প্রবন্ধ - কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
মানুষ আইনস্টাইন
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
নিউইয়র্ক শহর। কুলু কুলু তানে বয়ে চলেছে হাডসন নদী। এরই তীরে দাঁড়িয়ে আছে ‘রিভার সাইড’ গীর্জা। আর পাঁচটা গীর্জার থেকে এই গীর্জার পরিবেশ যেন একটু আলাদা। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে আকর্ষণ করে গীর্জার প্রাচীরে উৎকীর্ণ ছয়শত মনীষির প্রতিকৃতির সঙ্গে থাকা আইনস্টাইনের প্রতিকৃতি। দু-দণ্ড না দাঁড়িয়ে উপায় নেই। শুধু বিজ্ঞানী নন, মানুষ হিসেবেও তিনি সকলের নমস্য।
আইনস্টাইন মনে প্রাণে ছিলেন শান্তিবাদী। অর্থ, যশ কোনও কিছুর প্রতি তাঁর লোভ ছিল না। খ্যাতির শিখরে পৌঁছেও তাঁর কোনও অহঙ্কার ছিল না। তিনি সবসময় বলতেন, ‘আমার মানসিক ও শারীরিক জীবন নির্ভর করছে যে সকল জীবিত বা মৃত ব্যাক্তিদের পরিশ্রমের উপর আমি তাদের প্রতিদিন স্মরণ করি। আমি যে খাদ্য খাই, যে পোশাক পরি, যে গৃহে বাস করি তা সবই তো করে দিয়েছে অন্য লোক। এমনকী শৈশব থেকে যে জ্ঞানভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছি, তাও অন্যের দান। অন্যের কাছ থেকে যতটা পেয়েছি ততটাই আমাকে দান করে যেতে হবে।
১৪ মার্চ ১৮৭৯ জার্মানির উলম শহরে এক ইহুদি পরিবারে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম। পিতা হেরম্যান আইনস্টাইন ছিলেন একজন ছোট ব্যবসায়ী। মিউনিখে স্কুল জীবন শেষ করে অ্যালবার্ট ভর্তি হন জুরিখের পলিটেক্নিক্ ইনস্টিটিউটে। পড়াশোনা শেষ করে সামান্য কেরাণীর চাকরি দিয়ে জীবন শুরু করলেও গবেষণার কাজের প্রতি ছিল তাঁর অদম্য আগ্রহ। মস্তিষ্ক ও মেধা ছিল তাঁর আসল গবেষণাগার। তাত্ত্বিক ও ফলিত বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটানোর জন্য তাঁর দরকার হয়েছিল শুধু কিছু কাগজ, পেন্সিল আর একরাশ গাণিতিক সংখ্যা।
১৯০১ সালে কৈশিক আকর্ষণ বিষয়ে আইনস্টাইনের প্রথম মৌলিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এরপর গণিত, তাপ, আলোক ও বিদ্যুৎ বিষয়ের উপর তাঁর মৌলিক প্রবন্ধগুলি একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে। আইনস্টাইনই প্রথম বলেন, ‘বিশ্বজগত গতিশীল’। এখানে কোনও কিছুই স্থির নয়। আমরা যা কিছু মাপছি তা গতির পরিপ্রেক্ষিতেই মাপতে হবে। তাই শুধু দৈর্ঘ, প্রস্থ ও বেধ এই তিনটে দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও বস্তুর সঠিক পরিমাপ করা সম্ভব নয়। জটিল গাণিতিক বিশ্লেষণের পর তিনি গড়ে তুললেন তাঁর বিখ্যাত ‘স্পেস টাইম ফাংশন’। সেইসঙ্গে পরিমাপের জগতে প্রবর্তিত হলো চতুর্থ মাত্রা ‘সময়’ অর্থাৎ, ‘ফোর্থ ডায়মেনশন’।
নিউটন বলেছেন, ‘মাধ্যাকর্ষণ পদার্থের স্বাভাবিক ধর্ম’। আইনস্টাইন কিন্তু ভিন্ন মত পোষণ করলেন। তিনি বললেন, ‘যেহেতু বিশ্বজগত গতিশীল তাই এখানে অ্যাবসল্যুট মাপ বলে কিছু নেই। সমস্ত কিছুই একে অপরের আপেক্ষিক’। একমাত্র আলোকে তিনি নিত্য বস্তু বলেছিলেন এবং আলোর গতিবেগকেই তিনি চরম গতিবেগ বলে মনে করতেন। ভর ও গতিবেগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন ভর ও গতি একে অপরের উপর নির্ভরশীল। কোনও বস্তুর গতি বাড়লে তার ভরেরও গতি বাড়ে। এই গতি বাড়তে বাড়তে যদি আলোর গতিবেগের সমান দাঁড়ায় তাহলে বস্তুর ভর হয়ে যাবে অসীম।
আইনস্টাইনের আগে বিজ্ঞানীদের ধরণা ছিল পদার্থ ও শক্তি দু’টি বিপরীত সত্ত্বা। আইনস্টাইন বললেন, না, দুটো একই— একটির আরেকটিতে রূপান্তরিত হওয়া সম্ভব। তাঁর ধারণা যে অমূলক নয় তার প্রমাণ রাখলেন বিখ্যাত সূত্র E=mc2 (E = শক্তি, m = ভর, c = আলোর গতিবেগ) আবিষ্কার করে।
১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ‘স্পেশাল থিয়োরি’ এবং ১৯১৬ সালে ‘জেনারালাইজড থিয়োরি’ প্রকাশিত হয়। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বিজ্ঞানী মহলে বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে পালটে দিয়ে বিজ্ঞানের আঙিনায় এক বিরাট বিপ্লবের সৃষ্টি করে। এরপরেই আইনস্টাইনের খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে অ্যালবার্ট নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৩৩ সালে হিট্লারের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য তিনি গোপনে জার্মানি ত্যাগ করে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড হয়ে আমেরিকায় চলে যান এবং ১৯৪০ সালে সেখানকার নাগরিকত্বগ্রহণ করেন।
আমেরিকার নিউজার্সি স্টেটের একটি শহরের নাম প্রিন্সটন। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও এই শহরের নামে। আইনস্টাইন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঐ পদেই তিনি সম্মানের সঙ্গে কাজ করেন। আইনস্টাইন চাইতেন বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হোক, ধ্বংসের কাজে নয়। হিরোসিমা ও নাগাসাকির উপর পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটার পর তিনি দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন, “আবার যদি জন্মাতে হয় তবে যেন বিজ্ঞানী হয়ে না জন্মাই। জন্মাতে চাই কামার, কুমোর বা ছুতোর হয়ে যাতে করে চিন্তার বাক্যে ও কর্মের স্বাধীনতা থাকে, শান্তি থাকে কর্মে ও মনে”।
অবসর গ্রহণের পর আইনস্টাইনকে সাত হাজার ডলার পেনশন দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। আইনস্টাইন অতি সাধারণ জীবনযাপন পছন্দ করতেন। তিনি যে বাড়িতে থাকতেন সেটাও ছিল অতি সাধারণ মানের। তিনি দেখলেন তাঁর অবসর জীবনযাপনে অত অর্থের প্রয়োজন নেই। তাই তিনি পেনশনের অর্থ কমিয়ে দিতে বললেন। অনেক অনুরোধ উপরোধের পর অবশেষে তিনি ছয় হাজার ডলার পেনশন গ্রহণে সম্মত হন।
১৯৫৫ সালে এপ্রিল মাস। সমগ্র বিশ্বে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল— অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আর ইহলোকে নেই। জন্ম সূত্রে ইহুদী হওয়ায়, প্রথানুযায়ী ‘হেভরাহ কদিশ’ (ধর্মীয় পুরোহিতদের সাহায্য নেওয়া) এবং ‘মিতজভার’ (মৃতদেহ নিয়ে শোভাযাত্রা) হওয়া উচিত। কিন্তু কোনোটাই ছেলে হানস্ অ্যালবার্টের ইচ্ছে নয়। পিতার শেষ ইচ্ছেকেই সম্মান জানাতে তিনি বেশি আগ্রহী। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের শেষ ইচ্ছে ছিল, ইহুদী ধর্মের সমস্ত নিয়ম অগ্রাহ্য করে তাঁর মৃতদেহ যেন কোনো ‘ক্রিমেটোরিয়ামে’ নিয়ে গিয়ে দাহ করা হয় এবং দাহ শেষে ছাইগুলি যেন কোনও গোপনস্থানে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে ঐ ছাইয়ের উপর কোনো স্মৃতি বানিয়ে তাঁকে দৈব প্রেরিত কোনও মহাপুরুষে পরিণত করা না হয়।
হানস্ অ্যালবার্ট পিতার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী কোনও পুরোহিত ডেকে মৃত ব্যাক্তির আত্মার শান্তির জন্য কোনো ‘হেসপেড’ পাঠ করাননি বা পিতার মৃতদেহের সঙ্গে পবিত্র ইজরাইলের এক চিমটে মাটিও দিতে দেন নি। তবে বোনেদের অনুরোধে ‘তাহারা’ অর্থাৎ মৃতিদেহকে ধুয়ে মুছে গন্ধদ্রব্য মাখিয়ে দেওয়া এবং ‘ইয়া ক্রিচিন’-এ অর্থাৎ মৃতদেহকে ইহুদী প্রথানুযায়ী মৃত্যুর প্রতীক পোশাক হিসেবে একটি ধবধবে সাদা আলখাল্লা পরিয়ে দিতে রাজী হয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যরাতে প্রিন্সটন শহর থেকে একটি গাড়ীতে করে পিতার মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে হানস্ অত্যন্ত গোপনে ক্রিমেটোরিয়ামে দাহ করে ছাইগুলি কোনও এক গোপন স্থানে ছড়িয়ে দেন যার সাক্ষী একমাত্র তিনি নিজে।
0 comments: