ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
জল রেখা - ১১
নন্দিনী সেনগুপ্ত
বসন্ত বোধহয় থমকে গিয়েছিল সে সময় হঠাৎ। মনে আছে। হুবহু মনে আছে নিরূপের। আইয়মের সাথে দেখা হবার প্রায় মাসখানেকের মধ্যেই ঘটেছিল সেই দুর্ঘটনা। অরূপ আর বউদি ভোরবেলা নতুন গাড়ি কিনে যাচ্ছিল দক্ষিণেশ্বরে পূজা দিতে। একটা লরি এসে মেরে দিয়ে চলে যায়। কিছু করার ছিল না। চেনা যাচ্ছিল না কাউকে। গাড়ির সামনের দিকটা একদম তুবড়ে গিয়েছিল খেলনার মত।
বিকেলে ফ্লাইট পেয়েই নিরূপ পৌঁছে গিয়েছিল। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন সবাই ঘিরে ছিল, তাও নয়ন কেমন যেন চুপ হয়ে গিয়েছিল। একেবারে শিশু তো আর নয়। দশ বারো বছরের কিশোর, সব বুঝেও চিৎকার করে কাঁদতে পারছিলনা। সকালে তো ওই গাড়িতে তারও যাবার কথা ছিল দক্ষিণেশ্বরে। আলেসেমি করে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে না চাওয়ায় মা বকাবকি করছিল। বাবা বলল, ‘ছেড়ে দাও না রুমু। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। আজ না হয় শুধু তুমি আর আমি। পূজা দিয়ে একদম লঙ ড্রাইভ!’ তারপর দুজনের ফিসফিসানি আর হাল্কা হাসির শব্দের মাঝে নয়ন আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। কি জানি কোথায় চলে গেল দুজনে মিলে কোন লঙ ড্রাইভে। আর ফিরবেনা কেউ। আর বকাবকি করবে না মা। আর আদর করবেনা ‘আমার সোনা বাবা, আমার নয়ন, নয়ন-মণি’ বলে। বাবা তো কোনওদিন বকে না, শুধুই আহ্লাদ দেয়। কখনও রাগারাগি করেনা, নিজে হাসিমুখে থাকে আর সবাইকে হাসায়। মাঝে মাঝে মা আর ঠাম্মাকে পিছনে লেগে রাগিয়ে দেয়। বাবা তো কখনও কাউকে বকে না, কাঁদায় না; আজ কেন সবাইকে কাঁদাচ্ছে বাবা? নয়ন ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল। বুঝতে চেষ্টা করছিল কার বেশী কষ্ট হচ্ছে, বাবা মাকে হারিয়ে ওর নিজের, নাকি সন্তান এবং পুত্রবধূকে হারিয়ে ওর ঠাম্মার। বুঝতে পারছিল না নিজে বেঁচে গেল বলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেবে কিনা!
নিরূপ বাড়িতে ঢুকে সবাইকে সামলানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারছিল না। বাবা পাথরের মত বসে ছিলেন। বউদির বাপের বাড়ির লোকজন সবাই সেসময় পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নিরূপ নিজের শোক ঠিকভাবে বুঝতে পারছিল না। সে কোনওদিন সংসারের ব্যাপার ঠিকঠাক বোঝে না। এমনকি দোকান বাজারও সেভাবে কখনও করেনি। প্রয়োজন পড়ে নি। চাকরির জায়গাতে সে বরাবর কলকাতার বাইরে পোস্টিং নিয়েছে। এমনকি ফিল্ডেও ঠাকুর চাকর থাকেই, তারাই সামলায়। যদি নাও থাকে, নিরূপ কোনও ঝুটঝামেলার মধ্যে যায়না। বহুবার এমন হয়েছে, রান্না খাবারের বদলে ফলমূল খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। যেটুকু না হলেই নয়, তার সেটুকুতেই চলে যায় দিব্য। সাংসারিক জটিলতা সে বোঝার চেষ্টাও করে না। মাকেও সে ঠিকঠাক বুঝতে পারেনা। মনে হয় মা বড় অভিমানী। অরূপ বুঝত। না, সে অরূপের থেকে আট বছরের ছোট হওয়া সত্ত্বেও কোনওদিন দাদা বলে ডাকেনি। একদম সমবয়সী বন্ধুর মত ব্যবহার করত। সব কথা বিশ্বাস করে অরূপকেই বলা যেত বাড়িতে। যাইই হোক না কেন, অরূপ ঠিক সামলে নিত সব। কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে পার্টিতে গিয়ে নিরূপ মাল খেয়ে আউট, কে সামলেছিল বাড়িতে সব আড়াল করে? অরূপ। ছোটবেলায় স্কুলে ক্লাস টেস্টে অঙ্কে গোল্লা, কে সব অঙ্ক শিখিয়ে অ্যানুয়াল পরীক্ষায় নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছে দিল? অরূপ। সব, সব সমস্যার সমাধান থাকত অরূপের কাছে। এখন নিজেই চলে গেল। কে সামলাবে সব কিছু? ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিল না নিরূপ।
অশৌচ মিটবার আগেই পুনে থেকে বড়কাকা কাকিমা আর খুড়তুত ভাই নিবিড় চলে এসেছিল। নিবিড় প্রায় নিরূপের বয়সী। বড়কাকা সবে রিটায়ার করেছেন। ওরা এমনিতেও চলে আসতেন কলকাতায়। আজ এই শোকের সময় সবাই মিলে এসে পাশে দাঁড়ানোয় নিরূপ কিছুটা আস্বস্ত হয়েছিল। কাজের জায়গায় ফিরে গেলে মা যে একদম একা হয়ে যাবে না, এই ভাবনাটা তাকে শান্তি দিচ্ছিল কিছুটা। আত্মীয়দের মধ্যে কেউ একজন বলছিল ‘রবিকে খবর দেওয়া হয়েছে?’ নিরূপ হতবাক হয়ে তাকিয়েছিল চারপাশে। সত্যিই ত, ছোটকাকাকে কিভাবে খবর দেওয়া সম্ভব? সে যে কোথায় আছে, সেটাই বা কে বলবে? বড়কাকা সামলে দিয়েছিলেন কিছুটা। একটু অশোভন মনে হয়েছিল নিরূপের, যখন ওইসময় বড়কাকা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘আরে না, না। ও কোনও সম্পর্ক রাখে না ফ্যামিলির সঙ্গে। কোথায় আছে আমরা জানিই না, এখন খবর দেব কি ভাবে?’ কিন্তু তখনকার মত অস্বস্তিটা চাপা পড়ে গিয়েছিল।
বাড়িভর্তি লোকজনের মাঝে নিরূপ নয়নকে খুঁজছিল। আসা অবধি সেভাবে নয়নের সঙ্গে কথা হয়নি তার। দেখে মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেলো ছেলেটা। এত গম্ভীর হয়ে থাকছে। মনে হচ্ছে ওর ভিতরে অনেককিছু পাক খাচ্ছে। অবশেষে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে দেখা পেল। পুরানো ম্যাগাজিনের স্তূপের মধ্যে কি যেন ঘাঁটাঘাঁটি করছে। নিরূপ এগিয়ে গিয়ে বসে একপাশে রাখা ভাঙ্গা চৌকির উপরে। ধীরে ধীরে বলে, ‘কি খুঁজছিস ভুটু?’ এই নামেই সে বরাবর ডাকে ভাইপোকে। আবার বলে, ‘ওসব ধুলো ঘাঁটিসনা এখন, হাঁচি-কাশি হবে। আয় আমার পাশে বস একটু’। নয়ন এসে বসে। নিরূপ ওর পিঠে হাত বোলায়। এক সপ্তাহের মধ্যেই যেন ছেলেটার গোলগাল চেহারাটা ভেঙে গিয়েছে। গাল বসে গিয়েছে। নিরূপ জড়িয়ে ধরে। বাঁধ ভাঙ্গে। হু হু করে কেঁদে ওঠে ছেলেটা। বলে, ‘কি হবে গাগা?’ নয়ন তাকে কাকা বলেনি কখনও। একটা অদ্ভুত ডাক ঠিক করে নিয়েছিল নিজেই শিশুকাল থেকে। গাগা। গাগাকে জড়িয়ে ধরে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেঁদে ওঠে নয়ন। নিরূপ সান্ত্বনা দেয়, ‘কিছু হবে না। আমি আছি তো। তোর যেটা দরকার, আমাকে বলবি। আমি আছি ভুটু। তুই আমার সঙ্গে যাবি? পাহাড়ে? খুব বড় সাহেবি ইস্কুল আছে সেখানে। তোকে ভর্তি করে দেবো। বিশাল খেলার মাঠ, ক্রিকেট, ফুটবল সব খেলা হয়। কি ভালো রেজাল্ট করে ছেলেরা। খুব ভালো করলে ওরাই স্কলারশিপ দিয়ে বিদেশে পড়তে পাঠায়। যাবি?’ নয়নের কান্নার দমক কমে আসে। মাথা নাড়ে ধীরে ধীরে। ‘না গাগা’... অনুচ্চ স্বরে এক অদ্ভুত দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করে এই বালক, ‘আমি এই বাড়ি ছেড়ে গেলে ঠাম্মা-দাদু আরও একা হয়ে যাবে। আমি এখানেই থাকব।’ বলে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে তারপর বলে, ‘এই ম্যাগাজিনগুলোর থেকে ছবি খুঁজছিলাম। ওয়ার্ক এডুকেশনে প্রজেক্ট জমা দিতে হবে। বাবা তো এগুলো সব সাজিয়ে দিত... এখন আমাকে নিজেকেই তো করতে হবে।’... নিরূপ বুঝতে পারে, সত্যিই এক ধাক্কায় যেন ছেলেটা অনেক দায়িত্বশীল হয়ে গিয়েছে; অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।
0 comments: