0

গল্প - দেবদত্তা ব‍্যানার্জী

Posted in

গল্প


ইন্দ্রজাল
দেবদত্তা ব‍্যানার্জী



বহুদিন পর সকালবেলা ভাঙ্গা ট্রাঙ্ক থেকে নীল ভেলভেটের ওপর জরীর কাজ করা জোব্বাটা বার করে রোদে দিয়েছিল মানিক। ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বার হচ্ছিল রঙীন বল, পালকের ঝারণ, কাগজের মালা, রঙীন ফুলের তোড়া আরো কত কিছু। বারান্দার এককোণে চট পেতে বইখাতা নিয়ে বসেছিল রোগা রোগা দুটো ছেলে মেয়ে। অপার বিস্ময় চোখে মেখে ওরা তাকিয়ে ছিল মানিকের ট্রাঙ্কের দিকে। এ যেন আলিবাবার সম্পদ। 
-"বলি সক্কাল বেলা কাজ কাম নাই ? আর তোরাও পড়া ছাইড়া কি দেখস অমন হাঁ কইরা ? যেমন বাপ তেমনি হইসে ছাওল গুলান....." পলার চিৎকারে একচিলতে উঠোনের কোনে যে মেনী বেড়ালটা বসে রোদ পোহাচ্ছিল সেটা পালিয়ে গেল। ভুকু কুকুরটা আম গাছের কোনায় বসে ছিল, সেটাও বেরিয়ে গেলো। তুলসি মঞ্চের সামনে একটা চরুই আর দুটো শালিক বসেছিল, তারাও উড়ে গেলো। তনু আর মনা গরগর করে পড়তে শুরু করল। আর মানিক একটা রংচঙে লাঠি হাতে নিয়ে মন দিয়ে দেখতে শুরু করল।
-"আইজ ঘরে চাল বারন্ত। বাজার না আইলে খাওন জুটবে না কইয়া দিলাম।" গজ গজ করতে করতে পলা এক তাল কাপড় নিয়ে কলতলায় বসে কাচতে শুরু করল।
মানিক তাড়াতাড়ি জিনিসগুলো গুছিয়ে উঠে পরেছিল। প্রথম ঘরটার দরজার পিছনে ঝোলানো রঙচটা প‍্যান্টের পকেটে কয়েকটা খুচরো পয়সা আর একটা ছেড়া কুড়িটাকার নোট পেলো। গত দু দিন ইনকাম নেই প্রায়। আজকাল লোকজন কেমন বদলে গেছে। সবাই ব‍্যস্ত। মানিক পথে ঘাটে ট্রেনে ম‍্যাজিক দেখিয়ে বেড়ায়। ওর বাবা পরাগ সরকার ছিল নাম করা ম‍্যাজিশিয়ান। কত জায়গা থেকে ডাক আসত। কত সন্মান ছিল ওদের। এই দূর্গানগরকে সবাই ম‍্যাজিশিয়ান পরাগ সরকারের জন‍্যই চিনত একদিন। সারা ভারত বাবার সাথে খেলা দেখিয়েছে একদিন মানিক। 
কিন্তু যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেককিছুই বদলেছে। আজকাল ম‍্যাজিক কেউ দেখে না। মনোরঞ্জনের হাজারটা উপকরণ ছড়ানো চারদিকে। শেষের দিকে বাবাও এটা বুঝেছিল। মানিককে বলেছিল চাকরির চেষ্টা ক‍রতে। কিন্তু উচ্চমাধ‍্যমিক পাশ ছেলেকে কে কাজ দেবে। তাও বাবার পরিচিতি কাজে লাগিয়ে একটা কারখানায় কাজ পেয়েছিল মানিক। ছুটির দিন গুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ম্যাজিক দেখাতো। 
আজ তিন বছর ঐ কারখানাও বন্ধ। ট্রেনে, ষ্টেশনে, রাস্তার মোড়ে ম‍্যাজিক দেখাতে শুরু করেছিল মানিক। তবে এতেও প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কতবার পুলিশ ভেঙে দিয়েছে জিনিস। কতবার ভিড় ট্রেনে অন‍্য হকারদের সাথে বচসা হয়েছে। প্রথম প্রথম স্কুলে বা বাচ্চাদের জন্মদিনে ডাক পেত মানিক। আজকাল আর তাও পায় না। 


পলার গয়না বেচে, ঘরের কিছু পুরানো জিনিস বেচে কোনোরকমে চলছিল সংসারটা। পাড়ার মুদি দোকানে ধার, বাচ্চা গুলোর বই খাতা কেনা হয় না ঠিকমতো। 


বাজারের কাছটায় এসে মানিক এদিক ওদিক দেখে। জামাল ছিল ওর স্কুলের বন্ধু। ঐ কোনের মুদি দোকানটা ওদের দুই ভাইয়ের। জামালের দাদা আর দুজন কর্মচারী দোকাল সামলাচ্ছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় মানিক। 
পাঁচ কেজি চাল, ডাল, ডিম, সয়াবিন আর তেল নিয়ে পকেটে হাত দিয়ে বলে -"এমা, টাকার ব‍্যাগটা বোধহয় ঘরেই ফেলে এলাম। এখন ..... আজ আবার তাড়া আছে। দমদমের একটা স্কুলে শো আছে আজ। .... জামাল নাই ?" নিজের অভিনয়ে নিজেই চমকে ওঠে মানিক!!
সাকিলদা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে -"পরে দিয়ে যেও মনে করে। আজ রবিবার.... স্কুল ছুটির দিন । "


মানিক একটা বোকা বোকা হাসি দিয়ে ব‍্যাগ নিয়ে হাঁটা দেয়। ওধারে শাক পাতা নিয়ে বসেছিল কয়েকজন। একটু বেথুয়া শাক আর অল্প আলু পেয়াজ নিয়ে বাড়ির পথ ধরে সে।


দুপুরে বেথুয়া শাক আর ডিম কশা দিয়ে ভাত খেতে খেতে ছেলে মেয়েকে গল্প করে ম‍্যাজিক শোয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কত কি খেত একসময়। ছেলে মেয়ে অবাক হয়ে শোনে। 


-"মানিক আছে নাকি ঘরে?" স্থানিও পার্টির ডানহাত ভবেশ দত্তর ডাকে বেরিয়ে আসে মানিক। পার্টির তিনজন লোককে দেখে অবাক হয়। 
-"পরশু বিকেলে মেলার মাঠে একটু ম‍্যাজিক দেখাতে হবে। যার আসার কথা ছিল আসবে না। তা একঘন্টার শো । পারিশ্রমিক পাবে। " ভবেশ দত্তর চোখ মানিককে ভেদ করে চারপাশে পাক খায়। পলা আর দুই ছেলে মেয়েও বেরিয়ে এসেছিল। ভবেশের শকুনের চোখ। পলা দরজার আড়ালে ঢুকে দাঁড়ায়। 
গদগদ মানিক বলে -"বসুন না দাদা!! আপনি এসেছেন এতো সৌভাগ‍্য। ...."
-"তাহলে ছটা নাগাদ চলে এসো। " বাড়িটা ভালো করে খেয়াল করে সাঙ্গপাঙ্গো সহ চলে যান ভবেশ দত্ত। 


মানিক পরম উৎসাহে ভাঙ্গা ট্রাঙ্ক টেনে প্রাকটিশে মেতে ওঠে। বারো বছরের তনু আর আট বছরের মনা প্রবল উৎসাহে এটা ঐটা এগিয়ে দেয়। এভাবেই মহরা চলে।


এতো ঠাণ্ডায় মেলার মাঠে সাকুল‍্যে এগারো জন দর্শক দেখে একটু ঝিমিয়ে পরে মানিক। তবুও টাকার চিন্তা করে খেলা দেখাতে শুরু করে। আরো দু চার জন এসে জোটে। 


তনু আর মনার মনে হয় ঐ নীল জোব্বা পরা লোকটা ওদের বাবা না, কোনো রূপকথার দেশের লোক। অবাক হয়ে ওরা খেলা দেখে।কি ভাবে ফুল গুলো রঙ বদলায়। দড়িটা হঠাৎ শক্ত হয়ে যায় বাঁশের মত। কলসির জল শেষই হয় না।
শীতে কাঁপতে কাঁপতে এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে বাবার সাথে বাড়ি ফেরে ভাই বোন। পলার হাতের গরম পাতলা খিচুরি অমৃত মনে হয়। রাতে কড়কড়ে পাঁঁচশো টাকার নোটটা পলাকে দিয়ে মেলায় পাওয়া উত্তরিওটা পলার গলায় পরিয়ে মিটিমিটি হাসে মানিক। বহুদিন পর পলাকে আবার নতুন করে আবিস্কার করে। পলাও আজ মুখ না করে ধরা দেয় মানিকের আহ্বানে। ছেড়া কাঁথার নিচে ঝড় ওঠে, একটু পরে রতিক্লান্ত তৃপ্ত শরীর দুটো শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখে নতুন দিনের।


ছেলেটার জ্বর এসেছিল ঠাণ্ডা লেগে। এক কাপ গরম লাল চা আর এক মুট মুড়ি ওর সামনে রেখে পলা উঠে আসে। মানিক আজ কাজে বেরিয়েছে। নীল জোব্বাটা রোদে দিয়েছিল সকালে। জায়গায় জায়গায় ফেঁসে গেছে পুরানো জোব্বা। তার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে আলপোনা কাটছে ভাঙ্গা বারান্দায়। তনু এক মনে সেদিকে তাকিয়ে কি ভাবছে। একটা বাইক জোড়ে ব্রেক করে ওদের বাড়ির সামনে।


-"মানিক আছে ? ও মানিক?" আবার ভবেশ দত্তর ডাকে তনু বলে -"বাবা কাজে গেছে। "
-"ও, ফিরলে একবার পার্টি অফিসে আসতে বলো ওকে।" বাইকের আওয়াজ তুলে এগিয়ে যায় ভবেশ দত্ত। অজানা ভয়ে কেঁপে ওঠে পলা। 


রাতে মানিক বেশ খুশি মনেই বাড়ি ফিরেছিল। বহুদিন পর ভালো রোজগার হয়েছিল। ফেরার পথে ভবেশের লোক ওকে পার্টি অফিসে নিয়ে গেছিল। ওখানেও ভালোই কথা হয়েছে। স্টেশনের পাশের হোটেল থেকে দু টুকরো মাংস আর আলু ঝোল কিনে এনেছিল ফেরার পথে । জ্বরের মুখেও ছেলেটা একটা রুটি খেয়েছিল ঐ ভাড়ে চুবিয়ে।
রাতে শুয়ে পলাকে মানিক জানায় ভবেশ দত্তের প্রস্তাব। পলা শিউরে ওঠে। ওর শকুনের চোখ যে এদিকে পড়েছে পলার মনেই হয়েছিল। বলে ভবেশকে না করে দিতে। 
কিন্তু মানিক বলে এতে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। কত জায়গায় হচ্ছে এসব। এককালীন মোটা টাকা দেবে। বাড়িটাও রিপিয়ার করে দেবে। মাসে মাসে টাকা আসবে। তাছাড়া ভবেশ খুশি থাকলে মানিক কাজ পাবে। আজকাল পার্টির অনুষ্ঠান পাড়ায় পাড়ায়। পলা শক্ত হাতে মানিককে জড়িয়ে ধরে বলে-" ঘরে দুইটা ছাওয়াল। শুনছি এতে শরীলের ক্ষেতি হয়! কি দরকার। "
-"আরে কে বলেছে এসব! এখন ঘরে সেধে আসা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলবো বলছো?"
পলাকে আদর করতে করতে মানিক বলে-" এবার আচ্ছে দিন আসবে। ছেলে মেয়ে দুটোকে পেট ভরে খেতে দেবো। পড়াবো। " পলার শুকনো বুকে মুখ গুজে আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখে সে।




পরদিন সকালেই ভবেশ লোকজন নিয়ে এসে মাপঝোঁক শুরু করে।
মানিক ছেলে মেয়েকে বলে -''এবার হবে আসল ম‍্যাজিক!! দেখবি কি হয় !! " জ্বর গায়ে মনা পরম উৎসাহে উঠে বসে। তনু বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। পলা আড়াল থেকে দেখে। সবাইকে ও চেনেও না। ছেড়া শাড়ি পরে বাইরে যেতে লজ্জা করে।
ভবেশ দত্ত বলেছিল মোবাইল টাওয়ার বসবে ওদের বাড়িতে। ছাদটা পাকা করে দেবে সেই কোম্পানি। আসেপাশে ফাঁকা জায়গা তেমন নেই। দু ধারেই দোতলা বাড়ি। ওদের বাড়ির সাথেই একটু ফাঁকা উঠোন আছে। এই জায়গাটাই পছন্দ কোম্পানির। ভবেশ আবার ওদের কন্ট্রাকটার!!


ছেড়া কাপড়টা একটু গুছিয়ে নেয় পলা। ভয়ে ভয়ে দরজার পাশ থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করে যে বাচ্চাদের টাওয়ারের নিচে রাখলে ক্ষতি হবে না তো কোনো? 
ভবেশের লোলুপ দৃষ্টি চাটতে থাকে পলাকে। বলে-" কি যে বলো বৌঠান? কিছুই হবে না। আপাতত কিছুদিন তোমাদের অন‍্য জায়গায় থাকার ব‍্যবস্থা করবো। ছাদটা ঢালা হয়ে গেলেই ফিরে আসবে। "


ওরা চলে যেতেই পলা ফেটে পরে মানিকের ওপর। বলে -"আমার মোটেই ভালো ঠেকতাছে না কইয়া দিলাম। ওর লগে মিশন ভালো না। "
জ্বরের ঘোরে কাঁপতে থাকা ছেলেকে নিয়ে ব‍্যস্ত হয়ে ওঠে পলা। বিকেলের দিকে হাসপাতালে দিতে হয় মনাকে। জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বকতে থাকে মনা।বলে -"বাবা, ম‍্যাজিক করে জ্বর ভালো করে দাও আমার। " কখনো বলে -"বাবা ম‍্যাজিক করে একটা কমলা বা আপেল এনে দাও। আমি খাবো।"
তনু ভাই আর মাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। ম‍্যাজিক দেখানোর রঙচঙে লাঠিটা হাতে করুণ চোখে দাঁড়িয়ে থাকে মানিক। 


তিনদিন যমে মানুষে টানাটানির পর রুগ্ন ছেলে নিয়ে বাড়ি ফিরে পলা দেখে আম আর পেয়ারা গাছটা কাটা গেছে‌। গোলাপ আর কুন্দ ফুলের ঝারটাও নেই। রাস্তা থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে ভগ্নপ্রায় বাড়িটা। মানিক বলে দুদিনের মধ‍্যে ওদের উঠে যেতে হবে। ভবেশ দত্ত ঘর ঠিক করে দিয়েছে রেল লাইনের পাশেই। অনেক টাকাও দিয়েছে। পলার দু চোখে জলের ধারা।ও জানত ঐ টাকাতেই ছএলেটার চিকিৎসা হয়েছে। কিন্তু ফল গাছ দুটো ও বিয়ে হয়ে এসে লাগিয়েছিল। গাছ দুটোও ওর সন্তানের মতো ছিল। প্রচুর ফল দিত আম গাছটা। বছরে দুবার পেয়ারা হত গাছটায়। সারা রাত ঘুম আসে না পলার। মনে হয় চারদিকে ভবেশ দত্তর চোখ ওকে গিলে খাচ্ছে। মানিক শুধু বলে -"চোখ যখন পড়েছে ওকে দিতেই হবে। না হলে ও জোর করে নেবে। "
সব কিছু বাঁধা ছাদা করে পরদিন শেষবারের মতো বাড়িটার দিকে তাকায় পলা। তুলসি মঞ্চে প্রনাম করে। 


ভাঙ্গা ট্রাঙ্ক আর বাকি জিনিস ঠেলা গাড়িতে তোলা শেষ। হঠাৎ রুগ্ন মনা এগিয়ে যায় বাড়িটার সামনে। ওর হাতে ঐ চকচকে ম‍্যাজিকের লাঠি। বাবার মতো করে লাঠিটা ঘোরায় ও বাড়িটার সামনে তিনবার। বলে -"হোগাস ফোগাস গিলি গিলি ছুঃ "
তিন জোড়া চোখ অবাক হয়ে দেখে। বাড়িটা নতুন হয়ে গেছে, আম আর পেয়ারা গাছটা ফলে ফলে ভরা। বারান্দায় বসে পড়ছে দুই ভাইবোন। পলা মশলা বাটছে। আর মানিক নীল জোব্বা গায়ে ম‍্যাজিক প্র‍্যাকটিস করছে ।

0 comments: