত ও পুঁজিবাদী) সঙ্গে পার্থক্য এই যে, এই রাষ্ট্র আর শোষক শ্রেণীর হাতিয়ার নয়। এটা শ্রমিকশ্রেণীর হাতিয়ার, তা ব্যবহৃত হয় নিজ দেশের পরাজিত পুঁজিপতিশ্রেণীর প্রতিরোধ প্রচেষ্টা ঠেকানো অথবা অন্যদেশের বুর্জোয়াদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য। 

সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক ক্রমাগত উৎপাদিকা শক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। সুদূর ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন উৎপাদন এত বিপুল হবে যে সেই অবস্থায় এ নীতি কার্যকরী হবে, ‘প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে, আর প্রত্যেকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী ভোগ করবে’। এই সমাজই সাম্যবাদী সমাজ। এই হচ্ছে শ্রেণীহীন সমাজ। এই সমাজে রাষ্ট্র থাকবে না। সমাজতন্ত্রের অগ্রগতির সাথে সাথে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। এইভাবে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। 

এই প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। 

পৃথিবীতে সব জায়গায় একই সঙ্গে একই ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থা শুরু হয় নি। যেমন আজকের পৃথিবীতে কোথাও সমাজতান্ত্রিক সমাজ, কোথাও পুঁজিবাদী সমাজ আবার কোথাও বা আরও পিছনের কোন সমাজ বর্তমান রয়েছে। কোন দেশে একই সঙ্গে দুই বা ততোধিক উৎপাদন ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে যে ব্যবস্থাটি প্রধান তার দ্বারা সেই সমাজকে চিহ্নিত করা হয়। 

কোন সমাজই স্থায়ী নয়। প্রত্যেকটি সমাজের অভ্যুদয়, বিকাশ ও পতন (বা অন্য উন্নততর সমাজে রূপান্তর) আছে। সমাজ বিকাশের মূল কারণ নিহিত আছে উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্যে। উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে প্রথম পরিবর্তন আসে উৎপাদিকা শক্তির। তারপর নতুন উৎপাদন সম্পর্কের প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই ঘটনাটি ঘটে মানুষের সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়াই এবং কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেণীর ইচ্ছা নিরপেক্ষভাবে। এই কারণে জন্ম নেয় শ্রেণীসংগ্রাম। শ্রেণীসংগ্রাম প্রতিটি শ্রেণীবিভক্ত সমাজে থাকবেই। এটাই আসলে সমাজ বিকাশের মূল চালিকা শক্তি। শ্রেণীসংগ্রামের পরিণতি বিপ্লবে। বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজের গুণগত পরিবর্তন হয়, নতুন উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। 

একটি সমাজের ভিত্তি তার অর্থনীতি। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন দ্বারাই সমাজ পরিবর্তিত হয়, পরিবর্তন হয় তার উপরিকাঠামো অর্থাৎ রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি এটা যেমন সত্য, তেমনই উপরিকাঠামোও যে ভিত্তিতে প্রভাবিত করে, তাও সত্য। ভিত্তি ও উপরিকাঠামোর মধ্যে সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক। যেমন, উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বই আপনাআপনি উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে না। উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধিত হয় রাজনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে। বিপ্লবের দ্বারা প্রথমে রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, পরিবর্তন হয় রাষ্ট্র ব্যবস্থায়। তারপর উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন (যা ইতিমধ্যেই অনিবার্য ও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে) আনা হয়। উৎপাদন ব্যবস্থার এই পরিবর্তন সমাজের অন্যান্য দিকে সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রবলভাবে প্রভাব ফেলে এবং সেই সব ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে। বিষযটি বুঝতে হলে শ্রেণী, রাষ্ট্র ও বিপ্লব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়োজন। 

শ্রেণী: নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুগে নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থায় যে জনসমষ্টি উৎপাদন যন্ত্রের (উপায়ের) সঙ্গে একই রকম সম্পর্কে থাকে তারা একটা শ্রেণী। মানব সভ্যতার ইতিহাসে তিনটি শ্রেণী বিভক্ত যুগ দেখতে পাওয়া যায়-দাস, সামন্ত ও পুঁজিবাদী যুগ। প্রত্যেক যুগে দুটি প্রধান শ্রেণী আছে। একটি শোষক, অপরটি শোষিত। দাস যুগে দাস মালিক ও দাস, সামন্ত যুগে সামন্ত প্রভু ও কৃষক বা ভূমিদাস, পুঁজিবাদী যুগে পুঁজিপতি ও শ্রমিক। প্রত্যেক যুগে প্রধান দুটি শ্রেণীর মধ্যবর্তী আরও কিছু শ্রেণী থাকে, যেমন আজ পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় পেটি বুর্জোয়া। 

একমাত্র আদিম সাম্যবাদী সমাজ ও ভবিষ্যতের সাম্যবাদী সমাজ বাদ দিলে প্রত্যেক যুগে সমাজের কোন না কোন শ্রেণী অধিপতি শ্রেণী হয়। তারাই হয় শাসকশ্রেণী। রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি সেই শ্রেণীর স্বার্থানুযায়ী তৈরী হয়। দাস সমাজে দাস মালিক, সামন্ত সমাজে সামন্ত প্রভু, পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতিশ্রেণী এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রমিকশ্রেণী অধিপতি ও শাসক শ্রেণী। যে কোন সংস্কৃতি দর্শন, সামাজিক রীতিনীতি বিশেষ যুগের চিহ্ন ও বিশেষ শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে। 

শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শ্রেণী সংগ্রাম থাকবেই। শ্রেণী সংগ্রাম পরিণতি লাভ করে বিপ্লবে। শ্রেণী সংগ্রাম কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বা রাজনৈতিক অঙ্গনে চলে, তাই নয়। উপরিকাঠামোর বিভিন্ন জায়গায়ও শ্রেণী সংগ্রাম চলে। একটি সমাজে সংস্কৃতি বা সামাজিক রীতিনীতির প্রধান অংশ ঐ সমাজে অধিপতি শ্রেণীর স্বার্থের প্রতিফলন ঘটায়। কিন্তু সেখানেও বিরুদ্ধ শ্রেণীর সংস্কৃতি বা বিরুদ্ধ শ্রেণীর (শোষিত শ্রেণীর) চিন্তাভাবনার পরিচয় বা ছাপ পাওয়া যায়। 

রাষ্ট্র:আদিম সাম্যবাদী সমাজের পর যখন প্রথম শ্রেণী বিভক্ত সমাজের উদ্ভব তখনই রাষ্ট্রের জন্ম। রাষ্ট্র এমন একটা ব্যবস্থা যার দ্বারা শোষিত শ্রেণীকে দমন করে রাখা হয়। এর প্রধান অঙ্গ পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং প্রশাসন ব্যবস্থা। বিচার বিভাগ, আইন ইত্যাদিও এর অন্তর্ভূক্ত। দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজ এই তিন সমাজে শোষণের পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন এবং রাষ্ট্রের রূপও ভিন্ন ভিন্ন। যেমন সামন্ত যুগে রাজতন্ত্র ছিল রাষ্ট্রের প্রধান চেহারা, পুঁজিবাদী যুগে রাজতন্ত্রের জায়গা দখল করেছে বুর্জোয়া গণতন্ত্র। তবে সকল যুগেই সকল সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য একই, তা হল এই যে, রাষ্ট্র হচ্ছে দমন-পীড়নের যন্ত্র। 

বিপ্লবের মাধ্যমে বিপ্লবীশ্রেণী পুরাতন রাষ্ট্র কাঠামোকে পরিবর্তন করে নিজের শ্রেণী স্বার্থ অনুযায়ী নতুনভাবে রাষ্ট্র কাঠামো তৈরী করে। যতদিন যাচ্ছে রাষ্ট্রের কাঠামো তত জটিল হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যেকটি শ্রেণী বিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র হচ্ছে শোষকশ্রেণীর শোষণ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার প্রধান হাতিয়ার। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হল গুণগতভাবে ভিন্ন চরিত্রের। এখানেও রাষ্ট্র দমন করার জন্যই লাগে। কিন্তু তা শোষণের হাতিয়ার নয়। শ্রমিকশ্রেণী পুরাতন রাষ্ট্র ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে তার নিজস্ব স্বার্থানুযায়ী একেবারে নতুন ধরনের রাষ্ট্রযন্ত্র তৈরী করে যার রাজনৈতিক রূপ হচ্ছে সর্বহারার একনায়কত্ব। 

বিপ্লব:সামাজিক বিপ্লব বলতে বোঝায় সমাজের গুণগত পরিবর্তন অর্থাৎ এক সমাজ থেকে আরেক সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তর অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন। উৎপাদন সম্পর্কের কোন পরিবর্তন হল না, কিন্তু কেবলমাত্র সরকার পরিবর্তন হল (তা যদি জনগণের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়েও হয়) তবে তাকে বিপ্লব বলা যায় না। সমাজ প্রতিদিনই কিছু কিছু করে পরিবর্তিত হচ্ছে। উৎপাদিকা শক্তির কিছু না কিছু বিকাশ হচ্ছে। এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব পড়ছে। ক্রমাগত নতুন উৎপাদন সম্পর্কের তাগিদ জাগছে জনগণের একটা বিরাট অংশের মধ্যে। শোষিত ও নির্যাতিত শ্রেণীগুলির সঙ্গে শাসক ও শোষকশ্রেণীর দ্বন্দ্ব ক্রমাগত বাড়ছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য অঙ্গনে শ্রেণীসংগ্রাম বিকাশ লাভ করছে। শোষিত ও নির্যাতিত শ্রেণীগুলির মধ্যে শ্রেণী চেতনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ গুলি হচ্ছে সমাজের পরিমাণগত পরিবর্তন। এ পরিবর্তন প্রতিদিনই হচ্ছে, কিন্তু এত সামান্য যে তা চোখে ধরা পড়ে না। শেষে একটা পর্যায়ে পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয়, যখন শোষিত শ্রেণীগুলি ক্ষমতাসীন শ্রেণীকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এটাই বিপ্লব। 

বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন শ্রেণী রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে এবং তারপরে সেই শ্রেণী প্রথমে রাষ্ট্রকে নিজের স্বার্থানুযায়ী তৈরী করে এবং একই সঙ্গে পুরাতন উৎপাদন সম্পর্ক বাতিল করে নতুন উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করে। তাহলে যে কোন ধরনের সরকার পরিবর্তন বা যে কোন ধরনের বিদ্রোহ তা যত মহৎ হোক না কেন (এমনকি তা যদি গণবিস্ফোরণ বা গণঅভ্যুত্থানও হয়), তাকে বিপ্লব বলা যাবে না। 

বিপ্লবে দুটি জিনিস থাকতে হবে- ১) রাষ্ট্র ক্ষমতায় নতুন শ্রেণীর অবস্থান নেয়া এবং সেই শ্রেণীর স্বার্থানুযায়ী নতুন রাষ্ট্রকাঠামো তৈরী হওয়া, ২) উৎপাদন ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন।যেহেতু, বিপ্লব মানে নতুন শ্রেণীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল (সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে এই শ্রেণী হল শ্রমিকশ্রেণী), অতএব বিপ্লব হবে সশস্ত্র। কারণ, রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গই হচ্ছে সশস্ত্রবাহিনী। হয় এই বাহিনীকে পরাজিত করতে হবে, অথবা সশস্ত্র বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যকে দলত্যাগ করে বিপ্লবের পক্ষে যোগদান করতে হবে, অন্যথায় বিপ্লব জয়যুক্ত হতে পারে না। 

বিপ্লব মানে ক্ষমতাসীন শোষকশ্রেণীকে পরাজিত করে ক্ষমতা বহির্ভূত শোষিত ও নির্যাতিত শ্রেণীর বা শ্রেণীসমূহের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল। অতএব, বিপ্লব মানে গণবিপ্লব। এতে অবশ্যই ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। নির্বাচন বা সাধারণ ক্যু’র মাধ্যমে কখনও বিপ্লবের কাজ সম্পন্ন হতে পারে না। 

এই হলো মার্ক্সীয় দর্শন এবং ঐতিহাসিক ও দ্বন্দ্বমূলক বস্ত্তুবাদের আলোকে সমাজ বিকাশ সম্পর্কে আমার শিক্ষা। 

এবারে আসি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্বামী বিবেকানন্দ সমাজ বিকাশ সম্বন্ধে কি বলেছেন তার কথায়। 

“আমি সমাজতন্ত্রী, তার কারণ এই নয় যে সমাজতন্ত্রকে আমি একটা পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ সমাজব্যবস্থা বলে মনে করি, কারণটা এই যে উপবাস করার চেয়ে আধখানা রুটি মেলাও ভাল।“ 

"অন্য সব সমাজব্যবস্থাই পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেগুলি ত্রুটিপূর্ণ। এই অবস্থাটাকেও একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক; আর কিছুর জন্য না হলেও অন্তত এর নূতনত্বের জন্যই একবার পরীক্ষা করা দরকার। একই মানুষের দল সব সময় সুখ বা দুঃখ ভোগ করে যাবে; তার চেয়ে বরং সুখদুঃখের একটা পুনর্বণ্টন হওয়াই ভাল! ভাল-মন্দের মোট পরিমাণ পৃথিবীতে সব সময় একই থাকে। নূতন নূতন ব্যবস্থার দ্বারা জোয়ালটা কাঁধ বদল করে মাত্র, আর কিছু নয়।" 

“সমাজের নীচেকার লোকটিও এই দুঃখময় পৃথিবীতে একটু সুদিনের মুখ দেখুক। এর ফলে এই তথাকথিত সুখাস্বাদের অভিজ্ঞতা পার হয়ে এরা সবাই এসে শেষ পৰ্য্ন্ত পরমেশ্বরের শরণ নেবে; এই পৃথিবী, তার গভর্ণমেণ্ট, তার আর যত সমস্যা সম্পর্কে এদের সকল মিথ্যা মায়ামোহ তখন কেটে যাবে ।" 

এই উদ্ধৃতিগুলির ভিতরে বিবেকানন্দের মানসপরিধি এবং তার ভাবনার স্বরূপ সার্থকভাবে প্ৰতিফলিত হয়েছে। বাস্তব সমাজব্যবস্থাটাকে উন্নত করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে একদিন আমাদের সকল দুঃখের অবসান ঘটবে এই ধারণাটা যে ভুল সে কথাটা প্ৰমাণ করাই নিম্নে উদ্ধৃত অংশটির মূল উদ্দেশ্য। 

“আর একটা মস্তবড় ভুল আমরা করে থাকি এই ভেবে যে পৃথিবীতে মঙ্গলের পরিমাণটা ক্রমবর্ধিষ্ণু এবং অমঙ্গলের পরিমাণটা ক্রমক্ষয়িষ্ণু। এর থেকে এটাই প্ৰমাণ করার চেষ্টা হয়ে থাকে যে, অমঙ্গলটা ক্ৰমশঃ ক্ষয় হয়ে লোপ পেয়ে যাবে, এবং শেষ পৰ্য্ন্ত মঙ্গলটাই শুধু থাকবে।…কিন্তু সমাজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গল যত বাড়ছে, অমঙ্গলও ততই বেড়ে চলেছে।” সমাজ-জীবনের ব্যবহারিক বা বস্তুতান্ত্রিক অগ্রগতির ধারা মানুষের সমস্যার শেষ সমাধান করতে পারে না। চিত্ত ও চেতনাকে ঈশ্বরভাবে ভাবিত করে তবেই মানুষের নিষ্কৃতি”।অথচ, একথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে এই রচনার মধ্যপথে বিবেকানন্দ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়,বৈশ্য ও শূদ্রদের ক্রমিক আধিপত্যের ভিত্তিতে সমাজ বিবর্তনের কথা বলেছেন এবং একথা অকুষ্ঠিতভাবেই স্বীকার করা চলে যে উনবিংশ শতাব্দীর প্রান্তবাসী এই সাধক-সন্ন্যাসীই ভারতীয় মনীষীদের ভিতরে সর্বপ্রথম শ্রেণীস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ বিবর্তনের ধারা অনুধাবন করার মত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর বিশ্লেষণ-পদ্ধতি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকে কতটা অসম্পূর্ণ সে কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের মূল সূত্রের ভিতরে তিনি যে শ্রেণীস্বার্থের সন্ধান পেয়েছেন এবং সে-কথা যে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্ৰকাশ করেছেন ভারতীয় সমাজদর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর এই মৌলিকত্ব অনস্বীকার্য। 

তিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়,বৈশ্য ও শূদ্র এই চারিটি শব্দের ব্যঞ্জনগত ব্যাপক অর্থ গ্ৰহণ করেছেন এবং এর দ্বারা সমগ্ৰ মানবসমাজের ইতিহাস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের প্রথম স্তরটিকে ব্ৰাহ্মণ্য সভ্যতা বলে সামগ্রিক ভাবে চিহ্নিত করা যুক্তিযুক্ত কিনা সে বিষয়ে ন্যায়সঙ্গত সন্দেহ থাকলেও এবং ক্ষয়িষ্ণু ব্ৰাহ্মণ্য সভ্যতার সঙ্গে উন্মেষমুখী ক্ষাত্রসভ্যতার সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছবার ধারণাটিকে একটি অতিসরলীকৃত সূত্র বলে অগ্রাহ্য করলেও বৈশ্য ও শূদ্র সভ্যতা সম্পর্কে বিবেকানন্দ যা বলেছেন তা আধুনিক সভ্যতার মর্মভেদী এক সুগভীর অন্তদৃষ্টির পরিচায়ক।বৈশ্য শাসনের মূলগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিবেকানন্দ বলেছেন-“It is awful in its silent crushing and blood-sucking power.”বিবেকানন্দ মোটেই মার্কসবাদী ছিলেন না একথা মনে রাখলে এই বাক্যটির ব্যঞ্জনাময় বৈশিষ্ট্য আমাদের আরও বেশী বিস্মিত করে। মার্কসবাদী সমাজবিজ্ঞানী সমাজবাস্তবের আরও সুনিপুণ বিশ্লেষণ করে এই কথাই বলতেন। পণ্যপ্রধান পুঁজিবাদী সভ্যতায় শ্রমিকের শ্রমজাত উদ্বৃত্ত মূল্য মুনাফার আকারে নিঙড়ে নেয়ার এমন একটি কৌশল আছে যে শ্রমিকের মোট শ্রমের কত অংশ তার নিজের জন্য আর কত অংশ মালিকের মুনাফার জন্য বিনা পারিশ্রমিকে নিয়োজিত হচ্ছে সে হিসাব করা শ্রমিকের পক্ষে অসাধ্য হয়ে ওঠে। ভূমিপ্রধান ক্ষত্রিয়যুগে শ্রমজীবী মানুষের স্বাৰ্থমুখী শ্রম ও মালিকমুখী শ্রমের পরিমাণিক পার্থক্যটা যত সহজে চোখে পড়ে পণ্যপ্ৰধান বৈশ্য সভ্যতায় তত সহজে চোখে পড়ে না। পণ্যময়ী জুজুমূর্তির অন্তরালে শ্রমিকের শ্রমসঞ্জাত মূল্য-পরিমাণটা ঢাকা পড়ে যায়। পণ্যের বিনিময় যে মূলতঃ শ্রমশক্তির মূল্যের বিনিময়, আর সেই মূল্যের একটা বিরাট অংশ যে উদ্বৃত্ত হয়ে মুনাফার আকারে শোষণ করে নেয়া হয়— উৎপাদনের এই সামাজিক ইতিহাসটা চাপা পড়ে যায়। 



এইজন্যই পুঁজিবাদী আমলে শোষণটা চলে নিঃশব্দে, কারণ শোষণকে শোষণ বলে চেনা যায় না, এবং এই শোষণের পরিমাণটাও নিঃশব্দে বেড়ে চলে। পণ্যের গায়ে তার মূল্যোৎপত্তির ইতিহাসটা ব্যাখ্যা করে লেখা থাকে না।এতটা বিশ্লেষণী চিন্তার ভিত্তিতে বিবেকানন্দ ও কথাটি বলেননি। কিন্তু একটা ব্যাপার তিনি পরিষ্কারভাবেই লক্ষ্য করেছেন, পণ্যবাহিনী বৈশ্যসভ্যতার আড়ালে মানুষের রক্ত শোষণ চলে নিঃশব্দে এবং এই শোষণ আরো বেশী ভয়ঙ্কর ।বৈশ্য-সভ্যতার মূল্যনিরূপণে বিবেকানন্দ একদেশদর্শী ছিলেন না। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পৰ্যন্ত বিপুল পরিমাণ পণ্যসঞ্চালনের মারফত মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগসূত্র স্থাপন করেছে এই বৈশ্যসভ্যতা, এবং একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সীমাবদ্ধ জ্ঞান বিজ্ঞান কৃষি ও সভ্যতার অমূল্য সম্পদ ছড়িয়ে দিয়েছে সারা পৃথিবীতে। 

কিন্তু ঠিক এর পরই তিনি প্রশ্ন করছেন, “যাদের শারীরিক শ্রমের ওপর নির্ভর করে ব্ৰাহ্মণের প্রভাব, ক্ষত্ৰিয়ের ক্ষমতা ও বৈশ্যের সম্পদ সম্ভব হয়েছে তারা কোথায়? সব দেশে সব যুগে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে “নীচু জাতি,” “অন্ত্যজ,” অথচ যারাই হল আসলে সমাজের শরীর, তাদের ইতিহাসটা কি? উচ্চবর্ণের একচ্ছত্র অধিকারকবলিত জ্ঞানবিজ্ঞানের ভাণ্ডারে একটু ভাগ বসাবার অপরাধে ভারতবর্ষে যাদের জন্য জিহ্বা ও মাংস উপড়ে নেওয়ার মত কোমল শাস্তি বিধান করা হয়েছে ভারতের সেই চলন্ত শবগুলি, বিশ্বের সেই ভারবাহী পশুগুলি, সেই শূদ্র জনসাধারণ, তাদের ভাগ্যে কি লেখা আছে?”বৈশ্য সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এর এমন একটি সাধারণ চরিত্র লক্ষ্য করেছেন যা যে কেউ সমর্থন করবেন। তিনি বললেন, “ক্ষত্রিয়ের হাত থেকে ক্ষমতা করায়ত্ত করার সময়ে বৈশ্যদের এমন কোন সদিচ্ছা ছিলনা যে ক্ষমতাটা শূদ্ৰশ্রেণীর হাতে পড়ুক। “ 

এই একই প্রবন্ধের প্রারম্ভে তিনি দেখিয়েছেন যে শাসনক্ষমতায় জনসাধারণের প্রকৃত অধিকার ভারতবর্ষে কোন দিন ছিল না, না ব্ৰাহ্মণযুগে, না ক্ষত্ৰিয়-বৌদ্ধযুগে। ইতস্ততঃ পরোক্ষভাবে, বিক্ষিপ্ত ও বিশৃঙ্খলভাবে জনসাধারণ আত্মপ্রকাশের জন্য সংগ্ৰাম করেছে। কিন্তু তারা নিজেদের ভিতরে কোন সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে পারে নি। শিক্ষাদীক্ষা যখন সবই ছিল ঋষিদের হাতে তখন স্বভাবতই জনতার পক্ষে এমন কোন শিক্ষালাভের সম্ভাবনা ছিল না যার দ্বারা তারা কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, মানুষের সামগ্রিক ও সাধারণ মঙ্গলের জন্য একতাবদ্ধ হতে পারে। এদিকে কিন্তু পারস্পরিক স্বার্থের খাতিরে ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্ৰিয় শেষ পৰ্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হলো। এই ধরণের ঐক্যের সহজাত পাপ হিসেবে এরা সবাই মিলে জনসাধারণের রক্তশোষণ, শক্রর উপর প্রতিহিংসা, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করার কাজগুলি চালিয়ে যেতে লাগল, এবং শেষ পর্যন্ত পশ্চিমাগত মুসলমান আক্রমণকারীদের হাতে সস্তা ও সহজ শিকারে পরিণত হল। শোষিত জনসাধারণের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতীয় সমাজেতিহাসের এমন স্পষ্ট বিচার বিবেকানন্দের পূর্বে অন্য কোনও ভারতীয় মনীষী করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। অক্টোবরের রুশ বিপ্লবের সঙ্গে পূর্ববর্তী বিপ্লবগুলির মৌলিক পার্থক্য দেখাতে গিয়ে মাক্সবাদী দার্শনিকরা বলেছেন পূর্ববর্তী বিপ্লবগুলিতে একদল শোষকশ্রেণীর জায়গায় আর একদল শোষকশ্রেণী ক্ষমতায় প্ৰতিষ্ঠিত হয়েছে মাত্ৰ, শোষিত শ্রেণীর হাতে কোন দিনই ক্ষমতা আসেনি। কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবই হল পৃথিবীর প্রথম বিপ্লব যা শোষিত শ্রেণীকে ক্ষমতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিবেকানন্দ “শূদ্ৰ-বিপ্লব” দেখে যান নি, কিন্তু প্রাক্-শূদ্ৰ বিপ্লবগুলিতে শেষপৰ্যন্ত যে শোষকশ্রেণীর হাতেই সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা বহাল রয়েছে এ ঘটনা তাঁর সন্ধানী চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি। সমকালীন পশ্চিমী সমাজের গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করে আসন্ন “শূদ্ৰ-বিপ্লব" সম্পর্কে বিবেকানন্দ নিঃসংশয় ছিলেন, “সোশ্যালিজম, এনার্কিজম, নিহিলিজম এবং এই জাতীয় অন্যান্য মতবাদগুলি আসন্ন সমাজবিপ্লবের অগ্রদূত", “শূদ্রের আধিপত্য অবশ্যম্ভাবী, কেউ একে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না"। 

শ্রমিকশ্রেণীকে পঙ্গু করে রাখার জন্য পুঁজিপতি শ্রেণীর একটা চিরাচরিত অপকৌশল আছে। নিপীড়িত শ্রেণীর ভিতরে যদি কেউ বিদ্যাবুদ্ধি ও গুণগরিমায় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন, চতুর পুঁজিপতিশ্রেণী তাকে ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা ও ক্ষমতা দিয়ে নিজেদের দলে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে, যার ফলে সে আপন শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিচুত হয়ে শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদের সেবাতেই আত্মনিয়োগ করে, পুঁজিবাদের স্বার্থে নিজশ্রেণীর উপর নিজের বিস্তীর্ণ প্রভাবের অপব্যবহার করে এবং বিপ্লবের পথ থেকে শ্রমিক শ্রেণীকে প্ৰতিনিবৃত্ত করে। বিবেকানন্দ প্রাচীন ভারতীয় সমাজেও নিপীড়িত শ্রেণীর মানুষের এই স্বধৰ্মচুতি ও স্বশ্রেণীদ্রোহিতা দেখতে পেয়েছেন। 

“শূদ্ৰকে ধন সঞ্চয়, জ্ঞানার্জন ও শিক্ষালাভের কোনও সুযোগই দেয়া হয়নি বললেও চলে। এই সামাজিক বঞ্চনার সঙ্গে আরও একটা অসুবিধা এনে যোগ করে দেয়া হল। শূদ্ৰশ্রেণীর ভিতরে অসাধারণ গুণাবলী ও প্ৰতিভা নিয়ে কেউ যদি জন্মগ্রহণ করত তখনই সমাজের উচ্চতর প্রভাবশালী শ্রেণীগুলি তার উপর সম্মান ও উপাধির পুষ্পবৃষ্টি করত, এবং তাকে তার আপনি শ্রেণীর পরিধি থেকে টেনে তুলে নিয়ে উচ্চতর গোষ্ঠীচক্রের মধ্যে স্থান করে দিত। তার সম্পদ ও প্রজ্ঞাশক্তি তখন নিয়োজিত হত একটি বিজাতীয় শ্রেণীর স্বার্থে। তার আপন শ্রেণীর জনসাধারণ তার বিদ্যাবুদ্ধি ও সম্পদ থেকে কোন সাহায্যই পায় নি।” এই স্বধৰ্মচ্যুতি ও স্বশ্ৰেণীদ্রোহের দৃষ্টান্ত হিসাবে তিনি যাঁদের নাম বললেন তাঁরা হলেন বশিষ্ট, নারদ, জাবাল সত্যকাম, ব্যাস, কৃপ, দ্রোণ এবং কর্ণ। শ্রেণীআভিজাত্যের দিক থেকে এদের প্রত্যেকেরই জন্মকাহিনী, পিতৃপরিচয় বা মাতৃপরিচয় সন্দিগ্ধ রহস্যে আবৃত। “জ্ঞান বা বীরত্বের পুরস্কার স্বরূপ এঁরা কেউবা ব্ৰাহ্মণ সমাজে কেউবা ক্ষত্ৰিয় সমাজে উন্নীত হলেন।” বিবেকানন্দ মন্তব্য করেছেন-“এদের এই সামাজিক উর্ধ্বগতির ফলে গণিকা, দাসী, মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কি যে উপকার হল তা বোঝা দুষ্কর।”। ব্যাস, বিদুর ও জাবাল সত্যকামের উদাহরণ দেখিয়ে যখন আমরা প্ৰাচীন ভারতের উদার আদর্শের জয়গানে আবেগে আত্মহারা হই তখন বিবেকানন্দ দেখালেন যে উচ্চশ্রেণীর এই স্বার্থগন্ধী উদারতায় আত্মপ্রসাদের কোনো অবকাশ নেই। এই চমকপ্রদ ব্যাখ্যার ভিতরে অনেকটা কল্পনা ও অতিশয়োক্তির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে এমন সন্দেহের অবকাশ থাকলেও প্রাচীন ভারতীয় সমাজ বাস্তবের বিশ্লেষণে সুপ্রযুক্ত এই বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গী ও বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা এবং একটি সংস্কারমুক্ত সতর্ক চেতনা আমাদের আধুনিক মনকেও সচকিত করে তোলে, নূতন করে ভাববার রসদ যোগায়। আমরা সকলেই জানি দার্শনিক দিক থেকে বিবেকানন্দ ছিলেন শঙ্কর-বেদান্তের অনুগামী। তথাপি বলতে দ্বিধা করলেন না, “রামানুজ শঙ্কর, এরা শুধু পণ্ডিত মাত্রই ছিলেন, এদের হৃদয় ছিল অতি সঙ্কীর্ণ। কোথায় সেই ভালবাসা, পরের দুঃখে কাঁদে কোথায় সেই হৃদয়?" 

ভারতে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিবেকানন্দের ধিক্কারও কম জ্বালাময় ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে অবাক লাগে এই ভেবে যে অমন সুতীব্ৰ আবেগও তাঁর বুদ্ধির দীপ্তিকে কলুষিত করতে পারেনি। মিস মেরী হেলির কাছে লেখা একখানা চিঠিতে লিখলেন,"আধুনিক ভারতে বৃটিশ শাসনের কেবল একটা মাত্ৰই মাঙ্গলিক চরিত্র আছে যদিও এই চরিত্রটি এসে পড়েছে বৃটিশের অজ্ঞাতসারে । এই শাসন আর একবার ভারতবর্ষকে বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে টেনে বার করেছে, বহির্জগতের সংস্পর্শে আসতে তাকে বাধ্য করেছে” “কিন্তু রক্ত শোষণ করাই যে শাসনের মূল উদ্দেশ্য সে শাসন দেশের মূলত কোন মঙ্গল করতে পারে না … শিক্ষাবিস্তার আর বরদাস্ত করা হবেনা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা শেষ হয়ে গেছে, অবশ্য বহু আগেই আমাদের নিরস্ত্র করা হয়েছে। কয়েকটি নিরীহ সমালোচনামূলক কথা লেখার জন্য তৎক্ষণাৎ যাবজ্জীবন কারাবাসের ব্যবস্থা হয়েছে, অন্যদের বিনাবিচারে আটক করা হয়েছে, কেউ জানে না এদের মাথা কয়টা কখন কেটে ফেলা হবে। ইংরেজ সৈনিকরা আমাদের পুরুষদের হত্যা করেছে, নারীদের ইজ্জত কেড়ে নিচ্ছে। আর এরই পুরস্কার হিসাবে আমাদের পয়সায় এই সৈনিকদের পথ-খরচা ও পেন্সন দিয়ে বিলাতে পাঠানো হচ্ছে। মনে করো তুমি আমার এই চিঠিখানা প্ৰকাশ করে ফেলেছ, তাহলে ভারতবর্ষে এই মাত্ৰ যে আইন পাশ হয়েছে সেই আইনের বলে ভারতীয় ইংরেজ সরকার এখান থেকে আমাকে টেনে হিচড়ে ভারতে নিয়ে যেতে পারবে এবং বিনা বিচারে আমাকে হত্যা করতে পারবে। দরকার হলে রয়টারের প্রতিনিধি হুকুম মাফিক খবর তৈরী করে ঠিক উল্টা খবর প্রকাশ করবে। যে ঈশ্বর সকলের পিতা, দুৰ্বলের রক্ষার জন্য যিনি সবলকে ভয় করেন না, যাঁকে ঘুষ দিয়ে কেনা যায় না এমন একজন ঈশ্বর কি কোথাও আছেন?" এরই সঙ্গে আবার মিলিয়ে দেখুন, “যীশু আর বাইবেল দিয়ে ইংল্যাণ্ড ভারতবর্ষ জয় করেনি। ভারতবর্ষ জয় করেছে সেই ইংল্যাণ্ড ফ্যাক্টরির চিমনি যার রণপতাকা, পৃথিবীর বাজার যার রণক্ষেত্র।" 

বিবেকানন্দের ভাবনার ভিতরে স্বদেশচেতনা ও শ্রেণীচেতনা কিরূপ একাত্মতা লাভ করেছিল তার দৃষ্টান্ত হিসাবে আর একটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি। চিকাগো থেকে তিনি দেওয়ান হরিদাস বিহায়ীদাস দেশাইকে লিখেছেন- “ইতিহাসের কোনকালে কবে কোথায় তোমাদের ধনিক জমিদার পুরোহিত ও রাজরাজরার দল গরীবের জন্য একবার ও ভেবেছে? অথচ এদের মাথাগুলো গুঁড়ো করেই তো তাদের শক্তির জীবনশোণিত তৈরী হয়েছে। ভারতের দরিদ্রশ্রেণীর ভিতরে এত বেশী মুসলমান কেন বলতে পার? তরবারির জোরে তাদের ধর্মান্তরিত করা হয়েছে একথা অর্থহীন। জমিদার ও পুরোহিতের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার আশাতেই তারা মুসলমান হয়েছে। এরই ফলে দেখতে পাচ্ছ বাংলাদেশের কৃষকশ্রেণীর ভিতরে হিন্দুর চেয়ে মুসলমান অনেক বেশী কারণ বাংলাদেশে জমিদারের সংখ্যাটা অনেক বেশী।” এ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি বা না করি, সন্ন্যাসীর ইতিহাসচেতনায় শ্রেণীচেতনার প্রভাব এখানে সুস্পষ্ট। বিবেকানন্দ অন্যত্র একাধিকবার উল্লেখ করেছেন যে শোষিত শ্রমজীবী জনসাধারণ শোষকশ্রেণীর করায়ত্ত রাজশক্তির সমর্থনে দাঁড়াবার মত কোনও উৎসাহ অনুভব করেনি বলেই ভারতবর্ষ বারবার বিদেশীশক্তির পদানত হয়েছে। 

কিন্তু এই চেতনার সঙ্গে সঙ্গে তার ভাবনার যে একটা সুনির্দিষ্ট সীমা ছিল সেদিকেও লক্ষ্য না রাখলে আমাদের আলোচনা পথভ্ৰষ্ট হতে বাধ্য। তিনি একথাও বলেছেন, “সবশেষে আসবে শ্রমজীবীর প্রভুত্ব। এর একটা সুফল ফলবে, পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পুনর্বণ্টন হবে, সঙ্গে সঙ্গে এর একটা কুফলও বোধ হয় দেখা দেবে, সংস্কৃতির মান নীচে নেমে যাবে। সাধারণ শিক্ষা বিপুলভাবে প্রসার লাভ করবে, কিন্তু অসাধারণ প্রতিভাশালীদের সংখ্যা ক্ৰমশঃ কমে যাবে।” যুগ থেকে যুগান্তব্যাপী একটানা বঞ্চনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে “শূদ্র-বিপ্লব” অবশ্যম্ভাবী। বিবেকানন্দ তাঁর দিনে এই অনাগত ও আসন্ন বিপ্লবকে ভবিষ্যতের অভিনন্দন জানাতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। ন্যায়নীতি ও সমাজনীতি উভয় দিক থেকেই এ বিপ্লব অপরিহার্য্য একথা তিনি বুঝেছিলেন। তবুও এ বিপ্লবের দ্বারা মানুষের মনুষ্যত্ব যে দুৰ্বার পদক্ষেপে অগ্রগামী হবে এমন বিশ্বাস তাঁর ছিল না, এ বিপ্লবের দ্বারা মনুষ্যত্ব লাভের সমস্যা সমাধান হবে এমন আশা তিনি পোষণ করতেন না। “শূদ্র-চরিত্র” সম্পর্কে একটা নিদারুণ বেদনাময় হতাশা এই অবিশ্বাসের মূলে কাজ করেছে। 

“বর্তমান ভারত” প্রবন্ধে তিনি বললেন “শূদ্ৰ-শ্রেণীর” অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু শূদ্র জাগবে তার শূদ্রত্ব নিয়ে। “শূদ্ৰত্ব” বলতে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন তাও ব্যাখ্যা করেছেন। “স্মরণাতীত কাল থেকে অত্যাচারের চাপে বিচূৰ্ণিত এই শূদ্র শ্রেণী দাসমনোবৃত্তি গ্ৰহণ করে কুকুরের মত উচ্চবর্ণের পদলেহন করে এসেছে আর না হয়ত অমানুষ নিষ্ঠুর পশুতে পরিণত হয়েছে। তাদের আশা ভরসা বার বার ধূলিসাৎ হয়েছে। লক্ষ্যানুসন্ধানের দৃঢ়তা ও কর্মক্ষেত্রে অবিচল অধ্যবসায় বলতে তাদের কিছুই নেই।” বিবেকানন্দ যে আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন সে স্বপ্ন যে কোনদিন বাস্তবে রূপায়িত হবে এমন ভরসা তার ছিল না। ব্ৰাহ্মণের প্রজ্ঞা, ক্ষত্ৰিয়ের শক্তি, বৈশ্যের সংগঠনী প্ৰতিভা ও শূদ্রের সাম্যনীতির সমন্বিত স্বরূপই ছিল তার আদর্শ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। কিন্তু এই বলিষ্ঠ কল্পনাকে তিনি একটি সন্দেহাকুল জিজ্ঞাসা চিহ্ন দিয়ে সমাপ্ত করলেন–“কিন্তু সে কি সম্ভব?” 

তাঁর জীবনে এ জিজ্ঞাসার উত্তর মেলেনি। দ্বিধা-কণ্টকিত সমাজে জীবনের এই নিরুত্তর জিজ্ঞাসা, ব্যথিত আবেগের এই আশাহীন ব্যাকুলতাই বোধ হয় তাঁকে ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসার পথে সকল সমস্যার চরম বিশ্ৰান্তি খুঁজতে বাধ্য করেছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে মানুষকে যেতে হবে, শ্রমজীবীর আধিপত্যের ভিতর দিয়ে মানুষের সামাজিক অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হবে ইতিহাসের এই অমোঘ অনুশাসন লঙ্ঘন করার উপায় নেই। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাই সব শেষে মানুষকে বুঝিয়ে দেবে এও যথেষ্ট নয়। আরও আগে চলতে হবে। সামাজিক ও ব্যবহারিক উন্নতির উত্তঙ্গ শিখরে আরোহণ করেও শেষ রক্ষা হবে না। তখন মানুষ বুঝতে পারবে আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য্যই সবচেয়ে বড় কথা। যাকে জানলে সব জানা হয়ে যায়, যাকে পেলে আর কিছু পাওয়ার বাকী থাকে না, যার আলোতে চন্দ্ৰ-সূৰ্য্য আলো দেয় সেই পরমেশ্বরের ঐকান্তিক আরাধনাই চরম মুক্তির পরম পন্থা। স্বচ্ছ দৃষ্টি, ক্ষুরধার বুদ্ধি, বিজ্ঞানীসুলভ বিশ্লেষণী শক্তি, নিপীড়িত মানুষের কল্যাণকামনায় উদ্বেলিত এক দুরন্ত আবেগ, এ সব কিছুই যেন কোন এক অবসন্ন সন্ধ্যায় চূড়ান্ত অবসান খুঁজেছে বৈদান্তিক ব্রহ্মবাদের পরম প্রশান্তির মধ্যে। যে ঈশ্বর মানুষের মুখে রুটি যোগাতে পারে না সে ঈশ্বরে বিবেকানন্দ বিশ্বাস করেন নি। কিন্তু রুটি যেদিন জুটবে সেদিন মানুষও বুঝবে রুটির চেয়ে ঈশ্বর অনেক বড়, এই ছিল সমাজবাদী বিবেকানন্দের অধ্যাত্মবাদী বিশ্বাস। 

কে ঠিক? কে ভুল? এ বিচার করার যোগ্যতা এবং ধৃষ্টতা আমার নেই। দূরদর্শী দার্শনিকদের তত্ত্ব এবং বিশ্বাসের সত্যতা কেবল সময়ই নিরূপন করতে পারে। সাম্যবাদের যে প্রভাতে শ্রেণীহীন সমাজের সূর্যোদয় হবে সেই প্রভাতকে স্বাগত জানাবার জন্য হয়তো আমাদের প্রজন্মের কেউ থাকবে না। তবুও নিশ্চিত জানি সেই প্রভাত আসবেই। কিন্তু তার পরের সন্ধান আজও পাইনি। তারই খোঁজ করে চলেছি অবিরাম । তার খোঁজ পাওয়া কি সম্ভব, কোথায় পাবো তার খোঁজ?

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী

Posted in


প্রবন্ধ


সপ্তম রিপু 
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী 


সময়টা পূজো আসছে আসছে। 

মাতৃ আগমনের সংবাদটা অনেকে অনেকরকম ভাবে পান। আমি পাই কোলাজে লেখা দেবার তাগাদা আসতে শুরু করলে । 

হায়দ্রাবাদে আমার মতন যে কজন প্রবাসী বঙ্গ সন্তান নিজেদের সাহিত্যিক ভেবে আনন্দ পান, তেনাদের কাছে কোলাজ যাকে বলে মরূদ্যানে কল্পতরু। সবার কথা বলা মুশকিল, তবে আমার লেখা কোলাজে প্রকাশিত হলে আমি নিজেকে অত্যন্ত সন্মানিত মনে করি। 

ধন্যবাদ জানাই সেই সকল অক্লান্ত পরিশ্রমী ব্যক্তিদের, যাঁরা আজকের আলোর গতিতে চলমান জীবনযাত্রার সঙ্গে তালমিলিয়েও, আমার মতো বটতলার লেখকদের মন আনন্দে ভরিয়ে দেন নিজেদের সৃষ্টি ছাপার অক্ষরে জ্বাজল্যমান অবস্থায় দেখার সুযোগ দিয়ে।ভাবতে ভাল লাগে আজকের হল্লা রাজাদের রাজত্বেও, বনের মোষ তাড়াইবার লোক কম পড়ে নাই। 

যাইহোক কি লিখব ভাবতে ভাবতেই সময় চলে যাচ্ছে । 

উৎপটাং কিছু একটা লেখার ইচ্ছে অনেক দিনের কিন্তু ইট পাটকেল চকলেট বোম খাবার ভয়ে অনেকদিন চুপচাপ ছিলাম। এবার সাহস করে লিখেই ফেলব ভাবলাম। 

প্রথমে ভেবেছিলাম ছদ্ম নামে লিখব, কিন্তু ভেবে দেখলাম, কোন লাভ নেই। এবার পূজোয় শ্বশুর কন্যার উড়িষ্যার “ধমকাই” শাড়ীর বায়না রাখতে না পারার জন্য এমনিতেই সকালে চায়ের বদলে “ছ্যাঃ” পাচ্ছি তারপর যদি ভদ্রমহিলা জানতে পারেন নাম ভাঁড়িয়ে ভুলভাল কিছু লিখছি, তবে যাকে বলে আমার সব্বনাশের মাথায় বাড়ি পড়তে বেশি দেরি হবে না।মাইক নিয়ে বলা ছাড়াও জাস্ট ডায়ালে ফোন কোরে ঘটনাটাকে একটা অন্য মাত্রা দেবার ক্ষমতা যে ওনার আছে, তার পরিচয় আমি অনেকবার পেয়েছি। 

তাই “ভয় কি মরণে...”। 

যাইহোক, “সপ্তম রিপু” কথাটার সাথে আমি নিজেও এখনও পর্যন্ত পরিচিত নই।আদৌ 

কথাটা আছে কিনা জানিনা। তবে আমাকে যাঁরা মোটামুটি ভাবে জানেন, তাঁরা এটা 

অতি অবশ্যই মানেন যে আমি যে ব্যাপারে যত কম জানি, সেই বিষয়ে আমি ততো 

বেশী লেখা বা বলার ক্ষমতা ধরি। 

আমার নিজেরও তাই মত। 

পরম করুণাময় ঈশ্বর, আমার ওপর জন্মকাল থেকেই অযাচিত ভাবে এই পক্ষপাতিত্ব 

করে আসছেন। তিন সত্যি করে বলছি এখানে আমার কোনও কালো হাত নেই। নাম 

না জানা, নাম না শোনা যে কোনও বিষয়ের ওপর আমি একটা পুরো অখণ্ড রবীন্দ্র 

রচনাবলী লিখে ফেলতে পারি। 


(২) 

অনেক ভণিতা হোল, আমার ভুল ভাল লেখার জমি তৈরি করার জন্য। এবার আসল প্রসঙ্গে আসা যাক। পাঠকবর্গের সহনশীলতার পরীক্ষায় আমি সবাইকে ফুল মার্ক্স দিলাম, অবশ্য যাঁরা এখনও পর্যন্ত আমার সঙ্গে আছেন, ব্যাপারটার শেষ না দেখে ছাড়বেন না বলে। 

আর যাঁরা ইতিমধ্যে রণে ভঙ্গ দিয়েছেন, তাঁদেরকে জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। 

শাস্ত্রে আছে মানুষ ষড় রিপুর বশ-কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ এবং মাৎসর্য। এই ছটি শত্রুকে জয় করতে পারলেই মানুষের মানব জন্ম সার্থক বলা যেতে পারে।একজন আদর্শ মানুষ গুণগত ভাবে এই ছটি ঋণাত্মক ধর্মাবলম্বী উপাদান বশে রাখবে, বশবর্তী হবে না। 

এই নিয়ে অবশ্য যথেষ্ট তর্কের অবকাশ আছে। 

তার্কিকদের কথায় কান না দিলেও, সাধারণ মানুষের মনে একটা সাধারণ প্রশ্ন অতি অবশ্যই জাগতে পারে যে যদি সকল মানুষ এই ষড় রিপুর দ্বারা সত্যি সত্যি চালিত না হয় তবে আমাদের এই বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা চলমান থাকতে পারবে কিনা? 

প্রশ্নটার মূল্য দশ লক্ষ্য টাকা ধরা যেতেই পারে। 

বিষয়ের লেবুটাকে বেশী কচলিয়ে তেতো করবার আগে, ষড়রিপুর ছটা উপাদানকে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা যাক। 

প্রথমেই ধরা যাক “কাম” রিপুটাকে। আপাত অর্থে কাম কথাটার মানে সেক্স সম্বন্ধীয় হলেও, অন্য অর্থে অ্যাকাডেমি বাংলা অভিধান বলছে “কামনা, ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা ভোগবাসনা, লিপ্সা, যাচঞা”। 

এখন কথা হচ্ছে, অন্য সব অর্থ ছেড়ে দিয়ে যদি প্রথম রিপুর আপাত অর্থটাকেই জাপটে ধরি তবে এই রিপুকে ত্যাগ করলে সংসারের বৃদ্ধি মানে সাদা কথায় যাকে বলে বংশ বৃদ্ধি তথা বিকাশ স্তব্ধ হয়ে যাবে। 

আবার ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা না থাকলে জীবনের কর্ম পদ্ধতি নতুন সংজ্ঞা পাবে। যদিও গীতা বলেছে, কর্মন্যেয়াধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। কিন্তু সর্বসাধারণকে কর্মে নিয়োজিত করতে হলে জনগণের পছন্দমতো খুড়োর কলে McD বা KFC’র আইটেম নাম্বার ঝোলাতেই হবে। রোম অলিম্পিকে গোল্ড মেডেলটা গলায় পড়বার ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নটা না দেখাতে পারলে মিলখা সিং এর কোচ “ভাগ মিলখা, ভাগ” বলতে পারতেন না। 

দ্বিতীয় রিপু “ক্রোধ” জীবকে চরম সর্বনাশের পথে চালিত করে।আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত দ্বিতীয় রিপুই সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর। তবে তার্কিকেরা বলে থাকেন দ্বিতীয় রিপু মানুষকে আত্মরক্ষায় উজ্জীবিত করে।ক্রোধের বশেই রাজা তাঁর প্রজাদের শত্রুর আক্রমণ 


(৩) 

থেকে রক্ষা করেন। দুষ্টের দমন করেন। কাজেই মানুষের জীবনে ক্রোধের প্রয়োজন আছে। 

তৃতীয় রিপু “লোভ” এক অদ্ভুত রিপু।মানুষ মনে হয় ২৪x৭x365 শয়নে, স্বপনে, জাগরণে লোভ রিপুর বশবর্তী। 

এই নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতেই পারে। 

সকালে জম্পেশ করে হিঙের কচুরি-আলুর দম-জিলিপি খেয়ে নিয়েই আবার দুপুরে কচি পাঁঠার ঝোল আছে শুনে জিভে জল আসেনি এমন ত্যাগী মহাপুরুষ বিরল। এরপর যখন গিন্নির কাছ থেকে জানতে পারি সত্যনারায়নের কাছ থেকে আনা ইলিশের ভাপাটা রাত্রে পাতে নামবে, তখন জিভের বারিধারা ধরার জন্য মুখের সামনে বাটি ধরতে পারলে ভালো হয়, নয়তো পরিধেয় বস্ত্র নষ্ট হতে পারে। 

শুধু এই নয়। 

মাসমাইনে পাবার দিনও শেয়ার বাজারে নিজের ধরে রাখা শেয়ারগুলোর স্বাস্থ্যের দিকে দৃষ্টিপাত না করে থাকা খুব মুশকিল। 

গভীর ঘুমের মধ্যে সুখ স্বপ্নে কোটি টাকার লটারি পাওয়াটাকে যে অবদমিত হঠাৎ বড়লোক হবার লোভ বলা যাবে না, এটা বলা খুব মুশকিল। 

আবার এই লোভের অনুপস্থিতিতে মানুষ যে তার বর্তমান জীবন যাত্রার উন্নতি সাধনে ব্যর্থ হোত এ বিষয়ে খুব কম লোকই আপত্তি করবেন মনে হয়। 

কিন্তু There is a BUT! 

শাস্ত্রে আছে, “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু”। 

এই জায়গাটাতে একটু দাঁড়ানো যাক। 

২৪x৭x৩৬৫ নিজের অজান্তে লোভের বশবর্তী হয়ে পাপ-পুণ্যের হিসেবটা গুলিয়ে যেতেই পারে।কিন্তু কথাটা হোল লোভ ত্যাগ করতে পারলে কি মৃত্যুকে এড়ানো সম্ভব? এর উত্তরে কিন্তু পণ্ডিতেরা নীরব। 

কাজেই শয়নে, স্বপনে, জাগরণে লোভ রিপুর তাড়নায় অসাড় সংসার চক্র ঘোরে নিরবধি। 

সাধারণ ভাবে চিন্তা করলে প্রথম এবং তৃতীয় রিপু দুজনকে বৈমাত্রেয় ভাই বলা যায়।বৈমাত্রেয় বলার কারণ এই যে এই দুই ভায়ের মধ্যে চরিত্রগত কিছু পার্থক্য আছে। অদম্য, অনিয়ন্ত্রিত, অসংযত কামনাই লোভে পরিণত হয়। 

তার্কিকদের মতে সমস্ত সাধারণ মানুষের জাগতিক কর্মকাণ্ডের পিছনে এই তৃতীয় রিপুর অবদান সর্বাধিক।প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাহিদা আর অতিরিক্ত প্রয়োজনের দুনিয়া সৃষ্টি করার পিছনে এই তৃতীয় রিপুই যে অগ্রগামী সে বিষয়ে সন্দেহ না থাকাটাই স্বাভাবিক। 


(৪) 

চতুর্থ রিপু “মদ” এর দিকে এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক। 

মদ শব্দের তাৎক্ষণিক অর্থ সুরা মনে হলেও আভিধানিক অর্থে দেখছি “দম্ভ”, “গর্ব”, “অহংকার”, “দর্প” ইত্যাদি শব্দগুলি উপস্থিত। 

আক্ষরিক অর্থে এই সকল গুন কিন্তু রজোগুণী ব্যক্তিদের আধার।সাধারণত রজোগুণী ব্যক্তিরাই সমাজে নেতৃস্থানীয় পদাধিকার অর্জনে অত্যধিক ব্যাকুলতা প্রদর্শন করে থাকেন।আবালবৃদ্ধবনিতা তাদের নেতা, রাজাদের মধ্যে এই গুণগুলোই দেখতে চান নিজেদের আলুনি জীবনের মসলা হিসেবে। বনেদী রাজপরিবারের এই গুনগুলোই Blue Blood হিসেবে সমাজে পরিচিত। 

মদমত্ত রাজপরিবার আমজনতার কাছে সর্বদাই ভগবানরূপে পূজিত হন। এক্ষেত্রে ভারতবর্ষের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হলেও রাজা-রাণীর দেশ England-ও খুব একটা পিছিয়ে থাকবে না। 

পঞ্চম রিপু “মোহ” খুবই Deceptive. কথাটার অর্থ “মায়া”।এই যে “কোলাজ”, তার জন্য যে লেখা, এসবই মায়া। যাঁরা লিখেছেন, যাঁরা পড়ছেন – সবই মায়া।ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব সীতাদেবীকেও মায়া আখ্যা দিয়েছেন। রাম-সীতা-লক্ষণের বনে যাবার দৃশ্যটা কল্পনা করুন।লক্ষণের দৃষ্টিপথে সীতা মায়া রূপে রামকে অদৃশ্য করে রেখেছেন। 

রজনীকান্তর একটা গান আছে, “তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে……মোহ কালিমা মুছায়ে।” 

হিন্দু দর্শন শাস্ত্রের মতে এই পুরো জগতটাই মায়া। যা দেখছি, যা কিছু বন্ধনে নিজেদের জড়াচ্ছি সব, সবই মায়া। 

এখন কথা হচ্ছে এই রিপুকে যদি অস্বীকার করি তবে দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রাথমিক কারণটাই পেছনের সারিতে চলে যাবে। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে পঞ্চম রিপু “মোহ”কে ত্যাগ করে এই জগতে জীবনধারণ এক কথায় অসম্ভব। 

ষষ্ঠ রিপু “মাৎসর্য” মানে “অন্যের ভালো দেখতে না পারা”। এক কথায় “পরশ্রীকাতরতা"।পণ্ডিতেরা বলেন “Schadenfreude” এই জার্মান শব্দটার ইংরেজিতে সঠিক কোন একাক্ষর শব্দ নেই। তবে তর্জমা করলে যেটা দাঁড়ায় সেটা হচ্ছে – Whenever a friend succeeds, a little something me dies. 

অনেকে বলেন Envy বা Jealous শব্দ দুটো কাছাকাছি হলেও সঠিক নয়।তবে বাঙলায় সমকক্ষ একটা ভাল তৎসম শব্দ আছে-অসূয়া। 

মহাভারতে দুর্যোধন পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থে ঐশ্বর্যময় জীবনযাত্রা দেখে Schadenfreude Syndrome-এ ভুগতেন। এটাকে সরলীকরণে “মাৎসর্য” রিপুর প্রভাব বলা যেতেই পারে। 

সত্যি কথা বলতে গেলে পুরাকালে যাঁরা রাজসিংহাসনে বসে রাজ্য চালাতেন তাঁদের ওপর যদি মাৎসর্য রিপুর প্রভাব না থাকত তবে তাঁদের পক্ষে কোনমতেই অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে পৃথিবীর সমস্ত রাজাদের বশ্যতা স্বীকার করানো সম্ভব হত না। 


(৫) 

বর্তমানকালে এইপ্রকার উদ্দেশ্য সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে কিন্তু প্রাচীনকালে অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান একটি অবিস্মরণীয় কীর্তি হিসেবে পরিগণিত হত। 

অতএব ধরে নিতে কোনও বাধা নেই যে “সদা সত্য কথা বলিবে” খ্যাত মহারাজ যুধিষ্ঠির মাৎসর্য রিপুর দাস ছিলেন। বেচারা দুর্যোধনই শুধু পরশ্রীকাতর হিসেবে কুখ্যাত হয়ে রইলেন। 

আপাতত ষড় রিপুর গুনাগুণ বিচার বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে যে এদের সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করলে মনুষ্য সৃষ্ট এই বর্তমান সমাজ অচল হয়ে পড়তে পারে। রন্ধন শিল্পে যেমন সকল উপাদানের সঠিক মাত্রার উপস্থিতি স্বাদিষ্ট ব্যঞ্জনের সৃষ্টি করে থাকে ঠিক সেইরকম সঠিক অনুপাতে ষড় রিপুর উপস্থিতি মনুষ্য জীবনে অতি অবশ্যই প্রয়োজনীয়। গীতায় স্বত্ব, রজো ও তম তিনটি গুনের কথা বলা হয়েছে। একটি আদর্শ চরিত্র গঠনে এই তিন গুনের যেরূপ সঠিক পরিমাণের উপস্থিতি প্রয়োজন, সেরূপ ষড় রিপুরও যে সঠিক মাত্রার উপস্থিতি প্রয়োজন সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকা উচিত নয়। 

মহাভারতের অনুশাসন পর্বে, পিতামহ ভীষ্ম স্বজন হত্যায় অনুতপ্ত যুধিষ্ঠিরকে রাজধর্ম সম্পর্কে যে জ্ঞান দান করেছিলেন, সেটি যে “রাজধর্ম্যানুশাসন” নামক একটি সুগার কোটেড ষড় রিপুর সুসম মিশ্রণ মাত্র, সেটি অতি অবশ্যস্বীকার্য। 

বলি ভণিতার পর ভণিতা তো হোলো, এবার আসল কথাটায় আসা যাক – সপ্তম রিপু। সত্যি কথাটা বলেই ফেলি তাহলে। 

পাঠক জনগণ যদি এই অপাঠ্য লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়ে আমার সাথে একমত হন তবে এই সপ্তম রিপু নামক ঋণাত্মক গুণটির জন্য আমি পেটেন্টের দরখাস্ত করতে পারি। এই রিপুটির উপস্থিতি সর্বপ্রথমে যদিও মহাভারতের কুরুক্ষেত্র পর্বে পরিলক্ষিত হয়, তবু কোন এক অজানা কারণে এই ঋণাত্মক গুণটিকে কখনই রিপুর তালিকাভুক্ত করা হয় নি। 

এই সপ্তম রিপুটি হোল বিষাদ। 

মহাভারতের যুগে অর্জুন প্রথম এই রিপুর বশবর্তী হয়েছিলেন। তারপর থেকে সভ্যতা যত এগিয়েছে এই রিপুর প্রভাব ক্রমে ক্রমে অল্পে অল্পে বাড়তে বাড়তে এই একবিংশ শতাব্দীতে একবারে মহামারীর রূপ ধারণ করেছে বলা যেতে পারে। 

বিষাদ, ইংরেজিতে বলতে গেলে বলতে হয় Depression. 

হতাশা, ভাল না লাগা, Mood নেই, মন খারাপ লাগা, Negative feelings ইত্যাদি সর্বপ্রকার মানসিক অবস্থানকেই সপ্তম রিপুর অন্তর্গত বলা যেতে পারে।বর্তমান সমাজে মানুষের জীবনযাত্রার চরিত্র যে গতিতে বদলে যাচ্ছে এবং তার সাথে জীবনের নিরাপত্তাহীনতা যে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলেছে তারই ফলস্বরূপ বিষাদ রিপু আজ মনুষ্য সমাজকে পূর্ণগ্রাসগ্রস্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে চলেছে। 


(৬) 

এই রিপুর একটি বিশেষ ক্ষমতা হোল সরাসরি মানুষের মনকে গ্রাস করে ফেলা। আর তার প্রভাবে মহাভারতে যুগে অর্জুনের যা অবস্থা হয়েছিল, বিজ্ঞানের এই বিপুল অগ্রগতির যুগেও সকল বিষাদগ্রস্ত মানুষেরও একই রকম উপসর্গ দেখা দেয়। 

কুরুপাণ্ডব উভয় সেনার মধ্যে অর্জুনের অনুরোধে সারথি কৃষ্ণ রথ স্থাপন করলে, ভীষ্ম-দ্রোণসহ আর সকল আত্মীয়স্বজনকে দেখে বিষাদগ্রস্ত অর্জুন বলে উঠেছিলেন, 

“সীদন্তি মম গাত্রানি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি। 

বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে।।” 

“আমার গাত্র সকল অবসন্ন হচ্ছে এবং মুখ পরিশুষ্ক হচ্ছে। আমার শরীরে কম্প ও রোমহর্ষ হচ্ছে।” 

পরে অর্জুন আরও বলেছেন যে তাঁর হাত থেকে গাণ্ডীব খসে পড়ছে এবং ত্বক পরিদগ্ধ হচ্ছে। বসেও থাকতে পারছি না, আমার মনও যেন ঘুরছে – ইত্যাদি আরও অনেক Depressing কথাবার্তা, এমন কি যুদ্ধ করতেও অস্বীকার করেছিলেন। 

লক্ষ্য করলে দেখা যায় বর্তমান কালেও বিষাদগ্রস্ত মানুষের Depressing symptom গুলোও একই প্রকার। 

এই সপ্তম রিপুর আঘাত বড়ই দুর্বিষহ।মানসিক অবস্থা ক্রমশই নিম্নগামী হয়।ঠিকমত পরিচর্যা না হলে বিষাদগ্রস্ত মানুষ আত্মঘাতীও হতে পারে। বহু বিখ্যাত মানুষ এই রিপুর আঘাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বা নিতে চেয়েছিলেন। বর্তমান যুগে সারা পৃথিবী জুড়ে শত সহস্র মানুষ আজ বিষাদগ্রস্ত অবস্থায় দিন যাপন করে চলেছেন। 

সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল প্রতিমুহূর্তে মানুষের সপ্তম রিপুর আঘাতের কারণ হিসেবে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতম বিষয়গুলির প্রভাব ক্রমশই বিস্তার লাভ করে চলেছে। চাকুরিস্থলে Increment, Promotion, চারচক্রযানের দৈর্ঘ্য, আবাসনের বর্গ ফুট, সন্তানের পছন্দমাফিক বিদ্যালয়, Branded পরিচ্ছদ ইত্যাদি আরও অনেক প্রকার হিসাবপত্তর মানুষকে প্রতিনিয়ত বিষাদগ্রস্ততার কুম্ভীপাকে নিষ্পেষিত করে চলেছে। 

ভাগ্যবান অর্জুনের Friend, Philosopher, Guide & Mentor হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন। গীতার প্রথম অধ্যায়ে সপ্তম রিপুর আঘাতে জর্জরিত অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধার করেছিলেন বাকি সতের অধ্যায় জুড়ে ৫৭৬টা শ্লোকের ভোকাল টনিক দিয়ে। মাঝে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে এমন ভয় দেখিয়ে ছিলেন যে অর্জুন জোড়হাত করে বলেছিলেন, 

“নমঃ পুরস্তাদথ পৃষ্ঠতস্তে। 

নমোস্তুতে সর্বত এব সর্ব।। 

“তোমাকে সম্মুখে নমস্কার, পশ্চাতে(?) নমস্কার, হে সর্ব, তোমাকে সর্বদিকে নমস্কার।” শেষে অর্জুন বলেছিলেন, “আমি তোমার এই রূপ দেখে ভীত হয়েছি। তুমি আবার সেই চতুর্ভুজ রূপেই আবির্ভূত হও।” 


(৭) 

আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যাদের কৃষ্ণের মতো Mentor নেই বা থাকলেও ভরসা রাখতে পারি না বৈজ্ঞানিক যুগের যুক্তিবাদের হাতে গরম প্রামাণ্য তথ্যের অভাবে, তাদের পক্ষে সপ্তম রিপুর হাত থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ – 

“Positive thinking and daily dose of exercise 

Makes a person most healthy, wealthy and wise.” 

আর যাঁদের শ্রীকৃষ্ণে বিশ্বাস আছে, তাঁরা পথ খুঁজে পান, 

“সর্বধর্মানাং পরিত্যাজ্যং মামেকং শরণংব্রজ। 

অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্য মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।” 

গীতা-মোক্ষ যোগ/৬৬তম শ্লোক 

কিন্তু মুশকিলটা হোল, আমার মতো “যে জন আছে মাঝখানে” পাবলিকদের।আমরা না পারি “আস্তিক” হয়ে “ভগবান ভরসা”-য় জীবন কাটাতে, আবার ভগবানেরই ভয়ে “নাস্তিক” হতেও পারি না। 

আমাদের জন্য বোধহয় বাঙালীর সেই সদাজাগ্রত ৩৩,০০,০০,০০১ নম্বর ঠাকুরই ভরসা – গুরুদেব শ্রীশ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

ভদ্রলোকের অসীম ক্ষমতা। একের পর এক পরম নিকট আত্মীয়, এমন কি স্ত্রী, পুত্র এবং কন্যা, সবাইকে হারাবার পরও ভেঙে পড়েন নি। তারপরেও তাঁর চিন্তাধারা আর লেখনী স্তব্ধ না হয়ে জন্ম দিয়ে গেছে অসামান্য সব সৃষ্টির। 

একমাত্র তিনিই বোধহয় বলতে পেরেছেন, 

“আমি তোমার কাছে শান্তি চাব না 

থাক না আমার দুঃখ বেদনা।” 

গুরুদেবের অমর সাহিত্য সৃষ্টির অবদানকে মাথায় রেখেও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে ওনার জীবন দর্শনই এই শতাব্দীর মহামারি সপ্তম রিপু রোগটির একমাত্র বিশল্যকরণী – Always stay positive and be productive. 

সর্বশেষে, এটাও বলা প্রয়োজন যে সপ্তম রিপুরও একটি Positive side আছে। অর্জুনের এই রিপুর দ্বারা আঘাত প্রাপ্তের ফল হিসেবে আমাদের “শ্রীমদভগবদগীতা” নামক ৭০০ শ্লোক সমৃদ্ধ মহাগ্রন্থটির প্রাপ্তি। 

“।।কৃষ্ণ বলো, সঙ্গে চলো।।” 

পুঃ এই প্রবন্ধটি গুরু-চণ্ডাল রোগে পিড়ীত। ইহার আরোগ্যের বিধান দান করিয়া কেহ যেন সময়ের অপব্যবহার না করেন। পাঠ সম্পূর্ণ করিয়াছেন- এমন সকল পাঠকবর্গের কাছে ইহাই লেখকের বিনীত মিনতি। Victorian অথবা Queen’s English ভাষার বর্তমান SMS রূপ লেখককে সাহসী হইতে সাহায্য করিয়াছে। 

0 comments:

0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ৮
শিবাংশু দে


''... সেই বাল্যকালে কবে থেকে গান গাইতে শুরু করলাম তা আমার মনেও নেই-- গান গাইছি-তো-গাইছি-তো-গাইছি। কোনো ওস্তাদ অথবা শিক্ষকের কাছে নাড়া বেঁধে বারীতিমতো লেখাপড়া শেখার মতো করে গান আমি কখনও শিখিনি। ছোটবেলার দিনগুলি থেকে শুরু করে, বড় হয়েও শুধু গান শুনেছি আর গেয়েছি। কোনো সঙ্গীত-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গান শিখবার সৌভাগ্য আমার অদৃষ্টে কখনও জোটেনি।''


১৯২৮ সালের গোড়ার দিকে পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জ থেকে আসা এক সতেরো বছর বয়সের সদ্যোতরুণ কলেজ ছাত্র উত্তর কলকাতার সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরে প্রথমরবীন্দ্রনাথের দেখা পেয়েছিলেন। একটু অপ্রত্যাশিত ছিলো সেই অনুষ্ঠানে কবির আগমন। কারণ এই সময় 'ভদ্র'ঘরের 'বয়স্থা' মেয়েদের দিয়ে জনসমক্ষে নৃত্য অনুষ্ঠানপরিবেশন করার অপরাধে ব্রাহ্মসমাজের চাঁইরা কবিকে তীব্রভাবে নিন্দা ও ভর্ত্সনা করে যাচ্ছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য বা দৃষ্টিকোণকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়েসমাজকর্তাদের এক তরফা বিষবর্ষণে তিনি রীতিমতো ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত ছিলেন। কিন্তু সেই সব 'রুচি'বাগীশ কর্তাব্যক্তিদের আমন্ত্রণ তিনি অস্বীকার করেননি এবং সেই সভায়অত্যন্ত অসুস্থ শরীরে তিনি উপাসনা পরিচালনা করা ছাড়াও একটি ব্রহ্মসঙ্গীতও গেয়েছিলেন। এই ঘটনাটি, সেই মূহুর্তে না হলেও ধীরে ধীরে এই তরুণটিকে বিশেষভাবে প্রভাবিতকরে। কবিকথিত, '' সব বিদ্বেষ যেন দূরে যায় তব মঙ্গলমন্ত্রে'' বাণীটি কীভাবে তিনি নিজের জীবনে প্রতিফলিত করতে পেরেছিলেন তার প্রথম পাঠ পেলেন তরুণটি , এভাবেই।


১৯২৯ সালে বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াকালীন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় কয়েকজন মানুষের, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, হিমাংশু দত্ত, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় আর সন্তোষ কুমার সেনগুপ্ত ।সন্তোষকুমার আর তিনি সে সময় একটি মেসে একই ঘরে থাকতেন। সঙ্গীতের আবহের মধ্যে থাকলেও তাঁর সঙ্গীতচর্চা সীমাবদ্ধ ছিলো শুধু ব্রাহ্মসমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেসমবেত গায়কমন্ডলীর একজন হিসেবে। সেই সময় ব্রাহ্মসমাজের গায়করা ব্রহ্মসঙ্গীতের প্রশিক্ষণ দিতেন নিজের মতো করে। সেই তরুণের নিজের ভাষায়, ''.... তখনকার দিনেকোনো স্বরলিপির বই সামনে রেখে শেখানো হত না, গাওয়াও হত না। (শিক্ষকেরা) যেভাবে গাইতেন, আমরাও ঠিক সেইভাবেই গাইতাম। ব্রহ্মসঙ্গীত যা গাওয়া হত তা কার বাকাদের রচিত এইসব প্রশ্নও তখন মনে হতনা। 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' বলে আলাদা কোনো শ্রেণীবিভাগ তখন একেবারেই ছিলোনা। কিশোরগঞ্জে বাবা মায়ের মুখে, ময়মনসিংহেরব্রাহ্মদের মুখে এবং কলকাতাতেও মাঝে মাঝে শুনতাম 'রবিবাবুর গান' অথবা 'রবিঠাকুরের গান'।'' তিনি অবশ্য এক দিক থেকে সৌভাগ্যবান ছিলেন। পারিবারিক যোগাযোগেরকারণে আরও অনেকের সঙ্গে শুনতেন টুলুমাসী, বুঁচিমাসী বা মেজদি'র গান। টুলুমাসী'র গানের গলা ছিলো '' যেমন সুরেলা, তেমন মিষ্টি'', আর বুঁচিমাসীর গলায় '' মিষ্টিত্ব তোছিলই, আবার 'জোয়ারী' বলে একটি মজার ব্যাপারও ছিল''। এই টুলুমাসী ও বুঁচিমাসী, সাহানা দেবীর মতো কবির বিশেষ স্নেহের পাত্রী ছিলেন। টুলুমাসী হলেন সুপ্রভা রায়, সুকুমাররায়ের পত্নী ও সত্যজিতের মাতা, বুঁচিমাসীর ভালো নাম কনক দাশ এবং মেজ'দি ছিলেন সতীদেবী।

''... তখনকার দিনে রুচিসম্পন্ন অবস্থাপন্ন রবীন্দ্র-ভক্ত ব্যক্তিদের বাড়িতে অন্যান্য রেকর্ডের সঙ্গে সাহানা দেবী, কনক দাশ ও সতীদেবীর রেকর্ড বাজতই...'' 


ব্রাহ্ম হলেও, শান্তিনিকেতনের অন্দরমহলে তাঁর কোনও যোগাযোগ ছিলোনা। বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন উৎসবে বেড়াতে যেতেন সেখানে। কিন্তু সেখানে যে গান শুনতেন তারকোনও প্রভাব তাঁর উপর পড়তো না। ''.... এক নম্বর কারণ হতে পারে যে , ঐ গানগুলির রস গ্রহণ বা উপভোগ করার ব্যাপারে আমার নিজের অক্ষমতা কিংবা দু নম্বর কারণহতে পারে এই যে যাদের মুখে ও গলায় ঐ সব গান শুনতাম, গানের মধ্যে রস সঞ্চারণে তাদের অক্ষমতা। আবার এই কথাটিও সত্যি যে তখনকার দিনে সঙ্গীতরসিকরা এবংসাধারণ শ্রোতারাও রবীন্দ্রনাথের প্রেম পর্যায়ের গান এবং ঋতুসঙ্গীতগুলিকেও যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন না। এই সব গানগুলির প্রতি তাদের রীতিমতো অশ্রদ্ধাই ছিল।''


১৯৩৫ সালে চাকরিতে ঢুকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। সুরেন্দ্রনাথের পুত্র সুবীরেন্দ্রনাথের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। এই সময় তিনি সুবীরঠাকুরের সূত্রে ইন্দিরাদেবীর সংস্পর্শে আসেন। ইন্দিরাদেবীর পাম অ্যাভেনিউয়ের বাড়িতে তাঁর নিয়মিত গতায়াত হতে থাকে। ইন্দিরাদেবীই তাঁকে কবির অধ্যাত্মসঙ্গীতের বৃত্তেরবাইরে থাকা গানের সঙ্গে পরিচিত করান। ইন্দিরাদেবী পিয়ানো বাজিয়ে কোন গান কীভাবে গাইতে হয় তার প্রশিক্ষণ দিতেন। ''আমি চিনি গো চিনি তোমারে'' গানটি পশ্চিমীকায়দায় হার্মোনাইজ করে তিনি গাইতেন। তাঁরই নির্দেশনায় যুবকটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাকী রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া শুরু করেন। ''.... সেই দিনগুলি থেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রেম ওনানা পর্যায়ের গানগুলির রসে আমি মজা পেতে লাগলাম।'' তখনও তিনি 'স্বরবিতান' নামের কোনও স্বরলিপি বইয়ের নাম শোনেননি। স্বরলিপি বুঝতেনও না। তবে পরবর্তীকালে'টাকা জমিয়ে' কিছু স্বরলিপির বই তিনি কিনে ফেলতে পেরেছিলেন এবং নিজে নিজে স্বরলিপি দেখে গান গাওয়ার অভ্যেসও হয়ে যায় তাঁর। তিরিশের দশকের শেষদিকে সুরেশচক্রবর্তী মশায়ের উদ্যোগে তিনি বেতারকেন্দ্রে গান গাওয়ার সুযোগ পা'ন আর শৈলজারঞ্জনের নির্দেশনায় কনক দাশের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে এইচ এম ভি থেকে একটিরবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশ করেন। গানদুটি ছিলো, ''সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান'' আর '' হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব'' । কিছুদিন পরে আবার দু'টি গানকনক দাশের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে রেকর্ড করেন তিনি, '' ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে'' আর ''ঐ ঝঞ্ঝার ঝংকারে ঝংকারে...''। মোটামুটি এই সময়েই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ট পরিচয়হয় দ্বিজেন চৌধুরী, অজিত চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ রায় এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আরেকজন ঘনিষ্ট বন্ধুও তিনি পেয়েছিলেন এই সময়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। এইসব বন্ধু,গণনাট্য সঙ্ঘ, ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি এবং পথেঘাটে ইতরশ্রোতাদের সঙ্গে যোগাযোগ, তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সম্পূর্ণ অন্য মাত্রায় বোঝা এবং ততোধিক ভিন্ন শৈলিতেপরিবেশন করার একটা ক্ষমতা এনে দেয়। এই সময়েই শ্রীহট্ট থেকে আসা একটি ছেলে তাঁকে বলেন, '' জর্জদা, রবীন্দ্রসঙ্গীত যেভাবে আপনি গাইলেন সেইভাবে যে রবীন্দ্রসঙ্গীতগাওয়া যায় তা আগে ভাবতেও পারিনি।'' এই ছেলেটির নাম ছিলো হেমাঙ্গ বিশ্বাস। শুধু যে নতুন প্রজন্মের শ্রোতারাই জর্জ'দার গুণগ্রাহী ছিলেন তাই নয়, সেই সময় বাংলা গানেরজগতে অলিখিত রাজা পঙ্কজকুমার জর্জদা'কে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। পঙ্কজকুমার জর্জদা'কে কখনও ডাকতেন 'সম্রাট' বা কখনও 'মিস্টার ট্রাস্ট' সম্বোধনে। ডেকে নিয়ে গিয়েনিউ থিয়েটার্সের ফিল্মে কোরাস গাওয়াতেন। সত্যি কথা বলতে কি সেই সময়, অর্থাৎ চল্লিশ দশকের প্রথম দিকে, জর্জদা প্রকাশ্যে মাঠেঘাটে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র বা হারীনচট্টোপাধ্যায়ের লেখা গান গাইতেন মূলতঃ গণনাট্যের অনুষ্ঠানে।এ ছাড়া ব্রাহ্মসমাজ সম্পৃক্ত আসরে বা ইন্দিরাদেবীর গীতবিতানের অনুষ্ঠানে, সমবেত বা একক রবীন্দ্রসঙ্গীতগায়ন ছিলো তাঁর গানের বিশ্ব। গণনাট্যের আসরেও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন তিনি, কিন্তু সেখানে চাঁইরা তাঁর এই শখটিকে 'বিচ্যুতি' বলেই মনে করতেন। তাঁর একক রবীন্দ্রসঙ্গীতেররেকর্ড কিন্তু প্রকাশিত হয়েছিলো চল্লিশ দশকের শেষ দিকে। ঠিক কবে হয়েছিলো তা তাঁর মনে ছিলোনা। তবে খুঁজে পেতে দেখা যাচ্ছে ১৯৪৭ সালে তাঁর প্রথম ডিস্ক কলাম্বিয়াকোম্পানি বাজারে ছাড়ে। একদিকে, ''এ শুধু অলস মায়া'' আর অন্যদিকে ''দিন পরে যায় দিন''। তার পর বছর ন-দশ তিনি কলাম্বিয়া ছাপেই রেকর্ড করতেন। কিন্তু সেটা বন্ধ হয়েযায় রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ডের বাজার যথেষ্ট ভালো নয় বলে।

গণনাট্য সঙ্ঘ ও কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে এই 'ঘনিষ্টতা' ও তদ্ভব অনুপ্রেরণা, জর্জদাসহ আরো যে দুজন শিল্পীকে ভবিষ্যতের রবীন্দ্রসঙ্গীত মানচিত্রে চিরস্থায়ী গরিমার আসন এনেদিয়েছিলো তাঁরা হলেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্র। 


জর্জদা বা দেবব্রত বিশ্বাস সম্পর্কে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী বা শ্রোতাদের মনে যে অনুভূতিটি রয়েছে তা'কে নৈসর্গিক বলা যেতে পারে। অনুভবের জগতে ব্যক্তি জর্জদা হয়তোএকজন আত্মীয়ের মতো মুগ্ধ জনতার হৃদমাঝারে নিজের স্থান করে নিয়েছেন, কিন্তু তাঁর গাওয়া গান আজকের শ্রোতাদের কাছে জল-মাটি-অক্সিজেনের মতো প্রাকৃতনৈসর্গিক সম্বল। তাঁর যে দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্বের বিবরণ ইতোমধ্যে দিয়েছি সেখানে একটা সূত্র অতি স্পষ্ট, তাঁর গান শোনা বা শেখার পদ্ধতি ছিলো একান্ত নিজস্ব। তার সঙ্গে আরকোনও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর শিক্ষা বা অনুশীলন ক্রিয়াকে তুলনা করা যায়না। যে দুজন শিল্পীর রবীন্দ্রসঙ্গীতচর্চা সিদ্ধির বিচারে তাঁর নিকটতম, সেই পঙ্কজকুমার বাহেমন্তকুমারের সঙ্গেও এই ক্ষেত্রে তাঁর কোনও সমান্তরাল মাত্রা নেই। তাঁদের তিনজনের মধ্যে যে উল্লেখযোগ্য সাধারন লক্ষণগুলি রয়েছে, তার মধ্যে প্রধান তাঁদের প্রত্যেকেরনিজস্ব বিপুল জনপ্রিয়তা। কোনও পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল্যে নয়, স্বকীয়তার উজ্জ্বল মানদন্ডে তাঁরা শ্রোতার মনের নিভৃতকোণে নিজেদের তো বটেই, আরো সরাসরি বলতেগেলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য প্রাপ্য সিংহাসনটি পেতে দিয়েছিলেন।


জর্জদার গান আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন আসরে শুনেছি পাঁচ-ছ'বার। রেকর্ডের গান তো জ্ঞান হওয়া থেকে প্রায় নিত্যদিনের সঙ্গী। বহুবার বোঝার চেষ্টা করেছি ওঁর গানের মধ্যেকোন লক্ষণটি এতো বেশি মোহগ্রস্ত করে? তা কি তাঁর ব্যারিটোন কণ্ঠ অথবা শব্দে সুর প্রয়োগের অন্যতর ভঙ্গি, কিংবা সাড়ে তিন মিনিটের এক-একটা নির্মাণে প্রত্যেকবার পাল্টেযাওয়া প্যাটার্ন। মন্দ্রসপ্তকে কাঁচ চুরমার জোয়ারির টান আর তারসপ্তকে পঞ্চম পেরিয়েও অনায়াস সুর ধরে রাখা, '' ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি''।কমবয়সে বুঁচিমাসীর গলায় জোয়ারি শুনে রোমাঞ্চিত স্মৃতিকে ম্লান করে তাঁর নিজের কণ্ঠে, '' গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিলো তারা''। এইসব জাদু পেরিয়ে থেকে সম্পূর্ণ অন্যমেরুতে থাকা তাঁর মহাভারতের কর্ণের মতো একটি ভাবমূর্তি, যার সারাজীবনের 'পরাজয়ে'র পদাবলীই শ্রোতার কাছে জয়ের ফলকপ্রস্তর। পন্ডিতের ভৎর্সনা প্রপাত, শ্রোতাদেরহাত ধরে ফিরে আসতো পুষ্পবর্ষা হয়ে। শ্বাসরোগে সীমিত দমের আকুলতাকে ব্যবহার করতেন ম্যারাথন দৌড়ে শেষ ল্যাপে সাফল্যের অধীরতার মতো। সব মিলিয়ে একটাএকেবারে অন্যরকম একটা পরিবেশনা, যা শুনলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিরায় রক্তের লালিমা অনুভব করা যেতো। তপ্ত, উজ্জ্বল, চরিতার্থ মাত্রার সম্পূর্ণ অনুভব। 

যতো বয়েস বেড়েছে, জর্জদা'র কন্ঠস্বরের ন্যাচরল বেস বেড়েছে আর কমেছে লয়ের দ্রুততার দম। এই প্রাপ্তি ও ক্ষতি, দুটোকেই তিনি অবলীলায় ব্যবহার করতে পেরেছেননিজের পক্ষে। যতোদিন গেছে তিনি গানের লয় কমিয়ে দিয়েছেন। স্বরবিতানে যে তালনির্দেশ করা আছে তাতে বদ্ধ না থেকে তালমুক্ত নাটকীয়তা নিয়ে এসেছেন গাইবার সময়।এই গুলো ই তো ছিলো তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ। তবে এ সবই তাঁকে শ্রোতার কাছে বেশি করে নিয়ে এসেছে, সে শ্রোতা 'প্রস্তুত' বা 'অপ্রস্তুত' তার অপেক্ষা রাখেনি।‘পন্ডিত’রা পরিস্থিতিটি ঠিক বুঝতে পারেননি তখন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের শুদ্ধতা নিয়ে বেশ দ্বিধায় ছিলেন।


কণ্ঠের সুর দিয়ে গানকে বেঁধে রাখা ছাড়াও তিনি সম্পূর্ণ অন্য শৈলিতে চিন্তা করেছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ডে যন্ত্রানুষঙ্গের প্রয়োগ নিয়ে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর শেষ যুদ্ধ তোছিলো-ই এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। গান পরিবেশনের সময় সহযোগী যন্ত্রসঙ্গীতের কুশল ব্যবহার, সম্পূর্ণ আবহ ও গানের চরিত্রটিকে অন্যস্তরে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তুকর্তাবাবারা তাঁকে অতোটা স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। বাকিটা তো ইতিহাস। এই বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার সামান্য কিছু উদাহরণ দেখা যেতে পারে। যেমন, 'এইতো ভালোলেগেছিলো', পুরোনো রেকর্ড, যন্ত্রানুষঙ্গ শুনলে মনে হবে যেন একজন বাউল গাঁয়ের পথে পথে গেয়ে চলেছে, সুরের উচ্চাবচ, ধারাস্রোতের মধ্যে একটা গড়িয়ে যাওয়ার গতিআছে। এটাই ঐ সুরবিন্যাসের নাট্যরস। পুরোনো গানের মধ্যে 'আজি যতো তারা তব আকাশে'যন্ত্রবিন্যাসের মধ্যে একটা বিরাটকে ধরার জমকালো প্রয়াস আছে। অন্তত ষোলোপিস অর্কেস্ট্রা ব্যবহার হয়েছে মনে হয়। কয়েকটি গানের যন্ত্রায়োজন বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, যেমন, গায়ে আমার পুলক লাগে, এ কী মায়া লুকাও কায়া, বহুযুগের ওপারহতে, দারুণ অগ্নিবাণেরে, গোধূলিগগনে মেঘে ইত্যাদি ইত্যাদি। 'বহুযুগের ওপার হতে' শুনলে মনে হয় সলিল চৌধুরির কম্পোজিশন। 'প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে'র প্রায় সমান সুরেতৈরি ' আমার জ্বলেনি আলো অন্ধকারে'র লয় ধরে রেখেছে ম্যারাকাস। গলার রিভার্ব বাড়িয়ে শুধু কর্ডে আঘাত করে লয় ধরে রাখা তাঁর আগে রবীন্দ্রসঙ্গীতে আর কেউ করেনি।যেসব গানের সুরে অভিভাবক রাগের ভূমিকা প্রকট থাকে, সেখানে মূলত বাঁশি ( কারণ তাঁর কন্ঠের মন্দ্র ও বাঁশির তার পরস্পরকে বেঁধে রাখে) মুখ্য ভূমিকা পালন করে, তারসঙ্গে থাকে সেতার ও বেহালা। যেমন, আজি শ্রাবণ ঘন গহন মোহে, আমার যেদিন ভেসে গেছে, আমার রাত পোহালো ইত্যাদি। আবার একটু দ্রুত লয়ে, অনেক দিনের আমার যেগান, প্রিলিউড পিয়ানো দিয়ে, কিন্তু চলে যাচ্ছে বাঁশিতে। আবার ঢিমে লয় 'এ মণিহার' য়ে তিনি তাঁর কন্ঠের বেসকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, তাই গানটি বাঁশি দিয়ে শুরু করে বেহালায়চলে যাচ্ছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ও বাণীর মধ্যে যে নাটকীয় টানাপড়েন তাকে তিনি সতত সফলভাবে খুঁজে পেয়েছেন এবং নিজের পরিবেশনায় তাকে মূলস্রোতের সঙ্গে পূর্ণমর্যাদায় মিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন।

আজকের শ্রোতাদের কাছেও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা সমানভাবে স্বীকার্য। তাঁর গায়ন পদ্ধতি ও রবীন্দ্রসঙ্গীতকে একটি ভিন্নমাত্রায় নিজস্বভাবে ব্যাখ্যা করার সামর্থ্য, তাঁকে নিজেরসময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে রেখেছিলো।

0 comments:

0

বইঘর - রঞ্জন রায়

Posted in


বইঘর
রঞ্জন রায়



নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা
— একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া 

[এটি সন্মাত্রানন্দ রচিত “নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা- অতীশ দীপংকরের পৃথিবী” উপন্যাসটির পুস্তক সমালোচনা নয়, সে যোগ্যতা আমার নেই, -- বড়জোর এক মুগ্ধ পাঠকের প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে। ] 

পাতা ওল্টাতেই বিস্ময়। দর্শনের গুঢ় এবং কূট প্রশ্ন ও কয়েক শতাব্দী আগে জন্মানো এক ক্ষণজন্মা বাঙালী মেধা অতীশ দীপংকরকে নিয়ে উপন্যাস লেখার কথা ভেবেছেন প্রথম জীবনে রামকৃষ্ণ মিশনে সেবাব্রতী এক সন্ন্যাসী! এই পাঠকের মিশনের সঙ্গে যতটুকু সম্পর্ক তাতে ওখানকার সন্ন্যাসীরা গৌতম বুদ্ধকে জয়দেব গোস্বামীকৃত দশাবতার স্তোত্রের বেঁধে দেয়া ভূমিকা অনুযায়ী বিষ্ণুর এক অবতার --‘নিন্দসি যজ্ঞবিধেয়রহযাতম, সদয়হৃদয়দর্শিতপশুঘাতম’ হিসেবে ভাবতেই অভ্যস্ত। 

কিন্তু ‘অনাত্মবাদীন’ ‘ক্ষণিকবাদীন’ বৌদ্ধদর্শন মিশনের জীবনে কোন অভিঘাত সৃষ্টি করে না। কারণ রামকৃষ্ণদেব ও বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক মানসভূমি বেদান্ত এবং ধর্মাচরণের বাহ্যিক দিকটি শাক্তমত ও তন্ত্র আশ্রিত। ঠাকুরের ভৈরবীসাধনা ও বেলুড়ে কালীপূজোর রাতে পশুবলি জনসাধারণের গোচরে। 

অথচ বইটি ইতিহাসের গবেষণাপত্র নয়, কোন দার্শনিক পাত্রাধার-কি-তৈল কিংবা তৈলাধার-কি-পাত্র বিচারে কণ্টকিত গ্রন্থ নয় । এটি আদ্যন্ত নিটোল একটি উপন্যাস। ইহাতে কল্পনার যাদুমিশ্রণ, প্রেম-প্রত্যাখ্যান-বিরহ-বলিদান-প্রতিহিংসা-জয়-পরাজয় সবই আছে। 

উপন্যাসটি লিখলেন সন্মাত্রানন্দ! প্রথমেই সংশয়। একজন গার্হস্থ্যজীবন পরিত্যাগী মানুষ কী করে ফুটিয়ে তুলবেন ষড়রিপুর তাড়নায় জ্বলেপুড়ে খাক হওয়া মানুষের ছবি? যিনি এই রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের জগতকে অবিদ্যাজনিত মিথ্যাত্বের সাময়িক সৃষ্টি বলে মেনে নিয়েছেন তাঁর কলমে কী করে ফুটবে এর সৌন্দর্য ও কন্টকিত রূপ? এই পূর্বাগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। 

অবশ্য সন্ন্যাসীর সাহিত্যচর্চা একেবারে কালাপাহাড়ি কিছু নয়। স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছেন ‘সখার প্রতি’ ও ‘দি কাপ’ এর মত কবিতা। আর রচেছেন অতি আধুনিক বাংলায় ছোট ছোট বাক্যবন্ধে ‘প্রবাসে’র মত জার্নাল। পণ্ডিচেরির নিশিকান্তের কবিতাও স্মরণীয়। তবে সেসব আধ্যাত্মিক বক্তব্যের কাব্যরূপ। কবিতার শৈলীর আবশ্যকীয় বিমূর্ত মাত্রা সেই স্পেস দেয় । কিন্তু গদ্যরচনা? বিশেষ করে উপন্যাস? এখানে তো চরিত্ররা রক্তমাংসের, সময় অতীতচারী হয়েও ছুঁয়ে যাবে সমকালের যন্ত্রণাকে, নইলে তা পর্যবসিত হয় জাদুঘরের দ্রষ্টব্যে। উপন্যাস লেখার এ’সব ঝামেলার সঙ্গে সন্মাত্রানন্দ সম্যক অবহিত। তাই বইটির প্রস্তাবনায় তিনি অকপট—“ – অতীশ দীপংকরের জীবনেতিহাস এ উপন্যাসের আশ্রয়, কিন্তু বিষয় নয়।– শাশ্বত মানবীসত্তাই ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু। কখনও সে-নারীসত্তার নাম কুন্তলা, কখনও স্বয়ংবিদা, কখনো –বা জাহ্নবী”। 

গজব রে গজব! এই সংশয় শুধু আমার নয়। বইটি পড়ে জানতে পারলাম যে মিশন কর্তৃপক্ষ ও একই দোলাচলে ভুগেছেন সন্মাত্রানন্দের সাহিত্যকৃতি নিয়ে, অবশ্য আমার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। তাই একদিন তাঁকে নিজের ঝোলা কাঁধে তুলে মিশন থেকে বেরিয়ে আসতে হল। শ্রেয় ও প্রেয়র দ্বন্দ্বে উনি কলমকেই বেছে নিলেন আর আমরা পেলাম এই উপন্যাসটি। 

এই ঘটনাটি, এই কঠিন নির্ণয় তাঁর মানসে এক অমিট ছাপ ফেলেছে। তাই বইটির কথক হিসেবে নিজের জীবনের আদলে বর্ধমান থেকে কোলকাতায় এসে সোনারপুরের হোস্টেলে থেকে বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে স্ট্যাটিস্টিক্সে এম এস সি করে সন্ন্যাসী হওয়া এবং সাহিত্যচর্চার তাগিদে মিশন থেকে বেরিয়ে এসে লেখক হওয়া শাওন বসু চরিত্রটির নির্মাণ। তাই ভিক্ষু মৈত্রীগুপ্ত বিক্রমশীলা বিহারে সঙ্ঘনির্দিষ্ট আচারবহির্ভূত আচরণের জন্যে অতীশ দীপংকরের আদেশে সঙ্ঘ থেকে বহিষ্কারের মুখোমুখি হয়েও অবিচলিত শান্ত ও নির্বিকার থেকে যান । 

এবার আসি মূল বইটির কথায়। এর ‘কথনশৈলী’ আদৌ একরৈখিক নয় । এতে সময় তিন খন্ডে বিভক্ত—দশম শতকের শেষ থেকে একাদশ শতক,ত্রয়োদশ শতক ও একবিংশ শতক। কিন্তু এই ত্রিস্তর কালখণ্ডগুলো বিচ্ছিন্ন (ডিস্ক্রিট) নয়; বরং ‘ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বস্তুত একই সমতলে অংকিত পরস্পরছেদী তিন বৃত্তের মতন। এর পর আরও জটিল গঠন চোখে পরে । যেমন, “ওই তিনটি বৃত্তের ছেদবিন্দুগুলোর মধ্য দিয়ে কোনো কোনো বিশেষ মুহূর্তে এক যুগের চরিত্রগুলোর সঙ্গে অন্য যুগের চরিত্রদের’ দেখা হয়ে যায়, বিনিময়ও হয়। 

একে কী বলব? বাঙলাভাষায় লেখা প্রথম জাদু-বাস্তবতার উপন্যাস? জানি না । সেই নান্দনিক বিচারের ধৃষ্টতা আমার নেই । তবে আমি বলব যে এই প্রচেষ্টায় লেখার প্রসাদগুণ, কালোপযোগী ভাষার পরিবর্তন ও লেখার টান আমাকে বাধ্য করেছে সারারাত জেগে একটানা পড়ে উপন্যাসটি শেষ করে পরের দিন দুপুরে পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখে ফেলতে। কারণ, দেরি করলে সেটা হবে সুচিন্তিত এক সমীক্ষা; আতসকাঁচে ধরা পড়া অনেক ফাঁকি-ফোকর। কিন্তু উপে যাবে আমার তাৎক্ষণিক ভালো লাগা, পূর্বাগ্রহ কাটিয়ে মুগ্ধতায় ভেসে যাওয়া। 

কেন মুগ্ধতা? 

প্রথম কারণটি সন্ন্যাসীর কলমে প্রকৃতি ও নারীর রূপবর্ণনা, তাও একজন সাধারণ পঞ্চেন্দ্রিয়তাড়িত পুরুষের রূপমুগ্ধতার দৃষ্টিতে। কোথাও কোথাও দুই এক হয়ে গেছে। 

কাহিনীর আশ্রয় বাঙ্গালাদেশের ঢাকা- বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মানো রাজপুত্র চন্দ্রপ্রভ কেমন করে সুবর্ণদ্বীপে (ইন্দোনেশিয়া) আচার্য ধর্মকীর্তির কাছে পাঠশেষ করে বিক্রমশীলা মহাবিহারের আচার্য অতীশ দীপংকর হয়ে উঠলেন। কিন্তু মূল সুরটি হল প্রতিবেশী কিশোরী কুন্তলার বিফল কামনা, ও তন্ত্রসাধনার মধ্য দিয়ে কখনো স্বয়ংবিদা কখনও অন্যরূপে অতীশকে পাওয়ার প্রয়াস। এইভাবে এবং একবিংশ দশকে সেই বজ্রযোগিনী গ্রামে কৃষক অনঙ্গ দাসের কন্যা জাহ্নবীর মধ্যেও সেই চিরন্তন নারী হৃদয়ের আকুতির প্রকাশ। আর কালচক্রের পরস্পরছেদী তিন বৃত্তের ঘুর্ণনে চিরন্তন নারী কখনও ইয়ংচুয়া, কখনও স্বয়ংবিদা, কখনও বা জাহ্নবী। বাৎসল্য, প্রেম ও দাম্পত্যের মধ্যে নারীর তিন রূপের প্রকাশ। তাই তারাদেবীর ও তিনটি মূর্তি,--কাঠের, পাথরের ও ব্রোঞ্জের। 

এবার একটু তিব্বতী শ্রমণ চাগ লোচাবার চোখে স্বয়ংবিদার রূপ দর্শন করা যাক। 

‘শ্বেত রাজহংসের মত দৃঢ়পিনদ্ধ শুভ্র কঞ্চুলিকা, সুনীল উত্তরী পীনোন্নত বক্ষদেশকে আবৃত করে স্কন্ধের উপর বিলম্বিত ও দীর্ঘিকার মন্দবাতাসে উড্ডীন। ----- 

‘স্বয়ংবিদা প্রশ্ন করলেন, “কী দেখছ লামা? একে রূপ কহে। এই রূপসমুদ্র অতিক্রম করতে পারলে সন্ন্যাসী হবে। আর যদি অতিক্রম করতে অসমর্থ হও, যদি এতে নিমজ্জিত হও , তবে কবি হবে”। (পৃ- ১২৭) 

‘অশ্রুর প্লাবনের ভিতর অপরূপা রমণীর দৃঢ় কুচাবরণ কঞ্চুলিকা শিথিল হ’ল। শিহরিত চাগ দেখলেন, সেই সুবিপুল কনককলসবৎ স্তনকুসুমের যুগ্ম কুচাগ্রচূড়া অনাবৃত বিস্ময়ে তাঁরই দিকে উন্মুখ হ’য়ে তাকিয়ে রয়েছে। --- আহ! এ কী জ্বালা! রমণীর চুম্বনে এত বিষ , এত ব্যথা! ‘(পৃ- ১৩৬) 

আর চুয়াল্লিশটি অধ্যায়ে বিবৃত ও প্রায় ৩৫০ পৃষ্ঠায় বিন্যস্ত এই উপন্যাসটিতে ধ্রুবপদের মত ঘুরেফিরে আসে একটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক দোঁহা—‘ যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস/ নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধুলিকালীন মেঘ/ পুষ্পরেণু ভেসে আসবে বাতাসে/ আর পালতোলা নৌকো ভেসে যাবে বিক্ষিপ্ত স্রোতোধারায়---/ সহসা অবলুপ্ত দৃষ্টি ফিরে পেয়ে তুমি দেখবে—আমার কেশপাশে বিজড়িত রয়েছে অস্থিনির্মিত মালা;/ তখন –কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব ---‘। 

দ্বিতীয় মুগ্ধতা সন্ন্যাসী লেখকের সমকালের রাজনৈতিক ও সামাজিক পটপরিবর্তনের প্রতি সজগতা ও সংবেদনশীলতা। বিশ বছর পরে কলকাতায় ফিরে এসেছে স্বামী শুভব্রতানন্দ, পূর্বাশ্রমের শাওন বসু হয়ে। দেখছে এই কোলকাতাকে সে চিনতে পারছে না । 

‘উড়াল পুলের ঘোমটা আর বাইপাসের ওড়না পরেছে কল্লোলিনী।--- কলকাতার নিজস্ব সম্মান ছিল তার কৃষ্টিতে, তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে, এখন ব্যবসায়ীদের হাতে বিকিয়ে গেছে। ক্রমশঃ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে মানুষ, কেমন খিঁচিয়ে কথা বলে আজকাল সবাই। কেউ কাউকে একটু সরে বসে জায়গা দিতে রাজি নয়’। 

আবার দেখুন রাজনীতির ক্ষেত্রে ‘ আদর্শ কিছু নয় ক্ষমতাই সব। --- কেন্দ্রে সমাসীন এই ধর্মধ্বজীরা যাকে হিন্দুধর্ম বলে মানে, সেটা পৌরাণিক হিন্দুধর্মেরও একটা অবক্ষয়িত রূপ। এবং তারা নিজেদের সবথেকে বড়ো দেশপ্রেমিক বলে মনে করে। অহিন্দুরা কি ভারতীয় নয়?’ 

জে এন ইউয়ের কানহাইয়া কুমারের ঘটনায় বিচলিত প্রাক্তন শিক্ষক সন্মাত্রানন্দ লেখেন—‘ গ্রেপ্তার হয়ে গেল ছাত্রটি। বিচারের আগেই দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রাঙ্গণে আইনজীবীরা ছেলেটির ওপর প্রচণ্ড প্রহার চালাল। ---- 

‘ছাত্ররা কি রাজনীতি করবে? নাকি, ছাত্রাণাং অধ্যয়নং তপঃ? (আহা! কী অভিনব চিন্তা!)বিচারের আগেই আইনজীবীরা কি আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারেন? তাঁদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে না কেন কেউ? এসব বহু তাত্ত্বিক আলোচনার অন্তে ছাত্রটি যখন ছাড়া পেল, তখন রাজনৈতিক দলগুলি এই যুবক ছাত্রটির মধ্যে তাদের মেসায়াকে খুঁজে পেতে লাগল’।(পৃ-১৪৩)। 

তৃতীয় কারণ, পৃ-১৫৬তে মতবাদ ও সত্যের আপেক্ষিকতা নিয়ে প্রাঞ্জল ব্যাখ্যাটিঃ 

‘মানুষ সত্যের এক-একটি রূপ কল্পনা করে মাত্র। আর সত্যের উপর আরোপিত বা কল্পিত সেই সব রূপকেই ‘মতবাদ’ কহে। অধিকারীবিশেষে প্রতিটি মতবাদই প্রাথমিকভাবে উপকারী, কিন্তু কোনও মতবাদই সত্যকে সাক্ষাৎ দেখিয়ে দিতে পারে না । যুক্তি প্রয়োগ করলে সমস্ত মতই অন্তিমে খণ্ডিত হয়ে যায়’। 

বিতর্কসভায় দীপংকরের মুখে এই বাক্যটিতে এক লহমায় ধরা পরে সমস্ত ‘বাদ’, --হিতবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, জাতীয়তাবাদ থেকে সমাজবাদ ও মার্ক্সবাদ—এর উপযোগিতা ও সীমাবদ্ধতা। জীবন চলমান আর সমস্ত ‘বাদ’ দেশ ও কালে আবদ্ধ। তাই স্থবির। 

মুগ্ধতার শেষ কারণটি একটু ব্যক্তিগত। পৃষ্ঠা ৮৬ থেকে পাচ্ছি অতীশ দীপংকরের ভাবনাবিশ্ব। এখানে পৌঁছে চমকে গেলাম। প্রাক্তন বৈদান্তিক সন্ন্যাসী কত সংক্ষেপে ও সহজ করে দীপংকরের অনুভবের মাধ্যমে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করছেন বৌদ্ধদর্শনের সার। বিশেষ করে এই দুটো তত্ত্ব--তার ‘ল অফ কজালিটি’ বা কার্য-কারণ সম্পর্ এবং নির্বাণ বলতে কী বোঝায়। আর বৌদ্ধদের মধ্যেও সেই ধারণাগুলির বিবর্তন। প্রতি বিষয়ে প্রাচীন সর্বাস্তিবাদী ও সৌত্রান্তিক( মোটা দাগে হীনযানী) এবং শূন্যবাদী ও বিজ্ঞানবাদীদের ( মহাযানী) মধ্যে কোথায় তফাৎ ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন মহাযান ও হীনযান নামের উদ্ভব ও সার্থকতা। উঠে এসেছে আদি বুদ্ধিজম ও পরবর্তী সংশোধনের যাথার্থ্য নিয়ে বিতর্ক। অনেকটা যেন ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট প্রভেদ, বা কম্যুনিস্ট শিবিরের গোঁড়া মার্ক্সবাদী ও সংশোধনবাদীদের বিতণ্ডা। 

আমি কয়েকবছর আগে কাংড়ার ধর্মশালায় তিবেতান ইন্সটিট্যুট এর বারান্দায় এক তরুণ লামাকে চেপে ধরে বৌদ্ধদর্শনের কার্য-কারণ তত্ত্ব (পতীচ্চসমুৎপাদ) বোঝার চেষ্টা করি। এঁরা নাগার্জুনের মাধ্যমিক দর্শন বা শূন্যবাদের অনুগামী। তারপর দিল্লির টিবেট হাউসে অধ্যক্ষ লামার দর্শন ক্লাসে যাই ও ‘গতে গতে পারাগতে’র ব্যাখ্যা শুনি যা এই উপন্যাসে দীপংকরের ভারতে গুপ্তভাবে গ্রন্থ পাঠানোর প্রয়াসে কোড হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তারপর মন না ভরায় কোলকাতায় থেরবাদীদের প্রধান ভিক্ষু সুমনপালের কাছে যাই। উনি মিলিন্দ-পঞহো অর্থাৎ রাজা মিনান্দার ও ভিক্ষু নাগসেনের মধ্যে প্রশ্নোত্তর পড়তে বলেন। 

কিন্তু এখানে এই বারো নম্বর অধ্যায়ে সন্মাত্রানন্দ সংক্ষেপে সুন্দর বুঝিয়েছেন। 

“ ইতি ইমস্মিং সতি, ইদং হোতি। ইমসসুপ্পাদা, ইদং উপজ্জতি।–যদি এই কারণটি উপস্থিত থাকে, তবে এই ফল হবে। কারণ উৎপন্ন হলে কার্যও উৎপন্ন হবে। ইতি ইমস্মিং অসতি, ইদং ঞ হোতি। ইমস্ম নিরোধা, ইদং নিরুজ্ঝতি। -- যদি এই কারণ না থাকে তাহলে এই ফলও থাকবে না । কারণটির নিরোধ হলে কার্যটিও নিরুদ্ধ হয়ে যাবে”। (এখানে কি লেখক এই ধারণাটির একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা ‘ডিপেন্ডেন্ট অরিজিনেশনে’র পক্ষে?) 

তারপর এসেছে এই কার্য-কারণ শৃংখলার বারোটি কড়া বা নিদান; যথাক্রমে অবিদ্যা, সংস্কার, বিজ্ঞান, নামরূপ, ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা, তৃষ্ণা, উপাদান, ভব, জাতি ও দুঃখ। এর একটি থাকলেই অপরটি থাকবে, একটি চলে গেলেই অপরটিও নির্বাপিত হবে। আর এই চক্রাকারে আবরতনের নাভি হল তৃষ্ণা। তাই নির্বাণপ্রাপ্তির জন্যে জয় করতে হবে সমস্ত তৃষ্ণাকে, এমনকি নির্বাণের তৃষ্ণাকেও! কোথাও কি এলিয়টের নাটক ‘মার্ডার ইন ক্যাথিড্রাল’ এ রাজদন্ডে মৃত্যুর আগে বিশপ অফ ক্যান্টারবেরির কাছে শহীদ হওয়ার লোভ ত্যাগের প্রস্তাবের কথা মনে পড়ছে! 

তারপর এল পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত করে এল এই নির্ণায়ক কথা যে রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান বা আত্মচেতনার প্রবাহ –এই পঞ্চস্কন্ধ মিলেই ‘আমি’। এর বাইরে আর কোন জ্ঞেয় বস্তু নেই । 

তারপর বিতর্কসভার মধ্য দিয়ে আমরা হীনযান ছেড়ে মহাযানে পৌঁছালাম, আরও বলতে গেলে অসঙ্গ –বসুবন্ধুর বিজ্ঞানবাদে। এখানে সন্মাত্রানন্দ কি মহাযানের পক্ষে একটু টেনে খেলিয়েছেন? কারণ আলয়বিজ্ঞান ও বিজ্ঞপ্তিমাত্রতার ধারণার সঙ্গে (জ্ঞাতা-জ্ঞেয় অভেদ) যে অদ্বৈত বেদান্তের (অহং ব্রহ্মোস্মি) বেশ মিল! আর উপন্যাসকারের সে স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু সতর্ক লেখক ধরিয়ে দেন যে বৌদ্ধমতে সকলই ক্ষণিক, নিয়ত পরিবর্তনশীল। অন্যদিকে উপনিষদের কথিত ‘আত্মা’ জীবের অপরিবর্তনীয় সত্তা। 

আমার পরিচিত অনেকের কাছে এই অধ্যায়টি বাহুল্য এবং কাহিনীর গতিরোধক মনে হয়েছে। আমার তা মনে হয় নি। উপন্যাসে কাহিনীর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ দেশ-কাল-চরিত্রকে এবং তাদের মধ্যের সংঘাতকে তুলে ধরা। তাই ভাল উপন্যাসে একটি ডিসকোর্স থাকবেই। আর এই দার্শনিক অভিঘাতের মধ্যেই রয়েছে দীপংকর চরিত্রের অনীহার বীজ যা তাকে সংসার , ঐশ্বর্য এবং নারীর প্রেমের আহবানকে প্রত্যাখ্যান করতে প্রেরিত করে। 

আমার মুগ্ধতার চতুর্থ কারণ, আচার্য ধর্মকীর্তির চরিত্রচিত্রণ ও তাঁর সঙ্গে অতীশ (চন্দ্রগর্ভ) এর আলোচনায় বৌদ্ধদর্শনের নির্বাণ ও বোধিলাভের সঙ্গে আপামর জনসাধারণের ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনে অবিচার ও অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার অনুসন্ধান করা। 

ধীমান আচার্য ধর্মকীর্তি বুদ্ধিষ্ট লজিকের বিরাট ব্যক্তিত্ব, ‘প্রমাণবার্তিকে’র মত গ্রন্থ লিখেছেন। আর একদিকে সহজ সরল ও বালকের মত কৌতুক ও পরিহাসপ্রিয়। ছবিটি মিলে যায় পঞ্চাশ বছর আগে কোলকাতায় প্রকাশিত অবন্তীকুমার সান্যাল ও জয়ন্তী সান্যাল সম্পাদিত ‘হাজার বছরের প্রেমের কবিতা’সংকলনে ধর্মকীর্তির রচনা বলে প্রকাশিত একটি চার লাইনের কবিতায়। যার সারাংশ হচ্ছেঃ 

নারীকে দেখেই আমি বুঝেছি ভগবান বুদ্ধের কথাটি যথার্থ যে এই বিশ্বের স্রষ্টা কোন ঈশ্বর হতে পারে না। কারণ, তাহলে নারীকেও ঈশ্বরই সৃষ্টি করতেন। তারপর কি তিনি তাঁর এই অপরূপ সৃষ্টিকে ছেড়ে দিতেন! 

উপন্যাসের ১১০ পাতায় সংশয়দীর্ণ ধর্মকীর্তি শিষ্য অতীশ দীপংকরকে প্রশ্ন করেনঃ 

পীড়িত জনতা আনন্দময় জীবনের স্বপ্ন দেখে। তারা নির্বাণ চায় না, বাঁচতে চায় । তারা চায় দূঃখ-অতিক্রমী আনন্দময় জীবনযাপনের কৌশল। তাদের এই চলমানতার দর্শন যদিও কী বৈদিক, কী শ্রামণিক শাস্ত্রদ্বারা সমর্থিত নয়, তবু আস্তিক, নাস্তিক, লোকায়ত, উপাসনাকেন্দ্রিক সকল প্রকার চিন্তাকেই তা আত্মস্থ করে নিয়ে সমাজজীবনে স্থান দিয়েছে। ‘আমি তাই ভাবি, বস্তুত আমাদের ধর্মদেশনা কি লোকসাধারণের উপকার করে? অথবা, আমরাই লোকসাধারণের দ্বারা উপকৃত হই?’ 

এ সংশয় একেবারেই ঘটমান বর্তমানের সংশয়। আমাদের সবার মনেই অহরহ এ প্রশ্ন ওঠে, নানাভাবে। 

আবার তরুণ অতীশ বলেন— যে কোনও যুগেই পরপীড়ক রাজশক্তি লোকসাধারণের ওই দারিদ্র্যবিজয়ী দুঃখজয়ী জীবনীশক্তি শোষণ করে নিতে চায়, কিন্তু তা নিবিয়ে দিতে পৃথিবীর তাবৎ নৃপতিই অসমর্থ। 

এ যেন রবীন্দ্রনাথের ‘ওরা কাজ করে’ পড়ছি বা শুনছি ‘জরুরী অবস্থার’ দিনে ফক্কড় কবি বাবা নাগার্জুনের লেখা দুটি লাইনঃ 

‘সুকখী ঠুট পর বৈঠ কর কোয়েলিয়া কর গই কুক, 

বাল বাঁকা না কর সকী শাসন কা বন্দুক।“ 

অস্যার্থঃ 

শুকনো ডালে বসেও কোয়েল দিচ্ছে কুক, 

ঠেকাতে পারল কই তাকে ক্ষমতার বন্দুক. 

তাহলে এই পরীক্ষামূলক আঙ্গিকে লেখা উপন্যাসটি কতদূর সার্থক? আমার কাছে এ প্রশ্ন অবান্তর। অনেক সমীক্ষকের মতে দার্শনিক বিতর্কের মধ্যে কোথাও মাঝখানে দাঁড়ি টেনে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ষড়দর্শনকে প্রতিযোগী করে না দেখিয়ে একই মননের বিভিন্ন ভাবের প্রকাশ হিসেবে দেখানো যেন একটু জোর করে হয়েছে। আর এক সমীক্ষকের মতে ভাষায় কোথাও কোথাও সমস্যা আছে। কিছু শব্দের তদ্ভবীকরণ যেন ঠিকমত দাঁড়ায়নি। 

এহ বাহ্য। চারদিকে সিরিয়াল-গন্ধী উপন্যাসের প্লাবনের মধ্যে এই আখ্যানটি এক আনন্দদায়ক ব্যতিক্রম। 

আজকের এই অসূয়া-হিংসা- অনাচার- মদগর্বী পশুতার দিনে ভারতে বুদ্ধের বাণী, মাত্র শান্তিজল ছিটানো নয়, হিংসার অসারতা, অনিত্যতা ও আত্মঘাতী প্রবণতাকে বোঝা একান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। চাইব, এই বইটি আরও লোকে পড়ুক, আলোচনা করুক।

0 comments: