প্রবন্ধ - শিবাংশু দে
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
কবিরা খড়া বজার মেঁ
শিবাংশু দে
কবিরা খড়া বজার মেঁ, মাঁগে সবকা খ্যয়ের।
না কাহুসে দোস্তি, না কাহুসে ব্যয়ের।।
('বজার' মানে মানে এই সমাজবিশ্ব। কবির সেখানে দাঁড়িয়ে সবার মঙ্গল কামনা করছে। তার সঙ্গে কারও বন্ধুতা নেই, শত্রুতাও নেই কারও সঙ্গে।)
ছোটবেলায় পড়া কবিরের অনেক দোহার থেকে এই দোহাটি আলাদা করে মনে থেকে গিয়েছিলো। নির্গুণ ভূমাদর্শনের সব কথা এই কটা শব্দের মধ্যে ধরে ফেলা কবিরের পক্ষেই সম্ভব। বয়সের বিভিন্ন স্তরে এই শব্দনির্মাণটি বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।
প্রাতিষ্ঠানিক, লোকাচারনির্ভর ধর্মবিশ্বাসের অসারত্ব নিয়ে আমাদের সভ্যতায় ক্রমাগত চর্চা চলেছে গত তিন হাজার বছর। যদি আদি যুগের প্রথম প্রধান পুরুষ হিসেবে আমরা শাক্যমুনি বুদ্ধকে চিহ্নিত করি, তবে মধ্যযুগের প্রধান পুরুষ ছিলেন সন্ত কবির। যদিও জন্মসূত্রে বুদ্ধ ছিলেন আর্যসভ্যতার প্রতিভূ এক সামন্তপুত্র আর কবির, সমাজের প্রান্তিকতম নিম্নবর্গের একক একটি স্বরমাত্র। দুজনের জন্যই চ্যালেঞ্জ ছিলো মানুষের মৃত্যু হলেও শেষ পর্যন্ত যে মানব থেকে যায়, সেই তত্ত্বটিকে অবিসম্বাদে প্রমাণ করে যাওয়া। দুজনের মধ্যে কবিরের কাজটি বোধ হয় একটু বেশি কঠিন ছিলো। কারণ তাঁর ছিলো মূলতঃ সমন্বয়ের সাধনা। রাম, হরি, আল্লাহ, ব্রাহ্মণ-আত্মণ, উপনিষদ-বেদান্ত, নাথপন্থা, নির্গুণ ব্রহ্ম, অলখ নিরঞ্জন, সুফিবাদ, এমনকি শংকরের মোহমুদ্গর জাতীয় ( মায়া মরি না মন মরা/ মর মর গয়া শরীর।/ আশা তৃষ্ণা না মরি/ কহ গয়ে দাস কবির ।।) নানা পরস্পর বিচ্ছিন্ন মতবাদকে আত্মস্থ করে, বরণ আর বর্জনের ক্ষুরস্যধার পথে নিজের সাধনা আর লোকশিক্ষার পরম্পরা চালিয়ে যাওয়া। উপরন্তু আমাদের সভ্যতা ততোদিনে আরো হাজার দেড়েক বছর পেরিয়ে এসেছে। মধ্যযুগের 'এতো রক্ত কেন?' প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের বিবেক পর্যুদস্ত তখন।
এই সময়টি নিয়ে একটু ভেবে দেখা যাক। দিল্লির সুলতান, বিখ্যাত বা কুখ্যাত তুর্কি মুহম্মদ বিন তুঘলক আর নেই। নিহত হয়েছেন ভাই ফিরোজ শাহ তুঘলকের হাতে। সেই ফিরোজ শাহ তুঘলকও মারা গেলেন ১৩৮৮ সালে। দিল্লির মসনদে প্রায় রোজ রাজাবদল। সীমান্তের ওপারে বহুদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলেন তুর্কো-মোঙ্গল যুদ্ধব্যবসায়ী তইমুর লংগ। ১৩৯৮ সালের শীতকালে তিনি আক্রমণ করলেন দিল্লি। তৎকালীন সুলতান মাহমুদ শাহ পালিয়ে বাঁচলেন। কিন্তু আট দিনের দিল্লি অবরোধে এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হলো এবং লুণ্ঠিত হলো সব সম্পদ। একজন মুসলিম শাসকের হাতে এতো মুসলিমের রক্তচিহ্ন বোধ হয় এদেশ প্রথম দেখেছিলো তখন। হিন্দু হিন্দুর সঙ্গে নেই, মুসলিম মুসলমানের সঙ্গে নেই। মানুষ মানুষের সঙ্গে নেই। ইতিহাসের ঘোর অন্ধকার পর্ব শুরু হয়েছিলো সেদিন।
বারাণসি শহরের দক্ষিণে একটি প্রাচীন জলাশয় আছে। এই বিশাল সরোবরটির সঙ্গে কোনওকালে গঙ্গার যোগসূত্র ছিলো। নদীর মতো-ই এর জলে তরঙ্গ উঠতো এবং মানুষজনের কাছে এর পবিত্রতার খ্যাতিও শোনা যেতো। তরঙ্গকে হিন্দিতে বলে লহর, আর ফার্সিতে জলাশয়কে বলে তাল, হিন্দিতে তা হয়ে যায় তালাও। এই সরোবরটিকে লোকে বলতো লহরতাল, অপভ্রংশে লহরতারা। তার জলে ছিলো পদ্মবন আর শীতল শান্তি। আজকের বারাণসি রেল স্টেশন থেকে তিন কিমি মতো দক্ষিণে হবে। নদী গতিপথ পরিবর্তন করায় আজ গঙ্গার জল আর সেখানে পৌঁছোয়না। সরোবরের ব্যপ্তি আর নেই।
একজন মুসলিম তন্তুবায়, নাম আলি, ডাকনাম নিরু, বিয়ে করতে গিয়েছিলেন শহরের উপান্তে মান্দুর গাঁয়ে। এই মান্দুর আজকের মডুয়াডিহ। নতুন বৌ নীমাকে নিয়ে দ্বিরাগমন করতে যাবার সময় লহরতালের ধারে একটি সদ্যোজাত শিশুকে তাঁরা কুড়িয়ে পান। তার গর্ভধারিনীর কোনও খোঁজ নেই, দেখে মনে হয় উত্তমকুলে জন্ম। খোঁজাখুঁজি করেও যখন কোনও দাবিদার মেলেনা, তখন এই দম্পতি তাকে আল্লাহর আশীর্বাদ ভেবে বাড়িতে নিয়ে আসেন। নীরুর তাঁতবাড়ি ছিলো লহরতারার থেকে পাঁচ-ছ কিমি উত্তরে বরুণানদীর চৌকাঘাটের কাছে। সেখানে ছিলো একটা টিলার মতো উঁচু জমি, মুহল্লা নরহরপুরা, সেখানেই দরিদ্র নিরুজোলার দরিদ্রতর গেরস্থালী। আজ তার নাম নিরুটিলা। মৌলভি সাহেব সেই কুড়িয়ে পাওয়া শিশুর নাম দেন ঈশ্বরের নামে, কবির। কবির বড়ো হয়ে ওঠেন এই আবহে। বড়ো হবার পর তাঁর কাছে কেউ যখন বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইতো, তিনি বলতেন,
কবিরা তেরি ঝোপড়ি
গলকট্টো কে পাস ।
জো করেগা সো ভরেগা
তুম ক্যিঁউ হোত উদাস ।।
সেটা ছিলো গলকট্টো অর্থাৎ কসাইদের টোলা। তারা ছাড়া থাকতো কিছু জুলাহা আর সস্তা গণিকা। শৈশব থেকেই এই দরিদ্র মানুষগুলি ও তাদের কাদামাটির জীবনধারার সংস্পর্শে থেকে কবির বুঝতে পেরেছিলেন পোষাকি ব্রাহ্মণ্য অধ্যাত্মিকতার বহ্বাড়ম্বর এই সব দরিদ্র সংখ্যাগুরু মানুষদের কাছে কতটা মূল্যহীন।
নরহরপুরায় নিরুজোলার টিলার উপর ভাঙ্গাচোরা পর্ণকুটির আর পাশের একটা চবুতরা ছিলো কবিরের খাস দুনিয়া। একটু বড়ো হবার পর তিনি পিতার সঙ্গে জাতব্যবসায় যোগ দেন। দিনের শেষে এই চবুতরাটিই ছিলো সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে গল্পগুজবের ঠিকানা। এখানে বসেই কবির আশপাশের নিরক্ষর, হতদরিদ্র, মানহীন শ্রমজীবীর দলকে আশ্বাস দিতেন তাদের মানুষজন্ম বৃথা নয়। তাদেরও ঈশ্বরলাভ হতে পারে। ঈশ্বর শুধু ব্রাহ্মণ আর শেখসৈয়দের মৌরসিপট্টা নয়। দিনে দিনে কবিরের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে মানুষের ভীড় নরহরপুরার পুরোনো চবুতরা ছাপিয়ে যায়। পাশে আর একটা নতুন চবুতরা তৈরি করতে হয়। কবিরের নামে তার নাম হয় কবির চবুতরা। লোকমুখে সেই নাম কবিরচৌরা হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই কবিরচৌরাতে বসেই ধনীর আরও ধনলালসা দেখে ঈশ্বরের কাছে কবিরের আর্জি,
সাঁই ইতনা দিজিয়ে
জা ম্যঁয় কুটুম সমায় ।
ম্যঁয় ভি ভুখা না রহুঁ
সাধো ন ভুখা জায় ।।
আবার ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিতদের আত্মগর্ব দেখে প্রচার করলেন তাঁর অমোঘ উক্তি,
পোথি পড়ে পড়ে জগ মুয়া
পণ্ডিত বনেঁ ন কোয় ।
ঢাই আখর প্রেম কা
পড়ে সো পণ্ডিত হোয় ।।
তাৎক্ষণিক জাগতিক সাফল্যের আশায় অতৃপ্ত অসহিষ্ণু মূঢ়দের শোনালেন,
ধীরে ধীরে রে মনা
ধীরে সব কুছ হোয় ।
মালি সিঁচে সও ঘড়া
রিত আওয়ে ফল হোয় ।।
ইতিহাস যখন থেকে নিয়মানুগভাবে নথিবদ্ধ হয়েছে, অর্থাৎ সপ্তম-অষ্টম শতকে, তার পরের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এই শিশুটির আবির্ভাবের তথ্য সতত কুয়াশায় অন্তরালে। শুধু আবির্ভাবেই নয়, তাঁর তিরোভাবের তথ্যও রূপকথার রাজ্যের কথকতা। ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ এতো পরস্পরবিরোধী যে এই মানুষটির সর্বসম্মত কোনও জীবনকথা এখনও পাওয়া যায়না। তাঁর জন্মসাল হিসেবে একবার বলা হয় ১৩৯৮, আবার কখনও ১৪৪০ বা ১৪৫৫ সন। তবে তিনি গুরু নানকের (জন্ম ১৪৬৯) অনেক আগেই এসেছিলেন সেটা নিশ্চিত। গুরু নানকের 'জন্মসাক্ষী' পঞ্জি বেশ নিষ্ঠা সহকারে গ্রন্থিত আছে। সেখানে দেখছি তাঁর প্রথম দেশযাত্রা, যাকে শিখরা 'উদাসী' বলে থাকেন, সেটি ছিলো ১৫০০ থেকে ১৫০৭ সালের মধ্যে। এই সময়ই গুরু নানক বারাণসিতে সন্ত কবিরের সঙ্গ করেছিলেন। গুরু নানকের সঙ্গী ছিলেন ভাই মর্দানা, একজন মুসলিম। এর ঠিক আগেই ১৪৯৯ সালে গুরু নানকের ইষ্টদর্শন হয় এবং তিনি প্রচার করতে থাকেন, ঈশ্বর তাঁকে বলেছেন জগতে হিন্দুও নেই, মুসলমানও নেই, শুধু 'আমি' আছি। তাই নানক সমস্ত প্রচলিত ধর্মমতকে অস্বীকার করে 'ঈশ্বর'এর শিষ্য হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেন। শুধুমাত্র ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমেই যে মানুষের উত্তরণ ঘটে সেই আদর্শই তিনি সন ১৫০০ থেকে ১৫২৪ পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষ, তিব্বত, মধ্য এসিয়া, আরবদেশ ও শ্রীলংকায় প্রচার করেন। গুরু নানক যখন বারাণসিতে এসেছিলেন, তখন সন্ত কবিরের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা মধ্যগগনে। কারণ গুরু নানকের ধর্মমত যেসব সাধকের চিন্তন ও বোধিপুষ্ট, সন্ত কবির তার মধ্যে প্রধান। গুরু গ্রন্থসাহিবে সর্বাধিক গ্রন্থিত রচনা সন্ত কবিরের বাণী থেকেই সংগৃহীত। তাই ধরে নেওয়া যায় মোটামুটি ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে পরে হতে পারে। কিন্তু তিনি যে একদিন এদেশের মাটিতে বেঁচে ছিলেন, হেঁটে বেড়িয়েছেন, আর এদেশেই একদিন ঐহিক অস্তিত্ত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সামূহিক মানববিশ্বে লীন হয়ে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ রয়ে গেছে তাঁর রচনাবলীতে আর লোকবিশ্বাসে ।
জাতি জুলাহা নাম কবিরা , বনি বনি ফিরো উদাসী .....
জুলাহা, বাংলায় যার নাম জোলা, অর্থাৎ তন্তুবায় নামের শ্রমজীবী শ্রেণী ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিলো। কিন্তু সেই সময় এইদেশের যেসব প্রান্তে বয়নশিল্পের চূড়ান্ত উন্নতি ঘটেছিলো, সেখানে স্বাভাবিকভাবে তন্তুবায়বর্গের মানুষদের বৃহৎ বসতিও প্রতিষ্ঠিত হয়। বারাণসি ছিলো উত্তর ভারতে সে রকম একটি কেন্দ্র। সেখানেই জন্ম সন্ত কবিরের এবং তিনি স্বীকার করেছিলেন পালক পিতার বৃত্তিগত পরিচয়। সেই সূত্রে মুসলিম হলেও অধ্যাত্মদর্শনের প্রথম গুরুমুখী পাঠ তিনি নিয়ে ছিলেন সন্ত রামানন্দের (আনুমানিক ১২৯৯- ১৪১০) কাছে। ভারতবর্ষে মধ্যযুগের ভক্তিবাদী অধ্যাত্ম আন্দোলনের তিনি ছিলেন প্রধান পুরুষ। তাঁর দর্শনের সঙ্গে পারস্য থেকে আসা ইসলামি সুফি দর্শন মিলেমিশে তৈরি হয় এ দেশের প্রথম সমন্বয়বাদী অধ্যাত্মসাধনা। পরবর্তীকালের ভারতবর্ষে বৃহত্তর জনমানসে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শন বলতে যে বোধটি বিকশিত হয়েছে তার অংকুর এই সময়েই স্ফুরিত হয়। এই আন্দোলনের সমস্ত নায়করা, যেমন, সন্ত কবির, সন্ত রবিদাস, সন্ত নানক, পরবর্তীকালে সন্ত তুকারাম সবাই সন্ত রামানন্দের ভাবশিষ্য। সন্ত রামানন্দ ও কবিরের সম্পর্কটি ভারতবর্ষে পরবর্তীকালের অধ্যাত্ম ও রাজনৈতিক জগতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিংবদন্তি বলে সন্ত কবির নিজের জন্মপরিচয় লুকিয়ে সন্ত রামানন্দের থেকে শিক্ষা নেন। কারণ তখনও পর্যন্ত প্রয়াগের ব্রাহ্মণ রামানন্দ কোনও 'বিধর্মী'কে তাঁর উপদেশ দিতে স্বীকৃত ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাস বলে সন্ত রামানন্দ ও সন্ত কবিরের মধ্যে দীর্ঘ বোধবিনিময়ের ধারা দুজনকেই একসঙ্গে সমৃদ্ধ করে তোলে। এমন রটনাও রয়েছে যে কবিরের মাতা ছিলেন এক অকালবিধবা ব্রাহ্মণ রমণী। রামানন্দ তাঁকে পুত্রবতী হবার বর দিয়েছিলেন। ফলতঃ তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। তবে সম্ভবতঃ ঘটনা হলো, কবিরের প্রকৃত পিতা রামানন্দের একজন ব্রাহ্মণ শিষ্য এবং কবিরের গর্ভধারিণী সেই ব্রাহ্মণ বিধবা রমণী। লোকলজ্জায় তাঁরা সদ্যোজাত সন্তানকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন লহরতারার জলে। সেখান থেকেই 'ম্লেচ্ছ' জোলা নিরু আর নিমা তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। অবশ্য আধুনিককালের পণ্ডিতরা এই কিংবদন্তি'তে আস্থা রাখেন না। শার্ল ভডভিল বলেছেন, কবির ছিলেন একেবারে নিম্নবর্গের আতরাফ মুসলমান পরিবারের সন্তান, যাঁরা আদত ইসলামি ধর্ম বা লোকাচার সম্বন্ধে বিশেষ ওয়কিফহাল ছিলেন না। তাঁরা সম্ভবত ছিলেন পুরুষানুক্রমিক নাথপন্থী ইতরবর্গের মানুষ। হয়তো নেহাৎ অর্বাচীন, কলমা কবুল করা মুসলমান। যার ফলে কবিরের রচনায় যেসব উদাহরণ, চিত্রকল্প, প্রতীকী সন্দর্ভ আমরা বার বার দেখতে পাই, সেখানে তন্ত্র, নাথপন্থা ও অন্যান্য লোকজ বিশ্বাসের প্রভাব বিশেষ প্রকট। ওয়েন্ডি ডনিগার তো সরাসরি বলেছেন, কবির সচেতনভাবে হিন্দু ও ইসলাম দুটি ধর্মবিশ্বাসকেই প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব 'ধর্মমত' প্রচার করেছিলেন এই দুটি ধর্মের ধ্বংসাবশেষের উপর। এ বিষয়ে তাঁর উত্তরসূরি ছিলেন মধ্যযুগের বহু সুফি সাধক।
তবে সন্ত কবিরের নিজস্ব ব্যাখ্যায় সন্ত রামানন্দ অনুসৃত শ্রীরামানুজ কথিত নির্গুণ ব্রহ্ম, একেশ্বরবাদ ও প্রেমভক্তির পথে ঈশ্বর, আল্লাহ, হরি, রাম বা অলখ নিরঞ্জনলাভ দর্শনতত্ত্ব সেই সময় থেকেই আপামর ভারতবাসীর মধ্যে অত্যন্ত কার্যকরীভাবে গৃহীত হয়েছিলো। অনেকদিন পরের মানুষ আমাদের লালন সাঁই বলছেন,
'শুদ্ধভক্তি মাতোয়ালা, ভক্ত কবির জেতে জোলা
সে ধরেছে ব্রজের কালা, দিয়ে সর্বস্বধন তাই।।
ভক্তের দোরে বাঁধা আছেন সাঁই।।'
জব ম্যঁয় থা, তব হরি নহি
অব হরি হ্যাঁয়, ম্যঁয় নহি
সব অঁধিয়ারা মিট গয়া
জব দীপক দেখা ম্যঁয়নে।।
সেই অন্ধকারযুগে সহায়হীন নিপীড়িত শ্রমজীবী শ্রেণীর ইতরমানুষদের আত্মার শুশ্রূষায় প্রদীপের আলো হাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন সন্ত কবির। তিনি সন্ন্যাসী ছিলেন না। সংসার করেছিলেন, পত্নীর নাম ছিলো লো'ই। এক পুত্র কমাল আর কন্যা কমালি। পুত্র কমাল পিতার সাধনার মর্ম বুঝতেন না। তিনি ছিলেন বিষয়বিষে বিজড়িত। আক্ষেপ করে কবির বলেছিলেন,
' বুরা বংস কবির কা, উপজা পুত কমাল
হরি কে সুমিরন ছোড়কে, ঘর লে আয়া মাল।।'
গুরু রামানন্দ ও শিষ্য কবিরের মূল কর্মক্ষেত্র ছিলো শহর বারাণসি। গুরু ছিলেন সে সময়ের ভারতবর্ষে একজন শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, দার্শনিক ও প্রসিদ্ধ চিন্তানায়ক আর চেলা ছিলেন 'নিরক্ষর' সামাজিক মর্যাদাহীন জোলা। নিজের সম্বন্ধে কবির বলেছিলেন,
'মসি কাগদ ছুয়ো নহি
কলম গহি নহি হাথ।।'
আর গুরু সম্বন্ধে বলেছিলেন,
' গুরু গোবিন্দ দোনো খড়েঁ
কাকে লাগু পাঁয়
বলিহারি গুরু আপনো
গোবিন্দ দিয়ো মিলায়।।'
সন্ত কবির ছিলেন ভারতবর্ষের শাশ্বত ইতরযানী বোধিবিশ্বের ভাণ্ডারী ও নায়ক। ব্রাহ্মণ্য বোধ ও উপলব্ধির চেনা কক্ষপথের বাইরে আবহমানকাল ধরে এদেশে গরিষ্ঠ মানুষের মননজগতের শ্রেষ্ঠ ফসল উদ্গত হয় সন্ত কবিরের এই সব অমৃতবাণীর মাধ্যমে। তাঁর বাণীর প্রথম প্রামাণ্য সংকলন পাওয়া গুরু অর্জনদেব সংগৃহীত শিখদের 'আদিগ্রন্থ' আর গোবিন্দওয়াল পোথির মধ্যে। তার পর রাজস্থান থেকে সংগৃহীত 'বীজক' আর বুন্দেলখণ্ড থেকে নথিবদ্ধ করা 'অনুরাগসাগর'। এসবের প্রণেতা ছিলেন নিরক্ষর, তাই এর প্রামাণ্যতা শুধু বাচনিক ঐতিহ্যের মধ্যে বিচরণ করেছে। উইলসনসাহেবের মতে কবিরের রচিত দোহাসংকলনের সংখ্যা আট। বিশপ ওয়েস্টকট সাহেব বলেছেন সংখ্যাটি চুরাশি। অন্যমতে রামদাস গৌড় বলেন কবিরের রচনার একাত্তরটি সংগ্রহ রয়েছে। তবে তাঁর সমস্ত রচনাই 'বীজকে'র মধ্যে মোটামুটি গ্রন্থিত আছে। বীজকের তিনটি ভাগ আছে, রমৈনি, সবদ আর সারওয়ি। শৈলির বিচারে তাঁর রচনায় রয়েছে তিনধরণের রচনা। দোহে, সলোক (শ্লোক) আর সাখি (সাক্ষী)। তাঁর রচনাগুলি যেহেতু ভক্তদের শ্রুতির মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিলো, তাই অনেক ভাষায় তার নানা রূপ দেখা যায়। যেমন, পঞ্জাবি, ব্রজভাখ, রাজস্থানী, খড়ি বোলি, অওধি, পুরবি ইত্যাদি।
তিনি ছিলেন এক গর্বিত 'জুলাহা'। যেখানেই নিজের সম্পর্কে কিছু বলার, তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে নিজের শ্রমজীবী জাতিপরিচয় নিয়ে সরব হয়েছেন। ঈশ্বর তাঁর কাছে একজন শ্রেষ্ঠ তন্তুবায়। ঠিক যেভাবে একজন জোলা সুতোর সঙ্গে সুতোর খেলায় মত্ত হয়ে অনুপুঙ্খ কৌশলে শিল্পসৃষ্টি করে, সেভাবেই ঈশ্বর মাতৃগর্ভ নামক তাঁত থেকে সমস্ত প্রাণ, সারা জগতসংসারকে উৎপন্ন করছেন। এই ধারণাটি তন্ত্র ও আগমের একটি মুখ্য সূত্র। আবার তাঁর আরাধ্য 'হরি' সম্বন্ধে বলছেন,
' সাত সমন্দর কী মসি করৌঁ
লেখনি সব বনরাই ।
ধরতি সব কাগদ করৌঁ
হরিগুণ লিখা ন জাই ।।'
পশ্চিমের সংস্পর্শে আসা ভারতীয়দের মধ্যে বিদেশে কবিরবাণী প্রচারের প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অগ্রগণ্য। ১৯১৫ সালে 'সংস অফ কবির' নামে তাঁর অনুদিত কবিরের একশোটি কবিতা লন্ডনে প্রকাশিত হয়। ইভলিন আন্ডারহিল এই সংকলনটির ভূমিকা লিখে দেন। এই বইটি পড়েই ডব্লিউ বি ইয়েটস পশ্চিমে কবিরকে বিস্তৃত পরিচিতি দান করেন। অবশ্য পরবর্তীকালের গবেষকদের মতে এই একশোটি কবিতার মধ্যে বড়ো জোর ছ'টি কবিতা কবিরের নিজস্ব রচনা। বাকিগুলি সম্ভবতঃ কবিরের শিষ্যপ্রশিষ্য নানা ভক্ত সাধকের সৃষ্টি। যদিও সেগুলিতে কবিরের দর্শন ও রচনাশৈলি বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করা হয়েছিলো।
কবিরের তিরোভাব হয়েছিলো বারাণসি থেকে প্রায় দুশো কিমি দূরে গোরখপুরের কাছে মগহরে। তাঁর জন্মের কাহিনী এতো-ই অস্পষ্ট যে তাঁর প্রকৃত জন্মস্থান বারাণসি কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কিন্তু বনারস তাঁর কর্মভূমি এবং চিরকালীন ভারতবোধে এই স্থান ও কবির অচ্ছেদ্য সম্পর্কে বাঁধা। একসময়ের গণিকা, কসাই ও অন্যান্য 'অসামাজিক' পেশায় নিয়োজিত মানুষ অধ্যুষিত এই স্থানে বসবাস করে মহাত্মা কবির কোন প্রেরণায় নিখিল মানবাত্মার কাছে তাঁর শাশ্বত সন্দেশ পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন, তা হৃদয়ঙ্গম করার একটা বাসনা আমাকে তাঁর দিকে টেনে নিয়ে যায়। অন্ধকার মধ্যযুগে ভারতদর্শনের সারসংক্ষেপ একজন 'অশিক্ষিত', হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিলো আর্যাবর্তের সংখ্যাগুরু নিপীড়িত, দরিদ্র, হতমান, ইতর মানবজাতির কাছে আত্মার শুশ্রূষা হয়ে।
"চাহ মিটি, চিন্তা মিটি, মনওয়া বেপরওয়াহ
জিসকো কুছ নহি চাহিয়ে, উওহ হ্যাঁয় শহনশাহ।।"
Gurubhaar n0y, kintu diptis0ncharee lekha m0nke ujjw0l k0re. Lekh0kke obhin0ndon!
ReplyDelete