0

বইঘর - সুকন্যা দাস ও শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া

Posted in


বইঘর


বীর্যশুল্কা - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
সুকন্যা দাস ও শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া



বাংলা সাহিত্য সোপানের রথী মহারথীবৃন্দে শরদিন্দুর স্থান আজও অনির্ণীত। পাঠকপ্রিয়তা আর গুণমানে বিরোধ আছে বলে বিশ্বের তাবৎ সমালোচক নিঃসন্দেহ; আর তাতেই শরদিন্দুর স্থান নির্ণয়ে আরও জটিলতা। তঁর পাঠকপ্রিয়তা নিয়ে সন্দেহ নেই, গুণমান নিয়ে প্রশ্নও ধোপে টেঁকে না। তাঁর গোয়েন্দা-চরিত্র নিছক গোয়েন্দা নন, একজন মেধাবী সমাজ-মনস্তাত্বিক, তাঁর ঐতিহাসিক কাহিনীসমূহের বিন্যাসে ইতিহাস আর কল্পনা কত অনুপাতে মিশেছে তা মাপতে গিয়ে কাহিনীর ফাঁদে মজে যেতে হয় পাঠকের সঙ্গে সঙ্গে সমালোচককেও। তাঁর ছোটগল্পগুলি কুললক্ষণে রোমান্টিক হলেও তাতে বুদ্ধিমত্তা বা যুক্তির ধারা কদাচিৎ ছিন্ন হয়। শরৎশশীর মায়াডোর অনুভবের পূর্বেই সে যেমন হরণ করে নেয় আমাদের মন, প্রশংসাকুণ্ঠ সমালোচকের প্রশংসা আদায়ের আগেই তাঁর হৃদয়ে আসন পেতে বসেন শরদিন্দু। 

‘বীর্যশুল্কা’ শরদিন্দুর অধিকাংশ গল্পের মতই রোমান্টিক। রোমান্টিক কেবল ভাবপ্রবণতায় নয়, ফুরফেরে প্রেমের গল্পের আদল স্পষ্ট শুরু থেকেই। গল্পগুলির গল্প না হয়ে ওঠা নিয়ে আর যার দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা যাক, শরদিন্দুর দিকে যাবে না। রাজা রাণী মন্ত্রী সান্ত্রী পাত্র মিত্রদের কেবল মাপমতো আসনে বসিয়েই দরবার জাঁকিয়ে তোলেননি তিনি, বীর্যবান রাজার দরবারের সব আকর্ষণ কেন্দ্রীভূত করে দিয়েছেন অষ্টাদশী সুমিত্রার আননে অধরে হাস্যে লাস্যে বিলোল কটাক্ষে। তাঁর রূপ লাবণ্যের পেছনে কেবল রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র কোটালপুত্রদের ঘুরিয়ে মারেন না তিনি, বেঁধে রাখেন পাঠকের মনও। 

কিন্তু শরদিন্দু জানেন রাজা রাণী পাত্র মিত্র দিয়ে ছেলেভোলানো রূপকথা হয়। আর নিছক ছোটদের জন্য রূপকথায় সম্ভবত ‘বীর্যশুল্কা’ সন্তুষ্ট নয়। তাই অনুপান হিসেবে ভাবতে হয়েছে আরো অনেককিছু। প্রেক্ষাপটে কতখানি ইতিহাস থাকলে বাঁধা পড়তে হয়, প্রাপ্তমনস্ক বাঙালি পাঠককে তা রপ্ত করিয়েছেন অন্য সাহিত্য চন্দ্রমা বঙ্কিম স্বয়ং। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘রাজসিংহ’-ই কেবল নয়, রমেশচন্দ্র দত্ত-র ‘মাধবীকঙ্কণ’, ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত’, ‘রাজপুত জীবন সন্ধ্যা’-য় ঐতিহাসিক কাহিনীর আর একরকম পরিপুষ্টি পেয়েছে বাঙালি পাঠক। প্রত্নতাত্বিক পরিচয়ের আড়ালে ঢাকা পড়লেও রাখালদাসের ‘শশাঙ্ক’, ‘ধর্মপাল’, ‘করুণা’-র কথা-ও নিশ্চই বিস্মৃত ছিলেন না দেশি বিদেশি ঐতিহাসিক কাহিনির নিষ্ঠ পাঠক শরদিন্দু। রবীন্দ্রনাথও ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বাঙালি পাঠককে গল্প শুনিয়েছেন ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’, ‘রাজর্ষি’-তে। তাই প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের গন্ধ থাকলেই যে বাঙালি পাঠক চিত্তকে উদ্বেল করা যাবে এমন সামান্য ভাবনা নিশ্চই শরদিন্দুর ছিল না। একদিন যিনি ‘কালের মন্দিরা’ (১৯৫১), থেকে ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ (১৯৭২) লিখে বাংলায় ঐতিহাসিক কাহিনীর অবিসম্বাদী সম্রাট হয়ে উঠবেন, এবং কোনো কোনো সমালোচক যাঁকে ঐতিহাসিক কাহিনী রচনায় এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রেরও ওপরে স্থান দেবেন, তাঁর সলতে পাকানোতেও যে থাকবে বুড়ো আঙুলের নির্ভুল ছাপ তা ‘বীর্যশুল্কা’-র (১৯৩৪) পাঠকমাত্রেই স্বীকার করবেন নিশ্চই। 

গল্পের শুরুতেই যখন জানা যায়, ‘রাজকুমারী সুমিত্রার আর কিছুতেই বর পছন্দ হয় না।’ তখন পাঠক-মাত্রেই কল্পনা বিকাশের একটি নিশ্চিন্ত আশ্রয় পান; বোঝা যায় এ সেই রাজা রাণী পাত্র মিত্রের চিরচেনা কল্প-জগৎ এবং গল্প নিশ্চই আবর্তিত হবে রাজকুমারীর ‘বর’ পাওয়া ঘিরে। পুরুষ পাঠকের নিজেকে সুমিত্রার সম্ভাব্য পানিপ্রার্থী-রূপে আর পাঠিকার নিজেকে সুমিত্রার আসনে বসিয়ে সম্ভাব্য বরের কল্পনায় হারিয়ে যেতে বাধা নেই। মাত্র দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে সুমিত্রার মনও কিছুটা জানা হয়ে যায় পাঠকের; নিজের দৃঢ় শারীরিক গঠনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণভাবে সে (বিবাহযোগ্যা সুন্দরী অষ্টাদশীকে নিশ্চই কেউই ‘আপনি/ আজ্ঞে’-র অপরিচয়ের দূরত্বে স্থাপন করতে চাইবে না) কিছু দৃঢ়মনাও বটে। ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো ‘মোমের পুতুল’ তার না পসন্দ। 

গল্পের অনির্ণীত প্রেক্ষাপট, সুমিত্রার দেশ-কাল কিছু স্পষ্ট হয় সামান্য পরেই; তক্ষশীলা, শক বংশ। কুতুহলি পাঠক মানচিত্রে তক্ষশীলার অবস্থান নির্ণয়ে না দৌড়েও নিশ্চই বুঝতে পারবে, এ নিছক ঘরের কথা নয়। নিছক রূপকথা বাদ দিলে ঘরের কথা নিয়েই এতকাল ঐতিহাসিক উপন্যাস জমিয়েছেন বঙ্কিম থেকে রাখালদাস। পাশাপাশি এ কথাও নিশ্চই শরদিন্দুকে মাথায় রাখতে হয়েছে, সুমিত্রার মত রাজকন্যা ঠিক বাঙালির ঘরে লভ্য নয়। আবার রূপকথার গল্পই হোক বা ইতিহাস, দৃঢ় রাজকুমারী চরিত্র-ই বা কোথায়। দুর্গেশনন্দিনী-তে আয়েষা বা দেবী চৌধুরানির ঐতিহাসিকতায়, নারী চরিত্রকে খুব বেশিদূর কল্পনাশ্রয়ী করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু যে পথ তাঁর সাহিত্যগুরু (শরদিন্দু, বঙ্কিমচন্দ্রকে তাঁর সাহিত্যগুরু হিসেবে বারে বারে উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন প্রসঙ্গে) দেখিয়ে গেছেন, তা নিয়ে কিছুদূর নাড়াচাড়া করার ইচ্ছা নিশ্চই শরদিন্দুর ছিল। আবার ‘শূদ্রই হোক আর চণ্ডালই হোক’ বীর্যবত্তাকেই বরণ করার আকাঙ্খাও যে কখনই বাঙালি-কন্যা সুলভ হত না সে বুঝতেও সমাজ-মনস্তত্বে পণ্ডিত শরদিন্দুর ভুল হবার কথা নয়। সব মিলিয়ে রাজকুমারী সুমিত্রাকে শক-কন্যা হিসাবে উপস্থাপনা, শরদিন্দুর কাহিনী নির্মানের মুন্সিয়ানাকে চমৎকার ব্যক্ত করেছে। পাশাপাশি শরদিন্দু মানস যে উনিশ শতকী উদার ‘হিউম্যানিজম’-এ ঋদ্ধ; জাতি ধর্ম বর্ণগত বাধা যে মিলনের উদার কল্পনায় ব্যাহত হতে পারে না, সে কথাটুকুও সূক্ষাকারে পাঠক মানসে তুলে ধরা হয়তো শরদিন্দুর সচেতন পরিকল্পনাতেই ছিল। ‘সেকালে শুদ্রকে কেউ এত ঘৃণা করত না-’ এই বক্তব্য সর্বৈব ইতিহাসহাস সম্মত না হলেও, নতুন যুগে যে তাই হওয়া উচিত, প্রয়োজনে ইতিহাসকেও যে নতুন করে ‘রচনা’ করা উচিত, এমন ভাবনা শরদিন্দু যে ভাবেননি, সে কথা তাঁর সামগ্রিক রচনাবলির নিরিখে জোর করে বলা যায় না। বক্তব্যের সমর্থনে যে যুক্তি তার পরের পংক্তিতেই আছে, তা অপরিপক্ক পাশ্চাত্য-ভাবাপন্ন ‘আধুনিক’দেরও হয়তো স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি। 

শরদিন্দুর কাহিনির গতি সর্বদাই আপাত ধীর। ছোটগল্পের সামান্য পরিসরেও স্থান কাল প্রেক্ষিত উপস্থাপিত হয় স্পষ্টভাবে। তারপর কুমারী সুমিত্রা চিত্রণে কিছু নতুন বর্ণ যোজনা ঘটে। তাঁর স্বয়ম্বর ঘোষণা হয়। ‘বাহুবল, হৃদয়বল আর বুদ্ধিবল’ যে তার কাছে সমান বিবেচ্য, তা পানিপ্রার্থীদের পাশাপাশি জানতে পারে পাঠকও। এই ত্রিস্তরী ইউরোপীয় ‘হিউম্যানিজম’, সে যুগের শক কন্যাকে সূচিত করে কি না, ‘ইতিহাস’ এত বিস্তৃত খবর দেয় না, পাঠকের কিন্তু ‘আধুনিক’ এক ভাবনার ‘ইতিহাসায়ন’ নিয়ে মজে যেতে বাধা থাকে না। 

কাহিনির নামকরণ থেকে কাহিনীর কেন্দ্রিয় চরিত্র যে নারী সে কথা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। সে চরিত্রে পাঠককে কিছুদূর নিমজ্জিত করে নতুন চরিত্রের উপস্থাপনা। আম পাঠকের মন কেন্দ্রিয় কাহিনিতে এতদূর মজ্জিত থাকে যে, সে হয়তো খেয়াল করে না, আসলে দুটি নতুন চরিত্র উপস্থাপিত হয় প্রায় একই সঙ্গে। মকরকেতু রাজ্যের একজন সেনানী। পাঠক যেন বেখেয়াল না হন ‘মকরকেতু’ কার নাম এবং কী তার বৈশিষ্ট্য। মকরকেতুর চরিত্র এবং সেই চরিত্র বর্ণনায় কিছু বেশি মনোযোগ থেকে, পাঠক তাঁর সম্ভাবনা নিয়ে কিছু কল্পনার সুযোগ নিতেই পারেন। মকরকেতু কেবল যে বিশালদেহী যুবা তাই নয়, সভায় আগন্তুকের উপস্থিতি এবং মকরকেতুর প্রতিক্রিয়া থেকে পাঠক তাঁর অতিপ্রতিক্রিয়ার কারণ আন্দাজ করে না এগোলে, চরিত্রটিকে সামান্য পরিসরেও বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার অভিসন্ধিটি নষ্ট হয়। 

একই সঙ্গে অন্যতর যে চরিত্রকে আমরা দেখি, সে ধীর প্রবাহী কাহিনীতে প্রায় ঝঞ্ঝা নিয়ে আসে। ছোটগল্পের পরিসরে কাহিনিকে পরিণতির দিকে আকর্ষণের পক্ষে যথেষ্ট সময় পাওয়া গেছে। আগন্তুকের নাটকীয় প্রবেশ এবং ক্রম পরিচয়ে পাঠকের সঙ্গে সঙ্গে কুমারী সুমিত্রার মনেও যে উত্তেজনার সঞ্চার তা প্রকাশে শরদিন্দুর মুন্সিয়ানা সন্দেহাতীত। কুমারী সুমিত্রার কাছে আগন্তুকের পরিচয় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি পাঠকের সঙ্গে তাঁর অপরিচয়ের দূরত্ব শুধু ঘোচে তাই নয়, যুবকের মনস্কামনার সঙ্গে যেন যুক্ত হয়ে যায় পাঠকের প্রার্থনাও। ১৯৩৪-এর ভারতবর্ষের ইতিহাস বাঙালির ক্রম-ম্রিয়মানতার ইতিহাস। সুভাষচন্দ্র ছাড়া তার হাতে বলার মতো কিছু নেই। সেই প্রেক্ষিতে গল্পে ‘বাঙালি’ কুশীলবের প্রবেশে বাঙালি যে নবোদ্যমে তাঁর সঙ্গে একাত্ম হতে চাইবে, তাঁর ‘জয়’ প্রার্থনা করবে আর সেই সূত্রে পাঠক চিত্তে কাহিনীটি অমোঘ হয়ে ঠাঁই নেবে, ততটুকু মনস্তত্বের জ্ঞান শরদিন্দু্র ছিল। বাঙালি পাঠকের কথা ভেবে রচিত গল্পে সুমিত্রা হেন নায়িকার জন্য ছদ্মবেশে যে বাঙালি নায়ককেই আসতে হবে তা প্রায় একপ্রকার নিশ্চিত ছিলই। শরদিন্দু সেই অবশ্যম্ভাবী কল্পনাকে গল্পে বাস্তবায়িত করেছেন। 

‘শক বংশের অনেক ক্ষত্রপ’ যখন ‘ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে রাজত্ব করছিলেন’, তখন ‘আর্যাবর্তের পূর্ব সীমান্তে’, ‘বঙ্গ’ বলে একটি প্রদেশের অস্তিত্ব ইতিহাস-সম্মত হলেও তার রাজা ভাষিক পরিচয়ে ‘বাঙালি’ হয়ে উঠেছিলেন এমন প্রমাণ ইতিহাস দেয় না। পাশাপাশি এ কথাও মনে রাখা দরকার, শরদিন্দু ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে বসেননি। বঙ্গ দেশের লোকেদের ‘পাখির ভাষা’-র খ্যাতি/অখ্যাতি তখনই দেশে বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে কি না সে চুলচেরা বিচারে পাঠকের কোনো লাভ নেই; বরং বঙ্গ-দূত চণ্ড যখন নিজেদের ভাষাকে কোকিল-কণ্ঠের মধুরতার সঙ্গে তুলনীয় করে, রাজসভার পরিহাসকে সম্মানে পর্যবসিত করে, তখন বাঙালি পাঠক মুঘল যুগ থেকে চলে আসা প্রচলিত পরিহাসের একটা যুতসই জবাব পেয়ে খুশি হয়।

বঙ্গ-দূত চণ্ডের প্রবেশ প্রথমাবধি নায়কোচিত, কিন্তু কখনই অতি-নায়কোচিত নয়। সে যে বীর তার করণ-কৌশল তার প্রমাণ, কিন্তু একাধিক রাজ প্রহরীর সঙ্গে দ্বন্দে সে পরাজিত, বন্দি ও ভূলুণ্ঠিত হয়। তাতে তার শ্লাঘার যে কোনো হানি হয়নি পরক্ষণেই তার করণে বচনে তা পরিস্কার। ‘বন্ধন-মুক্ত হয়ে যখন সে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তখন এই ছিন্নবেশ বিদেশী যুবার চেহারা দেখে কুমারী সুমিত্রার তীব্রজ্জ্বোল চোখদুটি ক্ষণকালের জন্য নত হয়ে পড়ল। তিনি উত্তরীয়টি ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিলেন।’ মধুর রসের আখ্যানে, আদি রসের যে সূক্ষ শালীন প্রকাশ শরদিন্দু রাখেন, তাতে একদিকে যেমন বিভিন্ন বয়সী পাঠক রোমাঞ্চিত হতে বাধ্য, অন্যদিকে কাহিনী রসসিক্ত হতে বাধ্য। সূক্ষাকারে যে প্রতিনায়কের ইঙ্গিত পাঠক মকরকেতুর মধ্যে দেখেন, ক্রমে তার সঙ্গে চণ্ডের মোলাকাত এবং এবং পরিণতি কেবল পাঠককে উল্লসিত করে না, রাজকুমারি সুমিত্রাকেও কিছু প্রভাবিত করে বই কি। 

বাহুবল, বুদ্ধিবলের সমস্ত জটিল পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে সুমিত্রা বীর্য শুল্ক দিয়েই জয় করে নেয় রাজকুমারী সুমিত্রাকে। কিন্তু বনান্তরালের নির্জনতায় যে হৃদয়বলের পরীক্ষা স্বেচ্ছায় দেয় ছিন্নবেশ, রুক্ষকেশ ভিনদেশি যুবা, তার কাছে ‘স্বেচ্ছায়’ ‘আত্মসমর্পণ’ না করে পারে না ‘অহংকারী’ রাজকন্যা। ক্রমে সুমিত্রার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকও জানতে পারে, অজ্ঞাতকুলশীল চণ্ড বঙ্গ-কুমার কিছু ‘রসিক’ বটেন। তবে পাঠক নিশ্চই মানবেন, পরিহাসপ্রিয়তা বঙ্গ-কুমারের ছদ্মবেশের একমাত্র কারণ না’ও হতে পারে। ছদ্মবেশের পেছনে একদিকে যেমন কুমারীর হৃদয় জয়ের পর তাঁকে চমকিত করার বাসনা থাকতে পারে যেমন আমরা দেখি আরো বহু রূপকথা এমনকি সাম্প্রতিকতম ব্লক বাস্টার ‘বাহুবলী-২’-তে, তেমন থাকতে পারে স্বদেশ স্বজাতির সম্মান-গৌরবের প্রতি দায়বোধও। ভিনদেশে শেষপর্যন্ত যদি সফল না হওয়া যেত তাতে সাধারণ প্রতিনিধির পরাজয়ের সঙ্গে সমগ্র জাতির কলঙ্কেরর সম্ভাবনা থাকত না। কিন্তু রাজ-পুত্রের পরাজয়ের মধ্যে জাতিগত কলঙ্কের সম্ভাবনা থাকে। পরিচয় গোপন করে যুদ্ধে যোগদান এবং জয়লাভের পর পরিচয় ব্যক্ত করার মধ্যযুগের ইওরোপীয় ধারা থেকে শরদিন্দুও নিজের কাহিনী বিন্যাসকে স্বতন্ত্র করতে পারেননি। কৌশলটি বহুব্যবহৃত হলেও, তার সাফল্য যে নিশ্চিত তা হয়ত বিশ্বসাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক শরদিন্দুর ধারণা ছিল। 

তবে কৌশলে কুমারী হৃদয়ের ওপর প্রভাব বিস্তারের অতিনাটকীয় কৌশলটি হয়ত বঙ্গ-কুমারের আদৌ প্রয়োজন ছিল না। বঙ্গ-কুমাররে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ আর কুমারীর প্রতিক্রিয়ার ধারাবাহিক যে বিবরণ লেখক দিয়েছেন তাতে এ কাহিনী নিছক প্রথম দর্শনে প্রেম। হস্তমুষ্ঠি থেকে মুক্তা আহরণই হোক বা স্বর্ণকলসে শরবিন্ধন- কুমারীর প্রতিক্রিয়ায় ‘আশঙ্কা কি আনন্দ’ লেখক সন্দেহ প্রকাশ করলেও পাঠক বোধ করি করেন না। শেষ পর্যন্ত কুমারকে সুমিত্রার পরীক্ষা যেন আত্মপরীক্ষা দানে পর্যবসিত হয়- তিনি নিজে কুমাররে কতদূর যোগ্য তা নির্ণয়ের পরীক্ষা। 

কাহিনী শেষ পর্যন্ত কাঙ্খিত লক্ষ্যে শেষ হয়। বীর্য শুল্কে কুমার কুমারীকে জয় করেন, না কি আত্মসমর্পণে অহংকার-মুক্ত-কুমারী, চণ্ড-কুমারকে স্নিগ্ধ চন্দ্র-কুমারে পর্যবসিত করেন তা পাঠক নির্ণয় করুক, লেখক সে কথা স্পষ্ট করে রসভঙ্গ করেননি। তবে এ কথা গোপন করতে পারেননি, কাহিনী চিরকালীন পুরুষবাদী, জাতিসত্বাবাদী প্রায়-একরৈখিক শাশ্বত কাহিনী। এ কাহিনীতে অহংকারি কুমারী, কুমারের বির্যবত্তায় ক্রমে দ্রবীভূত হবেন, এ কাহিনিতে ‘বাঙালি কুমার’ (সম্ভবত হিন্দু) শক-কুমারিকে (সম্ভবত জৈন বা বৌদ্ধ) লাভ করতে বীর্যবত্তার সঙ্গে সঙে হৃদয়বত্তায়ও ‘আধুনিক পুরুষ’ হয়ে উঠবেন, এ কাহিনীতে কুমারী বিজিত হওয়ার পরও জয়ী হবার সুযোগ পাবেন (না হয় পুরুষের হৃদয়বত্তা, স্ফূট হবে না)। এ কাহিনী-র ‘পোলিটিক্যাল কারেক্টনেস’ নিয়ে সমালোচক গূঢ় তত্ব করুন, লেখক পাঠক-চিত্ত জয়ে কোনো তীরই অব্যবহৃত রাখবেন না। তাই পাঠক-চিত্ত জয়ে কাহিনীর সাফল্য নিয়ে পাঠকের আগেই হয়ত লেখক নিশ্চিত ছিলেন। 

0 comments: