2

বইঘর - শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া

Posted in


বইঘর


অমলকান্তি - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া



রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের সমারোহ, বর্ষব্যাপী সরকারি-অসরকারি অনুষ্ঠানে মুখরিত হয়ে আছে বাংলার সাহিত্য অঙ্গন। যদিও রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতা তখন নিজস্ব স্বরে প্রতিষ্ঠিত, নীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় তখনও গভীর হয়নি। পত্র-পত্রিকায় তাঁর কবিতা টুকটাক চোখে পড়লেও, প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধকার বারান্দা’ প্রকাশিত হয়েছিল সেই রবীন্দ্র-শতবর্ষেই; ১৩৬৭-র চৈত্রে(মার্চ/এপ্রিল ১৯৬১)। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের অভিঘাত আর সমাদর কদ্দূর হয়েছিল তা বুঝতে সেই বইয়ের ‘অমলকান্তি’-ই যথেষ্ট। প্রকাশের ষাট বছর পরেও সে কবিতাকে বাদ দিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার কোনও সংকলন প্রায় অসম্ভব। 

কী ছিল সেই কবিতায়! ছিল সামান্য এক ইস্কুল পড়ুয়া বালকের কথা—

“অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসত, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।”

কী আছে এই সাধারণ ক’টি পংক্তিতে? এক সাধারণ বালকের কথা; পড়াশুনায় নিতান্ত অপটু এক বালক। এমন বালক তখন বাড়ি বাড়ি দেখা যেত। অধিকাংশ বালক এমনই তো। কিন্তু রোজ রোজ দেরি করে স্কুলে আসা তো সাধারণ বাড়ির ছেলেদের চেনা গল্প নয়। পড়াশুনায় খামতির সঙ্গে এই অনিয়মানুবর্তিতার সম্পর্ক তো তখনও সমাজে খুব প্রচলিত বাস্তব নয়। সন্তানকে মানুষ করার জন্য অভিভাবকদের কাছে ইস্কুল তো তখনও সোনার কাঠি প্রায়; যার যাদু স্পর্শে সব গাধা ঘোড়া হয়ে ওঠে। তবে অমলকান্তির রোজ রোজ দেরি করে আসা বরদাস্ত করত কোন স্কুল আর কোন অভিভাবক? 

কবি পরবর্তী জীবনে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, অমলকান্তি এক বাস্তব চরিত্র। কবির সহপাঠী। সে ছিল নিতান্ত দরিত্র বাড়ির বস্তিবাসী এক ছেলে। বাড়ির দারিদ্র্যই নানান পাকে তাকে প্রতিদিন দেরি করিয়ে দিত ইস্কুলে; হয়তো পড়াশুনাতেও। কিন্তু সে সাধারণ বালককে নিয়ে কাব্যপ্রয়াস কেন! কারণ—

“আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল !”

এইখানে এসে আমাদের প্রতিদিনের পরিচিত ছবি যায় বদলে। অমলকান্তি-কে কেবল বোকা মনে হয় না, কিঞ্চিত ন্যাকাও মনে হয়। মনে হয় কবির কাব্যপ্রয়াসে এ এক আরোপ। ‘রোদ্দুর’ হতে চাওয়া ব্যাপারটা প্রথমত ভালো বোঝা যায় না, দ্বিতীয়ত ব্যাপারটার আরোপ নিয়ে মনে সন্দেহ থাকে না। কেউ মনে মনে এমন কথা ভেবে থাকলেও সে সব নিয়ে প্রকাশ্যে বলা বা তা নিয়ে কাব্য করা বর্তমান পাঠককূলে আর অনুমোদিত নয় বোধহয়। মাস্টার, ডাক্তার, উকিল হতে চাওয়ার মধ্যে যে স্বাভাবিকতা আছে, ‘রোদ্দুর’ হতে চাওয়া এবং তা প্রকাশ করার মধ্যে আছে তেমনই অস্বাভাবিকতা। 

পরবর্তীকালে অনেক চমৎকার কবিতা লিখে মর্যাদার আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন কবি। তখন আর প্রথম কাব্যগ্রন্থের কোনও কবিতার দায় নেওয়ার কিছু থাকে না। বরং আরোপের মুখোশ খুলে ফেলার মধ্যে কবির সততা থাকে, পাঠক সমাজের কাজে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন করে। অনেক প্রতিষ্ঠিত কবিকেই দেখা গেছে, প্রথম জীবনের আবেগ, উচ্ছ্বাস, ভ্রান্তি পরবর্তী জীবনে অবলীলায় প্রকাশ এবং স্বীকার করেছেন নিজেই। নিজেকে নিয়ে গেছেন সততার অন্যতর উচ্চতায়। কিন্তু সেই প্রবীনকালের সাক্ষাৎকারে নীরেন্দ্রনাথ জানান অমলকান্তির বাস্তবতার কথা। সে সত্যিই ছিল; ছিল তার রৌদ্রহারা অন্ধকার বস্তি। যেখানে আলো আসার কোনও সম্ভবনাই কোনওদিন ছিল না। তার পক্ষে নিজেই ‘রোদ্দুর’ হতে চাওয়ায় যে কোনও অবাস্তবতা ছিল না, বরং ছিল এক আর্তি, সে কথা বুঝে পাঠকের নতুন করে নীরবতা ছাড়া দেওয়ার থাকে না আর কিছু। 

এতখানি পড়ার পর স্বতই আমরা বুঝি অমলকান্তির থেকেও তার ‘রোদ্দুর’ হতে চাওয়ার মধ্যেই আছে তার বিশিষ্টতা। অমন বস্তি জীবনভারে ন্যুব্জ জীবন সে যুগে অন্তত বিশেষ কিছু ছিল না। বিশেষ এই বালকের প্রত্যাশা। অমন এক জীবন তাকে জীবনবিমুখ তো করেনি। তার অন্ধকার জীবনই বরং তাকে করে তুলেছে আলোর-পিয়াসী—

ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরূলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।

সে আলোর মেদুরতা কি আশ্চর্য বিশেষত্বে ধরা পড়ে কবির কলমে। জাম আর জামরুলের পাতায় বর্ষণক্ষান্ত শেষ-বিকেলের রোদ যেই দেখেছে সে এক লহমায় বুঝে যাবে তার সোনা রঙ, তার আশাবাদ, তার স্নিগ্ধতা। অমলকান্তি খর রোদে দশদিক ধাঁধিয়ে নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতি জাহির করতে চায় না; চায় শান্ত এক নিজস্ব রোদ। সে রোদের দিকে তাকিয়ে সব মাস্টার, ডাক্তার, উকিলের মনে পড়বে, এই রোদে মিশে আছে এক ব্যর্থ বালকের নিজস্ব উপস্থিতি। যেমন মনে পড়েছে কবির। নবম শ্রেণী পেরিয়ে তিনি এখন চল্লিশের কাছে। কবেকার ভুলে যাওয়া অমলকান্তি বর্ষণ-ক্ষান্ত বিকেলের রোদ বেয়ে এসে ভর করেছে কবির লেখনিতে। বেশ রোমান্টিক, কিন্তু আজকের নবম শ্রেণীর বালকের কাছে নিশ্চত ভাবেই ভাবালু; রূঢ় ভাবে বললে – ‘ন্যাকা’। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে কবিতার আধুনিকতা, রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিকতাকে, তার হাজার হাজার ভাবালু কবিতাকে নিতান্ত অবিশ্বস্ত বলে দাগিয়ে দিতে পারেনি। সেদিন অমন ভাবনাচিন্তা পাঠকচিত্তকে আকৃষ্ট করত তার প্রমাণ কবিতাটির এই দীর্ঘ জীবন। 

অমলকান্তির ঐতিহাসিক বাস্তবতার সুরে সুর মিলিয়ে ধরা পড়ে তার বর্তমানতা। সে যে রোদ্দুর হতে পারবে না, সে তার আকাঙ্খার বহর দেখেই পাঠক হয়ত বুঝেছিল। ‘রোদ্দুর’ বলে যদি বা কিছু হয়, কোনও মানুষ রোদ্দুর হতে পারে কিনা সে সন্দেহ নিয়েই পাঠক এগিয়ে চলে এবং জানতে পারে—

আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে,
চা খায়, এটা ওটা গল্প করে, তারপর বলে, উঠি তা হলে'।
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

এমনটা বাস্তব অমলকান্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ছাপাখানার অন্ধকার ঘর তার অতীতের সঙ্গে মানানসই। আমাদের হিসেবি যাপন আমাদের কোনও আশাভঙ্গের বেদনার মুখোমুখি দাঁড় করায় কিনা সন্দেহ। যারা অমলকান্তির সামাজিক স্তরের নয়, তারা বোঝে এটাই তো স্বাভাবিক; আর যারা অমলকান্তির সামাজিক স্তরের মানুষ, তারা বোঝে এই ব্যর্থতা আর যাই হোক আশাভঙ্গ নয়। অমলকান্তির ‘আশা’-র মধ্যেই ছিল অতি, অথবা অবাস্তবতা। 

কিন্তু তাতে তো অমলকান্তির কাব্যবিষয় হয়ে ওঠা আটকায় না। যা পাঠকের কাছে নিছক ‘অতি’, তা কবিজনোচিত সহমর্মিতায় হয়ে ওঠে কাব্য-বিষয়। অমলকান্তির ভাবনার অভিনবত্বই তো তাকে কবির আগ্রহ আকর্ষণের বিষয় করে তুলেছে। তার ব্যর্থতায় ব্যাথা পাওয়ার ক্ষমতাও কেবলমাত্র কবির সহজাত। কবির আক্ষেপ যাওয়ার নয়—

আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছাপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।

সমাজের নিয়ম মেনে অমলকান্তির সহপাঠীরা এক এক জীবিকায় থিতু হয়। তাদের জীবিকায় ছিল না অমলকান্তির অভিনবত্ব। তা ধরা দিতে কসুর করেনি ধাতুরূপ নির্ভুল পড়া ছাত্রদের জীবনে। স্বভাবতই তাদের সেই জীবিকায়ও আছে ধাতব বাস্তবতা; অভিনবত্ব নয়। সেই এক সুরে বাঁধা জীবন একে অপরের সঙ্গে বদলে নিলে হানি হয় না জীবনে বা যাপনে। ডাক্তার, মোক্তার, মাস্টার জীবন বদলে নিতে পারে যে কেউ যে কারও সঙ্গে। কিন্তু অমলকান্তির আকাঙ্খা অধরা শুধু নয়, হয়ত অধরণীয়ও। বদলে সে পেয়েছে ছাপাখানার ঝুলকালির জীবন। সে ব্যর্থতা কেবল ছুঁয়ে গেছে কোনো কবিকে। অমলকান্তি যেমন স্বতন্ত্র, তেমনি তার ব্যর্থতাও। সে ব্যর্থতা কবিতার জন্ম দেয়। কবির সহানুভূতি নিয়ে সে বেঁচে থাকে আবহমান কাল—

অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি - রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।

আজকের পাঠক হাজার ব্যঙ্গ, তাচ্ছল্য নিয়ে এতদূর এসেও অমলকান্তির জন্য কোনও লুকানো দীর্ঘশ্বাসে কি নিজেকে খুঁজে পায় না? সকলেরই তো থাকে এমন কোনও অবাস্তব আশা, যা ঠিক হওয়ার মতো কিছু নয়, তাই বলার মতোও কিছু নয়। কিন্তু নিত্যদিনের ক্লিন্ন জীবনে চাপা পড়ে থাকা সেই অবাস্তব স্বপ্ন অমলকান্তির ব্যর্থতার আখ্যানের পথ ধরে হয়তো রক্ত ঝরিয়ে যায় আমাদের গোপন হৃদয় ক্ষতে। আর রচিত হওয়ার অনেক বছর পরেও পাঠক খুঁজে নেয় অমলকান্তির আখ্যান। 

এই আপাত বয়ানের পাশে, কবির সাক্ষ্যে বাস্তব হয়ে ওঠা অমলকান্তির আখ্যানের পাশে অন্য একটি গোপন আখ্যান কোনোও পাঠক খুঁজে পেলে আশ্চর্য হওয়ার নেই। কবি টি এস এলিয়ট তাঁর বিখ্যাত সব কবিতার সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন নানান সাক্ষাৎকার বা লিখিত বয়ানে। কিন্তু পাঠক গভীরচারী হলে ধরা পড়ে যায় ‘ওয়েস্টল্যান্ড’-এর কবি-ঘোষিত ব্যাখ্যানের থেকেও বিশ্বস্ততর পাঠ। কবিতা তো শুধু কবিকে প্রকাশই করে না, গোপনও করে যে! সে দূর রচনা করার খেলায় কবিও কখনও হয়ে হয়ে ওঠেন দক্ষ খেলুড়ে। কবিস্বভাবী নীরেন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি অনুরাগ তো আর যৌবনের খেয়াল কথা হতে পারে না। রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষে হঠাৎ একদিন তিনি প্রকাশ করে বসলেন ‘অন্ধকার বারান্দা’! কেনই বা তাঁর বারান্দা অন্ধকার? তিনি কি গোপনে সব বাঙালি কবির মতই, রোদ্দুর কবি, রবি হওয়ার বাসনা পোষণ করেননি? বোঝেননি সে বাসনার অভিনবত্ব আর অপ্রাপনীয়তা? এই অমল-কান্তি বাসনাটি তাঁর মনোজ নয় তো? তিনি নিজেই অমলকান্তি নন তো? সবাই যখন ডাক্তার, মাস্টার, মোক্তার হতে চায়, তখন এক গোপন কবি, রবি=রোদ্দুর হতে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? সংসার সবাইকে টেনে নেবে নিজ নিজ পথে। কবি হতে চাওয়া নীরেন্দ্রনাথ নিজে এক পত্রজীবী। ফরমায়েসি লেখা লিখে পাতা ভরানোয় আর প্রেসে কাজ করা কালিঝুলি মাখা কর্মীতে তফাত কতদূর? কিন্তু তায় কি মনের কোণে কবি=রবি=রোদ্দুর হতে চাওয়ার আকাঙ্খা নিভে যেতে পারে? সেই অমল আকাঙ্খাই কি প্রেস কর্মী নীরেন্দ্রনাথকে দিয়ে প্রকাশ করিয়ে নেয় না তাঁর মনের বারান্দায় অন্ধকার নামার কথা? রবি-কবির জন্মশতবর্ষে নিভৃতে যে কাব্য প্রকাশ পায় তাতে অমলকান্তির ব্যর্থতার মধ্যে এবং বিশেষত্বের মধ্যে কি ধরা থাকে না কবি নীরেন্দ্রনাথ? 





2 comments:

  1. সবাই বড় হতে চায়, নীরেন্দ্রনাথ ও হয়তো.

    ReplyDelete