0

ধারাবাহিক - রাজর্ষি পি দাস

Posted in



ধারাবাহিক


ফেরা - ৩
রাজর্ষি পি দাস


সপ্তমী 
অক্টোবর ২০২০ 


আজ একজন অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়েছিলেন, মহিলা। আমি আমার স্কুল দেখতে গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ মন দিয়ে ঘুরেফিরে দেখার পর হঠাৎ দেখি মা বেরিয়ে আসছে। মা তো অবাক, তুই এখানে! আমিও অবাক, মা এখানে! পেছনে দেখি শ্রীঠাকুরের মন্দিরের চূড়ো। 



দুঃখ! কোথা থেকে কাকে দিয়ে শুরু করবো।

প্রথমে দুঃখ দিয়েছিল রিঙ্কুদি, আমার শরীর নিয়া মস্করা করত, বলত - ‘মাথা বড় দেহ ছোট বাঁটকুল’। বুড়াও ক্ষেপাত, ওরা হাতের ব্যাবহারে আমার বহর আর উচ্চতা নিয়ে হাওয়াতে একটা ড্রয়িং আঁকত। আমিও আয়নায়, ঐ রিঙ্কুদির বাড়িতেই ওদের ঘোষণার সততা যাচাই কোরে সম্ভবত জীবনে প্রথম দুঃখ পাই। যেটা আজ অব্দি কাটিয়ে উঠতে পারি নি। অমর উইপোকার মত ঐ হাওয়া-ড্রয়িং একটা পাকাপাকি আত্মগ্লানির বসত হয়ে বসে আমার বুকে। এখনও কোনও মেয়ের সামনে দাঁড়ালে, মানে যাকে মনে ধরে, চোখে চোখ রাখতে চাই, সেই ‘মাথা বড় দেহ ছোট বাঁটকুল’ হাওয়া ড্রয়িং কপকপ কোরে আমার ব্যক্তিত্ব খেয়ে ফেলে, ঝপাঝপ। ‘মাথা বড় দেহ ছোট বাঁটকুল’ খ্যাত আমি খোকনদের পুকুরে ঝাঁপ বা ওই মিটারগেজ রেলেলাইনের নিচে গলা দিইনি শুধু নারায়ণ দেবনাথ আর পিক্লুর জন্য। আমি আজীবন ঋণী থাকবো নারায়ণ দেবনাথ আর পিক্লুর কাছে নিজের চেহারার ঐ সফল প্রতিরূপ আবিস্কারের জন্য। শুকতারা! 

বাঁটুল দি গ্রেট।

পিক্লুর বন্ধুতা আর ওর দিদি চিত্রাদির বাড়তি ছাড়ে আমি বাঁটকুল নিয়মিত পড়ার সুযোগ পেয়ে কোথাও যেন নিজেকে ওভাররেট করা শুরু করে দিই। এই তো আমি, এটাই আমি, আমি আসলে হিরো, আমি পারি সব সমস্যার সমাধান করতে- যদা যদা হি ধরমস্য গ্লানি...। ভারত শব্দটা নিতে পারতাম না, ওটাকে তিন্সুকীয়া শব্দ দিয়ে রিপ্লেস কোরে...আমিই আসল বাঁটুল দি গ্রেট! তারপর আর বেরোতে পারলাম না নিজের বানানো এই ওভাররেটিং থেকে। 



ইকবাল দ্বিতীয় সিগারেট ধরিয়ে নির্বিকার ভঙ্গীতে বলল – কইতে অসুবিধা আছে? 

ট্রেন ছুটছে, আমি ছুটছি, ইকবাল ছুটছে, ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সে সিলেক্টেট হওয়া ২৬ টা ছেলে ছুটছে, তার সাথে না জানি কত মানুষ এই ট্রেনে ছুটছে। সবার স্টপেজ কি প্রথমবার, তা কি কোরে হয়! তবু বিশ্বাস করতে ভাল লাগছে যে এই গৌহাটি থেকে লক্ষ্ণৌ ট্রেনে আমরা সবাই নতুন নতুন জায়গায় নামব। স্থলপদ্ম নিশ্চয়ই ভারত নামক দেশে সব জায়গায় ফোটে! স্থলপদ্ম আমার সবচেয়ে প্রিয় ফুল এবং রং! 

আমি বলতেই পারি ইকবালকে যে আমার দ্বিতীয় দুঃখ আমার সাইকেল। না, আমি বলব না আমি ক্লাশ ৫ না ৬ থেকে কখনও দুর্গাপুজাতে নতুন জামা কাপড় সপ্তমী পার হবার আগে পেয়েছি। তখন তো আর পঞ্চমী থেকে পূজা শুরু হতো না, তবে সপ্তমী মানেই নতুন জামা-প্যান্ট । মানে যে বয়স থেকে মানুষের বাচ্চারা তুলনা – প্রতিতুলনা – অতিতুলনা শেখা শুরু করে, সপ্তমী থেকেই শুরু হয়ে যেত। ওদিকে যে পাড়ায় থাকি সেখানে মোটামুটি শহরের ৮০% বাঙালি কোটিপতি থাকে। মা তো অঞ্জলি পর্যন্ত দিতে বেরোত না, আর বাবা অনেক রাত অব্দি পূজার বাজারে খেটে নড়বড়ে ASE ৪০১ মার্ক ২ Ambassador নিয়ে বাড়িতে ঢুকে ক্লান্ত বিধ্বস্ত, চায়ের বদলে আমার মা’র সাথে তুমুল ঝগড়া, কখনও হাতাহাতি-আর আমার এক বৎসর বয়সী ভাইয়ের চিল চিৎকার... না আমি মনে করতে পারি না আমার কোনও পূজা ভাল কেটেছে। ওঁরা কেন ঝগড়া করতে করতে হিংস্র হয়ে উঠতেন বুঝতে পারতাম না, আজও বুঝি না। তবে ওঁরা কী বলছেন বা বলতে চাইছেন প্রতিবছর পুজোর কটাদিন ঢাকা পড়ে যেত কিশোরকুমারের গানে। কিশোর তখন পূজা সংখ্যার গানে ঈশ্বর- এই যে নদী যায় সাগরে...নয়ন সরসী কেন ভরেছ জলে... আর বাকীটা গান্ধীর ঢাক! 

মা, যখন আমি ক্লাশ টু থ্রি তে পড়তাম, আমাদের রান্নাঘরের পেছনে অধুনা খাদিমের আবিষ্কর্তা বা পাশে আমাদের বাড়িওয়ালা, ফিলিপস-ডিলার মজুমদার বাড়িতে গান বাজলেই মা বলে দিতে পারত কোনটা রবীন্দ্রসংগীত আর নজরুল বা শ্যামা, এমনকি গলা শুনে শিল্পীদের নাম পর্যন্ত, যেমন রবীন্দ্র হলে চিন্ময়, সুবিনয়, সাগর, সুচিত্রা আর নজরুল হলে মানবেন্দ্র, অনুপ--সেই মা দুম কোরে আলোর গতিতে ২ বছরের মধ্যে শুধু অনুকুল ঠাকুরের -- জয় রাধে রাধে আর ‘বারো বারো কর বিনতি’ তে নিজেকে বেঁধে ফেললেন কি কোরে! আমার বাবা ট্যাক্সি ড্রাইভার ছিলেন বলে? বাড়ীওয়ালার ছোট ছেলে রঞ্জন বাবা মা-র হিংস্র ঝগড়া, কিশরকুমারের গান থেকে খাদে উঁচুতে চলে গেলে বেলগাছের নীচে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিতেন বলে? 

প্রসাধন বলতে সবার জন্য শুধু বোরোলীন, মাকে কখনও সোনার গয়না পরতে দেখি নি, শাড়ি বলতে সুতির, তেল বলতে নারকেল, সবচেয়ে দামি রান্না বলতে ছানায় ময়দা মেশানো বড়া করে ছানার ডালনা। বাড়িতে গাড়ি থাকা সত্ত্বেও কোনওদিন দেখিনি বাবা মা কোথাও গাড়ি করে বেড়াতে যাচ্ছে, বা পাশাপাশি বসে হেসে কথা বলছে, বা চোখে চোখ রেখে কথা বলছে, সবসময় অভিযোগ আর ঝগড়া। সবসময় একটা দূরত্ব, যেটা হয়তো রাত্রিবেলা মাঝেমধ্যে ভাঙত, তাছাড়া কক্ষনও না! 

তাই মেনে নিয়েছি, শ্রীঠাকুর ছাড়া বরিশালের বাজারের মাড়োয়ারি তথা গোবরডাঙ্গার প্রায়-জমিদার পুত্র পুলিন বিহারি দাস আর ফরিদপুরের বহেমিয়ান পার্বতী দাসের একমাত্র মেয়ের আর কোনও গতি ছিল না! একজন কাউকে দরকার ছিল যাঁর হাত ধরে দুটো পূর্ববঙ্গীয় সচ্ছল বংশের রুচি আর অভিমান পাশাপাশি টিকে থাকতে পারে আর তিন্সুকীয়ার সংখ্যালঘু বাঙালির বৈষম্যমুক্ত শ্রীঠাকুরের সমাজে মেলামেশা করার ছাড়পত্র পেতে পারে! যেখানে ভক্তি এবং ডিসিপ্লিন বড় কথা, শিক্ষা-টাকাপয়সা নয়! তবে সমস্যাটা হলো অন্য জায়গায়, বাবা-মা যত ভক্তিতে ডুবে যান আমি তত ভক্তি ছেড়ে মাথা তোলার চেষ্টা করা শুরু করলাম, ওঁরা যত ডিসিপ্লিন্ড্‌ হন আমি তত উশৃংখল হতে থাকি। 

যতদূর মনে পড়ে আমাদের পাড়ায় তখন কেউ শ্রীঠাকুরের শিষ্য ছিলেন না! আমার বাবা জমিদার পুত্র ট্যাক্সি ড্রাইভার বিয়ের আগেই ঠাকুরের দীক্ষিত ছিলেন। কিন্তু প্রকাশিত এবং চর্চিত ছিল না। মা বিয়ের ২ বছর পর তিন্সুকিয়াতে এসে ব্যাপারটা বুঝতে ৪ বছর নিলেন। দীক্ষিত হলেন এবং সৎসঙ্গের আরও দুধাপ এগিয়ে গেলেন। স্বস্ত্যয়ন নিলেন। অনেকটা মাস্টার ডিগ্রির মত। এর পরে ডক্টরেট ডিগ্রীও আছে –ঋত্বিক! ছেলেমেয়ে একই স্কুলে পড়বে, তাই মায়ের পড়াশুনা বন্ধ কোরে দিয়েছিলেন আমার দিদিমা এবং বড়মামা। মা কি তার একটা প্রফাউন্ড কাউন্টার জবাব দিলেন ঠাকুরের আশ্রয় গ্রহণ কোরে? যেখানে তিন্সুকীয়ার মত একটা শহরে, যখন ববি সিনেমার পোস্টারের দিকে দৃষ্টিপাত পর্যন্ত পাপ ছিল-লায়ন’স ক্লাবের সদস্য আর রিক্সওয়ালা ছাড়া ববি দেখার কথা ভাবা যেত না, সেখানে শুধু ‘জয়গুরু’ বললেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে একই ঘরে প্রার্থনা-আলোচনা-আড্ডায় মেতে উঠতে পারত। তার উপর বাবা কিছুদিন আগেই পাড়াতে সেলাই, এম্ব্রডায়েরী শিখতে যাওয়া বন্ধ কোরে দিয়েছিল। এখানে ‘দিয়েছিলেন’ শব্দটা ব্যবহার করতে চাইছি না। 

যাই হোক মা বাবার এসব চক্করে আমার একাদশী শুরু হলো ক্লাশ ৫ থেকে! ছ্যাঃ! শ্রী ঠাকুরের প্রতি আমার রাগের এটা একটা অন্যতম কারণ যে উনি আমাকে নিরামিষ খেতে বাধ্য করেছেন, দীর্ঘ ১২ বছর। আর অদ্ভুত ভাবে ঠিক এইসময়টাতেই আমার মাছ ধরার নেশা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। পড়াশুনা মাথায় তুলে এপুকুর ওপুকুর! মাছ না খেলে কি হবে, ধরতে দোষ কী! আর মা শরীরে মাছের গন্ধ পেলেই হিংস্র, গুরুভক্তির অমর্যাদা হলে মানুষ সবচেয়ে বেশি হিংস্র হয় -এটা আমি মাকে দেখেই আত্মস্থ করে নিয়েছিলাম! পাশাপাশি শুরু হলো কুকুরপ্রেম, যে জন্তুকে বাবা সবচেয়ে ভয় এবং ঘেন্না করেন! হাতে ছিপ পাশে কুকুর - আমার নিজস্ব একটা ফ্রেম তৈরি হলো! 

আর ভোরবেলা উঠে ইস্টভৃতি তারপর মুখ বিষিয়ে থাঙ্কুনি পাতা--- হ্যাঁ এটাও ওঁর আজ্ঞা। একবার পৌঁছই তো, বেলগাঁও আর কতদূর, সব জলাঞ্জলি দেব! ট্রেনে অবশ্য ইস্টভৃতি চলছে। ভয়ে! ৪ দিন হলো কখনও ট্রেনে কখনও প্ল্যাটফর্মে। এ নিয়ে আমার সাথে শ্রীঠাকুরের সাথে কোনও কথা হয় নি। কথা হলে কি বলতাম! কি কব পারুল হেতেন! হ্যাঁ ওঁর অসংখ্য অসমীয়া শিষ্য ছিলেন, আছে, ইয়েস, কেলা বঙ্গালীর আমলেও! 

সাইকেলের কথা বলতে গিয়ে দুর্গাপূজা, বাবা-মা, রঞ্জনকাকু ... ঠাকুর, নিরামিষ, মাছ, কুকুর চলে এল। অথচ কানাইদার মুখ মনে পড়ল না! কী বলতে গিয়ে কি চলে আসে! আমি চুপ থাকাই ঠিক করলাম। ইকবাল উলটোদিকে তাকিয়ে আছে। ইকবাল কিছু একটা বলল, কিন্তু ব্রডগেজের হাওয়ার ঝাপটা ওর কথাকে উড়িয়ে পেছনে ফেলে দিল। 

আমি শুনতে না পাওয়াতে ইকবাল বিরক্ত - তুই বাল নিজের কথা কবি না আমার কথাও শুনবি না, ধুর। 

ও উঠতে চাইলে আমার দুহাত ওর কাঁধে, দুস্ত হাওয়াতে কিছু শুনতে পাচ্ছি না। ইকবাল একপলক আমার দিকে তাকিয়ে, তুই ইদিকে আয় তো। আমরা স্থান বদল করি । তুই ত কিছু কবি না, কিন্তু আমার কইতে হইব, ক্ষিদার গ্যাস আর দুঃখের গ্যাস মিল্লামিইস্যা পেটে খুব ব্যাথা, বোলে ইকবাল পোঁদ উঁচু কোরে বেশ কিছুক্ষণ ধরে পাদ দিল – ক্যালা, নাক চিপ্পা ব! 



রাত এখন ভোরের দিকে। ঘুম আসছে না! পাশের বার্থে ইকবাল মুখ হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। পাদ দেবার পর বলছিল, তুই কেলা বইয়া বইয়া ভাব...ভাবছিলাম তর মাইয়া লইয়া কবি তারপর আমি কমু...ধুর কেলা, সর্‌! 

অথচ আমি ইকবালকে বলতে চাইছিলাম এক হেমন্ত গোধূলিতে সূর্যের মাখন-হলুদ আলো একটি সাদা টেপ জামায় ঠিকরে এক পানচিবুক মুখে তিন্সুকিয়ার সুর্যাস্তের রঙ আর মাথার উপরে সেই মাখনহলুদ কিরণকে ছিন্নভিন্ন কোরে টিয়া পাখীর ঝাঁক আর ট্যাঁ ট্যাঁ! আর আমার কানাইদার সাইকেলের পিঠে চেপে ঝড়ের গতিতে ওদের গলির সামনে দিয়ে উড়তে উড়তে আসা-যাওয়া। রাখীর পানপাতা মুখ, পটলচেড়া চোখ, জলবেলুন গাল, টেপ জামার প্রান্ত থেকে ঝুলে পড়া নরম বাহু, অল্প পুরু ঠোঁট, টিকলো নাক আর টেপ জামায় এম্ব্রডায়েরি করা ফুলের পরাগবৃত্ত ঠেলে ওর সদ্য জাগ্রত বুকের ইশারা – আহা! বেমানান বলতে পাশে ওর উল্টো চেহারা আর ব্যাক্তিত্বের এক বলিষ্ঠ চেহারার মহিলা। দেখলেই মনে হতো ডেকে কান ধরে ওঠবস করাবে। তাই কানাইদার সাইকেল ছাড়া কোনওদিনও যেতাম না! রাখী পেয়েছিল ওর বাবার শরীর। ওর বাবা কাঠিয়া বাবার শিষ্য ছিলেন। জীতেন্দ্র টাইপ দেখতে, আমাদের পাড়াতে বর্ধন-আম্বানীর বাড়িতে গুরু-কীর্তনে খোল বাজাতেন। তারপর জীবনবীমার এজেন্টের কাজ রাত ৯ টা অব্দি, পদবী দে, পরেরদিন ৯-৫ অব্দি ডেইলি বাজারে দোকান চালাতেন, নাম শ্রীগুরু বস্ত্রালয়। মাথায় কাঠিয়াবাবাকে স্মরণ করা চন্দনের তিলক, বেচতেন ব্রা-প্যান্টি-জাঙ্গিয়া! 

হাসবি না কিন্তু, নিজের অজান্তে বলে উঠলাম আর উত্তরও পেয়ে গেলাম! 

দেখি ইকবাল হাওয়া বালিশ পেটে চেপে, সিগারেট ধরিয়ে বলছে—হালায় কইছত কিছু যে হাসুম! চল দরজাই যাই!


0 comments: