প্রপঞ্চ - পল্লববরন পাল ও শিশির রায়
Posted in প্রপঞ্চ
প্রপঞ্চ
পল্লববরন পাল ও শিশির রায়
অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি...
মিনার্ভা থিয়েটারে মূকাভিনয় দেখতে গেছি। কিংবদন্তি মূকাভিনেতা শ্রী যোগেশ দত্তের ‘যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমি’ এখন ওঁর মেয়ে, আমার বন্ধু-দিদি প্রকৃতি দত্তের হাতে সেজে উঠেছে নবরূপে, অ্যাকাডেমিরই সহধর্মী সংস্থা ‘পদাবলী’র পতাকাতলে সে-দিনের অভিনয়। স্বাধীনতা দিবস এগিয়ে আসছিল সামনে, মুক্তির আবহে তাই ‘পদাবলী’র নিবেদন ‘শহিদ ক্ষুদিরাম’। ১৯৭৭ সালে যোগেশ দত্ত করেছিলেন, নতুন প্রজন্ম নতুন ভাবে আর রূপে সাজিয়েছে তাকে। দর্শকাসনে আমরা ক’বন্ধুও তাই ছিলাম উন্মুখ, উৎকর্ণ।
‘উৎকর্ণ’ বলাটা ঠিক হল? মূকাভিনয় তো নীরব— মূক অভিনয়। সংলাপ আছে, শোনা যাচ্ছে না। মূকাভিনয়ে সংলাপও নিশ্চুপ। এত জন অভিনেতা মঞ্চে, প্রত্যেকের শরীরভাষা আলাদা। কত অনুভূতি আর আবেগ খেলা করছে একসঙ্গে— স্নেহ, ভালোবাসা, ঘৃণা, বন্ধুতা। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। বীরত্ব, শত্রুতা। শরীর‘ভাষা’ যখন, পড়তে তো পারছিই, শুনতেও পাচ্ছি। অথচ অভিনেতাদের মুখ বাঙ্ময় নয়। কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিতে তবু অসুবিধে হয়নি তো কোনও!
মঞ্চে দেখছি ক্ষুদিরামকে। তার বড় হয়ে ওঠা, বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়া, বিপ্লবীর প্রশিক্ষণ নেওয়া। সাহেবকে মারতে ভুল করে দুই বিদেশিনি মেমসাহেবকে গুলি ছোঁড়া। পালানো। ধরা পড়ে যাওয়া। একটা আগুনঝরা, সশব্দ, উচ্চকিত সময়কে তো যে কোনও অভিনয়-দল চাইবে স্লোগানে স্লোগানে, বিদ্রোহের আহ্বানে, প্রতিবাদী গর্জনে ভরিয়ে দিতে! পরাধীনতা যেখানে অভিনয়ের বিষয়বস্তু, সেখানে তো মঞ্চ ফেটে পড়ার কথা অনর্গল সশব্দতায়! অথচ, অবাক হয়ে ভাবছিলাম, যেখানে ‘শোনানো’টাই সহজ উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল, সেখানে ওঁরা চলে গেলেন ‘না-শোনানো’র রাজ্যে। প্রবল ভাবে সরব হওয়া যেখানে স্বাভাবিক, ইচ্ছে করে সেখানে ওঁরা মূক হয়ে গেলেন। আমি মুখে তোমায় ভোলাব না, ‘মূক’-এ তোমায় ভোলাব। নীরব হয়ে গিয়ে ওঁরা সরবতার দ্বার খুলে দিলেন। নিছক সংলাপের মধ্য দিয়ে যা শুনতাম, কিচ্ছু না-শুনে শুনতে থাকলাম তারও অনেক, অনেক বেশি।
বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। অভিনয়-শেষে, দর্শকের করতালির মধ্যে যখন কুশীলবদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন জানলাম, যে অল্পবয়সি ছেলেটি এতক্ষণ ক্ষুদিরামের চরিত্রে অভিনয় করল, সে জন্মবধির! এমনকি, এই নাটকের দুই পরিচালকের একজন— দিলীপ ভট্টাচার্য, যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমির বহু দিনের সঙ্গী— তিনিও তা-ই। মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম, অরিন্দম বা দিলীপবাবু রিহার্সালটা কী করে করেন। শ্রবণ-প্রতিবন্ধীদের সাঙ্কেতিক ভাষা আছে, তার ব্যবহারও বহুল প্রচলিত, কে না জানে? কিন্তু যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কেজো প্রয়োজনীয়তাটুকুর ও-পারে, এক শ্রবণ-প্রতিবন্ধী অভিনেতার সামনে নিজের অভিনয়কে দর্শকদের সামনে শিল্পবস্তু করে তোলার যে চ্যালেঞ্জ থাকে, এত অনায়াসে তা পেরোতে পারলেন কী করে ওঁরা? আক্ষেপ হচ্ছিল, অভিনয়ের আগে ওঁদের রিহার্সাল দেখিনি বলে। তা হলে হয়তো বুঝতে পারতাম: শোনা যায় না যা, তাকে আত্মস্থ, অন্তঃস্থ করা যায় কোন জাদুতে।
ফেরার পথে, ভগিনী নিবেদিতার একটা চিঠির কথা মনে পড়ল— সারদা দেবীকে লেখা। বহু দূর দেশে বসে তাঁর মনে পড়েছে মা’কে, মনে পড়েছে তাঁর ভালোবাসার কথা। সেই নরম, গভীর, নীরব ভালোবাসার তুলনা টানতে গিয়ে নিবেদিতা লিখছেন, ‘...ঈশ্বরের অপূর্ব রচনাগুলি সবই নীরব। তা অজানিতে আমাদের জীবনে প্রবেশ করে— যেমন বাতাস, যেমন সূর্যের আলো, বাগানের মধুগন্ধ, গঙ্গার মাধুরী— এই নীরব জিনিসগুলি সব তোমারই মতো।’
ভাবছিলাম, আমাদের চারপাশের এই চিৎকৃত সময়ের মধ্যে এই নীরবতাগুলিই শ্রেয়। বাইরের কান দিয়ে যা শুনি, সে কি শোনা? যে না-শোনা খুলে দিতে পারে অন্তরপদ্মের পাপড়ি, তাকে চাই— তাকেই।
শিশির রায়
বাহ, বেশ তো, পড়ে ভালো লাগল, জানতে পারলাম
ReplyDeleteঋতবাকের অন্য লেখগুলোও ক্রমশ পড়া যাবে
ReplyDeleteবাঃ।মুখে তোমায় ভোলাবো না, মূকে তোমায় ভোলাবো!লেখার গুনে সবটাই না হোক অনেকটাই দেখতে পেলাম।
ReplyDeleteবাঃ।মুখে তোমায় ভোলাবো না, মূকে তোমায় ভোলাবো!লেখার গুনে সবটাই না হোক অনেকটাই দেখতে পেলাম।
ReplyDeleteচুপ করে বসে আছি ...অনুভব করার চেষ্টাএ ..চোখে জল নিয়ে ..প্রণাম শ্রদ্ধা ওনাদের
ReplyDelete