2

বইঘর - চয়ন

Posted in


বইঘর


অনুবাদ ও অনুসৃষ্টি
চয়ন



নমস্কার। বইঘরের আড্ডায় জমায়েত সব আড্ডাধারীকে সশ্রদ্ধ নমস্কার। আজ আমি আপনাদের একটা গল্পের খানিকটা বলব। আপনারা বলবেন তার নাম আর লেখকের নাম। আজ্ঞে হ্যাঁ। সেই শিশু কিশোর সাহিত্যের গল্প। ওটাই আমার বিচরণক্ষেত্র কি না! তাহলে শুরু করি?

এক গাঁয়ে থাকত এক বিধবামায়ের একমাত্র ছেলে। একদিন সেই ছেলেকে কিছু টাকা দিয়ে তিনি এক বড় শহরে তাঁর মায়ের কাছে পাঠালেন। টাকার অঙ্ক এমন কিছু নয়। কিন্তু ছেলেটির মা যে বড় গরীব! ট্রেনে উঠল সে ছেলে। আলাপ হ'ল এক ধোপদুরস্ত খোস পোশাকের ভদ্দরলোকের সঙ্গে। তিনি ছেলেটিকে শহর সম্বন্ধে নানা আজগুবি গল্প শোনাতে লাগলেন। যেমন, শহরে কারও টাকা লাগলে ব্যাঙ্কে গিয়ে মস্তিষ্ক বাঁধা দিতে হয়। ছেলেটি শহরে কখনও যায় নি। সে হাঁ করে শুনতে লাগল। শেষে আরেক যাত্রী অতিষ্ঠ হয়ে বললেন, "মশায়ের মস্তিষ্ক বুঝি ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া আছে? ছেলেমানুষকে যাতা বোঝাচ্ছেন কেন?" সে ছেলে দুই বয়স্কের তর্ক শুনতে শুনতে ঘুমে ঢলে পড়ল। ঘুম ভেঙে উঠে দেখল তার কোটের লাইনিং এ পিন দিয়ে আটকানো খাম আর তার মধ্যের টাকা কোনওটাই নেই। ছেলেটি বুঝল ওই খোসপোশাকের লোকটাই চোর। সে নিলে চোরের পিছু। চোর গিয়ে উঠল এক হোটেলে। ছেলেটি উঁকি মেরে যখন দেখছে তখন তার পেছনে বাজল ভোঁপ ভোঁপ শব্দে মোটর হর্ণ। এক লাফে পেছনে ফিরে সে দেখল যে তারই সমবয়স্ক একটি মোটরহর্ণ ধারী হাসি খুশি ছেলেকে। তাদের মধ্যে হ'ল ভাব। গ্রামের ছেলের কাহিনী শুনে শহরের ছেলে তার হর্ণ বাজিয়ে ডেকে আনল তার সব বন্ধুকে যাদের মধ্যে সবচেয়ে বুঝদার হ'ল চশমাআঁটা প্রোফেসর। দেখতে দেখতে গঠিত হ'ল এক শিশু গোয়েন্দা বাহিনী। যাদের সংকেত বাক্য হ'ল.....

কি বললেন ধরে ফেলেছেন? সংকেত বাক্য গোবিন্দ? অনেক্ষণ আগেই? ছেলেটির নাম গোবিন্দ, কাহিনীর নাম দেড়শ খোকার কাণ্ড আর লেখক হেমেন্দ্রকুমার রায়? বড় খুশি হতুম 'হ্যাঁ' বলতে পারলে! কিন্তু, না, সে উপায় নেই। Password Emil, ছেলেটির নাম Emil, বই এর নাম Emil and the Detectives আর লেখক Eric Kastner!! 

হ্যাঁ, আপনাদের মতো আমিও অনেকক্ষণ স্তম্ভিত হয়েছিলাম যখন আমি আবিষ্কার করি ১৯৪৭ এ প্রকাশিত দেড়শ খোকার কাণ্ড আসলে এই বিদেশী বইটির আক্ষরিক অনুবাদ। আর কোথাও সেটা বলা নেই। বিশ্বাস না হয় উইকিপিডিয়া খুলুন। হেমেন্দ্রকুমারের অনেকগুলো বইয়ের নামের তলায় লেখা আছে, যে সব বিদেশীকাহিনীর তারা অনুবাদ, তাদের নাম। এটির ছাড়া। কিন্তু সন্দেহের কোন জায়গা নেই জানেন! প্রোফেসর নামটা অবধি বদলান নি হেমেনবাবু। শুধু তাই নয়। মূল বইতে লেখক স্বয়ং একটি চরিত্র হয়ে উঠেছেন। তাই Mr.Kastner দেড়শ খোকার কাণ্ডে হয়ে ওঠেন হেমেন রায়! দুটো বই পাশাপাশি রেখে পড়ুন। নিজেরাই বুঝে যাবেন। দেখবেন কী ভাবে বঙ্গীকরণ হয়েছে বইটির। Sergant Jeschke হয়েছে চৌকিদার নটবর, Pony হয়েছে নমিতা। লাইন ধরে ধরে আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন হেমেন্দ্রকুমার। কিন্তু এ নিয়ে তেমন কোনও আলোচনা আমার অন্তত চোখে পড়ে নি। আরও অবাক করা ব্যাপার হ'ল কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় মূল গ্রন্থটি এমিলের গোয়েন্দা কাহিনী নাম দিয়ে অনুবাদ করলেও বই দুটির মিল আর পার্থক্য নিয়ে আলোচনার খবর অন্তত আমার বইঘরে এসে পৌঁছয় নি। আজ্ঞে হ্যাঁ, পার্থক্যও আছে কিছু। 

শিশু কিশোর সাহিত্যের বিশ্লেষকরা অতীব বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করেন যে পশ্চিমি শিশু কিশোর সাহিত্যের অভিজাত শাখায় গোয়েন্দা কাহিনীর আবির্ভাব বেশ পরে। কিন্তু, যাকে pulp fiction বলে সেখানে বহু আগে তার নান্দীপাঠ হয়ে গেছে। লক্ষ্যনীয়, ইংলণ্ডে স্ট্র‍্যান্ড ম্যাগাজিনে ১৮৮৭ সালে আত্মপ্রকাশ করেন শার্লক হোমস এবং ১৮৯৩ সালে মার্ভেল এ দেখা দেন সেক্সটন ব্লেক! কিন্তু, তাঁর ভাগ্যে হোমসের খ্যাতি জোটেনি। কারণ তিনি মূল স্রোতের বাইরে অন্ত্যজ সাহিত্যের অংশ! শিশু কিশোর সাহিত্যের মূল স্রোতের প্রথম গোয়েন্দা কাহিনী যাতে শিশুরাই গোয়েন্দা, তার নাম হ'ল Emil and the Detectives। ১৯২৯ সালে জার্মান ভাষায় রচিত এ বই ইংরিজিতে অনূদিত হয় ১৯৩১ এ। 

হেমেনের কলকাতা প্রকৃতপক্ষে কাস্টনারের বার্লিন। এই বইয়ের মূল আকর্ষণ বার্লিনের স্পন্দিত জীবনকে কয়েকটা হালকা আঁচড়ে জ্যান্ত করে তোলার মধ্যে আর এক অদ্ভুত সারল্যের পরিমণ্ডল গড়ে তোলার মধ্যে। সারল্যের পরিমণ্ডল হেমেন্দ্রকুমারও তাঁর অনুবাদে গড়েছেন। কিন্তু তারপর তিনি বুঝেছেন দুটি দেশের মধ্যে পার্থক্য এতটাই বেশী যে তাঁকে কিছুটা স্বাধীনতা নিতেই হবে। দেখা যাক কী দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা। দুটি বই এর নগর বর্ণনাকে আমরা পাশাপাশি রেখে একবার দেখি। 

"It was getting dark, and the illuminated signs began to flash on and off. Trains thundered by on the overhead railway. Other trains rumbled beneath them on the underground. The noise in the street of all passing trams, buses, cars and motorbikes sounded to Emil like some crazy orchestra playing wildly." 

"তখন সন্ধ্যার অন্ধকারের সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্যে রাস্তার আলোর থামগুলো জ্বলে উঠেছে। দূর থেকে শিয়ালদহ স্টেশনের কোলাহল ও রেলগাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে কিছু কিছু। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে রাজপথের ট্রাম, লরি, মোটর, সাইকেল ও রিক্সা, প্রভৃতির আওয়াজ এবং জনতার হট্টগোল। এ যেন একটা বন্য কন্সার্ট।" 

কাছাকাছি তাই না? এরপরই Emil এর Neustadt আর প্রফেসর এর বার্লিনের তুলনা। আর ঠিক এইখানেই হেমেন্দ্রকুমারকে স্বাধীনতা নিতে হয়। কারণ বার্লিনকে কলকাতায় এনে ফেলতে পারলেও বাংলার গ্রাম কালিকাপুর আর জার্মানীর Neusstadt কে মেলানো অসম্ভব। তাই এইখানে লেখকের নিজস্ব স্বর স্পষ্ট শোনা যায় : "...আমাদের কালিকাপুরে যেও। সেখানে সকালে তুমি প্রথম জেগে উঠবে যেন পাখির গানের স্বপনপুরে।...ঘর থেকে বেরিয়ে এলে দেখবে, রোদ হাসি মাখা সবুজে ছাওয়া নাচঘরে কোকিল গাইছে, দোয়েল শ্যামা শিস দিচ্ছে, খঞ্জন নাচছে, বৌ কথা কও বউকে সাধাসাধি করছে আর তিতির ধরেছে যেন টিটকিরির সুর!" 

দশবছরের শিশুর হয়ে এখানে কথা বলছেন লেখক স্বয়ং। মূলের ওপর রাখছেন তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতির সাক্ষর। সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে সেই জটিল সৃষ্টি প্রক্রিয়ার যার মাধ্যমে রসানুবাদ ঘটে। অনুবাদ হয় অনুসৃষ্টি। কিন্তু এই সম্ভাবনাই সার। এরপর আবার নিষ্ঠাভরে মূলকে অনুসরণ। আক্ষরিক অনুবাদে বঙ্গীকরণ। এইখানে অপর একটি বইয়ের কথা মনে পড়ে, যেখানে মূল আর অনুবাদের এক জটিল রাসায়নিক ক্রিয়ায় যে যৌগ উৎপন্ন হয় তা অনন্য। নাম তার বুড়ো আংলা।

আপনারা তো জানেনই যে বুড়ো আংলার ভিত্তি হ'ল এক সুইডিশ ফ্যান্টাসী। ১৯০৬ এ প্রকাশিত হয় সে বই আর মুখ্যতঃ এর জন্যই লেখিকা সেলমা লাগেরলফ ১৯০৯ এ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। যে সময়টাকে শিশু সাহিত্যের প্রথম স্বর্ণযুগ ধরেন পশ্চিমি তত্ত্ববিদরা, সেই উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথম চোদ্দ বছর পর্যন্ত সময়কালে ইংলন্ডে যে পরিমাণ ফ্যান্টাসি সাহিত্য রচনা হয়েছে নবীন পাঠকদের জন্য সে তুলনায় অন্যান্য ইওরোপীয় দেশের অবদান বড়ই অপ্রতুল। সেই মুষ্টিমেয় কিছু কালজয়ী শিশু কিশোর সাহিত্যের অন্যতম হ'ল এ বই। Nils Holgersson পশুপাখিদের প্রতি নির্দয় ব্যবহারের জন্য পরিণত হ'ল বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ elf এ। বই এর বাকি অংশে পাই এক সাদা রাজহাঁসের পিঠে চেপে তার নানা বিস্ময়কর অভিযানের কাহিনী। তাই এ বই এর নামও The Wonderful Adventure of Nils.

এই বইকে ভিত্তি করেই ১৯৩৪ এ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেন অমর বুড়ো আংলা। আজ্ঞে হ্যাঁ, জেনে বুঝেই আমি রচনা করেন কথাটা ব্যবহার করছি। দেড়শ খোকার কাণ্ডকে আমি আক্ষরিক অনুবাদ বলেছি। কিন্তু বুড়ো আংলা একেবারেই তা নয়। এখানে অবনীন্দ্রনাথ অসাধ্য সাধন করেছেন। তিনি অবলীলায় বঙ্গীকরণ করেছেন লাগেরলফের সুইডেনের। আর যেভাবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে রসের বিচারে তিনি মূলকে ছাপিয়ে গেছেন। অতিলৌকিক প্রতিভা না থাকলে সেটা অসম্ভব। আমি আরেকটু এগোনোর আগে একটা কথা স্মরণে রাখুন। অবনীন্দ্রনাথ কিন্তু মূল সুইডিশ গ্রন্থটি ব্যবহার করেন নি। সম্ভবও ছিল না। তাঁর সামনে নিশ্চিত ছিল কোন ইংরিজি অনুবাদ। এই যেমন আমার সামনে আছে Velma Swanston Howard কৃত অনুবাদটি। দেড়শ খোকার কাণ্ড লিখতে গিয়েও হেমেন্দ্রকুমার নিশ্চয়ই ব্যবহার করেছিলেন মূল জার্মান গ্রন্থের কোনও ইঙ্গানুবাদ। যেমন আমি ব্যবহার করছি Eileen Hall কৃত অনুবাদটি।

দেখুন, যে কোনও সার্থক অনুবাদকে সাংস্কৃতিক অনুবাদ হতেই হবে। কারণ, প্রতিটি ভাষা তার নিজস্ব সংস্কৃতি সঞ্জাত। সাহেবরা বলেন, "The cultural grids determine how reality is constructed in both source and target texts, and the skill of the translator in manipulating these grids will determine the success of the outcome..... these cultural grids highlight the creativity of the translator, for he or she is inevitably engaged in a complex creative process." অতি উচ্চমানের সৃষ্টি প্রতিভা না থাকলে সার্থক অনুবাদ করা যায় না। যা শুধু ভাবানুবাদ নয় রসানুবাদ। Translation নয় Transcreation. এই বিচারেই বুড়ো আঙলা সার্থক। মূল বই এর সঙ্গে মিলিয়ে পড়লেই বোঝা যাবে কি সাবলীল ভাবে অবনীন্দ্রনাথ মূল গ্রন্থটির কিছু অংশ গ্রহণ আর কিছু অংশ বর্জন করছেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় The Great Crane Dance on Kullabarg অংশটিকে তিনি এড়িয়ে গেছেন অতিরেক ভেবে। আর ঘটনাক্রমও আগে পিছে করছেন যেমন তাঁর প্রয়োজন। সত্যিই এক জটিল সৃষ্টি প্রক্রিয়া! অনুবাদও অক্লেশে এক সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতিতে বদলে নেয়। এল্ফ হয় যক। গণেশ ঠাকুর আবির্ভূত হন মূলের থোড়াই কেয়ার করে। সাদা রাজহাঁসের সঙ্গে সুবচনী জুড়ে গিয়ে তাকে অতি চেনা করে তোলে। Smirre Fox হয় চাঁদপুরের শেয়াল। Tummetot হয় হংসপাল : ধ্বনি রইল কিন্তু পাল্টে গেল রূপ! মাত্র একটি ক্ষেত্রে বোধহয় সচেতন ভাবেই অবনীন্দ্রনাথ নাম দিয়ে ঋণ স্বীকার করেন। Akka from Kebnekaise রূপ নেয় চকা নিকোবরের। 

মূল গ্রন্থে আমরা দেখি মোরগের দল নিজস্ব নিয়মে জায়গার নাম ঘোষণা করছে : Grainscarce, Litte to eat, Swanholm। বুড়ো আংলাতে নরককুণ্ডু, পোড়োবাড়ি, মশালচুলি। কিন্তু এর ঠিক আগের অনুচ্ছেদটি কেবল বুড়ো আংলাতেই আছে। লাগেরলফ চেষ্টা করেও এর জন্ম দিতে পারতেন না! " 'কোন ডিহি?' 'রাজসাই --খাসা ভাই! 'কোন পুর? পেসাদপুর ---পিঁপড়ে কাঁদে। কার বাড়ি? ঠাকুর বাড়ি। কোন ঠাকুর? কোন ঠাকুর? ওবিন ঠাকুর -- ছবি লেখে!" কি আত্মপ্রত্যয়! কি অসীম দক্ষতায় মূলের ওপর নিজের স্বাক্ষর রাখা! Appropriation শব্দটা নির্ঘাত শোনেন নি অবন ঠাকুর। তাতে কি? তিনি করে দেখিয়েছেন! দেখিয়েছেন তাঁর অননুকরণীয় ভাষা বিভূতির সাহায্যে। 

আর এইখানেই আমি একটা দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। আপনারা নিজেরাই দেখুন কি ভাবে অনুবাদ সৃষ্টি হয়ে ওঠে।
" What kind of little hut is this? What kind of a little hut is this? 
Instantly the dog came out of his kennel--furiously angry--- and barked at the air.
" Do you call this a hut, you tramps! Can't you see that this is a great stone castle? Can't you see what fine terraces, and what a lot of lovely walls and great doors it has, bow, wow,wow, wow? Don't you see the garden? Can't you see the greenhouses? Can't you see the marble statues? You call this a hut, do you? Do huts have parks with beech woods and hazel bushes and groves and oak trees and firs and hunting grounds filled with game, wow, wow, wow, wow? Do you call this a hut? Have you seen huts with so many outhouses around them that they look like a whole village? You must know of a lot of huts that have their own parsonage, and that rule over the manors and farms and villages and cottages, wow,wow,wow? Do you call this a hut? To this hut belong the richest possessions in Skane, you beggars! You can't see a bit of land from where you hang in the clouds, that does not belong to this hut, wow, wow, wow!"

"ছপ্পড়টা কার? ছপ্পড়টা কার? 
কুকুরটা অমনি আকাশে নাক তুলে চেঁচিয়ে উঠল, ভেউ ভেউ করে বললে-- "ছপ্পড় কি? দেখছ না এটা নুড়িয়ার কেল্লা--পাথরে গাঁথা। দেখছ না কেল্লার বুরুজ, তার উপরে ওই গোলঘর-- সেখানে কামান বসানোর ঘুলঘুলি, নিশেন ওড়াবার ডাণ্ডা। গবাক্ষ, বাতায়ন, দরশন- দরওয়াজা। এসব দেখছ না!' 
হাঁসেরা কিছুই দেখতে পেলে না-- না কামান, না ঘুলঘুলি, না গবাক্ষ, না বাতায়ন। কেবল একটা চিলের ছাদে একটা আকাশ পিদিম দেবার বাঁশ দেখা গেল, তাতে একটুকরো গামছা ছেঁড়া লটপট করছে! হাঁসেরা হো হো করে হেসে বললে,--'কই? কই?' 
কুকুর আরো রেগে বললে --"দেখছ না, কেল্লার ময়দান যেন গড়ের মাঠ! দেখছ না কেলিকুঞ্জ সেখানে রাণী থাকেন। দেখ ওই হাম্মাম, সেখানে গোলাপ জলের ফোয়ারা। দেখতে পাচ্ছ না বাগ বাগিচা, আম খাস, দেওয়ান খাস?' হাঁসেরা দেখল পানা পুকুর, লাউ কুমড়োর মাচা এমনি সব, আর কিছু নেই! 
কুকুর আবার চেঁচিয়ে বললে-- "ঐ দেখ ওদিকে গাছঘর, মালির ঘর; আর এই সব সুড়কি পাতা রাস্তার ধারে ধারে পাথরের পরী, গ্যাসলাইটের থাম, বাঁধা ঘাট, বারো দোয়ারী নাট মন্দির। এসব কি চোখে পড়ছে না যে বলছ ছপ্পড় কার? ছপ্পড়ে কখনো কেলিকানন, পুষ্পকানন, কামিনীকুঞ্জ থাকে? না পাথরের পরী, ঘাটের সিঁড়ি থাকে? ঐ দেখ রাজার কাচারি, ঐ হাতিশাল, ঘোড়াশাল তোষাখানা। এসব কি ছপ্পড়ে থাকে?.. ছপ্পড় কখনো দেখতে হয়তো ও পাড়ার ওই জমিদার গুলোর বাড়ি দেখে এস। আমার মনিব কি জমিদার? এরা মুর্ধাভিষিক্ত। লেখাপড়ার ধার দিয়েও যায় না। ঘোড়া রোগে এদের সবাই মরেছে। সেকালে এরা চীনের রাজা ছিল। এখনো ফাটকে লেখা --পালদিং অফ নুড়িয়া। এই ছপ্পড়ের নহবতখানার চুড়ো দশক্রোশ থেকে দেখা যায় -- এমনি ছপ্পড় এটা"!

এবার আপনারাই বলুন। এটা কি ঠিক অনুবাদ? প্রথমত, সামাজিক আবহটাই বদলে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মাঝে মাঝে জুড়ে দেওয়া হয়েছে এমন সব লাইন যা মূলের সামাজিক আবহের স্পষ্ট সমালোচনা। ক্ষীয়মাণ সামন্তপ্রথাকে নিয়ে হাসিভরা বিদ্রূপ কিন্তু লাগেরলফের রচনায় নেই। আর এই ভাষা! ছবি লেখার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর হয় না।

বুড়ো আংলা এমন এক সময়ে রচনা করেছেন অবনীন্দ্রনাথ যখন তিনি বিস্ময়ভরা চোখে দেখতে চান জগত জুড়ে সঞ্চরমান সুন্দরকে। যার কিয়দংশ তিনি পেয়েছেন তাঁর ফলন্ত ফুলন্ত বাংলাদেশে আর বাকি অংশ হয়তো বা পশুপাখির বন্ধনহীন জগতে। হয়তো সেই কারণেই তিনি লাগেরলফের কাহিনী বেছে নিয়েছেন। ছোটখাটো জিনিসের অফুরন্ত শোভা, কল্পনা আর বাস্তব মেশা আবহের উপাদান সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি যা করেছেন তা এক নবরূপায়ণ। আমার দৃঢ়বিশ্বাস যদি এখনো বুড়ো আংলা অনুবাদের মারফৎ বিশ্বের দরবারে পৌঁছয় তবে নোবেল না হোক কার্নেগী বা নিউবেরি পদক তার বাঁধা! আর যদি তা নাও হয়, আমাদের সম্পদের কিছুটা ভাগ তো দেওয়া যাবে তথাকথিত প্রথম বিশ্বকে!

আমি বলতে চাই হেমেন্দ্রকুমার এমিলের বঙ্গীকরণ করেছেন ঠিকই। কিন্তু তিনি মূলের তেমন কোনও পরিবর্তন করেননি। অথচ একবারও বলেন নি তিনি অনুবাদ করছেন। অন্যদিকে 'ফ্রাঙ্কেস্টাইন' অবলম্বনে রচিত তাঁর "মানুষের গড়া দৈত্য" উপন্যাসের শেষে তিনি জানিয়েছেন যে "বাঙালি পাঠকের উপযোগী করার জন্যে আমি ঘটনা, স্থান ও পাত্র পাত্রীদের নাম পরিবর্তিত করতে বাধ্য হয়েছি এবং সর্বত্রই মূল রচনার অনুসরণ করতে পারি নি।" এরকম কোনও ফুটনোট বুড়ো আংলায় নেই। থাকলে ভাল হতো কিন্তু আমি বোধহয় বোঝাতে পেরেছি যে না থাকাতেও তেমন কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয় নি। কারণ, বুড়ো আংলা এক অনুপম সৃষ্টি। অনুসৃষ্টি। ঠিক যেমন দেড়শ খোকার কাণ্ড নিখুঁত অনুবাদ।।



2 comments:

  1. Khoob valo Laglo... Sathei dhonde pore gelam Sahitto jogote toskorbrittir songata thik ki dhoroner houya Uchit eta vebe.

    ReplyDelete
  2. ভাল লাগল।

    ReplyDelete