0

সম্পাদকীয়

Posted in




সম্পাদকীয়


দীপাবলী আসছে। আসছে আলোর উৎসব। কিন্তু আমি যেন কোথাও আলো দেখতে পাচ্ছি না। অদ্ভুত এক আঁধার ঘিরছে চারিপাশ। বধূ নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় যুবক ছুরিকা বিদ্ধ, প্রেমিককে সুপারি দিয়ে স্বামীকে খুন করানো, যৌন হিংসা, গার্হস্থ্য হিংসা ...এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা? সমস্ত সত্তা যেন ফাঁদে পড়া পাখির মত ছটফটাচ্ছে। আর্ত চীৎকারে ফেটে পড়তে চাইছে আমার স্বর: 

অপ ধ্ব্যন্তম্ ঊর্ণুহি পূর্ধি চক্ষুর্
মুমুগ্ধি অস্মান্ নিধয়েব বদ্ধান্।

---অন্বকারের জাল সরিয়ে আলোয় ভরো চোখ, আমরা জালে আটকানো পাখি, মুক্ত করো আমাদের। 

শক্তিরূপিণী দেবী কালিকাকে প্রলয়ঙ্করী রূপে আবির্ভূতা হতে দেখতে চাইছে ইচ্ছা। বিনাশ -- বিনাশ চাইছে সমস্ত অশুভের। দেবীকে তাঁর মহারুদ্রী, প্রচণ্ডা রূপে বন্দনা ক'রে মন বলতে চাইছে: 

কলনাৎ সর্ব্ব ভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্ত্তিতঃ।
মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পরা।।
কালসংগ্রসনাৎ কালী সর্ব্বেষামাদিরূপিণী।
কালত্বাদাদিভূতত্বাদাদ্যা কালীতি গীয়সে।।

পরক্ষণেই বুঝতে পারছি এ আমার প্রতিহিংসাকামীতা। হিংসার বিরূদ্ধে হিংসাকে ব্যবহার করলে তার অন্ত ঘটে না কখনও। তা কেবল বেড়েই চলে। আর, আমি কে বিচারের ভার নেওয়ার? কোনও না কোনও অন্যায় কি এই মরদেহও করে নি? 

অব দ্রুগ্ধানি পিত্র্যা সৃজা নো
অব যা বয়ং চকৃমা তনূভিঃ। 

----আমায় মুক্ত কর পিতৃপিতামহ থেকে প্রাপ্ত দ্রোহ থেকে, মুক্ত করো এই শরীর যে অন্যায় করেছে ,তার থেকেও দাও মুক্তি।

এই তীব্র প্রক্ষোভ মনে নিয়েই মাসির বাড়ী থেকে রওনা দিয়েছিলাম ঘরের দিকে উবের ক্যাবে সওয়ার হয়ে। একটা ছেলে - হ্যাঁ প্রায় আমার ছেলের বয়সী - গাড়ী চালাচ্ছে। হঠাৎ সে প্রশ্ন করল, "ম্যাম্ আপনি কী এখান থেকে কোথাও চলে যাচ্ছেন?" 

---"হঠাৎ এ প্রশ্ন?" 

অপ্রস্তুত হাসি হেসে সে বলল, "না, মানে, আপনার হাতে বড় বড় দুই ব্যাগ ভর্তি জামাকাপড় দেখছি কী না..." ভারী ভদ্র বাচনভঙ্গীটি। 

---"এগুলো পুরনো সব। এক NGO তে যাবে। যে সব বাচ্চার মা বাবার তাদের পুজোর জামা দেওয়ার সাধ্য নেই তাদের জন্য।" 

খানিক স্তব্ধতা। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে ছেলেটা আপন মনেই ছাড়া ছাড়া ভাবে বলতে লাগল: 

"ভগবান আপনাদের ভালো করবেন ম্যাম্। ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। একটা ছেঁড়া জামাও কেউ দেয়নি আমায় বা আমার বোনকে। বাপ মা মরে গেল, কাকা বোনটার সঙ্গে অসভ্যতা করল। বাড়ী ছেড়ে চলে এলাম। হার মানি নি, ম্যাম্। আর্ট কলেজে চার বছর পড়েছি। কলকাতা পুলিশের যে অ্যাডগুলো হয় না, ওগুলোর ড্রয়িংটা করি।  এখন বি.ফার্মা পড়ছি যাদবপুরে। সকাল বেলা একটা তরকারি বসিয়ে দু'ঘন্টা পড়ি। তারপর খেয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। পথে দু'একটা ট্রিপ সেরে ইউনিভারসিটি। সাড়ে চারটে পর্যন্ত। তারপর থেকে রাত বারোটার মধ্যে চোদ্দটা ট্রিপ সেরে বাড়ী গিয়ে আবার পড়তে বসি। বোনটা জোকা আই.আই.এম. এ পড়ে। ফাইনাল ইয়ার। প্লেসমেন্টও হয়ে গেছে। তিনটে সিমেস্টার মিলিয়ে মোট ২৪ লাখ টাকা। দিতে পেরেছি ম্যাম্। এখন ও চাকরিটা পেয়ে গেলেই আমার ছুটি। বাবা নেই, বাবার কাজটুকু করে দিয়েছি। এরপর ও আমায় ভুলে গেলেই ভালো।"

ভবানীপুর এসে গেল। আমায় বাড়ীর সামনে নামিয়ে ছেলেটা চলে গেল। ওর নামটাই জানা হয় নি। তাতে কিছু এসে যায় না। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে আমার চিত্ত এখন ঝলমলাচ্ছে। কান্নার আকাশ পেরিয়ে এসে পৌঁছেছে আলোকবিহঙ্গ সুপর্ণ। আলোর ভাষায় আকাশ ভরল ভালোবাসায়। আমি সেই আদিত্যবর্ণ পুরুষের দেখা পেয়েছি। 

ন দক্ষিণা বি চিকিতে ন সব্যা
ন প্রাচীনম্ আদিত্যা ন - উত পশ্চা।
পাক্যা চিদ্ বসবো ধীর্যা চিদ্
যুষ্মা নীতো অভয়ং জ্যোতির্ অশ্যাম্।

ডানও জানিনে, জানিনে কো বামও
পুব না, বসুরা, নয় পশ্চিমও
যাব সেই পথে, হে আদিত্যেরা,
নেতা -- নিয়ে যাবে যেখানে তোমরা
বুঝেই হোক বা না বুঝেই হোক
পেতে চাই সেই অভয় আলোক।।

ঋতবাকের সকল স্বজনকে জানাই আসন্ন দীপাবলীর প্রীতি ও শুভেচ্ছা।



0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - চয়ন

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


ক্রোধ - অক্রোধ
চয়ন 

শ্যামাপূজার প্রাক্কালে সম্পাদকীয়া আদেশ করলেন যে প্রচ্ছদ নিবন্ধ রচনা করতে হবে। ভাবলাম প্রসন্ন চিত্তে সবাইকে জানাব প্রীতি ও শুভেচ্ছা। রচনা করব বরাভয়দায়িনী, ভবতারিণী নাম্নী রূপকল্পের কোন টীকাভাষ্য। কিন্তু, লেখা শুরু করার ঠিক আগের মুহূর্তটিতে চোখ পড়ল বিজয়াদশমীর দিন জীবনসঙ্গীর হাতে খুন হওয়া মেধাবিনী মিতা দাসের শবদেহের ছবির ওপর। মনে পড়ল গত ১৫ই সেপ্টেম্বর দিল্লীতে ধর্ষিতা শিশুটির কথা আমাকে জানিয়ে আমার বোনের আকুতির কথা : "এগারো মাস দাদা! এগারো মাস বয়স ওর। কত ওজন হবে? পাঁচ কে.জি.? ও তোমার মেয়ে হতে পারত। আমার মেয়ে হতে পারত।" চিত্তের প্রসন্নতা আর রইল না। তার স্থান নিল প্রচণ্ড ক্রোধ। ভবতারিণীর রূপের পরিবর্তে আরেক কল্পবিগ্রহমূর্তির চিত্র উদিত হ'ল মানসপটে। ভীষণা, রক্তলোলুপা, খর্পরধারিণী, প্রলয়ঙ্করী কালিকার মূর্তি। বারবার মনে পড়তে লাগল স্বামী বিবেকানন্দের এক রচনার কথা। ১৮৯৮ তে লেখা। Kali The Mother। যন্ত্রণারূপিণী, বিনষ্টি রূপিণী, মৃত্যুরূপিণী দেবীর বন্দনা। নিবেদিতা লিখেছেন এই লেখা শেষ করেই স্বামীজি অজ্ঞান হয়ে যান। 

Kali The Mother

The stars are blotted out
The clouds are covering clouds
It is darkness vibrant, sonant.
In the roaring, whirling wind,
Are the souls of a million lunatics,
Just loosed from the prison house,
Wrenching trees by the roots
Sweeping all from the path.
The sea has joined the fray
And swirls up mountain waves,
To reach the pitchy sky.
The flash of lurid light
Reveals on every side
A thousand, thousand shades
Of death, begrimed and black.
Scattering plagues and sorrows,
Dancing mad with joy,
Come, Mother, Come! 
Death is Thy brearh.
And every shaking step
Destroys a world for e'er.
Thou 'Time ' the All Destroyer!
Come, O Mother, come!
Who dares misery love,
Dance in destruction's dance,
And hug the form of death, --
To him the Mother comes.

এই ভয়ঙ্করী, মহারুদ্রীর বন্দনা মন্ত্র জপ করতে ইচ্ছে হ'ল শঙ্খ ঘোষের ভাষায় : "এমনি করে থাকতে গেলে শেষ নেই শঙ্কার/ মারের জবাব মার/ বুকের ভেতর অন্ধকারে চমকে ওঠে হাড়/ মারের জবাব মার।" 

মন বারবার বলতে লাগল এই মহামারণ যজ্ঞের যথার্থ ঋত্বিক একজনই হতে পারেন। কুঠারধারী পরশুরাম। সমস্যা হ'ল তিনি পুরাণলোকের অধিবাসী। সেই কথনবিশ্বে আমার এই চণ্ড ক্রোধের কোন সঠিক বাকপ্রতিরূপের সন্ধান না পেয়ে দৃষ্টিপাত করলাম বঙ্গসাহিত্যলোকের দিকে। এবং সন্ধান পেলাম সেই পরশুরামের যাঁর কয়েকটি রচনায় অন্তত আমি আমার বর্তমান মানসিকতার প্রতিফলন স্থানে স্থানে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু, এ কি স্বপ্ন, না মায়া, না মতিভ্রম? কারণ, প্রথমত, রাজশেখর বসু একজন 'রসসাহিত্যিক', দ্বিতীয়ত, তাঁর ছদ্মনাম তিনি মোটেই পুরাণের পরশুরামের কথা ভেবে নির্বাচন করেন নি। ১৯২২ সালে এই অভিধা তিনি স্বর্ণকার তারাচাঁদ পরশুরামের নাম থেকে গ্রহণ করেন। কিন্ত, আমি যে দেখতে পাচ্ছি। ১৯৪৫ এ রচিত 'গামানুষ জাতির কথা' কাহিনীতে প্রথমে সমগ্র মানবজাতির বিনাশ কল্পনার পর গামানুষ জাতির সৃষ্টি ও বিলোপের কাহিনী বর্ণনা শেষে উপসংহারের তীব্র শ্লেষ যেন ফুটিয়ে তোলে তাঁর ভ্রুকুটিকুটিল মুখমণ্ডল : "মৃতবৎসা বসুন্ধরা একটু জিরিয়ে নেবেন তারপর আবার সসত্ত্বা হবেন। দুরাত্মা আর অকর্মণ্য সন্তানের বিলোপে তাঁর দুঃখ নেই। কাল নিরবধি, পৃথিবীও বিপুলা। তিনি অলসগমনা। দশ বিশ লক্ষ বৎসরে তাঁর তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে না, সুপ্রজাবতী হবার আশায় তিনি বারবার গর্ভধারণ করবেন।" গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে কোন এক সময় রচিত 'গন্ধমাদন বৈঠক' এ প্রায় হুবহু এক কথা : "পরশুরাম বললেন,'... ও সব চলবে না বাপু, আমি এখন বিষ্ণুর কাছে যাচ্ছি। তাঁকে বলব, আর বিলম্ব কেন, কল্কিরূপে অবতীর্ণ হও, ভূভার হরণ কর, পাপীদের নির্মূল করে দাও, অলস, অকর্মণ্য দুর্বলদেরও ধ্বংস করে ফেল, তবেই বসুন্ধরা শান্ত হবেন। আর তোমার যদি অবসর না থাকে তো আমাকে বল, আমিই না হয় আরেকবার অবতীর্ণ হই।" রক্তস্রোতে পৃথিবী ধুইয়ে দেওয়ার কল্পনা যিনি করেন তিনি 'রসসাহিত্যিক'? ১৯৫৩ সালে রচিত 'বালখিল্যদলের উৎপত্তি' কাহিনীতে না পড়ে পণ্ডিত হতে চাওয়া, অপদেবতার প্রভাবগ্রস্ত, ত্রিশঙ্কু ও বিশ্বামিত্রের ভজনাকারী, আশ্রম পোড়াতে অগ্রসর বালখিল্যদের রূপকের আড়ালে দেশের কিছুই না জেনে অর্ধপাচ্য বিদেশী মতাদর্শের অন্ধঅনুসরণকারীদের প্রতি পরশুরামের তিক্ত বিদ্রূপ নির্মমতার রূপ নিয়েছে : "ক্রতু একটু চিন্তা করে বললেন, 'এরা ব্রাহ্মণ সন্তান অপজাত হলেও অধৃষ্য ও অবধ্য, নতুবা মুখে লবণ দিয়ে এদের ব্যাপাদিত করা যেত।" 

'তিন বিধাতা', 'সিদ্ধিনাথের প্রলাপ', 'নিধিরামের নির্বন্ধ', 'গগন চটি', রামরাজ্য' এরকম আরও বহুরচনার নাম করা যেতে পারে যেখানে পরশুরামের কলম কুঠার হয়ে উঠেছে। ১৯৫০ এ রচিত 'ভীমগীতা' তো বিস্তৃততর আলোচনার দাবী রাখে। সে আলোচনার পূর্বে ১৯২৬ সালে রচিত পরশুরামের 'প্রার্থনা' নামক কবিতার অংশবিশেষ একবার পাঠ করা যাক : "যত খুশি দাও ক্ষমা অহিংসা অন্তরে মোর ভরি/ একটি কেবল মনের বাসনা ব'লে রাখি হে শ্রীহরি/ দুর্জন অরি একচড় যদি লাগায় আমারে কভু,/ তিনচড় তারে কশাইয়া দিব মাফ কর মোরে প্রভু।" স্বর্ণকারের নাম ছাড়িয়ে চারবছরের মধ্যেই লেখনীকে খরশান আয়ুধে পরিণত করে ক্রমে ক্রমে পরশুধারী জামদগ্ন্যেরই সমীপবর্তী যে হচ্ছিলেন 'রসসাহিত্যিক পরশুরাম' সে বিষয়ে আর কোন সংশয় বোধ করি থাকা উচিত নয়। বস্তুত: রাজশেখরের দৌহিত্রিপুত্র দীপংকর বসু স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, "নিজের সম্বন্ধে এই একটিমাত্র বিষয়ে তাঁকে বারবার বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখেছি... "এটা অত্যন্ত অপমানকর, 'রসসাহিত্যিক' আবার কী? আমি কি হাঁড়িতে রস ফুটিয়ে তৈরী করি?'" শ্রী বসু আরও জানিয়েছেন যে, "বহুবার বিশেষতঃ মানবসভ্যতার সমস্ত কুসংস্কার ও অন্যায়ের ক্ষেত্রে আঘাতের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর লেখা নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার রাজ্যে প্রবেশ করেছে।.... বুঝ যে জন জান সন্ধান।" ক্রোধসঞ্জাত অন্তর্দৃষ্টি সেই সন্ধানই দিল কি আমায়? 

একথা অনস্বীকার্য যে ব্যষ্টি ও সমষ্টির ক্রোধ কোন কোন সময় কল্যাণকর রূপ ধারণ করতে পারে। বেদে 'মন্যু' নামক দেবতার স্তুতি করা হয়েছে; মহাভারতে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করেছেন, "কথং মন্যুর্ণ বর্ধতে?" ঐ পাষণ্ডদের বিরুদ্ধে আপনার ক্রোধ কেন বেড়ে উঠছে না? ঠিক এই প্রশ্নই পরশুরাম ভীমকে দিয়ে করিয়েছেন তাঁর 'ভীমগীতা' তে : "কৃষ্ণ, তোমার শরীরে কি ক্রোধ বলে কিছুই নেই?" এই কাহিনী পরশুরামের সৃষ্টিবিশ্বে অতি উল্লেখযোগ্য এক স্থান অধিকার করে কারণ এখানে সাহিত্যিক পরশুরাম স্পষ্ট ভাবে এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারেন যা মহাভারতের অনুবাদক রাজশেখর বসুর পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। ভীম সরাসরি কৃষ্ণের প্রতিহিংসাপরায়ণতার সঙ্গে সম্পর্কহীন ধর্মযুদ্ধের তত্ত্বটিকেই চ্যালেঞ্জ করেন; "গোবিন্দ, তুমি নিতান্তই হাসালে। কংসকে মেরেছিলে কেন? জরাসন্ধকে মারবার জন্য আমাকে আর অর্জুনকে নিয়ে গিয়েছিলে কেন? রাজসূয় যজ্ঞের সভায় শিশুপালের মুণ্ডচ্ছেদ করেছিলে কেন? তোমার অক্রোধ কোথায় ছিল? আজ রণক্ষেত্রে অর্জুনের অক্রোধ দেখেও তাকে যুদ্ধে উৎসাহ দিলে কেন?" এই কাহিনীতে পরশুরাম নিজের সঙ্গে নিজেই বোঝাপড়ায় আসতে চান বলে মনে হয়। কারণ ভীম যখন বলেন, " যে লোক পরিণাম না ভেবে ক্রোধের বশে শত্রুকে আঘাত করে, সে হঠকারিতার ফলে নিজে মরতে পারে, তার আত্মীয়রাও মরতে পারে, কিন্তু তার স্বজাতির খ্যাতি ও প্রতাপ বেড়ে যায়"; তখনই আমরা বুঝতে পারি পরশুরাম স্মরণ করছেন যে সংস্কৃত ভাষায় সাহস আর bravery সমার্থক নয়। প্লাতো বা আরিস্তোতল যে নির্ভীক ধীরোদাত্ত বীরত্বকে arete বলতেন সেই বস্তুই ল্যাটিন cor এর হাত ধরে ইংরিজিতে হয়েছে courage। Cor শব্দের অর্থ হৃদয়। কিন্তু সাহস বলতে সংস্কৃত ভাষা কোন মহান হৃদয় বৃত্তিকে বোঝে না। সে যা বোঝে তা হ'ল Courage এর ঠিক বিপরীতার্থক শব্দ : Rashness। আর তাই পরশুরামের 'ভীমগীতা'য় শেষ কথা কৃষ্ণই বলেন, ভীম নয়: "যে ক্রোধের বশে ধর্মাধর্মের জ্ঞান হারায় না এবং অন্যায়ের যথোচিত প্রতিকার করে, সেই শ্রেষ্ঠ পুরুষ।" 

আমার ক্রোধ তবে এতক্ষণে তার প্রস্থানভূমি খুঁজে পেল। হৃদয়াবেগ প্রধান ক্রোধ ন্যায় অন্যায় বিচারে অক্ষম। আর সেই ক্রোধের বশবর্তী হয়ে রক্তস্নানের ইচ্ছা জিঘাংসাবৃত্তি হতে পারে কিন্তু ন্যায় বিচার প্রার্থনা নয়। চিত্তনদী উভয়তবাহিনী -- বহতি পাপায়, বহতি কল্যাণায় চ। আবেগের নদীকে যে দুদিকেই বওয়ানো যায়, একমাত্র মানুষই যে পারে ক্রোধের বেগ উলটো দিকে বওয়াতে : সেই শিক্ষাই পেলাম 'পরশুরাম' রাজশেখরের কাছ থেকে। মহাভারত অনুবাদকারী আমায় ডেকে বললেন, "ন মনুষ্যাৎ শ্রেষ্ঠতর হি কিঞ্চিৎ" : মানুষের চেয়ে বেশী বড় আর কিছুই নেই। 

তাহলে আমি কী করতে পারি? ঋতভাষী ঋতবাকের পদাঙ্ক অনুসরণ ক'রে চারপাশের মোহগ্রস্ত আঁধার পেরিয়ে আলোর উদ্দেশ্যে চলতে পারি। মূঢ়তার অন্ধকারে বন্দী বহুজনতার মধ্যে একাকী। মুহ্যন্তু অন্যে অভিতো জনাসঃ -- অপরে থাকুক মোহান্ধকারে -- কিন্তু আমি আলোর দিশারি হতে পারি যদি আমি তাই চাই। ঋতবাক সজাগ; সতর্ক তার বুধমণ্ডলী। তাঁরা স তর্ক ও বটে। নিজেকে বারবার যাচিয়ে নিয়ে তাঁরা প্রমাণ করেন যে জাগ্রতজনই ঋকমন্ত্রদের কৃপাধন্য : যো জাগায় তম্ ঋচঃ কাময়ন্তে। আমি আসন্ন দীপাবলী উৎসবের আলোর রোশনাই এর কথা স্মরণ করে গৌরী ধর্মপালের কথা একটু বদলে নিয়ে প্রার্থনা করতে পারি :

যত্র জ্যোতির্ অজস্রং যস্মিন্ লোকে স্বর্হিতম্।
তস্মিন মাং দেহি পবমান
অমৃতে লোকে অক্ষিতে।

যেখানে নিশিদিন আলোক অফুরান
যেখানে সূর্য অচল, ঠায় ---
প্রতিষ্ঠা কর আমায় পবমান
অমৃত অক্ষয় সে চেতনায়। 

এমনি করেই ক্রোধ রূপ নেয় অক্রোধের; ভীমা ভয়ঙ্করী হয়ে ওঠেন জননী বাক্। আর তাঁর ধ্যানমন্ত্রের সন্ধানও শঙ্খ ঘোষ রচিত 'স্লোগান' কবিতাটিতেই পাওয়া যায়: 

কথা কেবল মার খায় না কথার বড় ধার
মারের মধ্যে ছলকে ওঠে শব্দের সংসার। 

এই কথা বা শব্দই হ'ল সাহিত্য; যা সঙ্গে থাকে। এর চর্চাই ক্রোধকে সংহত করে উপলব্ধিতে উত্তীর্ণ করে। আমি বুঝি যে সংস্কৃত সাহস আর ইংরিজি courage এর মধ্যে যে ব্যবধান সংস্কৃত ক্রোধ আর বাংলা রাগের মধ্যেও ঠিক তাই। কারণ সংস্কৃতে রাগ বলতে ক্রোধের ঠিক বিপরীত অনুভূতিটিকে বোঝায় যার নাম ভালোবাসা। ক্রোধের বশে ধ্বংসস্বরূপা দেবীবন্দনা কারোরই কোন পরিবর্তন আনতে পারবে না কিন্তু অমৃত, অক্ষয় চেতন লোকে উত্তীর্ণ হ'লে; নিজের প্রতিহিংসাকামীতাকে দমন করলে হয়তো বা আমি সেই সৃজনবিশ্বের অংশভাক হতে পারব যার মন্ত্রশক্তি কিছু প্রতিজিঘাংসুকে থামাতে পারবে। ঋতবাক উচ্চারণে সেই বোধ জাগ্রত হয় মহাভারতকার যাকে বলেন 'অনুক্রোশ'। এ হ'ল সেই নৈতিক ধর্মবোধ যা প্রকৃতিগত : intrinsic। ঔচিত্য নির্ভর শুভাশুভবুদ্ধি যা মানুষকে মানবতা দেয় তার মূলে থাকে এই অনুক্রোশ। প্রতিকারহীন অ-দণ্ডিত অন্যায় দেখলেও এই বোধ আক্রোশকে শমিত করে। 'ভীমগীতা'কে রূপান্তরিত করে ভাগবত গীতায় যা মানুষকে বুদ্ধিযোগ আশ্রয় করে আসক্তিহীনভাবে (অর্থাৎ involved না হয়ে) বহুজনহিতায় এমন এক পরিবেশ গড়ে তুলতে প্রাণিত করে যেখানে আর কোনও অমিতার বা ঐ এগারোমাসের শিশুটির মতন অপর কোনও শিশুর একই পরিণতি ঘটবে না। ঋতভাষী কোনও কবি প্রতিহিংসক মানবকুলকে নিবৃত্ত করে বলবেন:

"মারের মুখে মার দাঁড়াবে? শোকের মুখে শোক?
এই তাহলে উপায়? পথ? পদ্ধতি? সহায়?
ফিরে যাবার রাস্তা শুধু একদিকেই এগিয়ে যাবে?
হত্যা থেকে পালটা হত্যায়?
তোমার মুখ কী করে আমি হাতে ধরব তবে?" ( জয় গোস্বামী) 



ঋণ স্বীকার : 
১) বেদ ও রবীন্দ্রনাথ --- গৌরী ধর্মপাল। 
২) ভাতকাপড়ের ভাবনা এবং কয়েকটি আটপৌরে দার্শনিক প্রয়াস -- অরিন্দম চক্রবর্তী।

0 comments:

0

প্রবন্ধ- সুমিতা দাসমজুমদার

Posted in





                                                                                                                                                                ছবি - পল্লব বরন পাল

প্রবন্ধ



ব্রাহ্মধর্ম ও রবীন্দ্রনাথ : রবীন্দ্র-ধর্ম 
সুমিতা দাসমজুমদার

মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র, যাঁদের মাতৃভাষা স্প্যানিশ, তাঁরা একবার রবীন্দ্র—প্রসঙ্গে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অতীন্দ্রিয় জগতের একটা আভাস পান তাঁরা, একটা আধ্যাত্মিকতার সুর তাঁর লেখার মধ্যে আছে, যেটা মানুষকে উঁচুতে তুলে নিয়ে যায়, আর মানুষকে আকুল করে! রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্য ঠিক এখানে, এই জায়গাটাতে। তাই তাঁর গান, সুরের ভাষায় অনায়াসে আলোড়ন তোলে এই বলে যে: 

আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে...
ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ—পানে।।

কিন্তু এই বীক্ষণ রবীন্দ্রনাথ পেলেন কোথায়? জন্মসূত্রে পাওয়া ব্রাহ্মিকতার মধ্যেই কী উপ্ত হয়েছিলে এর বীজ? নাকি, ব্যাপ্ত হ’য়েছিল নিজের অন্তরশায়ী ক্রিস্টালাইজড্‌ ধর্ম—চেতনায়?

ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথ; অতএব, জন্মসূত্রে ব্রাহ্ম। কর্মসূত্রেও ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যোগ ছিল তাঁর। একদা আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক হয়েছিলেন তিনি; এমন কি, বৃত হয়েছিলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদকের পদে। অথচ, পরবর্ত্তীকালে, ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে ক্রমশঃ দূরত্ব বাড়তে থাকে তাঁর। কট্টরপন্থী ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সংঘাত ও বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তিনি; এমন কি পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গেও তৈরি হয় দূরত্বের অক্ষরেখা। অথচ, গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর পিতার পার্শ্বচর। সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে সেই সময় তুমুল সংঘাতে জরিয়ে পড়েছিলেন পিতৃঅনুগত রবীন্দ্রনাথ। সরলাদেবীর লেখা ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ মেলে।

তবে কি, রবীন্দ্রনাথ, ব্যক্তিগত ধর্মবোধের ক্ষেত্রে, ভেতর থেকে ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছিলেন? অথবা, পাল্টে ফেলছিলেন নিজেকে? প্রথাগত ধর্মের নির্মোক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল এক নতুন মুখ – যা কিনা নতুনতর বোধে, চেতনায় উদ্বুদ্ধ? এমনকি, নাস্তিকতারও সহচর? তাই, ঋজু-কন্ঠে উচ্চারণ করতে পারেন ‘আমি ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন’ – এমন কথাও! লক্ষণীয়, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের radical প্রগতিমূলক চিন্তাভাবনা – ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে মানবহিতের ধারণা – গণ্ডীমুক্তিও ঘটেছিল সেই সময়। ব্রাহ্মসমাজে আমন্ত্রিত সদস্য হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে চাইছিলেন প্রশান্ত মহলানবিশ, সুকুমার সেন প্রমুখ তরুণদের দল।

ব্রাহ্মসমাজেও ক্রমশঃ পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে সর্বজনীন ধর্ম universal religion এর দিকে যাত্রা শুরু হয় তার। দেখা দেয় রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনার, চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে ক্রমবিবর্তন। অনলস, অনর্গল সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে শুরু হয় মুক্তধর্ম তথা সত্যধর্মের অনুসন্ধান-প্রয়াস। 

রোমাঁ রোলাঁ একবার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘যাঁর গ্যেটের মতো প্রতিভা ভারতের সব নদীর মিলন স্থলে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একথা ধরে নেওয়া চলে যে, তাঁর মধ্যে ব্রাহ্মসমাজের (এটা তাঁর পিতা মহর্ষি কর্তৃক সঞ্চারিত হয়েছিল) এবং রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নব-বেদান্তবাদের দুটি ধারা মিলিত ও সমন্বিত হয়েছিল। উভয়ের দ্বারা সমৃদ্ধ হ’য়ে অথচ উভয় থেকেই মুক্ত থেকে তিনি তাঁর মানসলোকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সার্থক মিলন ঘটিয়ে ছিলেন। সমাজ ও জাতির দিক থেকে বিচার করলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব চিন্তাগুলোকে প্রকাশ্যভাবে সর্ব প্রথম ঘোষণা করেছিলেন ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে স্বদেশী আন্দোলনের সূচনাকালে, অর্থাৎ বিবেকানন্দের দেহ রক্ষার চার বছর পরে। বিবেকানন্দের মতন একজন অগ্রদূতের প্রভাব যে তাঁর চিন্তাজগতের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা নিঃসন্দেহ।’ (দ্র. স্বামী বিবেকানন্দ : মনীষীদের চোখে, প্রকাশ – স্বামী সর্বভূতানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অফ্‌ কালচার, পৃঃ ৪১)।

বিবেকানন্দ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একবার রোমাঁ রোলাঁ কে বলেছিলেন, যদি তুমি ভারতকে জানতে চাও, বিবেকানন্দকে জান। তাঁর মধ্যে সবকিছুই ইতিবাচক, নেতিবাচক কিছু নেই।’

‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ একবার ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য’ নামে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন : ‘ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষীগণ ... প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে মিলাইয়া কার্য করিয়া গিয়াছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ রামমোহন রায়, রানাডে এবং বিবেকানন্দের নাম করিতে পারি। ইঁহারা প্রত্যেকেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাধনাকে একীভূত করিতে চাহিয়াছেন; ইঁহারা বুঝাইয়াছেন যে, জ্ঞান শুধু এক দেশে বা জাতির মধ্যে আবদ্ধ নহে, পৃথিবীতে যে দেশেই যে কেহ জ্ঞানকে মুক্ত করিয়াছেন, জড়ত্বের শৃঙ্খলমোচন করিয়া মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকে উন্মুখ করিয়া দিয়াছেন তিনিই আমাদের আপন – তিনি ভারতের ঋষি হোন বা প্রতীচ্যের মনীষী হউন – তাঁহাকে লিয়া আমরা মানব মাত্রেই ধন্য।’

কবির এই বীক্ষণেই কী ধরা পড়েনা যে ধর্ম সম্পর্কে তাঁর চেতনা কোনও বিধিবদ্ধ লক্ষ্মণরেখা মানেনি? ক্রমশঃ এই ধর্মবোধ ব্যাপ্ত হ’তে হ’তে চলেছে দিগন্তের অভিসারে! যে কবি একদা উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করে দিয়েছেন, ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয় / অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় / লভিব মুক্তির স্বাদ’ – আসলে, তাঁর নিজের ধর্ম কী? অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের নিজের ধর্ম কী? একবার কথাচ্ছলে বলেলছিলেন, বৈষ্ণবধর্ম তাঁর খুব ভাল লাগে – কেননা, তা’ অহেতুকি। সেখানে ভালবাসার জন্যেই ভালবাসা। ‘তাই তোমার আনন্দ আমার ‘পর।’ ভালবাসাই ভালবাসার শেষ কথা। কবির ব্যক্তিগত ধর্মবোধ, বাইরে থেকে আহৃত বা আরোপিত নয়, সেই ধর্মীয় চেতনা তাঁর অন্তরের কবিসত্তা থেকেই উৎসারিত, মনের মানুষে কবির অন্তরতম আনন্দেই তার চূড়ান্ত বিকাশ। বাইরে থেকে পাওয়া ধর্মচেতনা যে মানুষের সত্যকার ধর্মচেতনা নয়, সে কথাই কবি বলেছেন ‘Rabindranath Tagore : A Centenary Volume’ গ্রন্থে, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো লিখিত টTagore on the Bank of the River plate’ নামক প্রবন্ধে ; কবি বলেছিলেন, ‘The religion that only comes to us from external scriptures never becomes our own; our only tie with it is that of habit. To gain religion within is man’s lifelong adventure. In the extremity of suffering must it be born, on his life-blood it must live; and then, whether or not it brings him happiness, the man’s journey shall end in the joy of fulfillment.

‘ছিন্নপত্রাবলী’র ২৩৮ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘ঠিক যাকে সাধারণতঃ ধর্ম বলে, সেটা এ আমি আমার নিজের মধ্যে সুস্পষ্ট দৃঢ় রূপে লাভ করতে পেরেছি তা বলতে পারিনে, কিন্তু মনের ভিতরে ভিতরে ক্রমশঃ যে একটা সজীব পদার্থ সৃষ্ট হ’ইয়ে উঠছে তা অনেক সময় অনুভব করতে পারি। শাস্ত্রে যা লেখে, তা সত্য কি মিথ্যা বলতে পারিনে, কিন্তু সে সমস্ত সত্য অনেক সময় আমার পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযোগী – বস্তুত আমার পক্ষে তার অস্তিত্ব নাই বললেই হয়।’ ২৩৬ সংখ্যক পত্রে এই বক্তব্যকেই বিশদ আকারে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন - ‘আমরা বাইরের শাস্ত্র থেকে যে ধর্ম পাই, সে কখনো আমার হ’য়ে ওঠে না, তার সঙ্গে কেবল একটা অভ্যাসের যোগ দৃঢ় হ’য়ে আসে। যে ধর্ম আমার জীবনের ভিতরে সংসারের দুঃসহ তাপে ক্রিস্টালাইজড্‌ হ’ইয়ে ওঠে সেই আমার যথার্থ। ... সেই জিনিসটাকে নিজের মধ্যে উদ্ভূত করে তোলাই মানুষের পক্ষে মনুষ্যত্বের চরম ফল। চরম বেদনায় তাকে জন্মদান করতে হয়।’ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, ‘অভ্যাসের ধর্ম’ থেকে ‘প্রাণের ধর্মকে সম্পূর্ণ পৃথক করে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থেও নিজের এই ধর্মবোধের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘যে অভ্যাস বাইরে থেকে চাপানো, তা আমি গ্রহণ করতে অক্ষম।’

রবীন্দ্রনাথের প্রাণের ধর্ম – মানবধর্ম এবং তা একান্তভাবেই প্রেমের ধর্ম। কবিমানসে তাঁর জীবন দেবতার লীলার মধ্যেই সে ধর্ম আস্বাদনীয়। ‘Personality’ গ্রন্থে ‘Woman’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘With the growth of man’s spiritual life, our worship has become the worship of love.’ অর্থাৎ প্রেমের উপাসনাই ক্রমোন্নত অধ্যাত্ম-জীবনের সত্যকার উপাসনা। তাঁর যাবতীয় সাহিত্য-শিল্প রচনায় এই উপলব্ধির বিচিত্র রূপ ধরা পড়ে।

রবীন্দ্রনাথ মানুষের কাছে মুক্তি, মানবতা ও সত্যের দিশারী। মানবধর্ম, মুক্তধর্ম তথা সত্যধর্মের উপাসক রবীন্দ্রনাথ বৃহত্তর জীবন-সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন আমাদের। রবীন্দ্রনাথই মানব-সভ্যতাকে নতুন ক’রে মনে করিয়ে দেন ‘সৃষ্টির প্রথম রহস্য : আলোকের প্রকাশ’ ; আর, ‘সৃষ্টির শেষ রহস্য : ভালোবাসার অমৃত।



0 comments:

0

প্রবন্ধ - অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in



প্রবন্ধ

আইনের সিঁদুরবিন্দু 
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী 



ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা নং ৪৯৭। পৃথিবীর আর কোনও দেশের দণ্ডবিধিতে এই একবিংশ শতাব্দে এমন চিত্তাকর্ষক দ্বিতীয় কোনও ধারা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কেন চিত্তাকর্ষক - সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বরং যে অপরাধের শাস্তির জন্যে এই ধারাটি বরাদ্দ সেই অপরাধটি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

ইংরাজিতে অপরাধটিকে বলে adultery। ল্যাটিন adulterium থেকে আগত এই ইংরাজি শব্দটির অর্থ হলো, কোনও বিবাহিত ব্যক্তির নিজ স্বামী বা স্ত্রী ব্যতীত অন্য ব্যক্তির সঙ্গে স্বেচ্ছাকৃত যৌনসংগম। বিবাহিত ব্যক্তিটি পুরুষ হলে তিনি adulteror, মহিলা হলে তিনি adulteress। নিজের এই অনুবাদটির ওপর ভরসা না করে আমি অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ, দুটি অভিধান থেকেই adultery শব্দটির অর্থ তুলে দিচ্ছি: 

1. Voluntary sexual intercourse of married person other than with spouse [Oxford]. 

2. Sex between a married man or woman and someone who is not their wife or husband [Cambridge]. 

ভারতবর্ষ বাদে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের আইনি পরিভাষা(law lexicon)-য় এই শব্দটি উল্লিখিত অর্থে গৃহীত হয়েছে। বাংলা ভাষায় এই শব্দটির যথার্থ প্রতিশব্দ নেই। ‘ব্যভিচার’ শব্দটি এই অর্থে আমরা ব্যবহার করে থাকি ঠিকই, কিন্তু ‘ব্যভিচার’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অনেক বিস্তৃত। সেখানে যে কোনও ধরনের অনাচারকেই ব্যভিচার বলা হয়; যৌন অনাচারের ক্ষেত্রে ‘বিবাহিত/বিবাহিতা’ ও ‘অবিবাহিত/ অবিবাহিতা’র কোনও ভেদ এই অর্থের মধ্যে অনুপস্থিত। ‘পরকীয় গমন’(‘পরকীয়’ উভয় লিঙ্গার্থে ধরে) বললে বরং adultery শব্দের সঠিক অর্থটি পাওয়া যায়। 

বিভিন্ন দেশের দণ্ডবিধির প্রসঙ্গে আসার আগে আমি law lexicon -এ গৃহীত adultery -র সংজ্ঞাটি উল্লেখ করছিঃ 

Adultery is voluntary sexual intercourse between a married person and someone other than the lawful spouse. 

অর্থাৎ, আভিধানিক ও আইনি – দুটি অর্থেই পরকীয়গামী (adulteror) তিনিই যিনি বিবাহিত হয়েও নিজের স্ত্রী ব্যতীত অন্য মহিলার সঙ্গে যৌনসংগম করেছেন বা যিনি অন্যের স্ত্রী-তে উপগত হয়েছেন। আবার, পরকীয়গামিনী (adulteress) তিনিই যিনি বিবাহিতা হয়েও নিজের স্বামী ব্যতীত অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌনাচার করেছেন বা যিনি অন্যের স্বামীর সঙ্গে যৌনসংগম করেছেন। 

শব্দার্থ বা বাক্যার্থ নিয়ে এতখানি পরিসর খরচ করার উদ্দেশ্য একটাই – দণ্ডবিধিতে এই কার্যটিকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গণ্য করার অন্তর্নিহিত মূল নীতিটি খুঁজে বের করা। আশা করি এতক্ষণে বোঝা গেছে যে অপরাধটি মূলত বিশ্বাসভঙ্গের। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানটির পবিত্রতা রক্ষা করা। একদিকে ধর্মীয় ও নৈতিক বিচার, বংশধারা ও উত্তরাধিকারের বিশুদ্ধতা, অন্যদিকে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ও ব্যক্তি স্বাধীনতা – এই দুই টানাপড়েনে বিষয়টি জটিল ও তর্কসাপেক্ষ। এ নিয়ে বিশদ আলোচনা এই নিবন্ধে অপ্রাসঙ্গিক। তবুও এটি উল্লেখ করার হেতু এই যে, এই বিতর্কের কারণেই যুক্তরাজ্য সমেত ইউরোপের সব দেশগুলিই গত শতাব্দের মাঝামাঝি থেকে তাদের দণ্ডবিধি থেকে ‘পরকীয়গমন’-কে রেহাই দিয়েছে। ওই দেশগুলিতে তা এখন ব্যক্তিক অপরাধ (personal offence) মাত্র। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আজও এই বিতর্কের মীমাংসা হয়নি। ফলে সে দেশের ২৩টি রাজ্যে এখনও ‘পরকীয়গমন’ আইনত দণ্ডার্হ অপরাধ। তবে সেই সব রাজ্যের দণ্ডবিধিতে এটি বিবাহের অনেকগুলি চুক্তির মধ্যে যে চুক্তিটি ভঙ্গের অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয় তা হলো দম্পতির পরস্পরের প্রতি একনিষ্ঠ যৌনতায় আবদ্ধ থাকার চুক্তি। তৃতীয় কোনও ব্যক্তি যদি বিবাহিত দম্পতির এই একনিষ্ঠতা ভঙ্গের কারণ হন, তিনিও একই অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবেন। অপরাধী প্রমাণিত হলে এই কর্মে লিপ্ত দুই ব্যক্তির শাস্তি সমমাত্রিক, নারী-পুরুষের ভেদরেখা এই সব রাজ্যের দণ্ডবিধিতে অনুপস্থিত। 

এবার ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারাটি মূল ভাষায় একবার পড়ে নেওয়া যাকঃ 

Indian Penal Code 

Section 497: Adultery 

Whoever has sexual intercourse with a person who is and whom he knows or has reason to believe to be the wife of another man, without the consent or connivance of that man, such sexual intercourse not amounting to the offence of rape, is guilty of the offence of adultery, and shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to five years, or with fine, or with both. In such case the wife shall not be punishable as an abettor. 

দেখুন দেখি, এই না হলে আইন! একেবারে সোজা-সাপটা, জলবত্তরলম্‌; এদিক-ওদিক কিচ্ছু নেই, এর একটাই দিক। অন্য দেশের আইনটি বুঝতে এবং বোঝাতে গিয়ে এতক্ষণ আমার মাথাটি বন্‌বন্‌ করে ঘুরছিল। adultery, adulteror, adulteress, বিবাহিত, বিবাহিতা, কে কার স্বামী বা স্ত্রী, কে কার বিশ্বাসভঙ্গ, অধিকার-লঙ্ঘন ইত্যাদি করল – সেসব ভাবতে গিয়ে এমনই খেই হারিয়ে ফেলছিলাম যে আমাকে ওই ইংরাজি শব্দগুলির বিশ্রী কতগুলি বাংলা প্রতিশব্দ পর্যন্ত তৈরি করতে হল। 

এখানে আর সেসব ঝামেলা নেই। আমরা এখন অন্য দেশে, অন্য যুগে চলে এসেছি। আপনি যদি পর-এর অনুমতি বা প্রশ্রয় বিনা জেনেবুঝে পরদার গমন করেন, এবং আপনার এই কম্মটি ধর্ষণ বলে পরিগণিত না হয়, তাহলে আপনি adultery বা আমার বদজবানিতে, পরকীয়াগমন অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবেন, এবং আপনার পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাবাস, বা জরিমানা, বা দুটোই হতে পারে। আপনার দুষ্কর্মে সহযোগী হিসাবে পরদারটি কিন্তু শাস্তিযোগ্য হবেন না। 

শেষ লাইনটি পড়ে যদি আপনার আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়, তাহলে ধরে নিতে বাধ্য হব এই দেশে আপনি ভুল করে একশ বছর আগে নিয়ে ফেলেছেন! এ দেশের বিয়েতে চুক্তি বা বিশ্বাসের কোন প্রশ্ন নেই; কেননা, ওসব দুটি সচেতন মানুষের মধ্যে হয়। নারী তো অচেতন পদার্থ মাত্র। সুতরাং এখানে চুক্তি বা বিশ্বাসভঙ্গ অবান্তর কথা। তবে পরকীয়াগামী পুরুষটি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য, যেহেতু সে বিনা অনুমতিতে অপরের সম্পত্তিতে প্রবেশ করেছে (মাতৃবৎ পরদারেসু পরদ্রব্যেসু লৌস্ট্রবৎ - এই ঋষিবাক্যটি সাফ্‌ল করে পরদারেসু লৌস্ট্রবৎ গণ্য যদি না করতে পারেন তো কারাবাস অর্জনই আপনার নিয়তি)। কিন্তু নারীটি তার স্বামী এবং প্রভুর সম্পত্তিমাত্র, তার শাস্তির প্রশ্ন অবান্তর! আবার, স্বামী চাইলে তাঁর সম্পত্তিটি অন্য কাউকে ব্যবহার করতেও দিতে পারেন; তাতে কোনও অপরাধ সংঘটিত হবে না, বরং মহাভারত শুদ্ধ হবে – ক্ষেত্রজ সন্তানের কথা পাঠকেরা অবশ্যই অবগত আছেন। 

ভাবলে সত্যই অবাক হয়ে যেতে হয় ভারতীয় দণ্ডবিধিতে এমনই একটি ধারা আজও সগৌরবে বিদ্যমান! ইংরেজদের তৈরি করা এই ধারাটি তারা নিজেদের দেশে কবেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আর আমরা সেটিকে এখনও দিব্যি বয়ে নিয়ে চলেছি! জাতীয় মহিলা কমিশন ধারাটির সমালোচনা করে এটিকে বাতিল অথবা দেওয়ানি অপরাধের সামিল করার দাবি অবশ্যই জানিয়েছেন, কিন্তু বিস্তর যে সব নারীবাদী সংগঠন আছেন, যাঁরা বিভিন্ন অকিঞ্চিৎকর ব্যাপারে প্রায়ই প্রবল শোরগোল তোলেন, তাঁরা নারীর পক্ষে তীব্র অবমাননাকর এই ধারাটির প্রতি এতটা সহিষ্ণু কেন সেটা তাঁরাই জানেন! 

তথ্যসুত্র- 
1. Indian Penal Code
2. Adultery: A Comparison of Military Law and State Law and the Controversy by Melissa Ash Haggard 
3. Laws on Infidelity and Adultery (website: www.epis.us)

পুনর্মুদ্রণ

0 comments:

0

বইঘর - সুকন্যা দাস ও শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া

Posted in


বইঘর


দেবতার জন্ম - শিবরাম চক্রবর্তী
সুকন্যা দাস ও শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া


বাংলা সাহিত্যে শিবরাম চক্রবর্তী একক এবং বিশিষ্ট। মালদহের চাচল/ চাঁচল/ চাঁচোল জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম। বাড়ির পরিবেশ ভক্তিভাবাপন্ন; বাবা বৈষ্ণব, মা শাক্ত। কিন্তু জন্মগতভাবে তিনি বস্তুবাদী। বস্তুবাদের প্রতি নিষ্ঠা সময়ে তাঁর মধ্যে জন্ম দেয় সাম্যবাদী চেতনার। সাম্যবাদী হওয়ায় জমিদারি চলন বেশিদিন সহ্য হয়নি তাঁর। কেবল বৌদ্ধিক আকর্ষণ নয়, সাম্যবাদের প্রায়োগিক সম্ভবনাকে কেন্দ্র করেই তাঁর বিশিষ্ট জীবনযাপনের সূচনা। প্রথমে ছাত্রজীবনে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান এবং পরে পৈত্রিক জমিদারীর বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ তাঁকে দেশছাড়া করে। জমিদার পুত্রের গ্রাসাচ্ছাদনের লড়াই তাঁকে নিয়ে যায় বিচিত্র পেশার পথে— কখনও হকারি, কখনও সাংবাদিকতা, কখনও নিছক দিনমজুরী। আশ্চর্য ছিল তাঁর প্রাণশক্তি এবং জীবনরস। জীবনের প্রতি আকর্ষণ যেমন কখনও হারাননি, কখনও হারিয়ে ফেলেননি রসবোধ। বিচিত্র পেশার পথে, বিচিত্র জনসংযোগ— সবই হয়ে উঠেছে পরবর্তী জীবনে তাঁর বিশিষ্ট লেখক হয়ে ওঠার উপকরণ। ঘুরেছেন দেশজুড়ে, মিশেছেন বাছ-বিচার না করে, আর শেষে থিতু হয়েছেন কলেজস্ট্রিট এলাকার মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের মেস বাড়িতে। কলম জন্ম দিয়েছে এমন সব লেখা যা তাঁকে একদিকে করেছে বিশিষ্ট অন্যদিকে উত্তরাধিকারহীন। 

একদিকে হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন, অন্যদিকে গোয়েন্দা কল্কেকাশি— তাঁর গায়ে হাসির গল্পকারের তকমা এঁটে দিতে ভুলও করেনি, দেরিও করেনি বাঙালি। তাঁর মস্কো থেকে পণ্ডিচেরী বা আত্মজীবনী ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা সাধারণ পাঠকের বীক্ষার অতীত। কিন্তু সেসব তথাকথিত সিরিয়াস লেখার কথা বাদ দিলেও, হাসি, ঠাট্টা, তামাশা বা নেহাত চুটকির পেছনেও শিবরামের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ এবং সামাজিক মন্তব্যগুলি চোখে না পড়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু সেসবও সহজে চোখে পড়ে না আমাদের। স্বভাবতই ক্রমে প্রায় আড়ালে চলে যায় তাঁর ‘দেবতার জন্ম’-র মতো বিশিষ্ট গল্পও। তবে নিবিষ্ট পাঠকের কাছে শিবরামের আবেদন কোনওদিনই কেবল হাসির গল্পকার হিসাবে নয়। 

চলার পথে একটি পাথরের ক্রমে দেবতা হয়ে ওঠার গল্প আমাদের খুব অপরিচিত পৃথিবীর কথা নয়। হুবহু এমন না হলেও আমাদের চারপাশে এমন ঘটনা কতই ঘটে রোজ, যেখানে মানুষ তার স্বাভাবিক যুক্তি বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে লোক-প্রচলিত ধ্যানধারণার অন্ধ অনুবর্তন করে মাত্র। ঈশ্বর বিশ্বাস, সাধন পন্থা, শৈব-শাক্ত নিয়ে কোনও জটিল দার্শনিক বিতর্ক নয়, সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে কবচ-তাবিচ, তন্ত্র-মন্ত্র, তেলপড়া-জলপড়া, মাদুলি, গ্রহরত্ন নিয়েও আমরা প্রতিদিন যে নির্বিচার অন্ধত্ব দেখিয়ে চলি তা আমাদের বোধেও আসে না। সে নির্বোধ চর্চাই যে ক্রমে ডাইনি, ভূত, বাবাজি-মাতাজিদের সমাজে জাঁকিয়ে বসার সুযোগ করে দেয়, সামান্য প্ররোচনা এমনকি বিনা প্ররোচনাতেই মানবতা বিরোধী হানাহানি, খুনোখুনির জন্ম দেয় সে কথা খেয়াল রাখি না আমরা। আমাদের চারপাশের বিভিন্ন ‘থান’, শনিমন্দির, সন্তোষীমাতাদের নিয়ে গড়ে ওঠা অসামঞ্জস্যের সঙ্গে আপস করে নিয়েছি আমরা। এইসব ঘটনা আমাদের বাঁচার নিয়ত অনুসঙ্গ। আমাদের চোখেই পড়ে না আর। 

কিন্তু শিবরামের চোখ সাধারণের চোখ নয়। তিনি কেবল দেখেন আর পাশ কাটিয়ে পথ চলেন, এমন নয়। কথকের মতই তিনি এই সব অসঙ্গতিতে হোঁচট খান। কিন্তু বারে বারে হোঁচট খেয়ে উপেক্ষা করেন না। অসঙ্গতির মর্মমূলে আঘাত করার কথা ভেবে একদিন আক্রমণ করে বসেন অসঙ্গতিকে। জনতা চারপাশে ভিড় করে থাকে তাদের স্বভাব অনুযায়ী, এগিয়ে আসে না। সাম্যবাদে বিশ্বাসী লেখকের তা অসঙ্গত মনে হয় কিনা বোঝা যায় না। কথক কিন্তু হেলাভরে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেন না পাথর বা নুড়িটিকে। যে পাথরটি কথকের চলার পথের বিঘ্ন, তার মূলোৎপাটন করার মধ্যে কথকের যে চরিত্রের প্রকাশ, পাথরটিকে ছুঁড়ে ফেলাটাই তো সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতো। তা হয় না। কথক জনতার উদ্দেশে জানতে চায়, কারও পাথরটা দরকার আছে কিনা। কেন কথকের এই জিজ্ঞাসা। কথক কি তবে প্রথম থেকেই পাথরটির কোনও অন্যতর পরিণতি নিয়ে, সম্ভবনা নিয়ে আশাবাদী; নাকি আমজনতার কুসংস্কার নিয়ে আশঙ্কাবান? পাথরটিকে পড়ে থাকে একপাশে। প্রতিদিন তার দিকে চোখ পড়ে কথকের এবং চারপাশে ভিড় করে আসা জনতার। এই জনতার মধ্যে স্পষ্ট চরিত্র একটিই। তার সঙ্গে কথকের কথা হয় মাঝে মাঝে, পাথরটিকে ঘিরেই। পাথরটি কি কথকের মতো একজন নিখাদ যুক্তিবাদীর এতখানি মনোযোগের কারণ হতে পারে? কেন? না কি এ সেই আমাদের মনের অতলে গেঁড়ে বসে থাকা সংস্কারের বেড়ি। লোকসমক্ষে সে সংস্কার উপড়ে ফেলার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা যায়, নিজেকে সে সংস্কার থেকে মুক্ত করা যায় কি না সেটাই লেখকের নিরীক্ষা? 

গল্পের শুরু থেকেই নুড়িটি যে মনোযোগ পাচ্ছিল তার স্বাভাবিক পরিণতিতেই সে একদিন জোগাড় করে নেয় তার বাঞ্ছিত তেল সিঁদুর। আস্তানা নির্বাচন করে সম্ভাব্য বটতলাতেই। কথকের চলার পথে নিত্য চোখ পড়ে সেদিকে। ক্রমে দেখা যায় ভিড় করা জনতার মধ্যেই একজন সেই পাথরের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠায় যত্নশীল। সবই তো ঘটতে থাকে কথকের চোখের সামনে। যে শ্রম এবং যুক্তিবাদী মনন ক্রিয়াশীল ছিল পাথরটিকে উপড়ে ফেলার পেছনে, সেই যুক্তিবাদী মন প্রতিবাদ করে না কেন? 

স্বাভাবিকক্রমেই সেই থানে ভিড় বাড়ে। বাড়বেই। আমাদের চারপাশের প্রতিষ্ঠানের বাড়বাড়ন্ত শিবরামের যুগেই তো শুরু। বটতলার শনি, মনসা, শিবের আস্তানা দখল করে ঝান্ডা তোলার ইতিহাস তো সমসাময়িকই। সে সব আস্তানার সেবায়েতের যখন অভাব পড়েনি, পথের পাশে পড়ে থাকা পাথরেরই বা হবে কেন? আমাদের ঐতিহ্য তো ‘সত্য’ এবং ‘সর্বশক্তিমান’-এর (মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা সত্য) পারস্পরিকতায় আস্থা রাখা। আমরা তো ‘সর্বশক্তিমান’ বিশ্বাস করতে চাই, স্বাওভাবতই তাকে ঘিরে ‘সত্য’ নির্মান করি। আখড়ায় ক্রমে ভক্তের ভিড় বাড়ে, গাঁজার ধোঁয়ায় আবছা হতে থাকে পাথরের স্বরূপ। আফিম নিয়ে সতর্কতার কথা শিবরামের অজানা থাকার কথা নয়। মস্কো থেকে পণ্ডিচেরি যাঁর রচনা দেবালয় জুড়ে গাঁজার ধোঁয়ার স্বরূপ তাঁর কাছে অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। হট্টগোল বাড়ে, মেলা জমে। এসবই স্বাভাবিক ক্রমপর্যায়। অস্বাভাবিক তো ছিল পাতাল ফুঁড়ে ওঠা একটা স্বয়ম্ভু পাথরের অভ্রান্ততায় অবিশ্বাস। অবিশ্বাস করতে বিশ্বাসের জোর চাই। কথক তো তাই দিয়েই শুরু করেছিলেন। তারপর? 

গল্পের পরিণতির স্বার্থে গ্রামে বসন্ত শুরু হয়। কথকের আরও কিছু ‘বিপ্লব’ দেখা দেয় মাদুলি, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি নিয়ে অবিশ্বাসের বক্রোক্তিতে। হ্যাঁ, বস্তুবাদীর যুক্তির নিরিখে তাই তো হওয়া উচিত। ম্যালেন্ড্রিনাম ২০০ নিয়ে জ্ঞান সীমিত হলেও, তা যে সরল চোখে কুসংস্কার, আর সেখানে যে খোঁচা দেওয়া যায়, এটাই আমাদের সরল যুক্তিবাদ বলে তো। হাসপাতাল থেকে যুক্তিবাদী টিকাও তো পড়ে সময়ে। বৈজ্ঞানিক প্রগতিবাদের সেটাই তো পথ। যে প্রগতিবাদ পথ থেকে পাথর উপড়ে ফেলে, সেই প্রগতি সরল পথ তো হাসপাতালের টিকা। পাঠক কোথাও ঠোক্কর খায় কি? কিন্তু কিন্তু মাদুলি থেকে ম্যালেন্ড্রিনাম সেসবও তো বক্রোক্তির সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে। পাঠকের কি তাতেও আস্বস্তি বাড়ে? বাড়ার কথা নয়। আমাদের মধ্যবিত্ত মনন দশ আঙুলে পঁচিশ গ্রহরত্ন আর বস্তুবাদী বিপ্লব একই সঙ্গে সামলাতে অভ্যস্ত। সেই একই সরলরেখা একদিন পথ থেকে উপড়ে ফেলা পাথরের দেবতার সামনে যুক্তিবাদীর হাঁটু, কোমর, মেরুদণ্ড, উচ্চশিরকে বক্র করে। স্বতই অনাহত নাদ ধ্বনিত হয় ‘ব্যোম, ব্যোম’। 

শুরুর দিকে মনে হয়, নিখাদ বস্তুবাদ গল্পটির অন্তর্গঠন। কথক এই গল্পের প্রবক্তা। আম জনতার মত আম পাঠকের সামনে সে তুলে ধরবে যুক্তিবাদের শানিত দর্পণ। পাঠক গল্পের আয়নায় নিজেদের ভণ্ডামির মুখোশ দেখে চমকে উঠবে। চট করে চারপাশে তাকিয়ে দেখে নেবে কেউ দেখে ফেলেছে কি না। কিন্তু এত সরল রৈখিক নয় এ গল্পের চলন। সমাজ সচেতনতা বা মানব চরিত্রের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ বললে গল্পটি সম্বন্ধে কিছুই বলা হয় না। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটি তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গও নয় গল্পটির প্রধান আবেদন। হেনরিক ইবসেনের (Henrik Ibsen) An Enemy of the People নিয়ে সত্যজিতের বিখ্যাত সিনেমা গণশত্রু বা এমন আরো অনেক গল্প সিনেমা আমাদের জানা। শিবরামের গল্প মনে হয় এক করুণ ট্র্যাজেডি। ইবসেনের স্টকম্যান বা সত্যজিতের অশোক গুপ্ত নিজেদের যুক্তিবাদী অবস্থান থেকে হাজার আক্রমণেও নড়েন না। কুসংস্কার এবং কুসংস্কারের বেসাতি করা দালালদের হাতে তাঁদের লাঞ্ছনাই তাঁদের মহান করে। কিন্তু শিবরামের কথকের ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক উলটোটাই। বাহ্যত কোনও অবরোধের মুখে না পড়েও সে ক্রমে বদলে ফেলতে থাকে তার অবস্থান। কুসংস্কারের পাথুরে আঁতুড় ঠুকিয়ে নেয় তার উন্নত শির। গল্পের শুরুতে তার লড়াই, তার বিপ্লব সবই হয়ে দাঁড়ায় দেখনদারি। তবে গল্পের নিবিষ্ট পাঠক বোধকরি এই কমিক ভাঁড়ের জন্যও কিছু সমবেদনা অনুভব করবে। আমাদের মর্মমূলে বস্তি করা সংস্কার কীভাবে আমাদের উন্নত শিরকে টেনে নামায় সে-ও কিছু কম ট্র্যাজেডি। 

একটি সাধারণ পাথরকে কেন্দ্র করে কেমন গড়ে ওঠে ভক্তি ও বিশ্বাসের আশ্চর্য দেবালয়, সেটিই এ গল্পের একমাত্র পাঠ নয়। কথকের বিশ্বাসের রূপান্তর, অভিসারী শ্লেষে গল্পটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। এমন বিশ্বাসের জন্মে আশ্চর্য কিছু নেই। বস্তুলাভের জন্য বিশ্বাস স্থাপন প্রাচীন প্রচলন। এখনও যা আশ্চর্য করে শিবরামকে তা হলো কথকের রূপান্তর; তথাকথিত যুক্তিবাদীর হেরে যাওয়া। সম্ভবত কথকের মানসিকতার রূপান্তরই গল্পটির প্রধান পাঠ।


0 comments:

0

প্রাচীন কথা - মিথিল ভট্টাচার্য্য

Posted in


প্রাচীন কথা

মহাকাব্যের উপেক্ষিতা (দ্বিতীয় পর্ব)
মিথিল ভট্টাচার্য্য



সময় এরপর এক দ্রুত তালে এগিয়ে যায় সেই অভিশপ্ত দিনটিকে পেছনে ফেলে। ইদা পাহাড়ের বুকেই কেটে যায় আমার আর করির জীবনের বেশ কয়েকটি বছর। বাল্য থেকে কৈশোরে পা দেয় আমার করি, জানিনা কোন মহামন্ত্রে, না জেদে, যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠতে থাকে সে। প্রচণ্ডক্রোধের যে অঙ্কুরোদ্গম তার শৈশবে হয়েছিল, সেই অঙ্কুরই নিজের ডালপালা ছড়িয়ে এক মহীরুহে পরিণত হতে থাকে দিনের পর দিন। অনেক চেষ্টা করেছিলাম তাকে বুঝিয়ে এই ঘৃণার বীজ শিকড় সমেত উপরে ফেলার, কিন্তু পেরে উঠিনি। নিজের পিতার প্রতি, হেলেনের প্রতি আর সমগ্র ট্রয়ের রাজবংশের প্রতি প্রচণ্ড ক্রোধ আর ঘৃণার আগুন জ্বলে চলেছিল তার অন্তরে। 

আর আমি ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে ছিলাম একদিকে যেমন করিকে শান্ত করার, আর অন্যদিকে নিজের অতীতকে ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে চলার।

এইরকমই একদিন ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ঘরে ফেরে আমার করি। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বলে উঠি "কি রে? এত উত্তেজিত হয়েছিস কেন? শান্ত হয়ে বস, কি হয়েছে তোর?"

করি আমার দিকে তাকিয়ে রুদ্ধ স্বরে বলে ওঠে, "যার প্রতীক্ষা আমরা এতদিন ধরে করেছি তাই ঘটতে চলেছে মা, আমাদের প্রতি সমস্ত অন্যায়ের শাস্তি পেতে চলেছেন রাজকুমার প্যারিস, আর ওই হেলেন।"

আমি আতঙ্কে নীল হয়ে যাই, কি বলছে আমার করি, কি অনর্থ ঘটিয়ে এসেছে ও? 

কোনও মতে বলে উঠি "কি বলছিস তুই? ঠিক করে বল কি ঘটতে চলেছে?"

করি একটা তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বলে ওঠে, "যা ঘটার তাই ঘটতে চলেছে মা, গ্রীকরা তাদের সমস্ত শক্তি এক করে ছুটে এসেছে তাদের অপমানের প্রতিশোধ নিতে ট্রয়ের মাটিতে। এতদিনে নিজেদের পাপের শাস্তি পেতে চলেছে রাজকুমার প্যারিস আর ওই হেলেন।"

আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি করির দিকে, তার মানে অবশেষে সেই ভবিষ্যৎ আসতে চলেছে, যার আঁচ পেয়েছিলাম আমি অতগুলো বছর আগে! সত্যি কি তাহলে মহাবিনাশ আছড়ে পড়তে চলেছে ট্রয়ের বুকে? 

করির তীব্র স্বরে কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসি। 
করি জ্বলন্ত স্বরে বলে ওঠে, "দেখেছো মা অবশেষে আমাদের প্রতি অন্যায়ের শাস্তি কিভাবে নেমে আসছে আমাদের অপরাধীদের উপরে।"

আমি অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলে উঠি "ওই নিয়ে আমার আর কোনও আগ্রহ নেই রে, যা ঘটার তা ঘটবে, তাই নিয়ে ভেবে তোর আমার কোনও লাভ নেই। আমরা আমাদের জীবন নিয়েই এগিয়ে চলি, রাজ রাজড়াদের মধ্যে কি হচ্ছে, কি না হচ্ছ্‌ তাতে আমাদের কি?

কথা শেষ করে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাই, কিন্তু করি আমার পথ আটকে সামনে এসে দাঁড়ায়। একটু ইতস্তত করে যেন কিছু বলতে চায়। 

আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠি "কিছু বলবি? কিছু বলার থাকলে বল।"

করি একটু সময় নিয়ে নিজের সমস্ত দ্বিধা অতিক্রম করে অবশেষে বলে ওঠে "মা আমি এই যুদ্ধে গ্রীক পক্ষে অবতীর্ণ হতে চাই। আমাকে অনুমতি দাও।"

আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি আমার করির দিকে। শেষপর্যন্ত যে সর্বনাশের ভয় আমি পাচ্ছিলাম তাই কি ঘটতে চলেছে আমাদের মা ছেলের এই ছোট্ট সংসারে? এবার কি আলেকজাণ্ডারের পর করিকেও আমি হারাবো এই বাইরের জগতের সর্বনাশা আহ্বানে?

করির দিকে তাকিয়ে আমি দৃঢ় স্বরে বলে উঠি "না তুই এই যুদ্ধে কোনও মতেই অংশ নিবিনা, এটাই আমার আদেশ।"

করি ব্যাকুল স্বরে বলে ওঠে, "কিন্তু কেন মা?"

আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠি "কারণ এই যুদ্ধ আমাদের নয়, গ্রীক আর ট্রোজানরা নিজেদের মধ্যে যত খুশি কাটাকাটি করুক, আমাদের পার্বত্য নিমফদের তাতে কোনও ভূমিকা নেই, এই রাজনীতি থেকে দূরে থাকাই আমাদের জন্য মঙ্গল।"

করি আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, দৃঢ় স্বরে বলে ওঠে "না, এটা আসল কারণ নয় মা, আসল কারণ তুমি এখনও চাওনা রাজকুমারের প্যারিসের কোনও ক্ষতি হোক। তাইনা?"

নিজের সমস্ত সংকোচ দূরে সরিয়ে রেখে মুখোমুখি দাঁড়াই নিজের আত্মজের। আজ সমস্ত দ্বিধাকে দূরে সরিয়ে রেখে এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতেই হবে। 

করির নীল চোখদুটোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, একদম ওর বাবার চোখ দুটো পেয়েছে ও। ওর ওই নীল চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে গভীর স্বরে বলে উঠি, "হ্যাঁ, মিথ্যে বলবো না রে, কোথাও না কোথাও গিয়ে আমি আজও তার ক্ষতি চাইনা। কিন্তু তা আসল কারণ নয়, আসল কারণ তুই।"

করি হতভম্ব ভাবে বলে ওঠে "আমি?"

আমি একইভাবে উত্তর দিই, “হ্যাঁ তুই, কারণ আমি চাইনা তুই কোনও আত্মদহনে ভোগ। নিজের হাতে যদি নিজের পিতাকে মারণ আঘাত করিস, তবে আজ নিজের জমা রাগের কারণে কোনও যন্ত্রণা বা আত্মগ্লানি তোকে স্পর্শ না করলেও, এক না একদিন অনুশোচনা তোকে স্পর্শ করবেই। আর সেই যন্ত্রণা তোকে পেতে দেখতে আমি পারবোনা। তার থেকে অনেক ভালো আমরা দুজন এই রাজনীতির আবর্ত থেকে দূরে সরে থাকি।"

করি আমার দিকে তাকিয়ে আলতো স্বরে বলে ওঠে "আমার মনে হয়না মা, রাজকুমার প্যারিসকে নিজের হাতে হত্যা করলেও কোনও আত্মদহন আমাকে কোনও দিন স্পর্শ করবে। কিন্তু শুধু তোমার খুশির জন্য প্রতিজ্ঞা করছি, আমি তাকে কোনওদিনও আঘাত করবোনা।"

একটা শান্তির নিশ্বাস আমি ফেলেছিলাম সেদিন। কিন্তু বুঝতে পারিনি, নিজের জীবনের কত বড় ভুল আমি নিজের অজান্তেই করে বসেছিলাম সেদিন! 

ট্রয় আর গ্রীসের যুদ্ধের সংবাদের ঝড় ক্রমশ আছড়ে পড়তে থাকে এই নির্জন ইদা পাহাড়ের বুকে। যুদ্ধে ট্রোজানদের একের পর এক পরাজয়ের আর গ্রীকদের বিজয়ের গাঁথা। গ্রীক বীর একিলিসের হাতে পতন ঘটছে ট্রয়ের একের পর এক সুরক্ষা কবচের। 

আর যুদ্ধের এই অনবরত সংবাদে আরও ব্যাকুল হয়ে পড়তে থাকে আমার করি। বুঝতে পারি ট্রয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কতটা উৎসুক ও, কিন্তু পারছেনা শুধু আমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কারণে। 

এরমধ্যে একদিন সংবাদ আসে ট্রোজান বীর রাজকুমার হেক্টরের মৃত্যুর। 

রাখালদের মুখ থেকে শুনতে পাই, কিভাবে নিজের জন্মভূমির জন্য নিরপরাধ বীর নিজের প্রাণের আহুতি দিয়েছেন। 

নিজের অজান্তেই কখন যে দুইচোখ দিয়ে জলের ধারা নেমেছিল জানতেও পারিনি। 

করি বিস্মিত হয়ে বলে উঠেছিল "এক ট্রোজান রাজকুমারের জন্য তুমি কেন চোখের জল ফেলছো, মা?"

আমি ম্লান স্বরে বলে উঠেছিলাম "কারণ আমি কোনও ট্রোজান রাজকুমারের জন্য চোখের জল ফেলছিনা রে। ফেলছি এমন একজন মর্যাদাবান যোদ্ধার জন্য, যে নিরপরাধ হয়েও নিজের জন্মভূমির কারণে নিজের প্রাণের বিসর্জন দিলো। ভেবে দেখতো আজ যদি আমাদের এই ইদা পাহাড়ে কেউ আক্রমণ করতো তাহলে তুইও কি একই কাজ করতিসনা? জানিনা এই মারণ যুদ্ধ আর নিরপরাধ প্রাণের বলি নেবে? কেন এখনও ওই সর্বনাশীকে গ্রীকদের হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছেন না মহারাজ প্রিয়াম? আর কত মৃত্যু দেখতে চান তিনি?"

করি আমার দিকে এক গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে "তুমি কি সত্যি চাও মা, যে এই যুদ্ধ থেমে যাক?"

আমি একটা ম্লান হাসি মুখে নিয়ে বলে উঠি "যে কোনও কিছুর মূল্যে রে।"

কিছুক্ষণ এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল করি, তারপর নিঃশব্দে কিছু না বলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেছিলো। 

পরের দিন হঠাৎই নিজের বাবার মতোই কোথায় যেন হারিয়ে গেছিলো আমার একমাত্র অবলম্বন। ওর রাখাল বন্ধুদের কাছে, ইদা পাহাড়ের কাছের গ্রামের শস্ত্রব্যবসায়ী যাদের কাছে ও যেতে পারতো, ব্যাকুল হয়ে তাদের সবার কাছে গিয়ে ওর খোঁজ নিয়েছিলাম, কিন্তু কোথাও কোনও খোঁজ পাইনি ওর। অবশেষে যখন ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে গেলাম, তখনি দৃষ্টি পরে আমার কক্ষে রেখে যাওয়া একটা পত্রের দিকে, "মা, তোমার ইচ্ছে পূরণ করতেই যাচ্ছি। গ্রীকদের হাতে রানী হেলেনকে সমর্পন না করলে এই যুদ্ধ থামবেনা। আরও অনেক নিরপরাধ প্রাণ বলি হবে এই কাল সংগ্রামে। তাই অন্তত একবার চেষ্টা করতে যাচ্ছি এই যুদ্ধ সমাপ্ত করার। জানি তোমাকে বলে গেলে তুমি যেতে দিতেনা, তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে না জানিয়েই যাচ্ছি। যদি না ফিরি তাহলে তোমার এই অবাধ্য ছেলেটাকে ক্ষমা করে দিও।"

আমি পাগলের মতো ছুটে গেছিলাম ইদা পাহাড়ের বুক থেকে নিচের উপত্যকার দিকে, এই পথেই একদিন আমায় ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে গেছিলো আমার আলেকজান্ডার। আর আজ এই পথে নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজের ছেলেটাকে অন্তত হারাতে পারবো না আমি! 

ঝড়ের মতো আমি নেমে আসছি পাহাড়ের বুক থেকে সমতলের মৃত্যুভূমির দিকে, কিন্তু একটা আলোর সারি যেন আমার গতি রুদ্ধ করে দিলো। এ কারা উঠে আসছে সমতল থেকে ইদা পাহাড়ের বুকে? কিছু ট্রোজান সৈনিক দল বেঁধে উঠে আসছে এই পাহাড়ের বুকে, কেন? আবার কি অনর্থ করে বসলো বোকা ছেলেটা? আমিধীর পায়ে কোনও রকমে এগিয়ে যাই এই সৈনিক দলের দিকে। 

সৈনিক দলের প্রধান আমার সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। একমুহূর্তের জন্য আমার দিকে তাকিয়ে তারপর প্রশ্ন করে ওঠে "আপনিই কি পার্বত্য পরী ঈনন?"

আমার গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরোয় না, কোনও রকমে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই। 

একটু বিব্রত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে তারপর এই প্রধান বলে ওঠেন "আপনার পুত্র করিথাস, আজ ট্রয়ের প্রাসাদে প্রবেশ করেছিলেন, উনি রাজকুমার প্যারিসের প্রেয়সী হেলেনকে নিয়ে পালানোর প্রয়াস করেছিলেন।"

আমি মাঝপথেই তাকে থামিয়ে ব্যাকুল স্বরে বলে উঠি, "আমার করি, আমার করি ঠিক আছে তো?"

মাথা নত করে অপরাধী স্বরে সে বলে ওঠে "আমায় ক্ষমা করবেন, আপনার পুত্র আর জীবিত নেই, সে মারা গেছে।"

এই দুই লাইনের কথা কটা যেন এক নিমেষে আমার সমস্ত জীবনী শক্তিকে শুষে নেয় আমার শরীর থেকে। আমার করি, আমার ছোট্ট করি, যার ছোট্ট দুটো হাতকে আঁকড়ে ধরে আমি এতগুলো বছর এই নির্জন পাহাড়ে কাটিয়ে দিলাম, সেই করি আর নেই! না না এরা নিশ্চয় মিথ্যে বলছে, আমার করি আমাকে ছেড়ে যেতে পারেনা এইভাবে। 

সৈন্য প্রধান আমার সামনে থেকে সরে যান, তার দুজন অধীনস্থ সৈন্য আমার সামনে এগিয়ে নিয়ে আসে একটি সাদা কাপড়ে ঢাকা দেহ। শুধু তার মুখটা অনাবৃত, কোনও রকমে সমস্ত শক্তি এক করে তাকালাম ওই প্রাণহীন জড় শবদেহটার দিকে। একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এল আমার কণ্ঠ থেকে। এ তো আর কেউ না, এ তো আমার করি!

মুহূর্তের মধ্যে একটা অন্ধকার যেন নেমে এল আমার দুই চোখের সামনে, আমার পা দুটো যেন আর শরীরের ভার বইতে পারছেনা, আমি যেন একটা গভীর খাদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছি। 

সেনা প্রধান ছুটে এসে তার শক্ত হাতে আমাকে কোনও রকমে ধরে রাখে। প্রাণপণ চেষ্টায় কোনও মতে নিজেকে বার করে আনি ওই গোলক ধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া থেকে। 

একটু একটু করে আমি এগিয়ে যাই আমার ছোট্ট করির দিকে, আমার করি চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন আজ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, না ভুল বললাম কেউ কেড়ে নিয়েছে আমার একমাত্র সন্তানকে আমার বুক থেকে।
কষ্টের জায়গা যেন দখল করে নেয় একটা অমানুষিক ক্রোধ, সেনা প্রধানের দিকে নিজের রক্ত বর্ণের চোখ তুলে প্রশ্ন করি, "কিভাবে মারা গেছে আমার করি? কে? কে হত্যা করেছে ওকে?"

সেনা প্রধান মাথা নিচু করে বলে ওঠেন, "আপনার পুত্র করিথাস এক অসামান্য বীর। তিনি সমস্ত প্রহরীদের চোখে ধুলো দিয়ে অদ্ভুত কৌশলে যুদ্ধ করে হেলেনকে নিয়ে পালাচ্ছিলেন। হেলেনের খুব বেশি আপত্তি কিছু যে প্রকাশ পেয়েছিলো তাও মনে হয়নি। আর আমাদের মধ্যে বেশির ভাগ তার সামনে দাঁড়াতেই পারেনি, আর বাকিরা যেমন আমি নিজে, সেই চেষ্টাই করিনি, আমরা সবাই চেয়েছিলাম ওই সর্বনাশী চলে যাক ট্রয় থেকে। একদম শেষ দ্বারের সামনে যখন তারা পৌঁছে গেছে, তখন আচমকা তাদের গতি রোধ করে দাঁড়ান রাজকুমার প্যারিস। অদ্ভুত ভাবে আপনার এই বীর পুত্র রাজকুমার প্যারিসের সামনে অস্ত্র না তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। রাজকুমার তাকে আদেশ করেন হেলেনকে ফিরিয়ে দিতে, কিন্তু সে একবগ্গার মতো তার জেদে অনড় থাকে। এরপরেই রাজকুমার প্যারিস উদ্যত তরবারি নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পরে। কিন্তু সে নিজের অস্ত্রের দিকে একবারের জন্যও হাত বাড়ায়না। রাজকুমার প্যারিসের তরবারির মারণ আঘাত লাগে তার বুকে। শেষ মুহূর্তে সে আপনার অর্থাৎ তার মায়ের নাম নেয়। রাজকুমার প্যারিসও যেন এই নাম শুনে কেন জানিনা স্তম্ভিত হয়ে যান। এর কিছু সময়ের মধ্যেই মারা যায় আপনার পুত্র। আর রাজকুমার আমাদের আদেশ করেন উপযুক্ত সম্মানের সঙ্গে তার মৃতদেহ এই পাহাড়ে আপনার কাছে পৌঁছে দিতে, আর শুধু তাই নয় এই বীর বালকের অন্তিমসৎকারে সকল রকম সহায়তা করতে। যাতে রাজকীয় মর্যাদার সাথে সম্পন্ন হয় এই বীরের অন্তিম ক্রিয়া"

আমার তীব্র রোষে ভরা চীৎকার ধ্বনিত হতে থাকে ইদা পাহাড়ের প্রতিটি প্রান্তে, "আমার সন্তানকে হত্যা করে এখন তিনি আপনাদের পাঠিয়েছেন তার অন্তিমসৎকারের ব্যবস্থা করতে! দূর হয়ে যান, এই মুহূর্তে এই পাহাড় থেকে! দূর হয়ে যান! না হলে জীবনের প্রথমবারের মতো এই পার্বত্য পরীর দেওয়া অভিশাপের ভাগীদার হতে হবে আপনাদের সবাইকে। আমার সন্তানকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার শাস্তির ভাগ পেতে হবে প্রত্যেককে। যদি বাঁচতে চান এই মুহূর্তে এই পাহাড় থেকে পালিয়ে যান..."

আমার অমানুষিক ঘৃণা আর ক্রোধের ছাপ যেন এসে পরে প্রকৃতিরও বুকে। এক প্রাণঘাতী ঝড়ের কালো মেঘ যেন এক মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে আকাশের বুকে। 

একটা গভীর আতঙ্ক যেন জন্ম নেয় এই ট্রোজান সৈন্য দলের মধ্যে, ইদা পাহাড়ে বুক বেয়ে তারা দ্রুত পালিয়ে যেতে থাকে সমতলে দিকে। কিন্তু সৈনা প্রধান নিস্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন ইদা পাহাড়ের বুকে, কিছু সময়ের জন্য আমার দিকে ফিরে তাকান তিনি, একটা গভীর অপরাধবোধ যেন ফুটে ওঠে তার মধ্যে, কিছু যেন বলতে চান, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজের ভাষা হারিয়ে ফিরে যেতে উদ্যত হন। 

আমি তীব্র স্বরে বলে উঠি "দাঁড়ান"

সেনা প্রধান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ান। 

আমি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠি "বলে দেবেন আপনাদের রাজকুমার প্যারিসকে, আমার সন্তানকে আমি বুকে করে বড়ো করেছি। তার অন্তিম সৎকার আমি নিজেই করতে পারবো। তার জন্য আমার অন্য কারোর সাহায্যের দরকার নেই। তিনি যেন এবার তার নিজের এবং তার পরিবারের সৎকারের ব্যবস্থা শুরু করে দেন। কারণ এবার গ্রীকদের বীরত্বের সাথে যোগ হতে চলেছে এক পুত্রহারা পার্বত্য পরীর অভিশাপ। ট্রয় রাজবংশের আর একটা মানুষও প্রাণে বাঁচবেনা। আজ আপনারা আমার সন্তানের শব নিয়ে এসেছেন, কিন্তু আপনাদের শব বহন করার জন্য আর একটা প্রাণও অবশিষ্ট থাকবেনা। এ এই সন্তানহারা নিম্ফের অভিশাপ ট্রয় রাজবংশকে।"

সেনাপ্রধান আমার দিকে একমুহূর্তের জন্য তাকিয়ে থাকেন তারপর বলে ওঠেন, “আমার দুর্ভাগ্য যে আমি, এই আফ্রোদিতে পুত্র ইনিস এই রাজবংশের জামাতা, তাই আপনার এই অভিশাপের ভার আমাকেও বইতে হবে সারা জীবন। তাও আমি ভগবান জিউসের কাছে প্রার্থনা করবো যাতে এই পুত্রহারা মায়ের অভিশাপ সত্য হয়।" 

আর একটা কথাও না বলে দ্রুত পায়ে পাহাড়ের বুক থেকে সমতল ভূমির দিকে নেমে যায় ট্রয়ের সেনা প্রধান ,আফ্রোদিতে পুত্র ইনিস। 
আর পাগলের মতো আমি এগিয়ে যাই আমার সন্তানের দিকে, আমার করি, সে আর কোনওদিন উঠবেনা। আর কোনওদিন আমার কাছে জেদ করবেনা। সব... সব শেষ হয়ে গেছে আমার মূর্খতার জন্য।

যে রাখালেরা একদিন আলেকজাণ্ডারকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে পালন করেছিল, যারা আমার একমাত্র সহায় ছিল তাদের আলেকজান্ডারের অংশ ছোট্ট করিকে বড় করে তুলতে, তাদের সাহায্যেই আজ অন্তিম সৎকার করি আমার আত্মজের। চিতার প্রচণ্ড আগুনে মুছে যেতে থাকে আমার ভালোবাসার ছোট্ট পুতুল, আর তার সাথেই আত্মদহনে ছাই হয়ে যেতে থাকে তার এই অভাগী মা।

কেন? কেন আমি প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলাম ওকে দিয়ে যে ও রাজকুমার প্যারিসকে আঘাত করবেনা? কেন? আজ যদি এই প্রতিজ্ঞা আমি না করাতাম ওকে দিয়ে,তবে জীবিত থাকতো আমার করি। কেন আমি আমার করির জীবন বলি দিলাম সেই ব্যক্তির জন্য যে আমাদের দুজনকেই ছেঁড়া কাপড়ের মতো ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো? আজ তো আমার করির জীবিত থাকার কথা আর মারা যাবার কথা ওই রাজকুমার প্যারিসের। তাহলে কেন? কেন আজও সে জীবিত আছে?

করির চিতার সামনে থেকে আমি ছুটে যাই আমার আরাধ্যা মাতা রিয়ার মন্দিরে। এই দুর্ভাগী মা আজ ক্ষোভে, ক্রোধে ফেটে পরে অলিম্পাস মাতার সামনে, "তোমার উপাসিকা এই পার্বত্য পরী আজ অব্দি কোনও দিন তোমার কাছ থেকে পাওয়া দৈব শক্তির কোনো অপব্যবহার করেনি মা। সব সময় চেষ্টা করেছি সমস্ত মানুষদের রোগের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দেবার। কিন্তু আজ তোমার এই উপাসিকা ওই রাজবংশের ধ্বংস কামনা করছে মা। ওই ট্রোজান রাজবংশ যেন সমূলে ধ্বংস হয়, যে ভাবে আজ আমি আমার করিকে হারিয়েছি সেইভাবে ওই বংশের প্রত্যেক মা যেন নিজেদের সন্তানকে হারায়। আর ওই রাজকুমার প্যারিস যে কোনও দিন আমাদের যোগ্য সম্মান আমাদের দিলোনা, যে আজ নিজে হাতে আমার করিকে কেড়ে নিলো আমার বুক থেকে, সে যেন দগ্ধে দগ্ধে মরে। সহজ মৃত্যু যেন সে না পায়। তারই চোখের সামনে যেন ধ্বংস হয়ে যায় তার সমস্ত পরিবার। আর ওই বিশ্বসুন্দরী যার জন্য সে আমাকে আর আমার করিকে অবহেলায় ত্যাগ করেছিল, সেও যেন তার বিপদে তাকে একইভাবে ছেড়ে চলে যায় তারই চোখের সামনে। মা এই পুত্রহারা মায়ের অভিশাপ যেন ব্যর্থ না হয় "

একটা একটা করে দিন এগিয়ে যায়, আর তার সাথে ধ্বংসের মুখে এগিয়ে যেতে থাকে ট্রয়। আর সুদূর ইদা পাহাড়ের বুকে এক পার্বত্য পরী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে এই নগরীর শ্মশানে পরিণত হবার সংবাদের। অবশেষে সে পায় তার বহু প্রতীক্ষিত সংবাদ, গ্রিক বীর ওডেসিয়াসের চাতুরির সামনে অবশেষে ভেঙে পড়েছে ট্রয়ের সুরক্ষা।

ওডেসিয়াস এক কাঠের ঘোড়ার পেটে সৈন্য ঢুকিয়ে গ্রীক বাহিনীকে প্রবেশ করিয়েছে ট্রয়ের দুর্ভেদ্য প্রাচীরের ভেতরে। গ্রীকেরা অমানুষিক বর্বরতা দেখিয়েছে ট্রয়ের সর্বত্র, ধ্বংস হয়ে গেছে গোটা ট্রোজান রাজবংশ। বৃদ্ধ রাজা প্রিয়াম নিজে মারা গেছেন একিলিস এর পুত্র নিওপটলেমাসের হাতে।

আর হেলেন? হেলেন হাসতে হাসতে ট্রয় ছেড়ে নিজের পুরোনো স্বামী মেনেলাসের কণ্ঠলগ্না হয়ে ফিরে গেছে স্পার্টায়। আর বাদবাকি অবশিষ্ট ট্রোজানদের নিয়ে এক নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে সেই বীর ট্রোজান সেনা নায়ক ইনিস।

আর প্যারিস? না রাজকুমার প্যারিসের কোনও খবর নেই। সে নিরুদ্দেশ, শুধু এইটুকু জানা গেছে যে, সে নাকি প্রচণ্ড আহত হয়েছে ফিলোপটেটিসের নিক্ষিপ্ত হাইড্রার বিষ মিশ্রিত তীরে। স্বয়ং হারকিউলিস নাকি এই তীর গচ্ছিত রেখে গেছিলেন তার বন্ধু ফিলোপটেটিসের কাছে। যাক, যে বিষের যন্ত্রণা আজ এই সন্তানহারা নিম্ফ পাচ্ছে, সেই বিষ এবার অনুভব করুক রাজকুমার প্যারিস। ওই বিষের দহনে যেন দগ্ধে দগ্ধে মরে আমার করির হত্যাকারী। 

অবশেষে আবার ছুটে যাই মাতা রিয়ার মন্দিরে, এত দিনে আমার বাসনা পূর্ণ করেছেন আমার আরাধ্যা। কিন্তু তাও কেন শান্তি পাচ্ছিনা আমি ?

মাতা রিয়ার মন্দির থেকে ক্লান্ত শরীরে নিজের নির্জন কুটিরের দিকে ফিরে আসছিলাম আমি। হঠাৎ কালো কাপড়ে ঢাকা এক আগন্তুক আমার পথ আটকে দাঁড়ায়।

আমি কিছু সময়ের জন্য হতচকিত হয়ে যায়। বিস্মিত স্বরে বলে উঠি "কে আপনি? এইভাবে আমার পথ আড়াল করে দাঁড়িয়েছেন কেন?"

সেই ছায়া মূর্তি একটা ভাঙা ক্লান্ত স্বরে বলে ওঠে "ঈনন, আমি তোমার আলেকজাণ্ডার।"

প্রচণ্ড বিস্ময়ে আমি যেন স্তব্ধ হয়ে যাই।

সেই ছায়া মূর্তি কালো কাপড়ের আস্তরণ সরিয়ে দেয় নিজের উপর থেকে। কিন্তু এ কে? আমার আলেকজাণ্ডার বলি কি রাজকুমার প্যারিস, তার রূপ তো ছিল জগৎসেরা। তবে একি চেহারা হয়েছে তার!

রাজকুমার প্যারিস ম্লান হাসি হেসে বলে ওঠে "দেখছো ঈনন, কি অবস্থা হয়েছে তোমার আলেকজাণ্ডারের? হ্যাঁ ঈনন, যে অভিশাপ তুমি দিয়েছিলে ইনিসের সামনে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছে। আজ আমার গোটা বংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। হেলেন আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে নিজের আগের স্বামী মেনেলাসের সাথে। আর আজ আমি বিষের জ্বালায় মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়িয়ে আছি তোমার সামনে।"

একটা বিদ্রুপ মিশ্রিত স্বরে বলে উঠি "কোন আলেকজাণ্ডারের কথা আপনি বলছেন রাজকুমার, আপনার মনে নেই অনেক দিন আগেই আপনি আমায় বলেছিলেন যে আলেকজান্ডার মরে গেছে, তবে আজ আবার তার নাম মুখে নিচ্ছেন কেন? আর এতদিন পর মৃত্যুর মুখে এসে হঠাৎ আমার স্মরণ কিভাবে হলো আপনার? কেন এসেছেন এই অকিঞ্চিৎকর ইদা পাহাড়ে? আমাকে দোষারোপ করতে আপনার বংশের ধ্বংসের জন্য?"

রাজকুমার প্যারিস কাতর স্বরে বলে ওঠেন "না ঈনন, আমি এখানে তোমাকে কোনও রকম দোষারোপ করতে আসিনি। আমার নিজের পাপের শাস্তি আমি পেয়েছি, তার জন্য অন্য কাউকে দোষী করার মুখ আমার নেই। আমি তোমার কাছে এসেছি, ক্ষমা চাইতে আর তোমার দয়া ভিক্ষা করতে।"

আমি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠি "কিসের ক্ষমা? আমাকে আর করিকে ফেলে পালানোর জন্য ক্ষমা, না আমাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবার জন্য ক্ষমা? আর না কি নিজের পত্নীকে পরিত্যাগ করে অন্যের স্ত্রীকে নিজের শয্যায় স্থান দেবার জন্য ক্ষমা? এইসবের জন্য হয়তো আলেকজাণ্ডার পত্নী ঈনন আপনাকে ক্ষমা করেও দিতো, কিন্তু করিথাসের মাতা কোনওদিনও ক্ষমা করতে পারবেনা তার পুত্রের হত্যাকারীকে। "

কিছুসময়ের জন্য মৌন হয়ে যায় রাজকুমার প্যারিস, আমার চোখের দিকে তাকানোর সাহস হারিয়ে ফেলে সে, মাথা নত করে সে মৃদু স্বরে বলে ওঠে "করিকে আমি মারতে চাইনি ঈনন। আমার ধারণা অব্দি ছিলোনা যে ও আমার পুত্র। ওকে হেলেনকে নিয়ে পালতে দেখে আমি রাগে পাগল হয়ে গেছিলাম। তারপর যখন ও শেষ নিশ্বাস ফেলার সময় তোমার নাম নিলো, তখন উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম কি অনর্থ ঘটে গেছে আমার হাতে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি ওকে হত্যা করতে চাইনি।"

তীব্র স্বরে চীৎকার করে বলে উঠি "তাতে কি এসে যায় রাজকুমার? আপনি আমার করিকে মারতে চেয়েছিলেন না কি চাননি, তাতে কি এসে যায়? আমার করি আজ মৃত। আমার একমাত্র সন্তানকে আমি হারিয়েছি আপনার হাতে। আপনি সারাজীবন আমার চোখে থাকবেন শুধুমাত্র আমার করির হত্যাকারী হয়ে।"

রাজকুমার প্যারিস একটা ভাঙা স্বরে বলে ওঠে "সে আমার ও একমাত্র পুত্র ছিল ঈনন।"

আমি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠি "না, সে শুধু আমার একার পুত্র ছিল। তার পিতা আলেকজাণ্ডারের মৃত্যু তখনই হয়েছিল, যখন সে আমাদের দুজনকে ছেড়ে পালিয়ে গেছিলো ট্রয়ে। সেই দিনই মারা যায় আলেকজাণ্ডার আর তার শবদেহ থেকে জন্ম নেয় রাজকুমার প্যারিস। আর সেই রাজকুমার প্যারিসের সাথে আমাদের দুজনের কারোর কোনও সম্পর্ক ছিলোনা। যাই হোক আপনি কি দয়ার কথা বলছিলেননা, সেই কথাই বলুন? কি দয়া চান আপনি? কোন প্রয়োজনে এসেছেন এই তুচ্ছ পার্বত্য পরীর কাছে?"

লজ্জায় মাথা নত করে অবশেষে বলে ওঠেন রাজকুমার প্যারিস "তোমার কাছে বলার মুখ নেই, তাও মাথা হেঁট করেই প্রার্থনা করছি আমাকে মুক্তি দাও এই বিষের দহন থেকে। একমাত্র তুমিই পারো এই প্রচণ্ড বিষের জ্বালা থেকে আমাকে রক্ষা করতে, বাঁচাও তোমার আলেকজাণ্ডারকে ঈনন।"

আমার তীক্ষ্ণ হাসি প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরে ইদা পাহাড়ের আনাচে কানাচে, বিদ্রুপ মাখা স্বরে বলি "তাহলে এতদিনেও আপনি কিচ্ছু বদলাননি। আগেও যতটা স্বার্থপর ছিলেন, এখনও ঠিক তাই আছেন। আগেও নিজের স্বার্থের জন্য যেমন যেকোনও কাজ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করতেননা। এখনও ঠিক তাই করেন। আজ থেকে বহুযুগ আগে নিজের স্বার্থের জন্য নিজের স্ত্রী আর অবোধ ছেলেকে ত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার আগে যেমন একবারও ভাবেননি। আজও তেমনি নিজের স্বার্থের জন্য নিজে হাতে এই মায়ের সন্তানকে মারার পরও এই সন্তানহারা মায়ের কাছে আসার আগেও একবারও ভাবলেননা। আর কতটা নির্লজ্জ আর স্বার্থপর হতে পারেন আপনি?"

স্তব্ধ হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে রাজকুমার প্যারিস, আমি তার পাশ কাটিয়ে নিজের কুটিরের দিকে আবার চলতে শুরু করি। অসহায়ের মতো আবার আমার সামনে এসে দাঁড়ায় সে, ভাঙা দুর্বল স্বরে বলে ওঠে "আমি বারবার তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি ঈনন। আমাকে দয়া করো। এই কাল যন্ত্রণা আমি আর সইতে পারছিনা।আমাকে ক্ষমা করে এই যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি দাও ঈনন।"

একমুহূর্তের জন্য যেন আমার ভেতর থেকে জেগে ওঠে সেই আলেকজান্ডার প্রেয়সী তরুণী ঈনন। সে সব, সব কিছু করতে পারতো তার ভালোবাসার মানুষটার জন্য। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন আমার অন্তর চাইলো সব ভুলে এই অসহায় মানুষটাকে ক্ষমা করে দিতে, কিন্তু পরক্ষণেই জেগে উঠলো করিথাসের মাতা। আর সবকিছুর জন্য আজকের এই অসহায় মানুষটাকে আমি ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু আমার করির মৃত্যুর জন্য নয়। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে গাঢ় স্বরে বলে উঠি "আমায় আপনি ক্ষমা করবেন রাজকুমার, কিন্তু আপনাকে কোনওরকম সাহায্য করতে এই পার্বত্য পরী অপারগ। আপনি এখান থেকে চলে যান।"

আবার তার পাশ কাটিয়ে আমি এগিয়ে যাই আমার ছোট্ট কুটিরটার দিকে। পেছন থেকে একটা চূড়ান্ত ভেঙে পড়া স্বরে সেই মানুষটা বলে ওঠে, "যদি আমাকে উপশম করতে নাও পারো, তবে অন্তত এই বিষের হাত থেকে বাঁচাতে আমাকে মৃত্যু অন্তত দাও ঈনন। এই ভয়ানক জ্বালা আমি আর সইতে পারছিনা।"

আমি শেষবারের মতো পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি কালকের সেই অহংকারী মানুষটিকে এক জীবন যুদ্ধের পরাজিতের মতন দাঁড়িয়ে থাকতে। তারপর বলে উঠি "আপনাকে কোনও সাহায্য করে আমার পক্ষে সম্ভব নয় রাজকুমার প্যারিস। আপনি আমাকে বিদায় দিন।"

দ্রুত পায়ে নিজের অতীতকে পিছনে ফেলে রেখে জীবন পথে সামনের দিকে এগিয়ে যাই আমি। 

সন্ধের সময় আবার ফিরে যাই আমার আরাধ্যার মন্দিরে উপাসনা করতে। কিন্তু হঠাৎ পথের ধারে দেখি সেই রাখালের দল একজোট হয়ে কারোর চিতায় আগুন দিচ্ছে। একটু স্তম্ভিত হয়ে যাই আমি, এই সময় কার চিতায় আগুন দিচ্ছে এরা?

ধীর পায়ে আমি এগিয়ে যাই ওদের দিকে, একটা শোকের ছায়া যেন লেগে আছে আছে ওদের প্রত্যেকের মুখে, বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করি ওদের, "এ কার চিতা? কাকে আগুন দিচ্ছো তোমরা?"

ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কাতর স্বরে বলে ওঠে "আলেকজাণ্ডারকে ঈনন। তুমি জানোনা আমাদের আলেকজাণ্ডার এতো বছর পর আবার আমাদের কাছে ফিরে এসেছিলো। কোনোওএক বিষের জ্বালায় বড়ো কষ্ট পাচ্ছিলো বেচারা। সেই জ্বালা আর সহ্য করতে না পেরে বেচারা একটু আগে আত্মহত্যা করেছে। তুমি যদি একটু আগেও আসতে তবে হয়তো বাঁচাতে পারতে বেচারাকে। ও তো তোমারই আলেকজাণ্ডার।"

ওদের বলা শেষ কথাটা আমার কানের মধ্যে বার বার ধ্বনিত হতে থাকে, "ওতো তোমারই আলেকজাণ্ডার," সত্যি ও তো আমারই আলেকজাণ্ডার। সারা জীবন ধরে ওই তো একমাত্র ছিল আমার স্বপ্নের মানুষ। যতই অন্যায় ও করে থাকুকনা কেন আমার সাথে, এটাই তো নির্মম সত্যি যে সব কিছু সত্ত্বেও ওকে আমার অন্তর থেকে এক দিনের জন্যও দূর করতে পারিনি আমি। ও আমার কাছে ফিরে এসেছিলো নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে। আমি চাইলে ওকে বাঁচাতে পারতাম এই বিষের থেকে, কিন্তু বাঁচাইনি। নিজের প্রতিশোধের স্পৃহায় ওকে নিজের হাতে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি। সমস্ত অভিমান, রাগ, বিদ্বেষ মুছে যাচ্ছে আমার অন্তর থেকে, আর তার জায়গায় স্থান নিচ্ছে সেই সোনায় মোড়ানো অমূল্যের সময়ের স্মৃতিগুলো। আমার নিজের অজান্তেই আমার দুই চোখ থেকে জলের ধারা ঝরে পড়ছে, ওর মৃতদেহের উপর। একজন রাখাল আস্তে আস্তে ওর চিতায় আগুন প্রদান করলো। শুকনো কাঠ আগুনের ছোঁয়ায় এসে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। আর সেই আগুনে আমি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখছি আমার জীবনের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎকে। আর তো একটাই উদ্দেশ্য পড়েছিল আমার এই তুচ্ছ জীবনের 'প্রতিশোধ', তোমার মৃত্যুর সাথে আজ সেটাও শেষ হয়ে গেলো। আর কি নিয়ে বাঁচবো আমি? সারা জীবন করিথাসের মা তোমাকে ক্ষমা করতে পারেনি, কিন্তু আলেকজাণ্ডারের প্রেয়সী কিভাবে বাঁচাবে তার আলেকজাণ্ডার পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার পর? একটু একটু করে আগুনের আরোও সামনে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। একজন রাখাল চীৎকার করে উঠলো, "কি করছো ঈনন? অত কাছে যেয়োনা আগুনের। তুমিও তো পুড়ে যাবে শেষে?"

সেটাই তো চাই আমি, আমার ভালোবাসার আর ঘৃণার মানুষটার বিদায় নেবার সাথে আমার জীবনেরও যে সব উদ্দেশ্য শেষ হয়ে গেছে। আমার করিও বিদায় নিয়েছে, আর আজ বিদায় নিচ্ছে আমার জীবন পথের ভালবাসা ও ঘৃণা দুইয়েরই এই ধ্রুবতারা। আর কি লাভ আমার বেঁচে থেকে? আর চিন্তা করিসনা করি, এই দ্যাখনা তোর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আমি চলে আসছি তোর কাছে, এই নিষ্ঠুর জগৎ যে সংসারকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলো, তাকে আবার আমরা তিনজন মিলে জোড়া লাগাবো ওই অমরত্বের জগতে।

বিনা সংকোচে আমার আলেকজান্ডারের চিতায় হাসিমুখে ঝাঁপ দিলাম আমি। দেবতা হিফাস্টাস দয়া করুন আমায়। এবার এই জগৎ ছেড়ে আমার জীবনের সবথেকে প্রিয় দুটি মানুষের কাছে যাবার পথের দিশারী হন তিনি আমার। বিদায় মাতা রিয়া, তোমার এই তুচ্ছা উপাসিকা এই পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগে তোমাকে জানায় তার অন্তিম প্রণাম। 

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদেব ভট্টাচার্য

Posted in


ধারাবাহিক


সদগুরু 
সুদেব ভট্টাচার্য





সুখব্রত অনেকক্ষণ থেকেই আনচান করছিলেন ঘুমের ঘোরে। প্রীতিলতা খেয়াল করছে আজ কদিন ধরে সুখব্রত অদ্ভুতরকম সব স্বপ্ন দেখেন রাত্রে। আর পরক্ষণেই ঘুম ভেঙ্গে মাঝরাতে ধড়মড় করে জেগে ওঠেন। বিড়বিড় করে অনেক কিছু অস্পষ্ট কথা বলতে থাকেন আপন মনে। অথচ অনেকবার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও তিনি স্পষ্ট করে বলতে পারেননি তার স্বপ্নের ঘটনা, বৃত্তান্ত, পটভূমি কিছুই। শুধু একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের তীব্র আলোর কথা বারবার তিনি বলেন। এছাড়া নাকি আর কিছুই মনে থাকে না তার। প্রীতিলতা উঠে বসল বিছানার ওপরে। সুখব্রত অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার শান্ত হয়ে পড়লেন ঘুমের ঘোরে। কিন্তু প্রীতিলতার আর ঘুম আসছে না কিছুতেই। সে হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে কোনও এক অজানা ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল।

আজকেও বিকেলে পার্টির ছেলেরা এসেছিল সুখব্রতর খোঁজে। প্রীতিলতা ওঁর অনীহা আগে থেকেই আন্দাজ করেছিল। তাই ছেলেগুলোকে বাইরে থেকেই সুখব্রতর শরীর খারাপের কারণ দেখিয়ে বিদেয় করেছিল। সুখব্রত বহুদিন পার্টির ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছেন। অথচ একসময় এই মানুষটাই নাকি স্বদেশি, পিকেটিং সব করতেন নিয়মিত। এই ঘরেরই দেওয়ালে ঝুলত গান্ধী, পাটেলের ছবি। তখনও সুখব্রত অন্যসব মাঝবয়সী পুরুষদের মতই বেশ সাংসারিক ছিলেন। প্রীতিলতার প্রতি ছিল অগাধ প্রেম আর ছেলেদের পড়াশুনো নিয়েও ছিলেন অত্যন্ত ওয়াকিবহাল। ইদানীং ওই অজিতেশের সঙ্গে উত্তর কলকাতার কোন এক মঠে যাবার পর থেকেই সুখব্রত কেমন বদলে গিয়েছেন। অজিতেশ আর সুখব্রত আগে একসঙ্গেই কংগ্রেস করতেন। স্বাধীনতার আগে বেলেঘাটার বাড়িতে গান্ধীজি এলেই ওঁরা ছুটে যেতেন ওঁর কাছে। গান্ধীজি খুব স্নেহ করতেন সুখব্রতকে। অথচ সেই মানুষটাই এখন গান্ধীর নাম শুনলে বিরক্ত হন। সেই প্রসঙ্গ উঠলেই এখন বলেন, “গান্ধীবাদও সঠিক পথ নয়। স্বাধীনতার পরে কী লাভ হয়েছে মানুষের? পেরেছি আমরা জাগতিক পীড়ার অবসান ঘটাতে? এখনও মানুষ খেতে পায় না। একটা যুদ্ধ থামলে আরেকটা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। রোগ ব্যাধি, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসব কি কিছুই আটকাতে পারি আমরা? আসলে পার্থিব মতবাদ দিয়ে কখনও চিরন্তন পীড়া দূর করা যায় না। ঈশ্বরবিমুখ হয়ে মানুষ কোনওদিনও কোনও সুখলাভ করতে পারবে না।“

এসব কথা শুনে প্রীতিলতার কেমন যেন ভয় করে মনে মনে। গত ক’মাসে তার ঘরবাড়ি একটু একটু করে বদলাতে শুরু করেছে। গান্ধী পাটেলের ছবির জায়গায় এখন এক বয়স্ক সন্ন্যাসীর ছবি কোথা থেকে এনে সুখব্রত টানিয়ে রেখেছে। ছবিতে দৃশ্যমান এই মহাপুরুষের নাম এখন প্রীতিলতার কন্ঠস্থ হয়ে গিয়েছে। দিনে সারাক্ষণই প্রায় এই সন্ন্যাসীর নাম করতে থাকে সুখব্রত। সৌরপতি প্রত্যুষ। কলকাতার কোনও এক আধ্যাত্মিক মঠের প্রধান সন্ন্যাসী ইনি। সুখব্রত এখন সৌরপতি প্রত্যুষ অন্ত প্রাণ।

সুখব্রত বদলে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে। না, ধীরে ধীরে নয়। খুব দ্রুত। চেনা মানুষটাকে আর চিনতে পারে না প্রীতিলতা। কাজপাগল মানুষটা নিয়মিত এখন আর দোকানেও যান না। সারাদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে কি সব ঠাকুর দেবতার বই নিয়ে পড়াশুনো করেন এক মনে। আর দিস্তা দিস্তা কাগজে সেইসব শ্লোক, মন্ত্র লিখে রাখেন। বহির্জগতের সঙ্গে তখন তার সমস্ত সম্পর্ক যেন সম্পূর্ণ লোপ পায়। এভাবে কি কোনও ব্যবসা টিকতে পারে? বড়বাজারে অতবড় একটা ওষুধের দোকান শুধু দুজন কর্মচারীর হাতে ফেলে রাখা যায়? মাঝে মাঝে প্রীতিলতা অনেক বুঝিয়ে, ঝগড়া করে পাঠায় দোকানে। কেমন একটা উদাসীনতা নিয়ে সুখব্রত বেড়িয়ে যান বাড়ি থেকে। ফেরেনও অনেক রাত করে। জিজ্ঞেস করলে বলেন, “সৌরমঠে গিয়েছিলাম ফেরার পথে। সৌরপতির প্রবচন শুনলে একবার আর মাঝপথে কি উঠে আসা যায়?”

প্রীতিলতা আর কোনও কথা বাড়ায় না। কথা বাড়ালেই অশান্তির পরিবেশ তৈরী হয়। এদিকে ছেলে দুটোও বড় হচ্ছে। বড়জন বছর দুই হলো বিয়ে করেছে। আর ছোট ছেলে ম্যাট্রিক দেবে এইবার। এরকম অবস্থায় প্রীতিলতার ইচ্ছে করে না আর নতুন কোনও অশান্তির।

প্রীতিলতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাদরটা টেনে নেয় গায়ের ওপরে। একটা ঠাণ্ডা বাতাস জানলা দিয়ে বয়ে এসে তার গায়ে লাগে।

পরের দিন সকালে যখন তার ঘুম ভাঙে তখন এক রাঙা মিঠে ভোরের আলো প্রীতিলতার মুখে এসে পড়ে। ঘুমচোখে নভেম্বরের শীতটা গায়ে মেখে প্রীতিলতা চমকে ওঠেন। তার পাশে সুখব্রত নেই বিছানাতে। শুধু একটা কাগজ পড়ে রয়েছে সেই স্থানে – সুখব্রতর রেখে যাওয়া একটা চিঠি।

******************************************************

সুখব্রত যখন পা রাখলেন মঠের প্রবেশদ্বারে তখন বেলা অনেক হয়েছে। মাথার ওপর সূর্যদেব যেন আজ একটু বেশিই উজ্জ্বল। সুখব্রতর এরকম প্রাণবন্ত দিন খুব প্রিয়। তিনি ধীরে ধীরে মূল মন্দির ছাড়িয়ে মঠপ্রধান সৌরপতির ঘরে প্রবেশ করলেন। এখানে এখন এক অপার্থিব প্রশান্তি বিরাজ করছে। ঘরে ঢুকেই প্রথমেই সুখব্রতর চোখ পড়ল এক দিব্যকান্তি মহাপুরুষের দিকে। ঘরের মাঝে আসনে উপবেশন করে যিনি এখন গভীর ধ্যানে মগ্ন।

সুখব্রত নিশব্দ পায়ে এগিয়ে গিয়ে তাকে প্রণাম নিবেদন করলেন। তারপর তার পাশে বসে রইলেন অনেকক্ষণ।

কতটা সময় এভাবেই গেল তার মনে নেই আর। যখন সৌরপতি প্রত্যুষ চোখ মেলে আগত অতিথির দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, তখন তার মুখের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেল। পূর্ণিমার মত আলোকিত হয়ে উঠল তার চোখদুটি। তিনি নিজের অস্ফুটেই বলে উঠলেন, “সময় হলো অবশেষে।

সুখব্রত বললেন, “প্রভু, আমি আমার সংসার, জাগতিক জীবন সব কিছু ত্যাগ করে আপনার শরণে এসেছি। এর আগে আমাকে আপনি তিনবার ফিরিয়ে দিয়েছন। আর আমি যাব না, আমার মনোস্কামনা পূর্ণ করুন প্রভু। ফিরে যেতে আমি আর আসিনি। আমাকে গ্রহণ করুন গুরুদেব।

সৌরপতি বললেন, “আর ফিরে যেতে হবে না তোমাকে সুখব্রত। আমিও তো নিজেই এতদিন এই দিনের অপেক্ষা করছিলাম। তোমাকে ফিরিয়ে দেবার ক্ষমতা আজ আমারও নেই। যার গভীরে এত ব্যকুলতা তাকে ফেরাবার সাধ্যি আমার কোথায়? তুমি বোসো এখানে। আমি পুজোর আয়োজন করছি। আজ তোমাকে আমি দীক্ষাদান করব।

সুখব্রতের মুখটা ঝলমল করে উঠল আনন্দে। সৌরপতি যতক্ষণ পুজোর আয়োজন করতে লাগলেন ততক্ষণ সুখব্রত এক ঘোরের মধ্যেই ছিলেন। শেষমেশ এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সুখব্রত আসন পেতে বসলেন। সুগন্ধী ধূপ, পুষ্প এবং প্রদীপের শিখাকে সাক্ষী রেখে সৌরপতি প্রত্যুষ তার কর্ণকুহরে ঢেলে দিলেন বীজমন্ত্রের মধু। এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল ওর সারা শরীর জুড়ে। সুখব্রত হারিয়ে গেলেন এক অন্য অতীন্দ্রীয় জগতের অতলে।

সৌরপতি বললেন, “আমি জানি তুমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ সুখব্রত। তাই তোমাকে আমি এখনই সন্ন্যাসদান করব না। কারণ তুমি হয়ত পরবর্তীকালে গৃহীজীবনে আবার ফিরেও যেতে পারো।

সুখব্রত আকুল নয়নে বললেন, “না, গুরুদেব। আমি আর ফিরে যাব না আমার সাংসারিক জীবনে। আমার স্ত্রী ঘোর বস্তুবাদী এক নারী। কিন্তু সে বুদ্ধীমতিও বটে। তাই সে নিজে এই পথে না এলেও আমার এই নতুন আধ্যাত্মিক জীবনে সে কোনও বাঁধা দেবে না। আমি আজ একটি চিঠি রেখে এসেছি তার কাছে। আমি জানি, সে ঘোর অভিমানিনী এবং দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী। হয়ত সে আমার খোঁজও করবে না কোনওদিন আর। আমাকে সন্ন্যাসজীবনের মন্ত্র দিন প্রভু। আমার নবজন্ম হোক আপনার আশির্বাদে।“

সৌরপতি বললেন, “তোমাকে সন্ন্যাসী হতেই হবে সুখব্রত। তোমার জন্মই হয়েছে গেরুয়া চীবরকে নিজের একমাত্র ভূষণ করে তোলার জন্যই। সে তোমার ভবিতব্য। তবে আজই তার সময় নয়। তোমার থেকে আমার প্রত্যাশা অনেক অনেক বেশি। তোমার জন্য আরও বড় লক্ষ্য অপেক্ষা করছে।“

সুখব্রত মাথা নীচু করে বললেন, “তাহলে এখন আমার জন্য কী আদেশ প্রভু?”

সৌরপতি বললেন, “ভগবান সূর্যের কৃপাতে তুমি যখন নিজেই এতদূরে এসেছ, তখন এই পুণ্যভূমি ভারতবর্ষকে আরও ভালোভাবে জানো। আমার দুইজন শিষ্য ধর্মকাম ও কিরণজ্যোতির সঙ্গে তুমি পরিব্রজে বেরিয়ে পড়। উত্তর কাশি, বৃন্দাবন, হরিদ্বার, গয়া, ইত্যাদি পুণ্যভূমি ঘুরে এসো এবং সনাতন ধর্ম ও সৌরদের সম্পর্কে আরও জ্ঞান আহরণ করো। তারপর তোমরা ফিরে এলে আমি তোমাকে সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা দেব নিশ্চই। এই কদিনে তোমার সংসারের প্রতি আসক্তি ও মায়ার বাঁধন কিছুটা হলেও স্তিমিত হবে।

সুখব্রত মাথা নত করে গুরুর অনুজ্ঞাতে সম্মতি জানালেন। সেদিন বিকেলেই সুখব্রত বেড়িয়ে পড়লেন অন্য দুই সন্ন্যাসীর সঙ্গে উত্তরের পথে। তখনও তিনি জানতেন না আজ থেকে তিন বছর পরে এই দিনেই তিনি সন্ন্যাস ধর্মে নিজেকে দীক্ষিত করবেন। পিতৃপ্রদত্ত নাম ঘুচে যাবে আজীবনের জন্য। শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতিতে রূপান্তরের মতই এক নতুন জন্ম হবে তার। 

******************************************************

প্রীতিলতার এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে তিনবছর আগের সেই সকালটা। একদিন ঘুম থেকে উঠে সে একটি চিঠি পেয়েছিল বিছানায় – সুখব্রতর লেখা বিদায় পত্র। সুখব্রত তারপর আর ফেরেনি বাড়িতে। সেই সকালের পর থেকেই চিরকালের জন্য বদলে গিয়েছিল প্রীতিলতার সংসারের রোজনামচা। কিন্তু প্রীতিলতা একফোঁটাও চোখের জল ফেলেনি কোনওদিনের জন্য। নিজেকে শুধু মনে মনে আরও শক্ত করেছে প্রতিদিন। যে মানুষটার সঙ্গে ত্রিশবছরের সম্পর্ক সে একদিন এভাবে সবকিছু চুকিয়ে দিয়ে চলে পারে এটা ছিল তার কল্পনাতীত। তার বিশ্বাসের দাম এভাবে পেল সে? এভাবে চলে যাওয়া মানে তো আসলে পালিয়ে যাওয়া! একটা তস্করসুলভ হীন কাজ ছাড়া আর কি? 

তারপর ধীরে ধীরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে অলক্ষ্যেই। কোনওদিনও সে খোঁজ করেনি আর সুখব্রতর। ছেলেদের অনেক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও নিজের বুকে পাষাণ রেখে তার সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে প্রীতিলতা। সে ভালো করেই জানে, হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু যে নিজেই হারাতে চায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না আর। হয়ত সুখব্রতকে সে জোর করে নিয়েই আসতে পারত, কিন্তু মানুষটাকে কি আর ফেরানো যেত? মনে মনে তো সে অনেকদূরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। তাই জীর্ণ কুসুমের মত পরিত্যাগ করেছে সে সুখব্রতকে। নিজের থেকে, সংসার থেকে চিন্তা থেকে সুখব্রতকে বিসর্জন দিয়েছে প্রীতিলতা। নিজের হাতে দোকান ও সংসার চালিয়েছেন একা। আর সেইসঙ্গেই প্রতিটা বিগত মুহূর্তের সঙ্গে একটু একটু করে ভুলতে চেয়েছে পুরোনো স্মৃতি। এই কয়েক বছর ধরে সে ক্রমাগত নীরবে প্রলেপ লাগিয়ে চলেছে নিজের গোপন ক্ষতগুলিতে। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল তার। 

বছর তিনেক ধরে দেশ ও তীর্থ ভ্রমণের পরে ফিরে এসে সুখব্রত যেদিন সন্ন্যাস নিয়েছিলেন সৌরপতি প্রত্যুষের কাছে, সেদিনই নিজের সমস্ত জ্ঞান, শিক্ষা, জাগতিক সম্পদ অর্পণ করে দিয়েছিলেন তার সদগুরুর চরণে। সৌরপতি প্রত্যুষও তার এই নবাগত শিষ্যর চোখে এক স্বতন্ত্র দীপ্তি লক্ষ্য করেছিলেন হয়ত। কারণ সেদিন তার মুখেও এক অদ্ভুত প্রশান্তি দেখা গিয়েছিল। যেন এতদিন সৌরপতি সুখব্রতকেই খুঁজে ফিরছিলেন। এই মন্ত্রদানের জন্যই তো তিনি অপেক্ষা করেছিলেন আজীবন। সুখব্রত ইংরেজীতে ভালো, পদার্থবিদ্যায় স্নাতক। তাই সৌরপতি জানতেন এরকম একজন ব্যক্তিই পারবে তাঁর অবর্তমানে ভগবান সূর্যের এই সংঘ এবং তার নাম পৌঁছে দিতে সমগ্র পৃথিবীর মাঝে। সৌরপতির বয়স হয়েছে, তিনি জানেন তিনি আর বেশিদিন নেই। ভগবান সূর্যের চরণে তিনি আজীবন সেবা করেছেন, নিজের বাড়িতেই সামান্য একটা সঙ্ঘ খুলে তিনি নিত্য পূজাপাঠ করেছেন এবং দীক্ষা দিয়েছেন কয়েকশো মানুষকে। কিন্তু তিনি জানেন তাঁর যোগ্যতা সীমিত। আর এখন তো জরা এসে ধরেছে তাকে। আর কদিন পরেই তিনি চলে যাবেন সূর্যলোকে। কিন্তু অনেক কাজ বাকি রয়ে গেল ভেবে তিনি মাঝেমধ্যেই মুষড়ে পড়তেন। 

তবে এখন আর তিনি হতাশ হন না। তিনি জানেন সুখব্রতই পারবে সূর্যনাম প্রচার করতে এই বিশ্বমাঝে। ভগবান সূর্যই তাকে পাঠিয়েছেন তাঁর কাছে। এদিকে সুখব্রতও একনিষ্ঠ ভক্তের ন্যায় গুরুর সেবা করতে শুরু করলেন। সুখব্রতর বয়স ষাট এখন আর সৌরপতির বিরাশি। মোহ মায়ার জাগতিক বন্ধন যে তাঁকে আর টানে না সেই প্রমাণ ইতিমধ্যে পেয়েছেন সৌরপতি। সুখব্রত সারাজীবন শুধু গুরু সেবা করতে চান ও ইষ্টনাম জপ করতে চান। সৌরপতিও বুঝেছিলেন এটাই যথাযোগ্য সময়। তিনি সন্ন্যাস দান করলেন সুখব্রতকে। অতঃপর তার নতুন নাম হলো দিবাকরম। পিছনে পড়ে রইল তার পুরোনো জীবন, ওষুধের দোকান, ব্যবসা, স্ত্রী প্রীতিলতা ও দুই পুত্র। শুরু হলো এক নতুন জীবন। মুণ্ডিত মস্তক, কপালে সূর্যতিলক, গলায় তেজকন্ঠি এবং বাসন্তী রঙের চীবর এখন তার ভূষণ। সারাদিন তিনি ইষ্টনাম জপ ও সেবার কাজে ব্যাস্ত থাকেন। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন, তবে আরও বড় কিছু অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্য। দিবাকরম তা জানতেনও না। 

একদিন ভোরের বেলায় সূর্যপ্রণাম সেরে সুখব্রত মঠের টানা বারান্দার এক প্রান্তে বসে মালা গাঁথছিলেন পুজোর জন্য। এমন সময় এক গুরুভাই ধর্মকাম তাকে এসে কানে কানে কিছু বললেন।তার মুখের চেহারা বদলে গেল তৎক্ষণাৎ। তিনি মালা গাঁথা ফেলে ছুটে চললেন গুরুগৃহে। সৌরপতির প্রত্যুষ কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ত দেহ রাখবেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা বিশেষ ভালো নয়।


চলবে...

0 comments: