0

ওবাড়ির চিঠি - শতরূপা দত্ত

Posted in

ওবাড়ির চিঠি


ভয়ের সংস্কৃতি থেকে গুজব-গণপিটুনি
শতরূপা দত্ত



কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ‘পদ্মাসেতুতে মানুষের মাথা লাগবে’ এমন একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে মানুষের মধ্যে ‘ছেলেধরা’ আতঙ্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মহামারীর মতো এই আতঙ্ক এমনভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে যে, প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও, এমনকি একাধিক স্থান থেকে গণপিটুনির খবর পাওয়া গেছে।

সাধারণভাবে বাংলাদেশে স্থাপিত বড় যেকোন স্থাপনার ক্ষেত্রেই এমন গুজব ছড়ায়। আর সেতু হলে তো কথাই নেই। দেশের অনেক মানুষই ছোটবেলায় বহুবার এধরনের গুজব শুনেছেন বলে মনে করতে পারবেন। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মাসেতু হতে যাচ্ছে ইতিহাসের একটি বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। পদ্মাসেতুবিরোধী চক্র এই সুযোগ কাজে লাগাবে তাতে সন্দেহ কি? 

সরকারে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, গণমাধ্যম কর্মী ও সচেতন নাগরিকরা মনে করেন, যারা পদ্মাসেতুতে মাথা লাগার গল্পটি ছড়িয়েছে, তাদের হীন উদ্দেশ্য আছে। তারা এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন চায় না। নানাভাবে ঠেকাতে না পেরে এখন এই কুসংস্কার ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করছে তারা।

‘উত্তেজিত জনতা’র আচরণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, জনতার ভিড়ে ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার বিলুপ্তি ঘটে এবং প্রতিজন ব্যক্তি মিলে উত্তেজিত জনতার সমষ্টি তৈরি হয়। জনতার 'সম্মিলিত মন' তখন বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নেয় (সমাজ-মনোবিজ্ঞানী গুস্তাভ লে বোঁ)।সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ছেলেধরা সন্দেহে একদল মানুষ যখন কাউকে মারতে শুরু করে, তখন তাদের সবার মধ্য থেকে একযোগে বিবেকবোধ লোপ পায়। অথচ সাধারণ অবস্থায় দেখা যায়, তারাও নিরীহ মানুষ, তাদেরও বিবেকবোধ আছে। কিন্তু ঘটনার সময় সে মনে করে, সত্যিই সে একটা ‘ভালো কাজ’ করছে, সে ‘ন্যায়বিচারে’ অংশ নিচ্ছে। এই কাজকে তখন সে ‘বেআইনী’ বলেও মনে করে না। এই উত্তেজিত জনতা একবারও ভাবে না যাকে হত্যা করছে, সে আদৌ অপরাধী কিনা।

গণপিটুনির ক্ষেত্রে ক্ষোভ-রোষ-হিংসা কাজ করে, কাজ করে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনাস্থা। কোনো ঘটনা সম্পর্কে কিছুই না জেনেও মানুষ গণপিটুনিতে যোগ দেয়। বাংলাদেশে বর্তমানে একটি বিশেষ ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে। আর এই ভয়ই প্রতিদিন নৃশংস গণপিটুনির ঘটনার জন্ম দিয়েছে। 


এর আগেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে সাধারণ মানুষের মনে ভয়-আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে, সৃষ্টি হয়েছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থাগুলোর প্রতি আস্থাহীনতা। আর সেই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ায় প্রকৃত অপরাধীর পাশাপাশি নিরপরাধ মানুষকেও গণপিটুনির শিকার হতে হয়েছে। 

‘ছেলেধরা’ আতঙ্কে গণপিটুনির ঘটনায় আজ পর্যন্ত কেউ কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বলতে পারেনি, সন্দেহ করে যাকে মেরে ফেলা হলো সত্যিই সে ছেলেধরা ছিল কি-না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সে আসলে ছেলেধরা ছিল না। সম্প্রতি ঢাকায় গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যাওয়া তাসলিমা বেগম রেনুর সাথে সেটাই ঘটেছিল। 

রেণু ২০ জুলাই শনিবার সকালে উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যান বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে। রেণু স্কুলের ভেতরে যেতে চাইলে কয়েকজন অভিভাবক তাকে স্কুলের ভেতরে যাবার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করানোর কথা বলায় অভিভাবকরা তাকে ছেলেধরা হিসেবে সন্দেহ করে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহানাজ বেগমের কক্ষে নিয়ে যান। 

ওই প্রধান শিক্ষক পরে সংবাদ মাধ্যমে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, ‘দুইজন অভিভাবক তাসলিমাকে আমার কাছে নিয়ে আসেন। এরমধ্যে বাইরে প্রপাগান্ডা শুরু হয়ে যায়, স্কুলে ছেলেধরা ঢুকেছে। মুহূর্তের মধ্যে স্কুলের ভেতরে মানুষ আসতে শুরু করে। সে সময় আমাদের নিচের গেট বন্ধ ছিল। লোকজন ওই গেটের তালা ভেঙে স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করে আমার কক্ষ থেকে তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায়। এখানে স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, স্থানীয় উৎসুক জনতা এবং বহিরাগতরা ছিল। তখন কে অভিভাবক আর কে বহিরাগত, সেটি বোঝাই বড় মুশকিলের বিষয় ছিল।’

এই হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া উত্তেজনার পাশাপাশি ঘটেছে টার্গেট করে গণপিটুনি দেয়ার ঘটনাও। পূর্বশত্রুতার জের ধরে বাজারে বা লোক সমাগম আছে এমন জায়গায় ‘ছেলেধরা’ বলে গুজব রটিয়ে কোনো মানুষকে গণপিটুনিতে মেরে ফেলার সুযোগও নিয়েছে কেউ কেউ। যেমনটা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের সিরাজের ক্ষেত্রে। 

ছোট্ট মেয়েকে দেখতে গিয়ে ছেলেধরা হিসেবে গণপিটুনির শিকার হতে হয়েছে বাকপ্রতিবন্দী সিরাজকে। মেয়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া স্ত্রী ও তার দ্বিতীয় স্বামী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার, মাছ ধরা নিয়ে বিরোধের জেরে নওগাঁর মান্দায় ৬ জেলেকে ‘ছেলেধরা’ আখ্যা দিয়ে গণপিটুনি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পরে পুলিশ ওই ৬ জেলেকে উদ্ধার করে। 

আসলে, এভাবে গণপিটুনি দিয়ে কাউকে হত্যা করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করা সহজ, কারণ এসব ক্ষেত্রে সেই হত্যার দায় কারো একার কাঁধে পড়ে না। মামলা হলেও প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিত ও প্রমাণিত করার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়। দীর্ঘসূত্রিতার জালে পড়ে বিচার ব্যাহত হয়। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রাজীব নন্দী জানিয়েছেন, বাংলাদেশ-ভারতে গত ১০ বছরে চাঞ্চল্যকর ২০টি গণপিটুনির কোনো বিচার হয়নি এবং সঠিক তদন্তও হয়নি। 

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ছয় মাসেই বাংলাদেশে গণপিটুনিতে মারা গেছেন ৩৬ জন। ২৩ জুলাই আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, ১ মাস ৭ দিনের মধ্যে ১১টা গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। 

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা নিনা গোস্বামী জানিয়েছেন, বিভিন্ন কারণে গণপিটুনির ঘটনা ঘটে থাকলেও সম্প্রতি গুজবের কারণে গণপিটুনির ঘটনা বেড়েছে। 

গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গণপিটুনির শিকার থেকে বাদ পড়ছে না মানসিক প্রতিবন্দী, ভিক্ষুক, সেলসম্যান থেকে শুরু করে কোনো কাজে হঠাৎ কোনো এলাকায় গিয়ে পড়া নিরপরাধ সাধারণ মানুষও।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এই আধুনিক সময়ে এসেও মানুষ কেন কোনো স্থাপনা নির্মাণে মানুষের মাথা লাগা বা নরবলি দেয়ার মতো কুসংস্কারগুলোতে বিশ্বাস করে? 

বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক সুস্মিতা চক্রবর্তী জানিয়েছেন, নানা কিংবদন্তীমূলক কাহিনী, আবহমান কাল ধরে চলে আসা জনশ্রুতি এবং স্থানীয় সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন গল্পের ওপর বিশ্বাস করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে প্রবল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে যেসব গল্প শুনে আসে, কোনো ধরনের যাচাই ছাড়া সেগুলো বিশ্বাস করার প্রবণতার কারণেই এই প্রযুক্তির যুগেও সেসব গল্প সত্যি বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।

এছাড়াও মনে রাখা দরকার, ঐতিহাসিকভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশে নরবলি দেয়ার ইতিহাস রয়েছে। এ দেশের মানুষের গল্পগাথায়, অবচেতনে সে স্মৃতি ফিরে আসে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে নানা সময়ে সৃষ্টি হওয়া গুজব। 

প্রযুক্তির উন্নয়ন, ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহজলভ্যতার কারণে যেকোনো গুজব ছড়িয়ে পড়া এবং সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা আজকালকার দিনে অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে। ‘পদ্মাসেতুতে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে যে গুজবটি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, ইউটিউবে সেটা নিয়ে অনেক ভিডিও দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে ব্রীজের গোড়ায় কাটা মাথা এডিট করে রেখে দেয়া হয়েছে, এডিটিংয়ের সাহায্যে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে মাথা কেটে নিয়ে নদীতে ফেলা হচ্ছে। কারো সাধ্য নেই এ ভিডিওতে অবিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির অপব্যবহার গুজব ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করছে।

এর পাশাপাশি অনেকে মনে করছেন গুজব ছড়িয়ে পড়া রোধে সেতু কর্তৃপক্ষের বিশেষ ভূমিকা রাখা উচিৎ ছিল। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করেছেন, ২০১৫ সালের ১ মার্চ একটি খবর দেশের সমস্ত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে জানানো হয়েছিল, নদীতে পশুর রক্ত ঢেলে পদ্মাসেতুর ভিত্তি স্থাপন কাজের উদ্বোধন করেছে দায়িত্ব পাওয়া চাইনিজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। চাইনিজদের বিশ্বাস, বড় কাজের শুরুতে পশু উৎসর্গের মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, এড়ানো যায় বড় দুর্ঘটনা। এখন পদ্মাসেতুতে মাথা ও রক্ত লাগার গুজব ছড়ানোর সময় এই খবরকে ব্যবহার করছে গুজব সৃষ্টিকারীরা। সে সময়ই যদি সেতু কর্তৃপক্ষ এ ধরনের কোনো প্রথা পালনকে নিরুৎসাহিত করতো, নিদেনপক্ষে এই ধরনের রিচুয়্যাল পালনে খবর গণমাধ্যমে আসতে না দিতো, তবে হয়তো এ ধরনের গুজব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়াটা রোধ করা যেতো। 

মনোরোগবিদরা গণপিটুনির মানসিক প্রবণতাকে "মব সাইকোলজি" হিসেবে উল্লেখ করেন। তারা বলেন, যখন একটি সমাজে নির্দিষ্ট কোন বিষয় নিয়ে আতঙ্ক বা নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয় তখন জনসাধারণ এক ধরণের মানসিক অবসাদে ভোগে। সেটা থেকেই মানুষের মধ্যে এ ধরনের সহিংসতা দেখা দেয়।

‘মব লিঞ্চিং’-এর আভিধানিক অর্থ গণপ্রহার, প্রচলিত অর্থে গণপিটুনি। কিন্তু লিঞ্চিং মানে শুধু মারধোর বোঝায় না; উত্তেজিত একদল মানুষ একত্রে কোনো একক ব্যক্তিকে বা একটি দলকে পেটানো, কোপানো, পোড়ানো বোঝায়। যা গণপিটুনির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য- পেটানো, কোপানো, চোখ উপড়ে ফেলা, গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া।

গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর তা রোধে কি করা যেতে পারে তা নিয়ে সঠিক কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। সম্প্রতি সেতু কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মানুষকে সচেতন থাকতে বলেছে। 

জনগণের কাছে তথ্যপ্রবাহকে যতটা অবারিত করা হবে, ততই এধরনের গুজব তৈরি হওয়া এবং ছড়িয়ে পড়া কমবে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। এক্ষেত্রে মানুষের মনে স্বচ্ছতার অনুভূতি আনতে ব্রিজ নির্মাণের খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে, নির্মাণ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালকের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে বিস্তারিত জানানো যেতে পারে।

সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, গণপিটুনি ঠেকানোর একমাত্র পথ হচ্ছে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেওয়া থেকে বিরত থাকতে, গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে, কাউকে সন্দেহ হলে তাকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিতে এবং কোথাও গণপিটুনির ঘটনা ঘটলে তা রোধে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করতে প্রচারণা চালাচ্ছে সরকার। এর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছেলেধরা সংক্রান্ত বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট, যেকোনো ধরনের গুজব ছড়ানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নিচ্ছে বাংলাদেশ।

0 comments: