ছোটগল্প - স্বর্ণেন্দু সাহা
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
পাগলের খোঁজে
স্বর্ণেন্দু সাহা
“ও মশাই শুনছেন...”
“হ্যাঁ। বলুন।”
“একটু বিশেষ কথা ছিল। আপনি কি ব্যস্ত আছেন?”
“প্রচণ্ড ব্যস্ত আছি।”
“কী রকম ব্যস্ত আছেন তা তো আমার ঠিক মাথায় ঢুকছে না! কালো প্যান্ট আর লাল জামা পরে রকে বসে আছেন। এ কেমন ব্যস্ততা?”
“সে আপনি বুঝবেন না।”
“তা না হয় বুঝলাম না। কিন্তু, কথাটা জরুরী যে!”
“তাতে আমার কী?”
“একজনের খোঁজ করছি। আপনি সাহায্য করলে আপনাকে টেন পারসেন্ট কমিশন দেব।”
“অ। মোট টাকাটা কত?”
“কুড়ি হাজার।”
“আপনি কী ভেবেছেন? বলি ভেবেছেনটা কী? সবাইকে টাকা দিয়ে কিনতে চান? টাকা দেখাচ্ছেন? অ্যাঁ! টাকা! মনে রাখবেন, টাকা দিয়ে সকলকে কেনা যায় না। ক্রয়মূল্য থাকে না সবার।”
“ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। দেখি অন্য কাউকে পাওয়া যায় কিনা...”
“দাঁড়ান। বলছি...ইয়ে...ফিফটিন পারসেন্ট দিতে পারবেন?”
“অ্যাঁ! হ্যাঁ। নিশ্চয়ই।”
“কার খোঁজ চান বলুন?”
“আপনি যে প্রচণ্ড ব্যস্ত!”
“ব্যস্ত তো বটেই। তবু, হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও মানুষকে সাহায্য না করলে চলবে কী করে? মানুষ তো মানুষেরই জন্য।”
“আমার একজন সরেস, উঁচুদরের পাগল দরকার। দরকারটা অবশ্য ঠিক আমার নয়, আমার বসের।”
“পাগল! পাগল দরকার?”
“হ্যাঁ মশাই।”
“এই এলাকায় পাগলের অভাব নেই। নবকৃষ্ণ কর্মকারের কথাই ধরুন। মাঝবয়েসী লোক। সরকারী অফিসে চাকরি করত। সদ্য বাইক কিনেছিল। নতুন বাইকটা হঠাৎ একদিন চুরি হয়ে গেল। ব্যস্, নবকৃষ্ণ পাগল হয়ে গেল। এখন দিনরাত রাস্তায় বাইক চালানোর শ্যাডো প্র্যাকটিস্ করে। কাল্পনিক বাইকে বসে মুখে স্টার্ট দেবার মতো শব্দ করে। তারপর দু’হাত সামনে হ্যান্ডেল ধরার মতো করে রেখে দৌড়তে শুরু করে। ভাবে, বাইক চালাচ্ছে।”
“এর পাগলামোটা তেমন না...”
“আরো আছে। বলাই জানা। কার্গিল যুদ্ধের খবর শুনেই ও পাগল হয়ে যায়। তারপর থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে হুমকি দেয়, ‘সব শালাকে উড়িয়ে দেবো। মিসাইল, রকেট লঞ্চার সব ফিট করা আছে। বোমা ফেলবি? প্লেন সমেত প্লুটোয় পাঠিয়ে দেব।’—কেমন লাগল একে?”
“মন্দ নয়। তবে জমল না।”
“সুকুমার কুণ্ডু। পুরো খাপে খাপ পাগলামো বুঝলেন?”
“বোঝান।”
“ও নিজেকে খান পরিবারের সদস্য মনে করে।”
“মানে!”
“তিনটে সত্ত্বা ওর। ও কখনও নিজেকে আমির খান ভাবে, কখনও সলমন খান আবার কখনও শাহরুখ খান।”
“বাহ!”
“আমির খান হলে ‘গজনী’র ডায়ালগ, শাহরুখ খান ‘হলে চক দে ইন্ডিয়া’র ডায়ালগ আর সলমন হলে ‘দাবাং’ এর ডায়ালগ আওরাতে আওরাতে ও পাড়া পরিক্রমা করে বেড়ায়। ওই সময় কেউ ওর সাথে কথা বলতে গেলে তাকেও ও খান বানিয়ে দেয়।”
“অর্থাৎ?”
“উদাহরণ দিই। মজা করার জন্য রতন একদিন সুকুমারের সামনে গিয়ে গম্ভীর মুখে বলেছিল, ‘ভাই আমি সিনেমায় অ্যাক্টিং করতে চাই। তুই তো আমির খান, আমাকে চান্স দে।’”
“তারপর?”
“সুকুমার রতনের কথা শুনিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। রতনের হাত চেপে ধরে গরিলার মতো হাসতে হাসতে কী বলল জানেন?”
“আমি কীভাবে জানব!”
“বলল, ‘’অ্যাই! আমি আমির খান। তুই আমজাদ খান। আমি আর তুই মিলে গজনী পার্ট টু বানাব। হারামজাদা ডিরেক্টরটা গেল কোন চুলোয়?’”
“ভাল পাগল। তবে যতটা চাইছি ততটা নয়।”
“আরো আছে। উত্তাপের কথাটাই শুনুন আগে।”
“উত্তাপ! মানে উষ্ণতা! মানে টেমপারেচার! না, উত্তাপের ব্যাপারে আমি আগ্রহী নই।”
“পাগলের নাম উত্তাপ ঘোষাল।”
“ওহ! বেশ উত্তপ্ত নাম যা হোক...”
“এখানে আসবার সময় একটা চাররাস্তার মোড় লক্ষ্য করেছেন?”
“দেখেছি। কেন?”
“উত্তাপ ওই রাস্তার মোড়ে ফ্রিতে বারোটা থেকে ছ’টা ডিউটি দেয়।”
“ডিউটি?”
“ট্রাফিল পুলিশকে হঠিয়ে হাত-পা নেড়ে চাররাস্তার গাড়ি ও কনট্রোল করে।”
“পুলিশ বলে না কিছু?”
“উপায় নেই। প্রথমদিন বলতে যাওয়ায় দাঁত খিঁচিয়ে এমনভাবে তেড়ে গেছিল যে, পুলিশ বাবাজীবন বাইকের কথা ভুলে মেরে স্রেফ দৌড়ে লালবাজারের ছাদে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল।”
“পোষালো না।”
“নরেন মজুমদার। কাজ ঢিল কুড়োনো। কুড়িয়ে হাতের প্লাস্টিকে রাখে।”
“তারপর বিক্রি করে? আজকাল ঢিলও বেচা যায়?”
“ধুর্ মশাই! ও ঢিল কুড়োয় ছোঁড়ার জন্য।”
“সর্বনাশ! কাকে ছোঁড়ে?”
“বাছবিচার নেই। নিরপেক্ষ।”
“আর কেউ?”
“পছন্দ হলো না? আচ্ছা, এবার তাহলে রজতাভ মল্লিকের কথা বলি।”
“স্বচ্ছন্দে বলুন।”
“ভদ্রলোক কলেজের প্রফেসর ছিলেন। পড়াতেন। সেইসাথে নিজেও পড়তেন অমানুষিক ভাবে। বাড়ি ভর্তি শুধু বই আর বই। নিজে সায়েন্সের লোক হলেও ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য মায় অর্থনীতি কোনোকিছুই পড়া ছাড়তেন না। পড়তে পড়তেই উনি একদিন পাগল হয়ে গেলেন। এখন পথচলতি লোকজনকে দাঁড় করিয়ে খিটকেল মার্কা সব প্রশ্ন করেন।”
“উদাহরণ...”
“যেমন...ওবামার চুলের মেকানিক্যাল ইমপিডেন্স কত? সচিনের একশোতম সেঞ্চুরি পৃথিবীর গ্লোবাল ওয়ারমিং এর উপর কতটা প্রভাব ফেলেছে? মহম্মদ বিন তুঘলকের মস্তিষ্কের কেমিক্যাল অ্যানালাইসিস করলে কেমন রেজাল্ট পাওয়া যেতে পারে? ব্ল্যাক হোলকে রঙীন করার জন্য কোন কোম্পানীর রঙ ব্যবহার করা উচিত?”
“বাপরে!”
“অলরেডি চারজন এইরকম প্রশ্নের পাল্লায় পড়ে কোমায় চলে গেছে।”
“স্বাভাবিক। কিন্তু...”
“পছন্দ হয়নি? দেখুন, আর মাত্র একজন আছে। পাড়ার লোকেরা ওনাকে আড়ালে পাগলা মাস্টার বলে ডাকে।”
“বিবরণ?”
“সত্যলাল ধর। স্কুলটিচার ছিলেন। রিটায়ার করার পর প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি মিলিয়ে থোক কয়েক লাখ টাকা পেয়েছিলেন। ব্যাচেলর মানুশ...নিজেরও কয়েক লাখ জমানো ছিল। সব টাকা উনি দিলেন অনাথ আশ্রমে দান করে। ভাবুনতো-পাগল ছাড়া কেউ একাজ করে!”
“চমৎকার।”
“পেনশন পান। নিজের জন্য যতটা সম্ভব কম রেখে বাকি টাকা কাদের জন্য খরচ করেন জানেন?”
“উঁহু।”
“যাদের বর্ণনা আপনাকে দিলাম, সেই ছয় পাগলের জন্য। ওদের দুপুর ও রাতের খাবারের ঠিকানা সত্যলাল ধরের বাড়ি। নিজেও ওই পাগলদের সাথে বসেই খান।”
“অসাধারণ। দারুণ, দুর্দান্ত একজন পাগলের খোঁজ দিলেন আপনি। আমি ঠিক এরকম কারও সন্ধানেই ছিলাম। এই না হলে পাগল!”
“আমার কমিশনটা?”
“আমাকে ওই সত্যলাল ধরের বাড়িটা একটু দেখিয়ে দিতে হবে।”
“নিশ্চয়ই দেখাব। কিন্তু আমার কমিশন...”
“আরে মশাই, কমিশন আমি আপনার মুখে গুঁজিয়ার মতো গুঁজে দিয়ে যাবো। এখন বাড়িটা দেখিয়ে দেবেন চলুন।”
“চলুন।”
0 comments: