ছোটগল্প - সুদেব ভট্টাচার্য
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
জীবনধারা
সুদেব ভট্টাচার্য
সুধাকান্ত বসে আছেন এখনও একইরকম ভাবে। শীর্ণ হাতদুটি সমস্ত গায়ের জোর দিয়ে আঁকড়ে রয়েছে হুইলচেয়ারের দুটো হাতল। আবছা দৃষ্টির ঘোলাটে চোখদুটি এখনও একই দৃষ্টে চেয়ে রয়েছে উষার মুখের দিকে। অশীতিপর বৃদ্ধ হুইল চেয়ারে বসে এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না সৃষ্টির এই নিদারুণ অনভিপ্রেত আঘাতটির মানে। মেয়ে চন্দ্রাণী উষার মুখে চন্দনের টিপ পরিয়ে দিচ্ছে যত্ন করে। ছেলে রমেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে শববাহী গাড়ির খোঁজের কাজে। পুত্রবধূ রেশমাও এক কোণে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সবাই কেমন যেন ভীষণ গুম মেরে গিয়েছে। ভারী, গুমোট একটা আবহাওয়া এসে মাথার ওপর ধীরে ধীরে চেপে বসছে ক্রমাগত। সুধাকান্তর ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু তার মুখ থেকে কথা সরছে না তবু। শুধু একমনে চেয়ে আছেন উনআশি বছরের শায়িত উষার দিকে চেয়ে। অমন নরম মানুষটার হাত পা গুলি কেমন যেন শক্ত হয়ে গিয়েছে। উষা কি সত্যিই আর ফিরবে না কোনোদিন? সুধাকান্তর বুকের ভিতরে একশোটা কালবৈশাখী ধেয়ে আসছে। অজান্তেই ফুলে ফেঁপে উঠছে সে ঝড়। কিন্তু বাইরের কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না। সবাই শুধু লক্ষ্য করছে, এই অথর্ব বুড়ো মানুষটার মধ্যে হঠাত করে এই অদ্ভুত নির্লিপ্তি কোথা থেকে এল? চন্দ্রাণী মাকে সাজিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকালো একবার। সুধাকান্তর চক্ষু স্থির।
“বাবা তুমি এমন চুপ করে থেকো না, কিছু বলো -কেঁদে উঠল চন্দ্রাণী।”
জামাই এগিয়ে এসে সুধাকান্তর হুইলচেয়ারটা ঠেলে এগিয়ে নিয়ে এলেন উষার শবের কাছে। সুধাকান্তর পা দুটো টলে গেল যেন। শেষ পাঁচ বছরের দীর্ঘ রোগ ভোগের পর অসাড় পা-দুটোতে এই প্রথমবার যেন একটূ আলোড়ন হয়ে গেল। আর দীর্ঘ একষট্টি বছরের দাম্পত্য জীবনে সুধাকান্ত এই প্রথম ভয় পেলেন ঊষার কাছে যেতে। এত কাছে, ঊষা শুয়ে আছে নিস্পন্দ, অথচ সুধাকান্ত কুঁকড়ে যাচ্ছেন ভীষণ। তবে কি এ ঊষার কাছে নয়, মৃত্যুর কাছে এগিয়ে যাওয়া? নাকি একটা পরিত্যক্ত বিকেলের মত সামনের অনিশ্চিত জীবনটুকু একলা কাটানোর ভয়?
সুধাকান্ত চেয়ে আছেন এখনও বোবার মত ভাবলেশহীন। রমেশ গাড়ি নিয়ে এসে গিয়েছে। ঘরে প্রতিবেশীদের ভীড়, তিলধারণের জায়গা নেই। গামছা কোমরে পাড়ার ছেলেরা এসে হাজির। চন্দ্রানী কেঁদে চলেছে সমানে হাউহাউ করে। সুধাকান্তের একমাত্র বোন ললিতা এসে সুধাকান্তকে জড়িয়ে ধরে বলল, “দাদা, কিছু বলবি না তুই? তোর কষ্ট হচ্ছে দাদা? বউদিকে শেষবেলাতে কিচ্ছু বলবি না দাদা?”
সুধাকান্ত শুধু কাঁপতে থাকা একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। সাদা চাদরে আতরের কড়া গন্ধ নাক জ্বালিয়ে দেয়। সেই চাদর ঠেলে সরিয়ে তাঁর আঁঙ্গুলগুলি খুঁজে পেল ঊষার ডান হাতটা। কি ঠাণ্ডা! এত ঠাণ্ডা ছিল উষা! এত শক্ত! সুধাকান্ত বুঝতে পারেননি এতদিন? যখন কপাল ভরে মোটা করে সিঁদুর পরে উষারানী এই হাতেই বার্লি গুলে নিয়ে সুধাকান্তর মুখের সামনে দিত, কই তখন তো কড়া উত্তাপই টের পেতেন সুধাকান্ত। সারাদিন শাসন শুনতে শুনতে সুধাকান্ত তিতিবিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সারাদিন দুজনে মিলে ঝগড়া করতেই ব্যাস্ত। ছেলে-বৌ বুড়োবুড়িকে সামলাতেই হিমসিম।
ঊষা তো রেগে প্রায়ই দাঁতে দাঁত চেপে বলত, “বুড়ো এবার গেলে হাড় জুড়োয় আমার!”
সত্যিই তো, আগেই তো যাবার কথা ছিল তাঁর। রোজ দিনে পাঁচটা করে কড়া ট্যাবলেট আর ক্যাপসুল। সবকটা গুনে গুনে গেলাত ওই বুড়ি। রক্তে কেজি কেজি শর্করা আর পায়ে পক্ষাঘাত নিয়ে মানুষ বাঁচে? সুধাকান্ত নিজেই তাই পালটা সুরে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই তো রোগের ডিপো। আমি গেলে তো তোমারই থাকবে পড়ে সব। আমাকে তো যেতে বলবেই তুমি।”
কিন্তু একরাতের হার্ট অ্যাটাকে তো কিস্তিমাত করে দিল ঊষা। এভাবে বেহায়ার মতো চলে গেল? কাকে মজা বোঝালো সে? সুধাকান্তর চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। এত অভিমান সুধাকান্ত রাখবেন কোথায়? উষার আঙ্গুলগুলি সবার আড়ালে ভালো করে টিপে দিলেন তিনি। মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে হাতদুটো আবার গুটিয়ে নিলেন সুধাকান্ত। না, কাউকে কিছু বলার নেই তাঁর। তিনি তো আর ঘুমজাগানিয়া নন, এক অসহায় নীরব দর্শক মাত্র।
সুধাকান্তর কিছু বন্ধু এসে হাজির এর মধ্যে।
বিপিন এগিয়ে এসে বলল, “আমাদের ব্রাহ্ম সমাজের নিয়ম অনুযায়ী কিছু গান হবে না সুধাকান্ত? আমরা প্রার্থনা আর ব্রহ্মসঙ্গীত গেয়েই বৌদিকে বিদায় জানাতে চাই।”
সুধাকান্ত সম্মতিতে মাথা নাড়লেন। এখনও অবধি তাঁর ঠোঁট এতটুকুও ফাঁক হয়নি। ঘর ভর্তি লোক দাঁড়িয়ে আছে নীরবে। বিপিনবাবু উপনিষদের মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন, “অসদোমা সদগময়, তমসোমা জ্যোতির্গময় ,মৃত্যুর্মা অমৃতমগময়...”
সুধাকান্ত এই প্রথমবার জানলার বাইরে তাকালেন। ঝিরিঝিরি হাওয়ায় ব্যালকনিতে অযাচিতভাবে ঢুকে পড়া মাধবীলতার পাতাগুলি কেমন দোল খাচ্ছে। এই গাছটা ঊষার হাতে লাগানো। একষট্টি বছর অনেকটা বড় সময় হয়ত। সুধাকান্তর আবছা মনে পড়ে অষ্টাদশী ঊষার ভীতু, শ্যামলা মুখটা - মাথায় একটা সোলার মুকুট। মুখে ছিল আজকের দিনের মতই চন্দনের সাজ। টিপ টিপ পায়ে এই সংসারে এসে ঢুকেছিল ছোট্ট একটা মেয়ে। তারপর অনেকটা বছর পথ চলার পর সেই কিশোরীর পাকা গিন্নী হয়ে ওঠা। এরকমই এক মেঘলা দিনে অসুস্থ শাশুড়ির থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে সংসারের দায়ভার প্রাপ্তি, প্রথম মা হওয়া আর শেষমেশ শাসনকারী অভিভাবকের পালা সাঙ্গ করে চন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে ঠেকা। সেদিনের কাঁচা বাড়ি আজ তিনতলা হয়েছে, রমেশের বউ এসেছে, চন্দ্রাণী চলে গিয়েছে পরের বাড়ি। কুয়োতলা অদৃশ্য হয়েছে, সাদাকালো টিভি গিয়ে এলসিডি। সব কিছু পালটে গিয়েছে যেন হুহু করে ছুটে আসা কোনও দুরন্ত ট্রেনের গতিতে। তবু ঐ মাধবীলতার গাছটা আজও একই রয়ে গিয়েছে, তফাত শুধু এটাই - এবারের ফুলগুলি আর দেখা হবে না ঊষার।
জীবন কিরকম ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ঠিক গলে পড়ে। মীড়ের মত ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের গভীর কোনও তার। সিমেন্ট বালি কঙ্ক্রীট চাপা দিয়ে, মৃত্যুর বীভিষিকা নিয়ে এসে কি তাকে কোনোমতে স্তব্ধ করা যায়? আজ উষার নাম কেমন করে যেন মাধবীলতা হয়ে গেছে। সামনে একটা দেহ আকড়ে ধরে এরা মন্ত্র পড়ছে, কান্নাকাটি করছে। অথচ সুধাকান্ত বেশ বুঝতে পারছেন তাঁর ভিতরের ঘনীভূত মেঘগুলি যেন ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। ওই মাধবীলতার পাতার ভিতর দিয়ে সূর্যালোক ঠিক নিজের জায়গা খুঁজে নিচ্ছে।
সুধাকান্ত বারান্দার ওই জীবনটুকু থেকে আবার ফিরে এলেন তার ঘরে। এতক্ষণে অনেক গান গাওয়া হয়েছে। চন্দ্রাণীকে জল খাওয়াচ্ছে জামাই, বেচারীর চোখের জলও শুকিয়ে গিয়েছে শোকে।
সুধাকান্ত এখনও নীরব। ললিতা তার কাঁধ ছুঁয়ে রয়েছে। এবারে ডেডবডি নিয়ে যাওয়া হবে। বিপিনবাবু শেষ গানটি ধরলেন, “আছে দুঃখ আছে মৃত্যু...”
সুধাকান্তর এসব গান আর ভালো লাগছে না। বড্ড, বড্ড বেশি বিষাদ। তিনি হাতের ইশারাতে থামতে বললেন বিপিনবাবুকে।
রমেশ এগিয়ে এসে বলল, “বাবা এতক্ষণ তুমি একটাও কথা বলনি। এবারে মাকে নিয়ে যাবার সময় এসেছে। আমরা আস্তে আস্তে এগোই তাহলে। গাড়ি রেডি আছে। পিসি রইল ঘরে।”
চন্দ্রাণী কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বাবা পাষাণ হয়ে গেছে রে দাদা! বাবা, তুমি কিছু বলো। মাকে শেষ দেখাটা দেখে নাও।”
সবাই কাঁধে তুলল উষারানীকে। বলহরি হরিবোল। বলহরি হরিবোল।
সুধাকান্ত চোখদুটো বুজে ফেললেন। মনে মনে খেলার সাথীকে তিনি বিদায় জানাচ্ছেন শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। তিনি জানেন নিশ্চিত, অনন্তের পথে চলতে চলতে আবার কোথাও কোনো পথের বাঁকে আজকের এই বিষাদটুকু জীবন হয়েই ফিরে আসবে।
ললিতা সুধাকান্তর বুকে হাত রেখে ডুকরে উঠল, “দাদা, তোর কষ্ট হচ্ছে?”
এই প্রথমবার নির্জন ঘরে সুধাকান্ত ঠোট ফাঁক করলেন।
উদাত্ত কন্ঠে তিনি গেয়ে চলেছেন,
“মধুর তোমার শেষ যে না পাই, প্রহর হল শেষ...
ভুবন জুড়ে রইল লেগে আনন্দ আবেশ... ”
ললিতা শিউরে উঠল অসময়ে জীবনের এই তীব্র সুর শুনে। তার মাথা এখন তার দাদার কোলে রাখা। সুধাকান্তের দু’চোখ বেয়ে নামছে অবিরাম অশ্রুধারা। তবে ললিতা জানে, তার দাদা দুঃখে ভারাক্রান্ত নয়, এ হল আরও বড় কিছু জয়ের আনন্দধারা। সত্যিই প্রাণের স্পন্দন ভীষণ ছোঁয়াচে হয়ত। সেও গলা মেলালো সুধাকান্তর সাথে, “সায়ন্তনের ক্লান্ত ফুলের গন্ধ হাওয়ার পরে... অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরে...”
ব্যালকনিতে সন্ধার ঝিরিঝিরি হাওয়াতে তখনও গভীর আবেশে দোল খেয়ে চলেছে মাধবীলতার ডালগুলি।
AWESOME...
ReplyDelete