মুক্তগদ্য - শালিনী ঘোষ
Posted in মুক্তগদ্যমুক্তগদ্য
দেয়া আর ঈশ্বরের গল্প
শালিনী ঘোষ
(পর্ব ১)
- শেষ মাথার ভিটে
লাল মেঝে বারান্দা
সদর পেরুলে জুলুসের ঠাকুরদালান
বাতাস জুড়ে কেবল ঝিমধরা গন্ধ
সোহাগে সাজানো থাকে পালঙ
মেহগনি আসবাব
ফুলতোলা রেকাবিতে নিয়ম মেনে
রোজের মিষ্টি
গলিতে শাঁখারির হল্লা বাড়ে
শোওয়ার জো থাকেনা
কাজের মধ্যে
পানের ডিবেয় লক্ষ্মী বাঁধুন দেওয়া
আর
সময়ের বড়ি, আচার সাজিয়ে
হুসহাস কাক তাড়ানো
ঘর সাজিয়ে হাপিত্যেশে জন্ম ঘুরল যে!
পায়ে পড়ি, এসো...
- পায়ে হেঁটে শহর ঘুরেছ দেয়া? একের পর এক জীবন টপকে যাওয়ায় বড় নেশা। প্রত্যেক পথের মোড়ে আলাদা ঘ্রাণ। একেক দিন শুধু জিভ মেলে রাখি। দরজায় দরজায় আলাদা স্বাদ ঘোরে। চার পা অন্তর কোথাও লোনাভাব, কোথাও আশ্চর্য কর্পূরের আবেশ। এদিককার রঙও কেমন নতুন লাগে। সকালে ঘাটের দিকে পালোয়ানদের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ধাপি জুড়ে পরপর বেছানো থাকে শাড়ি। দ্রৌপদীর কথা ভারী মনে পড়ে সেসময়। কোথাও না কোথাও চিতা জ্বলেই যায় নাগাড়ে। ক্রমশ রোদ বাড়লে অভ্যস্ত হয়ে যাই। অত কটু তখন আর লাগেনা। চলে যাওয়ার এ এক আজব মজা, নিয়মমেনে তোমার পঞ্চব্যঞ্জনে সাড়া দেওয়ার তাড়া থাকে না। পুরি তরকারি চলতে থাকে আর দেদার চা। সন্ধে নামলে আরতির ধূম ওঠে। আমি সরে সরে থাকি। ভাবি, চিৎকার করে সব ভণ্ডামি গুঁড়িয়ে দিই; ভাবি, এমন বিশ্বাসের জোর যদি আমার থাকত... ছোট্ট ছোট্ট টুপড়ি সাজিয়ে কিছু ফুল, প্রদীপ ভাসিয়ে দেয় অনেকে। অনেকদূর অবধি যায়। তারপর ডুব। হিসেব কষি মনেমনে কোনটা কদ্দুর। সে বেজায় মজার খেলা, শিখিয়ে দেবোখন। সময় মেপে শুয়ে পড়ি আজকাল। আড়াইটে নাগাদ একটা গাড়ি থামে কাছাকাছি কোথাও। কদিন লক্ষ্য করে দেখেছি। চাপা শব্দ ওঠে। কিন্তু ঘোর পেরিয়ে কোনোদিনই মালকিনকে দেখা হয়ে ওঠেনা। এসময় তুমি আরো বুকের কাছে ঘন হয়ে আসতে। ঘুমোলে খানিক দাঁত দেখা যায় তোমার। আসছে মাসে কী এক পরব আছে, বিশাল মেলা বসে। যদিও সে এখান থেকে দিব্য দূর।
সাবধানে থেকো দেয়া। ঠোঁটে টান ধরছে। এখন আচমকা ঠাণ্ডা লেগে যায়।
(পর্ব ২)
- আর কোনো ঘাটে শরীর বাঁধতে পারিনা সাঁই। মন ডোবে না। চারপাশ দিয়ে জীবনের জোয়ার বয়ে চলে। অথচ আমিও বহু চেষ্টা করে দেখেছি, বিশ্বাস করো। কত তাপের দুপুরে, অসহ্য রাতে আর আর সব বুকে মাথা গুঁজে দিতে, এক চুমুকে শুষে নিতে নোনা ঠোঁট। আর সব চুমু কেমন কান্না হয়ে যায়। দীর্ঘ সঙ্গমের মাঝেও তোমার চোখ জেগে ওঠে। অকারণ উছলে যায় শরীরী তরল আর শ্বাসের ওঠাপড়ায় তোমার হাসি। আমার আর পাপবোধ জাগেনা সাঁই। আমার সন্ন্যাসের তুমি এক পৃথিবী পুরুষ হয়ে আমার সর্বস্ব লুঠপাট...
তুমি জানো, তোমার দেয়ার পরজন্মে বড় লোভ। ফিরেফিরে আসব সাঁই, বারবার। তুমি আমায় সব রমণ পেরিয়ে মিলনের বীজ দেবে বলো...
- দেশ বলতে তুমি কী বোঝো দেয়া? মানুষ? রাস্তা? বাড়ি? চারপাশের গাছ, তোমার শহর কোলকাতা, ম্যানহোল, কাশী মিত্তির ঘাট? সন্ধ্যে নেমে এল প্রায়। যেদিকে তাকাই বালি আর বালি। কী এক পোকা, তাতে হেঁটে যায়। ফিরতি পথ আলপনা আঁকা থাকে। আমার কিচ্ছু কাজ থাকেনা এসব সময়। আঙুলে আনমনা দাগ কাটি। নকশায় তোমার মুখ ফুটে ওঠে। বিনবিনে দেশোয়ালি সুর ভেসে আসে। দূরে গোটা চার পাঁচেক বাড়ির ছায়া। সেই নিয়েই গ্রাম। পায়ে পায়ে উঠে যাই। নিকোনো দেওয়াল। তাতে খড়িমাটি দিয়ে কত সুর বোনা। কত ফিকে হয়ে আসা উৎসবের মাঙ্গলিক চিহ্ন। মাঝেমাঝে খাটিয়া থাকে। আমি খানিক শুই, খানিক হাওয়া গুনি। হাওয়াদের ভাষা থাকে দেয়া। ঝড়েদের আসা টের পাওয়া যায়। এই আমার দেশ দেয়া। এই জলের খোঁজ, এই শীর্ণ শরীরে ঝলমল পাগড়ি, এই উটের সারি, ধুলো পথ আর নিয়মিত নেমে আসা অন্ধকার আমার দেশ, দেয়া। আমাদের। দেয়া, জীবন!
(পর্ব ৩)
- কাল রাতে সে এক ভারি মজার স্বপ্ন দেখলুম, জানো। দুপুরবেলা। চান সেরে বেরিয়েছি। আর ঠিক তক্ষুনি দরজায় আওয়াজ। আমি বলি, এই অসময়ে আবার কে! দরজা খুলে দেখি, তুমি। তুমি! এলে, সটান এসে বসলে। আমিও জল নিয়ে তড়িঘড়ি। আহা! তেতেপুড়ে এসেছে মানুষটা! সব কেমন সহজ গো। যেন এই, "ওগো, একটু মোড়ের মাথা দিয়ে ঘুরে আসি" বলে খানিক আগেই জুতোজোড়া গলিয়ে হাঁটা দিয়েছিলে। আমিও এমনি বেয়াকুব, এই যে তোমার জন্য এত্ত এত্ত হুড়ুমদুড়ুম কান্নাকাটি ভুলেই সারা। যেন লক্ষ্মীপ্রতিমাটি। যেন এইমাত্তর সিঁথিতে সিঁদুর, মাথায় নোয়া ছুঁইয়ে, "ঠাকুর, মানুষটাকে দেখো গো, ভালো রেখো, যেন অসুখ বিসুখ না বাঁধায়, তুমি ওকে সব রাস্তা সাবধানে পার করিয়ে দিও" র মতোই স্বাভাবিক তুমি এসেছ। হ্যাঁ গো, এমন কেন হয়? তুমি এলে আর চাদ্দিক আলো আলো। জ্যোতি বেরুলো। আমিও শান্ত।স্থির। যেন কুঁজোর জলে আটকানো তিরতিরে নদী।
তুমি বুঝি জীবনের চেয়েও বড়?
- অস্থির লাগছিল দেয়া। এতোলবেতোল রাস্তা দিয়ে হাঁটলাম অনেকক্ষণ। রাত বাড়ছে। ঝোড়ো হাওয়া। জেলেবস্তির দিকটায় একটা নৌকো পড়েছিল। আঁশটে গন্ধ। তাতেই চেপে বসলাম। বেলা পড়ে এলেই এসব দিক শুনশান হয়ে যায়। জলের দিকে তাকিয়ে থাকলে দু'একটা ট্রলারের আলো বিন্দু হয়ে চোখে ধরা পড়ে। আবার হুউউশ করে মিলিয়ে যায়। আসার পথে একটা বড় কাছিম মরে থাকতে দেখেছি। দমকা হাওয়ায় তার বাস ঝাপট দিচ্ছে। জলের রঙ ঘোর কালো। মাঝেমাঝে সামনে একটা ধূধূ মাঠ বলে ভ্রম হয়। চাঁদের আলো ঢেউয়ের মাথায় ঠিকরে পড়লে ফেনাগুলো চকচক করে ওঠে। ঢেউ গুনছি দেয়া। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জড়িয়ে আসে। মনে হয়, এই সমুদ্রের সামনে, এই বিশালতার সামনে আমি কেউ না, কিচ্ছু না। জলের সাথে আরেকটা বিন্দুমাত্র হয়ে মিশে যাচ্ছি আমি। প্রত্যেকটা গর্জনে, আছড়ে পড়ায় আসলে আমি। আমি, আমার ধর্ম, আমার জ্ঞান, আমার নীতি, আদর্শ, বোধ - সব সব সব আসলে চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে। জীবনে প্রথমবার এই আমার গা ছমছম করে উঠছে, দেয়া। দেয়া, আমার নিজেকে বড় সামান্য, এক্কেবারে নগ্ন লাগছে।
0 comments: