ধারাবাহিক - রাজর্ষি পি দাস
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
ফেরা - ৪
রাজর্ষি পি দাস
সাইকেল বা কানাইদা
Time is very slow for those who waits
Very fast for those who are scared
Very long for those who lament
Very short for those who celebrate
But for those who love, time is eternal …
- W.S
মুখের ভিতর চার-পাঁচটা তাম্বুল পান সাথে দশবারোটা বাতাসা, কড়ে আর মধ্যমা আঙুলের ফাঁকে বিড়ি -সেটা জ্বলছে, না নেভা তাতে কিছু যায় আসে না, হাত মুঠো করে হুঁকো টানার মত ভঙ্গি করে ঘনঘন টান দেওয়াটাই বড় ব্যাপার, ধোঁয়া নগণ্য।
– ক্যান্! বিড়ি নিব্বা গেলে তো ফেলাইয়া দেয়!
উত্তরে কানাই চাটার্জী, এক দেড়শো মিটার বাই কুড়ি মিটার লম্বা ভুখণ্ডের মালিক দু’পা ছ্যাতড়ে, একঝাঁক তাম্বুল পান আর বাতাসার সিন্নি বাতাসে ছিটিয়ে দিতে দিতে বলল – আগুন বুকে থাকে, বিড়িতে না! কিন্তু বুকে তো রামসীতা থাকে- আমার ক্লাশ সেভেন মার্কা উত্তর! কানাইদা কিছুটা সিন্নি এবার পত্ করে মাটিতে ফেলে – বাল্ থাকে! তারপর মুখ ঘুরিয়ে আমার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার পকপক করে হুকোমুঠো থেকে হাওয়া টেনে ---আসলে বাল মানে তো চুল… জানোস তো…তাহইলে বুকে বাল থাকবো না তো কী থাকবো! বাল!
কানাইদা নিজের পরপর বাল উচ্চারণে এবার সত্যি বিব্রত! কানাইদাকে সবাই পেছন থেকে কানাই-পাগলা বলে! বলে বেলা বাড়লে পাগলামো বাড়ে। এখন কটা বাজে? কানাইদা আকাশে একহাত ঘুড়িয়ে বলল –কটকটি খাই চল! আমি ঘাড় নাড়তেই কানাইদা আশ্বস্ত। দোকানের দিকে যেতে যেতে কানাইদা আবার ঝালিয়ে নেয়- দ্যাখ তুই আবার ঊষা-উমারে কইস না যে আমি তোরে ‘বাল’ কইছি! ততক্ষণে আমরা দোকানের সামনে, কটকটির বোয়ামের দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করি। কানাইদা শ্যাওলাধরা দাঁত বের করে হাসে! কানাইদা জানে না যে আমি জানি বাল বাংলায় গুপ্ত অঙ্গের চুল! আশোক বিজয় বলেছে!
ঊষা-উমা আমার জোড়া গৃহশিক্ষিকা! মণি স্যারের হাতে মার খেয়ে মাম্স বেরিয়ে এলে তড়িঘড়ি এই জোড়া শিক্ষিকার আশ্রয়। কারণ আমি এখন ক্লাশ সেভেনে- ফাইন্যাল্ পরীক্ষা আর তিনমাস পর! আর ওঁরা কানাইদার ছোট বোন! দুজনেই এম এ পাশ! কানাইদা ভীষণ ভয় পায় দুই বোনকে! এরা দুজন যখন তখন কেঁদে ফেলে! কানাইদার নাকি দুই বোনের কান্না দেখলেই মনে হয় ওরা শ্বশুড় বাড়ি চলে যাচ্ছে!
উমাদি উমার মতই উজ্জ্বল সুন্দর তেজস্বী আর ঊষা ঊষার মতই স্নিগ্ধ, চাপা, মমতাময়ী! এই জোড়া দিদিমণির কাছে পড়াশোনা যতটা হচ্ছে থেকে বেশি হচ্ছে সেতারশোনা! দুজনই সরস্বতীর মত এক পা মুড়ে বসে ট্ররাং ট্ররাং করে যে ঝংকার তোলে, আর মুর্ছণায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার মাথায় হাজার হাজার জানলার জন্ম হয়! কিন্তু আমি ঐকিক নিয়ম দিয়ে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না যে একটা ডানহাতের তর্জনি যদি গয়না পরে এতগুলো তারবাজায় আর বাঁহাত যদি মাত্র একটা তার টিপে টিপে ছোটাছুটি করে তাহলেও মাত্র একটা বিশেষ কিছু বাজে কেন? আমি আরও অবাক হই যখন নবদা এসে তবলায় ঢেউ তুলে ধাতব শব্দকে চামড়ার শব্দ দিয়ে বন্দি করে ফেলে! দুই বোনের সেকী হাসি তখন, চোখে আর মুখে! অবশ্য ঊষাদির সামনের দাঁত একটু উঁচু তাই চোখ দিয়েই বেশি হাসে আর উমাদির হাসিটা কেমন যেন, বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না!
এরকম একদিন সন্ধায় যখন সেতার আর তবলা ঢিমে তালে চলছে আর আমার বাংলা থেকে ইংলিশ ট্র্যান্স্লেশন শেষ, উমাদি ইশারায় জল আনতে বললে আমি বিরক্ত অথচ বাধ্য ছাত্রের মত রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে জ্যোৎস্নার আলোতে দেখি একটি সাইকেল জাম্বুরা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে! তখন সাইকেল মানেই অরণ্যদেবের তুফান! স্পষ্ট দেখলাম সাইকেলটা লেজ নাড়ছে, ওদিকে সেতার-তবলা বুঝি একটু গুঝিয়ে দ্রুত হলো! আমি জল ভুলে তুফানের কাছে এসে দেখি সাইকেলে তালা মারা নেই! আর কে পায় আমাকে, হাফ-প্যাডেলে ঠ্যাং ঠ্যাং করতে করতে যতটা সম্ভব তবলার তালে তালে জাম্বুরা গাছকে মাঝখানে রেখে চক্কর মারা শুরু করলাম! জাম্বুরাগুলো এত নীচে যে প্রায়ই হেড দিতে হচ্ছে। হঠাৎ পা পুরোটা ঘুরে গেল, আবার, আমার বিশ্বাস করতে পারছি না আমি ফুল প্যাডেল শিখে গেছি। ওদিকে ঊষা-উমা আরও দ্রুত হলো, সাথে নবদা! চামড়া আর ধাতব এবার মিলেমিশে চরিত্র হারিয়ে একটা নতুন সাউন্ডের জন্ম হলো -- টগবগ টগবগ… আফ্রিকার সোনালী তটে আমি এগিয়ে যাচ্ছি স্বপ্নের ডায়নার দিকে!
কিন্তু ডায়নাকে দেখতে উমাদির মতন লাগছে কেন? ডায়না হেসেহেসে কুটোপুটি, তুফানের লাগাম হাতে নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আমি এক হাতে স্যাট করে ডায়নাকে তুফানের পিঠে তুলে নিলাম অরণ্যদেবের মতন! তারপর ডায়নার চুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে সামনে নদী! পিরণ্হা ভর্তি নদী! আমি শিস দিলাম, নেফোরদিতি আর সলোমান আসবে! আমি আর উমাদি নদী পেরিয়ে- হঠাৎ সেতার আর তবলা থেমে গেল! আমিও সাইকেল থেকে নামিয়ে একপা মাটিতে রাখলাম! কানাইদার গলা!
তুই দুই বোনের সাথে একলগে বইয়া তবলা বাজাস ক্যান্! নব, তোর ধান্দা আমি বুঝি, দুজনের লগে বাজাবি আর আমার বুইন দুইটারে কনফিউস কইরা রাখবি... এ তো হইবো না! ক তুই কারে বিয়া করবি!
সাথে সাথে দুই বোনের একসাথে আর্তনাদ- দাদা! তারপরেই যৌথ কান্না শুরু!
পরের দিন দুপুরবেলা কানাইদা আমাকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে নবদার বাড়ির দিকে! মা প্রথমে ছাড়তে চাইছিল না! মা বুঝে উঠতে পারছিল না যে ভর দুপুরে কানাইয়ের হাতে ১২-১৩ বছরের ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া কতটা সেফ! কানাইদা মাকে পাত্তা না দিয়ে সোজা আমার হাত ধরে টেনে বাইরে এনে সাইকেলে বসিয়ে – সাড়েতিন টার মধ্যে দিয়া যামু! ওত বড় বাড়ির ছেলে, তার উপর সবাই পাগল বলে! মা আর কী করবে, দাঁড়িয়ে থাকে!
কানাইদা গোঁহাই দোকানের সামনে বাঁক নিয়ে ভারি শুকনো মুখে বলল
--নব ভালো ছেলে!
আমার আর ভালো লাগছে না। নিজেকে রেক্স ভাবতে ভালো লাগছে না। কারণ কানাইদা মোটেই বেতালের মতন নয়! কানাইদা বরং গুণধরের মতন পাশাপাশি দৌড়ক, আর সাইকেল্টা আমি চালাই! গতকাল রড ধরে ফুল প্যাডেলে পা দিয়েছি! কতক্ষণে বন্ধুদের বলব বলে তেতে আছি। উল্টে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট ধরে সাইকেলের সামনের রডে বসে কানাইদার জীবনের প্রতি রাগের নানারকম কারণ শুনতে হলো! কানাইদা সকাল থেকে মাত্র একবার পান্তাম্বুল্বাতাসার মহাভোগ খেতে পেরেছে তাও মাধুকরী করে। সেও সকাল সাতটার সময়। তারপর আর কপালে জোটে নি! দুই বোন কানাইদাকে বয়কট করেছে। দুপুরবেলা শুধু করলা ভাজা দিয়ে ভাত খেতে দিয়েছে! সবচেয়ে বেশি রেগে আছে উমাদি, আমার মতন কানাইদাও উমাদিকেই বেশি ভয় পায়, তাই ওই দিয়েই ভাত গিলে এসেছে! এখন ঢেঁকুর তুলতেও মানা, করলা পেছন ছাড়ে নি!
সুন্দরীরা নাকি একটু ক্ষ্যাপাটে হয়! কানাইদার অভিজ্ঞতা এব্যাপারে বেশ খারাপ! সে ঘরে হোক আর বাইরে! পাশের বর্মণ ব্যারাকের হীরাদিও নাকি এরকম ক্ষ্যাপাটে, বাঁশতলার রায় বাড়ির দিদিটাও নাকি পাগলী! আর শ্রিপুরিয়ার ভট্টাচার্য বাড়ির ছেমড়িটাতো ...ছ্যাঃ ছ্যাঃ ছ্যা...পাতেই দেওয়া যায় না! আমি ছ্যাঃ ছ্যাঃ শব্দযুগল শুনে ঘাড়ে হাত বুলিয়ে নিলাম! না শুকনো আছে। হঠাৎ ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল কানাইদার জন্য, সকাল থেকে মাত্র একবার তাম্বুল্বাতাসা আর খৈনি জুটেছে! আগে জানলে মা’র কাছে থেকে পাঁচ পয়সা নিয়ে আসতাম! আমার কিন্তু কানাইদাকে খুব একটা পাগল মনে হয় না! আমার বেশ লাগে কানাইদাকে! চিবুক উঁচু করে যখন অফস্পীন বল করে তখন তো হিরোও মনে হয়। ওত ভালো বল ঘোরাতে কেউ পারে না! তাছাড়া আমি এখন অব্দি পাগল দেখি নি! এদিকে সবাই সবাইকে পাগল বলে, মা আমাকে বলে, বাবা মাকে বলে, জেঠু বড়ছেলেকে বলে, আবার বড়ছেলে কাজলদা এসে বলে ‘আর কইবেন না, বাবার মাথা খারাপ হইয়া গেছে’! এই তো সেদিন শুনি গোস্বামী স্যার প্রেমেন্দু স্যারকে কথায় কথায় বলছিলেন- ‘ফাগইল হইয়া গ্যেছেন নি?’ তো!
নবদার বাড়ি গিয়ে শুনি নবদা বাড়ি নেই! কানাইদার মুখ চূণ! আকাশে সূর্য গনগন করছে! কানাইদার মুখ চোখ লাল হয়ে গেছে। কিছু একটা করতে চাইছে, কিন্তু কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না! আমার দিকে তাকায় আর নবদার বাড়ির দিকে তাকায়! আর না পেরে এক লাথে সাইকেলটাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে -- আমি ঊষা উমারে মুখ দেখাইতে পারুম নারে-- বলে রাস্তায় হাতপা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে পড়ে। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে পাশে বসে কান্না শুরু করি! নবদার বাবা-মা গেটের ওপার থেকে হতভম্ভ!
তারপর কানাইদা যেটা শুরু করল সেটা আরও অভাবনীয়। জানতামই না যে কানাইদা এটা পারে! কানাইদা কাঁদোকাঁদো গলায় তবলার বোল আওড়াতে শুরু করল- ধা তিন ধিন তা... তেরেকেটে ধা... তিন না...
দুতিনমিনিটের মধ্যে নবদার ঘরের ভিতর থেকে তবলায় প্রত্যুত্তর এল! নবদা বাজাচ্ছে! কানাইদা আবার তাল উচ্চারণে! বেশ জমে উঠল, কানাইদা কান্না ভুলে উরুতে চাপর মারতে মারতে তালের গতি বাড়াতে শুরু করল এবং ইশারায় আমাকেও হাততালিতে সঙ্গত দিতে বলল!
তারপর, দশমিনিট পর নবদা সাইকেলের পেছনে আমি সামনের রডে আর কানাইদার হাতে হ্যান্ডেল,আমরা চাটার্জী ব্যারাকের দিকে যাচ্ছি! আমার এখনও ঘোর কাটে নি, কানাইদা কী করে তাল উচ্চারণ করতে পারে! নবদা যেন আমার মনের কথা পড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল- আমাকে উমা বলেছিল তুমি নাকি ভালো তবলা বাজাতে, তোমার গুরু কে ছিলেন!
কানাইদা মুখে সিন্নির অভাব-- তাম্বুল খামুরে নব!
নবদা না শোনার ভান করে--আজ থেকে আমরা দুজন তবলা বাজাবো! আর হ্যাঁ, আমি ঊষাকে ভালোবাসি! কানাইদা সাইকেলে ব্রেক মেরে দুপা দুদিকে ছড়িয়ে দাঁড়ায়!
--আমি তো ভাবতাম ঊমা!
কানাইদা চিন্তিত!
সেই রাতে রান্নাঘরে বসে উমাদির ফোঁপানো কান্নাকে কে থামায়! আমি মাথা নীচু করে ডাইনিং টেবিলের আরেকপ্রান্তে বসে ভাবসম্প্রসারণ করছি-‘বদ্ধ জলার ন্যায়...’ ওদিকে বড় ঘরে ঊষাদির সাথে তবলা বাজাচ্ছে নবদা! উমাদি নাকে জলে চোখের জলে, উথলে উথলে –আমি আড়চোখে ব্যাপারটা লক্ষ্য রাখছি! ডায়না কাঁদছে, অরণ্যদেবের কী করা উচিত? কমিক্স্ বইতে তো কখনও দেখি নি ডায়না কাঁদছে!
হঠাৎ উত্তেজিত কানাইদা এসে বলে গেল –-- বেহাগ! আর কানাইদা চলে যেতেই উমাদি উঠে এসে ঠাস করে আমার গালে একটি চড় মেরে ধুপধাপ করতে করতে বাথরুমের দরজা এতজোড়ে দরজা বন্ধ করল যে সেতার আর তবলাও বন্ধ হয়ে গেল!
কানাইদাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এই তাম্বুল পান বাতাসা খৈনি বিড়ি একসাথে খাও কেন? কানাইদার নিস্পৃহ উত্তর, কাউকেই তো ভুলতে পারি না! মানে, আমি হাঁ করে তাকাই! কানাই দা আকাশে হাত ঘুরিয়ে, সিন্নি একগাদা নালার উপর ফেলে বলল, বাবাকে কি ভোলা যায়, কলেজ লাইফ তো সাইকেল চালানোর মতন একবার শিখলে কোনওদিন ভুলবি না আর মায়ের কথা আর কি কমু... এবার কানাইদার চোখ ছলছলে! কি আর কমু, নে তুই যখন জানতে চাইতাছোত, বাবা মারা গেল ক্লাশ নাইনে, তখন ঊষা ঊমা এইটুকু-বলে হাত প্রায় রাস্তায় ঠেকিয়ে ফেলে আর কি-তো বাবারে লইয়া শশ্মানে গেলাম বেলা ১ টায়! বাবা মারা গেছে মাঝরাতে, পেটে একটা পাউরুটিও পড়ে নাই! বেলা ২ টার সময় আর পারি না, এদিক ওদিক দেখি, কারে কই ক্ষিধার কথা, কইলেই তো মাইর খামু। দুই তিনবার বায়না কইর্যা বকা খাইছি! বাবার মুখে আগুন দেওয়ার আগে কীসের খাওয়া, হাবাইদা পোলা! হাঁটা দিলাম শশ্মানের গেটের দিকে, যাইতেই দেখি উলটা দিকে পান সিগারেটের দোকানে অসীম আর স্বপন সিগারেট ফুঁকতাছে! আমারে দেইখ্যা অসীম ডাকল! আমিও গেলাম! কইলাম ক্ষিধার কথা! স্বপন কইলো তাম্বুল খা, আর ক্ষিধা পাইবো না! কী আর কমু ডাবল তাম্বুল আর চাইর পাঁচটা নাগা পান চিবাইয়া রস গিলতেই আমার কী আনন্দ! যেন বাবার আগে উইড়্যা উইড়্যা স্বর্গে যাইতাছি! কি মিষ্টি কি মিষ্টি রে রাজা তোরে কি কইমু! তারপর টুই কইরা মাথাটা ঘুইর্যা গেল, সব অন্ধকার হইয়্যা গেল! আমি নাকী বেহুঁশ অবস্থাতেই বাবার মুখে আগুন দিছি! মাইরও নাকি খাইছি কাকাদের হাতে, সেসব মনে নাই!
তারপর, তারপর… আমার তর সইছে না!
তারপর আর কি হইবো, পরের দিন থিকা ঠিক করলাম চুত্মারানী তাম্বুল - মানে চুত্মারানীটা বাদ দিয়া শোন, বাবারে ভুলুম না, যারে মুখে দিয়া বাবার মুখে আগুন দিছিলাম তার গুষ্টি চিবাইয়া ছাড়ুম!
আর খৈণিটা কি কইর্যা আইল?
আমি এখন ক্লাশ টেনে পড়ি, কানাইদার সাইকেলটা দরকার! উমাদি বিয়ে করে ক্যালকাটায় কোথায় একটা চলে গেছে! ঊষাদি এখনও অবিবাহিত, উঁচু দাঁত নিয়ে একটা স্কুলে পড়ায়, ভোরের সেই স্নিগ্নতা উধাও, না নবদা দুইবোনের কাউকেই বিয়ে করে নি! সংস্কৃতে অবস্থা খুব খারাপ! যদিও রেগুলার সাব্জেক্ট নয়, অ্যাডিশ্যনাল, কিন্তু ফেল করা তো যাবে না! তাই আমার পাড়া থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে গণ্ডগ্রাম শ্রীপুরিয়ার শেষ প্রান্তে বড়াল পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত পড়তে যেতে হবে! বাবা সটান বলে দিয়েছে পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করতে! কিন্তু সেটা প্রেস্টিজের ব্যাপার! বাকী দুই বন্ধু সাইকেলে যাবে!
তীরের নাম্বার বিক্রী করার সময় পাচ্ছি না আর গ্যাবারডিন কাপড়ের ব্যবসাও এই আসমীয়া বাঙালি গণ্ডগোলে মাথায় উঠেছে! সাধারণ বাঙ্গালির হাতে এখন পয়সা নেই! যাঁদের আছে, তারা সোজা শিলিগুড়ি থেকে নিয়ে আসে, হংকং মার্কেট থেকে! আর সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক—আমার বাদল স্যার সব ব্ল্যাকার ঠেকে বলে এসেছে আমাকে টিকিট না দিতে! আমি নাকী দুর্লভ প্রতিভা। মেট্রিকে তিনটে লেটার পাবোই! কিন্তু ওসব করেও আর যাই হোক সাইকেল কেনা যায় না! তাই কানাইদা।
কানাইদা এখন পাড়ায় সবার খোরাক! সবাই পেছনে লাগে! প্রায়দিন কানাইদাকে দেখা যায় কাউকে না কাউকে তাড়া করছে, কখনও দেখা যার ছেঁড়া-নোংরা জামাকাপড় পরে ঘুরছে! মুখের কষ বেয়ে বুক অব্দি তাম্বুল পান-বাতাসা-খৈনি সিন্নির লালা! সবার থেকে টাকা চায়। হোক কানাইদা পাগল, আমার কানাইদার সাইকেল চাই! কানাইদা গত তিনবছরে যতটা না পাগল হয়েছে আমি তার চেয়ে অনেকবেশি বেপরোয়া হয়ে গেছি!
কানাইদা আমার কাছ থেকে এই প্রথম একটা সিগারেট নিয়ে সেই কড়ে আর অনামিকার মাঝখানে নিয়ে এক বিশাল টান দিয়ে বলল -- তারপর আসে বাতাসা, ওই যে প্রথম দিনের তাম্বুলের মধ্যে একটা মিষ্টি মিষ্টি ভাব, ওইটারে ধইর্যা রাখতে হইব তো! কইতে পারোস এইটা আমার আবিষ্কার! কিন্তু কাজ দেয় না! খাইতে হয় তাই খাই! ডাক্তার কয় সুগার নাকি তিনশো ছাড়াইয়া গ্যাছে! চোখের পুঙ্গা মাইর্যা দিবো! তা চোখ দিয়া করুম কী? ঊষাটার কষ্ট দেখুম!
আমি অধৈর্য, কানাইদা সাইকেলটা চলে!
এর মইধ্যে আবার সাইকেল আইলো কই থ্যিকা! কানাইদা ক্ষেপে যায়, যা জানতে চাইছোত সেটা শুন আগে! এবার শোন খৈনি কি কইরা মুখে ঢুকল! বেশিদিনের কথা না, তুই আমাগো বাড়িতে পড়তে আসার একবছর আগের কথা! মা একদিন কথা কইতে কইতে হারাইয়া গেল! আর কথারও বা কী দোষ, কোন বয়সে কতটা কথা বলতে হয় এই ব্যাপারটা যদি ৭০ বছর বয়সেও না শেখে তাইলে তো মুশকীল! সারাদিন কথা আর কথা! নন্তুর মারে দেখবি, ওই আমার মায়ের মতন কথাই খাইয়া নিবো! তবু তো আমার মা আস্তে আস্তে কথা কইতো কিন্তু সেন বৌদির মুখে তো সার্কাস পার্টির মাইক বইস্যা আছে যেন!
আমি থামাই – কানাইদা চলেন না সাইকেলটা দেখবো!
কানাইদাকে থামানো যাচ্ছে না!
– সে তুই আমার বাড়ি যাবি তো খুশীর কথা, ঊষা তো তোর খোঁজ নেয়! তা যা কইতাছিলাম! নন্তুর মা! আমি সাথে সাথে থামাই, না কানাইদা, সাইকেল!
কানাইদা খানিক্টা ছাই আকাসে উড়িয়ে, ভুল আমরা খৈনি নিয়া আলোচনা করতাছিলাম! তো কলেজে আমার নাকী মাথাটা একটু বেশি কাজ করা শুরু কইরা দিছিল, আমি আর্সে ছিলাম কিন্তু যখন তখন সাইন্সে, কমার্সের ক্লাশে ঢুইক্যা পড়তাম! গুলাইয়া যাইতো সবকিছু! বাবার নামের জন্য টীক্কা আছিলাম! বাবা ঢাকার কলেজে ইংলিশে এম এ ফার্ষ্ট ক্লাশ ছিল! আর তিন্সুকীয়া কলেজ তৈরি কইর্যা ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট বাবাই চালু করেন! সেক্সপীয়ার শুনবি!
আমার আবার ইংলিশে দুর্বলতা! সেক্সপীয়ারের নাম পার্থর পিসির মুখে শুনেছি, কিন্তু জানি না কিছু, আমার ইংলিশ-প্রীতি ছাড়পোকা ভর্তি রংঘর সিনেমাহলের ইংলিশ সিনেমা! আমাকে চুপ থাকতে দেখে কানাইদা মাঠে নামলেন
Time is very slow for those who waits
Very fast for those who are scared
Very long for those who lament
Very short for those who celebrate
But for those who love, time is eternal …
০১.০৭.২০১৯
আজ সাতদিন হলো আমি আর একবারের জন্যও অজ্ঞান হই নি! ডাক্তারের অতবড় চার্ট পেয়েছি যে! আমার পুরো জীবনটা পঞ্জিকার মত দিনক্ষণ অনুযায়ী চোখের সামনে ভাসছে! সুন্দরী ডাক্তার অর্পিতার মুখ মনে পড়ে গেল, লাল কলম দিয়ে কানাইদার নামের নীচে পরম যত্নে লালকালির দাগ দিলাম! কানাইদা বলেছিল, খৈনি খেয়ে নাকী আর্স সায়েন্স আর কমার্স পুরো পরিস্কার হয়ে গেছিল কিন্তু কলেজ কত্তৃপক্ষ আর বিশ্বাস করে নি! খৈনি নাকি এখনও কানাইদাকে গুলিয়ে যেতে দেয় না, বুড়ো হয়ে গেছে তো কী, সবার জন্য মাথার ভিতরে আলাদা আলাদা খোপ, এই খোপের ভাবনা নিয়ে অন্য খোপে ঢোকা চলবে না! তাই কানাইদার জীবনে খৈনি জিন্দাবাদ! আর বাকী রইল বিড়ির কথা, সেটা মায়ের চিতার সাথে সরাসরি জড়িত। মায়ের চিতা বৃষ্টির জন্য বারবার নিভে যাচ্ছিল বৃষ্টির জন্য, তাই কানাইদা মায়ের চিতার কাঠ থকে বিড়ি জ্বালিয়ে আগুন বুকে নিয়ে নেয়! তারপর থেকে ওই বিড়ি জ্বলছে কি নিভছে তাতে কি যায় আসে! আগুন তো বুকে থাকে বিড়িতে থাকে না!
0 comments: