Next
Previous
Showing posts with label পথে প্রবাসে. Show all posts
0

পথে প্রবাসে - অসীম দেব

Posted in







অমৃতসরের চিঠি ৩

তানিয়া,

হরমন্দির সাহিব আর জালিয়ানওয়ালাবাগ নিয়ে কিছু লিখলাম। সেই সিরিয়াস ব্যাপারে পঞ্জাবের লস্যি আর পরোটা আনতে চাই নি। কিন্তু বুঝতেই পারছিস, এই লস্যি আর পরোটা ছাড়া পঞ্জাবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রাত বললে ভুল হবে, ভোর হয়ে আসছে, হরমন্দির সাহিব থেকে বাইরে মেন রাস্তায় এসে দেখি লাইন দিয়ে কয়েকটি দোকান। সঙ্গের স্ত্রী, কন্যা, শ্যালিকা তো হাঁ হাঁ করে উঠলো, এখন এই অসময়ে এসব খেতে হবে না। আর আমি তো খাবোই, ভোর সাড়ে চারটের সময় এক স্টাফড আলু পরোটা, আর মালাই লস্যি নামিয়ে দিলাম। কি বলবো রে তানিয়া, এই জিনিষ তুই কলকাতায় পাবি না।

দুপুরের খাওয়ার পর আত্তারি বর্ডারের জন্য গাড়িতে রওয়ানা দিলাম। এই আত্তারি মানে ভারত পাকিস্তানের বর্ডার। আত্তারির ওপারেই পাকিস্তানের ওয়াগা। এটা দুই দেশের মধ্যে সাধারনের জন্য স্থলপথের যোগাযোগ ((গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড)। এখানেই রোজ বিকেলে দুই দেশের মিলিটারি ড্রিল হয়। আত্তারি ড্রিল এখন অমৃতসরের ট্যুরিস্টদের must see তালিকায় চলে এসেছে। সুতরাং অমৃতসরে, এমনকি আশেপাশের অঞ্চল থেকে দেশী বিদেশী যারাই ভ্রমণে আসেন, এই আত্তারি মিলিটারি ড্রিল তাঁদের জন্য এখন একটি আকর্ষণীয় ইভেন্ট।

আমাদের হোটেল থেকে রওয়ানা দিয়ে দিল্লী অমৃতসর হাইওয়েতে উঠে আত্তারি বর্ডার আরও প্রায় ৩৫ কিলোমিটার, সব মিলিয়ে হোটেল থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার। গাড়িতে যাওয়াই সবথেকে ভালো। প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগলো। শেয়ার তিন চাকার অটোও পাওয়া যায়, তবে অনেক বেশি সময় লাগে।

আত্তারি বর্ডার এক নির্জন জায়গা। যেহেতু পাকিস্তান বর্ডার, জায়গাটি সংবেদনশীল (sensitive) তাই এখানে বিএসএফ ছাড়া সাধারণ জনতার কোন বসতি নেই। সন্ধ্যার পর স্থানটি জনশুন্য হয়ে যায়। সেইসময় বিএসএফ ছাড়া অন্যান্য লোকজন এখানের রাস্তায় দেখা যায় না। বাস টেম্পো ট্যাক্সি তো অনেক দূরের কথা।

তানিয়া, কি দেখলাম সেটা লেখার আগে এই ড্রিল সম্বন্ধে তোকে দু’চার কথা জানাই। প্রথমত এটা শুধু ভারতের অনুষ্ঠান নয়। ১৯৫৯ সালে ভারত পাকিস্তান দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে এই ড্রিল চালু হয়। আমাদের থাকে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) জওয়ান, আর পাকিস্তানের থাকে পাকিস্তান রেঞ্জারস। ১৯৫৯ সালের কথা ধরলে, কালের নিয়মে এই ড্রিলের, ইংরেজিতে সহজ কথায় the way it is presented and style তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তবে এককথায় ইংরেজিতে একে বলা যায় the drill is characterized by elaborate and dance-like manoeuvres in a rapid speed and raising legs as high as possible. এর সাথে ফৌজি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যোগ করা যায় displaying the two countries’ rivalry আর দুই দেশের সরকারি কূটনৈতিক বিবৃতিতে বলা হয় a display of brotherhood and cooperation between the two nations. তবে শত্রুর সাথে কিভাবে মোকাবিলা করা উচিৎ, সেটাই বড় করে চোখে পড়ে। এর সাথে যোগ হয় জাতীয়তাবোধের চেতনা। সব মিলিয়ে এক আকর্ষণীয় ও উত্তেজক অনুষ্ঠান, যা লোকে বহুকাল মনে রাখতে পারে।

এই ড্রিল দেখার জন্য আমাদের কোন টিকেট লাগে না, সকলের জন্যই ফ্রি। ওখানে বিশাল পার্কিং জোন। পার্কিং লটে আমাদের গাড়ি রেখে লম্বা লাইন দিয়ে স্টেডিয়ামে পৌছালাম। স্টেডিয়াম মানে ইংরেজি ইউ স্টাইলের একটা স্ট্রাকচার। মাঝখানে দিয়ে ফুট ত্রিশেক চওড়া রাস্তা, দু’পাশে পাঁচ-ছ’ ফুট চওড়া ফুটপাথ। এই রাস্তার উপরেই বর্ডারে, মানে বর্ডারের সীমানাতেই এই অনুষ্ঠান হবে। এই ইংরেজি ইউ-এর খোলা দিকটার রাস্তার ওপারেই পাকিস্তানের বর্ডার। সেখানেও আমাদের মতন একটা গ্যালারি। গ্যালারি বললাম কারন পাকিস্তানের ওখানে মাত্র হাজার খানেক লোক বসতে পারে। আর আমাদেরটা অনেক বড়, ২৫ হাজার লোক বসতে পারে। শুনলাম, এমনি দিনেই আট দশ হাজার মতন লোক হয়, আর ট্যুরিস্ট সীজনে শনি রবি বা ছুটির দিনে পনেরো বিশ হাজার লোক হয়ে যায়।

আমরা যখন ওখানে গিয়ে পৌঁছেছি, তখন বেলা সাড়ে তিনটে হবে, এত আগে গিয়েও যে সীটটা পেলাম ঠিক মনের মতন হলো না। মানে বর্ডার প্রায় ৫০ মিটার দূরে, ভালোমতনই দেখা যাচ্ছে, তবে অনেকটাই কোনাকুনি পড়ে গেলো।

চারটা নাগাদ হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে একজন কম্যান্ডিং ফৌজি অফিসার এলেন। প্রাথমিক জয় হিন্দ, ভারতমাতা কি জয়, বন্দে মাতরম ইত্যাদি বলে আসরটাকে একটু নয়, অনেকটাই চাঙ্গা করে দিলেন। সারা স্টেডিয়াম জুড়ে সাউন্ড সিস্টেম, তার সাথে আমাদের স্লোগানের আওয়াজে চারিদিক গমগম করছে। আর উনি লম্বা স্টেডিয়ামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। হাতের, বডি ল্যাঙ্গুয়েজের কায়দায় বারবার বোঝাচ্ছেন যে আওয়াজ আরও জোরে চাই। হাতের ইশারায় বারবার বোঝাচ্ছেন, আমাদের এই আওয়াজ বর্ডারের ওপারেও পৌঁছানো চাই।

চারটা দশ নাগাদ অনেক ছেলেমেয়ের একটা দল এলো, প্রায় তিরিশ চল্লিশ জনের। এরা সবাই দর্শনার্থী। অনুষ্ঠান দেখতে এসেছে। বিএসেফের ফৌজিরা এঁদের ধরে এক একবারে চারজন করে স্টেডিয়ামের মাঝখানের রাস্তায় আমাদের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করালো। সারা স্টেডিয়াম তখন ওঁদের তালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে। তালি বা আওয়াজ কম হলেই সেই ফৌজি কম্যান্ডার বলছেন, আওয়াজে আরও জোর চাই। এর মিনিট দশেক বাদে, মানে চারটা কুড়ি নাগাদ ফৌজি কম্যান্ডার মাইক্রোফোনে ঘোষনা করলেন, মেয়েদের মধ্যে যারা নাচতে চায়, তাঁরা নীচে নেমে আসতে পারে। এটা শুধুমাত্র মেয়েদের জন্যই। জনতা এমনিতেই চাঙ্গা ছিলো। এই ঘোষনা শোনামাত্রই সারা স্টেডিয়ামের কোনা কোনা থেকে মেয়েদের দল সব দৌড়ে দৌড়ে নেমে এলো।

এবার শুরু হলো নাচ। পাকিস্তান বর্ডারের সামান্য দূরত্বে পাকিস্তানকে সামনে রেখে সারা স্টেডিয়াম জুড়ে গান চলছে হামসে যো টকরায়গা, আর সেই গানের সাথে নাচছে প্রায় শ’দুয়েক খানেক ভারতীয় মেয়ে। আর সামান্য দূরে বর্ডারের ওপার থেকে পাকিস্তানের লোকজন দেখছে, মাইকে শুনছে। কয়েকজন উৎসাহের আতিশয্যে বর্ডারের প্রায় কাছে চলে যায়। তাল মিলিয়ে সাপোর্ট দিচ্ছে পুরো স্টেডিয়াম। মেয়েরা, কেউ একজন অন্য আরেকজনকে চেনে না, তবু হাতে হাত ধরে দলবেঁধে হিউম্যান চেইন বানিয়ে স্বতঃফুর্ত হয়ে নেচে চলেছে।

পরে জানলাম, যে আমাদের ফৈজিরা ইচ্ছে করেই চার পাঁচজনকে হাতে জাতীয় তেরঙ্গা নিয়ে ছেড়ে দেয়, তবে বর্ডারের একদম কাছে যেতে দেয় না।

আর ফৌজি কম্যান্ডারের ভূমিকা তো আছেই। এই নাচ চললো প্রায় মিনিট চল্লিশেক। এর ফাঁকে ফাঁকেই ফৌজি কম্যান্ডারের সাথে তাল মিলিয়ে সারা স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে বারংবার আওয়াজ উঠছে

- হিন্দুস্তান

- জিন্দাবাদ

- ভারতমাতা কীইইইইইই

- ঝয়য়য়য়য়য় (কেন জানিনা, জয় বলতে গিয়ে আমার বারবার ঝয় বেরিয়ে আসছিলো)

- বন্দে

- মাআআআআতরম

সকলের এই সন্মিলিত আওয়াজে অদ্ভুত জাতীয়তাবোধের চেতনা আপনাআপনি এসে যায় রে, তানিয়া।

এরপর প্যারেড করে এলো আমাদের বিএসএফ এর জওয়ানরা। বর্ডার থেকে আন্দাজ ৭০ মিটার দূরে আমাদের সীমানায় এসে দাঁড়ালো। একদম প্রথম সারিতে দু’জন বিএসএফ মেয়ে। ড্রিলের শুরুতে এই দুটি মেয়ে হাতে তরোয়াল উঁচিয়ে ধেয়ে গেলো বর্ডারের দিকে। এই ড্রিলকে সঠিক বর্ণনায় কি বলবো জানিনা। যেভাবে, মানে যে স্পীডে মেয়ে দুটি এগিয়ে গেলো সেটা একেবারেই স্বাভাবিক হেঁটে প্যারেড করে যাওয়া নয়, এটাকে প্রায় দৌড়ে ধেয়ে যাওয়াই বলা চলে। মানে আমরা যদি কাউকে তাড়া করি, বা আক্রমণ করার জন্য ধেয়ে যাই, অনেকটাই সেইরকম। শরীরী ভাষায় ‘আজ তোকে শেষ করে ফেলবো’, সেইরকম। তারপর বর্ডারের গেটের সামনে গিয়ে কাঁধের উপর পা তুলে এক এয়ারকিক। পাকিস্তানের তরফেও একই রকম ড্রিল চলে। এই ড্রিল উভয় দেশের মধ্যে সিনক্রোনাইজড। এরপর একে একে ভারতীয় বিএসএফ জওয়ান ড্রিল করে চলেছে। একটু আগেই যা বললাম, যাকে বলে ধেয়ে যাওয়া, অনেকটাই যেন “আজ তোকে শেষ করে দেবো”, এই শারীরিক ভাষায়। ছবিটা দেখে নিজেই বল, এইরকম প্যারেড আগে দেখেছিস?

তারপর বর্ডারে গিয়ে এয়ারকিক, যা কাঁধ ছাড়িয়ে যায়। তারপর বুকের ছাতি দেখানো, সবই নিঃশব্দ শারীরিক ভাষায় শত্রুকে নিজের শৌর্যের প্রকাশ, অবশ্যই ফৌজি কায়দায়। ইংরেজিতে both sides intimidate each other by throwing high kicks and by staring. সাথে প্রবল ভারতীয় সমর্থন। লিখে পুরো বোঝানো যাবে না। ছবি দিলাম, তাহলেই বুঝতে পারবি।

অনুষ্ঠানের শুরুতে দুই দেশের বর্ডারের গেট খুলে দেওয়া হয়। আমাদের বর্ডার গেট তেরঙ্গা রঙের। সবার শেষে Beating Retreat. সূর্যাস্তের ঠিক আগে দুই দেশের জাতীয় পতাকা একই সাথে নামিয়ে আনা হয়।

তারপর দুই দেশের জওয়ানরা হাত মেলায়। এই বিশেষ শারিরীক ও মুখচোখের ভাষার হাত মেলানোকে ইংরেজি ভাষায় বলবো brusque handshake। এর মানে জানিস? এটা হলো quick and direct in manner or speech, and often not polite. If you describe a person or their behaviour as brusque, you mean that they deal with things, or say things, quickly and shortly, so that they seem to be rude. দুটো ছবি দিলাম, ফৌজির চোখ দুটো লক্ষ্য কর, যেন আগুনের ফুলকি।

এই brusque হাত মেলানোর পর দুই দেশের বর্ডারের দরজা আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর সেখানেই এই যৌথ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি।

তানিয়া,

একটু আগেই যা বললাম, এই প্যারেড এককথায় ফৌজি ভাষায় displaying the two countries’ rivalry আবার দুই দেশের কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরকারিভাবে বলতেই হয় an effort to display of brotherhood and cooperation between the two nations. কিন্তু যেটা পাওনা, সেটা আমাদের মতন সাধারণ দর্শনার্থীদের একটা জাতীয়তাবোধের চেতনা। এই ড্রিল দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই সেই জাতীয়তাবোধ বারংবার মনে চলে আসে। তাইতো একসাথে আওয়াজ তুলি

- হিন্দুস্তান

- জিন্দাবাদ

- ভারতমাতা কীইইইইইই

- ঝয়য়য়য়য়য়

- বন্দেএএএএ

- মাআআআতরমমমম

আমি ২৬ জানুয়ারি দিল্লির রাজপথে বা কলকাতার রেড রোডে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেড দেখেছি। কিন্তু এ এক অন্য মাত্রার। আমি তোকে বলবো, একবার শুধু অমৃতসরে এসে এই ড্রিল দেখে যা। এটা Show of the Lifetime. একটিবার এখানে এসে আমার কথাটা মিলিয়ে নিস।

অক্টোবর, ২০১০ সালে পাকিস্তান রেঞ্জারসের মেজর জেনারেল ইয়াকুব আলি খান প্রস্তাব দিয়েছিলেন এই aggressive আচরণ কমানোর জন্য। জবাবে ৯ নভেম্বর ভারতের তরফেও একই প্রস্তাব আসে। কিন্তু এটা সম্ভব হয় নি। মেজর জেনারেল ইয়াকুব আলি খান রেঞ্জারস জওয়ানদের জন্য বিশেষ কায়দার দাড়ি ও গোঁফেরও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এরজন্য তাঁদের বিশেষ ভাতাও চালু হয়েছিলো।

২ নভেম্বর ২০১৪ সালে এই বর্ডারেই অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সময় পাকিস্তান সীমানাতেই পাকিস্তানী উগ্রপন্থী হানায় ৬০ জন নিহত হন, আর ১১০ জন আহত হন। তখন কিছুদিন প্রবল উত্তেজনা ছিলো।

২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালের মিলিটারি সংঘাতের পর ৮ অক্টোবর পর্যন্ত এই যৌথ অনুষ্ঠান চালু ছিলো, কিন্ত সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য খোলা ছিলো না। প্রসঙ্গত বলি, দীপাবলী ও বকরি-ইদ উপলক্ষে, এবং স্বাধীনতা দিবসে উভয়পক্ষ নিজেদের মধ্যে উপহারের আদানপ্রদান করে। কিন্তু পাকিস্তান সেবার দীপাবলী উপলক্ষে ভারতকে প্রথাগত উপহারও দেয় নি।

তানিয়া,

এবার আসি আমার লেখার শেষ পর্যায়ে। অমৃতসর এলে কেশর ধাবায় যেতেই হবে, আর কাঁসার গেলাসে মালাই দেওয়া লস্যিও খেতেই হবে।

পুরনো কলকাতার যেমন অনেক বনেদী সন্দেশ, মোগলাই, বিরিয়ানী, কচুড়ির দোকান আছে, সেরকমই অমৃতসরের পুরনো গলিতে একটি ধাবা আছে, কেশর দা ধাবা। পুরনো শহরের পাসসিন চকের ছোট সরু রাজপুরা গলিতে। বাইরের গাড়ি ঢোকে না, মানে এখানের লোকজন ঢুকতে দেয় না, কারন গলি জ্যাম হয়ে যায়। তাই বেশ খানিকটা হেঁটে আসতে হয়।

১৯১৬ সালে লালা কেশর মল ও তাঁর স্ত্রী পার্বতী দেবী এর স্থাপন করেন। আমরা অমৃতসর আসার আগেই কয়েকজনের মুখে এর কথা শুনেছিলাম। হোটেলে গিয়ে ভালো ধাবায় খাবো বলা মাত্রই এক কথায় ওরা এই কেশর দা ধাবার কথা বললো। ট্যাক্সিতে উঠেও এর নাম বলতেই ট্যাক্সিওয়ালাও বললো অমৃতসরে ট্যুরিস্ট এলে এই ধাবাতেই আসে। লোকমুখে শুনলাম BBC, Discovery, Travel, Star টিভিতেও নাকি এর কভারেজ হয়েছে।

আমরা গিয়ে দেখি ছোট্ট গলির মাঝে এই ধাবার বাইরে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, মানে ওয়েটিং লিস্টে। আমাদের নম্বর ১৭, তখন ৬ নম্বর সবে ঢুকেছে। নম্বর এলে ভেতরে ঢুকলাম। লম্বা পাথরের টেবিলের দু’পাশে চারটে করে কাঠের স্টুল, চেনা অচেনার বালাই নেই। এভাবেই পাশাপাশি বা সামনাসামনি বসতে হবে। লিমিটেড নিরামিষ মেনু। যেসব খাবারগুলো খেতে লোকজন এখানে আসে, যেমন পরোঠা, তন্দুরি, কুলচা, চানা মশালা, ছোলে, এগুলো সবই আছে। এই লিমিটেড চয়েসের মধ্যেই মেনু ঠিক করতে হবে। কুইক সার্ভিস। সব মিলিয়ে ভালোই খাওয়া হলো, দামেও পকেটে চাপ পড়ে না।

আমি থালি নিয়ে পরোটা, চানা মসালা, ছোলে খেয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। এবার আমার স্ত্রী, কন্যা, শ্যালিকা শপিং করতে যাবেন। একেবারেই আমার বিষয় নয়। আমি গেলে উপদ্রবের আশংকা আছে। তাই, শান্তিপূর্বক সিদ্ধান্ত; আমি হোটেলেই থাকবো।

লস্যির কথা বললে, এই শহরের বিভিন্ন জায়গায় লস্যি স্পেসাল দোকান আছে, তাঁরা শুধুই লস্যি বিক্রি করে। পঞ্জাবের দুধ ভারতবিখ্যাত। এখানের লস্যি ভালো হবে না, তো কোথায় হবে?

তাহলে, তানিয়া,

এই হলো আমার অমৃতসরের ডায়েরি।

ভালো লাগলো?

কি জানি, তুই বিদেশে থাকিস, তোদের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা।

আর হ্যাঁ, একবার ফোন করবি তো? অনেকদিন হয়ে গেলো; তুই কিন্তু ফোন করিসনি।
23

পথে প্রবাসে - অসীম দেব

Posted in






অমৃতসরের চিঠি ২



তানিয়া,

আজ অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ নিয়ে কিছু বলি। তুই যতটুকু পড়েছিস, লোকমুখে শুনেছিস, তার থেকে অনেকটা বেশিই আমার লেখায় পাবি।

একটা কথা আগেই বলা দরকার, জালিয়ানওয়ালাবাগ ঘটনা আমাদের এক সংবেদনশীল ইতিহাস। আমরা যখন জালিয়ানওয়ালাবাগ যাবো, আমাদের এক মানসিকতার প্রস্তুতি নিতে হবে। স্বর্ণমন্দির যাই ধর্মীয় কারণে, আবার আত্তারি বর্ডারে ফৌজি প্যারেড দেখতে যাই জাতীয়তাবোধের মানসিকতায়। তেমনি জালিয়ানওয়ালাবাগও দেখার আগে একটা মানসিক প্রস্তুতির দরকার। পিছনের দেওয়ালে বুলেটের দাগ, সেই ব্যাকগ্রাউন্ডে মানুষ সেলফি তুলছে। শহীদ স্তম্ভ পিছনে রেখে নবদম্পতি হাসিমুখে সেলফি তুলছে। লোকজন উচ্চস্বরে খোশমেজাজে গল্প করছে, হাসি হুল্লোড়, এক যেন আনন্দের পরিবেশ। এভাবে জালিয়ানওয়ালাবাগ শহীদদের যে কতটা অশ্রদ্ধা করা হয়, এই চেতনাবোধই আমাদের হলো না। আমরা ভিক্টোরিয়া বা গড়ের মাঠে যাই, আইসক্রীম ঝালমুড়ি খাই। জালিয়ানওয়ালাবাগকেও আমরা সেই এক প্রমোদ উদ্যান ক্যাটাগরিতে ফেলে দিলাম। আমি যা দেখেছি, খুবই খারাপ লেগেছে, আর সেটাই এখানে লিখলাম।

তানিয়া, জালিয়ানওয়ালাবাগ লেখার ভূমিকায় বলা দরকার যে, আমরা বিভিন্ন ম্যাগাজিনে পত্রিকায় সোনার পাতে মোড়া অমৃতসরের যে মন্দিরটি দেখি, তার নাম হরমন্দির সাহিব। আর এই হরমন্দির সাহিব, অকাল তখত ও আরও বিভিন্ন মন্দির, মিউজিয়াম, লঙ্গর, বিশ্রামস্থল নিয়ে সামগ্রিকভাবে ঐ অঞ্চলকে বলে স্বর্ণমন্দির প্রাঙ্গণ (কমপ্লেক্স)। এই প্রাঙ্গণের ঠিক বাইরেই জালিয়ানওয়ালা মাঠ (বাগ)। জালিয়ানওয়ালা আসলে একটি মাঠ, প্রায় সাত একর জমির উপর, চারিদিকে তিনতলা বাড়ির উঁচু পাচিল, আর মাঠে ছিলো পাঁচটি ছোট ছোট নির্গম পথ।

এই জালিয়ানওয়ালাবাগ যে কারনে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে, সেটি কোনো শাসকজাতির পক্ষেই গৌরবের নয়, এটি ব্রিটিশ রাজশক্তির এক চরম লজ্জাজনক কীর্তি।

চল, অতীতে ফিরে যাই। ১৯১৯ সালে রওলাট আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়, যার সবথেকে বেশি প্রভাব দেখা যায় বাংলা ও পঞ্জাবে। এই আইন ছিলো “...stricter control of the press, arrests without warrant, indefinite detention without trial, and juryless in camera trials”. প্রতিবাদে মহম্মদ আলি জিন্না নিজের বম্বে এসেম্বলি সীট থেকে পদত্যাগ করেন, ভাইসরয়কে চিঠি লেখেন "I, therefore, as a protest against the passing of the Bill and the manner in which it was passed tender my resignation.... ... a Government that passes or sanctions such a law in times of peace forfeits its claim to be called a civilised government."

এই আন্দোলনে ১৯১৯ সালের ১০ই এপ্রিল দুই ভারতীয় বিদ্রোহী ডঃ সত্য পাল ও ডঃ সইফুদ্দিন কিচল্যুকে ব্রিটিশ রাজ গ্রেফতার করে, যদিও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো প্রামান্য অভিযোগ ছিলো না। এর প্রতিবাদে অমৃতসর শহরে প্রতিবাদ মিছিল হয়, যেখানে পুলিশ নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই ১২ জন মারা যান।

তখন অমৃতসর শহরে মার্সেলা শেরউড (Marcella Sherwood) নামের একজন ইংরেজ মিশনারী প্রায় ৬০০ ভারতীয় ছাত্রের একটি স্কুল চালাতেন। ১১ই এপ্রিল, গন্ডগোলের আশংকায় তিনি স্কুল বন্ধ করতে গিয়ে Kucha Kurrichhan গলিতে ক্ষুব্দ জনতার আক্রমনের শিকার হন, যদিও উপস্থিত কিছু ভারতীয় লোকের সাহায্যে তিনি বিপন্মুক্ত হন, এবং ওনাকে নিরাপদ গোবিন্দগড় দুর্গে আশ্রয় দেওয়া হয়।

অমৃতসর আপাত শান্ত থাকলেও পঞ্জাবের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ চলতেই থাকে। ১২ ই এপ্রিল অমৃতসর শহরে হরতাল চলাকালীন সিদ্ধান্ত হয় যে পরের দিন অর্থাৎ ১৩ই এপ্রিল, বৈশাখী উৎসবের দিনে জালিয়ানওয়ালা বাগে সকলে জমায়েত হয়ে প্রতিবাদ জানাবেন। এই জমায়েত রুখতে ব্রিটিশ সরকার ১৩ই এপ্রিল পঞ্জাবে মার্শাল ল’ জারি করে এবং সবরকম জমায়েতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। অমৃতসর শহরে কার্ফু জারি হয়, এবং শহরে প্রবেশ বা বাইরে যাবার জন্য বিশেষ অনুমতি নেওয়াও আবশ্যক করে দেওয়া হয়। সেদিন সকালে জেনারেল ডায়ার (Reginald Edward Harry Dyer) নিজে অমৃতসর শহর পরিক্রমা করে মাইকে সেই কার্ফু ও জমায়েতের উপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষনা করে। জনসাধারনের জ্ঞাতার্থে ইংরেজি, পঞ্জাবী, হিন্দী ও উর্দু ভাষায় সারা শহর জুড়ে প্রচার হয়।

তানিয়া, খেয়াল কর, সেই দিন অর্থাৎ ১৩ই এপ্রিল ছিলো শিখদের বৈশাখী উৎসবের দিন। প্রতিবাদ মিটিং না হলেও উৎসবের আনন্দে অনেকেই সেদিন জালিয়ানওয়ালা মাঠে এসে জড়ো হয়েছিলো। আর বৈশাখী উপলক্ষ্যে যারা সেদিন হরমন্দির সাহিব দর্শনে এসেছিলেন তাঁদেরও অনেকেই বাগানে ঘুরতে এসেছিলেন। সুতরাং যথেষ্ট লোকজন সেখানে ছিলো।

সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটার সময় কর্নেল ডায়ার (Reginald Edward Harry Dyer) গুর্খা (9th Gorkha Rifles) ও পাঠান / বালুচ (59th Scinde Rifles) বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হন। সঙ্গে দু’টো কামানগাড়িও এনেছিলেন, কিন্তু সরু দরজা দিয়ে সে দু’টি ভেতরে ঢুকতে পারে নি।

ডায়ার এসে জমায়েতকে চলে যেতে না বলে প্রথমেই যে একটিমাত্র ফটক (দরজা) খোলা থাকে, সেটি বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন, তারপরেই সৈন্যদের গুলি চালানোর হুকুম দেন। সাথে সাথে সৈন্যরা চতুর্দিকের নিরস্ত্র লোকজনের উপর গুলি চালাতে শুরু করে। সৈন্যরা তাঁদের শেষ গুলিটি বর্ষন করে তবেই থামে, তথ্য অনুযায়ী ১৬৫০ রাউন্ড। (** Cease-fire was ordered only when ammunition supplies were almost exhausted - Nigel Collett The Butcher of Amritsar: General Reginald Dyer. p. 262.) ডায়ার পরে বিবৃতি দিয়েছিলেন "was not to disperse the meeting but to punish the Indians for disobedience” - Nigel Collett The Butcher of Amritsar: General Reginald Dyer. p. 255-58) ডায়ার আরও বলেছিলেন (** "I have heard that between 200 and 300 of the crowd were killed. My party fired 1,650 rounds") ("Punjab Disturbances: The Case of General Dyer". Parliamentary Debates (Hansard). House of Lords. 19 July 1920. col. 254.) শিখ সেবা সমিতির তথ্য অনুযায়ী ৩৭৯ জন গুলিতে মারা যান, ও প্রায় হাজার জন আহত হন। The Hunter Commission confirmed the deaths of 337 men, 41 boys and a six-week-old baby. (** India. Committee on Disturbances in Bombay, Delhi, and the Punjab (1920). Report; disorders inquiry committee 1919–1920. pp. XX–XXI, 44–45, 116–7. Retrieved 8 September 2018.) (** William, Lord Hunter, Chairman of the Commission, former Solicitor-General for Scotland and Senator of the College of Justice in Scotland)

ইতিমধ্যে ১৯শে এপ্রিল জেনারেল ডায়ার মিশনারী মার্সেলা শেরউডের সাথে দেখা করে অর্ডার জারি করে every Indian man using that street to crawl its length on his hands and knees as a punishment. কারণ হিসেবে বলা হয় "Some Indians crawl face downwards in front of their gods. I wanted them to know that a British woman is as sacred as a Hindu god and therefore they have to crawl in front of her, too."

মিশনারী মার্সেলা শেরউড পরে জেনারেল ডায়ার সম্বন্ধে বলেছিলেন “...saviour of the Punjab”

শুধু ১৩ই এপ্রিল নয়, এর ঠিক দু’দিন পরেই, ১৫ই এপ্রিল, ১৯১৯ পঞ্জাবের গুজরনওয়ালায় পুলিস আবার নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালিয়ে ১২ জনকে হত্যা করে।

জালিয়ানওয়ালাবাগ ঘটনার পরে জেনারেল ডায়ার বিবৃতি দেয়, You people know well that I am a Sepoy and soldier. Do you want war or peace? If you wish for a war, the Government is prepared for it, and if you want peace, then obey my orders and open all your shops; else I will shoot. For me the battlefield of France or Amritsar is the same. I am a military man and I will go straight. Neither shall I move to the right nor to the left. Speak up, if you want war? (A Saga of Freedom Movement and Jallianwala Bagh, Udham Singh, 2002, p 149, Prof (Dr) Sikander Singh; Report of Commissioners, Vol I, II, Bombay, 1920)

জালিয়ানওয়ালাবাগের এই হত্যাকান্ড দেশে বিদেশে তুমুল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তখন উইন্সটন চার্চিল ছিলেন ব্রিটিশ Secretary of State for War। উনি ৮ই জুলাই, ১৯২০ হাউস অফ কমনসে বিবৃতি দেন, "The crowd was unarmed, except with bludgeons. It was not attacking anybody or anything ... When fire had been opened upon it to disperse it, it tried to run away. Pinned up in a narrow place considerably smaller than Trafalgar Square, with hardly any exits, and packed together so that one bullet would drive through three or four bodies, the people ran madly this way and the other. When the fire was directed upon the centre, they ran to the sides. The fire was then directed to the sides. Many threw themselves down on the ground, the fire was then directed down on the ground. This was continued to 8 to 10 minutes, and it stopped only when the ammunition had reached the point of exhaustion." (** Hansard (House of Commons Archives)". Hansard: 1719–1733. 8 July 1920)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২২শে মে সংবাদটি পেয়ে ব্রিটিশ রাজের নাইটহুড উপাধি ফেরত পাঠিয়ে দেন। ৩১শে মে, ২০১৯ উনি ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডকে চিঠি দেন "I ... wish to stand, shorn, of all special distinctions, by the side of those of my countrymen who, for their so-called insignificance, are liable to suffer degradation not fit for human beings." মহাত্মা গান্ধীও Boer War এ তাঁর ভূমিকার জন্যে পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকাতে ব্রিটিশের থেকে পাওয়া 'Kaiser-i-Hind' উপাধি ফিরিয়ে দেন।

এরপর হাউস অফ কমনসে ভোটাভুটিতে ২৪৭-৩৭ ভোটে ডায়ারের বিরুদ্ধে শাস্তির সিদ্ধান্ত হয়। though many Britons still thought him a hero for saving the rule of British law in India. তবে ডায়ারের কোনরকম শাস্তি হয়নি। “… The Legal and Home Members on the Viceroy's Executive Council ultimately decided that, though Dyer had acted in a callous and brutal way, military or legal prosecution would not be possible due to political reasons. However, he was finally found guilty of a mistaken notion of duty and relieved of his command on 23 March. He had been recommended for a CBE as a result of his service in the Third Afghan War; this recommendation was cancelled on 29 March 1920”. হান্টার কমিশনে ডায়ার বলেছিলো “... "I think it quite possible that I could have dispersed the crowd without firing, but they would have come back again and laughed, and I would have made, what I consider, a fool of myself.”

এরপর ১৯৪০ সালের ১৩ই মার্চ, আমাদের ভারতীয় উধম সিং লন্ডনের ক্যাক্সটন হলে মাইকেল ও’ডায়ারকে (Michael O'Dwyer) কে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেন। উধম সিং বিবৃতিতে বলেছিলেন, সেই ১৩ই জুলাই, ১৯১৯ বৈশাখী উৎসবের দিনে তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগে ছিলেন, এবং আহত হয়ে সব চাক্ষুস করেছিলেন। এই মাইকেল ডায়ার (Michael O'Dwyer) ছিলেন পঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্নর, উনি সেদিন কর্নেল ডায়ারকে (Reginald Edward Harry Dyer) নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালানোর অনুমতি দিয়েছিলেন।

কোর্টে উধম সিং বলেছিলো “… I did it because I had a grudge against him. He deserved it. He was the real culprit. He wanted to crush the spirit of my people, so I have crushed him. For full 21 years, I have been trying to wreak vengeance. I am happy that I have done the job. I am not scared of death. I am dying for my country. I have seen my people starving in India under the British rule. I have protested against this, it was my duty. What greater honour could be bestowed on me than death for the sake of my motherland?”

৩১শে জুলাই, ১৯৪০ ব্রিটেনে উধম সিং এর ফাঁসি হয়। তানিয়া, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে গান্ধী ও নেহরু উভয়েই উধম সিং এর কাজের নিন্দা করেছিলেন। কিন্তু ১৯৫২ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই নেহরুই বলেছিলেন, I salute Shaheed-i-Azam Udham Singh with reverence who had kissed the noose so that we may be free.

তানিয়া,

জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনায় ফিরে আসি। খেয়াল রাখিস, দু’জনের নামই ডায়ার। Reginald Edward Harry Dyer যে সৈন্যদের পরিচালনা করেছিলো, আর Michael O'Dwyer, পঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্নর যে গুলি চালানোর অনুমতি দিয়েছিলো। আমাদের বিপ্লবী উধম সিং যাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে, সে Michael O'Dwyer, সেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগে উপস্থিত ছিলো না, সে অন্য ডায়ারকে গুলি চালানোর অনুমতি দিয়েছিলো। আরেকটা কথা তোকে জানাই তানিয়া, এই Reginald Edward Harry Dyer জন্মসূত্রে ভারতীয়, ১৮৬৪ সালের ৯ই অক্টোবর, আমাদের মুড়ি তে (Murree, রাওয়ালপিন্ডির কাছে। এখন পাকিস্তান)।

উধম সিং যেদিন মাইকেল ডায়ারকে হত্যা করে, তার পরের দিন অমৃতবাজার পত্রিকা এর সমর্থনে লেখে The common people and revolutionaries glorified the action of Udham Singh. Much of the press worldwide recalled the story of Jallianwala Bagh, and allege O'Dwyer to have been responsible for the massacre. দ্যা টাইমস পত্রিকা লেখে “an expression of the pent-up fury of the down-trodden Indian People"। ঐতিহাসিক উইলিয়াম সিরের (William L. Shirer) লেখেন "Most of the other Indians I know (other than Gandhi) will feel this is divine retribution. O'Dwyer bore a share of responsibility in the 1919 Amritsar massacre, in which Gen. Dyer shot 1,500 Indians in cold blood. When I was at Amritsar eleven years after [the massacre] in 1930, the bitterness still stuck in the people there."

১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ভারতে এসে বিবৃতি দেন It is no secret that there have been some difficult episodes in our past – Jallianwala Bagh, which I shall visit tomorrow, is a distressing example. But history cannot be rewritten, however much we might sometimes wish otherwise. It has its moments of sadness, as well as gladness. We must learn from the sadness and build on the gladness (১৩ই অক্টোবর, ১৯৯৭)। রানীর এই মন্তব্যে আবার প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দর কুমার গুজরাল রানীর সমর্থনে বলেন Queen herself had not even been born at the time of the events and should not be required to apologise (** Burns, John F. (15 October 1997). "In India, Queen Bows Her Head Over a Massacre in 1919". The New York Times.) এলিজাবেথ এসেছিলেন,”she removed her shoes, paid her respects with a 30-second moment of silence, and only signed the Visitor’s Book, without any words”. রানীর এইরূপ ব্যাবহার আবার প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলো, তাহলে কি ব্রিটিশ রাজশক্তি বা সরকার এখনও এই ঘটনা আন্তরিকভাবে নিন্দা করতে পারে না?

২০১৩ সালে ডেভিড ক্যামেরন প্রথম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যিনি জালিয়ানওয়ালাবাগ এসে বলেন "a deeply shameful event in British history, one that Winston Churchill rightly described at that time as monstrous. We must never forget what happened here and we must ensure that the UK stands up for the right of peaceful protests".

জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনায় যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের শেষ জন, শিঙ্গারা সিং জুন ২৯, ২০০৯ এ মারা যান, ১১৩ বছর বয়েসে।

অনেক ইতিহাস লিখে ফেললাম রে তানিয়া, আসলে কি জানিস? এই জালিয়ানওয়ালাবাগের ইতিহাসটা প্রতিটি ভারতীয়র জানা দরকার।

আজ তোকে এর বেশি ডোজ আর দেবো না। তোদের ওখানে এখন রাত এগারোটা। যা, ঘুমিয়ে পড়।

0

পথে প্রবাসে - অসীম দেব

Posted in



















 ১


তানিয়া,

চারদিনের জন্য অমৃতসর ঘুরে এলাম। হঠাৎই ঠিক করলাম, অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না, তাই বাড়ির লোকজন মিলে কাছাকাছি কোন একটা জায়গা থেকে একটু ঘুরে আসি। মাত্র দু’দিনের নোটিশে ট্রেনের টিকিট, হোটেল, ট্রাভেল প্ল্যান সবই ঠিক করে ফেললাম।

অমৃতসর প্রসঙ্গে সবার আগে তানিয়া, এই শহরের ইতিহাসটা তোকে একটু বলি। অনেকেরই ইতিহাস ভালো লাগে না। তবু, কোনো ঐতিহাসিক জায়গায় যাওয়ার আগে তার ইতিহাস খানিকটা জেনে রাখা ভালো। নেটে দেখলাম, সাড়ে চার’শ বছরের ইতিহাস। এটাকে ছোট্ট করে লেখা সহজ নয়, তবু যতটা পারি ছোট করেই লিখলাম। প্রথম পর্যায়ে শুধু অমৃতসর শহরের ইতিহাস্টুকু। পরের পর্ব থেকে কি দেখলাম, কি খেলাম, এসব না হয় লেখা যাবে। ইতিহাসটা ছোটর মধ্যে মোটামুটি এইরকম দাঁড়ায়-

১৫৭৪-৭৭ সালে মুঘল সম্রাট আকবর চতুর্থ শিখ গুরু শ্রীরামদাসকে জমি দান করেন, এবং সেই স্থানেই অমৃতসর শহরের পত্তন হয়। আবার গেজেটের কিছু তথ্য অনুযায়ী শিখ সম্প্রদায় চাঁদা তুলে ৭০০ টাকায় তুং গ্রামের (Tung) জমিদারের থেকে এই জমিটি কেনেন। সেইসময় অঞ্চলটি ছিলো গভীর জঙ্গল, ও অনেক জলাশয়ে ভরা। গুরু শ্রীরামদাস ৫২ জন বিভিন্ন দ্রব্যের ব্যাবসায়ী আর কিছু বিভিন্ন শিল্পীকে (traders and artisans) এখানে ডেকে আনেন। এইভাবেই শহরটির পত্তন হয়। একদম শুরুতে যে ৩২ টি দোকান ছিলো, বংশানুক্রমে সেইগুলি এখনও আছে (Batisi Hatta, 32 shops). গুরু নিজেও এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। এর থেকেই এই স্থানটির নামকরন হয় রামদাসপুর। গুরু গ্রন্থসাহিবে এর উল্লেখ আছে। কথিত আছে যে বুদ্ধদেবও এখানে কিছুদিন সাধনা করেছিলেন। সেই সময়ও এই অঞ্চলে গভীর জঙ্গল ও জলাশয় ছিলো।

ষোড়শ শতাব্দীতে অমৃতসরে দুর্গিয়ানা হিন্দু মন্দিরটি তৈরি হয়। ছবি দিলাম তানিয়া, খেয়াল কর, এই হিন্দু মন্দিরটির স্থাপত্য অনেকটাই হরমন্দির সাহিবের ঘরানায় তৈরি, চূড়ার সোনার পাতও সেই একই ঘরানার। (বলে রাখি, অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরের প্রকৃত নাম হরমন্দির সাহিব)। এই দুর্গিয়ানা মন্দিরের চারিপাশে পুষ্করিণীও খনন করা হয়েছে। দেবী দূর্গার নামে এই মন্দিরটি, এখানে বিষ্ণু ও লক্ষীর পূজা হয়। সূর্য্যদেবের পৌত্র ইক্ষভাকু এখানে যজ্ঞ করতেন বলে স্থানীয় লোকের বিশ্বাস। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী অমৃতসর শহরের তীরথস্থল (Valmiki Tirath Sthal) অঞ্চলে মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রম ছিলো। লোকের বিশ্বাস, রামায়ণের লব ও কুশের জন্ম হয় এই আশ্রমে। জনশ্রুতি এই যে রামের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়াকে ও হনুমানকে লব-কুশ এখানের দুর্গিয়ানা মন্দিরের একটি গাছের সাথে বেঁধে রেখেছিলো। জনশ্রুতি আছে নিকটবর্তী লাহোর ও কাসুর শহরের নামকরণও এখান থেকেই হয়।

মহিমা প্রকাশ বার্তাক (Mahima Prakash Vartak) নামের একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থে ১৫৭৪-১৬০৪ সালের বিভিন্ন তথ্যের উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থটি, আনুমানিক ১৭৪১ সালে লেখা, এবং এটিকেই শিখদের সর্বপ্রাচীন তথ্যমূলক গ্রন্থ মানা হয়। (A semi-historical Sikh hagiography text. এর মানে biography of a saint or an ecclesiastical leader, an idealized biography of a founder, saint, monk, nun or icon in any of the world's religions). এই গ্রন্থেই দশজন শিখ গুরুর উল্লেখ আছে।

চতুর্থ শিখ গুরু রামদাসের নির্দেশে অমৃত সারস পুষ্করিণী (Amrita Saras “Pool of Nectar”) খননের কাজ শুরু হয়। সুতরাং এই পুষ্করিণী প্রকৃতির সৃষ্টি নয়, এটিকে খনন করা হয়েছিলো। এই অমৃত সারস নাম থেকেই অমৃতসর নামকরনের উৎপত্তি। ১৫৭৭ সালে পুষ্করিণীর কাজ শেষ হয়, আর ১৫৮৯ সালে পুস্করিণীর কেন্দ্রে হরমন্দির সাহিব প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন এই হরমন্দির সাহিবকেই আমরা স্বর্ণমন্দির বলি। ১৬০৪ সালে পঞ্চম শিখ গুরু অর্জুন গ্রন্থসাহিব রচনা করে হরমন্দির সাহিবে স্থাপন করলেন। বাবা বুদ্ধ সাহিব ছিলেন এর প্রথম গ্রন্থী।

১৭৬২ সালে আহমেদ শাহ দুররানী অমৃতসর শহর আক্রমণ করে এখানের সম্পদ লুঠ করে ও শহরটি ধ্বংস করে দেয়। এরপর ১৭৬৫ সালে জাঠ নেতা জাসা সিং আহলুওয়ালিয়ার নেতৃত্বে সম্মিলিত পঞ্জাব বাহিনী আফগান রাজা আহমেদ শাহ আবদালীকে পরাস্ত করেন। তারপর ১৮০২ সালে মহারাজা রণজিৎ সিং পঞ্জাবের বিভিন্ন ছোট ছোট রাজাকে একত্রিত করে শিখ ও পঞ্জাবের শক্তিশালী বাহিনী তৈরি করেন। পঞ্জাবের সামগ্রিক উন্নয়নে মহারাজা রণজিৎ সিং এর উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। পঞ্জাবের লোকজন তাই ওনাকে শের-ই-পঞ্জাব নামে সন্মান দেয়। তাঁরই শাসনকালে হরমন্দির সাহিবের দেওয়াল স্বর্ণখচিত করা হয়। আর রামবাগ প্রাসাদ, আর গোবিন্দগড় দুর্গের সংস্কার করা হয়। ১৮২২ সালে তিনি অমৃতসর শহরের চতুর্দিকে সুরক্ষিত দেওয়ালের প্রাচীর সীমানা (walled city) তৈরি শুরু করেছিলেন, যে কাজটি পরবর্তীকালে শের সিং সম্পূর্ন করেন। তিনি ১২ টি তোরনদ্বার তৈরি করেছিলেন। এখন তার একটিমাত্ররই অস্তিত্ব আছে, রামবাগ দ্বার। বাকিগুলি ব্রিটিশরা ধ্বংস করে দেয়। ১৮৪০ সালে ব্রিটিশরা এই সুরক্ষিত শহর আক্রমণ করে। এইসময়ই টাউন হল তৈরি হয়, আর রামবাগ বাগানের নামকরণ করে কোম্পানি বাগ। ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশরা পঞ্জাব দখল করে নেয়, আর আরেকটি দ্বার তৈরি করে Hall Gate
ইন্দো-ব্রিটিশ স্থাপত্য এর সেরা উদাহরণ খালসা কলেজ।


ব্রিটিশ আমলে পঞ্জাবের সিং সভা মুভমেন্ট (ingh Sabha Movement) ও প্রধান খালসা দেওয়ান পঞ্জাবে উচ্চ শিক্ষার জন্য একটি প্রতিষ্ঠা স্থাপনের জন্য তখনের শিখ মহারাজা ও সাধারণের থেকে আর্থিক সহায়তার আবেদন করেন, এবং জমি দানের অনুরোধ করেন। এর ফলে আর্থিক সাহায্য যেমন আসে, তেমনি অনেকেই জমি দান করেন।

১৮৯০ সালে Khalsa College Establishment Committee তৈরি হয়, প্রেসিডন্ট ছিলেন Colonel W. R. M. Holroyd, Director of Public Instruction, Punjab, আর সেক্রেটারি ছিলেন W. Bell, লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। কমিটিতে পঞ্জাবের ১২১ জন সদস্য ছিলেন। তাঁদের মধ্যে পাতিয়ালা, নাভা, কাপুরথালা আর মাজিথিয়ার মহারাজারাও ছিলেন। অনেক আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত হয় যে কলেজটির স্থাপনা হবে অমৃতসর শহরেই, এবং দ্বিতীয় একটি হবে লাহোর শহরে।

১৮৯২ সালে অমৃতসর খালসা কলেজের নির্মানকার্য শুরু হয়। স্থপতি ছিলেন রাম সিং। ১৯১১-১২ সালে নির্মানকার্য শেষ হয়।

প্রসঙ্গত, রাম সিং ছিলেন ইন্দো-ব্রিটিশ স্টাইলের বিখ্যাত স্থপতি। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজ অসবোর্ন হাউসে রানী ভিক্টোরিয়ার দরবার হল, মাইশোর ও কাপুরথালা প্রাসাদের দরবার হল, ও লাহোর কলেজ। এছাড়াও পঞ্জাবের পিঞ্জারা কাঠের কাজ তিনি বিশ্বের বহু দেশে জনপ্রিয় করেন।

তানিয়া,

এবার তোকে গুরু গ্রন্থসাহিব নিয়ে দু’কথা বলি। এটাও তোদের জানা দরকার। স্বর্ণমন্দিরের প্রকৃত নাম হরমন্দির সাহিব। গুরুদ্বারার নাম হয় বাংলা সাহিব, পাটনা সাহিব। খেয়াল করেছিস নিশ্চয়ই যে শিখেরা নিজেদের ধর্মগ্রন্থকে বলে গুরু গ্রন্থ সাহিব। এই সাহিব কথাটির অর্থ হৃদয়ের গভীর সম্মান উৎসর্গ করা। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, কোরাণে সাহিব কথাটির অর্থ সম্মানিত সঙ্গী।

এই গুরু গ্রন্থসাহিব গ্রন্থনায় মূলত ছ’জন শিখ গুরু - গুরু নানক, গুরু অঙ্গদ, গুরু অমর দাস, গুরু অর্জন, ও গুরু তেগবাহাদুরের বিশেষ অবদান আছে। এ ছাড়াও রামানন্দ, কবীর, নামদেভ এবং মুসলিম সুফি শেখ ফরিদের বিভিন্ন বাণী ও উপদেশও এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এটি রচিত হয়েছে গুরমুখী ভাষায়। এছাড়া লাহন্দা (পশ্চিম পাঞ্জবী), ব্রজভাষা, কৌরবী, সংস্কৃত, সিন্ধি ও পারসী ভাষায়ও গুরু গ্রন্থ সাহিবের অনুবাদ হয়েছে। সাধারণভাবে এই অনুবাদগুলিকে বলা হয় সন্ত ভাষা। এই ধর্মগ্রন্থের বাণীকে বলা হয় গুরবাণী।

১৬০৪ সালের ২৯শে আগস্ট আদি গ্রন্থটির রচনা সম্পন্ন করেন পঞ্চম শিখ গুরু, গুরু অঙ্গদ, এবং তিনদিন পরে ১লা সেপ্টেম্বর গ্রন্থটি হরমন্দির সাহিবে স্থাপন করা হয়। এই হরমন্দির সাহিব মন্দিরটি আজ স্বর্ণমন্দির নামে পরিচিত। হরমন্দির সাহিবের প্রথম গ্রন্থী ছিলেন বাবা বুদ্ধ। এরপর গুরু হরগোবিন্দ যোগ করেন রামকলি কি ভার, ও গুরু তেগবাহাদুরের কিছু বাণী। ১৭০৪ সালে মুঘল সম্রাট ঔরংজেবের সাথে যুদ্ধকালীন সময়ে গুরু গোবিন্দ ও ভাই মান সিং দমদমা সাহিবে গুরু তেগবাহাদুরের বানী ও উপদেশ সংযোজন করেন। এই নতুন খন্ডের নতুন নামকরণ হয় গুরু গ্রন্থ সাহিব। গুরু গ্রন্থ সাহিবের স্লোকগুলি ৩১ টি রাগের সুরে গাওয়া হয়ে থাকে। প্রথম ন’টি স্লোকের সুরকরন করেন গুরু হরগোবিন্দ। গুরু তেগবাহাদুরের হত্যার পরে গুরু গোবিন্দও অনেকগুলির সুরযোজন করেন।

ছোট করে এই হলো গ্রন্থসাহিবের ইতিহাস। এই ধর্মগ্রন্থটি এখন প্রতিটি গুরুদ্বারায় প্রতিষ্ঠা করা হয়।

তানিয়া,

তুই ভাবছিস একটু আগের উল্লেখ করা এই দমদমা সাহিব কি? কোথায়? তাহলে শোন। এর পুরো নাম শ্রী দরবার সাহিব দমদমা সাহিব তখত। দমদমার অর্থ বিশ্রামস্থল। আর তখত কথাটির অর্থ অস্থায়ী আসন। জুউজায়গাটি পঞ্জাবের ভাতিন্ডা অঞ্চলে। শিখধর্মে আরও চারটি অস্থায়ী আসন আছে – অকাল তখত, কেশরগড় সাহিব তখত, পাটনা সাহিব তখত ও হুজুর সাহিব তখত। ১৯৬৬ সালে শিখদের সর্বোচ্চ শিরোমণি গুরুদ্বারা প্রবন্ধক কমিটি এই দমদমা সাহিবকে পঞ্চম তখত হিসেবে স্বীকৃতি দান করেন।

এতক্ষণ তোকে অমৃতসরের শুধু ভূমিকাটাই দিলাম। এতক্ষণে আমাদের ট্রেন অমৃতসর স্টেশনে ঢুকে গেছে।

শতাব্দী এক্সপ্রেসে গিয়ে রাত এগারোটায় হোটেলে পৌছালাম।

পাল্কি সাহিব

এবার আমাদের প্রথম দিনের, সঠিক বললে প্ল্যানমাফিক প্রথম রাত বলি, বা পরের দিনের ভোর তিনটের সময় বলি, আমরা স্বর্ণমন্দিরে গিয়ে পাল্কি সাহিব অনুষ্ঠান দেখতে যাবো। মানে রাত আড়াইটে নাগাদ হোটেল থেকে রওয়ানা দিতে হবে।

এটি একটি অনুষ্ঠান, দিনে দু’বার হয়। রাত পৌনে দশটা নাগাদ হরমন্দির সাহিবে দিনের শেষ হুকুমনামা (Order of the Day) পাঠ হয়ে গেলে, এরপর রাত দশটা নাগাদ গুরু গ্রন্থসাহিবকে হরমন্দির সাহিব থেকে স্বর্ণখচিত পালকি সিংহাসনে সাজিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে অকাল তখত সাহিবে নিয়ে যাওয়া হয়। এই পালকিকেই বলে পালকি সাহিব। সকলের আগে একজন ট্রাম্পেট বাজিয়ে আসেন। পিছনে ভক্তরা কাঁধে সেই পালকি বহন করেন। সকলের বিশ্বাস, অকাল তখতে গুরু গ্রন্থসাহিব ঐসময় রাত্রির বিশ্রাম নেন। অকাল তখতে সেইসময় গ্রন্থসাহিব বন্ধ রাখা হয়, উনার নির্বিঘ্নে বিশ্রামের জন্য কীর্তন বন্ধ থাকে, শুধু কিছু বিশেষ স্লোক উচ্চারিত হয়। অন্যদিকে এইসময় হরমন্দির সাহিবের দৈনন্দিন পরিস্কারের কাজ চলে। ভক্তরাই এটি করেন। শীত গ্রীষ্মের সময় অনুযায়ী এই অনুষ্ঠানের সময়ের কিছুটা পরিবর্তন হয়।

পরদিন ভোররাতে চারটে নাগাদ ভক্তরা আবার গুরু গ্রন্থসাহিবকে পালকি সাহিবে স্থাপন করে অকাল তখত থেকে হরমন্দির সাহেবে শোভাযাত্রা করে নিয়ে আসেন। সেখানে পীড়া সাহেবের (পবিত্র শয্যা) উপর গুরু গ্রন্থসাহিব স্থাপন করা হয়। উপস্থিত সকল ভক্তরা গুরবাণী কীর্তন করেন। তারপর গ্রন্থ সাহিব খুলে তাঁর দিনের প্রথম বিশেষ অধ্যায় হুকুমনামা (Order of the Day) পাঠ করা হয়। একটু বেলার দিকে অর্দাস (শিখদের প্রার্থনা) শেষ হলে কড়া প্রসাদ সকলের জন্য বিতরন করা হয়। এই পালকি সাহিব শোভাযাত্রা দেখতেই দেশ বিদেশের অনেকে এখানে আসেন। আমরাও সেজন্যই ভোররাতেই এসেছি।

আমরা যখন রাত তিনটের সময় পৌছালাম, তানিয়া, দেখি অসংখ্য লোক। আসলে স্বর্ণমন্দির প্রাঙ্গণ চব্বিশ ঘণ্টা দিনে রাতে সকলের জন্যই উন্মুক্ত। আন্দাজ দেশ বিদেশের লক্ষখানেক দর্শনার্থী প্রতিদিন এখানে আসেন। এঁরা সকলেই যে শিখধর্মীয়, তা নয়। সর্বধর্মের লোকজনই এখানে আসেন। ভারতবর্ষের শিখদের সেবাধর্মের মানসিকতা এখন সারা বিশ্বে সমাদৃত। যে কোনো গুরুদ্বারে গেলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আর অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে সকলেই বিশেষভাবে সেটি উপলব্ধি করতে পারে।

আমরা রাতের বেলায় পালকি সাহিব দর্শনে গিয়েছিলাম কারন এক, তখন ভীড় কম থাকে। কম মানে হাজার পাঁচ সাতেক তো হবেই। আর দ্বিতীয় কারন, ঐ ভোররাতের স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় পরিবেশ থাকে অত্যন্ত মনোরম। আমরা অকাল তখতের এক কোণে গিয়ে বসলাম। রাত তিনটের সময় গিয়েও আমরা তখন অনেক লোকের পিছনে। জায়গাটা মনঃপূত হলো না, এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে আমরা হরমন্দির সাহিবের একদম প্রবেশদ্বারের কাছে গিয়ে বসে পড়লাম। সামনেই রেলিং, অর্থাৎ আমাদের ঠিক সামনে দিয়েই পালকি সাহিব শোভাযাত্রা যাবে। চারটে নাগাদ পালকি সাহেব এলো, অকাল তখতের সামনে পালকি রেখে অনেকক্ষন, প্রায় আধঘন্টা ধরে গুরবানী কীর্তন ও স্তোত্রপাঠ হলো। এরপর আমাদের সামনে দিয়ে স্বর্ণখচিত পালকি সাহিব ভক্তদের কাঁধে চড়ে হরমন্দির সাহিবে ফিরে এলেন।

এই পালকিযাত্রা আমার কাছে এককথায় ইউনিক (unique) মনে হয়েছে। দেবতাকে (এখানে দেবতা কিন্তু কোনো মূর্তি নয়) রাতের বিশ্রামের জন্য প্রতিদিন মূল মন্দির থেকে বিশ্রামস্থলে নিয়ে যাওয়া আবার প্রতিদিন সকালবেলা নিদ্রাভঙ্গের পরে মূল মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসা, এর দ্বিতীয় ধর্মীয় উদাহরণ হয়তো আছে, কিন্তু নেট বা এনসাক্লোপিডিয়া ঘেঁটে দ্বিতীয়টি আর পেলাম না। আরও জানলাম, ভক্তরা গুরু গ্রন্থসাহিবকে স্বর্ণমন্দির প্রাঙ্গনে নিয়মিত প্রদক্ষিণ করান।

পালকি দর্শনের পর আমরা আবার হরমন্দির সাহিবে ফিরে আসি। এই হরমন্দির সাহিব সর্বধর্মের জন্য উন্মুক্ত। এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন সুফি সন্ত মিয়াঁ মীর। এই মন্দিরের যদিও একটিমাত্র প্রধান দ্বার, কিন্তু সর্বমোট চারটি দ্বার আছে, যা সর্বধর্মকে সন্মান করে। স্থাপত্যের কথা ধরলে এটি ভারতীয় ও মুঘল ঘরানার মিশ্রন। তাজমহলের মার্বেল পাথরের কারুকার্য্যে এর অনেক মিল পাওয়া যায়। আরও একটি বিশেষত্ব, জলের উপরে আমরা মন্দিরের দ্বিতলটা দেখি, এর নীচের অংশ আছে জলের মাঝে। অনেকেই বলে স্বর্ণপমন্দির নাকি রাতের আলোয় বেশি সুন্দর লাগে। আমারও সেইরকমই মনে হলো।

তানিয়া,

যা দেখলাম, কতকগুলি বৈশিষ্ট তুলে ধরতে চাই। আমরা হিন্দুধর্মে মূর্তিপুজায় বিশ্বাস করি। আমাদের হিন্দুদের গীতার মতন শিখদের গুরু গ্রন্থসাহিব। এই গুরু গ্রন্থসাহিবকেই এঁরা পূজা করেন।

কিন্তু শিখদের প্রধান ব্যাবহারিক ধর্ম হলো সেবাধর্ম। সেসময় এঁরা জাতি-ধর্মের উচ্চ-নীচের ভেদাভেদ রাখেন না। সকলকেই এঁরা একনজরে দেখেন। এই স্বর্ণমন্দির প্রাঙ্গণে যারা যারা সেবক আছেন, বিভিন্ন সেবায় নিযুক্ত, তাঁরা প্রত্যেকেই পরিস্কার পোষাক পড়েছেন। কারোর পোষাকেই সামান্যতমও অপরিচ্ছন্নতা নেই। সকলকেই এখানে জুতো খুলে মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে হয়। জুতো জমা দেওয়ার কাউন্টার আছে, কোনো পয়সা দিতে হয় না। রাত তিনটের সময় কাউন্টারে যারা আছেন, দেখেই বুঝতে পারি উনারা প্রত্যেকেই ভদ্র, সমাজে প্রতিষ্ঠিত, আর কেউ কেউ হয়তো উচ্চবিত্তও। দিনের বেলায় ব্যাস্ততার মধ্যে সময় করতে পারেন নি, তাই রাতের দর্শনার্থীদের সেবা করতে এসেছেন। এনারা নির্দ্বিধায় খালি হাতে জুতোগুলো তুলে নিলেন। ভেতরে দেখি কয়েকজন জুতো পালিশ করছেন। এনাদের চেহারা আর পোষাকেও ভদ্র পরিবারের ছাপ। জানলাম, যদি জুতোয় ময়লা থাকে, এই সেবকেরা নিজেরাই সেটা পরিস্কার করে দেন।

স্বর্ণমন্দির প্রাঙ্গনের পুরোটাই মার্বেল পাথরে বাঁধানো। একনজরেই দেখা যায় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। প্রাঙ্গনের বিভিন্ন স্থানে ঝাড়ু রক্ষিত আছে। সেই পরিস্কার রাস্তায় অনেকেই হাতে ঝাড়ু নিয়ে সেটাকে আরও পরিস্কার করছেন, কেউ কেউ ভিজে কাপড় দিয়েও রাস্তা মুছে দিচ্ছেন। সারাদিন সারারাত একের পর এক দর্শনার্থী এসে সেই ঝাড়ু নিয়ে নিজেদের সেবাদান করছেন। সুতরাং এখানে অপরিচ্ছন্ন হওয়ার কোনো অবকাশই নেই। আমার জামার পকেটে জুতো জমা রাখার টোকেনটা ছিলো। পকেট থেকে মোবাইল বার করার সময় টোকেনটা পড়ে গিয়ে গড়িয়ে কিছুটা দূর চলে যায়। আমি কিছু করার আগেই দেখি একজন বয়স্ক মহিলা সেটি তুলে আমাকে দিলেন। আমি স্বভাবসিদ্ধ প্রথায় সুক্রিয়া (ধন্যবাদ) বলতেই তিনি প্রশ্ন করলেন, কিউ, সুক্রিয়া কিউ? অর্থাৎ এটি একটি সেবা, উনার মতে আমার ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ নয়।

এবার আসি গুরু কি লঙ্গরে। এটি চালু করেন গুরু নানক, পরবর্তীকালে তৃতীয় শিখগুরু গুরু অমরদাস এটি প্রথা হিসেবে চালু করেন। আবার অনেকে বলেন ১৫৭৭ সালে চতুর্থ গুরু রামদাস এটিকে প্রথা হিসেবে চালু করেন। মহারাজা রণজিৎ সিং ও পরবর্তীকালে পঞ্জাবের অনেক রাজা ও ধনী ব্যাক্তিরা এই লঙ্গরের জন্য বিশাল অংকের অর্থদান করেছিলেন। কথিত আছে, শিখরা সেবাদানে বিশ্বাস রাখেন এবং তাঁদের অর্জিত অর্থের দশ শতাংশ গুরুদ্বারা কমিটির উদ্যোগে সমাজের বিভিন্ন সেবামূলক কাজে দান করেন। এই সেবা শুধুমাত্র শিখদের নিজেদের জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে যে কোনো কল্যানমূলক কাজে।

এই গুরু কি লঙ্গরের সেবায় মহিলা, কিশোরবয়সী ও যুবক যুবতীদের অংশগ্রহণ এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। সারা দিনেরাতে এই লঙ্গর চালু থাকে, এবং আনুমানিক ষাট সত্তর হাজার দর্শনার্থী প্রতিদিন এখানে ভোজন করেন। বিশেষ বিশেষ দিনে এর দ্বিগুণ দর্শনাথীও লঙ্গরে আসেন। আমাকে একজন স্থানীয় জানালেন, দিনে ১২,০০০ কিলো ময়দা লাগে। আর লাগে দিনে অন্তত একশ’ গ্যাস সিলিন্ডার আর ৫,০০০ কিলো জ্বালানী। অটোমেটিক রুটি তৈরির মেশিনে ঘন্টায় ২৫,০০০ রুটি তৈরি হয়। অনেক দর্শনার্থীরা দূর দূরান্ত থেকে এসে স্বর্ণমন্দিরের মার্বেলে সারা রাত ঘুমিয়ে থাকেন বা বিশ্রাম নেন। এঁদের জন্য সকাল ৪টে থেকে ৫টা পর্যন্ত আনুমানিক ২৫ হাজার কাপ চা বিতরণ করা হয়।

তানিয়া, জানি না শুধু লিখে কলমের জোরে তোকে কতটা বোঝাতে পারবো। এ জিনিষ নিজের চোখে দেখতে হয়। তবু চেষ্টা করলাম যদি বোঝানো যায়। লঙ্গরে প্রবেশ করলেই দেখা যায় পরিস্কার পরিচ্ছন মার্বেলের জমিতে ততটাই পরিস্কার টানা লম্বা আসন পাতা। আসনের যেখানে খুশি বসা যায়, তবে সকলকেই আসন করে বসা এবং মাথা ঢেকে বসা বাধ্যতামূলক। সেবকেরা স্টিলের থালায় রুটি, ডাল, তরকারি আর ক্ষীর (ঘন দুধের মতন) পরিবেশন করেন। একটু পরে পরেই ধ্বনি ওঠে, যো বোলে সো নিহাল, সৎ শ্রী অকাল। একদিকে যখন খাদ্য পরিবেশন হয়, অন্যদিকে প্রায় একশ’ জন মহিলা আর পুরুষ তরকারি কেটে পরিস্কার করে ধুয়ে রাখেন, আর তারই পাশাপাশি লঙ্গরের বাইরে তখন আরেকদল মহিলা আর পুরুষরা এঁটো বাসন মেজে পরিস্কার করে রাখেন। প্রতিটি সেবা এঁরা আন্তরিকভাবে করেন, কোনো ফাঁকি থাকে না। তবে এও দেখলাম, অনেকেই ঘুরতে এসে শুধুমাত্র সেবা করার একটা ফটো তুলে নিয়ে চলে গেলো। হয়তো একটা মাত্র রুটি বেলে দিয়েই ফটো তুলে চলে গেলো, এরপর ফেসবুকে ছাপিয়ে দেবে।

তানিয়া,

আজ এই গুরু কি লঙ্গর শুধুমাত্র দুনিয়ার সবথেকে বড় কমিউনিটি কিচেনের স্বীকৃতিই অর্জন করেনি, তাঁরা বিভিন্ন সেবার মাধ্যমে অন্যদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনেও সক্ষম হয়েছে।

স্বর্ণমন্দির ঘুরে যা দেখলাম, এখানের মোটামুটি পুরো সেবাই বিনা পারিশ্রমিকের। শ্রমদান বলতে জুতো সংরক্ষণ, চলার পথের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, পুষ্করিণী পরিচ্ছন্ন রাখা ও লঙ্গর সেবা। এই গুরু কি লঙ্গর সেবা আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। তরকারি ইত্যাদি কেটে পরিস্কার করে যোগান দেওয়া, রান্না করা, পরিবেশন করা, ও থালাবাসন পরিস্কার করা। আর বিশেষ উর্দি পরা ভলান্টিয়াররা তো সর্বত্রই আছে। এছাড়া আছে সময় বিশেষে মন্দিরের রক্ষনাবেক্ষন, (maintenance)। এই সেবাও ওরা নিজেরাই করেন। তবে হ্যাঁ, এখানে প্রায় চারশ’ বেতনভোগী কর্মচারী আছেন। আর দিনেরাতের বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদান করেন আরও চার পাঁচশো জন।

তানিয়া, আজ এইটুকুই থাক। এরপর আমরা জালিয়ানওয়ালাবাগ যাবো, পাকিস্তান বর্ডারে বিএসএফের ড্রিল দেখতে হবে, পুরনো শহরের হাতীদ্বারের কাছে রাজপুরা গলিতে ১১৮ বছরের পুরনো কেশর দা ধাবায় গিয়ে পরোঠা খেতে হবে। ঘুরে ঘুরে পঞ্জাবী লসসি, কুলচা, তন্দুরী, খেতে হবে। শহরটাও তো একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছে আছে। এখন অনেক কাজ রে তানিয়া।

আজ এইটুকুই, গুড নাইট।




0

পথে প্রবাসে - অচিন্ত্য দাস

Posted in







আমি আর সার্জেন্ট ম্যাথু

ক্যালিফোরনিয়ার দক্ষিণ দিকে এই শহরে আমি আগেও থেকেছি। উঁচু-নিচু পাহাড়ি অঞ্চল জুড়ে ছড়ানো শহর। বাস বা মেট্রো ট্রেন তেমন নেই যে এদিক ওদিক ঘুরে আসা যাবে। দোকান-পাট, বাজার কিংবা পার্ক, এত দূরে দূরে যে গাড়ি ছাড়া যাওয়াই যায় না। তবু বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে একটা পেট্রোল ভরানোর জায়গা আছে, এরা বলে গ্যাস স্টেশন। সঙ্গে দু-একটা রেস্তঁরা, স্টার বাকস্ কফির দোকান, ‘পাঁচ ডলারে এক পাইন্ট’ লেখা বিয়ারের ঠেক।

সেখানে যেতে হলে চার লেনের বড় চওড়া রাস্তার ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হয়। ডানদিক দিয়ে সাঁ সাঁ করে দ্রুতগতিতে গাড়ি, ট্রাক চলে যায়। আর বাঁ-দিকের জমি একটা টিলায় অনেকখানি উঁচুতে উঠে গেছে। টিলার ঢালে ইতস্তত পাইন, ইউক্যালিপ্টস বা ম্যাপেল গাছ। আর আছে বুনো ঝোপঝাড়, ঘাস, আগাছা। এ রাস্তায় আমি আগে অনেক অনেক বার হেঁটেছি তবে এবারের পথচলা একেবারে অন্যরকম লাগছিল।

আমি বড় হয়েছি কোলকাতা শহরে, বাড়িতে সকাল থেকে রাত্তির অবধি রেডিওতে কলকাতা ক চালানো থাকত। বাড়ির রেডিও কোন কারণে বন্ধ হলেও বিরতি বলে কিছু ছিল না। পাশের বাড়ি বা পাশের পাশের বাড়ি থেকে স্পষ্ট শোনা যেত। কলকাতা ক এ রবীন্দ্রনাথের গানের আনুষ্ঠান, রেকর্ড বা লাইভ, লেগেই থাকত। সকাল-দুপুর-সন্ধে-রাত্তিরের বাছবিচার ছিল না। বহু গানের লাইন তাই মনের চেতন-অবচেতন কুঠুরিতে ঢুকে পড়েছিল, এতদিন পরেও রয়ে গেছে। পথচলা অন্যরকম লাগার সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতর থেকে বেজে উঠল – ‘এ পথে আমি যে গেছি বারবার, ভুলিনি তো একদিনও, আজ কি ঘুচিল চিহ্ন তাহার উঠিল বনের তৃণ...’

আসলে চেনা রাস্তা এবারে অন্যরকম লাগার কারণ আছে। এ বছর এদেশে ভালো বৃষ্টি হয়েছে, তাই শীতের পরে বসন্ত আসার সঙ্গে সঙ্গে মাঠঘাট ঝোপঝাড় বুনো ফুলে ভরে উঠেছে। এরকম বুনো ফুলের উৎসব আগে দেখিনি। হলদে, গাঢ় হলদে, বেগুনি, সাদা, গাঢ় নীল, কমলা – বিচিত্র সব রঙের ছড়াছড়ি। কোথাও একই আগাছায় ভিন্ন রঙের ফুল – সাদার পাশে তিন চার রকমের লাল। ঘাসের ওপর ফোটা বেগুনি ফুল একেক জায়গায় এমন ভাবে ছেয়ে রয়েছে যে একটু দূর থেকে মনে হয় কেউ যেন বুরুশ দিয়ে জমি রং করে রেখেছে।

রাস্তা অন্যরকম লাগার আরেকটা কারণও আছে অবশ্য। বছর সাতেক আগে এ শহরে যখন এসেছিলাম তখন এ রাস্তায় হাঁটতাম আমরা দুজনে। লক্ষ্য থাকত কফির দোকান। দোকানের দেয়ালে টাঙানো তালিকাটা দেখতাম – সেখানে নানা রকমের কফির নাম লেখা। আমাদের মধ্যে বচসা শুরু হয়ে যেত। আমি বলতাম আজ ‘আমেরিকানো উইথ হ্যাজেল নাট ফ্লেভর’ নেবো। সে বলত একদম না। আজ কাপুচিনো। আমি বলতাম বড় কড়া – দুপুরের ঘুমটা ভালো হবে না। শেষে অবশ্য ওর কথাই থাকত। সে আমার পাশে আজ হাঁটছে না। গত বছর আমার সাথী সব পথের শেষে চলে গেছে সবকিছু ছেড়ে। এখন বুঝলাম ওই বচসাটুকু না থাকায় কফিপান করার সব মজা সব আগ্রহ কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। আমি আজ লক্ষ্য ছাড়াই হাঁটছি।


রাস্তায় মানুষ দেখা যায় না বললেই চলে। তবে দৈবাৎ সামনে কেউ এসে পড়লে, তিনি মহিলা বা পুরুষ যেই হোন না কেন, মিস্টি হেসে ‘হাই’ বা ‘গুড আফটারনুন’ বলেন। আমিও ব্যাপারটা শিখে নিয়েছি। যেমন একটি লোককে দেখলাম তিনজন সঙ্গী নিয়ে আসছেন ওদিক থেকে। তিনজন মানে তিনটি কুকুর – একটি বড় আর দুটি শিশু কুকুর। সব এক জাতের, মানে ছোট দুটো বড়টির সন্তান হবে আর কি। সারমেয়চারক (মেষচারক কথাটা অভিধানসম্মত হলে এ শব্দটিও চলা উচিত) আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে ফুটপাথ ছেড়ে পাশের আগাছাময় জমিতে তিনটি পোষ্য নিয়ে সরে গেলেন। মুখে বললেন ‘সরি’। মানে এনার কারণে আমার পথ চলার অসুবিধে হয়েছে, তাই তিনি দুঃখিত। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ভদ্রতাবোধ আমি ইউরোপ-আমেরিকা বা জাপানের মতো দেশেই দেখেছি। আমাদের দেশ হলে ইনি আমার দিকে কটমট করে তাকাতেন – সে খরদৃষ্টির মানে – ‘আরে উজবুক কোথাকার! রাস্তা ছেড়ে দাঁড়া, কামড়ে দিতে পারে। চোখ নেই নাকি।’

আমি আমার সাধ্য মত ইংরেজিতে বললাম “না, না ঠিক আছে। তোমার ‘হাস্কি’ তিনটে খুব সুন্দর।” এইরকম দেখতে কুকুরের জাত যে হাস্কি তা আমার নতুন শেখা। সুযোগ পেয়েই প্রয়োগ করে দিলাম। লোকটি আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে স্মিত হেসে চলে গেলেন।

বুনো ফুলের বাহার দেখে মনে হচ্ছিল ঋতুরাজ বসন্ত স্বয়ং সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। হলদে ফুলে ছেয়ে থাকা প্রান্তর যেন তাঁর বসন প্রান্ত, থেকে থেকে মৃদু বাতাসে আন্দোলিত। লাল-নীল-কমলা-গোলাপী ফুল যেন তাঁর অঙ্গের ভূষণ, মাথার মুকুট। এ দেশ আমাদের দেশ থেকে বহুদূরে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে। পৃথিবীর উল্টোপিঠে। এখানকার জলবায়ু, গাছপালা, জীব-জন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। তবু রাস্তার ধারে রঙ-বেরঙের ফুলের ঘটা দেখে মনের ভেতরে সেই অনেকদিনের ফেলে আসা কলকাতা ক বাজতেই থাকল। ‘রং লাগালে বনে বনে কে…’, বনে এমন ফুল ফুটেছে…’ বা ‘কী অচেনা কুসুমের গন্ধে…’। রবীন্দ্রনাথ যদি বসন্তকালে এই দেশে, এই অঞ্চলে কটাদিন কাটিয়ে যেতেন তাহলে গীতবিতানে আরও শখানেক বসন্তের গান নিশ্চয় যোগ হতো। এইসব এলোমেলো কথা ভাবতে ভাবতে হাঁটছি, এমন সময় বাঁ পাশে একটা কম আগাছার জায়গা দেখলাম। এরকম নেড়া জমি দেখলে বোঝা যায় এ দেশের মাটি কিছুটা রুক্ষ ধরনের। তবে এখানে এমন কিছু ছিল যে আমাকে দাঁড়িয়ে যেতে হলো।

ফুট চারেক উঁচু একটা ক্রস মাটিতে পোঁতা। তার নিচে অনেক ফুল রয়েছে। প্লাস্টিকের ফুল নয়, কেউ আজ কিংবা বড়জোর কাল সন্ধেবেলা রেখে গেছে। সেখানে কাচের ফ্রেমে বাঁধানো দু-তিনটে ছবিও রয়েছে। একটি যুবকের, মোটর সাইকেল পাশে নিয়ে। আর রয়েছে অনেকগুলো আমেরিকার পতাকা, কিছু সাজাবার উপকরণ। একটা নীল রঙের কাগজের চক্রও আছে। এ জিনিস ছোটবেলায় চড়কের মেলা থেকে কিনতাম, হাওয়া দিলে ঘুরতে থাকে। যত জোরে হাওয়া বয় তত জোরে ঘোরে। আমরা বলতাম সুদর্শন চক্র। ক্রসটার আড়াআড়ি আংশতে একটা নাম লেখা আছে – সার্জন্ট ম্যাথু লোয়ানথাল। যেটা দেখে আমার মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল তা হলো – ছেলেটি মারা গেছে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে। জন্ম পনেরোই অক্টোবর উনিশশো পঁচানব্বই আর মৃত্যু …. তারিখটা ঠিক দেখছি তো … ইস, জন্মদিনেই ছেলেটি মারা গেছে। আরও বোঝা যাচ্ছে ছেলেটি আমেরিকার নৌসেনাতে কাজ করত। কাছেদূরে এতো ফুল ফুটেছে যে আমার সেই ‘সাত ভাই চম্পা’ গল্পটা মনে পড়ে গেল। এই ভাইটির জন্য কি কোথাও পারুল বোন নেই! যে একবার ডাকলেই ছেলেটি ছবি ছেড়ে উঠে এসে পা দিয়ে তার মোটর-সাইকেলটা ঝটাং করে চালু করবে?

আজকাল সকলের পকেটেই এক সবজান্তা মহাপুরুষ বাস করেন যাঁর নাম শ্রীগুগুল মহারাজ। আমি তাঁকে স্মরণ করে প্রশ্ন রাখলাম – সার্জন্ট ম্যাথু সম্বন্ধে জানতে চাই। এদেশে ফাইভ-জি চলে, তাই পট করে জবাব এসে গেল। ছেলেটি মোটর-সাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল, কয়েকদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে পনেরোই অক্টোবর মারা যায়। ছেলেটি এই শহরে নৌসেনার ঘাটিতে কাজ করত, কাজের স্বীকৃতি হিসাবে বেশ কটা পদকও পেয়েছিল।

আমার মনে হলো ছেলেটি তার চব্বিশতম জন্মদিনটা দেখে যাবে বলেই হাসপাতালে ওই কটা দিন প্রাণটুকু ধরে রেখেছিল।

কফির দোকান অবধি গেলাম তারপর উদ্দেশ্যহীন ভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে কফি না নিয়েই ফিরতি পথ ধরলাম। কোলকাতা ক, ভিনদেশি প্রকৃতির আশ্চর্য সুন্দর রূপ এসবের সঙ্গে ওই সার্জেন্ট ম্যাথুর কথাটা মাথায় রয়ে গিয়েছিল।

সার্জেন্ট ম্যাথুর জায়গাটা এবার আমার ডানদিকে। আমার পা আবার আটকে গেল। মনের ভুল? কি জানি। ছবির ম্যাথু আমাকে ডাকছে। ‘দাঁড়াও পথিকবর জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল …’ না, না তা কী করে হবে। এ তো অন্য দেশ। আর এটা নিশ্চয় একটা স্মৃতিচিহ্ন – এ শহরে সামরিক বাহিনীর জন্য এক বিস্তৃত সমাধি ক্ষেত্র আছে (আমি দেখেছি) – এ ছেলেটির সমাধি নিশ্চয় সেখানে। তবু আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ছবির ম্যাথু হাসিহাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বলছে “তোমাকে ভারি আনমনা লাগছে, তুমি কি কিছু ভাবছ যেতে যেতে?”

বললাম “হ্যাঁ, এ রাস্তা আমার চেনা। অনেক হেঁটেছি দুজনে। এখন সে আর নেই। তাই একা একা লাগছে, এই আর কি…”

“তুমি তো অন্যদেশের মানুষ। কবে এসেছিলে?”

“গত বছরই এসেছিলাম কিন্তু আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়াতে তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে গিয়েছিলাম। তার আগে এসেছিলাম দুহাজার ষোলতে, সেবার দুজনে এ রাস্তায় প্রায় রোজই হাঁটতাম।”

এ অঞ্চলে মাঝেমাঝেই জোর হাওয়া ওঠে। প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়া। ঝোপ-ঝাড় বড় গাছের পাতা সকলেই একসঙ্গে নুয়ে পড়ল। মহাসাগরের বাতাসকে সম্মান জানিয়েই বোধহয়। আর সেই সুর্দশন চক্র বাতাস পেয়ে হসহস শব্দ করে ঘুরে উঠল। আমার মনে হল এই ধ্বনি, গাছ-পালায় পলক দুয়েকের এই সঞ্চরণ – এ যেন ছবিতে আটকে থাকা ম্যাথু ছেলেটির দীর্ঘশ্বাস।

“ওহ, দুজার ষোলো! ষোলতে তো আমি এখানে ছিলাম না। তখন আমি নৌসেনাতে কাজ করি। এই শহরেই নৌসেনার বড় ঘাঁটি আছে জান তো? আমাকে সকলে খুব ভালোবাসতো, কাজে খুবই ভালো ছিলাম। অনেকগুলো মেডেল, পদক, সম্মান-টম্মান পেয়েছিলাম”

“তারপর কী হলো?”

“আরে আর বলো কেনো। এই রাস্তাদিয়েই আমার প্রিয় বাহন মানে মোটর-সাইকেলে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। সেদিন একটু বেশি জোরেই চালাচ্ছিলাম, তবে ওই রকম গতিতে আগে বহুবার চালিয়েছি, কিছু হয়নি। সেদিন কী করে যেন হাতটা একটু নড়ে গেল – সোজা ধাক্কা খেলাম রাস্তা-বিভাজকে মানে যাওয়ার আর আসার রাস্তার মাঝে যে সিমেন্ট করা আলের মতো থাকে সেটাতে। চোখ খুলে দেখি হাসপাতালের বিছানায়। তারপরেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

“কতদিন যে শুয়েছিলাম জানি না। একদিন একটু সময়ের জন্য ঘুম ভেঙেছিল। দেখলাম আমার ছোটবোন আমার বিছানার পাশে বসে খুব কাঁদছে। তার হাতে একটা রঙীন ফিতে মোড়া বাক্স। বলল “আজ তোর জন্মদিন…’। ব্যাস তারপর আর কিছু খেয়াল নেই। আরও বোধহয় অনেকদিন পরে একদিন ঘুম ভেঙে দেখি আমি এখানে। আমার সামনে ফুলটুল রাখা, বাড়ি থেকে কেউ না কেউ এসে দিয়ে গেছে। দিয়েও যায় রোজ। মরে গেছি, তাই রোজই আমার জন্মদিন!”

আমি বললাম “জানো ম্যাথু, আমাদের দেশে বলে যে মানুষ বারবার নতুন মানুষ হয়ে জন্মায়। তুমি হয়তো আবার কোথাও, কোনো পরিবারে জন্মাবে।”

ম্যাথু কিছু বলল না। তারপর যেই আমি যাবার জন্য পা বাড়িয়েছি, ম্যাথু বলল “শোন, একটা কথা বলি তোমাকে? তুমি অবশ্য আমার থেকে বয়সে অনেক বড় তবু আমি চারিদিক দেখতে দেখতে কিছু শিখেছি। ভাবছিলাম তোমাকে বলি, যদি তোমার মনটা একটু ভালো হয়”

ছবির দিকে এক পা এগিয়ে গিয়ে বললাম “বল, নিশ্চয় শুনব”

“জানো বন্ধু, এই যে আমি মরে গিয়েছি তাতে কিন্তু কোথাও কিছু পাল্টায়নি। সেই আগের মতোই শীতের পর বসন্তকাল এসেছে। ফুল ফুটেছে। আকাশ ঘন নীল, থেকে থেকে মহাসাগরের বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আমার বন্ধুরা, আমার বাড়ির লোকেরা আমাকে মনে রেখেছে ঠিকই, তবে সকলেই নিজের নিজের কাজে ফিরে গেছে। আমার জন্য কেউ বসে নেই। সত্যি আমার জন্য কেউ বসে নেই স…ত্যি… ওই দেখ আকাশে …”

বিকট আওয়াজে কানে তালা লেগে গেল। দুটো জেট প্লেন বেশ নিচু দিয়ে উড়ে গেল একসঙ্গে। ম্যাথু বলল “ওগুলো নৌসেনার উড়োজাহাজ। আমি কত উড়েছি। আমার বন্ধুরা চালাচ্ছে। আমি চিনি ওদের। আমাকে সকলে কী যে ভালোবাসতো, কিন্তু দেখ কাজ ওরা করে চলেছে, কাজ ছাড়লে তো চলে না...

“তাই বলছিলাম কী বন্ধু – তুমিও তোমার যা কাজ করার আছে তা করতে থাকো। পৃথিবীর নিয়ম কী জানো? যা হয় তা হয়। যা হচ্ছে তা হচ্ছে। যা হবার তা হবে। আমাদের কাজ কাজ করে যাওয়া। তবে কখনো ভাবতে বসো না যে এ কাজটা করছি বলে এটা হবে, ওটা পাবো। কী থেকে কী হয় তা সঠিক কেউ জানে না। ওসব প্রত্যাশায় নিজেকে জড়িয়ে না ফেলাই ভালো। এটাই সার কথা বন্ধু।”

দেড়টা বেজে গেছে, রদ্দুর কড়া হচ্ছে। আমি একটা হালকা সোয়েটার পরে বেরিয়েছিলাম, ওটা খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিলাম। ম্যাথু বলে উঠল “ইস, তুমি দেখছি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। আরো কিছুটা হাঁটতে হবে যে তোমাকে। ইচ্ছে করছে মোটর-সাইকেলে বসিয়ে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি”

আমি বললাম “বেশি দূর তো নয়, আমি বাড়ি পৌঁছে যাব। তবে ম্যাথু ভাই, একটা কথা বলি তোমাকে। তুমি আজ যা শেখালে তা দিয়ে আর যেটুকু রাস্তা আমার বাকি রয়েছে সেটুকু হেঁটে পার হয়ে যেতে পারব।”






1

পথে প্রবাসে - অচিন্ত্য দাস

Posted in









চাঁদিপুরের মতো সমুদ্র আমি কোনোদিন দেখিনি। জল ছুঁতে যেতে হয় কম করে মাইল খানেক। বিকেলের দিকে চাঁদিপুর পৌঁছে বালির ওপর হেঁটেহেঁটে জলের দিকেই যাচ্ছিলাম। প্রথম দিকে বালি খুব মিহি আর এঁটেল মাটির মত শক্ত। গাড়ি, মোটর সাইকেলের চাকার দাগ ছাড়া আর কিছু নেই। আর একটু যেতেই দেখা গেল বালি অপেক্ষাকৃত নরম আর বালুতট জুড়ে ডোরা ডোরা দাগ। বোঝা যায় জল এই অবধি আসে, হয়তো রোজ। এই ডোরা দাগগুলো জলের আসা-যাওয়ার চিহ্ন। সৈকত রেখা বলে কি কোনো কথা আছে? ঠিক জানি না তবে ইংরেজিতে “বীচ মার্ক” কথাটা শুনেছি। মনে হচ্ছিল সমুদ্রদেব আসবেন, তাই তাঁর দূতেরা আগে এসে বালিতে আলপনা এঁকে রেখে গেছে। কিন্তু কখন আসবেন? গুগলবাবাকে প্রশ্নটা ঠিক কী ভাবে করবো বুঝতে না পেরে এক ডাবওয়ালাকে জিগেস করলাম। সে বলল “আজ আর আসবেনি, কাল আসতে আসতে সাড়ে নটা দশটা বাজবে।”

আমাদের চাঁদিপুর ভ্রমণে, এই ডাব বিক্রতার একটি মুখ্য ভূমিকা ছিল। বলছি। আমার এক বন্ধু বলল “একটা জিনিস চেখে দেখতে চাস?” সম্মতির অপেক্ষা না করে সবার জন্য এক একটা ডাব কিনে ফেলল। ডাবের জল খাওয়ার জন্য যথারীতি কাটা অংশটায় একটা প্লাস্টিকের সরু নল মানে ‘স্ট্র’ ডোবানো। বলল “একটুখানি জল খেয়ে নে।” নিলাম। এবারে সে পকেট থেকে একটা চ্যাপটা রামের বোতল বার করে সকলের ডাবের জলে একটু একটু মিশিয়ে দিল।

সারাদিনব্যাপী যাত্রার ধকল আর শীত শেষ হয়ে গরম পড়ার আবহাওয়ায় শরীরে খানিকটা ক্লান্তি জমেছিল। প্রথম চুমুকটা দিয়েই মনে হলো, উফ কী দারুণ! শরীর মন একেবারে জুড়িয়ে গেল। এ জিনিসের পরে সমুদ্র-মন্থনের অমৃত পর্যন্ত বিস্বাদ লাগতো। অতি সাধারণ কায়দায় তৈরি এই অসাধারণ পানীয়টি চাঁদিপুরে আমার একটা বড় প্রাপ্তি। আবিষ্কারও বলা যেতে পারে।

বিকেল শেষ হয়ে সন্ধে নামছে। পশ্মিম দিকে সূর্যদেব পাটে নামবেন তাই সেদিকটায় বিচিত্র রঙের খেলা – যেমন সাধারণত হয়ে থাকে। আরও খানিকটা যাবার পর দেখলাম বালি আর শুকনো নেই, বালি আর জল মিশে রয়েছে। তার ওপর অস্তসূর্যের আলো বেশ একটা চিকিমিকি ভাব নিয়ে এসেছে। একটি পুরুষ, স্ত্রীলোক আর তাদের সঙ্গে একটি শিশু সেই চিকচিকে বালিতে পায় পায় সাগরের দিকে যাচ্ছে। এখান থেকে তাদের কালো স্যিলুট ছবির মতো লাগছে। ‘ম্যান, ওম্যান অ্যান্ড চাইল্ড’ কথাটা মনে পড়ে গেল। ফোন তাক করে ছবি তুললাম, কিন্তু সচরাচর এ সব জায়গায় যা হয় তাই হলো। ফোনের ক্যামেরায় মনের ভাবটুকু তেমন করে ধরা পরল না।

সাগর এখান থেকে আর বেশি দূর নয়। জলের সঙ্গে বালির নিয়মিত সহবাস – তাই বালি নরম আর জোলো। এখানে সৈকত রেখার নকশা অন্য ধরনের। ডোরা দাগ নয়, ছোট ছোট ডুমো ডুমো ছাপ, যেন চরাচর জুড়ে কেউ আশ্চর্য নিপুণতায় বড়ি দিয়ে রেখেছে। অনেকে জলের দিকে যাচ্ছে আমাদেরই মতো। কিংবা সেই নারী-পুরুষ-শিশুটির মতো। পায়ের ছাপ পড়ছে বালিতে। একটু এগিয়ে একবার ফিরে দেখলাম। নাঃ, আমাদের পায়ের ছাপ মুছে গেছে। সাগর বেলায় কারোর পায়ের ছাপই থাকে না। কোনোটা মিলিয়ে যায় একটু আগে কোনোটা তারপরে।

বঙ্গোপসাগরের জল স্পর্শ করে ফিরে আসছিলাম। দু-দুবার পাখির ঝাঁক দেখলাম, ছবি তুলতে না তুলতেই তারা হুস করে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল দূরে। দু-একটা ছোট সামুদ্রিক প্রাণী বালিতে আটকা পড়ে গেছে – এদের আর এ জীবনে সমুদ্রে ফেরা হবে না। পূব আকাশে আলো কমে আসছে আর সেই পড়ন্ত আলোতে মঞ্চে আসছেন এক নতুন চরিত্র। চাঁদ।

সেদিনটা ছিল পূর্ণিমা। পূব আকাশে খুব আবছা একটা সোনালী বৃত্তরেখা চোখে পড়ছে যদিও অন্যদিকে সূর্যদেব তখনো বিরাজমান। যতক্ষণে আমরা আবার রাস্তার ধারে ফিরে এলাম ততক্ষণে অবশ্য সূর্যদেব অস্তাচলে গেছেন। আকাশের রাজত্ব প্রায় সোমদেবের দখলে এসে পড়েছে।

বালুতট যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে গোটা সাত-আট সিড়ির ধাপ পেরিয়ে রাস্তায় ওঠা যায়। সিমেন্টের বাধানো ধাপগুলোর আড়াআড়ি বিস্তার অনেকটা। আমরা সেই সিড়ির ধাপে জায়গা করে বসলাম। সেদিন শুক্রবার, মানে কাল পরশু ছুটি। চাঁদিপুর জমজমাট। আমাদের মত দু-চারজন বাইরে থেকে এসেছে ঠিকই তবে বেশির ভাগ লোকজন আশেপাশের লোকালয় থেকেই সমুদ্রতীরে সন্ধে কাটাতে এসেছে। তেলেভাজা, মাছভাজা থেকে ঘুগনি, চাওমিন ইত্যাদি বেশ বিক্রি হচ্ছে। এখানে অন্যান্য সমুদ্রতীরের তুলনায় ঝিনুকের মালা, শাঁখ, ঘর-সাজানোর স্যুভেনির ধরনের জিনিসের দোকানের চেয়ে খাবারের আয়োজনই বেশি।

আমার মনোযোগ গিয়ে পড়ল মানুষ ছাড়া আরও চার রকমের প্রাণীর দিকে। গরু, কুকুর, বেড়াল আর ছাগল। ইংরেজিতে সিমবাওসিস বলে একটা কথা আছে যার মানে সহাবস্থান। দোকানদার আর ভ্রমণকারীদের সঙ্গে এদের চমৎকার সহাবস্থানের সম্পর্ক। ঘুরছে ফিরছে খাচ্ছে, কোনো ভয়ডর নেই। গরু, কুকুর বেড়াল – এরা তো বুদ্ধিমান প্রাণী জানতাম। কিন্তু ছাগল? এদের বুদ্ধি, সাহস আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যে কতটা হতে পারে তা চাঁদিপুরে না এলে জানতে পারতাম না। গোটা কতক কালো ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছিল – আমি তাদের লক্ষ করছিলাম। ছাগলের তাকানো যতই ফ্যালফ্যালে মনে হোক না কেন এদের দৃষ্টির জোর আছে। এত লোকের মধ্যে কারা পশুপ্রেমিক তা এরা সহজেই বুঝে নেয়। শুধু তাই নয়। এরা আরও বুঝতে পারে সে পশুপ্রেমিকের ধরনটা কেমন। মনুষ্য সন্তানটি কি সেই ধরনের পশুপ্রেমিক যে নিজের খাবার থেকে বা দোকান থেকে খাবার কিনে তাকে ভাগ দেবে! যদি সেরকম বুঝল তাহলে নারী, পুরুষ বা শিশু যাই হোক ছাগল তাকে ছাড়বে না। একেবারে গা ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকবে! শালপাতায় কিছুটা ঘুগনি, বিস্কুট যা পাচ্ছে তা পাতা-কাগজ সমেত খেয়ে নিচ্ছে। একবার দেখলাম শালপাতায় লেগে থাকা ঘুগনি দু-একবার শুঁকে একটা কুকুর ছেড়ে চলে গেল। তারপর এলো একটি ছাগশিশু। সে দেখেই বুঝল কুকুরভাই না খেলে কী হবে, এতে যথেষ্ঠ খাদ্যগুণ আছে। সময় নষ্ট না করে সব উদরস্ত করে নিল।

চাঁদ তখন আরও অনেকটা উঁচুতে উঠেছে, তা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ ডিগ্রী মতো হবে। সমুদ্র কি একটু কাছে এসেছে? হতে পারে। দূরের দিকটা চাঁদের আলোতে কীরকম যেন মোহময় লাগছিল। বেলা থাকতে যা দেখা যায় এ দৃশ্য তার থেকে একেবারে আলাদা। অন্ধকার হয়ে গেছে বলে সমুদ্রের দিকে বিশেষ কেউ যায়নি। রবীন্দ্রনাথের গানে ‘রক্তিম মরীচিকা’ বলে একটা কথা শুনেছি। দূরে যা দেখছি তাকে কি ‘চন্দ্রিম মরীচিকা” বলা যাবে!

আজ এই নিয়ে দ্বিতীয় বার জলের দিকে হাঁটা লাগালাম। বেশ খানিকটা যাবার পর দেখলাম বালির ওপর জলের একটা পাতলা স্তর এসে গেছে। পা দিলে থসথস করে। দাঁড়িয়ে পড়লাম। বালুতীর মেঝের মতো সমতল নয়, তার গায়ে সৈকত রেখার বিচিত্র নকশা কাটা। সেই জল মেশা নকশা-কাটা বালিতে চন্দ্রালোক অদ্ভুত খেলা খেলছে। এ ধরনের প্রতিফলিত চাঁদের আলো কখনো দেখিনি – অপার্থিব বললে ভুল হয় না। আর একটু দূরেই সমুদ্র, তার সঙ্গে চাঁদের আলোর সম্পর্কটা একটু বেশি চপল। তবে বালুতট, চাঁদের আলো আর সমুদ্র – এরা চরাচরব্যাপী একটাই ক্যানভাসে একই ছবির অংশ। যদিও বা কখনো ছবিতে বা সিনেমায় এর কাছাকছি কিছু দেখে থাকি, এরকম দৃশ্য স্বচক্ষে এ জীবনে কখনো দেখিনি। আর জনহীন এই বালুকাবেলায় পূর্ণিমা রাতে সে ছবির ভেতর নিজের ঢুকে পড়াও এই প্রথম। কয়েক মিনিট হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

হতবাক হওয়াটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, বহুযুগ থেকেই মানুষ চন্দ্রালোকে সমুদ্র দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। সে যুগের হতবাক মানুষেরা এসব দৃশ্যের স্মৃতি নিয়ে ঘরে ফিরে যেত। তাছাড়া আর কিছু করা সম্ভব ছিল না। দিন পালটে যাওয়ায় মানুষ হতবাক হয়ে যাবার পর আর তা করছে না। মানুষ মাত্রেরই পকেটে ফোন। আজকাল আবার সব রকম ফোনেই ভালো জাতের ক্যামেরা লাগানো থাকে। আজকের মানুষ যেখানে যা দেখে কচাকচ তার কটা ফটো তুলে নেয়।

আমিও তাই করলাম। এরকম দৃশ্যের সাংঘাতিক ভালো ফটো হতে পারে তা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু সে ভালো ছবি কী ভাবে তুলতে হয় তা আমার জানা নেই। তাই ফোন বার করে ওপরে নিচে এপাশে ওপাশে এলোপাথারি গোটা কয়েক ছবি তুলে রাখলাম। কখনো ভাবছিলাম ফোন আড়াআড়ি ধরলে ভালো হবে, কখনো লম্বালম্বি। পরে দেখেছিলাম ছবিগুলোতে ঘুটঘুটে অন্ধকারটাই ভালো এসেছে, তাছাড়া বিশেষ কিছুই নেই। একটা দুটোতে কী করে যেন খানিকটা চিকমিকে আলো দেখা যাচ্ছে।

ঠিক এই সময় আমি মনে মনে একটা কথা বুঝতে পারলাম। এই চাঁদিনী রাতের সমুদ্র আমার ভালো লাগছে না। একেবারে ভালো লাগছে না। এই চাঁদ, এই বালুকা বেলা, সমুদ্রের এই মৃদু তরঙ্গ – এরা যেন নিজেদের নিয়েই আছে। আমি এর মধ্যে নিমন্ত্রণ ছাড়া ঢুকে পড়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। এরা আমাকে চেনে না, নজরও করছে না। এই চরাচরব্যাপী উদাসীনতার মধ্যে আমি কারোর নই, কেউ আমার নয়। আমি সম্পূর্ণ একা। একাকীত্বের ভার বলে যদি কিছু থাকে তাহলে তা এখানে বহুগুণ বেড়ে গেছে।

পা চালিয়ে ফিরে এলাম সিমেন্টের বাধানো সিড়ির ধাপে। প্রায় নটা বাজতে চলল, তাই ভীড় পাতলা হয়ে গেছে। সন্ধের মেলা ভেঙে গেছে। গাঢ় লাল টমেটোর সস লেগে থাকা একটা কাগজের থালা সাগরের হাওয়ায় এদিকে সেদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে এলোমেলো। বেড়ালটা একটা বন্ধ দোকানের বেঞ্চিতে আধশোয়া, কুকুরগুলো বসে পড়েছে। গরু ফিরে গেছে। পশুপ্রেমিক-সন্ধানী ছাগল কিন্তু আছে। আমি যেতেই একটা ছাগল আমার কাছে এসে আমার পশুপ্রেমের ধরনটা বুঝে নিতে চাইছিল। মানে আমি কি কিছু কিনে একে ভাগ দেবো? তেলেভাজার দোকানের লোকটা আমার দিকে ঘুম চোখে তাকালো, বন্ধ করার আগে এ লোকটা কি এক ঠোঙা ফুলুরি কিনবে।

বেশি রাত্তিরে বালুতটে কেউ থাকুক তা এখানকার কতৃপক্ষ চান না। তাই নটা বাজলেই সব আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়। সাগরতীরের এলাকা জুড়ে উঁচুউঁচু খুটিতে যতগুলো জোরালো এল ই ডি আলো ছিল সব একসঙ্গে নিবে গেল। চন্দ্রালোক এতক্ষণ এল ই ডি আলোর দাপটে সুবিধে করতে পারছিল না। আলো নিবতেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল।

দূরের দিকটায় যেখানে গিয়েছিলাম সেখানে জল-স্থল-আকাশের বিরাট ক্যানভাসে আলো ছড়িয়ে চাঁদ আজ আশ্চর্য এক ছবি এঁকেছে। তবে বুঝতে পারলাম সে ছবির ভেতর থাকার চেয়ে চাঁদের আলোতে এই অপরিষ্কার আতি-সাধারণ জায়গাটুকুই আমার ভালো লাগছে।

সিমেন্টের বাধানো সিড়িতে বসে বসে ভাবছিলাম এখানে কত লোক এসেছে, তারপর চলে গেছে। আমি এই হাজার হাজার বেড়াতে আসা লোকের একজন মাত্র। আমিও দুদিনে চলে যাব। আমার কোনো বিশেষ পরিচিতি নেই, কেউ আমাকে আলাদা করে চেনেও না। তবু মনে হলো চাঁদের আলোতে এই কুকুর, ছাগল, বেড়াল, ফেরিওয়ালা আর তেলেভাজার দোকানিকে ভারি আপন লাগছে। আমি এদের কেউ না হলেও এই চন্দ্রালোকিত মুহূর্তটিতে আমি এদেরই একজন।

এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিলাম ডাবওয়ালা এখনো আছে কি না। ডাবের জলে রাম মেশানো ককটেল আরেকবার যদি পাওয়া যেত...
1

পথে প্রবাসে - অচিন্ত্য দাস

Posted in





যেসব খবরাখবর দিতে পারলে ভ্রমণ-পিপাসু লোকজনের সুবিধে হতে পারে, তা এই কদিনের ভেতরে প্রায় ভুলে গেছি। স্মৃতিতে যা রয়ে গেছে তা দেখছি সবই ব্যক্তিগত অনুভূতি। তাই এ লেখার পাঠক পাওয়া যাবে কি না জানি না। স্রেফ লেখার তাগিদেই লেখা।

কাম্বোজ দেশ মানে কাম্বোডিয়ার উত্তর পশ্চিম দিকটায় সিয়েম রিপ নামে একটি শহর আছে। বিমান থেকে নেমে বিমান-বন্দরটি দেখে চোখ আর মন দুইই জুড়িয়ে গেল। আজকালকার বড় বড় এয়ারপোর্টের মতো চকচকে ঝকঝকে কাচ আর ইষ্পাতের বিরাট বিরাট অট্টালিকা নেই। আছে গোটা চার-পাঁচ প্যাগোডা ধরনের বাদামী কাঠের ছাদওয়ালা প্রবেশ পথ। সবই একতলা, লিফ্ট বা চলন্ত সিড়ির কোনো ব্যাপার নেই। ভেতরে এসে দেখলাম আগমন ভবনটি (অ্যারাইভাল লবি র বাংলা করলাম) কয়েকটি পাথরের এবং কাঠের মূর্তি দিয়ে সাজানো। সুরুচিপূর্ণ, একটুও আতিশয্য নেই। কাম্বোডিয়ার এই মধুর আন্তরিক অভ্যর্থনা গত রাত্রির বিরক্তিকর অপেক্ষা আর রাতের-ঘুম-নষ্ট-করা বিমান যাত্রার ক্লান্তি অনেকটাই মুছে দিল।

সিয়েম রিপ শহরে প্রতিবছর সারা পৃথিবী থেকে বহু মানুষ আসে শহরের উপকণ্ঠে বিশ্ব-বিখ্যাত আঙ্কর ভাট মন্দিরটি দেখতে। সিয়েম রিপ শহরটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে, এককালে এই শহরই ছিল এ দেশের রাজধানী। তারপর রাজধানী অবশ্য সরে গেছে মেকং নদীর ধারে নম পেন শহরে। সিয়েম রিপ শহরটি চমৎকার। বোধহয় সকলেরই ভালো লাগার মতো। ভারি পরিচ্ছন্ন আর সাজানো শহর। সন্ধেবেলায় দোকান-পাটে বিক্রি হয় নানা ধরনের স্যুভেনির, টি-শার্ট, বুদ্ধমূর্তি। বাজারের পাশে পান-ভোজনের জন্য আছে পাব সট্রীট। তা ছাড়া ফুটপাথে বিক্রি হচ্ছে হাজার রকমের খাবার আর পানীয়। সিয়েম রিপ নামে একটা নদী বয়ে গেছে শহরের মাঝখান দিয়ে (নদী না বলে খাল বলাই ভালো) আর তার ওপর অনেকগুলি আলো-ঝলমলে সেতু। সব মিলিয়ে খুশি আর উৎসাহে ভরপুর। তবে আজকের লেখার বিষয় আঙ্কর ভাট মন্দির, তাই পরের দিন সকালে আঙ্গকর ভাট মন্দিরে গিয়ে যা দেখেছিলাম, যা মনে হয়েছিল তাই লিখছি।

রাস্তায় যেখানে বাস থেকে নামতে হয় সেখান থেকে মন্দির অবধি অনেকটা পথ। পথটির দুপাশে ভারি সুন্দর সবুজ ঘাসের জমি। মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ। বেশ কয়েকটা তাল গাছ চোখে পড়ল। এত দূর থেকেও মনে হলো বাপ রে, এত বড় এলাকা নিয়ে একটা মন্দির! মন্দিরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল এত বড় মন্দির চত্বর আর কোথাও দেখিনি। অবশ্য দেখবই বা কী করে। আঙ্গকর ভাটই তো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মন্দির।

এক জায়গায় রাস্তার দুপাশে দুটো প্রাচীন ভবন দেখলাম। গাইড বলল এইখানে রক্ষিত থাকত সেকালের বহু দুষ্প্রাপ্য পুঁথি-পত্র। মানে সে যুগের গ্রন্থাগার। এককালে বহু পণ্ডিত ব্যক্তি, বহু ছাত্র, বহু জ্ঞান-পিপাসু এখানে আসত অধ্যয়ন করতে। শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে গেছে। খালি বাড়ি দুটি পড়ে আছে মাঠের মাঝে। অবশ্য বয়সের আন্দাজে মনে হলো পাথরের তৈরি ভবন দুটির অবস্থা যথেষ্ঠ ভালো।

এখানে মন্দিরসহ সবকিছুর নির্মাণে বেলে পাথর বা স্যান্ড স্টোন ব্যবহার হয়েছিল। প্রায় বিশ-ত্রিশ ক্রোশ দূরের এক পাহাড়ের ঢাল থেকে পাথর কেটে নিয়ে আসা হতো। প্রতিটা পাথরে একটা গোল করে ঘাট কাটা আছে। শুনলাম সেখানে আংটা লাগিয়ে পাথরগুলি হাতী, বলদ বা ঘোড়া দিয়ে টেনে আনা হতো। আজ থেকে এক হাজার বছর আগে এই বিরাট কর্মকাণ্ড কল্পনা করলে ভারি অবাক লাগে।

একটা সেতু পার হতে হয়েছিল। গাইড ছেলেটি গর্বের সঙ্গে বলল যে এটি নাকি দুশ মিটার প্রশস্ত পরিখা, মন্দিরকে ঘিরে আছে। আমার কপালে ভাঁজ পড়ল। পরিখা তো দূর্গ বা কেল্লা বা বড়জোর রাজ-প্রাসাদের চারদিকে থাকতে পারে শত্রু আটকাবার জন্য। কিন্তু দেবস্থানে পরিখা?

উত্তর অবশ্য পেয়ে গেলাম একটু পরেই। দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত আঙ্কর ভাটের ইতিহাস যুদ্ধ ও হিংসা কণ্টকিত। এ মন্দিরের আদি নাম ছিল ‘বিষ্ণুলোক’। কিন্তু তারপরের রাজা-রাজড়ারা বৌদ্ধ ধর্মের দিকে সরে আসাতে এ মন্দিরে ধ্বংসের তাণ্ডব শুরু হয়। বিষ্ণুমূর্তির চিহ্নমাত্র দেখলাম না। তবে এই শেষ নয়, এরপরে বৌদ্ধ রাজাদের দিন শেষ হয়ে যেতে মন্দিরের ভেতর আবার ধ্বংসের খেলা চলেছিল। ভাঙাচোরার সময় দেয়ালে আঁকা ছবিগুলোর দিকে বোধহয় কেউ তেমন নজর দেয়নি। মন্দিরের টানা দেয়াল জুড়ে রামায়ণ-মহাভারতের বহু ছবি আঁকা রয়েছে। সমুদ্র-মন্থনের ছবিও চোখে পড়ল।

গাইড ছেলেটিকে আমার প্রথম থেকেই ভালো লেগেছিল। ইস্কুল পাশ – কলেজে পড়েনি। ভারি সরল। আমি তেমন কিছু না জানলেও বুঝতে পারছি ছেলেটা ইতিহাস মাঝেসাঝে গুলিয়ে ফেলছে। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছিল এক ধনুকধারী ঊর্ধপানে তীর নিক্ষেপ করার জন্য তৈরি, ওপরে একটা চাকা ধরনের কিছু আছে। মানুষটার ছবি আবছা হয়ে গেছে, মনে হল সে নিচের দিকে তাকিয়ে। গাইড বলল – এই হলো রাম। সীতাকে বিয়ে করার জন্য এই কঠিন লক্ষ্যভেদের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। এই রে! রামের হরধনু ভাঙা আর অর্জুনের লক্ষ্যভেদ গুলিয়ে ফেলেছে! ভারতীয় জনতা তা মানবে কেন! অনেকে একসঙ্গে বলে উঠল – না, এ হচ্ছে অর্জুন। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় লক্ষ্যভেদ করছে। গাইড দ্রৌপদীর নাম কোনোদিন শোনেনি, উচ্চারণও করতে পারল না। একজন ঠাট্টা করে বলল – তুমি তো রামায়ণ-মহাভারত মিশিয়ে ফেললে। তোমার তো বিরাট প্রতিভা! এতখানি বাংরেজি গাইড ছোকরা বুঝতে পারল না, তবে তাকে নিয়ে যে সকলে হাসছে, তা টের পেল। গোবেচারার মতো মুখ করে সে দাঁড়িয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল এখন যদি ছেলেটিকে কেউ ধমকের সুরে প্রশ্ন করে – হর-ধনু কে ভেঙেছিল বল... তাহলে পাঠশালার সেই বালকটির মতো গাইড বলবে – আমি ভাঙিনি স্যার, আমি জিনিসটা দেখিই নি…

এই যখন অবস্থা তখন অপ্রত্যাশিত ভাবে গাইড ছেলেটি এমন একটা উল্টো অস্ত্র ছাড়ল যেটা রাম বা অর্জুনের তূণে কোনোদিন ছিল না। জিনিসটা বরুণাস্ত্র ধরনের। সবকিছু গলিয়ে জল করে দিতে পারে।

গাইড ছেলেটি ভারি বিনয় করে বলল – আপনাদের মতো জ্ঞানীরা এখানে আসেন, তাই তো আমরা কিছু শিখতে পারি…

ব্যাস। সকলে ঠাণ্ডা, ভেতরে ভতরে খুশিও নিশ্চয়।

***

এই কয়েক মাস হলো, আমি আমার জীবন-সাথীকে হারিয়েছি। দুরারোগ্য অসুখে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই আমার ভেতরে কৃষ্ণ-গহ্বরের মতো বিরাট এক শূন্যতা পাকাপাকি ভাবে বাসা বেঁধেছে। একেক সময় সে শূন্য-গহ্বর আমার ভেতর থেকে বাইরে এসে পড়ে। অজগর সাপের মতো ঘিরে ফেলে আমাকে। আমি দলছুট হয়ে পড়ি। আনমনে রাস্তা চলি। সহযাত্রীরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যায়। পিছিয়ে পড়ি, ভাবতে থাকি কোথায় যাচ্ছি, কেনই বা যাচ্ছি। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের গানের লাইনটার মতো – ‘পথিকরা যায় আপন মনে, আমারে যায় পিছে রেখে …’।

আলাদা হয়ে পড়েছিলাম। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকাবার পর বুঝলাম বাকি সকলে কাঠের সিড়ি দিয়ে মন্দিরের দোতলায় উঠে পড়েছেন। আমিও উঠলাম। একা একা উঠে যা দেখলাম তাতে মন খারাপ হয়ে গেল। একতলার বিষ্ণুমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হয়ে কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে। আর এখানে সারিসারি বুদ্ধমূর্তি খণ্ডিত দেহে অবস্থান করছে। মূর্তির মাথা নেই, হাত নেই – বোঝাই যায় হামলাবাজেরা মুশল জাতীয় ভারী কিছু দিয়ে মূর্তিগুলি ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল। শুনলাম এগুলি স্থাপিত হয়েছিল বিষ্ণুমূর্তি ধ্বংস হবার পরে। সারকথা হলো মানুষের হিংসার কাছে সে বিষ্ণুই হোন বা বুদ্ধই হোন, কেউই পরিত্রাণ পাননি।

মন্দিরটি পাঁচ কিংবা সাত তলা ছিল। এখন তিন তলা অবধি ওঠা যায়। আবার কাঠের সিড়ি বেয়ে উঠলাম। সহযাত্রীদের অনেকজনই দেখলাম দোতলার চত্বরে ক্লান্তিতে বসে পড়েছেন। হয়তো পায়ের সমস্যা আছে – উরিক অ্যাসিড, গাউট বা আর্থারাইটিস। অথবা রদ্দুরের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্তিতে আরও দেখার ইচ্ছে উবে গেছে।

তিনতলার অবস্থা দেখে মনে হলো, বহু শতাব্দী পূর্বে যে হামলাবাজেরা বুদ্ধমূর্তি ভাঙ্গতে এসেছিল, তাদেরও আর্থারাইটিস ধরনের ব্যথাশুলো ছিল। কারণ তিনতলায় তাণ্ডবলীলার চিহ্ন স্পষ্টতই কম মনে হচ্ছে। তিন-চারটে বুদ্ধমূর্তি দেখলাম অক্ষত রয়েছে। ভগবান বুদ্ধের আর্শীবাদের ভঙ্গীতে দাঁড়ানো একটি মূর্তির সামনে এক মহিলা ও এক পুরুষ খুব ভক্তিভরে পুজো বা ধ্যান করছে। থালায় রাখা রয়েছে কলা, ড্র্যাগন ফ্রুট, পারসেমন, আপেল জাতীয় গোটাগোটা ফল। কটা বিদেশি টাকা প্রণামীও দেওয়া হয়েছে। বেশ মোটা একগোছা ধূপ জ্বলছে, তার ধোঁয়া বাতাসে কিছুক্ষণ নকশা কেটে মিলিয়ে যাচ্ছে। এই দেশে হিন্দু পুজোআর্চার সঙ্গে বুদ্ধ-উপাসনা মিলেমিশে যে এক হয়ে গেছে তা বোঝাই যায়।

এই দুজনকে দেখে মনে হলো তারা একমনে ভগবান বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করছে। আমারও কি কিছু প্রার্থনা করার আছে?

মন্দিরের তিনতলা যথেষ্ঠ উঁচুতে, আলসের ফাঁক দিয়ে অনেক দূর অবধি দেখা যাচ্ছে। সবুজ ক্ষেত, দু-একটা বসতি, টিলা, কালো ফিতের মতো রাস্তা। আমার নিজের ঘর খালি হয়ে গেছে, একা ঘরে মন লাগে না বলে দেশ ঘুরতে বেরিয়েছি। ঘুরতে ঘুরতে এসেছি আঙ্কর ভাট মন্দিরে। সেখানে সিড়ি বেয়ে উঠে এসেছি অনেক উঁচু এই তিন তলায়। আগে জানতাম না কী দেখব, তাই খানিকটা না জেনে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই শাক্যমুনির মুখোমুখি হয়ে পড়েছি। সামনে লেখা রয়েছে সম্মান দেখানোর জন্য প্রতিকৃতির সামনে মাথার টুপি বা কালো চশমা যেন খুলে রাখা হয়। তাই করলাম।

দাঁড়িয়ে আছেন শাক্যমুনি সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ। প্রকোষ্ঠটি আধো-অন্ধকার। দু-দুবার ছবি তোলার চেষ্টা করে দেখলাম সুবিধে হলো না। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। মনে হলো যেন এখানে কিছু না করে কিছুক্ষণ শুধুই দাঁড়িয়ে থাকি। এমনকি কী প্রার্থনা করা উচিত তাও মাথায় এলো না।

এরকম একটা জায়গায় এমন একটা মুহূর্তে নিজের কথা বা ইচ্ছে নিয়ে প্রাথর্না করা পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয় আর অবাস্তব ঠেকল। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ মনে হলো মানুষ যে প্রার্থনা বা উপাসনা করতে বসে তা কি শুধু বলার জন্য? তা তো শোনার জন্যও হতে পারে!

হয়তো। একতলার বিষ্ণুমূর্তি ইত্যাদি লুটপাট হয়ে গেছে, দোতলায় বুদ্ধমূর্তি হাত-পা-মাথা ভাঙ্গা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আঙ্কর ভাটের এই দুটো তলা আমাকে হয়তো বলতে চাইছে যা দেখলে তা হলো জীবনের দুঃখ-কষ্টের ছবি। তিনতলায়, মানে আরও উঁচুতে উঠতে পারলে ভগবান বুদ্ধের অক্ষত পূর্ণ অবয়ব দৃশ্যমান। খোলা মাঠের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদু বাতাস এই উঁচুতেও এসে পড়ছে।। সে বাতাস কোনো সুখ নিয়ে আসছে না ঠিকই, তবে স্বস্তির স্পর্শ রেখে যাচ্ছে।

আমি অন্য দশজনের মতো নেহাৎ সাধারণ মানুষ, এসব দার্শনিক ভাবনা আমার ভেতরে বেশিক্ষণ টেকে না, সাবানের ফেনার মতো পুটপুট করে মিলিয়ে যায়। টের পেলাম খিদে পেয়েছে, তাই অন্য সহযাত্রীদের সঙ্গে মন্দির চৌহদ্দির বাইরে রেস্তোঁরায় গিয়ে বসলাম।

কাচের বড় বড় আলমারিতে বহু রকমের খাবার। কোনোটাই অবশ্য চিনতে পারলাম না। ওদেশের ভাষায় লেখা, লোকেরাও কেউ তেমন ইংরেজি বোঝে না। তাই ঝুঁকি না নিয়ে এক কাপ আইস-ক্রীম নিলাম। একা একটা টেবিলে বসলাম, কারণ সহযাত্রীরা তখন জোর আলোচনায় ব্যস্ত। বিষয় – এখানে খাওয়া যাবে কি যাবে না, খেলে কী খাওয়া যেতে পারে। সাহায্য করার জন্য গাইডও একটা টেবিলে বসেছিল।

আইস-ক্রীমের দামটা একটু বেশি হলেও জিনিসটা ভালো। পরিমানটাও ভালো দিয়েছে। তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিলাম। এমন সময় গাইড ছেলেটির একটা কথা রেস্তোঁরার চেঁচামিচি ছাপিয়ে তিন-চারটে টেবিল টপকে আমার কানে এলো। সে বলছিল এইখানে সরকারের নিয়ম আছে যে আঙ্কর ভাটের মন্দির-চূড়ার থেকে বেশি উঁচু বাড়ি বা অন্য কোনো কিছু নির্মাণ করা যাবে না। আঙ্গকর ভাট মন্দিরই সবার ওপরে।

এই সরল ছেলেটা না জেনে একটা গভীর সত্যি কথা যেন আমার কাছে পৌঁছে দিল। মন্দিরের ওই উচ্চতায় ভগবান বুদ্ধের সামনে যে অনুভূতি হয়েছিল তার থেকে বেশি সত্যি আর কী হতে পারে? আঙ্কর ভাটের স্মৃতি একদিন আবছা হয়ে যাবে, হয়তো ভুলে যাব কোথায় আছে ফোনের ভেতর জমিয়ে রাখা সাধের ছবিগুলো। যতদিন বেঁচে থাকব আঙ্কর ভাটের তিনতলার সেই উচ্চতা থেকে পাওয়া শিক্ষাটুকু কিন্তু সঙ্গে রয়ে যাবে। তবে খাড়া কাঠের সিড়ি বেয়ে অত উঁচুতে সময়-অসময় উঠতে পারা যাবে কি না জানি না।
0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in





আমার ভারতবর্ষ

মুসম্মন বুরুজ (শাহি বুরুজ)


নসিব-এ-হিন্দৌস্তাঁ
পর্তুগিজ যাজক বুজিও এদেশের লোককে খুব ভালো চিনতেন। সেই কবে মানুচ্চিকে বলেছিলেন, ' দারা অত্যন্ত ভালো লোক, উদার, বুদ্ধিমান, সুশাসক। কিন্তু সেটাই এদেশের লোকের কাছে তাঁর প্রধান দোষ। হিন্দুস্তানের লোকেরা নীচ স্বভাবের। তারা দারা শুকোহের মতো মহান, হৃদয়বান শাসককে ভক্তি করেনা। তাদের জন্য দরকার তাদের মতো'ই নীচ, নৃশংস, অত্যাচারী স্বভাবের শাসক।

বের্নিয়ার আর ত্যাভারনিয়েরও খুব অবাক হয়েছিলেন। তাঁরা জানতেন, দিল্লি-আগ্রার সব প্রভাবশালী আমির-ওমরাহরা সারা জীবন বাদশা শাহজাহানের থেকে কী ধরনের সাহায্য, অনুকম্পা লাভ করেছিলেন। বাদশা শাহজাহানের দৌলতেই তাঁরা লাভ করেছিলেন ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, শক্তি-সামর্থ্য। কিন্তু অসুস্থ, অসহায় বাদশাকে পুত্র অওরঙ্গজেব যখন আগ্রা দুর্গে অত্যন্ত অপমানজনক ভাবে গৃহবন্দি করলেন, তাঁরা কেউ টুঁ শব্দ করলেন না। পিতৃপ্রতিম বাদশাহকে তাঁরা নীরবে, সভয়ে, সশংক ত্যাগ করলেন।

হিন্দুস্তানের সর্বকালের সবচেয়ে বিলাসী, সম্পদশালী, জাঁকালো রাজা নির্বাসিত হলেন আগ্রা দুর্গের এককোণে। তখন তাঁর রাজত্ব বলতে শুধু মুসম্মন (শাহি) বুরুজ আর শাহজহানি মহল। শুশ্রূষা বলতে কন্যা জহানারা বেগম। তবে অওরঙ্গজেব বাদশাহের জনানা মহলকেও সেখানে থাকতে দিয়েছিলেন। সঙ্গে থাকতেন তাঁর দুই জীবিত বেগম আকবরি মহল আর ফতেহপুরি মহল। শাহজহানের প্রথম সন্তান শাহজাদী পরহুনর বেগমও ছিলেন সেখানে। ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিলোনা। শাহজাদা মহম্মদ সুলতান দেখাশোনা করতেন বাদশাহ এবং সঙ্গিসাথিদের। তিনি চলে যেতে দায়িত্বে আসেন একজন নীচ স্বভাবের খোজা সর্দার, মুতমদ। মানুচ্চির ভাষায়, 'বেবুনে'র মতো চেহারা তাঁর। প্রতিপদে বাদশাকে অপদস্থ করাই ছিলো তাঁর প্রিয় কাজ।

বাদশাহ শাহজহান তখন খুবই ধর্মমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। কোরান পড়তেন, জপ করতেন, পণ্ডিতদের সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনা করতেন। বাকি সময় শাহজহানি মহলের ঝরোখা থেকে তাজের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকতেন। বাইরের কারুর সঙ্গে দেখা করা মানা ছিলো। একে ওকে চিঠি লিখতেন বলে অওরঙ্গজেবের আদেশে বাদশার মহলে কালি-কলম সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন চিঠি বলতে শুধু অওরঙ্গজেব আর তাঁর মধ্যে পরস্পর দোষারোপ করে লেখা পত্ররাজি। যার মধ্যে শুধু অওরঙ্গজেবের চিঠিগুলি উদ্ধার হয়েছিলো। তিনি সমানে দোষারোপ করতেন দারা আর তাঁর ওয়ালিদসাহেবকে। একমাত্র বক্তব্য, যদি তাঁরা ক্ষমতায় থাকতেন, তবে এতোদিনে হিন্দুস্তান থেকে ইসলাম বিতাড়িত হয়ে যেতো।

বাদশা শাহজহান পূর্বপুরুষ, যেমন আকবর আর জহাঙ্গিরের সূর্যদর্শনের জন্য নির্মিত লালপাথরের বুরুজটিকে নতুন ভাবে বানিয়েছিলেন বেগম মমতাজ মহলের যমুনা নদীর শোভা দেখার জন্য। আগ্রা দুর্গের এটিই সব চেয়ে উঁচু নির্মাণ। সতেরো শতকে তিনের দশকে তৈরি আটকোনা মর্মর পাথরের এই প্রাসাদটির সৌন্দর্য এক কথায় অনুপম। এই প্রাসাদটির মর্মর পাথরের জাফরি, কুলুঙ্গি আর দেওয়ালের ইনলে কারুকাজ পিয়েত্রা দুরা শৈলীর। চারদিকে বারান্দা ঘেরা, মাঝখানে গোল বুরুজ আর চমৎকার ফোয়ারা। বন্দি বাদশা শাহজাহান এখানেই কাটিয়েছিলেন তাঁর জীবনের শেষ আট বছর। এই প্রাসাদের ঝরোখা থেকেই তিনি তাকিয়ে থাকতেন তাজের দিকে। তাঁর অন্তিম শয্যাও পাতা হয়েছিলো ঠিক এর মাঝখানে। গ্রেট মুঘলদের উপযুক্ত একটি কীর্তি, মুসম্মন বুরুজ।

তখন বয়স চুয়াত্তর। পয়লা ফেব্রুয়ারি, ১৬৬৬। সোমবার। বাদশাহ বুঝতে পারলেন দিন শেষ হয়ে এলো। কিন্তু তিনি সজ্ঞানে, সচেতন আছেন। জহানারার অনুরোধে লিখলেন পুত্র অওরঙ্গজেবের অপরাধ মার্জনা পত্র। লিখলেন তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রটিও। কীভাবে অন্ত্যেষ্টির কাজ করতে হবে, তার নির্দেশ। জহানারা কাঁদছিলেন। তাঁকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বাকিদের বললেন জহানারার যত্ন করতে। রাতের থেকেই তাঁর জন্য কোরান পাঠ শুরু হলো। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে তিনিও শেষ প্রার্থনা সমাপন করলেন। ভোর তিনটে নাগাদ বাদশাহ শাহজাহানের ইন্তেকাল হলো।


জহানারা অনুরোধ করলেও অওরঙ্গজেব 'শাহি দাফন' মঞ্জুর করলেন না। আগ্রা থেকেই সইয়দ মহম্মদ কনৌজি আর কাজি কুরবান এসে তাঁর মরদেহের পরিচর্যা করে একটি চন্দন কাঠের কফিনে স্থাপন করলেন। অওরঙ্গজেব এলেন না। পুত্র মোয়াজ্জামকে পাঠালেন। যমুনা নদীতে বজরা করে নিয়ে যাওয়া হলো তাজমহলে। মমতাজমহলের পাশের কবরে বাদশা শাহজহান সমাহিত হলেন দুপুর নাগাদ।


এসবই মনে পড়ছিলো যখন মুসম্মন বুরুজের ঝরোখায় দাঁড়িয়ে বাদশাহের সাড়ে তিনশো বছর পর তাজকে দেখছিলুম আমরা। শাহজহানকে মনে পড়ছিলো। তাঁর শান-শওকত, অজেয় প্রতাপ, অপার ধনসম্পদ। এভাবেই শেষ হয়। মনে পড়ছিলো পাদরি বুজিওর ভবিষ্যদবাণী। এদেশের লোক ইতিহাসের সব সন্ধিক্ষণেই বেছে নেয় অওরঙ্গজেবের মতো শাসক। দারাশুকোহ তাদের জন্য অপাংক্তেয়। ইতিহাস বার বার পুনরাবৃত্ত হয়। আমাদের নসিবও এক নরক থেকে অন্য নরকের কুম্ভীপাকে আবৃত্ত হতে থাকে। পরিত্রাণ পেতে অনেক রক্তক্ষয়, শহাদৎ….


আমরা হয়তো ভুলিনা। আবার মনেও রাখিনা। এই আমাদের ভারতবর্ষ...