1

গল্প - উদয়নীল ভট্টাচার্য

Posted in


গল্প


খলিফা
উদয়নীল ভট্টাচার্য


(এক)

-আমার মেয়েটাকে বাঁচান হুজুর।

কথাটা কানে এল ওসি বদ্রু সাহেবের। সেকেন্ড অফিসারের কাছে বসে কেউ একটা এফ. আই. আর. লেখাচ্ছে। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সেকেন্ড অফিসারের টেবিলের দিকে উঠে এলেন বদ্রু। সেকেন্ড অফিসার আদিত্য চল্লিশ পেরিয়েছে অনেকদিন তবু এই মুহূর্তে এফ. আই. আর. লেখার থেকে তার সামনে বসা মেয়েটার দিকেই তার নজর বেশি। চেহারা থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো অথচ কি নিস্পাপ।বদ্রু চমকে গেলেন। এ মুখ যে বড় চেনা।কিন্তু ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে চব্বিশ বছর। তিনি তখন কলেজে। না তাহলে সে নয়।তার সাথে মিশে আছে জীবনের সবচেয়ে গভীর আক্ষেপ আর দাগ।তার কথা আর মনে করতে চান না বদ্রু। কিন্তু মুখের পাশে যে মুখ অর্থাৎ যে গলা শুনছিলেন এতক্ষণ বদ্রু, সে বৃদ্ধ। এ কি ওর বাবা? মুখে খোদলা খোদলা বসন্তের দাগ, আর দাগের খুব কাছে থেকে যে ধরনের সাদা দাড়ি শুরু হয়েছে তা বুঝিয়ে দিচ্ছে অভিযোগকারী মুসলিম। মাথায় ফেজ টুপিও সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে। কিন্তু সে অন্ধ। তার চোখ দুটো বোজা। নাহ ভুল ভাবছেন বদ্রু। কিন্তু পুলিশের মন বড় নাছোড়বান্দা। 

আদিত্যর সাথে মেয়েটির বাবা আর মেয়েটির কথোপকথনে বদ্রু বুঝলেন কেসটা ইভ টিজিং এর। কলেজ যাওয়ার পথে প্রায়শ একটি লাফাঙ্গা মেয়েটির পিছু নেয় বাইকে। কখনো পথ আটকায়, কখনো ওড়না টানে কিন্তু কেউ কিছু বলে না, উলটে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়।

‘নাম?’ বদ্রু পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলেন। অন্ধ বৃদ্ধের মুখ কেমন কুঁচকে গেল ভিন্ন কন্ঠস্বরে।

‘ওসি সাহেব জিজ্ঞেস করছেন, বলুন, নির্ভয়ে বলুন।’ আদিত্য পাশ থেকে উৎসাহ দিল। বদ্রু খেয়াল করলেন বাপ, মেয়ে দুজনেই থমকে গেল।নাম বলতে তারা যেন ইতস্তত করছে।

‘ভয় নেই, নির্ভয়ে বলুন,’ বদ্রু সাহস দিলেন।

‘আজ্ঞে চম্পক।’ মেয়েটি যেন মরিয়া হয়ে বলে ফেলল। আদিত্য মুহুর্তে নিভে গেল। বদ্রুও কিঞ্চিৎ থমকে গেলেন। চম্পককে তিনি জানেন। দলাশ্রয়ী রংবাজ। পার্টি ফান্ডে কাটমানি সাপ্লায়ার।অন্ধকারের ডন কিন্তু মাথার ওপরে উলঙ্গ রাজার বরাভয়।

‘না না আমি আপনাদের নাম জিজ্ঞেস করছি,’ বদ্রু আচমকা ছুঁড়লেন কথাটা।

‘আজ্ঞে আমার নাম সেক আব্দুল সামেত, আর এ আমার মেয়ে তানজিম,’ অন্ধ বৃদ্ধ খুব জড়সড় হয়ে উত্তর দিলেন, ‘আমি চোখে দেখিনা, মা মরা মেয়ে, আমরা বড় বিপদে আছি।’

এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য বিরাজমান পুলিশ স্টেশনে। ঘড়ির কাঁটার শব্দ অনেকদিন এত স্পষ্ট শোনা যায়নি। 

‘আমি কথা বলব, আপনারা যান, আর কোনো সমস্যা হবে না।’ বদ্রু দ্রুততায় নিজেকে সামলে নিলেন, ‘ওসব নিয়ে ডাইরী করে লাভ নেই, মামুলি ব্যাপার।’

বাপ, মেয়ে ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। কারণ তারাও চেনে চম্পককে। ফলে ব্যাপারটা এত সহজে মিটবে বলে পুলিশ যেমন আশ্বাস দিচ্ছে, তা তারা ঠিক হজম করে উঠতে পারল না। কিন্তু উপায়ন্তর না দেখে তারা আস্তে আস্তে বেরিয়ে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ দুই অফিসারই চুপচাপ রইলেন। এ চাকরিতে কাঞ্চন মূল্যে তারা অনেক পাপ হজম করেন। এখন আর গায়ে লাগে না। তবু হৃদয়বৃত্তি এমন জিনিস যা আশ্রয়প্রার্থী মানুষের সামনে কখনো কখনো অসহায় হয়ে পড়ে। মেয়েটির নিস্পাপ চাউনি আর অন্ধ অসহায় বাপের আকুতি কোথাও তাদের ছুঁয়েছে।

নিজের চেয়ারে এসে বসলেন বদ্রু। নিজের জীবনের ছোট ছোট অবিনশ্বর মুহুর্তগুলো জাম্প কাট করে মনের মধ্যে ভেসে এল।জীবনকে শুধু নিজের শর্তে দেখতে গিয়ে অনেক খোয়াতে হয়েছে, তবু এমন কোনো শৃঙ্গ জয় করা হয়নি, যেখানে আরামকেদারা পেতে বসে নিজের অতীতকে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখা যায়।চাকরি জীবনে হিরোইজমের মাশুল দিতে হয়েছে অনেক।তাই এস.আই থেকে শুরু করে আজও ওসিই রয়ে গেলেন। আবার তিনি যে আদ্যন্ত সৎ থেকে পুরো চাকরি জীবন কাটালেন তাও নয়। রেইড করতে গিয়ে যদি পছন্দের মিউজিক সিস্টেম পেয়ে গেছেন তখন তিনি ঘুষ নিয়েছেন, যদি ডাঁটিয়াল মোরগ কেউ উৎকোচ হিসেবে দিয়েছে তিনি নোলা পেতে নিয়েছেন আবার কোনো খেলার মাঠ কোনো প্রোমোটার যদি দখল করতে গিয়েছে তাকে বেমক্কা ঠেঙ্গিয়ে বদলিও হয়েছেন।এই আগেরবার যেমন এক প্রাদেশিক নেতা দক্ষিণবঙ্গে তার এলাকায় মিটিং করতে এসে রাতে মেয়েমানুষ চেয়েছিলেন বলে, তিনি মুখ ফস্কে বলেছিলেন যে তিনি বেশ্যার দালাল নন, তাই তিনি এখন উত্তরবঙ্গে এই প্রান্তিক জেলায়।আবার এখানে এসে সীমান্তের চোরাচালানদারদের কাছ থেকে ভালো ভালো সুগন্ধি, ভালো আধুনিক হোম এপ্লায়েন্স নির্দ্বিধায় হজম করেছেন আবার সমাজবিরোধী গোছের যারা, সাধারণ পাবলিককে হ্যারাস করে, জীবন দুর্বিষহ করে দেয়, তাদের দেখলেই তার একটা নিঃশব্দ বুলেট চুপিসাড়ে মাথা গেঁথে দিতে ইচ্ছে করে। এর আগে তিনবার করেছেন। একবার এক ছোট নেতাকে রাতে বাড়ি ফেরার সময় গলির ভেতর থেকে মাথার পেছনে বুলেট ঝেড়ে, পরেরদিন দুটো ফালতু লোককে সন্দেহভাজন সাজিয়ে তদন্ত মাঝপথে ভেস্তে দিয়ে খালাস করে দিয়েছেন। ছোট নেতা মেয়ে চালানের বেওসা করত। কাকপক্ষীতে টের পায়নি। তার বাড়িতে যে মহিলা কাজ করতে তার তের বছরের মেয়েটাকে কোথায় পাচার করে দিয়েছিল। তিনি এগোতে গিয়ে বুঝলেন র‍্যাকেটটা বড় আর পেছনে যারা আছে তারাই ভোটে জেতার ঘুঁটি সাজায়। তিনি সোজা রাস্তায় পারবেন না কিন্তু কাজের মহিলার কান্না তিনি ভুলতে পারেননি। তাই মনের গহীনে ঘুঁটি সাজিয়েছিলেন। ছোট নেতার মৃত্যুতে খুব হৈচৈ হয়েছিল কিন্তু কেউ কিছু কিনারা করতে পারেনি।

ইদানীং চম্পক সম্পর্কে তার তাই মনে হয়। প্রথম করণদিঘি থানায় আসতেই আদিত্য তাকে বলেছিল চম্পক কাউকে রেয়াত করেনা।থানার ভাগটা দেয় ঠিকই কিন্তু এটা বুঝিয়ে দেয় যে সেটা দয়ার দান।আজকে তানজিম আসাতে একটা পুরোনো স্মৃতি উস্কে গিয়ে চম্পককে নিয়ে ভাবনাটা আবার উস্কে গেল। অনেকদিন চোরাশিকারে নামেননি বদ্রু। এই পোর্টফোলিওতে থেকে সবার চোখ এড়িয়ে একটা বেয়ারা হায়না কে রাতের অন্ধকারে চুপিসাড়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া খুব রিস্কি, তবু মাঝে মাঝে শিকারের সাধ জাগে।উফফ গায়ের রোঁয়া খাড়া হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে শিরশির করে রিভলবারটা কক করে যখন আস্তে আস্তে জীবন্ত মানুষটা কে তাক করেন আর ট্রিগারটা আঙ্গুলের চাপে আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসে মোক্ষম মুহুর্তে, কেমন একটা শিউরোনো আনন্দ হয়, কোনো পাপ নেই তায়। চম্পকের ভাবনাটা আজ বড় আসছে।তাকে কেমন বলেছিল, ‘পুলিশের আবার কোনো জাত আছে নাকি, বেশ্যাও তোদের চেয়ে পবিত্র।’

নাহ, চম্পককে খালাস দিতে হবে। ওর চলার রাস্তা গুলো রেইকি করতে হবে। তার আগে চম্পকের একটা প্রতিদ্বন্দ্বী খাড়া করা দরকার।

-হ্যাঁ বড়বাবু বলছিলাম, ভালো আছেন তো? অনেকদিন এদিকে আসেন না যে? না ঠিকই আছে আপনাদের দয়ায়। বলছিলাম, চম্পককে একটু সাবধানে থাকতে বলুন। মুসলিম মহল্লায় গিয়ে মহিলাদের অসম্মান করছে। সংখ্যালঘু ব্যাপার, বলা যায়না কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। তাছাড়া পলিটিক্যালি এনক্যাশ হতে পারে তো, তাই আর কি, হ্যাঁ ওদের তো আবার রগচটা লোক কম নেই, কি হতে কি হয়ে যাবে... আরে না না, আপনাকে জানিয়ে রাখলাম আর কি, আসবেন সময় পেলে কখনো।

সার্ভিস রিভলবার নামক গয়নাটা কোমর থেকে হাতে নিলেন বদ্রু।কি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে বিন্দু বিন্দু ছ’টা অন্ধকারের ডিম।

(দুই)

ভোর হচ্ছিল তখন।গলির মুখে পড়েছিল লাশটা। একটা নেড়ি কুকুর শুঁকছিল তাকে। অদূরে বাইকটা পড়ে আছে। একজন দুজন করে লোক জমছে। একই সাথে শঙ্কা আর স্বস্তির ছাপ সবার মুখে।কারণ সামনে যে শুয়ে আছে তাকে কেউই পছন্দ করেনা, কিন্তু কে সেই লোক যে এমন দোর্দন্ডপ্রতাপ শয়তানকেও শুইয়ে দিতে পারে, তার কথা ভেবেই অনেকে শিউরে উঠছিল। তাহলে কি বাজারে আবার নতুন কেউ এল? অচেনা শয়তানের চেয়ে চেনা শয়তান ভালো। থানা খবর পেয়েছে? একজন অত্যুৎসাহী ফোন করতে গিয়ে দেখল, বড়বাবুর এনফিল্ডটা দূর থেকে ব্রহ্মনাদে ছুটে আসছে। সবাই পথ ছেড়ে দাঁড়ালো।বদ্রুর বাইকটা এসে লাশের মাথার কাছে এসে দঁড়ালো।বদ্রু বাইক থেকে নেমে সবাই কে দূরে যেতে বললেন।তারপর লাশের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসলেন।

চম্পক ঘুমোচ্ছে।তার গলার কাছ থেকে কিছুটা রক্ত নেমে রাস্তায় জমাট বেঁধে আছে। বদ্রু পকেট হাতড়ে দেখলেন। কিছু টাকা আর দু চারটে সিমেন্ট কোম্পানীর কার্ড।গাটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বদ্রু মদের গন্ধ পেলেন। কিন্তু তার চেয়েও যেটা তাকে ভাবাচ্ছে, এতটা ক্ষত গলায় কিন্তু রক্ত এত কম কেন? জীবনে অনেক গলাকাটা বডি তিনি দেখেছেন কিন্তু এত শৈল্পিক অস্ত্রোপচার তিনি শেষ কবে...?

তিনি জানেন একমাত্র তিনি জানেন যে চম্পককে তিনি মারতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই কেউ...। এখন অনেক ছানবিম করতে হবে। চব্বিশ ঘন্টা গলায় ঝুলবে কতগুলো জিজ্ঞাসা চিহ্নের মালা। তার ওপর জবাবদিহি। কেউ কি চম্পকের প্যারালালে উঠে আসছিল নিঃশব্দে? না তেমন কোনো তো...। হ্যাঁ একটা ক্ষীণ যোগসূত্র আছে।কালকেই আঁচ করা উচিত ছিল। আদিত্য কে দরকার, হ্যাঁ আদিত্যকে।

-বলো কুইক ঠিকানাটা বলো...হাজী মহল্লা? সে তো অনেকটা জায়গা...কোনো ল্যান্ডমার্ক?...ফোন নং?... ছেড়ে দাও, ওখানে সাজু ল্যাংড়ার ঘর আছে না?...ওকে ডেকে পাঠাও...সাজু হাসপাতালে?...

ফোনটা ছাড়লেন।ক্ষুরের কাজ। চম্পকের গলার দাগটা ক্ষুরের কাজ।আর এমন শিল্পী একজনই আছে। কিন্তু চম্পকের পাছায় তো অটোমেটিক থাকে, সে বার করল না কেন? আর এভাবে ক্ষুরের তুলি যে বুলিয়েছে সে এখানেই বা আসবে কেন? কিন্তু এখুনি কিছু নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। অভিজ্ঞতায় তিনি জানেন সিদ্ধান্ত কোনো সরলরেখা নয়। অতএব নেক্সট ডেস্টিনেশন হাজী মহল্লা।

(তিন)

পোশাক পরে বাইক নিয়ে ওসি সাহেব ঢুকছে মানে কিছু গণ্ডগোল আছে। মহল্লায় সাড়া পড়তে আরম্ভ করল। মসজিদের পাশের ঠেকটায় অনেকে আড্ডা মারে, বাইকটা সেখানেই দাঁড় করালেন বদ্রু।

‘স্যার?’ একজন মুরুব্বি গোছের এগিয়ে এল।

‘একটা অন্ধ লোক, সাথে একটা সুন্দরী মেয়ে আছে, নাম সেক আব্দুল, চিনিস?’

‘ওরা তো আজ সকালে বেরিয়ে গেল।’

‘কোথায়?’

‘বলল তো উত্তরপ্রদেশ।’

‘শিট, কদিন ধরে আছে এখানে?’

‘অনেকদিন, তা বছর কুড়ি, বছর তিনেক আগে তো আব্দুল চাচার চোখ নষ্ট হয়ে গেল।’

‘ওরা কে কে থাকত?’ একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে প্রশ্ন করলেন বদ্রু।

‘বাপ আর মেয়ে, মা তো দশ বছর হল মারা গেছে।’

‘চম্পক ওদের বিরক্ত করত?’

‘হ্যাঁ স্যার, ওরা খুব অসহায় ছিল, আমরা ঠিক করেছিলাম এবার হেস্তনেস্ত করব, আপনাদের তো হাতপা বাঁধা।’

‘চম্পক কাল রাতে মার্ডার হয়ে গেছে,’ ওদের স্তম্ভিত মুখটা ভালো করে জরিপ করলেন বদ্রু, তারপর আচমকা প্রশ্ন ছোঁড়ার মতো জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওদের বাড়িটা কোথায়? তুই আয় তো আমাকে দেখিয়ে দিবি।’

তালা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকলেন বদ্রু, ভীড় জমছে বাইরে। আর পাঁচটা গেরস্থালীর মতোই। কোথাও হাটকে খুব একটা লাভ হলো না। শুধু সেই চেনা আতরের গন্ধ আর একটা দাবার বোর্ড, একটা টেবিলের ওপর একটা নিঃসঙ্গ দাবার বোর্ড। তলায় একটা চিরকুট গোঁজা।খুললেন বদ্রু। জাস্ট দুকলম লেখা-

-আজ রাত ন’টায়, তেলতা স্টেশনে, তুমি দাবা খেলতে ভালবাসতে বদ্রু মিঞা। হবে নাকি একহাত?

(শেষ দৃশ্য)

রাত সাড়ে আটটায় ডাক্তার দেখাতে কলকাতা যাবেন বলে কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এসছেন বদ্রু। দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।করণদিঘি থেকে কাছের স্টেশনগুলো বিহারে। তেলতা থেকে জল্পাইগুড়ি যাবেন। রাত ন’টা চারে ট্রেন আছে।কিন্তু আদৌ তিনি কোথায় যাবেন নিজেই জানেন না। হাতের ঝোলা ব্যাগটা গাছের চারপাশে বাঁধানো বেদিতে রেখে বসলেন বদ্রু। ঝোলায় একটা রিভলবার আছে, সিজার লিস্টে এন্ট্রি নেই এটার।পুরোনো হিসেব চোকানোর আছে। কিন্তু কাজটা এখানে করলে হবে না। আপাতত তার সাথে দেখা হওয়ার দরকার।

তার সাথে।

মানে খলিফার সাথে। খলিফা। এককালের দোস্ত। সেই যখন স্কুলে পড়তেন তখন থেকে। তবে দোস্ত না শত্রু সেটা এককথায় বলা মুশকিল। বদ্রু’র বাবা ছিলেন নিপাট ভালো মানুষ শিক্ষক। আর খলিফার বাবা ছিলেন ভবঘুরে। এমনিতে মেলায় ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতেন আর কখনো কখনো যাত্রা দলে মেকআপ করে বেড়াতেন। কিন্তু বাকী সময় কি করতেন বলা মুশকিল। কিন্তু ম্যাজিকের মোহে পড়ে গেছিলেন বদ্রু। আর তাই প্রায় যেতেন খলিফার বাড়ি। খলিফার মা ছিল না। তাই ঘরগুলো কেমন অগোছালো হয়ে থাকত। যতনা অগোছালো তার চেয়েও বেশি রহস্যময়।গন্ধে কেমন নেশা লাগত বদ্রুর। খলিফা বলত আতরের গন্ধ, এ আতর মদিনা থেকে আসে, তার বাবা নাকি নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান, তিনিই সব শখ করে যোগাড় করে আনেন। যেমন দাবাটা। মসলিন কাপড়ের তৈরী। কি হাল্কা আর কেমন পুরোনো ইতিহাসের গন্ধ। আর ঘুঁটিগুলো সব হাতির দাঁতের। খলিফা শুধু তাকে চলন শেখালো চাল গুলো নয়। তিনি শুধু হারতেন। খলিফা তাকে আশ্চর্য সব মেকআপ করে তাক লাগিয়ে দিত কিন্তু তাকে সাজিয়ে দিতনা।

এইরকমই একদিন খলিফাদের ঘরের ম্যাজিক দ্রব্য ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা ক্ষুরে হাত কেটে গেল বদ্রুর। খলিফার আব্বু খুব বকাবকি করলেন, তারপর বদ্রুকে তাদের বাড়িতে আসতে বারণ করলেন।আর যেতেনও না বদ্রু। খলিফাও ডাকত না। তারপর স্কুল পেরিয়ে একদিন কলেজে আবার দেখা খলিফার সাথে। খলিফা খুব জনপ্রিয়।কলেজের সোশ্যালে ম্যাজিক শো, নাটকে মেকআপ, সবজায়গাতে খলিফা। মেয়েদের কাছেও সমান জনপ্রিয়। কিন্তু বদ্রুকে পাত্তা দেয়না। স্কুলেও স্পোর্টসে খলিফা অলরাউন্ডার ছিল কিন্তু পড়াশুনোয় সুবিধের ছিলনা। একটা ওপরচালাকি ছিল কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়। বদ্রু পড়াশুনোয় যথেষ্ট ঠিকঠাক, কুইজে চাম্পিয়ান, চেহারায় যথেষ্ট ভদ্র ঘরের ছাপ কিন্তু যৌবনের প্রারম্ভে যে যৌনঈর্ষা বাসা বাঁধে তাতে পুড়তে শুরু করলেন বদ্রু। যেদিন আফরিনের জন্য গোলাপ কিনে তাকে দেবেন বলে তার ক্লাসের দিকে যাচ্ছেন, দেখলেন খলিফা তাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে স্টার্ট দিচ্ছে।

তারপর থেকে এক অদ্ভুত লড়াই শুরু হলো। কলেজের দাবা চ্যামপিয়নশিপে ফাইনালে খলিফার কাছে হারলেন বদ্রু। তার সেই তির্যক হাসি ভোলেননি তিনি, আরো ভোলেননি আফরিনের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সময় সেই সংলাপ, ‘কোনো হিন্দু ছেলেকে আব্বু মেনে নেবেনা।’

তারপর তিনি যখন পুলিশের চাকরি পেয়ে এস.আই. হিসেবে ডেপুটেশনে নিজের পি.এসে. কয়েকদিন পোস্টেড, আফরিনের চাচা খুন হয়ে গেল। গলাটা কাটা। আর সেই রাতেই উধাও হয়ে গেল খলিফা আর আফরিন। হাতে অনেক পাওয়ার তবু কিছুই করতে পারেননি বদ্রু।


রাত ন’টা চারের ট্রেন ছেড়ে চলে গেল। স্টেশন ফাঁকা। দূর থেকে লাঠি হাতে সেক আব্দুলকে হেঁটে আসতে দেখলেন বদ্রু। শুনশান স্টেশন চত্বর। কেউ নেই শুধু একটা খাবার সন্ধানী নেড়ি কুকুর।

তাকে ক্রস করে যখন পেরিয়ে যাচ্ছে আব্দুল, বদ্রু ডাকলেন, ‘সেলাম আলেকুম খলিফা।’

আব্দুল থমকে দাঁড়াল, তারপর লাঠি ঠক ঠক করতে করতে এসে দাঁড়াল তার সামনে। ‘হবে নাকি দাবা একহাত?’

অন্ধ লোকটার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। তার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে এল সে। বদ্রু রিভলবার শক্ত করে চেপে ধরলেন। কিন্তু আব্দুলের তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সে এসে লাঠি ঠুকে ঠুকে সামনে এসে বসল।

‘চিনতে পারলে বদ্রু মিঞা? সেক বদরুজ্জামান?’ খলিফা হাসল।

‘না পারিনি আজকে ক্ষুরের কাজটা দেখে মালুম হল, আফরিনের চাচার গলায়ও তো একই কাজ করেছিলে না দোস্ত?’

‘হ্যাঁ সে তার ভাতিজিকে নিজের ছেলের বৌ বানাতে গেছিল, নিজের ভোগে লাগাবে বলে, সে বাঁচলে, আফরিন বাঁচত না।’

‘কাজটা বোধহয় চাচা মানে তোমার আব্বুর কাছে শেখা, তাই না?ম্যাজিক আর যাত্রা করে কি পেট চলে, তার থেকে সুপারি কিলিং অনেক দমদার।’

‘আমি কিন্তু পয়সার জন্য বা কোনো অন্যায় কারণে আফরিনের চাচাকে মারিনি।’

‘ঝুট,তাহলে চম্পক?’ মুহুর্তে বদ্রু উঠে এসে খলিফার চোখের পাতা তুলে ধরলেন।দুটো চোখের নীচে সাদা মণি, যেমন অন্ধদের থাকে, সব গুলিয়ে যাচ্ছে, ‘তাহলে চিঠিটা লিখলে কি করে?’

‘অভ্যেস বদ্রু মিঞা, এখনো ঘুঁটি ছুঁয়ে বলে দিতে পারি রাজা না মন্ত্রী, গজ না ঘোড়া, কাল তোমার গলার আওয়াজ শুনেই আমি চিনতে পেরেছি তোমায়, কিন্তু তুমি এমন ভাবে চম্পকের ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলে বুঝলাম মেয়েটাকে এখানে রাখা যাবে না আর, তাই পাঠিয়ে দিলাম, তোমাদের হয়ত অনেক বাধ্যবাধকতা থাকে। হঠাৎ মনে হল পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা না করে যাব, আর কি কপাল দেখো তখনি খবর পেলাম চম্পক মার্ডার হয়ে গেছে। জানতাম তুমি আমার খোঁজে আসবে, তাই এক কলম লিখে এলাম। মনে হলো অনেক কিছু জানার আছে তোমার, হয়ত আফরিনের কথা।’

‘তাকে তো তুমিই বুঝিয়েছিলে যে আমি হিন্দু?’

‘প্রেমে কোনো দোষ নেই, ভালো ঘরের ছেলে তুমি, ভালো ফিউচার, আর আমার? ঐরকম আব্বু, অন্ধকারের জীবন, আমি মুক্তি চাইছিলাম, আফরিন সাড়া দিচ্ছিল, কিন্তু মাঝে তুমি এসে দাঁড়ালে, আমার উপায় ছিল না। যদি সে তোমার ডাকে সাড়া দিত তাহলে হয়ত আমি তোমাকেও...,’ বলতে বলতে ঝোলা হাতড়ে একটা রামের বোতল বার করে আনল খলিফা, সঙ্গে দুটো কাঁচের গ্লাস, ‘খাবে নাকি একটু? আফরিন চলে যাওয়ার পর থেকে খাই, তানজিম বারণ করত, কিন্তু আমার আর কী আছে জীবনে?’ হাসল খলিফা, ‘এতে কোনো বিষ নেই।’

‘আফরিনের কি হয়েছিল?’

‘আমায় ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল, সন্দেহ করত ওর চাচাকে আমিই মেরেছি, মন্দ লোকের তো অভাব নেই, পাশেই একটা বিবি মরা লোকের প্রেমে পড়ে গেছিল আফরিন, বাধ্য হয়েই, আমার উপায় ছিল না।’

‘খতম?’ বদ্রু বিস্ময় সামলাতে না পেরে গ্লাসে চুমুক দিলেন।

‘যন্ত্রণা পায়নি, ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে সরবতে দিয়েছিলাম তারপর মসলিন রুমাল গলায় পেঁচিয়ে ক্ষুর টেনেছিলাম, রক্ত বেরোয় না।’

‘আর সে লোক?’

‘তাকেও, এবার নিশ্চই আমাকে তোমার খুন করতে ইচ্ছে করছে, সময় আছে হাতে, তার আগে আরেকবার দাবা হবে নাকি? কোনোদিন তো জেতোনি আমার সঙ্গে বদরুজ্জামান?’ বলতে বলতে ঝোলা থেকে দাবার বোর্ড বার করল খলিফা, ‘ঘুঁটিটা যদি সাজিয়ে দাও।’

বদ্রু ঘুঁটি সাজিয়ে চাল দিলেন। মাথায় ঝড় চলছে। একে তো আফরিনের খবরটা হজম হচ্ছে না তার ওপর চম্পক। সব ধাঁধা।খলিফা প্রতিটা চালের পর হাতড়ে দেখে নিচ্ছে তার ঘুঁটির পজিশন। কিন্তু একবার ঘোড়াটা সুবিধে মত পাশের ঘরে সরিয়ে সুবিধেজনক জায়গার চলে এলেন বদ্রু। খলিফা টের পেলনা। পরের চালে মন্ত্রী গেল খলিফার। উত্তেজনা টের পাচ্ছেন বদ্রু, দ্রুত কয়েক গ্লাস মেরে দিলেন। জয় আস্তে আস্তে করায়ত্ত হচ্ছে এবং জিতলেন বদ্রু।ব্যাগ থেকে অটোমেটিকটা বার করলেন। না জয় সেলিব্রেট করতে নয় আফরিনের জন্য, কিন্তু মাথাটা বড্ড টলছে। খলিফা কে নাগালে পেয়েও নিশানা করতে পারছেন না।রামে কিছু মিশিয়েছে খলিফা? তারপর আর কিছু মনে নেই।

পরদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙল বদ্রুর। নিঝুম ভোর। ধড়মড় করে উঠে বসলেন। না খলিফা নেই। কোনো চিহ্নই নেই।শুধু পাথরের টুকরো চাপা দেওয়া একটা চিঠি আর একটা কাগজের প্যাকেট।চিঠিটা খুললেন বদ্রু।

‘বদ্রু মিঞা,

তখন যদি বলতাম তুমি অপদার্থ তাই চম্পককে আমিই মেরেছি তুমি হয়ত রাগের মাথায় গুলি চালিয়ে দিতে। আফরিন যেমন আমার প্রাণ, তানজিমও। তাই চম্পক বাঁচেনি। আব্বুর থেকে আমি শুধু ক্ষুরের কাজটাই শিখিনি, মেকআপটাও শিখেছি। প্যাকেটের মধ্যে সাদা কন্টাক্ট লেন্স দুটো পাবে। তবে তোমার পতন হয়েছে অনেক, ঘোড়াটা না সরালে তুমি জিততে না। আমি ইচ্ছে করে হেরেছি। তুমি যবে থেকে এ থানায় ঢুকেছো তবে থেকেই আমাকে অন্ধ আর বয়স্ক সাজতে হয়েছে যাতে তোমার চোখে না পড়ি। আজ আফরিন নেই কিন্তু তুমি তো আছো, আমার চির প্রতিদ্বন্দ্বী। বড় ভালোবাসি তাই তোমাকে। কিন্তু তার চেয়েও ভালোবাসি তানজিমকে। আশা করি তার মুখ চেয়ে আমার পিছু আর তুমি নেবেনা।কাল রাতের আড্ডার জন্য ধন্যবাদ।

1 comment:

  1. অসাধারণ বুনোট। শেষ অবধি চমকটা বজায় রাখতে পেরেছেন।
    দোলা সেন

    ReplyDelete