ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Diary Entry-07
3rd. July, 1942, Friday.
প্রিয় কিটী,
জান, গতকাল হ্যারী এসেছিল। আমাদের বাড়িতে। আমার বাবা আর মা-এর সাথে দেখা করার জন্য। আমি অবশ্য জানতাম, হ্যারী আসবে। তাই প্রস্তুত হয়েই ছিলাম, হ্যারীর উপযুক্ত আতিথেয়তার জন্য। সে এলে তাকে কিছু জলখাবার দেওয়ার জন্য আমি নিজে একটা কেক, অল্পকিছু মিষ্টি এনে রেখেছিলাম। এ’ছাড়া, চা-এর সঙ্গে দেওয়ার জন্য ভাল কিছু বিস্কুটও নিয়ে এসেছিলাম। হ্যারী আসার পর, আমরা প্রথমে ঘরে বসেই গল্প করছিলাম। কিন্তু ঘরের ভিতর একঘেয়ে লাগার জন্য, কিছুক্ষণ পরেই আমরা দুজন একসাথে রাস্তায় হাঁটতে বেরোলাম। আসলে ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না। ঘরে সবাই ছিল। সবার মধ্যে আমি হ্যারীকে একা পাচ্ছিলাম না। আলাদা করে হ্যারীর সাথে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। রাস্তায় কিছুক্ষণ ওর সাথে ঘোরার পর যখন বাড়ী ফিরলাম, তখন সময় প্রায় আটটা-দশ। বুঝতেই পারছিলাম বেশ দেরী হয়ে গেছে। আমাদের অকারণে দেরী হওয়ার জন্য বাবা সত্যিই আমাদের উপর কিছুটা রেগেও গিয়েছিলেন। তাঁর মতে, কাজটা আমরা মোটেই ভাল করিনি। তাঁর কথাটাও সত্যি। কারণ এখন বাইরের অবস্থা এমনই যে, রাত্রি আটটার পর ইহুদিদের পক্ষে বাড়ীর বাইরে থাকাটা আদৌ নিরাপদ নয়। তাই, বাবার রাগটা অযৌক্তিক এ’কথা বলা যাবে না। বাবার রাগ দেখে, বাবাকে শান্ত করার জন্যে, আমায় কথা দিতে হলো, এরপর থেকে আমি যে কোন অবস্থাতেই, রাত্রি আটটা বাজার দশ মিনিট আগেই বাড়ী ফিরে আসব, পরে নয়। এর অন্যথা কিছু হবে না।
হ্যারী গোল্ডবুরগ ( Harry Goldberg) ওরফে, হেল্যো সিল্ভারবারগ (Helmuth “Hello” Siberberg)। এর সাথে অ্যানির বিশেষ সম্পর্ক ছিল। হ্যারী প্রাথমিক জীবনে জিওনিষ্ট আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়লেও, পরে তার ভাষ্য অনুসারে সে আন্দোলনের মূল কেন্দ্র থেকে সরে আসে। প্রথমে হ্যারী ফ্যানীর সাথে মিশলেও, অ্যানির সাথে বন্ধুত্ত হওয়ার পর সে ফ্যানীর সাথে সম্পর্ক থেকে সরে আসে।তবে, তার দাদু ঠাকুমা বিষয়টাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি। তাঁদের মতে অ্যানির বষস অপেক্ষাকৃত কম। (অনুবাদকের সংযোজিত)
আগামীকাল হ্যারী, আমাকে ওর বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করেছে। এ’কথা শোনার পর থেকেই আমার বন্ধু জ্যোপি (Jopie ) সারাক্ষণ আমার পিছনে লাগতে শুরু করল, আর আমায় ‘হ্যারী’র নাম বলে, খ্যাপাতে লাগল। তবে তোমায় একটা সত্যি কথা বলি। জ্যোপিকে আমি অবশ্য এ’কথাটা বলি নি। তা’হলে আর পিছনে লাগার মজাটা পাব না। বিশ্বাস কর, আমি এখনও হ্যারীর প্রেমে পড়ি নি। তবে কথাটা এভাবে না বলে, বলা উচিৎ, এখন ও আমার একজন বিশেষ ছেলে বন্ধু। সেইভাবে প্রেমিক বলা যায় না। তাই ছেলে বন্ধুর চেয়ে বেশী কিছু ভাবার দরকার এই মুহূর্তে আছে বলে আমার মনে হয় না। হ্যারী আমার একজন বিশেষ ছেলে বন্ধু, যাকে আমার মা আড়ালে বলেন আমার প্রনয়- প্রার্থী বা আমার রসাসক্ত। অবশ্য এটা ঠিক, হ্যারী আমার অন্যসব ছেলে বন্ধুদের থেকে আলাদা। আমার বিশেষ বন্ধু।
এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটেছে। হ্যারী একদিন সন্ধ্যেবেলায় ইভার বাড়ী গিয়েছিল, তার সাথে গল্প করার জন্য। এ’কথা অবশ্য ইভাই আমায় বলে। হ্যারীকে ইভা তখন জিজ্ঞাসা করেছিল, “ফ্যানী আর অ্যানির মধ্যে তুমি কাকে বেশী পছন্দ কর?” উত্তরে হ্যারী বলেছিল, “তোমার এটা জেনে কি হবে? তোমার ত’ কোন লাভ নেই।” তখন এ’কথা বললেও, চলে যাওয়ার সময় হ্যারী ইভাকে না’কি বলেছিল, “শোন, আমার অ্যানিকেই বেশী ভাল লাগে। তবে এই কথাটা এখনই সবাইকে বলার প্রয়োজন নেই।” এরপরই হ্যারী বেশ দ্রত গতিতে বেরিয়ে চলে যায়। আর একটা কথা তোমায় বলি, সেদিন সন্ধ্যেবেলায় হ্যারী কিন্তু ইভার সাথে বেশীক্ষণ গল্প করে নি।
ইভা গোল্ডবারগ ( Eva Goldberg )। ইভার কিশোরী বেলার ইতিহাস অ্যানির মতোই। ইভাদের পরিবার অ্যানিদের বাড়ীর প্রায় উল্টো দিকে ছিল। মার্বেদেপ্লাইন এলাকার (Merwedeplain Square) একদিকে ছিল অ্যানিদের বাড়ি আর অন্যদিকে ছিল ইভাদের বাড়ি। বষসের দিক থেকে দুজনই ছিল প্রায় সমবয়সী। দু’জনে একই স্কুলে পড়ত। তবে দুজনের মধ্যে খুব একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না। স্কুলেও দু’জনের বন্ধুর গ্রুপ ছিল আলাদা। স্যানী লেড্যারম্যান (Sanne Ledermann ) এই দুজনেরই কমন ফ্রেন্ড।
ইভা গোল্ডবারগ-এর ছোট বষসের ছবি।
অ্যানি ফ্রাঙ্ক (ডান দিকে), সয়ানি লেড্যারম্যান (মাঝখানে), ইভা গোল্ডবারগ (বাম দিকে)। ছবির ডান দিকে অ্যানি।
এর থেকেই বেশ স্পষ্ট বোঝা যায় যে, হ্যারী আমায় পছন্দ করে এবং ভালবাসে। অর্থাৎ শুধু বন্ধুত্ব বা কথা বলে মজা পাওয়ার জন্য, হ্যারী আমার সাথে কথা বলে না। মারগটও আমায় বলেছে, “হ্যারী বেশ ভাল ছেলে।” আমিও মারগটের সাথে একমত হয়েই বলেছি, “হ্যারী একটু বেশী ভাল ছেলে। অন্ততঃ আমার তুলনায়।” আমার মায়ের কাছেও ওর প্রশংসা শুনেছি। মা-ও বলেছে, হ্যারী দেখতে বেশ ভাল, ব্যবহারটাও ভাল। এককথায় বেশ ভাল ছেলে। আমি জানি আমার পরিবার ওকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছে। এর জন্য আমারও বেশ ভাল লেগেছে। আমি জানি, হ্যারীও আমাদের পরিবারকে মন থেকেই পছন্দ করে। শুধু একটা ব্যাপারেই আমার আপত্তি। হ্যারী মনে করে, ওর বান্ধবীটি একটি বাচ্ছা মেয়ে। তবে সত্যি কথা বলতে কি, কথাটা ত’ সত্যি। এটা ত’ অস্বীকার করা যায় না।
ইতি,
অ্যানি
----------------------------------------------------------------------------------------------
অনুবাদকের সংযোজন -
বর্তমান অংশে হ্যারী গোল্ডবুরগ-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যে অ্যানির প্রণয়াসক্ত ছিল। এই প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অ্যানি তার ডাইরিতে যে নামগুলি উলেখ করেছিল, তার মধ্যে বেশ কিছু নামে সে ইচ্ছাকৃত পরিবর্তন এনেছিল। অবশ্য, গুপ্তগৃহে থাকার সময়, যখন সে রেডিওতে মিত্র বাহিনীর অগ্রগতির প্রথম খবর পায়, তখন সে ভেবেছিল যে, যুদ্ধের পর তার ডাইরি তাদের অনুভূতির দলিল হিসাবে প্রকাশিত হবে। তাই সে কিছু নামের পরিবর্তন করে। পরবর্তী কালে ওটো ফ্রাঙ্ক যুদ্ধের পর মিয়েপের কাছ থেকে অ্যানির লিখিত ডাইরি ও বিভিন্ন চিঠিপত্র পেয়ে, ঠিক করেন সেগুলো প্রকাশ করার।
(১) অ্যানি তার বন্ধু হিসাবে, হ্যারী গোল্ডবুরগের নাম উল্লেখ করেছে। হ্যারী গোওল্ডবুরগের আসল নাম ছিল, হেল্ম্যুথ “হেল্যো” সিল্ভারবারগ (Helmuth “Hello” Silberberg)। আমরা পরবর্তী অংশে দেখব, অ্যানি ১৯৪২ সালের ৯ই জুলাই বৃহস্পতিবার, বাবার সঙ্গে গোপন উপগৃহে (Annex) আশ্রয় নেয়। তার ঠিক দুসপ্তাহ আগে, অ্যানির সাথে হেল্যোর প্রথম বন্ধুত্ত হয়। হেল্যো, অ্যানির সাথে পরিচয় হওয়ার আগে, ফ্যানী নামে একটি মেয়ের সাথে ঘনিষ্ট ছিল। হেল্ম্যুথ সিল্ভারবারগের জন্ম জার্মানির জেলসেংকিরচেন (Gelsenkirchen) প্রদেশে। জাতিগত ভাবে তাদের পরিবার ছিল ইহুদি। হিটলারের সম্ভাব্য নিপীড়নের ভয়ে, হেল্যোর মা বাবা, তাকে নেদারল্যান্ডে তার দাদু ঠাকুমার কাছে পাঠিয়ে দেন। তাঁরাও ওটো ফ্রাঙ্কের মতোই মনে করতেন, হিটলার নেদারল্যান্ডের নিরপেক্ষতাকে যথাযথ মর্যাদা দেবে। কিন্তু হেল্যোর সাথে নেদারল্যান্ডের জায়োনিস্ট আন্দোলনকারীদের যোগাযোগ ঘটে। নেদারল্যান্ডের জায়োনিস্ট নেতা ডেভিড বেন গুঁরিয়ন-এর সাথে (David Ben Gurion) হেল্যোর যোগাযোগ হয়। সে সেখানে যাতায়াত করত। এ’কথা সে অ্যানিকেও বলেছে। সে মনে মনে অ্যানিকে পছন্দ করলেও, অ্যানি তাকে প্রথমে তার ভাল বন্ধু বলেই মনে করত। তবে অ্যানির মা ভাবতেন অ্যানির প্রতি হেল্যো কিছুটা আসক্ত। অন্যদিকে হেল্যোর দাদু ঠাকুমাও অ্যানির থেকে ফ্যানীকে বেশী পছন্দ করতেন। তাছাড়াও, হেল্যোর জায়োনিস্টদের সাথে মেশা তার দাদু বা ঠাকুমা একদম পছন্দ করতেন না। শেষ পর্যন্ত, তাঁরা তাকে বেলজিয়ামে নিয়ে চলে যান। সেখানেও প্রথম দিকে তাঁরা কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। তারপর ১৯৪৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর আমেরিকার সৈন্যবাহিনী বেলজিয়াম মুক্ত করলে, সিল্ভারবারগ পরিবার বিপদ ও মানসিক ভারমুক্ত হয়। আশ্চর্যজনক হলেও, ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ সালে আমেরিকা যেদিন বেলজিয়ামকে জার্মান মুক্ত করে, সেদিনই জার্মানির গেস্টাপো বাহিনীর নির্দেশে অ্যানি ও তার পরিবারকে, ওয়েস্টারব্রুক থেকে আউশ্চউইট (Auschwitz) এর অসামরিক বন্দী শিবিরে স্থানান্তরিত করা হয়। হেল্ম্যুথ পরিবার অবশ্য যুদ্ধের পর পাকাপাকিভাবে আমেরিকায় বসবাস করতে শুরু করে। হেল্ম্যুথ সিল্ভারবারগ তাঁর নাম পরিবর্তন করে এড সিল্ভারবারগ নামে পরিচিত হন। ২০১৫ সালে এড সিল্ভারবারগ ৮৯ বছর বয়সে মারা যান।
(২) অ্যানি তার ডাইরির এই পাতায়, ইভার নাম উল্লেখ করেছে। ইভার বিষয়টা আরও একটু বিস্তৃত করে বলা দরকার। কারণ অ্যানির সাথে এবং তার পরিবারের সাথে, ইভার সম্পর্ক গভীর ও প্রায় চিরকালীন। এখানে ইভাকে ইভা স্কোলস (Eva Schloss) নামে উল্লেখ করা হয়েছে। ইভার আসল নাম ইভা জেরিংগার (Eva Geiringer) অ্যানি ও ইভার জীবন ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রে সমঞ্জস্যপূর্ণ । দুজনের বয়স প্রায় একই ছিল। ইভা জেরিংগারের পরিবার অ্যানিদের পরিবারের সাথেই মারোয়েডপ্লেন (Merwedeplein) এলাকায় বাস করত। ইভা তার অন্য বন্ধু অ্যানি বা স্যানীর মত ছিল না। সে কিছুটা “ট্মবয়” মার্কা মেয়ে ছিল। সে অ্যানিকে একটু অন্য চোখে দেখত। অ্যানির পোশাক পরিচ্ছদের বিশিষ্টতা, বাইরের জগত সম্পর্কে তার কৌতূহল ও উৎসাহ তাকে অবাক করত। কিন্তু ছেলেদের ব্যাপারে অ্যানির কিছু বেশী দুর্বলতা সে ভাল চোখে দেখত না। ইভা তার আত্মজীবনীর একজায়গায় লিখছে, “অ্যানির, আমার মতন কোনও ভাই ছিল না। তাই তার ছেলেদের ব্যাপারে একটু বেশী উৎসাহ ছিল, যা আমার মধ্যে ছিল না।” জার্মান ভাষায় কথা বলতে সুবিধা হবে ভেবে, অ্যানি তার বাবার সাথে ইভার বাবার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। বাস্তবে অ্যানি ও ইভার বন্ধুত্বের বৃত্ত ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। আর ওদের মধ্যে বন্ধুত্বের সেতু হিসাবে ছিল স্যানী লেডারম্যান। ইভার ভাই হেঞ্জকে (Heinz) আর অ্যানির দিদি মারগটকে জার্মান সৈন্য একইদিনে সৈন্য শিবিরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর অ্যানির বাবা ওটো ফ্রাঙ্ক যেমন তার পরিবার নিয়ে আত্মগোপন করেন, তেমনি ইভার পরিবার আত্মগোপন করে, তবে তারা দুটি ভাগে ভাগ হয়ে আত্মগোপন করেছিল। ইভা তার মাকে নিয়ে একটি গোপন জায়গায় যায়, অন্য একটি জায়গায় তার বাবা আর ভাই হেঞ্জ আত্মগোপন করে। দুভাগে ভাগ হয়ে আত্মগোপন করলেও, অ্যানিদের ধরা পড়ার প্রায় তিন মাস আগে ইভাদের পরিবারের সকলে একসাথে দুজায়গা থেকে জার্মান গুপ্তচরের মাধ্যমে ধরা পরে। তাদের সকলকে আউশ্চউইট (Auchwitz) অসামরিক বন্দী শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তী কালে ইভার বাবা ও ভাই সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজ ইভা আর তার মাকে আউশ্চউইট বন্দী শিবির থেকে মুক্ত করার পর তারা দুজনে বিরকেন্যু (Birkenau) পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে (আউশ্চউইট বন্দী শিবির থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে বিরকেন্যু বন্দী শিবির অবস্থিত) বাবা ও ভাইয়ের খোঁজ করলেও তাদেরকে পায় নি। কেবল সেখানে ওটো ফ্রাঙ্ককে অর্ধ মৃত ও অসুস্থ অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাঁকে উদ্ধার করে। এর প্রায় আট বছর পর, ওটো ফ্রাঙ্ক ইভার বিধবা মাকে বিবাহ করেন। এই দিক থেকে ইভা, অ্যানি ও মারগটের বৈপিত্র বোন। আরও পরে ইভা তাঁর আত্মজীবনী লেখেন। নাম দেন, “ইভার গল্প - অ্যানি ফ্রাঙ্কের জীবিত বৈপিত্র ভগিনীর কাহিনী”, (Eva’s Story : A survivor’s Tale by the Stepsister of Anne Frank)। এ’ছাড়াও ইভা মুক্তির পর তাদের পুরানো বাসস্থানে ফিরে গিয়েছিল। সেখানে ঘরের মেঝের গালিচার ভিতর থেকে, ইভা তার ভাই হেঞ্জের আঁকা বেশ কিছু ছবি পায়। সেই ছবি নিয়ে ইভা আমেরিকায় হেঞ্জের ছবির প্রদর্শনী করেন। ২০১৩ সালে ইভা জার্মানির অত্যাচার আর পৈশাচিকতা নিয়ে একটি বই লেখেন। বইয়ের নাম After Auschwitz : A Story of Heartbreak and Survival of Anne Frank ।
৩) শ্যুসেন “স্যানী” লেডারম্যান (Susanne “Sanne” Ledermann ) স্যানী ছিল অ্যানির ঘনিষ্ট বন্ধু। অ্যানি তার ডাইরির বহুস্থানে স্যানীর নাম উল্লেখ করেছে। স্যানীর নাম বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে উচ্চারিত হয়েছে। কোথাও শ্যুসেন, কোথাও শ্যুসানা, কিন্তু বন্ধুরা তাকে স্যানী নামে ডাকত। তার পরিবারের লোকেরা জার্মান উচ্চারণে “শ্যুসি’ নামে ডাকত। স্যানী ও তার পরিবারকে ১৯৪৩ সালের ২০শে জুন জার্মানের গেস্টাপো বাহিনী গ্রেপ্তার করে প্রথমে ওইয়েস্টারব্রকে নিয়ে যায়। তারপর সেখান থেকে ১৬ই নভেম্বর ১৯৪৩-এ আউশ্চউইট (Auschwitz) নিয়ে গিয়ে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মেরে ফেলা হয়। তাদের পরিবারে একমাত্র স্যানীর দিদি বারবারা লেড্যারম্যান (Barbara Ledermann) বেঁচে ছিলেন। তিনি জায়োনিস্টদের গোপন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের পত্র বাহকের কাজ করতেন। তাদের সাহায্যে বারবারা নিজের নামে “এরিয়ান”-এর পরিচয় পত্র সংগ্রহ করেন । তার সাহায্যে বেঁচে যান। তিনি নোবেল বিজেতা প্রাণরসায়নবিদ মারটিন রডবেলকে (Martin Rodbell) বিবাহ করেন।
৪) লেড্যারম্যানের মতনই অ্যানি আরও একজন প্রিয় বন্ধু ছিল। যাকে অ্যানি তার ৩০শে জুন, ১৯৪২- এর পাতায় জ্যোপী নামে উল্লেখ করেছে। জ্যোপীর আসল নাম জ্যাক্যুইলিন ভ্যান মারসেন বা জ্যাক্যু (Jacqueline Van Maarsen or Jacque)। বন্ধুমহলে সে জ্যোপী বা জ্যাক্যু নামেই পরিচিত ছিল। অ্যানির সাথে জ্যাক্যু বা জ্যোপীর ঘনিষ্টতা অনেক আগে থেকে। জ্যাক্যুর সাথে অ্যানি মাঝে মাঝে খারাপ ব্যবহার করে ফেলত, তার জন্য অ্যানি তার ডাইরিতে দুঃখ প্রকাশও করেছে। গোপন অন্তরালে থাকার সময়, অ্যানি জ্যাক্যুর উদ্দেশ্যে একটি বিদায় পত্রও লিখেছিল। অবশ্য সেটা জ্যাক্যুইলিন পায় অনেক পর। অ্যানি মারা যাওয়ার পর। জ্যাক্যুর মা ছিলেন জন্মসূত্রে ফরাসী খ্রিষ্টান। তিনি তাঁর প্রভাব খাটিয়ে, তাঁদের পারিবারিক নাম থেকে “ই-কারান্ত” উচ্চারণ বাদ দিয়ে দেন। উদ্দেশ্য ছিল, নামের মধ্যেকার “ইহ্যদি” চিহ্নটিকে মুছে দেওয়া। অর্থাৎ জ্যাক্যুইলিন পরিবর্তিত হয়ে হয়, “জ্যাকলীন”। এভাবে নতুন করে পরিচয় পত্র তৈরী করে যুদ্ধের সময় অ্যামস্টারডামে থাকলেও, জার্মান বাহিনীর নজরের বাইরে থাকেন। জ্যাক্যু পরবর্তী জীবনে, তার বাল্য প্রেমিক রুড স্যান্ডারস (Ruud Sanders)কে বিবাহ করেন, এবং অ্যামস্টারডামেই থেকে যান। জ্যাক্যু তাঁর জীবনকালে অ্যানির উপর চারটি বই লেখেন- ১) অ্যানি এবং জ্যোপী (১৯৯০);,২) অ্যানি - আমার বন্ধু (১৯৯৬), ৩) আমার নাম অ্যানি, সে বলত অ্যানি ফ্রাঙ্ক (২০০৩), ৪) অ্যানি থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত (২০০৯)।
৫) অ্যানির আরও একজন বন্ধুর নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন। অ্যানি তার ডাইরিতে তাকে পিটার ওয়েসেলস (Peter Wessels) নামে ডেকেছে। পিটার ওয়েসেলস-এর আসল নাম ছিল লুটজ পিটার শিফফ (Lutz Peter Schiff)। গত ৩০শে জুন ১৯৪২ এর পাতার সঙ্গে পিটার ওয়েসেলস এর ছবি (উইকিপিডিয়া থেকে পাওয়া) দেওয়া হয়েছে। ছবিটি পিটারের কিশোর বয়সের। দেখতে অতি সুদর্শন এক কিশোর। প্রকাশ্যে না’হলেও অ্যানি মনে মনে পিটারকে পছন্দ করত ও ভালবাসত। অ্যানি তার ডাইরিতে লিখেছে, ১৯৪০ সালের গ্রীষ্ম- অবকাশের আগে পর্যন্ত দুজন দুজনকে পছন্দ করত। কিন্তু ১৯৪০ সালে অ্যানির বয়স যখন ১১, তখন ১৪ বছরের পিটার ক্রমেই অ্যানির কাছ থেকে সরে গিয়ে, অন্য আরেকজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তবে অ্যানি পিটারকে কখনই ভুলতে পারে নি। এমনকি অ্যানি যখন অ্যানেক্সে ভবনে লুকিয়ে ছিল, তখনও অ্যানি পিটারকে ভাবত। পিটার তাকে একসময় একটি গলার হার উপহার দিয়েছিল। সেই হারটা ছিল অ্যানির অন্যতম প্রিয় হার। অ্যানি ও মারগটকে বন্দী করে আউস্টউইচটে (Auschwitz Concentration Camp) নিয়ে যাওয়ার আগে পিটারকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেখানেই তাকে মেরে ফেলা হয়। অর্থাৎ পিটারের সাথে অ্যানির পরবর্তীকালে আর দেখা হয় নি। ২০০৯ সালে অ্যানি ফ্রাঙ্কের সংগ্রহশালায় “বালক” পিটার শিফফ- এর একটি ছবি পাওয়া যায়। এই ছবিটি না’কি অ্যানিকে তার কোন এক ক্লাস ফ্রেন্ড দিয়েছিল। অ্যানির কাছে থাকা এই ছবিটাই “অ্যানি ফ্রাঙ্কের বাড়ী” নামক ওয়েবসাইটে দেখতে পাওয়া যায়।
বন্দী শিবির থেকে মুক্তি লাভের পর, ওটো ফ্রাঙ্ক অ্যানির লাল ডাইরিটা মিয়েপের কাছ থেকে পান। তিনি ঠিক করেন অ্যানির লেখা ডাইরিটা তিনি ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করবেন। এই সময় তিনি লক্ষ্য করেন, যে অ্যানি তার ডাইরিতে প্রায় সবার নাম পরিবর্তন করে দিয়েছে। অবশ্য মাঝখানে, যখন শোনা যায় নেদারল্যান্ড জার্মানির কবল থেকে মুক্ত হবে, তখন অ্যানি তার ডাইরির বেশ কিছু ব্যবহৃত নাম পুনরায় পরিবর্তন করে। কারণ তার আশা ছিল, যুদ্ধের পর তার এই ডাইরি প্রকাশিত হবে। যুদ্ধকালীন অবস্থায় মানুষ বিশেষ করে ইহুদি যে পৈশাচিক ও বর্বরোচিত অত্যাচার ও নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে দিনপাত করতে বাধ্য হয়েছে, সেই সত্য সবার সামনে বেরিয়ে আসবে। অ্যানির এটাই ছিল আশা। কিন্তু ইতিহাস তাকে সে সুযোগ দেয় নি। যাইহোক যুদ্ধের পর ওটো বন্দী শিবির থেকে অসুস্থ অবস্থায় বেরিয়ে আসার পর, তিনি দেখেন, তাঁর পরিবারে একমাত্র তিনিই বেঁচে আছেন। এই সময় তিনি মনস্থ করেন, অ্যানির ডাইরি প্রকাশ করার। প্রকাশ করতে গিয়ে, তিনি পুনরায় অ্যানির ডাইরিতে ব্যবহৃত নাম গুলি পরিবর্তন করে অনেকক্ষেত্রে চরিত্রের আসল নাম উল্লেখ করেন। বিশেষকরে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামগুলিকে অপরিবর্তিত রাখেন। অন্য নামগুলির ক্ষেত্রে, তাদের বংশ নাম বা উপাধি অপরিবর্তিত রেখে, তাদের নামগুলির কিছু পরিবর্তন করেন।
pore valo laglo....
ReplyDelete