প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সৌম্য ব্যানার্জী
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
স্বর্ণযুগ
সৌম্য ব্যানার্জী
সেদিন সংবাদে দেখলাম, ভারতবর্ষ নাকি ২০১৮ থেকে demographic dividend-এর এক সোনালী সময়কালে প্রবেশ করেছে, যার মেয়াদ আগামী সাঁইত্রিশ বছর! ব্যাপারটা খায় না মাথায় মাখে বোঝার জন্য সংবাদটা খুঁটিয়ে পড়লাম। বিষয়টা ভারতবর্ষের বর্তমান জনসংখ্যার বয়সবিন্যাস সংক্রান্ত। গত বছর থেকে ভারতবর্ষের জনসংখ্যার সিংহভাগ নাকি কর্মক্ষম বয়সে উপনীত হয়েছে। ১৪ বছরের নীচে আর ৬৪ বছরের উপরে যাদের বয়স, অর্থাৎ যারা জীবনধারণের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল, তারা এখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। যার অর্থ, ভারতবর্ষের কর্মক্ষম জনসংখ্যার অনুপাত এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ!
এই সোনালী সংবাদ কিন্তু কোনও সরকারি প্রতিবেদন বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘোষণা নয়। রীতিমতন রাষ্ট্রসঙ্ঘের জনসংখ্যা তহবিলের (UNFPA – United Nations Population Fund) নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী নির্ণিত পরিসংখ্যান, যার মূল উপপাদ্য হলো একটি দেশের জনসংখ্যার বয়সবিন্যাসে পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে সেদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা। এই পরিবর্তন আসে দেশের মানুষের গড়পড়তা আয়ু সুস্থির (stabilisation of life expectancy) হওয়ার পর যখন সামগ্রিক উর্বরতা (TFR – Total Fertility Rate) কমতে থাকে, অর্থাৎ নারী পিছু শিশুর সংখ্যা হ্রাস পায়। সাম্প্রতিক অতীতে এই জাতীয় উন্নয়নের সাক্ষী জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া বা থাইল্যান্ডের-এর মতন তাবড় তাবড় দেশ। এদের মধ্যে জাপানে প্রথম এই স্বর্ণযুগের সূচনা হয় ১৯৬৪ সালে। পরিসংখ্যান বলছে, তৎপরবর্তী দশ বছরের মধ্যে পাঁচ বছর জাপানি অর্থনীতির বাৎসরিক বৃদ্ধির হার ছিলো দুই অঙ্কের, যে কোনও উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য যা বিরাট কৃতিত্বের বিষয়। এই কিছুদিন আগে, ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাপান এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড-এর সুবিধা ভোগ করেছে। তারপর সামাজিক ও প্রাকৃতিক নিয়মে আবার তাদের জনবিন্যাস পাল্টে গেছে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড বা ব্রাজিলের মতন দেশগুলি বর্তমানে এই স্বর্ণযুগের মধ্যে দিয়ে চলেছে। এমন কি বাংলাদেশের জনবিন্যাসেও ভারতবর্ষের সঙ্গে সঙ্গেই ২০১৮য় এই বিবর্তন ঘটে গেছে। ইউ.এন.এফ.পি.এ-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী তৈরি নীচের তালিকাটা থেকে বিভিন্ন দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড-এর মেয়াদকাল বোঝা যাবে:-
সুতরাং, যতই আপনি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্দিহান হন বা নাক সিঁটকান, মানতে আপনি বাধ্য যে অদূর ভবিষ্যতে ভারতীয় অর্থনীতির হুড়মুড়িয়ে উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী।
কিন্তু এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে। কিন্তু সেই ‘কিন্তু’তে প্রবেশ করার আগে বর্তমান সময়টার একটা পর্যালোচনা করা দরকার। ১৯৬৪র কথা ছেড়েই দিলাম, ১৯৯৪তেও পৃথিবীটা যেরকম ছিলো, আজ তার থেকে অনেকটাই অন্যরকম। প্রযুক্তিগত মহাবিপ্লব ঘটে গেছে গত তিন দশকে। অনেকখানি পরিবর্তন ঘটেছে মানুষের সমাজচেতনাতেও। আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সমাজচেতনাও উন্নীত হবে। হয়েছে কিনা, সেটা সমাজতাত্ত্বিক এবং অবধারিতভাবে রাজনৈতিক তর্কসাপেক্ষ। তবে সেই তর্কে না গিয়েও এটা বোধহয় বলাই যায় যে, সম্প্রতি সারা বিশ্বেই মানুষের অস্থিরতা বাড়ার এবং সহনশীলতা কমার যে ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেটা কোনও শান্তিপ্রিয়, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্যই খুব স্বস্তিদায়ক হতে পারে না। এর জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ জাতীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজকগুলোকে দায়ী করা যেতেই পারে। ইতিহাসের আদিকাল থেকেই এরা সাম্যের চাইতে বেশি বিভেদ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সে তো চিরকালীন সমস্যা, এবং সে সমস্যা যেন ধীরে ধীরে কিছুটা কমেও আসছিলো। অন্তত নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকেও সেরকমটাই মনে হতো। তারপর হঠাৎ হলো কি?
আপনি হয়তো বলবেন, আরে ওই সময়টাই তো ধর্মীয় মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো! ঠিক কথা। উঠলো যে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঠিক ওই সময়েই কেন উঠলো? একটা কিছু trigger factor তো কাজ করেছে তার পিছনে! সেটা কি?
আবার ভেবে দেখুন... প্রযুক্তি-বিপ্লব জিনিসটা পূর্ণগতি লাভ করেছিলো ওই নব্বইয়ের গোড়াতেই। প্রচারমাধ্যম, সংযোগমাধ্যমের রমরমা শুরু হয়েছিলো ওই সময়েই। প্রথমে কেবল টিভি, তারপর একে একে কম্পিউটার আর মোবাইল ফোন ছেয়ে ফেললো বাজার। পৃথিবী মোটামুটি হাতের মুঠোয় এসে গেলো সাধারণ মানুষের, এবং সেই সঙ্গে শুরু হলো কর্মক্ষেত্রে কম্পিউটার-চালিত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার, যাকে বলে large scale automation।
হয়তো আপনাদের কারও কারও মনে পড়বে যে এই প্রযুক্তিগত উল্লম্ফনের পর পরই চাকরির বাজারে একটা ঘটনা ঘটতে শুরু করে। সেটা যে তার আগে হয়নি, তা নয়। কিন্তু এই সময়ে তার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। ঘটনাটা হলো VRS: Voluntary Retirement Scheme, স্বেচ্ছাবসর প্রকল্প। এটা সেই সময়ে ঘটে মূলত উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোতে, যেখানে কারখানাকর্মীদের বিকল্প হিসেবে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুতগতিতে বাড়ে। প্রচুর মানুষ সেই প্রকল্পের আওতায় এককালীন থোক টাকা নিয়ে স্বেচ্ছাবসর নেন। অনেকে বাধ্য হন নিতে। মোটের উপর, সেই শুরু হয় মানুষের বিকল্প হিসেবে যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার।
ব্যাপারটাতে এখন আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগের যে কোনও ব্যাঙ্কের শাখার কথা ভাবুন... কম পক্ষেও কুড়ি-পঁচিশজন লোক কাজ করতো একেকটা শাখায়। এখন সেটা এসে দাঁড়িয়েছে আট-দশে। কোথাও কোথাও আরও কম। যাঁরা internet banking-এ অভ্যস্ত, তাঁদের আজকাল আর এটিএম-এই যেতে হয় না, শাখা তো দূরস্থান। ব্যাঙ্কগুলোও আজকাল তাদের গ্রাহকদের শাখায় যেতে খুব একটা উৎসাহ দেয় না। সুতরাং, এটা বোঝা যাচ্ছে যে কর্মীসংখ্যা সংকোচন শুধু উৎপাদনের ক্ষেত্রে আর সীমিত নেই। পরিষেবা ক্ষেত্রেও বেশ ভালোরকমভাবেই শুরু হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট কোনও সংস্থায় একসঙ্গে কয়েক হাজার কর্মীর বরখাস্ত হওয়া আজকের দিনে আর খুব বিস্ময়কর ঘটনা নয়।
এই ব্যাপারটার আঁচ সেরকম মারাত্মকভাবে যে আমাদের অর্থনীতির উপর এতদিন পড়েনি, তার কারণ সমান্তরালভাবে কিছু নতুন নিয়োগের সৃষ্টি হওয়া, যা প্রধানত হয়েছে তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে। রাতারাতি গজিয়ে ওঠা সফ্টওয়্যার আর মোবাইল পরিষেবা সংস্থাগুলো একসঙ্গে বহু লোকের কর্মসংস্থান করেছিলো একসময়ে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতিটা অন্যরকম। ছোট এবং মাঝারি মাপের সফ্টওয়্যার কম্পানিগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে, এখনও যাচ্ছে। প্রতিযোগিতার চাপে মোবাইল সংস্থাগুলোরও নাভিশ্বাস উঠছে। অদূর ভবিষ্যতের চাকরির বাজার সম্বন্ধেও একমাত্র ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলি ছাড়া আর কারও ভবিষ্যদ্বাণীই বিশেষ আশাব্যঞ্জক শোনাচ্ছে না... এবং সেটাই স্বাভাবিক, কারণ অদূর ভবিষ্যতে অতি দ্রুত এবং অতি ব্যাপক হারে কর্মক্ষেত্রে মানবমস্তিষ্কের জায়গা দখল করতে চলেছে যে বস্তুটি, তার নাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
AI বা Artificial Intelligence কিন্তু আজ আর রকেট বিজ্ঞান নয়। গুগল, ফেসবুক, ইন্স্টাগ্র্যাম, স্মার্ট ফোন, স্মার্ট টিভি, কন্ঠ-নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিগত সহায়ক(অ্যামাজন একো-র মতন) জাতীয় নানা ধরণের নিত্যব্যবহার্যের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন আমরা তার উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠছি এবং যত দিন যাবে, তত বেশি উঠবো। বস্তুত, যে গবেষণার পিছনে এই মুহূর্তে পৃথিবীতে সব থেকে বেশি অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে, সে গবেষণা এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত। তাই AI দিনে দিনে আরও বেশি বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে তার ব্যাপক ব্যবহার আজ সর্বজনবিদিত। সমাজমাধ্যমগুলি এ.আই-এর সাহায্যে যেভাবে কোটি কোটি মানুষের চরিত্র আর চাহিদা প্রায় নির্ভুলভাবে প্রতিনিয়ত বিশ্লেষণ করছে ও সেই তথ্য তাদের বিজ্ঞাপনদাতাদের জুগিয়ে চলেছে, তাও আজ আর খুব বেশি বিস্ময়ের উদ্রেক করে না। সফ্টওয়্যারের তৈরি ধ্রুপদী সঙ্গীতের কথাও হয়তো আপনারা অনেকে শুনেছেন, যে সঙ্গীত প্রথমটা অনেক বড় বড় বোদ্ধাকে রীতিমতন চমকে দিয়েছিলো। কিন্তু সম্ভবত আপনারা অনেকে অবাক হবেন শুনে যে সফ্টওয়্যারের লেখা যে সব কবিতা গত এক দশক ধরে ইওরোপ-অ্যামেরিকার সাহিত্যজগতে ঝড় তুলছে, সেগুলি বেশ কিছু বিশিষ্ট ‘মানবতাবাদী’ কবির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে! এ প্রসঙ্গে botpoet.com জাতীয় ওয়েবসাইটগুলি দ্রষ্টব্য। বিশেষ করে এই ওয়েবসাইটটিতে একটি চিত্তাগ্রহী guessing game আছে – কোন কবিতাটি মানুষ কবির লেখা আর কোনটি যন্ত্রকবির, তাই নিয়ে। হলপ করে বলতে পারি, অবাক হবেন।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে শুধুমাত্র যান্ত্রিক উৎপাদন, তথ্য বিশ্লেষণ বা তার সফল প্রয়োগে নয়, যে বিষয়ে এতদিন মানুষের মৌরসীপাট্টা ছিলো, সেই বৌদ্ধিক সৃজনশিল্পেও এবার তার প্রতিযোগী এসে গেছে... এবং এও স্বতঃসিদ্ধ যে এই প্রতিযোগিতা দিনে দিনে যত বাড়বে, মানুষের নিরাপত্তাবোধ ততই বিপন্ন হবে।
এই সমাজচিত্র তিন দশক আগে সেই নব্বইয়ের গোড়াতে অবশ্যই ছিলো না, কিন্তু উৎপাদনক্ষেত্রে ব্যাপক হারে স্বয়ংক্রিয়-করণের পরিপ্রেক্ষিতে এর আভাস একটা পাওয়া যাচ্ছিলো বটেই... এবং বিপদের একটা আঁচ পাওয়া যাচ্ছে অথচ সে বিপদটা ঠিক কিরকম হতে পারে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না – এইরকম পরিস্থিতিই সম্ভবত সব চাইতে অস্বস্তিকর। সেইরকমটাই হয়েছিলো সে সময়ে। বহু সরকারি-আধাসরকারি-বেসরকারি সংস্থায় কম্পিউটারাইজেশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ধর্মঘট, ইত্যাদিও হচ্ছিলো। তাতে ঘটনাটাকে একটু বিলম্বিত করা গেলেও আটকানো যায়নি। যায়ও না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতির অবধারিত ফলস্বরূপ সামাজিক বিবর্তনকে আটকানোর প্রচেষ্টা যে বাতুলতা মাত্র, সে বিষয়ে আজ আর কারও কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
তবে সমস্যা হলো, একটা সমাজ এবং তার সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি যখন অতি দ্রুত বিবর্তিত হয়, যেমনটা এখন ভারতবর্ষের মতন উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলি হচ্ছে, তখন তার গতির সঙ্গে তাল রাখা সে সমাজের অল্পশিক্ষিত আমজনতার পক্ষে মানসিকভাবে বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তারা না জানে অর্থনীতির অং-বং-চং, না বোঝে বিজ্ঞানের হিং-টিং-ছট! শুধু অবাক বিস্ময়ে দেখে, চিরাচরিত ধ্যানধারণাগুলো রাতারাতি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়ে চোখের সামনে নাকের ডগায় এমন সব তাজ্জব ব্যাপার-স্যাপার ঘটতে লেগেছে, যা কোনওদিন কল্পনাই করা যায়নি... এবং সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে তাদের নিরাপত্তাবোধের অভাব এবং অনিশ্চয়তা, যে পরিস্থিতি পেশাদার রাজনৈতিক নেতাদের জন্য একেবারে সুবর্ণ সুযোগ। তাঁদের ব্যবসার মূলধনই তো ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে মানুষের অনিশ্চয়তা!
এখানে সে প্রসঙ্গের অবতারণা নিরর্থক। আমাদের বর্তমান আলোচনা ভারতের জনতাত্ত্বিক স্বর্ণযুগের আগমনপথের মাঝখানে যে ‘কিন্তু’টা হিমশীতল দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে নিয়ে। তার নাম ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার উল্লিখিত হয়েছে। সে নাম – কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর্টিফশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। দিনে দিনে তার বুদ্ধি বিকশিত হচ্ছে। ঈশ্বরের সৃষ্টিই বলুন বা প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফল, মস্তিষ্ক নামক প্রাণীদেহের যে অত্যাশ্চর্য অঙ্গটির পরমতম বিকাশের আধার হিসেবে মানুষের এতদিনের অহঙ্কার, তা আজ বিপন্ন। অদূর ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে মানুষের কর্মযোগের কতখানি অংশের কাণ্ডারী হয়ে বসবে, একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই তার একটা মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া আজ আর খুব কঠিন নয়… এবং সেই ধারণাটা আমাদের ক্রমবর্ধমান চাকরিনির্ভর জনসংখ্যার জন্য বেশ খানিকটা দুশ্চিন্তার কারণ তো বটেই।
তাই বলছিলাম যে, আগামী সাঁইত্রিশ বছর ব্যাপী ‘জনবিন্যাস মুনাফা’র যে স্বর্ণযুগে আমরা প্রবেশ করতে চলেছি, তার বিষয়ে আশাবাদী হতে কোনও দোষ নেই। পর্যাপ্ত সংখ্যায় সক্ষম কর্মী যে কোনও অর্থনীতির জন্যই সবিশেষ আনন্দের কথা। কিন্তু যদি সেই কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমানে কাজই না থাকে, তাহলে? কারখানা বা দপ্তরের নিয়মিত কাজের কথা ছেড়েই দিলাম... চিকিৎসা, ওকালতি (সম্প্রতি ওয়াশিংটনের নামজাদা আইন সংস্থা বেকার হোস্টেটলার ‘রস’ নামক একটি এ.আই. সফ্টওয়্যারের নামে ওকালতির লাইসেন্স নিয়েছে। আপাতত সে আইনজীবীদের সাহায্য করবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতে নামলে তাকে মামলায় হারানো কোনও মানুষ আইনজীবীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হবে) বা শিল্পসৃষ্টির মতন একান্তই মনুষ্যোচিত কাজগুলিও যেরকম উৎকর্ষের সঙ্গে বুদ্ধিমান সফ্টওয়্যার করছে, তাতে কোনও সংস্থার পক্ষে এই সব কাজের জন্য মানবকর্মীর চাইতে রোবটকর্মী নিয়োগ করাই শ্রেয় মনে হওয়া স্বাভাবিক... বিশেষ করে যেখানে রোবটকে নিয়মিত মাইনে দিতে হয় না এবং তার কোনও integrity issue বা সততা বিষয়ক সমস্যাও থাকে না।
আমি বলছি না যে কালই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা চাকরির বাজার খেয়ে নেবে। তার জন্য সময় লাগবে। তবে সে সময় অফুরন্ত নয়। ভেবে দেখুন, আমরা মনে করেছিলাম পরিবেশ দূষণে পৃথিবীর কন্ঠরোধ হতে এখনও অনেক দেরি আছে। ততদিনে মানুষ উপায়ান্তর বার করে ফেলবে। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর নাভিশ্বাস অস্পষ্টভাবে হলেও শোনা যাচ্ছে এবং নিকট ভবিষ্যতে তাকে সুস্থ করে তোলার কোনও উপায়ও দেখা যাচ্ছে না। আসলে শুধুমাত্র বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নয়, মানুষের বিপুল সংখ্যাস্ফীতির কারণেও সামাজিক বিবর্তনের গতিটি অতিমাত্রায় ত্বরান্বিত হয়ে পড়েছে। সে গতির সঙ্গে তাল রাখা আমাদের পক্ষে প্রতিদিন আরও কঠিন হয়ে উঠছে। দুরূহ হয়ে উঠছে অদূর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও সম্যক ধারণা করা। তাই, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড-এর স্বর্ণযুগের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও আমাদের কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে... ভবিষ্যতের অত্যুন্নত পৃথিবীতে আমাদের মতন সাধারণ ছা-পোষা মানুষদের কতখানি প্রয়োজনীয়তা থাকবে? আদৌ থাকবে কি? নাকি অর্থনৈতিক শোষণের যুগ পার হয়ে এসে মানুষ এবার এক সম্পূর্ণ নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে চলেছে, যার নাম অর্থনৈতিক অপ্রাসঙ্গিতা...?
কবিতার খেলাটা বেশ মজার; নেশা লেগে গেল। ৪৭টা কবিতায় ট্রাই মারলাম। শেষের দিকে ভুল কম হচ্ছিল। এ আইয়ের কবিতায় কবির বুকের ধুকধুকি নেই ।
ReplyDeleteসময়োপযোগী অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক লেখা। পড়ে যুগপৎ বিস্মিত এবং মুগ্ধ হলাম!! এ আই নিয়ে আমার নিজের ও কৌতূহল ছিল অনেক।
ReplyDelete