Next
Previous
Showing posts with label ওবাড়ির চিঠি. Show all posts
0

ওবাড়ির চিঠি - শতরূপা দত্ত

Posted in


মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার ইতিহাস ও ৩০ লাখ শহীদের গল্প


বাংলার সবুজ মাঠকে লাল করে দিতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলি। তার ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, ‘Paint the green of East Pakistan red.’ আর তা তিনি দিয়েও ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ইতিহাসের বাইরে রয়েছে বর্বরতার এক বিশাল ইতিহাস। এই দেশের এমন কোনো জেলা নেই, এমন কোনো থানা, ইউনিয়ন বা গ্রাম নেই, যেখানে পাকিস্তানী বাহিনী নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজ করেনি। 

গণহত্যার সংজ্ঞা খুঁজতে গেলে জানা যায়, কোনো জাতি, আদিবাসী গোষ্ঠী, বিশেষ বর্ণের জনগোষ্ঠী অথবা কোনো ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করে দেবার উদ্দেশ্যে তাদের উপর হামলা চালানো হলে, সেটি গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হবে। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ’ থেকে প্রকাশিত দলিলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যাকাণ্ডকে ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ঙ্কর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করেছে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। 

১৯৭১-এর মার্চের ২৫ তারিখ থেকে পরবর্তী নয় মাসে পরিকল্পিতভাবে বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, তিন লক্ষেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়াসহ অপহরণ, গুম ও বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। আর এসব হামলায় পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে বাঙালি-অবাঙালি সমন্বয়ে গঠিত রাজাকার, আল বদর, আল শামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা।

আন্তর্জাতিক মহলের মতে, ১৯৭১-এ পাকিস্তান সেনাবাহিনী তিন মিলিয়ন বা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে। ‘৩০ লাখ’ সংখ্যাটির সমর্থন রয়েছে ‘এনসাইক্লোপেডিয়া আমেরিকানা’, ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন’, ‘টাইম’ ইত্যাদি ম্যাগাজিনে। এদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডে নাজি বাহিনীর বর্বরতার চাইতেও ভয়াবহ।

২৫ মার্চের গণহত্যা দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর বাঙালি নিধনের শুরু। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার ও পিলখানায় সেনা-অভিযান চালায় তারা। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি পুলিশ, ইপিআর এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের হত্যা করতে শুরু করে। কত ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-ইপিআর-সাধারণ মানুষ সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন তা গুনে শেষ করা যাবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমগুলোও সেদিন রেহাই পায়নি। পাকিস্তানী হানাদাররা সেই রাতে আগুন দিয়ে ও মর্টার সেল ছুঁড়ে একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, জাতীয় প্রেসক্লাব ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীকেও। অস্ট্রেলিয়ার পত্রিকা ‘হেরাল্ড ট্রিবিউনে’র রিপোর্ট অনুসারে, শুধু ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরেই ১ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।

এ তো গেলো শুধু একটি শহরের একটি দিনের হিসেব। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের প্রতিটি দিনেরই এমন অনেক হিসেব রয়েছে। আজো দেশের আনাচে কানাচে খুঁজে পাওয়া যায় বধ্যভূমি-গণকবর, যেগুলো পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের দেশীয় দোসরদের সংঘটিত গণহত্যার দগদগে প্রমাণ হাজির করে। 

২০১৮ সালে ‘১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’ তাদের একটি জরিপ সম্পর্কে জানায়, জরিপে তারা শুধু ১০ জেলাতেই ১,৭৫২টি গণহত্যার তথ্য পেয়েছেন। সেই ১০টি জেলা হলো নীলফামারি, বগুড়া, নাটোর, কুড়িগ্রাম, পাবনা, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, নারায়ণগঞ্জ, ভোলা ও খুলনা। দশ জেলার মধ্যে গণহত্যার সবচেয়ে বেশি ঘটনা পাওয়া গেছে খুলনায়। সেখানে ১,১৫৫টি গণহত্যা, ২৭টি বধ্যভূমি, ৭টি গণকবর এবং ৩২টি নির্যাতন কেন্দ্রের তথ্য পাওয়া গেছে। এখনো জরিপ কাজ চলমান রয়েছে। 

এর আগে ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’ বাংলাদেশে প্রায় ৯৪২টি বধ্যভূমি সনাক্ত করে, যার মধ্যে চট্টগ্রামেই রয়েছে ১১৬টি। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমির শুধু একটি গর্ত থেকেই স্বাধীনতার পর ১১০০ মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি দামপাড়া। ১৯৭১ সালে এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেনা পাহারায় ৫/৬টি ট্রাকবোঝাই জীবন্ত মানুষ ধরে নিয়ে আসা হতো। লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার পর তাদের মাটিচাপা দেওয়া হতো। ধারণা করা হয়, এখানে আনুমানিক ৪০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। রাজশাহীর একটি বধ্যভূমিতে একশটি গণকবর থেকে দশ হাজার মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। স্বাধীনতার পর খুলনার গল্লামারী বধ্যভূমি থেকে প্রায় পাঁচ ট্রাক ভর্তি মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় পাওয়া যায়। ওখানে আনুমানিক ১৫ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। 

শুধুমাত্র খুলনার চুকনগরেই ১৯৭১ সালের ২০ মে, একদিনে ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানার রেলব্রিজটি লালব্রিজ নামে পরিচিত। এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনারা ট্রেন থামিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে ব্রিজের পাশে জমিগুলোতে পুঁতে রাখতো। পুরুষদের হত্যা করা হতো, আর নারীদের ক্যাম্পে এনে দিনের পর দিন নির্যাতনের পর হত্যা করে মাটিচাপা দিত বর্বর পাকিস্তানী সেনারা। ১৯৭১ এর ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকার-আলবদরদের সহযোগিতায় ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গায় তিন হাজারেরও বেশি বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করে। 

ঢাকার মিরপুরে স্বাধীনতার পর ১০টি বধ্যভূমির সন্ধান মেলে। কালাপানি বধ্যভূমি, রাইনখোলা বধ্যভূমি, শিরনির টেক বধ্যভূমি, সারেং বাড়ি বধ্যভূমি, গোলারটেক বধ্যভূমি, বাংলা কলেজের আমবাগান বধ্যভূমি, আলোকদি বধ্যভূমি, মুসলিম বাজার বধ্যভূমি, শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি ও জল্লাদখানা বধ্যভূমি। এরমধ্যে রায়েরবাজার এবং জল্লাদখানার মতো বধ্যভূমির মোট লাশের সংখ্যা কখনোই নির্ণয় করা সম্ভব হবে না।

অধ্যাপক আনিসুর রহমান ঢাকার শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি দেখে এসে বলেছিলেন- ‘কসাইখানায় কসাইকে দেখেছি জীবজন্তুর গোস্তকে কিমা করে দিতে। আর শিয়ালবাড়িতে গিয়ে দেখলাম কিমা করা হয়েছে মানুষের হাড়। ... আমরা শিয়ালবাড়ির যে বিস্তীর্ণ বন-বাদাড়পূর্ণ এলাকা ঘুরেছি তার সর্বত্রই দেখেছি শুধু নরকঙ্কাল আর নরকঙ্কাল। পা বাঁচিয়েও হাড়হীন মাটির ওপর পা ফেলতে পারিনি। দেখেছি কুয়ায় কুয়ায় মানুষের হাড়।’

নয় মাসের গণহত্যার তালিকায় বধ্যভূমি আর গণকবরগুলোতে ঘুমিয়ে থাকা শহীদরাই নন, তাদের পাশে আরো আছেন বিভিন্ন পাকিস্তানী ক্যাম্পে নৃশংস নির্যাতন, ধর্ষণের শিকার হওয়া অসংখ্য নারীরা, নৃশংস ধর্ষণের পর যাদের আরো নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। আর আছেন তৎকালীন পূর্ববাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পতাকাবাহী, মুক্তিযুদ্ধের পৃষ্ঠপোষক বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা।

ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১৪ তারিখের মধ্যে পাকিস্তানী বাহিনী ও আলবদরের হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রকৌশলী।

এখানেই শেষ নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা এবং গবেষকদের গবেষণা থেকে ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৭১ সালে ভারতে চলে যাওয়া প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শরণার্থীর ভেতর ৬ থেকে ১২ লাখ মানুষ পথকষ্ট, খাদ্যাভাব, অপুষ্টি ও মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া ডায়েরিয়া-কলেরায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

বাংলাদেশে নিজেদের পরাজয়ের কারণ বের করতে ১৯৭২ সালে পাকিস্তান ‘হামাদুর রহমান কমিশন’ গঠন করে। ২৮ বছর সে রিপোর্ট লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রেখেছিল দেশটি। ২০০০ সালে গণমাধ্যমে এই কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হলে দেখা যায়, কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সিনিয়র পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তারা প্রায় সবাই-ই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনের কথা স্বীকার করেছেন।

১৯৮১ সালে জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়, মানব সভ্যতার ইতিহাসে, সবচেয়ে স্বল্প সময়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। গড়ে প্রতিদিন ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। গণহত্যার ইতিহাসে প্রতিদিনের এই গড় হিসেবই এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি। গণহত্যার এই ইতিহাসের কথা তেমন করে বলা হয়ে ওঠেনি আজো। অথচ, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বুকে যে গণহত্যা চালিয়েছিলো সে রকম আরেকটি গণহত্যার উদাহরণ খুঁজে বের করা প্রায়ই অসম্ভব।
0

ওবাড়ির চিঠি - শতরূপা দত্ত

Posted in

ভাষাকে ভালোবেসে জন্ম নিলো একটি দেশ

বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে আজ আর নতুন করে বলার কিছু নেই। রাষ্ট্রভাষার অধিকার আদায়ের পথ পেরিয়ে ভাষা আন্দোলনের রক্তঝরা দিনটি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জন করে নিয়েছে। হয়ে উঠেছে পৃথিবীর বড়-ছোট-বিলুপ্তপ্রায় সমস্ত ভাষার প্রতিনিধি। আজ একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্মরণ করতে গিয়ে আমরা উচ্চারণ করি- বেঁচে থাকুক পৃথিবীর সমস্ত ভাষা।

বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার গণদাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে এই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও, বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারতীয় উপমহাদেশ ভেঙে জন্ম নিলো ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি দেশ। দেশভাগের সময় পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষী ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ভিন্নভাষী পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহম্মদ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হওয়া উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। এসময় শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ অন্যান্য ভাষাবিদরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গ্রহণ করা না হলেও নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসনে অবাঙালি উচ্চপদস্থ আমলাদের আধিক্যের কারণে লোকচক্ষুর অন্তরালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত চলতে থাকে। এ চক্রান্ত ধরা পড়ে যায় নতুন রাষ্ট্রের পোস্ট কার্ড, এনভেলপ প্রভৃতিতে ইংরেজির সঙ্গে শুধু উর্দুর ব্যবহার দেখে। আর তাই জন্মের পরপরই ভাষার প্রশ্নে বিভেদ সৃষ্টি হয় পাকিস্তানের দুটি অংশে।

১৯৪৭ সাল থেকেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন-সংগ্রাম চলতে থাকে। ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় এসে ২৭শে জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় ঘোষণা দেন- ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এই ঘোষণা যেন সেই আন্দোলনের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিলো। আর তাই আসে ২১শে ফেব্রুয়ারির সেই তপ্ত দুপুর, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় নামে ছাত্র-শিক্ষক-সাধারণ মানুষের ঢল। একটা ভাষাকে ভালবেসে, সেই ভাষায় কথা বলার, গান করার, ভালবাসার, ক্ষোভ প্রকাশের অধিকার চেয়ে পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিতে দ্বিধা না করা এক আশ্চর্য মিছিল সেদিন হতবাক করে দেয় বিশ্ববাসীকে।

ভাষার জন্য কতজন মানুষ সেদিন প্রাণ দিয়েছিলেন, তার সঠিক হিসেব আজো বের করা সম্ভব হয়নি। যে পাঁচজন শহীদের নাম বেশি শোনা যায়, তাঁদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বরকত ও জব্বার এবং ঢাকার আরেক বাসিন্দা রফিক পুলিশের গুলিতে নিহত হন ২১শে ফেব্রুয়ারিতে। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মারা যান রিকশাচালক সালাম এবং হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অলি আহাদ জানিয়েছিলেন, ২২শে ফেব্রুয়ারি ভিক্টোরিয়া পার্কের (বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্ক) আশেপাশে, নবাবপুর রোড ও বংশাল রোডে গুলিতে কতজন মারা গেছেন তার সঠিক সংখ্যা কারো জানা নেই। আহমদ রফিক তাঁর ‘একুশ থেকে একাত্তর’ বইয়ে নিহতদের মধ্যে আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ ও সিরাজুদ্দিনের নাম উল্লেখ করেছেন।

বাহান্নর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে প্রথম স্মারক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিলে ১৯৫৩ সালের মার্চে। এতে কবির উদ্দিন আহমেদ ‘একুশের ঘটনাপুঞ্জী’ নামে একটি প্রতিবেদনে লেখেন, শহীদদের লাশগুলো চক্রান্ত করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ...পরদিন সকাল নয়টায় জনসাধারণের এক বিরাট অংশ ‘মর্নিং নিউজ’ অফিস জ্বালিয়ে দেয় এবং ‘সংবাদ’ অফিসের দিকে যেতে থাকে। ‘সংবাদ’ অফিসের সম্মুখে মিছিলের উপর মিলিটারি বেপরোয়া গুলি চালায়। অনেকেই হতাহত হয় এখানে। কবির উদ্দিন আহমেদের বিবরণ থেকে আরো জানা যায়, ২৪শে ফেব্রুয়ারি ‘সর্বদলীয় কর্মপরিষদের’ পক্ষ থেকে সর্বমোট ৩৯ জন শহীদ হয়েছেন বলে দাবি করা হয়।

২১শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় গণতান্ত্রিক যুবলীগের চট্টগ্রাম জেলা শাখার আহ্বায়ক এবং ‘সীমান্ত’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী লেখেন একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। সেই দীর্ঘ কবিতার কয়েকটি লাইন ছিলো-

‘ওরা চল্লিশ জন কিংবা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে- রমনার রৌদ্রদগ্ধ
কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়...’

এখানে কবির ব্যবহার করা চল্লিশ সংখ্যাটি কি নিছক একটা সংখ্যাই ছিলো? নাকি এটাই ছিলো সত্যিকার শহীদের হিসেব? ভাষা আন্দোলনের এতো বছর পেরিয়ে গেলেও আজো আমরা সেই আন্দোলনের শহীদদের সঠিক সংখ্যা, তাদের নাম-পরিচয় উদ্ধার করতে পারিনি, এ আমাদেরই লজ্জা।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের পরপরই কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণে সমবেত হয়েছিলেন কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

ভারত থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর সরাসরি ভাষা আন্দোলনে শরিক হন তিনি। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত কার্যক্রমে তিনি অংশগ্রহণ করেন। তিনি এই মজলিসকে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বহু কাজে সাহায্য ও সমর্থন করেন (সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মযহারুল ইসলাম: পৃ.১০৪)।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। এই সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেছিলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা সৈনিক গাজীউল হক লিখেছেন, ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক। এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’(সূত্র: ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’; গাজীউল হক, ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্র)

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলার সময়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত মিছিলে নেতৃত্ব দেন ।

১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এই হরতালে যুবক শেখ মুজিব নেতৃত্ব দেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতার হন। ভাষা সৈনিক অলি আহাদ তাঁর ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫’ গ্রন্থে লিখেছেন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ থেকে ১০ই মার্চ ঢাকায় আসেন।

১৯৪৮ সালের ১৬ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা নিয়ে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।

ভাষা সৈনিক গাজীউল হক তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।’(গাজীউল হক: আমার দেখা আমার লেখা, পৃষ্ঠা-৪০)।

একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে অনেক গল্প-কবিতা-উপন্যাস। আগেই বলেছি, একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে প্রথম রচিত কবিতা ছিলো মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কবিতাটি রচিত হয়। চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে ১৯৫২ সালেরই ২২শে ফেব্রুয়ারি এই কবিতা পাঠ করেন চৌধুরী হারুনুর রশিদ। ১৭ পৃষ্ঠার দীর্ঘ এ কবিতাটি ছাপা হয় চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার কোহিনূর প্রেস থেকে।

’৫২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের হাতে প্রথম শহীদ মিনার ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ রচনা করেন ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতাটি (‘স্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু)। প্রথম শহীদ মিনার ভাঙার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ইকবাল হলে বসে সঙ্গে সঙ্গেই এই কবিতাটি রচনা করেন তিনি। সেই কবিতার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে ভাষা আর দেশমাতৃকার জন্য ভালবাসার তীব্র বারুদ-

‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো
চারকোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো! যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে
হীরের মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটকা ধূলায় চূর্ণ যে পদ-প্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাঁপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য।
ইটের মিনার
ভেঙেছে ভাঙুক! ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
চারকোটি পরিবার।’

ভাষা আন্দোলনভিত্তিক প্রথম গান ‘ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’। রচয়িতা ভাষা সৈনিক আ ন ম গাজিউল হক। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আর্মানিটোলা ময়দানের জনসভায় গানটি গাওয়া হয়। আবদুল গাফফার চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ রচনার আগেই গাজী ভাই (গাজীউল হক) লিখেছিলেন ‘ভুলবো না, ভুলবো না’।

১৯৫৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রকৌশলী মোশাররফ উদ্দীন আহমদ প্রথম প্রভাতফেরিতে গাওয়া গান ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে, আজকে স্মরিও তারে’ রচনা করেন। এতে অপূর্ব সুর সংযোজন করেন আলতাফ মাহমুদ। আলতাফের সঙ্গে প্রথম কণ্ঠ মেলান শিল্পী সংসদের নিজামুল হক, মোমিনুল হক ও ছাত্রনেতা গাজীউল হক।

একুশের প্রথম নাটক মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’। প্রথম উপন্যাস জহির রায়হান রচিত ‘আরেক ফাল্গুন’। একুশের চেতনায় নির্মিত প্রথম সিনেমা জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’।

১৯৫৪ সালের ৭ মে গণপরিষদে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পায় এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১৪(১) পুনর্লিখিত হয় এভাবে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং বাংলা’। তবে আইয়ুব খানের নেতৃত্বে গঠিত সামরিক সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে পুনঃস্থাপনের চেষ্টা আগাগোড়াই বলবৎ রাখে।

ভাষা মানুষের প্রাণ, মানুষের আশ্রয়, মানুষের অবলম্বন, মানুষের শক্তি। ভাষা মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয়। একটি জাতির ভাষা কেড়ে নিলে সে জাতি বিলুপ্ত হতে আর বেশি সময় লাগে না। সে কথা বাংলার মানুষ সেদিন বুঝেছিলো বলেই নিজের ভাষাকে বাঁচাতে, মায়ের ভাষাকে বাঁচাতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে কার্পণ্য করেনি। ভাষার জন্য যে লড়াইটা শুরু হয়েছিলো, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সে লড়াই শেষ হলো। ভাষার জন্য ভালোবাসা থেকে জন্ম নিলো একটি নতুন দেশ। বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে মানচিত্রের বুকে লেখা হলো একটি নতুন নাম। সে দেশের নাম বাংলাদেশ।
0

ওবাড়ির চিঠি - শতরূপা দত্ত

Posted in

পেঁয়াজের ঝাঁঝে কাঁপছে উন্নয়নমুখী বাংলাদেশ

একমণ ধানের দামে দুই কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গায়। এখানকার বাজারগুলোতে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৬০-২৪০ টাকায়। আর হাটগুলোতে আমন ধান মণ প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪৮০-৫৪০ টাকায়। “বাজারের যে হাল তাতে পরিবার নিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকায় দায়।”- চুয়াডাঙ্গা নতুন ভান্ডারদহ গ্রামের কৃষক হাশেম আলী সরোজগঞ্জ বাজারে এসে এভাবেই নিজের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার নেই - বাংলাদেশের মানুষ এ কথা ভাবতেই পারে না। বহুদিন ধরে প্রচলিত ব্যবহারের কারণে পেঁয়াজ আমাদের রান্নার একটি বাধ্যতামূলক উপাদানে, আমাদের খাদ্য-সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে।

অথচ সম্প্রতি পেঁয়াজের ঝাঁঝে চোখে সর্ষেফুল দেখছে বাংলাদেশের মানুষ। আগস্ট থেকেই ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করেছিল পেঁয়াজের দামের পারদ। নভেম্বরের মাঝামাঝিতে এসে তা যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে বিশ্ব রেকর্ড করতে চাইছে প্রতিদিন। সরকারের নানা পদক্ষেপেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না পেঁয়াজের বাজার। যে পেঁয়াজ আগে পাওয়া যেতো ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে, সেই পেঁয়াজই নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ শেষে খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ২৫০ টাকা পর্যন্ত। আর পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হয়েছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়। 

অবশ্য, বাজারে পেঁয়াজের আকাশ ছোঁয়া দাম থাকলেও মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা সেই দাম পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। এজন্য ব্যবসায়ীদের মজুদ ও সিন্ডিকেটকেই দায়ী করেছেন পেঁয়াজচাষিরা। এছাড়া মৌসুমের শুরুতেই বৃষ্টি হওয়ায় পেঁয়াজের উৎপাদন এবার কিছুটা কম হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তারা।

সম্প্রতি রপ্তানি নীতি সংশোধন করে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের একটি সমিতি জানিয়েছে, বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদার ৬০ শতাংশ মেটানো হয় দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ থেকে। বাকি ৪০ শতাংশ আমদানি করা হয়। আর এই আমদানির সিংহভাগই আসে ভারত থেকে। 

অবশ্য, পেঁয়াজের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এমন অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দেখছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি ও হ্রাস দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। বর্তমান সরকারের কৃতিত্বকে ম্লান করে দেওয়ার জন্য কোনো অসাধু চক্র এই সংকট তৈরি করেছে কিনা তা খুঁজে দেখার বিষয়ে জোর দিতে বলছেন তারা। মনে করিয়ে দিয়েছেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় বড় কৃতিত্ব ম্লান করে দেওয়া হয়েছিল লবণ ও মরিচের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি করে। পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও মজুদদার ও ফড়িয়ারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। পরিস্থিতি মোকাবেলা না করলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না বলেও মত প্রকাশ করেন তারা।

আরেকটি পক্ষ অবশ্য মনে করছেন, সরকারের অদক্ষতা এবং আইনের কঠিন প্রয়োগ না থাকাই পেঁয়াজের দাম বাড়ার মূল কারণ। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেট ও প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারসাজির কারণে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে বলে মত দিয়েছেন তারা।

পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও নৈরাজ্যের পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীরা জড়িত থাকতে পারে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তেমন অভিযোগ বরাবরই যেকোনো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পর করা হয়। কিন্তু এবার সরকারের প্রতিষ্ঠান ‘প্রতিযোগিতা কমিশন’-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাজারে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে একটি সিন্ডিকেট থাকতে পারে। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ধীরে চলা নীতির সমালোচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পর এ পর্যন্ত সাতটি দেশ থেকে ৬৬ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। পাঁচ হাজার টন বন্দর থেকে খালাস করা হয়েছে। মিসর ও তুরস্ক থেকে কিছুদিনের মধ্যে ৫০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আসবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, আমদানি করা পেঁয়াজ জেলায় জেলায় পাঠানো হবে। টিসিবি ট্রাকে করে তা বিক্রি করবে।

কিন্তু সাধারণের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাওয়া পেঁয়াজের বাজারের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরার কৌশল বের করতে হবে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছন, দুইভাবে খুব দ্রুত বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রথমত, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা দেওয়া। দ্বিতীয়ত, বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘোষিত বড় চালান দ্রুত দেশে পৌঁছানো এবং ছোট আমদানিকারকদের ব্যাংকের ঋণসুবিধা নিশ্চিত করা।

পেঁয়াজের দাম নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংসদ সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কিনা তা খুঁজে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।

কৃত্রিম সংকট তৈরির বিষয়টি যে মিথ্যে নয় তা বোঝা যায়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পচে যাওয়া বস্তা বস্তা পেঁয়াজ যখন ফেলে দেয়া হয় কর্ণফুলী নদীতে, যখন জানা যায়, খাতুনগঞ্জে বিভিন্ন গুদামে পড়ে আছে বিপুল পরিমাণ পচা পেঁয়াজ।

পেঁয়াজ নিয়ে এই হাহাকারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মানুষকে কয়েকদিন পেঁয়াজ না খেতেও অনুরোধ করেছেন। বলেছেন, আমি নিজেও রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার করতে মানা করেছি রাঁধুনিকে। পেঁয়াজ ছাড়াও অনেক মজার রান্না করা যায়। 

তবে সাধারণ মানুষ পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেননি। রন্ধন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর মূল কারণটি লুকিয়ে রয়েছে আমাদের মনে। ইউটিউবে জনপ্রিয় একটি রান্নার চ্যানেল আছে রুমানা আজাদের। তিনি বলেন, পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার কথা বাঙালি চিন্তাও করতে পারেন না। মা-খালাদের রান্না দেখে দেখে আমাদের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে যে পেঁয়াজ ছাড়া কোন তরকারি রান্না সম্ভব না। বিশেষভাবে মাংস ও মাছ। আদা, রসুন হয়তো বাদ দেয়া চলে, কিন্তু পেঁয়াজ থাকতেই হবে। এই রন্ধনশিল্পী মনে করেন, বাঙালিরা ঐতিহ্যগতভাবে যেসব রান্না জানে, তাতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন মেনে নিতে চায় না।

এই রন্ধনশিল্পী জানিয়েছেন, পেঁয়াজ ছাড়া বেশ কয়েকটি রান্না তিনি তৈরি করেছেন, এমনকি মাছ-মাংসের পদও, সেগুলো খেতেও খুবই ভালো হয়েছে।

রন্ধন শিল্পীরা বলেন, তরকারিতে পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়নি, এটা বলে না দিলে কেউ সহজে টেরও পাবেন না। কিন্তু মনের মধ্যে এমনভাবে পেঁয়াজের ব্যবহার গেঁথে গেছে যে, যে মুহূর্তে মানুষ জানতে পারে রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়নি, তখন আর তরকারিটি আগের মতো মজা লাগে না।

পেঁয়াজ কোন সবজি নয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘অ্যালিয়াম সেপা’। গোত্র হচ্ছে লিলি। এটি মূলত একটি মসলা জাতীয় উদ্ভিদ। উপমহাদেশে কবে থেকে রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার শুরু হলো তা জানা যায় না। তবে, বাঙালির হেঁশেলে যে পেঁয়াজ ছাড়াও সুস্বাদু রান্নার রেসিপি সেই প্রাচীন কাল থেকেই আছে, ব্যবহারের অভাবে সেটাই ভুলে গেছে মানুষ। সুস্বাদু নিরামিশ রান্নার পাশাপাশি পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া রান্না করা মাছ-মাংসের মজাদার রেসিপিও আছে বাঙালির ভাণ্ডারে। অপেক্ষা শুধু সেই মানিক-রতন খুঁজে আনার।

বাঙালিকে খাদ্যরসিক জাতি বলা হলেও, পেঁয়াজ নিয়ে কান্নাকাটি দেখে মনে হচ্ছে খাবারে নতুন কিছু এক্সপেরিমেন্ট করতে বড় ভয় তাদের। পেঁয়াজ ছাড়া রান্না হবে না বা রান্না ভালো হবে না- এই যে ধারণাটা আমাদের মাথায় তৈরি হয়েছে, এর সঙ্গে বাস্তবতার আসলে কোনো সম্পর্ক নেই। পেঁয়াজ দেশি-বিদেশি কোনও রান্নার জন্যই অতীব জরুরি কোনও দ্রব্য নয়। 

বাংলাদেশের একজন ক্রেতা বলেন, “দেশি পেঁয়াজের দাম ২৬০ টাকা, আর আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ২৩০ টাকা। এই দামে পেঁয়াজ না খেলে কী হয়! যতদিন আগের দামে না ফিরবে, ততদিন পেঁয়াজ ছাড়াই তরকারি খাব।”- এই সিদ্ধান্তে যদি দৃঢ় হয়ে দাঁড়াতে পারতো দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ, তবে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্র হয়তো সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ভেঙে পড়তো। অথচ, তা না করে, পেঁয়াজকে দৈনন্দিন জীবনে এমনই আঁকড়ে ধরেছে মানুষ, যে এটি এখন রাজনীতির পণ্য হয়ে উঠেছে।
0

ওবাড়ির চিঠি -শতরূপা দত্ত

Posted in

সম্প্রীতি ও সৌহার্দে বাংলাদেশের দুর্গাপূজা

বাংলাদেশে সম্প্রতি ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। স্লোগানটি আজকালকার হলেও, এর অসাম্প্রদায়িক ভাবটি কিন্তু বহু যুগ আগের, বাংলার জল-মাটি-হাওয়ায় মানুষে মানুষে এই মেলবন্ধন শতাব্দী-প্রাচীন। তাই বাংলাদেশের প্রধান উৎসবগুলোর মধ্যে দুটি ঈদ, পহেলা বৈশাখ আর শারদীয় দুর্গাপূজা এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণযোগ্য।

পঞ্চাশের দশকেও বাংলাদেশে দুর্গাপূজা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক আনন্দঘন আয়োজন। পূজামন্ডপের আঙ্গিনায় রামায়ণ কীর্তন, পালাগান, কবির লড়াই অনুষ্ঠিত হতো। দুর্গাপূজা উপলক্ষে আয়োজিত হতো মেলা। মেলাপ্রাঙ্গনে থাকতো নাগরদোলা, মোরগের লড়াই থেকে শুরু করে নানা আয়োজন। এসব আয়োজনে ধর্মীয় বৈপরীত্য ভুলে গ্রামের সব মানুষ উৎসাহের সাথে অংশগ্রহণ করতো। 

পাকিস্তান আমলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ছড়িয়ে দেয়া সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প বাঙালির সংস্কৃতিতে যে আঘাত করেছিলো, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা থাকলেও তাকে পুরোপুরি পরাস্ত করা যায়নি। ধর্মান্ধ মৌলবাদের বিষবৃক্ষ থেকে কিছু অনাকাঙ্খিত ফল তাই মাঝেমধ্যেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা চালিয়ে যায়। তাই এখন আর গ্রামে-গঞ্জে দুর্গাপূজার তেমন বড় আয়োজন দেখা যায় না। দুর্গাপূজা এখন অনেকটাই শহরকেন্দ্রিক। তবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনাসহ বড় বড় মহানগরে ধুমধামের সাথে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকে চারপাশ। যেমন নিরাপত্তা বাড়াতে হয় ঈদের নামাজে, তাজিয়া মিছিলে, পহেলা বৈশাখের প্রভাতী আয়োজনে।

এসবের মাঝেও দুর্গাপূজা যেভাবে উৎসবের আমেজে ও সম্প্রীতির বন্ধনে বাংলাদেশের মানুষকে একীভূত করে, এমনটি অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না। পাড়ায়-পাড়ায়, মণ্ডপে-মণ্ডপে মানুষের যে ঢল নামে তা যে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরই ঢল নয়, সে কথা হলফ করে বলা যায়।

মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর একটি নির্বাচিত অংশ শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম। এতে তেরোটি অধ্যায়ে মোট সাতশোটি শ্লোকে দুর্গাকে নিয়ে প্রচলিত তিনটি গল্প- মধু-কৈটভের কাহিনী, মহিষাসুরের কাহিনী ও শুম্ভ-নিশুম্ভের কাহিনী রয়েছে। আর আছে মর্ত্যে বা পৃথিবীতে প্রথম দুর্গাপূজা প্রচলনের কাহিনী। এই কাহিনী রাজা সুরথ ও সমাধি নামের এক বণিকের। সুশাসক ও যোদ্ধা হিসেবে রাজা সুরথের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। কিন্তু একবার এক যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটে। সেই সুযোগে তাঁর মন্ত্রী ও সভাসদেরা তাঁর ধনসম্পদ ও সেনাবাহিনীর দখল নেন। মনের দুঃখে বনে বনে ঘুরতে ঘুরতে রাজা মেধা নামে এক ঋষির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। মেধা মুনি রাজাকে নিজের আশ্রমে আশ্রয় দেন। একদিন বনের মধ্যে রাজা সমাধি নামে এক বণিকের দেখা পেলেন। সমাধির স্ত্রী ও ছেলেরা তাঁর সব টাকাপয়সা ও বিষয়সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। মেধা ঋষির উপদেশে তাঁরা দুজন দুর্গাপূজা করলেন। দেবীর বরে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হলো। 

পুরাণে বর্ণিত এই মেধা ঋষির আশ্রমটি অবস্থিত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালীর করলডেঙ্গা পাহাড়ে। বর্তমানে এটি মেধষ মুনির আশ্রম নামে পরিচিত। ১৯০০ সালে স্বামী বেদানন্দ নামে এক সাধক দৈবাদেশ পান কড়লডেঙ্গার বেতসা নদীর তীরে যাওয়ার জন্য। আদেশানুসারে সেখানে এসে মেধষ মুনির আশ্রমকে অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচান স্বামী বেদানন্দ। ১৯৭১ সালের ১৬ জুন পাকিস্তানী সেনারা এই আশ্রমে লুটপাট চালায় এবং গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্দিরে পাথরের প্রতিমা প্রতিস্থাপন করে আবার পূজা শুরু হয়।

বলা হয়ে থাকে, অবিভক্ত বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের সামন্ত রাজা কংস নারায়ণ। সম্রাট আকবরের শাসনামলে (ষোড়শ শতকে) বাংলার দেওয়ান হন তিনি। এতো বড় এক পদ পাওয়ার আনন্দে রাজা চাইলেন পৌরণিক যুগের মতো এক মহাযজ্ঞ করতে। রাজার পুরোহিত বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্য বংশের রমেশ শাস্ত্রী জানালেন, বিশ্বজিৎ, রাজসূর্য, অশ্বমেধ ও গোমেধ- এই চার রকমের যজ্ঞ করার নিয়ম আছে। কিন্তু রাজার জন্য এই চার যজ্ঞের কোনোটাই করা সম্ভব নয়। যজ্ঞের বদলে তাই দুর্গাপূজা করার পরামর্শ দিলেন রাজপুরোহিত। রাজা খুশি মনে দুর্গাপূজার আয়োজন করলেন। সেইসময় এই পূজার জন্য খরচ হয়েছিল আট থেকে নয় লক্ষ টাকা। বর্তমানে যে পারিবারিক কাঠামো সমেত পূজিত হন দেবী, তার সূচনা হয় তখন থেকেই। 

রাজা কংসনারায়ণের সভাপণ্ডিত ছিলেন কৃত্তিবাস পণ্ডিত। তিনি ছিলেন নদীয়ার ব্রাহ্মণ। রাজার অনুরোধে ১৪৬০ শকাব্দে বাংলায় রামায়ণ রচনা করেন তিনি, যা ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ নামে বাংলার ঘরে ঘরে নতুন এক আলোড়ন সৃষ্টি করে। 

বাংলায় দুর্গাপূজা শুরু হলেও আপামর হিন্দুদের কাছে তখনই এটি বৃহত্তর পূজা হয়ে উঠেনি। উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বিভিন্নজনের আত্মজীবনীতে এ পূজার তেমন একটা বর্ণনাও পাওয়া যায় না। সে হিসেবে বলা যায়, তখনও এটি হিন্দুদের প্রধান উৎসবে পরিণত হতে পারেনি।

ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস টেলর ১৮৩৯ সালে লেখা তাঁর ‘ট্রপোগ্রাফি অব ঢাকা’ বইতে ঢাকার প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে- ‘মহররম’, ‘বেরা’ এবং ‘বৈষ্ণ’ উৎসবের কথা বললেও দুর্গাপূজার ব্যাপারে ছিলেন নিশ্চুপ। ঢাকার বাসিন্দা হৃদয়নাথ মজুমদার উনিশ শতকের সত্তর দশকেও দুর্গাপূজার ব্যাপারে কিছু বলেননি। বরং বলেছেন ‘হোলি’, ‘ঝুলন’, ‘মহররম’-এর মতো ধর্মীয় উৎসবের কথা।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত তাঁর ‘আট দশক’ বইতে লিখেছেন, “ঢাকার মতো বৈষ্ণব প্রধান শহরে সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা নয়। আসল উৎসব ছিল ঝুলন আর জন্মাষ্টমী। শহরে অনেক মন্দির ছিল, সেগুলো ঝুলনের সময়ে উৎসবের সাজে সাজানো হতো।”

তাই বলে যে ঢাকাতে দুর্গাপূজা একদমই হতো না তা কিন্তু নয়। ভবতোষ বাবু আরও লিখেছেন, “বারোয়ারি দুর্গাপূজার প্রচলন তখনও হয়নি অন্তত ঢাকাতে। পূজা দেখতে যেতাম সূত্রাপুরের ঢাকার বাবু নন্দলালের বাড়িতে যেখানে দোতালা প্রমাণ বড় প্রতিমা হতো। সবচেয়ে বেশি যেতাম টিকাটুলি ছাড়িয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের পূজোয়। আমরা সবাই মিলে কাজ করতাম। ভিড় সামলানো থেকে দর্শনার্থীদের জুতোর খবরদারি করা পর্যন্ত। সন্ন্যাসীরা কীর্তন করতেন: আমরাও তাতে যোগ দিতাম।”

পরবর্তীতে দেখা যায়, দুর্গাপূজা উপলক্ষে খবরের কাগজগুলো পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যেতো। ১৯০২ সালে ঢাকার প্রভাবশালী বাংলা পত্রিকা ‘ঢাকা প্রকাশ’ থেকে জানা যায়, ‘শারদীয় পূজা উপলক্ষে আগামী সপ্তাহ হইতে চার সপ্তাহের নিমিত্ত ঢাকা প্রকাশ বন্ধ থাকিবে। গ্রাহক, অনুগ্রাহক এবং পৃষ্ঠপোষকবর্গের যথাযোগ্য অভিবাদন ও সাদর সম্ভাষণ করিয়া আমরা অবকাশ গ্রহণ করিতেছি। মা সর্ব্বমঙ্গলী সকলের মঙ্গল বিধান করুন।’ বোঝা যায়, বিস্তৃত হচ্ছে দুর্গাপূজার আয়ো্জন। তবে, তখনও এসব পূজার অধিকাংশই ছিল পারিবারিক।

সার্বজনীন পূজা ব্যাপক আকারে শুরু হয় ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর। দেশ ভাগের পর এককভাবে পূজা করাটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। এর ফলে ব্রাক্ষণ-অব্রাক্ষণ নির্বিশেষে মিলেমিশে পূজা করার চল শুরু হয়। তবে এখনো পারিবারিক পূজার চল রয়ে গেছে পুরানো ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। ‘৭১ এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শুরু হয় দেশের কেন্দ্রীয় দুর্গা পূজা। 

বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে উপমহাদেশের একমাত্র রক্তবর্ণের প্রতিমায় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো এই পূজা। আয়োজকরা জানান, তাদের পূর্বপুরুষ সর্বানন্দ দাস আসামের শিবসাগরে মুন্সিপদে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন সাধক পুরুষ। একবার কামরূপ-কামাক্ষ্যায় পূজার জন্য পাঁচ বছরের একটি মেয়ে চাইলে স্থানীয়রা তাকে একটি মেয়ে দেন। মহাষ্টমীর দিনে কুমারী পূজা শেষে সর্বানন্দ দাস দেখেন, কুমারীর গায়ের রং পরিবর্তন হয়ে লালবর্ণ ধারণ করেছে। এই দৃশ্য দেখে তিনি কুমারীরূপী দেবীকে জিজ্ঞাসা করেন, মা আমার পূজা সুসম্পন্ন হয়েছে কি? উত্তরে ভগবতী বলেন, হ্যাঁ, তোর পূজা সিদ্ধ হয়েছে। এখন থেকে ভগবতীকে লাল বর্ণে পূজা করবি। পরবর্তী বছর সর্বানন্দ দাস তার নিজ বাড়ি মৌলভীবাজারের পাঁচগাঁওয়ে রক্তবর্ণের প্রতিমায় শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। আজো সেই ঐতিহ্য বজায় রয়েছে। ব্যতিক্রমী এই দুর্গা প্রতিমা দেখতে পূজার ক’দিন মানুষের ঢল নামে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলটিতে।

২০১০ সাল থেকে বাগেরহাট সদরের হাকিমপুর গ্রামের শিকদার বাড়িতে ব্যক্তিউদ্যোগে দেশের বৃহত্তম দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। প্রতিমার সংখ্যার দিক দিয়ে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পূজামণ্ডপ বলে দাবি করেন পূজার আয়োজক ডা. দুলাল শিকদার ও তার ছেলে লিটন শিকদার। প্রতিবছর এখানকার প্রতিমা সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ বছর (২০১৯) এই মণ্ডপে ৮০১টি প্রতিমা নির্মাণ করা হয়েছে। 

দুর্গাপূজার আনন্দ দ্বিগুণ হয় তা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে দুর্গাপূজা সূচনালগ্ন থেকেই সকল ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির মিলনমেলা হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। শারদীয় এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে মানুষের মধ্যে এক সৌহার্দ্যের বাতাবরণ সৃষ্টিতে অসামান্য অবদান রেখে আসছে। এভাবেই দুর্গাপূজা বাঙালির অন্যতম একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
1

ওবাড়ির চিঠি - শতরূপা দত্ত

Posted in

ওবাড়ির চিঠি


পিতার ভবনে, অমৃতসদনে ইতিহাসের অশ্রুবিন্দু
শতরূপা দত্ত


বাঙালীর অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে একটি ঐতিহাসিক বাড়ির সঙ্গে। জড়িয়ে আছে হাজারো সংগ্রামের ইতিহাস। একটি জাতির মুক্তির ইতিহাস – একটি দেশের জন্মের ইতিহাস। ’৬০ এর দশক থেকে সেই ছোট্ট বাড়িটি সাহস, দৃঢ়তা আর বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে আছে বাংলার মানুষের কাছে। ধানমন্ডি লেকের ধারে ৩২ নম্বর সড়কে ৬৭৭ নম্বরধারী সেই বাড়িটি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুকে জানতে হলে দেশের সব নাগরিককে একবারের জন্য হলেও এই ‘অমৃতসদনে’ আসতে হবে।

১৯৬২ সালের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বাংলার মুক্তিসনদ ’৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী ’৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ’৭১ সালের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বঙ্গবন্ধু নেতা-কর্মীদের সঙ্গে প্রেরণার বাতিঘর হয়ে মতবিনিময় করেছেন এই বাড়িতে বসেই। ৭ই মার্চের সেই কালজয়ী ভাষণের রূপরেখাও তিনি সাজিয়ে নিয়েছিলেন এ বাড়ির কনফারেন্স টেবিলে বসে। ২৩ মার্চ ১৯৭১-এ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনটিতেই বিক্ষুব্ধ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয় এখানেই, যা সাথে সাথেই ছড়িয়ে যায় সারা বাংলায়। স্বাধীনতা পরবর্তী দিনগুলোতে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবেও এ বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু তার রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। ৩২ নম্বরের এই বাড়িটিতে তখনও দেশের সাধারণ মানুষের জন্য ছিলো অবারিত দ্বার। আবার, এ বাড়িতেই নেমে আসে শোকাবহ রাত ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ এর সেই রাতে সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাড়িটির প্রেরণাদায়ক ঐতিহ্যের কথা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে পরবর্তীকালে এ বাড়ির নম্বরও পরিবর্তন করে দেয়া হয়। এই কু-উদ্দেশ্যেই একে বলা হতো, ধানমন্ডি ১১ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়ি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলা যে এত সহজ নয়, তা জানতো না খুনীরা। তাই, আজো ৩২ নম্বর বলতে মানুষ বঙ্গবন্ধুর বাড়িকেই বোঝে।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কৃষি ও বনমন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু। তবে, সে সরকার বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। অতঃপর ১৯৫৬ সালের কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। তবে, তখনও ঢাকায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের মাথা গোঁজার নিজস্ব কোনো ঠাঁই ছিল না। তিনি সপরিবারে থাকতেন ঢাকার আবদুল গণি রোডের ১৫ নম্বর বাড়িতে। এসময় পিডব্লিউডি থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছিল। একদিন বঙ্গবন্ধুর পিএস নুরুজ্জামান পিডব্লিউডি থেকে একটি আবেদনপত্র এনে দেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে। সেটি জমা দেয়া হলে ১৯৫৭ সালে বেগম মুজিবের নামে ছয় হাজার টাকা মূল্যের এক বিঘার একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রথমে দুই হাজার টাকা এবং পরে কিস্তিতে বাকি চার হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। ওই বছরই শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নিবেদিত প্রাণ শেখ মুজিব দলকে সময় দেবেন বলে ছেড়ে দেন মন্ত্রিত্ব।

১৯৫৮ সালে টি বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় সেগুনবাগিচায় একটি বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর নামে। সে বছরই আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করলে গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। ১২ই অক্টোবর সেগুনবাগিচার বাড়িটি তিন দিনের মধ্যে ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে। সন্তানদের নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুল মাঠের পাশে মাসিক ২০০ টাকা ভাড়ায় একটি বাড়িতে এসে ওঠেন বেগম মুজিব। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শেখ মুজিবের পরিবার যে এই বাড়িতে থাকেন, তা জানাজানি হয়ে গেলে বাড়ির মালিক বেগম মুজিবকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেন। সন্তানদের নিয়ে আবার তিনি এসে ওঠেন সেগুনবাগিচার একটি বাসার দোতলায়। পরবর্তী ২ বছর এখানেই তাঁরা ছিলেন। ১৯৬০ সালের ১লা অক্টোবর বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্তি পান। চাকরি নেন আলফা ইন্শিওরেন্স কোম্পানির কন্ট্রোলার অব এজেন্সিস পদে। বেতন ৩ হাজার টাকা। বেতনের সেই টাকার উপর নির্ভর করে পিডব্লিউডির বরাদ্দ দেয়া সেই প্লটে ১৯৬১ সালে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হয়।

বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধারকর্জ করে, বন্ধুবান্ধবদের সহায়তায় এবং হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে ঢাকার বুকে ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব ঠিকানা। নির্মাণ কাজ তদারকি করেছিলেন তৎকালীন পিডব্লিউডির নির্বাহী প্রকৌশলী ও পরবর্তীকালে পূর্তসচিব মাইনুল ইসলাম। নির্মাণ কাজে নানাভাবে আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও দপ্তরিক সহকর্মীরা। সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহকর্মী চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের নূরুল ইসলাম। আলফা ইন্শিওরেন্স কোম্পানির একজন কর্মকর্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক এবং পারিবারিক সম্পর্ক। নূরুল ইসলাম ‘ক্রস ওয়ার্ড’ লটারী খেলতেন। একদিন লটারীতে ব্যবহার করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোটকন্যা শেখ রেহানার নাম। সেইদিনই তিনি পেয়ে যান ছয় হাজার টাকা। সেই টাকা তিনি গচ্ছিত রাখেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে। বাড়ির নির্মাণ কাজে টাকার সংকট দেখা দিলে নূরুল ইসলাম এই গচ্ছিত টাকা কাজে লাগানোর অনুরোধ করেন। সেই টাকা ঋণ হিসাবে গ্রহণ করে পরবর্তীতে তা পরিশোধও করেন বঙ্গবন্ধু। বাড়ির জানালার গ্রিল সরবরাহ করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা রংপুরের মতিউর রহমান। বাড়ি নির্মাণকালে কেয়ারটেকার ছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার আরজ আলী।

কোনোমতে নির্মাণকাজ শেষ করে ১৯৬১ সালের ১লা অক্টোবর সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতে উঠে আসেন। বাড়িতে ঢুকতেই ছিল একটি ছোট রুম, যা ড্রয়িংরুম হিসাবে ব্যবহার করা হতো। আসবাব বলতে ছিল একসেট বেতের সোফা মাত্র। একতলা বাড়িটিতে তখন ছিল দুটি বেডরুম। যার একটিতে থাকতেন বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব। অন্যটিতে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তার পাশের কক্ষটি রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। রান্নাঘরের এক পাশে থাকতেন শেখ কামাল ও শেখ জামাল।

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ৩২ নম্বরের এ বাড়িটিকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে দোতলার কাজ শেষ হয়। ১৯৯৪ সালে লেখা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরেছেন ৩২ নম্বরের বাড়িতে তাঁদের বসবাসের দিনগুলির কথা :

‘১৯৬১ সালে এই বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কোনোমতে তিনটা কামরা করে এতে আমরা উঠি। এরপর মা একটা একটা কামরা বাড়াতে থাকেন। এভাবে ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে দোতলা শেষ হয়। আমরা দোতলায় উঠে যাই। ছয় দফা দেবার পর কাজকর্ম বেড়ে যায়। নিচতলাটা তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই ব্যতিব্যস্ত। নিচে আব্বার শোবার কামরাটা লাইব্রেরি করা হয়।’

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যে টেলিফোনটি প্রথম সংযোগ দেয়া হয় সেটির নম্বর ছিল ২৫৬১। এই টেলিফোন নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। আইয়ুব খানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রায়ই এ টেলিফোনটিতে আড়ি পাততো। তাই, শেখ ফজলুল হক মনি বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলতে চাইলে নিজের নাম গোপন করে ‘বালিওয়ালা’বলে নিজের পরিচয় দিতেন। আর সিরাজুল আলম খান নিজের পরিচয় দিতেন ‘ইটাওয়ালা’ বলে।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালির স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাসও, আছে হারানোর বেদনা। স্বাধীন দেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট রাতের অন্ধকারে একদল বিশ্বাসঘাতক বিপথগামী সেনা অফিসারের হাতে ৩২ নম্বরের বাড়িতেই সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন নরপিশাচরা রাতের অন্ধকারে হামলা চালায় স্বাধীনতার স্থপতির বাসভবনে। পৈশাচিক উল্লাসে বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুর নির্মমভাবে হত্যা করে তারা।

সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ তিনটি বাড়িতে সংঘটিত খুনীদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বীভৎসতার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ পিএসসি :

‘কী বীভৎসতা! রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল বাড়িটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাঁচ, মেঝে ও ছাদে। রীতিমতো রক্তগঙ্গা বয়ে যায় বাড়িটিতে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর হয়ে পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। নিথর দেহের পাশেই পড়েছিলো তাঁর ভাঙ্গা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল। টেলিফোন অপারেটর। মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব। বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল। নিচ তলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের। এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবীর ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের লাশ।’

সেদিন আরো হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর ছেলে আরিফ, কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, সেরনিয়াবাতের বাসায় থাকা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে।

এরপর বাড়িটি সিল করে দেয় তৎকালীন সরকার। হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। পরে, তাঁরা ভারত সরকারের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে ভারতে চলে আসেন। নির্বাসিত অবস্থায় দিল্লীতে বসবাস করতে থাকেন শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশে ফিরে এলে বাড়িটি ফিরে পান তিনি।

এর বছর খানেক পর শেখ হাসিনা সংবাদপত্রে একটি নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেখতে পান। হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশনের সেই বিজ্ঞপ্তির তালিকায় ৩২ নম্বরের বাড়িটিও ছিল। বাড়ি নির্মাণে পাকিস্তান আমলে ঋণ হিসেবে নেয়া ১২ হাজার টাকা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ও পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ক্ষমতায় থেকেও এই অতি সাধারণ বাড়িটির কোন ‘উন্নয়নও’ করার চেষ্টা করেননি তিনি। ঋণ বকেয়া থাকায় নিলামে ওঠে বাড়িটি। ১২ হাজার টাকা বকেয়া পরিশোধের পর বাড়িটির দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয় শেখ হাসিনাকে। জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য বাড়িটি বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেন তিনি।

১৯৯৪ সালের ১৪ই আগস্ট উদ্বোধন করা হয় জাদুঘরটি। নাম দেয়া হয়- ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর।’‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন:

‘মিউজিয়াম করতে গেলে অনেক পরিবর্তন করতে হয়। সে পরিবর্তন কমিটি করাচ্ছে। আমি প্রায়ই যাই দেখতে। দেয়ালগুলোতে যখন পেরেক ঠোকে, জিনিসপত্রগুলো যখন সরিয়ে ফেলে, বুকে বড় বাজে, কষ্ট হয়, দুঃখ হয়। মনে হয় ঐ পেরেক যেন আমার বুকের মধ্যে ঢুকছে। মাঝে-মাঝেই যাচ্ছি, ঘুরে দেখে আসছি যতই কষ্ট হোক। এই কষ্টের মধ্যে, ব্যথা-বেদনার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। সে আনন্দ হলো, আমরা জনগণকে তাদের প্রিয় নেতার বাড়িটি দান করতে পারছি। জনগণের সম্পত্তি হবে ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি। এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি। আমরা তো চিরদিন থাকবো না কিন্তু এই ঐতিহাসিক বাড়িটি জনগণের সম্পদ হিসেবে সব স্মৃতির ভার নিয়ে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবে।’

জাদুঘরটা সাদামাটা। তিন তলা ভবন মাত্র। নয় কক্ষবিশিষ্ট এ ভবনের আসবাব পত্রও একদমই সাধারণ মানের। ভবনে ঢুকতেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। প্রথম তলায় আরও রয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে নিহত সবার ছবি এবং কিছু আসবাবপত্র। এই ঘরটি আগে ছিল ড্রইং রুম। এই ঘরে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্বরা। এর পাশের ঘরটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের পড়ার ঘর। এখানে তিনি লেখালেখির কাজও করতেন। ১৯৭১ সালে এই ঘর থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠানো হয়েছিলো সারাদেশে।

দোতলায় বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘর। এ ঘরের সামনে করিডর থেকে নিচে যাওয়ার সিঁড়িতেই ঘাতকদের গুলিতে মারা যান জাতির পিতা। এখনো গুলির চিহ্ন সেখানে রয়ে গেছে। আর রয়েছে, শিল্পীর তুলিতে আঁকা বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ অবস্থার একটি প্রতিকৃতি। শোবার ঘরে তাঁর বিছানার পাশেই ছোট টেবিলে সাজানো আছে তাঁর প্রিয় পাইপটি, তামাকের কৌটা। রয়েছে টেলিফোন সেট ও রেডিও। সামনের খাবার ঘরের একপাশে আছে শিশু রাসেলের বাইসাইকেল। আছে খাবার টেবিল, থালা, বাটি। আছে রেকসিনের সোফা। শেখ জামালের কক্ষে দেখা যায় তাঁর সামরিক পোশাক। বাড়ির তৃতীয় তলায় শেখ কামালের কক্ষে তাঁর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সাজিয়ে রাখা আছে। এছাড়াও রয়েছে পুত্রবধূ সুলতানা কামালের বৌভাতের সবুজ বেনারসি শাড়ি, রোজী জামালের লাল ঢাকাই জামদানি, বিয়ের জুতা, ভাঙা কাচের চুড়ি, চুলের কাঁটা, রাসেলের রক্তমাখা জামা, বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা সাদা পাঞ্জাবি, তোয়ালে, লুঙ্গি, ডায়েরি।

বাড়ির দেয়াল, দরজা, ছাদসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘাতকের বুলেটের চিহ্ন ১৫ই আগস্টের সেই অমানবিক বীভৎসতার কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি যাদের ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে সম্বোধন করতেন, এদেশের সেই সমস্ত ভাইদের মধ্যকার একদল বিশ্বাসঘাতকের অপকীর্তির ইতিহাসের এই দেয়াললিখন যুগ যুগ ধরে নিন্দিত হতে থাকবে।

মূল বাড়ির পেছনে রয়েছে জাদুঘরের সম্প্রসারিত নতুন ভবন। বঙ্গবন্ধুর বাবা-মায়ের নামে এ ভবনের নাম দেয়া হয়েছে ‘শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুন’ গ্যালারি। ২০১১ সালের ২০শে আগস্ট এ অংশটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়। ছয় তলা এ ভবনের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র রয়েছে। পঞ্চম তলায় রয়েছে পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র।

বঙ্গবন্ধু ভবনের গেটের উল্টোদিকে একটি স্মৃতিস্তম্ভে খোদাই করে কীর্তিত হয়েছে সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা একটি অবিস্মরণীয় কবিতার বিশেষ অংশ, যেটা আসলে কবির উপলব্ধির চিরন্তন সত্যকেই ধারণ করে আছে। এই কবিতায় লেখা কথাগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রতিটি বাঙালির মনের কথা, যা সর্বদা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরে অন্তরে :

‘যতকাল রবে পদ্মা, মেঘনা
গৌরী, যমুনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান’
0

ওবাড়ির চিঠি - শতরূপা দত্ত

Posted in

ওবাড়ির চিঠি


ভয়ের সংস্কৃতি থেকে গুজব-গণপিটুনি
শতরূপা দত্ত



কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ‘পদ্মাসেতুতে মানুষের মাথা লাগবে’ এমন একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে মানুষের মধ্যে ‘ছেলেধরা’ আতঙ্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মহামারীর মতো এই আতঙ্ক এমনভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে যে, প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও, এমনকি একাধিক স্থান থেকে গণপিটুনির খবর পাওয়া গেছে।

সাধারণভাবে বাংলাদেশে স্থাপিত বড় যেকোন স্থাপনার ক্ষেত্রেই এমন গুজব ছড়ায়। আর সেতু হলে তো কথাই নেই। দেশের অনেক মানুষই ছোটবেলায় বহুবার এধরনের গুজব শুনেছেন বলে মনে করতে পারবেন। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মাসেতু হতে যাচ্ছে ইতিহাসের একটি বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। পদ্মাসেতুবিরোধী চক্র এই সুযোগ কাজে লাগাবে তাতে সন্দেহ কি? 

সরকারে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, গণমাধ্যম কর্মী ও সচেতন নাগরিকরা মনে করেন, যারা পদ্মাসেতুতে মাথা লাগার গল্পটি ছড়িয়েছে, তাদের হীন উদ্দেশ্য আছে। তারা এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন চায় না। নানাভাবে ঠেকাতে না পেরে এখন এই কুসংস্কার ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করছে তারা।

‘উত্তেজিত জনতা’র আচরণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, জনতার ভিড়ে ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার বিলুপ্তি ঘটে এবং প্রতিজন ব্যক্তি মিলে উত্তেজিত জনতার সমষ্টি তৈরি হয়। জনতার 'সম্মিলিত মন' তখন বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নেয় (সমাজ-মনোবিজ্ঞানী গুস্তাভ লে বোঁ)।সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ছেলেধরা সন্দেহে একদল মানুষ যখন কাউকে মারতে শুরু করে, তখন তাদের সবার মধ্য থেকে একযোগে বিবেকবোধ লোপ পায়। অথচ সাধারণ অবস্থায় দেখা যায়, তারাও নিরীহ মানুষ, তাদেরও বিবেকবোধ আছে। কিন্তু ঘটনার সময় সে মনে করে, সত্যিই সে একটা ‘ভালো কাজ’ করছে, সে ‘ন্যায়বিচারে’ অংশ নিচ্ছে। এই কাজকে তখন সে ‘বেআইনী’ বলেও মনে করে না। এই উত্তেজিত জনতা একবারও ভাবে না যাকে হত্যা করছে, সে আদৌ অপরাধী কিনা।

গণপিটুনির ক্ষেত্রে ক্ষোভ-রোষ-হিংসা কাজ করে, কাজ করে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনাস্থা। কোনো ঘটনা সম্পর্কে কিছুই না জেনেও মানুষ গণপিটুনিতে যোগ দেয়। বাংলাদেশে বর্তমানে একটি বিশেষ ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে। আর এই ভয়ই প্রতিদিন নৃশংস গণপিটুনির ঘটনার জন্ম দিয়েছে। 


এর আগেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে সাধারণ মানুষের মনে ভয়-আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে, সৃষ্টি হয়েছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থাগুলোর প্রতি আস্থাহীনতা। আর সেই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ায় প্রকৃত অপরাধীর পাশাপাশি নিরপরাধ মানুষকেও গণপিটুনির শিকার হতে হয়েছে। 

‘ছেলেধরা’ আতঙ্কে গণপিটুনির ঘটনায় আজ পর্যন্ত কেউ কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বলতে পারেনি, সন্দেহ করে যাকে মেরে ফেলা হলো সত্যিই সে ছেলেধরা ছিল কি-না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সে আসলে ছেলেধরা ছিল না। সম্প্রতি ঢাকায় গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যাওয়া তাসলিমা বেগম রেনুর সাথে সেটাই ঘটেছিল। 

রেণু ২০ জুলাই শনিবার সকালে উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যান বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে। রেণু স্কুলের ভেতরে যেতে চাইলে কয়েকজন অভিভাবক তাকে স্কুলের ভেতরে যাবার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করানোর কথা বলায় অভিভাবকরা তাকে ছেলেধরা হিসেবে সন্দেহ করে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহানাজ বেগমের কক্ষে নিয়ে যান। 

ওই প্রধান শিক্ষক পরে সংবাদ মাধ্যমে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, ‘দুইজন অভিভাবক তাসলিমাকে আমার কাছে নিয়ে আসেন। এরমধ্যে বাইরে প্রপাগান্ডা শুরু হয়ে যায়, স্কুলে ছেলেধরা ঢুকেছে। মুহূর্তের মধ্যে স্কুলের ভেতরে মানুষ আসতে শুরু করে। সে সময় আমাদের নিচের গেট বন্ধ ছিল। লোকজন ওই গেটের তালা ভেঙে স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করে আমার কক্ষ থেকে তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায়। এখানে স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, স্থানীয় উৎসুক জনতা এবং বহিরাগতরা ছিল। তখন কে অভিভাবক আর কে বহিরাগত, সেটি বোঝাই বড় মুশকিলের বিষয় ছিল।’

এই হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া উত্তেজনার পাশাপাশি ঘটেছে টার্গেট করে গণপিটুনি দেয়ার ঘটনাও। পূর্বশত্রুতার জের ধরে বাজারে বা লোক সমাগম আছে এমন জায়গায় ‘ছেলেধরা’ বলে গুজব রটিয়ে কোনো মানুষকে গণপিটুনিতে মেরে ফেলার সুযোগও নিয়েছে কেউ কেউ। যেমনটা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের সিরাজের ক্ষেত্রে। 

ছোট্ট মেয়েকে দেখতে গিয়ে ছেলেধরা হিসেবে গণপিটুনির শিকার হতে হয়েছে বাকপ্রতিবন্দী সিরাজকে। মেয়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া স্ত্রী ও তার দ্বিতীয় স্বামী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার, মাছ ধরা নিয়ে বিরোধের জেরে নওগাঁর মান্দায় ৬ জেলেকে ‘ছেলেধরা’ আখ্যা দিয়ে গণপিটুনি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পরে পুলিশ ওই ৬ জেলেকে উদ্ধার করে। 

আসলে, এভাবে গণপিটুনি দিয়ে কাউকে হত্যা করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করা সহজ, কারণ এসব ক্ষেত্রে সেই হত্যার দায় কারো একার কাঁধে পড়ে না। মামলা হলেও প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিত ও প্রমাণিত করার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়। দীর্ঘসূত্রিতার জালে পড়ে বিচার ব্যাহত হয়। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রাজীব নন্দী জানিয়েছেন, বাংলাদেশ-ভারতে গত ১০ বছরে চাঞ্চল্যকর ২০টি গণপিটুনির কোনো বিচার হয়নি এবং সঠিক তদন্তও হয়নি। 

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ছয় মাসেই বাংলাদেশে গণপিটুনিতে মারা গেছেন ৩৬ জন। ২৩ জুলাই আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, ১ মাস ৭ দিনের মধ্যে ১১টা গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। 

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা নিনা গোস্বামী জানিয়েছেন, বিভিন্ন কারণে গণপিটুনির ঘটনা ঘটে থাকলেও সম্প্রতি গুজবের কারণে গণপিটুনির ঘটনা বেড়েছে। 

গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গণপিটুনির শিকার থেকে বাদ পড়ছে না মানসিক প্রতিবন্দী, ভিক্ষুক, সেলসম্যান থেকে শুরু করে কোনো কাজে হঠাৎ কোনো এলাকায় গিয়ে পড়া নিরপরাধ সাধারণ মানুষও।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এই আধুনিক সময়ে এসেও মানুষ কেন কোনো স্থাপনা নির্মাণে মানুষের মাথা লাগা বা নরবলি দেয়ার মতো কুসংস্কারগুলোতে বিশ্বাস করে? 

বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক সুস্মিতা চক্রবর্তী জানিয়েছেন, নানা কিংবদন্তীমূলক কাহিনী, আবহমান কাল ধরে চলে আসা জনশ্রুতি এবং স্থানীয় সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন গল্পের ওপর বিশ্বাস করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে প্রবল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে যেসব গল্প শুনে আসে, কোনো ধরনের যাচাই ছাড়া সেগুলো বিশ্বাস করার প্রবণতার কারণেই এই প্রযুক্তির যুগেও সেসব গল্প সত্যি বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।

এছাড়াও মনে রাখা দরকার, ঐতিহাসিকভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশে নরবলি দেয়ার ইতিহাস রয়েছে। এ দেশের মানুষের গল্পগাথায়, অবচেতনে সে স্মৃতি ফিরে আসে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে নানা সময়ে সৃষ্টি হওয়া গুজব। 

প্রযুক্তির উন্নয়ন, ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহজলভ্যতার কারণে যেকোনো গুজব ছড়িয়ে পড়া এবং সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা আজকালকার দিনে অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে। ‘পদ্মাসেতুতে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে যে গুজবটি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, ইউটিউবে সেটা নিয়ে অনেক ভিডিও দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে ব্রীজের গোড়ায় কাটা মাথা এডিট করে রেখে দেয়া হয়েছে, এডিটিংয়ের সাহায্যে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে মাথা কেটে নিয়ে নদীতে ফেলা হচ্ছে। কারো সাধ্য নেই এ ভিডিওতে অবিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির অপব্যবহার গুজব ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করছে।

এর পাশাপাশি অনেকে মনে করছেন গুজব ছড়িয়ে পড়া রোধে সেতু কর্তৃপক্ষের বিশেষ ভূমিকা রাখা উচিৎ ছিল। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করেছেন, ২০১৫ সালের ১ মার্চ একটি খবর দেশের সমস্ত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে জানানো হয়েছিল, নদীতে পশুর রক্ত ঢেলে পদ্মাসেতুর ভিত্তি স্থাপন কাজের উদ্বোধন করেছে দায়িত্ব পাওয়া চাইনিজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। চাইনিজদের বিশ্বাস, বড় কাজের শুরুতে পশু উৎসর্গের মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, এড়ানো যায় বড় দুর্ঘটনা। এখন পদ্মাসেতুতে মাথা ও রক্ত লাগার গুজব ছড়ানোর সময় এই খবরকে ব্যবহার করছে গুজব সৃষ্টিকারীরা। সে সময়ই যদি সেতু কর্তৃপক্ষ এ ধরনের কোনো প্রথা পালনকে নিরুৎসাহিত করতো, নিদেনপক্ষে এই ধরনের রিচুয়্যাল পালনে খবর গণমাধ্যমে আসতে না দিতো, তবে হয়তো এ ধরনের গুজব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়াটা রোধ করা যেতো। 

মনোরোগবিদরা গণপিটুনির মানসিক প্রবণতাকে "মব সাইকোলজি" হিসেবে উল্লেখ করেন। তারা বলেন, যখন একটি সমাজে নির্দিষ্ট কোন বিষয় নিয়ে আতঙ্ক বা নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয় তখন জনসাধারণ এক ধরণের মানসিক অবসাদে ভোগে। সেটা থেকেই মানুষের মধ্যে এ ধরনের সহিংসতা দেখা দেয়।

‘মব লিঞ্চিং’-এর আভিধানিক অর্থ গণপ্রহার, প্রচলিত অর্থে গণপিটুনি। কিন্তু লিঞ্চিং মানে শুধু মারধোর বোঝায় না; উত্তেজিত একদল মানুষ একত্রে কোনো একক ব্যক্তিকে বা একটি দলকে পেটানো, কোপানো, পোড়ানো বোঝায়। যা গণপিটুনির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য- পেটানো, কোপানো, চোখ উপড়ে ফেলা, গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া।

গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর তা রোধে কি করা যেতে পারে তা নিয়ে সঠিক কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। সম্প্রতি সেতু কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মানুষকে সচেতন থাকতে বলেছে। 

জনগণের কাছে তথ্যপ্রবাহকে যতটা অবারিত করা হবে, ততই এধরনের গুজব তৈরি হওয়া এবং ছড়িয়ে পড়া কমবে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। এক্ষেত্রে মানুষের মনে স্বচ্ছতার অনুভূতি আনতে ব্রিজ নির্মাণের খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে, নির্মাণ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালকের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে বিস্তারিত জানানো যেতে পারে।

সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, গণপিটুনি ঠেকানোর একমাত্র পথ হচ্ছে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেওয়া থেকে বিরত থাকতে, গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে, কাউকে সন্দেহ হলে তাকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিতে এবং কোথাও গণপিটুনির ঘটনা ঘটলে তা রোধে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করতে প্রচারণা চালাচ্ছে সরকার। এর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছেলেধরা সংক্রান্ত বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট, যেকোনো ধরনের গুজব ছড়ানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নিচ্ছে বাংলাদেশ।
0

ওবাড়ির চিঠি - শতরূপা দত্ত

Posted in

ওবাড়ির চিঠি

অ্যান্টিবায়োটিক - বন্ধু যখন হননকারী
শতরূপা দত্ত


সম্প্রতি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশের হাইকোর্ট। গত ২৪ এপ্রিল এ নিষেধাজ্ঞা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। পরদিন সেই রিট আবেদনের শুনানিতে এ ধরনের ওষুধ বিক্রি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হতে দেওয়াকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না সরকারের কাছে জবাব চেয়ে রুল জারি করা হয়।

অ্যান্টিবায়োটিক একটি জীবনরক্ষাকারী ওষুধ। কিন্তু আমাদেরই ভুলে বর্তমানে এটি হয়ে উঠেছে এক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউ-তে মারা যাওয়া রোগীদের ৮০ শতাংশের মৃত্যুর সঙ্গে ব্যাক্টেরিয়া প্রতিরোধী সুপারবাগের সম্পর্ক থাকতে পারে। বলা হচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

আজকের ভয়াবহ ছবিটি দেখার আগে একটু পেছনে তাকানো যাক। পেনিসিলিন একটি অ্যান্টিবায়োটিক। পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। ১৯২৮ সালে লন্ডনে। ১৯৪২ সালে প্রথম পেনিসিলিন মানুষের দেহে প্রয়োগ করা হয়। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের ক্ষত সারাতে পেনিসিলিনের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়। ব্রিটেন, আমেরিকার বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফ্লেমিং-এর সেই ‘যাদু ঔষধ’ তৈরি হতে থাকে, যা অসংখ্য জীবন বাঁচায়।

স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং নাকি বলেছিলেন, “এই অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে আজ কোটি কোটি লোক বেঁচে যাবে। অনেক বছর পর এগুলো আর কাজ করবে না। তুচ্ছ কারণে কোটি কোটি লোক মারা যাবে আবার।”

ফ্লেমিং সত্যিই এ কথা বলেছিলেন কিনা সে প্রমাণ আমার হাতে নেই, তবে আজ কিন্তু এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে বেশ কিছু কেস-স্টাডিতে দেখা গেছে, ‘অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা’ তৈরি হয়ে যাওয়ার কারণে বহু মানুষের শরীরে আর অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে ব্যাকটেরিয়ার বেঁচে থাকার ও বংশবিস্তার করার ক্ষমতা অর্জনই ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ বা ‘অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা’। আর এইঅ্যান্টিবায়োটিক সহনশীল ব্যাকটেরিয়াগুলোকেই বলা হয় সুপারবাগ। ২০১৬ সালে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সুপারবাগ দিন দিন এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠছে, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতিবছর ১ কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে এটি।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেশ কয়েকজন রোগীর কেস-স্টাডি উঠে এসেছে। এসব কেস-স্টাডিতে দেখা গেছে, কোনোঅ্যান্টিবায়োটিকই তাদের শরীরে কাজ করছে না। ফলে দুরারোগ্য রোগ দূরে থাক, সাধারণ অসুস্থতাতেও তাই ওষুধ প্রয়োগ করে ফল পাচ্ছেন না চিকিৎসকরা। চিকিৎসার সমস্ত উপকরণ হাতের কাছে থাকার পরও বলতে গেলে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হচ্ছে তাদের।

ফেসবুকে রাজীব হোসাইন সরকার নামে একজন চিকিৎসক চার বছরের একটি শিশুর কেস-স্টাডি সামনে এনেছেন। শিশুটিকে ঢাকা শিশু হাসপাতাল থেকে দেওয়া ইউরিন কালচার রিপোর্টটি প্রকাশ করে দেখিয়েছেন এর ভয়াবহতা। সেই রিপোর্টটিকে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘পৃথিবী থেকে মানবজাতি বিলুপ্তির সত্যয়িত সনদপত্র’ হিসেবে।

শিশুটির ইউরিন রিপোর্টে দেখা যায়, তাতে ১৮টি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে এবং ১৮টিতেই রেজিস্ট্যান্ট রেজাল্ট পাওয়া গেছে! চিকিৎসকদের হাতে শত শত অ্যান্টিবায়োটিক থাকলেও এই শিশুটির শরীরে কাজ করবে না একটাও। শিশুটি নিশ্চিত মারা যাবে।

আরো একটি ভয়ের কথাও সেই সাথে শুনিয়েছেন রাজীব হোসাইন সরকার, ঐ শিশুটির রিপোর্টের মতো আরো অন্তত ৩০০টি রিপোর্ট আছে তাঁর কাছে। দীর্ঘ এক বছরের চেষ্টায় সেগুলো সংগ্রহ করেছেন তিনি। জানিয়েছেন, সব ধরনের ব্যাকটেরিয়া রেজিস্ট্যান্ট এই ৩০০ রিপোর্ট যাদের, তারা যত ধনীই হোক, দুনিয়ার যে দেশেই চিকিৎসা করাক, যে ঈশ্বরের কাছেই নিজেকে সমর্পণ করুক, তারা আর ফিরবে না। তাদের মৃত্যু অনিবার্য।

সম্প্রতি দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতেও উঠে এসেছে এমনই দুটি কেস-স্টাডি। এগুলো থেকে জানা গেছে, ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউ-তে ভর্তি দুই রোগীর কথা, যাদের শরীরে একটি মাত্র অ্যান্টিবায়োটিককাজ করছে, যেটি আবার কিডনির জন্য ক্ষতিকর। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাঁরা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়েই আইসিইউ-তে এসেছেন। শুধু এ দুজনই নয়, জানা গেছে, আইসিইউ-তে ভর্তি রোগীদের অধিকাংশই কোনো না কোনোঅ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে বাজারে প্রচলিত ২০-২৫ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। আইসিইউ-র অধিকাংশ রোগীরই ২০টার মধ্যে অন্তত ১৮টা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। আর কিছু রোগী আছেন, যাঁদের সব অ্যান্টিবায়োটিকেই রেজিস্ট্যান্স।

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বেড়ে যাওয়াকে এর জন্য প্রধানত দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। কোন রোগের জন্য কোন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক কোন মেয়াদে দিতে হবে তা না জেনেই ফার্মেসির দোকানদার, পল্লী চিকিৎসক থেকে শুরু করে পাশের বাসার ভাই-ভাবী, বন্ধু-সহকর্মী, পাড়ার পরিচিত সবাই অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে। জানা গেছে, দেশের প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার ফার্মেসিতে ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয়। এছাড়া চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে যে অ্যান্টিবায়োটিকলিখছেন, রোগীরা পূর্ণমেয়াদে তা শেষ করছে না। বেশি দামের কারণে রোগীরা কিছুটা সুস্থ হলেই অ্যান্টিবায়োটিকের মেয়াদ শেষ না করেই ওষুধ বন্ধ করে দেন। ফলে তাঁদের শরীরে যে জীবাণু থাকছে, তা ওই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স তৈরি করছে। জানা যাচ্ছে, দেশে গড়ে প্রতিদিন সাত লাখ মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক খায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলোজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান দ্য টেলিগ্রাফকে বলেছেন, গত বছর প্রায় ৯০০ রোগী তাঁদের আইসিইউ-তে ভর্তি হয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে প্রায় ৪০০ জন মারা গেছেন, যার ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে রোগী যে ব্যাক্টেরিয়া বা ছত্রাক দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে, তা অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি সংবেদনশীল নয়।

সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাওয়া ব্যাকটেরিয়াগুলো শুধু আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরেইথাকে না। তারা বংশবৃদ্ধি করে, তাদের ছানা-পোনারাও রেজিস্ট্যান্ট হয়েই জন্ম নেয়। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশির মাধ্যমে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়াগুলো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একদম সুস্থ, কোনোদিনও একটাও অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়া একজন মানুষও এধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে এসে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যান। অর্থাৎ, ধরে নেয়া যায় আক্রান্ত মানুষটির সাথে সাথেই তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে পড়েন। এ সমস্যায় আক্রান্ত নারীর গর্ভজাত শিশু জন্ম থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে পৃথিবীতে আসবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগের প্রধান আহমেদ আবু সালেহ বিবিসি বাংলাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, সত্যি কথা হলো, ভবিষ্যতে ব্যবহার করার মতো কার্যকর কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আর তাঁদের হাতে নেই। বর্তমানে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এ কারণে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।

তবে শুধু কারণে-অকারণে অ্যান্টিবায়োটিক খেলে বা মেডিসিনের কোর্স শেষ না করলেই যে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সতৈরি হয়, তা কিন্তু নয়। আরো বেশি ভয়ের কথা হলো, মানুষের রোগ নিরাময়ের জন্য যে অ্যান্টিবায়োটিক বানানো হয়েছিল, অতিরিক্ত লাভের আশায় সেগুলো এখন পশুপাখিদের দ্রুত বর্ধনশীল করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

চট্টগ্রামে করা এক গবেষণায় উঠে এসেছে, শহরের অর্ধেকেরও বেশি পোলট্রি-মুরগির শরীরে এসব অ্যান্টিবায়োটিকঢোকানো হচ্ছে। শুধু চট্টগ্রাম নয়, এ চিত্র গোটা দেশেরই। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের উদ্যোগে ২০১৮ সালেঅ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও এর কার্যকারিতা নিয়ে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে মৎস্য খামারে ১০ ধরনের ও ৫০ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক ও গ্রোথ এজেন্ট ব্যবহার করা হয়। গরুর দুধের নমুনায় টেট্রাসাইক্লিন, সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, সিপ্রোসিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে সরকারের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাতেই। মাছ ও মাংসেও পাওয়া গেছে একই ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, যার বেশিরভাগই মানুষের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি। এমনকি, বাদ যায়নি কৃষিখাদ্যও।

গবাদি পশু বা হাঁস-মুরগির জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ আসলেই কতটা সহজলভ্য, তার প্রমাণ মেলে রাজধানী ঢাকার বঙ্গবাজারের পাশে প্রাণীর ওষুধের সারি সারি দোকান থেকে ঘুরে এলেই। কোনো প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই এখানে যেকোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক যে কেউ কিনে নিতে পারেন।

এক প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে কোনো ভেটেরিনারি চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া প্রাণিসম্পদের কোনো ওষুধ বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু সে নির্দেশনা মানা হচ্ছে না কোনোখানেই। দেশের বেশিরভাগ খামারি ওই সব ওষুধ সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায় তারা যখন তখন ইচ্ছামাফিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করছে। কিন্তুঅ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ কম হলে যেমন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়, তেমনি গবাদি পশু, মুরগি বা মাছে এর ডোজ বেশি হলে তা তাদের শরীরে থেকে যায়। এগুলোর মাত্রা ঠিক না রাখলে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানবদেহে ঢুকে ক্ষতি ঘটাতে পারে। আগুনের তাপেও এরা প্রভাবিত হয় না। এসব অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের কিডনি নষ্ট করে ফেলতে পারে।

এর পাশাপাশি কৃষিপণ্যে, শস্য ও সবজি চাষের সময় ব্যবহৃত কীটনাশক কোনো না কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকথেকেই তৈরি। সেগুলোও শস্য এবং সবজির মাধ্যমে প্রবেশ করছে মানুষের শরীরে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃষিখাদ্যের মাধ্যমে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করায় রাজধানী ঢাকার ৫৫.৭ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

শুধু সরকারি নিষেধাজ্ঞা নয়, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাওয়া জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়তে হলে তাই আমাদের সকলের সচেতনতা সবার আগে প্রয়োজন। হয়তো এখনো অনেক দেরি হয়ে যায়নি, সবাই মিলে চেষ্টা করলে হয়তো এখনো পৃথিবী থেকে মানব জাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবার মতো একটি হুমকি থেকে আমরা আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে পারবো।
0

ও বাড়ির চিঠি - শতরূপা দত্ত

Posted in

ওবাড়ির চিঠি


বাংলাদেশের ঈদ 
শতরূপা দত্ত 



ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। ‘ঈদ’ আরবি শব্দ। যার অর্থ হলো ফিরে আসা। ঈদ যেহেতু আনন্দের বার্তা নিয়ে মুসলমানের দ্বারে বার বার ফিরে আসে, তাই এ আনন্দকে ঈদ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। 

পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে যেসব প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয়, সেগুলোর মধ্যে ঈদুল ফিতর হচ্ছে সময়ের মাপে কনিষ্ঠতম। এই মহান ও পুণ্যময় উৎসবের উদযাপন শুরু হয় আজ থেকে ১৩৮৮ সৌর বছর আগে থেকে। ইসলামের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মদিনাতে হিজরতের অব্যবহিত পরই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়। এর আগে পৌত্তলিক ভাবনায় অগ্নিপূজকদের নওরোজ এবং মূর্তিবাদীদের মিহিরজান নামে দু’টি উৎসবে মদিনাবাসী শরিক হতো। 

বাংলাদেশে ঈদের দিন দুইটি খুবই জাঁকজমকের সাথে উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়। সবাই এ দিন যার যার সাধ্য অনুযায়ী ভালো পোশাক পরে। ঘরে ঘরে উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও এ আনন্দের অংশীদার হয়। মুসলমানরা এ দিন খুতবাসহ ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। আত্মীয়-স্বজনের সাথে কুশল বিনিময় করেন। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই কোলাকুলিসহ সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময় করে। সমাজের ধনী ও সক্ষম ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট হারে গরিবদের ফিতরা বা শর্তহীন অনুদান বিতরণ করে থাকে, যা ধর্মীয় দিক থেকে ধনীদের জন্য বাধ্যতামূলক। 

বাংলায় এই উৎসবের কীভাবে উদ্ভব হয়েছিল তার ইতিহাস ও তথ্য সঠিকভাবে আজও জানা যায়নি। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান তাঁর ‘বাংলায় ঈদ, বাঙালির ঈদ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বাংলায় ঈদোৎসবের বিশদ ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। আমাদের এই ভূখণ্ডে কবে, কখন, কীভাবে ঈদোৎসবের উদ্ভব হয়েছে তার কালক্রমিক ঘটনাপঞ্জি কোনো ইতিহাসবেত্তা বা ইসলামের ইতিহাস গবেষক এখনো রচনা করেননি। তবে নানা ইতিহাস গ্রন্থ ও ঐতিহাসিক সূত্র থেকে বাংলাদেশে রোজাপালন এবং ঈদ-উল-ফিতর বা ঈদ-উল-আজহা উদযাপনের যে-খবর পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় ১২০৪ খৃস্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে এলেও এদেশে নামাজ, রোজা ও ঈদোৎসবের প্রচলন হয়েছে তার বেশকিছু আগে থেকেই। এতে অবশ্য বিস্মিত হবার কিছু নেই। কারণ, বঙ্গদেশ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মুসলিম অধিকারে আসার বহু আগে থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সুফি, দরবেশ ও সাধকরা ধর্ম-প্রচারের লক্ষ্যে উত্তর ভারত হয়ে পূর্ব-বাংলায় আসেন। অন্যদিকে আরবীয় এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের বণিকেরা চট্টগ্রাম নৌবন্দরের মাধ্যমেও বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এভাবেই একটা মুসলিম সাংস্কৃতিক তথা ধর্মীয় প্রভাব যে পূর্ব-বাংলায় পড়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ঈদোৎসবের সূচনাও ওই প্রক্রিয়াতেই হয়েছে।’ 

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রাখা আব্বাসীয় খলিফাদের আমলের রৌপ্যমুদ্রা থেকে জানা যায়, অষ্টম শতকের দিকেই বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ফলে, এই সুফি, দরবেশ এবং তুর্ক-আরব বণিকদের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশে রোজা, নামাজ ও ঈদের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে সেসময় ঈদ-রোজা ছিল বহিরাগত ধর্মসাধক, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীদের ধর্মীয় কাজ ও উৎসব। এদেশবাসীর ধর্ম ও সামাজিক পার্বণ নয়। 

এ দেশে রোজা পালনের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় তাসকিরাতুল সোলহা নামের গ্রন্থে। এ গ্রন্থে দেখা যায় আরবের জনৈক শেখউল খিদা হিজরি ৩৪১ সন মোতাবেক ৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় আসেন। বঙ্গদেশে ইসলাম আগমন পূর্বকালে শাহ সুলতান রুমি নেত্রকোনা এবং বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুরের রামপালে আস্তানা গেড়ে (সেন আমলে) ইসলাম প্রচার শুরু করেন বলে জানা যায়। শেখউল খিদা চন্দ বংশীয় রাজা শ্রীচন্দের শাসনকালে (৯০৫-৯৫৫ খৃস্টাব্দ) বাংলায় আগমন করেন বলে অনুমান করা হয়। 

তবে এদের প্রভাবেই পূর্ব বাংলায় রোজা, নামাজ ও ঈদ প্রচলিত হয়েছিল, এ কথা বলা যায় না। এঁরা ব্যক্তিগত জীবনে ওইসব ইসলাম ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব পালন করতেন একথা বলাই সঙ্গত। কারণ বাংলাদেশে ‘নামাজ’, ‘রোজা’ বা ‘খোদা হাফেজ’ শব্দের ব্যাপক প্রচলনে বোঝা যায়, আরবীয়রা নয়, ইরানীরাই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। কারণ শব্দগুলি আরবীয় ভাষার নয়, ফার্সি ভাষার। 

ঢাকার ইতিহাসবিদ হাকিম হাবীবুর রহমান বলেছেন , ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহসুজার নির্দেশে তাঁর প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম একটি ঈদগা নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ্য ছিল ২৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১৩৭ ফুট।নির্মাণকালে ঈগদাটি ভূমি থেকে বার ফুট উঁচু করা হয়। ঈদগাহের পশ্চিম দিকে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে সেখানে মেহরাব ও মিনার নির্মাণ করা হয়। মুঘল আমলে দরবার, আদালত, বাজার ও সৈন্য ছাউনির কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল এ ঈদগা। প্রথম দিকে শুধু সুবেদার, নায়েবে নাজিম ও অভিজাত মুঘল কর্মকর্তা এবং তাদের স্বজন-বান্ধবরাই এখানে নামাজ পড়তে পারতেন। পরে ঈদগাটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই ঈদগার পাশে উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে একটি মেলারও আয়োজন করা হয়। এই ঈদগার পাশে একটি সুন্দর সেতুর চিহ্নও রয়েছে। ঈদগাটি এখন সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। 

মুঘল যুগে ঈদের দিন যে হইচই বা আনন্দ হতো তা মুঘল ও বনেদি পরিবারের উচ্চপদস্থ এবং ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধ ছিল। তার সাথে সাধারণ মানুষের ব্যবধান না থাকলেও কিছু দূরত্ব ছিল। তাই ঈদ এ দেশে জাতীয় উৎসবে রূপান্তর হতে সময় নিয়েছে। 

‘সেকালের ঈদ’ প্রবন্ধে শামসুজ্জামান খান লিখেছেন, ‘রাজধানী শহর ঢাকার (১৬০৮) প্রতিষ্ঠার পর এখানে মোগল শাসক, ঢাকার নবাব, অভিজাত ধনিক-বণিক সম্প্রদায় এবং আদি ঢাকাবাসীর বর্ণাঢ্য ঈদ উৎসব উদ্​যাপনের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রামীণ বাংলাদেশে সেকালে ঈদ উৎসব তেমন একটা ছিল না বললেই চলে। কারণ, কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলার মুসলমানরা ছিল দরিদ্র, তাদের হাতে নগদ অর্থ ছিল না। আধুনিক অর্থে সামাজিক চেতনা ও কমিউনিটির বোধেরও তখন জন্ম হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটা সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর অবস্থাও সৃষ্টি হয়নি। ১৯৩৭-৪০-এ শেরেবাংলা, নজরুল, আব্বাসউদ্দীনের রাজনীতি, সাহিত্য ও সংগীতে তার সূত্রপাত। আর ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর নগর উন্নয়ন, মধ্যবিত্তের বিপুল বিস্তার এবং নগদ অর্থবিত্তের সমাগমে ঈদ উৎসব এক প্রধান বর্ণাঢ্য ও জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। সেকাল থেকে একালে উত্তীর্ণ ঈদ উৎসব এখন অনুজ্জ্বল থেকে ক্রমে ক্রমে অত্যুজ্জ্বল মহিমায় অভিষিক্ত।’ 

উনিশ শতকের শেষ দিকে ঈদের আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে যুক্ত হয় একটি নতুন উপাদান, লোকজ মেলা। সেই ধারা আজো কমবেশি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঈদ আনন্দমেলার আয়োজন করা হয়। 

ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতরের আনুষ্ঠানিকতার দিকটি প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে বাংলাদেশে ঈদের আনন্দোৎসবের দিকটি সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মধ্যেই সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ছোটবেলায় ঈদের দিন সকাল সকাল তৈরি হয়ে বন্ধুদের বাসায় বাসায় বেড়াতে যাওয়ার মজার কথা আজো ভুলতে পারি না। গণমাধ্যম কর্মী হওয়ার সুবাদে এখন ঈদের দিনটা সাধারণত কর্মক্ষেত্রেই কাটাতে হয়। কিন্তু সহকর্মীদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেয়ার মজাটা পাওয়া যায়। বয়সে বড় সহকর্মীদের কাছ থেকে সেলামী আদায় করা আর ছোটদের সেলামী দেয়া, কাজের ফাঁকে পরস্পরের হাতে মেহেদী পরিয়ে দেয়া, অফিসে খাওয়া-দাওয়ার বিশেষ আয়োজন আর অফিস শেষে বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানো বা স্রেফ আড্ডার মধ্য দিয়ে এখন ঈদের দিন কাটে। অন্যধর্মের মানুষ হয়েও এ আনন্দে শরিক হতে কোনো দিন কোনো বাধা অনুভব করি নি। আমি এমন অনেক অমুসলিম পরিবারকে চিনি, যারা ঈদ উপলক্ষে নতুন কাপড় কেনেন, ঈদের দিন ঘরে সেমাই, পায়েস, পোলাও-মাংসের আয়োজন করেন। এ যেন শুধুই অকারণ আনন্দে উৎসবে মেতে থাকা। বাংলাদেশে তাই ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। বাঙালির সংস্কৃতি হলো ধর্মনিরপেক্ষ মানবসংস্কৃতি, উদার সামাজিক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতিতে আছে সামাজিক সম্মিলন ও সমন্বিত ভাবধারা। বাঙালি সংস্কৃতির সামাজিক উপাদানগুলো সংস্কৃতির শক্তিকে বলিষ্ঠতা দিয়েছে।এমনকি ধর্মীয় উৎসব-পার্বণগুলোও পরিণত হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির উপাদানে। 

ঈদ সামনে রেখে প্রতিবারই ঈদের বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে, এতে একই সাথে চাঙ্গা হয়ে ওঠে দেশের অর্থনীতি। ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে পাঠায়। ঈদের সময় বৈদেশিক আয়ের প্রবাহ বেড়ে যাওয়া গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। চাঙ্গা হয়ে ওঠে ব্যাংকিং খাতও। 

তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি, ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট টিভির প্রভাবে বর্তমানে ঈদ উদযাপনের পদ্ধতি পাল্টে গেছে। আগে ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ঈদকার্ড প্রেরণ বেশ জনপ্রিয় ছিল। বর্তমানে অফিস ও কর্পোরেট জগতে এর প্রচলন থাকলেও ব্যক্তি পর্যায়ে তেমন একটা নেই বললেই চলে। সে জায়গা দখল করেছে ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপ, ইনস্ট্রাগ্রাম, ভাইবার, টুইটার, ইমেইল বা মোবাইলের এসএমএস বা এমএমএস। ঈদের আনন্দ আবর্তিত হয় ফ্যাশন ডিজাইন, বিউটি পারলার ও শপিংকে কেন্দ্র করে। তবে কিশোরী-তরুণীদের হাতে মেহেদি লাগানো একাল-সেকাল দুই কালেই খুব জনপ্রিয়। ঈদ উপলক্ষে সাত দিনব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোতে। 

ঈদের দিনে দল বেঁধে প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার নিয়ম গ্রামে কিছুটা থাকলেও শহরে এখন নেই বললেই চলে। সারাদিন অলস সময় কাটানোর পর বিকালে বা সন্ধ্যায় শিশু পার্ক, এ্যামিউজমেন্ট পার্ক বা আত্মীয়স্বজনদের বাসায় বেড়াতে বের হয় কেউ কেউ। এছাড়া ঘরে বসে টেলিভিশনে নানা রকম অনুষ্ঠান উপভোগ করেই দিন কাটিয়ে দেয় কেউ কেউ। 

একসময় ঈদের সেলামি হিসেবে বরাদ্দ থাকত পাঁচ-দশ টাকা বা পঞ্চাশ টাকা। এখন অবশ্য সেটা ৫০০ টাকাও ছাড়িয়েছে। আগের মতো যৌথ পরিবারে ঈদ কাটানোর সৌভাগ্য অনেকের হয় না। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বদলে গেছে অনেক কিছু।