ছোটগল্প - সার্থক মজুমদার
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
হালিম
সার্থক মজুমদার
শান্তিপুর শাল রিপেয়ারিং হাউস। ক্ষয়াটে নীল রঙের ওপর সাদায় লেখা হোর্ডিং। বোঝা যায় লেখার ওপর নতুন করে রঙ পরেনি অনেকদিন। বারো ফুটের রাস্তার ওপর ছোট দোকানখানা। নামেই শাল রিপেয়ারিং হাউস। আসলে নেহাতই লণ্ড্রী। তাছাড়া এই মধ্যবিত্ত পাড়ায় কজনেরই বা রোজ শাল মেরামত করার দরকার পরে, শুধু এখানে কেন, কোনও বাঙালি পরিবারেই বা আজকাল এক আধটার বেশী শাল দেখা যায়। তা দোকান চলে খারাপ নয়। এই এলাকায় আরও দুএকটা লণ্ড্রী আছে বটে, কিন্তু শান্তিপুর শাল রিপেয়ারিং এর আলাদা কদর। নামের গুণেই কি না কে জানে, তবে ভালো শাড়ি, জামা যা কিছু ধোয়া কাচার জন্য সবাই এখানেই আসে। তা ছাড়া দোকানের মালিক চাঁদুদার ব্যবহারও তার একটা কারণ। মুখে পান, সকলের সাথে একগাল হেসে কথা বলেন। নিজের দোকানের চেয়ে চাঁদুদাকে বেশী দেখা যায়, বাজারে মাছের দরাদরি করতে কিংবা মোড়ের মাথায় ন্যাপার চায়ের দোকানে। তাঁর আসল নাম নাসির আহমেদ গাজি, কিন্তু এই হিন্দু পাড়ায় নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালানোর জন্য দিব্যি সকলের চাঁদুদা হয়ে গেছেন। তাঁর আসল পরিচয় যে কেউ জানে না তা নয়, তবে মন রাখে না। এ নিয়ে কোনও সমস্যাও নেই।
ফুট ছয়েকের দোকান জুড়ে সস্তা কাঠের ওপর সানমাইকা বসানো কাঁচ দেওয়া শো কেস। চাঁদুদা যখন এখানে সেখানে আড্ডা মেরে বেড়ান, দোকান আগলে বসে থাকে চাঁদুদার একমাত্র কর্মচারী হালিম। হালিম চাঁদুদার গ্রামের ছেলে। বেজায় অভাবী, গরীব ঘরের ছেলে বলে চাঁদুদা নিয়ে এসেছিলেন, তা সে আজ অনেকদিন, অন্তত বছর দশেক হবে। শহরে এতদিন থাকলে কি হবে, হালিমের মধ্যে থেকে সেই অজ পাড়া গাঁয়ের ছাপ এখনও একেবারেই যায়নি।
দোকানের সব কাজই হালিমের। অর্থাৎ দোকান খোলা, বন্ধ করা, ঝাঁটপাট দেওয়া, পরিস্কার করা থেকে দোকানে বসে খদ্দের সামলানো, তার মধ্যেই কিছু জামাকাপড় ইস্ত্রি করা। আর দোকান বন্ধের সময়টাতে যাবতীয় জামাকাপড় কাচা। চাঁদুদা যে সময়টুকু থাকে, সে সময়টুকু দোকানের ক্যাশটা দেখে, তা বাদে দোকানের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ সবই হালিম। হালিম যে কি করে দোকানে খদ্দেরদের সামলায়, হিসেব মিলিয়ে জামাকাপড় আর টাকাপয়সা দেওয়া নেওয়া করে সেটা আশ্চর্যের, কারণ তার মাথাটা বিশেষ পরিস্কার নয়। পাড়ার ছেলেদের কাছে সে একটি চলমান খোরাক, তার চেহারা, চলাফেরা, কথাবার্তার কারণে। হালিম মাথায় ছোটখাটো, বড়জোর ফুট পাঁচেক হবে, গায়ের রঙ মিশকালো। গুলি গুলি দুটো মার্বেলের মতো চোখ, সামনের দাঁত জোড়া বেজায় উঁচু, সব মিলিয়ে তাকে প্রায় নিয়েনডারথালদের আধুনিক সংস্করণ বলে মনে হয়। আর সেই মুখশ্রীর সাথে যেটা সকলের চোখে পড়বেই, তা হলো তার শরীরের গঠন। পাড়ার দুর্গা পুজোয় প্রতি বছরই যখন বাজেট নিয়ে টানাটানি হয় তখন ছেলেরা বলে, বরং অসুর ছাড়া ঠাকুর কিনে এনে অসুরের জায়গায় হালিমকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হোক। এটা ওদের পাড়ার একটা চলতি রসিকতা। সত্যই, লণ্ড্রীর জামাকাপড়ের বিশাল বিশাল গাঁটরি টেনে টেনে তার হাত পায়ের পেশী হয়েছে দেখার মতো। তার রেশ ধরে অনেক সময়ই পাড়ার উঠতি ছেলের দল তাকে অসুর বলে ডাকে। কি হয়তো সে যাচ্ছে দোকান খুলতে কি বন্ধ করে ঘরে, তাকে দেখে পাড়ার রক থেকে আওয়াজ উঠলো, ‘এই অসুর, এই শালা অসুর। আয় এখানে’। তা ব্যাপারটা কোনওদিনই অত্যাচারের জায়গায় যায়না, কারণ হালিম এতে আদৌ কোনও রাগ করে না, কোনও প্রতিবাদ করে না। তার মুখেও সবসময় একগাল হাসি লেগেই থাকে। তাকে যাই বলো না কেন, সে শুধু একগাল হাসবে। তার কারণ সে চট করে বুঝে উঠতেই পারেনা, কোন কথার পিঠে কোন কথা বলতে হয়। আর এই শহরের ছেলে ছোকরারা যেন কথার মেল ট্রেন, এদের সাথে সে কি করে পেরে উঠবে, কাজেই সবাই দেখেছে সে শুধু একগাল হাসে। ছোট ছেলেপুলেরা তার কাপড়ের গাঁটরি ধরে টানাটানি করলে সে বড়জোর ‘হো ভাগ, ভাগ’ করে তাদের তাড়ায়।
হালিম পাড়ার সকলের কাছেই শুধু হালিম। ছোট থেকে বড় সকলের কাছে। কারুর হালিমদা, কি হালিমকাকা, কি ভাই কিছু নয়, সকলের কাছেই শুধু হালিম। পাড়ায় তার বন্ধুবান্ধবও কেউ নেই। তার সুখ দুঃখের কথা দুটো শুনবে বসে, এতো সময় কি ধৈর্য কারুর নেই, পাড়ার বেকার ছেলেগুলোরও নয়। তাছাড়া চাঁদুদা তাকে সাবধান করে দিয়েছে, বলে দিয়েছে পাড়ার ছেলে ছোকরাদের সাথে না মিশতে। হালিম তাই, কচ্চিৎ দোকান খালি পেলে, আর চাঁদুদা থাকলে তার সাথেই যা দু-চারটে কথা বলে। তা কথা হালিমের বেশী আসেও না মাথায়। চাঁদুদাই বরং এটা সেটা বকে। মাসে দুমাসে একবার দেশে যায় চাঁদুদা, মাকে দেখতে। এখানে সংসার আছে চাঁদুদার। বিবি বাচ্চাদের এনে রেখেছে শহরে, কিন্তু মা দেশে রয়ে গেছে ভায়েদের কাছে। তাকে দেখতে যায়, তাছাড়া জমিজিরেতও। ফিরে এসে বলে দেশের খবরাখবর। হালিমের মাইনের থেকে কিছুটা টাকা তখনই গিয়ে হালিমের বাড়িতে দিয়ে আসে চাঁদুদা। হালিম দেশে যায় দুই ঈদে দুবার। তখন প্রতিবারই দিন দশেক করে বন্ধ থাকে দোকান। হঠাৎ জামা কাপড় দিতে এসে দোকান বন্ধ দেখে লোকজনের খেয়াল হয়, ওঃ হো, এখন তো আবার ঈদ, এরা সব দেশে গেছে!
হালিমেরা তিন পুরুষের জোলা। কিন্তু বাপ ছোটবেলায় মারা যাওয়ার পর, তিন বোনেদের নিকা করাতে গিয়ে ধারে ধারে মাথা বিকিয়ে গেছে। জমিজমা সামান্য যা ছিল সে তো বটেই এমনকি বাপের আমলের তাঁতটা অবধি বেচে দিতে হয়েছে মহাজনের ধার শোধ করতে। তারপর আর কি, চাঁদুদা তাকে নিয়ে এসেছে এখানে, একটা ভাই তার জনমজুর খাটে গ্রামেই। দুটো পুরুষমানুষই বাড়ির বার হয়ে গেলে গাঁ ঘরে মেয়েদের দেখবে কে! বাড়িতে তার মা রয়েছে, রয়েছে বউ, একটা মেয়ে পাঁচ বছরের। ভাইটারও নিকে করিয়েছে দু বছর হলো, তারও কচি ছেলে একটা। সব মিলিয়ে তার ঘরে অনেক কটা মানুষ, অনেক কটা পেট। কাজেই হালিম চেষ্টা করে, যতটা বেশী করে সম্ভব টাকা পয়সা বাড়িতে পাঠাতে।
এখানে অবশ্য হালিমের থাকার কোনও খরচ নেই। এই দোকানটা যাদের জায়গায়, সেই রায়চৌধুরী বাবুরা আগে এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। এখন জমিদারি না থাকলেও কিছু কিছু জমি পুকুর তাদের নামে রয়ে গেছে। তাদেরই বাইরের পুকুরের পাড়ে, একটা কুঁড়ে ঘর তুলে নিয়ে থাকে হালিম। নেহাত বাখারি আর তালপাতার ছাওয়া ঘর। চাঁদুদাই কীভাবে যেন ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তা এরকম জায়গা এই শহরে জোটানো সহজ কথা নয়। সামনে পুকুর, পুকুরপাড়ে আট দশটা নারকেল গাছ। তার ছায়ায় জায়গাটা প্রায় বাগান বাগান। পুকুরের ওপর দিয়ে গরমকাল, বর্ষাকাল যাবত হুহু করে হাওয়া আসে। ভারি ভালো লাগে জায়গাটা তার। তাছাড়া এই পুকুরেই জামাকাপড় কেচে নেয় সে। তার দিকটায় অবশ্য কোনও ঘাট নেই, তাতে কিছু আসে যায় না হালিমের। পাড় ভেঙে একটা জায়গা একটু ঢালু হয়ে গেছে, তাতেই হয়ে যায় ওর। আর নারকেল গাছগুলো জুড়ে দড়ি টাঙিয়ে রেখেছে সে, যাবতীয় কাচা কাপড় ওইখানেই শুকোতে দেয়। আর তারপর নারকেল গাছের ছায়ায়, কুঁড়ের বাইরেটায় মাটির উনুনে বসে বসে ভাত রাঁধে আর জামা কাপড় পাহারা দেয়। শুকনো নারকেল পাতার জ্বাল, আগুন বেশ ধরে ওঠে, রান্নায় বেশী বেগ পেতে হয়না তাকে। ভারি সুবিধে। এর বদলে যদিও রায়চৌধুরী বাবুদের এটা সেটা কাজকর্ম করে দিতে হয় হালিমকে। কখনও কখনও এই পুকুরের, আরও দুটো পুকুরের পানা পরিস্কার, নারকেল পেড়ে দেওয়া গাছে চড়ে। চাঁদুদা বলেই রেখেছে, বাবুদের কোনও কাজে কখনও না করবি না, সে করেও না, একবার শুধু, একটা পাঁঠা জবাই করার জন্যে ডাক পরেছিল তার। সে পারেনি, প্রায় কেঁদে ফেলে পারবে না বলে পালিয়ে এসেছিল। পরে চাঁদুদা গিয়ে বাবুদের বোঝায়, গায়ে ওরকম অসুরের মতো জোর হলে কি হয়, সে একটা পাখিও মারতে পারে না। বাবু বলেছিলেন, তোরা মুসলমান, তোরা যদি না পারিস তো কি করে চলে। শেষ অবধি বাজারের কসাইকে ডেকে এনে সে যাত্রা উপায় হয়েছিল।
বর্ষাকালটা হালিমের জন্য বড্ড কষ্টের। টানা বৃষ্টি বেশী হলে পুকুর ভেসে যায়। তার ঘর এক হাঁটু পানিতে। নিজেকে নিয়ে সে ভাবেনা, দুখানা প্লাস্টিকের প্যাকেট, দড়ি দিয়ে বেঁধে মোজার মতো করে পায়ে পরে নিলেই হলো, তার চিন্তা জামাকাপড় নিয়ে। জামাকাপড় কাচার উপায় নেই, শুকোনোর উপায় নেই, শুধু তার কুঁড়ের একমাত্র আসবাব একটি কাঠের তক্তপোষ জুড়ে জামাকাপড়ের স্তুপ বেড়ে চলে। তখন তার না আছে তক্তপোষে শোয়ার উপায়, না রান্না করে খাওয়ার কোনও জায়গা। খলখল করে কই মাছের ঝাঁক, এদিক ওদিক দিয়ে ভেসে যায়, সে ধরে না, কি করবে ধরে, উনুন পাতবে কোথায়, রাঁধবে কিসে, সব তো পানিতে পানি। তা এসব কি আর গাঁ ঘরে হয় না! হয়, অনেক বেশীই হয়, বরং শহরেও যে সে এসবের মধ্যে আছে সে নেহাত আল্লার দোয়া। এমনই বোঝায় চাঁদুদা তাকে। পানি নেমেও যায় দু-চারদিনেই। তখন আবার সব আগের মতন।
দোকান বন্ধ করে ফিরতে হালিমের রাত নটা সাড়ে নটা বেজে যায়। অত রাতে আর রান্না করার হাঙ্গামা করতে ভালো লাগে না তার। দুপুরের ভাত একটা সানকিতে পানি ঢেলে রাখা থাকে। তাই খেয়ে নেয় সে, একটু নুন তেল, কাঁচালঙ্কা যদি থাকে তো একটু কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে। মাঝে মাঝে চাঁদুদা এটা ওটা শাক সবজি এনে দেয়, এই দুটো পটল কি একটা বেগুন, কি চারটে আলু, এরকম যখন যা ইচ্ছে হয়। তা যখন যা দেয় তাই ভেজে রাখে দুপুরবেলা, রাত্তিরে পান্তার সাথে আলু কি বেগুন ভাজা, আহা, যেন বেহেস্ত। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে, তার কুঁড়ের সামনেটায় বসে থাকে হালিম। নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পরে কখনও কখনও। বাবুদের পুকুরের ওপারের থেকে কাদের বাড়ির রসুইয়ের গন্ধ নিয়ে হাওয়া এসে ঝাপটা মারে। এই সময়টা তার বাড়ির কথা মনে পড়ে। আম্মার কথা, বিবি খালেদার কথা, চোখ বুজে থাকলে মনে হয় মেয়ের কচি মুখটা যেন ওখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। সে ভাবে, শহর বলে সে এত রাতে এভাবে বসে। গাঁয়ে তাদের এখন মাঝরাত্তির।
কদিন ধরে মনটা ভারি খুশী হয়ে আছে হালিমের। এখন রমজান মাস চলছে। আর ক’দিন বাদে ঈদ আসছে। আজ তিন-চার মাস বাড়ি ফেরেনি সে। মেয়েটার মুখ, বিবির মুখ যেন চোখের উপর এসে খেলা করে যাচ্ছে। ঈদে যাবে সে দেশে। দোকান বন্ধ থাকবে তখন দিন দশেক। তা থাকুকগে। ঈদের জন্য অনেকদিন ধরে টাকা পয়সা জমাচ্ছে হালিম। একদিন দোকান বন্ধ দেখে যাবে সে খিদিরপুরে ফ্যান্সি মার্কেটে। বাড়ির সকলের জন্য কেনাকাটা করবে। মেয়েটার জন্য লেহেঙ্গা কিনবে লাল টুকটুকে, কাঁচের চুড়িও। আম্মার জন্য শাড়ি। ভাইয়ের বাচ্চা, বিবি সবার জন্য জামাকাপড়। খালেদার জন্য শাড়ি ছাড়া আর কি নিয়ে যাবে লুকিয়ে, ভেবে পায় না হালিম! প্রতিবারই কিছু না কিছু এরকম নিয়ে যায় সে। রাতে বিছানায় শুয়ে খালেদাকে দেয়, আর দেশলাই জ্বালিয়ে দেখে খালেদার মুখের রং বদলানো। এবারে কি কিনবে, আতর! আগে একবার বলেছিল বটে খালেদা, আতর আনতে। গাঁ ঘরের মেয়ে বউ, আতর চোখেই বা দেখেছে কতটুকু। ভেবে নিজের মনে হাসে হালিম, সে নিজে যেন শহরে থেকে আতরের দরিয়ায় ভাসছে। এইসব ভাবতে ভাবতেই হালিমের মনে পড়ে প্যান্টের পকেটে বিশটা টাকা রয়েছে। ফেরার সময় ভাঙা বাজার থেকে দুটো বেগুন কিনে এনেছিল সে, তখন ওই টাকাটা বেঁচেছিল। টাকাটা তুলে রাখা দরকার, নইলে পকেটে থাকলে বেফালতু খরচ হয়ে যাবে। সে টাকাটা নিয়ে তুলে রাখার জন্য তক্তপোষের উপর পেতে রাখা পাটির নীচে হাত গলায়। এটাই তার টাকা জমানোর জায়গা, তার চৌহদ্দির মধ্যে সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান। কিন্তু হাত গলিয়ে সে পরিচিত স্পর্শটা পায়না। অন্ধকারে এপাশ ওপাশ হাতরায়। একটা ভয়ের স্রোত নেমে যায় ওর শরীর বেয়ে। কাঁপা হাতে কোনওরকমে ছুটে এসে একটানে পাটিটা সরিয়ে ফেলে হালিম। কিচ্ছু নেই সেখানে। তার তিন চার মাসের সঞ্চয়ের একটি টাকাও সেখানে নেই। সে যেন বিশ্বাস করতে পারে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তারপর... গুঙিয়ে কেঁদে ওঠে। অসুরের মতন শক্তিশালী মানুষটা শিশুর মতন কাঁদতে থাকে কাচার জন্য নিয়ে আসা কাপড়ের গাঁটরিতে মুখ গুঁজে। তার মনে হয় গোটা দুনিয়ায় যেন কেউ নেই, শুধু সে একেলা রয়েছে তার দুর্ভাগ্য নিয়ে। তাই তার কান্না শুনে কেউ ছুটে আসেনা, কেউ গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে একটু সান্ত্বনা দেয় না তাকে। কাঁদতে কাঁদতে তার মাথাটা একটু পরিস্কার হয়, তার মনে পড়ে ক’দিন ধরে পাড়ার কতগুলো উটকো ছেলে তার ঘরেতে হানা দিচ্ছিল। এমনিই তার কাজের সময় পাঁচটা বাজে ইয়ার্কি ঠাট্টা করে চলে যেত, তাদেরই কেউ টাকার সন্ধান পেয়েছিল। সে জানে ওই কটা ছেলেকে সে যদি একাও চায় মাটিতে শুইয়ে দিতে পারে, কিন্তু সে তেমন কিছু করবে না। সে জানে, কাল চাঁদুদা যখন শুনবে বলবে কাউকে কিছু না বলতে, তাকেই দোষ দেবে ছেলেগুলোকে ঘরে ঢুকতে দেওয়ার জন্য। হয়তো কিছু টাকা তাকে দিয়েও দিতে পারে চাঁদুদা, যদি তার নিজের হাতে পয়সাকড়ি ভালো থাকে। তবু কষ্টে তার বুকটা ফেটে যায়, গত ক’মাস এত মেহনত করে, না খেয়ে না পরে জমানো টাকাগুলো... সে দেখতে পায়, সে যখন বাড়ি ফিরবে, ছোট মেয়েটা তার দৌড়ে আসবে, ‘আব্বা কি এনেছ আমার জন্য!’ তারপর তার খালি হাত দেখে, সে কি অবাক হয়ে যাবে, রাগে দুঃখে হয়তো তার সাথে কথাই বলবে না। ঈদের দিন সকালে যখন মেয়েটা আর ভাইয়ের বাচ্চাগুলো তার কদমবুসি করতে আসবে সে তাদের ঈদি দেবে কোথা থেকে। খালেদা কিছুই বলবে না তাকে, কেবল অভিমানে গুমরে গুমরে মরবে। কত আর বয়স তার, কিছুই তো তাকে দিতে পারেনি সে। এসব মনে পরে থেমে আসা কান্না ফের তার দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। এই নির্জনে কেউ তাকে দেখার নেই, কেউ নেই তাকে বোঝার, এই রাতে তাই সে প্রাণ উজাড় করে কাঁদে। আর তারপর কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পরে হালিম। চাঁদের আলো নারকেল পাতার ঝরোখার উপর পরে তার চারদিকে জাফরির কাজ বুনে যায়। চৌধুরী বাবুদের পুকুর পেরিয়ে মিঠে মিঠে দখিনা বাতাস এসে তাকে সোহাগ জানায়। আর তারা ভরা আকাশের নীচে, নারকেল গাছের নীচে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকে দানবের চেহারার এক শিশু।
এমন সব মুহূর্তের জন্য খোদা স্বয়ং বোধহয় অপেক্ষায় থাকেন। তিনি তাঁর কোনও জিব্রাইলকে পাঠান সেখানে, কে জানে, শুধু দেখা যায়, ঘুমের মধ্যে অসুরের চেহারার শিশুটির মুখে ফুটে উঠছে শান্তির হাসি।
Darun..
ReplyDeletekhub valo...kintu kemon duum kore ses hye gelo..jahhh !!
ReplyDelete