0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়


হুম। আবার বাংলা নিউইয়ার! ১৪২৫। অতএব একটা গোটা দিন সৌখিন পাঞ্জাবি-পায়জামা, লালপেড়ে শাড়ি খোঁপায় বেলফুল, ‘হ্যাপি নববর্ষ’, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’। আর তারপর মাসখানেকের মধ্যে এই “২৫” সংখ্যাটা ক্রমে ক্রমে অস্পষ্ট হতে থাকবে আমাদের মগজে – তারপর ফের সেই একই চিত্রনাট্য – ‘এই গুরু, এটা যেন বাংলা কত সাল - ২৩ নাকি ২৬?’

এই আমাদের বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানা – আমাদের কোনও শাখা নাই – নাম ও সহি মিলাইয়া লইবেন।


এগারো মাসের বাচ্চা কিম্বা আশি বছরের বৃদ্ধা - কারুর রক্ষে নেই – সবাই মেয়েছেলে – রোজকার সংবাদপত্রের একঘেয়ে খবর – বিরক্ত লাগে আজকাল – এরা কি আর কোনও খবর পায় না? প্রথম প্রথম মোমবাতি নিয়ে হাঁটতেও হয়েছে বেশ কয়েকবার – সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে হ্যান্ডলুম কটনের শাড়ী, মোটা করে কাজল আর বড়ো টিপ পরে সকলের সঙ্গে মিছিলে - যদিও আমার বাড়িতে কোনও এগারো মাস বা আশি বছর নেই! পরের দিন আবার একগাদা টাকা খরচ - স্পা করাতে! তবু – ইটস্‌ মাই সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি –

এও আমাদের বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানা – আমাদের কোনও শাখা নাই – নাম ও সহি মিলাইয়া লইবেন।


কলেজলাইফে খুব লাল সালওয়ার পরতাম – পরতে ভালোও বাসতাম - অনেক পরেছি, পরতে পরতে রঙ নষ্ট হয়ে গেছে, তবুও – এখন সাদা শাড়ী পড়ি, নীল পাড় – বেশ লাগে – এখনকার ফ্যাশন!  ইদানিং আবার গেরুয়া ছেয়ে যাচ্ছে শপিংমলগুলো – নেক্সট মাসের স্যালারি পেলে – ভাবছি ...

হ্যাঁ, এও আমাদের বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানা – আমাদের কোনও শাখা নাই – নাম ও সহি মিলাইয়া লইবেন।


ওমুকের ছেলে জয়েন্টে ক্র্যাশ করেছে – ওর ছ’টা মাস্টার ছিলো – তোমার সুপুত্রকে তো গুনে গুনে আট’টা দিয়েছিলাম – গত দু’বছর ধরে টেনেছি – স্মার্টফোন, ল্যাপটপ যেদিন চেয়েছে, পরেরদিনই এনে দিয়েছি – এই ইনভেস্টমেন্টের এই রিটার্ণ? আসলে আমারই বোঝা উচিৎ ছিলো – আরে বাবা, জিন বলে তো একটা ব্যাপার আছে, না? তোমার ছেলের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাটাই ভুল – ওমুকের তো ওই চাকরি, আমি কাউন্সিলারকে দিয়ে সময় ও জায়গামতো পালিশ না দিলে এতদিনে পথে বসতো – ঈশ্‌, আমার ‘পেস্টিজ এক্কেবারে পাংচার’! 

আরে, এটাও আমাদের বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানা – আমাদের কোনও শাখা নাই – নাম ও সহি মিলাইয়া লইবেন।


সামনে কবিপক্ষ – এই চল্‌, একটা পত্রিকা বের করি – বাংলায় লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের সঠিক সময় এই কবিপক্ষে। কেন? আমরাই লিখবো – সদনে পঁচিশে বৈশাখ ধুন্ধুমার বিক্রি করবো সবাই মিলে – দে, চাঁদা দে – সাতদিনের মধ্যে লেখাপত্র জমা দে – তারপর কম্পোজ-প্রেস-বাইণ্ডিং অনেক কাজ –

ঠিকই ধরেছেন, এও আমাদের বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানা – আমাদের কোনও শাখা নাই – নাম ও সহি মিলাইয়া লইবেন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


প্রবাদের জন্মকথা 
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় 

শিরোনাম দিয়েছি বটে, কিন্তু প্রবাদের কোন জন্মকথা হয় না। কোন একটি প্রবাদ, কবে তার উৎপত্তি, তা হয়তো খুঁজে দেখা যেতে পারে, কিন্তু উৎপত্তির সঙ্গেসঙ্গেই সেটা প্রবাদ হয় না, হয় লোকমুখে উচ্চারিত হতে হতে। ‘রাতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়েই কলকাতায় আছি’ বলেছিলেন আদি কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত দুশ’ বছর আগে তারপর নগরবাসীর মুখফেরতা হয়ে প্রবাদের চেহারা পেয়েছে। গিরিশচন্দ্র ঘোষ ১৩০ বছর আগে তাঁর ‘প্রফুল্ল’ নাটকে একটা সংলাপ লিখেছিলেন – মুখ্য চরিত্র যোগেশ বিলাপ করছে ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেলো’। একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন নির্দেশক নাট্যচরিত্র যোগেশের সেই বিলাপ কালক্রমে প্রবাদ হয়ে গেছে। এ রকম অনেক প্রবাদবাক্য আমরা জানি, সাহিত্য, নিত্যদিনের কথাবার্তায় প্রয়োগ করি, যেগুলির উৎপত্তির কার্যকারণ ও অন্তর্নিহিত অর্থ খুজে পাই। কিন্তু মৌখিক কথাবার্তায় সৃষ্ট হাজার হাজার প্রবাদবাক্য হারিয়েই যাচ্ছে। 



‘প্রবাদ’কে লোকসাহিত্যের অঙ্গ বলা হয়, যদিও আধুনিক সাহিত্যের অনেক বাক্য বা কথন প্রবাদের তালিকায় প্রবেশ করেছে। কোন একটি সংজ্ঞাতে প্রবাদকে বাঁধা যায় না। একটি প্রচলিত সংজ্ঞা ‘প্রবাদ হল দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সঞ্জাত সংক্ষিপ্ত বাক্য বা বাক্যাংশ’। এই সংজ্ঞাতেও অসঙ্গতি খুঁজে পাবেন কেউকেউ। ‘জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্রাণ’ এই পংক্তি বা বাক্যটি দুখিনী ফুল্লরার বারো মাসের অভিজ্ঞতার বিবৃতি, আবার ‘লাগে টাকা দেবে গৌরি সেন’ এই প্রবাদটিতে ব্যক্তির অভিজ্ঞতার উপস্থিতি নেই। তবুও প্রবাদ যে লোকজীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই উদ্ভুত এ বিষয়ে বিতর্কের খুব বেশি অবকাশ নেই। লোকসাহিত্য গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, “সাধারণ জীবনের অভিজ্ঞতার উপরই প্রবাদ রচিত হইয়া থাকে, ইহার রচনা কোন কোন সময় জটিল হইয়া উঠিতে পারে, কিন্তু ভাব কিংবা বক্তব্যের দিক হইতে লোকসাহিত্যের অন্যান্য বিষয়ের মতো ইহাও নিতান্ত সাধারণ স্তরের জীবনের সমস্যা লইয়াই রচিত হয়। বাংলা দেশের সাধারণ কৃষিকর্ম, রন্ধনকর্ম, পারিবারিক জীবনের কিংবা সমাজের নানা সমস্যা, এই সকল বিষয়ই প্রবাদে প্রধানত প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। কোন অলৌকিক, রোমান্টিক কিংবা নিগূঢ বিষয় ইহাতে স্থান পায় না”। অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যের ভিত্তিতেই প্রবাদ রচিত হয়, মানুষের শাশ্বত জ্ঞানের ভিত্তিতে নয়” (‘বাংলার লোক-সাহিত্য’ ৬ষ্ঠ খন্ড – প্রবাদ) । তবুও প্রবাদ কখনও কখনও শাশ্বত জ্ঞানের চেহারা নিয়ে নেয়। “সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে” প্রবাদটি মানুষের সাংসারিক অভিজ্ঞতা সঞ্জাত আবার শাশ্বত সামাজিক জ্ঞানও বটে। আবার ‘ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়’ প্রবাদটিতে শাশ্বত জ্ঞানের ইঙ্গিত আছে কিন্তু অভিজ্ঞতালব্ধ এমন বলা যায় না। চর্যাপদ থেকে শুরু করে চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, কবিকঙ্কণের চন্ডীমঙ্গল, কিংবা রামায়ণ, মহাভারতে অনেক প্রবাদবাক্য পাওয়া যায়, যেগুলির পরবর্তী যুগের লেখকদের হাতে রূপভেদ ঘটেছে। ভারতচন্দ্রের রচনায় পাই ‘হাভাতে যদ্যপি চায় সাগর শুকায়ে যায়’ আধুনিক লেখক রূপভেদ ঘটিয়ে লিখেছেন ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়’। 



অনেকে ‘প্রবাদ’ ও ‘প্রবচন’কে এক গোত্রের মনে করেন। সেটি ঠিক নয়। প্রবাদ অভিজ্ঞতা সঞ্জাত সরস, ব্যঞ্জনাধর্মী অর্থবহ বাক্য, কিন্তু প্রবচন বা প্রকৃষ্ট বচন নীতিবাক্য,উপদেশ বা পরামর্শমূলক আপ্তবাক্য। ‘খণার বচন’গুলি কৃষিকার্য ও সাংসারিক অভিজ্ঞতা সঞ্জাত উপদেশবাক্য, কিন্তু প্রবাদ নয়। ‘নদীর ধারে পুঁতলে আলু, আলু হয় গাছ বেরালু’ খণা কথিত এই বচনে বালি-মাটিতে আলু চাষের পরামর্শ রয়েছে, কিন্তু এটা প্রবাদ হিসাবে গন্য করা যায় না। আবার ব্যতিক্রমও আছে ‘বামুন, বাদল, বাণ / দক্ষিণা পেলেই যান’ খণার বচনের অন্তর্গত কিন্তু প্রবাদ হিসাবেই গন্য হয়েছে। নীতি-বাক্যের সঙ্গে প্রবাদের তফাত আছে। সামাজিক আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রবাদের মূল্য আছে কিন্তু নীতি ও তত্বকথা হিসাবে সেই মূল্য চিরন্তন বা সার্বজনীন নয়। তত্বজ্ঞান বা লোকশিক্ষা কখনোই প্রবাদের মূল কথা নয়। ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’ প্রবাদটি নৈতিক জগতের সত্য বটে, কিন্তু ব্যবহারিক জগতের তথ্য নয়। ‘তেমনই জন জামাই ভাগনা, তিন নয় আপনা’ প্রবাদটি ব্যবহারিক জগতের তথ্য হলেও নৈতিক জগতের সত্য নয়। এর ব্যতিক্রম যে নেই তাও নয়, যেমন ‘টাকা মাটি মাটি টাকা’ শ্রী রামকৃষ্ণের কথা বা প্রবচন, কিন্তু প্রবাদবাক্য হিসাবেও প্রয়োগ হয় এর অর্থময়তা ও অন্তর্নিহিত সামাজিক পর্যবেক্ষনের জন্য। খ্যাতকীর্তি প্রবাদ সংগ্রাহক ডক্টর সুশীল কুমার দে’র মন্তব্য শিরোধার্য করে বলি “প্রবাদের প্রধান অনুপ্রেরক নৈতিক জ্ঞান নয়, সাংসারিক জ্ঞান; পরোক্ষ চিন্তা নয়, প্রত্যক্ষ অনুভূতি। ...প্রবাদের মধ্যে যে সত্য নিহিত থাকে তাহা প্রায়ই আপেক্ষিক সত্য – তত্বের সত্য নয়, তথ্যের সত্য...প্রবাদ মুখ্যত বাস্তব ঘেঁষা – ইহা পথঘাটের প্রাজ্ঞতা, প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার স্বচ্ছন্দ প্রকাশ – a short sentence drawn from long experience”। (‘বাংলা প্রবাদ, ছড়া ও চলতি কথা’ – সুশীলকুমার দে) 



অনেক প্রবাদে ইতিহাসের স্পর্শ পাওয়া যায়, আবার অজস্র প্রবাদ-বাক্যে সেকালের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যও দেখা যায়। “ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে”এই ঘুমপাড়ানি ছড়াটি আধুনিক যুগেও প্রবাদের মতো ব্যহার হয়। প্রবাদটি আমাদের সেই নবাব আলিবর্দীর আমলের বর্গি হামলার ইতিহাসে নিয়ে যায়। অনেক প্রবাদ, যেগুলিতে সেই স্থানের বা সেখানকার মানুষের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান সেইসব প্রবাদে বিদ্রুপ, বিদ্বেষ থাকতে পারে তবুও সামাজিক বাস্তব অভিজ্ঞতাই উৎপত্তির কারণ বলেই সেগুলি প্রবাদবাক্য হয়ে উঠেছে। ‘লম্বা কাছা, কাছা টান তবে জানবে বর্ধমান’। আধুনিক বর্ধমানবাসীর পোষাক পরিচয় নিশ্চই এটা নয় কিন্তু দুশোবছর আগের গ্রামীণ অভিজ্ঞতা হয়তো এমনই। এইরকম আরো কয়েকটি প্রবাদবাক্যে স্থানিক বৈশিষ্ট্য বিবৃত হয়েছ, সেগুলি হয়তো এখন প্রাসঙ্গিক নয় কিন্তু আঠেরো-উনিশ শতকের গ্রামীণ সমাজে এই প্রবাদবাক্যগুলিতে বিবৃত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল, তবেই তো এগুলি রচিত হয়েছিল। প্রত্যক্ষ সামাজিক পর্যবেক্ষনের ফলেই এইসব প্রবাদগুলির উৎপত্তি। কয়েকটি নমুনা - (১) বাঁদর, সভাকর,মদের ঘড়া এই তিন নিয়ে গুপ্তিপাড়া’ (২) রাড়, ষাঁড় সন্যাসী, তিন নিয়ে বারানসী’ (৩) বেহায়া, বেরসিক বাঁকা তিন নিয়ে ঢাকা (৪)শান্তিপুর রসের সাগর, এক এক ঘরে তিন তিন নাগর (৫) রাস, তাস জোরের লাঠি তিন নিয়ে পানিহাটি। 



বাংলার লোকসাহিত্যের মতো বাংলার লোকপ্রবাদগুলিও লুপ্তপ্রায়। একথা ঠিক যে আমাদের আধুনিক শহুরে মার্জিত মননে অনেক লোকপ্রবাদ অশ্লীল মনে হয়, সেগুলির প্রয়োগ করা থেকে আমাদের রুচিশীল মনন বিরত থাকে। কয়েকটি নমুনা – (১)’দোজবরের মাগ সোঁদর বনের বাঘ’ (২) ‘বেরিয়ে এলাম বেশ্যা হয়ে কুল কলঙ্ক ক্ষয়/এখন কিনা ভাতার শালা ধম্ম বেচে খায় (৩)’সাত রাঁড় এক এয়ো যার কাছে যাই সেই বলে আমার মতো হয়ো’ (৪)’আদরবিবির চাদর গায়, ভাত চায় না ভাতার চায়’ (৫) ন্যাংটো পোঁদে কাপড়, পোঁদ বলে বড় ফাঁপর’ ; এই প্রবাদবাক্যগুলি একালের রুচিশীল মননে পরিহারযোগ্য মনে হলেও প্রবাদগুলির মধ্যে লুকিয়ে থাকা সমকালীন সময়ের সরল পর্যবেক্ষণ, গ্রামীণ মানুষের সরল যাপন, সরস বোধকে অস্বীকার করা যায় না। এইসব পর্যবেক্ষন যে সত্য একথাও বাংলার সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যাবে। খ্যাতকীর্তি প্রবাদ সংগ্রাহক ও গবেষক সুশীলকুমার দে বলেছেন “জাতির আভ্যন্তরীণ বাস্তব বিবরণ, তাহার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও রসিকতা, তাহার জীবন্ত ভাষা ও বিচিত্র ভূয়োদর্শন, তাহার ধর্ম-কর্ম, বিদ্যাশিল্প, ব্যবসা-বানিজ্য, চাষবাস, জলহাওয়া, আচার-ব্যবহার, সন্সকার-সংস্কৃতি, শাসন-শিক্ষা, সমাজের সকল শ্রেণি ও সকল স্তরের বৈশিষ্ট্যের যথেচ্ছ চিত্র প্রবাদগুলিতে ব্যপ্ত হইয়া আছে – যাহা কল্পনার রঙে রঙ্গীন বা ভাবমাধুর্যে অতিন্দ্রীয় নয়, নিতান্ত ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য ও বাস্তব-বুদ্ধির ঈক্ষণে সরস ও সজীব”। (ড.সুশীলকুমার দে / ‘বাংলা প্রবাদ, ছড়া ও চলতি কথা’) 



পুরনো কলকাতা নি্যেও অনেক প্রবাদ আছে যেমন ‘বেটী মাটি মিথ্যা কথা এই নিয়ে কলকাতা’ কিংবা (২) ‘তেঁতুলে নেই টক কলকাতার ঢপ’ ইত্যাদি। এখন এগুলি প্রাসঙ্গিক মনে না হলেও তিনশো বছর আগের শৈশবের কলকাতার কিছু পর্যবেক্ষণ তো বটে। এইরকম পুরাতন কলকাতাকে নিয়ে অনেক প্রবাদ রচিত হয়েছিল মুখে মুখে। তা সেই তিনশো বছর আগের গন্ডগ্রাম কলকাতাও আর নেই তাই আধুনিক কলকাতাকে চিনতে সেই প্রবাদগুলিও অপ্রাসঙ্গিক। তবুও পুরনো কলকাতার কয়েকটি প্রবাদ এখনও বেশ বেঁচে আছে আর তার জন্মকথা জানতে আমাদের আগ্রহও আছে। তেমনই তিনটি প্রবাদের গোড়ার কথায় গিয়ে লেখাটির ইতি টানবো। 

(১) “ধনীর মধ্যে অগ্রগন্য রামদুলাল সরকার, বাবুর মধ্যে অগ্রগন্য প্রাণকৃষ্ণ হালদার”। প্রবাদবাক্যটিতে উনিশ শতকী কলকাতার দুই ধনাঢ্য ব্যক্তির নাম রয়েছে। বাঙালির স্বাধীন শিল্পদ্যোগ ও ব্যবসার ক্ষেত্রে রামদুলাল সরকার একটি স্মরণীয় নাম। নিতান্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে ধণাঢ্য শিল্পদ্যোগী হয়ে ওঠার পেছনে এক চমকপ্রদ গল্প আছে। রামদুলাল সরকারের জন্ম ১৭৫২ ও মৃত্যু ১৮২৫। বাল্যকালে পিতৃ-মাতৃহীন রামদুলাল মাতামহীর আশ্রয়ে প্রতিপালিত হতে থাকেন। মাতামহী সেকালের প্রসিদ্ধ ধনী মদনমোহন দত্তর গৃহে পাচিকার কাজ করতেন। মদনমোন রামদুলালকে স্নেহ করতেন, সামান্য লেখাপড়া শিখিয়ে তাঁর গদিতে দশটাকা বেতনের চাকরিতে নিয়োগ করেন। একবার মদনমোহন রামদুলালকে নিলাম কিনতে পাঠিয়েছিলেন। রামদুলাল নিলাম ক্রয় না করে চোদ্দ হাজার টাকায় নিলামে একটা ডুবে যাওয়া জাহাজ কেনেন তারপর সেই জাহাজটি এক সাহেবের কাছে এক লক্ষ টাকায় বিক্রি করে দেন। এই কেনা-বেচায় লাভ করা পুরো টাকাটা রামদুলাল মালিক মনমোহন দত্তকে দিয়ে দেন। মদনমোহন রামদুলালের সততা ও ব্যবসাবুদ্ধিতে খুশি হয়ে ঐ একলক্ষটাকা রামদুলালকেই দিয়ে দেন এবং স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার পরামর্শ দেন। ঐ টাকায় স্বাধীনভাবে ও সততার সঙ্গে ব্যবসা করে বিপুল ধন সঞ্চয় করেন রামদুলাল। রামদুলালকে বলা হত ভারতের প্রথম লাখপতি ব্যবসায়ী। এ দেশের বহির্বানিজ্যের পথপ্রদর্শক ছিলেন রামদুলাল। আঠেরো শতকে শেষে বাংলার সঙ্গে আমেরিকার বহির্বানিজ্যের যোগাযোগ ঘটে প্রধানত রামদুলালের মাধ্যমে। আমেরিকার ব্যবসায়ীরা রামদুলালের নামে তাঁদের একটি বানিজ্য জাহাজের নামকরণ করে। চিন, ইংলন্ড, আমেরিকার বণিক্মহলে রামদুলালের ছিল অশেষ খ্যাতি। রামদুলাল তাঁর অর্জিত অর্থ দরিদ্রকল্যাণ ও সৎকাজে ব্যয় করেন। সেকালের মানুষ রামদুলালের এই ভূমিকাকে গ্রাহ্য করেই প্রবাদ রচনা করেছেন যে এটাই প্রকৃত ধনীর লক্ষন। প্রবাদবাক্যটির অপর ব্যক্তি প্রাণকৃষ্ণ হালদার ছিলেন চুঁচুড়ার প্রসিদ্ধ ধনী কিন্তু অন্য মেরুর মানুষ। নিজেকে ইংরাজি কায়দায় পরিচয় দিতেন ‘বাবু প্রাণকিষেণ হলডর’। সেকালে ‘বাবু’ শব্দটি ছিল বিদ্রুপের বস্তু, উনিশ শতকের কদর্য ‘বাবু কালচার’এর পৃষ্ঠপোষক। প্রাণকৃষ্ণ হঠাৎ ধনী হয়েছিলেন অসৎ উপায় অবলম্বন করে। ‘নোট ও কোম্পানীর কাগজ’ জাল করে প্রাণকৃষ্ণ ধন-সম্পত্তি লাভ করেন। জাল করার অপরাধে প্রাণকৃষ্ণের দীপান্তর হয়েছিল। প্রাণকৃষ্ণের অপরাধে সহায়তা করার জন্য ভাই নীলমণি হালদারও দন্ড ভোগ করেন। ভাবা যেতে পারে প্রবাদ রচয়িতা উনিশ শতকের কদর্য ‘বাবু’ সংস্কৃতির এক পৃষ্ঠপোষককেই চিনিয়েছেন প্রাণকৃষ্ণের মধ্য দিয়ে। আবার বলতে হয় সেই কথাটা প্রবাদের মধ্যে বিদ্রুপ, রসিকথা থাকে, কিন্তু লুকিয়ে থাকে সমকালীন সত্যও। 



(২) ‘লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন’ খুব জনপ্রিয় ও বহু ব্যবহৃত প্রবাদ। তা গৌরী সেন কি সত্যিই ছিলেন ? হ্যাঁ ছিলেন, কিন্তু কে ছিলেন এই গৌরী সেন ? গৌরী সেনের কথা বলার আগে বৈষ্ণবচরণ শেঠের কথা বলতে হয়। শেঠ পদবীধারী তন্তুবায় পরিবার ছিল কলকাতার আদি বাসিন্দা আর এক তন্তুবায় পরিবার বসাকদের সাথে হুগলীর সপ্তগ্রাম থেকে গোবিন্দপুর গ্রামে (এখনকার দক্ষিণ কলকাতা) বসতি স্থাপন করে ইংরেজরা আসারও আগে। পরে তারা সুতানুটি অঞ্চলে চলে আসেন। বৈষ্ণবচরণ ব্যবসা-বানিজ্য করে ধনবান হয়ে উঠেছিলেন। কলকাতায় জোড়াবাগান অঞ্চলে বৈষ্ণবচরণের নামে একটি রাস্তা আছে। এই বৈষ্ণবচরণের ব্যবসার অংশীদার ছিলেন গৌরী সেন। গৌরী সেনের আদি নিবাস ছিল হুগলীতে। সেখান থেকে চলে আসেন কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলে, থাকতেন কলুটোলা স্ট্রীটে। একবার বৈষ্ণবচরণ গৌরী সেনের নামে সাত নৌকা দস্তা কেনেন। পরে দেখা গেলো দস্তার মধ্যে রূপোর ভাগই বেশি। বৈষ্ণবচরণ ভাবলেন গৌরী সেনের ভাগ্যজোরেই দস্তা রূপো হয়ে গেছে। তিনি রূপো মেশান দস্তা বিক্রির সব টাকা গৌরী সেনকে দিয়ে দিলেন, আর গৌরী সেন হয়ে গেলেন বিপুল অর্থবান । এহেন ধনবান গৌরী সেন খুব অমায়িক ছিলেন ও দান-ধ্যানে অর্থ ব্যয় করতে ভালোবাসতেন, ঋণগ্রস্ত দরিদ্র কিংবা কণ্যাদায়গ্রস্ত পিতা গৌরী সেনের কাছ থেকে ফিরে যেতেন না। ঋণের দায়ে কেউ কারারুদ্ধ হলে তিনি তাকে মুক্ত করে আনতেন। এমনকি যাকে সাহায্য করছেন সে তাঁকে প্রতারণা করছ কি না তাও যাচাই করতেন না। তাঁর দানশীলতার জন্যই মুখে মুখে প্রবাদের সৃষ্ট হয়েছিল ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’। 



(৩) আর একটি প্রবাদ ‘হরি ঘোষের গোয়াল’ পুরনো কলকাতার প্রবাদ হলেও আজও সাহিত্যে, দৈনন্দিন কথাবার্তায় হামেশাই ব্যবহৃত হয়। কে এই হরি ঘোষ আর কেনই বা প্রবাদটির জন্ম ? হরি ঘোষের পুরো নাম শ্রীহরি ঘোষ। তাঁর পিতা বলরাম ঘোষ ছিলেন চন্দননগরের ফরাসী গভর্নর দুপ্লের দেওয়ান। বলরাম দুপ্লের দেওয়ানী করে ধনবান হয়েছিলেন। কলকাতায় শ্যামবাজার সংলগ্ন বলরাম ঘোষ স্ট্রীট নামে বহু পুরাতন একটি রাস্তা আছে। পলাশী যুদ্ধের আগের বছর ১৭৫৬তে পিতা বলরামের মৃত্যুর পর শ্রীহরি কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে কুড়ি বিঘে জমির ওপর বাড়ি, বাগান, পুকুর বানিয়ে বসবাস করতে থাকেন। ইংরেজরা মীরকাশিমের কাছ থেকে ইংরেজরা মুঙ্গের দুর্গের দখল নেওয়ার পর ইংরেজরা শ্রীহরিকে মুঙ্গের দুর্গের দেওয়ান নিযুক্ত করে। দেওয়ানী করে শ্রীহরি অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে শ্রীহরি বিশাল একটি বাড়ি করেন সেখানে বহু আত্মীয়-সজন, বন্ধু-বান্ধব,দুঃখী মানুষ, অনাহুত, রবাহুতত্রা থাকতেন। তাদের ভরন-পোষন করতেন শ্রীহরি। সেই বাড়িটিই প্রবাদের ‘হরি ঘোষের গোয়াল’। ধনবান, অথচ খুবই সাদাসিধে মানুষ ছিলেন শ্রীহরি। সেই জন্য ঠকেওছিলেন। এক আত্মীয়ের জামিনদার হয়েছিলেন, কিন্তু সেই ব্যক্তি সেই সুযোগ নিয়ে পালিয়ে যায় ,ফলে ইংরেজরা শ্রীহরির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। প্রতারিত হয়ে মনোকষ্টে শ্রীহরি কাশী চলে যান। সেখানেই ১৮০৬ সালে শ্রীহরি ঘোষের মৃত্যু হয়। 

এভাবেই রামদুলাল সরকার, গৌরী সেন, হরি ঘোষরা অমরত্ব পেয়ে যান প্রবাদের মধ্যে। প্রবাদের যেমন জন্মকথা হয় না, মৃত্যুও হয় না প্রবাদের, কিংবা প্রবাদের মানুষেরও। 



তথ্যসূত্র (১) ‘বাংলা প্রবাদ, ছড়া ও চলতি কথা’ / ড. সুশীলকুমার দে (২) ‘বাংলার লোকসাহিত্য’ ৬ষ্ঠ খণ্ড / ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য (৩) ‘কলকাতা বিচিত্রা’ / রাধারমণ রায় (৪) ‘ভারতকোষ’ ৪র্থ খণ্ড / বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ 

2 comments:

0

প্রবন্ধ - বিবি বসু

Posted in


প্রবন্ধ


মোরা শিক্ষা বলি কাকে!
বিবি বসু


প্রবন্ধ লেখা যথেষ্ট কঠিন কাজ। আর কঠিন কাজে অনীহা কিছু নতুন নয়। যা বলছি তা কতকগুলো টুকরো ভাবনা বই কিছু নয়।আচ্ছা ধান ভানতে শিবের গীত না গেয়ে প্রসঙ্গে আসি সরাসরি। কয়েকটা আলগা ভাবনা আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করে নিই নাহয়। বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে যা দেখছেন, তাই নিয়ে ভাবছেন কিছু? বিপুল কর্মযজ্ঞ চলেছে---নাম সর্ব শিক্ষা মিশন।উদ্দেশ্য ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত কোন শিশুকে শিক্ষাক্ষেত্রের বাইরে না রাখা।উদ্দেশ্য আংশিক সফল নি:সন্দেহে। নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে কটা কথা বলি।বর্তমানে স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে পাশ ফেল প্রথা অবলুপ্ত হবার কারণে স্বভাবতই অনেক মানুষ অনেক কথা বলছেন।বিষয়টির বিরোধিতা করছেন। শিক্ষার মানের অবনমন ঘটছে এতে---একথা তারা সোচ্চারে বলেন। তাদের প্রশ্নের উত্তর পরে দিচ্ছি। এখন দেখি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাশ ফেল না থাকায় পড়ুয়ারা কতটা উপকৃত। প্রথমত: পাশ ফেল প্রথা উঠে যাবার ফলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্কুলছুট হবার প্রবণতা অনেক কমেছে। দ্বিতীয়ত: শিশুশ্রমের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্রথা।প্রশ্ন উঠবে কিভাবে। দাঁড়ান গুছিয়ে বলার চেষ্টা করছি। আজকাল বাড়িতে কাজের লোক পান? রাতদিনের লোক? আমাদের ছোটবেলায় দেখা পুতুলের মা, বাদলের মা প্রায় লুপ্তপ্রায় প্রজাতি। ভেবে দেখেছেন কেন? কারণ তাদের আর গ্রামের বাইরে বেরিয়ে শহরে এসে গৃহস্থ বাড়িতে রাতদিনের কাজ করতে হচ্ছেনা। তারা ১০০ দিনের কাজ পাচ্ছেন। স্বামী স্ত্রী উভয়েই কাজে বেরিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ির ছেলেটি বা মেয়েটি থাকবে কোথায়। সর্বজনের জন্য শিক্ষার দ্বার খুলে গিয়ে কিন্তু এই সমস্যার সমাধান হয়েছে খানিক। শিশুকে তাই বই, খাতা, স্কুলের ব্যাগ, জুতো, দুপুরের খাওয়া দাওয়া তফসিলি জাতিভুক্ত ছাত্র ছাত্রীদের আর্থিক অনুদান দিয়ে বিদ্যালয়ে রাখা হচ্ছে। এই বিদ্যালয়ের চৌহদ্দির মধ্যে শিশু সবচেয়ে নিরাপদ। আর পড়াশোনা? মুখ টিপে হাসছেন? হ্যাঁ, স্বীকার করছি এখনকার সরকারি স্কুলের এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের ছেলেমেয়েরা আপনার মতন ক্লাস সেভেনে 'শ্রীকান্ত'র চারটে খণ্ডই পড়ে ফেলেনি। তারা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। তবু স্কুলে নিত্য যাওয়া আসা চলার ফলে যতটুকু ইনপুটই। পাক না কেন, তা ফেলনা নয়।বিদ্যালয়ে তাকে উচ্চৈঃস্বরে বলা অশ্রাব্য ভাষা শুনতে হয়না। সে এক অন্য জগতের সন্ধান পায় যা থেকে তার আগের প্রজন্ম বঞ্চিত ছিল।ভবিষ্যতে এইসব শোনা কথার স্মৃতি ফিকে হলেও, কিছু অবশিষ্টাংশ মাথার কোন কোণ থেকে ঘাই মারবে। তার সন্তানকে সে চাইবে আলোর পথে ঠেলতে। এইটুকু প্রাপ্তিই বা কম কি! তর্ক উঠবে এবার। ক্লাস এইটে কারোর জীবন শেষ হয়ে যায়না। এই সরকারি নো ডিটেনশন রীতির ফলে যে সকল ছেলেমেয়ের পড়াশুনোর ভিত ঝুরঝুরে রয়ে গেল,তারা ক্লাস নাইনে অবধারিত ফেল করবে।তখন কি হবে। এক বছর, দুবছর, তিনবছর সুযোগ নাহয় দেয়া গেল কিন্ত তাতেওতো যার হবার নয় তার হবেনা।মধ্যিখান থেকে আত্মবিশ্বাসে ভয়ানক চিড় ধরবে। নিজেকে নিয়ে লজ্জা বাড়বে। তখন? এক্ষেত্রে সমাধান একটাই। না সেটা এখনো ভারতে করা সম্ভব হয়নি।তবে আমরা যদি সবাই মিলে বিভিন্ন জায়গায় বারবার বলে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি, তাহলে ভারত ভাগ্যবিধাতারা কোন একদিন সাড়া দিয়ে ফেলতেও পারেন সেই চেষ্টাটাই করা যাক। শিক্ষক শিক্ষিকারা যে ছাত্র বা ছাত্রীকে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ালেন, তাদের ওপর একটু ভরসা করেই দেখুন না সরকার বাহাদুর। ক্লাস এইটের পর শিক্ষকদের বেছে দিতে হবে কারা জেনারেল স্ট্রিমে পড়বে আর কারা কারিগরি শিক্ষায় যাবে।সেইমতো ইস্কুলে ইস্কুলে যদি ভোকেশনাল ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয় এবং ট্রেনিং শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের রীতিমতন যাচাই করে যদি সরকারি সার্টিফিকেট দেওয়া যায়,তাহলে সামগ্রিক চিত্রটাই কিন্তু পালটে যাবে। এবার প্রশ্ন হ'ল ভোকেশনাল ট্রেনিং হ'ল, সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া সার্টিফিকেটও এল কিন্তু কর্মসংস্থানের উপায় কি? প্রশিক্ষিত মানুষজন নিয়ে চলতে গেলে আন-অর্গানাইজড সেক্টরের চলবে কিভাবে? সরকার নির্ধারিত মূল্য দিয়ে যে তাদের শ্রমের মূল্য চোকাতে হবে। ছোট ব্যবসায়ীর নাভিশ্বাস উঠে যাবে।তাহলে উপায়? কোনমতে বি.এ পাশ বেকারদের মতনই কি এই সব প্রশিক্ষিত ছাত্রছাত্রীর জীবন কাটবে? তাহলে এত ঘটা ন্যাটা করে ট্রেনিং--এর প্রয়োজনটা কি ছিল? সরকারি ক্ষেত্রে নাহয় নিয়ম করা গেল সরকারি তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত ব্যক্তি ছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে(কারিগরি বিদ্যার প্রয়োগমূলক ক্ষেত্রগুলোতে) নিয়োগ করা যাবেনা। কিন্তু পাড়ার হরবিলাস কাকার কাছে হাতেকলমে কাজ শেখা বাপনকে দিয়ে বছরভর চলতে থাকা মেলা, খেলা, রক্তদান শিবির, সাইকেল বিতরণ উৎসব, রবীন্দ্রজয়ন্তী ইত্যাদি প্রভৃতির জন্য ইলেক্ট্রিকের কাজ আর করানো যাবেনা। প্রত্যেকটি পঞ্চায়েত এবং মিউনিসিপালিটির অধীনে থাকবে এইসব প্রশিক্ষিত কারিগরদের নিয়ে গড়া এসোসিয়েশন। এলাকার প্রশিক্ষিত কারিগরদের নাম এখানে নথিভুক্ত থাকবে। বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষকে যোগাযোগ করতে হবে এলাকার পঞ্চায়েত বা মিউনিসিপ্যালিটির সাথে। সেখান থেকে কাজ করার মানুষ পাওয়া যাবে এবং কাজ শেষে নির্দিষ্ট মূল্য অফিসে এসে রসিদের বিনিময়ে মেটাতে হবে। মানুষজনকেও আর প্লাম্বার, ইলেক্ট্রিশিয়ান, কার্পেন্টার, বিউটিশিয়ান, ড্রাইভারদের জন্য হাঁ করে দিনের পর দিন বসে থাকতে হবেনা আর রাস্তায় যার সাথে দেখা হবে তাকে বলতে হবেনা, 'ভাই আমার টয়লেটের সিস্টার্ন কাজ করছেনা,কাজ জানা কাউকে পাঠাতে পারেন?' আর ভোকেশনাল ট্রেনিংপ্রাপ্ত কেউ স্বাধীন ব্যবসা করতে চাইলে উপযুক্ত মূলধনের যোগান সে কোথা থেকে কিভাবে পাবে, তাও পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন নাহলে বিশাল জীবনসমুদ্রে কূলহীন ভাসতে হবে। যাক অনেক অলীক কথা বলে ফেললাম। তাও বলি এদেশে কিস্যু হবেনা যারা ভাবছেন, তারা কি তাদের ছোটবেলায় দেখেছিলেন বাড়ির বাসন মাজেন যে বাসন্তীদি তার মেয়ে ইউনিফর্ম পরে, দুটো বেণী বেঁধে পিঠে ব্যাগ নিয়ে,বিশ্ব বাংলার লোগো দেওয়া সাইকেল চালিয়ে ইস্কুলে যাচ্ছে? দেখেননি। এটা যখন কালের নিরিখে সম্ভব হয়েছে, বাকিটাও যে হবেনা এমন কথা বুক ঠুকে বলি কিভাবে? কোন গল্পকারকে এযুগের গল্পে লিখতে হবেনা----পরপর দুবছর ক্লাসে উঠতে না পারায়, অমুকের ইস্কুলে যাওয়া চিরতরে ঘুচে গেল।তাই না? চলুন আশা রাখি। এই বিপুল মানবসম্পদ একদিন ঠিকভাবে ব্যবহৃত হবে আর দেশটা ঝলমলে হাসি হাসবে। হিন্দু-মুসলিম, রামনবমী-মহরম জাতীয় ভাবনা ভাবার সময় থাকবে না  মানুষের। প্রত্যেকের হাতে কাজ ...আর তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করাটাই যে মনুষ্যধর্ম, সেটা বুঝতে পারবেন আপামর ভারতবাসী।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


গার্ড (অনুবাদ গল্প) 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 



৪ 

হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর এসে ছিঁড়ে দিয়ে গেল সেই নিঝুম নৈঃশব্দকে। এতখানি উচ্চকিত সেই কর্কশ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর যে ঠীলের দ্রুতপদের চলন আপনা থেকে ধীর হয়ে গেলো। তার কানে এসে আওয়াজটা আছড়ে পড়তে লাগলো তীব্রভাবে। সে বুঝতে পারলো যে একটা কুটিরের ছাতের খোলা জানালা দিয়ে আওয়াজটা আসছে। কুটিরটা কার সেটা সে জানে। একটু বেশি জানে। 

পাছে নিজের পদশব্দে পরিষ্কারভাবে সেই আওয়াজ শুনতে না পায়, তাই ঠীল একদম পা টিপে টিপে চলতে লাগলো। আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে সে কান পাতলো, ঠাহর করবার চেষ্টা করতে লাগলো যে লেনা ঠিক কি বলছে চীৎকার করে... 

-‘ওরে শয়তান, বদমাশ, বজ্জাত! খিদের পোকা আবার কুরকুর করে উঠেছে, তাই না? দাঁড়া, আজ তোকে এয়সান শিক্ষা দেবো, জীবনে যাতে না ভুলিস, সেই ব্যবস্থা করবো।’ এর পরে কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর ধোপা কাপড় কাচার সময় যেভাবে কাপড় আছড়ে কাচে, সেরকম আওয়াজ পাওয়া গেলো। তারপরে আবার গালিগালাজের বন্যা বইতে লাগলো। 

‘হতভাগা কোথাকার! তোর ঘ্যানঘ্যানানির জন্য কি আমার পেটের ছেলেটা উপোষ করে মরবে?’... হাল্কা একটা কান্না-কান্না গলার বিপরীতে আবার গর্জে উঠল চীৎকারটা... ‘চোপ, একদম চুপ। নয়তো আট দিনের খোরাক একবারে একসঙ্গে গিলে বসে থাক তুই!’ 

কান্নার মিহি হাল্কা আওয়াজটা থামছিল না। 

ঠীলের হঠাৎ মনে হলো যে তার হৃদপিণ্ডটা বড্ড ভারি ঠেকছে। কেমন যেন উল্টোপাল্টা ধপাধপ আওয়াজ হচ্ছে তার বুকের ভেতরে। সে কাঁপতে শুরু করল। তার অন্যমনস্ক দৃষ্টি মাটির দিকে স্থিরভাবে কি যেন দেখছিল, কিংবা কিছুই দেখছিল না। শক্ত পেশল হাত দিয়ে সে বারেবারে নিজের মেচেতার দাগওয়ালা কপালের উপর থেকে ভিজে চুলের গুচ্ছটা সরিয়ে দিচ্ছিল। 

সে যেন সহ্য করতে পারছিল না এই পরিস্থিতিটা। তার শরীরের মাংসপেশী ফুলে উঠলো, আঙুলগুলো শক্ত হয়ে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠল তার হাত; কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যই। আবার যেন এক অক্ষম গ্লানি, অদ্ভুত ক্লান্তি নেমে এলো ঠীলের শরীরে। 

ধীরে ধীরে সে সংকীর্ণ, ইট পেতে রাখা প্রবেশদ্বার দিয়ে নিজের কুটিরে ঢুকলো। ক্লান্ত, ভারি পদক্ষেপে সে উঠতে লাগলো উপরে; কাঠের সিঁড়িটায় হাল্কা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হলো। 

‘উফফ, উফফ, উফফ’... আবার শুরু হলো চীৎকারটা, একসাথে তিনটে শব্দের মধ্যে যেন পৃথিবীর পুঞ্জীভূত রাগ, ক্ষোভ বেরিয়ে এলো; ‘হাড়হাভাতে, দুষ্টু, ধূর্ত, কুচুটে, ভীতুর ডিম, অসভ্য ছেলে’... প্রত্যেকটা শব্দের মধ্যে দিয়ে গলার জোর ক্রমশ সপ্তমে চড়ছিল। কণ্ঠস্বরটা এক দুই মুহূর্তের জন্য হাঁপাতে লাগলো, তারপর আবার নতুন উদ্যমে শুরু হলো, ‘কী-ঈ-ঈ, তুই আমার ছেলেটাকে মারতে চাস? এত সাহস তোর? এই দুর্বল, অসহায় শিশুর উপরে হাত তুলতে যাচ্ছিস তুই? নীচ কোথাকার! বেশি কিছু বলতে চাই না তোকে আমি... নইলে দেখতিস---’ 

ঠিক সেই মুহূর্তে ঠীল নিজের বাড়ির বসবার ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকল, আর লেনার বাক্যটা অসমাপ্ত রয়ে গেল। ঠীল লক্ষ্য করল যে লেনার মুখ প্রচণ্ড রাগে একদম সাদা হয়ে গেছে, কী এক তীব্র ঘৃণায় যেন বেঁকে উঠেছে তার ঠোঁটদুটো! উদ্যত ডানহাত নামিয়ে নিয়ে লেনা দুধের পাত্রের কাছে গিয়ে শিশুর দুধের বোতল ভরতে লাগলো। যদিও বেশির ভাগ দুধ বোতলের বাইরে উপচে টেবিলে পড়ে গেলো, তবুও সে ভরতে লাগলো। দৃশ্যতঃ ভীষণ অপ্রস্তুত লেনা নতুন করে রান্নাঘরের এটা ওটা কাজ টেনে টেনে করতে শুরু করল। সে ভেবে পাচ্ছিল না যে এরকম অসময়ে ঠীল হঠাৎ ঘরে ফিরে এলো কেন? সে কি তাহলে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আড়ি পাতছিল? নাহ... অসম্ভব। আর পাতলে পাতবে। কী এমন অপরাধ করেছে সে? ছেলে মানুষ করতে গেলে অমন করতে হয়। শক্ত হতে হয়। নাহ, সে তার নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার। লেনা নিজের মনে গজগজ করতে লাগলো। 

ঠীলের কানে লেনার কোনও কথাই ঢুকছিলনা। সে একদৃষ্টে ক্রন্দনরত টোবিয়াসকে দেখছিল। তার ভিতরে ভয়ঙ্কর এক ক্রোধ পাক খেয়ে উঠছিল; সে অতিকষ্টে সেটা চেপে রাখার চেষ্টা করছিল। সেটা চাপতে গিয়ে সে কেশে উঠছিল; পুরনো একটা শ্লেষ্মার দমক উঠে আসছিল তার নাকমুখ দিয়ে, তার চোখে এক অদ্ভুত চোরা চাহনি ঝলকানি দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একমুহূর্তের জন্য তার চোখ আটকে গেলো লেনার দিকে। সে দেখতে পেল তার বিশাল বাহু, যা এখনো শান্ত হয়নি। সে দেখতে পেল তার বিশাল অর্ধ-উন্মুক্ত স্তনযুগল নিঃশ্বাসের তালে তালে উঠছে পড়ছে, যেন বক্ষাবরণী ফেটে বেরিয়ে আসবে এখনি। সে দেখতে পেল তার বিশাল ঘেরের স্কার্ট দুলে উঠছে, আরও বিশাল দেখাচ্ছে তার চওড়া নিতম্ব। তার মনে হলো যেন এই নারীর শরীর থেকে অদ্ভুত এক শক্তি নির্গত হচ্ছে, সেটা এতখানি সাঙ্ঘাতিক যে সে এর মুখোমুখি দাঁড়াতে সম্পূর্ণ অক্ষম; ঠীলের নিজেকে ভীষণ অসহায়, ক্ষুদ্র বলে মনে হলো। 
তার মনে হলো এক উর্ণনাভ তাকে ঘিরে জাল বুনে চলেছে, সেটা সূক্ষ্ম অথচ লোহার মতো শক্ত; সে কেটে বেরিয়ে আসতে পারছে না। সেটা সুন্দর, কিন্তু সে বন্দী তার মাঝে; এক অদ্ভুত নেশা যেন তাকে অবশ করে রেখেছে। সে কোনও কথাই বলতে পারছিল না। 

অশ্রুসিক্ত চোখে এক কোণে দাঁড়িয়ে ভীতসন্ত্রস্ত টোবিয়াস লক্ষ্য করল যে তার বাবা দ্বিতীয়বার আর তার দিকে ফিরে তাকাল না। চুল্লির উপরের তাকের এককোণ থেকে ভুলে ফেলে যাওয়া খাবারের থলেটা নেবার আগে সেটা তুলে ধরে একবার লেনার দৃষ্টি আকর্ষণ করল ঠীল। হয়তো বা জবাবদিহি করলো তার হঠাৎ ফিরে আসার ব্যাপারটা নিয়ে। তারপর এলোমেলোভাবে একটা সংক্ষিপ্ত মাথাঝাঁকুনি দিয়ে ঠীল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। 

ঠীলকে মাঝপথে একবার ফিরে যেতে হয়েছিল, তা সত্ত্বেও সে নির্দিষ্ট সময়ের পনেরো মিনিট পরেই পৌঁছে গেলো তার গন্তব্যে, তার কাজের জায়গায়। শান্ত অরণ্যের মধ্য দিয়ে ভীষণ দ্রুতগতিতে সে হেঁটে গিয়েছিল। আগের যে লোকটি ডিউটিতে ছিল, তার কাজের সময় ফুরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে চলে যায়নি। অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল যে, ঠীল এলে - তবে সে যাবে। যাবার জন্য একদম তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে আউটপোস্টের কেবিনের বারান্দায়। সাদারঙ করা ঘরটার দেওয়ালে কালো দিয়ে লেখা নম্বরটা দূর থেকে পাইনের জঙ্গলের ফাঁক দিয়েও বেশ ভালো দেখা যাচ্ছিল। 

দুজনে করমর্দন করল এবং পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো বিপরীত দিকে। একজন ঢুকে গেলো আউটপোস্টের কুটিরের ভিতরে এবং আরেকজন, ঠীল যেদিক থেকে এলো, তার উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল রেলের ট্র্যাক বরাবর। ঠীলের সেই কাশির আওয়াজটা একবার শোনা গেলো, তারপর সেটা থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের ভিতরে মানুষের সাড়াশব্দ একেবারে থেমে গেলো। ঠীল অপরিসর চৌকোনা কেবিনের মধ্যে সেই রাতের ডিউটির প্রস্তুতি শুরু করলো। সে যান্ত্রিকভাবে কাজগুলো করে যাচ্ছিল, কারণ তার মনে বারে বারে উঁকি দিচ্ছিল সেদিনকার ঘটনাটা। সে তার রাতের খাবারটা জানালার লাগোয়া টেবিলে রেখে দিল। জানালা দিয়ে রেলের ট্র্যাক পরিষ্কার দেখা যায়। তারপর সে তার মরচে-পড়া ছোট্ট স্টোভটা ধরিয়ে এক পাত্র জল চড়িয়ে দিল। তারপর গুছিয়ে রাখতে লাগলো তার যন্ত্রপাতি, শাবল, কোদাল, বেলচা ইত্যাদি সবকিছু। লণ্ঠনটা ভালোভাবে পরিষ্কার করে তেল ভরে নিল তাতে। 

যখন সে এসব কাজ সারছিল, তখন কর্কশভাবে তিনবার বেল বেজে উঠল এবং জানা গেলো যে ব্রেসলাউগামী ট্রেন এই আউটপোস্টের নিকটবর্তী স্টেশনে পৌঁছে গেছে। কোনোরকম তাড়াহুড়ো না দেখিয়ে ঠীল কেবিনের ভিতর থেকে গুছিয়ে নিলো গার্ডের কাঁধের ব্যাগ এবং নিশান। ধীরেসুস্থে কেবিন থেকে বেরিয়ে বালির উপরে পায়ে চলা পথ দিয়ে কুড়ি পা হেঁটে সে পৌঁছে গেলো রেলগেটের কাছে। প্রতিবার ট্রেন যাবার সময় নিয়মমাফিক ঠীল রেলের গেট বন্ধ রাখে এবং ট্রেন চলে গেলে খুলে দেয়। যদিও সেই ক্রসিংএর পথ দিয়ে কেউ যাতায়াত করতো না, তবুও সে কোনওদিন নিয়ম ভাঙেনি। গেট বন্ধ করে সে গেটের সাদা কালো ডোরাওয়ালা বারের উপরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। 

তার ডাইনে বাঁয়ে দুদিকেই রেলপথ হারিয়ে গিয়েছে অরণ্যের গভীরে। ট্র্যাকের পাটাতনগুলোর মাঝে মাঝে বিছানো আছে লালচে রঙের নুড়িপাথর। অনেক দূর থেকে দেখলে মনে হবে রেলওয়ে ট্র্যাকের সমান্তরাল চলে যাওয়া লাইনগুলো যেন লোহার জালের মতো ঘিরে রয়েছে। দিগন্তের কাছে গিয়ে সরু হয়ে যাচ্ছে সেই জালের প্রান্ত। 

ধীরে ধীরে একটা হাওয়া উঠল; জঙ্গলের অন্য প্রান্তে পৌঁছে গেলো সেই বাতাসের তরঙ্গ। ট্র্যাকের সঙ্গে একসাথে এগিয়ে চলা টেলিগ্রাফের লাইন থেকে যেন একটা হাল্কা গুঞ্জন উঠল। টেলিগ্রাফের খুঁটিগুলোকে অতিকায় মাকড়সার মতো দেখাচ্ছিল; মনে হচ্ছিল তারা একটা পোস্ট থেকে আরেকটা পোস্টে ক্রমান্বয়ে জাল বুনে রেখেছে। অজস্র পাখির ঝাঁক ঝুলছিল, দোল খাচ্ছিল টেলিগ্রাফের তারে। একটা কাঠঠোকরা অন্য কোনও দিকে না তাকিয়ে যেন হাহা করে হাসতে হাসতে উড়ে গেলো ঠীলের মাথার উপর দিয়ে। 

(চলবে) 

[গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘বানভ্যার্টার ঠীল’ গল্প অবলম্বনে রচিত] 

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী

Posted in


ধারাবাহিক


পায়ের শব্দ 
সোমঙ্কর লাহিড়ী



চুম্বকঃ- অ্যান্ডির ফ্ল্যাটে একটি মধ্য বয়স্কা কলগার্লের দেখা পায় কাঞ্চন। যাকে অ্যান্ডি কোথা থেকে পেয়েছে সেটাই মনে করতে পারে না। চলে যাওয়ার সময় তার ফোনের থেকে পাওয়া যায় অ্যান্ডি ও তার কিছু ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি, সাথে অ্যান্ডির কোকেন নেওয়ার ভিডিও ক্লীপ। ফোনটা ফেলে দিয়ে মেয়েটিকে তাড়িয়ে দেয় অ্যান্ডি। একটা রিসর্টের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অ্যান্ডি ও তাদের দল আর্মাডিলো বাগডোগরার প্লেন ধরে। সাথে দেখা যায় মুকেশ ও শীলাকে। তারা চা বাগানের ভেতরে সেই রিসর্টে গিয়ে পৌছয়। 


৪ 

চা বাগানের অনেকটা ভেতরে সেই রিসর্ট যেখানে আজ সন্ধ্যা থেকে সারারাত ধরে চলবে পার্টি। রাস্তা থেকে বা চা বাগানের ভেতরে অনেকটা ঢুকলেও কোন ধারণা করা যাবে না এই ‘টি ভ্যালি’ রিসর্টটার বিশালত্ব সম্পর্কে। 

পাহাড়ের গায়ের ঢাল বেয়ে বেশ খানেকটা উপরের দিকে উঠে গিয়ে শুরু হয়েছে “টি ভ্যালি” আর উপরের দিকে উঠে গেছে আরো বেশ অনেকটা। এক পাশে দেখা যাচ্ছে খাদ। গভীর, তবে খুব মারাত্মক নয়। নিজেকে উচ্চতায় আসীন দেখলে কেমন লাগে সেটার ধারণা পাওয়া যাবে, এর ধারে দাঁড়ালে। কিন্তু ঠেলে ফেলে কারোকে মারা যাবে কিনা, সেটা সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যাবে। 

সেই খাদের ধার ধরে বাঁধান রাস্তা বেঁকে ঢুকে গেছে অনেকটা। তারপরে রয়েছে টেনিস, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদির কোর্ট। আরো পেরিয়ে রাস্তাটা নেমে গেছে নীচের দিকে সেখানে গিয়ে পৌঁছলে পাওয়া যাবে গলফ কোর্স। উপর থেকে প্যারা গ্লাইডিং এর ব্যবস্থাও রয়েছে এসে নামবে সেই গলফ কোর্সের মাঠেই। 

এদের সবার পিছনে পাহাড়ের গা এলিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে “টি ভ্যালি”র বাঙ্কোয়েট যার দু পাশে রয়েছে দুতলা বিশিষ্ট টানা দুটো বিন্ডিং, যেখানে এসে লোকেরা থাকবে। অবাক হয়ে দেখতে হয় পাহাড়ের বিভিন্ন রক্মের সবুজ ও গোটা বিল্ডিঙের বিভিন্ন রকমের সবুজকে কি সুন্দর ভাবে মেলানো হয়েছে। কোথাও একটু চোখে লাগছে না। তাকিয়ে দেখলে মুখ থেকে বাহ! শব্দটা নিজে থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে আসে। 

অ্যান্ডিদের গাড়ি যাখানে থামল সেটা সেই রিসর্টের রেসিডেন্স বিল্ডিঙের পিছনের দিক। গাড়ি থামতে ডিপি নিজে অ্যান্ডি অ্যান্ড আর্মাডিলোকে রিসিভ করতে এলো। 

অ্যান্ডির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডিপি বলল, 

আই থিংক ইউ ডোন্ট হ্যাভ এনি প্রবলেম রিচিং হিয়ার? কথাটা বলতে বলতে মাথাটা ঘুরে গেল শেলীর দিকে। 

অ্যান্ডির উত্তরের আগেই ডিপি শেলীর দিকে ফিরে সামান্য ঝুঁকে ওর হাতটা ধরে সাহেবদের মতো হাতের উল্টোদিকে একটা প্রায় লালাসিক্ত চুম্বন দিয়ে সেই একই কথা জিজ্ঞাসা করল। 

শেলী হাতটা কোনওক্রমে ছাড়িয়ে নিয়ে হেসে মাথা নাড়াল। অস্বাস্তিটা খুব সুক্ষ্মভাবে চোখে ফুটে উঠল। 

প্রশ্নের কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে ডিপি সবাইকে বলল, 

ওয়েলকাম টু দ্য টি ভ্যালি। আপনারা আসুন দেখুন আমার এই স্বপ্নের রিসর্টকে আমি কেমন করে সাজিয়েছি। 

ঘটা করে সবাইকে বলল বটে কিন্তু নিজে শেলীর হাত ধরে সবার আগে আগে হাঁটতে শুরু করল, তারপরে মুকেশের দিকে তাকিয়ে বলল, 

তু খ্যায়াল রাখনা সবকা। 

আর্মাডিলোর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, 

প্লীজ ফীল অ্যাট হোম। 

ডিপি মুখ ঘোরানোর সাথে সাথে সবার মধ্যে একটা নিঃশব্দ হাসি স্রোতের মতো বয়ে গেল। অ্যান্ডি বলল, 

মিঃ বাজোরিয়া উড ইউ মাইন্ড ইফ উই টেক সাম রেস্ট? 

দুপক্ষই হাঁফ ছাড়ল, শেলী বাদে। 



অ্যান্ডিঘরে ঢুকে মুকেশকে বলল, 

টোক ফোক কিছু থাকলে দে। 

আমি বললাম না, কি আমি সাথে করে আনিনি। আর রাতে পারফর্ম করবি, এখন থেকে নেশা করিস না ভাই। প্রোগ্রাম ঝুলে গেলে বাজে ব্যাপার হবে। 

অ্যান্ডি ওর কথায় কান না দিয়ে ঘরে রাখা ফ্রীজের খুলে ভেতর থেকে একটা ভদকার বোতল বার করে নীট খানেকটা গলায় ঢেলে বলল, 

আমার প্রফেশান নিয়ে নো জ্ঞান, ওকে। জয়েন্ট ফয়েন্ট থাকলে দে, না হলে ফোট এখান থেকে। আমার সোজা হিসেব, তুমি আমাকে খুশী রাখো, আমি তোমায় খুশি রাখবো, সেটা স্টেজ হলে গানে, নেশা হলে টাকায়, বিছানা হলে শরীর দিয়ে। ওকে। এখন মালের জোগাড়, ঠিক আছে? 

মুকেশ ফোন বার করে কাকে যেন ফোন করল মিনিট দশেক বাদে দরজায় টোকা দিয়ে একজন একটা সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে গেল, ভেতরের সিগারেটগুলো দেখলে বোঝা যায় কাগজের ভেতরে তামাকের স্থান নিয়েছে গাঁজা। 

অ্যান্ডি একটা ধরিয়ে টান লাগিয়ে ধোঁয়া ধরে রাখল বেশ খানেকটা সময়, তারপরে সেই ধোঁয়া নাক দিয়ে গলগল করে উগরে দিয়ে বলল, 

শেলীটাকে ওই কুমড়োটা নিয়ে চলে গেল, এখন আমি কি এখানে বসে তোর গালে চুমু দেবো? 

বাকি টিমকে সাথে থোড়া.... 

এই শালা, ঐ টুঙটুঙি গুলোর সাথে যা করার স্টেজে করব। তুই আমাকে জ্ঞান দিসনাতো। আমি ওদের ছাড়াও প্রোগ্রাম করে নিতে পারবো, ওরা আমাকে ছাড়া এক পা চলতে পারবে না। বিকজ আয়াম দ্যা স্টার অফ আর্মাডিলো। লোকে আমার গান শুনতে পয়সা দেয়, ওদের টুঙটুঙি আর ড্রাম শোনার জন্যে নয়। বাকি টিমকে সাথ থোড়া, মাই ফুট শালা। 

মুকেশ হেসে বলল, চিল ম্যান চিল। ইতনা গুসসা আচ্ছা নেহী। আচ্ছা বস্‌ আমি একটু আমার ঘরে যাচ্ছি। তবে বস্‌ একটু বুঝে টেনো। রাতে অনেক হুজ্জত হাঙ্গামা করতে হবে তোমায়। ভেবো না, জ্ঞান নেহী দে রাহা হুঁ। 

মুকেশ ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে অ্যান্ডি ড্রেস ছেড়ে তোয়ালে জড়িয়ে গেল ফ্রেশ হতে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে একসাথে নীট ভদকা আর গাঁজা তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। বেশ তুরীয় একটা ভাব ধীরে ধীরে ছড়িয়ে আচ্ছে গোটা শরীরটাতে। আরাম, একটা আরাম ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে অ্যান্ডিকে। 

শাওয়ারটার নীচে দাঁড়িয়ে সেটা খুলে দিতেই পুরো নেশা একেবারে ক্যারা মেরে দিল। অ্যান্ডি প্রায় লাফিয়ে শাওয়ারের নীচ থেকে পালিয়ে নিজেকে বাঁচাল। বাপরে কী ঠাণ্ডা জল। নেশার একেবারে চুলকে চৌষট্টি হয়ে গেল এক ঝটকায়। প্রবল বেগে শাওয়ার থেকে পরা ঠান্ডা জলের ধারার দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগল অ্যান্ডি। যেন ওটা কোনভাবে এসে ওকে আক্রমণ করবে। কোনও রকমে হাত বাড়িয়ে শাওয়ারটা বন্ধ করে বাজোরিয়ার গুষ্টির ষষ্ঠিপুজো করে ঐ আধভেজা অবস্থায় বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। 

অমন সাধের নেশা চটকে যাওয়ায় মেজাজ তুরিয় টু তিরিক্ষি। রুম সার্ভিসকে ফোন করে গালি দেবে নাকি ঘরে ডেকে এনে গালি দেবে সেটা ভাবতে ভাবতেই ডোর বেল বেজে উঠল। অ্যান্ডি ভাবল বাবা! কি সার্ভিস! ভাবতে না ভাবতেই দরজায় নক! দরজাটা খুলতেই সামনে দেখল এক পরমা সুন্দরী মহিলা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। যার বয়েস কুড়ি থেকে দু হাজার যেকোন একটা হতে পারে বলেই মনে হলো অ্যান্ডির। মুহুর্তে ভাবল একে ঝাড় দেবো? এত সুন্দরী। বাট স্টিল আয়্যাম আ স্টার! হোয়াই নট? 

দরজা খোলার সাথে সাথে এসি ঘরে ঘুরতে থাকা গাঁজার খোসবাই মহিলার নাকে ধাক্কা দিল, নাকটা সামান্য কুঁচকেই সোজা করে নিল। অ্যান্ডি শুরু করে দিল ঐ আধভেজা তোয়ালে জড়ানো অবস্থায়, 

লুক হোয়াট ইউ হ্যাভ ডান টু মি? বার তিনেক লুক আর বার দুয়েক ডান ও বলে দিল হাফ নেশায়। 

দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার মুখে একটা কৌতুকপূর্ণ হাসি খেলে গেল। তারপরে অ্যান্ডির ঐ দড়ি পাকানো চেহারাটার দিকে একবার তাকিয়ে কৌতুকপূর্ণ গলায় বলল, 

কি হয়েছে স্যার? 

গলার আওয়াজেও যে নেশা হতে পারে অ্যান্ডির জানা ছিল না। খানেকটা থতমত খেয়ে গিয়ে বলল, 

বাথরুমের জল কি ঠাণ্ডা। বাপরে!! জমে মরে যাচ্ছিলাম প্রায়। বাই দ্য ওয়ে, আয়্যাম অ্যান্ডি, মেইন ভোকালিস্ট অফ আর্মাডিলো। বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিল সেই মহিলার দিকে। 

তিনি সে সবে পাত্তা দিলেন না বিশেষ, ঘরে এলেন, বাথরুমের ভেতরে গিয়ে সব দেখে বললেন, 

হোয়াই ডিডন্ট ইউ আক্টিভেটেড দ্য টেম্প কন্ট্রোল? হিয়ার ইস দ্য কী অ্যান্ড আ লি’ল প্যানেল বাই হুইচ ইউ ক্যান সেট ইয়োর সুটেবল টেম্পারেচার। আই থিংক ইউ ডিডন্ট নোটিস ইট। 

অ্যান্ডির কানে যেন সুরের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল, সে আর থাকতে না পেরে বলল, 

এভার থট অফ সিঙ্গিং অ্যাস অ্যা ক্যারিয়ার? 

সেই মহিলা ঘরে এসে কোন কথার উত্তর না দিয়ে বাইরের দিকের জানলা দুটো খুলে দিল। তারপরে বলল, 

মাই নেম ক্যারিস সাম মিউজিক, ইউ নো। অ্যায়্যাম শুভলক্‌সমি বাজোরিয়া, শুব্বু ডিপি’স বেটারহাফ, উই ইউজুয়ালি হায়ার মিউজিশিয়ান্স অ্যাজ পার আওয়ার নীডস। আই হ্যাভ হার্ড আল মোস্ট অল অফ ইয়োর নাম্বারস, কোয়ায়েট গুড। সো আই থট আই কুড কাম এন্ড গিভ ইউ অ্যা ভিসিট। বাট রাইট নাও ইউ আর মোস্ট আনইম্প্রেসিভ টু মি অ্যাজ অ্যা পার্সন। বাই দেন। 

অ্যান্ডিকে একেবারে বোল্ড করে দিয়ে শুব্বু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আর ফিরে তাকিয়ে মৃদু একটা হাসি দিয়ে বলল, 

ক্লীন ইয়োরসেলফ আপ, ফ্রম অল দ্য ইনটক্সিকেশান, অ্যান্ড ডোন্ট স্পয়েল দ্য শো ইন দ্য নাইট। 

অ্যান্ডির হাঁমুখ আর বন্ধ হতে চাইছিল না। শুব্বু বাজোরিয়া চলে যাওয়ার পরে ঘরের দরজা বন্ধ করে অ্যান্ডি বাথরুমে গিয়ে ঐ আগের ঠাণ্ডা জলের স্রোত সরাসরি নিজের শরীরের উপর দিয়ে বইয়ে দিল। বেশ খানেক বাদে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ফোন তুলে তার টুংটুঙির গ্রুপকে ফোন করে বলল, 

এক রাউন্ড টিউনিংটা সেরে নিবি তো?

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত


॥২১॥ 

কে বলেছে তোমরা নিরালম্ব, নেই কোনো প্রতিস্রোতে সফল উদ্ধার?/ চিনেছে বিরূপ স্রোত ডাকছে জল, আবার সংসার 

গোরাচাঁদ 

সৌমজিত ওয়াশরুমে যাবার অছিলায় বাইরে বেরিয়ে গেছে এটা গোরাচাঁদ বুঝতে পেরেছিলেন। বিশাল টেন্টের নিচে অতি মার্জিত রুচিসম্পন্ন মিটিংরুম তখন একেবারেই নিঃশব্দ। সেইসময় উনি শুনতে পেলেন অতি ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট ভারী বুম বুম মর্টার শেলের বিস্ফোরণ। থেমে থেমে। প্রায় দশমিনিট ধরে চলল। সৌমজিত আসছে না কেন? গোরাচাঁদ ভীষণ উত্কণ্ঠিত হয়ে উঠলেন। ছটফট করতে লাগলেন। সেরগেই সেটা ওয়াচ করছিল। ধামসার বিপদ সংকেত ঘণ্টা চার পাঁচ আগেই থেমেছে। সেটাতে বার বার একটাই ম্যাসেজ অনেকক্ষণ ধরে ছড়াচ্ছিল। খেড়িয়া শবর গোলগো ভুনিয়া সান্ডি গিদি নাগো ঢেলকি সব উপজাতিদেরই বলা হয়েছিল, তোমাদের সমূহ বিপদ। তোমাদের বস্তি উচ্ছেদ করার জন্য আজ প্রচুর কামানের গোলা বর্ষণ হবে। তোমরা যদি প্রাণে বাঁচতে চাও তো বিশ্রামবেলার (দুপুর) আগেই দুধ ঝর্ণার পাশে বড় ময়দানে তোমাদের ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে জমায়েত হও। কিন্তু বেশকিছুক্ষন প্রায় ঘণ্টা তিনেক পরই আরএকটা ড্রাম ম্যাসেজ ঘোষিত হয়েছিল সকলে যেন অন্য একটি বিশেষ জায়গায়, একটা খাড়া উঁচু স্লেটের মতো মসৃণ চ্যাটালো পাথরপাহাড়ের উল্টো দিকে বন্ধ গুহামুখের কাছে যেন যায়। দুধ ঝর্ণার পাশের মাঠে কেউ যেন ভুলেও না যায়,এই সাবধানতা বারবার ম্যাসেজে বলা হয়েছিল। এই জায়গাটি গোরাচাঁদকে বারবার কাছে টানে। স্বপ্নে কল্পনায় যখনতখন।কিন্তু একবারও সেখানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু চোখের সামনে ওই সম্মোহক জায়গাটি স্পষ্ট ফুটে ওঠে। মন আকুপাকু করে ওঠে। যেন সেখানে কিছু ছেড়ে এসেছেন তিনি। কবে? কিভাবে? কি আছে সেখানে? ম্যাসেজটি তো পেরোর। সিওর,নো ডাউট। কিন্তু সেখানে সে সকলকে কেন ডাকলো? তার উদ্দেশ্য মহত্‍ এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন?

সৌমজিত মুখ মুছতে মুছতে ফিরে এলো। ও নিশ্চয়ই হেভি শেলিংগ যা আগেই আদেশ দিয়ে রেখেছিল তা বন্ধ করার ম্যাসেজ পাঠালো কিংবা কামান দাগা আরোও জোরালো করতে অর্ডার দিয়ে এলো। আবার হয়তো সরকারের অনুমোদন নিতে চেষ্টা করে এলো। কিছুই সম্ভব। গোরাচাঁদের একটিই প্রচ্ছন্ন অভিমান ভিতর থেকে ঠেলে উঠতে চাইছে। এতোদিন পর নিজের পিতাকে দেখেও তার এতোই নিরাসক্ত নিস্পৃহ ভাব?ও একবারও তাঁর মুখের দিকে তাকালোনা পর্যন্ত। গোরাচাঁদের মুখে গালাগাল আসেনা। তবু তাঁর মনে হলো খুব চিত্কার করে গাল দিতে। ইউ বাস্টার্ড শুওর সন অফ আ বিচ! কিন্তু সৌমজিতের মুখ দেখে সঙ্গে সঙ্গে সেই চিন্তা উবে গেল। মুখ ভয়ে কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। হাত কাঁপছে। এমনিতেই মুখে বয়েসের ছাপ পড়েছে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। সংসারী হয়েছে কি না বোঝা যাচ্ছেনা। ঘন ঘন মুখ মোছা, কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজ ওঠানো,ধপকরে বসে পড়া কপালে ঘাম ফুটে উঠেছে এইসব দেখে গোরাচাঁদের মনেহলো কিজানি স্ট্রোক হলো নাতো? এইসব দেখে গোরাচাঁদের অপত্য স্নেহ ভীষণ ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তিনি টেবিলে রাখা জলের গেলাসের ঢাকনা খুলে জলটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। সৌমজিত মাথা নিচুকরে জলটা নিয়ে একনিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলল। কিন্তু কিছুই বললনা। সারগেই সেটা ওয়াচ করলো।

তাঁবুর ভিতরে নিঃশব্দতা বিরাজমান। এখন আর গোলাগুলি চলছেনা। এলাকার প্রান্তদেশে প্রায় কুড়িমিনিট ধরে চলছিল হেভি মরটারিং। তাঁবুর ভিতরে সারগেই,দুজন সার্জেন্ট,সৌমজিত ও তার সহকারী ইকবাল কয়েফ এবং গোরাচাঁদ। কারো মুখে কথা নেই। অধর্য সারগেই উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবে,সেইসময় বয়স্ক বিগ্রেডিয়ার সাহেব,সুবেদার ও ল্যান্সনায়েক হাতে একটা কাগজ নিয়ে ঢুকল। বিগ্রেডিয়ার সৌমজিতকে যথারীতি মিলিটারী সৌজন্যমূলক কায়দায় স্যালুট করে তার সামনে টেবিলে কাগজটি রাখলেন। সেটা পড়ে সৌমজিতের ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠলো। চোখ লাল করে তাকালো বিগ্রেডিয়ারের দিকে। ওই চিঠিতে কি লেখা আছে সেটা জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল গোরাচাঁদের তবে একটুপরেই সেটাও জানা হয়ে গেল। বিগ্রেডিয়ার খুব শান্ত স্বরে ধীরে ধীরে বললেন, আজকের মহড়ার স্থগিতাদেশটি যে সরকার থেকে এসেছে,সেটা তো কোনো ইউনিটের কাউকেই তো জানিয়ে দেননি স্যার। উপরন্তু কামানের গোলাবর্ষণ হয়েও গেল। সরকারের আদেশ অমান্য করে জানমালের যা ক্ষতি হয়েছে তার রেসপন্সিবিলিটি কে নেবে স্যার? এটা খুবই ডেলিকেট ম্যাটার। বিশেষ করে এটা আদিবাসী এলাকা। এমনকি যে ইউনিটকে আপনি অর্ডার করেছেন,সেই টুকড়ি ফৌজ এখনো একশনে। এখনো আপনি মোবাইলে ওদের বিরতির আদেশ দিতে পারতেন। ওদের কোর্টমার্শেল হলে আপনিতো পারবেননা বাঁচাতে? তাই এইসবের সম্পূর্ণ দায় আপনার। স্টে অর্ডার থাকা সত্ত্বেও যাদের যাদের আপনি যে আজ একশনে নামতে বাধ্য করেছেন সেটা লিখিত রেকমেণ্ড করুন। এই দাবীতে তারা এই চিঠি লিখেছে। আপনি এলাউ করুন স্যার। 

সৌমজিত এবার কাউকে কিছু না বলে সটান উঠে আবার বাইরে ওয়াশরুমে চলে গেল। সারগেই তার এই আনফেয়ার এটিচ্যুডে ভীষণ উশখুশ করছে বাইরে বেরোবার জন্য, গোরাচাঁদ সেটা লক্ষ্য করলেন। সৌমজিত অবশ্য পাঁচমিনিট পরই ফিরে এলো। হাতে একটা টাইপকরা নোটিশ। সহজভাবেই সবারকাছে একটা এপোলজি চেয়ে নিলো তার এই আনফেয়ার বিহেভিয়ারের জন্য। বিগ্রেডিয়ারের দিকে নোটিশটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,আজ এখন থেকে এক ঘন্টা পর একটা এমারজেন্সি মিটিং ডাকা হচ্ছে এই ময়দানে। সব ইউনিটের সবাইকেই থাকা চাই। আপনি নিজে এটার মনিটারিং করুন। আর হ্যাঁ। মর্টার শেলিং বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো জান মালের ক্ষতি হয়নি। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আপনাদের কোনো জবাবদিহি কারোর কাছে করতে হবেনা। ভয় নেই কারো চাকরি যাবে না। সৌমজিত এবার সারগেই এর দিকে তাকালো। মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে দিল। ওর হাত ধরে ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক রকমভাবে ক্ষমা চেয়ে নিল। সারগেইয়ের হাত ছেড়ে এবার সরাসরি গোরাচাঁদের দিকে তাকাতেই গোরাচাঁদের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তাকিয়ে দেখলো সৌমজিতের মুখের ভাবের কোনোরকম পরিবর্তন নেই। সেই একরকম কাঠ কাঠ ধাতব নিস্পৃহ ভাবলেশহীন মুখ। ওর নিশ্চয়ই ভেতরে জোর প্রদাহ। নাম পজিশন অর্থ প্রতিহিংসা মেটানো সব ভেস্তে গেল এই বুড়োর জন্য। আর গোরাচাঁদের অন্তরে কি জ্বালা কম? যে মানুষটি তার সামনে তার চোখে চোখ রেখে অপরিচিতের মত কথা বলতে চাইছে তার শরীরে তারই রক্ত? তারই ঔরসে জন্ম? যার জন্যে দুনিয়ার আলো দেখছে,যার কোলে পিঠে মানুষ হয়েছে তাকেই কিনা ভিনমানুষ ভাবছে? কিংবা শত্রু? এমনো নিমকহারাম কেউ হতে পারে?

সৌমজিত গোরাচাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেই যাচ্ছে কিন্তু তাঁর কানে কিছুই ঢুকছিল না। কয়েকটি টুকরো টুকরো কথা উনি বুঝতে পারলেন। ও বলছিল, আমাদের কাছে সরকারের রেকর্ড নথিপত্র সব আছে যে পুরো শিমুলিয়া উগ্রবাদী অধ্যুষিত এলাকা। সরকার আদেশ আমাকে দিয়েছে এই এলাকা বিপদ মুক্ত করার। সে আজ নয় কাল করবই। ওই কালো নোংরা হিংস্র জংলী আদিবাসীগুলোকে... শুনুন মিঃ দাস....। আর কিছু গোরাচাঁদের মাথায় ঢুকলো না। সজ্ঞাহীন হয়ে লুটিয়ে পড়লেন। 

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ২৬

সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়


Diary Entry - 24
16th. October, 1942, Friday

প্রিয় কিটী, 

আমি সত্যিই এখন খুবই ব্যস্ত। বলতে পার এক সেকেন্ডের জন্যেও আমার দম ফেলার ফুরসৎ নেই। আমি বাবার "আশ্রয়ে" (কিংবা বলতে পার প্রশ্রয়ে) আবার পড়ায় মন দিয়েছি। অথবা বলতে পার, মন দিতে বাধ্য হয়েছি। তুমি জান, আমি ইতিমধ্যে " La Belle Nivernaise- The Story of an Old Boat and Her Crew" ( বইটার পরিচয় ২২ নম্বর এন্ট্রিতে দেওয়া হয়েছে। এখানে বইটির প্রচ্ছদের একটি ছবি দেওয়া হল ---- অনুবাদক ) বইটার গোটা একটা অনুচ্ছেদ অনুবাদ আমি করে ফেলেছি। বিশ্বাস করো, একদম খারাপ হয়েছে, এ’কথা বলতে পারবে না। 


অনুবাদ করতে গিয়ে বেশ কিছু নতুন শব্দ পেছিলাম। সেই শব্দগুলো প্রথমে আলাদা করে লিখে, তারপর সেইগুলোর অর্থ আলাদা করে অন্য জায়গায় ব্যাখ্যা করে লিখেছি। এরপর আমার জীবনের সবচেয়ে জঘন্য যে বিষয়টা সেটার কথা বলি। সেটা হল অঙ্ক। জঘন্য হওয়া সত্ত্বেও ইতিমধ্যে আমি বেস কিছু অঙ্কও করেছি।সবশেষে আর প্রায় তিন পাতা ফরাসী ব্যকরণ মুখস্থ করেছি।ফরাসী ভাষার ব্যাকরণ খুব একটা সহজ নয়। তাই বিষয়টা বলতে যত সহজ-সরল লাগছে, করতে আদৌ ততটা সহজ বলে মনে হয় নি, কিংবা আমিও মনে করি নি। বাবার কাছে আমার প্রথমেই একটা আবেদন ছিল। আমি রোজ অঙ্ক করব না। সপ্তাহে দু-এক দিন করব।কারণ রোজ যদি অঙ্ক করতে হত, তা’হলে আর কিছু পড়ার মতো মন থাকত না। মোটামুটি ঔখানেই পড়া বন্ধ করে বিশ্রাম নিতে হত। বাবা নিজেও জানে অঙ্ক বিষয়টা অতি জঘন্য আর জটিল বিষয়। ওটা কিছুতেই রোজ করা যায় না। বাবারও কোনদিন অঙ্ক করতে ভাল লাগত বলে মনে হয় না। তা’না হলে কেউ এককথায় আমার প্রস্তাবে রাজি হয়? একটা সত্যি কথা শুনবে? আমি কাউকে কোনদিন কথাটা বলিও নি, আর কাউকে এই কথাটা বুঝতেও দিই নি। আমার বাবা অঙ্কে নিজেও খুব একটা দক্ষ ছিলেন না। তবে বাবা বুদ্ধি করে সেটা কাউকে বুঝতে দিতেন না।তবে এটা ঠিক যে, মাঝে মাঝে আমি বাবার চেয়ে দ্রুত অঙ্ক করে দিতে পারতাম।বাবা তার জন্যে আমার প্রশংসাই করতেন। তাই বলে তুমি আবার মনে করে বস না যে আমি বা বাবা দু'জনেই অঙ্কে খুব ভাল। যখন তখন অঙ্ক করে দিতে পারি। বরং তার উল্টোটাই। মাঝে মাঝেই আমাকে বা বাবাকে অঙ্ক করার জন্যে বা মেলানোর জন্যে মারগটের শরণাপন্ন হতে হত।এ’কথাটা গোপন করার কোন মানেই হয় না, যে মারগট আমাদের মধ্যে অঙ্কে বেশই ভাল ছিল, অন্ততঃ আমাদের চেয়ে তাড়াতাড়ি অঙ্ক কষে দিতে পারত। অবশ্য এটাও ঠিক, মারগট আমায় বা বাবা বললে বাবার জন্যে অঙ্ক কষে দিলে, কোন রকম অহংকার দেখাতো না।এমনিতেই সে অবশ্য চুপচাপ।আমার মতো ছটফটে বা বাচাল স্বভাবের নয়। যারা চুপচাপ থাকে তারা অঙ্ক তাড়াতাড়ি করতে পারে। কারণ বাবার কাছেই শুনেছি ভাল অঙ্ক করার জন্যে ধীরস্থির হতে হয়। যেটা মারগট ছিল। তবে একটা বিষয়ে আমি তোমায় আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বলেতে পারি। শর্টহ্যান্ড লেখার ব্যাপারে আমি নিশ্চিতভাবে পিটার আর মারগটের থেকে অনেক এগিয়ে। এই ব্যাপারে মারগটের ধীরস্থির হওয়ার কোন বিশেষ ফল হয় নি। 

গতকাল আমি The Assault বইটা শেষ করলাম। বইটা অবশ্যই মনোরঞ্জক এবং ভাল। মানে, তুমি পড়তে শুরু করলে আর ছাড়তে পারবে না যতক্ষন না শেষ হচ্ছে। তবে Joap ter Heul (১৬ নম্বর এন্ট্রিতেও এই বইটার কথা বলা হয়েছে --- অনুবাদক ) এর মতো মনোরঞ্জক কখনই নয়। সেটা এর চেয়েও ভাল। আমার মতে Cissy van Marxveldt একজন প্রথম শ্রেণীর লেখিকা। সুদূর ভবিষ্যতে আমি আমার ছেলে মেয়েদেরও এই বইটা পড়তে বলব। তাতে অন্ততঃ তারা তাদের মায়ের রুচিটা বুঝতে পারবে। এবং “মা” হিসাবে, আমার সম্পর্কে একটা বিশেষ ধারণা গড়ে উঠবে। 

মা আমি আর মারগট আবার কাছাকাছি চলে এসেছি।আমাদের মধ্যে যে বিরোধগুলো ছিল, তার সবকিছু মিট্মাট হয়ে গেছে,কি’না, তা’বলতে পারব না। তবে আমরা কেউই আর ঐসব বিরোধ নিয়ে ভাবছি না। এখন ত' আমি ওদের সাথেই প্রায় গা' ঘেঁষাঘেষি করেই থাকি। সত্যিই ত' ওরা ছাড়া আমার আপনজন বলতে আর কে’ই বা আছে ? এটা কেন যে আমি মাঝে মাঝে ভুলে যাই, সেটাই আমি বুঝতে পারি না। আসলে আমি কারুর কথা সহ্য করতে পারি না।আমার একটা স্বাধীন মত আছে, সেটা কেউ যদি চেপে দিতে চেষ্টা করে, তখনই আমি রেগে যাই।কিন্তু যাই হোক না কেন, ওদের সাথে থাকতেই আমার বেশী ভাল লাগে।সেটাই ত’ স্বাভাবিক। ওরা ত’ আমার বোন আর মা। গতকাল সন্ধ্যেবেলা ,আমি আর মারগট একই বিছানায় শুয়েছিলাম। শুয়ে শুয়ে গল্প করছিলাম। শুধু কি শুয়েছিলাম আর গল্প করছিলাম, প্রায় সারাটা সন্ধ্যে বিছানাটাকে নিয়ে দু'জনে ধামসা ধামসি করেছি। অবশ্যই প্রধান ভূমিকা ছিল আমার। এ’সব ব্যাপারে যে আমার উৎসাহের কোন কমতি থাকবে না, সে’রকম সন্দেহ কারুর থাকা উচিৎ নয়। তবে দু'জনে মিলে সারা সন্ধ্যে যে ভীষণ মজা করেছিলাম, এটা সত্যি।অনেকদিন পর মনে হচ্ছিল মারগটকে আবার আমি আগের মতো করে পাচ্ছি। মারগট হঠাত আমায় জিজ্ঞাসা করল, সে আমার ডাইরিটা পড়তে পারে কি'না ? আমি বললাম, "হ্যাঁ”।সত্যিই ত আমার ডাইরি সে কেন পড়তে পারবে না? সে’ত’ আমার দিদি।আমার সবকথাই সে জানে। তারপর আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। আমি মারগটকে জিজ্ঞাসা করলাম, বড় হয়ে ও' কি হতে চায় ? মারগট কোন উত্তর না দিয়ে শুধু আমার দিকে তাকেয়ে মিটি মিটি করে হাসছিল। ঠিক যেন, বিষয়টা ওর একান্ত গোপন ব্যাপার।আমি কিন্তু মারগটের মতো চুপ করে ছিলাম না।আমি বেশ জোরের সঙ্গেই বলে দিলাম,”আমি বড় হয়ে শিক্ষক হতে চাই।“ আমি জানি না, আমি আদৌ কোনদিন হতে পারব কি'না ? তবে, "হতে চাই" এই চিন্তাটা করতে দোষ কি? না হতে পারলে হব না, ব্যাস ফুরিয়ে গেল। কিন্তু তার জন্যে, আমার কোন ইচ্ছা থাকতে পারে না? আসলে অন্যে কে কি হতে চায়, এ'ব্যাপারে বেশী কৌতূহল না থাকাই শ্রেয়। তবে আমি ত’ আমার ব্যাপারে ভাবতেই পারি, কিংবা স্বপ্নও দেখতে পারি, যে আমি শিক্ষিকা হয়েছি। তাই বলছিলাম, আমি কিন্তু কি' হতে চাই সেটা ভাবতে দোষ কোথায়? হওয়া বা না হওয়াটা ত পরের ব্যাপার। আগে ত’ ভেবে নিই। আর কিছু না হোক স্বপ্নটা ত’ দেখে নি। 

আজ সকালে আমি অকারণে পিটারের বিছানায় শুয়েছিলাম (এটা বোধহয় ঠিক করি নি। বাবা আর মায়ের দিকে তাকিয়ে সেটাই মনে হল। কিন্তু কেন, তা আমি জানি না)।পিটার তার জন্যে আমায় তাড়া করে এসেছে। আমি জানি ওর বিছানায় শুয়ে আমি ঠিক করিনি। বিশেষকরে ওকে না জানিয়ে। পিটার অবশ্য এ’সব কিছু না বলেই, আমার দিকে তেড়ে এল। আমি ওর বিছানায় শুয়েছি ব'লে,আমার উপর রেগেই খাপ্পা। তবে আমি ওর রাগকে খুব একটুও ভয় পাই না। ওর উচিৎ ছিল অন্ততঃ একবার আমায় বন্ধুত্ত মূলক মনোভাব দেখানো। কারণ আর যাই হোক না কেন, গতকালই ওকে আমি একটা গোটা আপেল,খাওয়ার জন্যে দিয়েছিলাম। 

মারগটকে সেদিন হঠাতই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "আচ্ছা, আমি কি দেখতে খুব খারাপ ?" মুচকি হেসে মারগট উত্তর দিয়েছিল, আমার মধ্যে না'কি বেশ একটা 'আলগা চটক আছে।' উত্তরটা, আমি যা জানতে চেয়েছিলাম, আদৌ তার মত নয়। উত্তরটা অস্পষ্ট উত্তর। তবে মারগট বলেছিল আমার চোখদুটো না'কি সুন্দর। এই উত্তরটাও অস্পষ্ট। তোমার কি মনে হয় ? 

আজ এপর্যন্তই থাক। আবার পরে লিখব। 




ইতি,

অ্যানি। 


অনুবাদকের সংযোজনঃ- 

Joop ter Heul:- জোপ – টার- হিউল মূলত একটি কাল্পনিক চরিত্র। Setske de Haan ( 24 November 1889 to 31 October 1948) ওরফে ক্রীসী ভ্যান মারক্সভেল্ড ( Cissy van Marxveldt – এই নামেই তিনি জোপের সম্পর্কে তাঁর বই লিখতেন ) এই কাল্পনিক চরিত্রটির স্রস্টা। চরিত্রটি মূলত কিশোর কিশোরীদের কথা ভেবে সৃষ্ট। ক্রিসী তথা সেতস্কী সৃষ্ট জোপ ছিল এক কল্পনা প্রবণ, একগুঁয়ে এবং জেদী মেয়ে। অ্যানি চরিত্রটির সঙ্গে তার নিজের মানসিকতার সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিল। তাই তার চরিত্রটি হয়ে উঠেছিল এত প্রিয় চরিত্র। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে ক্রিসী বা সেতস্কী জোপকে নিয়ে প্রায় চারটি বই লেখেন। প্রথমটি কিশোরীর জোপের স্কুল জীবন; দ্বিতীয়টি তার বয়ঃ সন্ধিকালের আখ্যান ; তৃতীয়টি তার বিবাহ উত্তর জীবন ; চতুর্থটি তার ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার জীবন । এই প্রায় কুড়ি বছর পর পঞ্চম বইটি লেখেন। প্রথম চারটি বইয়ের কথা অ্যানির সঙ্গে সম্পর্কিত ভাবে এখনও স্মরণ করা হয়। এটা মনে করা হয়তঃ বাহুল্য হবে না যে, অ্যানির জন্যেই জোপ-টার-হিউলের বইগুলো এত জনপ্রিয় হয়েছিল। নীচে জোপ টার হিউলের একটি জনপ্রিয় বইয়ের ছবি দেওয়া হল। 



0 comments:

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল



উপন্যাস - ত্রিধারা 
লেখক - ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 
প্রকাশক - ধানসিঁড়ি 

লেখিকা ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের এটি দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম কলাবতী কথা। সেটি পড়ে ভালো লেগেছিল। তাই এই রচনাটি সম্বন্ধে প্রত্যাশা বেশিই ছিল। বলা বাহুল্য নিরাশ হইনি। লেখিকার প্রাচীন কাল ও সভ্যতার উন্মেষ নিয়ে অনুসন্ধিৎসা এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে। কিন্তু আধুনিক জীবনের দ্বন্দ্বও যেন আমাদের চিনিয়ে দেয় লেখিকা বর্তমান সম্পর্কেও নিস্পৃহ নন ।
উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে তিন প্রজন্মের তিন নারীকে ঘিরে। এদের জীবনে একটি আশ্চর্য সমাপতন। প্রত্যেকের মাতৃত্বকে ঘিরে এক রহস্য। অদ্ভুত ভাবে অনুষঙ্গে উঠে এসেছে মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকা গুহা। অনেকে অনেক অর্থ করবেন, আমার মনে হয়েছে মধ্যম পাণ্ডবের অনার্য বিবাহ এবং একটি প্রান্তিক স্রোতধারা কিভাবে যেন ভারতবর্ষের মূলস্রোতে মিলে গিয়েছিল। এখানে তার একটি সমকালের প্রতিফলন। এই উপন্যাসের দ্বিতীয় যে প্রতিপাদ্য, মাতৃত্বের অধিকার একটি প্রাকৃতিক অধিকার। এর সণ্গে মিশে আছে আমাদের প্রাচীন কালের মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার বীজ। জননী যেখানে প্রকৃতির নির্বাচিত। সৃষ্টি ধারণ ও পালনের একক ক্ষমতার বাহক। 
উপন্যাসটি সুখপাঠ্য। তবে আপাতসুখকে সরিয়ে গভীরতর পর্যবেক্ষণের দাবী আছে তার। পাঠক মাত্রই সেই দায় স্বীকার করবেন। 
এই ধারার উপন্যাস লেখকের মেধা ও মননের পরিচয় বহন করে। 


বইটির মুদ্রণে যত্নের ছাপ পরিস্ফুট। ভালো কাগজ ও নির্ভুল ছাপা নজর কাড়ে। প্রচ্ছদে দেখা যায় তিনটি ধারা অরণ্য বনরাজির পাশ দিয়ে বয়ে গিয়ে কখনও মিলেছে, কখনও বা স্বতন্ত্র ধারায় বয়ে গেছে। সুন্দর প্রচ্ছদ।

0 comments:

0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in


স্মৃতির সরণী


কথামালা
বিপুল দাস



একটি শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে উঠতে অনেক সময় দরকার। ভৌগোলিক ভাবে যেমন কোনও ক্ষেত্রের উর্বরতা রাতারাতি বৃদ্ধি পায় না, সময় পলি বহন করে আনে। সঞ্চিত হতে থাকে অনুর্বর সেই জমির ওপর। তারপর কর্ষণ, বীজবপন, সারপ্রয়োগ, নিড়ানির পর ফসল ফলে, ঠিক তেমনই কোনও জনপদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রাতারাতি তৈরি হয় না। তার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয়। কিছু শর্ত থাকে। প্রাচীন শহরগুলোতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বহমানতা থাকে। ক্ষেত্র প্রস্তুতই থাকে, শুধু বীজ বপনের অপেক্ষা। একটি জনপদের সমস্ত মানুষের মানসিক শিক্ষার স্তরকে উন্নীত করে তোলা একজন মানুষ বা একটি প্রতিষ্ঠানের সাধ্য নয়। বিশেষ করে সেই শহর যদি অর্বাচীন হয়, নিতান্ত ব্যবসায়িক কারণেই দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে, ভিন ভিন্ন সংস্কৃতির বিচিত্র জনজাতির আবাস হয় – তবে নির্দিষ্ট, একমুখী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠা কঠিন। নবীন শহর শিলিগুড়ির সেই সমস্যা রয়েছে। বাণিজ্যে, ক্রীড়াক্ষেত্রে এ শহর বেশ এগিয়ে গেছে, কিন্তু শুধু কিছু ঝাঁ-চকচকে পথঘাট, রাতে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত শহর, অজস্র আধুনিক কেতার দোকানপাট, অসংখ্য হোটেল, বেশুমার নার্সিং-হোম একটা শহরের উন্নতির মাপকাঠি নয়। সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকান্ড যে কোনও শহরের একটি অন্যতম আধুনিকতার পরিচয়। এ শহরে শেষ কবে বড় মাপের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসেছে, সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ ভুলে গেছে। এখানে বড় মাপের টেবিল-টেনিস আসর বসে, নেহরু কাপের খেলা হয়, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা হয়, বলিউডি গানার মেহ্‌ফিল বসে, কিন্তু কোনও গবেষকের প্রয়োজনীয় বই আনতে হয় কলকাতা থেকে। একমাত্র নাট্যোৎসবের সময় ‘কলিকাতার’ দল এলে দর্শক আনুকূল্য পায় উদ্যোক্তা। অন্য সময় প্রেক্ষাগৃহ শূন্য। ভালো প্রেক্ষাগৃহ বলতে সবেধন নীলমণি দীনবন্ধু মঞ্চ। এ শহরে কবিসভার চেয়ে হরিসভা, শোকসভা, জনসভার শোভা বেশি। খুব অনিয়মিত ভাবে হাতে গোণা কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। স্বীকার করতে লজ্জা আছে, কিন্তু দ্বিধা নেই – শিলিগুড়ি শহরের আশপাশের ছোট মফস্‌সলি শহরগুলোর সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্য এবং মান অনেক বেশি গৌরবময়। পাশের শহর, পাশের রাজ্য, এমন কী সীমান্তঘেঁষা শহর বলে পাশের রাষ্ট্র থেকেও এ শহরে মানুষ ছুটে আসে জীবিকার তাগিদে, চিকিৎসার গরজে, কাঞ্চঞ্জঙ্ঘায় সানরাইজ দেখতে। হাতির পিঠে চড়ে গণ্ডার দেখতে। শিলিগুড়ির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কত পুরনো, এ খবর তাদের কাছে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। আর, শহরজুড়ে যারা ভিন্ন রাজ্য থেকে এসে শুভলাভের কড়ি গুণে চলেছে, শিলিগুড়ির সাংস্কৃতিক মানোন্নয়ন হ’ল কিনা, তাদের কিছু আসে যায় না।

উত্তরবাংলার এই মফস্‌সল শহরে যাদের জন্ম, তাঁরা বড় হয়েছে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা, করতোয়ার ভিজে বাতাসে। নদীপারে কাশবনের দোলা আর উত্তরে তাকালেই দা গ্রেট হিমালয়ান রেঞ্জ। পাহাড় পরিষ্কার থাকলেই ভোরে দেখতে পাই কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্র মুকুটে একরকম লাল, আবার বিকেল গড়ালে সেখানে কেমন দুখি লাল। আমাদের অস্তিত্ত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মইষাল বন্ধুর গান, চা-বাগানের কুলি-লাইনের গল্প, বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্টের আর মহানন্দা স্যাংচুয়ারির গাঢ় সবুজ গন্ধ। উত্তরের দারুণ বর্ষা আর কনকনে শীত। শালশিমুলজারুলখয়েরের ছায়ায় আমাদের বড় হয়ে ওঠা। মানুষের চৈতন্যে অবিরত রেকর্ডিং হতে থাকে ছড়ানো-ছেটানো এই সব উপাদান। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নেওয়া এই সব উপকরণ যেন একটা আর্কাইভে জমা হতে থাকে। বস্তুত, প্রায় তখনই ঠিক হয়ে সে কী লিখবে, কাদের নিয়ে লিখবে। এ কারণেই উত্তরের লেখকদের গল্পে বারে বারে তিস্তা নদী এসেছে, কাঠমাফিয়াদের কথা এসেছে, ভাওয়াইয়া ও রাজবংশীদের কথা এসেছে। বহুদিন আগে দেখা ডুয়ার্সের বাসে একজন ভুটিয়া রমণীর নাকে সোনার নথের ঝিকমিক মগ্ন-চৈতন্যে নিহিত থাকে। ধূপগুড়ির রোদ্দুর আর ওই নথের ঝিলিক নিয়ে একটা গল্প তৈরি হয় আমার মগজে। স্কুলে পড়ার সময় পিকনিক করতে গিয়ে সেভোকে করোনেশন ব্রিজের ওপর থেকে একমুঠো পাহাড়ি ঝাউপাতা ফেলে দিয়েছিলাম তিস্তার জলে। এই নদী বাংলাদেশে জলে গেছে। এখন বয়স যখন হেলে পড়েছে অড সাইডে, একটা গল্প তৈরি হতে চায়, যার নাম হতে পারে – মনোয়ারা বেগমের প্রতি শুভেচ্ছা।

পাহাড় থেকে গড়িয়ে নেমেই মহানন্দা সমতলে এসেছে শিলিগুড়িতে। পাহাড় গড়িয়ে পাথর আসে। পাথর গড়িয়ে চূর্ণীভবন চলে দীর্ঘকাল ধরে। নদীর গর্ভে বালি জমে। এখন ওই রুগ্ন, কঙ্কালসার নদীর দিকে তাকালে আমার বুকের ভেতরে কষ্টটা টের পাই। থাক, আমি দুঃখটা বালিচাপা দিয়ে রাখি।

কিছুদিন আগে আগে হঠাৎ মনে হ’ল যাই, একটু সেই নদীকে দেখে আসি। আমার প্রিয় মহানন্দা। রাস্তা পার হয়ে নতুন বসতির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদী আর খুঁজেই পাই না। এ কী রে বাবা, পুকুরচুরি শুনেছি, আস্ত নদীটাও চুরি হয়ে গেল নাকি। যেখান দিয়ে হেঁটে এলাম, একদিন সেখানে ডুবজলে সাঁতার কাটতাম। অনেক সরে গেছে নদী। শেষে পাওয়া গেল। ঘরবাড়ি শেষ হওয়ার পর একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়ালাম। এখানে অন্ধকার। একটা বড় গাছও হয়ে গেছে এ ক’বছরে। হিসেব করে দেখলাম তা প্রায় চল্লিশ বছর পরে আবার নদীর পারে এসে দাঁড়িয়েছি। গাছ তো বড় হতেই পারে।

গাছটার নীচে গিয়ে বসলাম। আমার ছেলেবেলার নদী। আমার পায়ের কাছে মহানন্দা। উত্তরে তাকালে স্পষ্ট দেখা যায় তিনধারিয়া, কার্শিয়াং-এর আলো। অন্ধকারে কালো জল পাড়ে এসে ছলাত্‌ ছলাত্‌ শব্দে ভেঙে পড়ছে। সেই চিরকালের চেনা নদীকে ভীষণ অচেনা মনে হয়। কোথা থেকে এসেছে এই নদী ? কত যুগ ধরে বয়ে চলেছে এই নদী ? এর নাম কে রেখেছে মহানন্দা ? জগদীশচন্দ্র বসুর সেই বিখ্যাত লেখাটার কথা মনে পড়ল। ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে। আমি তো বিখ্যাত মানুষ নই, তবু ইচ্ছে হ’ল নদীর সঙ্গে কথা বলতে। ফিসফিস করে উচ্চারণ করলাম –

নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ ?

কার্শিয়াং-এর কাছে একটা ছোট্ট সরোবরে আমার জন্ম।

নদী, তোমার যাত্রাপথের গল্প বলো।

পাহাড়ে কত শত চঞ্চল ঝর্ণা এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের সবাইকে নিয়ে পাহাড়ের বন্ধন ছেড়ে নেমে এলাম শিলিগুড়ির সমতলে। আমার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে গেল। এ শহরের মানুষ নদীকে ভালোবাসে না। আমি কলুষিত হলাম। ওদিকে সুকিয়াপোখরি থেকে বালাসন এসে আমার সঙ্গে মিলিত হ’ল। শিলিগুড়ি পার হয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর এগিয়ে চলেছি। গজলডোবা থেকে তিস্তা ক্যানাল হয়ে তিস্তার জল এসে পড়েছে আমার বুকে। লকগেট বন্ধ করে সেই জল পাঠিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিমে। শুখা মরশুমে ফসল ফলায় উত্তর আর দক্ষিণ দিনাজপুরের সুখা জমিতে।

তারপর ?

তারপর বিহারে ঢুকে পড়েছি। নেপাল থেকে আসা মেচি নদীর সঙ্গে দেখা হ’ল কিষাণগঞ্জের কাছে। সমস্ত জলসম্পদ নিয়ে ক্রমে আরও দক্ষিণে এঁকে বেঁকে, কতবার দিক পালটে অনেক পথ পার হওয়ার পর নাগর ও কুলিকের মিলিত ধারা এসে মালদহ জেলার মহানন্দপুরের কাছে আমার সঙ্গে মিশে গেল। তখন আর আমার সেই পাহাড়ি চঞ্চল খরধারা নেই। কিছুটা অলস ছন্দে আমার এগিয়ে চলা। কত স্ফীত হয়েছি।

নদী তার দুঃখের কথা বলে। কেউ শোনে না। ট্রাক ভর্তি বালিপাথর চলে যায় নগর-সভ্যতার দিকে। শহরের চারপাশে যে সবুজ বলয় ঘিরে রাখত শিলিগুড়িকে, সেই বলয়ের ব্যাসার্দ্ধ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। উন্নয়ন চাইলে উচ্ছেদও তোমাকে মেনে নিতে হবে। পুবে বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্ট কত দূরে সরে গেছে। এখন সেখানে মানুষ, শুধু মানুষ। উত্তরে মানুষের প্রতিরোধ অগ্রাহ্য করে চা-বাগান উচ্ছেদ করে তৈরি হয়েছে বিলাসবহুল আবাসন। পশ্চিমে নদীর ওপারেও চলে গেছে শিলিগুড়ি। আর দক্ষিণে শিলিগুড়ি এখন জলপাইগুড়ির দিকে দৌড়ে চলেছে। শুধু মানুষ, শুধু ধূসর কংক্রিট। বৈকুণ্ঠপুর থেকে সবুজ টিয়ার ঝাঁক এখন আর আসে না শিলিগুড়িতে।

তবু সৃষ্টির বাসনা জেগে থাকে কিছু মানুষের মনে। এই প্যাশনের মৃত্যু হয় না। রয়েছেন কিছু অধ্যাপক। রয়েছে কিছু নাটকের দল। মাঝে মাঝে ছবির প্রদর্শনীও হচ্ছে। গদ্যপদ্যের জগতে শক্তিশালী কলম নিয়ে এগিয়ে আসছে কিছু তরুণ মুখ। ওরাই গানে, কবিতায় মুখর করে তোলে বইমেলা।

কতকাল হ’ল শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনের ক্যান্টিন বন্ধ। মমতাজ আলি, আস্‌রাফ আলির কথা মনে পড়ে। পুরনো স্টেশন প্রায় পরিত্যক্ত। আরও দক্ষিণে নতুন স্টেশনঘর হয়েছে। খুঁজেই পাই না কোথায় ছিল আমদের সেই মফস্‌সলি কফি-হাউস রেল-ক্যান্টিন। ওখানেই এক নির্জন দুপুরে অমরেশ ওর প্রেমিকার বান্ধবীর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলে বুঝেছিলাম, কাকে বলে – একটি কথার দ্বিধা থরো থরো চূড়ে ...।

হঠাৎ কোনও দিন বিধান মার্কেটে ‘নেতাজি কেবিন’-এ যাই। এখানেও শিলিগুড়ির লেখক-শিল্পীরা আসা-যাওয়া করত। এখন আর করে কি না, জানি না। তপনের বিখ্যাত বই-এর দোকান ‘বুকস্‌’ বন্ধ হয়ে গেছে। উত্তরবাংলার প্রায় সব লেখককবিরা এখানে আসত তাদের প্রয়োজনীয় বই-এর খোঁজে। আমাদের নিত্যদিনের সায়ং সভার নাটমন্দির ছিল বুকস্‌। যে কোনও বই দরকার হলেই তপনকে বলতাম। তপন ওর লোক দিয়ে আনিয়ে দিত। অনেকেই এক সময় প্রচুর বই আনিয়েছেন এই বুকস্‌ মারফত্‌। আমাদের খুব কষ্ট হয়েছিল বুকস্‌ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর। এত বড় শহর। বলা হয় দ্বিতীয় কলকাতা নাকি। অথচ বুকস্‌-এর মত আর একটা বই এবং লিটল্‌ ম্যাগাজিনের দোকান শিলিগুড়িতে হ’ল না। শহরে এতগুলো কলেজ, কাছেই বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, এত মানুষ, এত দোকানপশার, অথচ আমাদের একটা পাতিরাম বা ধ্যানবিন্দু নেই। আমাদের হংকং মার্কেট আছে, আমাদের বিদেশি ব্যাঙ্ক আছে, আমাদের বিখ্যাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে, আমাদের মন্দির-মসজিদ-গির্জা-গুরুদ্বার আছে, অথচ হায়, একটি ছোটখাটো কলেজ স্ট্রিট নাই।

হবে নিশ্চয় একদিন। আশায় বাঁচে চাষা। কলকাতার ইতিহাস তিনশ বছরের। এই শহরের গঞ্জ থেকে মফস্‌সল শহর হয়ে বড় শহর হয়ে ওঠার ইতিহাস খুব বেশি হলে পঞ্চাশ বছরের। এই শহরের সংস্কৃতির ইতিহাস যেদিন লেখা হবে, সেদিন পাহাড়তলির নাম আলাদা ভাবেই উল্লেখিত হবে।

0 comments:

0

প্রাচীনকথা - দোলা সেন

Posted in


প্রাচীনকথা


পঞ্চকন্যার একজন
দোলা সেন



অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরীস্তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরেন্নিত্যং মহাপাপম বিনাশনম॥


প্রাতঃস্মরণীয়া পাঁচ নারী। সকালে উঠে স্মরণ করলে পাপক্ষয়। এই পাপক্ষয় নিয়ে এই অভাজনের মনে এক সন্দেহ আছে। বিষয়টা অনেকটা ‘মার কথা না শুনলে ঠাকুর পাপ দেবে’ জাতীয় কী? পাশ করার লোভে যেমন পড়া, পুণ্যের লোভ দেখিয়ে এই নামগুলি জনমানসে গেঁথে দেবার প্রচেষ্টা হলেও হতে পারে। কিন্তু কেন? আমাদের পুরাণের বিবিধ রূপ। রূপক, অলংকার, দর্শন, ধর্ম – বিভিন্ন আলোয় তা ভিন্ন ভিন্ন রঙ ছড়ায়। আর এখানেই এই মহাকাব্য দুটি অন্য সবার থেকে আলাদা। আবার যুগ যুগ ধরে এর একটি সহজ সাধারণ আটপৌরে রূপও চলে আসছে। চণ্ডীমণ্ডপ, কথকতার আসর, ঠাকুমা-দিদিমার গল্পের ঝুলি আলো করে এর উপস্থিতি। বস্তুতঃ এই রূপটির জন্যই মহাভারত আর রামায়ণ আজও জনজীবনের অঙ্গ। ইলিয়াড ওডেসির মতো তা গবেষকের সংগ্রহশালায় বাস করেনি।

আচ্ছা, যদি সব কিছু সরিয়ে রেখে সহজ মানবী হিসেবে দেখি এই পাঁচটি মেয়েকে? ফিরে দেখি তাদের আজকের এক মেয়ের চোখ দিয়ে? খুব কি অনধিকার চর্চা হবে? সহজ গল্পের সহজ মানেটুকু দেখতে গিয়ে পেতেও তো পারি অন্য কোনও স্পেকট্রাম? তারই খোঁজে চলতে গিয়ে আজকের নারীর নাম হোক অহল্যা।

॥অহল্যা॥

পঞ্চকন্যার এক কন্যার নাম অহল্যা। দ্রৌপদীর মতো ইনিও অযোনিসম্ভবা অলোকসামান্যা রূপসী। কথিত আছে উর্বশীর রূপের গর্ব খর্ব করার জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল ঘুরে সব জায়গার শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য চয়ন করে সৃষ্টি করেন এই মানসকন্যাকে। পুরুষের বহু জন্মের কামনার ধন এই রমণী। কোনও অসুন্দরতার স্পর্শ নেই যে নারীর অঙ্গে – তিনিই অহল্যা। এই অনিন্দ্যসুন্দরী কন্যাকে সৃষ্টি করে পিতামহ পড়লেন মহা চিন্তায়। কোথায় রেখে নিরাপদে বড় করবেন এই মেয়েকে? অনেক ভাবনাচিন্তার পরে তাঁর মনে পড়ল মহাঋষি গৌতমের কথা। কঠোর ব্রহ্মচারী এই তাপসের কাছেই অহল্যা একমাত্র নিরাপদ বলে মনে হলো তাঁর। একটু দুষ্টু হাসিও ফুটে উঠল প্রজাপতির মুখে। এই সুযোগে ব্রহ্মচারীর অগ্নিপরীক্ষাটাও হয়ে যাবে। অতএব একদিন তিনি মহর্ষির কাছে গিয়ে বললেন, - “দেখ হে, আমি ক’দিনের জন্য একটু বাইরে যাচ্ছি। ততদিন তুমি যদি মেয়েটিকে তোমার আশ্রয়ে সুরক্ষিত রাখ, তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হই। আমি ফিরে এসে ওকে নিয়ে যাব।“

গৌতম রাজি হয়ে গেলেন। অহল্যা তাঁর আশ্রমে থেকে গেল। ঋষির কোন হেলদোল হলো না। তিনি সারাদিন তাঁর জপতপ, পূজার্চনা নিয়েই থাকেন। অহল্যা তাঁর তপোবনে সবার চোখের আড়ালে ফুলের মতো, পাখির মতো, হরিণশিশুর মতো বড়ো হতে থাকে। ভারি লক্ষ্মী মেয়ে। রোজ গৌতমের ঘরদুয়ার পরিষ্কার করে দেয়। সাজিয়ে রাখে পূজার উপকরণ, ফুলের মালা। তুলে আনে বনের ফল – সুন্দর করে সাজিয়ে খেতে দেয় মহর্ষিকে। সুরভি গাইয়ের দুধ দিয়ে কোনওদিন বানিয়ে দেয় পরমান্ন। কুটিরের সামনে লাগায় বনফুলের চারা। দেখতে দেখতে মহর্ষির মাথা গোঁজার কুটিরটি এক সুন্দর গৃহ হয়ে উঠল।

ব্রহ্মা আড়াল থেকে খেয়াল রাখছিলেন সবই। গৌতমের সংযমে তিনি অভিভূত। বেশ কিছু বছর অতিক্রান্ত। কিশোরী অহল্যা যৌবনপ্রান্তে উপনীত। এবার তাকে প্রাত্রস্থ করার সময় এসেছে। তিনি আবার এসে দাঁড়ালেন গৌতমের দুয়ারে। পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতো ঋষিও বিনা বাক্যব্যয়ে ফিরিয়ে দিলেন গচ্ছিত সম্পদ।

কিন্তু এ মেয়ে তো সাধারণী নয়! একমাত্র ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষই পারে এর যোগ্য জীবনসঙ্গী হতে। বড় চিন্তায় পড়লেন প্রজাপতি। অনেক ভেবে স্থির করলেন সবচেয়ে কম সময়ে যে মহাবীর প্রদক্ষিণ করতে পারবেন ত্রিভুবন, তিনিই হবেন অহল্যার স্বামী।

এদিকে অহল্যা ব্রহ্মলোকে ফিরে যাওয়ায় গৌতম তাঁর কুটিরে আগের মতোই একা। কিন্তু সত্যি কি আগের মতোই? এতগুলো বছরে তাঁরও তো বয়েস বেড়েছে অনেকটাই। এই দীর্ঘ দিনযাপনে তিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন গৃহসুখে, সযত্নচর্চিত শয্যায়,হাতের কাছে সাজিয়ে দেওয়া পূজার উপাচারে, এগিয়ে দেওয়া খাদ্যে। এছাড়া অহল্যার প্রতি অনুরাগও কি সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর মধ্যে? হয়েও যদি থাকে, আজীবন ব্রহ্মচারীর পক্ষে তার স্বরূপ অনুধাবন করা সম্ভব নয়। তবুও অহল্যাকে ফিরিয়ে আনতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। ব্রহ্মার কন্যাপণ শুনে তাই তাঁর মুখে একটুকরো হাসি খেলে গেল। গোহাল থেকে সুরভিকে বাইরে এনে তাকে প্রদক্ষিণ ও প্রণাম করে তিনি রওনা দিলেন ব্রহ্মলোকে।

এদিকে অহল্যার রূপে ত্রিজগৎ মোহিত। দেবাসুর-মনুষ্যের সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। কিন্তু এসে দেখলেন ত্রিলোকপ্রতিভূ গোমাতা সুরভিকে প্রদক্ষিণ করে পণ জিতে কন্যা নিয়ে চলে গেছেন মহর্ষি গৌতম।

ইন্দ্রের অহমিকায় বড্ড লাগল। তিনি দেবরাজ। স্বর্গ- মর্ত্য-পাতালে সমস্ত শ্রেষ্ঠ জিনিসে তাঁরই অগ্রাধিকার – এ জাতীয় একটা ধারণা তাঁর আছে। তাছাড়া অহল্যার রূপ তাঁকে পাগল করেছে। যেনতেনপ্রকারেণ এ রমণীরত্ন তাঁকে পেতেই হবে, - এই ধারণা থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছেন না তিনি।

এদিকে অহল্যা ফিরে এসেছে গৌতমগৃহে। চিরকাল একলা আশ্রমে পালিত হবার কারণে বিবাহ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা তার ছিল না। সে হয়ত খুশিই হয়েছিল তার শৈশবের পরিচিত আশ্রয়ে ফিরে এসে। সে তার নিত্যকর্মে যোগ দিল আগের মতোই।

আর গৌতম? আজীবন কঠোর ব্রহ্মচারী তিনি। কিন্তু জাগতিক রীতি সম্পর্কে তিনি অবহিত। বিবাহিতা স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে তাঁর সম্যক ধারণা আছে। কিন্তু দীর্ঘ ব্রহ্মচর্য এবং উপাসনার যে জীবনকে এতদিন শ্রেয় বলে মেনে এসেছেন, এই প্রায় প্রৌঢ় বয়সে সেখান থেকে বিচ্যুত হওয়া তাঁর পক্ষে সুকঠিন। হয়ত প্রর্থিতও নয়। তাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে দীর্ণ হতে থাকেন ঋষি। চিরসৌম্য শান্ত মানুষটি তাই মাঝে মাঝেই মেজাজ হারান। সামান্য ত্রুটিতেই অহল্যার কপালে জোটে তীব্র তিরস্কার।

অহল্যা বোঝে না তার কী অপরাধ। তবে আজকাল তারও বড় ভুল বেড়েছে। জলে নিজের ছায়া দেখে নিজেই আনমনা হয়ে যায়। জল ভরে আনতে দেরি হয়ে যায় প্রায়ই। পুজোর ফুল সাজাতে গিয়ে কখন যেন দু একটি ফুলে তার কেশদাম সেজে ওঠে। অবসর সময়ে হয়ত গড়ে নেয় ফুলের মালা কিংবা পুষ্পকঙ্গন। যতই সুন্দতরা হয়ে ওঠে অহল্যা, ততই তিরস্কারে ধিক্কৃত হয় বেচারী।

ইন্দ্র রোজ চলে আসেন তপোবনে। গোপনে লক্ষ্য করেন অহল্যাকে। তার সৌন্দর্যে, ব্যক্তিত্বে আরও মোহাবিষ্ট হন। অহল্যা-গৌতমের বিচিত্র দাম্পত্যও চোখ এড়ায় না তাঁর। দিন দিন চঞ্চল হয়ে ওঠেন দেবরাজ। ঋষির অভিশাপের ভয় তাঁকে সামনে আসতে দেয় না, আর অহল্যার অমোঘ আকর্ষণ তাঁকে ফিরে যেতে দেয় না।

এই দোলাচলে দুলতে দুলতে ইন্দ্র একদিন মরিয়া হয়ে উঠলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন রোজ সকালে নদীতে স্নান আহ্নিক সেরে তবে প্রাত্যহিক পূজায় বসেন ঋষি। আর নদীতীরে অনেকখানি সময় তিনি নির্জনে জপতপ করেন। এই সময়টাই কাজে লাগালেন দেবরাজ। একদিন সকালে মহর্ষি নদীর দিকে রওয়ানা হবার পরে গৌতমের ছদ্মবেশ ধরে তিনি কুটিরে প্রবেশ করলেন। অহল্যা অসময়ে স্বামীকে দেখে অবাক ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল – মুনিবর অসুস্থ হয়ে পড়লেন কি? গৌতমরূপী ইন্দ্র জানালেন, শরীর নয়, চঞ্চল হয়েছে তাঁর মন। অহল্যার পদ্মপলাশের মতো চোখ, ভ্রুয়ের বিভঙ্গ, ক্ষীণ কটি তাঁকে নদীপথ থেকে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করেছে। চমকে ওঠে অহল্যা। গৌতম বলছেন একথা! “ঈশ্বরের চেয়েও প্রাপণীয় অহল্যা”- একথা বলছেন সেই মহান ঋষি? সন্দেহে তীব্র হয় অহল্যার চোখ। আর সেই সরল সত্য চোখে ধরা পড়ে যায় ইন্দ্রের ছদ্মবেশ। কঠোর তিরস্কারে বিদ্ধ করে তাঁকে। কিন্তু চৌষট্টি কলাভিজ্ঞ দেবরাজকে কিভাবে প্রতিহত করবে এই সরলা নারী? জীবনে যে এই প্রথম সে শুনছে যৌবনের জয়গান।

“তোমার পরশ অমৃতসরস, নয়নে তোমার দিব্য বিভা” – নদীর জলে নিজের যে ছবি দেখতে দেখতে সে আনমনা হয়ে যেত, ইন্দ্রের চোখে, তার বাচনিতে সেই রূপমুগ্ধতার প্রকাশ তাকে নির্বাক করে দিল। জীবনে প্রথম পাওয়া অনুরাগের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল তার তনুদেহ। শুধু তাকে একবার চোখের দেখা দেখতে, তার কাছে আসতে প্রতীক্ষারত যে প্রেমিক, তাকে ফেরাতে পারল না অহল্যা। সমস্ত দেহ-মন-প্রাণ দিয়ে সে অনুভব করল জীবনের অন্য এক সত্যরূপ।

সময়ের টুকরোগুলো ছোট্ট ছোট্ট বলের মতো গড়িয়ে গেল এদিক ওদিক। তবু কোনও এক সময় ঝড় থামল। ইন্দ্র জানেন এবার তাঁকে যেতে হবে। কিন্তু বহু প্রতীক্ষিত মিলনে সময়ের হিসেবে কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। চলে যাবার পথে তিনি মুখোমুখি হলেন গৌতমের। সত্যদ্রষ্ট্রা ঋষির অগোচর কিছুই রইল না। ক্রুদ্ধ ঋষির অভিশাপে লিঙ্গ স্খলিত হলো তাঁর। আর সারাদেহে এক হাজার স্ত্রীযোনিচিহ্ন ফুটে উঠল। লজ্জায় ইন্দ্র অজ্ঞাতবাসে মুখ লুকোলেন।

আর অহল্যা? সরল সত্যভাষিণী মেয়েটি সত্যি কথাই বলেছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করবে কে? স্বেচ্ছায় এক প্রণয়ীকে গ্রহণ করার মতো দুঃসাহস করতে পারে যে নারী, তাকে আর কিই বা তিনি করতে পারেন পাষাণ করে দেওয়া ছাড়া? এই অনিন্দ্যসুন্দর রূপরাশি দেখতে পাবে না আর কেউ। এই সত্যযুগ পার হয়ে ত্রেতাযুগে সেই কবে শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে আসবেন, তাঁর পাদস্পর্শে মুক্তি ঘটবে এই পাপীয়সীর। ততদিন শুধু বায়ুভক্ষণ করে প্রতীক্ষা করবে হতভাগিনী।

রাজসিংহাসন খালি থাকলে বড় বিপদ। দেবকুল ধরে পড়লেন গৌতমকে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে ইন্দ্রকে ক্ষমা করলেন ঋষি। হাজার যোনি হাজার চক্ষুতে পরিবর্তিত হলো। পুরুষত্বও ফিরে পেলেন সহস্রলোচন। শাপে বরই হলো বরং তাঁর।

আর অহল্যা? সে তো সামান্য এক নারী মাত্র। তাই সে অপেক্ষা করে রইল। একযুগ শেষ হলো। নতুন যুগপুরুষ জন্ম নিলেন। তিনি বড় হবেন, বনবাসে যাবেন, তবে না তাঁর পাদস্পর্শে অহল্যার মুক্তি?

তাই হলো। পাষাণরূপী অহল্যার গায়ে পা ঘষলেন শ্রীরাম। কি জানি, হয়ত বনপথে চলতে গিয়ে কোনও ময়লা লেগেছিল তাঁর পায়ে! সেই পায়ের ছোঁয়ায় মানুষীরূপ ফিরে পেল অহল্যা। শ্রীরামচন্দ্রের বন্দনা করল সে। এবার তাকে ফিরে যেতে হবে ঋষি গৌতমের কাছে। মহান ঋষি বিষ্ণুর আদেশে তাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়েছেন!

ভাগ্যের কি পরিহাস! পরপুরুষকে স্পর্শ করার জন্য পাথর হয়েছিল যে নারী তাকে জীবনছন্দে ফিরিয়ে আনতে সেই পুরুষেরই ছোঁয়ার প্রয়োজন হলো। প্রেমের স্পর্শে পাথর মেয়ে প্রাণ ফিরে পেল অবহেলার পাদস্পর্শে!

তৎকালীন সমাজে নারীর অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য এই কাহিনী আমার চোখে একটি দিগ্দর্শকের কাজ করে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, পাষাণী অহল্যা কি মনুষ্যরূপ ফিরে পেয়ে সত্যি বেঁচেছিল? নাকি অন্যের ইচ্ছের এক চলমান পুতুল হলো বলেই সে ফিরে যেতে পারল তার পতিগৃহে? ইন্দ্রের কামনা আর গৌতমের রোষ – এ দুয়ের মাঝে পড়ে অহল্যার নিয়তি পাষাণ হয়ে যাওয়া।

0 comments: