ছোটগল্প - রুখসানা কাজল
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
মন্থন
রুখসানা কাজল
কাটা পেঁয়াজের খোসার ভেতর আঙ্গুল চালিয়ে কি যেন খুঁজছেন আমার শাশুড়িমা। কি খুঁজছেন মা? অমলিন হাসি দিয়ে তিনি জানালেন, কুচোনো কিছু পেঁয়াজ পড়ে গেছে তাই তুলছি মা। এ হে ময়লা লেগে গেছ তো! ফেলে দিলে হয় না! অকৃত্রিম ঘৃণায় সিঁটিয়ে উঠি। খুঁজে পাওয়া পেঁয়াজগুলো পরম যত্নে মুঠো করে টিউবওয়েলের জলে ধুয়ে মিশিয়ে দিলেন বাটিতে উঁচু হয়ে থাকা কাটা পেয়াঁজের সাথে। খাওয়ার যোগ্য জিনিস হেলাফেলায় ফেলতে নেই গো মেয়ে। ওরাও অভিশাপ দেয়। উপচে পড়া চিনিগুলো অন্য বোয়ামে তুলে রাখতে রাখতে আমি ভাবি কি তুলছি আমি? স্নেহ, ভালবাসা, ঘৃণা, নাকি অবিশ্বাসের সূতোনটি সাপ?
জয়ঢাক পেট নিয়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াই। কখনও পড়তে বসি। কখনও পুরানো বাড়ির খসে পড়া দেয়াল, ছাদ দেখি। কলম দিয়ে খুঁচিয়ে দেয়ালের ক্ষতগুলো থেকে আরও বালু সিমেন্ট ঝরিয়ে দিই। শাশুড়িমা হাসেন। স্নেহ ছলকে উঠে তার চোখে মুখে । যদিও মনের ভেতর অশান্তি, এই তো বয়স মেয়েটার, সামনে অসীম সময় পড়ে আছে। কি করে এতটা পথ একা পেরুবে মেয়েটা! বিয়ের বছরেই স্বামীটা মরে গেল! তার আদরের সর্বশেষ সন্তানটি। হাসির সাথে কান্নারা মিশে যায়, তিনি আমার মাথায় হাত রেখে জানতে চান, শিশুটিকে কি রাখবে, মা? তোমারো তো অধিকার আছে দ্বিতীয় জীবন বেছে নেওয়ার! নিজেকে নিয়ে ভাববার!
সাঁঝ সন্ধ্যায় সবাই যখন ঘরে ঘরে ব্যস্ত ধূপ দিতে, নামাজ পড়তে, নাস্তা বানাতে আমি পেটের উপর হাত রেখে বলি, এই আছিস? আমার হাত কাঁপে, মেরুদণ্ডে স্রোত ভাংগে টেনশনের। আর ঠিক তখুনি চিনচিনে এক নাড়াচাড়া মাতৃবন্ধি নাড়িতে টান দেয়। আমি মাথা শক্ত করে বলি, থাকুক মা। একা লড়াইয়ে ও না হয় আমার বন্ধু হবে! শাশুড়ি মার কালো মুখে মুক্তো গড়ায়। তিনি নদীতে বইঠা ফেলার মত হাত দুলিয়ে বলেন, আসুক, আসুক তোমার রাজাধিরাজ, আসুক তবে। তুমি মন দিয়ে পড়ো মা। পড়ো পড়ো! লড়তে গেলে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে হবে যে!
হাসপাতেলের কেবিনে চোখ খুলে দেখি অনেকগুলো মুখ। ঝাপসা। কে যেন খুশি খুশি গলায় বলে উঠল, শুনছ ডক্টরকে জানাও ওর সেন্স এসেছে। ব্যাথার সাগরে ছেঁড়া পাতার মতো দুলছি আমি । একেকটি ব্যাথার ঢেউ আছড়ে পড়ছে আর আমি কুঁকড়ে কেঁদে ফেলছি। কেউ একজন জেতা ট্রফির মতো একটি শিশুকে তুলে ধরল খানিক উঁচুতে। প্রচণ্ড রাগে কাঁদছে শিশুটি। কে এই শিশুটি? হাতের নাম্বার লেখা কাগজটি প্রতিটি সশব্দ কান্নার সাথে কেঁপে কেঁপে উঠছে। এত ক্রোধ কেন শিশুটির? ও কি ভুল কোলে এসে পড়েছে! এরা কারা? পরাজিতের উঠোনে এ কোন বিজয় উৎসব! একটি শীর্ণ হাত আমার কপাল ছুঁয়ে হাসছে, ও মেয়ে তোমার সেনাপতি এসে গেছে। আর তুমি একা নও। মার পাশে আরও কিছু উদ্ভাসিত মায়ামুখ। চেনা চেনা অথচ হারিয়ে যাচ্ছে অচেনার অলিগলিতে। প্রাণপণে সেন্স ধরে রাখার চেষ্টা করছি। হ্যাঁ, আমি... আমিই জন্ম দিয়েছি শিশুটিকে— তীব্র আলোর সেই ওটি, ডাক্তারদের মুখোশ মুখ!
জু্তায় খটখট তুলে সাদা এপ্রন পরা একজন ডকটর দ্রুত এসে আঁতকে উঠে। কাকে যেন ধমকে ডাক দেয়, এখন তো সেন্স আসার কথা নয়। নার্স সিস্টার--- সিরিঞ্জ উঠে আসে ডাক্তারের হাতে। অচেনতার গোলাপি ঘরে চলে যেতে যেতে দেখলাম আপন রক্তের নয় মানুষগুলো সজল ব্যাকুলতায় চেয়ে আছে। ভালবাসার কি কোনও নির্দিষ্ট গোত্র থাকে? ভালবাসার পিতা কে? মাতা? কতজন ভাই বোন আছে ভালবাসার? কাছের, দূরের, আরও দূরের লতায় পাতায় জড়ানো ছড়ানো আত্মীয়রা কি করে, কোন মায়ায় বেঁধে রাখে ভালবাসাকে?
শিশুটির কপালে কালো টিপ, চোখে কাজল পরাতে না পেরে শাশুড়িমা ওর পায়ের নীচে কাজলের টিপ পরিয়ে দিলেন। ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল সবাই। ডক্টর আন্টি দেখলেই বকে দিয়ে বলবে, বড় আপা এসব কুসংস্কার। তারপর নিজেই দরোজায় ঝুলিয়ে দেওয়া লিস্ট দেখিয়ে বলে যাবে আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রে নবজাতকের যত্ন আত্তি লালন পালনের নির্দেশনামা । শাশুড়ি মার মুখে দুষ্টু হাসি। চকিত শালিকের মতো মাথা নেড়ে মেনে নিলো ডাক্তারবোনের সব কথা। তারপর নির্জন দুপুরে খালি বাসায় সবাই চলে যেতে শিশুটিকে স্নান করিয়ে, পাউডার মাখিয়ে চুলের ফাঁকে কাজলের টিপ পরিয়ে তিনি গুন গুন করে সুর তোলেন, পরথমে বরনোনা করি আল্লাহ রসুলের নাম, তারপরেতে শোনো পুত্র তোমার -- -
কি বোঝে কে জানে সুর থামালেই শিশুটি চেঁচিয়ে কাঁদে। তিনি ঘুম তাড়িয়ে আবার সুরে ফিরে আসেন। ক্লান্তিহীন অবিরাম সুরের সুতোয় বাঁধা পড়ে যায় দুটি অসম প্রাণ। আমি বয়সি মানুষটির গায়ে এক পাত্তার নরম কাঁথা ছড়িয়ে দিই। দুজনেই ঘুমুচ্ছে। আড়াই দিন বয়সি শিশুটির গায়ে হাস্নুহেনা সুগন্ধ, ওর মুঠো করা লাল হাতের ভেতর একটি আঙ্গুল রাখতেই আশ্চর্য আন্দাজে আমার দিকে ঘুরে আসে। এক অস্ফুট অভিমানের শব্দ করে আদরে জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দেয় আঙ্গুল। চোখের দীর্ঘ পাপড়িতে মেঘ জমা ভেজা রঙ । পাপড়ি ছুঁতেই হঠাৎ তাকিয়ে দুটি হাতই পুরে দেয় মুখের ভেতর। পায়ের আঘাতে সরে যায় গায়ের কাপড়। নাভি বাঁধা ব্যান্ডেজ দুলছে। ছোট্ট আদুরে পেট। পেটের নীচে পুরুষ পরিচয়ের দিকচিহ্ন লিঙ্গটি নমিত কোমল সুন্দর । আমি আরেকটু ছুঁয়ে দিই। পায়ের পাতায় পদ্ম রঙ। তাতে শাশুড়ি মায়ের আঁকা বিপদ তাড়ানো স্বস্তিশেল। স্মৃতির খাম থেকে মুছে যায় অচেনার সব অক্ষর। কি অসহায় ছোট্ট মিষ্টি মানুষটি। শরীর কাঁপিয়ে ধেয়ে আসে রক্তকণা। দুটি বুকে দোল খায় আসমুদ্র বাঁচার রসদ। এই প্রথম শিশুটিকে দু হাতে তুলে নিই। কি করে যেন বুঝতে পারি ক্ষুধা লেগেছে বাবুটার। খাওয়ার যোগ্য অমিত সুধা ঝরে যাচ্ছে যুগল স্তন বেয়ে। সভ্যতাতে অভিশাপ ছোঁয়ার আগেই স্তন তুলে দিই ওর মুখে।
মেকিয়াভেলী রেখে লম্বা শিকের জানালার বাইরে কলাগাছগুলো দেখি। মা কলাগাছের আশেপাশে অসংখ্য ছোটবড় শিশু গাছ। হাতে হাতে ছুঁয়ে আছে সবাই সবাইকে। আমিও ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি সুনির্মিত শিল্প। হাত, পা, কান, একমাথা নরম কালো চুল, চোখ, দৃষ্টির গভীরতা। ও দেখে আমাকে। ওর চোখে চিরচেনার সাদা আলো। শাশুড়িমা দু কাপ চা এনে ঘন হয়ে কাছে বসেন, শিশুরাই ঈশ্বর। ওরাই পথ। ঘর। মাঠ। আকাশ। সমুদ্র। ওরাই পৃথিবী। বেঁচে থাকার অপাপ শক্তি। স্বপ্ন। সাহস। ওদের জন্যেই বাঁচতে ইচ্ছ করে। বাঁচতে হয়! এই যে বেঁচে থাকা সে তো তোমাদের জন্যেই মা।
আশ্বিনের হঠাৎ ঝোরা বৃষ্টিতে নেয়ে গেছে কলাঝোপ । বড় গাছগুলো থেকে জল ঝরে পড়ছে ছোটদের মাথায়। হাতে পায়ে। মানুষের ঝোপে মাকে ছুঁয়ে আমি । আমার কোলে এক শিশু। দুদিন পরেই পরীক্ষা। থিয়োরি। পলিটিক্যাল থট। শিশুটির নরম ঠোঁটে, গালে, কপালে, লালপায়ের তালুতে চুমু খাই। গুনগুন করছে মা, এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায় এ কি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু -- আমি দোল দিই ঝুলনের দোল। মা আমিনার কোলে, যশোদা মাঈয়ের কোলে, আমার কোলে দোলে পৃথিবী দোলে!
ভারি সুন্দর হয়েছে... শুভেচ্ছা
ReplyDeleteসার্থক
যেমন উপমা ব্যবহার, তেমন ভাষার বাঁধুনি, তেমনই গল্পের কাঠামো ও গতি। তোমাকে প্রানিপাত গো দিদি।
ReplyDelete