2

প্রবন্ধ - শুভাশিস চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


বিশ্বপথিক অমিয় চক্রবর্তী

শুভাশিস চক্রবর্তী



আইনস্টাইন আমেরিকায় বেড়াতে এলেন। রবীন্দ্রনাথও তখন আমেরিকায়। নিউ ইয়র্কের পার্ক এভিনিউতে বন্ধু এলমহর্স্টের ফ্ল্যাটে বিশ্রাম নিচ্ছেন। সাংবাদিক আর ভক্তদের চোখ এড়িয়ে একরকম গোপনে নিউইয়র্কে পৌঁছোলেন আইনস্টাইন। দু-দিন পর জানতে পারলেন রবীন্দ্রনাথ এখানেই আছেন। মাস কয়েক আগে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বার্লিনে সাক্ষাৎ হয়েছিল, এক সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। আইনস্টাইন ফোন করলেন রবীন্দ্রনাথকে— তিনি কবির সঙ্গে একটা দিন কাটাতে চান। তবে মিডিয়া যেন কোনওভাবেই জানতে না পারে। ১৯৩০-এর ঘটনা এটি।


রবীন্দ্রনাথের তৎকালীন সাহিত্য সচিব অমিয় চক্রবর্তী কি করবেন মনে মনে ভেবে ফেললেন। ফটোগ্রাফার মার্টিন ভস তখন অল্পবয়সী, কিন্তু ছবি তুলিয়ে হিসেবে মার্কিন দেশে তাঁর বেশ সুনাম। অমিয় চক্রবর্তী তাঁকে নিয়ে এলেন, বারান্দায় বহু ঘণ্টা লুকিয়ে রাখলেন। ফ্ল্যাটে প্রবেশের মুখেই ফটোগ্রাফার দেখলে বিজ্ঞানী খুশি হবেন না, জানতেন অমিয়। সারাদিন রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের সাক্ষাৎ চলল, আর ফটোগ্রাফার বারান্দায় লুকিয়ে থাকলেন। চলে যাবার সময় অমিয় চক্রবর্তী আইনস্টাইনকে ভয়ে ভয়ে ছবি তোলার প্রস্তাব দিলে বিজ্ঞানী তাতে এতটুকু খুশি হলেন না। শেষপর্যন্ত অবশ্য ছবি তোলা হয়েছিল।


নেপথ্যে থেকে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ অমিয় চক্রবর্তী আরও অনেকবারই করেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিনিধি হিসেবে গান্ধীজির সবরমতি আশ্রমে একাধিকবার গেছেন, সেখানেই আলাপ এবং বন্ধুত্ব গভীর হয়ে ওঠে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে। ১৯৩৫-এ স্ত্রী কমলা নেহরু যখন অসুস্থ, তাঁর শুশ্রুষা করবার ফাঁকে ফাঁকে জওহরলাল অমিয় চক্রবর্তীকে অনেক চিঠি লিখেছেন, সেসময়ের অন্তত পঁচিশটি চিঠি রক্ষিত আছে দিল্লির নেহরু মিউজিয়ামে। স্ত্রীর গুরুতর অসুস্থতার এই সময়ে জওহরলালকে হঠাৎই কারারুদ্ধ করা হয়। কমলা নেহরুকে নিয়ে যাওয়া হয় জার্মানিতে বেডেনওয়েইলারের স্যানেটোরিয়ামে। অমিয় চক্রবর্তী বন্ধুপত্নীকে দেখতে গেছেন। চিকিৎসকেরা তাঁকে জানালেন, দু-মাসের বেশি কমলা বাঁচবেন না। যদি জওহরলালকে এই শেষ সময়ে আনা যায়, তাহলে ভালো হয়। কিন্তু এই প্রস্তাবে কমলা রাজি হচ্ছেন না। ব্রিটিশ পুলিশের দয়াভিক্ষা তিনি চান না। তিনি মনে করেন, কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামীর এই রকম বিশেষ সুযোগ পাওয়া উচিত নয়। অমিয় চক্রবর্তী এবারেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিজের কর্তব্য ভেবে ফেললেন। সব দিক ঠিক রাখতে হবে। কারও বিশ্বাসে আঘাত করা যাবে না অথচ কাজটিও ফলপ্রসূ হতে হবে। চিকিৎসাকেন্দ্রের এক জার্মান চিকিৎসককে দিয়ে কমলার শারীরিক অবস্থা বিষয়ে জার্মান ভাষায় একটি রিপোর্ট লিখিয়ে নিলেন তিনি। নিজে কোনও মন্তব্য না করে সেই সময়ের ভারতসচিব লর্ড জেটল্যান্ডকে রিপোর্টটি পাঠিয়ে দিলেন। হঠাৎই বিনা শর্তে, বিনা আলোচনায় জহরলালকে মুক্তি দিয়ে জার্মানি চলে যেতে বলা হয়। সেখানে পৌঁছালেন যখন, কমলা তখনও বেঁচে। স্ত্রীর মত্যুর সময় জহরলাল পাশেই ছিলেন। তিনি কোনওদিন জানতে পারেননি, এই ঘটনার নেপথ্য নায়ক কে। সুভাষচন্দ্র বসু আন্দাজ করেছিলেন, তাঁর একটি চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীকে এই কাজের জন্য নিজের সমর্থন জানিয়েছিলেন। ব্রিটিশ কোনও অফিসারের আকস্মিক বলে ফেলার সূত্রে মহাত্মা গান্ধীও জানতে পেরেছিলেন ঘটনাটির কথা।


অমিয় চক্রবর্তীর জন্ম ১৯০১-এর ১০ এপ্রিল। শ্রীরামপুরে। মামাবাড়িতে। বাবা ছিলেন অসমের গৌরীপুর এস্টেটের দেওয়ান। কৈশোর কাল কেটেছে সেই নদীবেষ্টিত শ্যামকান্তি পরিবেশেই। কবিতা লেখার হাতটি তখন থেকেই বেশ সুন্দর। প্রমথ চৌধুরী আর ইন্দিরা দেবী বড় ভালবেসে ফেলেছিলেন কিশোর অমিয়কে— সেই অল্প বয়সেই দেশি-বিদেশি কবি-সাহিত্যিককে দীর্ঘ চিঠি লেখেন তাঁদের লেখার ভালোমন্দ জানিয়ে। জেরম কে. জেরম, এইচ. জি. ওয়েলস, এমনকি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বুঝতেই পারেননি পত্র লেখকের বয়স মাত্রই পনেরো! চৌধুরীদম্পতি কিশোর অমিয়কে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনে। কয়েকদিন থাকবেন তাঁরা। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, অমিয়র জ্বর চলে এল। লজ্জিত কুন্ঠিত সদ্য গোঁফ ওঠা কিশোর কি করবেন বুঝতে পারছেন না। লজ্জার হাত থেকে বাঁচালেন রবীন্দ্রনাথই। ছেলেটির অবস্থা বুঝে দরদ দিয়ে বললেন, ‘কিছু চিন্তা কোরো না, কেউই কিছু মনে করবে না, এই ঘরোয়া বৈঠকে তুমি শুয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দাও।’ তারপরে কত আশ্চর্য আলোচনা। শুয়ে শুয়ে শুনে যাচ্ছেন সেই অপার্থিব মানুষটির বক্তব্য। বারান্দার ওদিক থেকে দেখা যায় খোয়াইয়ের দিগন্ত— চোখ চলে যায় সেদিকেও। সন্ধ্যা বেলায় গানের বাসর— তারও মুগ্ধতা লেগে থাকে কিশোরটির চোখে মুখে।


অঘটনটি ঘটল এর কিছুদিন পর। একটা মত্যু এসে জোর ধাক্কা দিয়ে গেল অমিয়কে। তাঁর থেকে বছর দেড়েকের বড় দাদা, অরুণচন্দ্র, বিনা কারণে, শুধুমাত্র পরলোকের ইঙ্গিত পাবার ব্যাকুল বাসনায় আত্মহত্যা করলেন। ভরা পূর্ণিমায় পদ্মা নদী নীচে বয়ে চলেছে, ঈশ্বরদি স্টেশনের কাছে ব্রিজের উপর রেল লাইনে শুয়ে জ্যোৎস্নায় নিমগ্ন ছিলেন— দার্জিলিং মেল তাঁর উপর দিয়ে চলে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল অমিয়কে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ চৌধুরী। কিছু করে না বসে ছেলেটি। নতুন বউঠানের আত্মহত্যার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন অমিয়কে, ‘…সেই প্রচণ্ড বেদনা থেকেই আমার জীবন মুক্তির ক্ষেত্রে প্রথম প্রবেশ লাভ করলে। আমি ক্রমে বুঝতে পারলুম জীবনকে মৃত্যুর জানলার ভিতর থেকে না দেখলে তাকে সত্যরূপে দেখা যায় না।’ প্রমথ চৌধুরীও তাঁকে নানা ভাবে বোঝাচ্ছেন। উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ পরস্পরকে চিঠিও লিখছেন অমিয় বিষয়ে কী করা উচিত, তা আলোচনা করে। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসাই শ্রেয় মনে করলেন, লিখলেন, ‘তুমি শান্তিনিকেতনে এসে আমার কাছে কিছুদিন থাক’।


সেযাত্রায় শান্তিনিকেতনে না এলেও পাকাপাকিভাবে সেখানে চলে এলেন অমিয় ঠিক চার বছর পরে। বি.এ. পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছেলে এম.এ.তে ভর্তি না হয়ে শান্তিনিকেতনে যাচ্ছে— স্বাভাবিকভাবেই বাবা এটা মানতে পারেননি। তাছাড়া এটা কোনও চাকরি নয়, মাস মাইনে বলে যে একটা বস্তু থাকে তার কোনও ব্যাপার নেই, শুধুমাত্র ‘রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য আর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শের’ আশায় নিজের ভবিষৎকে এভাবে শেষ করা— বাবা ক্ষুন্ন হলেন মনে মনে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আশ্রমের কলেজ স্তরের মেয়েদের ইংরেজি সাহিত্যের শেলি‌-কীটস বিষয়ে ক্লাস নেবার দায়িত্ব দিলেন। কিন্তু তাদের থেকে মাত্রই কয়েক বছরের বড় এই শিক্ষকের ক্লাস মেয়েরা করবে কেন? রোগাটে চেহারা, অনাকর্ষণীয় অমিয়র ভক্ত নয় তারা। ফলে, শিক্ষক অপেক্ষা করেন, মেয়েরা আসে না তাঁর ক্লাসে। এই উপেক্ষা কষ্ট দেয় অমিয়কে। রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে নিজের অক্ষমতার দায় নিয়েই চিঠি লেখেন। রবীন্দ্রনাথ হস্তক্ষেপ করলেন। সমস্যার সমাধানও করলেন। কিন্তু অমিয় চক্রবর্তীকে যে চিঠিটি লিখলেন তাতে বিশ্বভারতী নিয়ে তাঁর স্বপ্নভঙ্গের একটা রেশ কোথাও যেন লুকিয়ে থাকল, ‘তোমার ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসে ছেলেমেয়ে কেউ যায়নি সেটাতে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের চিত্তশূন্য অহঙ্কার প্রকাশ পায়। এদেরই জন্যে আমি আমার রক্ত জল করে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়াচ্চি, নিজের আসল কাজ মাটি করচি এই কথা মনে করে পরিতাপ হয়।’


মাঝে মাঝে এই ক্লাস নেওয়া ছাড়াও অমিয় চক্রবর্তীকে তখন আর একটি দায়িত্ব পালন করতে হত। বিশ্বভারতীতে আগত দেশি–বিদেশি অতিথিদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব। দূরদেশ থেকে আগত প্রবাসীদের বন্ধু হতে তাঁর খুব বেশি সময় লাগত না। আর এসবেরই সুবাদে, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের তৈরি বড় বাড়িতে, আমলকি–বীথির কাছেই, সবুজ দরজা-অলা ছোট্ট একটা ঘরে থাকার ব্যবস্থা হল তাঁর। অমিয় চক্রবর্তী লিখছেন, ‘ঐ ঘরে বসে কত পড়তাম, কবিতা লিখতাম…। শান্তিনিকেতনে তখন যেন হাওয়ার স্রোতে ভেসে বেড়াতাম। এত উৎসাহ, এত বিচিত্র আনন্দ, কবির সান্নিধ্যই সব আনন্দের সঙ্গে যুক্ত। পরে আমার‘সবুজ ঘর’ ছেড়ে তাঁরই বাড়ি ‘কোণার্ক’-এ তিনি নিয়ে গেলেন, তাঁর সাহিত্য সহকারীর পদ গ্রহণ করলাম।’


রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিবের কাজ কি ছিল?


বিদেশি চিঠিপত্রের উত্তর দেয়া, কবিতা কপি করা, বাংলা ও ইংরেজি পাণ্ডুলিপি প্রকাশের জন্য সাজিয়ে রাখা, বইয়ের প্রুফ দেখা, অতিথি-অভ্যাগতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা— এমনকি সাংবাদিকদের ইন্টারভিউ দেওয়া। এর আগে রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্যদেশ ভ্রমণের সময় অমিয়কে সঙ্গীরূপে চেয়েছিলেন, কিন্তু অনেকের বাধা নেপথ্যে জেগে উঠেছিল। শান্তিনিকেতনে একটা গোষ্ঠী বারবার অমিয়র বিরুদ্ধাচরণ করে গেছেন। পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কারণেই কবির সঙ্গে পেরু যেতে পারেননি তিনি। জাপান থেকে রবীন্দ্রনাথ তারযোগে অমিয়কে ডেকে পাঠালেন, তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে বললেন, কিন্তু নানা মতের দ্বন্দ্বে সেবারেও যেতে পারলেন না। অমিয় চক্রবর্তী জানতেন কারা বাধা দিচ্ছেন, শত্রুতা করছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে ঘুণাক্ষরেও তাঁদের নাম প্রকাশ করেননি। মনে মনে ভেবেছেন, ‘শান্তিনিকেতন মৈত্রীর স্থান, প্রীতির স্থান, সে কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। …সংসারের কিছুই বাঁধা নিয়মে চলে না, তাই দোষ দেব কাকে?’


কিন্তু ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন ইওরোপে গেলেন, তখন লন্ডন থেকে বার্লিনে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন অমিয় চক্রবর্তী। ভাগ্যিস ছিলেন। তাই সেই সফরে রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইনের সাক্ষাতের মনোজ্ঞ বিবরণ লিখে গেছেন, এমনকি গোপনে তাঁদের কথোপকথনের নোটও নিয়েছেন। মহাবৈজ্ঞানিক যেখানে থাকতেন, সেই পাড়ার নাম কাপুথ। ছোট্ট দোতলা বাড়ি, দেয়াল দিয়ে লতা উঠেছে, উপরের ঘরে হাসিগল্পে, চা-খাওয়ায় সময় কাটল। তখন আইনস্টাইনের স্ত্রী-কন্যাও ছিলেন। বাড়িতে বিরাজ করছে স্নিগ্ধ আনন্দ। বার্লিনে রবীন্দ্রনাথের হোটেলের ঘরেও সাক্ষাত করতে এসেছিলেন আইনস্টাইন। রবীন্দ্রনাথের ঘরের জানালার বাইরে ওয়ানসে হ্রদের সায়াহ্নের জল তখন রঙিন, পাল তুলে ছুটিবিলাসীদের ছোট ছোট পানসি নৌকো ভেসে চলেছে, তীরে শিশু আর বয়স্করা একসঙ্গে খেলছে, চড়ুইভাতি করছে। রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইন পাশাপাশি বসলেন, তাঁদের কথোপকথন শুরু হল। সে এক মহার্ঘ অতুলনীয় সন্ধ্যা। কিন্তু এই দুই মহাবন্ধুর কথাবার্তায় সব আনন্দ অতিক্রম করে মানুষের ভাগ্য সম্বন্ধে বেদনার প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। অমিয় চক্রবর্তীর লুকিয়ে লুকিয়ে নেওয়া নোটটাই পরে রবীন্দ্রনাথের ‘রিলিজন অফ ম্যান’ বইতে প্রকাশ পেল। এরপর তাঁদের আবার সাক্ষাৎ হল আমেরিকায়। দুজনের ছবি তোলার সেই কাহিনি আগেই জেনে গেছি আমরা।


রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিবের পদ ছেড়ে দিলেন অমিয় ১৯৩৩–এ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ডে। স্ত্রী-কন্যা শান্তিনিকেতনে রয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথকে বলে গেলেন,কবির বাণী বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার কাজেই তিনি ইওরোপ যাচ্ছেন। সত্যিই সেখানে পৌঁছে অমিয় নানা ধরণের উদ্যোগ নিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। একটি ক্ষেত্রে অমিয় চক্রবর্তীর সাফল্য স্মরণীয়। পথিবীর যে মহাদেশটি তখনও পর্যন্ত আমাদের, এমনকি রবীন্দ্রনাথেরও চেতনায় ছায়াচ্ছন্ন ছিলো— সেই পরাভূত আফ্রিকার আদি সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন প্রজন্মের কল্যাণব্রতী কিছু ইউরোপীয়র চোখে দেখা আলাদা এক আফ্রিকা তখন জেগে উঠছিল। মুসোলিনির অত্যাচারে তখন পিষ্ট হচ্ছে আবিসিনিয়া। সম্রাট হাইলে সেলাসি স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছেন। নির্বাসিত উগান্ডার রাজপুত্র নিয়াবঙ্গো। এই পরিস্থিতিতে ১৯৩৬-এর ১৭ নভেম্বর অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথকে দীর্ঘ একটি চিঠিতে আফ্রিকা সম্বন্ধে অবহিত করে শেষে লেখেন, ‘আমার কেবলি মনে হচ্ছিল আফ্রিকার এই Tribe Eternal নিয়ে আপনি যদি একটি কবিতা লেখেন। আফ্রিকার সম্পর্কে আপনার কোনো কবিতা নেই— এইরকম কবিতা পেলে কীরকম আনন্দ হবে বলতে পারি না।’সাময়িক বিষাদে-অবসাদে আচ্ছন্ন রবীন্দ্রনাথের প্রথমে উৎসাহ হয়নি। তবুও অমিয়র বারংবার তাগাদায় আফ্রিকার লাঞ্ছিত অপমানিত ইতিহাস বিষয়ে উদাসীন থাকতে পারলেন না। এরপরেই লিখলেন বিখ্যাত‘আফ্রিকা’ কবিতা, ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭–এ। অমিয়কে কবিতাটি পাঠিয়ে সঙ্গে লিখলেন, ‘বাংলা ভাষার কুলুপমারা এই কবিতা নিয়ে ওদের কী কাজে লাগাবে?’ প্রিন্স নিয়াবঙ্গো পরে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে এই কবিতার একটি অনুবাদও করিয়ে নিয়েছিলেন। হাইলে সেলাসি সোয়াহিলি ভাষায় সেই অনুবাদের অনুবাদ করিয়ে ছড়িয়ে দিলেন সারা আফ্রিকা জুড়ে। প্রিন্স নিয়াবঙ্গো এবং ফ্রেজার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন। এই ভাবে বাংলা কবিতায় প্রবেশ করে আফ্রিকা আমাদের বিবেক-চেতনার অন্তর্গত হয়ে গেল চিরকালের জন্য।


সুভাষচন্দ্র বসু তখন নিজের চিকিৎসার জন্য ইওরোপে। অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা তাঁর চিঠি থেকে বোঝা যাচ্ছে ভিয়েনাতে অমিয়বাবুর বক্তৃতার আয়োজন করতে সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত ব্যগ্র, ‘…আপনি অবিলম্বে জানাইবেন ভিয়েনায় কোন তারিখে পৌঁছিবেন এবং আন্দাজ কয়দিন থাকিবেন। আপনার জন্য বক্তৃতার আয়োজন করিতে অনেকে ব্যস্ত…।’ এরই সঙ্গে লিখলেন, ‘প্যারিস-এ গিয়া যদি কোনও কাজে লাগিতে পারি তাহা হইলে আমি সানন্দে যাইব।’


পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের মধ্যে গান্ধী-সুভাষের দ্বন্দ্বে অমিয় চক্রবর্তী স্বস্তি বোধ করেননি। তবে তাঁর মনে হয়েছে ‘সুভাষবাবু একটু বাড়াবাড়ি করচেন’— এইভাবে রবীন্দ্রনাথকে তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছেন স্বমত। কেননা এই দ্বন্দ্বে রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রেরই সমর্থক ছিলেন। রোমা রোলাঁর ভারত সম্পর্কিত দিনলিপিতে একটি কৌতূহল উদ্রেককারী তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৩৫-এর ১২ জানুয়ারি রোলাঁ লিখেছেন, অমিয় চক্রবর্তী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। রোলাঁকে তিনি খুব জোর দিয়ে বলেছেন, ভারতের তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা জওহরলাল নেহরুরই একমাত্র আছে।


১৯৪৮-এ অমিয় চক্রবর্তী আমেরিকার নাগরিকত্ব নেন। আইনস্টাইন তাঁকে নিউ জার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য আমন্ত্রণ জানান। ফলে অমিয়র জীবনে এক নব অধ্যায় শুরু হয়। ১৯৪৯-এ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে জওহরলাল মার্কিন সফরে গেলেন। রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যানকে আইনস্টাইনের সঙ্গে নিভৃতে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছে জানালেন। ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপতি আইনস্টাইনকে হোয়াইট হাউসে আনানোর বন্দোবস্ত করতে উদ্যত হলে জওহরলাল তাঁকে নিরস্ত করলেন। তিনি চাইলেন না অত বড় একজন মনীষী নিজে এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন। অমিয় চক্রবর্তীর উদ্যোগে ব্যবস্থা হয়ে গেল। জওহরলাল, ইন্দিরা গান্ধী, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত এবং অমিয় চক্রবর্তী প্রথমে গেলেন বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের বাড়ি। দুপুরের আহার সেখানে সেরে বিকেলে পৌঁছলেন আইনস্টাইনের সেই জগতবিখ্যাত ১১২ মার্সার স্ট্রিটের বাড়িতে। ঘন্টা দুয়েকের নিবিড় হাস্যময় সেই সাক্ষাৎ এক বিরল ঘটনা।




২.


লাহোরের ফরমান ক্রিশ্চান কলেজে অনারারি প্রফেসর হিসেবে অমিয় পড়িয়েছেন তিন বছর। চুক্তির মেয়াদ ফুরোবে। নতুন চুক্তি করতে চাইছেন না। লাহোরে থাকতে চাইছেন না আর। শান্তিনিকেতনে না হোক,কলকাতায় অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে আসতে চাইছেন, রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি থাকতে চাইছেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে কিংবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শূন্য অধ্যাপক পদে যোগ দেবার ইচ্ছের কথা রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে জানালেন। রবীন্দ্রনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে অমিয় চক্রবর্তী সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জানিয়ে, প্রশংসা করে এই বিষয়ে অনুরোধ জানালেন। অমিয়বাবু নিজেও হাত গুটিয়ে বসে নেই। অক্সফোর্ডে ইংলিশ বোর্ডের চেয়ারম্যান নিকল স্মিথ, সি.এস. লিউসদের শংসাপত্র পেশ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনকি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে আধুনিক ইংরেজি কবিতার বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতাও দিয়েছেন। অথচ আশার আলো খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।


এদিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে রবীন্দ্রনাথকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করতে শিগগিরই ভারতের প্রধান বিচারপতি স্যর মরিস গয়্যরের শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হওয়ার কথা। মধ্যস্থ হিসেবে অমিয় চক্রবর্তী স্যর মরিসের সঙ্গে চিঠিপত্র লিখে অনুষ্ঠানের বিধিব্যবস্থা ঠিক করছেন। শান্তিনিকেতনের সিংহসদনে অনুষ্ঠান হবে। আসনের টানাটানি খুব, তাই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে আমন্ত্রিত বিশিষ্ট প্রতিনিধিদের সংখ্যা। অনুষ্ঠানের দিন ধার্য হয়েছে ৭ আগস্ট ১৯৪০। হঠাৎ এর মধ্যে কলকাতা থেকে রবীন্দ্রনাথ চিঠি পেলেন, অমিয় চক্রবর্তী আসছেন না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিয়োগ কমিটির মিটিং ইতিমধ্যে হয়ে গেছে এবং উপযুক্ত আবেদনকারীর অভাবে কাউকেই তাঁরা নাকি নিয়োগ করতে পারেননি। চিঠিতে লিখেছেন অমিয়: ‘বাংলাদেশ ছেড়ে চললাম— এখানে যেভাবে দিন কেটেছে— যে–রকম ব্যবহার পেয়েছি তাতে আর থাকা সম্ভব নয়।’ নিয়োগ–কমিটির কোনও–কোনও সদস্য আশ্রমের অনুষ্ঠানেও যাবেন, অমিয় সেই অনুষ্ঠানে তাই আর থাকতে চাইলেন না। রবীন্দ্রনাথ অমিয়কে লিখলেন: ‘আমার বিশেষ ইচ্ছা তুমি ৭ আগস্টের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকো। আর কোনো কারণ নয়— তোমাকে আমি যে অন্যদের চেয়ে শ্রদ্ধা করি সেইটে দেখাবার সুযোগ পেতুম।’ অনুষ্ঠানের দিন দেখা গেল রবীন্দ্রনাথ ছাড়া মঞ্চে বসে আরও চারজন: স্যর মরিস, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান, বিচারপতি হেন্ডারসন এবং অমিয় চক্রবর্তী। সবাই অক্সফোর্ডের আনুষ্ঠানিক হুড গাউন পরিহিত। ওই অনুষ্ঠানের মঞ্চে বসে অমিয় চক্রবর্তীর কী করণীয় ছিল জানা যায় না। মঞ্চের নীচে সামনের সারিতে বসেছিলেন অক্সফোর্ডের বিশিষ্ট ভারতীয় স্নাতকেরা। অন্য অতিথিদের স্থান হয়েছিল পিছনের সারিতে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন এমন কেউ-কেউ যারা মাত্র কয়দিন আগেই কলকাতার অধ্যাপক নিয়োগ কমিটির বৈঠকে অমিয় চক্রবর্তীর যোগ্যতা বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের চোখের সামনে অমিয় চক্রবর্তীকে মঞ্চে আসন দেবার অসাধারণ ইঙ্গিত-নাটকটির রচয়িতা অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ, যা মূল অনুষ্ঠানের সমান্তরালে সেদিন অভিনীত হয়ে গেল। তারপরেই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত পালটে গেল দ্রুত। কয়েক মাসের মধ্যেই অপ্রত্যাশিত নিয়োগপত্র পেয়ে কলকাতায় ফিরে এলেন অমিয় চক্রবর্তী। অধ্যাপকের স্থায়ী চাকরি পেলেন ইংরেজি বিভাগে।


বাবার অমতে, নিজের উজ্জ্বল কেরিয়ার রাতারাতি জলাঞ্জলি দিয়ে যে যুবক শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে আসার লোভে শান্তিনিকেতনে চলে এসেছিলেন, ১৯৩৩–এ তিনি সচিবের পদ ত্যাগ করে, শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে বিলেত পাড়ি দিলেন শুধুই ডিগ্রি লাভের বাসনায়? বোধহয় এটা আংশিক সত্য। আসলে অমিয় বুঝতে পারছিলেন ‘মহাপুরুষের ছত্রতলে বিরাজ করার মধ্যে একটা অলীকতা আছে— ঐ রকম আশ্রয় মানুষের সত্তার পক্ষে ক্ষতিকর।’ অমিয় চক্রবর্তী যে মূলত একজন কবি, মোট পনেরোটি কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা, তার প্রকাশ কিন্তু ১৯৩৩-এর মধ্যে, যখন তাঁর বয়স বত্রিশ ছুঁয়ে ফেলেছে, তখনও আমরা সেভাবে দেখতে পাচ্ছি না। ‘খসড়া’, ‘একমুঠো’, ‘দূরযানী’, ‘পারাপার’, ‘পালা-বদল’, ‘অনিঃশেষ’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থগুলি প্রকাশ পাচ্ছে ১৯৩৮ থেকে। শুধু তাই নয়, ১৯৮৬–র ১২ জুন, তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুই খণ্ড ‘কবিতাসংগ্রহ’, দুটি গদ্যের বই, দশটি ইংরেজি বই। প্রায় সারা পৃথিবী ভ্রমণ করেছেন, স্বদেশ–বিদেশ মিলিয়ে অন্তত দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। অ্যালবার্ট শোয়াইজার পদক,ইউনেস্কো প্রদত্ত বিশেষ পুরস্কার, ওয়াটুমুল ফাউন্ডেশন পুরস্কার, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম, ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পেয়েছেন। সারা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য বিখ্যাত মানুষের সঙ্গ করেছেন— ইয়েটস, এলিয়ট,রবার্ট ফ্রস্ট, পাবলো ক্যাসালস, বার্নাড শ, সিলনপা, পাস্তেরনাক, চেস্টারটন, শোয়াইটজার, কে নেই সেই তালিকায়? তাঁর ‘সংগতি’ কবিতার ‘মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর/পোড়ো বাড়িটার/ঐ ভাঙ্গা দরজাটা/মেলাবেন’— পংক্তিগুলো এখন ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’ প্রবাদের জন্ম দিয়ে ফেলেছে। ‘তোমারও নেই ঘর/আছে ঘরের দিকে যাওয়া’, ‘আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে’, ‘কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে’— এসব পংক্তি তাঁর লেখা জীবনের শেষ সাড়ে চার দশকে, সেই ১৯৩৩–র পরেই।


সৃষ্টির এই অসম্ভব ক্ষুধা যাঁর মধ্যে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মত রয়ে গেছে, তাঁর পক্ষে এটাই ভাবা স্বাভাবিক যে রবীন্দ্র–বলয় থেকে নিজেকে সরিয়ে না নিয়ে যেতে পারলে, তাঁর আত্মসত্তার মুক্তি নেই। শিষ্য-প্রতিম নরেশ গুহকে লিখেছেন, ‘যে-সংসর্গমহিমা বিরাট রবীন্দ্রনাথের কাছে অজস্র ধারায় পেয়েছি তা বাড়তির অংক— তিনি একদিন স’রে গেলে আমি কি সূর্যচন্দ্রহীন হ’য়ে যাবো? মন বলত, চলো, চ’লে যাই।’ তাই তিনি শান্তিনিকেতন ছাড়লেন।


অমিয় চক্রবর্তীর এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন সুভাষচন্দ্র বসু। একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘আপনি যে ‘শান্তিনিকেতন’ থেকে চলে এসেছেন তাতে একটু আশ্চর্য হয়েছি। তবে আমার মনে হয় যে বড় গাছের ছায়ায় বেশি দিন থাকলে অন্য গাছও সহজে বড় হতে পারে না। অন্ততঃপক্ষে মহাত্মা গান্ধীর শিষ্যবর্গকে দেখে আমার একথা মনে হয়। স্বামী বিবেকানন্দ তাই তাঁর শিষ্যদের নিজের সঙ্গে বেশি দিন রাখতেন না।’


রবীন্দ্রনাথ এই বিচ্ছেদ মানতে পারেননি। অমিয়র উপর তাঁর আশ্চর্য নির্ভরতা, আস্থা, বিশ্বাস ছিল। যেদিন আশ্রম থেকে বিদায় নিচ্ছেন অমিয়, তাঁর বোলপুর স্টেশনমুখী মোটর গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন, ‘যদি কখনও কিছুমাত্র দরকার হয়, অমিয়, আমাকে জানিয়ো।’ অমিয় কবিকে নমস্কার করলেন, মুখে তাঁর একটিও কথা এলো না। গাড়ি চলে গেল। বিমর্ষ রবীন্দ্রনাথের মনে গত পনেরো বছরের স্মৃতি বারবার ফিরে আসছে। রাত জেগে তাঁর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করা, কোণার্ক বাড়ির বারান্দায় বসে মেঘাবত আসন্ন সন্ধ্যাকে দেখা, হ্যাভেলক এলিসের প্রশ্নের উত্তরে অমিয়কে ‘বিজ্ঞান’ সম্পর্কে মনের সব কথা অনর্গল বলে যাওয়া— এইসব ভাবতে ভাবতে চিঠি লেখার কাগজে উজাড় করে দিলেন মনখারাপের অতল শব্দমালা, ‘এতদিন পরে আজ তুমি চলে গেলে কীরকম খারাপ লাগচে বলতে পারি নে। এ যেন মৃত্যুর বিচ্ছেদের মতোই কেবলি মনকে বৃথা আঘাত করচে। যখন মানুষ বেঁচে থাকে তখন কোনোমতেই মনে হয় না কোনোদিন মত্যু আসতে পারে। কিন্তু শেষকালে আসে। তারপরে মনকে সেই শূন্যতার সঙ্গে বোঝাপড়া করিয়ে নিতে হয়। …তুমি আমার অনেক করেচ, অনেক ক্লান্তি থেকে বাঁচিয়েচ— তোমার সহযোগিতা আমার পক্ষে বহুমূল্য হয়েছিল সে কথা কোনো দিন ভুলতে পারবো না— কোনো দিন তোমার অভাব পূর্ণ হবে না।’






------------------------------


(কৃতজ্ঞতা: শঙ্খ ঘোষ, অর্চনা গুহ, সুমিতা চক্রবর্তী, সুমিতা ভট্টাচার্য, সুচরিতা গুহ, অভিষেক চক্রবর্তী)

2 comments:

  1. দামি লেখা।
    আমার মনে পড়ছে চিনে কালচারাল রেভোলুশনের তান্ডবের অভিঘাতে ক্ষূব্দ অমিয় চক্রবর্তীর দেশ পত্রিকায় একটি একপাতার কবিতা, যার প্রথম লাইনটি খানিকটা এইরকম--
    " মহাচীন,
    এরা কারা তোমার নামের ধজা নিয়ে --"
    বিশ্বাস করতেন এই ঝড় সাময়িক। তাই শেষ পংক্তিটি ছিল--
    " অপেক্ষায় আছি এক প্রতিবেশী কবি।"

    ReplyDelete
  2. অনেক তথ্য জানা গেল এই প্রবন্ধে। লেখককে ওনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete