0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in

ধারাবাহিক


আহিরণ নদী সব জানে
রঞ্জন রায়

কয়েক কোশ দূরের ছুরিখুর্দ বা ছোটকী ছুরি গাঁ থেকেএসেছিল আমোল সিং বৈদ্যরাজ, সঙ্গে দুই চ্যালা। কী না কোসমগাছের শুকনো ফল, ডাল আর পাতা নিয়ে যাবে। তার থেকে বীজ পিষে হবে তেল। সেই তেলের অনেক গুণ; গায়ের ব্যথা সারে, পিদিম জ্বলে, পোয়াতির পেটে মালিশ করা যায়। 

বৈদ্যরাজের অভিজ্ঞ চোখ ভাল করে কোসমকে জরিপ করল, সামনে পেছনে দু’দিক থেকে। দুটো ফল কুড়িয়ে নিয়ে টিপে টুপে কিছু বিড়বিড় করল। পাতা হাতে ধরে দেখল তার শিরা-উপশিরা। গাছের শরীরে দু’জায়গায় দাগ দিয়ে চ্যালাদের বলল কোপ লাগাতে। এদিকে রাগে ফুঁসছিল কোসম। ওরা টের পায় নি। প্রথমজন কুড়ুল তুলে হাঁকড়ালো এক কোপ, কিন্তু কুড়ুল গেল পিছলে, ছিটকে পড়ল মাটিতে। 

খিঁচিয়ে উঠল আমোল সিং—কেইসন লেরভের আদমি! ঘর লে কা খাকে আয়েহস?

ক্যামন ল্যাবা রে তুই! বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে আসিস নি?

অন্য চ্যালাটি এবার তুলল কুড়ুল। গাছের সামনে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে লাগালো এক কোপ। আর কী আশ্চর্য! এবার কুড়ুল ঠিকরে গিয়ে পড়ল ওদের গুরু বৈদ্যরাজের পায়ে। আমোল সিংয়ের গলা চিরে বেরল বীভৎস আর্তনাদ। আর যায় কোথায়! দুই চ্যালা গুরুকে ফেলে দানো ! দানো! চিৎকার করে পড়িমড়ি করে ছুটে পালালো। ঘন্টা দুই পরে ওরা ফিরে এল গাঁ থেকে জনাদশেক লোক আর একজন বৈগাপুরুতকে সঙ্গে নিয়ে। প্রথমে বৈগা মন্ত্র পড়ে অপশগুন বা অশুভ জায়গাটা বন্ধন করল। তারপর রক্তে মাখামাখি পা অর্ধচেতন আমোল সিংকে ওরা নিয়ে গেল গাঁ থেকে বয়ে আনা একটি খাটিয়ায় শুইয়ে।

ওই ঘটনা ঘটেছিল এই আহিরণ নদীর পাড় ঘেঁষে আর পুরো ব্যাপারটা ড্যাবডেবিয়ে বড়ো বড়ো চোখ মেলে দেখেছিল বট-অশত্থ-পাকুড়ের দল। ঠিক কথা। তারপর বহুদিন নদীর এপারের জঙ্গলে কোন মনিষ্যি কাঠ কাটতে আসেনি। সেই কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বট-পাকুড়। সবটাই কি ভাল হলো? মানুষকে বাদ দিয়ে কি আমাদের চলে? ভেবে দেখ।

কোসমের আঁতে ঘা লাগল কি? ও বলল—বেশ কথা। মানুষের সঙ্গে আমাদের কিসের সম্পর্ক? কত্তারা খোলসা করে বলুন।

কেন? দেয়া-নেয়ার সম্পক্কো, সে কি আজ থেকে? সেই বাপ-পিতামোর ও অনেক আগে থেকে।

যেমন, আমরা ওদের ছায়া দিই, ফল-ফুল দিই, জ্বালানি কাঠ দিই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঘর বানাতে খুঁটি, বাতা, ঘর ছাইতে কড়ি-বরগা। আরে তুই ও তো দিস, তেল বানাতে ফল।

বেশ, প্রতিদানে ওরা কী করে?

চিড়বিড়িয়ে উঠল নব্যযুবক বনইমলি। কী করে? আমাদের অ্যায়সি কী ত্যায়সি করে। 

কোথা থেকে উড়ে এল একঝাঁক ঘরফেরতা পাখির ঝাঁক। ওদের পাখার সরসরানিতে হাওয়ায় ঢেউ উঠল—ঠিক ঠিক। 

তারপর কেটে গেছে দু’কুড়ি বছর। আহিরণ নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। ও এখন মাঝবয়েসি।

সেই কোসম গাছেরও দিন গিয়েছে। গত মাসে কোরবা শহর থেকে এল ফড়ের দল। ওষুধের কারখানার জন্যে নদীর ধারে জড়িবুটির খোঁজ করতে। 

চোখ গেল ভরভরন্ত কোসমের দিকে। কাছে এসে চোখ কুঁচকে জরিপ করল। ওর নতুন জেগে ওঠা পল্লবে হাত বুলিয়ে দেখে পাকা হাতে উপড়ে নিল জোড়াপাতা,বোঁটা শুদ্ধু। ওরা গাছে চড়ে ছিঁড়ে আনল কোসমফল। ওর বীজ থেকে তেল হবে; এ তেলের দাম আছে। নানান কাজে লাগে। খেটে খাওয়া মানুষের ব্যথাবেদনা সারে। সন্ধেবেলায় তেলের কুপি জ্বলে, কেরাচিন কিনতে হয় না।

আঁধার নামছে। কা-কা করতে করতে বাসায় ফিরছে কাকের দল। অনেক উঁচু দিয়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে বকের সারি। মাছরাঙা আর কোঁচবকের কাজ ফুরিয়েছে। একটা বেরসিক কাঠঠোকরা সারাদিন ঠকঠক করে কাজ করছিল, সেও এবার ক্ষ্যামা দিল।

ঝিঁঝিঁদের বৃন্দগান উদারা ছাড়িয়ে মুদারায়। হঠাৎ সব চুপ। কান্নার আওয়াজ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কোসম গাছ।

বট-অশত্থ বোঝাতে চাইল। কেঁদে লাভ নেই। যা হবার তা তো হয়ে গিয়েছে। গায়ের ব্যথা? ও সকাল নাগাদ ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আগেই বলেছিলাম- ওরে, অত উদু-উদু করিস নি। শুনলে তো!

এখন বসন্ত এসেছে। শিমূলের ডালে ডালে রাঙা হাতছানি। পলাশের কুঁড়ি দেখা যায়। মৌ বনে মৌ ধরেছে। এবার চৈত্রের ঝড়ে তেমন কোন ক্ষতি হয় নি। আমের মুকুল ঝরে যায় নি। বেড়েছে মৌমাছিদের আনাগোনা। কিন্তু দিন ফিরেছে মহুয়াগাছের। সারাবছর কেউ ওর খোঁজ নেয় না। এখন ফল ধরেছে। তার ম’ ম’ গন্ধে ভিড় জমায় হরিণ আর ভালুক। রাত্তিরে দল বেঁধে আসে লাজুক চিতল হরিণের দল। অন্ধকারে জ্বলে ওদের হীরা-সবুজ চোখ। আগে তলার পড়ে থাকা মহুয়া কুড়িয়ে খায়, চিবিয়ে নেয় ওর ভেতরের চোরকাঁটার মত ছোট্ট কাঁটাগুলো। তারপর মাথা তোলে আর নজর দেয় উঁচুডালে পাতার ভেতর লুকিয়ে থাকা ফলগুলোর দিকে। শেষে পেট ভরলে পাশে নদীর পাড় থেকে গলা বাড়িয়ে জলে মুখ দেয়, ল্যাপল্যাপিয়ে চেটে খায় আহিরণের মিষ্টি জল। ফিরে যায় নিজেদের নিরাপদ ডেরায়।

কখনও একা আসে বিরাট শিংয়ের ডালপালাওলা সম্বর। সতর্ক, কান খাড়া। ওর শত্রু অনেক। এদিকে নেকড়ে নেই। ডোরাকাটা বাঘের দল সরে গিয়ে ডেরা বেঁধেছে টিলার ওপরে আর ঘন বাঁশঝাড়ের আড়ালে। এদিকে সেসব তেমন নেই। কিন্তু আছে লোভী হায়না আর গুলবাঘা, এদিকের মানুষজন বলে ‘বুঁদিয়া শের’। ওর সঙ্গে দৌড়ে হরিণ পেরে ওঠে না। তারপর রয়েছে হুড়ার আর বুনোকুকুরের হামলা। একা সম্বরের পক্ষে পালিয়ে বাঁচা কঠিন। ও ভালো করেই জানে- আপন মাংসে হরিণা বৈরি।

তবে মহুয়ার আসল প্রেমিক হলো ভালুক। ও আসে একা একা, কখনও সপরিবারে। চার পায়ের ধারালো নখে আঁকড়ে ধরে মহুয়াকে, উঠে বসে গাছের ডালে, দোল খায় উল্টো হয়ে। যদি চোখে পড়ে ঝুলন্ত মৌচাক, ওকে আর পায় কে! গায়ের লোমশ কম্বলের বর্মে প্রতিহত হয় ক্রুদ্ধ মৌমাছিকুলের সাঁড়াশি আক্রমণ। ও অনায়াসে ভেঙে ফেলে চাক। চেটেপুটে খায় মধু, যতটা পারে। 

ও আসে সাঁঝের বেলায়, ও আসে ঘুমজড়ানো চোখে শুকতারা ডোবার আগে। আর পেটপুরে মহুয়া খেয়ে মাতাল হয়ে ঘুরে বেড়ায় আপনমনে। কখনো কখনো বেখেয়ালে পৌঁছে যায় লোকালয়ে। 

কিন্তু সেটা শত্রুপুরী। মানুষেরা দল বেঁধে আসে। দা-কুড়ুল- গাঁড়াশি- কটার-ভালা নিয়ে হামলা করে, তিনদিক থেকে। ওদের বিশ্বাস ঋক্ষরাজের নখের মালা ধারণ করলে রোগাপটকা ল্যাকপেকে সিংও গব্বর পা্লোয়ানকে ধোবি-পাছাড় দিতে পারে। আর ওর শরীরের বিশেষ অঙ্গের তেলে বর্দ্ধিত হবে পুরুষত্ব। একা ভালুক পালায়, কিন্তু মানুষের দল কাছাকাছি এসে পড়লে ও ক্লাসরুমে মুরগি হবার ভঙ্গিতে নীচু হয়ে দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে দেখে নেয় দুশমনদের। কারণ, ওর চোখের উপর ঝুলে পড়া গোছা গোছা লোমের চোটে ওর পক্ষে সামনাসামনি কাউকে দেখা দুষ্কর। তাই সে দেখায় ভেল্কি; উলটো ডিগবাজি খেয়ে এক নিমেষে ঝাঁপিয়ে পড়ে একজন দুশমনের ঊপর। নখে চিরে দেয় বুক, কামড় দেয় গালে, গলায়। ভালুকের হামলায় আহত মানুষ হয় চোখ হারায়, নয় ঘা বিষিয়ে মারা যায় মাস খানেক পরে; অথবা বেঁচে থাকে মুখে ও শরীরে ভালুকের সঙ্গে অসম যুদ্ধের পরিণতির সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে।

আহিরণের দুই পারের বিভিন্ন গাঁয়ে—যেমন ছুরিখুর্দ, ছুরিকলাঁ, সতরেংগা, মাদন, লখনপুর বা কোসা গাঁয়ে গেলেই এমন কিছু চেহারা চোখে পড়বে। তবে গত বর্ষায় আমোল সিং বৈদ্যরাজের পরাজয়ের পর থেকে দশগাঁয়ের কেউ আর আহিরণের ওদিকের জঙ্গলে যায় নি। 

কিন্তু বছর ঘুরতে চলল, ঘটনার ঝাঁঝ গেছে ফিকে হয়ে। আর পেটের জ্বালা বিষম জ্বালা। তাই এই ফাগুনে যখন বনে বনে শুকনো পাতা ঝরে দেখা দিচ্ছে নতুন কচিপাতা,আর দুপুরে এলোমেলো গরম হাওয়ার ঘুর্ণিতে ঊড়িয়ে নিচ্ছে কুটো,তখন দুকালু লকড়হারা বা কাঠুরে তার দশবছরের মেয়ে দ্রুপতীবাঈকে নিয়ে জঙ্গলে চলল জ্বালানি কাঠ কাটতে। ও কাটবে কাঠ, সেগুলোকে আঁটি বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে সাঁঝের বেলা বাড়ি ফিরবে। পরের দিন গাঁয়ের সম্পন্ন মানুষজনের বাড়ির দরজায় দরজায় গিয়ে হাঁক পাড়বে—বোঝা লেবে ও দাঈ! এক এক বোঝা দু’রুপিয়া। 

কাঠ কিনবেন গিন্নিমা! এক এক আঁটি জ্বালানি কাঠ দু’টাকা।

শেষে দরাদরি করে বারো আনা আঁটি হিসেবে বেচে ঘরে ফিরবে চাল কিনে। অভিজাত চাল হলো দুবরাজ, বিষ্ণুভোগ, শ্রীকমল, চিনিশক্কর আর কালিমুছ। এগুলো দুই থেকে আড়াইটাকা কিলো। এরা কিনবে মোটা বহুপ্রসবিনী ধানের চাল; যেমন গুরমিটিয়া বা স্বর্ণা। আট আনা থেকে দশ আনা বড়োজোর।

আরও আছে। ওর চালাকচতুর মেয়েটা--যাকে ওর মা ডাকে দ্রুপতী বা দুরুপতী বলে,আর পঞ্চায়েত ভবনে বালবাড়ির বহিনজি বলেন ‘দ্রৌপদী’—কুড়োবে শুকনো তেন্দু, কুল আর মহুয়া, নিয়ে আসবে বড়ো গামছায় বেঁধে। ওর মা সেগুলো মাটির দাওয়ায় বিছিয়ে দিয়ে শুকিয়ে নেবে। তখন শহর বা গঞ্জ থেকে আসবে ফড়ের দল। দেশি মদের কারখানার ফড়ে। ওরা ঘরে ঘরে গিয়ে নগদ পয়সা ধরিয়ে নামমাত্র দামে কিনে নেবে সব। সরকারি ভাষায় মাইনর ফরেস্ট প্রডাক্টস্। তারপর ভাল কমিশনে সেসব সাপ্লাই দেবে কারখানায় বা লাইসেন্সহীন দেশি চোলাইয়ের ভাটিতে।

দুকাল বা দুর্ভিক্ষের সময়ে জন্মেছিল বলে বাপ নাম রেখেছিল দুকালু। ওর এসবে কিছু যায় আসে না। হাতে দুটো নগদ এল, তাতেই খুশি; জানে যে দুনিয়ায় ভগোবান দু’রকম লোক বানিয়েছেন—একদল ঠকাবে, অন্য দল ঠকবে। ও দ্বিতীয় দলের স্থায়ী সদস্য। 

তবে নেহাৎ হাঁদা ভোঁদা নয়। কিছু শুকনো মহুয়া সরিয়ে রেখে পরে গোপনে ঘরের পেছনের কোলাবাড়িতে (কিচেন গারডেনে) উনুন বানিয়ে মাটির হাঁড়িতে জ্বাল দিয়ে নিজেরাই বানাবে মহুয়ার মদ। নিজেরা খাবে, ইয়ারদোস্ত পাড়াপড়শিকে খাওয়াবে আর পহুনা (অতিথি/আত্মীয়স্বজন) এলে খাতির করবে।

এসব দুকালুরামদের জন্যে নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবারে ব্যাপারটা হলো অন্যরকম। দ্রুপতী এই প্রথম বাপের সাথে হাত লাগাতে জঙ্গলে এল। আর ভালুক-মানুষ লড়াইয়ের সাক্ষী হয়ে এলাকায় নতুন ইতিহাস গড়ল।

0 comments: