প্রাচীনকথা - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীনকথা
রাজোচিত
অনিন্দিতা মণ্ডল
পর্ব পাঁচ
রাতের অন্ধকারে একটি প্রজ্বলিত দীপাধারের আলোয় দিওদোরাস লিখে চলেছেন সেদিনের যুদ্ধের বর্ণনা। রাজা পোরাসের পক্ষে বিশাল হস্তীযূথ তাঁদের পক্ষে বড়ই প্রয়োজনীয় ছিল। গ্রীক সৈন্যদের রক্ত মজ্জা অস্থি নিমেষে এই হস্তীপদে পিষ্ট হয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়। তদুপরি, হস্তী রণনিপুণ। মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগে দক্ষ। সেই সব অস্ত্র গ্রীক সৈন্যদের পর্যুদস্ত করে ফ্যালে ... । রাতের অন্ধকারে অন্য একটি কক্ষে জাগ্রত আলেকজান্ডার ভবিষ্যৎ পন্থা নির্ধারণ করছিলেন। ক্রমশ তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন, এ যুদ্ধের পরিণতি ভালো হবেনা। তবে কি সন্ধি প্রস্তাব দেবেন? অসহনীয় অপমানে নীল হয়ে যাচ্ছেন তিনি। তা কি করে সম্ভব? অথচ তা নাহলে জিতে ফেরার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। মনে পড়ল আসার পথে তক্ষশীলায় তিনি বাম্ভন সমন বলে পরিচিত এক দার্শনিক গোষ্ঠীকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর গুরুজনেরা তাঁকে জানিয়েছিলেন যে এই ভূখণ্ডে দার্শনিকদের স্থান বড় উচ্চে। রাজার চেয়েও। তিনি কর্ণপাত করেননি। তবে কি সত্যিই এদের অলৌকিক শক্তি আছে? নয়ত তাঁর মতো দিগবিজয়ী বীরের সঙ্গে সম্মুখ সমরে এরা এমন শক্তি প্রদর্শন করে? তিনি দোলাচলে দুলতে থাকেন। যুদ্ধ না সন্ধি। কোনটি প্রয়োজন?
দুর্গের অন্দরে মন্দির সংলগ্ন চাতালটির পাশের প্রস্তরপ্রকোষ্ঠে বসে শোকগ্রস্তা মহিষী ও অন্যান্য পুরনারী। রাজা পরমানন্দ এতটুকু কালক্ষেপ না করে রওনা দিয়েছেন উত্তরে। নির্দিষ্ট যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছতে হবে শীঘ্র। শোক করবার সময় আছে। যাবার আগে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন। দেবীপূজা যেন কোনোভাবেই বন্ধ না হয়। তাই রাজমহিষী ও বধূমাতা নিজেদেরকে সরিয়ে এনেছেন উৎসব থেকে। রাজকন্যা অম্বিকা এই সময়ে ত্রস্তপদে প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করল। নীচু হয়ে মাতার পদধূলি নিয়ে সে আশীর্বাদ চাইল। মাতা অবাক। কিসের আশীর্বাদ? বিশেষত এ শোকের সময়! রাজকন্যা উত্তর দিলেন – না, এ উৎসবের সময়। এ রাজ্যের রাজপুত্র বীরগতি লাভ করেছেন। মাতা আমাকে অনুমতি দিন। আমি আপনার অনুমতি ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করি। আমি সমরাঙ্গনে যেতে চাই। সেনাপতি জয়বর্মা আমাকে কন্যার অধিক স্নেহ করেন। আমার শস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ। আমি হস্তীচালনায় সুদক্ষ। অগ্রজের অবর্তমানে পিতাকে রক্ষার ভার আমার ওপরে বর্তায়।
বিতস্তার গতি অনুসরণ করে উত্তর মুখে ষাট ক্রোশ দূরে যুদ্ধক্ষেত্র। রাজা পরমানন্দর সহায়তায় সেখানে জড় হয়েছে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী। তাই দেখে গ্রীক সেনাদের মুখে হতাশার চিহ্ন ফুটে উঠছে। কিন্তু আলেকজান্ডার নিজের সংকল্পে অবিচল। ইন্দ্রস্থান তিনি জয় করবেনই। রাজপুত্র মৃত। বৃদ্ধ রাজার মনোবল নিশ্চয় ভেঙে গিয়েছে। পুত্রশোকে বিপর্যস্ত রাজা সম্মান বাঁচাতে যুদ্ধে এসেছেন। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে সত্যই খুব উচ্চ মানসিকতা। কিন্তু পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। অতএব যুদ্ধ জারি।
ক্রমশ অস্ত্রচালনা করতে করতে অজস্র গ্রীক সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল ত্রিগর্তর সেনাদের ওপরে। তারা নিশ্চিত হতে শুরু করেছে যে ত্রিগর্তর পরাজয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। নিশ্চিন্ত সেনারা যখন আরও আরও এগিয়ে যেতে থাকল তখন আলেকজান্ডার নিজে তাঁর অশ্ব বুসেপটেলসকে চালনা করলেন এবং তাদের অনুসরণ করতে করতে এগিয়ে গেলেন। কেউ যেন ভীতস্বরে বলে উঠল – সম্রাট অন্দরে প্রবেশ করবেন না। কিন্তু তিনি কর্ণপাত করলেন না। আহা, বড় সুখের সময়। ইন্দ্রস্থানের অতুল সম্পদের অধিকারী হতে চলেছেন তিনি। ত্রিগর্তর স্বর্ণভাণ্ডার এখনই হাতের মুঠোয় আসবে। তিনি রথ চালনা করে দিলেন। কিন্তু একি! কোথায় তাঁর অজেয় সৈন্যদল! কোন শুন্যতা তাদের গ্রাস করে নিলো! তিনি যেন একটি বৃহৎ বৃত্তের মধ্যে পরিধি বরাবর প্রবেশ করেছেন। ক্রমশ সেই বৃত্তরেখা সংকুচিত হয়ে আরও আরও অসংখ্য বৃত্তের জন্ম দিচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন যে এভাবেই তিনি কেন্দ্রে পৌঁছে যাবেন। কিন্তু বেরিয়ে আসবেন কোন পথে? এই কি সেই চক্রব্যুহ? যার কথা গূঢ়পুরুষ বলেছিল? পেছনে বৃত্তের প্রতিটি রেখা ধরে শত্রু সৈন্য আবর্তিত হচ্ছে যে! সেই শত্রুসৈন্যদের দুটি রেখার মাঝে নিহত ধুলিলুণ্ঠিত তাঁর সৈন্যরা। হঠাৎ চোখ পড়ল বৃত্তের কেন্দ্রে। একটি শ্রাবণমেঘবর্ণ হস্তী। তার পিঠে চৌদোলায় আসীন এক দেবী। হ্যাঁ দেবীই তো! আলেকজান্ডারের নিজের গাত্রবর্ণ স্বর্ণাভ। এ দেবীর গায়ে যেন গোলাপের লালিমা। কি অসামান্য রূপ! গ্রীকদেবী আফ্রোদিতির কথা মনে হচ্ছে তাঁর। তাঁর গূঢ়পুরুষ সংবাদ দিয়েছিলেন যে ত্রিগর্তকে রক্ষা করেন স্বয়ং দেবী অম্বা। তাই অপরাজেয় ত্রিগর্ত। তিনি বিশ্বাস করেননি। কিন্তু এখন তো নিজের চোখে দেখছেন। মনে পড়ল তাঁর। ডেলফির মন্দিরে গিয়েছিলেন তিনি। পুরোহিত এক দৈবাদিষ্টা নারী। তিনি নিজের সম্পর্কে দৈব বাণী শুনতে চেয়েছিলেন। প্রয়োজনীয় পূজাদি সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু পুরোহিত আবেশে চোখ বন্ধ করে আছেন। সম্রাটের মনোবাসনা উচ্চারণ করছেন না। বিরক্ত সম্রাট দেবী পাইথিয়াকে চুলের মুঠি ধরে টেনে আনলেন উন্মুক্ত চত্বরে। আবিষ্ট পাইথিয়া তখন দুর্বল কণ্ঠে বলেছিলেন – সম্রাট, তুমি অপরাজেয়। আজ মনে হচ্ছে যন্ত্রণাকাতর পাইথিয়া তাঁর সঙ্গে প্রবঞ্চনা করেছেন। নাকি তিনিই শুনতে চেয়েছিলেন এই বাণী! এখন সম্মুখে তাঁর প্রতিপক্ষ এই দেবী। দেবীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি কি পারেন? মুহূর্তের অসাবধানতায় একটি গদার আঘাত নেমে আসল তাঁর শিরে। তিনি অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পড়ে গেলেন। আঘাত বাড়তে লাগল। ক্রমে আরও আরও। তিনি জ্ঞান হারাতে হারাতে শুনতে পেলেন এক ক্রুদ্ধ সেনার কণ্ঠস্বর। আমাদের রাজপুত্রের হত্যাকারীর শিরে আঘাত করো। আঘাতে আঘাতে চূর্ণ করে দাও শির। রাজপুত্রের শিরে আঘাত করেছিল এই পাপিষ্ঠ। হঠাৎ একটি নারীকণ্ঠ শুনতে পেলেন - যে আঘাতে শত্রু পরাজিত হয়, আঘাত তত দূর থাক। তিনি নিশ্চিত হলেন। স্বয়ং দেবী অম্বা যুদ্ধ করছেন। বিস্মৃতির অতলে ডুবতে ডুবতে তাঁর মস্তিষ্কে দেবী আফ্রোদিতি আর দেবী অম্বা যেন মিলেমিশে যেতে থাকলেন।
রাজা পরমানন্দ চন্দ্র ভেবেছিলেন এই বিদেশী রাজপুত্রকে একক দ্বন্দযুদ্ধে আহ্বান জানাবেন। দুপক্ষেই অযথা লোকক্ষয় থেকে নিষ্কৃতি। কিন্তু গ্রীক রাজপুত্রের অসম্ভব মেধা। তিনি রাজাকে একটি ছোট্ট চতুষ্কোণে বদ্ধ রেখে দিলেন। তাঁর সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন রাজা যেন এই বর্গক্ষেত্র থেকে বের হতে না পারেন। চক্রব্যুহ নয়, বর্গব্যুহ। চক্রব্যুহের মতো বুভুক্ষু নয় বটে তবে প্রধান প্রধান যুযুধানকে বদ্ধ করতে পারে। রাজা পরমানন্দ শক্তিশালী বীরপুরুষ। তিনি অনায়াসে ব্যুহভেদ করেছেন। কিন্তু সময় লেগেছে। আর এই সময়ের মধ্যে তাঁর কন্যা, রাজকন্যা অম্বিকা, সেনাপতি জয়বর্মার পরিচালনায় হস্তীযূথ চালনা করেছে। তাও আবার চক্রব্যূহে। কেন্দ্রে সে নিজে ছিল। ফল, রাজপুত্র আলেকজান্ডার, যাকে ত্রিগর্তবাসীরা লোকচন্দ্র নামে ডাকছে, সেনাপতি সালুক্যর সহায়তায় কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে গ্রীক স্কন্ধাবারে ফিরেছেন। তাঁর শুশ্রূষা চলছে। গ্রীকবাহিনী এখন বন্দী।
মন্ত্রণা কক্ষে বসে আছেন রাজা পরমানন্দ চন্দ্র। আহত মুমূর্ষু শত্রু রাজপুত্র সামনে আসীন। সমউচ্চতার বেদীতে বসে। পরমানন্দ জানিয়েছেন, এক রাজা অপর আরেক রাজার প্রতি রাজার তুল্য ব্যবহারই করে, অন্তত এদেশে। দস্যু বা তস্করের ব্যবহার বিজিত পক্ষ পায়না। সুতরাং সমউচ্চতা তাঁর প্রাপ্য। এবার রাজপুত্র বলুন তিনি কি চান। রাজা তাকে সসম্মানে ইন্দ্রস্থান ছেড়ে চলে যেতে দেবেন। নতমস্তকে আলেকজান্ডার মুক্তি চাইলেন। দেহ ও মনোবল দুইই ভেঙে গিয়েছে। তিনি বিদায় প্রত্যাশী। কিছুকাল নীরবতার পর রাজার কণ্ঠ শোনা গেলো – তথাস্তু। আপনি ইন্দ্রস্থান ত্যাগ করতে পারেন। তবে একটি শর্ত। যে পথে এই ভূখণ্ডে আগমন ঘটেছিল সেই পথে গ্রীক সৈন্য ফিরবেনা। ফিরবে আমার নির্দেশিত পথে। আলেকজান্ডার মুখ তুলে চাইলেন। কি বিচক্ষণ! যে পথে তাঁর রাজকর্মচারী নিযুক্ত আছে সেই পথে তাঁর শক্তি সংগ্রহের সুযোগ ছিল। কিন্তু প্রাণের আশা কি এত সহজে ছাড়া যায়?
মুক্তি যে বেদনার, মুক্তি যে অপমানের, সেই অনুভূতি তাঁকে অহরহ বড় যাতনা দিচ্ছে। তবু শয্যাশায়ী সম্রাটের চেতনায় ফিরে ফিরে আসছে একটি মুখ। স্বপ্নেও ভাসছে সেই মুখ। দেবী অম্বা। পাইথিয়াকে ওভাবে নিগ্রহ করা উচিত হয়নি। উচিত হয়নি গুরু এরিস্টটলকে অসম্মান করা। ক্রমশ জাগছে কৃতকর্মের স্মৃতি। ব্যথিত হচ্ছেন। আর তখনই কানে ভাসছে মধুর সেই কন্ঠস্বর। আর আঘাত নয়।
মুক্ত গ্রীক সৈন্য দুটি দলে ভাগ হয়ে ফিরে চলেছে। পশ্চিমে সিন্ধুর তীর ধরে চলেছেন আলেকজান্ডার। পথে ছোট ছোট রাজ্য। সেখানে পরাজিত বিরক্ত গ্রীক সেনারা লুণ্ঠন ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আর আলেকজান্ডার প্রতিদিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। হারিয়ে ফেলছেন শৌর্য বীর্য। ক্রমে দম্ভের শিখর থেকে নামছেন। এই পৃথিবীর প্রতি বিরক্তিতেও তাঁর মনে পড়ছে বিশ্ববন্দিত আচার্যের কথা। মুঠোয় যতটা ধরা যায় তার চেয়ে একফোঁটা বেশিও তোমার কিছু নেই।
· Maharashtrian Onyankosh (page 531, Vol. 7)
· মৌর্য যুগের ভারতবর্ষ, ইরফান হাবিব, বিবেকানন্দ ঝা। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি। ২০১৬ কলকাতা
· penelope.uchicago.edu – Life of Alexander, by Plutarch
0 comments: