প্রাচীন কথা - মিথিল ভট্টাচার্য্য
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
মিথিল ভট্টাচার্য্য
সময় এরপর এক দ্রুত তালে এগিয়ে যায় সেই অভিশপ্ত দিনটিকে পেছনে ফেলে। ইদা পাহাড়ের বুকেই কেটে যায় আমার আর করির জীবনের বেশ কয়েকটি বছর। বাল্য থেকে কৈশোরে পা দেয় আমার করি, জানিনা কোন মহামন্ত্রে, না জেদে, যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠতে থাকে সে। প্রচণ্ডক্রোধের যে অঙ্কুরোদ্গম তার শৈশবে হয়েছিল, সেই অঙ্কুরই নিজের ডালপালা ছড়িয়ে এক মহীরুহে পরিণত হতে থাকে দিনের পর দিন। অনেক চেষ্টা করেছিলাম তাকে বুঝিয়ে এই ঘৃণার বীজ শিকড় সমেত উপরে ফেলার, কিন্তু পেরে উঠিনি। নিজের পিতার প্রতি, হেলেনের প্রতি আর সমগ্র ট্রয়ের রাজবংশের প্রতি প্রচণ্ড ক্রোধ আর ঘৃণার আগুন জ্বলে চলেছিল তার অন্তরে।
আর আমি ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে ছিলাম একদিকে যেমন করিকে শান্ত করার, আর অন্যদিকে নিজের অতীতকে ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে চলার।
এইরকমই একদিন ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ঘরে ফেরে আমার করি। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বলে উঠি "কি রে? এত উত্তেজিত হয়েছিস কেন? শান্ত হয়ে বস, কি হয়েছে তোর?"
করি আমার দিকে তাকিয়ে রুদ্ধ স্বরে বলে ওঠে, "যার প্রতীক্ষা আমরা এতদিন ধরে করেছি তাই ঘটতে চলেছে মা, আমাদের প্রতি সমস্ত অন্যায়ের শাস্তি পেতে চলেছেন রাজকুমার প্যারিস, আর ওই হেলেন।"
আমি আতঙ্কে নীল হয়ে যাই, কি বলছে আমার করি, কি অনর্থ ঘটিয়ে এসেছে ও?
কোনও মতে বলে উঠি "কি বলছিস তুই? ঠিক করে বল কি ঘটতে চলেছে?"
করি একটা তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বলে ওঠে, "যা ঘটার তাই ঘটতে চলেছে মা, গ্রীকরা তাদের সমস্ত শক্তি এক করে ছুটে এসেছে তাদের অপমানের প্রতিশোধ নিতে ট্রয়ের মাটিতে। এতদিনে নিজেদের পাপের শাস্তি পেতে চলেছে রাজকুমার প্যারিস আর ওই হেলেন।"
আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি করির দিকে, তার মানে অবশেষে সেই ভবিষ্যৎ আসতে চলেছে, যার আঁচ পেয়েছিলাম আমি অতগুলো বছর আগে! সত্যি কি তাহলে মহাবিনাশ আছড়ে পড়তে চলেছে ট্রয়ের বুকে?
করির তীব্র স্বরে কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসি।
করি জ্বলন্ত স্বরে বলে ওঠে, "দেখেছো মা অবশেষে আমাদের প্রতি অন্যায়ের শাস্তি কিভাবে নেমে আসছে আমাদের অপরাধীদের উপরে।"
আমি অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলে উঠি "ওই নিয়ে আমার আর কোনও আগ্রহ নেই রে, যা ঘটার তা ঘটবে, তাই নিয়ে ভেবে তোর আমার কোনও লাভ নেই। আমরা আমাদের জীবন নিয়েই এগিয়ে চলি, রাজ রাজড়াদের মধ্যে কি হচ্ছে, কি না হচ্ছ্ তাতে আমাদের কি?
কথা শেষ করে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাই, কিন্তু করি আমার পথ আটকে সামনে এসে দাঁড়ায়। একটু ইতস্তত করে যেন কিছু বলতে চায়।
আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠি "কিছু বলবি? কিছু বলার থাকলে বল।"
করি একটু সময় নিয়ে নিজের সমস্ত দ্বিধা অতিক্রম করে অবশেষে বলে ওঠে "মা আমি এই যুদ্ধে গ্রীক পক্ষে অবতীর্ণ হতে চাই। আমাকে অনুমতি দাও।"
আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি আমার করির দিকে। শেষপর্যন্ত যে সর্বনাশের ভয় আমি পাচ্ছিলাম তাই কি ঘটতে চলেছে আমাদের মা ছেলের এই ছোট্ট সংসারে? এবার কি আলেকজাণ্ডারের পর করিকেও আমি হারাবো এই বাইরের জগতের সর্বনাশা আহ্বানে?
করির দিকে তাকিয়ে আমি দৃঢ় স্বরে বলে উঠি "না তুই এই যুদ্ধে কোনও মতেই অংশ নিবিনা, এটাই আমার আদেশ।"
করি ব্যাকুল স্বরে বলে ওঠে, "কিন্তু কেন মা?"
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠি "কারণ এই যুদ্ধ আমাদের নয়, গ্রীক আর ট্রোজানরা নিজেদের মধ্যে যত খুশি কাটাকাটি করুক, আমাদের পার্বত্য নিমফদের তাতে কোনও ভূমিকা নেই, এই রাজনীতি থেকে দূরে থাকাই আমাদের জন্য মঙ্গল।"
করি আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, দৃঢ় স্বরে বলে ওঠে "না, এটা আসল কারণ নয় মা, আসল কারণ তুমি এখনও চাওনা রাজকুমারের প্যারিসের কোনও ক্ষতি হোক। তাইনা?"
নিজের সমস্ত সংকোচ দূরে সরিয়ে রেখে মুখোমুখি দাঁড়াই নিজের আত্মজের। আজ সমস্ত দ্বিধাকে দূরে সরিয়ে রেখে এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতেই হবে।
করির নীল চোখদুটোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, একদম ওর বাবার চোখ দুটো পেয়েছে ও। ওর ওই নীল চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে গভীর স্বরে বলে উঠি, "হ্যাঁ, মিথ্যে বলবো না রে, কোথাও না কোথাও গিয়ে আমি আজও তার ক্ষতি চাইনা। কিন্তু তা আসল কারণ নয়, আসল কারণ তুই।"
করি হতভম্ব ভাবে বলে ওঠে "আমি?"
আমি একইভাবে উত্তর দিই, “হ্যাঁ তুই, কারণ আমি চাইনা তুই কোনও আত্মদহনে ভোগ। নিজের হাতে যদি নিজের পিতাকে মারণ আঘাত করিস, তবে আজ নিজের জমা রাগের কারণে কোনও যন্ত্রণা বা আত্মগ্লানি তোকে স্পর্শ না করলেও, এক না একদিন অনুশোচনা তোকে স্পর্শ করবেই। আর সেই যন্ত্রণা তোকে পেতে দেখতে আমি পারবোনা। তার থেকে অনেক ভালো আমরা দুজন এই রাজনীতির আবর্ত থেকে দূরে সরে থাকি।"
করি আমার দিকে তাকিয়ে আলতো স্বরে বলে ওঠে "আমার মনে হয়না মা, রাজকুমার প্যারিসকে নিজের হাতে হত্যা করলেও কোনও আত্মদহন আমাকে কোনও দিন স্পর্শ করবে। কিন্তু শুধু তোমার খুশির জন্য প্রতিজ্ঞা করছি, আমি তাকে কোনওদিনও আঘাত করবোনা।"
একটা শান্তির নিশ্বাস আমি ফেলেছিলাম সেদিন। কিন্তু বুঝতে পারিনি, নিজের জীবনের কত বড় ভুল আমি নিজের অজান্তেই করে বসেছিলাম সেদিন!
ট্রয় আর গ্রীসের যুদ্ধের সংবাদের ঝড় ক্রমশ আছড়ে পড়তে থাকে এই নির্জন ইদা পাহাড়ের বুকে। যুদ্ধে ট্রোজানদের একের পর এক পরাজয়ের আর গ্রীকদের বিজয়ের গাঁথা। গ্রীক বীর একিলিসের হাতে পতন ঘটছে ট্রয়ের একের পর এক সুরক্ষা কবচের।
আর যুদ্ধের এই অনবরত সংবাদে আরও ব্যাকুল হয়ে পড়তে থাকে আমার করি। বুঝতে পারি ট্রয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কতটা উৎসুক ও, কিন্তু পারছেনা শুধু আমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কারণে।
এরমধ্যে একদিন সংবাদ আসে ট্রোজান বীর রাজকুমার হেক্টরের মৃত্যুর।
রাখালদের মুখ থেকে শুনতে পাই, কিভাবে নিজের জন্মভূমির জন্য নিরপরাধ বীর নিজের প্রাণের আহুতি দিয়েছেন।
নিজের অজান্তেই কখন যে দুইচোখ দিয়ে জলের ধারা নেমেছিল জানতেও পারিনি।
করি বিস্মিত হয়ে বলে উঠেছিল "এক ট্রোজান রাজকুমারের জন্য তুমি কেন চোখের জল ফেলছো, মা?"
আমি ম্লান স্বরে বলে উঠেছিলাম "কারণ আমি কোনও ট্রোজান রাজকুমারের জন্য চোখের জল ফেলছিনা রে। ফেলছি এমন একজন মর্যাদাবান যোদ্ধার জন্য, যে নিরপরাধ হয়েও নিজের জন্মভূমির কারণে নিজের প্রাণের বিসর্জন দিলো। ভেবে দেখতো আজ যদি আমাদের এই ইদা পাহাড়ে কেউ আক্রমণ করতো তাহলে তুইও কি একই কাজ করতিসনা? জানিনা এই মারণ যুদ্ধ আর নিরপরাধ প্রাণের বলি নেবে? কেন এখনও ওই সর্বনাশীকে গ্রীকদের হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছেন না মহারাজ প্রিয়াম? আর কত মৃত্যু দেখতে চান তিনি?"
করি আমার দিকে এক গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে "তুমি কি সত্যি চাও মা, যে এই যুদ্ধ থেমে যাক?"
আমি একটা ম্লান হাসি মুখে নিয়ে বলে উঠি "যে কোনও কিছুর মূল্যে রে।"
কিছুক্ষণ এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল করি, তারপর নিঃশব্দে কিছু না বলে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেছিলো।
পরের দিন হঠাৎই নিজের বাবার মতোই কোথায় যেন হারিয়ে গেছিলো আমার একমাত্র অবলম্বন। ওর রাখাল বন্ধুদের কাছে, ইদা পাহাড়ের কাছের গ্রামের শস্ত্রব্যবসায়ী যাদের কাছে ও যেতে পারতো, ব্যাকুল হয়ে তাদের সবার কাছে গিয়ে ওর খোঁজ নিয়েছিলাম, কিন্তু কোথাও কোনও খোঁজ পাইনি ওর। অবশেষে যখন ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে গেলাম, তখনি দৃষ্টি পরে আমার কক্ষে রেখে যাওয়া একটা পত্রের দিকে, "মা, তোমার ইচ্ছে পূরণ করতেই যাচ্ছি। গ্রীকদের হাতে রানী হেলেনকে সমর্পন না করলে এই যুদ্ধ থামবেনা। আরও অনেক নিরপরাধ প্রাণ বলি হবে এই কাল সংগ্রামে। তাই অন্তত একবার চেষ্টা করতে যাচ্ছি এই যুদ্ধ সমাপ্ত করার। জানি তোমাকে বলে গেলে তুমি যেতে দিতেনা, তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে না জানিয়েই যাচ্ছি। যদি না ফিরি তাহলে তোমার এই অবাধ্য ছেলেটাকে ক্ষমা করে দিও।"
আমি পাগলের মতো ছুটে গেছিলাম ইদা পাহাড়ের বুক থেকে নিচের উপত্যকার দিকে, এই পথেই একদিন আমায় ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে গেছিলো আমার আলেকজান্ডার। আর আজ এই পথে নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজের ছেলেটাকে অন্তত হারাতে পারবো না আমি!
ঝড়ের মতো আমি নেমে আসছি পাহাড়ের বুক থেকে সমতলের মৃত্যুভূমির দিকে, কিন্তু একটা আলোর সারি যেন আমার গতি রুদ্ধ করে দিলো। এ কারা উঠে আসছে সমতল থেকে ইদা পাহাড়ের বুকে? কিছু ট্রোজান সৈনিক দল বেঁধে উঠে আসছে এই পাহাড়ের বুকে, কেন? আবার কি অনর্থ করে বসলো বোকা ছেলেটা? আমিধীর পায়ে কোনও রকমে এগিয়ে যাই এই সৈনিক দলের দিকে।
সৈনিক দলের প্রধান আমার সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। একমুহূর্তের জন্য আমার দিকে তাকিয়ে তারপর প্রশ্ন করে ওঠে "আপনিই কি পার্বত্য পরী ঈনন?"
আমার গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরোয় না, কোনও রকমে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই।
একটু বিব্রত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে তারপর এই প্রধান বলে ওঠেন "আপনার পুত্র করিথাস, আজ ট্রয়ের প্রাসাদে প্রবেশ করেছিলেন, উনি রাজকুমার প্যারিসের প্রেয়সী হেলেনকে নিয়ে পালানোর প্রয়াস করেছিলেন।"
আমি মাঝপথেই তাকে থামিয়ে ব্যাকুল স্বরে বলে উঠি, "আমার করি, আমার করি ঠিক আছে তো?"
মাথা নত করে অপরাধী স্বরে সে বলে ওঠে "আমায় ক্ষমা করবেন, আপনার পুত্র আর জীবিত নেই, সে মারা গেছে।"
এই দুই লাইনের কথা কটা যেন এক নিমেষে আমার সমস্ত জীবনী শক্তিকে শুষে নেয় আমার শরীর থেকে। আমার করি, আমার ছোট্ট করি, যার ছোট্ট দুটো হাতকে আঁকড়ে ধরে আমি এতগুলো বছর এই নির্জন পাহাড়ে কাটিয়ে দিলাম, সেই করি আর নেই! না না এরা নিশ্চয় মিথ্যে বলছে, আমার করি আমাকে ছেড়ে যেতে পারেনা এইভাবে।
সৈন্য প্রধান আমার সামনে থেকে সরে যান, তার দুজন অধীনস্থ সৈন্য আমার সামনে এগিয়ে নিয়ে আসে একটি সাদা কাপড়ে ঢাকা দেহ। শুধু তার মুখটা অনাবৃত, কোনও রকমে সমস্ত শক্তি এক করে তাকালাম ওই প্রাণহীন জড় শবদেহটার দিকে। একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এল আমার কণ্ঠ থেকে। এ তো আর কেউ না, এ তো আমার করি!
মুহূর্তের মধ্যে একটা অন্ধকার যেন নেমে এল আমার দুই চোখের সামনে, আমার পা দুটো যেন আর শরীরের ভার বইতে পারছেনা, আমি যেন একটা গভীর খাদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছি।
সেনা প্রধান ছুটে এসে তার শক্ত হাতে আমাকে কোনও রকমে ধরে রাখে। প্রাণপণ চেষ্টায় কোনও মতে নিজেকে বার করে আনি ওই গোলক ধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া থেকে।
একটু একটু করে আমি এগিয়ে যাই আমার ছোট্ট করির দিকে, আমার করি চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন আজ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, না ভুল বললাম কেউ কেড়ে নিয়েছে আমার একমাত্র সন্তানকে আমার বুক থেকে।
কষ্টের জায়গা যেন দখল করে নেয় একটা অমানুষিক ক্রোধ, সেনা প্রধানের দিকে নিজের রক্ত বর্ণের চোখ তুলে প্রশ্ন করি, "কিভাবে মারা গেছে আমার করি? কে? কে হত্যা করেছে ওকে?"
সেনা প্রধান মাথা নিচু করে বলে ওঠেন, "আপনার পুত্র করিথাস এক অসামান্য বীর। তিনি সমস্ত প্রহরীদের চোখে ধুলো দিয়ে অদ্ভুত কৌশলে যুদ্ধ করে হেলেনকে নিয়ে পালাচ্ছিলেন। হেলেনের খুব বেশি আপত্তি কিছু যে প্রকাশ পেয়েছিলো তাও মনে হয়নি। আর আমাদের মধ্যে বেশির ভাগ তার সামনে দাঁড়াতেই পারেনি, আর বাকিরা যেমন আমি নিজে, সেই চেষ্টাই করিনি, আমরা সবাই চেয়েছিলাম ওই সর্বনাশী চলে যাক ট্রয় থেকে। একদম শেষ দ্বারের সামনে যখন তারা পৌঁছে গেছে, তখন আচমকা তাদের গতি রোধ করে দাঁড়ান রাজকুমার প্যারিস। অদ্ভুত ভাবে আপনার এই বীর পুত্র রাজকুমার প্যারিসের সামনে অস্ত্র না তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। রাজকুমার তাকে আদেশ করেন হেলেনকে ফিরিয়ে দিতে, কিন্তু সে একবগ্গার মতো তার জেদে অনড় থাকে। এরপরেই রাজকুমার প্যারিস উদ্যত তরবারি নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পরে। কিন্তু সে নিজের অস্ত্রের দিকে একবারের জন্যও হাত বাড়ায়না। রাজকুমার প্যারিসের তরবারির মারণ আঘাত লাগে তার বুকে। শেষ মুহূর্তে সে আপনার অর্থাৎ তার মায়ের নাম নেয়। রাজকুমার প্যারিসও যেন এই নাম শুনে কেন জানিনা স্তম্ভিত হয়ে যান। এর কিছু সময়ের মধ্যেই মারা যায় আপনার পুত্র। আর রাজকুমার আমাদের আদেশ করেন উপযুক্ত সম্মানের সঙ্গে তার মৃতদেহ এই পাহাড়ে আপনার কাছে পৌঁছে দিতে, আর শুধু তাই নয় এই বীর বালকের অন্তিমসৎকারে সকল রকম সহায়তা করতে। যাতে রাজকীয় মর্যাদার সাথে সম্পন্ন হয় এই বীরের অন্তিম ক্রিয়া"
আমার তীব্র রোষে ভরা চীৎকার ধ্বনিত হতে থাকে ইদা পাহাড়ের প্রতিটি প্রান্তে, "আমার সন্তানকে হত্যা করে এখন তিনি আপনাদের পাঠিয়েছেন তার অন্তিমসৎকারের ব্যবস্থা করতে! দূর হয়ে যান, এই মুহূর্তে এই পাহাড় থেকে! দূর হয়ে যান! না হলে জীবনের প্রথমবারের মতো এই পার্বত্য পরীর দেওয়া অভিশাপের ভাগীদার হতে হবে আপনাদের সবাইকে। আমার সন্তানকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার শাস্তির ভাগ পেতে হবে প্রত্যেককে। যদি বাঁচতে চান এই মুহূর্তে এই পাহাড় থেকে পালিয়ে যান..."
আমার অমানুষিক ঘৃণা আর ক্রোধের ছাপ যেন এসে পরে প্রকৃতিরও বুকে। এক প্রাণঘাতী ঝড়ের কালো মেঘ যেন এক মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে আকাশের বুকে।
একটা গভীর আতঙ্ক যেন জন্ম নেয় এই ট্রোজান সৈন্য দলের মধ্যে, ইদা পাহাড়ে বুক বেয়ে তারা দ্রুত পালিয়ে যেতে থাকে সমতলে দিকে। কিন্তু সৈনা প্রধান নিস্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন ইদা পাহাড়ের বুকে, কিছু সময়ের জন্য আমার দিকে ফিরে তাকান তিনি, একটা গভীর অপরাধবোধ যেন ফুটে ওঠে তার মধ্যে, কিছু যেন বলতে চান, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজের ভাষা হারিয়ে ফিরে যেতে উদ্যত হন।
আমি তীব্র স্বরে বলে উঠি "দাঁড়ান"
সেনা প্রধান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ান।
আমি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠি "বলে দেবেন আপনাদের রাজকুমার প্যারিসকে, আমার সন্তানকে আমি বুকে করে বড়ো করেছি। তার অন্তিম সৎকার আমি নিজেই করতে পারবো। তার জন্য আমার অন্য কারোর সাহায্যের দরকার নেই। তিনি যেন এবার তার নিজের এবং তার পরিবারের সৎকারের ব্যবস্থা শুরু করে দেন। কারণ এবার গ্রীকদের বীরত্বের সাথে যোগ হতে চলেছে এক পুত্রহারা পার্বত্য পরীর অভিশাপ। ট্রয় রাজবংশের আর একটা মানুষও প্রাণে বাঁচবেনা। আজ আপনারা আমার সন্তানের শব নিয়ে এসেছেন, কিন্তু আপনাদের শব বহন করার জন্য আর একটা প্রাণও অবশিষ্ট থাকবেনা। এ এই সন্তানহারা নিম্ফের অভিশাপ ট্রয় রাজবংশকে।"
সেনাপ্রধান আমার দিকে একমুহূর্তের জন্য তাকিয়ে থাকেন তারপর বলে ওঠেন, “আমার দুর্ভাগ্য যে আমি, এই আফ্রোদিতে পুত্র ইনিস এই রাজবংশের জামাতা, তাই আপনার এই অভিশাপের ভার আমাকেও বইতে হবে সারা জীবন। তাও আমি ভগবান জিউসের কাছে প্রার্থনা করবো যাতে এই পুত্রহারা মায়ের অভিশাপ সত্য হয়।"
আর একটা কথাও না বলে দ্রুত পায়ে পাহাড়ের বুক থেকে সমতল ভূমির দিকে নেমে যায় ট্রয়ের সেনা প্রধান ,আফ্রোদিতে পুত্র ইনিস।
আর পাগলের মতো আমি এগিয়ে যাই আমার সন্তানের দিকে, আমার করি, সে আর কোনওদিন উঠবেনা। আর কোনওদিন আমার কাছে জেদ করবেনা। সব... সব শেষ হয়ে গেছে আমার মূর্খতার জন্য।
যে রাখালেরা একদিন আলেকজাণ্ডারকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে পালন করেছিল, যারা আমার একমাত্র সহায় ছিল তাদের আলেকজান্ডারের অংশ ছোট্ট করিকে বড় করে তুলতে, তাদের সাহায্যেই আজ অন্তিম সৎকার করি আমার আত্মজের। চিতার প্রচণ্ড আগুনে মুছে যেতে থাকে আমার ভালোবাসার ছোট্ট পুতুল, আর তার সাথেই আত্মদহনে ছাই হয়ে যেতে থাকে তার এই অভাগী মা।
কেন? কেন আমি প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলাম ওকে দিয়ে যে ও রাজকুমার প্যারিসকে আঘাত করবেনা? কেন? আজ যদি এই প্রতিজ্ঞা আমি না করাতাম ওকে দিয়ে,তবে জীবিত থাকতো আমার করি। কেন আমি আমার করির জীবন বলি দিলাম সেই ব্যক্তির জন্য যে আমাদের দুজনকেই ছেঁড়া কাপড়ের মতো ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো? আজ তো আমার করির জীবিত থাকার কথা আর মারা যাবার কথা ওই রাজকুমার প্যারিসের। তাহলে কেন? কেন আজও সে জীবিত আছে?
করির চিতার সামনে থেকে আমি ছুটে যাই আমার আরাধ্যা মাতা রিয়ার মন্দিরে। এই দুর্ভাগী মা আজ ক্ষোভে, ক্রোধে ফেটে পরে অলিম্পাস মাতার সামনে, "তোমার উপাসিকা এই পার্বত্য পরী আজ অব্দি কোনও দিন তোমার কাছ থেকে পাওয়া দৈব শক্তির কোনো অপব্যবহার করেনি মা। সব সময় চেষ্টা করেছি সমস্ত মানুষদের রোগের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দেবার। কিন্তু আজ তোমার এই উপাসিকা ওই রাজবংশের ধ্বংস কামনা করছে মা। ওই ট্রোজান রাজবংশ যেন সমূলে ধ্বংস হয়, যে ভাবে আজ আমি আমার করিকে হারিয়েছি সেইভাবে ওই বংশের প্রত্যেক মা যেন নিজেদের সন্তানকে হারায়। আর ওই রাজকুমার প্যারিস যে কোনও দিন আমাদের যোগ্য সম্মান আমাদের দিলোনা, যে আজ নিজে হাতে আমার করিকে কেড়ে নিলো আমার বুক থেকে, সে যেন দগ্ধে দগ্ধে মরে। সহজ মৃত্যু যেন সে না পায়। তারই চোখের সামনে যেন ধ্বংস হয়ে যায় তার সমস্ত পরিবার। আর ওই বিশ্বসুন্দরী যার জন্য সে আমাকে আর আমার করিকে অবহেলায় ত্যাগ করেছিল, সেও যেন তার বিপদে তাকে একইভাবে ছেড়ে চলে যায় তারই চোখের সামনে। মা এই পুত্রহারা মায়ের অভিশাপ যেন ব্যর্থ না হয় "
একটা একটা করে দিন এগিয়ে যায়, আর তার সাথে ধ্বংসের মুখে এগিয়ে যেতে থাকে ট্রয়। আর সুদূর ইদা পাহাড়ের বুকে এক পার্বত্য পরী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে এই নগরীর শ্মশানে পরিণত হবার সংবাদের। অবশেষে সে পায় তার বহু প্রতীক্ষিত সংবাদ, গ্রিক বীর ওডেসিয়াসের চাতুরির সামনে অবশেষে ভেঙে পড়েছে ট্রয়ের সুরক্ষা।
ওডেসিয়াস এক কাঠের ঘোড়ার পেটে সৈন্য ঢুকিয়ে গ্রীক বাহিনীকে প্রবেশ করিয়েছে ট্রয়ের দুর্ভেদ্য প্রাচীরের ভেতরে। গ্রীকেরা অমানুষিক বর্বরতা দেখিয়েছে ট্রয়ের সর্বত্র, ধ্বংস হয়ে গেছে গোটা ট্রোজান রাজবংশ। বৃদ্ধ রাজা প্রিয়াম নিজে মারা গেছেন একিলিস এর পুত্র নিওপটলেমাসের হাতে।
আর হেলেন? হেলেন হাসতে হাসতে ট্রয় ছেড়ে নিজের পুরোনো স্বামী মেনেলাসের কণ্ঠলগ্না হয়ে ফিরে গেছে স্পার্টায়। আর বাদবাকি অবশিষ্ট ট্রোজানদের নিয়ে এক নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে সেই বীর ট্রোজান সেনা নায়ক ইনিস।
আর প্যারিস? না রাজকুমার প্যারিসের কোনও খবর নেই। সে নিরুদ্দেশ, শুধু এইটুকু জানা গেছে যে, সে নাকি প্রচণ্ড আহত হয়েছে ফিলোপটেটিসের নিক্ষিপ্ত হাইড্রার বিষ মিশ্রিত তীরে। স্বয়ং হারকিউলিস নাকি এই তীর গচ্ছিত রেখে গেছিলেন তার বন্ধু ফিলোপটেটিসের কাছে। যাক, যে বিষের যন্ত্রণা আজ এই সন্তানহারা নিম্ফ পাচ্ছে, সেই বিষ এবার অনুভব করুক রাজকুমার প্যারিস। ওই বিষের দহনে যেন দগ্ধে দগ্ধে মরে আমার করির হত্যাকারী।
অবশেষে আবার ছুটে যাই মাতা রিয়ার মন্দিরে, এত দিনে আমার বাসনা পূর্ণ করেছেন আমার আরাধ্যা। কিন্তু তাও কেন শান্তি পাচ্ছিনা আমি ?
মাতা রিয়ার মন্দির থেকে ক্লান্ত শরীরে নিজের নির্জন কুটিরের দিকে ফিরে আসছিলাম আমি। হঠাৎ কালো কাপড়ে ঢাকা এক আগন্তুক আমার পথ আটকে দাঁড়ায়।
আমি কিছু সময়ের জন্য হতচকিত হয়ে যায়। বিস্মিত স্বরে বলে উঠি "কে আপনি? এইভাবে আমার পথ আড়াল করে দাঁড়িয়েছেন কেন?"
সেই ছায়া মূর্তি একটা ভাঙা ক্লান্ত স্বরে বলে ওঠে "ঈনন, আমি তোমার আলেকজাণ্ডার।"
প্রচণ্ড বিস্ময়ে আমি যেন স্তব্ধ হয়ে যাই।
সেই ছায়া মূর্তি কালো কাপড়ের আস্তরণ সরিয়ে দেয় নিজের উপর থেকে। কিন্তু এ কে? আমার আলেকজাণ্ডার বলি কি রাজকুমার প্যারিস, তার রূপ তো ছিল জগৎসেরা। তবে একি চেহারা হয়েছে তার!
রাজকুমার প্যারিস ম্লান হাসি হেসে বলে ওঠে "দেখছো ঈনন, কি অবস্থা হয়েছে তোমার আলেকজাণ্ডারের? হ্যাঁ ঈনন, যে অভিশাপ তুমি দিয়েছিলে ইনিসের সামনে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছে। আজ আমার গোটা বংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। হেলেন আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে নিজের আগের স্বামী মেনেলাসের সাথে। আর আজ আমি বিষের জ্বালায় মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়িয়ে আছি তোমার সামনে।"
একটা বিদ্রুপ মিশ্রিত স্বরে বলে উঠি "কোন আলেকজাণ্ডারের কথা আপনি বলছেন রাজকুমার, আপনার মনে নেই অনেক দিন আগেই আপনি আমায় বলেছিলেন যে আলেকজান্ডার মরে গেছে, তবে আজ আবার তার নাম মুখে নিচ্ছেন কেন? আর এতদিন পর মৃত্যুর মুখে এসে হঠাৎ আমার স্মরণ কিভাবে হলো আপনার? কেন এসেছেন এই অকিঞ্চিৎকর ইদা পাহাড়ে? আমাকে দোষারোপ করতে আপনার বংশের ধ্বংসের জন্য?"
রাজকুমার প্যারিস কাতর স্বরে বলে ওঠেন "না ঈনন, আমি এখানে তোমাকে কোনও রকম দোষারোপ করতে আসিনি। আমার নিজের পাপের শাস্তি আমি পেয়েছি, তার জন্য অন্য কাউকে দোষী করার মুখ আমার নেই। আমি তোমার কাছে এসেছি, ক্ষমা চাইতে আর তোমার দয়া ভিক্ষা করতে।"
আমি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠি "কিসের ক্ষমা? আমাকে আর করিকে ফেলে পালানোর জন্য ক্ষমা, না আমাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবার জন্য ক্ষমা? আর না কি নিজের পত্নীকে পরিত্যাগ করে অন্যের স্ত্রীকে নিজের শয্যায় স্থান দেবার জন্য ক্ষমা? এইসবের জন্য হয়তো আলেকজাণ্ডার পত্নী ঈনন আপনাকে ক্ষমা করেও দিতো, কিন্তু করিথাসের মাতা কোনওদিনও ক্ষমা করতে পারবেনা তার পুত্রের হত্যাকারীকে। "
কিছুসময়ের জন্য মৌন হয়ে যায় রাজকুমার প্যারিস, আমার চোখের দিকে তাকানোর সাহস হারিয়ে ফেলে সে, মাথা নত করে সে মৃদু স্বরে বলে ওঠে "করিকে আমি মারতে চাইনি ঈনন। আমার ধারণা অব্দি ছিলোনা যে ও আমার পুত্র। ওকে হেলেনকে নিয়ে পালতে দেখে আমি রাগে পাগল হয়ে গেছিলাম। তারপর যখন ও শেষ নিশ্বাস ফেলার সময় তোমার নাম নিলো, তখন উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম কি অনর্থ ঘটে গেছে আমার হাতে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি ওকে হত্যা করতে চাইনি।"
তীব্র স্বরে চীৎকার করে বলে উঠি "তাতে কি এসে যায় রাজকুমার? আপনি আমার করিকে মারতে চেয়েছিলেন না কি চাননি, তাতে কি এসে যায়? আমার করি আজ মৃত। আমার একমাত্র সন্তানকে আমি হারিয়েছি আপনার হাতে। আপনি সারাজীবন আমার চোখে থাকবেন শুধুমাত্র আমার করির হত্যাকারী হয়ে।"
রাজকুমার প্যারিস একটা ভাঙা স্বরে বলে ওঠে "সে আমার ও একমাত্র পুত্র ছিল ঈনন।"
আমি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠি "না, সে শুধু আমার একার পুত্র ছিল। তার পিতা আলেকজাণ্ডারের মৃত্যু তখনই হয়েছিল, যখন সে আমাদের দুজনকে ছেড়ে পালিয়ে গেছিলো ট্রয়ে। সেই দিনই মারা যায় আলেকজাণ্ডার আর তার শবদেহ থেকে জন্ম নেয় রাজকুমার প্যারিস। আর সেই রাজকুমার প্যারিসের সাথে আমাদের দুজনের কারোর কোনও সম্পর্ক ছিলোনা। যাই হোক আপনি কি দয়ার কথা বলছিলেননা, সেই কথাই বলুন? কি দয়া চান আপনি? কোন প্রয়োজনে এসেছেন এই তুচ্ছ পার্বত্য পরীর কাছে?"
লজ্জায় মাথা নত করে অবশেষে বলে ওঠেন রাজকুমার প্যারিস "তোমার কাছে বলার মুখ নেই, তাও মাথা হেঁট করেই প্রার্থনা করছি আমাকে মুক্তি দাও এই বিষের দহন থেকে। একমাত্র তুমিই পারো এই প্রচণ্ড বিষের জ্বালা থেকে আমাকে রক্ষা করতে, বাঁচাও তোমার আলেকজাণ্ডারকে ঈনন।"
আমার তীক্ষ্ণ হাসি প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরে ইদা পাহাড়ের আনাচে কানাচে, বিদ্রুপ মাখা স্বরে বলি "তাহলে এতদিনেও আপনি কিচ্ছু বদলাননি। আগেও যতটা স্বার্থপর ছিলেন, এখনও ঠিক তাই আছেন। আগেও নিজের স্বার্থের জন্য যেমন যেকোনও কাজ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করতেননা। এখনও ঠিক তাই করেন। আজ থেকে বহুযুগ আগে নিজের স্বার্থের জন্য নিজের স্ত্রী আর অবোধ ছেলেকে ত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার আগে যেমন একবারও ভাবেননি। আজও তেমনি নিজের স্বার্থের জন্য নিজে হাতে এই মায়ের সন্তানকে মারার পরও এই সন্তানহারা মায়ের কাছে আসার আগেও একবারও ভাবলেননা। আর কতটা নির্লজ্জ আর স্বার্থপর হতে পারেন আপনি?"
স্তব্ধ হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে রাজকুমার প্যারিস, আমি তার পাশ কাটিয়ে নিজের কুটিরের দিকে আবার চলতে শুরু করি। অসহায়ের মতো আবার আমার সামনে এসে দাঁড়ায় সে, ভাঙা দুর্বল স্বরে বলে ওঠে "আমি বারবার তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি ঈনন। আমাকে দয়া করো। এই কাল যন্ত্রণা আমি আর সইতে পারছিনা।আমাকে ক্ষমা করে এই যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি দাও ঈনন।"
একমুহূর্তের জন্য যেন আমার ভেতর থেকে জেগে ওঠে সেই আলেকজান্ডার প্রেয়সী তরুণী ঈনন। সে সব, সব কিছু করতে পারতো তার ভালোবাসার মানুষটার জন্য। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন আমার অন্তর চাইলো সব ভুলে এই অসহায় মানুষটাকে ক্ষমা করে দিতে, কিন্তু পরক্ষণেই জেগে উঠলো করিথাসের মাতা। আর সবকিছুর জন্য আজকের এই অসহায় মানুষটাকে আমি ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু আমার করির মৃত্যুর জন্য নয়। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে গাঢ় স্বরে বলে উঠি "আমায় আপনি ক্ষমা করবেন রাজকুমার, কিন্তু আপনাকে কোনওরকম সাহায্য করতে এই পার্বত্য পরী অপারগ। আপনি এখান থেকে চলে যান।"
আবার তার পাশ কাটিয়ে আমি এগিয়ে যাই আমার ছোট্ট কুটিরটার দিকে। পেছন থেকে একটা চূড়ান্ত ভেঙে পড়া স্বরে সেই মানুষটা বলে ওঠে, "যদি আমাকে উপশম করতে নাও পারো, তবে অন্তত এই বিষের হাত থেকে বাঁচাতে আমাকে মৃত্যু অন্তত দাও ঈনন। এই ভয়ানক জ্বালা আমি আর সইতে পারছিনা।"
আমি শেষবারের মতো পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি কালকের সেই অহংকারী মানুষটিকে এক জীবন যুদ্ধের পরাজিতের মতন দাঁড়িয়ে থাকতে। তারপর বলে উঠি "আপনাকে কোনও সাহায্য করে আমার পক্ষে সম্ভব নয় রাজকুমার প্যারিস। আপনি আমাকে বিদায় দিন।"
দ্রুত পায়ে নিজের অতীতকে পিছনে ফেলে রেখে জীবন পথে সামনের দিকে এগিয়ে যাই আমি।
সন্ধের সময় আবার ফিরে যাই আমার আরাধ্যার মন্দিরে উপাসনা করতে। কিন্তু হঠাৎ পথের ধারে দেখি সেই রাখালের দল একজোট হয়ে কারোর চিতায় আগুন দিচ্ছে। একটু স্তম্ভিত হয়ে যাই আমি, এই সময় কার চিতায় আগুন দিচ্ছে এরা?
ধীর পায়ে আমি এগিয়ে যাই ওদের দিকে, একটা শোকের ছায়া যেন লেগে আছে আছে ওদের প্রত্যেকের মুখে, বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করি ওদের, "এ কার চিতা? কাকে আগুন দিচ্ছো তোমরা?"
ওরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কাতর স্বরে বলে ওঠে "আলেকজাণ্ডারকে ঈনন। তুমি জানোনা আমাদের আলেকজাণ্ডার এতো বছর পর আবার আমাদের কাছে ফিরে এসেছিলো। কোনোওএক বিষের জ্বালায় বড়ো কষ্ট পাচ্ছিলো বেচারা। সেই জ্বালা আর সহ্য করতে না পেরে বেচারা একটু আগে আত্মহত্যা করেছে। তুমি যদি একটু আগেও আসতে তবে হয়তো বাঁচাতে পারতে বেচারাকে। ও তো তোমারই আলেকজাণ্ডার।"
ওদের বলা শেষ কথাটা আমার কানের মধ্যে বার বার ধ্বনিত হতে থাকে, "ওতো তোমারই আলেকজাণ্ডার," সত্যি ও তো আমারই আলেকজাণ্ডার। সারা জীবন ধরে ওই তো একমাত্র ছিল আমার স্বপ্নের মানুষ। যতই অন্যায় ও করে থাকুকনা কেন আমার সাথে, এটাই তো নির্মম সত্যি যে সব কিছু সত্ত্বেও ওকে আমার অন্তর থেকে এক দিনের জন্যও দূর করতে পারিনি আমি। ও আমার কাছে ফিরে এসেছিলো নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে। আমি চাইলে ওকে বাঁচাতে পারতাম এই বিষের থেকে, কিন্তু বাঁচাইনি। নিজের প্রতিশোধের স্পৃহায় ওকে নিজের হাতে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি। সমস্ত অভিমান, রাগ, বিদ্বেষ মুছে যাচ্ছে আমার অন্তর থেকে, আর তার জায়গায় স্থান নিচ্ছে সেই সোনায় মোড়ানো অমূল্যের সময়ের স্মৃতিগুলো। আমার নিজের অজান্তেই আমার দুই চোখ থেকে জলের ধারা ঝরে পড়ছে, ওর মৃতদেহের উপর। একজন রাখাল আস্তে আস্তে ওর চিতায় আগুন প্রদান করলো। শুকনো কাঠ আগুনের ছোঁয়ায় এসে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। আর সেই আগুনে আমি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখছি আমার জীবনের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎকে। আর তো একটাই উদ্দেশ্য পড়েছিল আমার এই তুচ্ছ জীবনের 'প্রতিশোধ', তোমার মৃত্যুর সাথে আজ সেটাও শেষ হয়ে গেলো। আর কি নিয়ে বাঁচবো আমি? সারা জীবন করিথাসের মা তোমাকে ক্ষমা করতে পারেনি, কিন্তু আলেকজাণ্ডারের প্রেয়সী কিভাবে বাঁচাবে তার আলেকজাণ্ডার পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার পর? একটু একটু করে আগুনের আরোও সামনে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। একজন রাখাল চীৎকার করে উঠলো, "কি করছো ঈনন? অত কাছে যেয়োনা আগুনের। তুমিও তো পুড়ে যাবে শেষে?"
সেটাই তো চাই আমি, আমার ভালোবাসার আর ঘৃণার মানুষটার বিদায় নেবার সাথে আমার জীবনেরও যে সব উদ্দেশ্য শেষ হয়ে গেছে। আমার করিও বিদায় নিয়েছে, আর আজ বিদায় নিচ্ছে আমার জীবন পথের ভালবাসা ও ঘৃণা দুইয়েরই এই ধ্রুবতারা। আর কি লাভ আমার বেঁচে থেকে? আর চিন্তা করিসনা করি, এই দ্যাখনা তোর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আমি চলে আসছি তোর কাছে, এই নিষ্ঠুর জগৎ যে সংসারকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলো, তাকে আবার আমরা তিনজন মিলে জোড়া লাগাবো ওই অমরত্বের জগতে।
বিনা সংকোচে আমার আলেকজান্ডারের চিতায় হাসিমুখে ঝাঁপ দিলাম আমি। দেবতা হিফাস্টাস দয়া করুন আমায়। এবার এই জগৎ ছেড়ে আমার জীবনের সবথেকে প্রিয় দুটি মানুষের কাছে যাবার পথের দিশারী হন তিনি আমার। বিদায় মাতা রিয়া, তোমার এই তুচ্ছা উপাসিকা এই পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগে তোমাকে জানায় তার অন্তিম প্রণাম।
0 comments: