প্রবন্ধ - ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
সপ্তম রিপু
ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী
(১)
পুজো আসছে।
মাতৃ আগমনের সংবাদটা অনেকে অনেকরকম ভাবে পান। আমি পাই কোলাজে লেখা দেবার তাগাদা আসতে শুরু করলে।
হায়দ্রাবাদে আমার মতন যে কজন প্রবাসী বঙ্গ সন্তান নিজেদের সাহিত্যিক ভেবে আনন্দ পান, তাঁদের কাছে কোলাজ যাকে বলে মরূদ্যানে কল্পতরু। সবার কথা বলা মুশকিল, তবে আমার লেখা কোলাজে প্রকাশিত হলে আমি নিজেকে অত্যন্ত সন্মানিত মনে করি।
ধন্যবাদ জানাই সেই সকল অক্লান্ত পরিশ্রমী ব্যক্তিদের, যাঁরা আজকের আলোর গতিতে চলমান জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়েও আমার মতো বটতলার লেখকদের মন আনন্দে ভরিয়ে দেন নিজেদের সৃষ্টি ছাপার অক্ষরে জ্বাজল্যমান অবস্থায় দেখার সুযোগ দিয়ে। ভাবতে ভাল লাগে, আজকের হাল্লা রাজাদের রাজত্বেও বনের মোষ তাড়াইবার লোক কম পড়ে নাই।
যাইহোক, কি লিখব ভাবতে ভাবতেই সময় চলে যাচ্ছে।
উৎপটাং কিছু একটা লেখার ইচ্ছে অনেক দিনের, কিন্তু ইঁট পাটকেল চকলেট বোম খাবার ভয়ে অনেকদিন চুপচাপ ছিলাম। এবার সাহস করে লিখেই ফেলব ভাবলাম।
প্রথমে ভেবেছিলাম ছদ্মনামে লিখব, কিন্তু ভেবে দেখলাম, কোন লাভ নেই। এবার পুজোয় শ্বশুরকন্যার উড়িষ্যার “ধমকাই” শাড়ীর বায়না রাখতে না পারার জন্য এমনিতেই সকালে চায়ের বদলে “ছ্যাঃ” পাচ্ছি, তারপর যদি ভদ্রমহিলা জানতে পারেন নাম ভাঁড়িয়ে ভুলভাল কিছু লিখছি, তবে যাকে বলে আমার সব্বোনাশের মাথায় বাড়ি পড়তে বেশি দেরি হবে না। মাইক নিয়ে বলা ছাড়াও জাস্ট ডায়ালে ফোন কোরে ঘটনাটাকে একটা অন্য মাত্রা দেবার ক্ষমতা যে ওনার আছে, তার পরিচয় আমি অনেকবার পেয়েছি।
তাই “ভয় কি মরণে…………”।
যাইহোক, “সপ্তম রিপু” কথাটার সাথে আমি নিজেও এখনও পর্যন্ত পরিচিত নই। আদৌ কথাটা আছে কিনা জানিনা। তবে আমাকে যাঁরা মোটামুটি ভাবে জানেন, তাঁরা এটা অতি অবশ্যই মানেন যে আমি যে ব্যাপারে যত কম জানি, সেই বিষয়ে আমি ততো বেশী লেখা বা বলার ক্ষমতা ধরি। আমার নিজেরও তাই মত।
পরম করুণাময় ঈশ্বর, আমার ওপর জন্মকাল থেকেই অযাচিত ভাবে এই পক্ষপাতিত্ব করে আসছেন। তিন সত্যি করে বলছি, এখানে আমার কোনও কালো হাত নেই। নাম না জানা, নাম না শোনা যে কোনও বিষয়ের ওপর আমি একটা পুরো অখণ্ড রবীন্দ্র রচনাবলী লিখে ফেলতে পারি।
(২)
অনেক ভণিতা হোল, আমার ভুল ভাল লেখার জমি তৈরি করার জন্য। এবার আসল প্রসঙ্গে আসা যাক। পাঠকবর্গের সহনশীলতার পরীক্ষায় আমি সবাইকে ফুল মার্ক্স দিলাম, অবশ্য যাঁরা এখনও পর্যন্ত আমার সঙ্গে আছেন, ব্যাপারটার শেষ না দেখে ছাড়বেন না বলে।
আর যাঁরা ইতিমধ্যে রণে ভঙ্গ দিয়েছেন, তাঁদের জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা।
শাস্ত্রে আছে মানুষ ষড় রিপুর বশ-কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ এবং মাৎসর্য। এই ছটি শত্রুকে জয় করতে পারলেই মানুষের মানব জন্ম সার্থক বলা যেতে পারে। একজন আদর্শ মানুষ গুণগত ভাবে এই ছটি ঋণাত্মক ধর্মাবলম্বী উপাদান বশে রাখবে, বশবর্তী হবে না।
এই নিয়ে অবশ্য যথেষ্ট তর্কের অবকাশ আছে।
তার্কিকদের কথায় কান না দিলেও, সাধারণ মানুষের মনে একটা সাধারণ প্রশ্ন অতি অবশ্যই জাগতে পারে যে, যদি সকল মানুষ এই ষড় রিপুর দ্বারা সত্যি সত্যি চালিত না হয় তবে আমাদের এই বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা চলমান থাকতে পারবে কিনা?
প্রশ্নটার মূল্য দশ লক্ষ টাকা ধরা যেতেই পারে।
বিষয়ের লেবুটাকে বেশী কচলিয়ে তেতো করবার আগে, ষড়রিপুর ছটা উপাদানকে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা যাক।
প্রথমেই ধরা যাক “কাম” রিপুটাকে। আপাত অর্থে কাম কথাটার মানে সেক্স সম্বন্ধীয় হলেও, অন্য অর্থে অ্যাকাডেমি বাংলা অভিধান বলছে “কামনা, ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা, ভোগবাসনা, লিপ্সা, যাচঞা”।
এখন কথা হচ্ছে, অন্য সব অর্থ ছেড়ে দিয়ে যদি প্রথম রিপুর আপাত অর্থটাকেই জাপটে ধরি তবে এই রিপুকে ত্যাগ করলে সংসারের বৃদ্ধি, মানে সাদা কথায় যাকে বলে বংশ বৃদ্ধি তথা বিকাশ, স্তব্ধ হয়ে যাবে।
আবার ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা না থাকলে জীবনের কর্ম পদ্ধতি নতুন সংজ্ঞা পাবে। যদিও গীতা বলেছে, কর্মন্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। কিন্তু সর্বসাধারণকে কর্মে নিয়োজিত করতে হলে জনগণের পছন্দমতো খুড়োর কলে McD বা KFC’র আইটেম নাম্বার ঝোলাতেই হবে। রোম অলিম্পিকে গোল্ড মেডেলটা গলায় পরবার ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নটা না দেখাতে পারলে মিলখা সিং এর কোচ “ভাগ মিলখা, ভাগ” বলতে পারতেন না।
দ্বিতীয় রিপু “ক্রোধ” জীবকে চরম সর্বনাশের পথে চালিত করে। আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত দ্বিতীয় রিপুই সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর। তবে তার্কিকেরা বলে থাকেন দ্বিতীয় রিপু মানুষকে আত্মরক্ষায় উজ্জীবিত করে। ক্রোধের বশেই রাজা তাঁর প্রজাদের শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন। দুষ্টের দমন করেন। কাজেই মানুষের জীবনে ক্রোধের প্রয়োজন আছে।
(৩)
তৃতীয় রিপু “লোভ” এক অদ্ভুত রিপু। মানুষ মনে হয় ২৪x৭x365 শয়নে, স্বপনে, জাগরণে লোভ রিপুর বশবর্তী।
এই নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতেই পারে।
সকালে জম্পেশ করে হিঙের কচুরি-আলুর দম-জিলিপি খেয়ে নিয়েই আবার দুপুরে কচি পাঁঠার ঝোল আছে শুনে জিভে জল আসেনি এমন ত্যাগী মহাপুরুষ বিরল। এরপর যখন গিন্নির কাছ থেকে জানতে পারি সত্যনারায়ণের কাছ থেকে আনা ইলিশের ভাপাটা রাত্রে পাতে নামবে, তখন জিভের বারিধারা ধরার জন্য মুখের সামনে বাটি ধরতে পারলে ভালো হয়, নয়তো পরিধেয় বস্ত্র নষ্ট হতে পারে।
শুধু এই নয়।
মাসমাইনে পাবার দিনও শেয়ার বাজারে নিজের ধরে রাখা শেয়ারগুলোর স্বাস্থ্যের দিকে দৃষ্টিপাত না করে থাকা খুব মুশকিল।
গভীর ঘুমের মধ্যে সুখ স্বপ্নে কোটি টাকার লটারি পাওয়াটাকে যে অবদমিত হঠাৎ বড়লোক হবার লোভ বলা যাবে না, এটা বলা খুব মুশকিল।
আবার এই লোভের অনুপস্থিতিতে মানুষ যে তার বর্তমান জীবন যাত্রার উন্নতি সাধনে ব্যর্থ হতো, এ বিষয়ে খুব কম লোকই আপত্তি করবেন মনে হয়।
কিন্তু There is a BUT!
শাস্ত্রে আছে, “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু”।
এই জায়গাটাতে একটু দাঁড়ানো যাক।
২৪x৭x৩৬৫ নিজের অজান্তে লোভের বশবর্তী হয়ে পাপ-পুণ্যের হিসেবটা গুলিয়ে যেতেই পারে। কিন্তু কথাটা হলো, লোভ ত্যাগ করতে পারলে কি মৃত্যুকে এড়ানো সম্ভব? এর উত্তরে কিন্তু পণ্ডিতেরা নীরব।
কাজেই শয়নে, স্বপনে, জাগরণে লোভ রিপুর তাড়নায় অসাড় সংসার চক্র ঘোরে নিরবধি।
সাধারণভাবে চিন্তা করলে প্রথম এবং তৃতীয় রিপু দুজনকে বৈমাত্রেয় ভাই বলা যায়। বৈমাত্রেয় বলার কারণ এই যে এই দুই ভায়ের মধ্যে চরিত্রগত কিছু পার্থক্য আছে। অদম্য, অনিয়ন্ত্রিত, অসংযত কামনাই লোভে পরিণত হয়।
তার্কিকদের মতে সমস্ত সাধারণ মানুষের জাগতিক কর্মকাণ্ডের পিছনে এই তৃতীয় রিপুর অবদান সর্বাধিক। প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাহিদা আর অতিরিক্ত প্রয়োজনের দুনিয়া সৃষ্টি করার পিছনে এই তৃতীয় রিপুই যে অগ্রগামী, সে বিষয়ে সন্দেহ না থাকাটাই স্বাভাবিক।
(৪)
চতুর্থ রিপু “মদ” এর দিকে এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক।
মদ শব্দের তাৎক্ষণিক অর্থ সুরা মনে হলেও আভিধানিক অর্থে দেখছি “দম্ভ”, “গর্ব”, “অহংকার”, “দর্প” ইত্যাদি শব্দগুলি উপস্থিত।
আক্ষরিক অর্থে এই সকল গুণ কিন্তু রজোগুণী ব্যক্তিদের আধার। সাধারণত রজোগুণী ব্যক্তিরাই সমাজে নেতৃস্থানীয় পদাধিকার অর্জনে অত্যধিক ব্যাকুলতা প্রদর্শন করে থাকেন। আবালবৃদ্ধবনিতা তাদের নেতা,রাজাদের মধ্যে এই গুণগুলোই দেখতে চান নিজেদের আলুনি জীবনের মসলা হিসেবে। বনেদী রাজপরিবারের এই গুণগুলোই Blue Blood হিসেবে সমাজে পরিচিত।
মদমত্ত রাজপরিবার আমজনতার কাছে সর্বদাই ভগবানরূপে পূজিত হন। এক্ষেত্রে ভারতবর্ষের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হলেও রাজা-রাণীর দেশ England-ও খুব একটা পিছিয়ে থাকবে না।
পঞ্চম রিপু “মোহ” খুবই Deceptive. কথাটার অর্থ “মায়া”। এই যে “কোলাজ”, তার জন্য যে লেখা, এসবই মায়া। যাঁরা লিখেছেন, যাঁরা পড়ছেন – সবই মায়া। ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব সীতাদেবীকেও মায়া আখ্যা দিয়েছেন। রাম-সীতা-লক্ষ্মণের বনে যাবার দৃশ্যটা কল্পনা করুন। লক্ষণের দৃষ্টিপথে সীতা মায়া রূপে রামকে অদৃশ্য করে রেখেছেন।
রজনীকান্তর একটা গান আছে, “তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে……মোহ কালিমা ঘুচায়ে।”
হিন্দু দর্শন শাস্ত্রের মতে এই পুরো জগতটাই মায়া। যা দেখছি, যা কিছু বন্ধনে নিজেদের জড়াচ্ছি সব, সবই মায়া।
এখন কথা হচ্ছে, এই রিপুকে যদি অস্বীকার করি তবে দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রাথমিক কারণটাই পেছনের সারিতে চলে যাবে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে পঞ্চম রিপু “মোহ”কে ত্যাগ করে এই জগতে জীবনধারণ এক কথায় অসম্ভব।
ষষ্ঠ রিপু “মাৎসর্য” মানে “অন্যের ভালো দেখতে না পারা”। এক কথায় “পরশ্রীকাতরতা"। পণ্ডিতেরা বলেন “Schadenfreude” জার্মান শব্দটার ইংরেজিতে সঠিক কোন একাক্ষর শব্দ নেই। তবে তর্জমা করলে যেটা দাঁড়ায় সেটা হচ্ছে – Whenever a friend succeeds, a little something in me dies.
অনেকে বলেন Envy বা Jealousy শব্দ দুটো কাছাকাছি হলেও সঠিক নয়। তবে বাঙলায় সমকক্ষ একটা ভাল তৎসম শব্দ আছে – অসূয়া।
মহাভারতে দুর্যোধন পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থে ঐশ্বর্যময় জীবনযাত্রা দেখে Schadenfreude Syndrome-এ ভুগতেন। এটাকে সরলীকরণে “মাৎসর্য” রিপুর প্রভাব বলা যেতেই পারে।
সত্যি কথা বলতে গেলে, পুরাকালে যাঁরা রাজসিংহাসনে বসে রাজ্য চালাতেন, তাঁদের ওপর যদি মাৎসর্য রিপুর প্রভাব না থাকত, তবে তাঁদের পক্ষে কোনওমতেই অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে পৃথিবীর সমস্ত রাজাদের বশ্যতা স্বীকার করানো সম্ভব হত না।
(৫)
বর্তমানকালে এইপ্রকার উদ্দেশ্য সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে কিন্তু প্রাচীনকালে অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান একটি অবিস্মরণীয় কীর্তি হিসেবে পরিগণিত হত।
অতএব ধরে নিতে কোনও বাধা নেই যে “সদা সত্য কথা বলিবে” খ্যাত মহারাজ যুধিষ্ঠির মাৎসর্য রিপুর দাস ছিলেন। বেচারা দুর্যোধনই শুধু পরশ্রীকাতর হিসেবে কুখ্যাত হয়ে রইলেন।
আপাতত ষড় রিপুর গুণাগুণ বিচার বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে যে এদের সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করলে মনুষ্যসৃষ্ট এই বর্তমান সমাজ অচল হয়ে পড়তে পারে। রন্ধনশিল্পে যেমন সকল উপাদানের সঠিক মাত্রার উপস্থিতি স্বাদিষ্ট ব্যঞ্জনের সৃষ্টি করে থাকে, ঠিক সেইরকম সঠিক অনুপাতে ষড় রিপুর উপস্থিতি মনুষ্য জীবনে অতি অবশ্যই প্রয়োজনীয়। গীতায় স্বত্ব, রজো ও তম তিনটি গুণের কথা বলা হয়েছে। একটি আদর্শ চরিত্র গঠনে এই তিন গুণের যেরূপ সঠিক পরিমাণের উপস্থিতি প্রয়োজন, সেরূপ ষড় রিপুরও যে সঠিক মাত্রার উপস্থিতি প্রয়োজন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকা উচিত নয়।
মহাভারতের অনুশাসন পর্বে পিতামহ ভীষ্ম স্বজন হত্যায় অনুতপ্ত যুধিষ্ঠিরকে রাজধর্ম সম্পর্কে যে জ্ঞান দান করেছিলেন, সেটি যে “রাজধর্ম্যানুশাসন” নামক একটি সুগার কোটেড ষড় রিপুর সুসম মিশ্রণ মাত্র,সেটি অতি অবশ্যস্বীকার্য।
বলি ভণিতার পর ভণিতা তো হলো, এবার আসল কথাটায় আসা যাক – সপ্তম রিপু। সত্যি কথাটা বলেই ফেলি তাহলে।
পাঠক জনগণ যদি এই অপাঠ্য লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়ে আমার সাথে একমত হন তবে এই সপ্তম রিপু নামক ঋণাত্মক গুণটির জন্য আমি পেটেন্টের দরখাস্ত করতে পারি। এই রিপুটির উপস্থিতি সর্বপ্রথমে যদিও মহাভারতের কুরুক্ষেত্র পর্বে পরিলক্ষিত হয়, তবু কোন এক অজানা কারণে এই ঋণাত্মক গুণটিকে কখনই রিপুর তালিকাভুক্ত করা হয় নি।
এই সপ্তম রিপুটি হোল বিষাদ।
মহাভারতের যুগে অর্জুন প্রথম এই রিপুর বশবর্তী হয়েছিলেন। তারপর থেকে সভ্যতা যত এগিয়েছে এই রিপুর প্রভাব ক্রমে ক্রমে অল্পে অল্পে বাড়তে বাড়তে এই একবিংশ শতাব্দীতে একবারে মহামারীর রূপ ধারণ করেছে বলা যেতে পারে।
বিষাদ, ইংরেজিতে বলতে গেলে বলতে হয় Depression.
হতাশা, ভাল না লাগা, Mood নেই, মন খারাপ লাগা, Negative feelings ইত্যাদি সর্বপ্রকার মানসিক অবস্থানকেই সপ্তম রিপুর অন্তর্গত বলা যেতে পারে। বর্তমান সমাজে মানুষের জীবনযাত্রার চরিত্র যে গতিতে বদলে যাচ্ছে এবং তার সাথে জীবনের নিরাপত্তাহীনতা যে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলেছে, তারই ফলস্বরূপ বিষাদ রিপু আজ মনুষ্য সমাজকে পূর্ণগ্রাসগ্রস্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে চলেছে।
(৬)
এই রিপুর একটি বিশেষ ক্ষমতা হলো সরাসরি মানুষের মনকে গ্রাস করে ফেলা। আর তার প্রভাবে মহাভারতের যুগে অর্জুনের যা অবস্থা হয়েছিল, বিজ্ঞানের এই বিপুল অগ্রগতির যুগেও সকল বিষাদগ্রস্ত মানুষেরও একই রকম উপসর্গ দেখা দেয়।
কুরুপাণ্ডব উভয় সেনার মধ্যে অর্জুনের অনুরোধে সারথি কৃষ্ণ রথ স্থাপন করলে, ভীষ্ম-দ্রোণসহ আর সকল আত্মীয়স্বজনকে দেখে বিষাদগ্রস্ত অর্জুন বলে উঠেছিলেন,
“সীদন্তি মম গাত্রানি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি।
বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে।।”
অর্থাৎ, আমার গাত্র সকল অবসন্ন হচ্ছে এবং মুখ পরিশুষ্ক হচ্ছে। আমার শরীরে কম্প ও রোমহর্ষ হচ্ছে।
পরে অর্জুন আরও বলেছেন যে তাঁর হাত থেকে গাণ্ডীব খসে পড়ছে এবং ত্বক পরিদগ্ধ হচ্ছে। বসেও থাকতে পারছি না, আমার মনও যেন ঘুরছে – ইত্যাদি আরও অনেক Depressing কথাবার্তা, এমন কি যুদ্ধ করতেও অস্বীকার করেছিলেন।
লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বর্তমান কালেও বিষাদগ্রস্ত মানুষের Depressing symptomগুলোও একই প্রকার।
এই সপ্তম রিপুর আঘাত বড়ই দুর্বিষহ। মানসিক অবস্থা ক্রমশই নিম্নগামী হয়। ঠিকমত পরিচর্যা না হলে বিষাদগ্রস্ত মানুষ আত্মঘাতীও হতে পারে। বহু বিখ্যাত মানুষ এই রিপুর আঘাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বা নিতে চেয়েছিলেন। বর্তমান যুগে সারা পৃথিবী জুড়ে শত সহস্র মানুষ আজ বিষাদগ্রস্ত অবস্থায় দিন যাপন করে চলেছেন।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, প্রতিমুহূর্তে মানুষের সপ্তম রিপুর আঘাতের কারণ হিসেবে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতম বিষয়গুলির প্রভাব ক্রমশই বিস্তার লাভ করে চলেছে। চাকুরিস্থলে Increment, Promotion,চারচক্রযানের দৈর্ঘ্য, আবাসনের বর্গ ফুট, সন্তানের পছন্দমাফিক বিদ্যালয়, Branded পরিচ্ছদ ইত্যাদি আরও অনেক প্রকার হিসাবপত্তর মানুষকে প্রতিনিয়ত বিষাদগ্রস্ততার কুম্ভীপাকে নিষ্পেষিত করে চলেছে।
ভাগ্যবান অর্জুনের Friend, Philosopher, Guide & Mentor হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন। গীতার প্রথম অধ্যায়ে সপ্তম রিপুর আঘাতে জর্জরিত অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধার করেছিলেন বাকি সতের অধ্যায় জুড়ে ৫৭৬টা শ্লোকের ভোকাল টনিক দিয়ে। মাঝে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে এমন ভয় দেখিয়েছিলেন যে অর্জুন জোড়হাত করে বলেছিলেন,
“নমঃ পুরস্তাদথ পৃষ্ঠতস্তে।
নমোস্তুতে সর্বত এব সর্ব।।’’
তোমাকে সম্মুখে নমস্কার, পশ্চাতে(?) নমস্কার, হে সর্ব, তোমাকে সর্বদিকে নমস্কার। শেষে অর্জুন বলেছিলেন, “আমি তোমার এই রূপ দেখে ভীত হয়েছি। তুমি আবার সেই চতুর্ভুজ রূপেই আবির্ভূত হও।”
(৭)
আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যাদের কৃষ্ণের মতো Mentor নেই বা থাকলেও ভরসা রাখতে পারি না বৈজ্ঞানিক যুগের যুক্তিবাদের হাতে গরম প্রামাণ্য তথ্যের অভাবে, তাদের পক্ষে সপ্তম রিপুর হাত থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ –
“Positive thinking and daily dose of exercise
Makes a person most healthy, wealthy and wise.”
আর যাঁদের শ্রীকৃষ্ণে বিশ্বাস আছে, তাঁরা পথ খুঁজে পান,
“সর্বধর্মানাং পরিত্যাজ্যং মামেকং শরণংব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্য মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।”
(গীতা-মোক্ষ যোগ/৬৬তম শ্লোক)
কিন্তু মুশকিলটা হলো, আমার মতো “যে জন আছে মাঝখানে” পাবলিকদের। আমরা না পারি “আস্তিক” হয়ে “ভগবান ভরসা”-য় জীবন কাটাতে, আবার ভগবানেরই ভয়ে “নাস্তিক” হতেও পারি না।
আমাদের জন্য বোধহয় বাঙালীর সেই সদাজাগ্রত ৩৩,০০,০০,০০১ নম্বর ঠাকুরই ভরসা – গুরুদেব শ্রীশ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ভদ্রলোকের অসীম ক্ষমতা। একের পর এক পরম নিকট আত্মীয়, এমন কি স্ত্রী, পুত্র এবং কন্যা, সবাইকে হারাবার পরও ভেঙে পড়েননি। তারপরেও তাঁর চিন্তাধারা আর লেখনী স্তব্ধ না হয়ে জন্ম দিয়ে গেছে অসামান্য সব সৃষ্টির।
একমাত্র তিনিই বোধহয় বলতে পেরেছেন,
“আমি তোমার কাছে শান্তি চাব না
থাক না আমার দুঃখ বেদনা।”
গুরুদেবের অমর সাহিত্য সৃষ্টির অবদানকে মাথায় রেখেও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে ওঁর জীবন দর্শনই এই শতাব্দীর মহামারি সপ্তম রিপু রোগটির একমাত্র বিশল্যকরণী – Always stay positive and be productive.
সর্বশেষে, এটাও বলা প্রয়োজন যে সপ্তম রিপুরও একটি Positive side আছে। অর্জুনের এই রিপুর দ্বারা আঘাত প্রাপ্তির ফল হিসেবে আমাদের “শ্রীমদভগবদগীতা” নামক ৭০০ শ্লোক সমৃদ্ধ মহাগ্রন্থটির প্রাপ্তি।
“।।কৃষ্ণ বলো, সঙ্গে চলো।।”
--------------------------------
(পুঃ- এই প্রবন্ধটি গুরু-চণ্ডাল রোগে পিড়ীত। ইহার আরোগ্যের বিধান দান করিয়া কেহ যেন সময়ের অপব্যবহার না করেন। পাঠ সম্পূর্ণ করিয়াছেন- এমন সকল পাঠকবর্গের কাছে ইহাই লেখকের বিনীত মিনতি। Victorian অথবা Queen’s English ভাষার বর্তমান SMS রূপ লেখককে সাহসী হইতে সাহায্য করিয়াছে।)
0 comments: