0

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ২৬

সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়


Diary Entry - 24
16th. October, 1942, Friday

প্রিয় কিটী, 

আমি সত্যিই এখন খুবই ব্যস্ত। বলতে পার এক সেকেন্ডের জন্যেও আমার দম ফেলার ফুরসৎ নেই। আমি বাবার "আশ্রয়ে" (কিংবা বলতে পার প্রশ্রয়ে) আবার পড়ায় মন দিয়েছি। অথবা বলতে পার, মন দিতে বাধ্য হয়েছি। তুমি জান, আমি ইতিমধ্যে " La Belle Nivernaise- The Story of an Old Boat and Her Crew" ( বইটার পরিচয় ২২ নম্বর এন্ট্রিতে দেওয়া হয়েছে। এখানে বইটির প্রচ্ছদের একটি ছবি দেওয়া হল ---- অনুবাদক ) বইটার গোটা একটা অনুচ্ছেদ অনুবাদ আমি করে ফেলেছি। বিশ্বাস করো, একদম খারাপ হয়েছে, এ’কথা বলতে পারবে না। 


অনুবাদ করতে গিয়ে বেশ কিছু নতুন শব্দ পেছিলাম। সেই শব্দগুলো প্রথমে আলাদা করে লিখে, তারপর সেইগুলোর অর্থ আলাদা করে অন্য জায়গায় ব্যাখ্যা করে লিখেছি। এরপর আমার জীবনের সবচেয়ে জঘন্য যে বিষয়টা সেটার কথা বলি। সেটা হল অঙ্ক। জঘন্য হওয়া সত্ত্বেও ইতিমধ্যে আমি বেস কিছু অঙ্কও করেছি।সবশেষে আর প্রায় তিন পাতা ফরাসী ব্যকরণ মুখস্থ করেছি।ফরাসী ভাষার ব্যাকরণ খুব একটা সহজ নয়। তাই বিষয়টা বলতে যত সহজ-সরল লাগছে, করতে আদৌ ততটা সহজ বলে মনে হয় নি, কিংবা আমিও মনে করি নি। বাবার কাছে আমার প্রথমেই একটা আবেদন ছিল। আমি রোজ অঙ্ক করব না। সপ্তাহে দু-এক দিন করব।কারণ রোজ যদি অঙ্ক করতে হত, তা’হলে আর কিছু পড়ার মতো মন থাকত না। মোটামুটি ঔখানেই পড়া বন্ধ করে বিশ্রাম নিতে হত। বাবা নিজেও জানে অঙ্ক বিষয়টা অতি জঘন্য আর জটিল বিষয়। ওটা কিছুতেই রোজ করা যায় না। বাবারও কোনদিন অঙ্ক করতে ভাল লাগত বলে মনে হয় না। তা’না হলে কেউ এককথায় আমার প্রস্তাবে রাজি হয়? একটা সত্যি কথা শুনবে? আমি কাউকে কোনদিন কথাটা বলিও নি, আর কাউকে এই কথাটা বুঝতেও দিই নি। আমার বাবা অঙ্কে নিজেও খুব একটা দক্ষ ছিলেন না। তবে বাবা বুদ্ধি করে সেটা কাউকে বুঝতে দিতেন না।তবে এটা ঠিক যে, মাঝে মাঝে আমি বাবার চেয়ে দ্রুত অঙ্ক করে দিতে পারতাম।বাবা তার জন্যে আমার প্রশংসাই করতেন। তাই বলে তুমি আবার মনে করে বস না যে আমি বা বাবা দু'জনেই অঙ্কে খুব ভাল। যখন তখন অঙ্ক করে দিতে পারি। বরং তার উল্টোটাই। মাঝে মাঝেই আমাকে বা বাবাকে অঙ্ক করার জন্যে বা মেলানোর জন্যে মারগটের শরণাপন্ন হতে হত।এ’কথাটা গোপন করার কোন মানেই হয় না, যে মারগট আমাদের মধ্যে অঙ্কে বেশই ভাল ছিল, অন্ততঃ আমাদের চেয়ে তাড়াতাড়ি অঙ্ক কষে দিতে পারত। অবশ্য এটাও ঠিক, মারগট আমায় বা বাবা বললে বাবার জন্যে অঙ্ক কষে দিলে, কোন রকম অহংকার দেখাতো না।এমনিতেই সে অবশ্য চুপচাপ।আমার মতো ছটফটে বা বাচাল স্বভাবের নয়। যারা চুপচাপ থাকে তারা অঙ্ক তাড়াতাড়ি করতে পারে। কারণ বাবার কাছেই শুনেছি ভাল অঙ্ক করার জন্যে ধীরস্থির হতে হয়। যেটা মারগট ছিল। তবে একটা বিষয়ে আমি তোমায় আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বলেতে পারি। শর্টহ্যান্ড লেখার ব্যাপারে আমি নিশ্চিতভাবে পিটার আর মারগটের থেকে অনেক এগিয়ে। এই ব্যাপারে মারগটের ধীরস্থির হওয়ার কোন বিশেষ ফল হয় নি। 

গতকাল আমি The Assault বইটা শেষ করলাম। বইটা অবশ্যই মনোরঞ্জক এবং ভাল। মানে, তুমি পড়তে শুরু করলে আর ছাড়তে পারবে না যতক্ষন না শেষ হচ্ছে। তবে Joap ter Heul (১৬ নম্বর এন্ট্রিতেও এই বইটার কথা বলা হয়েছে --- অনুবাদক ) এর মতো মনোরঞ্জক কখনই নয়। সেটা এর চেয়েও ভাল। আমার মতে Cissy van Marxveldt একজন প্রথম শ্রেণীর লেখিকা। সুদূর ভবিষ্যতে আমি আমার ছেলে মেয়েদেরও এই বইটা পড়তে বলব। তাতে অন্ততঃ তারা তাদের মায়ের রুচিটা বুঝতে পারবে। এবং “মা” হিসাবে, আমার সম্পর্কে একটা বিশেষ ধারণা গড়ে উঠবে। 

মা আমি আর মারগট আবার কাছাকাছি চলে এসেছি।আমাদের মধ্যে যে বিরোধগুলো ছিল, তার সবকিছু মিট্মাট হয়ে গেছে,কি’না, তা’বলতে পারব না। তবে আমরা কেউই আর ঐসব বিরোধ নিয়ে ভাবছি না। এখন ত' আমি ওদের সাথেই প্রায় গা' ঘেঁষাঘেষি করেই থাকি। সত্যিই ত' ওরা ছাড়া আমার আপনজন বলতে আর কে’ই বা আছে ? এটা কেন যে আমি মাঝে মাঝে ভুলে যাই, সেটাই আমি বুঝতে পারি না। আসলে আমি কারুর কথা সহ্য করতে পারি না।আমার একটা স্বাধীন মত আছে, সেটা কেউ যদি চেপে দিতে চেষ্টা করে, তখনই আমি রেগে যাই।কিন্তু যাই হোক না কেন, ওদের সাথে থাকতেই আমার বেশী ভাল লাগে।সেটাই ত’ স্বাভাবিক। ওরা ত’ আমার বোন আর মা। গতকাল সন্ধ্যেবেলা ,আমি আর মারগট একই বিছানায় শুয়েছিলাম। শুয়ে শুয়ে গল্প করছিলাম। শুধু কি শুয়েছিলাম আর গল্প করছিলাম, প্রায় সারাটা সন্ধ্যে বিছানাটাকে নিয়ে দু'জনে ধামসা ধামসি করেছি। অবশ্যই প্রধান ভূমিকা ছিল আমার। এ’সব ব্যাপারে যে আমার উৎসাহের কোন কমতি থাকবে না, সে’রকম সন্দেহ কারুর থাকা উচিৎ নয়। তবে দু'জনে মিলে সারা সন্ধ্যে যে ভীষণ মজা করেছিলাম, এটা সত্যি।অনেকদিন পর মনে হচ্ছিল মারগটকে আবার আমি আগের মতো করে পাচ্ছি। মারগট হঠাত আমায় জিজ্ঞাসা করল, সে আমার ডাইরিটা পড়তে পারে কি'না ? আমি বললাম, "হ্যাঁ”।সত্যিই ত আমার ডাইরি সে কেন পড়তে পারবে না? সে’ত’ আমার দিদি।আমার সবকথাই সে জানে। তারপর আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। আমি মারগটকে জিজ্ঞাসা করলাম, বড় হয়ে ও' কি হতে চায় ? মারগট কোন উত্তর না দিয়ে শুধু আমার দিকে তাকেয়ে মিটি মিটি করে হাসছিল। ঠিক যেন, বিষয়টা ওর একান্ত গোপন ব্যাপার।আমি কিন্তু মারগটের মতো চুপ করে ছিলাম না।আমি বেশ জোরের সঙ্গেই বলে দিলাম,”আমি বড় হয়ে শিক্ষক হতে চাই।“ আমি জানি না, আমি আদৌ কোনদিন হতে পারব কি'না ? তবে, "হতে চাই" এই চিন্তাটা করতে দোষ কি? না হতে পারলে হব না, ব্যাস ফুরিয়ে গেল। কিন্তু তার জন্যে, আমার কোন ইচ্ছা থাকতে পারে না? আসলে অন্যে কে কি হতে চায়, এ'ব্যাপারে বেশী কৌতূহল না থাকাই শ্রেয়। তবে আমি ত’ আমার ব্যাপারে ভাবতেই পারি, কিংবা স্বপ্নও দেখতে পারি, যে আমি শিক্ষিকা হয়েছি। তাই বলছিলাম, আমি কিন্তু কি' হতে চাই সেটা ভাবতে দোষ কোথায়? হওয়া বা না হওয়াটা ত পরের ব্যাপার। আগে ত’ ভেবে নিই। আর কিছু না হোক স্বপ্নটা ত’ দেখে নি। 

আজ সকালে আমি অকারণে পিটারের বিছানায় শুয়েছিলাম (এটা বোধহয় ঠিক করি নি। বাবা আর মায়ের দিকে তাকিয়ে সেটাই মনে হল। কিন্তু কেন, তা আমি জানি না)।পিটার তার জন্যে আমায় তাড়া করে এসেছে। আমি জানি ওর বিছানায় শুয়ে আমি ঠিক করিনি। বিশেষকরে ওকে না জানিয়ে। পিটার অবশ্য এ’সব কিছু না বলেই, আমার দিকে তেড়ে এল। আমি ওর বিছানায় শুয়েছি ব'লে,আমার উপর রেগেই খাপ্পা। তবে আমি ওর রাগকে খুব একটুও ভয় পাই না। ওর উচিৎ ছিল অন্ততঃ একবার আমায় বন্ধুত্ত মূলক মনোভাব দেখানো। কারণ আর যাই হোক না কেন, গতকালই ওকে আমি একটা গোটা আপেল,খাওয়ার জন্যে দিয়েছিলাম। 

মারগটকে সেদিন হঠাতই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "আচ্ছা, আমি কি দেখতে খুব খারাপ ?" মুচকি হেসে মারগট উত্তর দিয়েছিল, আমার মধ্যে না'কি বেশ একটা 'আলগা চটক আছে।' উত্তরটা, আমি যা জানতে চেয়েছিলাম, আদৌ তার মত নয়। উত্তরটা অস্পষ্ট উত্তর। তবে মারগট বলেছিল আমার চোখদুটো না'কি সুন্দর। এই উত্তরটাও অস্পষ্ট। তোমার কি মনে হয় ? 

আজ এপর্যন্তই থাক। আবার পরে লিখব। 




ইতি,

অ্যানি। 


অনুবাদকের সংযোজনঃ- 

Joop ter Heul:- জোপ – টার- হিউল মূলত একটি কাল্পনিক চরিত্র। Setske de Haan ( 24 November 1889 to 31 October 1948) ওরফে ক্রীসী ভ্যান মারক্সভেল্ড ( Cissy van Marxveldt – এই নামেই তিনি জোপের সম্পর্কে তাঁর বই লিখতেন ) এই কাল্পনিক চরিত্রটির স্রস্টা। চরিত্রটি মূলত কিশোর কিশোরীদের কথা ভেবে সৃষ্ট। ক্রিসী তথা সেতস্কী সৃষ্ট জোপ ছিল এক কল্পনা প্রবণ, একগুঁয়ে এবং জেদী মেয়ে। অ্যানি চরিত্রটির সঙ্গে তার নিজের মানসিকতার সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিল। তাই তার চরিত্রটি হয়ে উঠেছিল এত প্রিয় চরিত্র। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে ক্রিসী বা সেতস্কী জোপকে নিয়ে প্রায় চারটি বই লেখেন। প্রথমটি কিশোরীর জোপের স্কুল জীবন; দ্বিতীয়টি তার বয়ঃ সন্ধিকালের আখ্যান ; তৃতীয়টি তার বিবাহ উত্তর জীবন ; চতুর্থটি তার ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার জীবন । এই প্রায় কুড়ি বছর পর পঞ্চম বইটি লেখেন। প্রথম চারটি বইয়ের কথা অ্যানির সঙ্গে সম্পর্কিত ভাবে এখনও স্মরণ করা হয়। এটা মনে করা হয়তঃ বাহুল্য হবে না যে, অ্যানির জন্যেই জোপ-টার-হিউলের বইগুলো এত জনপ্রিয় হয়েছিল। নীচে জোপ টার হিউলের একটি জনপ্রিয় বইয়ের ছবি দেওয়া হল। 



0 comments: