0

গল্প - রঞ্জন চক্রবর্তী

Posted in



গল্প


ভালবাসি
রঞ্জন চক্রবর্তী

কলকাতার বিখ্যাত নিউরোলজিষ্ট ডা: দ্বিজেন চৌধুরি সকাল সকাল বেলা এগারোটার মধ্যে শেষ পেশেন্ট দেখে নিজের চেম্বার থেকে ব্যাগ, কাগজ পত্র গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি অভিমুখে রওনা দিতে যাবে আর তক্ষনি মিস্ সেন মানে ডা: চৌধুরির একেবারে ডান হাত, পটীয়সি অ্যাসিস্ট্যান্ট বা সেক্রেটারি মিস্ চন্দ্রা সেন ঘরে ঢুকে জানাল, "স্যার, ডা: ঘোষের ফোন আছে। মধুছন্দা ঘোষ।" 

"আচ্ছা কানেক্ট কর" বলে নিতান্ত নিমরাজি হয়ে ফোনটা ধরল দ্বিজেন। না, মধু ওর ক্লাসমেট তাই ওর সঙ্গে ফোনে বা সাক্ষাতে আড্ডা মারতে ওর খারাপ একেবারেই লাগেনা। হাজার হলেও ওই একজনের সঙ্গেই ওর একটু মাখামাখি হয়েছিল কলেজে, মানে এন আর এস্ অর্থাৎ নীলরতন সরকার এ। তারপর মধু গায়নাকলজি নিয়ে স্পেশালাইজ্ করল আর দ্বিজু নিউরোলজি নিয়ে। দুজনেরই জমাট প্র্যাক্টিস্ এবং ব্যস্তসমস্ত জীবন তবু বন্ধুত্ব তাদের মধ্যে এখনও অটুট। দুজনের দুটো সংসারে বিয়ে হয়ে যাবার পরেও সামাজিক বা সাংসারিক ভাবে মেলামেশা বহাল। দুজনের পরিবারের সঙ্গেও অদ্ভূতভাবে মনের মিল হয়ে সম্পর্কটা আরও জমাট হয়েছিল। ছুটি ছাটায় দুই পরিবারের মধ্যে আড্ডা দিলেই যেন বেশ একটু রিফ্রেশিং লাগত। তবে সেদিনের কথা আলাদা। সেদিন দ্বিজেনকে বাড়িতে গিয়েই ছুটতে হত রাজধানী এক্সপ্রেস ধরতে। এলাহাবাদের কনফারেন্সে যেতে হত তাকে। কী-নোট অ্যাড্রেসটাই তার। তাই তাড়াহুড়ো করে কাজকর্ম সেরে সকালের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যেতে চাইল যাতে দুপুর আড়াইটের ট্রেনটা তার মিস্ না হয়ে যায়। 

এত ব্যস্ততার মধ্যেও মধু'র ফোনটা ধরে বলল, "হ্যালো, কিরে, কিখবর?"

"ভাল রে। জানি তোর তাড়া আছে। চন্দ্রা বলল আমাকে। তোকে চট্ করে কাজের কথাটা জানিয়ে রাখি। আমার অনেক পুরোন, স্কুলের এক বন্ধু অনীতাকে তোর কাছে পাঠাব। অনীতা মুখার্জি। তুই এলাহাবাদ থেকে ফিরে আয় তারপরে তোর সঙ্গে নাহয় কথা হবে এই নিয়ে। ওরাও কদিন কলকাতার বাইরে গেছে। দুদিন পরেই ফেরার কথা। ওকে একটু হেল্প করিস্। বেচারি একটু বিপদের মধ্যে আছে।"

"হ্যাঁ, নিশ্চয় নিশ্চয়। মনে থাকবে, অনীতা মুখার্জি বললি তো। এখন রাখি?" বলে ফোনটা রেখে নিশ্চিন্তে অফিস বন্ধ করে বেরিয়ে পড়ল দ্বিজেন। সেদিন বিনা কোন অসুবিধায় হাওড়া ষ্টেশনে রাজধানী ধরে এলাহাবাদে চলে গেল দ্বিজেন। পরের দিনটা নানান কাজের ব্যস্ততা, লেক্চার, আলোচনা ইত্যাদির মধ্যে কেটে গেল। আর রাতের রাজধানী এক্সপ্রেসে ফেরত আসবে বলে এলাহাবাদ ষ্টেশনে এসে পৌঁছল দ্বিজেন। ট্রেনটা নির্ধারিত সময়ের প্রায় মিনিট পনের লেট-এ এল। তা রেলওয়েজ এবং ট্রেনগুলোর যা অবস্থা তাতে পনের মিনিটের দেরীকে কিছুই মনে হলো না দ্বিজেনের। বিশেষ করে রাত বিরেতে যখন ট্রেন ধরতে হয়, তখন রাত পৌনে বারটা আর বারটার মধ্যে বিশেষ তফাৎ নেই বলেই মনে মনে ভাবল সে। 

নিজের ফার্ষ্ট এ.সি'র কামরা খুঁজে নিতে অসুবিধে হলনা দ্বিজেনের। চার বার্থের কেবিনে ঢুকে দেখল একদিকের নীচের বার্থে একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক তখনও জেগে বসে একটা বই পড়ছিলেন । তার ওপরের বার্থে কেউ ঘুমোচ্ছিলেন বুঝতে পারল আর উল্টোদিকের ওপরের চতুর্থ বার্থটা দেখল ফাঁকাই। নিজের ছোট্ট স্যুটকেসটা সামলে রেখে ভদ্রলোকের উল্টোদিকে নীচের বার্থে অ্যাটেনডেন্টের করে রাখা বিছানার ওপর বসল দ্বিজেন। চারদিকটায় একটু চোখ বুলিয়ে ব্যাগে গুছিয়ে রাখা নাইট স্যুটটা বার করে বাথরুমে গেল চেঞ্জ করতে। ফিরে এসে লক্ষ্য করল সেই ভদ্রলোকের বইটা সামনের ছোট টেবিলের ওপর উপুড় করে রাখা। হয়ত পড়ার ফাঁকে একটু বিরাম নিচ্ছেন। দ্বিজেন নিজের পরিহিত পোষাকটাকে সযত্নে হুক-এ ঝুলিয়ে বসল আর তখনই লক্ষ্য করল ভদ্রলোকের বইটা একটা বাংলা উপন্যাস। মনে মনে একটু আলাপ করতে চাইলেও এই মাঝরাতে ওপরের বার্থের মানুষটির যাতে ঘুম না ভেঙ্গে যায় তাই চুপ করেই রইল। তারপর অনেক দিনের অভ্যেসমত ব্যাগ থেকে একটা স্কচের বোতল বার করে আগে থেকে রাখা কাঁচের গ্লাসে একটু ঢেলে সামনের ছোট্ট টেবিলটাতে রাখল। হঠাৎ নজর করল যে সামনের ভদ্রলোক তাকে নিরীক্ষণ করে যাচ্ছেন তখন থেকে। আর থাকতে না পেরে বাংলাতেই গলা নামিয়ে দ্বিজেন জিজ্ঞেস করল, "কি, আপনি তো দেখছি জেগেই আছেন। একটু সঙ্গ দেবেন নাকি?" কথাটা শুনে প্রশ্নটা এড়িয়ে ভদ্রলোক একটু খুশি খুশি গলায় বললেন, "ও আপনি বাঙালি?"

"হ্যাঁ কেন? আপনি কি ভাবছিলেন?"

"বাঙালি যে ভাবিনি তা বলাই বাহুল্য।"

"নমস্কার, আমি ডক্টর দ্বিজেন চৌধুরি।"

"নমস্কার, আমার নাম পরিমল মুখার্জি। তবে আমার ওসবে সখ নেই" 

"ঠিক আছে। কিন্তু আপনি এত রাতেও জেগে? ঘুমোবেন না?"

"আচ্ছা আপনি কি ডাক্তার না ডক্টরেট?"

দ্বিজেন সামান্য হেসে বলল, "আমি নিউরোলজিষ্ট। কলকাতাতেই প্রাইভেট প্র্যাক্টিস আমার।"

"কি সৌভাগ্য আমার, এ তো সাক্ষাৎ ভগবানের যোগাযোগ!" ভদ্রলোক সামান্য চাপা গলায় বললেন। 

"এ কথা বলছেন কেন?"

এবারে ওপরের বার্থে ঘুমন্ত মানুষটির দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় পরিমলবাবু গলাটা একেবারে খাদে নামিয়ে খুব সাবধানতার সঙ্গে নীচু গলায় বললেন, "আমার স্ত্রী, বুঝলেন? বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল অদ্ভূত ব্যবহার করছে।"

"অদ্ভূত মানে? কিরকম?" দ্বিজেনের খুব কৌতূহল হল জানার। যেন পেশেন্টের সিম্পটম জানতে চাইছে। 

"আর বলবেন না। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে ধাক্কা দিয়ে আমাকেও ঘুম থেকে তুলে দিয়ে বলে আমাকে ভালবাস? বুঝুন মশাই" 

"তা উনি কি শুধু মাঝ রাতেই ঘুম থেকে উঠে এরকম করেন?"

"না, না। আর একদিন দাড়ি কামাচ্ছিলাম। হঠাৎ গালটা একটু কেটে গিয়ে একফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল। সেই রক্তের ফোঁটা হাতে নিয়ে সিঁথিতে লাগিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল ভালবাস? এই রকম যখন তখন ভালবাস ভালবাস বলে আমায় ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে। আমাদের বিয়ের প্রায় বাইশ বছর হতে চলল। এখনও কি ভালবাসার পরীক্ষা দিতে হবে?"

দ্বিজেন মনে মনে ভাবল বোধহয় ইমোশনাল ডিপেন্ডেন্সির কেস। কিন্তু কিছু না বলে ওর ওয়ালেট থেকে একটা কার্ড বার করে পরিমলবাবুর দিকে বাড়িয়ে বলল, "আচ্ছা আমার কার্ডটা রাখুন। আর একদিন আমার চেম্বারে নিয়ে আসুন। আমি ভাল করে দেখে বলব কি করা উচিৎ। হয়ত কিছু টেষ্টও করাতে হবে। আর যদি কোন সাইকোথেরাপিষ্টের কাছে পাঠাতে হয়, তাও বলে দেব।"

পরিমলবাবু কার্ডটা ভাল করে দেখে নিজের একটা ছোট ব্যাগে রেখে দিয়ে বললেন, "ঠিক আছে। কিন্তু আমার স্ত্রীকে এই ব্যাপারে কিছু বলবেন না। হয়ত মানতেই চাইবেনা আর তাতে উল্টো বিপত্তি হবে। হাওড়া আসতে আসতে তো কাল সকাল হয়ে যাবে। তখন নিশ্চয় আপনাকে দেখে আলাপ করতে চাইবে। 

"হ্যাঁ, হ্যাঁ আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আর কথা বাড়াবনা। আচ্ছা আপনারও যে আমার সঙ্গে এত কথা হল, আলাপ হল সেকথা বলবেন না।"

এই বলে এক চুমুকে স্কচের গ্লাসটা খালি করে দ্বিজেন শুয়ে পড়ল আর পরিমলও "গুড় নাইট" বলে নিজের বার্থে শুয়ে পড়ল। পরদিন সকালে সারাক্ষণ খুব গম্ভীর হয়ে থাকল দ্বিজেন আর ভদ্রমহিলার দিকে বিশেষ তাকালও না। পরিমলবাবুর দিকেও না। যেন কেউ কাউকে চেনেনা, জানেনা। ইতিমধ্যে হাওড়া এসে গেলে দ্বিজেন একরকম তাড়াহুড়ো করেই দৌড়ে নেমে গেল। পেছন ফিরে আর দেখলওনা। 

***

এরপর কদিন বাদে মধুছন্দার ফোন এল। চন্দ্রা লাইনটা দিয়েই সেই দক্ষতা মেশান গলায় বলল, "স্যার, ডা: ঘোষের ফোন আছে। মধুছন্দা ঘোষ। অনেকক্ষণ ধরে চাইছেন কিন্তু আপনি পেশেন্ট দেখছিলেন তাই দিতে পারিনি।"

"আচ্ছা দাও।" বলে দ্বিজেন মনে মনে ভাবল চন্দ্রা কি একটা যন্ত্র?" ভেবে নিজের মনেই একটু হেসে উঠল। 

"কি রে দ্বিজু, আছিস্ কেমন? যা ব্যস্ত তুই! তোকে তো ধরাই যায়না।"

"নে নে রাখ। এবার বল কি বলবি। শুনলাম নাকি অনেকক্ষণ থেকে চেষ্টা করছিস কথা বলার?"

" হ্যাঁ রে। তোকে আমার বন্ধুর কথা বলেছিলামনা?"

"অনীতা, মনে আছে আমার। কিন্তু সে তো আসেনি আমার কাছে এখনও।"

"জানি। আমি ওকে তোর কথা জানিয়ে রেখেছি। ও হয়ত আজ, কালের মধ্যেই যোগাযোগ করবে।"

"ওর সমস্যাটা কি? তোর কি জানা আছে? তাহলে একটু জানিয়ে রাখ।"

"হ্যাঁ হ্যাঁ, তোকে জানিয়ে রাখব বলেই তো ফোনটা করা। সমস্যাটা হল স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভালবাসার ট্রাষ্ট নিয়ে।"

"কি রকম?" জানতে চায় দ্বিজেন। 

"তোর কোন পেশেন্ট এরকম আছে যে মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে পাশে শুয়ে থাকা মানুষটাকে জাগিয়ে তুলে তুমি আমায় ভালবাস বলে কনফার্ম করে?"

"দাঁড়া দাঁড়া, এই সিম্পটমটা কোথায় যেন কিছুদিন আগেই শুনেছি। আচ্ছা, তোর বন্ধুর পুরো নাম কি অনীতা মুখার্জি বলেছিলি?"

"অনীতাকে তুই চিনিস্ নাকি? আগে বলিস্ নি তো?"

"না মানে ঠিক চেনা নয় তবে ওর স্বামীর নাম কি পরিমল?"

"হ্যাঁ, ঠিক তাই। তুই ওদের জানলি কি করে?"

"ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল রাজধানী এক্সপ্রেসে এলাহাবাদ থেকে আসার সময়, ট্রেনেই। তখনই ভদ্রলোক ওর স্ত্রীর এই অদ্ভূত ব্যবহারের কথা জানান। খুব সম্ভবত: অনীতার ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিস-অর্ডার হয়েছে। তবে সিওর হতে হবে তাই পরিমলবাবুকে বলেছি তোর ওই অনীতাকে নিয়ে আমার চেম্বারে আসতে। যদি কোন সাইকোলজিষ্ট বা সাইকোথেরাপিষ্টের দরকার হয়, আমি বলে দেব।"

"অত সোজা ব্যাপার হলে আমি তোর কাছে পাঠাতামনা।"

"মানে? কি বলতে চাস্ তুই?"

"এই যে ভদ্রলোক, মানে ওই পরিমল নামের ব্যক্তিটিই অসুস্থ। উনি যা যা করেন সেই সবই ওনার স্ত্রীর নামে চালিয়ে দেন।"

"বলিস্ কি রে? আমার এত বছরের অভিজ্ঞতায় সেদিন একটুও বুঝতে পারিনি! মানে ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিস-অর্ডার আর সঙ্গে ফ্যাক্টিশাস ডিস-অর্ডার বাই প্রক্সি?"

"তুই বোধহয় এবার ঠিক দিকেই এগোচ্ছিস্। যাই হোক তোর হাতে অনীতাকে ছেড়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হব এবার।"

"একটা কথা বল্ তো। তুই এত নিশ্চিত হলি কি করে যে অসুখটা পরিমলের। অনীতার নয়?"

"কারণ ওর কথা কেউ বিশ্বাস করছিলনা বলে ও লুকিয়ে নাইট-ভিসান ক্যামেরায় ভিডিও রেকর্ড করে রেখেছে। আমাকে দেখিয়েছে। তোকেও দেখাবে বলে আমার কাছে তোর খোঁজ করছিল। ও ভয় পাচ্ছে যে কি জানি যদি কোন কারণে ক্যামেরাটা পরিমলের হাতে পড়ে যায় তাহলে ওদের এই দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের সম্পর্কে ছেদ পড়ে যেতে পারে। রাখছি এখন।"

"আচ্ছা" বলে ফোনটা রেখে দ্বিজেন নিজের মনেই বলল, "তুমি তো গভীর জলের মাছ পরিমল! কিন্তু আমি তোমায় ধরে ফেলেছি।" একটু ব্যঙ্গ কি ছিল সেই কথার মধ্যে নাকি ডা: দ্বিজেন চৌধুরির কনফিডেন্স? কে জানে। 

0 comments: