2

সম্পাদকীয়

Posted in



সম্পাদকীয়


আমরা শুনি, সব কিসু ব্যাদে আসে। অর্থাৎ, প্রশ্নহীন আনুগত্য, অচলায়তনের সাধনা এবং বেদ সমার্থক। কারণ? বেদ অপৌরুষেয়। খোদ ভগবানের বাণীকে প্রতিধ্বনিত করেছেন দ্রষ্টা ঋষিরা। 

আমরা বলি, এর চেয়ে অপব্যাখ্যা আর কিছু হতে পারে না। কারণ অপৌরুষেয় কথার অর্থ হলো নিজের তুচ্ছ ব্যক্তিত্ব ছাপিয়ে যাওয়া। ছোট 'আমি'কে ছাড়িয়ে এক অমৃতময় বিশাল 'আমি'র সঙ্গে এক হওয়া। শিল্পী, কবি, সঙ্গীতসাধক, অধ্যাত্মসাধক, সকলেই নিজের মত করে অপৌরুষেয়কে প্রকাশ করতে পারেন সাধনায় সিদ্ধিলাভের পর। তখন তাঁরা এই সীমাবদ্ধ পৃথিবীর মধ্যে, সীমায়িত জীবনের সমস্ত স্খলন, গ্লানি, ত্রুটি, কুশ্রীতা, যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে চলতে চলতে অসীমের আপন সুর শোনেন। সেই অনন্ত, অপারকে নিজের মধ্যে প্রকাশিত হতে দেখেন। 

তে ইদ্ দেবানাং সধমাদ আসন্। 
ঋতাবানঃ কবয়ঃ পূর্বাস্যঃ।। 

পূর্ব কবিরা ছিলেন ঋতবান্, সৃষ্টির মূল সুরের দোহার, দেবতারা তাঁদের আনন্দসখা। এঁরা আমাদের পিতৃপুরুষ। এঁদের উচ্চারিত বাক্-এর অমোঘ ঋতরূপকে উচ্চারণ করতে চায় ঋতবাক। ঋতবাক ছুঁতে চায় মানুষের মধ্যের অগ্নিকে। রক্ষা করতে চায় তাকে। সে বারংবার বলে, অগ্নিমীড়ে পুরোহিতম্। ঋতবাক বিশ্বাস করে একজন কবি লেখক তখনই সার্থক হন যখন তিনি সত্যমন্ত্র। আর একমাত্র এই সত্যেরই কাছে সে দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতার জন্য ঋতবাক মূল্য দিতেও প্রস্তুত। তার আপনজনে ছাড়লে তাকে সে বলে ভাবনা করা চলবে না। বন্ধ দুয়ার যদি বারে বারে ঠেলেও না খোলে তবু সে হার মানবে না। আড়াল সরিয়ে সরিয়ে সে খুঁজবে সত্যকে - যাকে অন্ধকার ঢেকে রাখে, আর ঢেকে রাখে আলোও! 

ঋতেন ঋতম্ অপিহিতিং ধ্রুবং বাম্  

ঋত দিয়ে ঢাকা আছে মহাঋত। তার সমস্ত স্বজন, শুভৈষী, সমপ্রাণ সখাদের সঙ্গে নিয়ে ঋতবাকের যাত্রা সেই সুদূরের দিকে যেখানে বাণীর ধারা হৃদয় সমুদ্র থেকে সতত উৎসারিত হয়। ঋষি কবির সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে তাই সে বলতে চায়: 

এতা অর্ষন্তি হৃদ্যাত্ সমুদ্রাত্ 
শতব্রজা রিপুণা নাবচক্ষে।
ঘৃতস্য ধারা অভি চাকশীমি
হিরণ্যয়ো বেতসো মধ্যে আসাম্ 

"একশো হয়ে আসছে ধেয়ে উজল রসের ধারা 
হৃৎ-পারাবার হতে আমার --- শত্রু কী তার জানে? 
মধ্যিখানে দুলছি আমি সোনার বেতস পারা 
চেয়ে চেয়ে দেখছি ওদের পানে।" [অনুবাদ : গৌরী ধর্মপাল]

শারদীয়ার প্রাক্কালে সমস্ত ঋতব্রতীকে ঋতবাকের আলোছোঁয়া শুভেচ্ছা। সকলে সুস্থ থাকুন, স্বস্থ থাকুন, সত্যকে ধারণ করে রাখুন।।




ঋণস্বীকার - সুহোত্র

2 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যের 
তিন বন্দ্যোপাধ্যায় : জীবন ও সাহিত্য

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় 

নিবন্ধটির শিরোনামের যাথার্থ্য সম্পর্কে পাঠকের প্রশ্ন থাকতে পারে, কেননা এই নিবন্ধে যে তিনজনের জীবন ও সাহিত্যভাবনার সূত্রগুলি বুঝতে চেয়েছি, তাদের সকলেরই প্রতিষ্ঠা স্বাধীনতার অনেক আগেই। বলা ভালো এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায় – বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর ও মাণিক ১৯৩০ পরবর্তী বাংলা কথা সাহিত্যের অগ্রপুরুষ। তবু এমন শিরোনামের কারণ স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মের বাংলা কথা-সাহিত্যের কাছে আসা, তাদের পাঠাভ্যাসের নির্মাণ এদের সাহিত্য ঘিরেই। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ ১৯৪১এ, শরৎচন্দ্রও চলে গেছেন স্বাধীনতার নয় বৎসর আগেই। ততদিনে প্রবল আবির্ভাব হয়েছে বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

কর্মজীবনের প্রায় সবটাই স্কুলশিক্ষকতা করা বিভূতিভূষণ তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি ‘পথের পাচালি’ লিখলেন ১৯২৯এ। তার দু বছর পরে তারাশঙ্কর তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘুর্ণি’ লিখলেন ১৯৩১এ কারান্তরালে বসে, আর প্রায় একই সময়ে, ১৯২৮এ মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ আলোড়ন তুলেছে বাংলা সাহিত্য অনুরাগী মহলে। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের পর বাংলা সাহিত্যে যথার্থ উপন্যাস পাওয়া গেলো বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ তে। স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম প্রজন্মের আমরা কথাসাহিত্য পাঠ শুরু করলাম এদের দিয়েই।

বিভূতিভূষণের জন্ম হালিশহরের মুরারিপুকুর গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে ১৮৯৪এর ১২ই সেপ্টেম্বর। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা মৃণালিনী দেবী। বনগ্রাম হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার রিপন কলেজ (এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে স্নাতক হন। ১৯১৮য় ২৪ বছর বয়সে বিবাহ হয় শ্রীমতী গৌরী দেবীর সঙ্গে। মাত্র একবছর পরে গৌরী দেবীর অকাল বিয়োগ হয়। গৌরীর অকাল বিয়োগ তাঁর মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। তারপর দীর্ঘ চব্বিশ বছর বিপত্নিক জীবন যাপনের পর সাতচল্লিশ বছর বয়সে পুনর্বিবাহ করেন শ্রীমতী রমাকে। তার শেষজীবনের নিবাস শাল-পিয়ালের জঙ্গল ঘেরা ঘাটশিলার বাসভবনটি উৎসর্গ করেছিলেন প্রথমা পত্নীকে ‘গৌরীকুঞ্জ’ নামকরণ করে। নিজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা আরণ্যকও উৎসর্গ করেছিলেন গৌরী দেবীর স্মৃতিতে।

বিভূতিভূষণের সাহিত্যজীবন মাত্র একুশ বছরের। ১৯২১শে প্রবাসী পত্রিকায় ‘উপেক্ষিতা’নামে একটি গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যজীবনের সূচনা। ১৯২৫এ শুরু করেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘পথের পাচালি’র রচনা, তখন তিনি ভাগলপুরে কর্মরত। শেষ রচনা, উপন্যাস ‘দম্পতি’ তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় ১৯৫২তে। একুশ বছরের নাতিদীর্ঘ সাহিত্যজীবনে বিভূতিভূষণের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখা ৫৪টি যার মধ্যে ১০টি উপন্যাস, ২৫টি গল্পসংকলন, ও ৬টি কিশোরপাঠ্য রচনা। এছাড়াও ভ্রমণ কাহিনী, দিনলিপি ও অন্য রচনার সংখ্যা ১৩টি। অপু-কাহিনী ‘পথের পাঁচালি’ বিভূতিভূষণের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি, সংশয় নেই। এর পরেই রাখতে হবে তাঁর অনন্য সৃষ্টি ‘আরণ্যক’ (১৯৪৫)কে। প্রকৃতি প্রেমি বিভূতিভূষণ অরণ্যক লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন ভাগলপুরে কর্মরত থাকাকালীন। ‘স্মৃতির রেখা’ দিনলিপিতে ১৯২৮এর ১২ই ফেব্রুয়ারি লিখেছিলেন – “এই জঙ্গলের জীবন নিয়ে একটা কিছু লিখবো - একটা কঠিন শৌর্যপূর্ণ, গতিশীল, ব্রাত্য জীবনের ছবি। এই বন, নির্জনতা, ঘোড়ায় চড়া, পথ হারানো অন্ধকার - এই নির্জনে জঙ্গলের মধ্যে খুপরি বেঁধে থাকা। মাঝে মাঝে, যেমন আজ গভীর বনের নির্জনতা ভেদ করে যে শুড়ি পথটা ভিটে-টোলার বাথানের দিকে চলে গিয়েছে দেখা গেল, ঐ রকম শুড়ি পথ এক বাথান থেকে আর এক বাথানে যাচ্চে - পথ হারানো, রাত্রের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে ঘোড়া করে ঘোরা, এদেশের লোকের দারিদ্র, সরলতা, এই virile, active life, এই সন্ধ্যায় অন্ধকারে ভরা গভীর বন ঝাউবনের ছবি এই সব।...” 

আরণ্যক উপন্যাসটির বিরাট একটি অংশ জুড়ে আছে প্রকৃতি। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস থেকে এর স্বাতন্ত্র্য একাধিক। অন্য উপন্যাসগুলোতে প্রায় বাংলার শান্ত মধুর প্রাকৃতির রূপই স্থান পেয়েছে। ‘আরণ্যক’ পূর্ণিয়া ভাগলপুরের এক গভীর অরণ্য প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে এক অপরিচিত অরণ্য সমাজের খণ্ড খণ্ড জীবন চিত্র, বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণে সে জীবন শুধু অপূর্বই নয়, রহস্যময়ও বটে। প্রকৃতির সঙ্গে মানব মনের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বিধৃত হয়েছে ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে। 

‘পথের পাঁচালি’, অপরাজিত, আরণ্যক ছাড়া বিভূতিভূষণের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রচনা হ’ল – ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ (১৯৪০), ‘অভিযাত্রিক’ (ভ্রমণ/১৯৪০) ‘অনুবর্তন’ (১৯৪২), ‘দৃষ্টি প্রদীপ’ (১৯৪২), দেবযান’(১৯৫১), ‘কেদার রাজা’(১৯৪৫), ‘চাঁদের পাহাড়’ (কিশোর উপন্যাস / ১৯৪৮), ‘ইছামতী’(১৯৫০), ও ‘অশনি সংকেত’। 

গত শতকের ত্রিশের দশকে ‘কল্লোল’ ও ‘কালিকম’ গোষ্ঠী বাংলা সাহিত্যে নতুনতর ভাবনার সূত্রপাত করেছিল। তারাশঙ্কর, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখের সাহিত্যভাবনার প্রস্তুতি । বিভূতিভূষণ সযত্নে কল্লোল, কালিকলমের ভুমিকা থেকে দূরে থাকলেন। তিনি রসদ সংগ্রহ করলেন তারা-ভরা আকাশ, দিগন্ত-বিস্তৃত সবুজ, মেঘ, জ্যোৎস্না অন্ধকারের রহস্য আর অরণ্যের আহ্বান থেকে। মানুষকে তিনি দেখেন তার জটিলতাহীন এক অসহায় মূর্তিতে। যৌবনের চাঞ্চল্য,উচ্চাশার সংঘাত, সমাজবন্ধনের জটিলতা তিনি পাশে সরিয়ে রেখে মানুষের রূপমূর্তিটি ধরতে চেয়েছেন। এইজন্য একদিকে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সুনিবিড় আত্মীয়তা, প্রকৃতির কোলে মানুষের চির অসহায় বন্ধন; অপরদিকে মানুষের জীবনযাত্রার করুণ ও বেদনাময় জগতের ছবি আশ্চর্য নিপুনতায় এঁকেছেন বিভূতিভূষণ। পল্লীবাংলার অনাড়ম্বর জীবন ও গ্রাম্য প্রকৃতির স্নেহনিবিড় স্পর্শ তাঁর সাহিত্য সৃজনে। সাহিত্য ও জীবনের নিবিড় নৈকট্য বিভূতিভূষণে। 

গ্রামীণ বাংলার জীবন-ছবি তারাশঙ্করেও আছে। বিভূতিভূষণ যখন ভাগলপুরে পথের পাঁচালি লিখছেন, তারাশঙ্কর তখন জাতীয় কংগ্রেসে গান্ধীবাদে বিশ্বাসী অসহযোগ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। অসহযোগ আন্দোলনে ধৃত তারাশঙ্কর তাঁর ‘চৈতালী ঘূর্ণী’ লিখলেন কারান্তরালে বসে। 

স্বল্পায়ু বিভতিভূষণ চলে যান ১৯৫০এ (১লা নভেম্বর)। আরও স্বল্পায়ু মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও চলে যান ৪৮ বছর বয়সে। তারাশঙ্কর ছিলেন আরও বেশ কিছুদিন – মধ্য একাত্তর পর্যন্ত। সুতরাং, স্বাধীনতা-উত্তর কালে আমাদের সমাজের অনেক ভাঙ্গা-গড়া প্রত্যক্ষ করেছেন, দেখেছেন বাংলা ভাষা ভিত্তিক এক নতুন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্খা ও প্রস্তুতিও।

রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ প্রার্থী হয়ে তারাশঙ্কর গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। কবির সঙ্গে তাঁর আলাপের কিছু অংশ এইরকম – 

রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন শুরু করলেন “কি করো?

বললাম – করার মত কিছুতেই মন লাগেনি। চাকরীতেও না, বিষয় কাজেও না ; কিছুদিন দেশের কাজ করেছি। কিছুদিন দেশ সেবা করেছি।

অর্থাৎ জেল খেটেছো?

হ্যাঁ

ও পাক থেকে ছাড়ান পেয়েছো?

জানি না, তবে এখন ভাবি পেয়েছি।

সেইটে সত্য হোক। তা হ’লে তোমার হবে। তুমি দেখেছো অনেক। এত দেখলে কি করে?

কিছুদিন সমাজ সেবার কাজ করেছি। আর কিছুদিন বিষয়-কর্ম করেছি। সামান্য জমিদারী আছে। ঐ দুই উপলক্ষে গাঁয়ে গাঁয়ে অনেক ঘুরেছি, লোকের সঙ্গে অনেক মিশেছি, কারবারও করেছি।

সেটা সত্য হয়েছে তোমার। তুমি গাঁয়ের কথা লিখেছ, খুব ঠিক লিখেছ। তোমার মত গাঁয়ের মানুষের কথা আগে আমি পড়িনি। ...তুমি দেখেছ। আমি তো দেখার সুযোগ পাইনি। তোমরা আমাকে দেখতে দাওনি। আমাদের তো পতিত করে রেখেছিলে তোমরা। ...দেখবে – দু চোখ ভরে দেখবে। দূরে দাঁড়িয়ে নয়। কাছে গিয়ে পাশে বসে তাদের একজন হয়ে যাবে। সে শক্তি ও শিক্ষা তোমার আছে”। ...[‘আমার সাহিত্য জীবন’ গ্রন্থ থেকে]।

কথোপকথনের এই ক’টি পংক্তিতেই আমরা বুঝতে পারি কথাশিল্পী তারাশঙ্করের সাহিত্যভাবনার মূল সূত্রগুলি। তাঁর ‘রাইকমল’ গল্পটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে লিখেছিলেন - “গল্প লিখতে বসে যারা গল্প না লেখার ভাণ করে, তুমি যে তাদের দলে নাম লেখাওনি, এতেই আমি খুশি হয়েছি”। 

জন্ম ১৮৯৮এর ২৩শে জুলাই বীরভুম জেলার লাভপুর গ্রামে। পিতা হরিদাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা প্রভাবতী দেবী। ১৯১৬তে লাভপুর থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করে সাউথ সুবার্বন কলেজে (এখন যার নাম আশুতোষ কলেজ) ইন্টারমিডিয়েট পড়া শুরু করেন। কিন্তু বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। রাজনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার কারণে কলেজ শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায় তারাশঙ্করের। ১৯২৯তে গান্ধীজির আহবানে অসহযোগ আন্দোলনে সক্রীয়ভাবে অংশগ্রণ করেন এবং গান্ধীবাদে বিশ্বাসী হয়ে কংগ্রেসের নিষ্ঠাবান কর্মী হয়ে ওঠেন। আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯৩০এ কারারুদ্ধ হন কয়েক মাস। কারান্তরালে থাকাকালীন লেখেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’। কারাগারে থাকাকালীনই তখনকার কংগ্রেসী রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর মোহভঙ্গ ঘটে। তাঁর নিজের কথায় “তখন জেলখানায় রাজনীতি-সর্বস্ব মানুষের চেহারা দেখে ভবিষৎ ভাবনায় শঙ্কিত হয়েছি; চিত্ত ভারাক্রান্ত হয়ে তখন রাজনীতির দিকে চিত্ত সম্পূর্ণ রূপে বিমুখ হয়েছে”। এই সময় থেকেই তারাশঙ্কর নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করলেন সাহিত্য কর্মে, মানবজীবনের বিশাল রূপ কথাসাহিত্যে ফুটিয়ে তোলাই তাঁর ব্রত হ’ল। মুমূর্ষু সামন্ততান্ত্রিক ব্যক্তি, জীবন ও সমাজ অপরূপ করুণা ও মমতায় চিত্রিত তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ও গল্পগুলিতে। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র তাঁর অনেক গল্প ও উপন্যাসের বিষয়। যেখানে আছে গ্রাম জীবনের ভাঙ্গন ও উদীয়মান নগরজীবনের দ্বন্দ্ব।

বীরভুম অঞ্চলের অতি সাধারণ ও নিম্নবর্গের মানুষজন – বেদিয়া, বাজিকর, সাঁওতাল, আউল-বাউল, বৈষ্ণব, বাগদি, বাউড়ি, ডোম, গ্রাম্য কবিয়াল, তান্ত্রিক, প্রভৃতিদের দেখেছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে। তাদের জীবনচিত্র এঁকেছেন ‘রাইকমল’, ‘কবি’, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘গণদেবতা’, ‘হাসুলি বাঁকের উপকথা’, প্রভৃতি উপন্যাসে। 

বিপুল তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি। লিখেছেন ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্প সংকলন, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধ সংগ্রহ, ৪টি আত্মজীবনী এবং ২টি ভ্রমণ কাহিনী। তারাশঙ্করের কালজয়ী লেখাগুলির কয়েকটি মাত্র – চৈতালী ঘুর্ণী (১৯৩১), নীলকন্ঠ (১৯৩৩), রাইকমল (১৯৩৪), জলসাঘর (১৯৩৭), আগুন (১৯৩৭), রসকলি (১৯৩৮), ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯), কালিন্দী (১৯৪০), গণদেবতা (১৯৪২), কবি (১৯৪৪), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪), হারানো সুর (১৯৪৬), ডাকহরকরা (১৯৪৬), অভিযান (১০৪৬), হাসুলিবাঁকের উপকথা(১৯৫১), আরোগ্য নিকেতন (১৯৫৩)‌, পঞ্চপুত্তলী (১৯৫৬), সপ্তপদী (১৯৫৭), ডাকহরকরা (১৯৫৮), রাধা (১৯৫৮)।

ধর্মশাস্ত্রের অবাধ অনুশীলন ও ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে তারাশঙ্করের মানস গঠিত হয়েছিল। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবাদে তাঁর সামাজিক অভিজ্ঞতা, ভারতবোধ, অর্থনৈতিক সম্পর্কের জটিলতা, জমিদারতন্ত্রের অবক্ষয়, ও সমাজের নানান ভাঙা-গড়ার ছবি তাঁর উপন্যাস গল্পে। 

স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে ১৯৭১এ প্রয়াণ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রধান মুখ। 

মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাস, গল্পে সমাজ বাস্তবতার ছবি লিখলেন এক নতুনতর আঙ্গিকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে পৃথিবী জুড়ে মানবিকতা ও মূল্যবোধের চরম সংকট সময়ে বাংলা কথা সাহিত্যে নতুনতর ধারার সূচনা হয়েছিল যাঁদের লেখনিতে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদেরই একজন। 

জন্ম এখনকার ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে। পৈত্রিক নিবাস ঢাকার বিক্রমপুরে। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা নীরদাসুন্দরী। পিতার ঢাকার সেটলমেন্ট বিভাগে কর্মের সুবাদে বাংলা ও বিহারের নানা স্থানে বদলি হতে হতো আর সেই সূত্রে মানিকের শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলা ও বিহারের নানান স্থানে। কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনে স্কুল শিক্ষা শুরু করে কয়েক বছর টাঙ্গাইলে স্কুলে ভর্তি হন, সেখান থেকে আবার কাঁথির মডেল স্কুল হয়ে শেষ পর্যন্ত মেদিনীপুর জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। কলেজ শিক্ষা সম্পূর্ণ না করে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন পুরোপুরি সাহিত্যসেবায়।

সাহিত্যজীবনের প্রথম পর্বে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় ফ্রয়েডীয় দর্শনে প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রথম পর্বের লেখাগুলিতে তার ছায়াপাত ঘটেছে। বাংলা ভাষাও সাহিত্যের প্রাজ্ঞ অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত মন্তব্য করেছেন “ফ্রয়েডীয় মনস্তত্বকে তিনিই যথার্থ জীবনবোধের সঙ্গে যুক্ত করিয়া বাঙালি দরিদ্র, মধ্যবিত্ত এবং ধনী সমাজের নানা পরিপ্রেক্ষায় রূপদান করিয়াছেন। এই কারণে মাণিকের উপন্যাস বাস্তবধর্মী হইলেও সাময়িকতা দ্বারা খণ্ডিত নয়”। (ভারতকোষ – ৫ম খণ্ড)। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলে মার্কসবাদী জীবনদর্শনে।

শ্রমজীবি নীচুতলার মানুষ ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন সংগ্রাম ছিল মার্ক্সীয় তত্ত্বে গভীরভাবে প্রভাবিত এই কথাসাহিত্যিকের লেখার বিষয়বস্তু। মাত্র ৪৮বছরের জীবনকাল ছিল মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এই স্বল্পায়ু জীবনেই রচনা করেছেন বিয়াল্লিশটি উপন্যাস ও দুই শতাধিক ছোট গল্প। তাঁর উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘স্বাধীনতার স্বাদ’, ছোট বকুলপুরের যাত্রী(গল্প), প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এবং একটি প্রবন্ধ সংকলন, একটি নাটক আর মৃত্যুর অনেক পরে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি কাব্য সংকলন ‘মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা’। মানব জীবনযন্ত্রণার গভীরতর অনুভব আর নিচুতলার মানুষের মধ্যে জীবনের সত্য-প্রতীতির অন্বেষণ তাঁর সাহিত্য পরিক্রমায়। রাজনৈতিক সচেতনতা যে শিল্পের উৎকর্ষ হ্রাস পায় না, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ও গল্পগুলি তারই নিদর্শন। 

মাণিকের কবি পরিচয় আমরা জেনেছি তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে। অথচ, কবি মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স ঔপন্যাসিক মাণিক বন্দ্যোপাধায়ের মতই। জীবদ্দশায় কিছু কবিতা বিক্ষিপ্তভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। বহু কবিতাই আবদ্ধ ছিল তার রেখে যাওয়া দুটি খাতায়। একটি ১৯২৪ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত সময়কালে রচিত, আর একটি খাতায় ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত সময়কালে রচিত কবিতা। মৃত্যুর ১৪বছর পরে সেই দুটি খাতা উদ্ধার করে ৬৪টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্য সংকলন ‘মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা’। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে গিয়েছেন, “আমার বিজ্ঞানপ্রীতি, জাত-বৈজ্ঞানিকের কেন-ধর্মী জীবন জিজ্ঞাসা, ছাত্রবয়সেই লেখকের দায়িত্বকে অবিশ্বাস্য গুরুত্ব দিয়ে ছিনিমিনি লেখা থেকে বিরত থাকা প্রভৃতি কতগুলি লক্ষণে ছিল সুস্পষ্ট নির্দেশ যে সাধ করলে আমি কবি হতেও পারি; কিন্তু ঔপন্যাসিক হওয়াটাই আমার পক্ষে হবে উচিত ও স্বাভাবিক |”

মার্কসবাদী জীবনদর্শনে বিশ্বাসী মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের সাংগঠনিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন, যুক্ত হন ‘ফ্যাসি বিরোধী লেখক সঙ্ঘ’ ও প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘে’র সঙ্গে। ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য পদ গ্রহণ করেন ১৯৪৪এ। দারিদ্র ও অনটন ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী, যা ১৯৫০এর দশকে চরম আকার নেয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ আর্থিক সাহায্যের আবেদনে সাড়া দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় মাসিক ১০০টাকার পেনশন ভাতার ব্যবস্থা করেন ও চিকিৎসার জন্য এককালীন ১২০০টাকা মঞ্জুর করেন। ১৯৫৬র ৩রা ডিসেম্বর কলকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতালে জীবনাবসান হয় রবীন্দ্রোত্তর কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাত্র ৪৮ বছর বয়সে। 

স্বাধীনতা-উত্তর কালে বাংলাসাহিত্যের বিপুল বৈচিত্রে অনেক কালজয়ী উপন্যাসে বাঙালির সমাজ-জীবনের অনেক ওঠা-নামা, ভাঙ্গা-গড়ার ছবি লিখেছেন বনফুল, বিমল কর, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সতীনাথ ভাদুড়ী, সমরেশ বসু, প্রমুখ। তথাপি ১৯৫০এর দশকের শেষ পর্যন্ত বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্কর-মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই ত্রয়ীর কাজই ছিল বাংলাসাহিত্যের প্রধান মুখ হয়ে ওঠা।



[তথ্যসূত্র : ভারতকোষ (৫ম খণ্ড), ‘আমার সাহিত্যজীবন’ – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বিংশ শতাব্দীর বাংলা উপন্যাসে বাস্তব’ – সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় (বাংলা আকাডেমি পত্রিকা-১১), ‘ইতিকথা ও পরের কথা : মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস্তববাদী শৈলী’ – মালিনী ভট্টাচার্য, বাংলা আকাডেমি পত্রিকা ১৩ ও কালোত্তীর্ণ শিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহম্মদ আসাদ – দৈনিক সংগ্রাম, ঢাকা]










0 comments:

0

প্রবন্ধ - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ



কীভাবে শেক্‌স্‌পিয়র প­­­­­­ড়তে নেই
রাজা লিয়র প্রসঙ্গে এ.সি.ব্র্যাডলি ও কেনেথ মিউওর

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য



রাজা লিয়রকে অনেকেই মনে করেন শেক্‌স্‌পিয়র-এর মহত্তম রচনা, তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক। বিশিষ্ঠ সাহিত্য-সমালোচক অ্যানড্রু সিসিল ব্র্যাডলি (১৮৫১ – ১৯৩৫)-র কিন্তু মনে হয়েছিল এর প্রথম কথাটি ঠিক, দ্বিতীয়টি নয়।১. নাটক হিসেবে যখন তিনি রাজা লিয়র-এর বিচার করেন, তাঁর মনে হয় : কয়েকটি অঙ্কে দুর্ধর্ষ হলেও, সামগ্রিকভাবের হ্যামলেট, ওথেলো আর ম্যাকবেথ-এর তুলনায় এটি নিশ্চিতভাবে খাটো। কিন্তু শেক্‌স্‌পিয়র-এর মহত্তম কীর্তি হিসেবে যখন তিনি রাজা লিয়রকে দেখেন, তখন নাটকটিকে তিনি রাখেন ইস্কাইলাস-এর বদ্ধ প্রমিথিউস আর দান্তে-র দিব্যাভিসার-এর দলে; এমন কি বেটোফেন-এর মহত্তম সব সিম্ফনি আর মেদিচি উপাসনালয়ের মূর্তিগুলির পাশাপাশি।২.

ব্রাডলি-র এমন মনে করার কারণ কী? আসলে গড়নের দিক থেকে রাজা লিয়র-এর বেশ কয়েকটি অসঙ্গতি তাকে বড়ই পীড়া দিয়েছিল। শেক্‌স্‌পিয়র-এর মহত্তম রচনায় সেগুলি যেন চাঁদের কলঙ্কর মতো। ব্র্যাডলি মনে করতেন : নাটক হিসেবে শেক্‌স্‌পিয়র-এর ট্র্যাজেডিগুলির মধ্যে ওথেলো-ই সবচেয়ে নিখুঁত।৩. সে তুলনায় রাজা লিয়র-এ অসঙ্গতির মাত্রা বড্ড বেশি। তার কয়েকটি নমুনাও তিনি দিয়েছেন।৪.

‘ব্র্যাডলি’-র এমন নটি ‘বিমূঢ়তা’-র সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েছিলানে আরএক শেক্‌স্‌পিয়র বিশেষজ্ঞ, কেনেথ মিউওর (১৯০৭-৯৬)।৫. যেমন,(১) এডগার কেন মুখ বুজে তার বাবাকে এড়িয়ে চলে (মিউঅর-এর উত্তর : কারণ এডমন্ড তাকে বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছে যে তার (এডগার-এর) জীবন বিপন্ন।) (২) লিয়র বলেন পঞ্চাশজন সহচর ছাঁটাই করার কথা, যদিও গনেরিল কোনো সংখ্যা উল্লেখ করেন নি। (মঞ্চ থেকে তাঁর স্বল্পকালীন অনুপস্থিতির সময় লিয়র শুনে থাকবেন যে তাঁর সঙ্গে ঐ ব্যাপারে পরামর্শ করার আগেই গনেরিল সহচরদের অর্ধেক ছাঁটাই করে দিয়েছিলেন; বা হয়তো লিয়র অতীন্দ্রিয় ভাবসংযোগ (টেলিপ্যাথি) করতে পারেন।)

এই ধরণের সওয়াল আর সেগুলির জবাব পড়তে পড়তে মনে হয়: মিউঅর কি ঠাট্টা করছেন, নাকি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই এমন জবাব দেওয়া? পরের একটি সওয়াল জবাব থেকে প্রথম সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে হয়। ব্র্যাডলি-র প্রশ্ন ছিল: ভাঁড় (ফুল)-এর নিয়তি সম্পর্কে আমাদের জানাতে শেক্‌স্‌পিয়র কেন অবহেলা করলেন? মিউঅর-এর উত্তরে তাচ্ছিল্যই প্রকাশ পায় : ‘বিশেষ কোনো কারণ নেই, একমাত্র উপন্যাস-পাঠকদের অনিবারণীয় কৌতূহল ছাড়া, কেন আমাদের তা বলা উচিত। যখন তার আর কোনো দরকার নেই, পেশাদার ভাঁড় মিলিয়ে যাবে এমনটাই যথাযথ।’

তিনটি ব্যাপারে মিউঅর অবশ্য স্বীকার করেছেন : শেক্‌স্‌পিয়র কিছু কিছু তুচ্ছ অসঙ্গতির দোষে দোষী। কিন্তু তাঁর পরিস্কার বক্তব্য : মঞ্চে অভিনয়ের সময়ে কেউ এগুলো নজর করবে না। তিনি অবশ্য ব্র্যাডলি-র ঐ তিনতি প্রশ্নরও উত্তর দিয়েছিলেন, সেগুলিও কিন্তু হালকা চালে। যেমন, অঙ্ক ৪ দৃশ্য ৩-এ কর্ডেলিআ-কে পাঠানো একটি চিঠির উল্লেখ করেছেন ব্র্যাডলি, যদিও বার্তাটি মৌখিক (অঙ্ক ৩, দৃশ্য ১ দ্র.)। মিউঅর-এর জবাব : কেন্ট হয়তো একটি চিঠি ও তারই সঙ্গে মৌখিক বার্তাও পাঠিয়েছিলেন, বা শেক্‌স্‌পিয়র হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন বা আশা করেছিলেন যে তাঁর দর্শকরা ভুলে গেছেন। 

আর একটি প্রশ্ন-উত্তর একই ধরণের। ঝড়ের মধ্যে রাজাকে খুঁজে পেয়ে কেন্ট কেন ‘হালূ’ বলে ওঠেননি? জবাব : অভিনেতা ‘হালূ’ আওয়াজটি যোগ করে দিতেন, অথবা রাজার দুরবস্থা দেখে কেন্ট সেই ব্যবস্থার কথা ভুলে গিয়েছিলেন।

আসলে মিউঅর যাকে বলেছেন ‘উপন্যাস পাঠকদের অনিবারণীয় কৌতূহল’ সেটিই সারকথা। ব্র্যাডলি-র মনে ঐসব প্রশ্ন উঠেছিল একই জাতের কৌতূহল থেকে। উনিশ শতকের আগের কোনো দর্শক/পাঠক নাটকে ছোটো-বড় নানা অসঙ্গতি নিয়ে বিচলিত হতেন না, এগুলো তাঁদের নজরেই পড়ত না। সাহিত্যে, শিল্পে আর সেই সঙ্গে দর্শকদের/পাঠকদের মনে বাস্তববাদ ঘাঁটি গাড়ার পরে এইসব ফ্যাচাং দেখা দিল। এখনকার দর্শক/পাঠক চান ঘটনার পরিপূর্ণ সঙ্গতি, আগের কোনো দৃশ্যে যা বলা হয়েছে পরের কোনো দৃশ্যে বিনা নোটিশে যেন তার অন্যথা না হয়। ব্র্যাডলি তাই প্রশ্ন তোলেন (প্রশ্ন নং ৯) : অঙ্ক ৩, দৃশ্য ১এ কথা দেওয়ার পরেও কর্ডেলিআ কেন জনৈক ভদ্রলোকের কাছে কেন্ট-এর পরিচয় দেন না ? মিউঅর-এর জবাবটি বেশ মজাদার : শেক্‌স্‌পিয়র বোধহয় মত বদলেছিলেন।

বাস্তববাদী নাটকে আকৈশোর অভ্যস্ত দর্শক/পাঠক যদি সেই মন নিয়েই শেক্‌স্‌পিয়র-এর নাটক দেখতে/পড়তে যান, গোড়াতেই তিনি একটি বিরাট ভুল করবেন। শেক্‌স্‌পিয়র নাটক লিখেছিলেন এমন যুগে – ষোলো শতকের শেষ আর সতেরো শতকের শুরু – যখন ‘বাস্তববাদ’ বলে কোনো ধারণার জন্মই হয় নি।৬. তখনকার নাট্যকার ও প্রযোজক আর দর্শকমন্ডলী আখ্যান (প্লট) ও সংলাপের সঙ্গতি, সাযুজ্য ইত্যাদির পরোয়া করতেন না। সফোক্লেস (--পাঁচ শতক) থেকে শেক্‌স্‌পিয়র সকলের নাটকেই কমবেশি অসঙ্গতি ও বিচ্যুতি খুঁজে বার করা সহজ।৭ কোনো কোনো দর্শক/পাঠক এই খোঁজের নেশায় মজে যান। নাটকের গুণাগুণ বিচারের চেয়ে মেতে ওঠেন ভুলচুক বার করার আনন্দে। 

একা ব্র্যাডলি নন, আরও অনেকেই গল্পের অসঙ্গতিকেই বড় করে দেখেন। কারুর কাছে যদি সেই দেখাকে ‘অযথা’ মনে হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই ; নাটক কেন, সাহিত্য পড়ার, পড়ানোর ও সমালোচনার রীতিনীতি কয়েক দশক অন্তর বদলায়। আগে যেসব প্রশ্ন খুবই ন্যায্য ও স্বাভাবিক বলে ধরা হতো, পরে সেগুলি গণ্য হয় অবান্তর ও বেদরকারি বলে। গত শতকের প্রথম ভাগে, এমনকি দ্বিতীয় ভাগের গোড়াতেও, শেক্‌স্‌পিয়র-এর নাটকের যাবতীয় সংস্করণে ভূমিকা ও টীকার ঝোঁক ছিল একদিকে। বিশ শতকের শেষ দশকে সে ঝোঁক আর এক থাকে নি। নাটকের পাঠ-এর বদলে হালে জোর পড়েছে প্রযোজনার দিকে। রাজা লিয়র-এর তিনটি আর্ডেন সংস্করণ দেখলেই তা ধরা পড়ে।৮.

সুগঠিত নাটক, যার ঘটনায়, সংলাপে কোনো অসঙ্গতি থাকবে না, তেমন রচনা ষোলো-সতেরো শতকের নাটকে প্রত্যাশা করাই বৃথা। যে যুগে যে মাপকাঠি অচল সে যুগে সেই মাপকাঠি ব্যবহার করলে লেখা ও লেখক – দুএর প্রতিই অবিচার করা হয়,দর্শক/পাঠকও ইচ্ছে করে নিজেকে বঞ্চিত করেন। শিল্প-সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে এটিও এক ধরণের কালব্যত্যয় দোষ।

আবার ব্র্যাডলি-র কথায় ফিরে আসি। ভুল প্রত্যাশার দরুন তিনি যে কী গভীর সঙ্কটে পড়েছিলেন সেটি ভেবে দেখার মতো। রাজা লিয়র পড়ে নিশ্চয়ই একবার নয়, বারবার সমস্ত অন্তর দিয়ে ব্র্যাডলি উপলব্ধি করেছিলেন : এটি শুধু এক মহানাটক নয়, বিশ্বসাহিত্যে মহত্তম শিল্পকৃতির একটি। কিন্তু সেই উপলব্ধি বাধা পাচ্ছিল এক সংস্কারের চাপে। সেটি হলো সুগঠিত নাটক-এর সংস্কার। এই সংস্কারকে গুরুত্ব দেওয়ার ফল হয় মারাত্মক। নাটকের বিষয়বস্তুর চেয়ে বড় হয়ে ওঠে তার আঙ্গিক। ব্র্যাডলি-র মতো সূক্ষ্ম সংবেদনশীল শেক্‌স্‌পিয়র অনুরাগীও আঙ্গিকের দিকটিতে এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে অন্তরের উপলব্ধিতেও তিনি স্বচ্ছন্দে সাড়া দিতে পারেন নি। শেক্‌স্‌পিয়র-এর যুগে নাট্যশালার সঙ্গে সংযুক্ত কেউই সুগঠিত নাটক-এর ধার ধারতেন না – এই সহজ সত্যটি তিনি মনে রাখেন নি। অথচ এইটুকু খেয়াল করলেই মনের যাবতীয়ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব তিনি এড়াতে পারতেন।

ব্যাপারটা একটু আশ্চর্য লাগে। সুগঠিত নাটক নামটি নতুন হলেও ধারণাটি প্রাচীন। আরিস্তোতলও (চার শতকে--) এমন নাটকেরই পক্ষপাতী ছিলেন। তবুও তিনি বলতে পেরেছিলেন : অন্য ব্যাপারে ঘাটতি থাকলেও ইউরিপিদেসকেই কবিদের ক্ষেত্রে ‘সবচেয়ে ট্রাজিক’ বলে ধরা হয়।৯. কোনো কোনো ভাষ্যকার অন্য কথা বললেও ঘটনা এই যে মঞ্চে ‘সবচেয়ে শক্তিশালী পরিণাম’ই নাটকের শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের আসল মাপকাঠি। নিজে মূলত আঙ্গিকবাদী হয়েও সফোক্লেস প্রমুখের চেয়ে ইউরিপিদেসকেই এই বিচারে জয়মুকুট পরিয়েছেন আরিস্তোতল।

অন্যদিকে, ব্র্যাডলি তাঁর সমস্ত বিচার-বিবেচনাকে বাঁধা রেখেছেন নাটকের ঘটনা ও চরিত্রের সঙ্গতির কাছে। অথচ ব্র্যাডলি আদৌ কেতাবি লোক ছিলেন না। তিনি শুধু নাটক পড়তেন না, নিয়মিত থিয়েটার দেখতে যেতেন, অভিনয় ও প্রযোজনা থেকে নাটকের পাঠ (টেকস্‌ট্‌) নিয়ে সিদ্ধান্ত করতেন।১০. নিজে আঙ্গিকবাদী হওয়া সত্ত্বেও মঞ্চসাফল্যেই আরিস্তোতল নাটক বিচারের মানদন্ড বলে স্বীকার করেছিলেন। : সেইটিই ব্র্যাডলি মানতে পারেন নি। তার জন্যেই এত গোল। 



টীকা :


১. ব্র্যাডলি ১৯৭৯. পৃ. ১৯৮।

২. ঐ, পৃ. ১৯৯।

৩. ঐ, পৃ. ২০০। 

৪. ঐ, পৃ. ২১০-১৩।

৫. মিউঅর ১৯৫২/১৯৬৫, ভূমিকা, পৃ. পঞ্চাশ টী ৩; ১৯৭২/১৯৮৭, পৃ. পঞ্চান্ন টী.৩। ব্র্যাডলি-র যাবতীয় আপত্তির উত্তর (বা উত্তরের নামে ঠাট্টা) এই টীকাতেই রয়েছে (যথাক্রমে পৃ. পঞ্চাশ-একান্ন আর পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্নয়)।

৬. ১৮৫০ এর দশকের আগে সাহিত্যের ক্ষেত্রে রিয়ালিজম শব্দটির চল ছিল না। হেমিংস সম্পা, পৃ. ৯, ১৬২, ১৭৯দ্র।

৭. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ২০০২-০৩ দ্র.।

৮. এর প্রথম দুটির সম্পাদক ছিলেন কেনেথ মিউওর (১৯৫২,১৯৭২), তৃতীয় পর্বর সম্পাদক আর.এ. ফোক্‌স্‌(১৯৯৭)। শুধু আর্ডেন সংস্করণ নয়, আন্যান্য সংস্করণের ক্ষেত্রেও এমন হেরফের চোখে পড়ে। 

৯. পোএটিক্‌স্‌ ১৩।৬, ১৪৫৩ক, ২৯-৩০। শিশির কুমার দাশ – অনু. পৃ.৩৬।

১০. জন রাসেল ব্রাউন-ই বোধহয় প্রথম এই ব্যাপারটি শেক্‌স্‌পিয়র পাঠকদের নজরে আনেন। (১৯৮৫, পৃ, তেরো, ২০০৭, পৃ.১)। ব্র্যাডলি-র বইটির তৃতীয় সংস্করণ নামে পালগ্রেভ থেকে যে বইটি বেরিয়েছে (১৯৯২) তাতেই ব্রাউন-এর একটি ভূমিকা আছে, কিন্তু ১৯৮৫-র ভূমিকার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই।

১১. কাব্যতত্ত্ব-র একাধিক অধ্যায়ে মঞ্চসাফল্যকেই নাটকের শেষ বিচার বলে ধরা হয়েছে। (যেমন, অধ্যায় ১৩, ১৭, ২৪ইঃ)। এছাড়া রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ১৯৯৮-৯৯ ও ২০০৮ দ্র.



রচনাপঞ্জী :



Aristotle : Poetics, Ed. D. W. Lucas. Oxford : Clarendon Press. 1988. --- ---- -Bhattacharya, Ramakrishna, Aristotle’s Attitude to Euripides : A Study, Journal of the Department of English, Calcutta University, 1998-99, pp. 7-13.

--. Aristotle’s Attitude to Spectacle and Melody, Yavanika, 2008, No. II, 95-101.

--. “Inconsistencies” in the Text of King Oedipus, Journal of the Department of English, Calcutta University, 2002-03, pp. 1-12.

Bradley, A.C. Shakespearean Tragedy (reprint of the second edition with of new introduction by John Russell Brown.) Houndmills & Longdon : Macmillan Education Limited, 1989.

Brown, John Russell. Introduction to Bradley (see above), 1985, reprinted 1989.

--. Introduction to Bradley (third edition), Houndmills & New York : Palgrave 1992.

--. A.C.Bradley on Shakespeare’s Tragedies. New York : Palgrave Macmillan,2007.

Foakes, R. A. (ed.), King Lear : Walton-on-Thames : Thomas Nelson & Sons, 1997.

Hemmings, F.W. (ed.) The Age of Realism, Harmondsworth : Penguin Books, 1974.

Muir, Kenneth (ed.) King Lear, London, Methuen, 1952/1965.

--. King Lear London: Routledge, 1972/1987.

শিশিরকুমার দাশ (অনু.)। কাব্যতত্ত্ব : আরিস্টটল। আশা প্রকাশনী, ১৯৭৭।



কৃতজ্ঞতাস্বীকার :

অমিতাভ ভট্টাচার্য, নয়না দে, সন্দীপন সেন ও সিদ্ধার্থ দত্ত।





0 comments:

1

প্রবন্ধ - শিবাংশু দে

Posted in


প্রবন্ধ


কবিরা খড়া বজার মেঁ
শিবাংশু দে



কবিরা খড়া বজার মেঁ, মাঁগে সবকা খ্যয়ের।
না কাহুসে দোস্তি, না কাহুসে ব্যয়ের।।

('বজার' মানে মানে এই সমাজবিশ্ব। কবির সেখানে দাঁড়িয়ে সবার মঙ্গল কামনা করছে। তার সঙ্গে কারও বন্ধুতা নেই, শত্রুতাও নেই কারও সঙ্গে।)

ছোটবেলায় পড়া কবিরের অনেক দোহার থেকে এই দোহাটি আলাদা করে মনে থেকে গিয়েছিলো। নির্গুণ ভূমাদর্শনের সব কথা এই কটা শব্দের মধ্যে ধরে ফেলা কবিরের পক্ষেই সম্ভব। বয়সের বিভিন্ন স্তরে এই শব্দনির্মাণটি বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।

প্রাতিষ্ঠানিক, লোকাচারনির্ভর ধর্মবিশ্বাসের অসারত্ব নিয়ে আমাদের সভ্যতায় ক্রমাগত চর্চা চলেছে গত তিন হাজার বছর। যদি আদি যুগের প্রথম প্রধান পুরুষ হিসেবে আমরা শাক্যমুনি বুদ্ধকে চিহ্নিত করি, তবে মধ্যযুগের প্রধান পুরুষ ছিলেন সন্ত কবির। যদিও জন্মসূত্রে বুদ্ধ ছিলেন আর্যসভ্যতার প্রতিভূ এক সামন্তপুত্র আর কবির, সমাজের প্রান্তিকতম নিম্নবর্গের একক একটি স্বরমাত্র। দুজনের জন্যই চ্যালেঞ্জ ছিলো মানুষের মৃত্যু হলেও শেষ পর্যন্ত যে মানব থেকে যায়, সেই তত্ত্বটিকে অবিসম্বাদে প্রমাণ করে যাওয়া। দুজনের মধ্যে কবিরের কাজটি বোধ হয় একটু বেশি কঠিন ছিলো। কারণ তাঁর ছিলো মূলতঃ সমন্বয়ের সাধনা। রাম, হরি, আল্লাহ, ব্রাহ্মণ-আত্মণ, উপনিষদ-বেদান্ত, নাথপন্থা, নির্গুণ ব্রহ্ম, অলখ নিরঞ্জন, সুফিবাদ, এমনকি শংকরের মোহমুদ্গর জাতীয় ( মায়া মরি না মন মরা/ মর মর গয়া শরীর।/ আশা তৃষ্ণা না মরি/ কহ গয়ে দাস কবির ।।) নানা পরস্পর বিচ্ছিন্ন মতবাদকে আত্মস্থ করে, বরণ আর বর্জনের ক্ষুরস্যধার পথে নিজের সাধনা আর লোকশিক্ষার পরম্পরা চালিয়ে যাওয়া। উপরন্তু আমাদের সভ্যতা ততোদিনে আরো হাজার দেড়েক বছর পেরিয়ে এসেছে। মধ্যযুগের 'এতো রক্ত কেন?' প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের বিবেক পর্যুদস্ত তখন। 

এই সময়টি নিয়ে একটু ভেবে দেখা যাক। দিল্লির সুলতান, বিখ্যাত বা কুখ্যাত তুর্কি মুহম্মদ বিন তুঘলক আর নেই। নিহত হয়েছেন ভাই ফিরোজ শাহ তুঘলকের হাতে। সেই ফিরোজ শাহ তুঘলকও মারা গেলেন ১৩৮৮ সালে। দিল্লির মসনদে প্রায় রোজ রাজাবদল। সীমান্তের ওপারে বহুদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলেন তুর্কো-মোঙ্গল যুদ্ধব্যবসায়ী তইমুর লংগ। ১৩৯৮ সালের শীতকালে তিনি আক্রমণ করলেন দিল্লি। তৎকালীন সুলতান মাহমুদ শাহ পালিয়ে বাঁচলেন। কিন্তু আট দিনের দিল্লি অবরোধে এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হলো এবং লুণ্ঠিত হলো সব সম্পদ। একজন মুসলিম শাসকের হাতে এতো মুসলিমের রক্তচিহ্ন বোধ হয় এদেশ প্রথম দেখেছিলো তখন। হিন্দু হিন্দুর সঙ্গে নেই, মুসলিম মুসলমানের সঙ্গে নেই। মানুষ মানুষের সঙ্গে নেই। ইতিহাসের ঘোর অন্ধকার পর্ব শুরু হয়েছিলো সেদিন। 

বারাণসি শহরের দক্ষিণে একটি প্রাচীন জলাশয় আছে। এই বিশাল সরোবরটির সঙ্গে কোনওকালে গঙ্গার যোগসূত্র ছিলো। নদীর মতো-ই এর জলে তরঙ্গ উঠতো এবং মানুষজনের কাছে এর পবিত্রতার খ্যাতিও শোনা যেতো। তরঙ্গকে হিন্দিতে বলে লহর, আর ফার্সিতে জলাশয়কে বলে তাল, হিন্দিতে তা হয়ে যায় তালাও। এই সরোবরটিকে লোকে বলতো লহরতাল, অপভ্রংশে লহরতারা। তার জলে ছিলো পদ্মবন আর শীতল শান্তি। আজকের বারাণসি রেল স্টেশন থেকে তিন কিমি মতো দক্ষিণে হবে। নদী গতিপথ পরিবর্তন করায় আজ গঙ্গার জল আর সেখানে পৌঁছোয়না। সরোবরের ব্যপ্তি আর নেই।

একজন মুসলিম তন্তুবায়, নাম আলি, ডাকনাম নিরু, বিয়ে করতে গিয়েছিলেন শহরের উপান্তে মান্দুর গাঁয়ে। এই মান্দুর আজকের মডুয়াডিহ। নতুন বৌ নীমাকে নিয়ে দ্বিরাগমন করতে যাবার সময় লহরতালের ধারে একটি সদ্যোজাত শিশুকে তাঁরা কুড়িয়ে পান। তার গর্ভধারিনীর কোনও খোঁজ নেই, দেখে মনে হয় উত্তমকুলে জন্ম। খোঁজাখুঁজি করেও যখন কোনও দাবিদার মেলেনা, তখন এই দম্পতি তাকে আল্লাহর আশীর্বাদ ভেবে বাড়িতে নিয়ে আসেন। নীরুর তাঁতবাড়ি ছিলো লহরতারার থেকে পাঁচ-ছ কিমি উত্তরে বরুণানদীর চৌকাঘাটের কাছে। সেখানে ছিলো একটা টিলার মতো উঁচু জমি, মুহল্লা নরহরপুরা, সেখানেই দরিদ্র নিরুজোলার দরিদ্রতর গেরস্থালী। আজ তার নাম নিরুটিলা। মৌলভি সাহেব সেই কুড়িয়ে পাওয়া শিশুর নাম দেন ঈশ্বরের নামে, কবির। কবির বড়ো হয়ে ওঠেন এই আবহে। বড়ো হবার পর তাঁর কাছে কেউ যখন বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইতো, তিনি বলতেন,

কবিরা তেরি ঝোপড়ি
গলকট্টো কে পাস ।
জো করেগা সো ভরেগা
তুম ক্যিঁউ হোত উদাস ।। 

সেটা ছিলো গলকট্টো অর্থাৎ কসাইদের টোলা। তারা ছাড়া থাকতো কিছু জুলাহা আর সস্তা গণিকা। শৈশব থেকেই এই দরিদ্র মানুষগুলি ও তাদের কাদামাটির জীবনধারার সংস্পর্শে থেকে কবির বুঝতে পেরেছিলেন পোষাকি ব্রাহ্মণ্য অধ্যাত্মিকতার বহ্বাড়ম্বর এই সব দরিদ্র সংখ্যাগুরু মানুষদের কাছে কতটা মূল্যহীন। 

নরহরপুরায় নিরুজোলার টিলার উপর ভাঙ্গাচোরা পর্ণকুটির আর পাশের একটা চবুতরা ছিলো কবিরের খাস দুনিয়া। একটু বড়ো হবার পর তিনি পিতার সঙ্গে জাতব্যবসায় যোগ দেন। দিনের শেষে এই চবুতরাটিই ছিলো সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে গল্পগুজবের ঠিকানা। এখানে বসেই কবির আশপাশের নিরক্ষর, হতদরিদ্র, মানহীন শ্রমজীবীর দলকে আশ্বাস দিতেন তাদের মানুষজন্ম বৃথা নয়। তাদেরও ঈশ্বরলাভ হতে পারে। ঈশ্বর শুধু ব্রাহ্মণ আর শেখসৈয়দের মৌরসিপট্টা নয়। দিনে দিনে কবিরের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে মানুষের ভীড় নরহরপুরার পুরোনো চবুতরা ছাপিয়ে যায়। পাশে আর একটা নতুন চবুতরা তৈরি করতে হয়। কবিরের নামে তার নাম হয় কবির চবুতরা। লোকমুখে সেই নাম কবিরচৌরা হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই কবিরচৌরাতে বসেই ধনীর আরও ধনলালসা দেখে ঈশ্বরের কাছে কবিরের আর্জি,

সাঁই ইতনা দিজিয়ে
জা ম্যঁয় কুটুম সমায় ।
ম্যঁয় ভি ভুখা না রহুঁ
সাধো ন ভুখা জায় ।।

আবার ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিতদের আত্মগর্ব দেখে প্রচার করলেন তাঁর অমোঘ উক্তি, 

পোথি পড়ে পড়ে জগ মুয়া
ণ্ডিত বনেঁ ন কোয় ।
ঢাই আখর প্রেম কা
পড়ে সো পণ্ডিত হোয় ।।

তাৎক্ষণিক জাগতিক সাফল্যের আশায় অতৃপ্ত অসহিষ্ণু মূঢ়দের শোনালেন,

ধীরে ধীরে রে মনা
ধীরে সব কুছ হোয় ।
মালি সিঁচে সও ঘড়া
রিত আওয়ে ফল হোয় ।।

ইতিহাস যখন থেকে নিয়মানুগভাবে নথিবদ্ধ হয়েছে, অর্থাৎ সপ্তম-অষ্টম শতকে, তার পরের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এই শিশুটির আবির্ভাবের তথ্য সতত কুয়াশায় অন্তরালে। শুধু আবির্ভাবেই নয়, তাঁর তিরোভাবের তথ্যও রূপকথার রাজ্যের কথকতা। ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ এতো পরস্পরবিরোধী যে এই মানুষটির সর্বসম্মত কোনও জীবনকথা এখনও পাওয়া যায়না। তাঁর জন্মসাল হিসেবে একবার বলা হয় ১৩৯৮, আবার কখনও ১৪৪০ বা ১৪৫৫ সন। তবে তিনি গুরু নানকের (জন্ম ১৪৬৯) অনেক আগেই এসেছিলেন সেটা নিশ্চিত। গুরু নানকের 'জন্মসাক্ষী' পঞ্জি বেশ নিষ্ঠা সহকারে গ্রন্থিত আছে। সেখানে দেখছি তাঁর প্রথম দেশযাত্রা, যাকে শিখরা 'উদাসী' বলে থাকেন, সেটি ছিলো ১৫০০ থেকে ১৫০৭ সালের মধ্যে। এই সময়ই গুরু নানক বারাণসিতে সন্ত কবিরের সঙ্গ করেছিলেন। গুরু নানকের সঙ্গী ছিলেন ভাই মর্দানা, একজন মুসলিম। এর ঠিক আগেই ১৪৯৯ সালে গুরু নানকের ইষ্টদর্শন হয় এবং তিনি প্রচার করতে থাকেন, ঈশ্বর তাঁকে বলেছেন জগতে হিন্দুও নেই, মুসলমানও নেই, শুধু 'আমি' আছি। তাই নানক সমস্ত প্রচলিত ধর্মমতকে অস্বীকার করে 'ঈশ্বর'এর শিষ্য হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেন। শুধুমাত্র ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমেই যে মানুষের উত্তরণ ঘটে সেই আদর্শই তিনি সন ১৫০০ থেকে ১৫২৪ পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষ, তিব্বত, মধ্য এসিয়া, আরবদেশ ও শ্রীলংকায় প্রচার করেন। গুরু নানক যখন বারাণসিতে এসেছিলেন, তখন সন্ত কবিরের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা মধ্যগগনে। কারণ গুরু নানকের ধর্মমত যেসব সাধকের চিন্তন ও বোধিপুষ্ট, সন্ত কবির তার মধ্যে প্রধান। গুরু গ্রন্থসাহিবে সর্বাধিক গ্রন্থিত রচনা সন্ত কবিরের বাণী থেকেই সংগৃহীত। তাই ধরে নেওয়া যায় মোটামুটি ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে পরে হতে পারে। কিন্তু তিনি যে একদিন এদেশের মাটিতে বেঁচে ছিলেন, হেঁটে বেড়িয়েছেন, আর এদেশেই একদিন ঐহিক অস্তিত্ত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সামূহিক মানববিশ্বে লীন হয়ে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ রয়ে গেছে তাঁর রচনাবলীতে আর লোকবিশ্বাসে । 

জাতি জুলাহা নাম কবিরা , বনি বনি ফিরো উদাসী .....

জুলাহা, বাংলায় যার নাম জোলা, অর্থাৎ তন্তুবায় নামের শ্রমজীবী শ্রেণী ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিলো। কিন্তু সেই সময় এইদেশের যেসব প্রান্তে বয়নশিল্পের চূড়ান্ত উন্নতি ঘটেছিলো, সেখানে স্বাভাবিকভাবে তন্তুবায়বর্গের মানুষদের বৃহৎ বসতিও প্রতিষ্ঠিত হয়। বারাণসি ছিলো উত্তর ভারতে সে রকম একটি কেন্দ্র। সেখানেই জন্ম সন্ত কবিরের এবং তিনি স্বীকার করেছিলেন পালক পিতার বৃত্তিগত পরিচয়। সেই সূত্রে মুসলিম হলেও অধ্যাত্মদর্শনের প্রথম গুরুমুখী পাঠ তিনি নিয়ে ছিলেন সন্ত রামানন্দের (আনুমানিক ১২৯৯- ১৪১০) কাছে। ভারতবর্ষে মধ্যযুগের ভক্তিবাদী অধ্যাত্ম আন্দোলনের তিনি ছিলেন প্রধান পুরুষ। তাঁর দর্শনের সঙ্গে পারস্য থেকে আসা ইসলামি সুফি দর্শন মিলেমিশে তৈরি হয় এ দেশের প্রথম সমন্বয়বাদী অধ্যাত্মসাধনা। পরবর্তীকালের ভারতবর্ষে বৃহত্তর জনমানসে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শন বলতে যে বোধটি বিকশিত হয়েছে তার অংকুর এই সময়েই স্ফুরিত হয়। এই আন্দোলনের সমস্ত নায়করা, যেমন, সন্ত কবির, সন্ত রবিদাস, সন্ত নানক, পরবর্তীকালে সন্ত তুকারাম সবাই সন্ত রামানন্দের ভাবশিষ্য। সন্ত রামানন্দ ও কবিরের সম্পর্কটি ভারতবর্ষে পরবর্তীকালের অধ্যাত্ম ও রাজনৈতিক জগতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিংবদন্তি বলে সন্ত কবির নিজের জন্মপরিচয় লুকিয়ে সন্ত রামানন্দের থেকে শিক্ষা নেন। কারণ তখনও পর্যন্ত প্রয়াগের ব্রাহ্মণ রামানন্দ কোনও 'বিধর্মী'কে তাঁর উপদেশ দিতে স্বীকৃত ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাস বলে সন্ত রামানন্দ ও সন্ত কবিরের মধ্যে দীর্ঘ বোধবিনিময়ের ধারা দুজনকেই একসঙ্গে সমৃদ্ধ করে তোলে। এমন রটনাও রয়েছে যে কবিরের মাতা ছিলেন এক অকালবিধবা ব্রাহ্মণ রমণী। রামানন্দ তাঁকে পুত্রবতী হবার বর দিয়েছিলেন। ফলতঃ তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। তবে সম্ভবতঃ ঘটনা হলো, কবিরের প্রকৃত পিতা রামানন্দের একজন ব্রাহ্মণ শিষ্য এবং কবিরের গর্ভধারিণী সেই ব্রাহ্মণ বিধবা রমণী। লোকলজ্জায় তাঁরা সদ্যোজাত সন্তানকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন লহরতারার জলে। সেখান থেকেই 'ম্লেচ্ছ' জোলা নিরু আর নিমা তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। অবশ্য আধুনিককালের পণ্ডিতরা এই কিংবদন্তি'তে আস্থা রাখেন না। শার্ল ভডভিল বলেছেন, কবির ছিলেন একেবারে নিম্নবর্গের আতরাফ মুসলমান পরিবারের সন্তান, যাঁরা আদত ইসলামি ধর্ম বা লোকাচার সম্বন্ধে বিশেষ ওয়কিফহাল ছিলেন না। তাঁরা সম্ভবত ছিলেন পুরুষানুক্রমিক নাথপন্থী ইতরবর্গের মানুষ। হয়তো নেহাৎ অর্বাচীন, কলমা কবুল করা মুসলমান। যার ফলে কবিরের রচনায় যেসব উদাহরণ, চিত্রকল্প, প্রতীকী সন্দর্ভ আমরা বার বার দেখতে পাই, সেখানে তন্ত্র, নাথপন্থা ও অন্যান্য লোকজ বিশ্বাসের প্রভাব বিশেষ প্রকট। ওয়েন্ডি ডনিগার তো সরাসরি বলেছেন, কবির সচেতনভাবে হিন্দু ও ইসলাম দুটি ধর্মবিশ্বাসকেই প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব 'ধর্মমত' প্রচার করেছিলেন এই দুটি ধর্মের ধ্বংসাবশেষের উপর। এ বিষয়ে তাঁর উত্তরসূরি ছিলেন মধ্যযুগের বহু সুফি সাধক। 

তবে সন্ত কবিরের নিজস্ব ব্যাখ্যায় সন্ত রামানন্দ অনুসৃত শ্রীরামানুজ কথিত নির্গুণ ব্রহ্ম, একেশ্বরবাদ ও প্রেমভক্তির পথে ঈশ্বর, আল্লাহ, হরি, রাম বা অলখ নিরঞ্জনলাভ দর্শনতত্ত্ব সেই সময় থেকেই আপামর ভারতবাসীর মধ্যে অত্যন্ত কার্যকরীভাবে গৃহীত হয়েছিলো। অনেকদিন পরের মানুষ আমাদের লালন সাঁই বলছেন,

'শুদ্ধভক্তি মাতোয়ালা, ভক্ত কবির জেতে জোলা
সে ধরেছে ব্রজের কালা, দিয়ে সর্বস্বধন তাই।।
ভক্তের দোরে বাঁধা আছেন সাঁই।।'

জব ম্যঁয় থা, তব হরি নহি
অব হরি হ্যাঁয়, ম্যঁয় নহি
সব অঁধিয়ারা মিট গয়া
জব দীপক দেখা ম্যঁয়নে।।

সেই অন্ধকারযুগে সহায়হীন নিপীড়িত শ্রমজীবী শ্রেণীর ইতরমানুষদের আত্মার শুশ্রূষায় প্রদীপের আলো হাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন সন্ত কবির। তিনি সন্ন্যাসী ছিলেন না। সংসার করেছিলেন, পত্নীর নাম ছিলো লো'ই। এক পুত্র কমাল আর কন্যা কমালি। পুত্র কমাল পিতার সাধনার মর্ম বুঝতেন না। তিনি ছিলেন বিষয়বিষে বিজড়িত। আক্ষেপ করে কবির বলেছিলেন, 

' বুরা বংস কবির কা, উপজা পুত কমাল
হরি কে সুমিরন ছোড়কে, ঘর লে আয়া মাল।।'

গুরু রামানন্দ ও শিষ্য কবিরের মূল কর্মক্ষেত্র ছিলো শহর বারাণসি। গুরু ছিলেন সে সময়ের ভারতবর্ষে একজন শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, দার্শনিক ও প্রসিদ্ধ চিন্তানায়ক আর চেলা ছিলেন 'নিরক্ষর' সামাজিক মর্যাদাহীন জোলা। নিজের সম্বন্ধে কবির বলেছিলেন, 

'মসি কাগদ ছুয়ো নহি
কলম গহি নহি হাথ।।'

আর গুরু সম্বন্ধে বলেছিলেন,

' গুরু গোবিন্দ দোনো খড়েঁ
কাকে লাগু পাঁয়
বলিহারি গুরু আপনো
গোবিন্দ দিয়ো মিলায়।।' 

সন্ত কবির ছিলেন ভারতবর্ষের শাশ্বত ইতরযানী বোধিবিশ্বের ভাণ্ডারী ও নায়ক। ব্রাহ্মণ্য বোধ ও উপলব্ধির চেনা কক্ষপথের বাইরে আবহমানকাল ধরে এদেশে গরিষ্ঠ মানুষের মননজগতের শ্রেষ্ঠ ফসল উদ্গত হয় সন্ত কবিরের এই সব অমৃতবাণীর মাধ্যমে। তাঁর বাণীর প্রথম প্রামাণ্য সংকলন পাওয়া গুরু অর্জনদেব সংগৃহীত শিখদের 'আদিগ্রন্থ' আর গোবিন্দওয়াল পোথির মধ্যে। তার পর রাজস্থান থেকে সংগৃহীত 'বীজক' আর বুন্দেলখণ্ড থেকে নথিবদ্ধ করা 'অনুরাগসাগর'। এসবের প্রণেতা ছিলেন নিরক্ষর, তাই এর প্রামাণ্যতা শুধু বাচনিক ঐতিহ্যের মধ্যে বিচরণ করেছে। উইলসনসাহেবের মতে কবিরের রচিত দোহাসংকলনের সংখ্যা আট। বিশপ ওয়েস্টকট সাহেব বলেছেন সংখ্যাটি চুরাশি। অন্যমতে রামদাস গৌড় বলেন কবিরের রচনার একাত্তরটি সংগ্রহ রয়েছে। তবে তাঁর সমস্ত রচনাই 'বীজকে'র মধ্যে মোটামুটি গ্রন্থিত আছে। বীজকের তিনটি ভাগ আছে, রমৈনি, সবদ আর সারওয়ি। শৈলির বিচারে তাঁর রচনায় রয়েছে তিনধরণের রচনা। দোহে, সলোক (শ্লোক) আর সাখি (সাক্ষী)। তাঁর রচনাগুলি যেহেতু ভক্তদের শ্রুতির মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিলো, তাই অনেক ভাষায় তার নানা রূপ দেখা যায়। যেমন, পঞ্জাবি, ব্রজভাখ, রাজস্থানী, খড়ি বোলি, অওধি, পুরবি ইত্যাদি।

তিনি ছিলেন এক গর্বিত 'জুলাহা'। যেখানেই নিজের সম্পর্কে কিছু বলার, তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে নিজের শ্রমজীবী জাতিপরিচয় নিয়ে সরব হয়েছেন। ঈশ্বর তাঁর কাছে একজন শ্রেষ্ঠ তন্তুবায়। ঠিক যেভাবে একজন জোলা সুতোর সঙ্গে সুতোর খেলায় মত্ত হয়ে অনুপুঙ্খ কৌশলে শিল্পসৃষ্টি করে, সেভাবেই ঈশ্বর মাতৃগর্ভ নামক তাঁত থেকে সমস্ত প্রাণ, সারা জগতসংসারকে উৎপন্ন করছেন। এই ধারণাটি তন্ত্র ও আগমের একটি মুখ্য সূত্র। আবার তাঁর আরাধ্য 'হরি' সম্বন্ধে বলছেন, 

' সাত সমন্দর কী মসি করৌঁ
লেখনি সব বনরাই ।
ধরতি সব কাগদ করৌঁ
হরিগুণ লিখা ন জাই ।।'

পশ্চিমের সংস্পর্শে আসা ভারতীয়দের মধ্যে বিদেশে কবিরবাণী প্রচারের প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অগ্রগণ্য। ১৯১৫ সালে 'সংস অফ কবির' নামে তাঁর অনুদিত কবিরের একশোটি কবিতা লন্ডনে প্রকাশিত হয়। ইভলিন আন্ডারহিল এই সংকলনটির ভূমিকা লিখে দেন। এই বইটি পড়েই ডব্লিউ বি ইয়েটস পশ্চিমে কবিরকে বিস্তৃত পরিচিতি দান করেন। অবশ্য পরবর্তীকালের গবেষকদের মতে এই একশোটি কবিতার মধ্যে বড়ো জোর ছ'টি কবিতা কবিরের নিজস্ব রচনা। বাকিগুলি সম্ভবতঃ কবিরের শিষ্যপ্রশিষ্য নানা ভক্ত সাধকের সৃষ্টি। যদিও সেগুলিতে কবিরের দর্শন ও রচনাশৈলি বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করা হয়েছিলো।

কবিরের তিরোভাব হয়েছিলো বারাণসি থেকে প্রায় দুশো কিমি দূরে গোরখপুরের কাছে মগহরে। তাঁর জন্মের কাহিনী এতো-ই অস্পষ্ট যে তাঁর প্রকৃত জন্মস্থান বারাণসি কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কিন্তু বনারস তাঁর কর্মভূমি এবং চিরকালীন ভারতবোধে এই স্থান ও কবির অচ্ছেদ্য সম্পর্কে বাঁধা। একসময়ের গণিকা, কসাই ও অন্যান্য 'অসামাজিক' পেশায় নিয়োজিত মানুষ অধ্যুষিত এই স্থানে বসবাস করে মহাত্মা কবির কোন প্রেরণায় নিখিল মানবাত্মার কাছে তাঁর শাশ্বত সন্দেশ পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন, তা হৃদয়ঙ্গম করার একটা বাসনা আমাকে তাঁর দিকে টেনে নিয়ে যায়। অন্ধকার মধ্যযুগে ভারতদর্শনের সারসংক্ষেপ একজন 'অশিক্ষিত', হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিলো আর্যাবর্তের সংখ্যাগুরু নিপীড়িত, দরিদ্র, হতমান, ইতর মানবজাতির কাছে আত্মার শুশ্রূষা হয়ে। 

"চাহ মিটি, চিন্তা মিটি, মনওয়া বেপরওয়াহ
জিসকো কুছ নহি চাহিয়ে, উওহ হ্যাঁয় শহনশাহ।।"



1 comments:

0

প্রবন্ধ - কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


মানুষ আইনস্টাইন 
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়



নিউইয়র্ক শহর। কুলু কুলু তানে বয়ে চলেছে হাডসন নদী। এরই তীরে দাঁড়িয়ে আছে ‘রিভার সাইড’ গীর্জা। আর পাঁচটা গীর্জার থেকে এই গীর্জার পরিবেশ যেন একটু আলাদা। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে আকর্ষণ করে গীর্জার প্রাচীরে উৎকীর্ণ ছয়শত মনীষির প্রতিকৃতির সঙ্গে থাকা আইনস্টাইনের প্রতিকৃতি। দু-দণ্ড না দাঁড়িয়ে উপায় নেই। শুধু বিজ্ঞানী নন, মানুষ হিসেবেও তিনি সকলের নমস্য। 

আইনস্টাইন মনে প্রাণে ছিলেন শান্তিবাদী। অর্থ, যশ কোনও কিছুর প্রতি তাঁর লোভ ছিল না। খ্যাতির শিখরে পৌঁছেও তাঁর কোনও অহঙ্কার ছিল না। তিনি সবসময় বলতেন, ‘আমার মানসিক ও শারীরিক জীবন নির্ভর করছে যে সকল জীবিত বা মৃত ব্যাক্তিদের পরিশ্রমের উপর আমি তাদের প্রতিদিন স্মরণ করি। আমি যে খাদ্য খাই, যে পোশাক পরি, যে গৃহে বাস করি তা সবই তো করে দিয়েছে অন্য লোক। এমনকী শৈশব থেকে যে জ্ঞানভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছি, তাও অন্যের দান। অন্যের কাছ থেকে যতটা পেয়েছি ততটাই আমাকে দান করে যেতে হবে।

১৪ মার্চ ১৮৭৯ জার্মানির উলম শহরে এক ইহুদি পরিবারে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম। পিতা হেরম্যান আইনস্টাইন ছিলেন একজন ছোট ব্যবসায়ী। মিউনিখে স্কুল জীবন শেষ করে অ্যালবার্ট ভর্তি হন জুরিখের পলিটেক্‌নিক্‌ ইনস্টিটিউটে। পড়াশোনা শেষ করে সামান্য কেরাণীর চাকরি দিয়ে জীবন শুরু করলেও গবেষণার কাজের প্রতি ছিল তাঁর অদম্য আগ্রহ। মস্তিষ্ক ও মেধা ছিল তাঁর আসল গবেষণাগার। তাত্ত্বিক ও ফলিত বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটানোর জন্য তাঁর দরকার হয়েছিল শুধু কিছু কাগজ, পেন্সিল আর একরাশ গাণিতিক সংখ্যা। 

১৯০১ সালে কৈশিক আকর্ষণ বিষয়ে আইনস্টাইনের প্রথম মৌলিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এরপর গণিত, তাপ, আলোক ও বিদ্যুৎ বিষয়ের উপর তাঁর মৌলিক প্রবন্ধগুলি একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে। আইনস্টাইনই প্রথম বলেন, ‘বিশ্বজগত গতিশীল’। এখানে কোনও কিছুই স্থির নয়। আমরা যা কিছু মাপছি তা গতির পরিপ্রেক্ষিতেই মাপতে হবে। তাই শুধু দৈর্ঘ, প্রস্থ ও বেধ এই তিনটে দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও বস্তুর সঠিক পরিমাপ করা সম্ভব নয়। জটিল গাণিতিক বিশ্লেষণের পর তিনি গড়ে তুললেন তাঁর বিখ্যাত ‘স্পেস টাইম ফাংশন’। সেইসঙ্গে পরিমাপের জগতে প্রবর্তিত হলো চতুর্থ মাত্রা ‘সময়’ অর্থাৎ, ‘ফোর্থ ডায়মেনশন’। 

নিউটন বলেছেন, ‘মাধ্যাকর্ষণ পদার্থের স্বাভাবিক ধর্ম’। আইনস্টাইন কিন্তু ভিন্ন মত পোষণ করলেন। তিনি বললেন, ‘যেহেতু বিশ্বজগত গতিশীল তাই এখানে অ্যাবসল্যুট মাপ বলে কিছু নেই। সমস্ত কিছুই একে অপরের আপেক্ষিক’। একমাত্র আলোকে তিনি নিত্য বস্তু বলেছিলেন এবং আলোর গতিবেগকেই তিনি চরম গতিবেগ বলে মনে করতেন। ভর ও গতিবেগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন ভর ও গতি একে অপরের উপর নির্ভরশীল। কোনও বস্তুর গতি বাড়লে তার ভরেরও গতি বাড়ে। এই গতি বাড়তে বাড়তে যদি আলোর গতিবেগের সমান দাঁড়ায় তাহলে বস্তুর ভর হয়ে যাবে অসীম। 

আইনস্টাইনের আগে বিজ্ঞানীদের ধরণা ছিল পদার্থ ও শক্তি দু’টি বিপরীত সত্ত্বা। আইনস্টাইন বললেন, না, দুটো একই— একটির আরেকটিতে রূপান্তরিত হওয়া সম্ভব। তাঁর ধারণা যে অমূলক নয় তার প্রমাণ রাখলেন বিখ্যাত সূত্র E=mc2 (E = শক্তি, m = ভর, c = আলোর গতিবেগ) আবিষ্কার করে। 

১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ‘স্পেশাল থিয়োরি’ এবং ১৯১৬ সালে ‘জেনারালাইজড থিয়োরি’ প্রকাশিত হয়। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বিজ্ঞানী মহলে বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে পালটে দিয়ে বিজ্ঞানের আঙিনায় এক বিরাট বিপ্লবের সৃষ্টি করে। এরপরেই আইনস্টাইনের খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। 

১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে অ্যালবার্ট নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৩৩ সালে হিট্‌লারের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য তিনি গোপনে জার্মানি ত্যাগ করে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড হয়ে আমেরিকায় চলে যান এবং ১৯৪০ সালে সেখানকার নাগরিকত্বগ্রহণ করেন। 

আমেরিকার নিউজার্সি স্টেটের একটি শহরের নাম প্রিন্সটন। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও এই শহরের নামে। আইনস্টাইন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঐ পদেই তিনি সম্মানের সঙ্গে কাজ করেন। আইনস্টাইন চাইতেন বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হোক, ধ্বংসের কাজে নয়। হিরোসিমা ও নাগাসাকির উপর পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটার পর তিনি দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন, “আবার যদি জন্মাতে হয় তবে যেন বিজ্ঞানী হয়ে না জন্মাই। জন্মাতে চাই কামার, কুমোর বা ছুতোর হয়ে যাতে করে চিন্তার বাক্যে ও কর্মের স্বাধীনতা থাকে, শান্তি থাকে কর্মে ও মনে”। 

অবসর গ্রহণের পর আইনস্টাইনকে সাত হাজার ডলার পেনশন দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। আইনস্টাইন অতি সাধারণ জীবনযাপন পছন্দ করতেন। তিনি যে বাড়িতে থাকতেন সেটাও ছিল অতি সাধারণ মানের। তিনি দেখলেন তাঁর অবসর জীবনযাপনে অত অর্থের প্রয়োজন নেই। তাই তিনি পেনশনের অর্থ কমিয়ে দিতে বললেন। অনেক অনুরোধ উপরোধের পর অবশেষে তিনি ছয় হাজার ডলার পেনশন গ্রহণে সম্মত হন। 

১৯৫৫ সালে এপ্রিল মাস। সমগ্র বিশ্বে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল— অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আর ইহলোকে নেই। জন্ম সূত্রে ইহুদী হওয়ায়, প্রথানুযায়ী ‘হেভরাহ কদিশ’ (ধর্মীয় পুরোহিতদের সাহায্য নেওয়া) এবং ‘মিতজভার’ (মৃতদেহ নিয়ে শোভাযাত্রা) হওয়া উচিত। কিন্তু কোনোটাই ছেলে হানস্‌ অ্যালবার্টের ইচ্ছে নয়। পিতার শেষ ইচ্ছেকেই সম্মান জানাতে তিনি বেশি আগ্রহী। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের শেষ ইচ্ছে ছিল, ইহুদী ধর্মের সমস্ত নিয়ম অগ্রাহ্য করে তাঁর মৃতদেহ যেন কোনো ‘ক্রিমেটোরিয়ামে’ নিয়ে গিয়ে দাহ করা হয় এবং দাহ শেষে ছাইগুলি যেন কোনও গোপনস্থানে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে ঐ ছাইয়ের উপর কোনো স্মৃতি বানিয়ে তাঁকে দৈব প্রেরিত কোনও মহাপুরুষে পরিণত করা না হয়। 

হানস্‌ অ্যালবার্ট পিতার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী কোনও পুরোহিত ডেকে মৃত ব্যাক্তির আত্মার শান্তির জন্য কোনো ‘হেসপেড’ পাঠ করাননি বা পিতার মৃতদেহের সঙ্গে পবিত্র ইজরাইলের এক চিমটে মাটিও দিতে দেন নি। তবে বোনেদের অনুরোধে ‘তাহারা’ অর্থাৎ মৃতিদেহকে ধুয়ে মুছে গন্ধদ্রব্য মাখিয়ে দেওয়া এবং ‘ইয়া ক্রিচিন’-এ অর্থাৎ মৃতদেহকে ইহুদী প্রথানুযায়ী মৃত্যুর প্রতীক পোশাক হিসেবে একটি ধবধবে সাদা আলখাল্লা পরিয়ে দিতে রাজী হয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যরাতে প্রিন্সটন শহর থেকে একটি গাড়ীতে করে পিতার মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে হানস্‌ অত্যন্ত গোপনে ক্রিমেটোরিয়ামে দাহ করে ছাইগুলি কোনও এক গোপন স্থানে ছড়িয়ে দেন যার সাক্ষী একমাত্র তিনি নিজে।


0 comments:

0

বিশেষ রচনা - গুরু বলে তারেই প্রণাম করবি মন

Posted in










ছবি সৌজন্যে- দ্য টেলিগ্রাফ
বিশেষ রচনা                                      


গুরু বলে তারেই প্রণাম করবি মন
চয়ন



- সুনীলদা, চয়ন বলছি
- হ্যাঁ, বলুন 
- দাদা, এই সদ্য একটা বই বেরিয়েছে। বিদ্যাসাগরের লেখা সংস্কৃত ভূগোল বই এর প্রথম বাংলা অনুবাদ। নাম হ'ল..
- ভূগোলখগোলবর্ণনম। রেডি আছে। আর হ্যাঁ, ক্যালকাটা ইউনিভারসিটি থেকে বেরিয়েছে, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের বিবিধ প্রবন্ধ। ওটাও এক কপি রাখছি। জানি তো, আপনি নেবেন...

যাঁর সঙ্গে এই কথোপকথন তাঁকে দেখতে চান? আসুন আমার সঙ্গে। কাঁকুড়্গাছি থেকে উল্টোডাঙা স্টেশনের দিকে যাওয়ার যে ফুটপাথ সেটা ধরে এগিয়ে চলুন। আপনার খিদে পেয়েছে কী? তাহলে ফুটব্রীজের তলার দোকান থেকে মোমো খেয়ে নেব। যদি না খান, তবে আরেকটু এগোই আসুন। সোনি ওয়র্ল্ড শো রুমের ঠিক মুখোমুখি বিশ্বাসদার রুমাল, জামাকাপড়ের স্টল আর অশোকদার মাটিতে ঢেলে রাখা পুরনো বইয়ের রাশির ঠিক মাঝখানে পেতে রাখা এই চৌকিটার সামনে দাঁড়াব আমরা। আলাপ করুন, এই ছোটখাটো চেহারার অমায়িক স্বভাবের মানুষটির সঙ্গে। ইনিই সুনীল কর। আমাদের সুনীলদা। উঁহু, নাকছাঁটা দেওয়ার ভুলটা করবেন না মোটে। কারণ, এখনই কারিগর থেকে সদ্য প্রকাশিত বইগুলি তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে এখানে পৌঁছে দেবেন। আসবেন সূত্রধরের কর্ণধার। আসবেন কবি সুমন্ত মুখোপাধ্যায়। আসবেন নীহাররঞ্জন রায়ের ভারতেতিহাস জিজ্ঞাসার মত অসাধারণ বইয়ের সম্পাদক, শ্রী তরুণ পাইন। আসবেন বহু কলেজের অধ্যাপকের দল। আসবেন বহু শিক্ষক শিক্ষিকা। হয়তো, হাতে সময় থাকলে, এসে পৌঁছবেন শঙ্খ ঘোষ। 

সুনীলদা সবার বন্ধু। যাঁরা এসেছেন তাঁরাও পরস্পরের স্বজন। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার মত অভাজনও প্রচুর স্নেহ পায় এঁদের কাছ থেকে। 

সুনীলদা বিশেষ পরিচিত জনদের হাতে লাল চায়ের গেলাস তুলে দেবেন। সন্ধে ঘনাবে। আলোচনা চলবে সাহিত্যতত্ত্ব, দর্শনশাস্ত্র, ইতিহাস নিয়ে। রসিকতা বিনিময় হবে। "জানেন তো উদ্দালকদা আজ মন্ত্রী বললেন, 'ঐ উল্টোডাঙায় extremistদের আড্ডায় যাচ্ছেন?' তাহলে চয়নও extremist?" পিঠে হাত রেখেছেন পুস্তকপ্রেমী, সুলেখক, সমাজ বিজ্ঞানে অগাধ পণ্ডিত শ্রী সৌমিত্র সেনগুপ্ত। 

"অরূপদা খাওয়াচ্ছেন কবে? দাদা তো ফাণ্ডামেন্টাল ফিসিক্স প্রাইজ পেলেন।" বিশ্ববন্দিত পদার্থবিজ্ঞানী শ্রী অশোক সেনের অনুজ অধ্যাপক অরুণ সেন হাসবেন, "আশিসবাবুর Return from Exile টা নিলে চয়ন? কিছু লিখবে ভাবছ?" " আরে চয়ন তো কেবল একটা বিষয় নিয়েই ভাবে। জিজ্ঞেস করুন ওকে। বলুন ১৯৫৪ সালের শুকতারার বৈশাখ সংখ্যাটা কেমন ছিল? দেখবেন ও বলবে ওপরের কোণায় নীল দাগ ছিল একটা।" আবার সমবেত হাসি। লজ্জা করলেও একটা তৃপ্তিও আসবে। আমাকে গ্রহণ করেছেন এই বুধমণ্ডলী। আমি সেই চিন্তনবৃত্তের অংশ যাকে এঁরা নিজেরাই পরিহাস করে বলেন, "The Ultodanga School of Social Thoughts"। এবং আপনিও তা হতে পারেন। 

২০০৬ সালের কথা। একটা বই কলেজ স্ট্রীট তোলপাড় করে কোথাও পাই নি। মন মেজাজ বড্ড খারাপ। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম কলকাতার পুস্তকবিশ্ব একসময় অন্যরকম ছিল। শ্যামাচরণ দে স্ট্রীটে Calcuuta Old Book Stall বা কুমারস' এর কথা ছেড়েই দিলাম। সে তো আমার জন্মেরও দুইদশক আগে গত শতাব্দীর পঞ্চমার্ধের কথা। কিন্তু, এই সেদিনও ১৯৯৪-৯৫ সালে সীগ্যল সাহিত্যতত্ত্বের ওপর বই খুঁজতে গিয়ে দেখেছি যে আমায় আধুনিকতম বই এর পাশাপাশি কালজয়ী গ্রন্থের হদিশ দিয়েছেন তপনদা। আরামদায়ক গদি আঁটা মোড়ায় বসে অতি সুস্বাদু কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে সারাদিন বইয়ের পাতা উলটেছি। আর আজ শপিং মল গুলোর কাউন্টারে গিয়ে কোনও বইয়ের নাম বললে কী বোর্ডে ঝড় তোলা আঙুলের মালিক মেকি হাসি হেসে যান্ত্রিক কন্ঠস্বরে বলেন সে বই স্টকে আছে না নেই। 

বাড়ী ফেরার পথে একবার ভাবলাম উলটোডাঙার সোনির সামনে ফুটপাথের দোকানটায় একবার খোঁজ করে যাই। গেলাম। পেলাম। আর আটকে রইলাম। ধীরে ধীরে হয়ে উঠলাম সুনীলদার স্বজন বৃত্তের অংশ। এর ঠিক দুবছর পরের কথা। সুনীলদার দোকান থেকে বিকাশ ভট্টাচার্যের ২০০০ টাকা দামের একটা বই চুরি হয়ে গেল। আমরা সবাই পালা করে পাহারা দিতাম দোকানটা তারপর থেকে। আজ্ঞে হ্যাঁ, সুনীলদার কাছে আপনি পাবেন Umberto Eco এর On Beayty, গৌতম ভদ্রের ন্যাড়া বেলতলায় যায় ক'বার, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অদ্ভুত রামায়ণ। এর সব কটাই অতি দামী বই। সুনীলদা আপনাকে দিতে পারেন Foucault এর Society Must Be Defended, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের Death of a Discipline, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের The Parlour and the Street, সুকেতু মেহতার Maximum City, ডি.ডি. কোশাম্বীর Combined Methodology, প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের টীকা টীপ্পনী, পরিমল রায়ের ইদানীং, নারায়ণ দেবনাথের কমিক্স সমগ্র। এই খানে ২০০৬ এ পামুক নোবেল পাওয়ার অনেক আগে আমি পেয়েছিলাম My Name is Red আর ২০০৮ এ Le Clezio নোবেল পাওয়ার ঠিক পরের দিন তাঁর লেখা Desert। ২০০৯ এর এক বিকেলে একটা মোটাসোটা বই তুলে অলস ভাবে তার পাতা ওল্টাচ্ছি। হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত আমি কেঁপে উঠলাম। এ কি আরম্ভ! : "One hand limp by his side, the other to his brow, the young Aristotole languidly reads a scroll unfurled on his lap, sitting on a cushioned chair with his feet comfortably crossed. Holding a pair of clip glasses over his bony nose, a turbuned and bearded Virgil turns the pages of a rubricated volume in a portrait painted fifteen centuries after the poet's death......Pointing to the right hand page of a book open on his lap, the Child Jesus explains his reading to the elders in the Temple while they, astonished and unconvinced, vainly turn the pages of their respective tomes in search of refutation...
All these are readers, and their gestures, their craft, the pleasure, responsibility and power they derive from reading, are common with mine.
I am not alone." 

আমার মনে হ'ল এটা আমার বই। কেবল আমার জন্য লেখা। পকেটে যা ছিল সব দিয়ে বইটা কিনে আচ্ছন্নের মত হাঁটতে হাঁটতে বাড়ী ফিরেছিলাম। এর কিছুদিন পর আমি জানি যে এই বইটির নাম সারা পৃথিবী জানে। আলবের্তো মানগুয়েলের A History of Reading। 

২০০৮ এর ১৮ই ফেব্রুয়ারি আমরা সুনীলদার দোকানে তাঁকে চা খাওয়ালাম। মোমো কিনে এনে রাস্তায় দাঁড়িয়েই ছোট মতো পার্টি হয়ে গেল একটা। আমাদের এত উচ্ছ্বাসের কারণ ঠিক তার আগের দিন দ্য টেলিগ্রাফ এ Mall Print শীর্ষক এক রচনায় সুদেষ্ণা ব্যানার্জী সুনীলদার কথা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন : "The biggest battle to the big-book-at-the-mall is perhaps being given by pavement shacks like the one near the Ultadanga crossing. Illuminated by the light from a Sony World showroom and sandwiched between hankerchiefs and stauettes, Sunil Kar sells Michel Foucault and Manik Bandyopadhyay, imported science journals and humble little magazines. 
" Sometimes people ask me if these are second hand -- as if one can't sell new books from the street," says the soft spoken but fiercely proud man who started his own enterprise after the book shop he worked in closed down. He thrives on personal relations and personalized service. Office goers on their। way back from Salt Lake and Baguiati stop to check out a stock chosen after scanning the review columns ( his brother runs a newspaper stall). He also offers 20 percent discount." আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব বিশেষ কিছু প্রকাশনার বই ছাড়া ইংরিজি বা বাংলা যে কোনও বইতে সুনীলদা আপনাকে শতকরা ২০ শতাংশ ছাড় দেবেন। এই ভাবেই গত ত্রিশ বছর চলছে সুনীলদার দোকান, আর আমি খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে তাঁকে দেখছি গত দশ বছর। আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই দানবাকৃতি শপিং মলগুলো যে ধনতান্ত্রিক বয়ানের প্রতিভূ, সুনীলদা তাঁর ফুটপাথের দোকানে একা হাতে গড়ছেন তার প্রতিবয়ান। সুদেষ্ণা তাই বড় সঠিক নামে ডেকেছেন একে : 'Foucault Corner'. 

দশ বছর আগে আমি যা ছিলাম আর এখন আমি যা তার মধ্যে বিপুল ব্যবধান। এ ক' বছরে আমার চিন্তনের ধরণ আমূল বদলে দিয়েছেন সুমিত সরকার, আশিস নন্দী, অরিন্দম চক্রবর্তী, রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্র। আর এঁদের সবার দেখা আমি পেয়েছি সুনীলদার মধ্যস্থতায়। তাই আজ সর্বসমক্ষে আমি তাঁকে গুরু বলে প্রণাম জানাই। প্রণাম সুনীলদা। পুনশ্চ ভূয়োপি নমোনমস্তে।



0 comments:

2

বইঘর - শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া

Posted in


বইঘর


অমলকান্তি - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া



রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের সমারোহ, বর্ষব্যাপী সরকারি-অসরকারি অনুষ্ঠানে মুখরিত হয়ে আছে বাংলার সাহিত্য অঙ্গন। যদিও রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতা তখন নিজস্ব স্বরে প্রতিষ্ঠিত, নীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় তখনও গভীর হয়নি। পত্র-পত্রিকায় তাঁর কবিতা টুকটাক চোখে পড়লেও, প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধকার বারান্দা’ প্রকাশিত হয়েছিল সেই রবীন্দ্র-শতবর্ষেই; ১৩৬৭-র চৈত্রে(মার্চ/এপ্রিল ১৯৬১)। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের অভিঘাত আর সমাদর কদ্দূর হয়েছিল তা বুঝতে সেই বইয়ের ‘অমলকান্তি’-ই যথেষ্ট। প্রকাশের ষাট বছর পরেও সে কবিতাকে বাদ দিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার কোনও সংকলন প্রায় অসম্ভব। 

কী ছিল সেই কবিতায়! ছিল সামান্য এক ইস্কুল পড়ুয়া বালকের কথা—

“অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসত, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।”

কী আছে এই সাধারণ ক’টি পংক্তিতে? এক সাধারণ বালকের কথা; পড়াশুনায় নিতান্ত অপটু এক বালক। এমন বালক তখন বাড়ি বাড়ি দেখা যেত। অধিকাংশ বালক এমনই তো। কিন্তু রোজ রোজ দেরি করে স্কুলে আসা তো সাধারণ বাড়ির ছেলেদের চেনা গল্প নয়। পড়াশুনায় খামতির সঙ্গে এই অনিয়মানুবর্তিতার সম্পর্ক তো তখনও সমাজে খুব প্রচলিত বাস্তব নয়। সন্তানকে মানুষ করার জন্য অভিভাবকদের কাছে ইস্কুল তো তখনও সোনার কাঠি প্রায়; যার যাদু স্পর্শে সব গাধা ঘোড়া হয়ে ওঠে। তবে অমলকান্তির রোজ রোজ দেরি করে আসা বরদাস্ত করত কোন স্কুল আর কোন অভিভাবক? 

কবি পরবর্তী জীবনে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, অমলকান্তি এক বাস্তব চরিত্র। কবির সহপাঠী। সে ছিল নিতান্ত দরিত্র বাড়ির বস্তিবাসী এক ছেলে। বাড়ির দারিদ্র্যই নানান পাকে তাকে প্রতিদিন দেরি করিয়ে দিত ইস্কুলে; হয়তো পড়াশুনাতেও। কিন্তু সে সাধারণ বালককে নিয়ে কাব্যপ্রয়াস কেন! কারণ—

“আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল !”

এইখানে এসে আমাদের প্রতিদিনের পরিচিত ছবি যায় বদলে। অমলকান্তি-কে কেবল বোকা মনে হয় না, কিঞ্চিত ন্যাকাও মনে হয়। মনে হয় কবির কাব্যপ্রয়াসে এ এক আরোপ। ‘রোদ্দুর’ হতে চাওয়া ব্যাপারটা প্রথমত ভালো বোঝা যায় না, দ্বিতীয়ত ব্যাপারটার আরোপ নিয়ে মনে সন্দেহ থাকে না। কেউ মনে মনে এমন কথা ভেবে থাকলেও সে সব নিয়ে প্রকাশ্যে বলা বা তা নিয়ে কাব্য করা বর্তমান পাঠককূলে আর অনুমোদিত নয় বোধহয়। মাস্টার, ডাক্তার, উকিল হতে চাওয়ার মধ্যে যে স্বাভাবিকতা আছে, ‘রোদ্দুর’ হতে চাওয়া এবং তা প্রকাশ করার মধ্যে আছে তেমনই অস্বাভাবিকতা। 

পরবর্তীকালে অনেক চমৎকার কবিতা লিখে মর্যাদার আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন কবি। তখন আর প্রথম কাব্যগ্রন্থের কোনও কবিতার দায় নেওয়ার কিছু থাকে না। বরং আরোপের মুখোশ খুলে ফেলার মধ্যে কবির সততা থাকে, পাঠক সমাজের কাজে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন করে। অনেক প্রতিষ্ঠিত কবিকেই দেখা গেছে, প্রথম জীবনের আবেগ, উচ্ছ্বাস, ভ্রান্তি পরবর্তী জীবনে অবলীলায় প্রকাশ এবং স্বীকার করেছেন নিজেই। নিজেকে নিয়ে গেছেন সততার অন্যতর উচ্চতায়। কিন্তু সেই প্রবীনকালের সাক্ষাৎকারে নীরেন্দ্রনাথ জানান অমলকান্তির বাস্তবতার কথা। সে সত্যিই ছিল; ছিল তার রৌদ্রহারা অন্ধকার বস্তি। যেখানে আলো আসার কোনও সম্ভবনাই কোনওদিন ছিল না। তার পক্ষে নিজেই ‘রোদ্দুর’ হতে চাওয়ায় যে কোনও অবাস্তবতা ছিল না, বরং ছিল এক আর্তি, সে কথা বুঝে পাঠকের নতুন করে নীরবতা ছাড়া দেওয়ার থাকে না আর কিছু। 

এতখানি পড়ার পর স্বতই আমরা বুঝি অমলকান্তির থেকেও তার ‘রোদ্দুর’ হতে চাওয়ার মধ্যেই আছে তার বিশিষ্টতা। অমন বস্তি জীবনভারে ন্যুব্জ জীবন সে যুগে অন্তত বিশেষ কিছু ছিল না। বিশেষ এই বালকের প্রত্যাশা। অমন এক জীবন তাকে জীবনবিমুখ তো করেনি। তার অন্ধকার জীবনই বরং তাকে করে তুলেছে আলোর-পিয়াসী—

ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরূলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।

সে আলোর মেদুরতা কি আশ্চর্য বিশেষত্বে ধরা পড়ে কবির কলমে। জাম আর জামরুলের পাতায় বর্ষণক্ষান্ত শেষ-বিকেলের রোদ যেই দেখেছে সে এক লহমায় বুঝে যাবে তার সোনা রঙ, তার আশাবাদ, তার স্নিগ্ধতা। অমলকান্তি খর রোদে দশদিক ধাঁধিয়ে নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতি জাহির করতে চায় না; চায় শান্ত এক নিজস্ব রোদ। সে রোদের দিকে তাকিয়ে সব মাস্টার, ডাক্তার, উকিলের মনে পড়বে, এই রোদে মিশে আছে এক ব্যর্থ বালকের নিজস্ব উপস্থিতি। যেমন মনে পড়েছে কবির। নবম শ্রেণী পেরিয়ে তিনি এখন চল্লিশের কাছে। কবেকার ভুলে যাওয়া অমলকান্তি বর্ষণ-ক্ষান্ত বিকেলের রোদ বেয়ে এসে ভর করেছে কবির লেখনিতে। বেশ রোমান্টিক, কিন্তু আজকের নবম শ্রেণীর বালকের কাছে নিশ্চত ভাবেই ভাবালু; রূঢ় ভাবে বললে – ‘ন্যাকা’। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে কবিতার আধুনিকতা, রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিকতাকে, তার হাজার হাজার ভাবালু কবিতাকে নিতান্ত অবিশ্বস্ত বলে দাগিয়ে দিতে পারেনি। সেদিন অমন ভাবনাচিন্তা পাঠকচিত্তকে আকৃষ্ট করত তার প্রমাণ কবিতাটির এই দীর্ঘ জীবন। 

অমলকান্তির ঐতিহাসিক বাস্তবতার সুরে সুর মিলিয়ে ধরা পড়ে তার বর্তমানতা। সে যে রোদ্দুর হতে পারবে না, সে তার আকাঙ্খার বহর দেখেই পাঠক হয়ত বুঝেছিল। ‘রোদ্দুর’ বলে যদি বা কিছু হয়, কোনও মানুষ রোদ্দুর হতে পারে কিনা সে সন্দেহ নিয়েই পাঠক এগিয়ে চলে এবং জানতে পারে—

আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে,
চা খায়, এটা ওটা গল্প করে, তারপর বলে, উঠি তা হলে'।
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

এমনটা বাস্তব অমলকান্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ছাপাখানার অন্ধকার ঘর তার অতীতের সঙ্গে মানানসই। আমাদের হিসেবি যাপন আমাদের কোনও আশাভঙ্গের বেদনার মুখোমুখি দাঁড় করায় কিনা সন্দেহ। যারা অমলকান্তির সামাজিক স্তরের নয়, তারা বোঝে এটাই তো স্বাভাবিক; আর যারা অমলকান্তির সামাজিক স্তরের মানুষ, তারা বোঝে এই ব্যর্থতা আর যাই হোক আশাভঙ্গ নয়। অমলকান্তির ‘আশা’-র মধ্যেই ছিল অতি, অথবা অবাস্তবতা। 

কিন্তু তাতে তো অমলকান্তির কাব্যবিষয় হয়ে ওঠা আটকায় না। যা পাঠকের কাছে নিছক ‘অতি’, তা কবিজনোচিত সহমর্মিতায় হয়ে ওঠে কাব্য-বিষয়। অমলকান্তির ভাবনার অভিনবত্বই তো তাকে কবির আগ্রহ আকর্ষণের বিষয় করে তুলেছে। তার ব্যর্থতায় ব্যাথা পাওয়ার ক্ষমতাও কেবলমাত্র কবির সহজাত। কবির আক্ষেপ যাওয়ার নয়—

আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছাপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।

সমাজের নিয়ম মেনে অমলকান্তির সহপাঠীরা এক এক জীবিকায় থিতু হয়। তাদের জীবিকায় ছিল না অমলকান্তির অভিনবত্ব। তা ধরা দিতে কসুর করেনি ধাতুরূপ নির্ভুল পড়া ছাত্রদের জীবনে। স্বভাবতই তাদের সেই জীবিকায়ও আছে ধাতব বাস্তবতা; অভিনবত্ব নয়। সেই এক সুরে বাঁধা জীবন একে অপরের সঙ্গে বদলে নিলে হানি হয় না জীবনে বা যাপনে। ডাক্তার, মোক্তার, মাস্টার জীবন বদলে নিতে পারে যে কেউ যে কারও সঙ্গে। কিন্তু অমলকান্তির আকাঙ্খা অধরা শুধু নয়, হয়ত অধরণীয়ও। বদলে সে পেয়েছে ছাপাখানার ঝুলকালির জীবন। সে ব্যর্থতা কেবল ছুঁয়ে গেছে কোনো কবিকে। অমলকান্তি যেমন স্বতন্ত্র, তেমনি তার ব্যর্থতাও। সে ব্যর্থতা কবিতার জন্ম দেয়। কবির সহানুভূতি নিয়ে সে বেঁচে থাকে আবহমান কাল—

অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি - রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।

আজকের পাঠক হাজার ব্যঙ্গ, তাচ্ছল্য নিয়ে এতদূর এসেও অমলকান্তির জন্য কোনও লুকানো দীর্ঘশ্বাসে কি নিজেকে খুঁজে পায় না? সকলেরই তো থাকে এমন কোনও অবাস্তব আশা, যা ঠিক হওয়ার মতো কিছু নয়, তাই বলার মতোও কিছু নয়। কিন্তু নিত্যদিনের ক্লিন্ন জীবনে চাপা পড়ে থাকা সেই অবাস্তব স্বপ্ন অমলকান্তির ব্যর্থতার আখ্যানের পথ ধরে হয়তো রক্ত ঝরিয়ে যায় আমাদের গোপন হৃদয় ক্ষতে। আর রচিত হওয়ার অনেক বছর পরেও পাঠক খুঁজে নেয় অমলকান্তির আখ্যান। 

এই আপাত বয়ানের পাশে, কবির সাক্ষ্যে বাস্তব হয়ে ওঠা অমলকান্তির আখ্যানের পাশে অন্য একটি গোপন আখ্যান কোনোও পাঠক খুঁজে পেলে আশ্চর্য হওয়ার নেই। কবি টি এস এলিয়ট তাঁর বিখ্যাত সব কবিতার সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন নানান সাক্ষাৎকার বা লিখিত বয়ানে। কিন্তু পাঠক গভীরচারী হলে ধরা পড়ে যায় ‘ওয়েস্টল্যান্ড’-এর কবি-ঘোষিত ব্যাখ্যানের থেকেও বিশ্বস্ততর পাঠ। কবিতা তো শুধু কবিকে প্রকাশই করে না, গোপনও করে যে! সে দূর রচনা করার খেলায় কবিও কখনও হয়ে হয়ে ওঠেন দক্ষ খেলুড়ে। কবিস্বভাবী নীরেন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি অনুরাগ তো আর যৌবনের খেয়াল কথা হতে পারে না। রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষে হঠাৎ একদিন তিনি প্রকাশ করে বসলেন ‘অন্ধকার বারান্দা’! কেনই বা তাঁর বারান্দা অন্ধকার? তিনি কি গোপনে সব বাঙালি কবির মতই, রোদ্দুর কবি, রবি হওয়ার বাসনা পোষণ করেননি? বোঝেননি সে বাসনার অভিনবত্ব আর অপ্রাপনীয়তা? এই অমল-কান্তি বাসনাটি তাঁর মনোজ নয় তো? তিনি নিজেই অমলকান্তি নন তো? সবাই যখন ডাক্তার, মাস্টার, মোক্তার হতে চায়, তখন এক গোপন কবি, রবি=রোদ্দুর হতে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? সংসার সবাইকে টেনে নেবে নিজ নিজ পথে। কবি হতে চাওয়া নীরেন্দ্রনাথ নিজে এক পত্রজীবী। ফরমায়েসি লেখা লিখে পাতা ভরানোয় আর প্রেসে কাজ করা কালিঝুলি মাখা কর্মীতে তফাত কতদূর? কিন্তু তায় কি মনের কোণে কবি=রবি=রোদ্দুর হতে চাওয়ার আকাঙ্খা নিভে যেতে পারে? সেই অমল আকাঙ্খাই কি প্রেস কর্মী নীরেন্দ্রনাথকে দিয়ে প্রকাশ করিয়ে নেয় না তাঁর মনের বারান্দায় অন্ধকার নামার কথা? রবি-কবির জন্মশতবর্ষে নিভৃতে যে কাব্য প্রকাশ পায় তাতে অমলকান্তির ব্যর্থতার মধ্যে এবং বিশেষত্বের মধ্যে কি ধরা থাকে না কবি নীরেন্দ্রনাথ? 





2 comments: